শিখণ্ডী – ১৫

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

সাহানা তন্ময় হয়ে পড়ে চলেছিল। মিতুকে ও দেখেছে রাস্তাঘাটে, ট্রেনে বাসে অপমানিত হতে, সেও শুধুমাত্র অন্যদের চেয়ে শারীরিকভাবে আলাদা হওয়ার জন্য। সেই মিতুই সম্পূর্ণ অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছে মহাভারতের একটি অবহেলিত চরিত্রকে! শুধু শিখণ্ডীই বা কেন, ইলার মতো এমন একটি না-নারী-না-পুরুষ চরিত্র যে মহাভারতে ছিল, তা কতজন জানে?

এভাবে রক্তমাংসের শিখণ্ডীকে ক’জন বিশ্লেষণ করতে পেরেছে? মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলোর আড়ালে শিখণ্ডী যে তাঁর যন্ত্রণা নিয়ে মূকই রয়ে গেছেন এ-কথা জানেন ক’জন?

ঊর্ণা আর পলি হোস্টেলে ফিরল দেড়টা নাগাদ। তখন হোস্টেল পুরো ফাঁকা। সাহানা স্কুলে যেতে না-পারলেও বাকিরা যে যার নিজের কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে।

হাতের ব্যাগটা রেখে ধপাস করে খাটে বসল ঊর্ণা। বলল, ‘আর্টারি কাটতে না পারলেও যা ড্যামেজ হয়েছে, তাতে ভাস্কুলার সার্জারি না কী যেন করতে হবে। তাতে প্রাণে বেঁচে যাবে। কিন্তু ডাক্তারবাবু বললেন, কিছু নার্ভ পারমানেন্টলি ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে।’

‘সে কী রে!’ অস্ফুটে বলল সাহানা।

‘হ্যাঁ।’ পলি কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে রইল। তারপর বলল, ‘বেশ কিছু টাকা লাগবে। আমি আর ঊর্ণা এর মধ্যেই তিন-চার হাজার টাকার ওষুধ কিনেছি। তোর কাছে কি কিছু হবে?’

‘ফোনে বললে এর মধ্যেই তুলে রাখতাম।’ সাহানা বলল, ‘ঠিক আছে। খেয়েই বেরিয়ে এটি এম এ যাচ্ছি। চিন্তা করিস না। আমি টাকা দেব। মিতুকে বাঁচাতে হবে।’

‘থানায় ডেকে কী জিজ্ঞেস করল তোকে?’ ঊর্ণা প্রশ্ন করল।

‘সে-রকম কিছু না।’ সাহানা বলল, ‘গণপতিকাকা বলে এসেছে যে আমি ওর সঙ্গে থাকতাম। তাই টুকিটাকি মামুলি প্রশ্ন করল। মাঝখান থেকে আমার স্কুল যাওয়া হল না!’

‘কিন্তু মিতু সুইসাইড করতে গেল কেন সাহানা?’ উর্ণা বলল, ‘ওর কীসের দুঃখ? মণিময়দাও জানতে চাইছিলেন।’

সাহানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বিধায়ক মণিময় হাজরা-র সুপারিশেই মিতুকে ভরতি করা গিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তো এবার উঠবেই। ধীরে-ধীরে ও বলল, ‘কী জানি! সারাটা জীবন রাস্তাঘাটে, বাজারে, দোকানে মেয়েটা কম অপমানিত তো হয়নি। সেটাই হয়তো বাড়তে-বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছিল যে আর নিতে পারেনি শেষমেশ।’

‘সেদিন যে লোকটা মিতুর ঘরে এসেছিল, তাকে তুই আগে কখনও দেখেছিস?’

‘না।’ শক্তমুখে কথাটা বলে সাহানা স্নান করতে ঢুকল। সকাল থেকে একই কথার চর্বিত-চর্বণে ক্লান্ত লাগছিল ওর। যে মেয়েটা সমাজের এক কোনায় পড়ে থাকত, অবহেলায় বাঁচত, হঠাৎ করেই সে যেন সবার চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে, যেহেতু সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। মৃত্যু এভাবেই মানুষকে অমর করে দেয়!

বাথরুমেও স্বস্তি পেল না সাহানা। দরজায় হঠাৎ ধাক্কা দিতে লাগল ঊর্ণা।

‘কী হল?’ জামাকাপড় কাচতে কাচতে চেঁচিয়ে উঠল সাহানা। রোজ সকালে একটু দূরের কর্পোরেশনের টাইম কল থেকে জল ভরে নিয়ে এসে রাখতে হয়। দিনে চার বালতিতে ওর আর ঊর্ণার মোটামুটি হয়ে যায়। হয়ে না গেলেও চালিয়ে নিতে হয়। পাঁচশো পঁচিশ টাকা ভাড়ায় চব্বিশ ঘণ্টা জল পাওয়ার আশা করা স্বপ্নমাত্র।

কিন্তু আজ সকাল থেকে ঊর্ণা ছিল না, সাহানাও নানা ডামাডোলে একেবারে ভুলে গিয়েছিল। একটু আগে গিয়ে এক বালতিই নিয়ে আসতে পেরেছে। তাতে কাচাকুচি আর স্নান সারা মানে প্রায় অসাধ্য সাধন। তবু সেই চেষ্টাই করছিল সাহানা।

‘তোর ফোন এসেছে! লেখা রয়েছে রমেন্দ্রবাবু পুলিশ।’

জং ধরে লাল হয়ে যাওয়া কলের ট্যাপটা বন্ধ করল সাহানা। হতাশভাবে কাচা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে এল। ততক্ষণে কলটা কেটে গিয়েছে। ঊর্ণা বলল, ‘এই পুলিশটাই কি তোকে জেরা করতে ডেকেছিল?’

উত্তর না দিয়ে কল ব্যাক করল সাহানা। রমেন্দ্র’র মার্জিত, ঈষৎ ধারালো গলা ভেসে এল ফোনে, ‘মিস মজুমদার, আপনি দুপুরের খাওয়া সেরে রেডি হয়ে থাকুন। আপনাকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হবে।’

‘মানে?’ সাহানা অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায় যাব আমি?’

‘আমি নয়, আমরা।’ রমেন্দ্র’র গলায় একটা হালকা কৌতুক ভেসে উঠল, ‘আমরা যাব মধুগঞ্জ। তদন্তের জন্য।’

‘তদন্তের জন্য মধুগঞ্জে! মানে?’

‘মিতালি দাসের জ্ঞান ফিরেছে। ওঁকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।’

‘খুনের চেষ্টা! কে করল?’

সাহানা’র প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। তার আগেই লাইন কেটে গেল। পরপর দু-বার চেষ্টা করেও ও আর লাইন পেল না।

পাশে দাঁড়িয়ে ঊর্ণা মোক্ষম শব্দটা শুনেছিল। ও অবাক হয়ে সাহানাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মিতুকে খুন কে করবে? ওই লোকটা? তুই ওকে আবার দেখলে চিনতে পারবি?’

‘তুই যখন বললি, রেডিয়াল আর্টারির কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে, আমার তখনই সন্দেহ হয়েছিল।’ সাহানার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। দেয়ালে ভর দিয়ে নিজেকে সামলাল ও। তারপর বলল, ‘মিতু নিজে নার্স। সুইসাইড করতে চাইলে ও ঠিক জায়গাতেই কাটবে। কান ঘেঁষে বেরোবে কেন?’

‘তাইতো!’ ঊর্ণা বিড়বিড় করল, ‘মিতুর নাকি চাকরিটা চলে গিয়েছে!’

‘তুই কী করে জানলি?’ সরু চোখে তাকাল সাহানা।

‘তুই বাথরুমে ঢোকার পর সিমি এসেছিল। ওকে একতলার বিদিশা বলেছে। গণপতিকাকাকে নাকি পুলিশ জানিয়েছে। মিতুর চাকরি চলে গেল কেন সাহানা?’

‘আমি জানি না।’ বিরক্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাথরুমে ঢুকল সাহানা। দরজা বন্ধ করার আগে শুধু বলল, ‘ক’টা কথা ইদানীং বলতাম আমি ওর সঙ্গে?’

মধুগঞ্জ টাউন দক্ষিণবঙ্গের আর পাঁচটা মফসসলের মতোই। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে বিদ্যাধরী নদী। ফেরিঘাটের আশেপাশে প্রচুর ছোটো-ছোটো দোকানপাট, বাজারহাট। ক্যানিং বা নামখানার মতো অত ঘিঞ্জি না হলেও মধুগঞ্জ বেশ জনবহুল এলাকা। রমেন্দ্র আগে থেকেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন। গাড়িটা বাজার এলাকা পেরিয়ে আসতেই একটা মোটর সাইকেলে দ্রুত এগিয়ে এল। চালক হাত দেখিয়ে গাড়িটা থামিয়ে কাছে এসে বললেন, ‘নমস্কার স্যার, আমি সুখেন বাগচি, মধুগঞ্জ থানার কনস্টেবল। ওসিসাহেব আমাকেই পাঠালেন আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

‘বেশ তো!’ রমেন্দ্র মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘আপনি গাড়িতে উঠে আসুন। বাইকটা ছেড়ে দিন।’

মোটর সাইকেলের পেছনে আরও একজন বসে ছিলেন। সুখেনকে নামিয়ে দিয়ে বাইক চলে গেল। সুখেন গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।

‘আপনি ফোন করার পরে দয়াসাগর আশ্রম সম্পর্কে খবর নিয়েছি, স্যার।’ হলদেটে দাঁত বের করে হাসলেন সুখেন, ‘দয়াসাগর আশ্রম প্রপার মধুগঞ্জ থেকে অনেকটা ভেতরে, এখনও অজ পাড়া-গাঁ। প্রায় চল্লিশ বছর আগে আশ্রমটা খোলা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কী এক মহারাজ। মানে কোনো মিশন-টিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এদিককারই লোক, ইস্কুলে পড়াতেন। হঠাৎ উধাও হয়ে যান, তারপর বছরকয়েক বাদে বেশভূষা বদলে ফিরে আসেন। এই অঞ্চলেরই কয়েকটা গঞ্জে আশ্রম খোলা হয় তখনই। ফান্ডিং আসত বাইরে থেকে। তো, আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, সেইসময়ে আশ্রমের প্রধান ছিলেন জগদানন্দ মহারাজ।’

রমেন্দ্র সরকার, সুখেন বাগচী, কিংবা গাড়িতে বসে থাকা কনস্টেবল, কেউ খেয়াল করলেন না যে নামটা শোনামাত্র সাহানা চমকে উঠল।

রমেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনিই কি এখনও আছেন?’

‘না স্যার।’ সুখেন মাথা নাড়লেন, ‘২০০৪ সালে উনি মারা যান।’

‘ও। বয়স হয়েছিল বুঝি?’

‘না না। উনি কাজ করতে-করতে মারা যান। হার্ট অ্যাটাক বোধ হয়।’

দয়াসাগর আশ্রমটা একেবারেই সাধারণ। গেট দিয়ে ঢুকে দু-তিনটে ছোটো বাড়ি। মাঝখানে মাঝারি মাপের একটা মাঠ, পাশে পুকুর। একটা গোয়ালও আছে, সেখানে গোরু রয়েছে তিন-চারটে। পাশে ছোটো বাগান, তাতে কিছু মরশুমি তরিতরকারি ফলে আছে। শান্ত পরিবেশ। পাখির কিচিরমিচির ডাক।

রমেন্দ্র ঢিমে তালে এগিয়ে গেলেন। সেভাবে কাউকে চোখে পড়ছিল না সাহানা’র। রমেন্দ্রও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুখেনের দিকে তাকালেন। সুখেন বাঁ দিকে এগিয়ে বললেন, ‘এদিকে আসুন স্যার। ওই হলুদ বাড়িটাই আশ্রমের অফিসঘর। এখন একজন মহারাজ আছেন বটে, কিন্তু আসল ক্ষমতা নাকি পার্টির একটা চ্যাংড়া নেতার হাতে। তাকে আমি চিনি অবশ্য। লোকটার নাম সন্টু।’

১৬

নির্জন অরণ্যে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন শিখণ্ডী। বনবাসে এই একাকী কালযাপনের একটি অদ্ভুত ফল তিনি উপলব্ধি করেছেন।

ইদানীং তাঁর চিন্তায় রাজকুমারী অম্বা’র আনাগোনা নিয়মিত ঘটে! কখনও তিনি মানসপটে দেখেন, গভীর অরণ্যে রাজকুমারী অম্বা তপস্যা করছেন। অতি কঠিন সেই তপস্যা। সম্পূর্ণ নিরম্বু অবস্থায় কাটছে দিনের পর দিন।

আবার কখনও দেখেন, অম্বা গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন অরণ্যের ঋষিকুলের মাঝে। সকলেই তাঁকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘কন্যা, তুমি তোমার পিতার কাছে ফিরে যাও। এখন সেটাই তোমার একমাত্র আশ্রয়!’

‘না!’ সজোরে মস্তক আন্দোলিত করে দৃপ্তকণ্ঠে বলছেন অম্বা, ‘আমি কিছুতেই ফিরে যাব না। দয়া করে এই আদেশ করবেন না। আমার কোনো আশ্রয়ের প্রয়োজন নেই। আমার আশ্রয় আমি নিজেই। কিন্তু ভীষ্মকে নিধন না করা অবধি আমার শান্তি নেই।’

‘বীরশ্রেষ্ঠ পরশুরাম যেখানে পরাজয় স্বীকার করেছেন, সেখানে কে সেই স্পর্ধা দেখাবে, কন্যা?’ ঋষিরা সকলে মিলে অম্বাকে বোঝাতে উদ্যত হন, ‘দেবসেনাপতির দেওয়া সেই পুষ্পমাল্যটি কেউ গ্রহণ করার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারলেন না। আর তুমি চিন্তা করছ গাঙ্গেয়-নিধনের কথা?’

অম্বা’র আয়ত দুই সুন্দর চোখে টলটল করে অশ্রু। রুদ্ধকণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন, ‘যদি কেউ না পারে, জম্বুদ্বীপ যদি বীরশূন্য হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমি নিজেই না হয় বধ করব আমার পরম শত্রুকে!’

‘তুমি?’

‘হ্যাঁ। এমন অস্ত্রবিদ্যায় নিজেকে দীক্ষিত করব, যাতে আমি নিজেই আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি। সমরে পাতয়িষ্যামি স্বয়মেব ভৃগুদ্বহ। আমি নিজেই ভীষ্মকে হত্যা করে রণাঙ্গনে ভূপতিত করব!’

‘তা কী করে সম্ভব?’ সমস্বরে ধ্বনিত হয় ঋষিবাক্য। মনে হয়, যেন দৈববাণীর মতোই চরাচর আচ্ছন্ন করছে সে ধ্বনি, ‘তুমি যে একজন নারী!’

ধীরে ধীরে সেই শব্দ ক্ষীণ হয়ে যায়। রাজকুমারী অম্বার অশ্রুসিক্ত মুখখানিও যেন সেই ক্ষীয়মাণ শব্দের অনুসরণ করে ধীরে ধীরে লীন হয়ে যায় শিখণ্ডীর মধ্যে।

শিখণ্ডী চমকে ওঠেন। ‘তুমি যে একজন নারী’ এই বাক্যটি ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাঁর কর্ণকুহরে। ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায় সেই শব্দতরঙ্গ। অম্বার অশ্রুসিক্ত মুখখানিও যেন সেই ক্ষীয়মাণ শব্দকে অনুসরণ করে ধীরে-ধীরে লীন হয়ে যায় শিখণ্ডীর মধ্যে।

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ান শিখণ্ডী। অকস্মাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল রাজধানী কম্পিল্যের কথা। সেখানে কী ঘটছে এই মুহূর্তে? নববিবাহিতা কুলবধূ কি তাঁর পিতাকে সেই ক্ষমার অযোগ্য প্রতারণার সংবাদ প্রেরণ করেছেন? দশার্ণ অধিপতি হিরণ্যবর্মা’র নিষ্করুণ কটুবাক্যের কশাঘাতে কি রক্তাক্ত হচ্ছে দ্রুপদের সম্মান?

নিজের অজান্তেই শিখণ্ডী’র চক্ষু থেকে ঝরে পড়ল লবণাক্ত কয়েকটি বিন্দু। তাঁর জন্য তাঁর পিতা-মাতাকে আর কতবার অপমানিত হতে হবে? তার চেয়েও বড়ো কথা, দশার্ণ নরেশ এই তঞ্চকতায় ক্ষুব্ধ হয়ে পূর্বাপেক্ষা দুর্বল, অর্ধায়তন পাঞ্চালকে আক্রমণ করবেন না তো? কী হবে তাহলে?

‘কী ভাবছেন, রাজকুমার?’

সচকিত হলেন শিখণ্ডী। দেখলেন, অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছেন কুম্ভক। স্মিতমুখে তিনি বললেন, ‘চলুন। আজ একজনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব।’

শিখণ্ডী বিস্মিতমুখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘রাজা শিখীধ্বজের সঙ্গে তো সেদিনই পরিচয় হল, কুম্ভক। আরও কেউ আছেন বুঝি এই অরণ্যে?’

‘আছেন বই কি।’ কুম্ভক বললেন, ‘এই অরণ্যে এক অতিমানব বাস করেন। তিনি যক্ষ জাতিভুক্ত, নাম স্থূণকর্ণ।’

দেশের সুদূর উত্তরপ্রান্তে বসবাস করে যক্ষ নামের এই রহস্যময় জাতি। শিখণ্ডী শুনেছেন, শুধু শারীরিক বল নয়, নানারকম আধিদৈবিক ও অলৌকিক বিষয়েও এই জাতি সিদ্ধহস্ত। যক্ষজাতির প্রধান হলেন স্বয়ং দিকপাল কুবের।

‘এই অরণ্যের মাঝে যেদিন আপনাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আবিষ্কার করি, সেদিন স্থূণকর্ণও আমার সঙ্গে ছিলেন।’ বললেন কুম্ভক, ‘আপনার জ্ঞান ফিরে আসার আগেই উনি সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন। তাই তখন আপনার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। আপনার সঙ্গে আলাপচারিতার পর থেকে আমি নিয়মিত তাঁর সঙ্গেও মনুষ্যত্বের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করছি।’

শিখণ্ডী জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে কুম্ভকের দিকে তাকালেন। কুম্ভক বললেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই আমি আপনাকে একটি কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছি, মনুষ্যত্ব লিঙ্গ, ধর্ম বা বর্ণের গণ্ডি দ্বারা বদ্ধ নয়। বর্তমানে আপনার দেহ একই আধারে দুটি সত্তাকে ধারণ করেছে ঠিকই। কিন্তু তার জন্য লজ্জিত হওয়া অযৌক্তিক। জানি না এই সত্য আপনি কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।’

কিয়ৎকাল নীরবে পথ চললেন কুম্ভক ও শিখণ্ডী। পুনরায় কুম্ভক বললেন, ‘তবে এই মুহূর্তে এ’প্রশ্ন শুধুই তাত্ত্বিক নয়। বরং পাঞ্চাল রাজ্য এক প্রকাণ্ড বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে এই নিয়ে।’

‘সে কী!’ শিখণ্ডী উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘কী বিপদ?’

‘দশার্ণের রাজা হিরণ্যবর্মা পাঞ্চাল আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর কন্যার সঙ্গে তঞ্চকতা করা হয়েছে, এমনই তাঁর বক্তব্য। সেই অপরাধের শাস্তি পাবে পাঞ্চাল।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শিখণ্ডী। তিনি এই আশঙ্কাই করেছিলেন। হিরণ্যবর্মা শুধু রণকুশল নন। তাঁর স্বভাবও একজন সৈনিকের মতো কিছুটা হঠকারী, আবেগপ্রবণ, যুদ্ধপরায়ণ। বিবাহের নামে কন্যার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে, এ-কথা জানলে পিতা হিসেবে তাঁর মস্তকে ক্রোধানল প্রজ্জ্বলিত হয়ে বিবেচনা ও সংযমকে দ্রুত ভস্মীভূত করবেই। দশার্ণের সেনাবাহিনীর বিশালতা ও বীরত্ব সমগ্র ভারতবর্ষে বিখ্যাত। সদ্য রণবিধ্বস্ত পাঞ্চাল এই সমরের জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়।

কুম্ভক বললেন, ‘যুদ্ধঘোষণার আগে হিরণ্যবর্মা আপনার পুরুষত্বহীনতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে চান। সেই বিষয়ে তিনি এক দূত প্রেরণ করেছেন পাঞ্চাল রাজসভায়।’

‘কীভাবে সম্পন্ন হবে এই পরীক্ষা?’ শতদুঃখেও শিখণ্ডী’র মুখে কিঞ্চিৎ হাসি দেখা দিল।

‘ক’দিনের মধ্যেই তিনি পাঞ্চালে প্রেরণ করবেন এক রমণপটিয়সী বারাঙ্গনাকে। তাঁর সঙ্গে সহবাস করে পুরুষত্বের প্রমাণ দিতে হবে আপনাকে। অকৃতকার্য হলে হিরণ্যবর্মা পাঞ্চালরাজ্য আক্রমণ করবেন। মহারাজ দ্রুপদ তাই আপনার সন্ধানে সৈন্য প্রেরণ করেছেন।’

কুম্ভকের অনুচ্চ স্বরে বলা কথাগুলো শিখণ্ডী’র মনকে সচল করে তুলছিল। হতাশ, দ্বিধাদীর্ণ মনোভাবের কুয়াশা ছিন্ন করে দেখা দিচ্ছিল কূটনীতি ও রণকৌশলের আলোক। পাঞ্চাল রাজ্যের উত্তরাধিকারীর বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা তাঁর মধ্যে জাগ্রত হচ্ছিল। সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষে তিনি একজন ক্ষত্রিয়, একজন রাজপুত্র!

দশার্ণ আকারে আয়তনে সুবিশাল রাজ্য না হলেও সামরিক শক্তির দিক দিয়ে গোটা জম্বুদ্বীপে এখন সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। রাজা হিরণ্যবর্মা স্বয়ং একজন অতিশয় দক্ষ ও সুকৌশলী যোদ্ধা। কিন্তু এই সংঘাতের ফলে কূটনীতির ক্ষেত্রে পাঞ্চালের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে। কুরুবংশের বিরুদ্ধে আসন্ন সমরে দশার্ণ তো বটেই, হিরণ্যবর্মা’র মিত্রস্থানীয় কোনো রাজ্যেরই সহযোগিতা পাওয়া যাবে না! ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করাতে চেয়েছিলেন দ্রুপদ, তা কিছুতেই পূর্ণ হবে না।

‘একজন ক্ষত্রিয় হিসেবে রাজধর্ম পালন করাই আপনার কর্তব্য, কুমার।’ শিখণ্ডী’র মনোভাব উপলব্ধি করতে পারছিলেন কুম্ভক। তিনি শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘সেই ধর্ম পালন করাকেই আপনি অগ্রাধিকার দিন। পাঞ্চাল রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে আমরা সবাই চাই, দশার্ণ যেন আমাদের শত্রুরাজ্যে পরিণত না হয়।’

‘এই যুদ্ধ কীভাবে রুদ্ধ করা সম্ভব, কুম্ভক?’ চিন্তিত স্বরে বললেন শিখণ্ডী, ‘রাজা হিরণ্যবর্মার প্রেরিত বারাঙ্গনা নিজরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করলেই রণদামামা বেজে উঠবে। এ তো অবধারিত! আপনি কি অন্য কোনো পুরুষকে পাঞ্চালকুমার সাজিয়ে বারাঙ্গনার কাছে প্রেরণের পরামর্শ দেবেন? এক প্রতারণার অভিযোগ খণ্ডনের জন্য আর এক প্রতারণা করতে বলবেন! মার্জনা করবেন কুম্ভক। রাজধর্মের প্রথম শর্ত হল সততা। শঠতার সাহায্য নিয়ে এত বড়ো অন্যায় আমি করতে পারব না। তা ছাড়া এ -কথা পরে হলেও জানাজানি হবেই। তার পরিণাম কী হবে, তা ভেবেছেন?’

কুম্ভক বললেন, ‘আমি তা বলিনি, কুমার। বরং অন্য একটি উপায়ের সন্ধান দিতে চাই আমি।’

‘কী উপায়?’

কুম্ভক বললেন, ‘আজ আপনাকে যাঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছি, সেই যক্ষ স্থূণকর্ণ আমার পরম বন্ধু। কিছুকাল আগে তাঁর ঘোর বিপদ উপস্থিত হয়েছিল। সেইসময় আমি তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। পাঞ্চাল রাজ্যের এই দুঃসময়ে আমার অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারবেন না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।’

‘কিন্তু তিনি এই বিষয়ে কী করতে পারেন?’ দ্বিধাগ্রস্ত শিখণ্ডী বললেন।

কুম্ভক হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘স্থূণকর্ণ যক্ষ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ভেষজ-বিশেষজ্ঞ। তিনি অরণ্যের বিভিন্ন দুর্লভ উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন দীর্ঘকাল ধরে। এমন এক ভেষজ সংকরায়ণের মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করেছেন, যা সেবন করলে অতি দ্রুত মানুষের লিঙ্গান্তর ঘটে।’

স্তম্ভিত শিখণ্ডী দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ‘এ আপনি কী বলছেন, ঋষি! এ কি সম্ভব?’

কুম্ভক বললেন,’সময় অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করে তোলে কুমার। আজ যা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়, শতবর্ষ পরে দেখবেন সেটাই বাস্তব হয়ে উঠেছে। এভাবেই মানবসভ্যতা এগিয়ে চলে। এইজন্যই সমাজ প্রগতিশীল।’

‘কিন্তু লিঙ্গান্তরের অর্থ তো শুধুমাত্র যোনিকে লিঙ্গরূপ দেওয়া বা লিঙ্গকে যোনিতে পরিণত করা নয়।’ শিখণ্ডী বললেন, ‘শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যা নারী বা পুরুষকে প্রজননক্রিয়ায় সাহায্য করে, উত্তরপুরুষের আগমন পথ সুগম করে, সেগুলো ছাড়া নারী বা পুরুষের দেহ বৃন্তহীন পুষ্পের মতো। সেইসব জটিল দেহজ অঙ্গ কোন কৌশলে কৃত্রিমভাবে বানানো সম্ভব?’

কুম্ভক বললেন, ‘আপনি রাজ্ঞী চূড়ালাকে চেনেন, কুমার?’

শিখণ্ডী একটু চিন্তা করে বললেন, ‘নামটি পূর্বশ্রুত মনে হচ্ছে। কিন্তু কার কাছে শুনেছি, তা ঠিক মনে করতে পারছি না। কে তিনি?’

‘রাজা শিখীধ্বজের পত্নী। তিনি একজন যোগিনী। প্রাচীন ও লুপ্তপ্রায় নানা জ্ঞানের অধিকারিণী তিনি। ফলে নানা গুপ্তবিদ্যায় তাঁর পারদর্শিতা আছে। তিনি কিছুকাল আগে এক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তার মাধ্যমে পুরুষ নারীতে এবং নারী পুরুষে রূপান্তরিত হতে পারে দেহের অন্তর্গত আনুষঙ্গিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সহ।’

‘অন্তর্গত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সহ!’ সবিস্ময়ে শিখণ্ডী বললেন, ‘এও কি সম্ভব?’

কুম্ভকের মুখ এক বিচিত্র হাস্যে ভরে উঠল। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি শল্যচিকিৎসা বিষয়ে কিছু জানেন?’

‘নিশ্চয়!’ বললেন শিখণ্ডী, ‘বিশ্বামিত্র-পুত্র মহর্ষি সুশ্রুত’র সাধনা তথা বিদ্যা সম্পর্কে কে না জানে? ‘সুশ্রুত সংহিতা’ নামক মহাগ্রন্থটির জন্য মানবেতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে। রাজপরিবারের প্রত্যেক পুত্রসন্তান ওই গ্রন্থটির অন্তত কিয়দংশ অধ্যয়ন করে। আমি যেহেতু পুরুষরূপে লালিত হয়েছি, তাই ওই শাস্ত্র আমিও অধ্যয়ন করেছি।’

‘সুশ্রুত কর্তৃক আবিষ্কৃত শল্যচিকিৎসায় চূড়ালা শুধু দক্ষ নন, তাঁকে বিশেষজ্ঞও বলা চলে।’ বললেন কুম্ভক, ‘সেই অধীত বিদ্যার সঙ্গে তিনি বহু স্ব-উদ্ভাবিত তত্ত্ব সমাযোজিত করেছেন। শল্যচিকিৎসায় বহু নব-নব জ্ঞান তাঁর দ্বারাই আবিষ্কৃত হয়েছে। মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের পরিবর্তন তারই অন্যতম। তবে তাঁর এই আশ্চর্য জ্ঞান আজও গোপন রয়েছে বিশ্বের কাছে।’

শিখণ্ডী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘শিখীধ্বজের পত্নী এত বিদুষী! তা সত্ত্বেও তিনি অরণ্যে এসে আপনার কাছ থেকে জ্ঞান শ্রবণ করছেন কেন?’

‘মানুষ প্রকৃত দৃষ্টির তুলনায় আপাতদৃষ্টি বা পূর্বলব্ধ ধারণাকে যে অধিক গুরুত্ব দেয়!’ কুম্ভকের মুখে এক রহস্যময় হাসি দেখা দিল, ‘শিখীধ্বজও তার ব্যতিক্রম নন।’

‘বুঝলাম না!’

‘সাধারণত ‘কী শুনছি’ এই প্রশ্নের তুলনায় ‘কার কাছ থেকে শুনছি’ এই বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মানুষের মনে। রাজমহিষী’র প্রজ্ঞা নিয়ে শিখীধ্বজ প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু রানি যতই বিদুষী হন, পুরুষ হয়ে এক নারীর কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ শিখীধ্বজের পুরুষ-অহংকে আঘাত করেছিল। তাই মোক্ষলাভের জন্য জ্ঞান আহরণে রাজা ত্যাগ করেছিলেন সংসার। গৃহেই পরমজ্ঞানী গুরু থাকা সত্ত্বেও তিনি এখানে এসে নির্ভর করেছেন আমার মতো অরণ্যচারী পুরুষের ওপর। আপনিও তো সেদিন নির্দ্বিধায় বললেন, বুদ্ধিতে নারী পুরুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট! আসলে এই বৈষম্যের ধারণা যুক্তিহীনভাবে গেঁথে রয়েছে অধিকাংশ পুরুষের মনে। চাইলেই তাকে উৎপাটিত করা সম্ভব নয়!’

শিখণ্ডী সবিস্ময়ে দেখলেন, অন্তর্লীন উত্তেজনায় কুম্ভকের নাসাদ্বয় স্ফুরিত হয়েছে। তাঁর দৃষ্টি হয়েছে তীব্রতর। নিশ্বাসও হয়েছে পূর্বাপেক্ষা ঘন। তাঁর এই আবেগের কারণ বুঝতে পারলেন না তিনি।

বিস্ময়কে মনের প্রকোষ্ঠে বন্দি রেখে আপাতত শিখণ্ডী এগিয়ে চললেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

১৭

আশ্রমের বর্তমান অধ্যক্ষ হলেন ভোলানন্দ মহারাজ। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, রোগাটে গড়ন, চোখে একখানা ঢাউস চশমা, পরনে হালকা হলুদ আলখাল্লা।

ভোলানন্দ মহারাজের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর তিনজন ব্যক্তি। তাঁদের প্রত্যেকেরই পরনে একইধরনের আলখাল্লা, বয়স পঞ্চাশের নীচে। এঁরা সবাই আশ্রমের আবাসিক শিক্ষক। সবাইকে একপ্রস্থ জেরা করা হলেও তেমন কিছু তথ্য পাওয়া যায়নি।

রমেন্দ্র সরকার অফিসে বসে আশ্রমের পুরোনো রেজিস্টার দেখছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, ‘এই আশ্রমের ফান্ড ঠিক কোত্থেকে আসে বলুন তো?’

‘সজনেখালি-র একটা ট্রাস্ট থেকে।’ সুখেন ঝুঁকে পড়ে ফিশফিশ করলেন, ‘ওই সন্টু নেতা হওয়ার পর থেকেই আশ্রম ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। আগে এ-সব এত ঝকঝকে ছিল না স্যার!’

রমেন্দ্র’র পাশে বসে সাহানাও দেখছিল, ২০০৪ সালে মিতু এই আশ্রম থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। সেই বছরের পাশ করা ছাত্রদের তালিকায় একেবারে ওপরে জ্বলজ্বল করছিল সুমিত মাইতি’র নাম। আড়চোখে রমেন্দ্র’র দিকে তাকিয়ে সাহানা তাঁর মুখে কোনো পরিবর্তন দেখতে পেল না। বরং রমেন্দ্র ভোলানন্দ মহারাজকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি এখানে কত বছর ধরে আছেন?’

‘ষোলো বছর।’ মিনমিনে গলায় উত্তর দিলেন ভোলানন্দ।

‘তার আগে কোথায় ছিলেন?’

‘গোসাবা সেন্টারে। আজ্ঞে, দয়াসাগর ট্রাস্টের মোট চারটে সেন্টার। মধুগঞ্জ, গোসাবা, হিঙ্গলগঞ্জ আর ডায়মন্ডহারবার। ট্রাস্টের প্রধান দপ্তর সজনেখালিতে।’

‘আপনারা চারজন ছাড়া এই আশ্রমে আর কোনো শিক্ষক আছেন?’

‘না স্যার।’

‘এখানে কতজন ছাত্র আছে এই মুহূর্তে?’

‘আশিজন।’

‘আপনার আগে এখানে যিনি প্রধান ছিলেন, তাঁর নাম কী ছিল?’

ভোলানন্দ একটু ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন, ‘জগদানন্দ মহারাজ, স্যার!’

‘আপনি চিনতেন?’

‘সেভাবে আলাপ ছিল না। ট্রাস্টের হেড অফিসে এক-দু’বার মিটিং-এ দেখা হয়েছিল।’

‘তিনি কীভাবে মারা যান?’

ভোলানন্দ মহারাজ বিব্রতমুখে বললেন, ‘আমি খুব ভালোভাবে জানি না। উনি মারা যাওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পর আমি জয়েন করেছিলাম। শুনেছি, পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন। তার থেকেই!’

‘তখন এই আশ্রমের সেক্রেটারি কে ছিলেন?’

‘অজিত নিয়োগী। তাঁর অনেক বয়স হয়েছিল, মারা গেছেন এই কয়েক মাস হল।’

‘হুঁ।’ রমেন্দ্র সুখেনের দিকে তাকালেন, ‘থানায় ফোন করে ট্রাস্টের সজনেখালি অফিসে স্টাফ পাঠাতে বলুন। আমার সেই সময়কার ডিটেইলস লাগবে। বিশেষত জগদানন্দের মৃত্যু নিয়ে আশ্রমের কাছে কী রিপোর্ট ছিল, সেই বিষয়ে আমার জানা দরকার।’

সুখেন তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়লেন, ‘ওকে স্যার।’

ভোলানন্দ বিবর্ণমুখে বললেন, ‘কেন স্যার? কোনো সমস্যা হয়েছে?’

রমেন্দ্র উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরের দরজার পাল্লাদুটো সপাটে দু-পাশে ঠেলে ঘরে ঢুকল একজন। চোয়াড়ে মুখ, চুলটা লাল এবং খয়েরির মাঝামাঝি এক ভয়ংকর রঙে রাঙানো, গায়ে সাদা জামা। এক হাতে একটা মোটা লোহার বালা। সে ঢুকেই রুক্ষ সুরে বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার? কী হচ্ছে এখানে, অ্যাঁ?’

সুখেন চাপা গলায় বললেন, ‘যাঁর কথা বলেছিলাম, ইনিই তিনি, স্যার। সন্টু। আশ্রমের সেক্রেটারি সন্টু রায়।’ ডান হাত নেড়ে রমেন্দ্রকে দেখিয়ে তিনি সন্টুকে বললেন, ‘কলকাতা থেকে এরা একটা তদন্তের জন্য এসেছেন।’

‘তদন্ত!’ ভ্রূ কুঁচকে সন্টু সাহানা’র আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল। তবে সে কিছু বলার আগেই রমেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী করেন, মিস্টার রায়?’

রমেন্দ্র’র নীচু, ভারী গলার সামনে সন্টু দ্রুত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করল। তারপর বলল, ‘আমি একটা এডুকেশনাল সেন্টার চালাই। লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত বলে এখানকার এম এল এ সাহেব আমাকে হেব্বি ভালোবাসেন।’

‘বাহ, জেনে খুব খুশি হলাম!’ রমেন্দ্র নির্বিকার মুখে মাথা দোলালেন।

 সন্টু এবার অধৈর্য হয়ে উঠল, ‘দেখুন, এই আশ্রম একটা পবিত্র জায়গা। এখানে এভাবে এসে মহারাজকে জেরা করছেন। আপনার কাছে কোনো ওয়ারেন্ট বা অর্ডার আছে?’

রমেন্দ্র সন্টু’র একটা কথাও শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। রেজিস্টারের একটা পাতা দেখিয়ে বললেন, ‘২০০০ সালে এই আশ্রম থেকে পাশ করা ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে শেষে, থার্ড ডিভিশনে পাশ করা যে নামটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা জনৈক সন্টু রায়ের। আপনিও কি এই আশ্রমের ছাত্র ছিলেন?’

একটু হকচকিয়ে গেলেও উদ্ধত ভঙ্গিতে সন্টু বলল, ‘হ্যাঁ। কেন? থার্ড ডিভিশন পেলে এখানকার সেক্রেটারি হওয়া যাবে না এমন কোনো শর্ত আছে?’

‘অবশ্যই নেই।’ রমেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন, ‘আপনি মিতালি দাসকে চেনেন?’

সাহানা স্পষ্ট দেখল, সন্টু’র মুখটা পার্চমেন্ট কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। শুকনো গলায় সে বলে উঠল, ‘কে মিতালি দাস?’

‘চেনেন না?’ রমেন্দ্র যেন খুব অবাক হলেন। সন্টু’র কাছে এসে তিনি বললেন, ‘মিতালি গড়িয়ার এক হাসপাতালের নার্স। তাঁকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি আপনার নাম করেছেন।’

‘আজব তো!’ সন্টু চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে কোথায় আমার নাম করবে অমনি আমার মাথায় দায় চাপবে? আমি ওই নামে কাউকে চিনি না! আপনি এইভাবে আমাকে হ্যারাস করতে পারেন না অফিসার! আমি এক্ষুনি দু’তিনটে ফোন করলে তার ফল যে আপনার পক্ষে ভালো হবে না, সেটা ওই সুখেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন।’

‘আমার কী হবে, সে পরে দেখছি।’ রমেন্দ্র নির্বিকার মুখে কনস্টেবলের হাতে ধরা ফাইল থেকে একটা বড়ো কাগজ সন্টু’র নাকের সামনে তুলে ধরলেন, ‘আগে আপনি বরং এটা দেখুন।’

‘ক-কী এটা?’ ঘটনার আকস্মিকতায় তুতলে উঠল সন্টু।

রমেন্দ্র কাগজটা সাহানার দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এঁকে চিনতে পারেন, মিস মজুমদার?’

সাহানা একঝলক দেখেই বলল, ‘হ্যাঁ। এ তো মিতু। মিতালি দাস।’

‘এই সার্টিফিকেট অনুযায়ী মিতালি দাস ২০০৪ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। রয়েছে রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর। অথচ কী আশ্চর্য! মধ্যশিক্ষা পর্ষদের রেকর্ডে এই রোল নম্বরের কোনো অস্তিত্বই নেই!’

সবাই চুপ।

কাগজটা ফাইলে ভরে রমেন্দ্র সন্টু’র দিকে ঘুরে বললেন, ‘যে প্রতিষ্ঠান থেকে মিতালি ‘পাশ করেছিলেন’ সেটির নাম হল ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমি। নামটা কি চেনা লাগছে, মিস্টার রায়?’

১৮

‘অসম্ভব!’ মস্তক আন্দোলিত করলেন স্থূণকর্ণ। অচঞ্চল অথচ দৃঢ় ভঙ্গিতে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার এই ওষধি এখনও যথাযথভাবে পরীক্ষিত নয়। কিছু জীবজন্তুর ওপর এটি প্রয়োগ করেছি বটে, কিন্তু তার প্রভাব থাকে মাত্র এক দিবসকাল। কোনো মানবশরীরে এর ফলাফল এখনও দেখা হয়নি। এই অবস্থায় পাঞ্চাল রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারীর ওপর আমি এই ওষধি প্রয়োগ করে সম্ভাব্য সংকটকে আহ্বান করতে পারি না।’

‘পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করুন, স্থূণ!’ কুম্ভক অধীর কণ্ঠে বললেন, ‘পৌরুষের আয়ু এক দিবসকাল হলেও চলবে। দশার্ণ অধিপতি যে বারাঙ্গনাটিকে যুবরাজের কাছে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে পাঠাবেন, তাকে তৃপ্ত করতে এক নৈশপ্রহরই যথেষ্ট। পাঞ্চাল রাজ্যকে ভবিষ্যৎ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই বক্রপথ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’

‘কিন্তু এই ওষধি আপনার দেহের ক্ষতি করতে পারে, কুমার!’ স্থূণকর্ণ বিব্রত ভঙ্গিতে শিখণ্ডীর দিকে তাকালেন।

কুম্ভক উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে নিরস্ত করে শিখণ্ডী রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘ইতিমধ্যেই আমি শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, যক্ষ! এই ধরাধামে আমার জন্মও জড়িয়ে আছে এক শতাব্দীপ্রাচীন ক্ষতর সঙ্গে। তাই আপনার ওষধি এক রাত্রি কাজ করার পর যদি আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়, তাতেও আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। পাঞ্চালকে দশার্ণের রোষ থেকে রক্ষা করতে পারার পর মৃত্যুবরণ করতে হলেও তৃপ্ত হবে আমার আত্মা। এর চেয়ে গৌরবের মৃত্যু একজন ক্ষত্রিয়ের কাছে কী হতে পারে, বলুন?’

শিখণ্ডী স্তব্ধ হওয়ামাত্র কুম্ভক বললেন, ‘আপনি আর দ্বিমত করবেন না, স্থূণ! আপনি সম্মতিদান করলেই আমরা চূড়ালার সাক্ষাৎপ্রার্থী হব। দুই প্রকার চিকিৎসার সুফল নিশ্চিতভাবেই শিখণ্ডীকে পুরুষের অবয়ব ও ক্ষমতা দান করবে যাতে দশার্ণ পাঞ্চালের শত্রুরাজ্যতে পরিণত না হয়।’

‘দুই প্রকার চিকিৎসা?’ সন্দিহান দৃষ্টিতে কুম্ভকের দিকে তাকালেন স্থূণকর্ণ, ‘অপর কোনো পদ্ধতির কথা বলতে চাইছেন আপনি?’

নিম্নকণ্ঠে কুম্ভক বললেন, ‘চূড়ালা যদি অস্ত্রোপচারে সম্মত হন…!’

‘চূড়ালা আপনাকে শল্যচিকিৎসায় তাঁর সাফল্যের কথা বলেছেন?’ স্থূণকর্ণের কণ্ঠে গভীর বিস্ময় ফুটে উঠল।

কুম্ভক নীরব রইলেন। কিছু না বলেও যেন চোখে চোখে কিছু বার্তালাপ হল কুম্ভক ও যক্ষের।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইলেন স্থূণকর্ণ। তারপর তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার ওষধি এবং চূড়ালার শল্যচিকিৎসা এই দুইয়ের মিলিত প্রভাব অবশ্যই রাজপুত্রের দেহে পরিবর্তন আনয়ন করতে সক্ষম। অন্তত এক দিবসকালের জন্য এই পরিবর্তন তো অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু নীতিগতভাবে তা সম্ভব নয়, কুম্ভক!’

‘কেন?’ শিখণ্ডী ও কুম্ভক একসঙ্গে বলে উঠলেন।

স্থূণকর্ণ বিচলিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘যক্ষরাজ কুবেরের অনুমতি ব্যতীত আমি এই ওষধি কারুর ওপর প্রয়োগ করতে পারি না।’

কুম্ভক এবার এগিয়ে গিয়ে হাত রাখলেন যক্ষের স্কন্ধে। নম্র কণ্ঠে বললেন, ‘যক্ষরাজ কুবেরের অনুমতি যে শীঘ্র পাওয়া যাবে না তা তো আপনার অজ্ঞাত নয়, বন্ধু। পাঞ্চালরাজ্যের অন্তর্গত অরণ্যে অবস্থান করছেন আপনি। আশ্রয়দাতা রাজ্যের এই চরম বিপদে কি তার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না?’

দীর্ঘক্ষণ মৌন রইলেন স্থূণকর্ণ। শিখণ্ডী এবং কুম্ভকও নীরব রইলেন। তাঁদের পাশে শব্দের সৃষ্টি করল অরণ্যের প্রাণী ও পতঙ্গেরা। হাওয়ার স্পর্শে গুঞ্জরিত হল বৃক্ষপত্রাদি।

কিন্তু সময় যেন স্তব্ধ হয়ে রইল স্থূণকর্ণের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

দিবাবসান ঘটছিল। সূর্যদেব পশ্চিম দিগন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। অন্ধকার ঘিরে ফেলছিল বিশাল বনানীকে। মুখর পাখিরা ক্লান্ত দেহে ফিরে যাচ্ছিল নিজেদের বাসস্থানে। প্রকাণ্ড বৃক্ষরাজি যেন ক্রমেই মিশে যাচ্ছিল ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে।

শিখণ্ডী’র মনে হল, পাঞ্চালের রুদ্ররূপ সূর্যও যেন অস্তমিত হয়েছে, আর সেই অন্ধকার গ্রাস করছে চরাচরকে।

‘মাত্র চারটি দিন আমাদের হাতে আছে, হে যক্ষ।’ বলে উঠলেন শিখণ্ডী, তারপরেই কম্পিল্যে এসে পৌছোবেন দশার্ণের সেই বারবনিতা। তার পূর্বে আমাকে এই বন ত্যাগ করে ফিরে যেতে হবে রাজধানীতে। আবারও … আরও একবার এক ব্যর্থ পুরুষ হওয়ার লজ্জার হলাহল ধারণ করতে হবে আমাকে। আবারও এক নারীর দু’চোখে আমি দেখব ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, আর পাঞ্চালের সর্বনাশ!’

অরণ্যের ওপর আকাশ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছিল। শিখণ্ডী’র মনে হল, তিনি সেখানে একটা নক্ষত্রও দেখতে পাচ্ছেন না।

কেন? কেন এই অন্ধকারের অন্ধত্বেও তাঁর ঘুম আসে না?

যতবার চোখ বন্ধ করে সুষুপ্তির সন্ধান করেন শিখণ্ডী, ততবার তাঁর বদ্ধ নয়নের অপর দিকে আবির্ভূত হন দুজন। এক ভয়ংকর অগ্নিগোলকের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে আঙুল তুলে বিদ্রুপের হাসি হাসতে থাকেন তাঁরা।

প্রথমজন দশার্ণের রাজকন্যা, শিখণ্ডীর অগ্নিসাক্ষী করে বিবাহ করা বধূ।

আর দ্বিতীয়জন? তিনি তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন!

প্রথমজনের মুখে থাকে প্রতারণার ক্ষোভ এবং শিখণ্ডী’র পুরুষত্বহীনতার জন্য বিদ্রুপ।

আর অন্যজন সজ্জন, তাই মুখে থাকে স্মিতভাব। কিন্তু সেই ভাবের মধ্যেও প্রচ্ছন্নে লুক্কায়িত থাকে পরিহাস!

শিখণ্ডী ছটফট করেন। ছুটে যান অর্জুনের কাছে। উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘একবার! একবার আমাকে সুযোগ দিন, হে অর্জুন! অপরিণত হলেও এই নারীদেহ আপনাকে তৃপ্ত করবে এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আপনার ওই সুঠাম দেহের স্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে আমার এই বরতনু। দয়া করে সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ একবার দিন আমায়!’

অর্জুন দূর থেকেই সহাস্যে মাথা নাড়ান, ‘আপনি তো নারী নন, শিখণ্ডী! অপরিণত নারীদেহ আপনার! আর আপনাকে তো পূর্বেই বলেছি, আপনার অন্তরে বাস করছেন এক পুরুষ! সঠিক সময়ে তা প্রকাশ পাবেই।’

অর্জুনের বাক্য শেষ হওয়া মাত্র শিখণ্ডী আকুল চোখে তাকান তাঁর সদ্যপরিণীতা স্ত্রীর দিকে। কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘শুনলে? শুনলে তুমি প্রিয়তমা? আমি একজন পুরুষ! আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না। বিশ্বাস করো, তুমি প্রতারিত হওনি!’

শিখণ্ডী দেখেন, নববধূ তাঁর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে প্রস্থান করছেন। তাঁর মুখে খেলা করছে উপহাস। ধীরে ধীরে তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন দৃষ্টিপথ থেকে।

চিৎকার করে উঠতে চান শিখণ্ডী। কিন্তু তিনি অনুভব করেন, তাঁর কণ্ঠনালি হতে কোনো শব্দ নির্গত হচ্ছে না। বরং কষ্টে, অপমানে তাঁর চোখের আড়াল থেকে মুক্তি পায় অশ্রুধারা। তাঁর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। অজস্র প্রাণ ও অপ্রাণে পূর্ণ এই বিশ্বচরাচরে তিনি যেন ক্রমশই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে থাকেন।

‘কুমার! কী হয়েছে আপনার? আপনি কি সুস্থ বোধ করছেন না?’

কুম্ভকের সোচ্চার আহ্বানে সহসা বাস্তবে ফিরে আসেন শিখণ্ডী। বস্ত্রে স্বেদবিন্দু মুছে বলেন, ‘আমি ঠিক আছি।’

কুম্ভক অধীর কণ্ঠে বলেন, ‘আপনি কি শুনলেন? স্থূণকর্ণ আপনাকে সাহায্য করতে সম্মত হয়েছেন, রাজকুমার! আপনার ওপর প্রয়োগ করা হবে সেই ওষধি। আর হ্যাঁ, চূড়ালাও সম্মতি জানিয়েছেন শল্যচিকিৎসায়!’

তৃণশয্যায় শরবিদ্ধ-বৎ চমকে উঠলেন শিখণ্ডী।

১৯

‘যাওয়ার সময়ও দেখলাম, এখনও দেখছি। এত মন দিয়ে কী পড়ছেন?’

রমেন্দ্র’র কথায় সাহানা একটু চমকে উঠে মুখ তুলল। ও সত্যিই একেবারে ডুবে গেছিল মিতু’র লেখা এই মহাকাব্যিক আখ্যানে। জানালার দিয়ে আসা হাওয়ায় উড়ছিল ওর চুলগুলো। কিন্তু ওর মুখে যে হাওয়া ধাক্কা মারছিল তাতে মিশে ছিল পাঞ্চালের সেই অরণ্যের বনজ ঘ্রাণ। তারই সঙ্গে ছিল সহস্রাব্দী পূর্বের সেই চরিত্রদের পরিণতি নিয়ে উত্তেজনা আর আশঙ্কা। খাতাটা বন্ধ করে একটা লম্বা নিশ্বাস নিল সাহানা। তারপর বলল, ‘মহাভারত।’

‘মহাভারত?’ রমেন্দ্র সত্যিই অবাক হলেন, ‘সেই অর্জুন, দ্রৌপদী, দুর্যোধন? আগে পড়েননি?’

‘এটা অন্য মহাভারত।’ কথাটা বলে দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল সাহানা, ‘আচ্ছা, আপনি তো বললেন যে মিতুর জ্ঞান ফিরেছে। ও এখন কেমন আছে?’

‘এখনও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়ার অবস্থা আসেনি।’ চিন্তিত মুখে বললেন রমেন্দ্র, ‘আপনি কি নিশ্চিত যে ওই সন্টু রায়ই সেদিন আপনাদের হোস্টেলে গিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ।’ জোর দিয়ে বলল সাহানা, ‘আমি সেদিন মুখে একটা ফেস প্যাক মেখে ঘরে বসে খাতা দেখছিলাম। আমার ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটেই মিতুর ঘরে গিয়েছিল সন্টু। আমার সঙ্গে একবার চোখাচোখিও হয়েছিল। আমার মুখে প্যাক লাগানো ছিল, তাই বোধহয় আজ আমাকে চিনতে পারেনি।’

‘মিস ঊর্ণাও সাক্ষ্য দিয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় মিতালি দাস বেশ কয়েকবার ওই নামটা বলেছেন।’ রমেন্দ্র মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের কথার ভিত্তিতেই সন্টুকে অ্যারেস্ট করবে মধুগঞ্জ থানা। ওয়ারেন্ট তৈরি হচ্ছে।’

সাহানা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘মিতু মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট জাল করে চাকরিতে ঢুকেছিল বলেই কি নার্সিং হোমের চাকরিটা চলে গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। জাল রেকর্ড কাজে লাগিয়ে চাকরিতে ঢোকার অপরাধে মিতু’র নামে একটা এফ.আই.আর-ও করেছে ওই নার্সিং হোম।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাহানা। মুখ নীচু করে বলল, ‘মিতু নার্সিংও পড়েছে মিতালি দাস নামের ওই জাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে, তাই না? নিজের ‘সুমিত মাইতি’ নামের ভালো রেজাল্টটা বেচারি কোনো কাজেই লাগাতে পারেনি। কিন্তু মিতু এতবছর ধরে কাজ করছে। হঠাৎ এখন নার্সিং-হোম কর্তৃপক্ষ কীভাবে এই বিষয়ে জানতে পারলেন?’

‘কেউ ফোন করে নার্সিং হোমে জানিয়েছিল। তারপর নার্সিং হোম ব্যাপারটা যাচাই করে দেখেছে। যাদবপুরের একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে করা হয়েছিল ফোনটা। যদুলাল, গাড়ি দাঁড় করাও সাইড দেখে।’ রমেন্দ্র সাহানাকে বললেন, ‘আসুন। মাথাটা কেমন জ্যাম হয়ে রয়েছে। চা না খেলে ঠিক হবে না।’

সাহানা গাড়ি থেকে নামল। এর আগে এদিকে কখনও আসেনি সে। রাস্তার পাশের একটা দোকান থেকে ঘন দুধ-চা দিয়ে যেতেই ও বিনাবাক্যব্যয়ে তাতে চুমুক দিল। সেই কখন ভাত খেয়ে হোস্টেল থেকে বেরিয়েছিল। তারপর এত কিছু ঘটে গেছে!

পাশেই বাসন্তী হাইওয়ে। দূরে দেখা যাচ্ছিল একটি বহুজাতিক আই.টি. কোম্পানির ক্যাম্পাস। রমেন্দ্র চা-র পুরু সরটা চামচ দিয়ে তুলে একপাশে ফেললেন। তারপর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মিতালি দাসের কাজকর্ম নিয়ে নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষের কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু মার্কশিট জাল থাকার কথাটা তাদের কাছে তোলা হলে তারা মিতু’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। এখন প্রশ্ন, ওই ফোনটা কে করতে পারে?’

‘মিতু’র কোনো শত্রু তো সেই অর্থে ছিল না।’ সাহানা বলল। রমেন্দ্র’র মধ্যে যে রুটিন কাজের পাশাপাশি সত্যিটা জানার একটা আগ্রহ আছে, সেটা ও বুঝতে পারছিল। ওর যা মনে হচ্ছিল, সেটাই বলে ফেলল এবার, ‘ফোনটা কি সন্টু রায় করতে পারে?’

‘সন্টু রায় এই নিয়ে মুখ খুললে ওর ওই ‘ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমি’-র দু’নম্বরি কারবারই সবার সামনে এসে পড়বে।’ থেমে থেমে বললেন রমেন্দ্র, ‘ওর ওই সংস্থায় আজ আমাদের একটা টিম যাবে। দক্ষিণবঙ্গের এমন গঞ্জগুলোতে জাল মার্কশিটের ব্যাবসা হয়েই থাকে। শুধু মার্কশিট কেন? এখানে সরকারি আর ভালো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন অভাব যে সব ক্ষেত্রেই জালিয়াতদের রমরমা চলে। মাঝে মাঝে ধরপাকড় চলে, তারপর আবার ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে। তবে আসল ব্যাপার সেটা নয়। মিতালি দাস ছেলে সেজে মাধ্যমিক দিয়েছে, পরে মেয়ের নামে মার্কশিট জোগাড় করে নার্সিং পড়েছে। এই অবধি বোঝা গেল। কিন্তু সন্টু রায় কেন মিতালি দাসকে খুনের চেষ্টা করবে?’

‘মিতু এই খুনের চেষ্টা নিয়ে ঠিক কী বলেছে, সেটা আমাকে একটু বলতে পারবেন?’ সাহানা অস্বস্তি নিয়েই বলল, ‘তদন্তের এ-সব কথা আমাকে বলতে অসুবিধে থাকলে অবশ্য…!’

‘কোনো অসুবিধে নেই।’ ফাঁকা গ্লাসটা রেখে দিয়ে বললেন রমেন্দ্র, ‘সেদিন উনি ডিউটি করে এসে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ কেউ একজন দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। উনি ভেবেছিলেন, আপনারাই কেউ হয়তো ওঁকে ডাকছেন। দরজা খুলে দিতেই ওঁর ওপর হামলা হয়। প্রথমে ওঁর গায়ে কেরোসিন তেল ছিটিয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল।’

‘আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা!’

‘ইয়েস! কিন্তু সামহাউ হয়তো চিৎকার শোনা যেতে পারে বলে সেটা শেষ অবধি করা হয়নি। কিন্তু মারধর করা হয়। তখন মাথায় একটা আঘাত পাওয়ার ফলে ওঁর চশমাটা পড়ে গেছিল। সবমিলিয়ে ওঁর তখন সেভাবে লড়ার ক্ষমতা ছিল না, তাও উনি বাধা দিয়েছিলেন। তখন আততায়ী ওঁর মাথায় আর একটা ঘা দিয়েছিল। তারপরেই কবজির শিরা কাটার চেষ্টা করা হয়। অপরাধী চেয়েছিল, রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু হোক আর সবাই যেন ভাবে যে উনি সুইসাইড করেছেন। ডাক্তার বলেছেন, আর কয়েক সেন্টিমিটার এদিক-ওদিক হলেই মারাত্মক ক্ষতি হত। কিন্তু আমাদের মাথায় সহজ প্রশ্ন এসেছিল, সুইসাইড করার হলে একজন নার্স ঠিকঠাক শিরা চিনবেন না কেন?’

‘কিন্তু দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।’

‘সেটা তো সবাই জানেন। এমনকি আবাসনের বাইরে যে ট্রাফিক সার্জেন্ট ডিউটি করছিলেন, তিনিও দরজায় ধাক্কা দেওয়ার ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। কিন্তু মিতালি দাসের ঘরের ভেতরের বাথরুম দিয়ে ছাদে যাওয়ার একটা সিঁড়ি আছে। সেখান দিয়েও তো কেউ বেরিয়ে যেতে পারে।’ সরু চোখে তাকালেন রমেন্দ্র।

সেই বাথরুমের সিঁড়িটা! সাহানা বলল, ‘মিতু দেখেছিল যে সন্টুই ওর ওপর হামলা করেছিল?’

‘তাইতো ওঁর বয়ান বলছে!’

‘কিন্তু সন্টু ওকে কেন মারতে চাইবে?’

দূরে কোথাও বোধহয় বৃষ্টি নেমেছিল। তার ছোঁয়ায় ঠান্ডা হয়ে গেছিল বাতাস, আশপাশ। সাহানা’র হঠাৎ শীত করে উঠল।

রমেন্দ্র চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার উঠে গাড়িতে বসলেন। সাহানাও বসার পর বললেন, ‘আপনার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবেন?’

‘দেখা করা যাবে?’ সাহানা ছটফটিয়ে উঠল, ‘কখন?’

‘এখনই। চলুন নার্সিং হোমে।’ সংক্ষেপে বললেন রমেন্দ্র, ‘আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলুন। দেখুন না, সন্টু’র মোটিভটা বোঝা যায় কি না। নইলে কিন্তু কেস দাঁড়াবে না।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন