হুমায়ুন কবীর
সব পুরুষের মধ্যেই নাকি লম্পটের বাস, কে যেন বলেছিল আজ ঠিক মনে করতে পারে না অরূপ ব্যানার্জি। দু’-চারজন আদর্শবাদী, কিছু সংখ্যক মহাপুরুষ আর সামান্য কয়েকজন ইমপোটেন্টের কথা অবশ্য আলাদা। আসলে সুযোগ আর সঠিক জায়গা পেলেই ভদ্রলোকের খোলস ছেড়ে লম্পট ঠিক বেরিয়ে আসবে। ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের নামকরা পিডিয়াট্রিশিয়ান অরূপ সন্ধ্যায় রাউন্ড দেওয়ার সময় তনুশ্রীর ফোনটা পেয়ে ভাবে, হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওর সঙ্গে কথা বললেই দেরি হয়ে যাবে। তাই জানতে চাইল বেবি ঠিক আছে কি না। তনুশ্রী “হ্যাঁ” বলতেই ও বলল, “দশ মিনিট পর গাড়িতে উঠে ফোন করছি।” ফোন কেটে দেয় তনুশ্রী।
ডা. অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ইভনিং রাউন্ডে বেরিয়েছেন ওয়ার্ডে, সঙ্গে হাউজ় স্টাফ আর জুনিয়র মিলে পাঁচজন। নিওনেটাল ইউনিটে গোটা ছয়েক বাচ্চা। সবে-সবে পৃথিবীতে ল্যান্ড করেছে, হাওয়া বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সময়টা এদের জন্য ক্রুশিয়াল, মায়ের পেটে থাকার সময় কেমন নিউট্রিশন পেয়েছে বা কী-কী অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে ঢুকছে তার যেমন ঠিক নেই আবার কার শরীরে কতটুকু অ্যান্টিজেন তৈরি হয়েছে তারও কোনও ইয়ত্তা নেই। হাসপাতালে সবাই বলে ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি জন্মানোর সঙ্গে-সঙ্গেই বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, শারীরিক অসুবিধাগুলোর কথা ঠিক খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জেনে নেন আর সেই মতো ওষুধ দেন। ক্যাজ়ুয়ালটি রেট নগণ্য, প্রিম্যাচিয়োরলি গুচ্ছের ব্যামো নিয়ে জন্মানো দু’-একটা বেবি ছাড়া ওঁর ট্রিটমেন্টে কেউ মরে না। সদা সতর্ক দৃষ্টি, সেপটিসেমিয়া না হয়ে যায়! তাহলে ফুলের মতো শিশুদের প্রাণ সংশয়। নার্স, আয়া থেকে শুরু করে জুনিয়র ডাক্তাররা পর্যন্ত ভয়ে কুঁকড়ে থাকে যেন কোনওভাবেই বি-কোলাই বা গ্রাম নেগেটিভ সিউডোমোনাস আক্রমণ না হানতে পারে। সন্তানের জন্ম দিতে আসা মা, তার জামাকাপড় থেকে ওয়ার্ডে যারাই ঢুকবে তাদের সব কিছুই স্টেরিলাইজ়ড হতে হবে, ডাক্তার সাফ জানিয়ে রেখেছে।
বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলা-টলা নয়, আসলে ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবজ়ারভেশন পাওয়ার অসাধারণ। বাচ্চার ফিচার আর মুখ-চোখ দেখেই বুঝতে পারেন অসুবিধেটা ঠিক কোথায় আর সেইমতো চিকিৎসা করেন। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় পর-পর বাচ্চাদের দেখছেন, ট্রিটমেন্ট আর ওষুধ বলছেন, জুনিয়াররা নোট করে নিচ্ছে। দশ মিনিট নয়, প্রায় পঁচিশ মিনিট পর নীচে নেমে এসে হাসপাতালের গেটে পার্ক করা হুন্ডাই সোনাটাতে শরীরটা এলিয়ে দিতেই ড্রাইভার গাড়ি ছুটিয়ে দেয় চার নম্বর ব্রিজের দিকে। ড্রাইভার জানে, ‘মা’ ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যেতে হবে এখন বাঘাযতীন চেম্বারে, ওখানে ত্রিশটা বাচ্চা দেখা শেষ করে তবেই যাবে যাদবপুর সেন্ট্রাল রোডের বিশাল দোতলা বাড়িতে।
ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে মোবাইল ফোন হাতে তুলে নেয় অরূপ। তনুশ্রীর কলের উপর তর্জনী দিয়ে টেনে দেয়। স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে তনুশ্রীকে কল হচ্ছে দেখে নিয়ে কানে চেপে ধরে ফোন—‘একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি, তাই নিয়ে মনে-মনে…’
“হ্যাঁ, হ্যালো, এখন ফ্রি?” তনুশ্রীর মিষ্টি গলা ভেসে আসে কানে। আগে নাকি তনুশ্রী প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর আর অ্যাঙ্করিং-এর কাজ করত, সঙ্গে টুকটাক গান আর আবৃত্তি। ওর কথা বলার গলাটা তাই আজও অসাধারণ। অনেক প্রচেষ্টা আর প্রশিক্ষণে রপ্ত করা গলার স্পষ্ট উচ্চারণে শ্রুতিমধুর করে বলা তনুশ্রীর কথাগুলো তাই অরূপের খুব ভাল লাগে। সারাটা দিন অমানুষিক পরিশ্রমের মাঝে ঠান্ডা কোলনের মতো।
“না, হাসপাতাল থেকে চেম্বারে যাচ্ছি, বাঘাযতীনে। তোমার খবর কী বলো? সব ঠিক আছে? এর মধ্যে দুপুরের দিকে কবে ফাঁকা থাকবে বলো, আমি আসব,” অরূপ গলায় যতটা সম্ভব বিনয় মিশিয়ে কথাগুলো বলে।
“আচ্ছা, নয় থেকে বারোই নভেম্বর কি ছুটি পাওয়া যাবে? যদি ছুটি পাওয়া যায়, তাহলে সুন্দরবন কি ঘুরে আসা যেতে পারে? আমার এক বান্ধবী তার বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছে। আমাকে খুব ধরেছে যাওয়ার জন্য। সিঙ্গল যাওয়ার উপায় নেই, কাপ্ল মাস্ট। এই পাঁচ-ছ’টা কাপ্ল যাবে সব মিলিয়ে। ব্যাপারটা গোপন থাকবে এটা বারবার বলেছে।” তনুশ্রী তার রেওয়াজি গলায় অনুরোধ এবং আকুতি মিশিয়ে ভাববাচ্যে কথাগুলো বলে। প্রায় আড়াই বছরের আলাপ এবং বছর দুই মন দেওয়া-নেওয়া, ছোট-ছোট ট্রিপে দু’-একটা জায়গায় তনুশ্রী অরূপের সঙ্গে গিয়েছে। কিন্তু এখনও ও সরাসরি তুমি বলে সম্বোধন করে না, কোথায় যেন দ্বিধা আর সংকোচ তনুশ্রীকে পেয়ে বসে। একসঙ্গে এবং আর কেউ না থাকলে তনুশ্রী অরূপকে তুমি বলেই সম্বোধন করে, কিন্তু ফোনে এভাবেই কথা বলে বেশির ভাগ সময়।
“চারদিন? ছুটি হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু আমার সব চেম্বারের কী হবে? আর তো মাত্র দশ-এগারো দিন বাকি, সব কি সামলানো যাবে?” স্বগতোক্তির মতো করে কথাগুলো বলে অরূপ, “আচ্ছা দেখি, তোমাকে কবে কনফার্ম করতে হবে? তোমার কি যেতে খুব ইচ্ছে করছে?” জানতে চায় অরূপ।
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কনফার্ম করতে হবে,” দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যায় তনুশ্রী। টুকটাক কথা বলে ফোন ছেড়ে দেয় অরূপ।
তনুশ্রীর যে যেতে খুব ইচ্ছে করছে তা বলাই বাহুল্য, না হলে ও কেন অনুরোধ করবে? অরূপ কি তবে সদ্যোজাতদের শরীর আর চোখের ভাষা পড়তে-পড়তে প্রেয়সীর অনুরোধের ভাষা বুঝতে ভুলে গেছে? তনুশ্রী তো কোনওদিন ওকে বিরক্ত করে না। নিজেকে সঁপে দেয় শর্তহীনভাবে, তা-ও প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেল।
অরূপের স্পষ্ট মনে আছে, দিল্লিতে চাইল্ড কেয়ারের উপর একটা মেডিক্যাল সেমিনার ছিল এআইআইএমএস-এ। সেমিনার শেষ করে ছ’টা পঁয়তাল্লিশের ফ্লাইট ধরার জন্য ছুটছে, অজানা মোবাইল থেকে ফোন এল একটা। অরূপের তখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেমিনারে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যগুলো। ফোন এড়িয়ে যায়। দিল্লি এয়ারপোর্টে একেবারে অন্তিম লগ্নে পৌঁছে চেক ইন করতে বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে, মনের মধ্যে দ্বিধা, বোর্ডিং পাস কি পাওয়া যাবে নাকি সময় পেরিয়ে গেছে? আবার ফোন এল। মনে হল ওই একই আননোন নম্বর থেকে। বিরক্তিতে কল রিজেক্ট করে দেয় অরূপ। সিকিয়োরিটি চেকের পর বোর্ডিং-এর জন্য গেটের কাছে পৌঁছতেই ওর নামে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে পায়, বোর্ডিং-এর জন্য ইমিডিয়েটলি ডাকছে গেটের কাছে মেম্বাররা। দৌড়ে গিয়ে গেট পেরিয়ে যায়। টানেল দিয়ে হেঁটে ফ্লাইটে ঢুকে যাওয়ার মুখে আবার ফোন সেই একই নম্বর থেকে। সিটের কাছে পৌঁছে হাতের ব্যাগেজ উপরের লাগেজ ক্যারিয়ারে গুঁজে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অরূপ। সিটে বসেই শুনতে পায় সিটবেল্ট বাঁধার আর মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেট হয় বন্ধ, নয়তো ফ্লাইট মোডে করে দেওয়ার ফরমান।
সওয়া ন’টায় কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমে মোবাইলের সুইচ অন করে গাড়ির ড্রাইভারকে গেটে ডাকার জন্য কন্ট্যাক্ট-এ ড্রাইভারের নাম খুঁজতে-খুঁজতেই আবার ফোন, সেই নম্বর থেকে। ফোন রিসিভ করে ধমক দেওয়ার গলায় বলে, “হ্যালো।”
“গুড ইভনিং স্যার, আমি তনুশ্রী সিংহ বলছি। ভেরি সরি টু ডিসটার্ব ইউ, কাইন্ডলি ক্ষমা করে দেবেন। আমার ছ’মাসের ছেলেকে আপনার বালিগ়ঞ্জ চেম্বারে দেখিয়েছিলাম দিন পনেরো আগে। তখন ওর জ্বর হয়েছিল, আপনার দেওয়া ওষুধ খেয়ে কমে যায়,” একটু থামে তনুশ্রী, দম নেয়, কান্না মেশানো গলায় বলে, “স্যার, আজ সকাল থেকে ওর প্রায় একশো দুই-তিন জ্বর আর বমি। বিকেল থেকে প্রায় খিঁচুনির মতো হচ্ছিল। আমি সল্টলেকে ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধও খাইয়েছি, কিন্তু সন্ধ্যার একটু আগে থেকেই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। জ্বর একটু কম তবে ওর যে খুব কষ্ট হচ্ছে, তা আমি বুঝতে পারছি। তা ছাড়া, কিছুই খাচ্ছে না।”
“আমি তো এভাবে না দেখে বলতে পারব না ঠিক কী হয়েছে। আপনি বরং যে-ডাক্তারকে দেখিয়েছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন,” অরূপের গলায় এবার আর সে বিরক্তি নেই, বরং পরামর্শ দেওয়ার মতো করে বলে।
“স্যার, আমি ওঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম। উনি যে ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন ওটাই কনটিনিউ করতে বললেন। আমি ঠিক ভরসা পাচ্ছি না,” তনুশ্রীর গলায় কান্না লুকনোর চেষ্টা স্পষ্ট।
“ঠিক আছে, ওকে আপনি ‘ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড কেয়ার’-এ নিয়ে যান। আমি বলে দিচ্ছি ওখানে, ভর্তি নিয়ে নেবে। আমি আগামীকাল সকালেই ওখানে যাব, আমি দেখে দেব,” এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়িতে উঠতে-উঠতে বলে অরূপ।
“স্যার, আপনি যদি আপনার যে কোনও চেম্বারে দেখে দেন, আমি বাচ্চাটাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে আসব। আসলে আমারও খুব জ্বর, ম্যালেরিয়া হয়েছে,” একটু দম নেয় তনুশ্রী, “বাড়িতে আমার এজেড মা ছাড়া কেউ নেই,” তনুশ্রী হাঁফাচ্ছে, তবে সেটা ম্যালেরিয়ার জ্বরে নাকি বাচ্চার শরীর খারাপের ভয়ে, ভাল বুঝতে পারে না অরূপ।
“আচ্ছা, আপনার বাড়ি কোথায়?” জানতে চায় অরূপ।
“স্যার, সল্টলেকে লাবনিতে আমাদের ফ্ল্যাট। এখানেই আমরা ভাড়া থাকি,” তনুশ্রী জবাব দেয়।
“ঠিক আছে, আমি আসছি আপনাদের ফ্ল্যাটে। আসলে আমি দমদম এয়ারপোর্ট থেকে এক্ষুনি রওনা দিয়েছি। যাদবপুরে বাড়িতে ফিরছিলাম, আজ আর কোনও চেম্বার নেই আমার। লাবনি আমি খুব চিনি। ওখানে কাছাকাছি আমার বন্ধু থাকে, আমি প্রায়ই যাই ওখানে। আপনাদের ব্লক আর ফ্ল্যাট নম্বর বলুন,” অরূপ বোর্ডিং পাসের এক কোণে লিখে নেয় তনুশ্রী সিংহর ঠিকানা।
অরূপ নিজেও বিশ্বাস করে, ওইদিন রাতে তনুশ্রীদের ফ্ল্যাটে না গেলে ওর ছেলেকে বাঁচানো যেত না। কীভাবে যেন ওর শরীরে মারাত্মক ডেঙ্গির জীবাণু ঢুকে পড়ে। আজও মনে পড়ে ওদের মা-ছেলেকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে, রাতেই ইন্সটিটিউট-এর আইসিইউ-তে ভর্তি করে সবরকম ট্রিটমেন্ট স্টার্ট করে তনুশ্রীকে ওষুধ খাইয়ে, ওকে ওদের লাবনির ফ্ল্যাটে নামিয়ে, যাদবপুরের বাড়ি যখন ফিরেছিল তখন ভোর পাঁচটা। শারীরিক কষ্ট ওর হয়েছিল খুব, তবে আনন্দও কম হয়নি, মৃতপ্রায় একটা বাচ্চাকে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনে।
সদ্যোজাত শিশুরা নাকি ডা. বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে হাসে। ডা. বন্দ্যোপাধ্যায় ভালই জানেন সব শিশুই কখনও-সখনও হাসে। মস্তিষ্কের কোষে-কোষে ওদের ভাবনাচিন্তার কোনও আনন্দের খোরাক পেলেই ওরা হাসে, অনেক সময় ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার সময়ও। অরূপ সবসময় মনেপ্রাণে চায় সব শিশুর মঙ্গল, দ্রুত হাসপাতাল থেকে মুক্তি আর ওষুধ ছাড়া অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থ থাক, এমনটাই। তনুশ্রীর ছেলেকেও সুস্থ করে তুলতে সময় লেগেছিল প্রায় দিন সাতেক। তবুও বেশি আনন্দ পেয়েছিল প্রায় মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য। তনুশ্রী টাকা দিতে চেয়েছিল, নেয়নি অরূপ। সরকারি মাইনে, চার-চারটে চেম্বারে প্রতিদিন আশি-পঁচাশিটা বাচ্চা দেখে তার বিপুল উপার্জন। তা ছাড়া রুগির বাড়িতে গিয়ে তাকে তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি, আর তনুশ্রীকে নিজে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসা ইত্যাদির মধ্যে যে ভাল লাগা, মনের আনন্দ, তার কোনও মূল্য হয় না।
তনুশ্রী সুন্দরী এবং যুবতী, তাই কি অরূপের সেবাতে করুণার উদ্রেক হয়েছিল বেশি করে? অরূপ নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছে বারবার। নাহ্, তেমনটা মনে হয়নি কোনওদিনও। একজন পুরুষমানুষও যদি এমন অসহায় অবস্থায় পড়ত তাহলেও একইরকম সাহায্য করত? হ্যাঁ, করত। নিজেকে স্তোক দিয়েছে বারবার।
এই ঘটনার প্রায় মাস দুই পর অরূপ এক রবিবার গেল লাবনিতে বন্ধুর বাড়িতে। আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার মুখে ফেরার সময় হঠাৎ মনে পড়ল তনুশ্রী আর ওর ছেলে যশের কথা, যাবে কি না ভাবতে-ভাবতেই একটা ফোন করে তনুশ্রীকে। তনুশ্রী একেবারে নাছোড়, আসতেই হবে ওর ফ্ল্যাটে নাহলে ভীষণ দুঃখ পাবে ও। অগত্যা গাড়িতে রাখা কতগুলো ওষুধের ফিজ়িশিয়ানস স্যাম্পল, কিছু বেবি ফুড নিয়ে ওদের ফ্ল্যাটের কলিং বেলের সুইচে আঙুল রাখল। পরে অরূপ নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছে, হঠাৎ সেদিন কেন গিয়েছিল তনুশ্রীর কাছে? নিজেই স্বীকার করেছে সল্টলেকে সেদিন বন্ধুর কাছে যাওয়াটা ছিল নিছকই নিজের মনকে স্তোক দেওয়া। আসলে তনুশ্রীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল, অদ্ভুত এক টানে বন্ধুর অজুহাতে বেরিয়ে পড়েছিল নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। রবিবার হাসপাতালে ওর অফ ডে, তা ছাড়া ওই দিনটা কোনও চেম্বার করে না অরূপ। বাড়িতেই শুয়ে-বসে, আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেয় পরের ছ’টা দিন নিজেকে তরতাজা রাখতে। এই দু’মাসে তনুশ্রীর সঙ্গে মাঝে-মাঝে যশের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হয়েছে, তবে ব্যক্তিগত কথা হয়নি তেমন কিছু। তাই সংকোচ পেয়ে বসেছিল অরূপকে।
বেল বাজানোর সঙ্গে-সঙ্গেই দরজা খুলে দেয় তনুশ্রী। শর্টস আর পাতলা ফিনফিনে হাল্কা ক্রিম কালারের স্লিভলেস টপ পরে দাঁড়িয়ে এক তরুণী, ওর বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়নো তনুশ্রীর সঙ্গে এই তরুণীর কোনও মিল নেই। অরূপ ওকে দেখছে বুঝতে পেরে বলে, “সরি স্যার। আপনি বসুন আমি চেঞ্জ করে নিই, এক মিনিটে।”
“এই তো বেশ আছ, এমনটাই থাক। তোমার সৌন্দর্যটা বরং আমি একটু উপভোগ করি,” অরূপ হঠাৎ প্রগল্ভ হয়ে ওঠে। আজ নিজেরই বিশ্বাস হয় না। তনুশ্রী শুধু লজ্জা পেয়ে বলেছিল, “ধ্যাত!”
দু’-কামরার ছিমছাম ফ্ল্যাটে তনুশ্রীর সংসার। পরিপাটি করে সাজানো, তবে কোনও কিছুরই বাহুল্য নেই। বরং অনেক কিছুরই অভাব দেখতে পায় অরূপ। ওর নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে কোনও তুলনাই হয় না তনুশ্রীর। কিন্তু অরূপের মনে হয়, মলিন যা কিছু, জীর্ণতা বা অভাব, তা ঢেকে রাখার এক চেষ্টা রয়েছে তনুশ্রীর সংসারে।
সেই ‘ধ্যাত’ বলে তনুশ্রী ওকে সোফায় বসিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেল এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে, অরূপ বুঝতে পারে না। তবে কিচেন থেকে একটা আওয়াজ আসছিল ঘর-ঘর করে, সম্ভবত মিক্সির আওয়াজ। অরূপের অনুমান ঠিক, মিনিট পাঁচ পরে ছোট্ট একটা ট্রে-তে দুটো গ্লাসে করে সবুজ শরবতের মতো কিছু নিয়ে ফিরে আসে তনুশ্রী। ওর ঝকঝকে লম্বা-লম্বা পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে অরূপ। আজ প্রায় বছর দুই পরেও স্পষ্ট মনে পড়ে অরূপের। সেন্টার টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে ওর পাশে সোফায় বসে তনুশ্রী।
“এটা কী?” অরূপ জানতে চায়।
“এটা শরবত, তবে মিষ্টি নয়,” তনুশ্রী একটা গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে অরূপের দিকে বাড়িয়ে ধরে। অরূপ তনুশ্রীর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে হালকা চুমুক লাগায়। অদ্ভুত স্বাদের কথা আজও মনে পড়ে অরূপের।
“ওরে-ব্বাস, এ তো দারুণ! এতে কী আছে?” অরূপ জানতে চায়।
“পুদিনা, আদা, কাঁচা লঙ্কা, গোলমরিচ, লেবুর রস, একটুখানি বিটনুন আর অনেকখানি ভালবাসা,” একটু থেমে বাক্যটা টেনে লম্বা করে বলে, “সঙ্গে কৃতজ্ঞতা।” তনুশ্রী তাকায় অরূপের মুখের দিকে। তনুশ্রী বুঝতে পারে, শুধু অরূপ নয়, ও নিজেও কেন জানে না কিছু ভুল কথা বলছে।
“সত্যিই অসাধারণ তোমার এই ভালবাসা মেশানো শরবত, এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ভাল প্রত্যেকটা ইনগ্রিডিয়েন্ট,” প্রসঙ্গ পালটাতে অরূপ বলে, “তোমাদের বাড়িতে, মানে তোমার সংসারে আর কে-কে আছে? তোমার ছেলেকে দেখছি না, ঘুমোচ্ছে?”
“আমাদের সংসারে শুধু মা, আমার ছেলে যশ আর আমি,” একটু থামে তনুশ্রী। বলে, “ছেলেকে নিয়ে মা লেকটাউনে মাসির বাড়িতে গিয়েছে। আমার মাসতুতো বোন জামশেদপুরে থাকে, গতকাল এসেছে। ওরও বছর তিনেকের একটা ছেলে রয়েছে, তাই মা যশকে নিয়ে গিয়েছে। আমাকেও নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করেছিল, আমি যাইনি। আসলে মাসিমণির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বছর চারেক হল খারাপ হয়ে গিয়েছে। আর মাসিমণির কথাটা আমার জীবনে খেটে যাওয়ার জন্য আমিও আর লজ্জায় সম্পর্ক রাখি না!” চুপ করে যায় তনুশ্রী।
অরূপ তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। তনুশ্রী মুখ নীচু করে বসে থাকে। মিনিটখানেক পর নিস্তব্ধতা ভাঙে তনুশ্রীই, মুখ তুলে তাকায় অরূপের দিকে। ওর বড়-বড় চোখের পাতা তুলে একবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “আমার জীবনটা খুব অদ্ভুত। বছর ছয় আগে ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে পাশ করলাম। বাবা তখনও বেঁচে। আমাকে বললেন, মাস্টার ডিগ্রি করতে। আমি মিডিওকার স্টুডেন্ট ছিলাম, পড়াশোনা করতে একদম ভাল লাগত না। আমার কথা বলার গলা নাকি খুব শ্রুতিমধুর ছিল। সহপাঠীরা তো বলতই, এমনকি কলেজের প্রফেসররাও খুব প্রশংসা করত। অনার্সের রেজ়াল্ট বেরোবার আগেই আবৃত্তি শিখতে শুরু করলাম। গলাটাকে ধরে রাখা আর প্রয়োজন মতো ছাড়া, কথা বলার, আবৃত্তি করার স্টাইল ইত্যাদি রপ্ত করলাম। দমদম ক্যান্টনমেন্টে আমাদের নিজস্ব বাড়ি আছে, তখন ওখানেই থাকতাম,” তনুশ্রী থামে, দম নিয়ে বলে, “প্রথমে পাড়ার ক্লাবে অ্যাঙ্করিং করলাম দুর্গাপুজোর সময় ফাংশনে। তারপর আস্তে-আস্তে ডাক আসতে লাগল অন্যান্য জায়গা থেকেও। ডিমান্ড মতো টাকাপয়সাও পাচ্ছিলাম। চুটিয়ে কাজ করছিলাম সরস্বতী পুজো পর্যন্ত। কনফিডেন্স পেয়ে টুকটাক গানও করতাম অ্যাঙ্করিং-এর ফাঁকে-ফাঁকে। ডানলপ মোড়ে একদিন এরকমই একটা ফাংশনে গেলাম আর ওখানে আলাপ হল গুরমিত সিংহ অরোরার সঙ্গে। তখন আমি আকাশে উড়ছি।”
অরূপ বলে, “হ্যাঁ, ডানলপ মোড়ে শিখদের বড় ডেরা আছে, গুরুদোয়ারাও আছে ওখানে। আমার এক বন্ধু থাকে টবিন রোডে, ওর কাছেই শুনি।”
“আমাকে স্বপ্ন দেখাল গুরমিতই, বলল, ‘সিনেমায় নামো’। ওদের ছিল বড় ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা, টাকাপয়সাও প্রচুর। আমার জন্যই বাংলা একটা ফিল্ম প্রযোজনা করল। বরাহনগরের ডাইরেক্টর ধরল একজনকে। সে তার সাঙ্গোপাঙ্গ জুটিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করিয়ে দিল। আমি অ্যাক্টিং করলাম সেকেন্ড লিড ক্যারেক্টারে। ফিল্ম এডিটিং-এর সময় বোঝা গেল ফিল্মটা চলবে না। গুরমিত ভয়ানক রেগে গেল। গালাগালি করল ডাইরেক্টরকে। ডাইরেক্টর ঝগড়াঝাঁটি করে চলে গেল। গুরমিত একজন ভাল এডিটরকে ধরে আনল। সে দেখে-টেখে বলল, ‘এই ফিল্ম রিলিজ় করলে রিলিজ়ের খরচাও জলে যাবে। রিলিজ় না হলে আর নতুন করে লোকসান নেই’। বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে আমার স্বপ্নের ফিল্ম ‘ভোর রাতের তারা’।” তনুশ্রী থামে, উঠে যায় কিচেনে, মিনিট দুই পরে ফিরে আসে দু’হাতে দুটো প্লেটে কেকের দুটো টুকরো আর চামচ নিয়ে। সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে প্লেট দুটো, বলে, “ফ্রিজ় থেকে শরবত বানানোর সময়ই বের করেছিলাম, গল্প করতে-করতে আনার কথা ভুলে গেলাম।”
“ভালই হয়েছে, তোমার শরবতটা এত ভাল ছিল যে ওর সঙ্গে কেক চলত না। শরবতে ভালবাসা মেশানো ছিল, আর কেকটাতে কী মিশিয়েছ?” রসিকতার সুরে অরূপ জানতে চায়। আসলে অতীতের কথা বলা শুরু করার পর থেকেই ঘরের পরিবেশ কেমন যেন গম্ভীর আর গুমোট হয়ে গিয়েছিল, তাই অরূপ ইচ্ছে করেই পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে।
“ধ্যাত, সব কথা ধরতে নেই,” লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নেয় তনুশ্রী, “কেকটা খান, ওভেনে গরম করে দিয়েছি।”
“কেক তো খাব, তোমার গল্প আগে শেষ করো,” অরূপ আগ্রহ ভরে ওকে উৎসাহ দেয়।
“হ্যাঁ, গল্পই বটে। আমার জীবনটা সত্যিই গল্পের মতো, তবে গল্প হলেও সত্যি, ভীষণ নিষ্ঠুর এক সত্যি। এপ্রিল মাসের দুপুর দুটোর মতো,” তনুশ্রী উঠে যায় সোফা থেকে, হেঁটে যায় নিজের বেডরুমের দিকে। ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ওর জীবনটাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। আকাশে উড়তে-উড়তে আছড়ে প়ড়ার মতো। সুখ, স্বপ্নগুলো ভেঙে ছড়িয়ে গেল অমৃতসর পর্যন্ত।
অরূপ বুঝতে পারে তনুশ্রীর জীবনের গল্প খুব নিষ্ঠুর, তাই ‘গল্প’ কথাটায় ও মনে ব্যথা পেয়ে থাকবে, ওকে টিজ় করার জন্য বলা নয়, মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া। সোফা ছেড়ে উঠে বেডরুমে ঢোকে নিঃশব্দে। তনুশ্রী জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। “আই অ্যাম সরি,” পিঠে আলতো করে হাত রাখে তনুশ্রীর।
তনুশ্রী ফিরে দাঁড়ায়। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ আর গাল মুছে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, “চলুন, আমার জীবনের গল্পটা শেষ করি,” হাত ধরে অরূপকে নিয়ে ফিরে আসে ড্রয়িংরুমের সোফায়, মুখোমুখি বসে এবার। “শুটিং-এর জন্য মাইথন ড্যাম গেলাম সবাই মিলে। গুরমিতের সঙ্গে এনকাউন্টারটা হল ওখানেই। শুটিং এবং কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সবাই। কখনও দার্জিলিং, তো কখনও পুণে। দমদম ক্যান্টনমেন্টে শুটিং শেষে ফিরলাম আড়াই মাস পর। টেস্ট করানো, সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি করতে-করতেই তিনমাস পেরিয়ে গেল আমার প্রেগনেন্সির। আর রিস্ক নেওয়া হল না। তাড়াহুড়ো করে রেজিস্ট্রি বিয়ে করলাম গুরমিতকে। তনুশ্রী বসু ছেড়ে তনুশ্রী সিংহ লেখা শুরু করলাম। গুরমিতের বাবা আর দাদি কিছুতেই মানতে পারল না আমাকে, বাড়িতে ঢুকতেই দিল না। গুরমিতের পিঠোপিঠি তিন ভাই। ওর ভাইয়েরা গুরমিতকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমাকে না ছাড়লে ওকে ঘরেই ঢুকতে দেবে না। গুরমিত আমাকে নিয়ে চলে এল এই ফ্ল্যাটে, ভাড়া নিয়ে সংসার পাতলাম। ওকে ওর বাবা আর ভাইয়েরা ব্যবসায় ঢুকতে দিল না। এর মধ্যেই যশপ্রীত জন্মাল। খবর আর মিষ্টি হাতে গুরমিত গেল ওদের ডানলপ মোড়ের বাড়িতে। ওর বা়ড়ির সবাই চলে গেছে অমৃতসর, ব্যবসাপত্র গুটিয়ে। গুরমিত ফিরে এল দুপুরে, সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিল আমাকে নিয়ে অমৃতসর যাবে ওর অধিকার চাইতে, ওর সম্পত্তির ভাগ চাইতে,” একটু থামে তনুশ্রী। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। দু’বার নাক টেনে বলে, “আমি ভয় পেয়ে গেলাম। যেতে রাজি হলাম না অমৃতসর। গুরমিত চলে গেল, বলে গেল, সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ফিরবে, ফিরবেই ফিরবে।” ধীরে-ধীরে শরীরটাকে মনে হয় টেনে তুলছে তনুশ্রী। এগিয়ে যায় বেডরুমের দিকে, দাঁড়ায় সেই জানলায় গিয়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো অরূপও উঠে আসে ওর পিছনে, টুঁ শব্দ করতে ভুলে যায় অরূপ, তনুশ্রীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় নিঃশব্দে।
“মাস দুয়েক হল গুরমিতের ফোন আউট অফ রিচ। এই যে দেখছেন সামনের গেটটা,” হাত তুলে সামনের গেট দেখায় তনুশ্রী, “এটা আবাসনের মেন গেট নয়, সাইডের একটা ছোট গেট। এই গেট দিয়েই যাওয়া-আসা করত গুরমিত। আমি তাই সময় পেলেই তাকিয়ে থাকি গেটটার দিকে। আমি চাই গুরমিত ফিরে আসুক। আমার জন্য না হোক, ও ফিরুক অন্তত যশপ্রীতের জন্য।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন