শিখণ্ডী – ৩০

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

চূড়ালা’র মুখ নীরব হাস্যে উদ্ভাসিত হয়েছিল।

শিখণ্ডী অভিভূত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শিখীধ্বজ-পত্নীর দিকে। তাঁর প্রত্যয় হচ্ছিল না, এই নারীই নিজের স্বামীর চৈতন্যলাভের জন্য অরণ্যে বাস করেছেন রাতের পর রাত, অনায়াসে পরিণত হয়েছেন পুরুষে।

সর্বোপরি, সেই নারী’র রূপরাশির মধ্যে শিখণ্ডী খুঁজছিলেন নিজের মিত্র কুম্ভককে। তাঁর চোখে চূড়ালার রূপ প্রতীয়মান হচ্ছিল না, প্রবল হয়ে ধরা দিচ্ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটিই!

নিজের প্রদেশে পাঞ্চাল রাজকুমারের আগমন সংবাদ পাওয়ামাত্র রাজপ্রাসাদে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। শিখীধ্বজ শশব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। সাদর আপ্যায়নের অন্তে শিখণ্ডীকে নিয়ে আসা হয়েছিল প্রাসাদের অন্তঃপুরে।

‘আমাকে মার্জনা করবেন কুমার।’ বিনীত ভঙ্গিতে বলেছিলেন শিখীধ্বজ, ‘অরণ্যে আপনাকে দেখে একবারেই চিনতে পারিনি! যেদিন নিজরাজ্যে ফিরে আসছি, সেদিন সেই অরণ্যচারী সাধক কুম্ভক আপনার প্রকৃত পরিচয় আমাকে জানান। তখন থেকে আমি অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি। ক্ষমাপ্রার্থনা করে দূতও প্রেরণ করেছি কম্পিল্য নগরীতে। জানি না, সেই বার্তা আপনার হাতে পৌঁছেছিল কি না।’

শিখণ্ডী বুঝতে পারলেন, শিখীধ্বজ আজও জানেন না কুম্ভকের প্রকৃত পরিচয়। যক্ষবিদ্যায় পারদর্শিনী চূড়ালা নীরবে স্বামীকে ফিরিয়ে এনেছেন নিজগৃহে।

শিখীধ্বজ পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন তার পরেই, ‘আমার স্ত্রী চূড়ালা। জ্ঞানে ও গুণে আমার তুলনায় শ্রেষ্ঠতর এই মানুষটিকে সহধর্মিণীরূপে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, যুবরাজ। তবে এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, কুম্ভকই আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেছিলেন। তাঁর কথা শুনেই উপলব্ধি করেছিলাম, জ্ঞানীর কোনো লিঙ্গভেদ হয় না। পুরুষ অহং আসলে মানুষকে অবনমনের পথে নিয়ে যায়।’

‘অসাধারণ আপনার চিন্তনশক্তি, শিখীধ্বজ!’ মুগ্ধ হলেন শিখণ্ডী।

শিখীধ্বজ সগর্বে হাসলেন, ‘এই প্রদেশটি এখন আমি এবং চূড়ালা যৌথভাবেই শাসন করি, রাজকুমার! আমরা দুজনেই যুগ্মপ্রধান এই অঞ্চলের। এও স্বীকার্য যে, কূটনৈতিক বা সামরিক সিদ্ধান্ত চূড়ালাই নিয়ে থাকেন। তাঁর দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা যে আমার চেয়ে অনেক বেশি!’

শিখণ্ডী নীরবে নমস্কার করলেন। চূড়ালাও প্রতিনমস্কার জানালেন। তিনি অনবগুণ্ঠিতা, সাবলীল। শুধু রাজমহিষী নন, একজন শাসিকার ব্যক্তিত্ব নিয়ে সহজ সুরে তিনি বললেন, ‘আপনাকে অতিথিরূপে পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছি, রাজকুমার। আশা করি পাঞ্চালরাজ এবং তাঁর পরিবারের সকলে ভালো আছেন।’

‘হ্যাঁ। সব সংবাদই উত্তম।’ স্বল্পকথায় উত্তর দিলেন শিখণ্ডী। তাঁর মনের মধ্যে উথালপাতাল হচ্ছিল। একদিকে জীবনের একমাত্র বন্ধুটিকে ফিরে পাওয়ার পুলক, অন্যদিকে বন্ধুর সঙ্গে সহজ না হতে পারার সংকোচ, আড়ষ্টতা তাঁর মনকে বিদীর্ণ করে তুলছিল।

কীভাবে সেই আরণ্য বন্ধুত্বকে ফিরিয়ে আনবেন তিনি? কুম্ভকের সেই বন্ধুত্ব যে তাঁর জীবনীশক্তি!

দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের যুযুধানে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন তিনি।

এমন সময় এক অমাত্য এসে মৃদু স্বরে কিছু বলতেই শিখীধ্বজ উঠে দাঁড়ালেন। করজোড়ে বললেন, ‘মার্জনা করবেন যুবরাজ। বিশেষ কারণে আমাকে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। আপনি দয়া করে রাণি চূড়ালার সঙ্গে বাক্যালাপ করুন। কোনো অস্বস্তির প্রশ্ন নেই। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এই রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য এর লিঙ্গসাম্য। আমি স্বল্পকালের মধ্যেই ফিরব। যে-কোনো প্রয়োজনে পরিচারকদের বলতে ইতস্তত করবেন না।’

শিখীধ্বজ প্রস্থান করলে চূড়ালা ও শিখণ্ডী নীরব হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। পাশে দুই পরিচারক ব্যজন করে চলল। দূর হতে ভেসে আসা মৃদু শব্দ, বাতাসে মিশে থাকা হালকা ভেষজ সুঘ্রাণ! শিখণ্ডী’র মনে হল, তিনি যেন সেই অরণ্যের মধ্যেই অবস্থান করছেন।

কিছুটা সহজ হয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘চূড়ালা, আমি… আমি যদি আপনাকে কুম্ভক বলে ডাকি, কোনো আপত্তি আছে? আপনি ছিলেন আমার একমাত্র বন্ধু। বন্ধুর তো কোনো লিঙ্গভেদ হয় না।’

‘লিঙ্গভেদ হয় না? তুমি নিশ্চিত? তবে আমাদের সেই বন্ধুত্ব ‘তুমি’ থেকে আবার ‘আপনি’তে উত্তীর্ণ হল কী করে? উত্তরণ বলব, না অবতরণ?’ চূড়ালা সকৌতুকে বললেন।

শিখণ্ডী আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন, ‘কুম্ভক! যখন আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল, তুমি ছিলে পুরুষ, আর আমি? পুরুষবেশী নারী! আর আজ! আমাদের লিঙ্গসত্তা আজ সম্পূর্ণ বিপরীত। তবু… তবু তুমি, তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু! সে যতই আমি পুরুষ, তুমি নারী হও না কেন!’

 চূড়ালা স্মিত হাসলেন, ‘আমি তো বলেইছিলাম, আমার কাছে লিঙ্গসত্তা অত্যন্ত গৌণ। পুরুষ এবং নারী, দু-জনকেই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন সমমর্যাদায়। প্রকৃতির নিয়মে বংশগতি অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে সৃষ্টি করতে হয়েছে তাদের বিপরীত ও পরিপূরক প্রজনন ব্যবস্থা। এটুকুই নারী ও পুরুষের প্রভেদ। বুদ্ধিতে, মেধায়, মননে লিঙ্গের কোনো অবদান নেই, প্রভাবও নেই। নারীদের পশ্চাদবর্তী করেছে আমাদের সমাজ, আমাদের সময়। প্রকৃতিকে তার জন্য দোষারোপ করা অনুচিত। বন্ধুত্বের সাম্যেও সেই বিভেদকে আরোপ করা অনুচিত।’

‘তা বুঝেছি কুম্ভক।’ শিখণ্ডী বললেন, ‘কিন্তু একটি কথা বলো। লিঙ্গসত্তাকে যদি গুরুত্ব নাও দিই, তাহলে সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবেও কি পারস্পরিক আকর্ষণকে আর গুরুত্ব দেওয়া চলবে না? হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা কি সেক্ষেত্রে মূল্যহীন হয়ে পড়বে?’

‘হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক, শিখণ্ডী।’ চূড়ালা বললেন, ‘ভালোবাসাই তো পৃথিবীকে সজীব রাখে। কিন্তু সেই ভালোবাসা শর্তহীন, স্বার্থহীন, উদ্দেশ্যহীন হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সম্পর্ক বিষিয়ে যায়।’

গভীর চিন্তায় মগ্ন রইলেন শিখণ্ডী। দ্বিধাদীর্ণ মনোলোকের বিভাজনের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করে প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ, শুধুমাত্র এক মানব হিসেবে কাউকে দেখা কীভাবে সম্ভব?

সমাজ কি কোনোদিন সেই স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারবে? মানসিকতার সেই উদবর্তন কি কখনও অনুমোদন পাবে রাষ্ট্রের বা সমাজের?

পাশের প্রশস্ত বাতায়ন দিয়ে এসে পড়ছে নম্র চন্দ্রালোক। সেই আলো সিক্ত করে তুলছে দুজনকেই।

সহসা আসন ত্যাগ করে কক্ষান্তরে গমন করলেন চূড়ালা। তিনি ফিরে এলেন মুহূর্তকাল পরেই, হাতে একটি স্বর্ণপাত্র নিয়ে। সেটি প্রসারিত করে বললেন, ‘এই ওষধিটি সেবন করো, শিখণ্ডী।’

কুম্ভককে প্রাণাধিক বিশ্বাস করেন শিখণ্ডী। বিনা-প্রশ্নে হাত বাড়িয়ে পাত্রটি নিয়ে তিনি মুখগহ্বরে ঢেলে দিলেন অর্ধতরল পদার্থটি।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র!

তাঁর সম্মুখের দৃশ্যপট দ্রুত পালটে গেল। তিনি পৌঁছে গেলেন এক দশক পরের পাঞ্চাল রাজ্যে।

শিখণ্ডী দেখলেন, ব্রাহ্মণবেশে পঞ্চপাণ্ডব এসে উপস্থিত হয়েছেন কম্পিল্য নগরীতে। দ্রৌপদী’র স্বয়ংবর সভার প্রকাণ্ড আয়োজনে সেখানে শুরু হয়েছে মহোৎসব। যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব মুণ্ডিত মস্তক ও ব্রাহ্মণবেশ সত্ত্বেও তিনি প্রত্যেককেই চিনতে পারলেন। সেই সারিতে, একেবারে কোণে বসে থাকা মানুষটিকেও চিনতে পারলেন তিনি, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন! সময় অর্জুনের যৌবনকে করে তুলেছে আরও পরিণত, আরও প্রবল, আরও প্রকট।

শিখণ্ডী’র সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল তাঁকে দেখে। আজ তিনি পরিপূর্ণ পুরুষ, তবু যেন অন্তঃসলিল মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হল।

তিনি শুনতে পেলেন, অর্জুনকে ফিশফিশ করে বলছেন এক স্থানীয় ব্রাহ্মণ, ‘জানেন তো, মহাত্মা দ্রুপদের কন্যা যজ্ঞবেদি থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন?’

‘অর্থাৎ?’ সবিস্ময়ে বলছেন অর্জুন, ‘তিনি যোনিজাতা নন?’

‘না।’ ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে বলছেন সেই ব্রাহ্মণ:

‘যজ্ঞসেনস্য দুহিতা দ্রুপদস্য মহাত্মনঃ
বেদীমধ্যাৎ সমুৎপন্না পদ্মপত্রনিভেক্ষণা।।
দর্শনীয়া’নবদ্যাঙ্গী সুকুমারী মনস্বিনী
ধৃষ্টদ্যুম্নস্য ভগিনী দ্রোণশত্রোঃ প্রত্যাপিনঃ।।*
(* মহাভারত আদিপর্ব)

এক দশক পূর্বে রাজা দ্রুপদ এক ভীষণ যজ্ঞ করেন। সেই প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞাগ্নি থেকে কবচ, তরবারি, ধনু ধারণ করে উঠে আসেন ধৃষ্টদ্যুম্ন ও তাঁর ভগ্নী দ্রৌপদী। যজ্ঞাগ্নি থেকে উচ্চারিত হয়, ওই পুত্রই হবে হস্তিনাপুরের অস্ত্রগুরু দ্রোণের মৃত্যুর কারণ। আর কন্যা দ্রৌপদী পরমাসুন্দরী, উপযুক্ত পাত্রকেই বেছে নেবেন পতিরূপে।’

‘পতিনির্বাচনের শর্ত কি শুধু পাত্রের বাহ্যিক রূপ?’ প্রশ্ন করলেন অর্জুন।

‘একেবারেই নয়।’ ব্রাহ্মণ সজোরে প্রতিবাদ করলেন, ‘ওই দেখুন, এক বিশেষ ধনুক নির্মাণ করা হয়েছে এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে। মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধা ছাড়া কারও পক্ষে সেই ধনুক উত্তোলন করাই সম্ভব নয়। ওই যে আকাশে ভাসমান কৃত্রিম যন্ত্রটি, ওখানেই রয়েছে একটি লক্ষ্য। যিনি ওই ধনুতে গুণরোপণ করে পাঁচটি বাণের সাহায্যে ওই ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তিনিই কন্যাকে লাভ করবেন স্ত্রীরূপে।’

শিখণ্ডী দেখতে পেলেন, অর্জুনের ঠোঁটের এক কোণে ফুটে উঠেছে আত্মবিশ্বাসের হাসি। দ্রৌপদীকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার কল্পনা প্রকট হয়েছে সেই হাসিতে।

একের পর এক যোদ্ধা বিফল হচ্ছেন। অবশেষে আসছেন দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণ।

অর্জুন প্রমাদ গুনছেন। কর্ণই এখানে একমাত্র বীর, যিনি সমরাঙ্গণে তাঁর সমতুল্য।

কিন্তু না। তিনি যে সূতপুত্র! পিতা দ্রুপদের অঙ্গুলিহেলনে দ্রৌপদী কর্ণকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে দিতেই অসম্মত হলেন।

অর্জুনের হাসি আরও প্রশস্ত হল। তিনি বুঝতে পারছেন, তিনি স্বয়ং ছাড়া এই সভায় যোগ্যতর আর কেউ নেই। দ্রৌপদী হবেন তাঁরই!

তিনি বুঝতেও পারলেন না, নিজের অজান্তেই তিনি হয়ে উঠলেন দ্রুপদের ক্রীড়নক!

একপ্রকার জোর করে মনের গতিপথ পরিবর্তন করলেন শিখণ্ডী। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি নিজেকে ফিরিয়ে আনলেন ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমানে। কম্পিল্যনগরীর সুসজ্জিত স্বয়ংবর সভা অদৃশ্য হয়ে গেল।

পুনরায় নিজেকে রাজা শিখীধ্বজের প্রাসাদে আবিষ্কার করলেন শিখণ্ডী।

‘কী হল?’ প্রশ্ন করলেন চূড়ালা।

শিখণ্ডী হেসে বললেন, ‘ভবিষ্যৎ দর্শনের আর প্রয়োজন নেই, কুম্ভক।’

‘কেন?’

‘আমি একটি সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছি।’ মুখে সেই হাসি ফুটিয়ে রাখলেন শিখণ্ডী, কিন্তু তা তাঁর নেত্রকে স্পর্শ করল না। সেভাবেই তিনি বললেন, ‘অর্জুন হন, আমার সহধর্মিণী হন, কিংবা জন্মদাতা পিতা! আমার জ্ঞাতসারে কোনো সম্পর্কই সম্পূর্ণরূপে শর্তহীন, স্বার্থহীন, উদ্দেশ্যহীন নয়। অজস্র সমীকরণ, অজস্র আকাঙ্ক্ষা এবং অবধারিত অপ্রাপ্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ঊর্ণনাভের জালের সদৃশ এই সামাজিক, পারিবারিক, ঐহিক অস্তিত্ব। এমন সম্পর্ক আমি বজায় রাখব। কিন্তু তাদের মাধ্যমে নিজের পরিচিতির সন্ধান আমি আর করব না।’

‘অভিনন্দন জানাই তোমাকে, শিখণ্ডী!’ চূড়ালার মুখ অকৃত্রিম হাস্যে ভরে উঠল, ‘সংসারে থেকেও প্রাপ্ত এই দর্শনবোধ আজ তোমাকে পরিণত করল এক উন্নততর মানবে। সত্যের পথে তুমি আরোহণ করলে আরও একটি শৃঙ্গে।’

শিখণ্ডী যেন সে-কথা শুনতেই পেলেন না। তিনি বললেন, ‘কেবল একমাত্র একটি সম্পর্কে কোনো শর্ত নেই।’

‘কোন সম্পর্কের কথা বলছ তুমি?’ চূড়ালা সহজভাবে জানতে চাইলেন।

‘বন্ধুত্ব।’ কম্পিত কণ্ঠে বললেন শিখণ্ডী, ‘প্রকৃত বন্ধুত্বের কোনো শর্ত হয় না। সেই প্রমাণ আমি পেয়েছি। এমন কিছুই নেই আমার, যা আমি তোমাকে দিতে পারি। তবু তুমি দিনের পর দিন আমার পাশে থেকেছ, হতাশ ‘আমি’, ভগ্ন ‘আমি’-কে উজ্জীবিত করেছ শুধুমাত্র বন্ধুত্বের বন্ধনে। এভাবেই আমার পাশে থেকো, কুম্ভক! এভাবেই থেকো, যতদিন না আমি ভীষ্মকে হত্যা করতে পারি! এভাবেই থেকো, যতদিন না আমি বহুযুগ পূর্বে রাজকুমারী অম্বার প্রতি হওয়া সেই অপরাধের জন্য সেই মহাবীরকে সমুচিত দণ্ড দিতে পারি।’

”উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে। রাজদ্বারে শ্মশানে চ যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।” অনুচ্চস্বরে কথাগুলো বলে শিখণ্ডীর হাতের ওপর হাত রাখলেন চূড়ালা।

৩১

দু-মাস পর …

সল্টলেকের একটা বেসরকারি ক্লিনিকের বাইরের ঘরে বসে ছিল সাহানা। বাইরে চওড়া পিচের রাস্তা, তার দু-পাশে ছাতিম গাছের সারি। রোদ ঝলমলে আকাশের নীচে এই শহরটাকে, এই পৃথিবীটাকে আগের চেয়ে অনেক শান্ত, অনেক স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল সাহানা’র।

হঠাৎ ফোনটা সরব হল। কে কল করেছেন তা দেখে নিয়ে সাহানা বলল, হ্যাঁ, বলুন?’

‘আদালতের রায় বেরিয়েছে।’ রমেন্দ্র’র গলা ভেসে এল, ‘অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের চার্জ প্রমাণিত হয়েছে। মানে আই.পি.সি থ্রি জিরো সেভেন। দশ বছরের জন্য সরকারের অতিথি হল সন্টু রায়। মিতালি’র ফোন সুইচড অফ বলছিল। তাই আপনাকে কল করতে হল।’

‘মিতু ডাক্তারের চেম্বারে। বেরোলে বলব, যেন আপনাকে ফোন করে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সাহানা বলল, ‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব!’

‘আমি আর আলাদা করে কী করলাম?’ খুব সহজভাবে বললেন রমেন্দ্র, ‘আদালত সব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। হাতের ছাপ, ফুটেজ, আপনার সাক্ষ্য এগুলো তো ছিলই। সন্টু’র সঙ্গে যে কিটব্যাগটা থাকে, সেখানে মিতু’র রক্ত লেগে থাকা ছুরিটা পাওয়ার পরেই আর সন্টু’র কোনো কথা ধোপে টেকেনি। তাতে আবার সন্টু’র হাতের ছাপও পাওয়া গেছিল! মোটিফও পরিষ্কার। মিতু সন্টু’র জাল ব্যবসা ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল। ওর পলিটিক্যাল দাদারা হাওয়া গরম বুঝে সরে যেতেই আর কোনো ঝামেলা হয়নি।’

সাহানা নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। বলল, ‘সেদিন আপনাকে যা বলেছিলাম, সেগুলো আদালতের সামনে এল না বলেই আলাদাভাবে ধন্যবাদ দিচ্ছি।’

‘ওগুলো আমি স্রেফ ভুলে গেছি।’ রমেন্দ্র হেসে ফেললেন, ‘আপনিও ভুলে যান। কত কিছুই তো আমরা দেখি-শুনি। সব কি মনে রাখতে পারি? মনে রাখা উচিতও নয় বোধহয়! রাখলাম। ভালো থাকবেন।’

ফোনটা রেখে সাহানা স্থির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ওর চোখ দুটো ছলছল করছে। গলার কাছটা দলা পাকাচ্ছে কী যেন! ষোলো বছর আগের সেই কথাগুলো ও না হয় এবার ভুলে যাবে। যে চিত্রনাট্য ওরা দুজনে মিলে সুনিপুণভাবে সাজিয়েছিল, সেগুলোও না হয় ভুলে যাবে।

কিন্তু মিতু কি পারবে ভুলতে?

আবারও সাহানার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই দৃশ্যপট। মন চলে যাচ্ছে বছর ষোলো আগের এক কালো অতীতে। এখানেও সেই মজার ব্যাপার।

যে-দৃশ্যের ছবি নিখুঁতভাবে ভেসে উঠছে ওর চোখের সামনে, কোনোকালেও সেই দৃশ্যের সাক্ষী ছিল না ও। কিন্তু মিতুর কাছে শুনতে শুনতে এমন হয়ে গিয়েছে, যেন এখন মনে হয়, মিতু নয়, সাহানাই ছিল সেদিন জগদানন্দ মহারাজের ঘরে।

মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর দিন। পনেরো বছরের মিতু মার্কশিট নিয়ে আশ্রমে ঢুকছে। এর আগে আশ্রমের কোনো ছাত্র এত ভালো রেজাল্ট করেনি! ‘সুমিত মাইতি’ নাম উজ্জ্বল করেছে আশ্রমের। জগদানন্দ মহারাজ নিজে মিষ্টি কিনে এনে হাসিমুখে বিতরণ করছেন। মিতুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন।

আর তারপর? সেই রাতে মহারাজের ঘরের দরজায় কে সাবধানে শব্দ করছে?

দরজা খুলে দিচ্ছেন জগদানন্দ। আগন্তুক তাঁর অতিপরিচিত, তবে সেই রাত্রে তার আসার কথা ছিল না। বিস্মিত কণ্ঠে জগদানন্দ বলছেন, ‘কী ব্যাপার! তুই এখন?’

মিতু’র মুখে ফুটে উঠছে স্বভাববর্জিত লাজুক ভাব। মদির কটাক্ষে সে ফিশফিশ করে বলছে, ‘এবার তো আশ্রম ছেড়ে চলে যাব। তাই আপনার জন্য খুব মন কেমন করছিল, মহারাজ!’

জগদানন্দ মহারাজ যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হচ্ছেন। মিতু কোনোদিক থেকে সুন্দরী নয়, নয় সুতন্বীও। শরীরে লাবণ্যর চেয়ে অনেক বেশি ‘ছেলে-ছেলে’ হাবভাব।

কিন্তু নারীবর্জিত জীবনে ‘নারীদেহ’টুকু পাওয়াই তো যথেষ্ট! তাই মিতু’র ওইটুকু কথাই ক্ষণিকের জন্য সুখের ইশারা হয়ে আসছে জগদানন্দের কাছে। না, শুধু সুখ নয়। সাহানা বুঝতে পেরেছিল, দীর্ঘ কয়েক বছরের এই এই অত্যাচারের পেছনে যৌনক্ষুধার থেকেও অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠেছিল আশ্রমের প্রধান হিসেবে মিতুকে ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা। ‘আমি পারি!’ এই অধিকারবোধ থেকেই জগদানন্দের কদর্য মন অন্যবারের মতো সেই রাতেও খিদে মেটাতে চেয়েছিল।

দরজায় ছিটকিনি তুলে ঘরের আলো নিভিয়েছিলেন জগদানন্দ। পেছন ফিরে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নিজের তক্তপোশের দিকে। কিন্তু তিনি তা পারেননি!

তার আগেই দুটো সরু হাত তাঁর গলাটা ধরে সবটুকু শক্তি দিয়ে তাঁর মাথাটা টেনে এনেছিল দরজার পাশের টেবিলটার দিকে। দীর্ঘসময়ের অপমান, নিগ্রহ, লাঞ্ছনা মিতুকে করে তুলেছিল প্রচণ্ড বলীয়ান। টেবিলের কোনাটা সজোরে লেগেছিল জগদানন্দের কানের একটু ওপরে। আকস্মিক ওই আক্রমণ সামলাতে পারেননি জগদানন্দ।

শরীরটা এলিয়ে পড়েছিল নীচে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল মিতু। অনুতাপ বা উত্তেজনায় নয়। হতভাগ্য মেয়েটি সেই স্তর পেরিয়ে এসেছিল ততদিনে। বরং পড়ে থাকা মানুষটা নড়ে উঠলে যাতে আবার প্রয়োজন হলে বারবার তাঁর মাথায় আঘাত করে শরীরটাকে একেবারে স্থির করে দেওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করাই ছিল মিতু’র লক্ষ্য।

‘হেমারেজ।’ শক্ত গলায় বলেছিল মিতু, ‘সিলেবাসে না থাকলেও মানুষের শরীর নিয়ে দিনের পর দিন নিজের খেয়ালে পড়াশোনা করতাম আমি। মহাভারতের মতোই, বলতে পারিস। খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তো। তাই জানতাম, কীভাবে…!’

বন্ধ দরজার পাশের জানালা দিয়ে নিজের রোগা শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়েছিল মিতু। তারপর নিঃশব্দে ঘরে ফিরে নিদ্রিত সহপাঠীর পাশের বিছানায় ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়েছিল।

পরদিন সকালে ওর ঘুম ভেঙেছিল প্রত্যাশিত হইচই শুনে। আটটা বেজে গেলেও জগদানন্দ মহারাজ দরজা খোলেননি। দরজা ভেঙে তাঁর দেহটা বের করে আনা হয়েছিল। দেহের অবস্থান থেকে মনে হয়েছিল, পা হড়কে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। অন্য কিছু মনে করারও তো কারণ ছিল না।

পুলিশ চাইছিল, ফরেনসিকের সাহায্য নিয়ে তদন্ত করতে। কিন্তু ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে এগোনোর আগেই আশ্রমের প্রধান দপ্তর সজনেখালি থেকে চেপে দেওয়া হয়েছিল গোটা ব্যাপারটা। এন জি ও’র মতো লাভজনক ব্যাবসা আর আছে নাকি? ট্রাস্টের তখন তিনখানা ব্রাঞ্চ, আর একটা শাখা খুলবে খুলবে করছে। তাঁর মধ্যে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মতো কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে গেলে বাইরে থেকে ফান্ড আসার যে দফারফা হয়ে যাবে! ট্রাস্টের আসল মাথাদের ওদিককার নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা রাখতেই হয়! তাঁরাই ফাইলটাকে চিরকালের মতো দেরাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু তার ঠিক চারদিন পর এক সন্ধ্যাবেলা আশ্রমে এসেছিল প্রাক্তন ছাত্র সন্টু রায়। মিতুকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সে বলেছিল, সেই রাতে ‘সুমিত মাইতি’ যে ওই ঘরে ঢুকেছিল, তারপর জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, তা কিন্তু সে বাইরের করিডোর থেকে দেখেছে। সে কি তাহলে পুলিশকে সব জানাবে?

মহারাজকে কেন খুন করল সুমিত? সন্টুকে খুলে বলতেই হবে!

অতঃপর সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা ব্ল্যাকমেলের খেলা। অমোঘ নিয়তির মতো বাকিটা ঘটছিল। দুর্দান্ত রেজাল্ট করা ‘সুমিত মাইতি’র বদলে ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমি থেকে জাল সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল মিতালি দাস। অচিরে বোঝা গেছিল সন্টু’র প্রকৃত উদ্দেশ্য। সার্টিফিকেটের হিসেবে আঠেরো হতে হতেই মিতু কাজ শুরু করল। সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হল সন্টু’র ব্ল্যাকমেল।

কিন্তু তারপর?

‘কী রে!’ মিতু’র ধাক্কায় সম্বিৎ ফিরে পেল সাহানা, ‘কী ভাবছিস এত গভীরভাবে? চল, আমার হয়ে গেছে।’

সাহানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী বললেন ডাক্তার?’

‘সামনের সপ্তাহ থেকে হরমোন থেরাপি শুরু করবেন।’ ঝলমলে মুখে তাকাল মিতু, ‘তার ছ’সপ্তাহ বাদে প্রথম সার্জারি।’

সাহানা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মিতুর দিকে। তারপর বলল, ‘বাহ! এতে তোর শরীরে কোনো ক্ষতি হবে না তো?’

‘তা একটু হবে। কিন্তু সেটা মনের কষ্টের চেয়ে বড়ো নয়।’

ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে দু’জনে চুপচাপ রাস্তা ধরে হাঁটছিল। মিতু’র চোখমুখ দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছিল আনন্দ। সেভাবেই ও বলে উঠল, ‘আজ হোস্টেলে মাংস নিয়ে যাব, কেমন?’

‘হুঁ।’ সাহানা অন্যমনস্কভাবে বলে।

‘কী হুঁ?’ বিরক্তকণ্ঠে মিতু বলল, ‘কী ভাবছিস বল তো তখন থেকে?’

সাহানা সচকিত হয়ে বলল ‘ঊর্ণা আর সিমি তো অনেক রাত করে ফিরবে।’

ঊর্ণা আর আগের স্কুলে চাকরি করে না। মণিময় হাজরা সত্যিই নিজের ইমেজের ভয়ে কথা বাড়ায়নি। রেকমেন্ডেশন এবং এক্সপিরিয়েন্স সার্টিফিকেট থাকায় অন্য একটা স্কুলে কাজ পেয়েছে ঊর্ণা। পলি আর সিমিও আর ম্যাসাজ পার্লারে কাজ করে না। বরং গড়িয়ার দিকে একটা স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সেলাইয়ের কাজ করে দুজনে। তিনজনেরই বাড়ি ফিরতে রাত হয়। কিন্তু সেইসময় ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে সাহানা বোঝে, ঘামতেলের মতো করে ক্লান্তির পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসের একটা দীপ্তি লেগে রয়েছে ওদের মুখে।

হ্যাঁ, এভাবেও বাঁচা যায়।

মিতু বলল, ‘সে ফিরুক। আমি জমিয়ে রান্না করব। আমতেল দিয়ে চিকেনের একটা ডিশ বানাব। ইন্টারনেট দেখে শিখেছি। দারুণ হবে, বল?’

‘সন্টুকে খুনের চার্জে ফাঁসিয়ে না দিলে তুই ওর হাত থেকে অব্যাহতি পেতিস না।’ সাহানা নীচু গলায় বলল, ‘তাই নিজেই নিজের হাতটা ওইভাবে কেটেছিলি, তাই না?’

মিতু অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, ‘আর কোনো উপায় ছিল না যে। তা ছাড়া তুই পাশে না থাকলে তো ওই ব্ল্যাকমেলের চক্কর থেকে মুক্তিই পেতামই না, সাহানা! নার্সিং হোমে ফোন করে জাল মার্কশিটের কথা তুই-ই জানিয়েছিলি। আমার কথামতো সন্টু বরং ওই বুথ থেকে ফোন করে বলতে গেছিল যে সব রেকর্ড ঠিক আছে। ফুটেজ ছিল সেটারই।’

সাহানা চুপ করে রইল। হ্যাঁ, প্রথম থেকে এই নাটকের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ও নিজে। সুপরিকল্পিত চিত্রনাট্যের মতোই সাজানো সংলাপ বলেছে, অভিনয় করেছে, অভিনয় করতে করতে কখনও ও নিজেই ভুলে গেছে যে ও অভিনয় করছে!

ভুলেই গেছে যে, মিতু ইচ্ছে করে এই নাটক সাজিয়েছে সন্টুকে শেষ করার জন্য। ফেস প্যাক মেখে দরজা খুলে নিজের ঘরে বসে থাকা থেকে শুরু করে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেওয়া, সবই ছিল সাজানো নাটক। অন্যদের কাছে সত্যি ঘটনা প্রমাণের তাগিদে।

‘কিন্তু সেদিন!’ সাহানা দাঁড়িয়ে পড়ল। মিতু’র চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? তা তো আজও বলিসনি! আমি তো খুব টেনশনে ছিলাম। যে ও-ই না কোনোরকমভাবে তোকে ফাঁসিয়ে দেয়!’

‘টাকা দেওয়ার নাম করে ওকে সেদিন ডেকেছিলাম আমি।’ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল মিতু, ‘সন্টু কিছু ভাবেনি, সবার সামনে দিয়েই এসেছিল। ওর ব্যাগের ছুরি দিয়ে একটা সুতো কাটিয়েছিলাম, যাতে ওর হাতের ছাপ পড়ে তাতে। তারপর সত্যিই রাগিয়ে দিয়েছিলাম জাল সার্টিফিকেটের ব্যাবসার কথা সবাইকে বলে দেব, এ-কথা বলে। তবে মারামারি হয়নি। বরং বুঝিয়েছিলাম, গণপতিকাকা এসে ওকে দেখলে কেলেঙ্কারি করবে। তখনই বলেছিলাম, যেন ও পেছনের সিঁড়ি দিয়ে বেরোয়, যাতে সামনের দিকের ঘরের কেউ ওকে না দেখে। ও নেমে যাওয়ার একটু আগেই অন্ধকারে মিশে ওই ছুরি দিয়ে হাতটা কেটেছিলাম। তারপর সেই ছুরিটা আবার ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম কিটব্যাগে। কিন্তু পুলিশের কাছে তুই ওকে চিনিয়ে না দিলে তো সবটাই বৃথা হত!’

‘টাকা নিতে যখন এসেছিল, তখন তিন লাখ টাকা সঙ্গে করে এনেছিল কেন?’

মিতু নীচু গলায় বলল, ‘ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমির জাল ব্যাবসায় যে আমিও একসময় কাজ করেছি। কী করব, নার্সিং পড়ার সময় পেট তো চালাতে হত। তাই, সুন্দরবনের গ্রামগুলো থেকে মুরগি জোগাড় করতাম! লোকে টাকা দিয়ে জাল সার্টিফিকেট কিনত। আমি সেদিন বলেছিলাম, অতদিন লেবার দিয়েছি, তার একটা কস্টিং নেই? থোক টাকাটা মেটাও, আমি মাসে মাসে যেমন খোরাক জোগাচ্ছি, জোগাব। বেসিক্যালি সন্টুর মাথাটা তো মোটা, তাই টোপটা গিলেছিল।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাহানা।

ওর কি মিতু’র ওপর রাগ হওয়া উচিত? হয়তো। মিতু খুনি। মিতু প্রতারক। মিতু মিথ্যুক। মিতুর প্রতি বিতৃষ্ণা আসাই উচিত।

কিন্তু সে’সব তো আদৌ হচ্ছে না ওর। বরং বিপদে বন্ধুর পাশে থাকা আর যথাসাধ্য সাহায্য করা ছাড়া অন্য কোনো ইচ্ছেই জাগছে না ওর মনে। কত রাঘব বোয়াল কত জঘন্য অপরাধ করে টাকার জোরে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে ছোটো থেকে পদে পদে অপমানিত হওয়া, পিছিয়ে থাকা মিতুকে যে পাপগুলো করতে হয়েছে, সেগুলো পরিস্থিতির চাপে পড়ে। সমাজ ওকে অপরাধী বানিয়েছিল! সমাজই ওদের স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দেয় না!

নীচু গলায় ও বলল, ‘সন্টু তোর নামে ওই কথাগুলো বললেও সেটা যে ধোপে টিকবে না, এ-ব্যাপারে তুই কীভাবে নিশ্চিত হলি?’

‘সন্টু ছাড়া একমাত্র যে মানুষ এই বিষয়ে মুখ খুলতে পারত, সে হল অজিত নিয়োগী।’ মিতু শান্তভাবে বলল, ‘ওই সময়ে উনিই স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন। কিন্তু তিনমাস আগে উনি মারা গেছেন। ওঁর মৃত্যুর খবরটা পাওয়ার পরেই আমি এই জাল থেকে বেরোনোর কথা ভাবতে শুরু করি। বাকিটা তো তুই জানিসই।’

হ্যাঁ, সাহানা জানে। তবে অনেক কিছু তো জানা, এমনকি কল্পনার বাইরেও হয়!

যেমন হয়েছিল, যখন একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে রেইনবো ফাউন্ডেশন নামে একটা সোসাইটি এগিয়ে এসে মিতু’র পাশে দাঁড়িয়েছিল। এল জি বি টি কিউ, অর্থাৎ সমকামী, উভলিঙ্গ ও রূপান্তরকামী মানুষের জন্য কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান। মিতুকে প্রয়োজনীয় আইনগত পরামর্শ দেওয়া, সাহায্য করা, তার লিঙ্গান্তরের জন্য চিকিৎসা ও সার্জারি, বাকি অর্থের জোগাড় করা এমনকি ব্যক্তিগত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও তারাই করেছে। এমনটা যে হতে পারে, এ-কথা কে ভেবেছিল?

কে ওই ফাউন্ডেশনের কাছে মিতু’র কথাটা জানাল? আজকের যুগে এমন একটা নিঃস্বার্থ উপকার কেই বা করবে?

অবশ্য একজন মানুষ আছেন, কিন্তু তিনি…! একটা অপ্রত্যাশিত উষ্ণতা সাহানা’র মুখে ছড়িয়ে গেল। পরেরবার চা-টা আর একটু যত্ন নিয়ে করতে হবে।

অন্য একটা কথা ওর মনে পড়ে গেল। একটা ট্যাক্সি সজোরে পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় অনেকটা জল ছিটিয়ে দিল। সাহানা চমকে উঠে মিতুর হাত ধরে সরে এল ফুটপাথে।

‘তোর লেখা মহাভারতের খাতাটা আমার কাছে রয়েছে। ওটা ছাপানোর ব্যবস্থা করবি না?’

‘ওটা যে তোর কাছে যত্নে থাকবে, সেই বিশ্বাস আছে আমার।’ মিতু বলল, ‘ছাপাব। ছাপাতে তো হবেই। দ্বাপর যুগ হোক বা কলি, যে যন্ত্রণা আমরা যুগ যুগ ধরে পেয়ে আসছি, তা সাধারণ মানুষ একটু জানুক! আগে এদিকটা ঠিকঠাক মিটে যাক। তারপর বইটা বের করব। বইটা তো শুধুই মহাভারত নয়, আমার কল্পনার জলরঙে মিশিয়েছি অনেক চরিত্রকে, যা হয়তো মহাকাব্যে নেই। রাজা শিখীধ্বজ পাঞ্চালের সামন্তরাজা ছিলেন না, ছিলেন মালব্য প্রদেশের অধিপতি। আর শিখীধ্বজ, চূড়ালা, কুম্ভকের আখ্যান মহাভারতে ছিল না, ছিল ‘যোগ বশিষ্ঠ’ গ্রন্থে। সত্যিকারের শিখণ্ডী তো চূড়ালার বন্ধুত্ব পাননি। কিন্তু আমি পেয়েছি। তাই নিজের মতো করে গড়েছি তাঁকে। এ এক অন্য মহাভারত!’

সাহানা বলল, ‘রমেন্দ্রবাবু পড়তে চাইছিলেন। দেব?’

সাহানার গালের ঈষৎ গোলাপি আভা চোখ এড়াল না মিতুর। মুখ টিপে হাসল ও, ‘নিশ্চয়ই! কিন্তু তুই আমাকে একটা কথা বল দেখি!’

সাহানা’র জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে মিতু ঢোঁক গিলল। চশমার আড়ালে থাকা বড়ো চোখদুটো সাহানা’র মুখে রেখে মিতু জিজ্ঞেস করল, ‘এটা শুধু জেন্ডার রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি একটা লম্বা প্রসেস! যেমন খরচ, তেমনই যন্ত্রণা। খরচ না হয় জোগাড় হয়েছে, শরীরের কষ্টও সয়ে নেব। কিন্তু মনের কালবৈশাখী? এত কিছুর পরেও তুই আমার পাশে থাকবি তো?’

‘চূড়ালাকে তো শিখণ্ডীর পাশে থাকতেই হবে!’ মিতু’র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল সাহানা। তারপর হাঁটতে থাকল। পাশ দিয়ে যাওয়া দু-জন পুরুষ আড়চোখে ওদের দেখলেন। সাহানা’র কাঁধটা আলগা হয়ে গেল।

সাহানা ভিজে স্বরে বলল, ‘তুই মিতালি হ’ কিংবা সুমিত, আমার কিচ্ছু যায় আসে না মিতু! আমার কাছে তুই আমার বন্ধু। তুই-ই তো লিখেছিলি, বন্ধুত্ব হওয়া উচিত স্বার্থহীন, উদ্দেশ্যহীন, শর্তহীন! বন্ধুর কোনো জেন্ডার হয় না। আমি সারাজীবন তোর পাশে থাকব।’

সাহানা মিতুর হাত ধরে হাঁটছিল। দেখুক সবাই। ওর কিছু যায় আসে না। প্রকৃত বন্ধুত্বের কোনো শর্ত হয় না, সমীকরণ হয় না। ওর আর মিতু’র মধ্যে এই মৈত্রীই থাকুক, যতদিন না ওদের পথচলা শেষ হয়।

সাহানা বলে, ‘অপারেশনের পর কী নাম নিবি? সুমিত মাইতি?’

‘নাহ!’ মিতু একটা সিগারেট ধরায়, ‘সুমিত মরে গেছে, সাহানা। সেই প্রতারক আর ফিরবে না।’

‘তবে?’

মিতু সাহানার চোখে চোখ রাখে। চশমাটা নাকের ওপর কিছুটা ঠেলে হেসে বলে, ‘শিখণ্ডী!’

সাহানা তার বন্ধুর হাতটা আরও জোরে আঁকড়ে ধরে।  

***

অধ্যায় ৭ / ৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন