হুমায়ুন কবীর
এখন পাঁচটা পনেরো। অনুপমা ঘড়ি দেখে কবজি ঘুরিয়ে। পাঁচটা কাপল লঞ্চে ফেরত এসেছে। একটা এখনও আসেনি। অনুপমা এগিয়ে যায় মৈনাকের কাছে। “মৈনাকদা একটা কাপল এখনও ফেরেনি লঞ্চে। আমি একটু দেখে আসছি মার্কেটটাতে, আপনি সঙ্গে আসবেন?”
“না নাহ্। এসেছে ফেরত। আমি দেখেছি। বোধহয় কোনও কেবিনে রয়েছে,” তনুশ্রী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“ওহ্ তাই?” মৈনাক চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় ডেকের দু’খানা কেবিন চেক করতে। অনুপমা মৈনাকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্রুত পায়ে মৈনাক ফিরে আসে লঞ্চের সামনের দিকে বসবার জায়গায়, “নাহ্ নেই।”
অনুপমা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় নীচে। মিনিটখানেকের মধ্যেই ফিরে আসে উপরে, “ইয়েস, দে আর দেয়ার ইনসাইড আ কেবিন।”
আফরোজ় আগেই দেখেছে নিধি আর ওর পার্টনার ডেকের উপর বসার জায়গায় নেই। অনুপমার কাছ থেকে শুনল ওরা কেবিনের কাছে। আলতো করে ছুঁয়ে থাকা অনুশ্রীর হাত ক্রমশ শক্ত হতে থাকে। অনুশ্রী আফরোজ়ের পিঠে কাঁধের কাছে আলতো করে ওর চিবুক ঠেকায়, “আমি তো রয়েছি সঙ্গে তোমার।”
অনু্পমা সামনের চৌকির পাশে এসে দাঁড়ায় লোয়ার ডেক থেকে। মুখ বাড়িয়ে কথা বলে নেয় সারেঙের সঙ্গে। সরে আসে একটু। “ওই যে ওপারের কিছু আলো আর জেটি দেখা যাচ্ছে, ওটাই সজনেখালি। ওখানেই আছে ম্যানগ্রোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, সরকারের টুরিস্ট লজ ইত্যাদি। আগামীকাল ব্রেকফাস্টের পর আমরা রিসর্ট ছেড়ে প্রথমে এখানে আসব। এখানে একটা ছোট্ট মিউজ়িয়াম আছে। একটা ছোট্ট পুকুর আছে। তাতে কয়েকটা ক্রোকোডাইল। আর আছে ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ার থেকে স্পটেড ডিয়ার দেখার খুব চান্স আছে,” একটু দম নেয় অনুপমা। বলে, “আজ আমরা ফিরছি রিসর্টে। পিচখালি নদীর উপরে। যেহেতু একটু-একটু করে এখন হাই টাইড আসছে, আমাদের ওখানে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। এখন পকোড়া, বেগুনির সঙ্গে চানাচুর দিয়ে মুড়ি থাকছে। আর যারা এসব পছন্দ করেন না, তাদের জন্য থাকছে ভেজ প্যাটিস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিকেন সসেজ, কফি আর দার্জিলিং টি। সবাই অবশ্য সব খাবার টেস্ট করতে পারেন!”
হাততালি দিয়ে ওঠে সুমন্ত, অরূপ, শর্মিষ্ঠা এবং পরে সবাই।
“সো গাইজ়, ড্রিঙ্কস উইল বি সারভড রাইট অ্যাট সেভেন।”
প্রবল হাততালি আর থ্যাঙ্ক ইউ-এর জোয়ারের মধ্যে মুচকি হেসে চৌকিতে বসে অনুপমা।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পৌঁছে যায় স্ন্যাক্স। বড় একটা টেবলক্লথ পেতে সারেঙের সামনে চৌকিতে দু’জন লঞ্চের সহযোগী একসঙ্গে নামিয়ে রাখে প্লেটগুলো।
“নূরজাহান অ্যান্ড জাহাঙ্গির হ্যাভ বিন লেফ্ট আউট, সামওয়ান মে কল দেম ইফ দে হ্যাভ ফিনিশ্ড।”
মেয়েরা মুখ টিপে হাসে। হাসি খেলে যায় পুরুষদের মধ্যেও। অনুপমা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে নামতে-নামতে বলে, “আই অ্যাম গোয়িং টু কল দেম।”
অনুপমা ফিরে আসে লঞ্চের ডেকে। একটু পরেই উঠে আসে নিধি আর ওর পার্টনার। সবাই তাকায় ওদের দিকে। নিধির পরনে ব্লু ডেনিমের শর্টস আর স্লিভলেস সাদা টপ। চুলের গোছা উপর দিকে তুলে টপ নট করে বাঁধা। সঙ্গে ওর পার্টনার ওপি। গ্রে কালারের বারমুডা আর সাদা টি-শার্ট।
আফরোজ় বেগুনি খাওয়া ভুলে তাকিয়ে থাকে নিধির দিকে। একবছরে নিধি কি সামান্য রোগা হয়েছে? একই রকমের গর্জিয়াস আর ঘাড় সামান্য হেলিয়ে ব্যক্তিত্বময় হাঁটা। শেষ বিকেলের সূর্যের আলো ওর মুখে, ওর লালচে সাদা মুখকে আরও উদ্ভাসিত করে তোলে। কিন্তু ওর বিষণ্ণ চোখজোড়া আফরোজ়ের চোখ এড়ায় না। মৈনাকের সামনে দিয়ে হেঁটে ডেকে পিছন দিকে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে ওরা বসে।
“সব পুরুষগুলোর মুখ কেমন হাঁ হয়ে গেছে দেখো। আর তুমিও দয়া করে মুখটা বন্ধ কর। মাছি নয়, আস্ত একটা স্যান্ড পাইপারই পথ ভুলে ওর বাসা মনে করে ঢুকে যাবে তোমার মুখে। বেচারির আর নিজের বাসায় ফেরা হবে না!” ফিসফিস করে বলে শর্মিষ্ঠা।
“ধুস, আমি ওর স্টাইল মেরে হাঁটাটা দেখছি। অঞ্জলি কি ভাবল লঞ্চের ডেক ফ্যাশন শোয়ের র্যাম্প!” মৈনাক একইরকম নিচু গলায় জবাব দেয়।
“এর নাম অঞ্জলি তুমি জানলে কী করে?” শর্মিষ্ঠা খোঁচা দেয় মৈনাকের পেটে।
“আরে ওর বয়ফ্রেন্ড ওপি-ই বলেছে মুখ ফসকে,” মৈনাক ছোট্ট উত্তর দেয়।
ওপি ফিরে আসে ডেকের সামনের দিকে। বড় একটা প্লেটে দুটো প্যাটিস, কয়েকটা চিকেন সসেজ আর সামান্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তুলে নেয়। সঙ্গে দুটো ফর্ক আর পেপার ন্যাপকিন। “গুড অ্যারেঞ্জমেন্ট মি. মুখার্জি, ইন ফ্যাক্ট, ভেরি গুড।” খাবার নেওয়া শেষ করে সোজা দাঁড়ায় ওপি।
“ক্রেডিট গোজ় টু মিস অনুপমা,” হাসিমুখে আলতো করে অনুপমার পিঠে হাত রাখে মৈনাক।
পুরুষের স্পর্শ টের পায় অনুপমা। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে ওপি-র চোখে তাকিয়ে বলে, “ইউ আর ওয়েলকাম স্যার।”
ওপি বলে, “উই হ্যাভ ডিসাইডেড টু স্পেন্ড টুনাইট অ্যাট দ্য কেবিন ইটসেল্ফ। হোয়াট ইজ় ইয়োর সাজেশন মি. মুখার্জি? আই হোপ দ্য বিগ ক্যাটস ওন্ট ডিসটার্ব আস।”
“নো নো। দ্য লঞ্চ উড বি অ্যাঙ্করড ইন দ্য মিডল অফ দ্য রিভার অ্যান্ড দো বিগ ক্যাটস ক্যান সুইম আপ টু দেয়ার, দে ওন্ট বি এব্ল টু জাম্প টু রিচ্ দ্য লঞ্চ ডিউ টু অ্যাবসেন্স অফ আ সলিড বেস। পায়ের নিচে মাটি নেই তো, জাম্প করবে কীভাবে? তা ছাড়া লঞ্চ পিচখালি নদীতে অ্যাঙ্কর করা থাকবে। ওদিকে টাইগার ভেরি রেয়ারলি ভিজ়িট করে। তা ছাড়া যদি উইনডোর দিকে আঁচড়ে ওঠার চেষ্টা করে, আপনি একটা দা বা হাঁসুয়া টাইপের কিছু রাখবেন। ওটা দিয়ে খোঁচা দেবেন,” মৈনাক হাসতে-হাসতে বলে।
ওপি সাহেবও হেসে ফেলেন, ওই হাসি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
ওপি সাহেব প্লেট নিয়ে চলে যান লঞ্চের পিছনের ডেকে। প্লেট মেলে ধরেন অঞ্জলির সামনে।
সুমন্ত-নাজ়িয়া আর অরূপ-তনুশ্রী উঠে দাঁড়ায়, “আমরাও একটু ভাল করে দেখে নিই কেবিন কতটা কমফর্টেবল হবে নাকি রিসর্টে থাকা বেটার হবে!”
“ম্যাডাম, থাকার জন্য অবশ্যই রিসর্ট বেটার হবে। ইনফ্রাস্ট্রাকচারই বলুন বা কমফর্ট লেভেল। বাট লঞ্চের কেবিন ইজ় অলটুগেদার আ ডিফারেন্ট এক্সপেরিয়েন্স। মর্নিং-এ রিসর্টে আসতে হবে ফর ওয়াশরুম অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। সব কেবিনে টয়লেট অ্যাটাচ্ড আছে। কিন্তু ফর হ্যাভিং বাথ, রিসর্টের টয়লেট ইউজ় করা ভাল হবে,” অনুপমা বিশদভাবে কাপলদের বলে।
“ওকে লেট আস প্রপারলি সি ফার্স্ট, দেন উই উইল ডিসাইড,” নাজ়িয়া সুমন্তর হাত ধরে এগিয়ে যায় ডেকের উপরের কেবিনে আর অরূপ-তনুশ্রী এগিয়ে যায় নীচের সিঁড়ির দিকে।
গলা তুলে অনুপমা বলে, “বাট গাইজ় ইউ অল রিকোয়ার টু কাম অন দ্য ডেক বাই সেভেন। ড্রিঙ্কস উইল বি সার্ভড শার্প অ্যাট সেভেন অ্যান্ড ডিনার অ্যাট নাইন অ্যাট রিসর্টস ডাইনিং হল।”
“ইট্স অলমোস্ট ওয়ান আওয়ার টু সেভেন। সো ডোন্ট ওরি অনুপমা। দে অল উইল ফিনিশ বাই দ্যাট টাইম,” মৈনাক চোখ ছোট-ছোট করে আশ্বস্ত করে অনুপমাকে।
“হোয়াট উইল দে ফিনিশ?” মুখ ফসকে বলে ফেলে অনুপমা।
“অবভিয়াসলি সিয়িং দ্য কেবিন প্রপারলি,” দু’ হাত দু’ পাশে ডানার মতো করে মেলে দেয় মৈনাক।
বোকার মতো প্রশ্ন করেছে বুঝতে পেরে হাসতে থাকে অনুপমা, আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ডেকে থাকা সবাই।
মৈনাক তাকায় আফরোজ়ের দিকে। দূরে আবছা অন্ধকার রহস্যময় দ্বীপের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে আফরোজ়। পাশে বসে অনুশ্রী ওর হাত নিয়ে খেলছে।
চেয়ার ছেড়ে মৈনাক এগিয়ে যায় সুরিন্দরের দিকে। “তুমকো কেবিন নহি দেখনা হ্যায়? দেখ লো ইয়ার, অচ্ছাহি হোগা…”
মৈনাক ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাই সুরিন্দরও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। “হ্যাঁ স্যার আমরাও তাহলে একটু কেবিন দেখে আসি…”
“হাঁ হাঁ যাও। ধীরে সুস্থে দেখো। তোমার কাছে একঘণ্টা টাইম আছে,” চোখ টিপে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে “পয়সাভি উসুল করনা হ্যায়।”
“ক্যায়া ক্যায়া স্যার? কঁহাসে…” মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারে সুরিন্দর। মৈনাকের ইশারা বুঝতে পেরে লজ্জা পায়। মুখ মটকে লজ্জা পাওয়ার হাসি হেসে বলে, “আপভিনা স্যার আদমিকা অন্দরতক ঝাঁক লেতে হ্যায়!”
মৈনাক জড়িয়ে ধরে সুরিন্দরকে। হাত মুঠো করে পূজাকে বুড়ো আঙুল দেখায়, “যাও এনজয় করো, অভি লৌটকে আনেকা বাদ বহুত গানা গানা পড়েগা অউর ডান্স ভি করনা পড়েগা।”
সুরিন্দর আর পূজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় নীচে।
মৈনাক একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আফরোজ়ের পাশে বসে। আলতো করে ওর পিঠে হাত রাখে, “কী রে পাগলা, কী দেখছিস? তখন থেকে চুপচাপ বসে আছিস?” লঞ্চের বাঁদিকে মাছ ধরার ডিঙি আর ডানদিক দিয়ে মালভর্তি মেকানাইজ়ড বোট বেশ জোরে এগিয়ে আসছে। সারেঙ ওদের সাবধান করতে বড় একটা ভোঁ করে হর্ন বাজায়।
রেলিং-এর উপর থেকে চিবুক সরিয়ে আনে আফরোজ়, “কিছু দেখছি না রে। শুধু তাকিয়ে আছি। চাপচাপ অন্ধকার এত বিশাল জঙ্গলটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে তাই ভাবছিলাম। কী অদ্ভুত তাই না?” আফরোজ় তাকায় মৈনাকের চোখের দিকে।
“আরে এর মধ্যে বিস্ময়ের কী আছে? রোজই সন্ধ্যা হয়, অন্ধকার নামে, নেমে আসে রাত…আফু তুই এত আবেগপ্রবণ কেন রে?”
“ধুস আবেগ কোথায়? আমি ভাবছি এই জঙ্গলের অধিবাসীদের কথা, ভাবছি বাঘগুলো কী করছে? হরিণ, বনশুয়োর, বনবিড়াল…এরা? এই অন্ধকারে এরা কি সবাই বাসায় আছে? এদের তো বাসা থাকে না, তাহলে এই জঙ্গলে এত কাদার মধ্যে কোথায় বসে রেস্ট করে…”
“যাঃ শালা, আফু বাঘ-শুয়োর নিয়ে এত ভাবছিস আর আমাকে ছুঁয়ে বল তো সারাটা দিন কেটে গেল, নিজের পার্টনারকে একটাও চুমু খেয়েছিস? তোর চোখের সামনে দেখ কেবিন দেখার নাম করে সবাই কেমন লাভ মেকিং-এ চলে গেল আর তুই এখানে বসে বসে বনবেড়াল কাদার মধ্যে বসবে কোথায়, কোথায় রেস্ট করবে ভেবে মাথা খারাপ করছিস। আরে ওরা শুধু বসছে, রেস্ট করছে তা নয়। রোম্যান্স, লাভমেকিং সবই করছে বনবিড়ালিদের সঙ্গে। না হলে বংশবৃদ্ধি আর হচ্ছে কী করে?”
“বনবিড়ালির সঙ্গে রোম্যান্স, কী যে বলেন স্যার,” অনুশ্রী হেসে ফেলে।
“আরে সব জীবই তো তার মতো করে রোম্যান্স করে।
“তুই-ই বা এখানে বসে আছিস কেন? তুই যা না তোর গার্লফ্রেন্ডের কাছে।”
“আরে শর্মিষ্ঠা আমার দেড় বছরের পুরনো গার্লফ্রেন্ড। ওর সঙ্গে তো সবসময় রোম্যান্স করছি। রাতেও করব। কিন্তু তোরা তো ফ্রেশার, তোরা কেন…”
“মৈনাকদা,” নিঃশব্দে অনুপমা এসে দাঁড়িয়েছে মৈনাকের পিছনে। মৈনাক পিছন ফিরতেই জিজ্ঞাসা করে, “ড্রিঙ্কসের সঙ্গে কী স্ন্যাকস দেব?”
“সামান্য পটাটো চিপস আর পিনাট রাখতে পার। কেউ খাবে বলে মনে হয় না,” একটু থেমে বলে, “আচ্ছা হুইস্কি অন দ্য রক হবে না?”
“হ্যাঁ স্যার, ওটাও হবে। আমরা রিসর্টের কাছে পৌঁছেই ঘাট থেকে আইস তুলে নেব, ওখানে ফোনে বলে দিয়েছি, ওরা রেডি রাখবে,” অনুপমা বলে।
“সো নাইস অফ ইউ। আচ্ছা অনুপমা, তুমি রোম্যান্স করো না?”
“হ্যাঁ স্যার করব, সারেঙকে বলেছি, সুন্দরবন থেকে আমাকে কাল একটা পাইথন জোগাড় করে দেবে, বেশ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রোম্যান্স করব স্যার, হেব্বি মজা হবে, গ্রেট ফান স্যার।”
“কেন? আমরা কি সবাই ব্রাত্য?”
“না স্যার, আপনি হলেন সেই মোটা বুড়ো… কী যেন, যার অনেকগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে! আপাতত শর্মিষ্ঠা ম্যাডাম আপনার বিরহে না হানিপ্রীত হয়ে যান,” অনুপমা হাসতে হাসতে চলে যায় সিঁড়ির দিকে, “ব্যবস্থাগুলো দেখি স্যার…”
মৈনাক ফেরে শর্মিষ্ঠার দিকে, হাঁক দেয়, “আরে এদিকে এসো, আমার বন্ধু আফু বিরহ ব্যথায় কাতর, ওর ব্যথার জায়গায় একটু ভলিনি স্প্রে করতে হবে। একটু জ্ঞান-ট্যান দিয়ে যদি একটু ভদকা খাওয়ানো যায় তবে আপাতত বছরখানেক ধরে গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে যাওয়ার যে মাতম মানাচ্ছে তাকে একটু পরকীয়ার রসে চোবানো যাবে!”
শর্মিষ্ঠা উঠে আসে ওদের কাছে। চারজনে মিলে বেশ আড্ডা জমে যায় মুহূর্তে। “এই মেয়েটিকে আমি প্রেমের দেবী মানি, আমার মতো অসহ্য পুরুষের সঙ্গে দেড় বছর কাটিয়ে ফেলল, ভাবা যায়,” মৈনাক স্বগতোক্তি করে। “এই যে দেখছ আমার বন্ধু আফু, ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কোনও মেয়ের দিকে তাকাত না, ভাবত নারী নরকের দ্বার। আরও বড় হয়ে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ল, লিভ ইন রিলেশনে থাকল চার বছর। তারপর বলা নেই কওয়া নেই সেই মেয়েটি দুম করে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তারপর থেকে ও আক্ষরিক অর্থেই মজনু বনে গিয়েছে। ওকে প্রায় জোর করে ধরে এনেছি, সঙ্গে একজন পার্টনারও এনেছে, কিন্তু ওর স্তব্ধ থেমে থাকা জীবন থেকে ও নড়তে-চড়তে পারছে না।”
শর্মিষ্ঠা তাকায় আফরোজ়ের দিকে, আফরোজ়ের ঠোঁটে হাসি, বলে, “মৈনাক আমাকে খুব ভালবাসে বলে এতগুলো কথা বলল, কিন্তু আমি মজনু-ফজনু হইনি, দিব্যি আছি আসলে যে-মেয়েটি আমাকে ছেড়ে গিয়েছে, তাকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম আর চেয়েছিলাম আমাদের সন্তান হোক। ওকে শুধু আমি ভালবাসি তাই নয়, ও ছিল আত্মার তৃপ্তি, চোখ মেলে দেখলে মনে হত আমাকে ছুঁয়ে আছে আর ছুঁলে মনে হত আমার হৃদয়ে হাজারটা মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছে। ওকে শুধু ভালবাসি বললে ভুল হবে, ও ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান, আমার এবাদত।”
“এমন পুরুষ পেলে সব মহিলাই বিয়ে করতে চাইবে, আপনাকে ছেড়ে কেন গেল তাই ভাবছি, ওর অন্য কোনও কম্পালশন ছিল না তো?” শর্মিষ্ঠা জানতে চায়।
“কম্পালশন থাকলে ওটাও আমাকেই বলতে পারত, দু’জনে মিলেই সলভ করতাম, আমি তো শুধু নিজের একার জন্য ভাবতাম না। যাক গে, যে গিয়েছে সে গিয়েছেই, তার জন্য এই সন্ধ্যাটা স্পয়েল করার কোনও মানেই হয় না। অনুপমা বোধহয় মিউজ়িক সিস্টেম, মাইক্রোফোন ইত্যাদি এনেছে, আর একজন দেখলাম গিটার এনেছে, নদীর বুকের উপর এই সন্ধ্যাটা আমরা আনন্দ করে কাটাতে পারি,” আফরোজ় আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়।
“আপনারা চেঞ্জ করে কিছু ক্যাজ়ুয়াল পরে নিন, আমরাও তাই করছি,” শর্মিষ্ঠা উঠে দাঁড়ায়, মৈনাকের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যায়।
“উপরের একটা কেবিন বোধহয় খালি আছে, তুমি কেবিনে যাও, আমি ডাইনিং স্পেস থেকে তোমার আর আমার লাগেজ দুটো নিয়ে আসি,” আফরোজ় অনুশ্রীকে উপরের কেবিন দেখিয়ে দেয়।
“ওকে,” অনুশ্রী উঠে চলে যায় কেবিনে, দরজায় ঢোকার আগে আড়চোখে দেখে নেয় নিধির দিকে। নিধি আর ওর পার্টনার পাশাপাশি বসে নিচু স্বরে গল্প করছে।
আফরোজ় দুটো সুটকেস হাতে নিয়ে উপরে আসে, ঢুকে যায় কেবিনের ভিতরে। ট্র্যাকপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরে বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে, ডেকের উপর একপাক ঘুরে আবার ঢুকে যায় কেবিনের ভিতরে, “ওয়াও, তোমাকে তো দারুণ লাগছে অনুশ্রী, তুমি স্কার্ট আর টপ পরো তা তো জানতাম না, বাইরে সব মেয়েকে দেখলাম শর্টস পরেছে আর ছেলেরা বারমুডা।”
“যাঃ, মৈনাকের গার্লফ্রেন্ড, কী যেন নাম, ও হ্যাঁ শর্মিষ্ঠাও শর্টস পরেছে?”
“না নাহ, ওরা এখনও উপরে ওঠেনি, অনুপমাকে দেখলাম লঞ্চের লোকেদের নিয়ে ডেকে পিছনের দিকে আলোর চেন লাগাচ্ছে আর বড় বড় দুটো বক্স লাগিয়েছে।”
“অল আর রিকোয়েস্টেড টু কাম অন দ্য ডেক, প্লিজ় অল অফ ইউ আর রিকোয়েস্টেড…” গম-গম করছে বক্সের আওয়াজ। আফরোজ় আর অনুশ্রী বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে, সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। অনুপমা নেই, শর্মিষ্ঠা একটা প্যারালাল স্লিকের প্যান্ট আর তার সঙ্গে লাল বুটিকের কুর্তি পরেছে, এলইডি আলোর চকমকানিতে অপূর্ব সুন্দর সাইকেডেলিক পরিবেশে সুন্দরীরা আরও মোহময়ী, ওদের শরীরী ভাষায় আমূল পরিবর্তন।
শর্মিষ্ঠা মাইক্রোফোন হাতে অ্যানাউন্সমেন্ট বন্ধ করে এগিয়ে যায় তনুশ্রীর কাছে, মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দেয় ওর হাতে, “এখন আমার এই বান্ধবীই অ্যাঙ্করিংয়ের কাজ করবে, তবে সবাইকে গান গাইতে আর ডান্সও করতে হবে, যে যেমন পারে, কোনও চাপ নেই।”
“আমরা ঘাটের কাছে কিছু করব না, জাস্ট এ মিনিট, লেট মি কালেক্ট সাম আইস, দেন উই উইল গো অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য ব্যাংক সো দ্যাট আদার্স আর নট ডিসটার্বড,” অনুপমা মাইক্রোফোন ফেরত দেয় তনুশ্রীকে, “ক্যারি অন প্লিজ়।”
“হ্যালো ফ্রেন্ডস, লেট মি স্টার্ট উইথ আ স্মল সং, এভরিবডি মাস্ট সিং অ্যান্ড ডান্স, দিস নাইন্থ নভেম্বর উইল নেভার কাম ব্যাক ইন আওয়ার লাইফ, সো; ‘না কুছ পুছা না কুছ মাঙ্গা/ তুনে দিল সে দিয়া যো দিয়া/ না কুছ বোলা কুছ তোলা/ মুসকুরাকে দিয়া যো দিয়া/ তুহি ধূপ তুহি ছায়া, তুহি আপনা পরায়া/ অউর কুছ না জানু, বস ইতনাহি জানু/ তুঝমে রব দিখতা হ্যায় ইয়ারা ম্যায় ক্যায় করুঁ…’” হাততালির ঝড় বয়ে যায়।
মৈনাক এগিয়ে যায় ওপি স্যারের দিকে, “স্যার নাউ ইটস ইয়োর টার্ন।”
সবাইকে অবাক করে ওপি স্যার গায়, “তেরা খিলোনা টুটা বালক, তেরা খিলোনা টুটা/ হ্যায় কিসমত নে লুটা তুঝকো, হ্যায় কিসমত নে লুটা…”
“হুররে, প্রত্যেকে গাইব আমরা অ্যান্ড নো মোর দুখ ভরি গান,” মৈনাক হাততালি দিয়ে চিৎকার করে গায়, “কজরা রে, কজরা রে, তেরে কালে কালে নয়না…।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন