হুমায়ুন কবীর
ক’দিন ধরেই মেজাজটা বেশ ফুরফুরে ছিল মৈনাক মুখার্জির, সবাইকে যেন দেখাতে চায়, দেখ শালারা, আমি একা লোচ্চা নয়। সুযোগ আর গোপনীয়তার নির্ভরতা পেলেই পুরুষমানুষের মধ্যে প্রাণিসুলভ পলিগ্যামাস স্বভাবটা বেরিয়ে পড়বেই। সবাই পরিপক্ব হদ্দ জোয়ান, তাইরে নারে, হবে না রে, যাব না রে করেও সবাই শেষপর্যন্ত অলমোস্ট রাজি হয়েছে সুন্দরবনের পরকীয়া ট্রিপে। মধ্যযৌবনে সবাই সমান, বাঙালি, পঞ্জাবি, বিহারি— সবাই একটু হাড়ে হাওয়া লাগাতে চায় পরিবার থেকে পালিয়ে। আহ্ কী আনন্দ! সঙ্গে যদি পরকীয়া তো সোনেপে সোহাগা। অদূর ভবিষ্যতে অনাবিল আনন্দের কথা ভেবে বিভোর ছিল মৈনাক। হঠাৎ সন্ধ্যার মুখে ডেকে পাঠাল ওর বস মিস্টার সেন, “কী, ছুটিতে যাচ্ছ?”
“ইয়েস স্যার, ফ্রম নাইন্থ টু টুয়েলফ্থ,” সপ্রতিভভাবে উত্তর দেয় মৈনাক।
“বাট ইউ মাস্ট ফিনিশ ইয়োর অ্যাসাইন্ড ওয়ার্কস বিফোর ইউ মুভ অন,” মিস্টার সেন পরিষ্কার করে বলেন।
“কিন্তু স্যার, আমাকে তো ওই কাজগুলো নভেম্বরের থার্ড উইকের মধ্যে দিতে বলেছিলেন চিফ, তখন আপনিও ওখানে ছিলেন,” মৈনাক একটু জোর দিয়ে কথাগুলো বলে।
“মে বি। তখন বলা হয়েছিল, বাট পলিসি হ্যাজ় বিন চেঞ্জড। ইউ উইল হ্যাভ টু ফিনিশ বিফোর ইউ মুভ টু অ্যাভেল লিভ,” মুখ মটকে, দু’হাতের তালু উলটে মুদ্রা করে উত্তর দিলেন মিস্টার সেন।
মৈনাকের মেজাজ গেল বিগড়ে। ওই কাজগুলো যদি শেষ করতে হয়, তাহলে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে প্রত্যেক দিন। অথচ করতেই হবে শেষ, মিস্টার সেন যখন বলেছেন, চিফের সঙ্গে আলোচনা করেছেন নিশ্চয়ই। ফাঁপরে পড়ে তাই হাঁকপাঁক করে মৈনাক। ওর এখন অনেক কাজ— একটা টুর সাকসেসফুলি অরগ্যানাইজ় করতে অনেক কিছু অ্যারেঞ্জ করতে হবে। ছোট একটা লাক্সারি বাস, একটা অন্তত গোটাদশেক কেবিনওয়ালা লঞ্চ, সাফিশিয়েন্ট ড্রিংকস হরেক রকমের, ফুড, স্ন্যাক্স, সাপোর্ট স্টাফ আরও যে কত কী, তার ইয়ত্তা নেই। তার মানে প্রত্যেক দিন দুপুরে অন্তত দু’ ঘণ্টা করে বেরোতে হবে। তাহলে অফিসে থাকতে হয় রাত বারোটা পর্যন্ত, তা আর সম্ভব নয়! তাহলে উপায়? বাড়ি ফিরে কম্পিউটরের সামনে রাতে, সারাদিনের ধকলের পর আবার?
ভোর পাঁচটা থেকে উঠে নিজের ফ্ল্যাটে কম্পিউটরের সামনে বসতে হবে— এ তো অত্যাচারের শামিল! স্কুল লাইফে পড়াশোনা করার মতো, তা ছাড়া এমনটা করতে হলে নারীসঙ্গ বাদ প্রায় দু’সপ্তাহ! না, ভাবতে পারছে না মৈনাক! শালা, ছাড়তে হবে এই চাকরিটা, কিন্তু এখন কোনও উপায় নেই। তাই কাল ভোর থেকে উঠে মুখ গুঁজে কাজ করতে হবে।
সব তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার আগে অশান্ত মন নিয়ে শান্তভাবে কাজ করে যায় নিজের টেবিলে বসে। সাড়ে আটটা নাগাদ মোবাইলে রিং হতেই এক মুহূর্ত আনন্দে নেচে উঠে আবার দপ করে নিভে যায়। শর্মিষ্ঠা সেন। ফোন রিসিভ করে নীরস গলায় বলে, “হ্যালো।”
“তোমার গলা এমন ম্যাড়মেড়ে লাগছে কেন? অফিস থেকে বেরোওনি?” শর্মিষ্ঠা জানতে চায়।
মৈনাক প্রায় প্রতিদিনই আটটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে, এসময় তার গাড়িতে থাকার কথা। অথচ ফোনে রাস্তার কোনও শব্দ নেই, হর্নের হালকা আওয়াজ, ইঞ্জিনের আওয়াজ কোনও কিছুই নেই, সবচেয়ে বড় কথা মৈনাকের গলার সেই রগুড়ে টোনটাই নেই।
“না, বেরোতে পারিনি, মিনিমাম দশটা পর্যন্ত কাজ করতে হবে। পাগল-পাগল লাগছে মাইরি! ডি ডি সেন ফাঁসিয়ে দিয়েছে,” মৈনাকের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
“কে ফাঁসিয়ে দিয়েছে?” শর্মিষ্ঠা জানতে চায়।
“ওই শালা আমার বস, দিব্যদর্শন সেন। খেঁকুটে খেঁকশিয়ালের মতো দেখতে, অথচ নাম দিব্যদর্শন,” মৈনাক জানে এইসব কর্পোরেট হাউজ়ে বস মানে হাতে মাথা কাটতে পারে, আবার চাইলে লিফট দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। আর কে না জানে ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে যোগ্যতা কখনওই উত্তরণের বা পুরস্কৃত হওয়ার মাপকাঠি নয়, বসেরা তাই সবসময় চায় বামন পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে, নইলে নিজেকে আর দৈত্য মনে হবে কেন?
সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে শর্মিষ্ঠা বলে, “আমি তো আজ আসব বাবু তোমার কাছে, তাহলে তোমার এত খচে থাকা মানায়?”
“আরে অফিস থেকেই তো বেরবো দশটায়, তারপর ফ্ল্যাটে পৌঁছতেই তো সাড়ে দশ-পৌনে এগারোটা, স্নান সেরে ডিনার করতে সাড়ে এগারোটা, বিছানায় আসতেই পৌনে বারোটা, আবার উঠতে হবে পাঁচটায়। তোমার দিকে তাকানোরর সময়ই তো পাব না, তুমি খচে বোম হয়ে যাবে না! এমন একজন সুন্দরী কি ওরকম উপেক্ষা সইতে পারবে?”
“খুব পারব বাবু। এখন ছাড়ো, আমি বরং তোমার ওখানে গিয়ে স্নান-টান করে খাবার অর্ডার দিয়ে সব আনিয়ে রাখি, তুমি এসে স্নান করেই কুপ-কুপ করে খেয়ে লক্ষ্মীছেলের মতো শুয়ে পড়বে,” শর্মিষ্ঠা পার্ক স্ট্রিটের অফিস লক করতে-করতে বলে।
“লক্ষ্মীছেলে না, লক্ষ্মীছাড়া হয়ে শুয়ে পড়ব! আগে তো পৌঁছই ফ্ল্যাটে, তারপরই বুঝতে পারব। বাই, এখন ছাড়ছি,” ফোন কেটে কাজে মন দেয় মৈনাক।
দশটা পাঁচে অফিস থেকে নেমে গাড়িতে চাপে মৈনাক। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম, হু-হু করে ছুটে চলেছে গাড়ি। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, নন্দন বাঁ হাতে ফেলে ড্রাইভার স্টিয়ারিং সোজা রেখে ঢুকে এল হরিশ মুখার্জি রোডে। অন্যান্য দিন এমন বেশি রাতে গাড়ি করে কলকাতার রাস্তায় যাতায়াত করলে পার্ক স্ট্রিট, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম বা নন্দন মোড়ে সাজগোজ করা কোনও মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিনা দেখে আর বোঝার চেষ্টা করে কোনও কলগার্ল আছে কিনা। শুধু দেখেই তৃপ্তি, মৈনাকের এখনও এমন খারাপ দিন আসেনি যে, রাস্তা থেকে কলগার্ল তুলে আনতে হবে! বিরক্তিতে মনটা ভরে আছে, তাই আজ আর রাস্তায় মন নেই, সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকে মৈনাক।
ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, তুখোড় ইঞ্জিনিয়ার আর সুদর্শন ব্যাচেলর মৈনাক মুখার্জি উঁচু পদে চাকরি করে, তাই মেয়েরা পতঙ্গের মতো ধেয়ে আসে। মাঝে-মাঝে অরুচি হয় আর তখনই ওর ইচ্ছে করে কলকাতা থেকে পালিয়ে ফোন-টোন সুইচ অফ করে দিয়ে পাহাড়ে গিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে। এই গতবছরই ডিসেম্বরের শীতে রাকার সঙ্গে ঝগ়ড়া করে পালিয়ে গেল টুংলু-সান্দাকফু, ফিরল সেই সাতদিন পর। এর আগেও একবার পালিয়ে চলে গিয়েছিল হৃষীকেশ, কেদারনাথ-বদ্রিনাথ। সেবার গণ্ডগোল বেধেছিল মৌমিতার সঙ্গে, মাস দুয়েক ঝামেলা চলার পর ব্রেক আপ আর তারপরই…
সত্যিই শর্মিষ্ঠা খুব গোছালো মেয়ে, সারাদিন ওর চেয়েও বেশি পরিশ্রম করে অফিসে, মাঝে-মাঝেই দৌড়োদৌড়িও করতে হয়। তারপর সাড়ে আটটার পর অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ওর ড্রইংরুম-বেডরুম পরিপাটি করে গুছিয়ে, স্নান-টান সেরে, শর্ট প্যান্ট-টি শার্ট পরে ডাইনিং-এ খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। মৈনাক ফ্ল্যাটে ঢুকে দৌ়ড়ে যায় বেডরুমে। জামা-প্যান্ট ছেড়ে সেঁধিয়ে যায় টয়লেটে। গরম জলে স্নান করে ট্র্যাকপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে বেরিয়ে আসে ডাইনিং-এ। এমনিতেই বিছানায় যেতে-যেতে প্রায় বারোটা, তারপর অনেকদিন বাদে আজ আবার শর্মিষ্ঠা এসেছে, ওকেও একটু সময় দিতে হবে। আবার উঠতে হবে ভোর পাঁচটায়।
“তুমি কি একটা ড্রিঙ্ক নেবে? আমি বানিয়ে দিই অন দ্য রক্স?” শর্মিষ্ঠা ভদকার গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে মৈনাককে।
“না থাক, আজ কিছুই নেব না, ডিনার সার্ভ করো,” মৈনাক শর্মিষ্ঠার দিকে একটু ঝুঁকে বাঁ হাত দিয়ে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলে, “তুমিই তো রয়েছ আমার রয়্যাল ড্রিংকস,” ডান হাতে শর্মিষ্ঠার ভদকার গ্লাস তুলে হালকা চুমুক দিয়ে বলে, “আজকে আমার আর ড্রিংকস লাগবে না।”
শর্মিষ্ঠা ফর্কে করে সামান্য চাউমিন তুলে মৈনাকের দিকে বাড়ায়। মৈনাক হাঁ করে চাউমিন খায়। হাত থেকে ফর্ক নিয়ে বলে, “তুমিও খাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“আচ্ছা তুমি এমন তাড়াহুড়ো করছ কেন বলো তো? তখন ফোনে বললে ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে, কেন ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে? তখন তোমার বসকে গালাগাল করছিলে, তোমার কী হয়েছে?” খাওয়া থামিয়ে শর্মিষ্ঠা তাকিয়ে থাকে মৈনাকের মুখের দিকে।
মুখের খাবার শেষ করে মৈনাক। তাকায় শর্মিষ্ঠার মুখের দিকে, বলে, “তোমাকে তো বলেছি আমরা নয় নভেম্বর সুন্দরবন যাব। আমাকে কিছু ডেটা অ্যানালিসিস, কিছু টেকনিক্যাল রাইটিং আর টেমপ্লেট ডিজ়াইনিং-এর কাজ দেওয়া আছে। বস বলছে ওগুলো শেষ করে তারপর ছুটিতে যেতে। অথচ কাজগুলো অ্যাসাইন করার সময় বলা হয়েছিল নভেম্বরের থার্ড উইকের মধ্যে কমপ্লিট করতে। ওগুলো যদি আমাকে এইটথ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হয়, তাহলে আমাকে বাড়তি চার ঘণ্টা কাজ রোজ করতে হবে, কারণ আমাকে টুরের জন্য লঞ্চ, বাস, ড্রিঙ্কস, খাবার-দাবার, সাপোর্ট স্টাফ সবই অ্যারেঞ্জ করতে হবে। তার মানে প্রতিদিন দু’ ঘণ্টা করে বেরোতে হবে…”
“আরে দুর, তুমি থামো তো! এগুলো এখন আবার কেউ নিজে করে নাকি! আমরা তাহলে কী কাজ করব? অফিস খুলে বসে আছি কেন?” শর্মিষ্ঠা মৈনাককে আশ্বস্ত করে, “আমি কালকেই অফিসের অনুপমাকে বলে দিচ্ছি, ও দু’দিনে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে তোমাকে ফিডব্যাক দিয়ে দেবে। আর একটা কাজ করো, ওকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়ে নাও। ও খুব গোছানো মেয়ে, সব কিছু গুছিয়ে রাখবে। স্টোর ইত্যাদি দেখবে, প্লাস তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কারও যদি পার্টনারের সঙ্গে ঝামেলা হয় তাহলে টেম্পোরারি কাজ চালিয়ে দেবে। তবে তার জন্য ওকে নিশ্চয়ই স্পেশ্যাল গিফট দিতে হবে,” একটানা কথাগুলো বলে শর্মিষ্ঠা উঠে যায় বেসিনের কাছে, “সত্যিই খুব ভাল মেয়ে এই অনুপমা।”
“বাব্বা! তুমি আমাকে সত্যিই বাঁচালে! আর এই তোমার মেয়ে, কী যেন নাম, হ্যাঁ অনুপমা। এ তো এক্কেবারে ফর মাল্টিপারপাস ইউজ়! সত্যিই সব পারবে তো?” মৈনাকের মুখে তৃপ্তির হাসি হালকাভাবে খেলে যায়। ওকে অনেক চাপমুক্ত মনে হয়। তবুও সামান্য সন্দেহ হয়, এমন মেয়ে কি বাস্তবে পাওয়া যায়! শর্মিষ্ঠার কথায় আর কাজে বিশেষ তফাত নেই। তা ছাড়া ও নিজেও যাচ্ছে আর সত্যিই তো ও টুর অপারেটরের কাজটাই করে।
“কালকেই আমাকে বলে দিয়ো ক’টা কাপল যাচ্ছে আর তাদের রিকোয়্যারমেন্ট কী কী।”
“ফুর্তি আর ফুর্তি, দেদার ফুর্তিটাই আমাদের বেসিক রিকোয়্যারমেন্ট। ভাল খানাপিনা আর কমফোর্ট। যারা যাচ্ছে সব বন্ধুই পয়সাওয়ালা, তাই ওদিকটায় পরোয়া না করলেও চলবে,” বেসিনে হাত ধুতে-ধুতে মৈনাক বলে।
মৈনাকের মধ্যে রগুড়ে ভাবটা ফিরে এসেছে, যাক বাবা, হাঁফ ছাড়ে শর্মিষ্ঠা। প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে আজ মৈনাকের কাছে এল, আর ওর যদি মুড অফ থাকে তো রাতের আনন্দটাই মাটি। যে ভাবেই হোক ওকে জাগিয়ে তুলতে হবে! টয়লেটের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, “আমার বান্ধবীটি কিন্তু বিরাট পয়সাওয়ালি নয় বরং নিম্ন মধ্যবিত্ত বলতে পার। জানি না ও অ্যাফর্ড করতে পারবে কি না!”
“আরে তুমি তো তোমার বান্ধবীর পার্টনারকে জানো না, ও হয়তো আপার ইনকাম গ্রুপের!”
“ঠিকই, আসলে তনুশ্রী মানে আমার বান্ধবী আমার ক্লাসমেট কাম ভেরি স্পেশ্যাল ফ্রেন্ড। তবে বড় একটা গন্ডগোল হয়েছে ওর সঙ্গে, মিসহ্যাপ বলতে পার। ওকে আর ওর বাচ্চাকে ছেড়ে ওর হাজ়ব্যান্ড অমৃতসর চলে গিয়েছে দু’বছরেরও বেশি হয়ে গেল। ওর একজন স্টেডি পার্টনার রয়েছে। সেই ভদ্রলোক খুবই কেয়ারিং। তবে ওর ফিন্যানশিয়াল পোজ়িশন আমি কিছু জানি না,” শর্মিষ্ঠা ঢুকে যায় টয়লেটে।
মিনিট দশেক পর বিছানায় দু’জন পাশাপাশি, শর্মিষ্ঠা ফিসফিস করে বলে, “পৌনে বারোটা, কিন্তু তাড়াহুড়ো কোরো না প্লিজ়। তোমাকে ভোরে উঠতে হচ্ছে না, তাই টেক ইয়োর টাইম।”
“অফ কোর্স, ইটস মাই টাইম অ্যান্ড আই উইল এনজয় ইট স্লোলি,” মৈনাক পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে শর্মিষ্ঠাকে।
সকাল আটটায় মৈনাকের যখন ঘুম ভাঙল শর্মিষ্ঠা স্নান করে তৈরি। বিছানায় উঠে বসে মৈনাক।
“তুমি টয়লেট থেকে ঘুরে এস, আমি তোমার চা আনছি,” শর্মিষ্ঠা বেডরুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
মৈনাক ভাবে শর্মিষ্ঠা সত্যিই ওর পাল্স বোঝে, ঠিক কখন কী চাই। অথচ নিজের পছন্দ-অ়়পছন্দ কখনও জোরালোভাবে বলেই না, তাই মৈনাকও আর ওকে জোর করে না। প্রথম প্রথম জোর করত শর্মিষ্ঠার উপর, নানা দামি-দামি গিফ্টও কিনেছে ওর জন্য। শর্মিষ্ঠা খুশি হলেও ওকে প্রত্যেকবারই বলেছে, “সত্যিই আমার এসব কিছু চাই না, আমি খুব সিম্পলি বাঁচতে চাই। শুধু তোমার যত্ন চাই। অবহেলা আর ঔদাসীন্য আমি সহ্য করতে পারি না।”
মৈনাক বিছানা ছেড়ে উঠে যায়, টয়লেট থেকে ফিরে এসে ডাইনিং টেবিলে চা নিয়ে বসে। শর্মিষ্ঠা জিজ্ঞাসা করে, “কী খাবে বলো, ব্রেড অমলেট নাকি কর্নফ্লেকস বা ওট?”
“তোমার যেটা ইচ্ছে ওটাই বানাও, আমার ভাল লাগবে।”
“ওকে ডান, ব্রেড অমলেট আর ফ্রুটস, ফ্রুটস তোমার ফ্রিজে আছে দেখলাম,” শর্মিষ্ঠা কিচেনে ঢোকে।
চায়ের কাপ হাতে মৈনাক ভেবে নেয় কাজগুলোকে কীভাবে শেষ করবে। শর্মিষ্ঠা ওর বোঝা অনেক হালকা করে দিয়েছে, তবে অফিসের কাজগুলোতে চাপ আছে। এর আগেও মৈনাক অনেকবার চাপের মুখে পড়েছে আর প্রত্যেকবারই ও কাজটা ঠিক করে ফেলতে পেরেছে। সেই স্কুলের দিনগুলো থেকেই দেখে এসেছে ওকে টার্গেট তাড়া করতে হয় না, শুধু কাজটায় মনোযোগ দিতে হয়। তাহলেই টার্গেট ঝক মেরে ওর হাতের কাছে ঠিক পৌঁছে যায়। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ঢুকে আসে বেডরুমে। জামাকাপড় ছেড়ে ঢুকে যায় টয়লেটে।
টয়লেটের দরজায় দু’বার নক হতেই মৈনাক বুঝতে পারে শর্মিষ্ঠা ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলেছে, “বেরোচ্ছি দু’ মিনিটে।”
ডাইনিং টেবিলে পরিপাটি করে সাজানো ব্রেকফাস্ট। মৈনাক টেবিলে বসতেই শর্মিষ্ঠা বলে, “আচ্ছা, নাইনথ নভেম্বর এখনও দেরি আছে, সব কাপ্লকে ডেকে রাতে একটা ছোট ডিনার পার্টি করলে হয় না? আলাপ-পরিচয় হওয়া ছাড়াও টুর প্ল্যান, খরচ-খরচা ইত্যাদি বা কোনও স্পেশ্যাল যদি কারও কিছু থাকে তাহলে জেনে নেওয়া যেতে পারে।”
“হলে ভালই হত, তবে সবাই কি চাইবে তাদের পার্টনারকে আগে-ভাগে এক্সপোজ় করতে? সময় বের করাও একটা সমস্যা। তা ছাড়া জানাজানি হওয়ার আশঙ্কা, পরকীয়াটা এখনও কলকাতায় কেউ খু্ল্লমখুল্লা করে না। তবুও তোমার কনসেপ্টটা আমি হালকা করে ভাসিয়ে দেখব, কোনও বায়ার আছে কি না!” মৈনাক খানিকটা অমলেটের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে-চিবোতে বলে।
“কতগুলো কাপ্ল যাবে বলে মনে হয়, মোটামুটি বলো,” আপেলের টুকরো মুখে ফেলে শর্মিষ্ঠা তাকিয়ে থাকে মৈনাকের দিকে।
ডান হাতে টোস্ট ধরে বাঁ হাতের আঙুলে গাঁট গোনে মৈনাক, “আমাদের নিয়ে ছ’টা কাপল। তা ছাড়া অনুপমা আর একজন একস্ট্রা মেয়ে যেতে পারে বলে একজন জানিয়েছে, কারণ একজন এসকর্ট সার্ভিস থেকে পার্টনার নিচ্ছে। মেয়েটি একা যেতে চাইছে না। সঙ্গে আরও একটি মেয়েকে নিতে চাইছে। দেখা যাক, এই চোদ্দো হেডস মোটামুটি। তবে অনুপমাকে বোধহয় আলাদা কেবিন বা হোটেলের কামরায় রাখা দরকার, এসকর্টের মেয়ের সঙ্গে না মেশানোই ভাল।”
“হ্যাঁ তাই হবে, ও কিন্তু ভালই সুন্দরী। ফিগারটা দেখার মতো,” শর্মিষ্ঠা এবার চেঞ্জ করার জন্য মৈনাকের বেডরুমে ঢোকে। “ওকে লাগিয়ে দিচ্ছি আজ থেকে তাহলে, ও তিন-চারদিনের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে আমাকে জানাবে।”
মৈনাক ব্রেকফাস্ট শেষ করে বেডরুমে ঢোকে। শর্মিষ্ঠা চেঁচিয়ে ওঠে, “অ্যাই, বাইরে যাও তাড়াতাড়ি। আমি চেঞ্জ করছি।”
“আহা আমি কি আর তোমার অ্যাসেট দেখতে বাকি রেখেছি? কতবারই তো…”
“প্লিজ় বাইরে যাও,” শর্মিষ্ঠা একহাতে শার্ট ধরে নিজেকে আড়াল করে। অন্য হাতে মৈনাককে ধাক্কা দিয়ে বেডরুমের বাইরে বের করে দেয়।
“আরে আমি কি দেখিনি?” মৈনাক অবাক হয়।
“ওগুলো অন্য সময়, অন্য মুহূর্ত। ওসব তুমি বুঝবে না,” শর্মিষ্ঠা ট্রাউজ়ার্সে পা গলাতে-গলাতে বলে, “তুমি কখন বেরোবে?”
“একসঙ্গেই বেরোই, আমার গাড়ি এসে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তোমাকে পার্ক স্ট্রিটে ড্রপ করে তারপর অফিস যাব,” মৈনাক ডাইনিং টেবিলে বসে নিউজ় পেপারের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বলে।
“না, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। তোমাদের কম্পাউন্ডের বাইরে পার্ক করা আছে,” শর্মিষ্ঠা সাদা শার্ট আর ডিপ ব্রাউন ট্রাউজ়ার্স পরে বেরিয়ে আসে বেডরুম থেকে।
“আরে গাছের তলায় রাখোনি তো?”
“ওহ নো, আর ভুল হবে না বাবা,” হাসতে হাসতে বলে শর্মিষ্ঠা, “সে বারে যা অকওয়ার্ড পজ়িশনে প়ড়েছিলাম। পুরো গাড়ি সাদা করে দিয়েছিল। লাল গাড়ির উপর পুরো সাদার বুটিক। ওয়াইপার চালিয়ে উইন্ডস্ক্রিন পরিষ্কার করলাম খুব কষ্ট করে, কিন্তু পুরো গাড়ি? রাস্তার পাশের গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে ট্যাক্সিওয়ালা, রাস্তার লোক সবাই হাসছিল আর আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। তোমাদের এই গল্ফগ্রিন ছা়ড়া আর কোথাও কি এত পাখি থাকে? মানে ওই ধরো সাদার্ন অ্যাভিনিউ বা সল্টলেকে?” শর্মিষ্ঠা হাসতে থাকে, পুরনো স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
“গাছগাছালি থাকলে পাখি থাকবেই, তবে গল্ফগ্রিনের মতো এত কোথাও আছে কিনা জানি না,” মৈনাকও হাসতে থাকে ওইদিনের কথা মনে পড়াতে।
“আচ্ছা আমরা তো যাচ্ছি সুন্দরবনে, ওখানে নিশ্চয়ই অনেক পাখি আছে?” শর্মিষ্ঠা জানতে চায়।
“আমি বছর পাঁচেক আগে একবার গিয়েছিলাম সুন্দরবন, তখন পাখি দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, তবে ঘন জঙ্গল দেখে অবাক হয়েছিলাম। অনেক হরিণ, বুনো শুয়োর আর নদীতে কুমির দেখেছিলাম মনে আছে। বাঘ দেখিনি, তবে বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। অত বড় জঙ্গল যখন কিছু না কিছু পাখি থাকবেই। তা ছাড়া পাখিরালয়ে আমাদের একদিন থাকার কথা,” মৈনাক এবার বেডরুমে ঢুকে জামাকাপড় চেঞ্জ করতে-করতে বলে।
শর্মিষ্ঠা বেডরুমে ঢুকে মৈনাকের ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ঠেকায়, বলে, “বাই, আজও আসব তোমার এখানে,” মেন দরজা খুলে বেরিয়ে যায় শর্মিষ্ঠা।
মিনিট তিন-চারের মধ্যেই তৈরি হয়ে নীচে নেমে আসে মৈনাক। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে গেট খোলে। এই এক খারাপ অভ্যেস! ও নিজে কি গেট খুলে উঠতে পারবে না? কতবার বারণ করেছে, অভ্যাস আর বদলাবার নয়। সিটে বসে হেলান দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে, যাকগে বাবা, ভোরে বাড়িতে অন্তত কম্পিউটরের সামনে বসতে হবে না। মনে-মনে একবার ভেবে নেয়, কে কনফার্ম করেনি! ওহ, মি. ওমপ্রকাশ সিন্হা মাঝে ফোন করেছিলেন ঠিকই, তবে এখনও… বলতে-বলতেই ফোন বেজে ওঠে ওমপ্রকাশ সাহেবের। মৈনাক ফোন রিসিভ করে বলে, “গুড মর্নিং মি. সিন্হা।”
“গুড মর্নিং, আওয়ার ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড মাইসেলফ উইল ভিজ়িট ইয়োর অফিস শর্টলি ফর আপডেটিং সাম সফটওয়্যার অ্যান্ড অলসো ফর সাম ডেটা অ্যানালিসিস।”
“ওকে, ইয়েস, প্লিজ় ডু কাম অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট আওয়ার ট্রিপ টু সুন্দরবন?”
“আহ, ইটস অন, উই আর রেডি টু সেল, বাট প্লিজ় কিপ ইট কনফিডেনশিয়াল অ্যান্ড প্লিজ় এনশিয়োর কমফর্টেবল অ্যান্ড সেফ জার্নি।”
“ইয়েস, অফ কোর্স,” মৈনাকের মুখে হাসি ছ়ড়িয়ে যায়, মনে মনে বলে, “শালা।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন