রামধনু – ১০

হুমায়ুন কবীর

তনুশ্রী আজ কিছুতেই ছাড়তে চায় না ডাক্তার অরূপ ব্যানার্জিকে। বারবার বলে, “আমি একেবারে একা হয়ে যাব রাতে। কাল ছ’টায় উঠে চলে যেয়ো যাদবপুরে, তারপর জিনিসপত্র গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে চলে এসো সকাল আটটায় সায়েন্স সিটির উলটো দিকে প্রগতি ময়দান থানার সামনে। ওখান থেকে বাস ছাড়তে-ছাড়তে সেই সাড়ে আটটা, কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। একটু তাড়াতাড়ি সব কিছু করতে হবে এই যা।”

অরূপ জানে রাতে তনুশ্রীর ফ্ল্যাটে থেকে যাওয়ার পক্ষে কোনও যুক্তি নেই, শুধু আবেগের কথা অবশ্য আলাদা। তনুশ্রী বলে, “মা যশকে নিয়ে মাসির বাড়ি আজ যেতেই চাইছিল না। বলছিল কাল সকালে যাবে লেকটাউনে। আমি নানান ঠুনকো অজুহাতে প্রায় জোর করে ওদের পাঠালাম শুধু তুমি আসবে বলে।” তনুশ্রী যদি যুক্তি দিয়ে বুঝত, তাহলে নিজেই বলত অরূপ নিজের বাড়িতে ফিরে যাক আর সকালবেলায় একটু সময় নিয়ে সব গুছিয়ে বাস ধরুক।

অরূপ ঋণগ্রস্ত মুদির মতো আস্তে-আস্তে মাথা দোলায় আর বলে, “সবে তো বিকেল, আহা আমি তো আছিই এখন। সে রাতের কথা রাতে ভাবা যাবে, তা ছাড়া রাতে তুমি একা থাকবে কেন? লাবণিতে বহু পেঁচা রয়েছে, রয়েছে ভাম। তারা সবাই রাতের লাবণির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায় আর লক্ষ রাখে সবাই ঘুমোল কিনা!”

অরূপ মজা করে এসব বললেও একটু হলেও টেনশনে আছেই। সুন্দরবনে সবসময় মোবাইলের সিগন্যাল পাওয়া যাবে কি না… অর্চনাকে কী বলবে, কোথায় যাচ্ছে? প্রায় প্রতিদিনই রুটিন করে রাত দশটা নাগাদ ফোন করে অর্চনা। তা ছাড়া মাঝে-মাঝে দুপুরবেলাতেও ফোন করে, যদি ফোনে না পায়! বিভিন্ন চেম্বারের ছেলেমেয়েদের এমনকি ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের ল্যান্ডলাইন নম্বরও আছে ওর কাছে। অরূপই সব জায়গার নম্বর ওর মোবাইলে লোড করে দিয়েছে লন্ডন যাওয়ার আগে। এখন মনে হচ্ছে এত নম্বর না দিলেই হত অর্চনাকে। তাই ঠিক করে নেয় অর্চনাকে বলবে রাঁচি যাচ্ছে কনফারেন্সে, আর কনফারেন্সের পর প্রতিদিন সাইটসিয়িং আছে বিভিন্ন জায়গায়। তাই দিনের বেলায় ফোন করার দরকার নেই, রাতে সময়মতো সে-ই ফোন করে নেবে।

অরূপের মনে পড়ে একবার গোয়া গিয়েছিল দু’দিনের কনফারেন্সে। অর্চনা ফোন করল প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ। সেক্স করার পর তনুশ্রী ওকে তখনও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, ওই অবস্থায় ফোন ধরল। টেনশনে ওর গলা কেঁপে গেল যখন অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, “আর একজনের নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি যেন! তুমি কোথায় আছ?”

“আরে এই তো বিছানায়,” একটু তোতলাতে লাগে অরূপ, “কেন? আসলে বাঘা বিচের উপর রিসর্টে আছি, তাই হয়তো আরব সমুদ্রের নিশ্বাস তুমি শুনতে পাচ্ছ,” ঠাট্টা করে তনুশ্রীর নিশ্বাসের শব্দ ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিল। অর্চনা সেদিন ওকে সন্দেহ করেছিল, তাই আধঘণ্টা পরে সামান্য অছিলায় আবার ফোন করেছিল। এবার ফোন ধরার আগে তনুশ্রীর হাত ছাড়িয়ে জানলার কাছে গিয়ে জানলা খুলে অর্চনার ফোন রিসিভ করল, যাতে সমুদ্রের গর্জনের আওয়াজ সামান্য হলেও অর্চনার কানে যায়। টুকটাক কথা বলার পর অর্চনা বলেছিল, “গোয়ায় বিদেশি মেয়েরা ইজ়িলি অ্যাভেলেবল। তুমি যেন আবার গলে যেয়ো না।”

সন্দেহ করার কারণও ছিল, অর্চনা সেবার চেয়েছিল ওর সঙ্গে গোয়া যাবে। “হাজার হোক দেশের মধ্যে এখানেই আমরা হনিমুনে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া তুমি জানো সমুদ্র আমার কত ভাল লাগে!”

“আমি সকাল ন’টা থেকে ছ’টা পর্যন্ত কনফারেন্সে থাকব, তারপর টায়ার্ড হয়ে রিসর্টের কামরায় বসে স্কচ খাব, তুমি গিয়ে কী করবে? আমি কম্পানি দিতে পারব না আদৌ, তুমি একা-একা বোর হবে। তা ছাড়া সেপ্টেম্বরে গোয়ার ওয়েদারও ভাল নয়, খুব গরম। একটু লম্বা টুর হবে যখন, তোমাকে নিয়ে যাব।”

অর্চনা এখন লন্ডনে, প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই। একমাত্র সন্তান অপরূপার এইট্‌থ স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা বলে কথা। তাই দাদার পিকাডিলি সার্কাসের বাড়িতে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। অপরূপাকে পড়ায় গাইড করছে ইংলিশে অনার্স অর্চনা। তাই এবার ট্রিপে রিস্ক কম। লন্ডনটা যেন বড্ড দূরে, তনুশ্রী এবার নিশ্বাস ছাড়লে বলতে হবে “তোমার বিরহে মোবাইলের শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মেডিটেরানিয়ান বা অ্যাটলান্টিকের দীর্ঘশ্বাস।”

সারাদিনই পিকাডিলি সার্কাসে কিছু না কিছু ঘটছেই, মানুষের স্রোতের চলমান রঙ্গমঞ্চ। অর্চনা একটু ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়ে দোকানে-দোকানে ঘুরে বেড়াতে। তবে ফাইনালি কিছু কিনতে হলেই অরূপকে একবার ফোন করে নেয় দিন-দুপুরেও। ওই ফোনগুলো ম্যানেজ করা তেমন কঠিন নয়। নিঃসন্তান ডাক্তার দম্পতি ওর দাদা-বউদি কেউ একজন বা অপরূপা থাকে ওর সঙ্গে, তাই তখন দিন দুপুরে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ কম।

ওফ্‌! এটা মনে হতেই আনন্দের এক শিহরন খেলে যায় অরূপের শরীরে, “চলো, তোমার জন্য কিছু ট্রেন্ডি ড্রেসেস, হটপ্যান্টস, স্লিপিং সুট, লঁজারি কিনে আনি।”

“আমার সব আছে, এখন বাজার যেতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। তুমি বরং আমার উপর একটু নজর দাও,” শরীর থেকে গাউন খুলে ফেলে শুধু অন্তর্বাস পরা তনুশ্রী সোফায় বসা অরূপকে জড়িয়ে ধরে, অরূপের মুখ-ঠোঁট চেপে বসছে তনুশ্রীর নাভির উপর। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে নেয় তনুশ্রীকে। অরূপের নিজেকে এখন শাজাহান মনে হয়।

প্রাথমিক আবেগ ঝরে যেতেই অরূপ বলে, “আমি চাই তুমি সুন্দরবনের ট্রিপে গিয়ে সবসময় হটপ্যান্টস পরবে, তোমার পা দুটো সত্যিই ভীষণ সুন্দর। আমি চাই সবাই দেখুক আর দোয়েল পাখির মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলুক।”

“যাঃ! আমার বান্ধবী শর্মিষ্ঠা এই ট্রিপটায় যাবে। ওকে দেখো, টিপিক্যাল বাঙালি সুন্দরী, একবার তাকালেই চোখ ফেরানো কঠিন। একটা ট্রাভেল এজেন্সি চালায়, ভীষণ স্মার্ট। পড়াশোনাতেও দুর্দান্ত ছিল, চৌখস ধরনের।”

“সে দেখা যাবে। তোমার মতো সুন্দর পা সচরাচর কারও হয় না। এখন ওঠো, কোনও রেস্তরাঁতে খেয়ে ফিরব।”

“এই তুমি কোথায়?” ফোন রিসিভ করতেই আদুরে গলায় প্রশ্ন ধেয়ে আসে অর্চনার।

“আজ এই অসময়ে?” পালটা প্রশ্ন করে অরূপ।

“আমি একটা ইনারগার্মেন্টসের দোকানে ঢুকেছি, কী ছোট-ছোট আর কিউট সব পোশাক, বুঝলে? তুমি দেখলে পাগল হয়ে যেতে, বুঝলে কিছু?”

“আরে আমিও তো,” বলতে গিয়েও সামলে নেয় অরূপ। মুখে বলে, “পাগল হয়ে কাজ নেই, দেখেশুনে কেনো, বিদেশি মেয়েদের শেপ-সাইজ় আলাদা। আমাদের এখানকার পূর্ণিমাপিসির মতো চেহারার মানুষদের ম্যাচ করবে না!”

“কী অসভ্য গো তুমি! সামান্য একটু মোটা হয়েছি বলে তুমি এখন খোঁটা দিচ্ছ? দাঁড়াও, একবার যখন জিমটিম করে রোগা হয়ে এসব পরে দাঁড়াব, তখন দেখব!”

“আগে রোগা হয়ে পরে মাপমতো এসব কিনলে হত না? অপু কী করছে?”

“যাঃ, তুমি অসভ্যতা করছ,” রাগে ফোন কেটে দেয় অর্চনা।

“কে, ম্যাডাম?” তনুশ্রী জিজ্ঞাসা করে, “কী বলছেন?”

“ও কিছু না, পিকাডিলি সার্কাসে একটা শপে ঢুকেছে লঁজারি কিনবে, তাই আমাকে ফোন করছে।”

তনুশ্রী আর নিজের জন্য কিছু শপিং করে রেস্তরাঁয় ডিনার সেরে লাবণির ফ্ল্যাটে পৌঁছয় তনুশ্রী আর অরূপ। তনুশ্রীর মন এখন অনেক হালকা। গুরমিতের কথা মনে পড়ে যায়। খুব হুল্লোড় করতে ভালবাসত, আউটডোরে শুটিং-এর পর ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত মুম্বই কিংবা পুণের শপিং কমপ্লেক্স-এ। অরূপও খুব কেয়ারিং। এর আগেও দিল্লির কনট প্লেসে তনুশ্রীকে নিয়ে শপিং করতে গিয়েছে অরূপ। তখন তনুশ্রীকে অনেক দ্বিধা পেয়ে বসেছিল। আসলে অরূপের সঙ্গে সম্পর্কটা তখনও তেমন দানা বাঁধেনি। এখন অনেকটা কাছের মনে হয় অরূপকে।

শর্মিষ্ঠা ফোন করে তনুশ্রীকে, হ্যাঁ, রিং হচ্ছে।

“হ্যালো, কী রে, সব ঠিক আছে তো কালকের প্রোগ্রামের?”

“হ্যাঁ, পারফেক্টলি অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। আমারই অফিসে অনুপমা বলে একটি মেয়ে কাজ করে, ও-ই সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করল। এভরিথিং ইজ় রেডি। উই আর অল সেট টু সেল, আটটা-সওয়া আটটার মধ্যে পৌঁছে যাস তোর পার্টনারকে নিয়ে, সাড়ে আটটায় বাস ছেড়ে যাবে কিন্তু!”

“ইয়েস, আসছি আমরা। শেষপর্যন্ত ক’টা কাপ্‌ল যাচ্ছে?” তনুশ্রী জানতে চায়।

“এখনও পর্যন্ত আমাদের ধরে ছ’টা কাপল আর আমার অফিসের অনুপমা। ও যাচ্ছে সবার দেখভাল করবে। লাস্ট মোমেন্টে কেউ সটকে গেলে অবশ্য আলাদা। হোপফুলি সবাই যাচ্ছে। আর হ্যাঁ, একটা কথা, তোরা চাইলে নাম চেঞ্জ করে নিতে পারিস। সবাই ফার্স্ট নামে প্রত্যেকে প্রত্যেককে অ্যাড্রেস করবে আর কারও টাইটেল আর প্রফেশন কেউ জানতে চাইবে না, যদি কেউ নিজে ভল্যান্টারিলি বলে সেটা আলাদা! আর কোনও কোয়্যারি থাকলে বল, না হলে আজকের মতো ছাড়ছি,” শর্মিষ্ঠা ফোন ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

“নো, নাথিং, ওকে গুড নাইট। সি ইউ টুমরো,” ফোন কেটে দেয় তনুশ্রী। সোফায় বসা অরূপকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, “তুমি ফ্রেশ হয়ে বেডরুমে এসো। খানিকক্ষণ থেকে চলে যেয়ো। আগামীকাল আমি ক্যাব নিয়ে চলে যাব সায়েন্স সিটি মোড়ে, তোমাকে কষ্ট করে পিকআপ করতে হবে না। বাট প্লিজ় মেক ইট বাই এইট ফিফটিন পজ়িটিভলি।”

“ওকে বেডরুমে আসছি। বাট তোমার লাগেজ প্যাকআপ করে নাও,” অরূপ সোফা থেকে উঠে টয়লেটে ঢোকে। তনুশ্রী ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অরূপ টয়লেট থেকে ফিরে আসে, বিছানায় উঠে বসে ওকে লক্ষ করে, খুশিতে তনুশ্রীর মুখে অদ্ভুত অভিব্যক্তিগুলো মন দিয়ে পড়ে অরূপ।

অরূপ ওকে দেখছে মনে হতেই ব্যাগ গোছানো বন্ধ রেখে তনুশ্রী বিছানার কাছে এসে অরূপের গলা জড়িয়ে ধরে। অরূপ ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে টেনে তুলে আনে বিছানায়। তনুশ্রী আজ অনেক স্বতঃস্ফূর্ত, অনেক অ্যাকটিভ। বিছানায় ছাপিয়ে যায় অরূপকে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসে অরূপ।

শর্মিষ্ঠা স্নান সেরে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায় নাইটি পরে। তারিফ করার দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে মৈনাক। “অ্যাই, আমাকে আজ নতুন করে দেখছ নাকি?” আদুরে গলায় শর্মিষ্ঠা জিজ্ঞাসা করে।

“মেয়ে মানেই রহস্য, ডিটেক্টিভ উপন্যাসের মতো। পরতে-পরতে রোমাঞ্চ,” মৈনাক হাত বাড়িয়ে ধরতে যায় শর্মিষ্ঠাকে। চকিতে শর্মিষ্ঠা সরে যায়।

“আগে সবাইকে ফোন করে কনফার্ম করে নাও আর বলো ঠিক সওয়া আটটায় যেন সায়েন্স সিটি মোড়ে পৌঁছে যায়। আমার বান্ধবী তনুশ্রী আমাকে ফোন করেছিল, ও কনফার্ম করেছে।”

“ইয়েস, সকলেই মোটামুটি কনফার্ম করেছে, তবুও একবার আফরোজ়কে ফোন করে নিই। ও একটু চাপা স্বভাবের। একটা লিভ-ইন রিলেশনশিপে ছিল প্রায় বছর চারেক, মেয়েটি কোনও অজ্ঞাত কারণে ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে বছরখানেক হল। তারপর থেকেই খুব মুষড়ে পড়েছে। দেখি ওর কী অবস্থা।”

মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিয়ে ডায়াল করে আফরোজ়কে, “হ্যালো আফু, সব ঠিক আছে তো রে তোর?” আন্তরিকভাবে জিজ্ঞাসা করে মৈনাক।

“হ্যাঁ, ঠিক আছে সব। ঠিক সওয়া আটটায় পৌঁছে যাব সায়েন্স সিটি মোড়ে,” আফরোজ় আশ্বস্ত করে মৈনাককে।

“রাতেই সব গুছিয়ে নে, বাই,” ফোন কেটে দেয় মৈনাক।

সব ঠিক আছে! মানিয়ে নেওয়ার নামই অভিযোজন। মানুষের মন বাঁচে না আলাদা করে, আফরোজ় জানে মন আর আবেগ হল সফটওয়্যার। শরীরে এদের বাস, আলাদা করে এদের অস্তিত্ব নেই। শরীর বেঁচে থাকলেই এরাও বাঁচে। অন্য শরীরের প্রতি ওয়েভলেংথ ম্যাচ করলে নানা অনুভূতি তৈরি হয়, প্রেম, ভালবাসা আর স্নেহ। ঘৃণা আর রিপালশন মিসম্যাচের ফল। নিধির সঙ্গে ওর ওয়েভলেংথ ম্যাচ করেছিল বলেই ওর প্রতি তৈরি হয়েছিল আকর্ষণ আর এই আকর্ষণই ক্রমশ জন্ম দিল ভালবাসার। ওর তরফ থেকে ভালবাসা থাকলেও নিশ্চয়ই নিধির তরফ থেকে হয়তো ছিলই শুধু মানিয়ে নেওয়া, টিকে থাকার মূলমন্ত্র অভিযোজন। মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থা। তাই কারণ ছাড়াই বেরিয়ে গেল ওর জীবন থেকে কোনও আবেগ না দেখিয়েই। এই মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থাই টিকিয়ে রেখেছে সমাজ আর জোড়াতালি দেওয়া বহু দাম্পত্য। ফোন রেখে অনুশ্রীর দিকে পাশ ফিরতেই দু’হাত দিয়ে অনুশ্রী জড়িয়ে ধরে আফরোজ়কে। আফরোজ় ভাবে এই জড়িয়ে ধরার মধ্যে কি কোনও ভালবাসা আছে? ভাল লাগা আছে নিশ্চয়ই, সঙ্গে নির্ভরতাও থাকতে পারে!

আফরোজ়ের মনে পড়ে অনুশ্রীর ডিভোর্সের দিনগুলোর টানাপোড়েন, অনুশ্রীই ওকে সব বলেছে। বিয়ে হওয়ার প্রথম দিন থেকেই শুরু। ওর শ্বশুরের লোভ আর লালসা! বরপণ লাগবে না দিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছিল ওর শ্বশুরমশাই… ‘তবে যদি সংসারে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু আপনার মেয়ের সুবিধের জন্য দিতে চান, দিতে পারেন।’ মোটরবাইক, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন আর প্রায় দশ ভরি গয়না দিয়েছিল অনুশ্রীর বাবা।

ফুলশয্যার পরের দিনই ওর শ্বশুরমশাই শুনিয়ে দিলেন, “বুঝলে বউমা, তোমার বাবা ক’টা জিনিস দিলেন ঠিকই তবে যদি ওগুলো একটু ভাল কোম্পানির দিতেন তাহলে চলত অনেকদিন। এগুলো তো বাজার চলতি জিনিস, আয়ু মাস তিন-চার, বড়জোর মাস ছয়েক। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যাবে মিস্ত্রিদের আনাগোনা আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়ির আবজর্না।”

অনুশ্রী মিনমিন করে বলেছিল, “এগুলো তো ভাল কোম্পানিরই বাবা, যথেষ্ট রেপুটেশন আছে মার্কেটে। তা ছাড়া পাঁচ-সাত বছর করে ওয়ারেন্টি আছে সবগুলোতেই!”

“আর ওয়ারেন্টি! কতবার বাইরের মিস্ত্রি ঘরে ডাকবে, তিতিবিরক্ত হয়ে যাবে।”

“সে দেখা যাবে বাবা, আগে তো খারাপ হোক,” অনুশ্রী জল ঢেলে দিয়েছিল ওই বিতর্কে। ড্রইংরুম থেকে বেরিয়ে দোতলায় বেডরুমে চলে গিয়েছিল। বাথরুমের বালতিতে নাইটি আর আন্ডারগার্মেন্ট ভেজানো আছে, ওটা কেচে বাথরুমে বা বেডরুমেই শুকোতে দিতে হবে! সৌমিত্র গতকাল ফুলশয্যায় ওগুলো নোংরা করে দিয়েছে দু’বার! তনুশ্রীর জঙ্ঘা, তলপেট, পেট আর বুকও নোংরা করে দিয়েছিল। বাথরুমে ঢুকে ঠান্ডা জলে প্রায় হাফ স্নান করেছিল অনুশ্রী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তাই মেজাজটা একটু বিগড়েই ছিল অনুশ্রীর। যাক গে, প্রথমদিন উত্তেজনায় এরকম হয়তো হয়ে থাকবে। মেজাজ খারাপ থাকলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। এমনিতে বেশ সুস্থ এবং সবল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এই সৌমিত্র। দিন সাতেক এরকমই চলার পর অনুশ্রী ঘাবড়ে গেল, সৌমিত্রকে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। ওষুধ কম, অনেক পরামর্শ দিল ডাক্তার। অনুশ্রী খুব যত্ন করে ওষুধ খাওয়াল সৌমিত্রকে আর অক্ষরে-অক্ষরে ডাক্তারের পরামর্শ মানতে সাহায্য করতে লাগল। কিন্তু কোথায় কী? মাসখানেক বাদেও অনুশ্রী ভার্জিন থেকে গেল! না ভার্জিন ঠিক নয়, হাজ়ব্যান্ডের কাছ থেকে বৈধ সঙ্গমে বঞ্চিতই থেকে গেল। অন্যদিকে শুরু হল আর এক উৎপাত। কারণ-অকারণে শ্বশুরমশাই ডেকে পাঠাতে লাগলেন ওর কামরায়, গাল টিপে নয়তো জড়িয়ে ধরে আদর, ‘‘বেশি করে খাও না কেন? বড্ড রোগা যেন তুমি, গায়ে তো শুধু ক’খানা হাড়, ভাল করে খাবে সবসময়!’’ প্রথম-প্রথম অনুশ্রীর মনে হত, শ্বশুরমশাই তো বাবার মতোই। কিন্তু কয়েকদিন পর থেকে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকতে লাগল। শাশুড়ি না থাকলেই এরকম করে জড়িয়ে ধরে বুড়ো, তা ছাড়া হাতের স্পর্শেও যেন অন্য কিছুর ইঙ্গিত, হাত দুটোও যেন কাঁধ থেকে ক্রমশ নীচের দিকে নামছে! এদিকে যৌনতায় ব্যর্থ সৌমিত্র কারণে-অকারণে কথা শোনাতে লাগল সকাল-সন্ধ্যা, সবকিছুর মধ্যেই খুঁত ধরতে যেন উদগ্রীব হয়ে থাকত!

মাসতিনেক এভাবেই কেটে গেল অনুশ্রীর। শ্বশুরমশাই চারবার ডাকলে একবার যেত অনুশ্রী। তা-ও দরজার বাইরে থেকে সাড়া দিত, “বাবা আমাকে ডাকছেন?” সৌমিত্রকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে গেল অনুশ্রী। আরও কিছু পরামর্শ আর ওষুধ দিল ডাক্তার, নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে নিজেকেই। দেখতে-দেখতে আরও মাস দুই কেটে গেল অনুশ্রীর দাম্পত্যের, সৌমিত্রর শরীর আর মন কোনওটাই নিয়ন্ত্রণে এল না, কিন্তু কিছু যৌন বিকৃতি এল সৌমিত্রর মধ্যে আর তা থেকেই অনুশ্রীর উপর শারীরিক অত্যাচার। এর মধ্যেই অনুশ্রী হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল একটা চাকরি, এটা পেলেই স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে অনেকটা। সাদামাঠা চেহারার পাস কোর্সে কমার্স গ্র্যাজুয়েট অনুশ্রী খবর কাগজে বিজ্ঞাপন দেখা শুরু করল নিয়ম করে, ইন্টারভিউও দিল কয়েকটা প্রাইভেট কোম্পানিতে। হয় মাইনে অনেক কম নয়তো অন্য ইশারা। একবার ভেবেছিল বাবার বাড়ি ভবানীপুরেই চলে যাবে চোখ-কান বন্ধ করে। রেলওয়ের ক্লার্ক বাবা অফিস থেকে লোন আর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা তুলে অনুশ্রীর বিয়ে দিয়েছিল। আরও দুটো বোন আছে সংসারে, তাই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে মনকে চাবুক কষিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখতে লাগল অনুশ্রী।

এরকম বিজ্ঞাপন দেখতে-দেখতেই ‘ড্রিমলাইনার’-এর অ্যাডটা চোখে পড়ল অনুশ্রীর। আফরোজ় আর অঞ্জনদা ইন্টারভিউ নিল।

“স্যার, সকাল ন’টা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত আমি পরিশ্রম করতে পারব।”

“ঠিক আছে, তিন মাস দেখব আমরা, তারপর এক্সটেনশনের কথা ভাবা হবে, সেটাও একবছরের জন্য। পরের এক্সটেনশন কাজ দেখে।”

তা-ও প্রায় বছরসাতেক আগের কথা, আফরোজ়ের ড্রিমলাইনারের বয়স তখন বছরখানেক। পরিশ্রমী আর বিশ্বস্ত অনুশ্রী। আফরোজ় অনেক করেওছে ওর জন্য, আর্থিক সাহায্য তো বটেই, মানসিক সাপোর্টটাও নেহাত ফেলনা নয়। কেস, পালটা কেস, কোর্ট-কাছারি ইত্যাদির টানাপোড়েন তা-ও প্রায় বছর দুয়েক ধরে। আফরোজ় কোনওদিনই হাত বাড়ায়নি অনুশ্রীর দিকে। যদিও ওই টানাপোড়েনের সময় অনেক সুযোগ দিয়েছে অনুশ্রী, অথচ আফরোজ় কোনও উৎসাহ দেখায়নি। তারপর অফিসে এসে গেল নিধি। আফরোজ় হুসেনের হুঁশ উড়িয়ে নিয়ে গেল অল্পদিনের মধ্যেই, ধূমকেতুর মতো উদয় হয়ে আলেয়ার মতো মিলিয়ে গেল নিধি। ভাঙা-চোরা মন নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আফরোজ়ের কাছে এগিয়ে এল অনুশ্রী। “কোনও প্রত্যাশা নয়, কোনও প্রতিশ্রুতি নয়, আমাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারেন। কোনও জটিলতা নেই, কোনও ডিমান্ডও নেই। আজকের দিনটা শুধু আজই, কাল অন্য কিছু ইচ্ছা করলে, তা করতেই পারেন, আমার কোনও সমস্যা নেই।” ভুবনেশ্বরে অফিসের কাজে গিয়েছিল আফরোজ় আর অনুশ্রী। কোনও ভণিতা ছাড়াই অনুশ্রী ডিনারের পরে চলে এল আফরোজের কামরায়, খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলল কথাগুলো। আফরোজ় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল, “সরি অনুশ্রী আমি তোমাকে বলতে পারব না, আই লভ ইউ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে আমি তোমাকে ব্যবহার করছি।”

“সরি স্যার, আপনি একা নয়, আমিও আপনাকে ব্যবহার করছি। বায়োলজিক্যাল কারণে আমরা পরস্পরকে ব্যবহার করছি। ইমপোটেন্ট হাজ়ব্যান্ড আর ভীমরতি ধরা শ্বশুরকে ছেড়ে এসেছি আজ প্রায় পাঁচ বছর হল। সংসারের ঘানি টানছি মেশিনের মতো, ব্যক্তিগত স্বাদ-আহ্লাদ, আনন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ভুলে গিয়েছি, কিন্তু শরীরের একটা চাহিদা তো থেকেই গেছে।”

আফরোজ় খাটে টেনে তুলেছিল অনুশ্রীকে। চূড়ান্ত মিলনের আগে জিজ্ঞাসা করল, “একটা কথা বলবে? যদিও এটা জিজ্ঞাসা করার কোনও মানে নেই, কোনও কিছু বিগড়োচ্ছেও না এর জন্য, জাস্ট আউট অফ কিউরিয়োসিটি বলতে পার, তুমি কি আজও ভার্জিন?”

“না স্যার। অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা, কিন্তু বাবার ইচ্ছে ছিল সায়েন্স নিয়ে পড়ি। হায়ার সেকেন্ডারিতে রেজ়াল্ট ভাল না হওয়াতে কোনও সাবজেক্টে অনার্স পেলাম না। বাবাই বলল, বি কম পড় অন্তত, চাকরি করলে বিএ-র চেয়ে বেশি কাজে লাগবে। তো ওই অ্যাকাউন্টেন্সি বুঝতে বাবার এক পিসতুতো ভাইয়ের কাছে যেতাম। ওই কাকাই একদিন জবরদস্তি রেপ করল ফাঁকা বাড়ি পেয়ে। বাড়ি ফাঁকা পেতে অনেক বুদ্ধি খাটিয়েছিল আমার কাকা। তারপর আমারও ওই শারীরিক মিলনটা ভাল লাগতে লাগল, সুযোগ পেলেই আমরা মিলিত হতাম। কাকা ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে চলে গেল রাঁচি, আমারও সেক্সলাইফে ইতি পড়ল। তারপর পাড়ার এক-আধজন প্রেম নিবেদন করেছে, তবে আমার পছন্দ হয়নি তাদের।”

দুটো রাত তাই ভালই কেটেছিল অনুশ্রীর। ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে আসার পর আফরোজ় আর ডাকেনি, তাই অনুশ্রীও আর ওই প্রসঙ্গই তোলেনি। এতগুলো দিন পার করে আবার ডাকল আফরোজ়, আগামীকাল সুন্দরবন যাবে চারদিনের জন্য। সন্ধ্যা থেকে আফরোজ়ের ফ্ল্যাটে এসে ওর ফ্ল্যাট গুছিয়ে যাচ্ছে অনুশ্রী। আফরোজ় অফিস থেকে ফিরল রাত ন’টা নাগাদ, “অঞ্জনদাকে সব পেন্ডিং কাজ বুঝিয়ে আসতে হল, তাই একটু দেরি হয়ে গেল, সরি। তুমি কখন এলে?”

“স্যার, আমি এসেছি সেই সন্ধ্যা ছ’টায়।” অনুশ্রী রিমোটের বাটন টিপে টিভি অফ করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আফরোজ় এগিয়ে এসে অনুশ্রীর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন