রামধনু – ৪

হুমায়ুন কবীর

আজ খুব ভোরে উঠে পড়েছে সুরিন্দর ভাটিয়া। হাতঘড়িতে আলো নেই, তাই মোবাইল বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রেখে ঘুমিয়েছিল সুরিন্দর। এমনিতে মোবাইল ও বিছানার কাছাকাছি রেখে ঘুমোয় না। রেডিয়েশন না ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভ ফিল্ড কী সব হয় যেন। টিভিতে দেখেছে, হোয়াট্সঅ্যাপে অনেকবার পড়েছে। আসলে একটা মেসেজ হোয়াট্সঅ্যাপে কেউ জেনারেট করলে ওটা বেশ কিছুদিন ঘুরতে থাকে শেয়ার হতে-হতে। অনেক ভিত্তিহীন মেসেজও থাকে হোয়াট্‌সঅ্যাপে, সুরিন্দর সেসব বুঝতে পারে। ওর বেডরুমের ভিতরেই আছে ছোট্ট স্টাডি টেবিল, ওখানে বসে ল্যাপটপে অফিসের অনেক কাজ করে নেয় ডিনারের পরে। তবে পাশের কামরাটাই ওর রেসিডেনশিয়াল অফিস কাম লাইব্রেরি। অনেকটা বড় কামরা, দু’পাশের দেওয়াল জুড়ে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত কাচের র‌্যাক, র‌্যাকে তার অজস্র বই, বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি। রাতে খুব জরুরি কোনও ফোন অনিশ্চিত সময়ে আসার থাকলে ও মোবাইল ফোন রাখে বেডরুমের স্টাডি টেবিলে, নাহলে ও ফোন রেখে আসে রেসিডেনশিয়াল অফিসের টেবিলে। এই অফিসের কামরায় ফোন বাজলে খুব আস্তে রিংটোন শোনা যায় বেডরুমে, জেগে থাকলে বা ভোরের দিকে ঘুম পাতলা হলে তবেই শোনা যায়। তাই সুরিন্দরের গাঢ় ঘুমের সময় মোবাইলে কল এলেও ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না। সকালে উঠে মিস্‌ড কল দেখে কল করে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়।

কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। ওকে দুর্গাপুর পৌঁছতে হবে সকাল আটটার মধ্যে ডিএসপি-র জেনারেল ম্যানেজারে বাংলোতে। তাহলেই আধঘণ্টা কথা বলা যাবে ওঁর সঙ্গে। সাড়ে আটটা পর্যন্তই, তার বেশি নয়। আসলে এরপরই দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের জিএম চলে যান জিম করতে, ফিরে এসে স্নান করে সওয়া দশটার মধ্যে অফিস পৌঁছনো চাই-ই চাই মিস্টার ওপি সিন্হার। ওপি সিন্হা রাশভারি লোক। ওর রাশ ভারী হলেও, কুছ পরোয়া ছিল না সুরিন্দরের। কিন্তু ওর রুজি-রোজগারের রাশ এখন এই ওপি-র হাতে। তাই ওর রাশ হালকা করার সুলুকসন্ধান বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছে সুরিন্দর।

মাস ছয়েক আগের কথা, তখন সদ্য-সদ্য ওপি সিন্হা ডিএসপি জিএম হয়ে এসেছেন। উনি অফিসে কোনও ডিল করেন না। তাই গোপনে ওঁর বাংলোয় একদিন পৌঁছে গেল সুরিন্দর, সন্ধের একটু পরেই। সিকিয়োরিটি গার্ড ওরই কোম্পানির, তাই বাংলোয় ঢুকতে অসুবিধে হল না। বড় লাড্ডুর প্যাকেট, কিছু কাজু, ভুজিয়া, ব্ল্যাক লেবেল আর আধা আত্মবিশ্বাস সঙ্গী করে লঘু চালে পা রাখল বাংলোর বারান্দায়। বেল বাজাতেই বেরিয়ে এলেন দশাসই চেহারার বিশাল এক মহিলা। হাবে-ভাবে গৃহকর্ত্রীর মতোই। সিন্হা সাহেব পটনার মানুষ, যদি মিসেস সিন্‌হাও পটনার মহিলা হন, তবে বলতেই হবে পটনাই বউ, বছর পঁয়তাল্লিশের মহিলা নিশ্চিতভাবেই একশো কিলোগ্রামকে কবেই পিছনে ফেলেছেন। শৌখিন সিন্‌হা সাহেবের এরকম একটা বউ বেশ বেমানান। সিন্‌হা সাহেবের বয়স হিসেব অনুযায়ী পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই হওয়ার কথা। কিন্তু জিম, সাঁতার ইত্যাদিতে নিয়মিত অভ্যস্ত, নিজেকে ফিট রেখেছেন খুব, দেখে তাই কিছুতেই পঁয়ত্রিশ-সাঁইত্রিশের বেশি মনেই হয় না! ছিমছাম লোকের এমন একটা বউ? সুরিন্দর সময়মতো টোপ ফেলবেই।

যেমন চেহারার মহিলা, তেমনই তার বাজখাঁই গলার আওয়াজ, “কাকে চাই? অভি শামকো কিঁউ?”

“ম্যাডাম, সাবসে মিলনা থা। থোড়া আরজেন্ট, ইসলিয়ে বাংলোমেহি আ গয়া। ইয়ে থোড়া-বহুত স্ন্যাকস অউর এক ব্ল্যাক লেবেল…” প্যাকেটগুলো এগিয়ে দেয় মহিলার দিকে।

“লেকিন শামকো সাব পূজা করতে হ্যাঁয়, কিসিসে মিলতে নহীঁ, আপ কল সুভহা আট বজে আ যাও, ম্যায় বোলকে রখুঙ্গি,” স্ন্যাকস-এর প্যাকেট নাকি ব্ল্যাক লেবেল-এর কথা শুনে ম্যাডামের গলার এমন আমূল পরিবর্তন, তা ভাল করে ঠাহর না করতে পারলেও সুরিন্দর সন্দেহ করে ব্ল্যাক লেবেলকেই। এই চেহারা আর যা-ই হোক, চাপাটি, পনির আর সরসোঁ কা শাগ খেয়ে হয় না, কুবলো-কুবলো গাল আর ফোলা চোখের পরিমণ্ডল দেখেই সন্দেহটা করে অতএব ব্ল্যাক লেবেলকেই।

ঝুলিয়ে দিল একটা রাত। সুরিন্দরের ইচ্ছে ছিল রাতেই ফিরে যাবে কলকাতা, কিন্তু সিন্হা সাহেবের সঙ্গে দেখা করে মামলা সেটল করেই যেতে হবে। তিনশোর বেশি গার্ড এই ইউনিটেই, পেমেন্টও রেগুলার। শুধু জিএম-কে কনভিন্স করতেই হবে কেন অন্য কোম্পানির চেয়ে ওর ‘ব্রাউন ফক্স’ বেটার। কনভিন্স যে শুধু মুখের কথায় হয় না, তা ভালই জানে সুরিন্দর। অনেকে সরাসরি পারসেন্টেজের হিসেব করে, কেউ বা কাইন্ডস বা অন্য কিছু। সুরিন্দরের কাছে সব ব্যবস্থাই আছে। হতভাগা ভারতবর্ষের এই এক দস্তুর। আগে পশ্চিমবাংলা আর কলকাতাকে নিয়ে গর্ব করত সুরিন্দর, কিন্তু এখন আর করে না। উত্তরপ্রদেশ আর বিহারের রোগ ভালই ছড়িয়েছে সমাজের সব স্তরেই।

অতএব পরদিন ঠিক আটটাতেই হাজির হয় সুরিন্দর। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সুরিন্দরের কোম্পানির খোঁজ নেয় ওপি সিন্হা। জানতে চায়, মেয়ে গার্ডও আছে কিনা।

“নহীঁ স্যার, লড়কিয়াঁ হ্যায় চার-ছে। উয়ো লোগ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অউর অফিস স্টাফ হ্যায়। লেকিন আপ লড়কি গার্ড চাহেঙ্গে তো হো যায়েগা স্যার,” চট করে ভালমানুষের মতো নির্বোধ মুখ করে আশ্বস্ত করে সুরিন্দর। মনে-মনে ভাবে, শালা ঠোকরাচ্ছে, গিলছে না। একটু অপেক্ষা করা ভাল। আর একটু বড় করে ঠোকরালেই টেনে খিঁচ মারবে, বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে লেকে টিকিট কেটে অনেক মাছ ধরেছে এই ক’দিন আগেও।

“অরে ইঁহা ক্যায়া করুঙ্গা, ফ্যামিলিকে সাথ রহতা হুঁ না! কলকত্তা আউঙ্গা, তব…” এই তো ফাতনা ডোবাচ্ছে ওপি সিন্হা।

“জি স্যার, কব কলকত্তা আয়েঙ্গে আপ? বন্দোবস্ত হো যায়েগা,” এবার সুরিন্দর খিঁচ মারে জোরে।

“জগ্‌হা সেফ হোনি চাহিয়ে হান্ড্রেড পার্সেন্ট,” ওপি ডাঙায় উঠেছে এবার।

“স্যার, ম্যাঁয় আলিপুর মেঁ এক মাল্টিপ্লেক্সমেঁ অকেলা রহতা হুঁ। তিন বেডরুমকা ফ্ল্যাট। এক রুম বিলকুল খালি হ্যায় বারাতল্লাকা মেরা ফ্ল্যাটমে। ওহ বিলকুল সেফ হ্যায়,” সুরিন্দর ওপিকে আশ্বস্ত করে, “আপ বতাইয়ে স্যার, আপ কব কলকত্তা আ রহে হ্যাঁয়।”

“কল-পরসো, তুম বন্দোবস্ত করকে বতাও, যিতনা জলদি হো সকে।”

“ওকে স্যার, ম্যাঁয় কলকত্তা লৌটকেহি সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করকে আপকো বুলাতা হুঁ। স্যার, মেরা এক ছোটাসা কাম থা…” সুরিন্দর এবার হালকা করে কাজের কথাটা ভাসিয়ে দেয়।

“হাঁ বতাও, তুমহারা ক্যায়া কাম হ্যায়?”

“স্যার, মেরা ‘ব্রাউন ফক্স’ কে গার্ড ডিএসপি-মে পিছলে তিন সালসে কাম কর রহেঁ হ্যাঁয়, থার্টি ফার্স্ট মার্চকে পহলেহি পয়লা এপ্রিলসে ফিরসে ওহ রিনিউ করানা হ্যায়। স্যার, আপ অগর চিফ সিকিয়োরিটি অফিসারকো একবার বোল দেঙ্গে তো…”

“ঠিক হ্যায়, তুম কলকত্তাওয়ালা বন্দোবস্তমে ধিয়্যান দো, বড়িয়াঁ অ্যারেঞ্জমেন্ট হোনি চাহিয়ে, ইঁহাকা কাম হো যায়েগা।”

বড়িয়াঁ অ্যারেঞ্জমেন্টই করেছিল সুরিন্দর। পূজা ইভেন্টসকে ফোন করে ব্যবস্থা করেছিল এক সুন্দরীর। দু’ ঘণ্টার জন্য হলে কুড়ি হাজার, আর পুরো রাতের জন্য হলে ত্রিশ হাজার। অনেক বার্গেনিং করে পঁচিশ হাজারে রফা করেছিল। সঙ্গে শিভ্যাস রিগ্যাল আর নামী রেস্তরাঁর খাবার।

ওপি সিন্হাও কথা রেখেছিল। এক্সটেনশন পেয়ে গিয়েছিল ‘ব্রাউন ফক্স’। শুধু কথা দিতে হয়েছিল, প্রতিমাসে অন্তত দু’বার এরকম অ্যারেঞ্জমেন্ট রাখতে হবে। মাসে হাজার সত্তরের ধাক্কা, সুরিন্দর তবু রাজি হয়ে গিয়েছিল, “জ়রুর স্যার।”

ভালই চলছে এই বন্দোবস্ত, তবে কেন হঠাৎ এই তলব আজ মাস সাতেক বাদে? ওপি-র গলা ছিল গম্ভীর, তাই সুরিন্দর আর অনুরোধ করেনি, আগামী শনিবারই তো আসার কথা ওরই ফ্ল্যাটে, ওই সময় কথা বললে হয় না?

কেউ কি খোঁচা দিল ‘ব্রাউন ফক্স’-কে নিয়ে? ওপি-র ফোনটা এসেছিল রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ— “আগামীকাল সকাল আটটার মধ্যে দেখা করো, আর্জেন্ট” বলেই ফোনটা কেটে দিল। টেনশনে সুরিন্দরের প্রথমে ঘুম ভাঙল দুটো কুড়ি মিনিটে। টয়লেট থেকে ফিরে এসে ঘুমোবার চেষ্টা করে সুরিন্দর। সাড়ে চারটেয় অ্যালার্ম দেওয়া আছে, তবুও ঘুম আসছে না! সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সুরিন্দর। তড়াক করে লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল যখন, ঘড়িতে তখন পৌনে চারটে, আর ঘুমোবার কোনও মানে হয় না। শুধু ডিএসপি-তেই তার পঞ্চাশ শতাংশ কর্মী… মাসে বারো হাজার প্রতি গার্ড আর আট হাজার ওদের মাসিক মাইনে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস এই ডিএসপি, তাই এই ইউনিট নিয়েই সুরিন্দরের টেনশন বেশি। কমপিটিটর অনেক মার্কেটে, অনেকের কাছেই আছে সুন্দরী পিআর কর্মী, কম রেট কোট করে কে যে কখন কাজ হাসিল করে নেবে, তার ইয়ত্তা নেই।

পাঁচটাতে গাড়িতে চেপে বসে সুরিন্দর স্নান-টান সেরে। ভোরের আকাশে আজ আর কোনও বিশেষত্ব নেই। নীল তো নয়ই, কেমন যেন একটা সাদাটে ধূসর। এই দুধ সাদা হুন্ডাই সোনাটা তার অত্যন্ত প্রিয় গাড়ি। বছর সাতেক আগে ‘ব্রাউন ফক্স’ শুরুর সময়টা ছিল মোটর বাইক। রাসবিহারীতে একবার ট্রাম লাইনে চাকা স্লিপ করে পড়ে হাতের হাড়ে চিড় ধরেছিল সুরিন্দরের। তারপর আর বাইক চাপেইনি বলতে গেলে। ভাঙা হাত নিয়েই বুক করেছিল ইন্ডিকা। দিন পনেরো বাদেই পেয়ে গেল ইন্ডিকা, ওই গাড়িতেই তার কেটেছিল প্রায় পাঁচ বছর। সোনাটা কেনা মাত্র মাস আষ্টেক। ভাগ্যিস ছিল এই গাড়িটা, তাই ধর্মতলা থেকে ওপি সিন্‌হাকে তুলে আনা, পৌঁছে দেওয়া এই গাড়িতেই। ও পি নিজের গাড়ি ছেড়ে দেয় এসএন ব্যানার্জি রোডের মুখটায়, আর তার সোনাটা পার্ক করা থাকে মেট্রোরেলের সাবওয়ের কাছে। ওখান থেকে গাড়ি ছুটে যায় সুরিন্দরের স্কাই ভিউ কমপ্লেক্সে। লিফটে উঠে সোজা সুরিন্দরের ফ্ল্যাটে। মাথায় ফ্ল্যাপ দেওয়া টুপি থাকে ওপি সাহেবের, প্রতিবারই আলাদা-আলাদা। ফ্ল্যাপ যথাসম্ভব সামনে মুখ কভার করা যাতে সিসিটিভিতে তার মুখের ছবি ধরা না পড়ে, স্টোর না হয়ে যায় হার্ডডিস্কে।

দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে গাড়ি উঠতেই সুইচ টিপে জানলার কাচ নামায় সুরিন্দর। সকালের ঠান্ডা বাতাস ওর মুখে ঝাপটা মারে। চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়। এই গভীর শ্বাস ওর টেনশন কমাতে সাহায্য করে। এমনটা প্রায় সময়েই করে ওদের বিল্ডিং-এর ছাদে উঠলেই। কলকাতার রাস্তায় গভীরভাবে শ্বাস নেয় না, প্রচুর পলিউশন। টোলপ্লাজ়া পেরিয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ছুটে চলেছে ওর গাড়ি, ড্রাইভার মন্টু খুবই বিশ্বস্ত। সাবধানে গাড়ি চালায়। ওর কাছেই হয়ে গেল প্রায় বছর তিনেক। সুরিন্দর বলে, “মন্টু, এসি বন্ধ করে তোমার জানালার কাচ সামান্য খুলে দাও।” নিজের দিকেও জানালার কাচ ইঞ্চি দেড়েক খুলে রাখে সুরিন্দর। অক্টোবরের শেষ, তার উপর সকাল। তাই গরম নেই। অতএব বাইরের অক্সিজেন ভরা প্রাকৃতিক বাতাস সুরিন্দরের পছন্দ। এখন টেনশন অনেক কম। আর দিনের আলোয় ও বিশ্লেষণ করছে ওপি সাহেবের ডেকে পাঠানোতে খারাপ কিছু নিশ্চয়ই নেই।

মন্টু ওর দিকের কাচ প্রায় ইঞ্চি ছয়েক নামিয়ে দিয়ে সামান্য ঘাড় ঘোরায় সুরিন্দরের দিকে। জিজ্ঞাসা করে, “গান চালিয়ে দেব?”

“হ্যাঁ, হালকা করে গুলাম আলি চালিয়ে দাও।”

হুকুম পেয়েই মন্টু সুইচ টিপে মিউজ়িক সিস্টেম চালিয়ে দেয়।

“তোমার খিদে পায়নি তো মন্টু?” হালকা চালে জিজ্ঞাসা করে সুরিন্দর।

“না দাদা, এত সকালে কী করে খিদে পাবে? তবে একটু চা পেলে ভাল হত,” মন্টু তার চায়ের ইচ্ছের কথা জানিয়ে দেয়।

“আচ্ছা দেখছি। আমি ভাবছিলাম শক্তিগড়ে পৌঁছে কচুরি-ল্যাংচা আর চা খাব,” সুরিন্দর বলে।

“হ্যাঁ দাদা, তাই চলুন, ওখানেই ভাল,” মন্টু বলে, “আর তো ঘণ্টাখানেক বড়জোর।”

“আটটায় দুর্গাপুর পৌঁছতে হবে মনে রেখো,” সুরিন্দর একবার সাবধান করে দেয় মন্টুকে।

“পৌঁছে যাব দাদা, চিন্তা করবেন না। আজ রাস্তায় কোনও বাওয়াল নেই বলেই মনে হয়,” গাড়ির স্টিয়ারিং সোজা রেখে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের শেষ প্রান্তে ফ্লাইওভারে গাড়ি তুলে দেয় মন্টু। বাঁদিকে বম্বে রোড আর ডাইনে ফ্লাইওভার থেকে নামলেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে।

রাতে টেনশনে ভাল করে ঘুম হয়নি, তাই মাথাটাকে সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সুরিন্দর, যদি ঘুম এসে যায়। মন্টুর কাছে টাকা দেওয়াই থাকে, তাই টোল প্লাজ়াগুলো নিয়ে চিন্তা নেই।

“দাদা, শক্তিগড় এসে গিয়েছি,” মন্টু গাড়ির স্পিড কমিয়ে সাবধানে গাড়িটাকে রাস্তা থেকে সামান্য নামিয়ে নির্দিষ্ট দোকানের সামনে পার্ক করে।

“ও! ঠিক আছে। আমার জন্য দুটো কচুরি আর একটা ক্ষীরের ল্যাংচা আনো আর তুমি যা খাওয়ার খেয়ে নাও,” গাড়ির সিটে মাথা হেলান দিয়েই বলে সুরিন্দর। শক্তিগড়ে চা-ব্রেকফাস্ট খেয়ে মন্টু গাড়ি ছুটিয়ে দেয় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে। ড্যাশবোর্ডে ঘড়ির দিকে একবার মন্টু আড়চোখে দেখে নেয়, পৌনে সাতটা। অনেকটা সময়। আরামসে গাড়ি চালালেই আটটার মধ্যে দুর্গাপুর পৌঁছে যাওয়ার কথা, পানাগড়ের ট্র্যাফিক জ্যামের গর্ভযন্ত্রণা তো আর নেই! চকচকে বাইপাস পানাগড়ে, এরকম রাস্তায় গাড়ি চালানোর আনন্দই আলাদা।

“দাদা, গাঁধী মোড় এসে গিয়েছি,” মন্টু জাগিয়ে দেয় সুরিন্দরকে। মন্টু জানে, দাদা সিটের পিছনে রাখা ন্যাপকিনে মুখ মুছে তৈরি হয়ে নেয় কারও সঙ্গে দেখা করার আগে।

“জানলার কাচ তুলে এসি চালিয়ে দাও,” সুরিন্দর সোজা হয়ে বসে সিটের পিছনে ফিরে ন্যাপকিন তুলে নেয়। ঠিক আটটা বাজতে পাঁচ মিনিট। একটু আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা দুর্গাপুর। কিন্তু মন্টু জানে, দাদা ঠিক সময়েই পৌঁছনো পছন্দ করে, তাই পানাগড় পৌঁছেই হিসেব কষে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিয়েছিল।

মিনিটের কাঁটা বারোটা ছাপিয়ে এক-দেড়-এর মধ্যেই রয়েছে, তখন সুরিন্দর ওপি স্যারের দরজার কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়াল।

ওপি সিন্হা নিজেই দরজা খুলে বেশ হাসিখুশি মুখে বলে, “পৌঁছ গিয়া তুম! অন্দর আও।”

সুরিন্দর ওর পিছন-পিছন সিন্হা সাহেবের বসার ঘরে ঢোকে। সিনহা সাহেব হাঁক দেয়, “অ্যাই কৌন হ্যায়? জ়রা চায়ে লাও,” সুরিন্দরের দিকে ফিরে বলে, “নাস্তা করোগে?”

“জি নহীঁ, স্যার। নাস্তা ম্যাঁয়নে কর লিয়া। স্রিফ চা লুঙ্গা।”

“ওকে। ভাবিজি অপনি মাইকে পটনা গয়ি হুয়ি হ্যায়। ম্যাঁয় ইসি শনিবার আয়ুঙ্গা তুমারে ওয়াহাঁ,” হাসি-হাসি মুখে তাকায় সুরিন্দরের দিকে।

“ঠিক হ্যায় স্যার। কোই প্রোবলেম নহীঁ। আইয়ে,” মুখে বলে সুরিন্দর। মনে-মনে ভাবে, শালা! গত শনিবারই তো এসেছিলে। এরই মধ্যে হালকা হতে ইচ্ছে করছে!

“ঠিক হ্যায়। অউর সুনো, উয়ো যো ফিল্মস্টার যেইসি দিখতি হ্যায় না, উসকোহি বোল দেনা প্লিজ়,” ওপি সিন্হা মুখে লোচ্চার হাসি ঝুলিয়ে রাখে।

“স্যার, উসকা ক্যা নাম হ্যায়? ম্যাঁয় তো কিসিকো দেখতা নহীঁ হুঁ,” সুরিন্দরও ন্যাকা সাজে। ও ভাল করেই জানে ওপি কার কথা বলছে। ওর নাম অঞ্জলি। এক রাতে ত্রিশ হাজারের কম নেয় না! তবে অঞ্জলিও ওর নাম নয়, এরা আবার ফ্লেশ ট্রেডে নিজের নাম ব্যবহার করে নাকি?

“আরে ইয়ার, খবর রাখখা করো। অ়ঞ্জলি হ্যায় উয়ো,” ওপি দৃঢ় গলায় বলে।

“অঞ্জলি? অচ্ছা স্যার, ম্যাঁয় কোশিশ করুঙ্গা,” সুরিন্দর বলে। মনে-মনে গাল দেয় ওপি সিন্হাকে। শালা বেশ্যাদের নাম, ঠিকানা ঠিকুজি নিয়ে বসে আছে একেবারে! তবে অঞ্জলি সত্যিই স্পেশ্যাল, ফিল্মের হিরোইনদের চেয়েও ওর চেহারা ভাল।

“অউরভি হ্যায়। তুমকোহি বন্দোবস্ত করনা পড়েগা,” এবার বেশ রহস্য মাখানো গলায় বলে ওপি।

শালা একসঙ্গে দুটোকে চায় নাকি রে বাবা! মুখের মধ্যে আগ্রহের চিহ্নগুলোকে ফুটিয়ে রেখে সুরিন্দর চেয়ে থাকে ওর চোখের দিকে।

“ম্যায় দিল্লি যাউঙ্গা নও নভেম্বরকো অউর লৌটুঙ্গা তেরাকো। অঞ্জলিকো সাথ দে দো!” মুখ খুশিতে ডগমগ, চোখ টিপে সুরিন্দরের পিঠ চাপড়ে দেয় ওপি।

“চারদিন!” আঙুলের গাঁট গোনে সুরিন্দর, “বাপ রে! কোই তৈয়ার হোগি স্যার?”

“তুম কিস দিন কাম আওগে?” ওপি এবার সরাসরি ওর দিকে কথাগুলো ছুড়ে দেয় মুখের হাসি মুছে।

“নহীঁ স্যার, ম্যাঁয় বোল রহা থা ইয়ে লোগ যানে কে লিয়ে তৈয়ার হ্যায় কি নহীঁ। পর ম্যাঁয় কোশিশ করুঙ্গা স্যার,” সুরিন্দর বলে, “দুসরি কোই অপশন স্যার? নহীঁ, ম্যাঁয় অঞ্জলিকো ট্রাই করুঙ্গা…”

“উয়ো অগর বিলকুল মনা কর দেতি হ্যায় তো ফির রিঙ্কু। ওহভি ঠিক হ্যায়।”

যাক, সেকেন্ড অপশন আছে তাহলে। প্রথমটা ওর মুখের লাজুক হাসি দেখে সুরিন্দরের মনে হয়েছিল, হয়তো অঞ্জলির প্রেমেই পড়ে গেছে ওপি সাহেব। একটু আগেই চা আর কুকি দিয়ে গেছে বেয়ারা। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সুরিন্দর বলে, “স্যার, অবতো আপ জিমমে যায়েঙ্গে, তো ম্যাঁয় চলা। ম্যাঁয় বতাউঙ্গা আপকো যেইসা বন্দোবস্ত হোগা।”

“অরে বৈঠো পাঁচ মিনিট। তুমারে লিয়ে ভি খুশখবরি হ্যায়,” হাসি-হাসি মুখে বলে ওপি সিন্‌হা।

“ক্যায়া স্যার?” আগ্রহভরে সুরিন্দর তাকিয়ে থাকে ওপি সাহেবের দিকে। “ম্যানেজমেন্ট নে ডিসাইড কিয়া হ্যায় অউর সৌ সিকিয়োরিটি গার্ড লেঙ্গে,” একটু থামে ওপি, “ক্যায়া, খুশখবরি হ্যায় কি নহীঁ? নভেম্বর মাহিনাসেহি, জিতনা জলদি হো সকে।”

সত্যিই এটা খুশ খবর। সুরিন্দরের ভিতরটা এবার আনন্দে নেচে ওঠে, তবে বাহ্যিক প্রকাশ কম। ওপি সাহেব মাসে-মাসে অনেক টাকা খরচ করালেও তার চেয়ে অনেক বেশি রোজগারের সুযোগ করে দিয়েছেন। অঞ্জলিকে যেভাবেই হোক রাজি করাতে হবে।

গাড়িতে চেপে বসে সুরিন্দর। ওপি সাহেব গেট পর্যন্ত এগিয়ে এসে ওকে সি অফ করে। সুরিন্দরের একটু মায়া হয় ওপি সাহেবের উপর। সত্যিই ওর বউ ভাগ্য খারাপ। বিয়ের সময় নিশ্চয়ই এমন চেহারা ছিল না! মিসেস সিন্হার মুখটা বছর কুড়ি আগে কেমন ছিল চেষ্টা করে ভেবে নেওয়ার, মুখের চার পোঁচ চর্বি আর শরীরের মেদ বাদ দিলে ছিমছাম এক যুবতীর অবয়ব পেয়ে যায় সুরিন্দর। সাহেবের সঙ্গে জিম করলেই তো পারে অল্পসল্প। নিজের জন্য না হোক, সিন্‌হা সাহেবের ভাল লাগবে, এই ভেবে অন্তত।

মিনিট তিনেক ডানদিক-বাঁদিক কয়েক পাক মেরে মন্টু গাড়িটাকে তুলে আনে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর। সুরিন্দরের মনটা এখন খুব উদার। সিটের পিছনে হেলান দিয়ে একবার ভেবে নেয় একশো ছেলেকে এখনই তুলে আনতে হবে। সীতাংশুকে বলে পাটুলিতে অন্তত দিন পাঁচেকের ট্রেনিং করিয়ে নিতে হবে প্লেসমেন্টের আগে। তিন মাস ট্রেনিং করানো সব ছেলে, দু’ সেট করে ইউনিফর্মও বানানো আছে শ’ দুয়েকের। আজই অন্তত একশো কুড়ি-পঁচিশজনকে ফোন করে ডেকে আনতে হবে। সীতাংশুকে ফোন লাগায় সুরিন্দর।

“হ্যাঁ, গুড মর্নিং। শোনো, আজই ফোন করো কম করে একশো পঁচিশজনকে। কালকের মধ্যে রিপোর্ট করতে বলো অফিসে। নভেম্বরের ফার্স্ট উইকে একশোজনকে পাঠাতে হবে ডিএসপি-তে। তার আগে পাটুলির মাঠে দিন পাঁচেকের একটা ট্রেনিং করিয়ে দাও শঙ্করকে দিয়ে। চুলটুল কেটে ফিটফাট হয়ে যাবে। রেপুটেশনের ব্যাপারটা সবসময় মাথায় রাখবে,” একটু দম নেয় সুরিন্দর, বলে, “ও হ্যাঁ, পরভিনকে বলবে আজ লাঞ্চের আগেই মেল চেক করে ডিএসপি-র অর্ডার এসেছে কিনা আমাকে জানাতে। আর আমি লাঞ্চের সময়ে অফিসে ঢুকছি,” ফোন কেটে দেয় সুরিন্দর। অঞ্জলির সঙ্গে দেখা করে আজই ওর ব্যাপারটা ফাইনাল করতে হবে, মন্টুকে বলে, “নিবেদিতা সেতুর রাস্তা ধরবে, লেকটাউন যাব।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন