রামধনু – ৭

হুমায়ুন কবীর

মন্টু গাড়িটা ভালই ছুটিয়েছে, এত তাড়াতাড়ি নিবেদিতা সেতু পৌঁছে গেল। সুরিন্দর সুইচ টিপে জানলার কাচ সামান্য নামায়। ধীরে-ধীরে লম্বা শ্বাস নেয়, আবার আস্তে আস্তে ছাড়ে। জানলা দিয়ে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ বুজে মন্দিরের ভিতরে মায়ের বিগ্রহের সামনে মনে-মনে হাঁটু গেড়ে বসে, মাকে ধন্যবাদ দেয় ওর সমস্ত রকমের উন্নতির জন্য। মায়ের কাছে ক্ষমা চায় ওর অজানা আর অনিচ্ছাকৃত দোষ ত্রুটি আর ভুলের জন্য।

“দাদা কোন রাস্তায় নামব? বিটি রোড নাকি যশোর রোডে এয়ারপোর্টের কাছে?” মন্টু জানতে চায়।

“যশোর রোডে এয়ারপোর্টের কাছে নামো। ওই শ্রীভূমিতে বড় পুজোটা যেখানে হয়, ওই প্যান্ডেলের কাছেই তো বাড়িটা, ওখানে যাব।” দুর্গাপুর থেকেই অঞ্জলিকে একটা এসএমএস করেছিল হোয়াটস্যাপ-এ, “কামিং অ্যাট ইয়োর ফ্ল্যাট অ্যারাউন্ড ইলেভেন টুডে, হ্যাভ অ্যান আর্জেন্ট টক।”

মেসেজটাতে দুটো সবুজ টিক পড়েছে তার মানে ও দেখেছে মেসেজটা কিন্তু উত্তর দেয়নি, বেরিয়ে গেলে বা অন্য কাজে এনগেজড থাকলে নিশ্চয়ই না বলত। তাই সুরিন্দর চান্স নিয়ে দেখতে চায়। এটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট, ওপি সাহেবকে যেভাবেই হোক খুশি রাখতে হবে।

নজরুল ইসলাম সরণি দিয়ে গাড়িটা অনেকটা এগিয়ে নিয়ে কাট আউট থেকে ডান দিকে ইউ টার্ন নিয়ে গিয়ার বদলে মন্টু অ্যাক্সেলেটরে চাপ দিতেই লেকটাউন মোড়ে পৌঁছে যায় গাড়ি। লন্ডন টাওয়ারের রেপ্লিকা ডান হাতে রেখে গাড়ি ঢুকে যায় লেকটাউনের রাস্তায়, কয়েকটা পাক মেরে মন্টু গাড়িটাকে নিয়ে দুর্গাপুজোর মণ্ডপের সামনে নিয়ে আসে। কয়েক লক্ষ মানুষের ভিড়ে এই চত্বর গমগম করছিল ক’দিন আগেও, এখন খাঁ-খাঁ, কয়েকজন মজুর প্যান্ডেল খোলায় ব্যস্ত।

“ব্যস ব্যস, তুমি এখানেই গাড়িটা পার্ক কর,” সুরিন্দর ভেজা টিসু দিয়ে মুখ মুছে নামার তোড়জোড় করে। প্যান্ডেলের বাঁদিক ঘেঁষে মন্টু গাড়ি থামাতেই নেমে পড়ে সুরিন্দর। এর আগে একবারই এসেছে সুরিন্দর। তবে ওই ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। তিনতলার ফ্ল্যাট বাড়িতে কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়ায় সুরিন্দর।

“এসো,” দরজা খুলে ভিতরে আসার আমন্ত্রণ জানায় অঞ্জলি। জুতো খুলে দরজা টপকে ভিতরে ঢোকে সুরিন্দর। অঞ্জলি ভিতরে ঢুকে যাওয়ার আগে সোফায় বসতে হাতের ইশারা করে সুরিন্দরকে। বেতের বোনা সোফায় পুরনো কুশন চেপটে বসে গিয়েছে। আগেই পালটানো উচিত ছিল বসার ঘরে এমন নানান জরাজীর্ণ সামগ্রী। মোটামুটি মাঝারি মাপের রঙিন টিভি ড্রইং রুমে আছে ঠিকই, তবে বহু পুরনো বাক্সের মতো মডেলের। দেওয়ালের রং পুরনো, কালচে হয়ে যাওয়া দেওয়ালে ঘরের আলো অদ্ভুত বিষাদগ্রস্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে আর এরই মধ্যে অঞ্জলির উপস্থিতি বড্ড বেমানান। ঘরের অন্যান্য সামগ্রীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে অঞ্জলির দিকে মন দেয় সুরিন্দর।

“এই শনিবার তোমাকে আমার ফ্ল্যাটে আসতে হবে, ক্লায়েন্ট দুর্গাপুরের ওই ভদ্রলোক,” সুরিন্দর ওর দিকে তাকিয়ে কোনওরকম গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই কথাগুলো বলে।

“এর জন্য আমাদের এখানে কষ্ট করে আসার কী দরকার ছিল? ফোনে বললেই তো পারতে,” অঞ্জলিও কোনওরকম ভনিতা ছাড়াই বলে।

“না, আরও আছে। সামনের মাস মানে নভেম্বরের নয় তারিখ থেকে তেরো তারিখ এই ক’টাদিন তোমাকে উনি দিল্লি নিয়ে যেতে চাইছেন। তোমাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে এলাম,” সুরিন্দর ওদের ফ্ল্যাটে আসার উদ্দেশ্য খোলসা করে বলে।

“এটাও তুমি ফোনে বলতে পারতে কিংবা শনিবার যখন তোমার ওখানে যেতাম তখনই বলতে পারতে,” অঞ্জলি এবার বিরক্ত হয়।

“আরে না, আমি ভাবলাম যদি তুমি অন্য কোথাও ওই সময়… তা ছাড়া টাকাপয়সার কথা ওই লোকটার কাছে বলতে চাইছিলাম না। ওর কাছে আমি দেখাই আমি তোমাকে ভাল চিনিই না।”

“তোমাকে আমি আগেও বলেছি আমার টাকার খুব দরকার। অন্য উপায় থাকলে এটা আমি কখনওই করতাম না। তবে আমি মাসে দু’-তিনদিনের বেশি এই কাজ করি না। এখন শুধু তোমার কাজই করি। তুমি আমাকে মাসে দু’দিন কাজ দাও আর বড়জোর এক-আধদিন, তা-ও খুব চেনাজানা কেউ থাকলে। তাই অন্য কোথাও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই।” ওর মা পরদা সরিয়ে উঁকি মারতেই অঞ্জলি সোফা ছে়ড়ে উঠে যায়। ফিরে আসে চায়ের কাপ-প্লেট হাতে নিয়ে, নামিয়ে রাখে সেন্টার টেবিলে।

“ঠিক আছে, তাহলে তুমি যাবে তো দিল্লি?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুরিন্দর জানতে চায় ওর কাছে।

“বড্ড ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে না? তুমি কী বলো?” সুরিন্দরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় অঞ্জলি।

“নাহ্‌, ওপি নিজেই ভয়ে আর টেনশনে মরে। ও তোমাকে এক্সপ্লয়েট বা ব্ল্যাকমেল করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। তা ছাড়া ও ম্যাচিওর লোক, ইমোশনাল অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ারের মতো কোনও কিছুতে কখনও জড়াতে চাইবে না, তাই সেফ,” একটু থামে সুরিন্দর, দম নেয়। অঞ্জলির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমাকে কী দিতে হবে বলো?”

“তুমি যা দেবে। তুমি তো জানো সব কথা,” এবার অঞ্জলির চোখ একটু চিকচিক করে। সুরিন্দরের মনে হয় অঞ্জলি সামান্য আপসেট হয়েও নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে তখন।

“সরি, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমি পুরো এক দেব তোমাকে। পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা বান্ডিল বার করে সেন্টার টেবিলের উপর রাখে সুরিন্দর।

“এতে পঞ্চাশ আছে, নভেম্বরের অ্যাডভান্স। শনিবারেরটা ওই দিন দেব। আচ্ছা, তোমার বাবা কেমন আছেন এখন?” সুরিন্দর সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

“ওই একইরকম। আসলে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে মিনিমাম দু’বার ডায়ালিসিস চালিয়ে যেতেই হবে। তুমি তো জানোই প্রথম প্রায় দু’বছর তো বোঝাই যায়নি দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গিয়েছে। ওখানে প্রচুর টাকা বেরিয়ে গেল। যদিও পুরো খরচের টাকাটাই আমাকে দিয়েছে আমার আগের বস। ও খুব ভাল ছিল, যখন যা চেয়েছি, দিয়েছে। কিন্তু ও যখন আমার কাছে কিছু চাইল ওটা আমি দিতে পারলাম না, ঝগড়াঝাঁটি হল। আমি ওই কোম্পানি ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। ওটা ছিল আমার মস্ত বড় ভুল, আজও আফশোস করি। তারপরই জীবনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেল। আমার একটা কিডনি দিতে চাইলাম, ওটা ম্যাচ করল না। তা ছাড়া আর কিছুতেই ডোনর পাচ্ছি না। যদিও কাঁচড়াপাড়ার দিকে একজনকে পেলাম, ও পঁচিশ লাখ চাইছে, যা আমার সাধ্যের বাইরে। দালাল ধরে রেখেছি ও বলেছে দশের মধ্যে করিয়ে দেবে। তাই আশায়-আশায় থাকি বাবাকে বাঁচিয়ে নেব। বাবা আবার আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে ভারতবর্ষের কোনায়-কোনায়।”

“তোমার চাকরির জায়গা থেকে লোন পাবে না?” সুরিন্দর জানতে চায়।

“না নাহ্‌, এখনও ছ’মাসই হয়নি। আমি তো আগের চাকরি মানে সেক্টর ফাইভে যেটা করতাম, ওটা ছেড়ে দিয়েছি। ওখানে যাতায়াতে খুব কষ্ট হত। তা ছাড়া ওয়ার্কিং আওয়ার্স অনেক বেশি। এখন এই তো লেকটাউনেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আছি, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। কেটেকুটে হাতে পঁচিশ হাজারের মতো পাই। হেঁটে চলে যাই বাড়ি থেকে, আটঘণ্টা ডিউটি করে আবার হেঁটে বাড়ি ফিরি। চাকরিতে অন্য কোনও টেনশন নেই, নেই কোনও পার্সোনাল মেন্টাল ইনভলভমেন্ট। এই বেশ আছি।”

“তোমার ভাই এখনও চাকরি পায়নি?” সুরিন্দর জুতোর লেস বাঁধতে বাঁধতে জিজ্ঞাসা করে।

“নাহ, ওর এটা লাস্ট সেমেস্টার। পাশ করে বেরিয়েই যে চাকরি পাবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। বরং না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রাইভেট কলেজের পাসআউট ইঞ্জিনিয়ারদের এখন এমনই অবস্থা,” অঞ্জলি সুরিন্দরের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে।

সুরিন্দর ঘুরে দাঁড়ায়, “তাহলে শনিবার দেখা হবে। সময়টা আমি ফোন করে জানিয়ে দেব, টেনটেটিভলি এইট-এইট থার্টি। বাই।”

সুরিন্দর বেরিয়ে যেতে সিঁড়ির নীচ থেকে আবার তিনতলায় উঠে আসে অঞ্জলি। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে ছিটকিনি তুলে দেয় দরজায়। সেন্টার টেবিলের উপর থেকে কাপ প্লেট তুলে নিয়ে ঢুকে যায় কিচেনে। সিঙ্কে নামিয়ে রাখে কাপ প্লেট। মায়ের দিকে তাকায়, মা একমনে রান্না করছে। রান্নার কড়াই থেকে চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞাসা করে, “কে এসেছিল রে?”

“সুরিন্দর এসেছিল মম্মা,” জলের কল খুলে কাপ ধুতে ধুতে উত্তর দেয় অঞ্জলি।

“ও কি আরও কাজের বরাত দিচ্ছে তোকে?”

“হ্যাঁ মম্মা, শনিবার যাব, কিছু কাজ ওর অফিসে করব, সকালে ফিরব। আবার ওর অফিসের কাজে নাইন্থ নভেম্বর দিল্লি যাব। ওর কল সেন্টারের কাজেই। এই তিন-চারদিন।”

“এতদিন কেন রে?” কড়াই থেকে চোখ তুলে অঞ্জলির মুখের দিকে তাকায় ওর মা।

“ওখানে ‌একটা বড় কোম্পানির সঙ্গে বিজ়নেস ডিল হবে, মানে এই টাই-আপ আর কী! ওরা কিছু কাজ আউটসোর্সিং করবে সুরিন্দরের কোম্পানিকে। কাজ হলেই আমি ফিরে আসব। রোজ তোমাদের ফোন করে খবর নেব যখনই ফাঁকা পাব,” অঞ্জলি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পাশের রুমে ঢুকে যায়। মিথ্যা বলার সময় মায়ের মুখের দিকে তাকায় না অঞ্জলি।

“ক’দিন পরে তিন-চারদিনের জন্য দিল্লি যাব পাপা। আজ তুমি কেমন আছ?” বাবার শীর্ণ অথচ ফোলা ডান হাত নিজের দু’হাতে তুলে নেয় অঞ্জলি।

“ভাল আছি রে আজ,” বিছানায় আধশোওয়া অবস্থাতেই উত্তর দেয় সঞ্জয় অগ্রবাল।

“কিন্তু তোমার চোখমুখ হাত সব ফোলা ফোলা লাগছে মনে হচ্ছে। তোমার পরের ডায়ালিসিসের ডেট কবে পাপা?”

“এই সোমবার,” ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে আধশোওয়া অবস্থা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করে সঞ্জয়। অঞ্জলি হাত ধরে টেনে তুলে বিছানায় বসিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে, “কেন যাবি রে দিল্লি? অফিসের কাজে?”

“হ্যাঁ পাপা, পার্ট টাইম কন্ট্র্যাক্টে কাজ করি যে-কোম্পানিতে, তাদেরই একটা কাজে,” মুখ নামিয়ে উত্তর দেয় অঞ্জলি, “কিন্তু তোমার শরীর খারাপ দেখাচ্ছে কেন? দিন দুই আগে মানে শনিবারই ডায়ালিসিস করিয়ে নিতে পারি। এই তো বাইপাসের উপর হসপিটালটায় করিয়ে নিই। সব মিলিয়ে আ়ড়াই হাজারের বেশি তো নয়। তুমি কষ্ট পাচ্ছ আমার তা দেখতে ভাল লাগে না পাপা।”

“না রে, আমি ভালই আছি। তোদের ছেড়ে যাবও না এখন, সে উপরওয়ালাও যদি বিরোধিতা করে তবুও না,” এটুকু কথা বলেই হাঁপাতে থাকে সঞ্জয়।

“পাপা তুমি ভাল হয়ে যাবে একদম, ডাক্তার আমাকে বলেছে। একটা ডোনর পেলেই…” অঞ্জলির গলা বুজে আসে, তাই কথা থামিয়ে চুপ করে থাকে যাতে ওর অসহায় অবস্থার কথা পাপা বুঝতে না পারে।

“তোর খুব কষ্ট তাই না রে? তোর আর তোর ভাইয়ের জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। আসলে এত দুর্বল লাগত আর মাথা ঘোরাত যে দু’বছর আগেই রিটায়ারমেন্ট নিতে বাধ্য হলাম। তারপর প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে তো জানিস পি এফ, গ্র্যাচুইটির কত গণ্ডগোল। যা হাতে পেলাম তাতে করে তোর পড়ার খরচ আর সংসার চালাতেই তো হাঁফিয়ে গেলাম। তুই যদি সংসারের হাল আর আমার দেখভাল না করতিস, তাহলে শুধু আমি নয় আমরা সবাই বেঘোরে মারা পড়তাম।”

“এরকম করে বোলো না তো পাপা, আমার খারাপ লাগে। তুমি ভাল হয়ে যাও, আমরা আবার সবাই একসঙ্গে বেড়াতে যাব। তোমার তো অনেকদিনের ইচ্ছা বৈষ্ণোদেবী যাবে আর আমার আর ভাইয়ের ইচ্ছা কাশ্মীর বেড়াতে যাব, দুটোই একসঙ্গে হয়ে যাবে!”

“ভাল হলেই ভাল। আমার এই হাত-পা, এই চেহারা কি আর ভাল হবে রে! আমি কি আর আগের মতো যেতে পারব!” সঞ্জয় সন্দেহ প্রকাশ করে আবার আধশোয়া হয়ে যায় বালিশে হেলান দিয়ে, “তুই আজ কাজে যাবি না?”

“আজ দুটো থেকে আমার ডিউটি পাপা,” একটু থেমে বলে, “এখন অনেক দেরি আছে। আচ্ছা পাপা, তোমার মনে আছে আমার যখন বছর বারো বয়স, ক্লাস সিক্সে পড়তাম, তখন আমাদের দার্জিলিং কালিম্পং বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলে।”

“হ্যাঁ, তা মনে নেই আবার! সাতদিন ছিলাম, কত জায়গা ঘুরে বেড়ালাম। লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ, ডেলো, বিন্দু মিরিক, সুখিয়া, সুখিয়া পোখরি, লোধামা। লেবং, রক গার্ডেন্স, টাইগার হিলস, দার্জিলিং মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট, জ়ু, বাতাসিয়া লুপ আর ম্যালে বেড়ানো সব মনে আছে রে!” সঞ্জয় সময় নিয়ে এক একটা জায়গার কথা ধীরে-ধীরে এমনভাবে বলে যেন, কল্পনায় একবার করে বেড়িয়ে নিচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রত্যেকটা জায়গার জীবন্ত ছবি।

“আচ্ছা বাবা, তোমার মনে আছে রম্ভিতে আমি খুব জেদ ধরলাম র‌্যাফটিং করব বলে। আমার দেখাদেখি ভাইও জেদ ধরল। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে তুমি আমাদের নিয়ে গেলে ‌র‌্যাফটিং করাতে। মম্মা বসে থাকল তিস্তা নদীর চরে। তারপর র‌্যাফটিং করার সময় নীচে পাথরে কোথাও ধাক্কা লেগে বোট টালমাটাল হতেই আমি ছিটকে পড়ে গেলাম বোট থেকে। আমরা সবাই লাইফজ্যাকেট পরেছিলাম, আমার ডুবে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু তুমি কেমন করছিলে। বোটম্যান জলে নামার আগেই তুমি ভাইকে কোল থেকে নামিয়ে বোটে রেখে জলে ঝাঁপ দিলে আমাকে জল থেকে তুলবে বলে। আর আমি ভয় পেয়ে কেমন চেঁচাচ্ছিলাম!”

“মনে নেই আবার? আমার সব মনে থাকে। কোথায়-কোথায় বেড়াতে গিয়ে কী-কী ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটেছে, সব মনে থাকে।”

অঞ্জলির চোখে জল, জল লুকোতে বাবার বিছানা ছেড়ে উঠে যায় জানলার ধারে। ওর ওইদিনের স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে। বাবা যেটা বলল না ওটাই ওর আজও…

আসলে বাবা হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন ওর জন্য। তারপর বোটম্যান যতই বলেছিল কিছুই হবে না, ওরা ঠিক তুলে নেবে উপরে, ওরা এগিয়ে যাওয়া বোটটাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওর কাছাকাছি, বাবা তার আগেই ঝাঁপ দিল জলে। ভাইও তখন ভয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদছিল। ওকে জল থেকে তুলে আনার পরেও বাবার শরীর ভয়ে কাঁপছিল আর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল অবিরাম। ওইদিনটার কথা প্রায়ই মনে পড়ে অঞ্জলির। ওই ছোট্টবেলাতে বাবার কান্না দেখে নিজের কান্না থামিয়ে বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। যত বড় হয়েছে ও বুঝেছে বাবা ওকে কত ভালবাসে!

বাবাকে বাঁচাতে সে সবসময় সবরকম আত্মত্যাগ করতে রাজি। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে বাবার অমানুষিক পরিশ্রম ওদের একটু ভালভাবে মানুষ করার জন্য। প্রাইভেট জুটমিলের লেবার অফিসারের চাকরিতে সবসময় টেনশন অথচ মাইনে সামান্য। হাজার অসুস্থতা সত্ত্বেও বাবাকে ট্যাক্সি চাপতে কিংবা কোনওদিন বিলাসিতা করতে দেখেনি।

“বাবা, তুমি রেস্ট নাও, আমি তৈরি হই,” অঞ্জলি বিছানার কাছে ঝুঁকে বাবার গালে গাল ছোঁয়ায়। ধীর পায়ে হেঁটে ঢুকে যায় নিজের কামরায়। স্নান করে তৈরি হয়ে, লাঞ্চ করে ওকে বেরিয়ে যেতে হবে ওর কাজের ঠিকানায়।

অঞ্জলি স্নান করে টয়লেট থেকে বেরোতেই ফোনে রিং হতে থাকে, ‘ম্যয় অগর কঁহু, তুমসা হসিন…’। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আননোন নম্বর, ধরবে না ধরবে না করেও ফোনটা রিসিভ করে, বলে, “হ্যালো…”

“হ্যালো,” ওপাশ থেকে পুরষ কণ্ঠ ভেসে আসে, “আজ কি একবার দেখা করতে পারবে? আমি মাঝে-মাঝে দোকানটায় যাই তোমাকে দেখতে, তুমি দেখলেই চিনতে পারবে। তবে যতদিন তুমি আলাদা করে দেখা করতে না চাইবে, তোমার কাছে আসব না আর আইডেনটিটিও ডিসক্লোজ় করব না।”

“আচ্ছা মুশকিল, আপনি কে এবং কী চান না জানলে আমি কেন আগে দেখা করতে চাইব।”

এই নিয়ে বার তিনেক ফোন করেছে ‘স্টুপিড ফোর’। এর আগেরবারই এই নামে নম্বর সেভ করেছে আগেরগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।

“আমি তোমাকে আগেও বলেছি তোমাকে আমার ভাল লাগে তাই আলাপ করতে চাই। আরও অনেক কিছু চাই তবে আলাপ করতে রাজি হলে তবেই সেসব বলব,” পুরুষ কণ্ঠ স্পষ্ট জবাব দেয়।

প্রথমবার যখন এই নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, ও ভেবেছিল হয়তো ওর কোনও ক্লায়েন্ট ফোন করেছে। একটু কথাবার্তা হওয়ার পরই অঞ্জলি বুঝতে পারে কোনও ক্লায়েন্ট নয় কিংবা পরিচিত কেউ নয়। এইসব উৎপাতের জন্য ফোনে ট্রু কলার অ্যাপ ডাউনলোড করেছে অঞ্জলি। কিন্তু এই ফোনে সেটা আসত রোমিও রোজ়ারিও নামে। কথাবার্তা খুব পলিশ্‌ড, নাহ্ কোনও ক্লায়েন্ট হতে পারে না। তাহলে সরাসরি ডিলের কথা বলত কিংবা হোটেলে বা ফ্ল্যাটে ডাকত। অঞ্জলির ক্লায়েন্ট বলতে বড়জোর দশ-বারোজন। ওদের মোটামুটি সবাইকে ওর মনে আছে, ওদের কারও গলা নয়। এমনিতে দু’জন রিপিট গেস্ট ওপি আর সুরিন্দর, সুরিন্দরের তো প্রশ্নই নেই আর ওপি এত পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে না, ইন ফ্যাক্ট প্রায় জনা ছয়-সাত বাঙালিই নয়। মোটামুটি সবার সঙ্গেই ও থেকেছে ফাইভস্টার হোটেলে কিংবা রিসর্টে। ওরা করপোরেট গেস্ট। ওরা এমন ইমোশনাল কথাবার্তা বলবে না। তাহলে কলেজের কেউ?

“কী হল, চুপ করে আছ কেন? কী ভাবছ? দেখা করবে? একবার দেখা করোই না। আমি সভ্য ভদ্র ছেলে, পড়াশোনায় ভাল। ভাল চাকরি করি, হতে পারে আমাকে তোমার পছন্দ হয়ে গেল!” এবার পুরুষ কণ্ঠ রসিকতার গলায় বলে।

“আপনি আমার সম্বন্ধে কী জানেন? শুধু দেখে ভাল লাগলেই হল? আমার কাজের জায়গায় প্লি‌জ় ডিস্টার্ব করবেন না, ওতে কোম্পানির আমার সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হবে,” অঞ্জলি এবার অনুরোধ করে।

“আমি অন্য জায়গাতেও তোমাকে দেখেছি। আমি অনেক কিছুই জানি তোমার সম্বন্ধে। যেমন ধরো তুমি খুব চাপে আছ তোমার বাবার জন্য একটা কিডনি জোগাড় করতে। তুমি নিজে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। তোমার ভাইও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। লাস্ট সেমেস্টার। তোমার বাবা মাড়োয়ারি কিন্তু মা বাঙালি। তোমরা বাড়িতে নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলো এবং আরও কিছু-কিছু জানি, সেগুলো না হয় দেখা হলেই বলব। আর হ্যাঁ তোমার কাজের জায়গায় তোমার কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না। ইন ফ্যাক্ট, কোথাও কোনওভাবে ক্ষতি হোক আমি চাইব না। দেখা না করতে চাইলেও ক্ষতি করব না। আমি তোমাকে আগেও বলেছি আই অ্যাম আ ভেরি রেসপন্সিবল অ্যান্ড ডিগনিফাইড পার্সন। পার্টির ঠিকাদার, সিন্ডিকেটের নব্য বা তৎকাল চ্যাংড়াও নয়,” ফোনের ওধার থেকে আননোন স্টু়পিড ফোর বেশ রগুড়ে গলায় বলে।

“আমার এখন সময় নেই আপনার সঙ্গে দেখা করার। আমি দু’জায়গায় চাকরি করি। আমার বাবা অসুস্থ। আপনি জানেন আমি হন্যে হয়ে একজন কিডনি ডোনর খুঁজছি। আমি যেদিন ফাঁকা থাকব আমিই আপনাকে ফোন করে দেখা করব। আমাকে প্লি‌জ় ডিস্টার্ব করবেন না,” কথা বলতে-বলতেই ওয়ার্ডরোব থেকে ফরমাল ট্রাউজ়ার্স আর শার্ট বের করে বিছানায় মেলে রাখে অঞ্জলি।

“ওকে ডান, আমি আর ডিস্টার্ব করব না তবে। তবে যদি একটা কিডনি ডোনর খুঁজে পাই তখনই ফোন করব। আমাকে প্লিজ় তোমার বাবার রিকোয়্যার্ড কিডনির স্পেসিফিকেশন আর ব্লাড গ্রুপটা এসএমএস করে পাঠিয়ে দিয়ো। ও হ্যাঁ, এসএমএসটা আননোন স্টুপি়ড ফোরে পাঠিয়ো। এক দুই তিন বা পাঁচ ছয়ে না চলে যায় ভুল করে,” ফোন লাইন কেটে দেয় আননোন স্টুপিড ফোর।

নাগরদোলার বাক্স দ্রুত নীচে নামার সময় যেমন অনুভূতি হয় তেমনটাই মনে হল অঞ্জলির, মুহূর্তের জন্য মনে হয় ওকে কেউ শূন্যে ছুড়ে দিয়েছে, এখনই মাটিতে আছড়ে পড়বে। ওই পুরু়ষ কি কোনও গোয়েন্দা পুলিশ নাকি প্রফেশনাল হ্যাকার? ওর ফোনের ডেটা পেল কীভাবে? খেতে বসে অন্যমনস্কভাবে এটাই ভাবতে থাকে অঞ্জলি। আচ্ছা ও যে মাঝেমাঝে অভিসারে যায়, সেসব জেনে যায়নি তো? নিজের মনকেই স্তোক দেয়, না তা সম্ভব নয়। ও ভুল করেও ফোনে কোনওদিন ডিসকাশনই করেনি এসব। এটা জানতে পারার কথা নয়। তবে ওর ফোনের তথ্য জানে, এমন কে হতে পারে?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন