শিখণ্ডী – ১০

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

অতি অশুভ ঘটনারও কিছু ভালো দিক আছে। এক্ষেত্রেও সেই প্রবাদ প্রযোজ্য। পাঞ্চালরাজ্যের শোচনীয় পরাজয় ও যুদ্ধ-পরবর্তী উথাল-পাতালে বিবাহমঞ্চ থেকে শূন্যহস্ত শিখণ্ডী’র প্রত্যাবর্তনের কথা অনেকেই বিস্মৃত হল। জীবন আবার ফিরে এল নিজ ছন্দে।

কিন্তু ভুলতে পারলেন না দু-জন। দ্রুপদ ও শিখণ্ডী।

দ্রোণের কাছে পরাজয়ের গ্লানি দ্রুপদকে দগ্ধ করে চলছিল প্রতিনিয়ত। তিনি শপথ করলেন, দ্রোণ তো বটেই, কুরুবংশকেও তিনি সমূলে বিনাশ করবেন। এই অপমানের গ্লানি অন্য কোনো উপায়েই নিবৃত্ত হবে না।

কিন্তু কীভাবে নেবেন তিনি প্রতিশোধ? তিনি নিজে উপনীত হয়েছেন প্রৌঢ়ত্বে। অর্জুনের মতো বীরের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা এই বয়সে তাঁর পক্ষে অসম্ভব।

একমাত্র সন্তান শিখণ্ডীরও যে সেই ক্ষমতা নেই, সে-বিষয়েও তিনি নিশ্চিত। প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও দ্রুপদ পুত্রের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। তিনিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, শিখণ্ডী পুরুষ নন।

কিন্তু দেবাদিদেবের আশ্বাসবাণীর তবে কী অর্থ? সে-রাতে অরণ্যে হওয়া দৈববাণী ‘তুমি পুত্রবান হবে!’ কি দেবতার পরিহাস ছিল?

দ্রুপদ আর ভাবতে পারেন না। যখনই তিনি মন্ত্রী-পারিষদদের মুখে শোনেন কীভাবে অর্জুনকে একেবারে সম্মুখে পেয়েও ভীত কাপুরুষের মতো শিখণ্ডী রণক্ষেত্র ত্যাগ করেছিলেন, বিস্ময়ে, ক্ষোভে, অপমানে রক্তাভ হয়ে ওঠে তাঁর মুখ।

তারপর সেই রাতেই শত্রুশিবিরে গোপনে গমন? তার কারণ আজও জানতে পারেননি তিনি। কাপুরুষের মতো ক্ষমাপ্রার্থনা কিংবা স্তাবকতার মতো সম্ভাব্য কারণ যতবার তাঁর মনে উদিত হয়েছে, ইচ্ছা হয়েছে শিখণ্ডীকে চরম শাস্তি দিতে। বহুকষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করেছেন তিনি। অবশেষে মেনে নিয়েছেন সন্তানের সীমাবদ্ধতা। কিন্তু তাঁকে তো অভীষ্ট পূরণ করতেই হবে। প্রতিশোধ তাঁকে নিতেই হবে!

রাজ্য শাসন এখন দ্রুপদের কাছে মুখ্য নয়, একান্তই গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ মানুষটি বারবার বুঝে নিতে চান, আপাত অপরাজেয় কুরুগরিমাকে কীভাবে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া যায়।

সেই লক্ষ্যেই পাঞ্চালের ওপর হওয়া আক্রমণটিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে চললেন তিনি। তার মাধ্যমেই তিনি একটি সত্য উপলব্ধি করলেন— ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র ও পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে তেমন হৃদ্যতা নেই। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাঁদের মধ্যে বিভাজনের রেখাটি। দ্রুপদ বুঝলেন, কোনোভাবে যদি এই দুই অংশের যে-কোনো একটিকে মিত্ররূপে লাভ করা যায়, তাহলেই তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। ক্রমাগত ইন্ধনে দুই পক্ষে যুদ্ধ লাগিয়ে ছারখার করে দেওয়া যাবে হস্তিনাপুরকে!

মনের মধ্যে ক্রমাগত অক্ষক্রীড়ার পঞ্জরি সাজাতে থাকেন দ্রুপদ। ওদিকে তাঁর পুত্র শিখণ্ডী আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যান। তীব্র সুগভীর এক অবসাদে ডুবে যেতে থাকেন তিনি। অজস্র ভৃত্যপারিষদ, অমাত্যের মাঝে থেকেও তিনি হয়ে পড়েন একাকী, নিঃসহায়।

যেমন এখন।

তার পাশাপাশি শিখণ্ডী আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সুগভীর এক অবসাদে ডুবে যেতে থাকেন তিনি। অজস্র ভৃত্যপারিষদ, অমাত্যের মাঝে থেকেও তিনি হয়ে পড়েন একাকী, নিঃসহায়।

কম্পিল্য নগরীর একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত পাঞ্চাল রাজ্যের রাজপ্রাসাদ। তারই অন্দরে স্ফটিকনির্মিত প্রকাণ্ড স্নানাগারে নগ্নদেহে এক প্রভাতে দুই জানুর মাঝে মাথা গুঁজে বসে ছিলেন শিখণ্ডী। অদূরে একটি পাত্রে রাখা ছিল শত পদ্ম। অন্য একটি পাত্রে ছিল দুগ্ধ। কিন্তু শিখণ্ডী’র সম্মুখে স্থিত দর্পণে তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠব নয়, বরং এক হেরে যাওয়া মানুষের ছবিই প্রতিভাত হচ্ছিল।

পারছেন না শিখণ্ডী! শতচেষ্টাতেও তিনি ভুলতে পারছেন না অর্জুনকে। যতই মনকে কঠোর করুন, অসাবধানতার প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে সদ্যযুবা অর্জুনের সুগঠিত বাহু, কপাট বক্ষ, উন্নত শির।

এবং অমোঘ পরিণতির মতো মনে পড়ছে পরবর্তী অপমান। যে অপমানের অধিকার অর্জুন পেয়েছেন বংশানুক্রমে। ভীষ্ম ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা শিখণ্ডীকে অপমান করাকে যেন নিত্যকর্ম হিসেবে গণ্য করেছেন?

কেন? তিনি কি এতই সুলভ? নারী অথবা পুরুষ, কোনো সত্তাই শক্তিশালী নয় বলেই কি যে কেউ তাঁকে আঘাত করার ক্ষমতা রাখেন?

কতক্ষণ এইভাবে স্নানাগারে বসে অন্তরে রক্তাক্ত হচ্ছিলেন, তিনি নিজেই জানেন না। ভ্রম ছিন্ন হল দ্বারের ওপারে তাঁর ব্যক্তিগত ভৃত্য সুষেণের কণ্ঠস্বরে।

‘রাজকুমার! মহারানি দীর্ঘ সময় ধরে কক্ষে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি জানতে চাইছেন, আপনার কি আরও বিলম্ব হবে?’

চমকিত হয়ে ওঠেন শিখণ্ডী। মাতা এসেছেন তাঁর কক্ষে?

রানি প্রশতী এখন অসুস্থ। প্রাসাদের নিজস্ব অংশেই তাঁর চলাফেরা ইদানীং সীমাবদ্ধ রয়েছে। কোনো প্রয়োজন থাকলে তিনি অন্যকে সেখানেই ডেকে পাঠান।

তিনি নিজে এসেছেন? নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটেছে। শিখণ্ডী দ্রুত স্নান সমাধা করে বেরিয়ে এলেন। নিজকক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন, প্রশতী বসে আছেন তাঁর পালঙ্কে।

‘আপনার আগমনের হেতু কী মাতা?’ শিখণ্ডী উদবিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘একবার বার্তা প্রেরণ করলেই আমি উপস্থিত হতাম। আপনি অকারণে কেন ক্লেশ…!’

‘কারণ আছে পুত্র।’ শিখণ্ডী’র কথার মধ্যেই বলে উঠলেন প্রশতী, ‘বসো আমার পাশে।’

শিখণ্ডী নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন। তারপর বললেন, ‘বলুন মাতা।’

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে নিজের বক্তব্যকে বুঝি সংহত করলেন প্রশতী। তারপর বললেন, ‘তোমার একটি উত্তম সম্বন্ধ এসেছে, পুত্র।’

বজ্রপাত হলেও বুঝি শিখণ্ডী এত চমকিত হতেন না। অপার বিস্ময়ে তিনি বললেন, ‘সম্বন্ধ, আবার?’

‘দশার্ণ রাজ্যের অধিপতি হিরণ্যবর্মা নিজে তাঁর একমাত্র কন্যার জন্য বিবাহপ্রস্তাব পাঠিয়েছেন, পুত্র।’

‘আমাকে ক্ষমা করুন, মাতা!’ রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠেন শিখণ্ডী, ‘আর অপমান সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। বিগত ঘটনার স্মৃতি আমৃত্যু আমাকে দংশন করবে। তার পুনরাবৃত্তি আমার পক্ষে সহন করা অসম্ভব। দয়া করে পিতাকে এ-কথা বোঝান।’

‘তোমার পিতা এক্ষেত্রে কিছুই করেননি, শিখণ্ডী।’ প্রশতী বললেন, ‘দশার্ণরাজের পক্ষ থেকেই এসেছে এই প্রস্তাব।’

‘কিন্তু সে প্রস্তাব তো অর্থহীন, মাতা!’ শিখণ্ডী অস্থির হয়ে বললেন, ‘ওঁরা বিবাহপ্রস্তাব পাঠিয়েছেন পাঞ্চালরাজ্যের রাজপুত্রকে। কিন্তু রাজপুত্র কোথায়?’

প্রশতী নির্বাক চেয়ে রইলেন সন্তানের দিকে।

শতচেষ্টাতেও অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না শিখণ্ডী। কেঁপে উঠে তিনি বললেন, ‘তাঁরা কি জানেন, রাজপুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করা শিখণ্ডী আসলে পুরুষ নয়, এমনকি নারীও নয়! সে কী তা সে নিজেই জানে না! হয়তো সে একটি জড়পদার্থ। শুষ্ক একটি ক্লীব, যাকে নিয়ে যথেচ্ছাচারের অধিকার প্রত্যেকের আছে!’

১১

থানায় ঢোকার সময়েই গতবছর শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে থেকে কেনা সাড়ে তিনশো টাকা দামের চটিটা ছিঁড়ে গেল সাহানার। বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে গেল ওর। একেই আজ স্কুল যেতে পারল না।

কাল সারা রাত জেগে, ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে আসছে। তবু ঠিকই স্নান করে স্কুল চলে যেত। কিন্তু হঠাৎ থানায় তলব।

থানার মধ্যে ঢুকতেই ও গণপতিকাকাকে দেখতে পেল। ভদ্রলোক একটা ফতুয়া আর পাজামা পরে বিরক্তমুখে বসে পা নাচাচ্ছিলেন, ওকে দেখামাত্র এগিয়ে এলেন।

‘তোমাদের জ্বালায় আমার সব কাজকারবার শিকেয় উঠবে সাহানা।’

সাহানা উত্তর দিল না। এই মুহূর্তে কারওর সঙ্গে কথা বলতে ওর ভাল লাগছে না। কাঁধের ঝোলা ব্যাগে রয়েছে মিতুর খাতাটা। মনটা সেদিকেই পড়ে আছে।

মিতুর লেখা মহাভারত পড়ে মিতুকে নতুনভাবে চিনছে ও। এতদিন দুজনে এক ছাদের তলায় থেকেছে, নানা সুখদুঃখের সাথি হয়েছে। কিন্তু মিতুর মনের মধ্যে যে এত কষ্ট, এত চাপা দুঃখ সেগুলোর খোঁজ কি সাহানা কখনও পেয়েছে? নাকি পাওয়ার চেষ্টা করেছে?

শিখণ্ডীর মতো মিতুও কি সারাক্ষণ নিজের সত্তাকেই খুঁজে চলে না?

চমক ভেঙে গেল গণপতিকাকার বকবকে, ‘আর তোমরাও ভারি বেয়াদপ। কাল রাতে আমাকে সব কিছু ভেঙে বললে না। এখন শুনছি মিতু নাকি মরার চেষ্টা করেছিল। তা মরবি তো মর, সরকার রেললাইন রেখে দিয়েছে, আমার বাড়িটাই কেন বেছে নিলি রে বাবা? ওইজন্য আগেই উঠে যেতে বলেছিলাম। শুনল না। কী কুক্ষণে যে না বুঝতে পেরে ওই হিজড়েকে থাকতে দিয়েছিলাম। আরে ওদের জায়গা ট্রেনে, বাড়িতে নয় …।’

সাহানার ধৈর্যচ্যুতি হল এবার। একটু রূঢ়স্বরেই বলল, ‘উলটোপালটা কথা বলবেন না কাকা। মিতু … মিতু হিজড়ে হতে যাবে কেন?’

‘ন্যাকা সেজো না সাহানা।’ গণপতিকাকা খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘বিশ্বসুদ্ধু লোক জানে ও কী। তোমাকে আর বোঝাতে হবে না। দেখলেই সবাই বুঝতে পারে। আমাকে নরম পেয়ে আর কত বোকা বানাবে?’

সাহানার প্রচণ্ড রাগ হলেও ও কথা বাড়াল না। উত্তর না দিয়ে ঢুকে গেল থানার মধ্যে। সামনে বসে থাকা একজন উর্দিধারী কনস্টেবল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে নাক খুঁটে যাচ্ছে। এছাড়া দূরে আর একজন লোক খবরের কাগজ পড়ছে।

‘আমি সাহানা মজুমদার। যদুনাথ কলোনিতে একটা লেডিজ হোস্টেলে থাকি। আমাকে ফোন করে থানায় আসতে বলা হয়েছে।’ সাহানা নিরাসক্তভাবে বলল।

উর্দিধারী তেরিয়া চোখে ওকে একবার আপাদমস্তক মেপে নিল। তারপর বলল, ‘কে আসতে বলেছেন?’

‘রমেন্দ্রবাবু।’

‘অ! মেজোবাবু!’ উর্দিধারী আঙুল উঁচিয়ে দূরের একটা খুপরি দেখিয়ে দিয়ে আবার নাক খুঁটতে লাগল।

সাহানা পিছু ফিরে দেখল, গণপতিকাকা একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন তীক্ষ্ন চোখে।

রমেন্দ্রবাবুই গতরাতে গিয়েছিলেন সাহানাদের হোস্টেলে। সাহানার আপত্তি সত্ত্বেও তিনি এক কাপ চা অর্ডার দিয়ে বললেন, ‘আসলে আমরা জানতে পেরেছি, হোস্টেলে আপনিই ছিলেন মিতালি দাসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।’

‘ঘনিষ্ঠ ছিলাম।’ চেয়ারে বসতে বসতে মৃদুস্বরে বলল সাহানা, ‘এখন আমি অন্য রুমে থাকি। অতটা কথা হয় না।’

রমেন্দ্রবাবু সামনে রাখা ভারী পেপারওয়েটটা হাতে করে কিছুটা সরিয়ে দিলেন, ‘হঠাৎ অন্য রুমে চলে গেলেন কেন?’

‘এমনিই।’ ঠোঁট কামড়ে উদগত কথাগুলোকে থামাল সাহানা, ‘মিতু নার্স। ওর শিফটে ডিউটি থাকত কোনোদিন নাইট, কোনোদিন ডে। আমাকেও রাত জেগে স্কুলের খাতা দেখতে হয়। মিতু’র ঘুমের অসুবিধা হত। আমারও। এখন যার সঙ্গে থাকি, সে-ও স্কুলে পড়ায়। তাই সেই সমস্যা নেই।’

‘বুঝলাম।’ রমেন্দ্র কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘মিতালি দাসের যেহেতু এখনও জ্ঞান ফেরেনি, ওঁকে আমরা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। তাই আপনার কাছে জানতে চাইছি, আপনি ওঁর পরিবার সম্পর্কে কী জানেন?’

সাহানা ইতস্তত করে বলল, ‘সেরকম কিছু না। সুন্দরবনের এক গ্রামে ওর বাড়ি ছিল। ও আর ওর মা সেখানে থাকত। মা মারা যাওয়ার পর থেকে গ্রামের আর কারওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এটুকুই জানি।’

‘ওর পড়াশুনো?’

‘শুনেছি ওইদিককারই একটি আশ্রমে পড়াশুনো করেছিল।’

‘ওই বাইরে থেকে আসা লোকটা যখন ওঁর ঘরে গিয়েছিল, আপনিই দেখেছিলেন। কোনো চ্যাঁচামেচির আওয়াজ পেয়েছিলেন?’

‘না।’ সাহানা বলল, ‘আমি স্কুলের খাতা দেখছিলাম।’

‘আচ্ছা ওই লোকটা কি আগেও আপনাদের হোস্টেলে এসেছে? না হলে মিতালি দাস কোন ঘরে থাকেন, সে জানল কী করে?’ সাহানা চুপ করে রইল।

রমেন্দ্র সোজাসুজি তাকালেন, ‘মিতালি দাস কেন সুইসাইডের চেষ্টা করলেন বলে আপনার মনে হয়, মিস মজুমদার?’

‘আমি কী করে জানব?’ মলিন মুখে একটা অসহায় হাসি ফুটিয়ে তুলল সাহানা, ‘বললাম না, এখন আর আমাদের মধ্যে সেরকম ইন্টিমেসি নেই।’

রমেন্দ্র চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। পেপারওয়েটটাকে ঘোরাতে-ঘোরাতে বললেন, ‘আমার মনে হয়, আপনি কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছেন।’

সাহানা কোনো কথা বলল না। অব্যক্ত কথাগুলো ওর গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠল।

‘আপনাকে আমি এইজন্যই থানায় ডেকে পাঠিয়েছি।’ সাহানা’র চোখে চোখ রেখে বললেন রমেন্দ্র, ‘আপনার সঙ্গে একদম খোলাখুলি কথা বলা দরকার হয়ে পড়েছে। জেরা নয়, এটাকে আলোচনা হিসেবেই ধরুন।’

‘মিতালি দাস কেন সুইসাইড করতে চেয়েছে,’ শান্ত গলায় বলল সাহানা, ‘তা আপনি ওর থেকেই জানতে পারবেন, স্যার। ডাক্তার তো বলেছেন, দু-তিনদিনের মধ্যেই ওর জ্ঞান ফিরবে।’

‘এই দু-তিনদিনও খুব জরুরি, মিস মজুমদার।’

‘কেন?’ অবাক হয়ে গেল সাহানা। ওর মনে পড়ে গেছিল, ছোটোবেলায় ওদের বাড়ির পাশের একজন দিদি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। পুলিশ এসেছিল ঠিকই, কিন্তু এমন বাড়াবাড়ি তো করেনি! রুটিন ইনভেস্টিগেট করে চলে গিয়েছিল। আর এখানে তো মিতু বেঁচে রয়েছে! তাহলে পুলিশ এতটা ‘উৎসাহ’ দেখাচ্ছে কেন? এর পেছনে কি অন্য কিছু বা অন্য কেউ আছে?

রমেন্দ্র বোধহয় সাহানা’র মনের কথা বুঝে ফেললেন। নীচু গলায় তিনি বললেন, ‘আপনি কি জানেন, মিতালি দাসের নার্সিং হোমের চাকরিটা চলে গেছে?’

‘সে কী!’ চমকে উঠল সাহানা, ‘কেন?’

‘নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হল, মিতালি দাসের মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেট জাল।’

‘অসম্ভব!’ সাহানা প্রায় চিৎকার করে উঠল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন স্যার, মিতু অমন মেয়ে নয়। মিতু পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। এটা, এটা মিথ্যে!’

‘বেশ তো।’ রমেন্দ্র নরম গলায় বললেন, ‘সেইজন্যই তো আপনার কাছ থেকে আমি জানতে চাইছি, মিতু কেমন মেয়ে? আপনি বলুন। বিশ্বাস করুন, আপনার বন্ধুরই উপকার হবে তাতে।’

সাহানা চুপ করে রইল। ওর মন ততক্ষণে স্পষ্ট দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। একপক্ষ মুখ খুলতে বারণ করছে, অন্যপক্ষ বলছে সব খুলে বলতে।

রমেন্দ্র আবার বললেন, ‘মিতালি দাসের ঘর সার্চ করে আমরা ওঁর কোয়ালিফিকেশন সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট পাইনি। উনি কোন আশ্রমে পড়তেন?’

সাহানা দাঁতে দাঁত চিপে প্রাণপণ চেষ্টা করেও মুখটাকে ভাবলেশহীন রাখতে পারল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠল।

‘এই ছবিটা চিনতে পারেন?’ রমেন্দ্র সেই ছবিটা উঁচু করে তুলে ধরলেন, যেটা মিতুর বাক্সে গতকালই সাহানা দেখেছে। বেশ ক’জন স্কুলপড়ুয়া ও তাদের শিক্ষকের একটা বিবর্ণ ফোটো।

‘না।’ দ্রুত মাথা নাড়ল সাহানা।

‘কেন মিথ্যে বলছেন?’ তীক্ষ্নদৃষ্টিতে সাহানা’র দিকে তাকিয়ে বললেন রমেন্দ্র, ‘আপনার যে মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই, তা আপনার ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমাকে বলুন, মিস মজুমদার। কে এই মিতালি দাস? বলুন!’

১২

গঙ্গার উপনদী যমুনা। যমুনার উপনদী বেতোয়া। বিন্ধ্য পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে বেতোয়া নদী মধ্যপ্রদেশের একাংশকে জলসিঞ্চিত করে যমুনায় মিশে গেছে। বেতোয়া-র উপনদী ধাশান বেতোয়ারই সমান্তরালে বয়েছে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে। এই দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড মহাভারতের যুগে দশার্ণ রাজ্য নামে পরিচিত ছিল, এখন যা মধ্যপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল। এই রাজ্যের অধিপতি হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে পাঞ্চাল-রাজকুমার শিখণ্ডী’র বিবাহ সুসম্পন্ন হল।

দ্রুপদ এবারও যথাসম্ভব বিবেচনা করেই দশার্ণ রাজকন্যাকে বধূমাতা করার সংকল্প নিয়েছেন। হিরণ্যবর্মা যুদ্ধশাস্ত্রে সুকৌশলী। তিনি নিজে শারীরিকভাবে নাতিদীর্ঘ হলেও দশার্ণ রাজ্যের সেনাবাহিনী উত্তর ও মধ্য ভারতের বহু রাজ্যের সম্ভ্রমের বস্তু। হিরণ্যবর্মা ছাড়াও বহু রথী ও মহারথীর বাস দশার্ণ রাজ্যে। ভবিষ্যতে কখনও পাঞ্চাল ফের আক্রান্ত হলে দশার্ণ রাজ্যের অকুণ্ঠ সাহায্য পাওয়া যাবে— এমনটা নিশ্চিত করেছেন দ্রুপদ। স্বাভাবিকভাবেই শিখণ্ডী’র সমস্ত আপত্তি, অনুরোধ, উপরোধ তিনি উপেক্ষা করেছেন। এমনিতেই পুত্র আর তাঁর স্নেহাস্পদ নয়। শিখণ্ডী’র বক্তব্য শুনেও বিরক্ত মুখে তিনি শুধু বলেছেন, ‘পাঞ্চালের কল্যাণের কথা এতটুকুও ভেবে থাকলে তুমি সম্মত হবে। দ্রোণ তথা কুরুবংশকে সমূলে বিনাশ করতে দশার্ণের সহযোগিতা যে অত্যন্ত প্রয়োজন, তা নিশ্চয় তুমিও অস্বীকার করবে না!’

এর পর আর কথা চলে না। চলেওনি।

সমস্ত নিয়ম-উপচার অন্তে, প্রায় মধ্যরাত্রে শ্রান্ত শিখণ্ডী নিজকক্ষে প্রবেশ করলেন। ব্রীড়াবনতা নববধূ তাঁর জন্য পুষ্পশোভিত পালঙ্কে বসে প্রতীক্ষায় ছিলেন। বহুমূল্য আভূষণ ও সুরভিত পুষ্পে অলংকৃত সেই কক্ষ এবং তাতে অপেক্ষায় থাকা নারীকে দেখে শিখণ্ডী’র শ্রান্ত দেহেও রক্ত-চলাচল দ্রুততর হয়ে উঠল। তাঁর বুকের ভেতর বাজতে শুরু করল দ্রিমি-দ্রিমি শব্দ।

কক্ষে প্রবেশের আগেও তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রশতী। স্বয়ং মহাদেবের আশীর্বাদ নাকি বর্ষিত হচ্ছে শিখণ্ডী’র ওপর। তাই, এই ‘চরম মুহূর্তেও’ দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

অসহায় হয়ে শিখণ্ডী তাকালেন সদ্যপরিণীতা বধূর দিকে। সেই মুখশ্রীর সঙ্গে একমাত্র প্রস্ফুটিত পদ্মেরই তুলনা চলে। তাঁদের চার চক্ষুর মিলনমাত্র নববধূ মৃদু হেসে চোখ নামিয়ে নিলেন।

শিখণ্ডী’র অন্তরে এক মরণপণ সংগ্রাম চলছিল। অন্তরের নারীসত্তাকে হত্যা করে, শয়নে-স্বপনে উদ্ভাসিত প্রিয় পুরুষ অর্জুনকে স্বেচ্ছারোপিত বিস্মৃতির নীচে সমাধিস্থ করে, নিজেকে কাঠিন্যে মুড়ে ফেললেন তিনি। মনে-মনে নিজেকে বলে চললেন তিনি, ‘না! আমি নারী নই। আমি একজন পুরুষ। হে দেবাদিদেব, আমাকে শক্তি দিন। পৌরুষ দিন। এই লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দিন।’

শয্যায় উপবিষ্ট হয়ে শিখণ্ডী কিছুক্ষণ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে দেখলেন তাঁর স্ত্রীকে।

দশার্ণ-রাজকন্যা সত্যই অনিন্দ্যসুন্দরী। অপরূপ মুখশ্রীর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে ঘন সুদীর্ঘ কেশরাজি। অপরূপ এক কবরীতে বিন্যস্ত হয়েছে সেই মেঘের মতো কেশদাম। তা সত্ত্বেও একান্ত অবাধ্য কিছু কেশ বাধা মানেনি। তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুখের দু’ধারে, যা নববধূর সৌন্দর্য অনেক গুণ বর্ধিত করে তুলেছিল।

হস্তীদন্তের মতো সুঠাম ও উজ্জ্বল দুই বাহু শেষ হয়েছিল রাজকন্যা’র সরু অথচ দীর্ঘ অঙ্গুলিগুলিতে। বহুমূল্য অঙ্গুরীয়-পরিহিত সেই দশটি সুশ্রী আঙুল কিছুটা নম্রতায়, কিছুটা আশঙ্কায় একে অন্যের সঙ্গে মুহুর্মুহু আলিঙ্গনে উষ্ণতা নিচ্ছে। তারই সঙ্গে, ঈষৎ হলেও, কেঁপে উঠছে রাজকন্যার বক্ষদেশ।

দশার্ণ-কন্যা গুরুস্তনী, তাই তাঁর বক্ষাবরণীতে আবৃত স্তনদুটি খানিক অধোমুখী। রাজকন্যার প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে তাদের আন্দোলন দেখতে দেখতে শিখণ্ডী নববধূর হাত স্পর্শ করলেন। ধীরে, অতি ধীরে, রাজকন্যার করপুটে বন্দি হল তাঁর হাতটি।

প্রাণপণে নিজের মনকে একাগ্র করছিলেন শিখণ্ডী। একজন প্রকৃত পুরুষের মতোই তিনি কামনা করতে চাইছিলেন এক অক্ষতযোনির সান্নিধ্য। সমান্তরালে তাঁর মনের মধ্যে অনুরণিত হয়ে চলেছিল এক কাতর অনুরোধ।

‘হে দেবাদিদেব, আমাকে শক্তি দিন। পৌরুষ দিন। ক্রমাগত লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দিন! আমার নারীত্ব লুপ্ত হোক। জাগ্রত হোক সুপ্ত পৌরুষ। এবার অন্তত সত্য হোক আপনার আশীর্বচন!’

উত্তপ্ত, কোমল নারীদেহের আলিঙ্গনে বদ্ধ শিখণ্ডীর দেহ তখন শিহরিত হচ্ছে। পেলব স্তনের স্পর্শে সাড়া দিয়ে তিনি স্ত্রী’র বক্ষবন্ধনীকে শিথিল করতে সচেষ্ট হচ্ছেন। নববধূও রতিক্রীড়ায় যথেষ্ট পারঙ্গমা। লঘু চুম্বনে, স্পর্শে তিনি কম্পন জাগাতে চাইছিলেন স্বামীতনুতে। অদূরে জ্বলন্ত দীপশিখাও যেন কেঁপে উঠছিল শয্যায় ঘন হয়ে ওঠা এই উষ্ণতার সান্নিধ্যে।

মৃদু শীৎকার ও স্পর্শে রাজকন্যা তাঁর স্বামীকে উত্তেজনার শীর্ষে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে। তারই সঙ্গে তাঁর দক্ষিণ হস্ত অমোঘ পর্যটকের মতো যাত্রা করেছিল স্বামীর নিম্নাঙ্গ-অভিমুখে।

ঠিক তখনই ঘটল ছন্দপতন।

নববধূ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি মূল অঙ্গটির অনুপস্থিতি। শিখণ্ডীর অপরাধী মুখের সামনে আরও একবার নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি।

স্ত্রী’র বিস্মিত দৃষ্টি অনুসরণ করলেন শিখণ্ডী। অন্তরের গভীরতম বিন্দু থেকে নীরবে তাঁর প্রার্থনা ধাবিত হচ্ছিল স্থান ও কালের অতীত কোনো এক রহস্যময় বিন্দুর দিকে, যেখানে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন আছেন মহাদেব!

শিখণ্ডী নিজের অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে প্রার্থনা করছিলেন তাঁর উদ্দেশে, ‘হে দেবাদিদেব! এই অসহনীয় লজ্জা থেকে আমায় মুক্তি দিন। কৃপা করুন! নচেৎ আমার প্রাণহরণ করুন। এই অস্তিত্ব শুধু আমার পিতা ও মাতার জন্য নয়, আপনার গরিমাকেও হরণ করবে। রক্ষা করুন আমায়!’

কিন্তু না। কেউ সাড়া দিলেন না শিখণ্ডীর কাতর আহ্বানে।

কয়েকদণ্ড পর নববধূ বুঝলেন, এ কোনো ভ্রম নয়, বরং নিষ্ঠুর সত্য। তাঁর আতঙ্ক ও ক্রোধমিশ্রিত আর্তনাদে মুখরিত হল রাজপ্রাসাদ। ছিটকে গেলেন তিনি শয্যার অপর প্রান্তে— যেন শিখণ্ডী কোনো মানুষ নন, ঘৃণ্য এক জীবমাত্র!

এত বড়ো প্রতারণা সহ্য করতে পারলেন না নববধূ। বিদ্যুৎবেগে তিনি অবতরণ করলেন পুষ্পশয্যা থেকে, তারপর নিষ্ক্রান্ত হলেন কক্ষ থেকে।

বিবাহের প্রথম রাত্রিতে পুষ্পশয্যায় শিখণ্ডী একাকী বসে রইলেন নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত হয়ে। তাঁর কর্ণকুহরে তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল নববধূর আর্তনাদ।

প্রস্তরবৎ হয়ে রইলেন শিখণ্ডী, নির্বাক, নিষ্কম্প। ক্রমে তাঁর মধ্যে জেগে উঠল এক অসহ জ্বালা। ক্রোধের রক্তরাগ আচ্ছন্ন করল তাঁর দৃষ্টিকে। প্রবল বাসনা হল তাঁর, সেই মুহূর্তেই এই নিষ্ফলা জীবনের চিরসমাপ্তি ঘটাতে। উদ্ভ্রান্তের মতো তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সংহত করলেন বিস্রস্ত বসন।

তারপর বেরিয়ে গেলেন অশ্বশালার উদ্দেশে।

১৩

‘মিতু পড়াশুনোয় ভালো ছিল। ওদের গ্রাম বৈকুণ্ঠপুরে ক্লাস ফোরের পর পড়াশুনোর কোনো সুযোগ ছিল না। কিছু ছেলে দূরের টাউনগুলোয় পড়তে যেত। মেয়েরা তাও যেত না। বারো-তেরো পেরোলেই তাদের বিয়ে হয়ে যেত। কিন্তু মিতু চেয়েছিল, ও লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তাই ও বাইরে পড়তে যায়। এই ব্যাপারে ওর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বৈদ্যনাথ মাইতি বলে গ্রামের একজন, যাঁকে মিতু বদুকাকা বলত। তিনি ছিলেন মিতু’র বাবার ছোটোবেলার বন্ধু। কিন্তু দুজন মিলে বাসন্তী, নামখানা, ক্যানিং কোথাও এমন কোনো স্কুল খুঁজে পায়নি যেখানে মেয়েদের বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া আর লেখাপড়ার ব্যবস্থা আছে।’

রমেন্দ্র মন দিয়ে শুনছিলেন। সাহানা থামতেই বললেন, ‘আর সেজন্যই মিতু আর তার বদুকাকা মিলে ঠিক করল যে, মিতু ছেলে সেজে পড়তে যাবে।’

সাহানা মাথা নীচু করল। চাপা স্বরে বলল, ‘অজ পাড়াগাঁ। বার্থ সার্টিফিকেট বা ওইসবের কোনো বালাই ছিল না। মিতুর চালচলন এমনিতেও ছেলেদের মতো। তাই ওকে ছেলের জামা পরিয়েই মধুগঞ্জের দয়াসাগর আশ্রমে ভরতি করানো হয়েছিল। সেই আশ্রমের আচার্য সোমানন্দ মহারাজ বৈদ্যনাথকে চিনতেন। বদুকাকা সেখানে মিতুর পরিচয় দিলেন নিজের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে। মিতালি দাসের নাম পালটে হল সুমিত মাইতি। গ্রামে মিতুকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। তাই ও রয়ে গেল ওই আশ্রমেই।’

‘হুম।’ রমেন্দ্র মাথা নাড়লেন, ‘মধুগঞ্জ বৈকুণ্ঠপুর থেকে অনেকটা দূরে। গ্রামের ছেলেপুলেরা বাসন্তী, ক্যানিং-এর দিকে গেলেও মধুগঞ্জে কেউ যায় না। তাই জানাজানি হওয়ারও তেমন ভয় নেই।’

‘গরিব ছেলেদের থাকা আর পড়াশোনার জন্য দয়াসাগর আশ্রমটা বানানো হয়েছিল। এন.জি.ও-র জন্য আসা ফান্ডে ওটা চলে। একটা ট্রাস্ট ওই আশ্রমটাকে পরিচালিত করে। আশ্রমের আরও তিনটে শাখা আছে সুন্দরবন এলাকায়।’

‘খোঁজ নিয়ে নিচ্ছি।’ রমেন্দ্র দ্রুত নোট নিচ্ছিলেন, ‘তারপর? মিতু ওখানেই থাকতে লাগল?’

‘হ্যাঁ। পড়াশোনা বা থাকা-খাওয়া কোনোটাই আহামরি কিছু নয়, তবু একেবারে না থাকার চেয়ে ওটুকুও ভালো। মিতু ছেলে সেজে পড়তে লাগল সেই দয়াসাগর আশ্রমে। ফাইভ পেরিয়ে সিক্স, সিক্স পেরিয়ে সেভেনে উঠল। শরীরে আসতে চাইল বয়ঃসন্ধি। কিন্তু মিতু তো মনেপ্রাণে ছেলেই, সে ওসব শারীরিক পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিল না। অন্য সব ছেলেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলাধুলো করত, দৌড়ঝাঁপ করত।’

কথাগুলো বলতে-বলতে সাহানা’র গলায় দলা পাকাচ্ছিল একটা কষ্ট। ও থেমে যেতেই রমেন্দ্র প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর?’

সাহানা একটু থেমে বলল, ‘পিরিয়ড চলাকালীন একদিন ওর রুমমেট ওর ব্যাগে খুঁজে পেল মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন। একটা ছেলে হয়ে মেয়েদের এইসব জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা তাদের চোখে খুবই অসভ্যতা। তার একমাস আগেই আচার্য সোমানন্দ মহারাজ বদলি হয়ে গিয়েছেন। আশ্রমে এসেছেন নতুন আচার্য। সেদিন সেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। মিতু প্রথম হয়েছে। ওর রুমমেট গিয়ে নালিশ করল নতুন আচার্যকে। মহারাজ, সুমিত ব্যাগে অসভ্য সব জিনিস নিয়ে ঘোরে। আচার্য রাতের খাওয়াদাওয়ার পর ডেকে পাঠালেন মিতুকে।’

রমেন্দ্রবাবু বললেন, ‘আর তারপর নিজের ঘরে মিতুর শ্লীলতাহানি করলেন। তাইতো?’

সাহানার চোখ ছলছল করছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল মিতুকে। মিতু যখনই এই কথাগুলো বলত, গলা কাঁপত। যে মিতু এত রুক্ষ, তার চোখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে নামত জল।

নতুন আচার্যের মাথায় প্রথমে মিতু যে মেয়ে, এই সম্ভাবনাটাই আসেনি। কিন্তু মিতু এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, আচার্য বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। তারপর একে একে ওর প্রতিটা পোশাক খুলিয়েছিলেন। আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর আশ্রমের একমাত্র মেয়েটিকে। তারপর নিজের বহুদিনের উপোসী বুভুক্ষু দেহের যৌন নিবৃত্তি করেছিলেন পেটের দায়ে পড়তে আসা মিতুকে দিয়ে।

কিশোরী মিতু সেদিন কাঁদছিল। কাঁপছিল একটা ভেজা পাখির মতো। গোঙাতে গোঙাতে বলছিল, ‘আমায় ছেড়ে দিন মহারাজ! আমার শরীরটা ভুল করে মেয়েদের মতো হয়ে গিয়েছে। আসলে … আসলে আমি একটা ছেলেই। আশ্রমের সবচেয়ে লম্বা নারকেল গাছটায় আমার মতো তরতরিয়ে কেউ উঠতে পারে বলুন?’

তার গোঙানি শব্দ হয়ে প্রবেশ করছিল না আচার্যের কানে। কিংবা প্রবেশ করলেও তিনি সেগুলো শোনায় কোনো মনোযোগই দেননি। সব শেষে ভয় দেখিয়েছিলেন, এসব কাউকে বললে তৎক্ষণাৎ আশ্রম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। শুধু তাড়িয়ে দেওয়াই নয়, খবর দেওয়া হবে পুলিশেও। জাল পরিচয় দেওয়ার জন্য।

ওই বয়সে সহজেই মানুষকে ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যায়। দাবিয়ে দেওয়া যায়। ওই বয়সে তর্ক করার ক্ষমতা বা ব্যবহারিক বুদ্ধি ততটা জোরদার হয় না। তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবে মিতু? বদুকাকা যে মারা গিয়েছে তার এক বছর আগেই। অগত্যা মিতু মাসে এক থেকে দু’বার সহ্য করতে লাগল আচার্যর অত্যাচার।

এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেল সাহানা।

‘তারপর?’ ঝুঁকে পড়লেন রমেন্দ্রবাবু।

‘আমি আর কিছু জানি না।’ সাহানা ক্লান্ত স্বরে বলল। ওর শরীরটা কেমন অবসন্ন লাগছিল। মনে হচ্ছিল, যে প্রিয় বন্ধুর বন্ধুত্বের বিশ্বাসে মিতু ওকে সব খুলে বলেছিল, এতক্ষণ ধরে সেই বন্ধুত্বের চূড়ান্ত অপমান করল ও।

খোলা বাজারে ধীরে ধীরে উলঙ্গ করে দিল মিতুকে।

তুই কয়েকদিন ধরে এত কষ্ট পাচ্ছিলি, কেন বললি না আমায় মিতু? কেন বললি না? ঘর পালটে গিয়েছে বলে কি মনও পালটে গিয়েছে?

রমেন্দ্রবাবু একটা জলের বোতল বাড়িয়ে দিলেন সাহানার দিকে।

‘নিন। জল খান।’

বিনাবাক্যব্যয়ে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল সাহানা। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, আমি এবার যেতে পারি কি?’

‘নিশ্চয়ই পারেন।’ রমেন্দ্রবাবু বললেন, ‘কিন্তু তার আগে একটা কথা বলুন মিস মজুমদার। আপনি মিতুকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?’

সাহানা উঠে দাঁড়িয়ে চুপ করে রইল।

মিতুর মতো মানুষদের দুম করে ‘হ্যাঁ, ভালোবাসি’ বলা যায় না। তাতে অনেকে বক্রোক্তি করে। অন্য অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করে।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে ও বলল, ‘একজন বন্ধু হিসেবে ওকে আমি নিশ্চয়ই ভালোবাসি স্যার। ওইটুকুই। আসি।’  

১৪

গভীর অরণ্য। দূরে শোনা যাচ্ছে বন্য প্রাণীর গর্জন। ঘন বনরাজি ভেদ করে পূর্বগগনে উদিত সূর্যদেবের আলোকের এক অতি ক্ষুদ্র অংশই গুল্মাবৃত ভূমিকে স্পর্শ করতে পারছে।

সেখানেই এক বৃক্ষতলে বসে আছেন শিখণ্ডী। রাত্রিজাগরণের কালিমা তাঁর চোখেমুখে।

উদাস নয়নে তিনি চেয়ে রয়েছেন দূর দিগন্তের দিকে।

তাঁর অনতিদূরে ধ্যানমুদ্রায় বসে আছেন এক তরুণ সন্ন্যাসী। তিনি অরণ্যচারী, তবে আরণ্যক রুক্ষতার পরিবর্তে তাঁর শ্মশ্রু-গুম্ফ বর্জিত মুখমণ্ডল প্রজ্ঞা ও সরসতার দ্যুতিতে ভাস্বর। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি ইলার নাম শুনেছেন?’

শিখণ্ডী নীরবে দুদিকে মস্তক আন্দোলিত করলেন।

‘বৈবস্বত মনুর কন্যা ছিলেন ইলা।’ তরুণ সন্ন্যাসী স্নিগ্ধ হাসলেন। বললেন, ‘তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন নারী হয়ে। কিন্তু তাঁর মন ছিল পুরুষের অনুরূপ। বিষু�’র বরে তিনি পৌরুষ লাভ করেন। তখন তাঁর নাম হয় সুদ্যুম্ন।’

শিখণ্ডী সচকিত হয়ে বললেন, ‘তবে কি আপনি আমায় বিষু�র আরাধনা করতে বলছেন, তপস্বী?’

‘আমার বক্তব্য এখনও সমাপ্ত হয়নি, রাজকুমার। একদিন শিব ও পার্বতী অরণ্য মধ্যে লাস্য ও ক্রীড়ায় রত ছিলেন। মৃগয়ার উত্তেজনায় সেই প্রান্তরে প্রবেশ করেন সুদ্যুম্ন। সেই অনুপ্রবেশে শিব রুষ্ট হন। তিনি শাপ দেন, যে পৌরুষ সুদ্যুম্নের এত অহংকারের বিষয়, যাকে সার্থক করার জন্য মৃগয়ায় এত ব্যগ্র তিনি, তা লুপ্ত হবে। সুদ্যুম্ন পুনরায় পরিণত হবেন নারীতে। সুদ্যুম্নের সহস্র অনুনয়-বিনয়ে শিবের ক্রোধ প্রশমিত হয়। শাপ পরিমার্জন করে তিনি বলেন, সুদ্যুম্নের লিঙ্গসত্তা পরিবর্তিত হবে প্রতি চান্দ্রমাসে। অর্থাৎ একমাস তিনি যাপন করবেন পুরুষ হিসেবে, পরের মাস নারী হিসেবে।’

‘তারপর?’

‘আমার এই প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ স্বতন্ত্র, রাজকুমার।’ যুবক তপস্বী চোখ বন্ধ করলেন, ‘এই আখ্যান থেকে কি আপনি উপলব্ধি করতে পারলেন একটি চরম সত্য? লিঙ্গভেদ যে একটি মানুষের পরিচিতি গড়ে তোলার জন্য অপ্রয়োজনীয়, লিঙ্গসত্তা কতটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়, এ-কথা কি অনুভূত হল আপনার? মনুষ্যধর্ম শুধুই তার দেহের যৌনাঙ্গের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। বরং তার কর্মই তাকে সংজ্ঞায়িত করে।’

‘জানি।’ ক্লিষ্ট স্বরে বললেন শিখণ্ডী, ‘কিন্তু আমার মতো ক্লীবদের যন্ত্রণা অনুভব করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। নিরন্তর নিজের অস্তিত্ব অন্বেষণের মধ্যে যে তীব্র অপমান রয়েছে, ক্লেদ রয়েছে তা পুনর্বার ব্যক্ত করে আর অন্তর্দহন বৃদ্ধি করতে চাই না আমি। আমার দেহ আমার মন অপেক্ষা নিম্নশ্রেণির, এ যে কত বড়ো অক্ষমতা, তা আমি কীভাবে আপনাকে ব্যাখ্যা করব, হে তাপস? আমার দেহ-মন যেন দ্বিখণ্ডিত হয়ে থাকে অহোরাত্র। এক ক্ষত্রিয় যোদ্ধা হিসেবে আমার কর্ম, এমনকি আমার জীবিত থাকাও যে এর ফলে কতখানি অপ্রাপ্তি আর অসুখে জর্জরিত, তা কি আপনি উপলব্ধি করতে পারলেন?’

‘মার্জনা করবেন রাজকুমার। কিন্তু এই শ্রেণিবৈষম্যের অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হল না। আপনার দেহ নারীর বলেই তা আপনার সামাজিক পরিচয়, অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় নিম্নতর এমনই কি বলতে চাইছেন আপনি?’

‘আমি নারীজাতিকে একবারও অসম্মান করছি না তপস্বী।’ শিখণ্ডী বললেন, ‘তাঁরাই তো প্রকৃতির মনুষ্যরূপ। তাঁরা সৃষ্টিকারিণী। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে আসে নতুন প্রাণ। কিন্তু জ্ঞান, বুদ্ধি, দৈহিক বলে তো তাঁরা পশ্চাদবর্তী। এ তো সর্বজনস্বীকৃত।’

‘তাই?’ তরুণ সন্ন্যাসী হাসলেন, ‘জ্ঞান ও বুদ্ধিতে তাঁরা দুর্বল? কীভাবে আপনি উপনীত হলেন এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে?’

শিখণ্ডী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘অযথা প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে লাভ নেই। ও-কথা থাক। আপনার কথা বলুন তপস্বী। এই বিপদসংকুল অরণ্যে নিরস্ত্র অবস্থায় আপনি কী করছেন? আমাকেই বা কী করে চিনলেন?’

তপস্বী হাসলেন, ‘পাঞ্চালের ভাবী উত্তরাধিকারীকে চিনব না, এমন অর্বাচীন আমি নই, শিখণ্ডী।’

প্রমাদ গণনা করলেন শিখণ্ডী। এই তরুণ ঋষি তাঁর বংশগত পরিচয় জানেন। অথচ এঁরই কাছে কিনা ক্ষণিকের অসতর্ক দৌর্বল্যে শিখণ্ডী ব্যক্ত করে ফেলেছেন নিজের মনোকষ্ট! এর ফলে এই গূঢ় কথা যদি সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়ে?

সহসা অনুশোচনায় ভরে উঠল তাঁর মন।

তপস্বী শিখণ্ডী’র মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব অনুধাবন করতে পারলেন। নম্রকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘শঙ্কিত হবেন না। এই কথোপকথন শুধু আমাদের দুজনের মধ্যেই সীমিত থাকবে। আমি কুম্ভক। এই বনেই থেকে সাধনা করি। মহারাজ দ্রুপদের অধীনস্থ সামন্ত রাজা শিখীধ্বজকে চেনেন নিশ্চয়ই?’

প্রকাণ্ড পাঞ্চালরাজ্যের অধীনে রয়েছে প্রচুর সামন্ত রাজ্য। ব্যক্তিগতভাবে সকলের সঙ্গে পরিচয় সম্ভব নয়। শিখণ্ডী নিরুত্তর রইলেন।

‘রাজা শিখীধ্বজ এখন তাঁর রাজ্য পরিত্যাগ করে অরণ্যে এসেছেন ঈশ্বরসাধনায়। আমি তাঁর ধর্মীয় উপদেষ্টা মাত্র।’

শিখণ্ডী এবার সসম্ভ্রমে কুম্ভককে নমস্কার করলেন।

কুম্ভক স্মিতমুখে বললেন, ‘রাজকুমার, আমরা ক্লীব বলতে বুঝি তাদের, যাদের পঞ্চেন্দ্রিয় নেই, জন্ম-মৃত্যু নেই, আত্মা নেই। তারা জড়। তাদের আছে শুধু সময়ের সঙ্গে জীর্ণতা, আছে ক্ষয়। আপনি নিজেকে ক্লীব কেন ভাবছেন, জানতে পারি কি?’

‘আপনার সংজ্ঞা আক্ষরিক, কুম্ভক!’

অদূরের পিপুলবৃক্ষের একটি শাখায় এসে বসল একটি নাম-না-জানা রঙিন পাখি। শিখণ্ডী পাখিটিকে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন, ‘দেখুন, ওই পাখিরও একটি সুস্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় রয়েছে। সেও হয় নারী, নচেৎ পুরুষ। তারও রয়েছে উত্তরাধিকারীকে পৃথিবীতে আনার ক্ষমতা। কিন্তু আমার মতো মানুষের কী রয়েছে? শিক্ষা, ইন্দ্রিয়, মনুষ্যত্বের সঙ্গে ওই পরিচিতি না থাকলে আমারও থাকবে শুধু সময়ের সঙ্গে জীর্ণতা আর ক্ষয়। তাই আমি ক্লীব!’

‘আপনার মনোভাব, আংশিকরূপে হলেও, অনুভব করতে সক্ষম আমি।’ কুম্ভক উঠে দাঁড়ালেন, ‘যদি আপত্তি না থাকে তাহলে কি এই দরিদ্রের কুটিরে কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারবেন?’

অতি সুদর্শন এই তপস্বী। ধূসর ও রুক্ষ বস্ত্রে আবৃত হলেও তাঁর ঋজু তনুদেহ থেকে যেন এক উজ্জ্বল জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। শিখণ্ডী কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর তাঁকে অনুসরণ করলেন।

কুম্ভকের আড়ম্বরহীন কুটিরে গিয়ে ত্যাগ করলেন রাজপোশাক, পরিধান করলেন কৌপীন ও চীর। কুম্ভকের সঙ্গে বসেই সামান্য ফলাহার সমাধা করলেন।

‘আপনি কি শিখীধ্বজের সঙ্গে, তাঁকে জ্ঞানদানের জন্য অরণ্যে এসেছেন, কুম্ভক?’

‘না। আমি এই অরণ্যেই বাস করি একাকী। একদিন হঠাৎই সাক্ষাৎ হয় শিখীধ্বজের সঙ্গে। রাজা তখন সদ্য পরিত্যাগ করে এসেছেন নিজের রাজ্য, পরিবার। নিঃসঙ্গ জীবনে ধীরে-ধীরে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করছিলেন ঈশ্বর সাধনায়। আমি এখন তাঁকে সেই পথে সাহায্য করি, এইটুকুই।’

‘কিন্তু কেন তিনি নিজের রাজ্য, সংসার সব ত্যাগ করে অরণ্যচারী হয়েছেন?’ কৌতূহলী শিখণ্ডী প্রশ্ন করলেন।

‘শিখীধ্বজ মনে করেন, গার্হস্থ্য জীবনযাপন করে ঈশ্বরলাভ সম্ভব নয়।’ কুম্ভকের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, ‘তাঁর ধারণা, নারীসঙ্গ সাধনার প্রতিকূল। পত্নীর সাহচর্যে ঈশ্বর লাভ হয় না। তাই তাঁর এই অরণ্যজীবন। আপাতত আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’

পাঞ্চালেরই অন্তর্গত এক ক্ষুদ্র প্রদেশের অধিপতি হয়েও শিখীধ্বজ তপস্বীবেশী পাঞ্চাল রাজকুমারকে চিনতে পারলেন না।

নিজ পর্ণকুটিরের বাইরে পদ্মাসনে বসে ছিলেন শিখীধ্বজ। কুম্ভককে দেখামাত্র বললেন, ‘স্বাগতম। সকাল থেকে প্রতীক্ষায় রয়েছি তোমার।’

‘কেন রাজন?’ সহাস্যে বললেন কুম্ভক।

শিখীধ্বজ যেন দেখতেই পেলেন না শিখণ্ডীকে। তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সুদূরে। মলিন মুখে বিষণ্ণতা ও জগৎসংসার সম্বন্ধে ঔদাসীন্য যেন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল প্রভাব বিস্তারের জন্য।

‘রাজ্যত্যাগের পর বেশ ক’টি চান্দ্রমাস অতিবাহিত হয়ে গেল, কুম্ভক! প্রথমে এই অরণ্যে আসার পর যে কী ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে আমার দিনগুলো কাটত, তারপর তোমার সঙ্গে পরিচয় হল। তোমারই সৌজন্যে সেই অস্থিরতাও ক্রমে দূর হল। ঈশ্বর সাধনার পন্থা তুমি আমাকে দেখালে। সযত্নে শেখালে যোগসাধনার পদ্ধতি।’

কুম্বক বললেন, ‘তা আমার পরম সৌভাগ্য, রাজন।’

‘কিন্তু, এত কঠোর তপস্যা করে, দিনের পর দিন একাহারী থেকে, কৃচ্ছ্রসাধনা করেও কেন শান্তি পাচ্ছি না কুম্ভক?’ শিখীধ্বজ উদগ্রকণ্ঠে বললেন, ‘সহস্র সাধনাতেও আমার মন একাগ্র হচ্ছে না। মুহুর্মুহু ভেসে উঠছে আমার রাজ্যের ছবি, আমার স্ত্রী চূড়ালার মুখ। আজও আমি নিতান্তই জাগতিক সব বন্ধনে আবদ্ধ। কেন, তপস্বী?’

কুম্ভক নীরবে শিখীধ্বজের পাশে বসলেন। তারপর বললেন, ‘সাধক চারপ্রকার। আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু, জ্ঞানী। এর মধ্যে আপনি কোন শ্রেণিভুক্ত হতে চান রাজন? আর্ত শুধুমাত্র বিপদ থেকে রক্ষা কিংবা সংকটমোচনের জন্য ঈশ্বরসাধনা করেন। অর্থসম্পদের জন্য ঈশ্বরসাধনা করেন অর্থার্থীরা। জীবনজিজ্ঞাসা সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর পেতে ঈশ্বরসাধনা করেন জিজ্ঞাসুরা। আর জ্ঞানী ব্যক্তি সাধনায় রত থাকেন, কারণ তিনি জানেন এটাই সুস্থ পথ। মানুষ সাধনা করে ধর্মের প্রকৃত রূপটি জানার জন্য, তথা আত্মোপলব্ধির জন্য। কোনো অলীক মোক্ষলাভ সেই সাধনার উদ্দেশ্য হতে পারে না।’

শিখীধ্বজ মন দিয়ে শুনছিলেন। কুম্ভক থামামাত্র বলে উঠলেন, ‘কিন্তু সেই সাধনায় যদি থাকে একাগ্রতার অভাব? তবে কি তা সঠিক পথের দিশারি হতে পারে?’

‘কেন পারবে না?’ কুম্ভক বললেন, ‘আপনি একজন রাজা। রাজার প্রকৃত ধর্ম রাজ্যপালন। আপনি একজন স্বামী। স্বামীর প্রকৃত ধর্ম স্ত্রী-সন্তানের প্রতি কর্তব্যপালন। আপনি একজন ক্ষত্রিয়। আপনার ধর্ম যুদ্ধের মাধ্যমে জয় আনয়ন। তাতেই আপনার মোক্ষ। তাতেই আপনার মুক্তি।’

‘এ কী বলছেন আপনি, তপস্বী!’ শিখীধ্বজ বিমূঢ় হয়ে পড়লেন, ‘তবে আমি যে এই কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়েছি তা মিথ্যা?’

‘আপনি মহর্ষি নারদের সম্বন্ধে প্রচলিত সেই কাহিনিটি স্মরণ করুন, রাজন। নারদ ভগবান বিষু�কে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর শ্রেষ্ঠ ভক্ত কে? নারদ আশা করেছিলেন, গোলোকপতি তাঁর নামই বলবেন, কারণ নারদ অহোরাত্র হরিনাম জপ করেন। কিন্তু তাঁকে আশ্চর্য করে ভগবান বিষু� শ্রেষ্ঠ ভক্তের শিরোপা দিলেন কলিঙ্গ নগরীর কালু নামের এক তেলিকে। নারদ বিস্মিত হতে ভগবান তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ওই তেলি সারাদিন তেলের ব্যাবসায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে ও সততার পরিচয় দেয়। তাই কর্মহীন নারদ নন, সে-ই শ্রেষ্ঠ ভক্ত, কারণ, কর্মই শ্রেষ্ঠ পূজা। যাঁর যা কর্ম, তাই তাঁর কুলধর্ম। যাঁর যা কুলধর্ম, তার সম্যক পালনেই তাঁর মোক্ষলাভ। তাতেই তাঁর মুক্তি।’

রাজা শিখীধ্বজ বিহ্বল দৃষ্টি মেলে কথাগুলো শুনছিলেন। কুম্ভক থামামাত্র তিনি বললেন, ‘কী আশ্চর্য! এতকাল এত সাধুসঙ্গ করেছি। কেউ এমন স্পষ্ট অথচ প্রাঞ্জলভাবে আমায় ব্যাখ্যা করেনি মোক্ষলাভের মর্মার্থ! তবে কি সাধনা ছেড়ে আমার রাজকার্যেই ব্রতী হওয়া উচিত, কুম্ভক?’

‘সেই সিদ্ধান্ত তো আমি নিতে পারি না, রাজন। আমার কোনো অভিমত বা উপলব্ধিকে আপনার ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না আমি। আপনার সামনে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো এই রূপে উপস্থাপন করতে পারি শুধু। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকেই। আপনি আরও ভাবুন, আপন অন্তরকে প্রশ্ন করুন। প্রয়োজনে আরও সময় নিন।’

কুম্ভক হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তবে আমি আশাবাদী যে অচিরেই আপনি এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। আজকের মতো বিদায় নিই।’

এতক্ষণে শিখীধ্বজের নজর পড়ল দণ্ডায়মান সুদর্শন শিখণ্ডীর ওপর। নিজ প্রভুপুত্রকে তিনি শনাক্ত করতে পারলেন না এই অভাবনীয় পরিবেশে, এই অপ্রত্যাশিত বেশবাসে। তাই শুধু প্রশ্ন করলেন, ‘ইনি কে, কুম্ভক? আপনার কোনো মিত্র?’

‘মিত্র তো বটেই, রাজন।’ কুম্ভক বললেন, ‘বিপদে যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ। বিদায়।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন