দেবারতি মুখোপাধ্যায়
পড়তে পড়তে সাহানা যেন দ্বাপর যুগেই চলে গিয়েছিল। ফোনটা হঠাৎ বেজে ওকে রীতিমতো চমকে দিল। ধাতস্থ হয়ে এই সময়ের কলকাতায় ফিরে আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ওর। মোবাইলটা রিসিভ করে কানে দেওয়ার সময় সাহানা দেখল, রাত এগারোটা বাজে।
‘হ্যাঁ, ঊর্ণা। বল। মিতু কেমন আছে?’
‘একইরকম। একজন সিনিয়র ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে দেখে গেলেন। তিনি বললেন, অল্পের জন্য রেডিয়াল আর্টারি বেঁচে গিয়েছে। ওটুকুই মন্দের ভালো। তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিলি?’
সাহানা হাই তোলে, ‘না না। জেগেই ছিলাম।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ঊর্ণা। তারপর ফিশফিশ করে বলে, ‘জানিস, একটা ব্যাপার মনে খুব খচখচ করছে। তোকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।’
‘কী ব্যাপার?’
‘ট্যাক্সি করে যখন নিয়ে আসছিলাম, তখন মিতু আমার কোলেই মাথা রেখে শুয়েছিল। মাঝে মাঝে ওর বোধহয় জ্ঞান আসছিল। আবার চলে যাচ্ছিল। তখন ও বিড়বিড় করে কিছু বলছিল।’
‘কী বলছিল?’
‘ঠিক শুনতে পাইনি।’ একটু ইতস্তত করল ঊর্ণা, ‘কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মধুপুর বা ওইরকম কিছু বলছিল ও।’
‘মধুগঞ্জ।’ সাহানা চিনতে পারল, ‘ওখানে একটা আশ্রমে মিতু পড়াশোনা করেছিল। সেটাই হয়তো বলছিল।’
‘হতে পারে। তুই তো ওর সঙ্গে অনেকদিন এক ঘরে ছিলি, ভালো জানবি। আর একটা নাম বলছিল বারবার। ঝন্টু না কী যেন।’ ঊর্ণার গলাটা হঠাৎই খাদে নেমে গেল, ‘মিতু কি সুইসাইড করতে চাইছিল?’
‘আমি কী করে জানব?’ সাহানা বিড়বিড় করল।
‘যে লোকটা আজ মিতুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাকে তুই চিনতিস?’
‘না। তুই এবার একটু বিশ্রাম নে।’ সাহানা ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে ফোনটা রেখে দিল।
মধুগঞ্জের দয়াসাগর আশ্রম। মিতু’র পড়াশোনাই শুধু নয়, বড়ো হওয়া আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রেও ওই আশ্রমের গুরুত্ব বিরাট। সাহানা জানে, মিতু ওখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেছে। তারপর নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছে ডায়মন্ডহারবারের একটা কলেজে।
এতদিন পর, এই অবস্থাতে মিতু ওই আশ্রম নিয়ে ভাবছে কেন?
স্কুলে পড়ার সময় মিতু নাকি খুব দামাল ছিল। তরতরিয়ে নারকেল গাছে উঠে পড়ত। অনেকটা উঁচু থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত। এই নিয়ে অনেকবার শাস্তিও পেয়েছিল ও। কখনও নিলডাউন হয়ে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কখনও খাওয়া বন্ধ হয়েছে।
কিন্তু স্কুল ছাড়ার দু-বছর আগে ওদের আশ্রমে নতুন আচার্য হয়ে আসা জগদানন্দ মহারাজ একটু বেশিই শাস্তি দিয়েছিলেন ওকে। সেই কথাগুলো বলতে গিয়ে কষ্ট আর রাগ উথলে উঠত মিতু’র দু-চোখে।
মিতু’র নিজস্ব মহাভারত-এ আবার মনোনিবেশ করতে চাইছিল সাহানা।
তখনই খুব কর্কশভাবে কে যেন ঘরের দরজার কড়া নাড়ল।
পুরোনো দিনের দু-পাল্লার দরজা। একটু আগেই ওদের সবার চেষ্টায় মরচে-ধরা ছিটকিনিও ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু বাইরে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার তা জানার কথা নয়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ধরে নিয়েই সে কড়া নেড়ে যাচ্ছিল।
উঠে দাঁড়িয়ে আগে খাতাটাকে নিজের কুর্তির নীচে, পাজামার দড়ির ভেতর গুঁজল সাহানা। উবু হয়ে ট্রাঙ্ক থেকে বের করল ছড়ানো-ছেটানো কাগজগুলো। সেগুলোকেও ও আড়াল করে ফেলল জামার তলায়। তারপর উঠে গিয়ে দরজাটাকে আলতো করে খুলল।
ঘরের মধ্যে প্রায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এলেন গণপতিকাকা। খাকি উর্দি-পরা দু-জন পুলিশও ঘরে ঢুকলেন, একজন পুরুষ, একজন মহিলা।
তাদের পেছনে ইতিউতি উঁকি মারছে একতলার কয়েকটা মেয়ে। উদগ্র কৌতূহল আর কিছুটা উত্তেজনা মিশে তাদের দৃষ্টিতে।
‘ব্যাপারখানা কী?’ বাজখাঁই গলায় চ্যাঁচালেন গণপতি, ‘এই ঘরের দরজা বন্ধ কেন? মিতু কোথায়?’
‘মিতুর শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে কাকা। ঊর্ণা আর পলি ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’ সাহানা শান্তভাবে বলল।
‘আমাকে সেটা জানাবে না একবারও?’ গণপতিকাকা গলার শির ফুলিয়ে চ্যাঁচাচ্ছিলেন, ‘আশ্চর্য! আর তুমিই বা মিতুর ঘরে ঢুকে বসে আছ কেন? তোমাদের জ্বালায় রাতে কি ঘুমোতেও পারব না? সবে খেয়ে উঠে ঘুমোতে যাচ্ছি, থানা থেকে ফোন। একটা মেয়ে নাকি সুইসাইড করেছে! রাস্তা থেকে দেখতে পেয়ে ওরা নাকি এসে নীচের মেয়েদের জিজ্ঞেস করে গিয়েছে। মেয়েছেলে পুলিশ নেই বলে তখন ঢোকেনি। আমার তো শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়! এ কী উটকো বিপদ! ওই তো গঙ্গাজলের মতো ভাড়া ছেটাও। তাতে এত ঝামেলা পোষায় না বাপু!’
‘আপনি থামবেন?’ পুরুষ পুলিশটি কড়া গলায় গণপতিকে চুপ করিয়ে দেয়। সাহানার দিকে ঘুরে সে জানতে চাইল, ‘আপনার নাম?’
‘সাহানা। সাহানা মজুমদার।’
‘কী করেন আপনি?’
‘গড়িয়ার কাছে একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াই।’
‘মিতালি দাস কি এই ঘরেই থাকত?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী হয়েছে খুলে বলুন।’
মহিলা পুলিশটি ঘরের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে সব দেখছিল। একতলার মেয়েগুলোর সঙ্গে সিমিও ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। সাহানা সংক্ষেপে পুরোটা বলল।
পুলিশটি বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ! আপনারা থানায় জানালেন না?’
‘আসলে তখন আমরা খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম।’ সাহানা বলল, ‘মিতু’র নিশ্বাস পড়ছে দেখে আগে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথাই মাথায় এসেছিল।’
‘যে লোকটা এসেছিল, তাকে কেমন দেখতে? কতক্ষণ ছিল?’
সাহানা বলল, ‘রোগা, ফর্সা, মাথার চুলে রং-করা। কতক্ষণ ছিল জানি না। আমি ঘর থেকে একঝলক দেখেছিলাম।’
‘অদ্ভুত!’ পুরুষ পুলিশটির ইউনিফর্মে লাগানো কয়েকটা তারা দেখে সাহানা’র মনে হল, ইনি কোনো অফিসার। রাশভারী ভঙ্গিতে গণপতি’র দিকে ঘুরে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘লেডিজ হোস্টেলে মেল গেস্ট আসতেই পারেন। কিন্তু কোনো রেজিস্টারের ব্যবস্থা নেই কেন? যে যখন পারছে চলে আসছে! এখানে উলটোপালটা ব্যাবসাও চলে নাকি, অ্যাঁ?’
সাহানা দেখল, গণপতিকাকা’র মুখ একেবারে লাল হয়ে গিয়েছে। বিড়বিড় করে কিছু বকছেন তিনি।
কোন হাসপাতাল, কারা নিয়ে গিয়েছে, কীভাবে নিয়ে গিয়েছে, মিতু কী করে, কোথায় বাড়ি, কোন নার্সিং হোমে কাজ করে এ-সব নোট করে নিলেন অফিসারটি। তারপর সাহানাকে বললেন, ‘আপনার মোবাইল নম্বর একটা কাগজে লিখে দিন। এই ঘরটা আমরা আপাতত তালা মেরে রেখে যাব। হোস্টেল ছেড়ে কেউ যাবেন না। আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন।’
মহিলা পুলিশটি তেরিয়া ভঙ্গিতে সাহানা’র দিকে এগিয়ে এল। কথা না বাড়িয়ে সাহানা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এল। গণপতিকাকা কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছিলেন কিছু বলবেন বলে। তার আগেই সাহানা বলল, ‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘরে যাচ্ছি, কাকা।’
উত্তরের অপেক্ষা না করে দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকল সাহানা, যেখানে ও আর ঊর্ণা থাকে। দু-দিকে দুটো সিঙ্গল খাট। মাঝে দুটো ছোটো আলমারি। ঘরের ছিটকিনি তুলে ও নিজের খাটে গিয়ে বসল।
সাহানা’র বুকের ভেতরটা কেমন তোলপাড় করছিল। ওই লোকটা কেন এসেছিল মিতুর কাছে? লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই কি মিতু দরজা বন্ধ করেছিল? কিন্তু এখান থেকে বেরোতে হলে তো ওর সামনে দিয়েই যেতে হবে। লোকটাকে ও বা অন্য কেউ বেরোতে দেখল না কেন?
আচ্ছা, মিতু কি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল? তাহলে কি অপমান আর আঘাত সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে ও এমন চরম কিছু করতে চেয়েছিল?
সাহানা’র মনে পড়ে গেল বছরখানেক আগে ট্রেনে করে একসঙ্গে বাড়ি ফেরার ঘটনাটা।
পুজোর একদম আগের কথা। পুজোর বোনাস কাজে লাগিয়ে নিউমার্কেট থেকে কেনাকাটা করে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ওরা যাদবপুর ফিরছিল। দুপুরবেলা বলে লেডিজ কামরায় ভিড় ছিল না তেমন। পার্ক সার্কাস থেকে বেশ কয়েকটা স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছেলে উঠেছিল। গোঁফদাড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তারা নামেই ছাত্র, বয়সের গাছপাথর নেই। বিড়ি টানতে-টানতে দরজার কাছে ঝুলছিল তারা।
মিতু আর সাহানা গরম বলে সিটে না বসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেগুলো ঝুলতে শুরু করায় সেই হাওয়াটুকুও আটকে যাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে মিতু বলেছিল, ‘ভাই, তোমরা জেনারেলে যাও না। ওগুলোও তো খালি। লেডিজে গুঁতোগুঁতি করছ কেন?’
ওরা প্রথমে উত্তর দেয়নি। মিতু আরও দু-তিনবার বলতে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওর দিকে। ছোটো করে ছাঁটা চুল, পরনের গেঞ্জি আর জিনস, পেটাই চেহারা পেরিয়ে ওদের দৃষ্টি স্থির হয়েছিল মিতুর প্রায় সমতল বুকের ওপর। একটা ছেলে নীচু গলায় অন্যদের কিছু বলেছিল। সঙ্গে-সঙ্গে কুৎসিতভাবে হেসে উঠেছিল অন্যরা।
বিরক্ত গলায় মিতু বলেছিল, ‘শুনতে পাচ্ছ না নাকি? তোমরা জেনারেলে যাও না।’
ঝট করে ওর দিকে মুখ ঘুরিয়েছিল ছেলেটা। দাঁত বের করে বলেছিল, ‘তুইও তো ছেলে না মেয়ে কিছুই বুঝতে পারছি না। হিজড়েও হতে পারিস। লেডিসে উঠেছিস কেন? শালা নিমাই!’
সাহানা জানত, নিমাই একটা অশ্লীল গালাগাল। যে মেয়েদের স্তন প্রায় সমতল বা নেই, তাদের উদ্দেশে চায়ের আড্ডা বা পাড়ার রক থেকে ছেলেরা ছুড়ে দেয় এই গালাগাল। এইরকম আর একটা গালি হল বি পি এ এল অর্থাৎ বুক-পেট একই লেভেলে।
যে মেয়েদের স্তন একটু বেশিই বড়ো, বা বয়সের তুলনায় শরীর পরিণত, তাদেরও নিস্তার নেই। এর মধ্যেই যে কত ছেলে তাদের বুকে হাত দিয়েছে, দলাইমলাই করে বাড়িয়েছে আয়তন এসব নিয়ে অশ্লীল আকারে-ইঙ্গিতে বা ভাষায় টিটকিরি শুনতে হয় তাদেরও। কখনও ভিড় জায়গায় পাশ দিয়ে তাড়াহুড়োর ভঙ্গিতে চলে যাওয়ার সময় নীচু স্বরে নোংরা কথা বলে যায় কেউ; অপমানে কান লাল হয়ে যায়, মেয়েরা তখন মাথা নীচু করে সরে যায়। কিংবা ভিড়ের অছিলায় ছুঁয়ে দেয় বুক, তলপেট বা নিতম্ব। যারা আরও দুঃসাহসী, তারা আরও কদর্য কিছু করে।
ভারতবর্ষে জন্মে প্রায় সব মেয়েকেই কমবেশি এই অসভ্যতা সহ্য করতে হয়েছে, হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা চুপচাপ সরে যায়।
কিন্তু মিতু তেমন মেয়ে নয়। সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছেলেটার ওপর। চুলের মুঠি ধরে কষিয়েছিল দুটো থাপ্পড়। আরও দড়কচা মার্কা ছেলে হলে ওরা মিতুকে ছাড়ত না। কিন্তু যতই এঁচোড়ে পাকা হোক, বয়সটা কুড়ির নীচে। কোনো মেয়ে চড় মারলে আকস্মিকতা সামলে পালটা মারার সাহস এখনও অর্জন করতে পারেনি ওরা।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তারপরই এসেছিল আসল আঘাতটা। দুপুরের ট্রেন, গোটা লেডিজ কামরায় সর্বসাকুল্যে জনাদশেক মহিলা। তাদের মধ্যে এক মধ্যবয়স্কা বেশ শ্লেষযুক্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘কোথাও শান্তি নেই এদের জন্য। অন্যরা তালি বাজিয়ে টাকা চায়, আবার এ মস্তানি শুরু করেছে।’
‘যা বলেছেন। ছেলেগুলো তো ঠিকই বলেছে! লেডিজে ওঠা কেন?’ উলটোদিকের দুজন মহিলা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলেন।
সাহানা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তিনজন ভদ্রমহিলাই পরে ছিলেন সুন্দর তাঁতের শাড়ি। কপালে টিপ, চুল সুবিন্যস্ত, কাঁধে ব্যাগ। সাজেগোজে শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। সম্ভবত কোনো স্কুলের শিক্ষিকা।
আহত স্বরে সাহানা বলে উঠেছিল, ‘এসব কী উলটোপালটা বকছেন আপনারা?’
কিন্তু ওই মহিলারা কেউ ওর কথায় গুরুত্ব দেননি। যেন শুনতেই পাননি, এমন ভাব করে নিজেদের মধ্যে অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলেগুলো ততক্ষণে নেমে গিয়েছিল। যাদবপুর আসার আগেই নেমে পড়েছিল ওরা দুজনেও।
চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিল ঢাকুরিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। মিতুর চোখ ছিল সামনের দিকে।
একটার পর একটা ট্রেন আসছিল, যাচ্ছিল। মিতু’র মুখ ছিল পাথরের মতো শক্ত। অনেকক্ষণ পর ও ভাঙা গলায় বলেছিল, ‘সবাই আমায় কেন হিজড়ে ভাবে রে সাহানা?’
সাহানা বলেছিল, ‘সবাই মোটেও ভাবে না মিতু। যারা অসভ্য তারা ভাবতে পারে।’
‘না। তা নয়। যারা ভাবে তারা মোটেই অসভ্য নয়।’ ধরা গলায় বলেছিল মিতু।
সাহানা অস্থির হয়ে বলেছিল, ‘কে কী ভাবল, তাতে কী যায় আসে মিতু? তুই ছোটো থেকে অনেক লড়াই করেছিস। পড়াশুনো শিখেছিস, নিজের যোগ্যতায় চাকরি জুটিয়েছিস। অন্যরা তোর এই লড়াইয়ের কথা জানেও না, জানলেও বুঝবে না। রাস্তা দিয়ে চলার সময় ঘেউ-ঘেউ করতে থাকা কুকুরদের ঢিল মারতে থাকলে আর এগোনো হবে না। ঢিল মারাই সার হবে।’
‘ছোটো থেকে ছেলেদের সঙ্গে মিশতাম।’ মিতু’র মুখটা থমথম করছিল, ‘খেলতাম। কাদায় দাপাদাপি করতাম। বরং মেয়েদের সঙ্গে খেলনাবাটি খেলতেই একদম ভালো লাগত না। কিন্তু বড়ো হতে শুরু করার পরেই গণ্ডগোল বাঁধল। ছেলেরা আমাকে আর দলে নিত না। অথচ মেয়েদের থেকেও আমি আলাদা ছিলাম। এই করতে-করতে ছেলে, মেয়ে কোনো দলেই আমার জায়গা হল না। আমি খুব একা হয়ে গেলাম। অথচ বিশ্বাস কর সাহানা, আমি কিন্তু নিজেকে একটা ছেলেই মনে করতাম। সেজন্যই যখন বাইরে পড়তে যেতে হল…।’
‘জানি।’ থামিয়ে দিয়েছিল সাহানা, ‘অনেকবার বলেছিস। এখন চল। পরের ট্রেন ঢুকছে। মন খারাপ করিস না।’
মিতু ম্লানমুখে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘তোদের সবার একটা করে নিজস্ব পরিচয় আছে, সাহানা। আমার নেই। শরীরের দিক দিয়ে আমি মেয়ে, অথচ মেয়েদের মতো চালচলন, পোশাক-আশাক আমার ভালো লাগে না। শিক্ষা, পেশা এ-সবের পরিচয় থাকলেও আমার লিঙ্গের কোনো পরিচয় নেই। সুলভ শৌচাগার থেকে শুরু করে টিকিট কাউন্টার, কোন লাইনে দাঁড়াব, বুঝতে পারি না! লোকে বলবে না কেন? আমি নিজেই তো জানি না, আমি আসলে কী! ! শরীর না মন, কোনটা বড়ো রে?’
এতদিন আগের কথা। তবু মনে পড়ে যেতে সাহানার বুকটা কেমন করে উঠল। খাটের ওপর একটা জলের বোতল পড়ে ছিল। সেটা থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল। ঘাড়ে-পিঠেও দিল কিছুটা।
মিতুর বেপরোয়া সাহসের খুব অনুরাগী ছিল সাহানা। কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে, সেই সাহস আর জেদের আড়ালে যেন ক্রমশই দীর্ঘতর হতে শুরু করেছিল বিষণ্ণতার ছায়া, অবসাদের কালো মেঘ।
রাস্তাঘাটে ঠোক্কর খেতে খেতে, লোকের ট্যারাবাঁকা কথায় মিতু কি ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর হয়ে পড়ছিল?
রাত সাড়ে বারোটা। পুলিশদুটো চলে গেছে অনেকক্ষণ। সাহানা খাটের ওপর বসে মিতুর খাতাটা আবার খুলল।
বিয়ে করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসা রাজপুত্র শিখণ্ডীর কী পরিণতি হল, তা জানার জন্য এই মুহূর্তে ছটফট করছে সাহানা। ছোটো থেকে মহাভারত পড়েছে, টিভিতে দেখেছে, রেডিয়োয় শুনেছে। কৃষ্ণ, অর্জুন বা দ্রৌপদীর মতো বিখ্যাত চরিত্রগুলোকেই বেশি করে জানার সুযোগ পেয়েছে। শিখণ্ডী, দ্রুপদ বা দুঃশলার মতো চরিত্রদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কোথায়?
মিতুর লেখার মতো এমন জীবন্ত কি কোথাও তারা হয়ে উঠতে পেরেছে?
যন্ত্রণাগুলো বড্ড এক বলেই কি মিতু এতটা একাত্ম হতে পেরেছে?
হস্তিনাপুরে বিবাহ করতে গিয়ে শিখণ্ডীর প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসার পর কেটে গিয়েছে তিন-তিনটি চান্দ্রমাস। এই তিনটি মাসে পাঞ্চাল রাজ্যের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে এক বিশাল ঝড়। বিধ্বংসী সেই ঝড়ের প্রকোপে দু-টুকরো হয়ে গিয়েছে পাঞ্চাল রাজ্য।
কোনো ঝড়ই অকারণে আসে না। প্রতিটা ঝড়ের পেছনেই থাকে উদ্দাম উত্তাল বাতাস। পাঞ্চাল রাজ্যে ধেয়ে আসা ঝড়ের পেছনের বাতাস পুঞ্জীভূত হতে শুরু করেছিল বহুবছর পূর্বে।
ঘটনার কেন্দ্রে এক প্রাচীন বন্ধুত্ব। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও এক তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে হস্তিনাপুরের কুরু রাজবংশ। এই কাহিনির মূল চরিত্র দুজন। একজন স্বয়ং পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ। দ্বিতীয়জন দ্রোণাচার্য।
ঋষি ভরদ্বাজ এবং অপ্সরা ঘৃতাচীর পুত্র দ্রোণ ছিলেন দ্রুপদের পুরোনো বন্ধু। দ্রোণের জন্ম ভারি বিস্ময়কর। ঋষি ভরদ্বাজের হরদ্বারে স্নানরতা লাস্যময়ী অপ্সরা ঘৃতাচীকে দেখে বীর্যপাত হয়। দ্রোণ অর্থাৎ কলশে সেই বীর্য সঞ্চিত রাখলে কালক্রমে সেখান থেকে জন্ম নেন দ্রোণ।
খুব অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু যদি ধরে নেওয়া যায়, অতি সুন্দরী হলেও অপ্সরা ঘৃতাচী গর্ভধারণে সক্ষম ছিলেন না, তাই সাহায্য নিতে হয়েছিল কলশের? আজকের টেস্টটিউব বেবির মতো?
বহুবছর আগের কথা। ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণ এবং পাঞ্চালের রাজপুত্র দ্রুপদ একইসঙ্গে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন মহর্ষি অগ্নিবেশের কাছে। দুজনে যাকে হরিহর আত্মা। একইসঙ্গে বিদ্যাভ্যাস করেন, একইসঙ্গে ঘোরেন-ফেরেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণসন্তান হয়েও দ্রোণ মহর্ষি অগ্নিবেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্র। ক্ষত্রিয় রাজপুত্র হয়ে দ্রুপদ দ্রোণের কাছে পরাজয়ে রাগ করেন না। বরং, বন্ধুর গর্বে গর্বিত হন তিনি।
একদিন দুই বন্ধু বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে কথা বলতে বলতে ঢুকে পড়লেন গভীর অরণ্যের একেবারে ভেতরে। যখন বুঝতে পারেন, তখন কিছুতেই পথ খুঁজে পান না। যত সময় যায়, অরণ্যের আরও গভীরের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে পড়তে থাকেন।
ক্ষত্রিয়পুত্র দ্রুপদ বললেন, ‘বন্ধু, তুমি ডানদিকে পথসন্ধান করো। আমি বামদিকে। যে খুঁজে পাব, সে জোরে হাততালি দেবে।’
তাই হল। দুই বন্ধু দুদিকের গভীর বনে হারিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দ্রোণ হঠাৎ হাততালির শব্দ শুনতে পেলেন।
কিন্তু হাততালিটা থামছে না, ক্রমাগত বেজেই চলেছে।
দ্রোণ বুঝলেন, দ্রুপদের কোনো বিপদ হয়েছে। তীরন্দাজিতে তাঁর প্রতিভা প্রশ্নাতীত, শব্দের উৎসের উদ্দেশে তিনি তৎক্ষণাৎ নিক্ষেপ করলেন শব্দভেদী বাণ। এক মুহূর্তও না বিরত হয়ে পরপর তির ছুড়ে যেতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর যখন অকুস্থলে গিয়ে উপস্থিত হলেন, দেখলেন, অদূরে পড়ে আছে এক বিশালাকার চিত্রকব্যাঘ্র। চিতাবাঘটির সারা দেহ শরাঘাতে ছেয়ে গিয়েছে।
অদূরে রক্তাক্ত দেহে ভূমিতে পড়ে আর্তনাদ করছেন দ্রুপদ। দ্রোণের শুশ্রূষা ক্রমে তাঁকে সুস্থ করে তুলল।
‘বন্ধু! তোমার জন্য আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। দ্বিতীয় জন্ম হল আমার আজ!’ দৃঢ় আলিঙ্গনে বন্ধুকে বদ্ধ করলেন দ্রুপদ, ‘তুমি আমার পরম বন্ধু, দ্রোণ!’
কথায় বলে, মন অতি সুপ্রসন্ন থাকলে সেই মুহূর্তে কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে নেই। আর মন ক্রোধে পরিপূর্ণ থাকলে সেইসময় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নেই।
কিন্তু দ্রুপদ বিস্মৃত হয়েছিলেন সেই অমোঘ নীতিবাক্য। বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় উদবেলিত হয়ে গদগদ স্বরে বলে ফেললেন, ‘আমি তোমায় কথা দিচ্ছি দ্রোণ। আমি যখন সিংহাসনে আরোহণ করব, পাঞ্চাল রাজ্য আমরা দু-ভাগে ভাগ করে নেব। কেমন?’
‘তা কেন?’ আপত্তি তুললেন দ্রোণ, ‘আমি ব্রাহ্মণ। আমার কাজ শিক্ষাদান করা। রাজধর্ম পালন আমার কর্ম নয়, দ্রুপদ। আমাদের বন্ধুত্ব আজীবন অটুট থাকুক, এতেই আমি সন্তুষ্ট।’
‘কিন্তু তাতে আমি সম্মত নই, দ্রোণ।’ দ্রুপদ আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য পাঞ্চাল রাজ্য উত্তরাধিকারীশূন্য হল না। এই ঋণ আমি কী করে বিস্মৃত হব? অর্ধেক রাজত্ব তোমাকে নিতেই হবে, বন্ধু!’
দ্রোণ অবশ্য এই প্রস্তাবে স্পষ্ট সম্মতি জানালেন না। স্মিতমুখে নীরব রইলেন তিনি।
তারপর অতিবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকবছর। শিক্ষান্তে দুই বন্ধুই স্ব-স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন। পাঞ্চালরাজ সোমক মারা যেতে সিংহাসনে আরোহণ করেছেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পৃষৎ। কালক্রমে তিনিও ইহলোকত্যাগ করলে রাজমুকুট পরিধান করেছেন দ্রুপদ। হয়েছেন পাঞ্চালেশ্বর।
অন্যদিকে দ্রোণ রয়ে গিয়েছেন একইরকম দরিদ্র। বিবাহ করেছেন মহর্ষি শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে। ঋষি শরদ্বানের দুই পুত্র ও কন্যা কৃপ ও কৃপী হস্তিনাপুর-নরেশ শান্তনুর আশ্রয়েই মানুষ। মহারাজ নিজেই উদ্যোগী হয়ে পালিতাকন্যা কৃপীর দায়ভার অর্পণ করেছেন দ্রোণের হাতে।
কৃপী আজীবন লালিত হয়েছেন রাজপ্রাসাদের বিলাসবৈভবে। তা সত্ত্বেও রাজা শান্তনু তাঁকে দ্রোণের সঙ্গে বিবাহ দিলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কারুরই জানা নেই। দ্রোণ অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন যোদ্ধা হলেও এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ মাত্র। সংসারে অস্বচ্ছলতার ছাপ স্পষ্ট।
তবে কৃপী স্বামীগৃহে এসে কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। বরং নিজগুণে শত অভাব-অনটনেও চালাচ্ছিলেন সংসার। তাঁর স্বামী দরিদ্র হলেও অসম্ভব আত্মাভিমানী। যত কষ্টই হোক, কখনোই তিনি হস্তিনারাজের সাহায্যপ্রার্থী হবেন না।
আজীবন রাজপ্রাসাদের বিলাসবৈভবে লালিত হয়েছেন কৃপী। তবু দরিদ্র স্বামী’র গৃহে এসে তিনি কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করেননি। বরং নিজগুণে শত অভাব-অনটনেও তিনি সংসারকে সুখময় করে রেখেছিলেন।
কিন্তু একদিন সেই সহজ ছন্দের পতন হল।
দ্রোণ তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। ছুটতে-ছুটতে তাঁর কাছে এল তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা। দ্রোণ দেখলেন, বালকের অধরের উপরিভাগে সাদা স্তর পড়েছে। হাতে একখানি পাত্র। সহর্ষে অশ্বত্থামা বলে উঠল, ‘বাবা বাবা! এই দ্যাখো, আমি দুধ খাচ্ছি।’
যারপরনাই বিস্মিত হলেন দ্রোণ। অশ্বত্থামা’র দুগ্ধপ্রীতি তাঁর অজানা নয়। বন্ধুদের দেখে সে প্রায়ই গোরুর দুধ খাওয়ার বায়না করে। দ্রোণ দরিদ্র ব্রাহ্মণ; গোপালনের সামর্থ্য তাঁর নেই। প্রত্যহ দুধ পাবেন কোথায়? কৃপী তাকে ভোলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সে ক্রমাগত বায়না করেই যায়।
আজ তাকে কে দুধ খেতে দিল?
হৃষ্টচিত্তে অশ্বত্থামা দ্রোণের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘মা দিয়েছেন।’
অশ্বত্থামা প্রস্থান করলে দ্রোণ ত্বরিতে স্ত্রী’র কাছে গেলেন। কৃপী দুধ কোথা থেকে পেলেন? তবে কি কোনো প্রতিবেশীর থেকে চেয়ে এনেছেন? দরিদ্র হলেও দ্রোণের স্বাভিমান প্রখর। তাঁর নিষেধাজ্ঞা কি তবে লঙ্ঘন করলেন কৃপী?
‘ওর বন্ধুরা সবাই দুধ খায়।’ অপরাধী মুখে বললেন কৃপী, ‘ও ছেলেমানুষ। দেখলে তো সাধ হবেই। অথচ আপনি শত অনুরোধেও কর্ণপাত করেন না। বাধ্য হয়ে আমি পিটুলি গুলে সেটিই ‘দুধ’ বলে ওকে দিয়েছি। ও শিশু। আসল ও নকল দুধের পার্থক্য করতে পারেনি। আপনি দয়া করে রুষ্ট হবেন না।’
দ্রোণ অত্যন্ত কুপিত হলেন। কিন্তু নিষ্পাপ পুত্রের হর্ষোল্লাস দেখে অপরাধবোধে ভরে গেল তাঁর মন।
সত্যিই তো! তিনি কেমন পিতা যে সন্তানকে সামান্য একটু দুধ খাওয়াতে পারেন না?
বিদ্যুৎচমকের মতো তাঁর মনে পড়ে গেল পুরোনো বন্ধু দ্রুপদের কথা। তাই তো! এতদিন তো মনেই পড়েনি দ্রুপদের সেই অঙ্গীকারের কথা। রাজা হলে তাঁর তো অর্ধেক রাজত্ব দ্রোণকে দান করার কথা!
তবে দ্রোণ ব্রাহ্মণসন্তান। রাজত্ব নিয়ে তিনি কী করবেন? ও-সব তিনি কামনাও করেন না। তবে বাল্যবন্ধু কি তাঁকে একটু সাহায্যও করবেন না? বন্ধুপুত্রের দৈনিক দুধ খাওয়ার সুযোগও কি তিনি করে দেবেন না? নিশ্চয়ই দেবেন। তিনি তো এখন পাঞ্চালের অধিপতি। এই সামান্য সাহায্য তাঁর কাছে নিশ্চয়ই অদেয় হবে না!
কিন্তু দ্রোণর জন্য অপেক্ষা করছিল এক অসম্ভব অপ্রত্যাশিত আঘাত। যে বন্ধুর জীবন তিনি একদিন বাঁচিয়েছিলেন, তিনি আজ তাঁকে চিনতেই অস্বীকার করলেন!
‘বন্ধু!’ দ্রুপদের অট্টহাস্য গুঞ্জরিত হল পূর্ণ সভায়, ‘হাসালেন, ব্রাহ্মণ। হ্যাঁ, আপনি প্রার্থী হয়ে আমার দ্বারে এসেছেন; নিশ্চয়ই আপনাকে কিছু দান করব! ক্ষত্রিয় হিসেবে তা আমার ধর্ম। কিন্তু একজন সমৃদ্ধ নৃপতি’র সঙ্গে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের বন্ধুত্ব! এ আপনি কী বলছেন?’
ক্ষোভে-দুঃখে দ্রোণ প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন পাঞ্চাল রাজসভায়। পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে যে এত বড়ো আঘাত পাবেন তিনি, প্রকাশ্যে এতটা অপমানিত হতে হবে এ তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। বিমূঢ়ভাবে কিছুক্ষণ মৌন থেকে তিনি বললেন, ‘মার্জনা করবেন, মহারাজ। পাঞ্চালরাজের স্মৃতিশক্তি যে এত দুর্বল, মহর্ষি অগ্নিবেশের গুরুকুলও যে আপনি বিস্মৃত হয়েছেন, তা সত্যিই আমার ধারণাতীত ছিল।’
দ্রুপদ যেন শুনতেই পেলেন না দ্রোণের কথা। স্পষ্ট উপেক্ষায় তিনি বাক্যালাপ করতে লাগলেন নিজের এক অমাত্যের সঙ্গে।
সভার সকলের বক্রদৃষ্টি ও উপহাসের মধ্য দিয়ে ধীরে-ধীরে সভাত্যাগ করলেন দ্রোণ। তাঁর সজল নয়ন ক্রমে শুষ্ক হল। তারপর সেই শুষ্ক নয়নে প্রজ্জ্বলিত হল তীব্র বহ্নিশিখা। বন্ধুত্বের অমৃতের স্থান নিল শত্রুতার উগ্র হলাহল। দ্রোণ প্রতিজ্ঞা করলেন, এই অপমানের প্রতিশোধ তিনি নেবেন।
অপমানিত দ্রোণকে সাহায্য করলেন তাঁর শ্যালক কৃপ। তিনি তখন হস্তিনাপুরের একশো পাঁচজন রাজকুমারের অস্ত্রগুরু।
‘আপনি আমার সঙ্গে হস্তিনাপুর চলুন, হে দ্রোণ।’ বললেন কৃপ, ‘রাজকুমারেরা প্রত্যেকেই প্রতিভাবান। বিশেষত তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সমকক্ষ যোদ্ধা ভবিষ্যতে ভূলোকে পাওয়া যাবে না। আপনি যদি তাদের অস্ত্রশিক্ষা দেন, তারাই একদিন আপনার হয়ে প্রতিশোধ নেবে।’
‘কিন্তু কুরু রাজবংশ কি আমায় এ-কাজের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করবেন?’ দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলেন দ্রোণ।
‘এ আপনি কী বলছেন?’ চমকে ওঠেন কৃপ, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরু হলেন আপনি, দ্রোণ! সকল দিব্যাস্ত্রের, বিশেষত আগ্নেয়াস্ত্রের বিদ্যা একমাত্র যাঁর আয়ত্তে, তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন সমস্ত রাজা, সকল রাজপুত্র। কুরু রাজবংশ এতে আগ্রহী হবেন না এ আপনি ভাবলেন কীভাবে? ভীষ্ম বহুবার আমায় অনুরোধ করেছেন আপনাকে এই প্রস্তাব জ্ঞাপন করতে। পাঞ্চালরাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত মৈত্রীর বশে আপনি অস্বীকৃত হবেন ভেবে আমি আপনাকে এযাবৎ এ-প্রস্তাব দিইনি। কিন্তু এবার আপনার বা আমার কারও কাছেই সেই দ্বিধার অবকাশ নেই।’
অতঃপর দ্রোণ উপস্থিত হলেন হস্তিনাপুর রাজগৃহে। বললেন, তিনি কুমারদের অস্ত্রদানে স্বীকৃত। কিন্তু তাঁর একটি বিশেষ শর্ত রয়েছে।
‘আপনার সমস্ত শর্তে আমি স্বীকৃত আচার্য।’ ভীষ্ম সসম্ভ্রমে বললেন, ‘কুমারদের অশেষ সৌভাগ্য তাঁরা আপনার কাছে শিক্ষা নেবে।’
‘বেশ। শিক্ষাশেষে তাঁদের কাছ থেকে অর্ধেক পাঞ্চাল গুরুদক্ষিণা চাই। তাঁরা যেন পাঞ্চালরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমাকে এনে দেন রাজত্বের অর্ধেক!’
ভীষ্ম বিস্মিত হলেন। হস্তিনাপুর ও পাঞ্চাল ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ দুই রাজ্য। তাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষীণ আত্মীয়তার বন্ধনও। গোপন শত্রুতা থাকলেও দুই পক্ষই সম্মুখসমর এড়িয়ে চলতে চায়। ভীষ্মের কাছে কিছুই অজ্ঞাত নয়। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের যে কুরুরাজ্যের সিংহাসনের প্রতি চিরন্তন শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে তা তিনি জানেন। বস্তুত, এই বিষয়ে অসামান্য দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন ভীষ্মের পিতা— স্বর্গত মহারাজ শান্তনু। ভবিষ্যতের কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধে যাতে দিব্যাস্ত্রবিদ দ্রোণ কুরুবংশের পক্ষ নেন, তা নিশ্চিত করার জন্যই নিজের পালিতা কন্যা কৃপী’র সঙ্গে তিনি দ্রোণের বিবাহ দিয়েছিলেন।
কিন্তু দ্রোণ স্বয়ং দ্রুপদের ওপর এত ক্ষুব্ধ কেন? এ যে অতিরিক্ত প্রাপ্তি!
স্বাভাবিকভাবেই ভীষ্ম তাঁর এই চিন্তাদের প্রকাশ্যে ব্যক্ত করলেন না। বিস্ময় সংবরণ করে তিনি শুধু বললেন, ‘যথা আজ্ঞা, আচার্য। আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত।’
দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা শুরু হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কেটে গেল দ্বাদশবর্ষ। ইতিমধ্যে সংঘটিত হল শিখণ্ডীর বিবাহবাসর থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনাটি। শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পর দ্রোণের আদেশে রাজপুত্ররা পাঞ্চালরাজ্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলেন। দ্রোণ স্থির করলেন, দুই ভাগে পাঞ্চাল আক্রমণ করা হবে।
প্রথমেই সমরে প্রবৃত্ত হলেন ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র।
শিখণ্ডী হস্তিনাপুরে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ফলে দ্রুপদের রাজনৈতিক গরিমাও কিঞ্চিৎ হ্রাস পেয়েছিল। প্রকৃত কারণ না জানায় অনুমান ও জনশ্রুতিই প্রচারিত হচ্ছিল অন্যান্য রাজ্যে। ফলে পাঞ্চালের সম্বন্ধে সম্ভ্রম-মিশ্রিত ভীতির ভাবটির স্থান নিচ্ছিল পরিহাস ও কৌতুক। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দ্রুপদ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তারই মধ্যে দ্রোণের ইন্ধনে কুরুবংশীয় রাজপুত্রদের এই পাঞ্চাল আক্রমণে তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। হস্তিনাপুরের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে লালিত ক্রোধ এবার অসহনীয় রূপ নিল।
দ্রুপদ অসাধারণ যোদ্ধা। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষ ভাবে, তিনি বুঝি তাদের বিভ্রান্ত করতে নিজের মতো দেখতে অনেকগুলি মানুষকে রণাঙ্গনে নিয়োগ করেছেন। কিন্তু তা নয়। এত দ্রুততার সঙ্গে দ্রুপদ স্থান-পরিবর্তন করেন যে শত্রুপক্ষ বিভ্রান্ত হয়ে পশ্চাদ্ধাবন করে। এবার সেই রণকৌশলের সঙ্গে যুক্ত হল ক্রোধ। বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে সমরে স্বয়ং মত্ত হলেন দ্রুপদ।
ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল শত কৌরব-রাজপুত্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।
তবে জয়ের আনন্দ উপভোগ করার অবকাশ পেল না পাঞ্চাল। এমন কিছু যে হতে পারে তা দ্রোণ নিজের দূরদৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে অনুমান করেছিলেন। এবার পাঞ্চালের দিকে ধেয়ে এল আর একটি বাহিনী। সেটি ক্ষুদ্রতর, কিন্তু তার নেতৃত্ব রইল পঞ্চপাণ্ডবের হাতে।
রণক্লান্ত দ্রুপদ শিখণ্ডীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানেন, শিখণ্ডী অসাধারণ যোদ্ধা। এর আগে বহু যুদ্ধে শিখণ্ডী একাই নেতৃত্ব দিয়ে রাজ্যকে সফলভাবে রক্ষা করেছেন। এবারেও তিনি নিঃসন্দেহে আক্রমণকারী বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিতে সক্ষম হবেন।
‘সুযোগ বারবার আসে না, পুত্র।’ শিখণ্ডীকে বললেন দ্রুপদ, ‘মনে করো সেই গ্লানিময় দিনের কথা, যেদিন রিক্তহস্তে সকলের কটাক্ষের সামনে দিয়ে অপমানিত হয়ে তোমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল পাঞ্চালে। স্মরণ করো, ক্ষাত্রমতে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা অন্যায়ভাবে ভঙ্গের কথা। যাও পুত্র, যাও! সেই অপমানের প্রতিশোধ নাও।’
শিখণ্ডী বেরিয়ে পড়লেন। বেজে উঠল রণদামামা।
পাঞ্চাল রাজ্যের তিনদিকের সীমান্তে শিবির স্থাপন করেছে শত্রুপক্ষ। ক্ষত্রিয় যুদ্ধনীতিতে অতর্কিত আক্রমণ নীতিবিরুদ্ধ। তাঁরা এখন তিন রাত্রি সেই শিবিরে যাপন করবেন, অপেক্ষা করবেন সন্ধিপ্রস্তাবের জন্য। এদিক থেকে কোনো সংকেত না গেলে তাঁরা বুঝবেন, শত্রুপক্ষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তখন তাঁরা এগিয়ে আসবেন। নিজের শিবিরে বসে এই ত্রিমুখী আক্রমণের সম্ভাব্য পরিণাম বিচার করছিলেন শিখণ্ডী।
সহসা তাঁর মনে পড়ল সেই দিনটির কথা, যেদিন সপারিষদ হস্তিনাপুরে গিয়ে তিনি সম্মুখীন হয়েছিলেন চরম লাঞ্ছনার। তাঁকে বলা হয়েছিল, পরিবারের অভিভাবক ভীষ্ম এই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে অসম্মত। কন্যাকে লগ্নভ্রষ্টা হওয়ার অসম্মান থেকে রক্ষা করার জন্য সিন্ধুপ্রদেশের রাজকুমার হস্তিনাপুরে প্রবেশ করেছিলেন। সাদরে আহূত তাঁর বাহিনীর পাশ দিয়ে নিজেদের হস্তী, উপঢৌকন-সহ অধোবদনে বিদায় নিতে হয়েছিল শিখণ্ডীকে।
সেদিনের কথা মনে করলেই যেন এখনও শিরায়-শিরায় আগুন জ্বলে ওঠে! শিখণ্ডী নিজের প্রতিবন্ধকতার কারণে বিবাহে প্রথমে অস্বীকৃত ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের বিষের প্রদাহ যে এত তীব্র, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
সেই অপমানের পর রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কেটেছে তাঁর। অমাত্যবর্গ থেকে রাজ্যবাসী— প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও গুঞ্জন ছড়িয়েছে রাজ্যে। উঠে এসেছে ভাবী স্ত্রীর আপত্তি থেকে রাজনৈতিক কৌশলের মতো বিভিন্ন সম্ভাব্য কারণ, বিচিত্র সব তত্ত্ব এবং কাহিনি।
কিন্তু শিখণ্ডী নিজে আজও বুঝতে পারেননি, ভীষ্ম কেন এ-বিবাহে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক ত্রুটির কথা পিতা দ্রুপদ এবং মাতা প্রশতী ছাড়া যে কেউই জানেন না। যে রাজবৈদ্য ও দুই ধাত্রী প্রসবকালে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের চিরতরে নীরব করে দেওয়া হয়েছিল অচিরেই। তাই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ।
তবে? হতে পারে ভীষ্ম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অসমসাহসী সত্যব্রতী পুরুষ, অন্তর্যামী তো নন!
‘কুমার!’ সেনাধ্যক্ষ প্রতাপের কথায় শিখণ্ডী সচকিত হলেন, ‘পঞ্চপাণ্ডব মাত্র এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে পাঞ্চাল আক্রমণ করতে এসেছেন সেও বিভক্ত হয়ে রয়েছে তিন ভাগে। সেই তুলনায় পাঞ্চালের আছে তিন অক্ষৌহিণী সৈন্য! তাই আমার মনে হয়, ওঁদের পরাজয় সময়ের অপেক্ষামাত্র।’
শিখণ্ডী’র নিশ্বাস দ্রুততর হল। প্রত্যাখ্যান রহস্যাবৃত থাকুক আপাতত। প্রতিশোধ নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তে তাঁর অভীষ্ট হোক।
‘আজ তৃতীয় দিবস।’ বলছিলেন প্রতাপ, ‘আজ সূর্যাস্তের পর থেকেই ওঁরা রণপ্রস্তুতি শুরু করে দেবেন। আমরা কি প্রতিরক্ষার জন্য ব্যুহ রচনা করব?’
‘না।’ উঠে দাঁড়ালেন শিখণ্ডী। তাঁর গৌরবর্ণ মুখ ইতিমধ্যে রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। নিজেকে সংযত রেখে শিখণ্ডী বললেন, ‘সকলকে প্রস্তুত হতে বলুন। এই আক্রমণ শুধু পিতা বা আমার বিরুদ্ধে নয়। পাঞ্চালের সীমাকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই এই যুদ্ধে শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া আবশ্যক। আত্মতুষ্ট হয়ে অপেক্ষা করার পরিবর্তে দ্রুত আক্রমণ এবং প্রতিপক্ষের বিনাশই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কাল প্রত্যুষে আমরা আক্রমণ করব। হস্তিনাপুরের রণসজ্জাকে মাটিতে মিশিয়ে দেব আমি।’
কিন্তু বাস্তবে হল ঠিক এর বিপরীত। পাঞ্চাল রাজ্যের তিন অক্ষৌহিণী সৈন্য হস্তিনাপুরের এক তৃতীয়াংশের সামনে যেন দাঁড়াতেই পারছিল না। একেবারে সম্মুখে অসমসাহসী যোদ্ধার মতো যুদ্ধ করে যেতে লাগলেন রাজকুমাররা।
যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব শানিত তরবারির আঘাতে কেটে ফেলতে শুরু করলেন সৈন্যদের।
ভীম হস্তী থেকে অবতরণ করে রত হলেন মল্লযুদ্ধে। দৈহিক বলে তাঁর তুল্য ভূভারতে কেউ নেই। পেশিশক্তিতে তিনি পরাজিত করতে লাগলেন শত্রুকে। দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা দ্রোণের শেখানো নানাবিধ ব্যূহ রচনা করলেন। শত্রুপক্ষ যুদ্ধের গতিতে সম্মোহিত হয়ে নিজেদের অজান্তেই প্রবেশ করতে লাগল সেইসব ব্যূহতে, কিন্তু বহির্গত হতে পারল না। এইভাবে বন্দি করতে লাগল ঝাঁক ঝাঁক পাঞ্চাল সৈন্য।
এবং অর্জুন!
অর্জুন যেন একাই এক সৈন্যদল! তাঁর নিক্ষিপ্ত শত শত কালান্তক শরের নির্ভুল লক্ষ্যভেদে ধরাশায়ী হতে লাগল পাঞ্চালসেনার সৈন্য থেকে উপসেনাপতিরা।
সেনাধ্যক্ষ প্রতাপ রথে আসীন হয়ে যুদ্ধ করছিলেন। সহসা তাঁর বুকে এসে বিঁধল অর্জুনের তির। যন্ত্রণায় রথ থেকে ভূমিতে পতিত হলেন তিনি।
সেনাপ্রধান নিহত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে পাঞ্চাল বাহিনীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। শিখণ্ডী একা শত শত শত্রুসেনা নিধন করলেও সেনাদের মনোবল বাড়াতে পারলেন না। রণে ভঙ্গ দিয়ে পলাতক হল এক বিপুল সংখ্যক সৈন্য। ক্রমশ রণক্ষেত্রে একা হয়ে পড়তে লাগলেন শিখণ্ডী।
ঠিক এই সময় তাঁর রথের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল তৃতীয় পাণ্ডবের রথ।
মৃত্যু অথবা প্রবল প্রতিপক্ষ দুয়ের কাউকেই ভয় পান না শিখণ্ডী। তিনি চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেন। নিহত সৈন্যদের রক্তাক্ত দেহের ওপর অস্তগামী দিনমণি তখন সযত্নে ছড়িয়ে দিয়েছেন রক্তরাগ।
নিজের তরবারি আর ঢাল নিয়ে শিখণ্ডী রথ থেকে অবতরণ করে অগ্রসর হলেন।
প্রতিপক্ষ অসিযুদ্ধে আহ্বান করলে সেভাবেই লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হতে হয়। পাঞ্চালের রাজকুমার ধনুর্বাণ ছেড়ে অসি তুলে নিয়েছেন দেখে অর্জুনও অসি হাতে তাঁর মুখোমুখি হলেন। মুখোমুখি হলেন দুই বীর যোদ্ধা। অর্জুন এগিয়ে এসে তরোয়াল উঁচু করে তুলে যুদ্ধের সংকেত দিলেন।
কিন্তু শিখণ্ডী?
তিনি যেন মূক হয়ে গিয়েছেন! অস্তমান সূর্যের রক্তিম আলোয় তাঁর মুখ যেন কেমন রহস্যময় ঠেকছে। প্রচণ্ড বিস্ময়ে একদৃষ্টে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর!
অর্জুন আবারও তলোয়ার তুললেন।
কিন্তু শিখণ্ডীর দিক থেকে কোনো সাড়া নেই। তিনি প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
অদ্ভুত ব্যাপার! অধৈর্য অর্জুন এবার দক্ষিণহস্তে নিজের শঙ্খ তুলে নিয়ে ফুঁ দিলেন। প্রচণ্ড শঙ্খধ্বনিতে প্রকম্পিত হল সমগ্র রণভূমি। মুমূর্ষু সেনারাও যেন সেই শব্দে ভয়ে কেঁপে উঠল শেষবারের মতো।
সুপ্তোহিতের মতো অর্জুনের দিকে তাকালেন শিখণ্ডী। কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ত্বরিতে আপন রথে আরোহণ করে তিনি সারথিকে নির্দেশ দিলেন রাজধানী কম্পিল্যের দিকে রথকে ধাবিত করার জন্য।
অর্জুন হতবাক হয়ে গেলেন। শিখণ্ডীর এমন অদ্ভুত আচরণের হেতু তাঁর বোধগম্যই হল না। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।
সেখানে পাঞ্চালের ভাবী উত্তরাধিকারী যুদ্ধ না করেই রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করলেন কেন?
স্তব্ধবাক দ্রুপদ সভায় বসে ছিলেন। দ্রোণের হয়ে পাঞ্চালের শাসনভার অধিকার করেছে পাণ্ডব-নেতৃত্বাধীন বাহিনী। দ্রুপদের সঙ্গীরা বিমূঢ়, হতচকিত। গণনাতীত সৈন্যের মৃত্যুতে রাজ্য জুড়ে হাহাকার উঠেছে। সেই শোকের প্রবাহে ভেসে গেছে দ্রুপদের ব্যক্তিগত অবমাননা।
‘এমনভাবে পরাজয়!’ দ্রুপদ মস্তকে করাঘাত করে বলে উঠলেন ভগ্নকণ্ঠে, ‘এমনকি সেনাধ্যক্ষ প্রতাপও নিহত। সামরিকভাবে এর উত্তর দেওয়া অসম্ভব। এই অবস্থায় আমাদের কী করণীয়?’
তখনই উত্তেজিতভাবে সভায় প্রবেশ করলেন মহামন্ত্রী চিত্রবান। দ্রুপদকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন, ‘মহারাজ, দুটি সংবাদ জ্ঞাপন করার ছিল। প্রথমটি, আচার্য দ্রোণ দূত মারফত একটি ভূর্জপত্র প্রেরণ করেছেন। পত্রটির ওপরে লেখা, পরাজিতের প্রতি বার্তা।’
দ্রুপদের নাসা স্ফীত হয়ে উঠল। ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে উঠল চোখ। এত দুঃসাহস এক ব্রাহ্মণের? বললেন, ‘কী লেখা আছে তাতে?’
‘বিষয়টি গোপন, মহারাজ।’
একে-একে বিদায় নিলেন অমাত্যেরা। শূন্যপ্রায় সভাকক্ষে দাঁড়িয়ে চিত্রবান বললেন, ‘আচার্য দ্রোণ লিখেছেন, আপনি বন্ধুত্ব বিস্মৃত হলেও তিনি হননি। তাই, আপনার রাজ্য তিনি আপনাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তবে পাঞ্চালের অর্ধাংশ হস্তিনাপুরের এক রাজপ্রতিনিধি তাঁর হয়ে শাসন করবেন। অপরাহ্নের পরেই কম্পিল্য ত্যাগ করে তাঁদের সৈন্যবাহিনী যাত্রা করবে হস্তিনাপুরের উদ্দেশে। বাল্যবন্ধুর স্মৃতিকে সজাগ করে তোলার জন্য এ ছিল তাঁর তরফে সামান্য প্রয়াস। তিনি আশা করেন যে এই পরাজয় থেকে আপনি যথোপযুক্ত শিক্ষা নিয়েছেন। আর এতদিনে আপনাদের বন্ধুত্বটা সমানে সমানে হল।’
দ্রুপদের মনে হল, কয়েক ক্রোশ দূরে অবস্থান করেও দ্রোণ যেন একটি প্রচণ্ড চপেটাঘাত করলেন তাঁর গণ্ডদেশে। প্রবলচিত্তবলে নিজেকে সংযত করে তিনি বললেন, ‘দ্বিতীয় সংবাদটি কী, মহামন্ত্রী?’
চিত্রবান নিম্নকণ্ঠে বললেন, ‘রাজকুমার শিখণ্ডী শত্রু-শিবিরে গোপনে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন।’
‘কেন?’ দ্রুপদ অত্যন্ত বিস্মিত হলেন।
‘তা জানতে পারিনি, মহারাজ।’
চিন্তামগ্ন হলেন দ্রুপদ। শিখণ্ডী অত্যন্ত বুদ্ধিমান। নিজে দক্ষ যোদ্ধা হওয়ার পাশাপাশি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কৌশলের প্রয়োগ করে সে একাধিকবার পাঞ্চালকে জয়ী করেছে যুদ্ধে। তার প্রতিবন্ধকতা বলতে একমাত্র শারীরিক বল। দৈহিক শক্তিতে সে একজন নারীর সমতুল। কিন্তু কুরুবংশীয়দের কাছে এমন শোচনীয় পরাজয়ের পর তাঁদেরই শিবিরে গোপনে গমনের হেতু কী হতে পারে? এর পশ্চাতে কি খেলা করছে কোনো কূট রাজনৈতিক অভিসন্ধি?
‘পত্রের উত্তর পাঠান মহামন্ত্রী।’ আপৎকালীন কর্মে নিজেকে নিমজ্জিত করতে প্রয়াসী হন দ্রুপদ, ‘তাতে জানিয়ে দিন, দ্রোণের এই মহানুভবতায় পাঞ্চাল রাজ্য ধন্য ও কৃতজ্ঞ। অদূর ভবিষ্যতে তিনি এই মহানুভবতার প্রতিদান অবশ্যই পাবেন।’
চিত্রবান প্রস্থান করলে দ্রুপদ স্বগতোক্তি করলেন, ‘তোমার ওই কুবুদ্ধিতে ভরপুর মস্তকটি কর্তিত করে ভূতলশায়ী না করা অবধি আমি শান্তি পাব না, দ্রোণ। তার জন্য আমার চাই এমন যোদ্ধা, যে সবদিক দিয়েই হবে বলশালী। শিখণ্ডীর মতো দুর্বলকে দিয়ে সেই কার্য সিদ্ধ হবে না।’
অর্জুন বিব্রতমুখে বসে ছিলেন। শিবিরে তাঁর অস্থায়ী কক্ষে বিরাজ করছিল এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সযত্নরক্ষিত সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর মধ্যে দুটি প্রাণী হিসাবে মুখোমুখি বসে রয়েছেন তিনি ও পাঞ্চাল রাজকুমার।
অর্জুন এখনও বুঝতে পারছেন না, পাঞ্চালকুমার কী চাইছেন! গতকাল রণক্ষেত্রে যুদ্ধকালে ওইরূপ অপ্রত্যাশিত আচরণ, তারপর গভীর রাতে ছদ্মবেশে শিবিরে আগমন। আচার্য দ্রোণ তো যুদ্ধে জয়লাভের পরেও পাঞ্চালরাজকে সব ফিরিয়েই দিয়েছেন, তবে এই আগমনের হেতু কী?
অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে পাঞ্চাল রাজকুমার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। তাঁর আপাদমস্তক কৃষ্ণকালো বর্ণের এক অদ্ভুত পোশাকে আবৃত। চোখদুটি ছাড়া সমস্ত অঙ্গই ঢাকা।
অর্জুন পুনরায় বললেন, ‘বলুন কুমার। আপনি কি আমার থেকে কোনো সহায়তা চান? আমরা সম্ভবত একই বয়সি। গুরুর আদেশে আমরা পাঞ্চাল রাজ্য আক্রমণ করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমি নিজে পাঞ্চাল রাজ্যের প্রতি একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন নই, তেমন কোনো কারণও ঘটেনি। আপনি নিঃসংকোচে বলতে পারেন।’
‘আপনি মর্ত্যের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, অর্জুন। আপনার শৌর্যে রূপে পৌরুষে আমি মুগ্ধ।’ রাজকুমার এই প্রথম কথা বললেন, ‘আমি আপনার চরণকমলে আশ্রয় চাই। দয়া করুন আমায়!’
চরণকমলে আশ্রয়? এর অর্থ? অর্জুন ভ্রূকুটি করলেন। একজন স্বাধীন দেশের ভাবী উত্তরাধিকারী তাঁর চরণে আশ্রয় চাইছেন কেন?
অর্জুন কিছু বলার আগেই শিখণ্ডী উঠে দাঁড়ালেন। একটানে খুলে ফেললেন কৃষ্ণকালো পরিধেয়টি। কক্ষের চতুর্দিকে দেদীপ্যমান প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় অর্জুন শিহরিত হয়ে উঠলেন।
‘এ কী!’
কোথায় যুবক রাজকুমার? এ যে অনিন্দ্যসুন্দরী এক যুবতি! সুন্দর সুডৌল মুখশ্রী। দীর্ঘ ঘন কেশ কটিদেশ ছাপিয়েছে। অর্ধস্বচ্ছ বক্ষবন্ধনীর আড়ালে স্তন ক্ষুদ্র হলেও স্পষ্ট প্রতীয়মান। সুডৌল হস্তে ও পদে কমনীয়তার পরিপূর্ণ ছাপ। ঘন অক্ষিপল্লবে ঢাকা যে চোখ এতক্ষণ অর্ধাবৃত ছিল, তা থেকে এখন ঝরে পড়ছে কামনার উন্মুক্ত আহ্বান।
অর্জুন বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়ালেন। সর্বাগ্রে তাঁর মনে হল, ইচ্ছাকৃত চরিত্রহননের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
‘কে আপনি? একজন নারী হয়ে মিথ্যাচারণ করে গভীর রাতে আমার শিবিরে প্রবেশের দুঃসাহস হয় কী করে?’
আর্তনাদ করে উঠলেন শিখণ্ডী, ‘মিথ্যাচার নয়! আমি … আমি সত্যিই নারী। জন্মেছিলাম শিখণ্ডিনী হয়ে। পিতা আমাকে পুরুষের মতো বড়ো করেছেন। রাজকন্যা নয়, রাজপুত্র হিসেবে আমাকে লোকসমাজে পরিচিত করানো হয়েছে। পৌরুষ আহরণের প্রতিযোগিতায় লড়তে লড়তে আমিও নিজেকে একজন পুরুষই ভাবতে শুরু করেছিলাম অর্জুন! কিন্তু, গতকাল আপনাকে দেখার পর আমার সেই ভ্রম দূর হয়েছে চিরজন্মের মতো। আপনার অপার পৌরুষে আমার বহুযুগ ধরে সুপ্ত থাকা নারীত্ব আবার জাগরিত হয়েছে। দয়া করুন আমায়!’
শিখণ্ডীর কথা শুনতে শুনতে অর্জুনের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বললেন, ‘আমার কাছে আপনি কী চাইছেন?’
শিখণ্ডী নীরবে অশ্রুপাত করছিলেন। এবার করজোড়ে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আমার চক্ষুর বন্ধনী খুলে দিয়েছেন, অর্জুন। আমি আপনার স্পর্শে, আপনার পৌরুষের ছোঁয়ায় নিজের নারীত্ব সার্থক করতে চাই! আমি জীবনে এতগুলো বছর এক চরম হীনমন্যতায় ভুগেছি। নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি পৌরুষকে। আজ নারীত্বের অমোঘ উদ্বোধনের দ্বারা না হয় সেইসব ব্যর্থ মুহূর্তের প্রায়শ্চিত্ত হোক!’
বলতে বলতে শিখণ্ডী নিজের বক্ষাবরণী উন্মুক্ত করলেন।
‘না, না।’ আর্তনাদ করে উঠলেন অর্জুন, ‘এ হয় না! আপনি থামুন, শিখণ্ডী।’
‘শিখণ্ডী নয় প্রিয়, শিখণ্ডিনী!’ শিখণ্ডী কাতরভাবে আলিঙ্গন করলেন অর্জুনকে, ‘আমি আপনার কাছে ভিক্ষাপ্রার্থনা করছি। একটি রাত! একটি রাত আমায় ভিক্ষা দিন অর্জুন! পুরুষ তো আমি হতে পারিনি। একটি রাতের জন্য অন্তত নারী হয়ে দেখি!’
‘আপনি পুরুষ হবেন শিখণ্ডী!’ অর্জুন শিখণ্ডীর বাহুডোর থেকে মুক্ত করতে চাইলেন নিজেকে, ফিশফিশ করে বললেন, ‘আপনি … আপনি মহাদিদেবের দৈববাণীতে আস্থা রাখুন।’
অধীর উন্মাদনায় নিজের অধর অর্জুনের ওষ্ঠে মিশিয়ে দিতে উদ্যত হতে চলেছিলেন শিখণ্ডী। দংশনের দহনে জাগিয়ে তুলতে চাইছিলেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষটিকে। কিন্তু অর্জুনের কথা শুনে তিনি থমকে গেলেন। প্রত্যাখ্যানের অপমান ছাপিয়ে তাঁর মনে জেগে উঠল কৌতূহল।
‘মহাদেবের দৈববাণী? আপনি সে-কথা কী করে জানলেন অর্জুন?’
কয়েক মুহূর্ত নীরব রইলেন অর্জুন। তারপর নিম্নকণ্ঠে বললেন, ‘ভগিনী দুঃশলা’র দ্বারপ্রান্ত থেকে বিনা দোষে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আপনাকে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল পাঞ্চালে। কুরুবংশের পক্ষে এ-আচরণ অশোভন বলে মনে হয়েছিল অনেকেরই। আমিও ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। সেদিন পিতামহ ভীষ্ম আমাকে আপনার ইতিহাস জানিয়েছিলেন, শিখণ্ডী। এতদিন কিছু সংশয় ছিল আমার মনে। কিন্তু আজ আমি নিঃসন্দেহ।’
‘ইতিহাস? কী ইতিহাস?’ বিমূঢ় ভাবে তাকালেন শিখণ্ডী। এই নিবিড়, গোপন মুহূর্তে আবার কেন ভীষ্মের নাম উচ্চারিত হল? ওই নাম শুনলেই যেন শিখণ্ডী’র সর্বাঙ্গে প্রদাহ জাগে।
কিন্তু কেন? এ-প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেও জানেন না।
‘আপনি জানেন না?’ অর্জুন সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন। শিখণ্ডী নীরবে মস্তক আন্দোলিত করলেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অর্জুন। তারপর বললেন, ‘আপনাদের পাঞ্চাল রাজসভার দক্ষিণ অলিন্দের পঞ্চম থাম থেকে একটি পদ্মমালা ঝুলছে। সেই মালা দেখেছেন কখনও?’
‘পদ্মমালা!’ বিমূঢ়ের মতো বলে ওঠেন শিখণ্ডী, ‘লক্ষ করিনি তো!’
শিখণ্ডীর কাঁধে হাত রাখলেন অর্জুন। তাঁর চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘ফিরে যান। সেই পদ্মমালাটিকে লক্ষ করুন। হয়তো কোনো বিস্মৃত মুহূর্তের স্মৃতি আপনার মনে জাগ্রত হবে, ভ্রাতা!’
অর্জুনের মুখোচ্চারিত শেষ শব্দটি শ্রবণমাত্র শিখণ্ডী’র চোখ জলে ভরে গেল।
ঈশ্বর তাঁকে ভাগ্যের ক্রীড়নক করে রাখতে চান কেন? আর কত শাস্তি পেতে হবে তাঁকে? কী দোষ তাঁর?
কোথায় যাবেন শিখণ্ডী?
পাঞ্চাল রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী আর কিছু বললেন না। জীবনের প্রথম ভালোবাসা যাকে নিবেদন করেছিলেন, তাঁকে নিজের উদগত অশ্রু দেখতে দিলেন না তিনি। শরীর ঢেকে নিলেন কৃষ্ণবস্ত্রে। অর্জুনকে করজোড়ে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন শত্রুশিবির হতে।
অপেক্ষা করছিল বিশ্বস্ত অশ্ব। অশ্বপৃষ্ঠে উড্ডীন হয়ে শিখণ্ডী দ্রুত এগিয়ে চললেন রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে।
‘মিতু! মিতু! কী করছিস মিতু!’ সাহানা ছুটে গিয়ে চেপে ধরে মিতুর হাত।
‘ছাড় আমাকে!’ মিতু কেমন গোঙাচ্ছিল। ওর মোটা কাচের চশমার আড়ালে চোখদুটো কেমন অস্বাভাবিক রকমের বড়ো দেখাচ্ছিল। প্রাণপণে নিজেকে সাহানার হাত থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল।
মিতুর শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছিল না সাহানা। চারতলার ছাদের পাঁচিলে ধস্তাধস্তি চলছিল। বাধ্য হয়ে সাহানা মিতুর চশমাটা কোনোরকমে খুলে ফেলে দিল মাটিতে। মিতুর প্রতিরোধ এবার অন্ধকারে অনেকটাই কমে এল।
সেই সুযোগে সাহানা ওকে জোর করে টেনে নিয়ে এল ছাদের এক কোণে। চিলেকোঠার সিঁড়ি ছাড়াও এই ছাদে ওঠার একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আছে ওদের দুজনের ঘরের বাথরুমের ভেতর দিয়ে।
কবেকার বাড়ি! কে বানিয়েছিল, তা ওরা কেন, গণপতিকাকা নিজেও বোধহয় জানেন না। কার মাথা থেকে যে তিনতলার এই ঘরের বাথরুম থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি বানানোর অদ্ভুত পরিকল্পনা এসেছিল, কেনই বা এসেছিল, তা নিয়ে ওরা হাসিঠাট্টা করেছে অনেকবার। কিন্তু এই সিঁড়ি দিয়েই বহু রাতে ওরা দুজন উঠে এসেছে ছাদে। রাতের আকাশের মিটমিট করা তারার নীচে বাবু হয়ে পাশাপাশি বসে দেখেছে কোনো সিনেমা। কিংবা গল্প করেছে আকাশপাতাল।
গোটা বাড়িটার মধ্যে তাই ওদের ঘরটা একটু বেশিই স্পেশাল।
সাহানা মিতুকে একরকম টানতে টানতে নিয়ে গেল ঘরে। তারপর দরজা বন্ধ করে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারল। শব্দ হল, ঠাস ঠাস।
‘লজ্জা করে না তোর?’ চিৎকার করে উঠল সাহানা, ‘শালা রাতের বেলা একপেট মদ গিলে ছাদ থেকে লাফাতে যাচ্ছিলি? দাঁড়া, এখুনি গণপতিকাকাকে ফোন করে বলছি!’
মিতু কাতরচোখে তাকাল, ‘চশমাটা দে।’
সাহানা বলল, ‘ছাদেই পড়ে আছে। এখন গোটা রাত কানা হয়ে থাক, সকালে গিয়ে কুড়োবি। এটাই তোর শাস্তি।’
মিতু ঢোঁক গিলল। চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে রয়েছে ওর। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘আজ সন্টু আবার ফোন করেছিল। চার হাজারে ওর খাঁই মিটছে না। আরও চাই।’
সাহানা থমকে গেল। বলল, ‘তোর সেই আশ্রমের সন্টু? যে তোদের সঙ্গে পড়ত, মাঝপথে পড়া ছেড়ে এখন লোকাল মস্তান হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। আমাদের সঙ্গে পড়ত না। অনেকটা বড়ো ছিল।’
‘ওই যাই হোক। তোকে প্রথমেই বারণ করেছিলাম মিতু।’ বিরক্ত গলায় সাহানা বলল, ‘নিজে ওইক’টা টাকা রোজগার করিস, সেখান থেকে আবার লোককে মাসে মাসে সাহায্য করার কী আছে? কে হয় ও তোর? নিজের আদিখ্যেতার জন্য এবার তুই মর!’
মিতু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর উঠে এসে সাহানাকে জড়িয়ে ধরল।
‘কী হল?’ সাহানা অবাক হচ্ছিল।
মিতু কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘সাহানা, বাবাকে আমার মনেও নেই। মা মরে যাওয়ার পর থেকে তোর মতো কেউ আমায় ভালোবাসেনি। তুই আমায় কখনও ভুল বুঝবি না তো?’
সাহানা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল, ‘রাত বারোটা বাজছে মিতু! এইসময় তোর কি মাথায় পোকা নড়ল? কাল সকালে উঠেই তো আবার দৌড়োতে হবে।’
মিতুর কানে সাহানার কথাগুলো ঢুকেছে বলে মনে হল না। ও একইরকমভাবে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছিল।
‘বুঝেছি। তুই নিজেও ঘুমবি না, আমাকেও ঘুমোতে দিবি না।’ সাহানা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ফিরে এল হাতে একটা খাবারের প্লেট নিয়ে।
‘এই নে। সন্ধে থেকে তো খালি গিলেছিস। একটু পায়েস করেছিলাম। খা।’
মিতু বাধ্য শিশুর মতো চুপচাপ পায়েস খেল কিছুটা। তারপর একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘তুই যদি কখনও জানতে পারিস, মিতু খুব খারাপ একটা মানুষ, আমাকে আগের মতো আর ভালোবাসবি সাহানা?’
‘হঠাৎ এই কথা কেন?’ সাহানা লঘুস্বরে বলল, ‘কী করেছিস তুই? কাউকে পিটিয়েছিস?’
মিতু বলল, ‘হ্যাঁ। শুধু পেটাইনি। পিটিয়ে মেরে ফেলেছি।’
‘বেশ করেছিস।’ সাহানা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে একটা আলতো ঘুসি মারল মিতুর পেটে।
কতদিন আগেকার কথা! তবু মনে পড়তে কেঁপে উঠল সাহানা। ঢকঢক করে জল খেল কিছুটা। বোতলের জল ঘরের মেঝেতেই ফেলে ঘাড়ে কপালে কানের পেছনে ঝাপটা দিল। মিতুর খাতাটা বন্ধ করে বাথরুমে গেল।
ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটে। গ্রীষ্মকাল, পুব আকাশ এর মধ্যেই ফর্সা হতে শুরু করেছে। খাতাটা নিয়ে সাহানা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ছিটকিনি এঁটে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল। একটা দমকা ঠান্ডা হাওয়া এসে ওর সারারাতের ক্লান্তিটাকে যেন জুড়িয়ে দিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে ও ফোন করল।
ফোনটা দু-বার বেজে-বেজে কেটে গেল। তৃতীয়বারে ঊর্ণার জড়ানো গলা শুনতে পেল ও, ‘হ্যাঁ, বল!’
‘ঘুমোচ্ছিলি?’
‘হ্যাঁ রে!’ ঊর্ণা খিঁচিয়ে উঠল, ‘আমাকে তো বিশাল পালঙ্ক দিয়েছে ঘুমোনোর জন্য। সারারাত মশার কামড়ে শেষ হয়ে গেলাম। এখন চেয়ারে বসেই ঢুলছি। সামনেই টয়লেট, দুর্গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে।’
সাহানা বলল, ‘মিতুর কোনো খবর আছে?’
‘একটু পরে ডাক্তার আসবে রাউন্ড দিতে। তখন জানতে পারব।’ ঊর্ণা বলল, ‘হ্যাঁ রে, হোস্টেলে নাকি পুলিশ এসেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী বলল? মিতুর ঘর সার্চ করল? জেরা করল সবাইকে?’
‘ওই আর কী।’ সাহানা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বল। মিতু’র ওই কী আর্টারি বললি, সেটা কাটা যায়নি? অন্য কোথাও কেটেছে?’
‘কাল রাতে ডাক্তার তো তাই বললেন।’ ঊর্ণা বলল, ‘মনে হয় এ-যাত্রা ও বেঁচে যাবে। তবে সার্জারি করতে হবে। না হলে রক্ত বন্ধ হবে না।’
মধ্যরাত্রি। রাজপ্রাসাদের বহির্কক্ষে জ্বলছে শুধু দুটি প্রদীপ। ঘন অন্ধকারে মনে হচ্ছে, এ যেন কোনো প্রেতপুরী। মূল প্রবেশদ্বারের দু-পাশে দণ্ডায়মান দুই অতন্দ্র রক্ষী কালো পোশাকে আপাদমস্তক আবৃত করে রাখা মানুষটিকে দেখে চমকে উঠল। শিখণ্ডী নিঃশব্দে মুখের অবগুণ্ঠন সরালেন। প্রদীপের আলোয় তাঁর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
প্রহরীরা দেশের রাজপুত্রকে এই অসময়ে দেখে শশব্যস্তে প্রধান দ্বার খুলে দিল।
কোথায় দক্ষিণ অলিন্দ? কোথায় সেই অলিন্দের পঞ্চম থাম?
শিখণ্ডী’র অন্তর দগ্ধ হচ্ছিল এক অসহ বেদনায়। এই বেঁচে থাকার কী অর্থ? কেন তাঁকে এইভাবে বাঁচতে হবে? কতদিন তাঁকে ধারণ করতে হবে এই বিচিত্র কালকূট? তিনি তো নীলকণ্ঠ নন!
শিখণ্ডী উন্মাদের মতো খুঁজছিলেন মালাটা। তাঁর ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মিথ্যা এই মনুষ্যজন্ম। মিথ্যা এই না-পুরুষ না-নারী হয়ে বাঁচা।
আর সর্বোপরি… মিথ্যা…সম্পূর্ণ মিথ্যা অর্জুনকে ছাড়া বাঁচা!
শূন্য অলিন্দে জ্বলছিল দশটি স্বর্ণপ্রদীপ। তাদেরই আলোয় তিনি অবশেষে খুঁজে পেলেন পঞ্চম থাম। তার গায়ে অনাদরে জড়ানো রয়েছে একটি পদ্মমালা। সতেজ, কিন্তু বিবর্ণ।
কী তাৎপর্য এই মালার? কোন রহস্য নিহিত আছে এর অন্তরে বিবর্ণ, তবু স্বতেজ কোন জাদুবলে?
কম্পিতহস্তে মালাটি নিলেন শিখণ্ডী। তৎক্ষণাৎ কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাত হল যেন। অন্ধকার চরাচর মুহূর্তে প্লাবিত হল বিদ্যুৎপ্রভায়। শুরু হল প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা। প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি যেন নতুন করে আক্রমণ করল পাঞ্চাল রাজপ্রাসাদকে।
সেই অতর্কিত অভিঘাতে শিখণ্ডী মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন।
স্বপ্ন, না অলীকবীক্ষণ? হঠাৎ স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যবর্তিনী হয়ে তাঁর চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল একের পর এক দৃশ্য। সে কি স্বপ্ন? না তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্কসঞ্জাত কল্পনা?
শিখণ্ডী দেখলেন, অন্ধকার পাঞ্চাল রাজপ্রাসাদ লুপ্ত হয়ে গেছে কালের কুয়াশায়। তার পরিবর্তে তিনি উপস্থিত হয়েছেন এক অন্য রাজসভায়। সেখানে আলোকিত মুখে একের পর এক আসনে বসে আছেন রাজা ও রাজপুত্রেরা। সিংহাসনের সামনে দণ্ডায়মান এক প্রৌঢ়, যাঁর সাজসজ্জা ও শিরস্ত্রাণ দেখে স্পষ্ট হয়, তিনিই এই রাজসভার অধীশ্বর।
বিনম্র নমস্কার করে কথা বলতে শুরু করলেন রাজা। প্রথমেই তিনি দূর-দূরান্ত থেকে আগত রাজকুমারদের উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। তাঁরা যে আহ্বানে সাড়া দিয়ে, দীর্ঘযাত্রার কষ্ট স্বীকার করে এই বিশেষ লগ্নে ও তিথিতে উপস্থিত হয়েছেন এতে তিনি কৃতজ্ঞ।
‘এখনই উপস্থিত হবেন কাশীরাজ্যের তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকা। স্বয়ংবরের নিয়ম অনুযায়ী যে কন্যা যাঁকে মনোনীত করে বরমাল্য প্রদান করবেন, তাঁর সঙ্গেই বিবাহ হবে সেই রাজকন্যার। এ-বিষয়ে কন্যাত্রয়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
অপার বিস্ময়ে, চেতনা এবং অচেতনের মাঝে দাঁড়িয়ে শিখণ্ডী দেখে চলেছিলেন এই ঘটনাক্রম। সব যেন কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে! সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে! কাশীরাজের স্বয়ংবরসভা তিনি কেন দেখছেন? কীভাবেই বা তা সম্ভব?
ইতিমধ্যে সভায় উপস্থিত হয়েছেন তিন কন্যা। অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা। তিনজনেই সুন্দরী, সুসজ্জিতা, সালংকারা। স্মিতমুখে বরমাল্য নিয়ে তাঁরা ধীরপদে এগিয়ে আসছেন সভার সামনের দিকে, যেখানে একবুক আশা নিয়ে প্রতীক্ষায় আছেন রাজপুত্রেরা।
কিন্তু এ কী! এ কী হচ্ছে?
দুর্দমনীয় ভঙ্গিতে এ কে প্রবেশ করলেন সভায়? এ যে হস্তিনাপুরের অভিভাবক চিরকুমার ভীষ্ম!
বর্তমানে তিনি প্রৌঢ়। কিন্তু শিখণ্ডী যাঁকে দেখছেন, তিনি তো মধ্য যৌবনে দীপ্ত ও দৃপ্ত। প্রবল বিক্রমে সভামধ্যে উপস্থিত হয়ে তিনি বলছেন, ‘স্তব্ধ হও! এই স্বয়ংবর হবে না।’
‘হবে না!’ কাশীরাজ বিমুঢ় ভঙ্গিতে বললেন, ‘কেন?’
‘কারণ আমি এই তিন কন্যাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছি।’ ভীষ্ম দ্রুতগতিতে এগিয়ে অম্বার হাত ধরে টান দিলেন, ‘যদি আপনাদের মধ্যে কারও ক্ষমতা থাকে, আমাকে প্রতিরোধ করতে পারেন।’
সভায় শুরু হয়েছে মৃদু গুঞ্জন। শ্লেষ আর ব্যঙ্গোক্তিতে মেতে উঠছেন পাত্ররা। তাহলে ভীষ্মের কৌমার্যব্রত ভঙ্গ হতে চলেছে এতদিনে! পিতার জন্য অনেক ক্লেশ স্বীকার করেছেন তিনি, আর পারছেন না। সেই হতাশা থেকেই তাঁর মনে বিবাহের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়ে উঠেছে তাহলে।
‘এ কেমন অনাচার!’ প্রতিবাদ করলেন এক পাণিপ্রার্থী সুদর্শন নৃপতি, ‘এ যে ধর্মবিরুদ্ধ! আপনি এমন করতে পারেন না।’
‘কেন পারি না?’ ভীষ্ম স্মিতমুখে বললেন, ‘আপনি কি রাক্ষসবিবাহের নাম শোনেননি? ক্ষাত্রধর্মানুযায়ী এই বিবাহ রীতিসিদ্ধ। কারওর আটকানোর ক্ষমতা থাকলে আটকাবেন।’
সেই নৃপতি মুহূর্তে তাঁর অসি কোষমুক্ত করলেন। বললেন, ‘আপনি এভাবে ওঁদের নিয়ে যেতে পারেন না!’
মুহূর্তের জন্য সভা স্তব্ধ হল। পরক্ষণেই, এক হাতে অম্বার হাত ধরে অন্য হাতে নিজের তরবারিকে উন্মোচিত করলেন ভীষ্ম। রাজসভা পরিণত হল রণভূমিতে। অন্য কোনো রাজা সেভাবে এগিয়ে না এলেও সেই সুদর্শন নৃপতি একাই চালিয়ে যেতে লাগলেন অসিযুদ্ধ। কিন্তু ভীষ্মের কাছে তিনিও হার মানলেন অচিরে।
রক্তাক্ত সেই রাজাকে ভূতলশায়ী করে ভীষ্ম নিজের রথে তুললেন কাশীরাজের তিন কন্যাকে। রথ ধাবমান হল হস্তিনাপুরের অভিমুখে।
আহ! শিখণ্ডীর মাথা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে প্রবল এক অজানা চাপে। তারই মধ্যে মানসপটে তিনি দেখে চললেন, কীভাবে ভীষ্ম তিন কন্যাকে নিয়ে পৌঁছোচ্ছেন হস্তিনাপুরে, তাঁদের তুলে দিচ্ছেন বিমাতা সত্যবতীর হাতে।
ভীষ্মের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা সত্যবতী-তনয় বিচিত্রবীর্যের জন্য হরণ করে আনা হয়েছে তিন কন্যাকে।
তেজস্বী অশ্বের ন্যায় ফুঁসে উঠছেন মধ্যমা অম্বিকা, ‘বলপূর্বক যিনি হরণ করে আনেন, রাক্ষস-বিবাহ মতে তিনিই একমাত্র পাত্র হতে পারেন। এর অন্যথা কি শাস্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ নয়?’
হস্তিনাপুরের রাজমাতা সত্যবতী গম্ভীর কণ্ঠে বলছেন, ‘বংশের ভবিষ্যৎ এখন সংকটের সম্মুখীন। এমতাবস্থায় অনাচার বলে কিছু হয় না, বৎসে! দেবব্রত ভীষ্ম সিংহাসনে আরোহণ করবেন না। আমার জ্যেষ্ঠপুত্র চিত্রাঙ্গদ ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছে। বিচিত্রবীর্যের অবর্তমানে হস্তিনাপুর উত্তরাধিকারীশূন্য হয়ে পড়বে। তাই তোমাদের তিনজনেরই কর্তব্য হবে যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ সন্তান উপহার দেওয়া।’
কনিষ্ঠা অম্বালিকা বলছেন, ‘কিন্তু বিচিত্রবীর্য তো বালক মাত্র! আর আমরা পূর্ণযুবতি!’
‘বিচিত্রবীর্য অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও আমি নিরুপায়।’ অধীর উদবেগে অধর দংশন করলেন সত্যবতী, ‘তার আয়ুরেখা দীর্ঘ নয়! কিশোরী বধূ এনে উত্তরাধিকারীর জন্য অপেক্ষা করার সময় তাই আমাদের নেই। তোমাদের কাছে আমি উত্তরাধিকারী ভিক্ষা চাইছি!’
তিন কন্যা একে অন্যের দিকে তাকান অসহায় দৃষ্টিতে। বলপূর্বক হরণ করে আনা হলেও এতক্ষণ তাঁদের উত্তেজিত করে রেখেছিল অন্য এক সম্ভাবনা। তবে কি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বীর, চিরকুমার ভীষ্মকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার গৌরব তাঁদেরই হতে চলেছে? সেই উদ্দীপনা ধূলিসাৎ হওয়ামাত্র তাঁরা আরও ভেঙে পড়েছেন।
শিখণ্ডী’র মনে হল, অসহনীয় যন্ত্রণায় তাঁর মস্তক যেন বিস্ফোরিত হবে এবার। তারই মধ্যে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, দুই বোন প্রতিবাদে সরব হলেও জ্যেষ্ঠা অম্বা কেন নির্বাক শ্রোতা? তাঁর বয়স তো ভাবী স্বামী বিচিত্রবীর্যের প্রায় দ্বিগুণ!
অতিকষ্টে শিখণ্ডী দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন অম্বার প্রতি। তৎক্ষণাৎ তাঁর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।
এ কী!
কাশীর রাজকন্যা অম্বার সঙ্গে তাঁর নিজের মুখের এমন অবিশ্বাস্য সাদৃশ্য কীভাবে সম্ভব? এই চিবুক, এই চোখ, এমনকি ওষ্ঠের বামপ্রান্তে ক্ষুদ্র তিলটি তো তাঁরই! এতটা সাদৃশ্য কাকতালীয় হওয়া অসম্ভব।
তা ছাড়া, এত কোলাহলের মাঝেও সেই সুন্দরী অম্বা কেন নিশ্চল, প্রস্তরবৎ? তাঁর কি এই বিবাহে কোনো আপত্তিই নেই?
‘তোমার কোনো বক্তব্য আছে, অম্বা?’ সত্যবতী নিজে থেকেই বললেন, ‘নির্দ্বিধায় বলতে পার। আজ থেকে আমি তোমাদের মাতা।’
অম্বা সজলনয়নে তাকালেন ভাবী শ্মশ্রুমাতার দিকে। রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমায়… আমায় মুক্তি দিন মাতা!’
‘কেন?’ সচকিত ভঙ্গিতে বললেন সত্যবতী।
‘আমি যে মনে মনে সৌভপুরীর রাজা মহাবীর শাল্বকে পতিরূপে বরণ করেছি!’ নতমস্তকে বললেন অম্বা, ‘স্বয়ংবর হলেও আমার এই সিদ্ধান্ত ছিল পূর্বস্থিরীকৃত। তিনি আজ ভীষ্মকে প্রতিহত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। আজ আমি তাঁর কণ্ঠেই বরমাল্য দিতাম! দয়া করে মুক্তি দিন আমায়। কুমারী হলেও মনে-প্রাণে আমি বিবাহিত!’
শিখণ্ডীর চোখের সামনে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হল উল্কার বেগে। তিনি দেখলেন, অম্বার অনুরোধে সত্যবতী তাঁকে মুক্তি দিলেন। অম্বা যাত্রা করলেন তাঁর প্রেমিক শাল্ব’র রাজ্যাভিমুখে।
কিন্তু বলপূর্বক যে কন্যাকে প্রকাশ্য সভা থেকে হরণ করেছেন ভীষ্ম, তাঁকে কীভাবে স্ত্রীর মর্যাদা দেবেন সৌভরাজ শাল্ব? একসময় যে কন্যাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর পুষ্প-রথকে শুষ্কমুখে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলেন শাল্ব।
কাতরকণ্ঠে শাল্ব বললেন, ‘ক্ষমা করো আমায়, অম্বা। তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসব। কিন্তু রাজধর্ম সর্বাগ্রে। এত কিছুর পর একজন অপহৃতা নারী রাজমহিষী হলে প্রজারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। ক্ষমা করো আমায়!’
অপমানিতা, রিক্তা অম্বা প্রত্যাবর্তন করলেন হস্তিনাপুরে। নিরুপায় হয়ে তিনি প্রস্তুত হলেন বিচিত্রবীর্যকে বরমাল্য পরানোর জন্য। কিন্তু অপমানের কশাঘাত অম্বাকে দগ্ধ করল পুনরায়।
‘যে নারী অন্য পুরুষের প্রতি অনুরক্ত, তাঁকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করব কীভাবে? অন্যপূর্বা নারী যে অগম্যা!’ অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করলেন বিচিত্রবীর্য।
‘তবে আমি কী করব?’ আর্তনাদ করে উঠলেন অম্বা, ‘আমি তো স্বেচ্ছায় আসিনি এখানে! আমাকে বলপূর্বক, ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে আসা হয়েছে!’
অম্বার কাতর প্রশ্নের উত্তর দিলেন না কেউ। এই নীরবতা অম্বা’র অপমানকে যেন তীব্রতর করে তুলল। ক্রুদ্ধ অম্বা ছুটে গেলেন ভীষ্মের কাছে। অগ্নিদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার জন্যই আমার এই অবস্থা! আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি! তবে কেন আপনি এইভাবে আমার জীবন থেকে সমস্ত সুখশান্তি হরণ করলেন?’
নতমস্তকে স্তব্ধবাক হয়ে রইলেন ভীষ্ম। সত্যিই তো, তাঁর জন্যই অম্বার এই পরিণতি!
অম্বার অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী অপমানে রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। তবু ভীষ্মকে তিনি ক্ষণিকের জন্য ভালো করে দেখলেন।
এই সেই মহাবীর দেবব্রত, যিনি শুধুমাত্র বৃদ্ধ পিতার কাম নিবৃত্তির জন্য হেলায় ছেড়ে দিয়েছিলেন এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার। ত্যাগ করেছিলেন দাম্পত্যসুখ! নিয়েছিলেন চিরকুমার থাকার ব্রত। আজও পুরুষকার যেন উদ্ধত অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তাঁর দীর্ঘ পেশিবহুল দেহের প্রতিটি রেখায়।
অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে বললেন অম্বা, ‘আপনি আমায় স্পর্শ করেছেন বলে সৌভরাজ আমায় প্রত্যাখ্যান করলেন। আপনার জন্য আমি স্বামী-সংসার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এর প্রতিকার আপনাকেই করতে হবে।’
‘আজ্ঞা করুন, দেবী।’ করজোড়ে বললেন ভীষ্ম, ‘আপনি যা শাস্তি দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব।’
‘উপায় এখন একটাই। আপনিই আমায় বিবাহ করুন!’ অম্বা’র চোখের গভীরে পুনরায় প্রজ্জ্বলিত হল অগ্নি।
‘অসম্ভব!’ চমকিত হলেন ভীষ্ম, ‘আমি যে চিরকৌমার্যের ব্রত নিয়েছি। এই ব্রত থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে ধর্মের পথ ত্যাগ করা।’
‘আর আপনি যে একজন নারীর ভবিষ্যৎ নষ্ট করলেন?’ অম্বা শানিতকণ্ঠে বললেন, ‘তার স্বপ্নকে চুরমার করে দিলে তা বুঝি আপনার ধর্মবিচ্যুতি নয়? নারীর ভবিষ্যৎরক্ষা বুঝি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়?’
মৌন রইলেন ভীষ্ম। কিছুক্ষণ পর থেমে থেমে বললেন, ‘আপনি চাইলে এই রাজপ্রাসাদেই থাকতে পারেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনার কোনো অমর্যাদা হবে না।’
‘কী!’ আহত বাঘিনির মতো গর্জে উঠলেন অম্বা, ‘আপনার দুঃসাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হচ্ছি গাঙ্গেয়! কাশীর রাজকন্যাকে আপনি আশ্রিতা করার দুঃসাহস দেখান?’
‘না আমি তা বলতে চাইনি অম্বা!’ ভীষ্ম কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘আপনি ভুল করছেন …!’
ভীষ্মের দিকে তর্জনী তুলে অম্বা কম্পিতকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার এত দম্ভ দেবব্রত? এত অহমিকা? আমি … আমি আজ এই হস্তিনাপুরের রাজসভায় শপথ করে বলছি, এই অপমানের প্রতিশোধ আমি নেব। নেব নির্মমতম প্রতিশোধ!’
শিখণ্ডী যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন গভীর রাতের অলিন্দে। তাঁর জিহ্বা শুষ্ক, চক্ষু রক্তবর্ণ, সর্বাঙ্গ যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তবু তাঁকে দেখে যেতে হয় সেই রুদ্ধশ্বাস নাটিকার একের পর এক অঙ্ক।
‘আহ! আহ!’ কাতর বেদনাবাক্য নিঃসৃত হতে থাকে তাঁর মুখ থেকে। মনে হয় এখনই জ্ঞান হারাবেন তিনি।
তবু তাঁকে দেখতে হয়। দেখে যেতে হয় সেই রুদ্ধশ্বাস নাটিকার একের পর এক অঙ্ক।
আহত অম্বা সুবিচারের আশায় ছুটে গেলেন পরশুরামের কাছে। সাশ্রুনয়নে বললেন, ‘প্রভু! আপনি ভগবান বিষু�র ষষ্ঠ অবতার। মর্ত্যে আপনার সমতুল যোদ্ধা বিরল। আমি সহায়সম্বলহীনা এক নারী। আমায় সাহায্য করুন প্রভু!’
পরশুরাম সব শুনে বিচলিত হয়ে বললেন, ‘ভীষ্ম আমার প্রিয় শিষ্যদের মধ্যে একজন। আমি তাকে অনুরোধ করব আপনাকে বিবাহ করতে। আপনি শান্ত হোন, মাতঃ।’
কিন্তু ভীষ্ম নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল রইলেন। গুরুকে প্রণাম করে তিনি বললেন, ‘আপনার জন্য আমি জীবনদান করতে সম্মত আছি গুরুদেব। কিন্তু অনুগ্রহ করে আমায় আমার ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে বলবেন না। কোনোমতেই আমি আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করতে পারি না।’
‘তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে বদ্ধপরিকর এতে আমি প্রীত হলাম, ভীষ্ম।’ পরশুরাম বলছেন, ‘কিন্তু আমিও রাজকুমারী অম্বাকে কথা দিয়েছি। আমাকেও সেই ধর্মরক্ষা করতে হবে। তাই, আমি তোমাকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে আহ্বান করছি।’
পরবর্তীকালে যে কুরুক্ষেত্র রক্তরঞ্জিত হয়ে উঠবে কৌরব ও পাণ্ডবদের সমরে, চলবে অষ্টাদশ দিবসের নিরন্তর সংগ্রাম, সেখানে তার কয়েক দশক পূর্বে এসে দাঁড়ালেন ভীষ্ম ও পরশুরাম। নিজের ধর্মরক্ষার্থে লড়তে হচ্ছে গুরুর বিরুদ্ধে, এই অপরাধে প্রথমেই ভীষ্ম পরশুরামের চরণধূলি নিলেন। আশীর্বাদ করলেন পরশুরাম।
এর পর শুরু হল ভীষ্ম বনাম পরশুরামের যুদ্ধ।
দীর্ঘ চব্বিশ দিন ধরে চলল গুরুশিষ্যের এই লড়াই। কেউই পরাজয় স্বীকার করলেন না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শ্রেষ্ঠ অস্ত্রের ব্যবহার করেও অপরপক্ষকে পরাজিত করতে পারলেন না। এমন যুদ্ধ ভূ-ভারতে কেউ দেখেনি!
অবশেষে রণে অব্যাহতি দিলেন পরশুরামই। করজোড়ে তিনি অম্বাকে বললেন, ‘আমায় ক্ষমা করুন মাতঃ। ভীষ্মের প্রকৃত শক্তি তাঁর প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞার জন্যই মৃত্যুও তাঁর ইচ্ছাধীন। কোনোভাবেই আমি তাকে পরাস্ত করতে পারলাম না।’
শিখণ্ডী বিস্ফারিত চোখে দেখছেন, এর পরেও অম্বা আশা ছাড়ছেন না। তিনি যাচ্ছেন দেবসেনাপতি কার্তিকের কাছে। অম্বার কাতর অনুরোধে কার্তিক তাঁকে দিচ্ছেন একটি নীলপদ্মের মাল্য। অম্বা যার কণ্ঠে সেই পদ্মমাল্য দেবেন, তিনিই সমর্থ হবেন ভীষ্মকে হত্যা করতে।
কিন্তু কী আশ্চর্যের বিষয়! কোনো নৃপতিই যে সেই মাল্য গ্রহণ করতে সম্মত হচ্ছেন না। বিরাট থেকে চেদী, মৎস্য থেকে অঙ্গ, প্রাগজ্যোতিষদেশ থেকে মদ্র— সমস্ত দেশের রাজা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করছেন অম্বাকে। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞার বলে লাভ করেছেন ইচ্ছামৃত্যু। কারও দুঃসাহস হল না সেই ক্ষমতাকে তুচ্ছ করার।
অবশেষে ক্লান্ত, ভগ্নহৃদয় অম্বা এসে পৌঁছোলেন পাঞ্চালরাজ্যের রাজধানী কম্পিল্যনগরীতে।
শিখণ্ডী দেখছেন, যেখানে তিনি এখন শুয়ে রয়েছেন, ঠিক সেখানে দাঁড়িয়েই অম্বা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের থেকে। দ্রুপদ বলছেন, ‘হস্তিনাপুর আমার শত্রু ঠিকই, কিন্তু ভীষ্ম অপরাজেয়। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাসনা আমার নেই, মাতঃ।’
ক্ষোভে-দুঃখে একাকিনী অম্বা প্রস্থানের আগে দক্ষিণ অলিন্দের এই পঞ্চম থামে রেখে দিচ্ছেন পদ্মমাল্যটি।
তারপর গহন অরণ্যে প্রবেশ করে দীর্ঘ তপস্যায় রত হলেন অম্বা। যমুনার তীরে অরণ্য মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলল তাঁর কৃচ্ছ্রসাধনা। পরিবর্তিত হচ্ছে ঋতু, অবিচ্ছেদ্য অবিচল থাকছে তাঁর সাধনা।
অবশেষে তুষ্ট হলেন মহাদেব। তিনি বললেন, ‘কন্যা, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কারণে প্রত্যক্ষভাবে তাঁকে বধ করা অসম্ভব। তবে আমি তোমায় বরদান করছি, এই জন্মে না হোক, আগামী জন্মে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবে তুমি!’
অশ্রুসজল চোখে অম্বা করজোড়ে বললেন, ‘কীভাবে প্রভু?’
উত্তর পাওয়া যায় না। অম্বা ভাবেন, এই জন্মে যখন তাঁর অভীষ্টপূরণ হচ্ছেই না, তখন আর এই জীবনের তাৎপর্য কী? অবমানিতা নারী প্রজ্জ্বলিত করেন অগ্নিকুণ্ড। জীবন্ত অম্বা ঝাঁপ দেন অগ্নিতে।
দ্রুত সেই অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান শিখায় ভস্মে পরিণত হতে থাকে অম্বার অনিন্দ্যসুন্দর দেহ।
আগুন জ্বলতে থাকে অনেকক্ষণ। অম্বার শেষ দীর্ঘশ্বাস বহনকারী সেই ধূম ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা অরণ্যে। পৌঁছোয় অরণ্যের অন্তিম প্রান্তেও, যেখানে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সুসন্তানলাভের জন্য মহাদেবের তপস্যায় মগ্ন এক রাজা।
শিখণ্ডীর এবার আর চিনতে অসুবিধা হল না নিজের জন্মদাতাকে।
আর সেই মুহূর্তেই তাঁর চেতনা ফিরে এল।
চোখ মেলে তিনি দেখলেন, নবপ্রভাতের রবিকিরণ রাজসভার অলিন্দকে স্বর্ণিময় করে তুলেছে। সূর্যোদয় হয়েছে একটু আগেই।
পূর্বরাতের স্মৃতিরা ফিরে আসে শিখণ্ডী’র মনে। রাজকুমারী অম্বার দুঃখ, বেদনা, আর্তি— সব যেন এক জন্ম পরে, জন্মান্তরের বেদনা বহন করে, বেদনার বিষে অশ্রু হয়ে নির্গত হতে থাকে শিখণ্ডীর চোখ দিয়ে।
তিনিই তবে পূর্বজন্মে রাজকুমারী অম্বা ছিলেন! তাই কি ভীষ্মের প্রতি তাঁর এমন জন্মগত অবোধ্য ক্রোধ, যার স্বরূপ আজ সহসা প্রকাশিত হল?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন