দেবারতি মুখোপাধ্যায়
ভর সন্ধ্যাবেলা নিজের খাটে শুয়ে ছিল ঊর্ণা। চুল খোলা, ডান হাতটা আড়াআড়িভাবে চোখের ওপর রাখা। কাছের একটা বাড়ি থেকে শাঁখ বাজানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। ফ্লাইওভার দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির শব্দ সেই শঙ্খধ্বনিকে অনেক কসরত করেও পুরোপুরি চাপা দিতে পারছে না।
চারদিকের যান্ত্রিক কোলাহলের মাঝে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে শাঁখের আওয়াজ যেন কেমন ঘোর লাগিয়ে দেয়। মনে হয়, সে যেন ধোঁয়া আর ধুলোয় ভরা এই মিথ্যে কথার শহর থেকে দূরে, কোনো এক অপাপবিদ্ধ অতীতে রয়েছে।
কোথায় আছে সে? শুয়ে শুয়ে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল ঊর্ণা।
আশ্চর্য! এতবছর এখানে রয়েছে, কোনোদিন এই আওয়াজটা তার কানে ধরা দেয়নি কেন? সে ধরতে চায়নি বলে?
‘উঠে বোস।’ বলল সাহানা, ‘সন্ধেবেলা শুতে নেই। স্কুল থেকে ফিরে অবধি শুয়ে আছিস কেন?’
পলি আর সিমি একটু দূরে মাটিতে বসে মুড়ি মাখছিল। আলুসেদ্ধ, লংকা, পেঁয়াজ আর আমতেল দিয়ে। শনিবারের সন্ধেটা ওরা ঊর্ণা আর সাহানা’র এই ঘরেই আড্ডা মারে। মিতু যে নার্সিং হোমে কাজ করত, তার পাশেই একজন বয়স্ক মহিলা আমতেল বিক্রি করেন। তাঁর কাছ থেকে কেনা শিশি থেকে আমতেল নেওয়ার সময় মিতু’র মুখটা মনে পড়ছিল পলি’র।
অলসভাবে উঠে বসল ঊর্ণা। ওর চোখদুটো ছলছল করছিল। সাহানা ঝুঁকে ওর কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘এই! তোর গা তো বেশ গরম দেখছি! কখন জ্বর এল?’
‘জানি না।’ ঊর্ণা দু-হাত দিয়ে কপালের দু’পাশ টিপে ধরল, ‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না রে!’
‘আবার কী হল?’ সিমি একটা বাটিতে কিছুটা মাখা মুড়ি দিয়ে এগিয়ে ধরল, ‘নাও ঊর্ণাদি, মুড়ি খাও। জ্বরের মুখে ঝাল-ঝাল টেস্ট ভালোই লাগবে। আজ যা মেখেছি না, মিতুদি খেলে খুব খুশি হত!’
‘হবে, হবে।’ বলল পলি, ‘সুস্থ হয়ে ও আমাদের সঙ্গে বসেই মুড়ি খাবে। নে ঊর্ণা, হাত বাড়া।’
ঊর্ণা যেন এ-সব কথা শুনতেই পেল না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘মণিময় হাজরার বউ আজ স্কুলে এসেছিল।’
‘তাই নাকি! হঠাৎ?’ সাহানা চমকে উঠল।
‘মণিময় পার্টির কাজে এক সপ্তাহের জন্য দিল্লি গেছে। ওর বউ স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করেছে, যাচ্ছেতাই ভাষায়…!’ বলতে বলতে এতক্ষণ ধরে চেপে থাকা কান্না ঊর্ণা’র চোখ ছাপিয়ে বাঁধভাঙা বন্যার মতো বাইরে বেরিয়ে এল। কান্নার দমকে ওর রোগা শরীরটা বেঁকেচুরে যেতে লাগল।
‘আমি নাকি একটা বাজারের বেশ্যা! টাকার লোভে আমি মণিময়ের সঙ্গে এইসব…!’
ঘরের বাকি তিনজন জানত, কতটা অসহায় অবস্থায় রয়েছে ঊর্ণা। তারা চুপ করে রইল। পলি একবার বলতে গেল, ‘শান্ত হ’, ঊর্ণা!’
‘কী করে শান্ত থাকব এর পরেও?’ ঊর্ণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চলল, ‘মণিময়ের কথা না শুনলে আমার চাকরিটা এতদিন থাকত? এতেই বাড়ি থেকে সারাক্ষণের তাগাদা, এই টাকায় নাকি হচ্ছে না! তোরা তো জানিস, কত জায়গায় কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেছি। আয়া-সেন্টার অবধি বাদ দিইনি। কিন্তু মণিময়ের লোক ঠিক এসে বাগড়া দিয়েছে। আমাকে অন্য কোথাও যেতে দেবে না! আজ সারা স্কুলের সামনে আমাকে এইসব শুনতে হল!’
এক ঝটকায় সাহানা’র মনে পড়ে গেল মিতু’র বলা কথাগুলো। ক্ষমতা! মণিময় নিজের ক্ষমতা দেখাচ্ছে ঊর্ণাকে ‘নিজের’ করে রেখে। ও শান্ত গলায় বলল, ‘তুই নিজের অবস্থার কথা মণিময়ের বউকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলি? সে নির্ঘাত জানে তার স্বামীটি কী জিনিস! তার চাপে মণিময় তোকে ছেড়ে সরে দাঁড়াতে পারে।’
ঊর্ণা সজল চোখে বলল, ‘তুই এইসব বউদের জানিস না। স্বামী যাই করে বেড়াক, তাদের দোষ এদের নজরে পড়বে না। আমি এ-সব বলতে গেলে আরও কথা শোনাত।’
‘এর পর আর কী শোনাত!’ বিরক্ত মুখে বলল পলি, ‘মণিময় জানে এইসব?’
‘খবর পেয়ে ফোন করেছিল।’ ঊর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘বলছে চুপচাপ থাকতে। ওর বউ নাকি মাথাগরম প্রকৃতির। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বেশি রিয়্যাক্ট করলে নাকি ওর ইমেজের ক্ষতি হবে।’
‘শালা …!’ পলি গালাগাল দিতে গিয়েও চুপ করে গেল, খিঁচিয়ে উঠে বলল, ‘তুই কিছু বললি না?’
‘কী বলব? এই নিয়ে কথাই বলতে চাইছিল না। খালি মিতুর কথা জিজ্ঞেস করছিল।’ ঊর্ণা চোখের জল মুছল। বলল, ‘আমি ঠিক করে ফেলেছি। এই চাকরি আমি ছেড়ে দেব।’
‘দিয়ে কী করবি?’ পলি জিজ্ঞেস করল।
‘দেখি কী পাই।’ ঊর্ণা দাঁতে দাঁত চিপল, ‘কিছু একটা ঠিকই পেয়ে যাব। আর না পাই রাস্তায় ভিক্ষে করব। তবু এত অপমানিত আর হতে পারব না!’
পলি ঠোঁট কামড়াল, ‘তুই ছাড়লেই কি মণিময় হাজরা তোকে ছাড়বে?’
ঊর্ণা বলল, ‘না ছাড়লে মেরে ফেলুক! যেভাবে বেঁচে আছি, সেটা কি আদৌ বেঁচে থাকা?’
‘শোন, চাকরিটা তুই ছেড়েই দে।’ সাহানা’র গলায় একটা অদ্ভুত, অপরিচিত সুর পেয়ে ঘরের বাকি তিনজনেই হাঁ করে ওর দিকে তাকাল।
সাহানা হাসল, ‘তবে তার আগে স্কুল থেকে এক্সপিরিয়েন্সের সার্টিফিকেটটা আদায় কর। তারপর কোনো একটা প্রি-স্কুলে অ্যাপ্লাই কর। সঙ্গে রেকমেন্ডেশন লাগা।’
‘কে দেবে ওকে রেকমেন্ডেশন?’ সিমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মণিময় তো ওকে অন্য কোথাও কাজই করতে দেবে না।’
‘দেবে।’ সাহানা’র মুখে হাসিটা স্পষ্ট হল, ‘এইবার দেবে। রেকমেন্ডেশনও ওই দেবে। তার কারণ, এইবার, এতদিনে ঊর্ণা’র হাতে একটা মস্ত বড়ো জিনিস এসে গেছে। মণিময়ের ইমেজ নিয়ে ভয়! এতদিন ঊর্ণা এই নিয়ে কিছু বলতে গেলে ব্যাপারটা বানানো বলে চেপে দেওয়া যেত। কিন্তু স্বয়ং মণিময়ের বউ যেখানে সবার সামনে চিৎকার করে কথাগুলো বলেছে, তখন তো ঊর্ণাকে আর মিথ্যেবাদী বলে দেওয়া যাবে না। ঊর্ণা বলবে, মণিময় জোর করে ওর সঙ্গে সহবাস করেছে। ভয় দেখিয়ে।’
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল ঊর্ণা।
সাহানা ওর মাথায় হালকা করে হাতটা রেখে বলল, ‘ক্ষমতা, ঊর্ণা! ও জিনিস আজ যার হাতে থাকে, কালকেই অন্যের হাতে চলে যেতে পারে। পার্টি অফিসের ঠিকানা তুই জানিস। মণিময়ের বদলে নমিনেশন পেতে কে আগ্রহী, সেটা জানতে পাঁচ মিনিট সময় লাগবে স্রেফ। আর এগুলো যে তুই জানিস, সেটা মণিময়কে হালকা করে বুঝিয়ে দিবি।’
কম্পিল্য নগরীরের সীমান্তে অবস্থিত বিশাল প্রমোদ উদ্যানের কেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রাসাদ পাঞ্চালের অন্যতম রাজকীয় বিশ্রামগৃহ। গোধূলিবেলায় দশার্ণের অধীশ্বর হিরণ্যবর্মার জ্যেষ্ঠপুত্র উপস্থিত হলেন সেখানে। ভগ্নীপতির পুরুষত্ব প্রমাণের চূড়ান্ত শংসাপত্র দেওয়ার ভার ন্যস্ত হয়েছে তাঁরই ওপর। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী।
আর আছেন এক বারাঙ্গনা। তিনি দশার্ণ রাজ্যের শ্রেষ্ঠ গণিকা। নাম অনঙ্গমোহিনী।
প্রাসাদে অপেক্ষা করছিলেন শিখণ্ডী। অতিথিদের স্বাগত জানানোর রাজকীয় কর্তব্য তিনিই পালন করেছিলেন। প্রাথমিক আলাপনের প্রয়োজন ছিল। দশার্ণের যুবরাজ তার মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়েছিলেন, এই পুরুষ রাজকুমারটি শিখণ্ডীই।
সামান্য পানাহারের পর একটি কক্ষে অবস্থান করছিলেন শিখণ্ডী। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুবল এসে নিম্নকণ্ঠে শিখণ্ডীকে জানিয়েছিল, দশার্ণের রাজকুমার প্রাসাদের বাহ্যিক অংশে একটি কক্ষে রাত্রিযাপন করবেন। প্রভাতে বারাঙ্গনা শিখণ্ডী’র কক্ষ থেকে বহির্গত হওয়ামাত্র যাতে তিনি সঠিক সংবাদ পান, তা নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা।
কিছুটা ইতস্তত করে সুবল আরও বলেছিল, ‘কুমার, মহারাজ আমাকে আদেশ করেছেন, আমি যেন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই একটি কথা। আপনার ওপরেই নির্ভর করছে এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ।’
শিখণ্ডী কোনো উত্তর দেননি। চারপাশের গোপনীয়তা ও অপমানের ছাপ তাঁকে মনে মনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে তুলছিল। মনে হচ্ছিল, এই দুঃসময়ে যদি পাশে পেতেন কুম্ভককে!
প্রাথমিকভাবে শ্যালককে দেখে শিখণ্ডী ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পুরুষত্বের পরীক্ষা নিতে এসেছেন এক বয়ঃকনিষ্ঠ! পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করেছিলেন তিনি। এখন সুবলের কথা শুনে তাঁর পুনরায় মনে হল, কতটা লাঞ্ছনা যে মিশে রয়েছে এই গোপন অভিসারে, তা কি পিতা দ্রুপদ বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝেও তিনি অসহায়? মূক? তবু, রাজধর্ম তথা পাঞ্চালের ভবিষ্যতের কথাটি ভেবে শান্ত থাকতে সচেষ্ট হলেন শিখণ্ডী।
না। এ কোনো অভিসার নয়, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত অগ্নিপরীক্ষাও নয়। এই রাতটির রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বের কথা ভেবে ব্যক্তিগত মান-অপমান এবং শারীরিক ক্লেশের কথা ভুলতে চাইলেন তিনি।
সন্ধ্যা একসময় রাত্রির রূপ নিল। প্রাসাদের অন্যান্য শব্দ ও গুঞ্জন স্তিমিত হতে-হতে মিলিয়ে গেল সুগন্ধ ও সূক্ষ্ম রঞ্জক মিশ্রিত বাতাসে। তখনই সেই রমণ-পারঙ্গমা নারী প্রবেশ করলেন শিখণ্ডীর কক্ষে।
এই নারী শুধু সুন্দরী নন, সুভাষিণীও। কক্ষে প্রবেশমাত্র তিনি শিখণ্ডীর নিকটে এসে অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিতে যুক্ত করে বললেন, ‘প্রণাম রাজকুমার! আমি অনঙ্গমোহিনী। বহুদিন ধরে আপনার নাম শুনছি। আজ প্রত্যক্ষ দর্শনের সৌভাগ্য হওয়ায় আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।’
শিখণ্ডী অপাঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন। অনঙ্গমোহিনী পূর্ণযৌবনা এবং অভিজ্ঞা। তাঁর চোখের মদির কটাক্ষ, উত্তুঙ্গ উচ্চাবচ, গুরু পয়োধর দেখে শান্ত থাকতে পারবে, এমন পুরুষ বোধ করি পৃথিবীতে নেই। তাঁর স্বচ্ছপ্রায় কাঁচুলির ফাঁকে গভীর বিভাজিকা সর্বনাশের ইশারা জাগিয়ে তোলে সম্মুখস্থ পুরুষের চোখে। এক্ষেত্রেও তাই হচ্ছিল। শিখণ্ডী বুঝতে পারছিলেন, তাঁর চক্ষুদ্বয় দূতের কাজ করতে শুরু করছে। দৃষ্টিসুখ ক্রমেই উদ্দীপকের আকারে পৌঁছে যাচ্ছে তাঁর শরীরের শিরায় শিরায়, জাগ্রত হয়ে উঠছে তাঁর সদ্যোজাত পুরুষ অঙ্গটি!
অনঙ্গমোহিনীও নিশ্চুপ দেখছিলেন। তাঁর রক্তাভ ঠোঁটের একপাশে খেলা করছিল এক রহস্যময় হাসি। নিজের প্রায় অর্ধেক বয়সি এই তরুণ রাজকুমার নাকি নপুংসক, এমনই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তাঁর কাছে। পরীক্ষার ভার তাঁর ওপর।
অনঙ্গমোহিনী খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন শিখণ্ডীর চোখ, বাহু, সর্বাঙ্গ। নপুংসক কিনা তা এখনই বোঝা না গেলেও লাজুক তো বটেই। এমন একজন উদ্ধতযৌবনার এত কাছে এসেও কুমার কিনা লজ্জায় মুখ অধোনমিত করে রেখেছেন!
মৃদু হেসে শিখণ্ডীকে আলিঙ্গন করলেন অনঙ্গমোহিনী। শিখণ্ডী’র বক্ষের গভীরে কম্পমান হৃদয়ের দ্রুত চলন উপলব্ধি করে তাঁর কর্ণমূলে ঈষৎ দংশন করলেন তিনি।
পাঞ্চালের আকাশে ঘন হল রাত।
পরের দুটি প্রহর কেটে গেল এক অভিজ্ঞা ও এক অনভিজ্ঞের রতিক্রিয়ায়।
গুরুসুলভ ধৈর্যে অনঙ্গমোহিনী শিখণ্ডীকে প্রশিক্ষিত করে তুললেন। ধীরে ধীরে রতিসুখের চূড়ান্তে আরোহণের পদ্ধতি আয়ত্ত করলেন শিখণ্ডী। তিনি বুঝতে পারলেন, সঠিক ব্যবহার কীভাবে দেহের প্রতিটি অঙ্গকেই করে তুলতে পারে রমণসহায়ক। প্রয়োজন ধৈর্য ও অস্থিরতা বর্জন। সর্বোপরি, দেহের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী যৌনাঙ্গ ‘মস্তিষ্ক’কে কীভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, সেই কৌশলের পাঠ তিনি লাভ করে চললেন।
এক-একবার উত্তেজনার চরম শিখরে উঠছিলেন শিখণ্ডী। তিনি চূড়ান্ত মিলনে রত হয়ে নিজেকে নিঃশেষিত করতে চাইছিলেন। তখনই অনঙ্গমোহিনী তাঁকে নিবৃত্ত করে নানা কলায় ভুলিয়ে মগ্ন করে তুলছিলেন প্রাকরমণ নানা ক্রিয়ায়। এভাবেই লম্বিত হচ্ছিল রতিক্রীড়া।
অবশেষে এল মধ্যরাত। শিখণ্ডী তখন কাতরভাবে প্রার্থী হলেন। চূড়ান্ত সংগমের সুখে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার আকুল আবেদন জানালেন তিনি।
অনঙ্গমোহিনী সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে। কামশাস্ত্রের শিক্ষায় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক নানা কৌশল শেখা শিখণ্ডী সর্বস্ব উজাড় করে দিলেন সেই মিলনে।
অলৌকিক সুখের সেই অনুভূতির স্রোতে প্লাবিত হল তাঁর দেহ-মন। নিশ্বাস, দংশন, আলিঙ্গন, নিষ্পেষণের সেই প্রবাহ উত্তাল হয়ে আছড়ে পড়ল এক দেহ হতে অন্য দেহে।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অপূর্ণতার যে যন্ত্রণা শিখণ্ডী’র চিরসখা হয়ে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে ঘুমে-জাগরণে, সে এতদিনে বিদায় নিল!
রাত্রি যখন ভোরের প্রথম আলোকের সঙ্গে অভিসারের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন অনঙ্গমোহিনী নীরবে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে এলেন। শিখণ্ডী তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
কিন্তু প্রাসাদে বহু মানুষ সেই রাতে ছিলেন নিদ্রাহীন। দশার্ণের যুবরাজও তাঁদেরই একজন। তাঁর উৎকণ্ঠায় ভরা জিজ্ঞাসু চোখের সামনে গিয়ে অনঙ্গমোহিনী সামান্য হাসলেন। অনন্তযৌবনা সেই নারীর শরীরে ক্লান্তি না থাকলেও রমণতাণ্ডবে বিস্রস্ত কেশ ও বসন প্রমাণ করছিল যে তিনি রাতটি নিছক সুখনিদ্রায় অতিবাহিত করেননি।
‘বলো অনঙ্গমোহিনী!’ উদবিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন দশার্ণ যুবরাজ, ‘রাজকুমার কি সত্যিই নপুংসক? সেক্ষেত্রে এই দণ্ডেই যুদ্ধসজ্জা করব আমরা। ভগ্নীর এই অপমান কিছুতেই মেনে নেব না আমি!’
অনঙ্গমোহিনী হেসে উঠলেন।
মদির কটাক্ষ হেনে গজগামিনী ছন্দে এগিয়ে এসে নিজ বাহুডোরে বাঁধলেন রাজকুমারকে। পূর্ণকণ্ঠে বললেন, ‘রুষ্ট হবেন না, কুমার। কিন্তু রাজকুমার শিখণ্ডী আপনার থেকেও তেজস্বী পুরুষ। আমাদের রাজকুমারীর নিশ্চয়ই কোনো ভ্রম হয়েছিল। এমন দীর্ঘ রমণশক্তি খুব কম পুরুষের মধ্যেই পেয়েছি। আমি অত্যন্ত তৃপ্ত, কুমার! নিশ্চিন্ত হতে পারেন, শিখণ্ডী নপুংসক নন।’
দ্রুত, অতি দ্রুতবেগে ধেয়ে চলেছিল অশ্বটি। তার পৃষ্ঠে আসীন শিখণ্ডী’র মনও স্থির ছিল না। চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছিল তাঁর নানা ভাবনা।
গত দুটি রাত্রির মতো সময় তাঁর জীবনে আগে কখনও আসেনি। আজন্মলালিত সংস্কারের বশে যে পুরুষভাব নিজের ওপর এতদিন আরোপ করেছিলেন তিনি, তা এখন সহজাত প্রবৃত্তির মতো তাকে তাড়িত করছে। তার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন গত দুই রাতে দুই রমণীকে তৃপ্ত করে। প্রথমজন দশার্ণ নগরীর রাজগণিকা অনঙ্গমোহিনী। দ্বিতীয়জন শিখণ্ডীর নববিবাহিতা স্ত্রী তথা দশার্ণ-রাজকন্যা।
প্রথমজন অভিজ্ঞা এবং রতিশাস্ত্রে পারদর্শিনী। দ্বিতীয়জন অতখানি কুশল না হলেও রতিবিলাসে আগ্রহী ও আগ্রাসী। দু’জনকেই তৃপ্ত করেছেন শিখণ্ডী। শস্যোন্মুখ ভূমিতে পাঞ্চাল রাজবংশের বীজ বপন করে বংশধারা অগ্রসর করার প্রয়াসের সূচনাও ঘটেছে গতরাত্রে। সেই বীজ আগামী দিনে পাঞ্চালকে সমৃদ্ধ করলে এই বিবাহ সর্বতোভাবে সফল বলেই পরিগণিত হবে।
দশার্ণ নৃপতি হিরণ্যবর্মা আজ প্রভাতে উপস্থিত হয়েছেন। কন্যার শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হয়ে অকৃত্রিম ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন তিনি। যুদ্ধভেরি ত্যাগ করে আলিঙ্গন করেছেন পরম আদরের জামাতাকে। দ্রুপদও সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছেন তাঁকে। ফলে, আজ সকাল থেকে রাজপ্রাসাদে আনন্দের পরিবেশ।
তারই মধ্যে, নিঃশব্দে এবং যথাসম্ভব গোপনে প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন শিখণ্ডী। মাতা প্রশতী শুধু তাঁর এই সাময়িক বিহারের কথা জানেন। শিখণ্ডী তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন সূর্যাস্তের আগেই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। যাত্রা শুরুর পরেই তাঁর মুখে দেখা দিয়েছে এক অনন্যপূর্ব দৃঢ়তা। বিষাদ আর আশঙ্কা যেন ভস্মের মতো করে প্রলিপ্ত করেছে তাঁর মুখটিকে।
উচ্চাবচ ভূমি এবং অরণ্যপথে চলতে চলতে শিখণ্ডী অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছোলেন।
এক পর্ণকুটিরের সামনে অশ্বপৃষ্ঠ ত্যাগ করলেন তিনি। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। কুটিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সামান্য ইতস্তত করলেন তিনি।
তারপর ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘প্রণাম, যক্ষ!’
‘কে?’ স্থূণকর্ণ কুটিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন।
তাঁকে দেখে চমকে উঠলেন শিখণ্ডী। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি বললেন, ‘এ কী! আপনার মুখচোখ এমন বিধ্বস্ত কেন? কী হয়েছে আপনার?’
‘বিশেষ কিছু নয়।’ স্থূণ দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘বরং আপনি বলুন। এই অরণ্যের অভ্যন্তরেও সুসংবাদ এসে পৌঁছেছে গতকালই। আপনি সফল হয়েছেন। দশার্ণ অধীশ্বর যুদ্ধচিন্তা পরিত্যাগ করেছেন।’
‘এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আপনার এবং দেবী চূড়ালা’র।’ শিখণ্ডী যুক্ত করে বললেন, ‘আপনারা না থাকলে আজ পাঞ্চাল ভয়ানক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হত।’
যক্ষের মুখে ম্লান, মেঘাচ্ছন্ন জ্যোৎস্না-সদৃশ হাসি দেখা দিল। ঈষৎ মস্তক আন্দোলন করে তিনি বললেন, ‘আপনার ভবিতব্যে যা ছিল, সেটিই বাস্তবায়িত হয়েছে, কুমার। আমরা নিমিত্ত মাত্র।’
শিখণ্ডী কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি প্রত্যাবর্তন করেছি। আপনি বলেছিলেন, আমার পৌরুষের আয়ু এক দিবসকাল। তা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। আপনি আমার পৌরুষ ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে সত্যবদ্ধ থাকার সুযোগ দিন, হে স্থূণকর্ণ!’
স্থূণ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাক্যালাপে ছেদ পড়ল। কুটিরের অভ্যন্তরের অন্ধকার ছেড়ে দিবালোকে এসে দাঁড়ালেন এক বিশালদেহী পুরুষ।
তাঁর দেহে কিছু বিকৃতি আছে, কিন্তু আয়তাকার চক্ষু, উন্নত নাসিকা এবং গুম্ফর প্রতিই শিখণ্ডী’র দৃষ্টি প্রথমে আকৃষ্ট হল।
স্থূণ কিঞ্চিৎ বিব্রত কণ্ঠে বললেন, ‘পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি পাঞ্চাল রাজ্যের ভাবী অধীশ্বর যুবরাজ শিখণ্ডী। আর ইনি যক্ষরাজ কুবের, আমাদের সম্প্রদায়ের অধিপতি! আমার কুটিরে আজ তিনি পদার্পণ করে আমাকে ধন্য করেছেন।’
শিখণ্ডী’র ভ্রূযুগল বিস্ময়ে ঊর্ধ্বমুখী হল। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে তিনি সসম্ভ্রমে প্রণাম করে বলে উঠলেন, ‘এ আমার পরম সৌভাগ্য যে স্বয়ং যক্ষরাজকে দর্শন করলাম!’
‘চিরায়ুষ্মান হও।’ যক্ষরাজ আশীর্বাদ করলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি সবই শুনেছি। স্থূণকর্ণের ঔষধের প্রভাবে তুমি যে পৌরুষের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছ সেই সংবাদও আমরা পেয়েছি। কিন্তু যক্ষকুলের অনুমতি ব্যতীত, আমার অজ্ঞাতে যে কারওর ওপর ওষধি প্রয়োগ করা যায় না, তা বোধ করি স্থূণকর্ণ বিস্মৃত হয়েছিল। তাই সেই দায় তাকে নিতে হবে।’
শিখণ্ডী চমকে উঠলেন। এইবার তিনি বুঝতে পারলেন, কেন স্থূণকর্ণের মুখ মলিন। কিন্তু তাঁর জন্য স্থূণ শাস্তি পাবেন, তা কী করে হয়? তিনি বলে উঠলেন, ‘মার্জনা করবেন যক্ষরাজ। কিন্তু স্থূণ তো মাত্র এক দিবসকালের জন্য আমার ওপর ওষধি প্রয়োগ করেছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সাময়িক, বিশেষত এত স্বল্প-সময়ের জন্য ওষধির প্রয়োগ তো যক্ষকুলে প্রচলিত ভিষগশাস্ত্র অনুযায়ী বৈধ। অঙ্গীকার অনুযায়ী আমি স্থূণ’র কুটিরে প্রত্যাবর্তন করেছি, যাতে তিনি আমার দেহ থেকে ওষধির প্রভাব অপসারণ করে দিতে পারেন।’
কুবের ভ্রূ-কুঞ্চিত করলেন। বললেন, ‘যক্ষরা প্রয়োজনে ক্ষণকালের জন্য কারও ওপর ওষধি প্রয়োগ করতে পারেন, এই গোপন নিয়ম তুমি কীভাবে জানলে?’
শিখণ্ডী সবিনয়ে বললেন, ‘আমাকে জানিয়েছেন এই অরণ্যের এক ব্রহ্মচারী, আমার প্রিয় বন্ধু কুম্ভক।’
কুবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্থূণকর্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কে এই কুম্ভক? তিনি কীভাবে আমাদের সম্প্রদায়ের গূঢ় নিয়ম জানলেন?’
স্থূণকর্ণ এক মুহূর্ত শিখণ্ডী’র দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘কুম্ভক তাঁর প্রকৃত নাম নয় প্রভু। তিনি রাজা শিখীধ্বজের স্ত্রী চূড়ালা!’
‘চূড়ালা?’
‘হ্যাঁ যক্ষরাজ। আপনি যাকে আশৈশব লালন করেছিলেন, নানা গুপ্তশিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন, সেই চূড়ালা।’
‘শিখীধ্বজের সঙ্গে বিবাহের পরও সে তার অধ্যয়ন ও গবেষণা অব্যাহত রেখেছে, এ-কথা জানি। কিন্তু এই গহিন অরণ্যে সে কী করছিল?’
‘সে অনেক কথা, প্রভু!’
স্থূণকর্ণ আবারও তাকালেন শিখণ্ডীর দিকে।
শিখণ্ডী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে এই বাক্যালাপ শুনছিলেন। তাঁর আরণ্যক জীবনের একমাত্র বন্ধু কুম্ভক আসলে এক নারী! কিন্তু কীভাবে? কেন?
‘রাজা শিখীধ্বজ ঈশ্বরসাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে চেয়েছিলেন।’ অনুচ্চ, কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বললেন স্থূণকর্ণ, ‘তিনি এমন এক গুরুর সন্ধান করছিলেন, যিনি তাঁকে সঠিক পন্থার সন্ধান দিয়ে সাধনার উচ্চমার্গে নিয়ে যেতে পারবেন। এই কাজের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট গুরু তাঁর প্রাসাদেই ছিলেন। তাঁর নিজের সহধর্মিণী। চূড়ালার মতো জ্ঞানী মার্গদর্শক পাওয়া সর্বার্থে সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু নারীকে, তদুপরি নিজের স্ত্রীকে, গুরু হিসেবে মেনে নেওয়ার ঔদার্য শিখীধ্বজ দেখাতে পারেননি। তাই স্ত্রী’র যোগ্যতা সম্বন্ধে অবগত হয়েও তিনি অরণ্যে চলে এসেছিলেন এক প্রকৃত সাধকের সন্ধানে।’
কুবের ভ্রূ-কুঞ্চিত করে শুনছিলেন। তিনি এবার বলে উঠলেন, ‘তাই চূড়ালা পুরুষের রূপ নিয়ে অরণ্যে উপস্থিত হয়েছিল, যাতে তার স্বামী সঠিক সাধনমার্গের সন্ধান পায়?’
‘হ্যাঁ, যক্ষরাজ। চূড়ালা আপনার শিক্ষা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি নিজেও নানা ওষধি এবং বিবিধ শল্যপদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তাদের সম্মিলিত প্রক্রিয়ায়, কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর সাহায্যে তিনি নিজের লিঙ্গান্তর ঘটিয়ে এই অরণ্যে এসেছিলেন। তাঁর যে সহজ কথারা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে শিখীধ্বজের কাছে গুরুত্ব পেত না, সেই কথাগুলোই এই আরণ্যক পরিবেশে এক পুরুষ ব্রহ্মচারী’র মুখনিঃসৃত হয়ে রাজাকে অভিভূত করে ফেলেছিল।’
‘আশ্চর্য কন্যা এই চূড়ালা!’ অভিভূত কণ্ঠে বললেন কুবের, ‘শৈশবকাল থেকেই সে অনন্যসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছিল। আমি জানতাম, ও একদিন ভূলোকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবে। কিন্তু অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল ওর নারীত্ব। সমাজ পুরুষকে নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠতর বলে মনে করে। যখন কোনো প্রতিভাধর নারী সমাজের সেই ভুল ভেঙে দিতে চায়, তখন হয় তাচ্ছিল্য করে, নয়তো বলপ্রয়োগ করে তার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। চূড়ালা’র প্রতিভা স্বীকৃতি পায়নি এই কারণেই।’
স্থূণকর্ণ ক্লান্ত ভঙ্গিতে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে শিখীধ্বজ এখন নিজেকে সংশোধন করেছেন। চূড়ালা কুম্ভকরূপে শিখীধ্বজকে সাধনার এক বিশেষ স্তরে পৌঁছোতে সাহায্য করেছিলেন। সেখানে উন্নীত হওয়ার ফলে নির্মোহ থাকার গুণ অর্জন করেছেন রাজা। এর মধ্যে চূড়ালা নিজে মদানিকা নাম্নী এক রমণীতে পরিবর্তিত হয়ে রাজার সঙ্গে সহবাসে প্রবৃত্ত হয়েছেন। তার ওপর রাজার কোনো অধিকারবোধ জন্মায়নি। শিখীধ্বজ উপলব্ধি করেছেন, প্রকৃত সিদ্ধিলাভের জন্য প্রয়োজন সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম এবং অপরিগ্রহ। এই গুণাবলি আয়ত্ত হলে গৃহে থেকে, রাজধর্ম পালন করেও ঈশ্বরোপলব্ধি হয়। এখন তাঁরা দুজনেই কর্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছেন।’
নিস্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনছিলেন শিখণ্ডী। বিস্ময় নয়, ক্রমে বন্ধুর জন্য হওয়া গর্ব তাঁর মনকে প্লাবিত করছিল।
বন্ধুত্বের তো কোনো লিঙ্গভেদ হয় না। কুম্ভক বা চূড়ালা পুরুষ না নারী তা শিখণ্ডী’র কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়েছিল। স্বামীকে তাঁর অভীষ্টলাভে সহায়তার জন্য তিনি দিনের পর দিন এই বিপদসংকুল অরণ্যে বাস করেছেন। এমনকি সেই পরিস্থিতিতেও শিখণ্ডী’র বিপদে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন চূড়ালা। স্থূণকর্ণকে তিনিই সম্মত করিয়েছিলেন ওষধি প্রয়োগে। শল্যচিকিৎসার দুরূহতম, গোপনতম বিদ্যার সফল প্রয়োগে তিনি শুধু শিখণ্ডীকে নয়, পাঞ্চালকেও রক্ষা করেছেন।
শিখণ্ডীর হঠাৎ মনে হল, চূড়ালা ওরফে কুম্ভকের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ কি একান্তই অসম্ভব? শিখীধ্বজ-জায়া, এক রাজ্ঞীর রূপেও তিনি কি আরণ্যক-জীবনের এই হতভাগ্য মিত্রটিকে বিস্মৃত হবেন?
উদগত অশ্রু সংবরণ করে সমকালে প্রত্যাবর্তন করলেন শিখণ্ডী। করজোড়ে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে ওষধিটি প্রত্যাহার করুন, স্থূণকর্ণ। আমি দায়মুক্ত হই!’
স্থূণকর্ণ অপরাধীর দৃষ্টিতে কুবেরের প্রতি দৃষ্টিপাত করে অধোবদন হলেন। কুবের শান্তভাবে বললেন, ‘আমার অনুমতি গ্রহণ না করে স্থূণ তোমাকে ওষধি দেওয়ায় আমি অত্যন্ত কুপিত হয়েছিলাম। তোমার আগমনে আর কিছুক্ষণ বিলম্ব হলে সে আমার দণ্ডভোগ করতে বাধ্য হত। কিন্তু কুমার, তোমার সততায় আমি মুগ্ধ। পৌরুষের মতো একটি বৈশিষ্ট্য, যার জন্য তুমি বহুকাল ধরে প্রার্থনা করেছ, তাকে স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিতে এসেছ তুমি!’
‘যত কষ্টই হোক, যত বেদনাই মনে সঞ্চিত থাকুক, আমি ক্ষত্রিয়, যক্ষরাজ।’ শিখণ্ডী’র মুখে ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল, ‘প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হওয়া আমার নীতিবিরুদ্ধ।’
‘সাধু!’ কুবের দক্ষিণ হস্ত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি যক্ষকুলপতি কুবের তোমাকে আশীর্বাদ করছি, শিখণ্ডী। ওই ওষধির প্রভাব তোমার দেহ থেকে প্রত্যাহৃত হবে না।’
‘কী!’ অসম্ভবের আশা এবং বিস্ময়ের যুগপৎ আঘাতে শিহরিত হলেন শিখণ্ডী, ‘এ কী বলছেন আপনি?’
স্থূণকর্ণও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন কুবেরের দিকে।
‘ঠিকই বলছি। এমনিতেও চূড়ালার অস্ত্রোপচার স্থায়ী প্রক্রিয়া।’ কুবের প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার মৃত্যুর পরই না হয় স্থূণকর্ণের ওই ওষধি আবার ফিরে আসবে যক্ষকুলের কাছে। ততদিন অবধি এ থাকবে তোমার কাছে। রাজকুমার শিখণ্ডী, এবার তুমি প্রকৃত অর্থে পুরুষ হলে, সারাজীবনের জন্য! চূড়ালা’র অস্ত্রোপচারের প্রভাব আর স্থূণকর্ণের প্রদত্ত ওষধির প্রভাব আমার আশীর্বাদক্রমে তোমার দেহে আমৃত্যু স্থায়ী হবে।’
বিহ্বল শিখণ্ডীর চোখ ভরে ওঠে উদগত অশ্রুতে।
নত হয়ে তিনি প্রণাম করেন দু-জনকে।
জলের ধারা কখন যে অনাহূত হয়ে এসেও তার দু-গাল ভাসিয়ে দিয়েছে তা বুঝতেই পারেনি সাহানা। এ কী লিখেছে মিতু? মহাভারতের এক আপাত গৌণ চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে লেখা এমন কাহিনি কীভাবে জন্মাল ওর মনের মধ্যে? আবেগ আর রোমাঞ্চ, অপমান আর সুখ,সব যেন সহস্রাব্দীর ব্যবধান অতিক্রম করে ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে।
কী করে এমন কিছু লিখল মিতু?
আর শিখণ্ডী তো অবশেষে পুরুষ হলেন। কিন্তু মিতু? মিতু কবে পাবে আকাঙ্ক্ষিত পৌরুষ?
‘আসতে পারি?’ রমেন্দ্র উঁকি দিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করায় সাহানা একটু থতোমতো খেয়ে গেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অল্প হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। আসুন।’
পুলিশের উর্দি নয়, বরং সাধারণ টি-শার্ট আর জিনস পরে এসেছিলেন রমেন্দ্র। সাহানা আর ঊর্ণা’র ঘরে দুটো তক্তপোশ আর আলমারি ছাড়াও দুটো আদ্যিকালের কাঠের চেয়ার আছে।
জীর্ণ চেহারার সেই দুটো চেয়ারের একটাতেই সাবধানে বসলেন রমেন্দ্র।
ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা জমে উঠছিল। সাহানা বাধ্য হয়ে বলল, ‘চা খাবেন?’
‘চা?’ রমেন্দ্র কী যেন ভাবতে শুরু করেছিলেন। এবার বললেন, ‘তা খাওয়া যায়।’
ঘরের কোণে একটা ছোটো স্টোভ আছে। রান্না একতলায় হলেও মাঝেমধ্যে চা খেতে ইচ্ছে হলে এই স্টোভটাই কাজে দেয়। অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে জল বসিয়ে সাহানা বলল, ‘দুধ নেই। লিকার করে দিচ্ছি। চিনি ক’চামচ দেব?’
‘দিন এক চামচ।’ রমেন্দ্র মিতু’র খাতাটা তুলে নিয়ে বলল, ‘আপনার রুমমেট কোথায়? মিস ঊর্ণা?’
‘ঊর্ণা স্কুলে গেছে।’ সাহানার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। রমেন্দ্র সরকার মিতুর খাতাটা হাতে নিলেন কেন? খাতার একেবারে প্রথমে কি মিতুর নাম লেখা আছে?
সাহানার মনে পড়ছে না।
রমেন্দ্র বললেন, ‘সেদিনও গাড়িতে দেখলাম, এই খাতাটা পড়ছিলেন। আজকেও দেখলাম, একেবারে তন্ময় হয়ে আছেন এর মধ্যে। এ তো দেখছি হাতে লেখা। কে লিখেছে?’
ডেকচিতে চায়ের জল টগবগ করে ফুটছিল। চামচ দিয়ে সেটা নাড়তে-নাড়তে সাহানা বলল, ‘মিতু।’
‘মিতু?’ রমেন্দ্র সত্যিই অবাক হলেন, ‘মানে মিতালি দাস? তিনি গল্প-উপন্যাস লিখতেন নাকি?’
সাহানা উত্তর দিল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাঁকনি আর কাপ নিয়ে ব্যস্ত হল।
রমেন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘যাকগে, যেটা বলতে এলাম। সন্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, মার্কশিট জাল করা আর মিতালি দাসকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে। মিতালি দাসের কবজিতে আর বাথরুম দিয়ে বাইরে যাওয়ার ওই সিঁড়িতে ওর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। নার্সিং হোমে যে সন্টুই ফোন করেছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে একটা সিসিটিভি ফুটেজ থেকে। আপনি সেদিন মধুগঞ্জ গিয়ে ওকে চিহ্নিত না করলে কাজটা এত সহজে হত না। তাই থ্যাংকস।’
সাহানা কোনো কথা না বলে কাপে চা ঢেলে, একটা প্লেট মুছে তাতে সেটা রাখল। তারপর এগিয়ে ধরল।
ওর মন বলছিল, ভদ্রলোক শুধু ধন্যবাদ জানাতে আসেননি।
রমেন্দ্র মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে কাপ-প্লেট হাতে নিলেন। তারপর বললেন, ‘দয়াসাগর আশ্রম আপাতত সিল করে দেওয়া হয়েছে। ওই মহারাজ আর বাকিদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে হেড অফিসে। সন্টু স্বাভাবিকভাবেই খুনের চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অনেক চিৎকার-চ্যাঁচামেচির ফাঁকে ও একটা অন্য ব্যাপার আমাদের জানিয়েছে। সেটা নিয়ে কথা বলতেই আপনার কাছে আসা।’
‘কোন ব্যাপার?’ সাহানার মনে হচ্ছিল, ওর বুকের ধুকপুক শব্দটা কি রমেন্দ্রবাবু শুনতে পাচ্ছেন?
সময় বহমান। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যাই হোক প্রলয় বা স্থিতি, সময় থেমে থাকে না। উচ্ছ্বাস থেকে শোক, সব কিছুই সময়ের প্রকোপে স্তিমিত হয়ে যায়। পাঞ্চালরাজ্যেও ফিরে এসেছে স্বস্তি।
দ্রুপদ ও শিখণ্ডী পিতাপুত্রের পারস্পরিক সম্পর্কেও দেখা দিয়েছে লক্ষণীয় উন্নতি। তবে মহামন্ত্রী চিত্রবানের আকস্মিক মৃত্যু রাজ্যে কিছুটা হলেও শোক ও আতঙ্কের আবহ সৃষ্টি করেছে নতুন করে।
কোনো এক গুপ্তঘাতকের আক্রমণে গভীর রাত্রে নিজপ্রাসাদে শয়নরত অবস্থায় নিহত হন চিত্রবান। রাজ্যের মহামন্ত্রী’র এহেন মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ামাত্র অস্থিরতা তৈরি হয়। অন্য এক অমাত্যের স্কন্ধে মহামন্ত্রীর দায়িত্ব ন্যস্ত হয় যথাশীঘ্র সম্ভব।
তবে শোকাহত দ্রুপদ শুধু এই পদক্ষেপটি নিয়েই শান্ত হননি। তাঁর আদেশে এখনও রাজ্যজুড়ে অনুসন্ধান চলছে, যাতে গুপ্তঘাতক এবং তার পশ্চাতে থাকা ষড়যন্ত্রীর পরিচয় জানা যায়।
এরই মধ্যে একদিন দ্রুপদ শিখণ্ডীকে ডেকে গোপন আলাপচারিতার মাধ্যমে আগামী পরিকল্পনার কথা জানালেন।
প্রাসাদের মধ্যে বজ্রপাত হলেও শিখণ্ডী এতটা বিস্মিত হতেন না। স্তম্ভিত হয়ে তিনি বললেন, ‘পিতা, এই দুই অনাথ শিশুকে আপনি ব্যবহার করবেন শুধুমাত্র কুরুবংশের সর্বনাশের জন্য?’
‘দুটি শিশুকে নয়।’ দ্রুপদ শিখণ্ডী’র ভ্রম সংশোধন করলেন, ‘শিশুপুত্রটি দ্রোণকে হত্যা করে আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে। আর কন্যাটি রাজপরিবারে ভাঙন ধরাবে।’
‘কিন্তু এসবের কি আর কোনো প্রয়োজন আছে, পিতা?’ শিখণ্ডী বললেন, ‘মহাদেবের আশীর্বাদ সত্য হয়েছে। যক্ষরাজ কুবেরের কৃপায় আমৃত্যু আমার পৌরুষ অটুট থাকবে। এই রাজ্যের ভাবী অধিপতি হিসেবে আপনার প্রতিজ্ঞা আমিই পূরণ করব। এটিই আমার সংকল্প!’
দ্রুপদ কিছুক্ষণ নির্বাক রইলেন। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘তোমাকে আঘাত দিতে চাই না, পুত্র। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের মন হওয়া উচিত লৌহকঠিন। বিগত যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর, বিশেষত অর্জুনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হয়ে তোমার রণভূমি ত্যাগের সংবাদটি পাওয়ার পর থেকে আমি তোমার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছি না। তোমার দেহ এখন পুরুষের হয়েছে, কিন্তু মন এখনও নারীর মতোই কোমল, সংবেদী। এমন দুটি নির্মম কার্য তোমার দ্বারা সম্পন্ন হবে, এই ভরসায় থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
শিখণ্ডী বজ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। গভীরতম দুঃস্বপ্নের মতো তাঁর মনে হল, তাঁরই জন্মদাতা তাঁকে যেন আবার নতুন করে রক্তাক্ত করছেন। পিতারই অঙ্গুলিহেলনে এক এক করে তাঁর দেহ থেকে অপসৃত করা হচ্ছে তাঁর আবরণ, আভরণ, উপাধি।
কিন্তু সেই অপসারণে কোনো প্রীতি নেই, আছে ঘৃণা, আছে তাচ্ছিল্য!
দ্রুপদ কি তাঁর এ’দশা উপলব্ধি করতে পারছিলেন? সম্ভবত নয়। বরং তিনি সোৎসাহে বলে চলেছিলেন নিজের নানা পরিকল্পনা।
শিখণ্ডীর মনে হঠাৎ অন্য এক প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটল। ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মহামন্ত্রী চিত্রবান কেন নিহত হলেন, পিতা? এই পরিকল্পনার মূল কাণ্ডারি কি ছিলেন তিনিই? তাই কি তাঁকে…?’
‘তুমি নারীর মতো কোমল হও বা পুরুষের মতো কঠিন, নির্বোধ নও, শিখণ্ডী! রাজায় রাজায় যুদ্ধে কত উলুখাগড়ার প্রাণ গেল, সেই হিসেব করা কি আমাদের সাজে?’ দ্রুপদ অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বলে দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন, ‘যেটা বলছিলাম শোনো। শিশুকন্যাটির নাম আমি রেখেছি দ্রৌপদী।’
‘দ্রৌপদী!’
‘অর্থাৎ দ্রুপদকন্যা। তবে যজ্ঞাগ্নি থেকে জাত, এই কথাটি প্রচারিত হয়েছে বলে ইতিমধ্যেই সে যাজ্ঞসেনী নামে পরিচিত হয়েছে। সে তোমার ভগিনী, শিখণ্ডী। তুমি এখন থেকে তাঁকে প্রকৃত জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতো করেই লালন কোরো। তাকে তুমি সেই কর্মের যোগ্য করে তোলো, যার জন্য এই বংশের একজন হয়ে তার নবজন্ম ঘটেছে। তাকে তুমি অর্জুনের উপযুক্ত করে তোলো!’
‘অর্জুন!’ শুষ্ককণ্ঠে বলে উঠলেন শিখণ্ডী।
‘সভায় প্রতিযোগিতা হবে ঠিকই।’ দ্রুপদের মুখে তির্যক হাসি দেখা দিল, ‘কিন্তু অর্জুন ছাড়া অন্য কেউ যাতে দ্রৌপদী’র পাণিগ্রহণ করতে না পারে, আমি সেই ব্যবস্থাই করব। ফলে দ্রৌপদী অর্জুনের কণ্ঠেই বরমাল্য দেবে। কিন্তু অর্জুন? তাঁকেও তো দ্রৌপদীর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। সেজন্য যা যা যোগ্যতা দ্রৌপদী’র মধ্যে কাঙ্ক্ষিত, সেগুলি যাতে তার আয়ত্ত ও অধীত হয়, তা তুমি নিশ্চিত করবে, পুত্র! রাজপরিবারে বধূরূপে প্রবেশ করে দ্রৌপদী নিজের অজ্ঞাতেই কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে বিভেদকে চূড়ান্ত এবং রক্তক্ষয়ী রূপ দেবে, এটিই এখন থেকে হবে আমার এবং তোমার লক্ষ্য!’
বিস্ফারিত চোখে দ্রুপদের দিকে তাকিয়ে রইলেন শিখণ্ডী। দ্রুপদ সুদক্ষ যোদ্ধা এবং সুশাসক, এ-কথা তিনি জানতেন। কিন্তু তিনি যে এমন একজন দূরদর্শী কূটনীতিজ্ঞ, তা তিনি ভাবেননি। সর্বোপরি, এই অক্ষক্রীড়ায় দ্রৌপদী’র মতোই নিক্ষিপ্ত হতে চলেছেন আরও একজন তৃতীয় পাণ্ডব, অদ্বিতীয় ধনুর্ধর অর্জুন! যাঁর প্রত্যাখ্যানের দহনজ্বালা শিখণ্ডীকে দগ্ধ করেছে এতদিন, তিনিই কিনা হবেন তাঁর ভগিনীপতি?
শিখণ্ডী’র মনে হল, প্রবল জ্বরে তিনি কাঁপছেন। তাঁর চেতনা যেন লুপ্ত হয়ে আসছে! পরবর্তী বেশ কিছুটা সময় কীভাবে কেটেছে, তা তিনি জানেন না।
প্রতিশোধস্পৃহায় তাড়িত ক্রোধান্ধ দ্রুপদ আরও বহু গুপ্ত পরিকল্পনা মেলে ধরেছেন তাঁর সম্মুখে। কখন সেই গোপন অধিবেশন সমাপ্ত হয়েছে, কখন তিনি রাজদরবার থেকে বেরিয়ে এসেছেন, কখন অশ্বপৃষ্ঠে প্রাসাদ ত্যাগ করে অজানার অভিমুখে ধাবিত হয়েছেন, এর কিছুই তাঁর শিখণ্ডীর জানা নেই!
প্রায়ান্ধকার পথে সহসা সম্বিৎ ফিরে পেলেন শিখণ্ডী। তিনি দেখলেন, বিশ্বস্ত অশ্বটি কোনো কারণে আর এগোতে চাইছে না। দিনমণি বিদায় নিয়েছেন, তবু এক বিষণ্ণ আলোকে আবৃত হয়ে আছে চরাচর।
তারই মাঝে এবার শিখণ্ডী’র দৃষ্টিতে ধরা দিল বেশ কিছুদূরে দণ্ডায়মান এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা। সেটি আলোকিত এবং রক্ষী-বেষ্টিত। পথ ছেড়ে সেদিকেই অশ্বকে চালিত করলেন শিখণ্ডী।
কিছুটা এগিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হলেন তিনি। এ তো কোনো শ্রেষ্ঠী, এমনকি অমাত্যের বাসগৃহ নয়! এ তো রাজপ্রাসাদ বলে মনে হচ্ছে! কম্পিল্যতে এমন কোনো প্রাসাদের অস্তিত্ব আছে নাকি?
তাছাড়া এ কি আদৌ কম্পিল্য? দূরে দেখা যাচ্ছে অনুচ্চ পাহাড়। সেই পাহাড়ের কোলে জমাট বেঁধে রয়েছে কুয়াশা।
এ কোথায় এসেছেন তিনি?
ঘোড়া থেকে নেমে এক পথচারীকে জিজ্ঞাসা করলেন শিখণ্ডী, ‘সামনের ওই প্রাসাদটির গৃহস্বামী কে, বলতে পারেন?’
‘মহাশয় কি এই অঞ্চলে নতুন নাকি?’ পথচারী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘ওটি তো আমাদের রাজা শিখীধ্বজের প্রাসাদ।’
রাজা শিখীধ্বজ! তিনিই তো পাঞ্চাল অধীনস্থ সেই ক্ষুদ্র সামন্ত রাজা, অরণ্যে যাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন শিখণ্ডী! চকিতে শিখণ্ডীর মনে পড়ে যায় কুম্ভক তথা শিখীধ্বজের স্ত্রী চূড়ালা’র কথা।
বিমূঢ় শিখণ্ডী নিজের অশ্বের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চাইলেন, তাঁর কোনো নির্দেশে সে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছে!
নাকি এ কোনো দৈবনির্দেশ?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন