রামধনু – ৯

হুমায়ুন কবীর

“মন্টু অফিস চলো,” গাড়িতে উঠে গেট বন্ধ করে বলে সুরিন্দর।

ধীর গতিতে ডাইনে-বাঁয়ে দু’-তিন পাক মেরে মন্টু গাড়ি তুলে আনে নজ়রুল ইসলাম অ্যাভেনিউ-এর উপর। মন্টু জানে ইএম বাইপাস দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে মা ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যেতে হবে নিউ আলিপুরের অফিসে।

সুরিন্দরের ফোনে রিং হতেই সিটে সোজা হয়ে বসে, গাড়ি পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্টের সিগন্যালে আটকে রয়েছে, মোবাইলের স্ক্রিনে নাম দেখে সীতাংশু। ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সীতাংশুর কন্ঠস্বর, “স্যার, শঙ্করদা আজ অফিস আসতে পারবে না বলছে, ওর শালির মেয়েকে আজ নাকি দেখতে আসছে ছেলে পক্ষ।”

“আগামীকাল আসবে তো?” সুরিন্দর জিজ্ঞাসা করে।

“হ্যাঁ স্যার, আগামীকাল সকাল দশটায় রিপোর্ট করবে বলেছে,” সীতাংশু ফোনে জবাব দেয়।

“ঠিক আছে, পরভিনকে বলো অফিসের অন্য কাজগুলো এখন ছেড়ে তুমি যাদের কল করছ আগামীকাল আসার জন্য তাদের একটা লিস্ট রেডি করতে। ডোশিয়ার থেকে নাম, ঠিকানা, হাইট আর অন্য ডিটেলস পেয়ে যাবে। শুধু ওয়েট, মোবাইল নম্বর আর ফোটোর আপডেট নিতে হবে। আর কারও যদি ঠিকানা পালটে থাকে, ওটার আপডেট নিতে হবে। মিনিমাম একশোপঁচিশজনকে ডাকো, ক্যাজুয়ালটি হবেই বিশ-পঁচিশটা, পাঁচ দিন ট্রেনিং হয়ে গেলে একশোজনকে দুটো বাস ভাড়া করে ডিএসপিতে পাঠাতে হবে।”

ফোন ছেড়ে এজেসি বোস রোড ফ্লাইওভারে গাড়ি ছুটছে। সুরিন্দর পরপর পরিচিত বিল্ডিংগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে একবার, হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল আসতেই বাঁদিকের নীচের দিকে তাকায় সুরিন্দর, ওর ব্রাউন ফক্স সিকিয়োরিটি সার্ভিসের কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কি না, নাহ্ মেরুন টুপির কেউ নেই গেটের কাছে বা সামনের লবিতে, থাকলেও গাড়ির স্পিডের কারণে নীচটা ভাল করে দেখার আগেই হুস করে বেড়িয়ে যায় গাড়ি। এখানে মাত্র চব্বিশজন সিকিয়োরিটি আছে ওর কোম্পানির, তবে মেন গেটের দায়িত্বে এখনও রয়েছে অন্য এক নামী কোম্পানির জনা ছয়। ওই কোম্পানির ম্যাডামকে বিলক্ষণ চেনে সুরিন্দর, প্রায় সাড়ে তিন-চার হাজারের কোম্পানি ছিল, বছর বারো-চোদ্দো চুটিয়ে ব্যবসা করেছে তবে এখন পড়তির দিকে, ম্যাডামের যৌবনের মতোই। সুরিন্দর যখন প্রথম ব্যবসা করতে নামে প্রায় সাতবছর আগে, তখন বিদ্যাসাগর সেতুর টোলপ্লাজ়াতে গার্ডের কোটেশন দিতে গিয়ে এইচআরবিসি অফিসে দেখেছে এই সোনালি ম্যাডামকে। চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো সৌন্দর্য আর চটক। সুরিন্দরের দিকে কেউ ফিরেই তাকাল না। ‘আরে পানি লাও, কফি লাও’ হাঁক পেড়ে চাপরাশি থেকে অফিসার পর্যন্ত সকলেই শশব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, সুরিন্দরের কোটেশন হাতে নিয়ে এমন মুখের ভঙ্গি করেছিল এক অফিসার যেন ও সেজেগুজে অফিস বেরোবার সময় গাছ থেকে কাক ওর কাঁধে পটি করে দিয়েছে।

হাসিমুখে অফিসারের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে সোনালি ভার্গব ম্যাডাম শরীর মটকে জুতোয় আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গিয়েছিল ওদের পাশ দিয়ে। সীতাংশু হতাশভাবে বলেছিল, “এক্স ফ্যাক্টর স্যার, এখানে কিচ্ছু করার নেই। তবে স্যার সময় পরিবর্তনশীল, মেয়েদের চরিত্র আর পুরুষের ভাগ্য পরতে-পরতে বদলায়, এরও একদিন শেষ আছে।” শেষ যে আছে এত বছর পরে তার প্রমাণ মিলছে। ব্যর্থতার যন্ত্রণা নিয়ে ফেরত এসেছিল সুরিন্দর, অনেক কম রেট দিয়েও হালে পানি পেল না রেপুটেশনের অভাবে।

আবার মোবাইলে রিং হয়, মোবাইল তুলে চোখের সামনে ধরে, স্ক্রিনে ভেসে ওঠে শঙ্কর মণ্ডল। রিটায়ার্ড এসআই। স্ক্রিনের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে ফোন রিসিভ করে সুরিন্দর, “গুড মর্নিং শঙ্করবাবু, কেমন আছেন?”

“গুড মর্নিং, ভাল আছি মি়. ভাটিয়া, তবে আজ অফিস আসতে পারব না, একটু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি…সীতাংশুকে বলেছি ব্যাপারটা, তবে আগামীকাল দশটার মধ্যে চলে আসব।”

“হ্যাঁ, শুনলাম আপনার শালির মেয়েকে দেখতে আসবে আজ…”

“হ্যাঁ, আপনি তো ওকে চেনেন…”

“শি ইজ় আ গুড গার্ল। ওকে, আজ আপনি নিজের কাজ সেরে নিন, সি ইউ টুমরো,” ফোন কেটে দেয় সুরিন্দর। এজেসি বোস রোড থেকে সিগন্যাল পেরিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে খালের ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি তাজ বেঙ্গলের সামনে আসতেই সুরিন্দরের চোখে পড়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরির কাছে বেশ একটু ভিড়, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সারি দিয়ে।

মন্টু বাঁ দিকে ঘাড় সামান্য ঘুরিয়ে বলে, “অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”

“ঠিক আছে, লাইনে রাখো গাড়ি,” সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে সুরিন্দর, ভেসে ওঠে শ্যামলীর মুখটা, বেশ ছিমছাম একটা মুখ, একটু শ্যামলা ধরনের, তবে ভাল ফিগার আর লম্বা চুল, অফিসের কাজের জন্যই শঙ্করবাবু নিয়ে এসেছিলেন, বিএ পাস, কম্পিউটর জানে।

প্রথম দিন কাজ করার পরই সুরিন্দর বুঝল এ মেয়ে কম্পিউটর জানে না, ই-মেল খুলতে বা লিখতে পারে না, পড়ে বুঝতে পারে না ইংরেজিতে লেখা খুব সাধারণ চিঠিও। সুরিন্দর দিনের শেষে নিজের চেম্বারে ডেকে পাঁচ লাইনের চিঠি ইংরেজিতে ডিকটেশন দিল আর বলল, “টাইপ করে নিয়ে এসো।”

একটু পরে পরভিন এল সুরিন্দরের চেম্বারে, “স্যার, শ্যামলী আপনার ডিকটেশন বুঝতেই পারেনি, কয়েকটা ওয়ার্ড লিখেছে মাত্র, তা-ও স্পেলিং মিসটেক প্রায় প্রত্যেকটাতেই।”

হতাশ সুরিন্দর তাকিয়ে থাকে পরভিনের দিকে। পরভিন বলল, “আমি চিঠিটা করে আনছি,” দরজা ঠেলে বেরোতে গিয়ে ফিরে এল, “স্যার, আপনি বললে বিল বানানো, ব্যাঙ্কের কাজ, পারসোনাল সেকশনের কাজ ওকে দেখিয়ে দিতে পারি। কম্পিউটর, ই-মেল, ব্রোশিয়োর বানানো, করেসপনডেন্স এসব পারবে না স্যার। ও বাংলা মিডিয়াম সরকারি স্কুলে পড়েছে, তারপর স্যার বিএ পাস করেছে পাস কোর্সে গভর্নমেন্ট এডেড কলেজ থেকে, কম্প্যুটারটাও শিখেছে‌ সরকারি কোনও ট্রেনিং সেন্টারে সিক্স উইক। বাট স্যার, অন করা আর শাট ডাউন ছাড়া প্রায় কিছুই জানে না।”

“ঠিক আছে, তুমি দেখে নাও কী-কী কাজ পারে, নাহলে পরে বাদ দেব,” সুরিন্দর সেদিনের পর ভুলে গিয়েছিল শ্যামলী প্রসঙ্গ। দিন সাতেক বাদে সুরিন্দর তৈরি হল মালদার জন্য। ওখানে অনেকগুলো ব্যাঙ্কে ওদের কোম্পানির সিকিয়োরিটির ব্যাপারটা ফাইনাল করার জন্য ওর একবার দিন দুয়েকের জন্য মালদা যাওয়ার প্রয়োজন। সীতাংশুকে বলল, কাগজপত্র গুছিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে নেওয়ার জন্য। বিকেলের দিকে ওর চেম্বারে ঢুকল পরভিন। একথা-সেকথার পর পরভিন বলল, “স্যার, এইসময় সীতাংশুদাকে দু’দিন মালদা যেতে হলে অফিসে কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে। যদি অনুমতি দেন তো শ্যামলী যেতে রাজি আছে কাগজপত্র গুছিয়ে, ওকে প্রপারলি ব্রিফ করে দেব।”

“শ্যামলী? ওহ্, ও পারবে সব?” বিস্ময়ে সুরিন্দর তাকিয়ে ছিল পরভিনের দিকে।

“হ্যাঁ স্যার, খুব পারবে, কথাবার্তায় বেশ চৌখস, ব্যাঙ্ক অফিসারদের আশা করি ইমপ্রেস করতে পারবে।”

“তাহলে যাক, বেশি কিছু কাজ তো নেই, সঙ্গে থাকলেই হবে। চেহারাটা মোটামুটি প্রেজ়েন্টবল আছেই, কথাবার্তা যা বলার আমিই বলব,” সুরিন্দর নিমরাজি হল শ্যামলীকে সঙ্গে নিতে।

ভোরবেলায় মালদা পৌঁছে স্টেশনের সামনেই ভাল একটা হোটেলে দুটো রুম বুক করল সুরিন্দর। শ্যামলী শুরু থেকেই উশখুশ করতে লাগল দেখে সুরিন্দর আলাদা ফ্লোরে দুটো রুম নিল। হাজার হোক পুলিশের বউয়ের ভাগ্নি, তায় আবার সেভাবে চেনা-জানা হয়নি। সারাদিনে কয়েকজন ব্যাঙ্ক অফিসারের সঙ্গে দেখা করা, দৌড়োদৌড়ি ইত্যাদিতে কেটে গেল। সন্ধ্যায় ফিরে এল হোটেলে। শ্যামলী সারাদিনই মোটামুটি সপ্রতিভই ছিল, খুব কাজের না হলেও মানানসই। হোটেলে ফিরে কেমন যেন অন্যমনস্ক আর গুম মেরে গেল। সুরিন্দর নিজের রুমে যাওয়ার আগে শ্যামলীকে বলল, “যা খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে নিয়ো নিজের সুবিধেমতো সময়ে।”

হঠাৎ ডোরবেল বাজতেই সুরিন্দর ঘড়ির দিকে দেখে, সাড়ে দশটা! অফিসের কাগজপত্র গুছিয়ে, ল্যাপটপে সামান্য কাজ করে একটা সিনেমা দেখছিল, তাই খেয়াল করেনি এতটা রাত হয়ে গিয়েছে। নিশ্চয়ই রেস্তোরাঁ থেকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে। দরজা খুলে অবাক সুরিন্দর, ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে শ্যামলী।

“তুমি খেয়েছ?” ওকে দেখে খাওয়ার কথাটাই প্রথম জিজ্ঞাসা করে সুরিন্দর।

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে শ্যামলী, খানিক ইতস্তত করে বলে, “আমার রুমে কেউ যেন উঁকি মারছে বারবার।”

“জানলা বন্ধ করে এসি চালিয়ে দাও আর জানলার পরদাগুলো ঠিক করে টেনে দাও।”

“সে সব করেছি। কিন্তু আমার মনে খটকা লাগছে কেউ যেন আমার রুমে উঁকি মারছে আর জোরে-জোরে নিশ্বাস ফেলছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তোমার রুমে যাও, আমি আসছি ডিনার করে,” ওকে আশ্বস্ত করে সুরিন্দর।

ডিনার সেরে সুরিন্দর যায় শ্যামলীর রুমে। টয়লেট, জানালার পরদা চেক করে। “নাহ্ কিচ্ছু নেই, তোমার মনের ভুল। যদি তোমার এখানে ভয় করে তুমি আমার রুমে যাও, আমি এটাতে থাকব।”

“ঠিক আছে স্যার,” শ্যামলী দ্রুত গুছিয়ে নেয় তার সুটকেস, সুরিন্দরের কামরায় এসে হাতে হাত লাগিয়ে গুছিয়ে দেয় ওর ট্রলি। কামরা বদল করে সুরিন্দর ঘুমিয়ে পড়ে সওয়া এগারোটা নাগাদ। ঘুমের ঘোরের মধ্যে দরজায় টুকটুক করে আওয়াজ, ও কি ঠিক শুনছে? ঘুম কাটাতে বিছানায় উঠে বসে সুরিন্দর। হ্যাঁ ঠিকই শুনছে। বিছানায় বসে খসখসে গলায় জিজ্ঞাসা করে, “কে?”

উত্তরের বদলে আবার টুকটুক আওয়াজ। সুরিন্দরের ভূতে ভয় নেই তাই উঠে গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শ্যামলী।

“স্যার আমার ভয় করছে। তাই চলে এলাম আপনার কাছে। যদি কিছু না মনে করেন তাহলে আপনার খাটের এককোণে শুয়ে পড়তে পারি,” সুরিন্দরের অনুমতির তোয়াক্কা না করে খাটে উঠে বসে শ্যামলী।

আলো নিভিয়ে খাটে যায় সুরিন্দর, শুয়ে পড়ার আগেই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্যামলী, “আমি রুম ভাড়া নেওয়ার সময়ই ভাবছিলাম শুধু-শুধু দুটো রুম না নিতে।” সুরিন্দরের হাত ঘুরছে শ্যামলীর শরীরে আর শ্যামলীর ঠোঁট চেপে বসেছে সুরিন্দরের ঠোঁটে। ঘণ্টাখানেক পরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে সুরিন্দর বুঝতে পারে ওর চেয়ে শ্যামলীর অভিজ্ঞতা কিছু কম নয়। দু’দিন পরে ওরা মালদা থেকে ফিরল, পরের দিন অফিসে শ্যামলী স্বাভাবিক, তবে আগের চেয়ে ওকে একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয় পরভিনের।

মাসখানেক পর আবার শ্যামলী সঙ্গী হয়েছিল সুরিন্দরের, তবে একরাতের জন্য। সুরিন্দর অবশ্য দুটো রুমই ভাড়া নিয়েছিল হলদিয়াতেও, রেকর্ডটা তো ঠিক রাখতে হবে! আরও মাস দুই পরে হঠাৎ একদিন কাজ ছেড়ে দিল শ্যামলী। শঙ্করবাবু বললেন, “বাড়ির কাছে শপিংমলে ভাল চাকরি পেয়েছে।”

প্রায় বছরখানেক বাদে আজ আবার শ্যামলীর কথা, পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসছে! অবাক কাণ্ড, শ্যামলী এতদিনেও একটা বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করতে পারল না!

অফিসে পৌঁছে সীতাংশু আর পরভিনের কাছ থেকে দুর্গাপুর থেকে ই-মেলে অর্ডারটা এসেছে কিনা জানতে চাইল সুরিন্দর। আসেনি। ওপি সাহেবকে ফোন লাগায় সুরিন্দর, প্রথমে বলে, “স্যার অঞ্জলি স্যাটারডে অউর উয়ো দিল্লিওয়ালা প্রোগ্রামকে লিয়ে কনর্ফাম হ্যায়।” তারপর ওপি সাহেব ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগেই সুরিন্দর বলে, “স্যার, উয়ো সৌ কা অর্ডার অবতক নহীঁ আয়া? ক্যা, নেট ডাউন হ্যায়? প্লেসমেন্টকা অর্ডার আপনে সাইন কর দিয়া? ওকে স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ স্যার।” সুরিন্দর তৃপ্তির লম্বা নিশ্বাস ছাড়ে।

ফোনে রিং হতেই স্ক্রিনের দিকে তাকায় সুরিন্দর, মুখার্জি স্যার। স্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে ফোন রিসিভ করে বলে, “গুড আফটারনুন স্যার।”

“অরে তুমনে অভি তক কনফার্ম নহীঁ কিয়া উয়ো নও সে বারাওয়ালা প্রোগ্রাম, জলদি বতাও।”

“অলমোস্ট কনর্ফাম হ্যায় স্যার। আজ শামকে অন্দরহি ম্যাঁয় আপকো ফোন করতা হুঁ,” একটু থেমে বলে, “ক্যায়া স্যার আপ বোলেঙ্গে অউর ম্যাঁয় নহীঁ যাউঙ্গা? মেরা গদর্নপে একহি সর হ্যায় স্যার।” সুরিন্দর আশ্বস্ত করে মুখোপাধ্যায় স্যারকে।

ফোন ছেড়ে দিয়ে ভাবে, অঞ্জলিকে একবার পাঠিয়েছিল মুখোপাধ্যায় স্যারের কাছে, তখন ওর মাস দুই কোনও গার্লফ্রেন্ড ছিল না। হ্যাঁ, ওই একবারই গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে, সুরিন্দর নিজেই গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল। ওপি সাহেবের সঙ্গে যাচ্ছে, চিনতে পারলে কেলেঙ্কারি বাধাবে না তো! অঞ্জলি খুব ভাল আর শিক্ষিত মেয়ে, ও কেন যে এভাবে নিজেকে মার্কেটে আনল সুরিন্দর ভাল বুঝতে পারে না! বাবাকে বাঁচাতে আর কি কোনও উপায় ছিল না?

তা-ও প্রায় মাস আষ্টেক আগের কথা, সুরিন্দরের তখন অদিতির সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে মাসখানেক আগে। সুরিন্দরের এমনিতে ইমোশন কম, তবুও হাজার হোক অদিতি বছর চারেকের গার্লফ্রেন্ড, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছে একসঙ্গে, অনেক সময় কাটিয়েছে একসঙ্গে সুরিন্দরের ফ্ল্যাটে, কারও কাছ থেকে সুরিন্দর লুকোয়নি অদিতিকে, দিল্লিতে ওর বাবা-মাও জানত সুরিন্দর আর অদিতি কাপল, বিয়ে হয়তো করেনি তবে যে-কোনওদিন ওরা বিয়ে করবে। অন্যান্য গিফট ছাড়াও ডায়মন্ড রিং আর গাড়িও কিনে দিয়েছিল অদিতিকে। অদিতি ছিল একটু চাপা স্বভাবের, ভবানীপুরের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা মেয়ে অথচ খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সাধারণ দেখতে আর স্বভাব ছিল শান্ত। ওই চার বছরে সুরিন্দর সত্যিই ওকে ভালবেসে ফেলে। কোনওদিন ওর সঙ্গে চিটিং করেনি, ওর লুক নিয়ে কোনওদিন একটা কথাও উচ্চারণ করেনি। অথচ একদিন সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটে এল, নিজের জামাকাপড়, জুতো, কসমেটিক্স, টুকটাক জিনিস গুছিয়ে নিল ব্যাগে, সুরিন্দরের হাতে হিরের আংটি ফেরত দিয়ে বলল, “সরি, তোমার সঙ্গে আর রিলেশনশিপ রাখতে পারছি না।” এর আগেও টুকটাক ঝগড়া হয়েছে অদিতির সঙ্গে। অদিতি চলে গিয়েছে পাঁচ-সাতদিনের জন্য, কিন্তু আবার ঝগড়া মিটিয়ে ঠিক ফিরে এসেছে নিজে থেকেই।

সুরিন্দর এবার একটু অবাক হয়েছিল আংটিটা ফেরত দেওয়ার জন্য। তবে ভেবেছিল, যা-ই হোক, অদিতি ঠিক ফিরে আসবে। দেখতে-দেখতে প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেল, অদিতি আর যোগাযোগ করল না, ফোন সুইচ অফ। সুরিন্দর ঝগড়া মেটাতে ওদের বাড়ি গেল, ওর বাবার কাছে শুনল রাজস্থান বেড়াতে গিয়েছে মায়ের সঙ্গে, দিনকয়েক পরে ফিরবে। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সুরিন্দর, দিন চার-পাঁচ পরে আবার গেল অদিতিদের বাড়ি। দরজায় বেল বাজাতে ওর মা দরজা খুলল, বলল “অদিতি নেই, হনিমুনে ইউরোপ গিয়েছে।”

আকাশ থেকে পড়ল সুরিন্দর, ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল ওর মা। সুরিন্দরের পৃথিবীটা এবার দুলে উঠল, কয়েকটা বাড়ি পরেই ওর বাবার ছোট কাপড়ের স্টল, ছুটে গেল সেখানে। অদিতির বাবা দোকানের কর্মচারী। বলল, “অদিতির বিয়ে হয়েছে বড়বাজারের বড় কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারে, ওদের ওখান থেকেই কাপড় কিনে এনে বিক্রি করত ওর বাবা, ওরা এখন ইউরোপে হানিমুনে গিয়েছে।”

দিনপাঁচেক নিজের ফ্ল্যাটের মধ্যেই আবদ্ধ থাকল সুরিন্দর, নিজেকে বোঝাল আর কোনও রিলেশনশিপে যাবে না, ওতে হৃদয় উপচে রক্তক্ষরণ হয় অকারণে। “খুব ভাল আর সুন্দরী মেয়ে পয়সা দিয়ে পাওয়া যায় কী ভাবে রে?” বন্ধু-বান্ধবদের সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে-করতে পেয়ে গেল পূজা ইভেন্টসের নাম, কালবিলম্ব না করে ফোন লাগাল সুরিন্দর, “সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে চাই, দাম নিয়ে ভাববেন না।”

অঞ্জলি এল সুরিন্দরের ফ্ল্যাটে। সুরিন্দর চমকে গেল, এমন মেয়েও বাজারে পাওয়া যায়! অঞ্জলি বলল, প্রায় চার বছর লিভ-ইন রিলেশনশিপে ছিল, এ ছাড়া আর কারও সঙ্গে কোনওদিন শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েনি। এই এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ দিনতিনেক আগে আর সুরিন্দরই তার প্রথম ক্লায়েন্ট। ওর সৌন্দর্য দেখে খেই হারিয়ে ফেলল সুরিন্দর, গলগল করে সুরিন্দর উগরে দিল অদিতির কথা, ওর দুঃখের কথা।

“মন খারাপ করবেন না, হয়তো অদিতির অন্য কোনও কম্পালশন ছিল। আপনি নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে অদিতির চেয়ে ভাল মেয়ে পেয়ে যাবেন।”

“দেখুন, আপনারও চার বছরের লিভ-ইন রিলেশন ভেঙে গেল, আর আমারও, আমরা কি নতুন করে শুরু করতে পারি?” সুরিন্দর অসহায়ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল।

“নিশ্চয়ই আপনি নতুন করে শুরু করবেন। তবে আমি পারব না, আমার সেই স্কোপ নেই। আমার প্রায়োরিটি আলাদা, আমার প্রেম করার সিচুয়েশন নেই। মাসে তিনটে ক্লায়েন্ট আমার চাই, প্রয়োজনে আশি-নব্বই হাজার টাকা। তাই মন চাইলেও আমি কারও সঙ্গে প্রেম করতে পারব না। আরও একটা অসুবিধে আমার আছে, যদি আমরা কোনওদিন বন্ধু হই, তবে আপনাকে বলব।”

অঞ্জলি মেলে ধরেছিল নিজেকে, কিন্তু সুরিন্দর পারেনি হৃদয়বিহীন শারীরিক সম্পর্কে যেতে। পাশাপাশি শুয়ে প্রায় সারারাত গল্প করে কাটিয়েছিল সুরিন্দর আর অঞ্জলি। সকালে ত্রিশ হাজার টাকা আর সুরিন্দরের ফোন নম্বর নিয়ে নিজের ফোন নম্বর দিয়েছিল অঞ্জলি। সুরিন্দর নিজে গাড়ি চালিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল এসপ্ল্যানেডে। কথা হয়েছিল, সুরিন্দর চেষ্টা করবে যতটা সম্ভব ওকে কাজ দিতে, যাতে অন্য কোথাও আর যেতে না হয়।

সুরিন্দর কথা রেখেছে। আরও বার দুই নিজের জন্যই টাকা দিয়েছে অঞ্জলিকে আর নিজের সবচেয়ে সেফ ক্লায়েন্টের জন্য। যখন যেমন পেরেছে ওকে পাঠিয়ে ইনকামের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অঞ্জলির জন্য মনটা আজও মাঝে-মাঝে মোচড় দেয়। কী এক রহস্যে মোড়া ওর জীবন শুধু ও-ই জানে!

মনের ভিতর বাতাস বইতে দিলেই মনটা হু-হু করে, অঞ্জলির কথা মনে পড়তেই মনে পড়ে সরিতার কথা। আজ একবার ডাকবে সরিতাকে, ওকে বলতে হবে সুন্দরবন যাওয়ার কথা। ‘হ্যাঁ’ বলবে নিশ্চয়ই, তবুও একবার ওকে বলতেই হয়।

ফোন করে সরিতাকে। রিং হচ্ছে। যাচ্চলে, ফোন ধরল না সরিতা। হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও সাধারণত ফোন ধরে, বড়জোর বলে, “রিং ব্যাক করছি পনেরো মিনিট বা আধঘণ্টা পরে।” একটু উদ্বেগ নিয়ে মোবাইল রাখে টেবিলের উপর। মাস ছয়েক আগে সরিতা একদিন এল সুরিন্দরের অফিসে। ইন্টারকমে পরভিন বলল, “স্যার, ব্যাঙ্ক থেকে এক ভদ্রমহিলা আর দুই ভদ্রলোক এসেছেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। ওঁরা বলছেন, খিদিরপুর ব্রাঞ্চের ম্যানেজারের সঙ্গে আপনার গতকাল কিছু কথা হয়েছিল, তার বেসিসে ওঁরা আপনার কাছে এসেছেন। ওঁদের পাঠাব স্যার?”

ওরে বাবা! গতকাল সাহিল সুলতান ওকে বলেছিলেন, “স্যার, আপনার কারেন্ট অ্যাকাউন্টে মাসের পর মাস অনেকটাই টাকা পড়ে আছে, ইন্টারেস্ট পাচ্ছেন না। আমাদের কাছে কয়েকটা ভাল স্কিম আছে, তাতে যদি শর্ট টার্ম ইনভেস্টমেন্ট-ও করেন, তাহলে ভাল ইন্টারেস্ট পাবেন।” সুরিন্দর ক্যাজ়ুয়ালি বলেছিল, “ঠিক আছে একদিন দেখব।”

তাই বলে আজকেই? বিরক্ত হয়ে বলে, “পনেরো মিনিট পরে পাঠাও।” কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুরিন্দর।

“মে আই কাম ইন?” দরজা সামান্য ঠেলে সরিতা হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে।

সুরিন্দর আর না বলতে পারেনি, “ইয়েস প্লিজ়।”

তিনজন ঢুকে এল ভিতরে। “প্লিজ় সিট ডাউন,” সুরিন্দর তাকায় সরিতার দিকে।

সুরিন্দরের মুখোমুখি সামনে টেবিলের দিকে একটু ঝুঁকে বসল সরিতা, বাকি দু’জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। হাসি-হাসি মুখে খুব আন্তরিকভাবে একজন শুভানুধ্যায়ীর মতো করে বিভিন্ন স্কিম নিয়ে বোঝাল সরিতা, আর সঙ্গত দিল তার সঙ্গীরা। সেদিন প্রায় পঁয়ষট্টি লাখ টাকা সুরিন্দর ইনভেস্ট করল, সরিতার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আপনি আমার জন্য যে-যে স্কিম ভাল হবে, সেগুলোতেই ইনভেস্ট করে দিন।”

অদিতির সঙ্গে ব্রেকআপ আর অঞ্জলির শরীর দেব তবু হৃদয় দেব না-র সুযোগে সরিতা ঢুকে এল ওর হৃদয়ে। ফোনে প্রেমালাপ চলল দিন পনেরো, তারপর সুরিন্দরের ফ্ল্যাটের রেসিডেনশিয়াল অফিস ঘুরে পাশের বেডরুমে চলে এল সরিতা সিংহ। ভারী মিষ্টি মেয়ে, সারাক্ষণ হাসিখুশি। সুরিন্দর গভীরভাবে সরিতাকে ভালবেসে ফেলল মাস দুয়েকের মধ্যেই।

মোবাইল হাতে তুলে নেয় সুরিন্দর, আঙুল দিয়ে সরিতার নামে টান দেয় স্ক্রিনে। ঝটকা লাগে সুরিন্দরের, আবার নো রিপ্লাই! এরকম তো হয় না! গতকাল রাতে ফোনে বলছিল, ওর শরীরটা ভাল নয়, তাহলে কি সাংঘাতিক কিছু… সুরিন্দর বেরিয়ে আসে অফিস থেকে। গাড়িতে চেপে মন্টুকে বলে, “চলো ছত্রিশ নম্বর সুধীর বসু রোড।”

মন্টু সুরিন্দরকে নামিয়ে গাড়ি পার্ক করতে নিয়ে আসে ডায়মন্ড হারবার রোডের উপর।

কলিং বেলের সুইচে আঙুল ছোঁয়াতে যেতেই ভিতর থেকে খুট করে একটা আওয়াজ, সুরিন্দর দরজা ঠেলে এক পা ঢোকায় ভিতরে, সরিতাকে সারপ্রাইজ় দেবে ও। সরিতা দাঁড়িয়ে দরজার পিছনেই, শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই, ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে জামাকাপড় পরা এক যুবক, ওর ঠোঁট চেপে বসেছে সারিতার ঠোঁটে, শেষ ভাললাগাটুকু শুষে নিচ্ছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে। বিস্ময়ে হতবাক সুরিন্দর।

আলিঙ্গন আলগা করে সারিতা বলে, “হাই সুরিন্দর, মিট মাই ফিঁয়াসে অজয়।”

“আই অ্যাম গেটিং লেট জান। বাই,” বলে হাত তুলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় অজয়।

বিছানা থেকে চাদর তুলে শরীরে জড়িয়ে নেয় সারিতা, “আমাদের রেজেস্ট্রি বিয়ে হয়েছে বছরখানেক আগেই, অফিশিয়ালি অজয় আমার হাজ়ব্যান্ড…”

“তাহলে আমি কে?” আর্তনাদের মতো চিৎকার করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সুরিন্দর, রাস্তায় নেমে ছুটতে থাকে। জোরে আরও জোরে, ওকে ধাওয়া করছে প্রতিধ্বনি, “তাহলে আমি কে?”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন