শিখণ্ডী – ১

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

দক্ষিণ কলকাতার এক ব্যস্ত উড়ালপুল। দু-পাশে রাস্তার আলো ঝলমল করছে। নীল-সাদা-হলুদ। আকাশে মেঘ জমাট বেঁধে রয়েছে, তারা দেখা যাচ্ছে না একটাও। ফ্লাইওভারের দু-পাশের দৈত্যাকৃতি বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং ঢেকে দিয়েছে সেই গম্ভীর আকাশের অনেকখানি।

কোনো কোনো বিজ্ঞাপন আবার চলছে ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় কিছুক্ষণ অন্তর পালটে যাচ্ছে তার ক্যাপশন, মডেলের হাসিমুখ, ঝলমলে রং।

উল্কার গতিতে গাড়ি ছুটে চলেছে। পাবলিক বাস, প্রাইভেট গাড়ি, বাইক। কেউ গতি কমাচ্ছে না। বাতাস কেটে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।

সবার বড়ো তাড়া।

কয়েক কিলোমিটার দূরে উড়ালপুলটা যেখানে নামতে নামতে মিশে যাচ্ছে চওড়া রাজপথের সঙ্গে, সেখানে কর্তব্যরত একজন ট্রাফিক পুলিশ। পরনে উর্দি, মাথায় হেলমেট।

কখনও বাঁ হাত, কখনও ডান হাত নেড়ে তিনি সিগন্যাল দেখাচ্ছেন। কখনও আবার এক হাত একদিকে থামার জন্য ইশারা করে অন্য হাত বিপরীত দিকে ক্রমাগত নাড়িয়ে আসতে বলছেন যাত্রীদের। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে তাঁর কানে প্রবেশ করে চলেছে নানা ধরনের গাড়ির হর্ন।

তবে তাতে ওই সার্জেন্ট বিচলিত হচ্ছেন না। কারণ এই শব্দ শুনতে তিনি গত কুড়ি বছর ধরে অভ্যস্ত।

কিন্তু তিনি কৌতূহলী হলেন যখন সেগুলো ছাড়া কিছু অন্যরকম শব্দতরঙ্গ বেশ কয়েক মুহূর্ত ধরে তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে চলল।

একটা কাঠের দরজায় উপর্যুপরি ধাক্কার শব্দ এবং সঙ্গে কয়েকটি মেয়েলি গলার চিৎকার।

তিনি বাঁ হাত নেড়ে গাড়িগুলোকে আসতে দিয়ে শব্দের উৎসের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকালেন।

ফ্লাইওভার যেখানে একেবারে ঢালু হয়ে এদিকে নেমে এসেছে, তার ওপারে একটা হাড়গোড় বের করা বাড়ি। তিনতলা। আগেকার দিনের সরকারি কোয়ার্টারের ধাঁচের। প্রতিটা তলায় সামনের দিকটা খোলা লম্বা করিডোর, সেই করিডোরে পরপর ঘর। বারান্দায় অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে।

শব্দটা আসছে ওই বাড়ির তিনতলার করিডোর থেকে। টিমটিমে হলদে আলো। এতক্ষণ চড়া আলো আর গাড়ির স্পটলাইটে অভ্যস্ত সার্জেন্টবাবুর চোখ প্রথমে ভালো দেখতে পাচ্ছিল না সেখানে কী হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর ধাতস্থ হতেই দেখতে পেলেন, কয়েকজন মেয়ে একটা বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। মেয়ে না বলে যুবতি বলাই ভালো। প্রত্যেকেরই পরনে ঘরে পরার ম্যাক্সি। চুল যেমন-তেমন চুড়ো করে মাথার ওপর বাঁধা।

উত্তেজিত কণ্ঠে কী যেন বলাবলি করছে সবাই, সঙ্গে দরজায় আঘাত করছে ক্রমাগত। তারা কী বলছে, তা এতদূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়।

সার্জেন্টের তীব্র কৌতূহল হলেও ডিউটি ছেড়ে ওদিকে যেতে পারবেন না। কিছুক্ষণ ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করে তিনি নিজের ওয়াকিটকিতে হাত দিলেন।

‘অ্যাই মিতু! মিতু! খোল শিগগিরই! কী পাগলামো করছিস?’

‘কী হয়েছে তোর? চায়ের দোকান থেকে আবার কিছু বলেছে? নাকি ফেরার সময় ট্রেনে?’

‘মিতু, এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে! গণপতিকাকার কাছে খবর চলে গেলে একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে। দরজাটা খোল।’

চারটে মেয়ে সমানে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল বন্ধ দরজার এপার থেকে। তাদের কথা কখনও নরম, কখনও গরম। কখনও তারা মিতু নামক বন্ধুটিকে বকাবকি করছে, পরক্ষণেই গলার স্কেল নামিয়ে আনছে অনুনয়ে।

একটা মেয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আমি এখানে এসেছি পনেরো মিনিট হয়ে গেল। তারও প্রায় আধঘণ্টা আগে একটা লোককে মিতুর ঘরে ঢুকতে দেখেছিলাম। তোরা কেউ লোকটাকে বেরোতে দেখেছিলি?’

‘না। আমি তো একটু আগে ফিরলাম!’ একটা মেয়ে বলে উঠল।

আর একটি মেয়ে বলল, ‘আমিও খেয়াল করিনি যে কেউ মিতুর ঘরে এসেছে।’

প্রথম মেয়েটা বিড়বিড় করল, ‘লোকটা গেল কখন? আর মিতুই বা কখন দরজা বন্ধ করল? আমার মনে হয়, আর দেরি না করে গণপতিকাকাকে ফোন করাই ভালো। কী বলিস ঊর্ণা?’

ঊর্ণা তার ম্যাক্সির ওপর একটা ফিনফিনে ওড়না জড়িয়ে রেখেছিল। এতক্ষণের উত্তেজনা আর দরজা ধাক্কানোর পরিশ্রমে তার কপালে এখন বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সিন্থেটিক ওড়না দিয়ে সে ঘাম মুছতে চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হল না। স্বেদবিন্দুগুলো কপাল থেকে উঠে গিয়ে সিন্থেটিক ওড়নার গায়ে জমিয়ে বসল।

সুতি হলে শুষে নিত। সিন্থেটিকের সেই ক্ষমতা নেই।

ঊর্ণা বলল, ‘দুমদাম কাজ করিস না সাহানা। গণপতিকাকাকে ফোন করা মানে দলবল নিয়ে এখনই চলে আসবে। তারপর হাজার জেরায় জেরবার করে দেবে। সন্ধেবেলা হোস্টেলে ব্যাটাছেলে এসেছিল কেন? আগে খবর দিইনি কেন? আরও কত কী। এমনিতেই তো আমাদের তাড়ানোর জন্য পা তুলে রয়েছে, এই অজুহাতে একেবারে লাথি মেরে বের করবে। তখন কোথায় যাব? কলকাতা শহরে কোথায় মিলবে এই পাঁচশো পঁচিশ টাকায় ঘরভাড়া? পলি, তুই এক কাজ কর। রান্নাঘর থেকে নোড়াটা নিয়ে আয়।’

পলি বলে মেয়েটার ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল। তারই মধ্যে সে দ্রুত পায়ে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে চলে গেল। সিঁড়ি নিয়ে নেমে একতলায় রান্নাঘর।

চতুর্থ মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘ঊর্ণাদি, তুমি দরজা ভাঙবে?’

‘তা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই সিমি।’ ঊর্ণা ঠোঁট কামড়াল, ‘পুরোনো দরজা, ভাঙতে বেশি সময় লাগবে না। দেরি করাও ঠিক নয়।’

‘মিতু যে এইরকম কাণ্ড করে বসবে, ভাবতেও পারিনি। কয়েকদিন ওর সঙ্গে সেভাবে কথাও হয়নি।’ সাহানা ফিশফিশ করল, ‘কিন্তু ঊর্ণা, দরজা ভাঙলে তো গণপতিকাকা জানতে পারবেই।’

‘সে দেখা যাবে। তেমন হলে সবাই মিলে চাঁদা তুলে কোনো ছুতোর মিস্ত্রিকে নিয়ে এসে …।’ ঊর্ণা বাক্যটা শেষ করল না।

সাহানা আর কিছু না বলে দরজায় আবার ঠকঠক করতে লাগল।

পাশেই বড়ো রাস্তা। ফ্লাইওভার। সেখান থেকে হুসহাস চলে যাওয়া গাড়িগুলোর আলো ঝলক ফেলছে জীর্ণ, পলেস্তারা খসে-পড়া এই লেডিজ হোস্টেলের বারান্দায়।

পলি মেয়েটা বোকা নয়। রান্নাঘরে এখন অনেকে থাকতে পারে। ও সেই ঝুঁকি নেয়নি। বদলে নিজেদের দুটো ঘরের দরজার খিল খুলে নিয়ে এসেছে।

পুরোনো দিনের দরজা। এমনিতেই ঘুণ ধরে নীচ দিকটা খয়ে গিয়েছে। খিলদুটো দিয়ে বারদশেক সবাই মিলে ধাক্কা দেওয়ার পরেই হুড়কোটা আর্তস্বরে ককিয়ে উঠে ভেঙে গেল।

ওরা হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখল, মিতু শুয়ে আছে।

বিছানায় নয়, লাল মেঝেতে। একটা হাত বুকের ওপর রাখা, আর একটা হাত এলিয়ে পড়ে রয়েছে পাশে। সেই হাতের কবজির পেছনদিক ক্ষতবিক্ষত। কবজির নীচ দিয়ে বেরোনো তাজা রক্ত সরু হয়ে মেঝেতে যাত্রা শুরু করেছে।

গোটা ঘরটায় ম-ম করছে কেরোসিন তেলের গন্ধ।

‘ওমা গো!’ সিমি ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, ঊর্ণা আটকাল। নীচু হয়ে খুব সন্তর্পণে মিতুকে স্পর্শ না করে নাকের নীচে হাত রাখল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘বেঁচে আছে। এখনও বেঁচে আছে। নিশ্বাস খুব আস্তে পড়ছে। কিন্তু পড়ছে। পলি, তুই এখুনি একটা ট্যাক্সি ডেকে আন। হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব!’

লেডিজ হোস্টেলের তিনতলায় থাকে ওরা চারজন। দোতলার ঘরগুলো বাড়িওয়ালার ব্যাবসার স্টোররুম, সেখানে কেউ থাকে না। একতলায় থাকে কিছু মেয়ে, সেখানেই গোটা বাড়ির রান্নাঘর।

হোস্টেলের নীচটা বেশ অন্ধকার। টিমটিমে আলো জ্বলছে। ঊর্ণা, পলি, সাহানা আর সিমি অনেক কষ্টে চ্যাংদোলা করে তিনতলা থেকে নামিয়েছে মিতুকে। একতলায় যে মেয়েরা থাকে, তাদের সঙ্গে ওদের বিশেষ সদ্ভাব নেই। খুচখাচ খটাখটি তো লাগেই, এর আগে দু-দু’বার বড়ো ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। মিতুকে ওইভাবে নামাতে দেখে তাদের দু-একজন ভ্রূ-কুঁচকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এলেও মুখে কিছু বলল না।

শত্রুপক্ষ হলেও সিমি ওদের একজনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে। মেয়েটার নাম বিদিশা। বেহালার দিকে একটা কলেজে পড়ে। ইতিহাস অনার্স। সঙ্গে পার্টটাইম কাজ করে একটা কল সেন্টারে।

তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সিমি আগ বাড়িয়ে বলল, ‘দ্যাখ না, মিতু হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।’

মিতুর শিরা কাটা হাতটা যতটা সম্ভব চাদরের আড়ালে লুকিয়ে রাখে ঊর্ণা।

কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। মিতুর অচৈতন্য দেহ আর চাদরে মোড়া হাত দেখেই সে যা বোঝার বুঝে ফেলল।

‘আমি যাব না দিদি।’

‘কেন যাবেন না?’ চাপা গলায় ফুঁসে উঠল ঊর্ণা, ‘যাবেন না তো ট্যাক্সির গায়ে ‘নো রিফিউজাল’ সেঁটে রেখেছেন কেন? সার্জেন্টকে ডাকব?’

‘সার্জেন্টকে ডাকলে আপনারাই ফাঁসবেন।’ নির্বিকার গলায় বলল ট্যাক্সিওয়ালা, ‘এসব লাফড়া কেস নেব না।’

‘কীসের লাফড়া? আমাদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আর তুমি তাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে না?’ সিমি বলল।

ট্যাক্সিওয়ালা আবার একবার চোখ বুলিয়ে নিল মিতুর ওপর। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট। চুল ছোটো করে ছাঁটা। বুকে খুব সামান্য হলেও স্তনের আভাস স্পষ্ট। অথচ পা-দুটো ছেলেদের মতো, কর্কশ লোমে ভরতি।

‘এ কি মেয়েছেলে না ব্যাটাছেলে?’

‘কী মুশকিল! লেডিজ হোস্টেলে ছেলে কোথায় পাবে তুমি?’ বিরক্ত সিমি বলল।

ট্যাক্সিওয়ালা ততক্ষণে ঝুঁকে পড়েছে মিতুর দিকে। মিতুর হাত, মুখ, বগল দেখছে খুঁটিয়ে।

‘মেয়েছেলের গায়ে কখনও এত চুল হয়? এদিকে মুখে দাড়ি-গোঁফ নেই।’ ট্যাক্সিওয়ালা ঊর্ণার দিকে তাকাল, ‘হিজড়ে নাকি?’

ঊর্ণা এবার শীতল কণ্ঠে বলল, ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক, হিজড়ে হোক, ও একজন মানুষ। অসুস্থ। তুমি যাবে কি না বলো?’

একটু পরে অতিরিক্ত তিনশো টাকা আর গাড়ির সিটে একটুও রক্ত না লাগার প্রতিশ্রুতিতে ট্যাক্সি ছুটল হাসপাতালের দিকে। ঊর্ণা আর পলি সঙ্গে উঠে পড়ল।

ওরা সাহানাকেও নিতে চাইছিল, কিন্তু ও বলল, ‘না, তোরা যা। আমি এদিকটা দেখছি।’

ট্যাক্সি চোখের আড়াল হওয়া-মাত্র বিদ্যুতের গতিতে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল সাহানা। দ্রুত গিয়ে ঢুকল মিতুর ঘরে।

ছোট্ট একটা ঘর। ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে একটা আদ্যিকালের তক্তপোশ। তাতে তেলচিটে বিবর্ণ চাদর পাতা। তক্তপোশেরই এক কোণে রাখা একটা ট্রাঙ্ক। পাশে মেঝেতে তখনও মিতুর রক্ত শুকিয়ে। দেয়ালের হুকে ঝুলছে মিতুর ইউনিফর্ম। সাদা রঙের হলেও এখন তা বহুবার সোডা দিয়ে কাচায় নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে।

গোটা ঘরে কেরোসিনের গন্ধ কেন?

একটু খুঁজতেই উত্তর পেল সাহানা। মেঝেতেই রাখা রয়েছে একটা কেরোসিনের বোতল। তার মুখটা খোলা। মিতুর ঘরে স্টোভ নেই। রাতবিরেতে চা খাওয়ার ইচ্ছা হলে সাহানার ঘরের স্টোভটা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তেল তো সেখানেই রয়েছে। মিতু ঘরে আলাদা করে এনে রেখেছে কেন?

মিতু কি মরতে চাইছিল?

কিন্তু কেন? যে ছুরি বা ব্লেডটা দিয়ে শিরা কেটেছে, সেটাই বা কোথায়?

নার্সিং হোম থেকে কখন ফিরেছিল মিতু?

বিকেল নাগাদ কি? সাহানা জানে না। সে তখন ঘরে বসে খাতা দেখছিল। ক্লাস টু’র হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার খাতা।

তক্তপোশের এক কোণে বালিশের পাশে রাখা তিন-চারটে মোটা মোটা বই। ওগুলো সব মহাভারত, সাহানা জানে। কোনটা গোটা মহাভারত, কোনটা কোনো এক বিশেষ পর্যায় নিয়ে লেখা। কোনোটা সংস্কৃত ভাষায়, কোনোটা বাংলায়। কিছু ইংরেজিতেও আছে।

লাগোয়া দেয়ালে একটা ছোট দেয়াল আলমারি। তার মধ্যেও রয়েছে কয়েকটা বই।

মিতুর ভালো নাম মিতালি দাস। বাড়ি সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামটা প্রায় বাংলাদেশ সীমান্তের একটা দ্বীপে। বাসন্তী থেকে যেতে প্রায় দু-ঘণ্টা লাগে। নাম বৈকুণ্ঠপুর। বৈকুণ্ঠ মানে যে স্বর্গ, তা মিতুই ওকে একদিন বলেছিল। অথচ স্বর্গ তো দূর, মর্ত্যের একেবারে প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলোও সেখানে নেই। এমনকি ইলেক্ট্রিসিটিও ছিল না বছরকয়েক আগে অবধি। গ্রামের প্রায় সব বাড়িই কাঁচা। ওপরে টিনের ছাউনি। ঝড়ঝঞ্ঝা হলেই মাথার ওপরের সেই পলকা ছাদটুকু উড়ে যায়। নদীর পাড় ভেঙে তলিয়ে যায় জমিজিরেত। মানুষকে বারবার নতজানু হতে হয় প্রকৃতির পায়ে।

মিতুদের গ্রামে একটা মাত্র স্কুল, সরকারি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে সেই স্কুল থেকে ক্লাস ফোর পাশ করে কাজে লেগে পড়ত।

পাশেই মাতলা নদী। দশ-বারো বছরের ছেলেমেয়েগুলো সেই নদীতে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা প্রায় কোমরজলে দাঁড়িয়ে চিংড়ির মীন ধরে। দিনের আলো ফোটার আগে চলে যায় তারা, ফেরে সূর্য ডুবলে।

খুব কম ছেলেমেয়েই ক্লাস ফোরের পর লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যায়। তখন তাদের চলে যেতে হয় গ্রামের বাইরে। কেউ যায় বাসন্তী, কেউ যায় নামখানা, কেউ ক্যানিং। মেয়েরা তাও যায় না। তারা কেউ মীন ধরে, কেউ ঘরে রান্নাবান্নায় মন দেয়। তেরো-চোদ্দোয় পড়তেই বিয়ে হয়ে যায়। সরকারি নিষেধাজ্ঞা সেখানে প্রহসন মাত্র।

মিতুর অবশ্য তা হয়নি। গ্রামের এক কাকার সাহায্যে সে পড়তে গিয়েছিল বাইরে। অনেক দূরের এক আশ্রমে। দুঃস্থদের আশ্রম। মাধ্যমিক পাশ করে নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিল। তারপর ওদিকের বেশ কয়েকটা নার্সিং হোমে কাজ করে বছরকয়েক পরে কলকাতায় এসেছিল।

ততদিনে তার মা মারা গেছে। দিনরাত জলে দাঁড়িয়ে মীন ধরে ধরে ওর মায়ের শরীরে নোনা ধরে গিয়েছিল। মিতু অবাক হয়নি। তাদের গ্রামের অনেকেই এই রোগে মারা যায়। মা ছাড়া ততদিনে গ্রামে তার কেউ ছিল না। বৈকুণ্ঠপুরের সঙ্গে সব যোগাযোগ মিনুর ছিন্ন হয়েছিল।

মিতু এখন একটা বেসরকারি নার্সিং হোমের নার্স। নামেই নার্স, আসলে আয়ার কাজ। রুগিদের পায়খানা-পেচ্ছাপ করাতে হয়, ক্যাথিটার পরাতে হয়। বেসিক নার্সিং ট্রেনিং-এ এখন ওইটুকুই জোটে। ঠিকঠাক নার্স হতে গেলে দরকার বি. এস. সি. নার্সিং। মিতু মাস গেলে হাতে পায় সাড়ে আট হাজার। তার সঙ্গে কাজ করা মেয়েরা অনেকেই বি. এসসি. নার্সিং করতে চলে যাচ্ছে টুকটাক করে। কিন্তু তার জন্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ হতে হয়। মিতু প্রাইভেটে বারো ক্লাস পরীক্ষা দেবে। বি এসসি নার্সিং এবং উচ্চমাধ্যমিক, দুটোর জন্যই টাকার প্রয়োজন।

এইসব কথা মিতুই সাহানাকে বলেছিল গল্পের ছলে। এই আদ্যিকালের লেডিজ হোস্টেলে সে এসেছে বেশ ক-বছর হল। তার যে মহাভারত পড়ার বাতিক আছে, তা এই হোস্টেলে সবাই জানে।

‘এই বয়সি কাউকে আমি দিনরাত মহাভারত পড়তে দেখিনি মিতু!’ প্রথম প্রথম সাহানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করত।

মিতু কিছু না বলে হাসত।

‘তা ছাড়া একবার পড়লি, হয়ে গেল। গল্প তো সেই একই। অর্জুন, ভীম, দ্রৌপদী, দুর্যোধন … কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আমরা সবাই ছোটোবেলায় পড়েছি।’

মিতু তখন প্রতিবাদ করেছিল, ‘কে বলল তোকে গল্প এক? মহাভারত কোনো সাধারণ কাহিনি নয় রে সাহানা! বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো মহাকাব্য। এক-একটি চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাহিনি এক-একরকম। তুই যতবার পড়বি, ততবার অন্য কোনো নতুন দিক আবিষ্কার করবি। প্রতিবার নিজের জীবনের কোনো না কোনো ওঠাপড়া, সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবি। কোন জটিল অবস্থায় পড়লে কী করা উচিত, তার সবরকমের রেফারেন্স তুই মহাভারতে পাবি। লোকে আজকাল পড়ে না তাই। কিন্তু এতবছর পরেও মহাভারত আমাদের জীবনে সমান প্রাসঙ্গিক।’

‘তোর এই মহাভারত-প্রেম কী করে হল হঠাৎ?’

‘হঠাৎ নয়।’ মিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল, ‘ছোটোবেলায় বদুকাকা বলত। তারপর যে আশ্রমে থাকতাম, সেখানকার আচার্যও আমায় মহাভারতের গল্প বলতেন। এভাবেই আগ্রহ জন্মায়। তারপর তাঁর থেকে বই নিয়েই পড়তে শুরু করেছি। আর ছাড়তে পারিনি। খুব ইচ্ছে ছিল, মহাভারত নিয়েই পড়াশুনো করব। কিন্তু তা আর হয়নি। পেট চালানোয় মহাভারতের চেয়ে নার্সিং-এর দাম বেশি।’

সাহানা নীচু স্বরে বলেছিল, ‘তবে যে বলেছিলি সেই আশ্রমের আচার্য…!’

‘ইনি তিনি নন।’ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল মিতু, ‘ইনি একেবারে প্রথমের দিকে ছিলেন। আমার যখন ক্লাস সেভেন, মারা যান। দশ থেকে চোদ্দো বছর, আমার জীবনের সেরা সময়, সাহানা!’

মিতুর বয়স এখন উনত্রিশ। অফিস থেকে ফিরে, অফিস যাওয়ার আগে কিংবা ছুটির দিনে, সে এখনও প্রায়ই ওই মহাভারতগুলোয় মুখ গুঁজে বসে থাকে।

‘থাকে’ই হবে তো? নাকি এর মধ্যেই ‘থাকত’ হয়ে গেছে মিতু?

সাহানার বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হচ্ছিল। কী হবে মিতু মরে গেলে? কেন ও এই ক’দিনে মিতুর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলল না? পাশের ঘরে থেকেও তো ও বেশ বুঝতে পারছিল, মিতু কয়েকদিন ধরে গুমরে রয়েছে। ‘বলছি বলব’ করে কেন গড়িমসি করল সাহানা? যে মেয়েটার সঙ্গে এক ছাদের তলায় এতগুলো বছর কাটিয়েছে, এই কয়েকটা মাসেই তাকে সাহানা ভুলে গেল কী করে?

ও সারা ঘরে চোখ বুলতে লাগল। তারপর আর কিছু না পেয়ে ট্রাঙ্কটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এই বেঢপ লোহার ট্রাঙ্কটা মিতুর প্রাণ। সবসময় তালা মারা থাকে। এমনকি বাথরুম গেলেও সঙ্গে চাবিখানা নিয়ে যায়। এই নিয়ে ওরা আগে কম মশকরা করেনি। কিন্তু মিতু তাতে পাত্তা দিত না।

ট্যাক্সিতে ওঠানোর সময় মিতুর হাফপ্যান্টের পকেট থেকে সবার অলক্ষ্যে বের করে নেওয়া চাবিটা তালায় ঢোকাল সাহানা। ওর বুকটা দুরুদুরু করছে। কেন— তা ও নিজেই জানে না।

ট্রাঙ্কটার ভেতরের অবস্থা ঘরের মতোই জীর্ণ। গোটা তিনেক বহুব্যবহৃত ট্রাউজার, শার্ট আর কিছু গেঞ্জি, অন্তর্বাস ছাড়া কিছুই তেমন নেই। গোটা ঘরে নেই একটা আয়নাও। মিতু ওসবের পরোয়া করে না।

ট্রাঙ্কের একেবারে নীচে সাহানা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা ফোটোগ্রাফ খুঁজে পেল।

ছবিতে মাঠে সার দিয়ে অনেকগুলো ছেলে বসে রয়েছে। সবাই আট-দশবছরের। প্রত্যেকের পরনে সাধারণ হাফপ্যান্ট আর শার্ট। একেবারে মাঝখানে চেয়ারে বসে রয়েছেন এক সন্ন্যাসী। গেরুয়া পোশাক। মধ্যবয়সি। চোখে চশমা।

এরা কারা? মিতুর সঙ্গে কয়েকমাস আগে পর্যন্তও একঘরে থেকেছে সাহানা, এই ছবি তো কোনোদিন দেখেনি! মিতু ওকে সব বলত, কিন্তু এই ছবিটা কখনও দেখায়নি।

সাহানা আবার ঝুঁকে পড়ল। ছবিদুটোর নীচে লুকিয়ে রয়েছে আরও কিছু কাগজপত্র আর একটা মোটাসোটা খাতা। খুলে দেখল, তা পুরো ভরতি। আলগোছে ওলটাতে ওলটাতে লাগল ও। শাল্ব, অম্বা, ভীষ্ম এইসব নামগুলো বারবার চোখে পড়তে লাগল ওর।

এটা কী? মিতু কি লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প লিখেছে? না, গল্প তো এত বড়ো হয় না। উপন্যাস এত বড়ো হয়।

মিতুর যে বাংলা ভাষার ওপর বেশ দখল, তা সাহানা জানে। শুধু বাংলা কেন, সবেতেই ওর দক্ষতা আছে। মিতু পড়াশুনোতে খুব ভালো ছিল।

কিন্তু তাই বলে মিতু উপন্যাস লিখতে পারে?

সাহানা উচ্চমাধ্যমিক পাশ। কলেজে সেকেন্ড ইয়ার অবধি পড়ে আর পড়েনি। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এই হোস্টেলের সবাই তাই। পড়া ছেড়ে ও কলকাতা এসেছিল কাজ খুঁজতে। তা প্রায় দশবছর হল। তখন কলকাতা শহর তো বটেই, শহরতলিতেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। অভিভাবকদের মধ্যে হঠাৎ জেগে-ওঠা ইংরেজিপ্রীতির চাহিদা মেটাতে একশ্রেণির ব্যবসায়ী খুলে ফেলছে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। অধিকাংশেরই কোনো গুণমান নেই, যা-হোক তা-হোক শিক্ষক বা শিক্ষিকা এনে, বিজ্ঞাপনে অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করে কোনো ফ্ল্যাটে বা গ্যারাজে চলছে শিক্ষা ব্যাবসা।

সাহানা নিজের পঞ্চান্ন শতাংশ নিয়ে পাশ করা বারো ক্লাসের সার্টিফিকেটের জোরে এমনই এক প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছিল। এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। গড়িয়ার ব্রহ্মপুরে। কিন্ডারগার্টেন থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত রয়েছে সেই স্কুলে। সাহানা সেই স্কুলের ক্লাস টু’র ক্লাস টিচার। সপ্তাহে পাঁচদিন স্কুল। সকাল দশটা থেকে দুটো। মাস গেলে মাইনে সাড়ে সাত হাজার টাকা।

মিতুর খাতার বাকি দুটো নাম মনে না পড়লেও সাহানা চিনতে পারল ভীষ্ম শব্দটা। অর্জুনের ঠাকুরদার নাম ভীষ্ম না? যিনি ভাইয়ের … না না… বোধহয় বাবার জন্য বিয়ে করেননি!

কী আশ্চর্য! এতগুলো বই থাকতেও মিতু কি আর একটা মহাভারত লিখছে নাকি?

সাহানার মোবাইল হঠাৎ বেজে উঠল।

‘হ্যাঁ ঊর্ণা, বল।’

‘এমারজেন্সিতে ভরতি করলাম। প্রথমে নিতে চাইছিল না। বলছিল সুইসাইড কেস নেবে না। থানায় ডায়েরি করে আসতে হবে।’

‘তারপর?’

‘মণিময়দা’কে ফোন করে সব বললাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভরতি নিয়ে নিল।’ ঊর্ণা এক নিশ্বাসে বলে গেল।

মিতু, সাহানা, ঊর্ণা, পলি, সিমি। ওদের মধ্যে ঊর্ণাই সবচেয়ে ভালো চাকরি করে। ঊর্ণা একটা সরকারি স্কুলের প্যারাটিচার। চোদ্দো হাজার আটশো টাকা মাইনে। আসল টিচারদের মাইনের ধারেকাছে না গেলেও সরকার এখন ষাট বছর অবধি ওদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বা কম কী? ঊর্ণা বি. এ. পাশ। অনার্সও ছিল নাকি। নিজের জন্য কিছু টাকা রেখে ঊর্ণা বাকিটা প্রতিমাসে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ওর মা, বাবা আর বিকলাঙ্গ ভাই। বাবা আগে কারখানায় কাজ করত। এখন বুকের অসুখে আর পারে না। ঊর্ণার টাকাতেই সংসার চলে। ওর বাবার আর ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য জলের মতো টাকা বেরিয়ে যায়।

ঊর্ণা আগের জুন মাসে বত্রিশে পা দিয়েছে। সংসারের স্বপ্ন আর দেখে না। বরং চাকরির বাইরে অন্য একজনকে ‘সঙ্গ’ দিতে হয় ঊর্ণাকে। ওদের স্কুলের পরিচালন কমিটির সেক্রেটারি মণিময় হাজরা, যিনি আবার ওই অঞ্চলের এম. এল. এ.-ও বটে। সেই সুপারিশেই মিতুকে ভরতি করা গিয়েছে।

সাহানা বলল, ‘কেমন আছে ও?’

‘অনেকটা ব্লাড লস হয়েছে। কবজিতে রেডিয়াল আর্টারি না কী থাকে, সেটা সম্ভবত কেটে গেছে। ডাক্তার বললেন কাল সকালের আগে কিছু বলা যাবে না।’

‘সে কী! আচ্ছা, আমরা থানায় খবর দেব না?’ সাহানা ফিশফিশ করল।

ঊর্ণা একটু থেমে বলল, ‘দিতে তো হবেই। কিন্তু মণিময়দা বললেন, আজ রাতটা যাক।’

সাহানা মোবাইলে ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে ন’টা।

‘তোরা ফিরবি না আজ?’

‘কী করে ফিরব?’ ঊর্ণার বিরক্ত গলা শোনা গেল, ‘কাউকে না কাউকে তো থাকতে হবে। তার চেয়ে দুজনই থাকি, গল্পগুজবে সময় কেটে যাবে। তুই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। ফোনটা হাতের কাছে রাখিস।’

সাহানা চুপ করে বসে রইল।

মিতুর এই ঘরটায় ও কতদিন পরে এল!

আগে সাহানা আর মিতু একসঙ্গে এই ঘরেই থাকত। তারপর একদিন গণপতিকাকা এসে ঝামেলা করল। সাহানাকে চলে যেতে হল অন্য ঘরে, ঊর্ণার সঙ্গে।

‘শোনো, কলকাতা শহরে এইরকম পজিশনে তোমরা যে ভাড়ায় রয়েচ, লোকে শুনলে ভিরমি খাবে, বুয়েচ? ভাড়া বাড়ানোর নাম করলেই তোমাদের হাগা পেয়ে যায়। তাও আমি কিছু বলি না। কিন্তু আমার বাড়িতে কোনো নষ্টামি চলবে না। মিতু থাকে থাকুক, কিন্তু ও একা থাকবে। কিলিয়ার?’

আচ্ছা, সেদিন কি সাহানার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল? গণপতিকাকার কথার প্রত্যুত্তরে বলা উচিত ছিল, ‘এসব কী বলছেন কাকাবাবু? আমার ওর সঙ্গে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

সাহানা সেদিন কিছু বলেনি। চুপ করে ছিল। গণপতিকাকা কিছুক্ষণ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কথা বলে চলে গিয়েছিল। বদরাগি আর কথাবার্তার ধরণ খারাপ হলেও লোকটা টাকার পিশাচ নয়।

রাত পৌনে দশটা। ঊর্ণা নেই, পলি নেই। সিমি অবশ্য আছে। কিন্তু সে ভারি ঘুমকাতুরে, বয়সেও অনেক ছোটো। এসপ্ল্যানেডের দিকের একটা বিউটি কাম ম্যাসাজ পার্লারে কাজ করে। ভালো পরিশ্রমের কাজ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ও ঘুমিয়ে পড়েছে। পলিও আর-একটা ম্যাসাজ পার্লারে কাজ করে। কিন্তু সে অত আদুরে নয়। তার দশাসই চেহারা, খাটতে পারে প্রচুর।

সাহানা আবার মিতুর খাতাটা খুলল। মিতুর হাতের লেখা বেশ ভালো। ডায়েরির হলদেটে মোটা কাগজের ওপর লাল কালিতে গোটা গোটা করে লেখা।

সাহানা প্রথম পৃষ্ঠা থেকে পড়তে শুরু করল।

আজকের হরিদ্বার থেকে চম্বল পর্যন্ত গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী যে সুবিশাল গাঙ্গেয় ভূমি, মহাভারতের কালে সেই রাজ্যেরই নাম ছিল পাঞ্চাল। এই ঐশ্বর্যময় রাজ্যটিতেই এই আখ্যান আরম্ভ হচ্ছে। এ-রাজ্যের বাসিন্দারা পাঞ্চাল নামে খ্যাত।

পাঞ্চালরাজ পৃষৎ দীর্ঘকাল বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজ্যশাসনের পর স্বর্গযাত্রা করলে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমানে সিংহাসনে আরোহণ করেছেন রাজা দ্রুপদ।

দিগন্তবিস্তৃত উর্বর শস্যশ্যামলা কর্ষণযোগ্য ভূ-ভাগ এবং পরিশ্রমী প্রজাবৃন্দ, এই দুই সম্পদে পাঞ্চাল রাজ্য অন্তরে-বাহিরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

হৈমন্তী প্রভাতের কবোষ্ণ আবহ জড়িয়ে আছে এ-রাজ্যের কৃষিভূমি, অরণ্য, নদী, এমনকি প্রজাদেরও সঙ্গে।

আজ যে তাদের বড়ো আনন্দের দিন। রাজা দ্রুপদের একমাত্র পুত্রের শুভবিবাহ আজ! রাজকুমার সবেমাত্র কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে উপনীত হয়েছেন। কোমল গণ্ডে এখনও ওঠেনি শ্মশ্রুগুম্ফ রেখা। তবু রূপলাবণ্যে তিনি ইতিমধ্যেই বহু তরুণীর দীর্ঘশ্বাস সৃজনে সক্ষম।

দিকে দিকে বেজে চলেছে আনন্দবাদ্য। রাজধানী কম্পিল্য পুষ্পের বর্ণে ও গন্ধে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেছে মালিনীরা— যাতে কোনো বিবর্ণ বা নিস্তেজ পুষ্প এ-আনন্দে ব্যাঘাত না ঘটায়।

রাজপুত্রের বিবাহ বলে কথা!

রাজপ্রাসাদের একেবারে বাইরে বিশাল তোরণের দু-পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুই দৈত্যসম হস্তী। এদের নাম গজরাজ ও পুষ্কর। তোরণ থেকে গুঞ্জরিত সুরলহরীর সঙ্গে সঙ্গত করছে দ্রুপদের প্রিয় এই দুই দ্বিরদের শুঁড়-সঞ্চালন। এক সুবেশ রাজকর্মচারী শঙ্খধ্বনি করল। দূরে দাঁড়িয়ে-থাকা প্রজারা সোল্লাসে হর্ষধ্বনি করে উঠল, ‘জয় পাঞ্চালরাজের জয়! জয় রাজকুমারের জয়!’

উদার হস্তে বিতরিত হচ্ছে মিষ্টান্ন। কোনো ভিক্ষুক আজ বঞ্চিত নয় রাজানুগ্রহ থেকে। মহামন্ত্রী চিত্রবান স্বয়ং অন্ন-বস্ত্র-অর্থ বিতরণের প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করছেন। তারই মধ্যে তিনি নিম্নকণ্ঠে ছত্রধারী সহচরকে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রস্তুতি কি সম্পূর্ণ হয়েছে?’

‘আজ্ঞে না প্রভু।’ বিনম্র উত্তর দেয় সহচর, ‘এখনও রাজপুত্রের প্রস্তুতি সমাপ্ত হয়নি।’

‘সে কী!’ অধৈর্য ভঙ্গিতে বলে ওঠেন চিত্রবান, ‘বিবাহের লগ্ন আগামীকাল গোধূলিতে। তার মধ্যে পৌঁছোতে হলে আর তো বিলম্ব করা চলে না।’

মহামন্ত্রী চিত্রবানের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও রাজগৃহে পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। প্রাসাদের অন্দরমহলে তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এক রুদ্ধশ্বাস নাটিকা।

মহারাজ দ্রুপদ বিরক্ত মুখে তাঁর শয়নকক্ষে পদচারণা করছেন। কিছু দূরে রাজপালঙ্কে ভর দিয়ে দণ্ডায়মান মহারানি প্রশতী। এই মধ্যযৌবনেও তিনি অপূর্ব সুন্দরী। তাঁর নির্মল হাস্যে শুষ্ক তরুলতাও নাকি মুহূর্তে সতেজ সবুজ হয়ে ওঠে।

কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি প্রফুল্ল নন। বরং এক ধূসর বিমর্ষতা তাঁর মুখটিকে নিষ্প্রভ করে তুলেছে।

দ্রুপদের থেকে সামান্য দূরে করজোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রাজকুমার। তিনি অনিন্দ্যকান্তি যুবাপুরুষ। আয়ত দুই চক্ষুর নেত্রমণি এতই কৃষ্ণবর্ণ যে ভ্রম হয়, তিনি বুঝি কাজল পরেছেন। তাঁর গাত্রবর্ণ হরিদ্রার মতো উজ্জ্বল।

আজ তাঁর বিবাহ। পরে নিশ্চয়ই তিনি আরও বহু রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী হবেন, কিন্তু প্রথম সমস্ত কিছুরই অনুভূতি স্বতন্ত্র।

এমন আনন্দের দিনে তাঁর মুখ মলিন কেন?

রাজকুমার করজোড়ে পুনরায় বলে উঠলেন, ‘দয়া করুন পিতা! জেনেশুনে এক কন্যার ধর্মনষ্ট করা কি শাস্ত্রসিদ্ধ?’

‘স্তব্ধ হও, অর্বাচীন!’ মহারাজ দ্রুপদ ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলেন। তাঁর চিৎকারের প্রাবল্যে শঙ্কিত রানি চকিতে দেখলেন দ্বারের দিকে।

তবে তাঁর শঙ্কা অমূলক। কক্ষের বাহিরে একাধিক স্তরে নিযুক্ত রয়েছে প্রহরীরা। রাজপরিবারের গোপন কথাটি যেন গোপনই থাকে, তা নিশ্চিত করাই তাদের কর্তব্য।

উত্তেজিত দ্রুপদ আবার বললেন, ‘তুমি কি দেবাদিদেব শিবকে মিথ্যাবাদী বলতে চাও?’

থরথর করে কেঁপে উঠলেন তরুণ রাজকুমার। ললাটে যুক্তকর স্পর্শ করে মহেশ্বরের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে তিনি বললেন, ‘এ কী বলছেন পিতা! প্রাতঃ প্রাতর্যথালোকো জায়তে সূর্যমণ্ডলাৎ, মত্তো জগত সর্বং জায়তেহস্তি বিলিয়তে।* সূর্য থেকে যেমন সহস্র আলো উৎপন্ন হয়ে আবার তাঁতেই বিলীন হয়, এই ব্রহ্মাণ্ড, এই বিশ্বজগৎ যে মহেশ্বরের থেকে উৎপন্ন হয়ে তাঁর মধ্যেই বিলীন হবে। তাঁকে আমি কী করে অশ্রদ্ধা করতে পারি?’

(* শিব গীতা ৭/৭)

দ্রুপদ কিঞ্চিৎ শান্ত হলেন। কণ্ঠের তীব্রতা কমিয়ে বললেন, ‘তবে তুমি এই বিবাহে অনিচ্ছুক কেন?’

রাজকুমারের দুই মায়াময় চোখ এবার জলে ভরে উঠল। খুব ধীর লয়ে তিনি বললেন, ‘মহাদেবই আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন পিতা, এই বিবাহ থেকে বিরত থাকতে।’

‘কী!’ দ্রুপদ যেন স্বকর্ণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

‘হ্যাঁ পিতা।’ রাজকুমার বললেন, ‘শিব নিজেই তো বলেছেন, নাস্তি সত্যাৎ পরো নানৃতাৎ পাতকং পরম। মানুষের সবচেয়ে পুণ্যের কাজ হল সত্যের পথে অগ্রসর হওয়া। এক্ষেত্রে কি আমি সত্যের পথে চলেছি? যাকে আমি আমার সহধর্মিণী করতে চলেছি, তাঁর প্রতি কি আমি স্বামীধর্ম পালন করতে পারব?’

‘পারবে পুত্র।’ এবার দ্রুপদ উত্তেজিত হলেন না। শান্তস্বরে তিনি বললেন, ‘আমার কথায় নয়, দেবাদিদেব শম্ভুর কথায় বিশ্বাস করো। তোমার জন্মের সময় তিনি স্বয়ং বলেছিলেন, নারীশরীর নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও তুমি একদিন পুরুষত্ব লাভ করবে। সেজন্যই একজন পুরুষ বাল্যকাল থেকে যা যা শিক্ষাগ্রহণ করে, তোমাকে তাই দেওয়া হয়েছে। অস্ত্রচালনা, শরক্ষেপণ, মল্লযুদ্ধ— কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। তুমিও প্রতিটি ক্ষেত্রে সবিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছ। সেটাই স্বাভাবিক। তোমার অন্তরে নারীত্ব নয়, কঠোর পৌরুষ আত্মগোপন করে রয়েছে। প্রজাপুঞ্জ তাই তোমাকে পাঞ্চাল রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবেই চেনে।’

‘আমি নিজেও তাই মনে করি পিতা।’ রাজকুমার অধোবদনে বলেন, ‘কিন্তু আমার শরীর যে আমার মনের বিপরীতে। পৌরুষ তো শুধু বীর্যদানে হয় না! শৌর্যে, বীরত্বে, সততাতেও পৌরুষ সংজ্ঞায়িত হয়। আমি না হয় দ্বিতীয়টাই নির্বাচন করলাম। ক্ষতি কী?’

‘তা হয় না।’ দ্রুপদের মুখ পুনরায় রক্তাভ হয়ে উঠল অবরুদ্ধ ক্রোধে, ‘পাঞ্চাল রাজ্যেরও উত্তরাধিকারী পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তুমি তা খর্ব করতে পার না। আর আমার স্থির বিশ্বাস শিখণ্ডী, তুমি … তুমি একদিন পরিপূর্ণ বীর্যবান পুরুষ হয়ে উঠবে। দেববাক্য মিথ্যা হতে পারে না।’

শিখণ্ডী নিষ্প্রভ মুখে পিতার দিকে তাকালেন। এমন আস্থার উত্তরে আর কীই বা বলার থাকতে পারে?

‘তা ছাড়া তুমি তো সবই জানো, পুত্র।’ দ্রুপদের মুখচ্ছবি সহসা গম্ভীর হয়ে উঠল, ‘হস্তিনাপুরের সঙ্গে পাঞ্চালের শত্রুতা তো আজকের নয়! আজ সেই রাজ্যটি শাসন করছেন ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ওই হস্তিনাপুর? রাজা হস্তী। হস্তীর পৌত্র রাজা অজমীঢ়। তাঁর এক পত্নীর গর্ভজাত পুত্র রাজা সংবরণ সিংহাসনে বসেছিলেন। অন্য পত্নীর পাঁচ পুত্রকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল সিংহাসন থেকে। সেই পাঁচ পুত্রই হস্তিনাপুর পরিত্যাগ করে এসে আমাদের এই পাঞ্চাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা তাঁদেরই উত্তরপুরুষ।’

জন্মাবধি এই প্রাচীন কাহিনি শ্রবণ করে আসছেন শিখণ্ডী। তবুও কিছুটা বিস্মিত স্বরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তবে আপনি সব জেনেশুনেও শত্রুর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে এমন উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন কেন, পিতা?’

দ্রুপদ বললেন, ‘একজন রাজপুত্র হিসাবে, ভবিষ্যৎ নৃপতি হিসাবে সেই কূটনৈতিক কারণ তোমার অনুমান করা উচিত, শিখণ্ডী। শত্রুকে নিধন করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন তার নিকটে থাকা। এক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্কের চেয়ে অধিক নৈকট্য আর কী হতে পারে? হস্তিনাপুরের রাজকন্যা পাঞ্চাল রাজ্যের পুত্রবধূ হয়ে এলে আমরা কুরুবংশীয়দের আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারব। সুদূর ভবিষ্যতে সেই ঘনিষ্ঠতাই আমার পঞ্চপূর্বসূরির বঞ্চনার প্রতিশোধ নেওয়ার পাথেয় হবে, পুত্র!’

শিখণ্ডী বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাঁর সুকৌশলী পিতার দিকে। দ্রুপদ যে নিজের সন্তানকেও হেলায় অক্ষক্রীড়ার পঞ্জরি বানাতে পারেন, তা শিখণ্ডী’র কল্পনার অতীত ছিল।

দ্রুপদ অবশ্য পুত্রের মনোভাব নিয়ে ভাবিত হলেন না। তিনি বলে চললেন, ‘তা ছাড়া, আমরা যদি বর্তমানের কথাও বিবেচনা করি, হস্তিনাপুরের সঙ্গে এই আত্মীয়তায় পাঞ্চালের লাভ প্রচুর। প্রয়াত রাজা বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। পাণ্ডু ইতিমধ্যেই প্রয়াত, তাঁর পাঁচটি পুত্র। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের একশোটি পুত্র ও সবচেয়ে কনিষ্ঠ একটিমাত্র কন্যা। সেই কন্যা, পরমাসুন্দরী দুঃশলাই তোমার ভাবী পত্নী। তুমি বুঝতে পারছ, সে পরিবারের মধ্যে কতখানি আদরণীয়া? পরবর্তীকালে ধৃতরাষ্ট্রনন্দন দুর্যোধনই রাজা হোক, বা পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, দুঃশলা তেমনই পরমাদৃতা থাকবে। একমাত্র জামাতা হিসাবে তুমি সমস্ত প্রতিকূলতায় তাদের পাশে পাবে, শিখণ্ডী! তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের প্রতিভার কথা ইতিমধ্যেই সর্বজনবিদিত। একদিকে নিজেদের বিপদে তুমি তাঁদের পাশে পাবে। অন্যদিকে তাঁদের বিনাশ-সাধনে ব্রতী হব আমরা। সমগ্র হস্তিনাপুর অধিকার করে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করব আমাদের পূর্বপুরুষদের।’

শিখণ্ডী নির্বাক হয়ে রইলেন। তাঁর পিতা সর্বার্থেই একজন রাজা, একজন কূটনীতিক। পুত্রের হৃদয়ের বাণী তাঁকে স্পর্শমাত্র করবে না, এ-কথা তিনি আবারও উপলব্ধি করলেন আজ।

‘যাও শিখণ্ডী, যাও!’ দ্রুপদ আলোকিত মুখে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। মহাদেবের অপার মহিমায়, হয়তো বিবাহের প্রথম রাতেই তুমি পৌরুষের শিখর স্পর্শ করবে, পুত্র! দুঃশলা তৃপ্ত হবে। এ আমার আশা নয়, দৃঢ় বিশ্বাস!’

বাক্যব্যয় নিষ্প্রয়োজন বুঝে আর কিছু বললেন না শিখণ্ডী। পিতা ও মাতাকে প্রণাম করে তিনি কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

তৎক্ষণাৎ তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল বাইরের বিবাহোপলক্ষ্যে বেজে চলা আনন্দবাদ্য।

এক লহমার জন্য তাঁর মনে হল, পিতার ধারণাই কি সঠিক? তিনি কি তবে সত্যিই পুরুষ? তবে কোথায় তাঁর পুরুষাঙ্গ? পেশিবহুল পুরুষ শরীরের পরিবর্তে কেন তাঁর তনুদেহ এমন পেলবতায় মোড়া? যৌবনের প্রারম্ভে উপনীত হয়েও শ্মশ্রুগুম্ফের আভাস নেই কেন তাঁর মুখমণ্ডলে?

আর পিতা যদি ভ্রান্ত হন, তবে এই আঠারো বছর বয়সেও তাঁর দেহে নারীত্বের অস্তিত্ব নেই কেন? যোনি আছে, কিন্তু তা শুষ্ক। স্তন আছে, কিন্তু তা একেবারেই অপরিণত। ঋতুদর্শন এখনও হয়নি।

কেন?

এই বিশ্বের প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব পরিচয় আছে। কেউ পুরুষ, কেউ নারী। প্রত্যেকে নিজস্ব পরিচয়ে সৃষ্টি করে আপন উত্তরাধিকার। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সৃজন করে আপন মানসভুবন, স্বীয় শারীর-পৃথিবী। কিন্তু তাঁর সেই সৌভাগ্য নেই।

তিনি কে? তিনি কি ক্লীব?

অলিন্দ দিয়ে হাঁটতে থাকেন শিখণ্ডী। শিশুকাল থেকে এই প্রাসাদের বিশাল কক্ষগুলিতে আর অলিন্দে ক্রীড়া করে বড়ো হয়েছেন তিনি। রাজ্যবাসীর কাছে গোপন থাকলেও এই প্রস্তর, এই ইষ্টক, এই প্রাচীর প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর শৈশব, তাঁর সব কিছু।

শিখণ্ডীর মনে হল, জড় হয়েও তারা যেন বিদ্রুপের হাসি হাসছে তাঁকে দেখে। নির্বাক স্থির অবস্থানেও অদৃশ্য আঙুল তুলে তারা যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, বিবাহের আয়োজন যত প্রকাণ্ডই হোক, কোনো নারীকে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার অধিকার তাঁর নেই।

‘আমি তো আপনার আজ্ঞানুসারে পুরুষই হতে চেয়েছিলাম, পিতা!’ স্বগতোক্তি করলেন শিখণ্ডী, ‘জন্মেছিলাম শিখণ্ডিনী হয়ে। কিন্তু আপনাকে তুষ্ট করতে মনের জোরে আমি এমন বহু কর্ম করেছি, যা নারীর অসাধ্য বলেই বিবেচিত হয়। অভ্যাসকালে অসিচালনায়, মৃগয়াকালে পশুনিধনে, যুদ্ধকালে শত্রুনিধনে সর্বত্র দেখাতে চেয়েছি পুরুষোচিত কাঠিন্যের ছাপ। আমার দেহ নারীর হলেও আপনার আদেশের সুচারু পালন আমাকে করে তুলেছে পুরুষ, তবে সে পৌরুষ আজও অন্তঃসলিল। বেশ। এক্ষেত্রেও, আপনার আদেশই শিরোধার্য। এই বিবাহ আমি করব।’

গতকাল শিখণ্ডী হস্তিনাপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে আটশত হস্তী এবং সহস্র সৈন্য। প্রতিটি হস্তীপৃষ্ঠেই রক্ষিত আছে শিখণ্ডী’র ভাবী শ্বশুরকুলের জন্য বহুমূল্য উপহারদ্রব্য। এই বংশে পুত্রের বিবাহ-বাসরে পিতা বা মাতা কারও উপস্থিতি অভিপ্রেত নয়। তাই শিখণ্ডীর অভিভাবক হয়ে তাঁর সঙ্গে চলেছেন রানি প্রশতী’র ভ্রাতা সত্যজিৎ।

রাজা দ্রুপদ আপাতত প্রশতী’র কক্ষেই বিশ্রাম করছেন। শিখণ্ডী সস্ত্রীক প্রত্যাবর্তন করবে আগামীকাল প্রভাতে। তাঁরা তো বটেই, গোটা রাজ্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছে নববধূকে সাদরে বরণের জন্য।

কেশবিন্যাস করতে-করতে রানি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দ্রুপদের তা নজর এড়াল না। গতদিবসে শিখণ্ডী’র প্রস্থানের পর থেকেই প্রশতী বিমর্ষ হয়ে রয়েছেন। তাঁর বিষাদের কারণ অনুমান করতে দ্রুপদের অসুবিধা হল না।

অনেকটা জবাবদিহির ভঙ্গিতে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমায় ভুল বুঝো না, রানি। তুমি ছাড়া আমার অন্য দুই মহিষী আমাকে এখনও সন্তান দিতে পারেননি। তোমার কাছে আমি ঋণী। তুমি তো জানো, তোমার গর্ভাবস্থায় রাজ্যশাসন ফেলে রেখে কীভাবে আমি দিনের পর দিন গভীর অরণ্যে মহাদেবের তপস্যা করেছি। শুধুমাত্র একটি পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষায়, চরম কৃচ্ছ্রসাধনে মনপ্রাণ দিয়ে দেবাদিদেবকে ডেকেছিলাম আমি। কোনো বর নয়, কোনো জয় নয়, শুধুমাত্র এক উত্তরাধিকারী চেয়েছিলাম আমি।’

‘আপনি তো বলেছিলেন, দেবাদিদেব আপনার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে আপনাকে সাক্ষাৎ দিয়েছিলেন।’ মৃদুস্বরে বললেন প্রশতী।

‘হ্যাঁ।’ দ্রুপদ মস্তকহেলন করেন, ‘মহাদেব বলেছিলেন, ‘তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট, দ্রুপদ! তোমার তপস্যা ব্যর্থ হবে না। তোমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী’র গর্ভে পুত্রসন্তানই পাবে।’

‘কিন্তু’ ইতস্তত করেন প্রশতী, ‘সন্তান জন্মের পর তো দেখলাম…!’

‘জানি তুমি কী বলবে।’ দ্রুপদ আশ্বস্ত করতে চাইলেন প্রশতীকে, ‘শিশ্নের পরিবর্তে শিখণ্ডী জন্মেছিল যোনি নিয়ে। আমি আশাহত হলেও তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলাম। সেই দ্যুতিময় শিশুকন্যার মস্তকের সামনের ভাগের কেশ বিন্যস্ত ছিল ময়ূরপুচ্ছের মতো। তাই মনে-মনে তার নামকরণ করেছিলাম শিখণ্ডিনী। স্থির করেছিলাম, পরদিন রাজ্যবাসীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব যে রাজকন্যার শুভাগমন ঘটেছে এ-রাজ্যে। কিন্তু সেই রাতেই যে স্বয়ং নীলকণ্ঠ আমার স্বপ্নে আবির্ভূত হলেন! তীব্র ভর্ৎসনা করে তিনি বললেন, আমি কি তাঁর কথায় ভরসা রাখতে পারিনি? আমার সর্বাঙ্গ কম্পিত হল। বললাম, ‘সেই স্পর্ধা আমি কী করে দেখাতে পারি প্রভু?’ তখন তিনি প্রশ্ন করলেন, তবে কেন তিনি পুত্রসন্তানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও আমি স্ত্রী-বাচক নামকরণ করার কথা ভাবছি?’

কথা শেষ করে দ্রুপদ বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক রইলেন।

স্বামীর মনের টানাপোড়েন উপলব্ধি করে রানি প্রশতী এগিয়ে এলেন। স্বামীর মস্তক নিজের বক্ষে আকর্ষণ করে অস্ফুটে বললেন, ‘স্থির হোন, রাজন। আপনি উপযুক্ত সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। স্বয়ং মহাদেব যখন আশ্বাস দিয়েছেন, শিখণ্ডী পৌরুষলাভ করবেই।’

দ্রুপদ আলিঙ্গন করলেন প্রিয়মহিষীকে। প্রশতী শুধুই তাঁর সহধর্মিণী নন, সহমর্মিণীও বটে।

বেশ কিছুকাল পর এই দম্পতি সুযোগ পেয়েছেন এক সংক্ষিপ্ত নিভৃতযাপনের। রাজকর্ম জটিল ব্যাপার। রানি প্রশতীও রাজপরিবারের নিত্যকর্মের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সাতিশয় ব্যস্ততার মধ্যে দিনযাপন করেন।

আজ অবসর পেয়ে দ্রুপদ নিজের অধর মিশিয়ে দিলেন প্রিয়তমার বান্ধুলিপুষ্পের তুল্য নরম ওষ্ঠে। দৃঢ় অভিষঙ্গে এক হাতে শিথিল করলেন রানির বক্ষবন্ধনীর ফাঁস। হস্তকাকুদ্রে নিষ্পেষণ করতে থাকলেন যুগ্মকমলের মতো দুই স্তন। তীব্র দংশনে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকলেন রানির উদ্ধত রক্তাভ স্তনমুখ।

তীব্র সুখে ছটফট করছিলেন প্রশতী। আশ্লেষে তিনি নখরাঘাতের চিহ্ন আঁকছিলেন স্বামীর পৃষ্ঠদেশে।

কিয়ৎক্ষণের রতিক্রীড়ার পর উত্তেজিত দ্রুপদ যখন রমণে প্রবৃত্ত হতে যাবেন, ঠিক তখনই কক্ষের বহির্দ্বারে মুহুর্মুহু আঘাত শোনা গেল।

‘কে?’ দ্রুপদের ক্রোধ ও বিরক্তি সগর্জনে প্রকাশিত হল।

এটি রানি প্রশতী’র ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ। রাজা ভেতরে উপস্থিত আছেন জেনেও কার এত বড়ো দুঃসাহস যে অসময়ে বিরক্ত করে?

রানি উঠে বসে বললেন, ‘আপনি বিব্রত হবেন না। হয়তো কোনো নবনিযুক্ত চপলা পরিচারিকা ভুল করে ফেলেছে। আমি দেখছি।’

ক্ষিপ্রহস্তে বিস্রস্ত বসন সংযত করে রানি এগিয়ে গেলেন। দ্বার উন্মুক্ত করে মৃদঙ্গীকে দেখে বিস্মিত হলেন তিনি। মৃদঙ্গী তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকা। প্রাসাদের সবচেয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ দাসী সে। ভ্রান্তিবশত সে এমন আচরণ করবে, এ একেবারেই অবিশ্বাস্য। তার অভিব্যক্তিও প্রশতী’র ধারণাকে সমর্থন করছিল।

‘কী হয়েছে, মৃদঙ্গী?’ রানি নিজেকে শান্ত রেখেই জানতে চাইলেন।

মৃদঙ্গী ভয়ার্ত কণ্ঠে অধোবদনে বলল, ‘অপরাধ মার্জনা করবেন রানিমা। একান্ত প্রয়োজন না থাকলে আমি…!’

‘বুঝেছি। কী হয়েছে তা বল।’

মৃদঙ্গী কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘কুমার হস্তিনাপুর থেকে এসে পৌঁছেছেন, রানিমা।’

প্রশতী চমকিত হয়ে বললেন, ‘সে কী! বধূমাতা এসে গেছে? এত সত্বর? আগামীকাল প্রত্যুষে আগমনের কথা ছিল তো। যাই হোক, তোমরা সব আয়োজন সম্পূর্ণ করেছ? বরণডালা, প্রদীপ, দূর্বা?’

ভূমিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মৃদঙ্গী বলল, ‘কুমার একাকী প্রত্যাবর্তন করেছেন, রানিমা।’

‘কী?’ প্রশতী স্বকর্ণকে বিশ্বাস করতে পারলেন না, ‘একাকী প্রত্যাবর্তন করেছেন মানে?’

মৃদঙ্গী মিথ্যা বলেনি। সত্যই রাজকুমার শিখণ্ডীকে রিক্ত হাতে আসতে হয়েছে নিজরাজ্যে। ফিরতে হয়েছে চরম অপমানের বোঝা স্কন্ধে নিয়ে। প্রকারান্তরে স্বীকার নিতে হয়েছে অবিশ্বাস্য অপরাধের অভিযোগ।

যে অপরাধ সম্পর্কে রাজপুত্র নিজেই অবগত নন।

এর অন্তর্বর্তী ঘটনাটি নিঃসন্দেহে মর্মন্তুদ এবং কৌতূহলোদ্দীপক। তা জানতে গেলে আমাদের যাত্রা করতে হবে পাঞ্চাল থেকে উত্তর-পশ্চিমদিক অভিমুখে। হস্তিনাপুর রাজ্যে।

বর্তমান দিল্লি নগরীর পূর্বদিকে, মিরাটের নিকটস্থ গঙ্গার যে দক্ষিণ তীরবর্তী অঞ্চল, তাই-ই দ্বাপর যুগে ছিল হস্তিনাপুর।

দুই পক্ষকাল আগে হস্তিনাপুরের নৃপতি ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র কন্যা দুঃশলার সঙ্গে নিজপুত্রের বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করেছিলেন দ্রুপদ। সেই প্রস্তাবের সঙ্গে প্রেরিত হয়েছিল নানাবিধ বহুমূল্য উপঢৌকন।

পাঞ্চালরাজের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর স্ত্রী গান্ধারী খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রের ভ্রাতা পাণ্ডু অকাল-প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর পঞ্চপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানদের সঙ্গে একইভাবে লালিত ও পালিত হচ্ছে। হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে বাস করেন পাণ্ডুজায়া বিধবা কুন্তীও।

কুন্তী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও বিদুষী রমণী। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী তাই একবার তাঁর সঙ্গেও পরামর্শ করার কথা ভাবলেন।

‘আমার মনে হয়, সবদিক থেকেই এ একেবারে উপযুক্ত বিবাহ-প্রস্তাব।’ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানালেন কুন্তী, ‘পাঞ্চাল ও হস্তিনা শক্তিতে, সমরে, আয়তনে, সমৃদ্ধিতে একেবারে সমকক্ষ দুই রাজ্য। দুঃশলা চতুর্দশী হলেও এখনও কারও বাগদত্তা নয়। পাঞ্চালরাজ্যের কুমারও যুবা, বয়স মাত্র সতেরো। আমার মনে হয় এই সম্পর্ক দু-জনের জন্য তো বটেই, দুই পরিবারের পক্ষেই শুভঙ্কর হবে।’

‘কিন্তু অন্য একটি সমস্যা আছে যে।’ গান্ধারী বললেন, ‘পিতামহ ভীষ্ম এখন রাজধানীতে উপস্থিত নেই। রাজকার্যে তিনি এখন অবস্থান করছেন পশ্চিমে, কাম্যক বনের নিকটে। তাঁর অনুমতি ব্যতীত আমরা কীভাবে এই বিবাহে সম্মতি দিতে পারি?’

কুন্তী কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, ‘বেশ। তবে অপেক্ষা করতে বলা হোক পাঞ্চালরাজকে। পিতামহ ফিরে এলে কুরুবংশীয় কন্যাদের নিয়ম অনুযায়ী স্বয়ংবরের আয়োজন করা হবে। দুঃশলা নিজের পছন্দ অনুযায়ী উপযুক্ত ক্ষত্রিয়নন্দন নির্বাচন করতে পারবে।’

সামান্য ইতস্তত করে গান্ধারী বললেন, ‘দুঃশলা কোথা থেকে পাঞ্চালের রাজপুত্রের রূপ ও শৌর্যের সুখ্যাতি শ্রবণ করেছে, জানি না। কিন্তু শ্রবণের পর থেকে সে আর স্বয়ংবরে সম্মত নয়, কুন্তী। পাঞ্চালরাজের কাছ থেকে প্রস্তাব আসার পরেই সে আকারে-ইঙ্গিতে তার অভিপ্রায় আমার কাছে ব্যক্ত করেছে।’

কুন্তী অপাঙ্গে গান্ধারীর দিকে তাকালেন। আশ্চর্য রমণী এই গান্ধারী! জন্মান্ধ স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী হতে মানুষটি বিবাহের পর একবারের জন্যও চোখ থেকে পট্টাচ্ছাদন খোলেননি। নিজে প্রখর বুদ্ধিমতী হলেও কুন্তী বোঝেন, গান্ধারী একেবারে স্বতন্ত্রা। ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাধিপতি হলেও রাজকর্মে পরোক্ষ চালিকাশক্তি তাঁর ব্যক্তিত্বময়ী, স্থিরবুদ্ধিসম্পন্না সহধর্মিণীই।

‘সেক্ষেত্রে আমরা অনর্থক কাল অপচয় করছি।’ কুন্তী স্মিত হেসে বললেন, ‘বিবাহের আয়োজন শুরু করলেই হয়। পিতামহের উদ্দেশে এই দণ্ডেই দ্রুতগামী দূত প্রেরণ করে দাও, যাতে তিনি সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করতে পারেন।’

ধৃতরাষ্ট্র তবু ইতস্তত করছিলেন। তাঁর এবং পাণ্ডু’র পিতা বিচিত্রবীর্য অকালে পরলোকগমন করেছিলেন। তারও বহু পূর্বকাল হতে হস্তিনাপুরের রাজ্য তথা রাজপরিবারের অভিভাবক হয়ে আছেন ভীষ্ম। নিঃস্বার্থ এক সুবৃহৎ বটবৃক্ষের মতো দণ্ডায়মান হয়ে যাবতীয় ঝড়-ঝঞ্ঝা, উত্তাপ ও শৈত্য থেকে রাজ্যকে রক্ষা করে চলেছেন পিতামত ভীষ্ম।

তাঁর প্রকৃত নাম দেবব্রত। বৃদ্ধ পিতা শান্তনু’র শেষ বয়সের প্রণয়কে পূর্ণতা দান করার জন্য ভীষ্ম বিমাতা সত্যবতী’র কাছে দুটি অঙ্গীকার করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বেচ্ছায় রাজ-সিংহাসন চিরকালের মতো পরিত্যাগ করেন বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের জন্য। এমনকি তাঁর উত্তরাধিকারী যাতে ভবিষ্যতে সিংহাসনের দাবি করতে না-পারে তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি চিরকৌমার্যের ব্রত নিয়ে ঘোষণা করেন, জগতের সমস্ত রমণীকে তিনি জননীর দৃষ্টিতে দেখবেন।

কী ভীষণ কঠোর এই দুই প্রতিজ্ঞা! পিতার জন্য এতখানি আত্মত্যাগ এর পূর্বে কেউ করেছেন কি? রাজা যযাতি নিজের ভোগতৃষ্ণা নিবারণের জন্য নিজ পুত্র পুরুর কাছে যৌবন প্রার্থনা করেছিলেন। পুত্রের থেকে আহরিত সেই যৌবন সহস্রবর্ষ ধরে উপভোগের পর যযাতি উপলব্ধি করেছিলেন, ভোগের দ্বারা ভোগের তৃষ্ণা মেটে না। তবু সেক্ষেত্রে পুরু পিতার অনুরোধে দান করেছিলেন নিজ যৌবন।

কিন্তু শান্তনু তো পুত্রের কাছে কোনো অনুরোধও করেননি! স্বেচ্ছায় এই ভীষণ ব্রত গ্রহণ এবং ভীষণতর ত্যাগের জন্যই দেবব্রত আজ ভীষ্ম!

পুত্রের এই আত্মত্যাগে সন্তুষ্ট শান্তনুই তাঁকে বর দিয়েছিলেন।

‘ন তে মৃত্যুঃ প্রভাবিতা যাবজ্জীতিতুমিচ্ছসি।

ত্বত্তো হ্যনুজ্ঞাং সম্প্রাপ্য মৃত্যুঃ প্রভাবিতাহনঘ!

হে পুত্র, তুমি যতকাল জীবিত থাকতে চাইবে, তোমার মৃত্যু হবে না। তুমি নিজে অনুমতি দিলে তবেই মৃত্যু তোমার কাছে আসতে পারবে।’

তারপর থেকে লৌহপুরুষ ভীষ্ম নীরবে পালন করেছেন এই রাজ্যকে। বিশ্বের অধীশ্বর হওয়ার যোগ্য হলেও তাঁকে পালন করতে হয়েছে শুধুমাত্র বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের অভিভাবকের ভূমিকা।

ইতিমধ্যে রাজ্যে একের পর এক পরিবর্তন এসেছে। শান্তনু ও সত্যবতীর দুই অযোগ্য পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য ভোগবিলাসে মত্ত থেকে অকালে স্বর্গারোহণ করেছেন। বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের কারণে সিংহাসনে বসেছিলেন কনিষ্ঠ পাণ্ডু। তিনিও আজ বিগত। একশো পাঁচজন রাজপুত্র আজ বেড়ে উঠছে পিতামহ ভীষ্মের স্নেহচ্ছায়ায়।

ঋজু অথচ নিষ্কাম, দৃঢ়চেতা অথচ উদাস, ক্ষত্রিয় অথচ জিতেন্দ্রিয় এই পুরুষটি সত্যই এক মহিরুহ। তাঁর অনুমতি না নিয়ে হস্তিনাপুরের সৈন্যবাহিনীর জন্য একটি অশ্ববাহিনীও ক্রয় করা হয় না।

অথচ বংশের একমাত্র রাজকন্যার বিবাহ নির্ধারিত হবে তাঁর অজ্ঞাতসারে!

‘কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন আপনি, আর্যপুত্র?’ গান্ধারী প্রশ্ন করলেন।

ধৃতরাষ্ট্র মুহূর্তে সব দ্বিধা ত্যাগ করলেন। বললেন, ‘না। কিছু না। আমি আজই পিতামহের সমীপে দূত প্রেরণ করছি। বিলম্বের প্রয়োজন নেই, বিবাহের আয়োজন শুরু হোক।’

কাম্যক বন সরস্বতী নদীর তীরে। কুরু সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত সেটি। বর্তমানে সেই স্থানে কচ্ছ উপসাগর বিরাজমান। পিতামহ ভীষ্ম প্রতি দ্বিবৎসরে একবার রাজ্যের সীমান্ত পরিদর্শনে যান। সীমান্তরক্ষীরা রাজধানী হস্তিনাপুর থেকে দূরে দীর্ঘকাল অবস্থান করে। তাদের মনোবল বহুগুণ বৃদ্ধি পায় ভীষ্মের উপস্থিতিতে।

হস্তিনাপুর থেকে কাম্যক অরণ্য পৌঁছোতে দূতের সময় লাগল এক পক্ষকাল। দূতের মুখে সব কথা শুনে চমকে উঠলেন ভীষ্ম। এ কী! তাঁর অনুপস্থিতির এই ক্ষণকালে যে এক ভয়ানক দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছে কুরুবংশের ওপর। বংশের একমাত্র কন্যা দুঃশলার বিবাহ নির্ধারিত হয়েছে পাঞ্চালের রাজপুত্রের সঙ্গে, যা একান্তই অসম্ভব!

ভীষ্ম তৎক্ষণাৎ হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করলেন। বিমূঢ় এক অমাত্য বললেন, ‘এখন গোধূলিবেলা। সন্ধ্যা আগতপ্রায়। আজ রাতে শিবিরে অবস্থান করে কাল প্রত্যুষে রওনা দিলে হয় না, প্রভু?’

‘না।’ স্বল্পবাক ভীষ্ম আদেশ দিলেন, ‘তোমরা কাল ধীরেসুস্থে এসো। আমার একমুহূর্ত বিলম্ব করলে চলবে না।’

দশজন বিশ্বস্ত সহচরকে নিয়ে নিরন্তর পথ চলেছেন ভীষ্ম। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় হস্তী বাসুদেব ছাড়া অন্য কোনো বাহনে এই যাত্রা অসম্ভব ছিল। পরিমিত আহার, পানীয়, দিনে মাত্র একপ্রহর বিশ্রাম এই হয়ে দাঁড়াল ভীষ্মের দিনযাপন। তা সত্ত্বেও এক পক্ষকাল পরে তিনি যখন হস্তিনাপুর রাজ্যে পৌঁছোলেন, ঘটনাচক্রে সেদিনই রাজকন্যা দুঃশলার বিবাহ।

গোটা রাজ্যে তখন উৎসবের আবহাওয়া। সকল গৃহ সজ্জিত করা হয়েছে পুষ্পমাল্যে। পথে সিঞ্চিত হয়েছে সুরভিত চন্দনবারি।

এমন সময় ভীষ্ম এসে উপস্থিত হলেন বিবাহ-অঙ্গনে। সেখানে তখন অগণিত দাসী ছাড়াও উপস্থিত রয়েছেন দুঃশলা, মহারানি গান্ধারী, গান্ধারীর ভ্রাতা শকুনির স্ত্রী এবং বিদুরপত্নী দেবিকা।

বিনা ঘোষণায় মহিলামহলে তাঁকে প্রবেশ করতে দেখে সবাই বিস্মিত হলেও পরমুহূর্তে সসম্ভ্রমে প্রণাম করলেন। গান্ধারী’র সামান্য ইঙ্গিতে পলকের মধ্যে সরে গেল দাসীরা। প্রস্থান করলেন শকুনি’র স্ত্রীও।

রইলেন শুধুমাত্র গান্ধারী, দুঃশলা ও দেবিকা।

ভীষ্ম একঝলক তাকালেন দুঃশলার দিকে। তাঁর মনে পড়ে গেল, বংশের একমাত্র কন্যা, সর্বকনিষ্ঠ এই পৌত্রী বলতে গেলে তাঁর ক্রোড়ে মানুষ হয়েছে। আজ সে বিবাহযোগ্যা। চিরকালের জন্য সে হস্তিনাপুর ছেড়ে চলে যাবে স্বামীর গৃহে। কিন্তু তিনি যা বলতে যাচ্ছেন, তা কি এই বালিকা সহ্য করতে পারবে?

সহ্য করতে না পারে, কাঁদুক। অশ্রু এবং কাল, এই দুইয়ের প্রলেপ বহু ক্ষতস্থান পূর্ণ করে দেয়। কিন্তু আজ তিনি কঠোর না হলে যে বিপর্যয় হবে, তা অপূরণীয়ই থাকবে।

নিজেকে দৃঢ় করলেন ভীষ্ম। তারপর অনুচ্চ অথচ স্থির কণ্ঠে বললেন, ‘এই বিবাহ হবে না।’

নৈঃশব্দ্য যেন পাষাণের মতো ভারী হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যে। শুধু স্তম্ভিত নয়, বাকশক্তিরহিত হলেন সকলে।

ইতিমধ্যে ভীষ্মের অন্দরমহলে প্রবেশের সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাসাদে। উপস্থিত হয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী ও বিদুর।

‘কী বলছেন জ্যেষ্ঠতাত!’ আর্তনাদ করে উঠলেন ধৃতরাষ্ট্র, ‘দুঃশলা যে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে পড়বে।’

‘না।’ শান্তকণ্ঠে বললেন ভীষ্ম, ‘আমি সেই ব্যবস্থা করেই এসেছি ধৃতরাষ্ট্র। সেজন্যই কিছু বিলম্ব হল। সিন্ধু প্রদেশের রাজা বৃদ্ধক্ষত্র আমার পূর্ব-পরিচিত। তিনি সজ্জন ক্ষত্রিয়। তাঁর পুত্র জয়দ্রথ সুপাত্র। সে আজ বিবাহলগ্নের মধ্যেই হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হবে।’

ধৃতরাষ্ট্র তবু শান্ত হতে পারলেন না। তীব্র অস্থিরতায় মস্তক সঞ্চালিত করে তিনি বলে ওঠেন, ‘কিন্তু পাঞ্চাল রাজ্যের কুমার যে এক্ষুনি এসে পড়বেন! তাঁকে কী জবাব দেব আমি? আমার অপমানের যে কোনো সীমা থাকবে না জ্যেষ্ঠতাত!’

মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে থাকেন ভীষ্ম। গত সাতদিন ধরে অরণ্যপথে আসার সময় বারবার আনমনা হয়ে পড়ছিলেন তিনি। তাঁর স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিল কয়েক দশক আগের একটি ঘটনা। এই চিরকুমার জীবনে একটিবার … মাত্র একটিবার স্পর্শ করা এক পেলব হাতের স্পর্শ ফিরে এসেছিল মনে।

তারই সঙ্গে, স্মৃতির গভীরতম বিন্দু থেকে ভেসে এসেছিল অনির্বচনীয় সুগন্ধ, এক ক্রুদ্ধ নারীকণ্ঠ, এক অভিসম্পাত … আহ!

দীর্ঘায়ু হওয়া যে কী যন্ত্রণাময় তা ব্যক্ত করা যায় না। তা শুধু সহন করতে হয়।

সম্বিৎ ফিরে পেলেন ভীষ্ম। থেমে থেমে বললেন, ‘তুমি শুধু বলবে, পিতামহ ভীষ্মের এই বিবাহে সম্মতি নেই। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। সব দোষ আমিই ধারণ করব।’

সকলের বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে প্রস্থানোদ্যত হয়েও থমকে যান তিনি, ‘আর হ্যাঁ, পাঞ্চাল রাজকুমারকে যথোপযুক্ত আতিথ্যের সঙ্গেই সসম্মানে বিদায় দিও। দেখো, তাঁর যেন বিন্দুমাত্র অপমান না হয়।’

অধ্যায় ১ / ৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন