শিখণ্ডী – ২০

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

‘আপনার কথা মেনে চলার চেষ্টা করি, ঋষিবর।’ সখেদে কুম্ভকের উদ্দেশে বললেন শিখীধ্বজ, ‘কুটিরের সামনের এই তৃণাচ্ছাদিত ভূখণ্ডেই অতিবাহিত হয় আমার দিবাকাল। ধ্যান করি, কিন্তু মনোনিবেশ করতে পারি না। বাহ্যিকভাবে ধ্যানমগ্ন হলেও আমার মন ছুটে বেড়ায় পতঙ্গের প্রায়। আমি সর্বত্যাগী নই, বরং আজও মনে-মনে গৃহী বলেই কি ঈশ্বরলাভের পথ আমার কাছে রুদ্ধ হয়ে থাকছে?’

‘গৃহীরা পাপী, গৃহীর দ্বারা উপাসনা সম্ভব নয় এই ভ্রান্ত ধারণা আপনার কেন হল, রাজন?’ কুম্ভক মস্তক আন্দোলিত করে বললেন, ‘কেই বা আপনাকে বলেছে যে গৃহী হলে ধ্যানে মোক্ষলাভ করা সম্ভব নয়? সফল ধ্যানের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মনের ভারসাম্য বজায় রাখা। তাতে সফল হলে বাকি পথটুকু কিন্তু বড়োই সহজ। চঞ্চল মন তার পরেই হয়ে ওঠে শান্ত, অথচ সপ্রাণ।’

‘কীভাবে সেই ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব, তপস্বী?’ ব্যগ্রকণ্ঠে জানতে চাইলেন শিখীধ্বজ।

‘তার জন্য সর্বাগ্রে জানতে হয়, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী।’ কুম্ভক মৃদুলয়ে বলে চললেন, ‘ভাবতে হয়, কী আমার পরিচয়? কে আমি? আপনাকে যদি প্রশ্ন করি, কে আপনি, কী উত্তর দেবেন, রাজন?’

‘আমি … আমি পাঞ্চাল রাজ্যের অন্তর্গত দক্ষিণ প্রদেশের অধিপতি।’ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন শিখীধ্বজ, ‘কিন্তু এখন রাজ্য পরিত্যাগ করে আমি অরণ্যচারী হয়েছি ঈশ্বরসাধনায়। এখন আমার একমাত্র পরিচয় আমি একজন সাধক।’

‘রাজা বা সাধক, দুই-ই আপনার বাহ্যিক পরিচয়, রাজন।’ স্মিতমুখে বললেন কুম্ভক, ‘বিস্মৃত হলে চলবে না, এগুলো বহির্জগতের পরিচয়মাত্র। দুটি স্তরে আমরা বাস করি একটি বাহ্যিক স্বভাব বা পরিচিতিকে চিহ্নিত করে, অন্যটি চেনায় অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিকে। যারা তাঁদের অভ্যন্তরীণ সত্তা সম্পর্কে অচেতন, তাঁরা এই বাহ্যিক পরিচিতিকে বড়ো বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমি কে, কী অবস্থায় রয়েছি, কী করছি সেগুলোই হয়ে ওঠে তাঁদের প্রধান চিন্তা। আপাতভাবে আত্মবিশ্বাসী দেখালেও প্রকৃত অর্থে তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, তাঁরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বাহ্যিক প্রকৃতি থেকে কীভাবে সর্বোত্তমটুকু নেওয়া যায়, সেই ভাবনাতেই তাঁরা বিভোর হয়ে থাকেন। কিন্তু, সাধনায় উত্তরণের পথ খুঁজতে হলে বাহ্যিক বাস্তব এবং অভ্যন্তরস্থ বাস্তব এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন আছে। এই কৌশলটিরই নাম ধ্যান। আবারও বলছি, যাঁরা বাহ্যিক অস্তিত্ব সম্পর্কে যত বেশি সচেতন, তাঁরা তত বেশি অভ্যন্তরস্থ অস্তিত্বটির থেকে দূরে চলে যান। তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।’

‘অর্থাৎ আপনি বলছেন, আমি যে নৃপতি ছিলাম, সেই সত্যটিকে পুরোপুরি ভুলে যেতে হবে?’ শিখীধ্বজের মুখমণ্ডলে বিস্ময় প্রকট হল।

কুম্ভক বললেন, ‘ভুলে যাওয়া নয়, রাজন। আপনাকে আয়ত্ত করতে হবে মানসিক চাঞ্চল্যহীন নির্লিপ্তি। যে-কোনো পরিস্থিতিতে থাকতে হবে অবিচল, অপরিবর্তিত। মানসিক দ্বিধা ও দ্বন্দ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায় ধ্যান। ক্রমে অন্তরের ও বাহিরের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তখনই আমরা শিখি কীভাবে বাহ্যিক জগতের আঘাত-সংঘাতের সামনে পড়লে পালিয়ে না গিয়ে তাদের সম্মুখীন হওয়া যায়। সেই সমরের জন্য আত্মশক্তিকে জাগ্রত করে তোলাই হল ধ্যানের লক্ষ্য। এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। পুরোটাই নিজের ভেতরের শক্তি।’

‘কিন্তু এর ফলে শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও আমাকে ভুলে যেতে হবে নিজের বাহ্যিক পরিচয়।’ চিন্তাকুল হলেন শিখীধ্বজ, ‘এটিই তো নির্লিপ্তি, তাই না? এটিই আমাকে অভ্যাস করতে হবে?’

‘হ্যাঁ, নির্লিপ্তি অভ্যাস করতে হবে, কিন্তু তারও স্তর আছে।’ কুম্ভক হাসলেন, ‘কোনো সুন্দরী যৌবনবতী রমণী আপনার সঙ্গ কামনা করলে যদি আপনি শুধু নির্লিপ্তির কারণে তাঁর আহ্বানে সাড়া না দেন, তবে তা নির্লিপ্তি নয়। ঔদাসীন্য বা নির্লিপ্তি তখনই সম্ভব যখন আপনি তাঁর কামনা ও বাসনাকে চরিতার্থ করবেন, কিন্তু তার ভিত্তিতে তাঁর ওপর কোনো অধিকার প্রয়োগ করবেন না। সাধনার প্রাথমিক শর্ত হল অপরিগ্রহ থাকা।’

এবার শিখীধ্বজ চমকে উঠলেন। ঈষৎ স্খলিতকণ্ঠে বললেন, ‘আপনি … আপনি জানলেন কী করে?’

কুম্ভক বললেন, ‘আমি জানি প্রতি রাত্রে আপনার কুটিরে আসেন এক সুন্দরী যুবতি। তিনি আকুল হয়ে আপনার কাছে সঙ্গ প্রার্থনা করেন। কিন্তু আপনি প্রতিরাত্রেই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন।’

‘আপনি ঠিকই বলছেন, কুম্ভক।’ শিখীধ্বজ বিব্রত কণ্ঠে বললেন, ‘তাঁর নাম মদানিকা। সাধনোচিত ব্রহ্মচর্যের অভ্যাস করার প্রয়াসে আমি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করি।’

কুম্ভক মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালেন, ‘এই সংযম কিন্তু আপনার সাধনা নয়, রাজন। এক সৈনিক দিবাকালে রণ ও রক্তের মধ্যে সফলতা সন্ধান করলেও নিশাকালে স্ত্রী ও পরিজনের সান্নিধ্যে সুখী হয়। সেটিই তার ধর্ম, সেটিই তার সাধনা। আপনি দিবালোকে যথাসম্ভব নির্লিপ্তির সঙ্গে আত্মানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবেন, কিন্তু রাত্রিকালে আপনি একজন গৃহী। জীবনে এই ভারসাম্য আনতে না পারলে আপনি মুক্তির পথ খুঁজে পাবেন না।’

শিখীধ্বজ অনেকক্ষণ নির্বাক রইলেন। তাঁর মনে অনেকরকম আবেগ একসঙ্গে কাজ করছিল, ‘কিন্তু কুম্ভক! আমি কী করে বুঝব যে গৃহী থেকেও আমি সফল সাধক হতে পেরেছি?’

কুম্ভক প্রস্থানোদ্যত হলেন। বললেন, ‘সময় আসুক। আমি বুঝিয়ে দেব। আজ রাত থেকে মদানিকাকে আপনি ফেরাবেন না। নিজেকেই নিজে পরীক্ষা করুন। দেখুন, কতটা নির্লিপ্তি অর্জন করতে পারছেন। দেখুন, রাত্রে গৃহী হয়েও দিনে সাধনায় কোনো বিঘ্ন ঘটছে কিনা!’

২১

একটা বিশাল বড়ো হলঘর। তাতে অন্তত ত্রিশখানা বেড, যার নব্বই শতাংশই ভরতি। প্রতিটি বেডের সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে রয়েছে রোগীর বাড়ির লোক।

মাঝে মাঝে রাউন্ড দিয়ে যাচ্ছে দু-একজন নার্স। ওপরে অনেকগুলো ফ্যান চলছে ঘটাং-ঘটাং শব্দ করে। চারপাশে ওষুধের গন্ধ।

নীচু গলায় হলেও প্রচুর মানুষের কথোপকথনে গোটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে একটা তীব্র গুঞ্জন।

হাসপাতালে এমারজেন্সিতে আনার জন্যই বোধহয় মিতুর লিঙ্গ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। তাকে ফিমেল ওয়ার্ডেই দেওয়া হয়েছে। রমেন্দ্র’র পেছনে হেঁটে সাহানা ঘরের মধ্যে একটু এগিয়ে আসতেই দেখল, জানালার পাশের একটা বেডে শুয়ে আছে মিতু। তাকিয়ে রয়েছে জানালার ওপাশে, হাসপাতালের পাঁচিল ছাড়িয়ে আকাশের দিকে।

সাহানা মিতু’র পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু মিতু কিছু টের পেল বলে মনে হল না।

আকাশের দিকে তাকিয়ে সে কি কোনো জটিল প্রশ্নের সমাধান খুঁজছিল? সাহানা’র চোখে পড়ল, মিতুর হাতের ক্ষতস্থানের ওপর পুরু ব্যান্ডেজ, অন্য হাতে স্যালাইনের চ্যানেল।

বেডের পাশেই রাখা হ্যাঙারে উলটো করে ঝোলানো স্যালাইনের বোতল থেকে মিতুর শরীরে নুন-জল ঢুকছে ফোঁটা ফোঁটা।

‘মিস দাস, আজ কেমন আছেন?’ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা জোরে বললেন রমেন্দ্র।

মিতু এদিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘একটু ভালো।’

সাহানা একটা বড়ো নিশ্বাস নিল। তারপর নীচু গলায় বলল, ‘মিতু?’

মিতু চমকে তাকাল। ওর চোখের কোলদুটো বসে গিয়েছে। গালও চুপসে গিয়েছে এই দু-দিনেই। তা সত্ত্বেও মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে তুলল ও। বলল, ‘তুই এলি তাহলে!’

‘হ্যাঁ এলাম। কে তোকে মারার চেষ্টা করেছিল, মিতু?’ সোজাসুজি আসল প্রশ্নে এল সাহানা।

চমকে উঠল মিতু। ঠোঁটদুটো ঈষৎ থরথর করে কেঁপে উঠল। সাহানার দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর আবার সাহানার দিকে তাকিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে ফিশফিশ করে বলল, ‘কাল অপারেশন আছে, সাহানা। ভাস্কুলার সার্জারি। ডাক্তার বলেছেন, কিছু নার্ভ সারাজীবনের জন্য অকেজো হয়ে যেতে পারে।’

সাহানার কানে কথাগুলো যেন ঢুকছিলই না। শান্ত, স্থির গলায় ও বলল, ‘বললি না তো, কে তোকে মারার চেষ্টা করেছিল! তাকে দেখিসনি তুই?’

এমন আচরণে একটু থমকে গেল মিতু। অস্ফুটে বলল, ‘সন্টু।’

‘ও কেন মারতে গেছিল তোকে?’ সাহানা ভ্রূ কুঁচকে বলল।

‘সন্টু সেদিন টাকা চাইতে এসেছিল।’ মিতুর চোখের কোণদুটো চিকচিক করে উঠল, ‘আমি দেব না বলায় দারুণ রেগে গেছিল। তখন আমিও আর থাকতে পারিনি। বলেছিলাম, ওর ওই ব্যাবসার কথা আমি সবাইকে বলে দেব! তারপরেই ওর মাথায় খুন চেপে গেছিল। প্রথমে আমাকে ধাক্কা মেরে একপাশে ফেলে কেরোসিন তেল ঢালতে গেছিল। চশমা খুলে গেছিল, তাও বাধা দিচ্ছিলাম। তখন আবার আমার মাথার পেছনে মারল কী যেন একটা তুলে। তারপর ব্লেড বা ছুরি টাইপের কিছু একটা বের করে আমার হাতে চালিয়ে দিল! ও চাইছিল, আমার মৃত্যুটা যেন আত্মহত্যা বলেই মনে হয়।’

‘তোর নার্সিং হোমের চাকরিটা যে চলে গিয়েছে, বলিসনি কেন?’ শক্ত গলায় জানতে চাইল সাহানা।

উত্তর না দিয়ে কান্নাভরা চোখটা অন্যদিকে ঘোরাল মিতু।

সাহানা আড়চোখে রমেন্দ্র’র দিকে তাকিয়ে ফিশফিশ করল, ‘মিতু, সন্টুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করলে ও কিন্তু সব কিছু পুলিশকে বলে দেবে।’

‘দিলে দিক।’ দাঁতে দাঁত চাপল মিতু, ‘আমি আর প্রতিমাসে এই অত্যাচার সইতে পারছি না!’

‘হুঁ।’ সাহানা উঠে দাঁড়াল, ‘আমি আসি। সাবধানে থাকিস। বেশি চিন্তা করিস না।’

রমেন্দ্রবাবু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন বাইরে যাওয়ার গেটের দিকে। কিছুটা গিয়ে পিছু ফিরে সাহানাকেও ইশারা করলেন বেরিয়ে আসার জন্য।

সাহানা যেতে উদ্যত হতেই মিতু কিছু না বলে সাহানার হাতদুটো জড়িয়ে ধরল।

সাহানা চাপা স্বরে বলল, ‘আমায় কী করতে হবে?’

‘বাথরুমের ঘোরানো সিঁড়ির সেই খাঁজটা মনে আছে তোর?’ ছলছলে চোখে তাকাল মিতু।  

২২

শিখণ্ডী নিজের পর্ণকুটিরে শুয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর চোখে ঘুম আসছিল না।

গত তিনদিন ধরে তাঁর শরীর ভারি অদ্ভুত কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে। যক্ষ স্থূণকর্ণ তাঁকে একটি বিশেষ ওষধি দিয়েছেন। পরপর তিন রাত্রি নৈশাহারের পর নিদ্রার পূর্বে সেটি সেবন করতে হয়।

প্রথম রাত্রির পরেই শিখণ্ডী বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর অনেক ভরাট হয়ে গিয়েছে এক রাতেই। কোমল বাহুদ্বয় অনেক বেশি দৃঢ় হয়েছে।

দ্বিতীয় রাত থেকে শুরু হয়েছিল যৌনাঙ্গ পরিবর্তনের জটিল প্রক্রিয়া। স্বয়ং চূড়ালা এসেছিলেন অসংখ্য বিচিত্রদর্শন শস্ত্রাদি সঙ্গে নিয়ে, রাত্রির অন্ধকারে আপন পরিচয় গোপন করে।

অবগুণ্ঠিতা সেই মহাপণ্ডিতার আগমনের মধ্যেই যেন লেখা ছিল আত্মবিশ্বাস।

শিখণ্ডীর হস্ত স্পর্শ করে তিনি তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘ভয় নেই। এই অস্ত্রোপচার জটিল, কিন্তু আশু ফলপ্রদ। কষ্টসাধ্য, কিন্তু অব্যর্থ।’

এর পর জ্ঞানহীন শিখণ্ডীর দেহের অভ্যন্তরে চূড়ালা ঘটিয়েছেন নানা পরিবর্তন। অনধিকারীর কাছে তা কষ্টকল্পনা বলেই মনে হবে। কিন্তু কুম্ভক এই জটিল প্রক্রিয়ার রহস্য সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। তিনি শিখণ্ডীকে পূর্বেই আশ্বস্ত করেছিলেন, এই জটিল ও সময়সাপেক্ষ শল্যচিকিৎসায় চূড়ালার সহকারী হবেন নাকি তিনিই! যদিও চিকিৎসা চলাকালীন শিখণ্ডী ছিলেন অচেতন!

আজ অন্তিম রাত। আগামীকাল প্রত্যুষে শিখণ্ডীর যখন ঘুম ভাঙবে, তখন তিনি আর নারী থাকবেন না, পরিণত হবেন পরিপূর্ণ পুরুষে!

এই কথাটা যতবার কল্পনা করছেন, আনন্দে তাঁর চক্ষু সজল হয়ে উঠছে। আশৈশব যে অসীম মানসিক যন্ত্রণা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে, স্বজনদের দৃষ্টি-অনুসারে নিজেকে পুরুষরূপে দেখতে চেয়েও না দেখতে পারার যে অগ্নি তাঁকে তিলে-তিলে দগ্ধ করেছে, এতদিনে তার হাত থেকে মুক্তি পাবেন তিনি।

পৌরুষ লাভের পর তিনি প্রথমেই কী করবেন?

কথাটি মনে হওয়ামাত্র শিখণ্ডীর মনশ্চক্ষে ধরা দিল তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের প্রতিচ্ছবি। তাঁর শরীরে রক্ত সঞ্চালন দ্রুততর হল। অর্জুন তাঁর নারীত্বকে অপমান করেছিলেন সেই রাত্রে, শিখণ্ডীর অসহায়ত্বকে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন তিনি। পুরুষ হয়ে সেই প্রতিশোধ শিখণ্ডী নেবেন। অর্জুন যত বড়ো বীরই হোন না কেন, শারীরিক দৌর্বল্যর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে তিনি এবার সমরাঙ্গনে ধরাশায়ী করবেন অর্জুনকে।

পরাজিত অর্জুনের অভিব্যক্তি কল্পনা করেই তৃপ্তিতে শিখণ্ডী’র সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিকেলে কুম্ভকের বলা কথাগুলো তাঁর মনে পড়ল।

‘আগামীকাল প্রভাতে আপনার দৈহিক পরিবর্তন সম্পূর্ণ হবে, রাজকুমার।’ বলেছিলেন কুম্ভক, ‘পুরুষত্ব অর্জন করা মাত্র আপনি রওনা দেবেন রাজধানী কম্পিল্যের উদ্দেশে। দশার্ণরাজ-প্রেরিত বারাঙ্গনা কালই এসে উপস্থিত হবেন রাজপ্রাসাদে। কিন্তু মনে রাখবেন, যক্ষ স্থূণকর্ণের ওষধির বলে প্রাপ্ত এই দৈহিক রূপান্তর সাময়িক। রানি চূড়ালা যা-ই দাবি করুন, তাঁর অস্ত্রোপচারের সুফল স্থায়ী কি না— তা এখনও প্রমাণিত নয়। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে মাত্র একটি রাত্রির জন্য আপনাকে শারীরিকভাবে পুরুষ করে তোলার জন্য। যদি চূড়ালার আবিষ্কার সঠিক না হয়, তবে আগামীকাল রাত্রিশেষে আপনি সম্ভবত আবার পরিণত হবেন নারীতে!’

‘কী!’

‘হ্যাঁ রাজকুমার। মিথ্যা স্তোকবাক্য আমি ঘৃণা করি। আপনি তেমনই মানসিক প্রস্তুতি নিন।’

‘এ কী বলছেন আপনি, ঋষি!’ নিষ্প্রভ মুখে বলেছিলেন শিখণ্ডী, ‘মাত্র একটি রাত্রির জন্য? এ যে আমার যন্ত্রণা হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি করবে। বারাঙ্গনার সেই রতিক্রিয়ার পরীক্ষায় হয়তো আমি কৃতকার্য হব। কিন্তু তারপর যখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী প্রত্যাবর্তন করবেন রাজ্যে? তখন কী হবে? সেই একই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমাকে! আবার!’

‘উত্তেজনার বশে আপনি ভুল পথে চালিত হচ্ছেন, শিখণ্ডী।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন কুম্ভক, ‘বিবাহ, পুরুষত্ব, মন, এগুলো সব গৌণ। আপনি ক্ষত্রিয়, আপনার কাছে রাজধর্ম পালন সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তার তুলনায় ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তা শুধু ক্ষুদ্রমনের পরিচায়কই নয়, দৌর্বল্যও বটে। আপনার দাম্পত্য সম্পর্কের তুলনায় দশার্ণের আগ্রাসী আক্রমণ থেকে পাঞ্চালকে রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ-কথা আপনার অজানা নয়। নিজেকে সংযত ও সংহত করুন। শুধুমাত্র পাঞ্চালকে রক্ষাই হোক এখন আপনার পাখির চোখ!’

সেই কথোপকথন স্মরণ করামাত্র যাবতীয় উত্তেজনা ও উল্লাস স্তিমিত হয়ে এল শিখণ্ডীর। তাঁর মনে হল, এই অষ্টপ্রহরের পুরুষত্ব নিয়ে কী করতে পারবেন তিনি?

অর্জুনকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করা? দশার্ণ-র রাজকন্যার বিদ্রুপবিকৃত মুখ চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দেওয়া? এ-সব কিছুই করা হবে না তাঁর!

রাজধর্ম পালনের জন্য কুম্ভকের এই প্রস্তাব গ্রহণ করা কি তাঁর পক্ষে আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে? নিজেকে ক্লীব ভেবেই বাঁচার চেষ্টা করছিলেন তিনি। একরাত্রির জন্য পাওয়া এই পৌরুষ যে কণ্টকাকীর্ণ পুষ্পের মতো তাঁকে বিদ্ধ করবে সারাজীবন!

আশ্চর্য চরিত্র এই কুম্ভক! দিনের পর দিন ইনি এই জনহীন প্রান্তরে তপস্যা করেন, ভাবতেই বড়ো বিস্ময় জাগে। নৈরাশ্যে তলিয়ে যেতে যেতেও ভাবছিলেন শিখণ্ডী।

এমন সুদর্শন, মহাজ্ঞানী, অথচ তরুণ তপস্বী এই অরণ্যের মাঝে ধ্যানস্থ থাকেন কীসের আশায়? একদিন কথায়-কথায় তাঁকে এই প্রশ্নটি করেই ফেলেছিলেন শিখণ্ডী। কুম্ভক একটি রহস্যময় উত্তর দিয়েছিলেন, যা তাঁকে আরও বিভ্রান্ত করেছিল।

‘সত্যযুগে শ্রীরামচন্দ্রের জন্য যেমন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সীতা, তেমনই রাজা শিখীধ্বজের জন্য আমার জন্ম পূর্বস্থিরীকৃত হয়ে ছিল, কুমার!’ সহাস্যে বলেছিলেন কুম্ভক, ‘কার্য সমাধা হলে জানকীর মতোই আমি পাতাল প্রবেশ করব। আর কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না।’

‘কোন কার্য? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না কুম্ভক!’

বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমিতে নেমে এলেও সেদিন বিমূঢ়ের মতো প্রশ্ন করেছিলেন শিখণ্ডী। সে প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি কুম্ভক। বরং স্মিত হাস্যে মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করে দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

নানা ঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত ভাবতে ভাবতে কখন যে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তা নিজেও বোঝেননি শিখণ্ডী। যখন তাঁর ঘুম ভাঙল, তখন সূর্যদেব পূর্বাকাশে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছেন। বিরাজ করছেন স্বমহিমায়।

দ্রুতপায়ে অনতিদূরের পুষ্করিণীর দিকে এগিয়ে গেলেন শিখণ্ডী। অনেকটা ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করলেন নিজেকে। হ্যাঁ, শারীরিকভাবে তিনি সত্যিই এখন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ পুরুষ! তাঁর বাহু পেশিবহুল ও বলিষ্ঠ হয়েছে, মসৃণ মুখে দেখা গিয়েছে শ্মশ্রুগুম্ফের কর্কশ সম্ভাবনা। হাতের শিরাগুলোর কাঠিন্য স্পষ্ট প্রতীয়মান, গোটা দেহে রোমাধিক্যও দৃশ্যমান।

মনে মনে ভিষগাচার্য স্থূণকর্ণ এবং বিদুষী চূড়ালাকে প্রণাম করলেন শিখণ্ডী। আর আনন্দে আলিঙ্গন করতে চাইলেন কুম্ভককে। তিনিই তো এইসব কিছুর কাণ্ডারি, শিখণ্ডীর পরম বন্ধু!

কিন্তু কুম্ভক নিজে না চাইলে তাঁর দেখা পাওয়া দুষ্কর। এও এক প্রহেলিকা!

মনে মনে বললেন শিখণ্ডী, ‘বন্ধু, চললাম! সারাজীবন কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধা থাকব তোমার কাছে! ভালো থেকো!’

আর কালক্ষেপ করলেন না শিখণ্ডী। যথাসাধ্য দ্রুতবেগে স্নানাদি সমাপ্ত করে রাজধানীতে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন তিনি। এতগুলো দিন এই কুটিরে তিনি একাকী বাস করেছেন। তবে সপ্তাহান্তে তাঁর নিজস্ব ভৃত্য সুবল এখানে আসত দ্রুপদের অজ্ঞাতে। পাঞ্চালরাজ ও রাজমহিষী’র মুখ চেয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের জন্য বারবার শিখণ্ডীকে অনুরোধ করত সুবল। তবে তার প্রধান কাজ ছিল কম্পিল্যের স্মৃতিবাহী শিখণ্ডী’র প্রিয় অশ্বের যথাযথ পরিচর্যা ও অভ্যাসের আয়োজন করা।

আজ সুবল এসেছে শিখণ্ডীর সেই প্রিয়তম বাহন নিয়ে। সামান্য কিছু ফলাহার সেরে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলেন শিখণ্ডী। কম্পিল্য অভিমুখে যাত্রা করলেন তিনি।

পেছনে পড়ে রইল অরণ্য! শেষ মুহূর্তেও কি দেখা হবে না কুম্ভকের সঙ্গে? শিখণ্ডীর মন ওই নিঃস্বার্থ বন্ধুর প্রতি ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে উঠছিল! কুম্ভক কি আসবেন না তাঁকে বিদায় সম্ভাষণে?

এতবছরের জীবনে এমন বন্ধু যে কখনও পাননি তিনি!

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন শিখণ্ডী। তারপর সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।

হ্যাঁ, তুচ্ছ অভিমান বা শোধ নয়, এই মুহূর্তে রাজধর্ম পালন করাই তাঁর একমাত্র কর্তব্য। সেটিই তাঁর অগ্নিপরীক্ষা!

২৩

সাহানা সশব্দে মিতুর খাতাটা বন্ধ করল। শেষ কবে এমন রোমহর্ষক কোনো কাহিনি ও পড়েছে, তা ওর মনে পড়ছিল না। নিজের পরিবারের ভেতরে-বাইরে, সমাজের সর্বত্র ক্রমাগত অপমানিত হতে হতে শিখণ্ডী শেষপর্যন্ত যক্ষ স্থূণকর্ণের ওষুধের সাহায্যে নিজেকে ‘পুরুষ’ করে তুললেন!

মিতু’র হাতে সেই বিবরণ যেন শব্দ আর অক্ষরের সীমা অতিক্রম করে তাকে নিয়ে গেছিল সুদূর অতীতের সেই অরণ্যে, যেখানে অন্তরে-বাহিরে দ্বন্দ্বে দীর্ণ হচ্ছিলেন শিখণ্ডী।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সাহানা। এতদিন একসঙ্গে থেকেও ও জানতে পারেনি, কী অনন্য লিখনশৈলী নিজের গভীরে ফল্গুর মতো করে বইয়ে চলেছে মিতু। কী সুনিপুণ বর্ণনা! পড়তে পড়তে যেন নিজেকেই মনে হয় মহাভারতকালের কোনো চরিত্র।

সাহানা জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। এতকাল এক ছাদের তলায় থেকেও ও টের পায়নি মিতুর এই প্রতিভার কথা। মনে হয়, অদৃশ্য হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করছে সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত, নাটকীয় টানাপোড়েন।

ওর মনে পড়ে গেল হাসপাতালে দেখে আসা শীর্ণ মিতুকে।

হাসপাতালে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বাথরুমের সিঁড়ির খাঁজের কথা শুনে সাহানা অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল মিতুর শেষ মুহূর্তে বলা কথাগুলোয়।

‘টাকাটা তুই খুব সাবধানে নিজের কাছে রাখিস সাহানা!’ ফোঁপাচ্ছিল মিতু।

সাহানা প্রথমে কিছুক্ষণ কথা খুঁজে পায়নি। তারপর বলেছিল, ‘এ … এত টাকা তুই পেলি কোথায়? কী করবি তুই এত টাকা দিয়ে?’

মিতু ওর শীর্ণ হাতদুটো বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেছিল সাহানাকে, ‘দরকার হবে। খুব দরকার লাগবে। পুলিশ বা অন্য কেউ খুঁজে পাওয়ার আগেই তুই তোর কাছে রেখে দিস, প্লিজ!’

সাহানা উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্নচোখে বলেছিল, ‘তোর তো নার্সিং-এর কাজটা চলে গিয়েছে, মিতু। মিতালি দাসের নামের মাধ্যমিক সার্টিফিকেটই যখন জাল, বি এস সি নার্সিং তুই করতে পারবি না। কী করবি তুই টাকাটা দিয়ে?’

মিতু কিছু বলেনি। চোখ বন্ধ করে নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়।

সাহানা আড়চোখে নিজের আদ্যিকালের পুরোনো ট্রাঙ্কটার দিকে তাকাল। চাবিটা ও রেখেছে নিজের বুকের খাঁজে। সেই ট্রাঙ্কের একেবারে নীচে রয়েছে মিতুর তিন লাখ টাকা।

কোথায় পেল মিতু এত টাকা?

আজ ঘরে সাহানা একাই রয়েছে। ঊর্ণা নেই, উইক এন্ডে মণিময় হাজরাকে সঙ্গ দিতে ডায়মন্ডহারবার গেছে। সাহানা জানে, ঊর্ণা সব দিক দিয়েই অসহায়। মাইনের ওই ক’টা টাকায় সংসার আর বিকলাঙ্গ ভাইয়ের চিকিৎসা সব চালানো যায় না। তা ছাড়া ওদের চাকরির মেয়াদ বাড়াতে গেলে স্কুলের সেক্রেটারি কাম বিধায়কের সুপারিশ বিরাট ভূমিকা নেয়। মণিময় হাজরা সব দিকেই ওকে বেঁধে রেখেছে।

মণিময়ের মেয়ের অন্নপ্রাশনে স্কুলের বাকিদের সঙ্গে ঊর্ণারও নিমন্ত্রণ ছিল। ঊর্ণা এসে ওকে ছবি দেখিয়েছিল, মণিময় হাজরার স্ত্রী বেশ সুন্দরী।

সাহানা’র মনে প্রশ্ন জেগেছিল, বাড়িতে সুস্থ-সবল স্ত্রী থাকতেও একজন পুরুষের এভাবে নারীসঙ্গ প্রয়োজন হয় কেন? এ কি শুধুই দেহজ আকর্ষণ?

সাহানা’র মনে পড়ল, এক সন্ধ্যায় মিতু এই প্রশ্নের একটা সহজ উত্তর দিয়েছিল।

‘এটা শুধু শরীরের খিদে মেটানো নয় রে।’ মুড়িমাখা হাতে নিয়ে বলেছিল মিতু, ‘সেজন্য কাউকে এভাবে বেঁধে রাখতে হয় না। এটা আসলে ক্ষমতার ব্যাপার। ‘আমি পারি!’ এই ভাবনা থেকেই কেউ বউকে পেটায়, কেউ আইন ভাঙে। আর যোগ্যতর স্ত্রী হলে তাকে অন্যভাবে আঘাত করে দমিয়ে রাখতে চায়। তুই খোঁজ নিয়ে দেখ, মণিময় নির্ঘাত নিজের বউয়ের ওপর কোনো গা-জোয়ারি করতে গিয়ে ঝাড় খেয়েছে। তাই ঊর্ণাকে ধরেছে।’

‘মানে তুই বলছিস, মণিময় হাজরা নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য…?’

‘সেটাই একমাত্র কারণ নয়। বেশিরভাগ ছেলেই আসলে চায় মুখের ভ্যারাইটি। তুই লক্ষ করে দেখবি। ওই যে একটা কথা আছে না, ‘খেঁদি পেঁচি নূরজাহান, আলো নিভলে সব সমান। কারওর বুদ্ধিদীপ্ত কথা শোনার প্রয়োজন হলে সে পুরোদস্তুর প্রেম করবে, শুধু শারীরিক সম্পর্ক মাখানো পরকীয়া নয়!’

হয়তো মিতু ঠিকই বলেছিল। তাহলে পরিপূর্ণ সুন্দরী হয়েও যখন মণিময় হাজরার স্ত্রী স্বামীকে পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়া থেকে আটকাতে পারলেন না, তবে সৌন্দর্য নিয়ে মানুষের এত অবসেশনই বা কেন?

‘এই যে এত ধর্ষণের খবর বেরোয়, পাঁচ-সাত বছরের মেয়ে দেখে কি কেউ উত্তেজিত হতে পারে? নাকি ষাট বছরের বৃদ্ধা কখনও ধর্ষিতা হতে পারে! অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণ আসলে ক্ষমতার আস্ফালন। ক্ষমতা দেখানোর একটা অস্ত্র!’

ক্ষমতা! হয়তো সেটাই আসল ব্যাপার। পুরুষ-নারী দুইয়ের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। সৌন্দর্যের ক্ষমতা দিয়ে কেউ অন্যকে বশ করে আর জননেতা কাজে লাগায় অন্য কোনো ক্ষমতা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সাহানা। ওদের ঘরের সামনাসামনি যে আড়াই ফুটের বারান্দা, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ফ্লাইওভার। ফ্লাইওভারের চারপাশটা ধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে এখন। সাইনবোর্ড ও লাইটপোস্টগুলোর ওপরে ঘোলাটে হয়ে আছে রাতের আকাশ।

সাহানা আনমনে ভাবছিল। দূরে দেখতে দেখতে ফিরে যাচ্ছিল ষোলো বছর আগের সেই দিনটায়। না, ঘটনাস্থলে ও নিজে উপস্থিত ছিল না। কিন্তু মিতুর মুখে বিভিন্ন সময়ে এতবার সেই ভয়ংকর ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ শুনেছে যে, নিজের অবচেতনে কখন যেন ও পুরো ব্যাপারটাকেই কল্পনার চোখে দেখতে শুরু করেছে।

চমক ভাঙল একটা ডাকে।

‘এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কী করছ, সাহানাদি? খাবে না?’

সাহানা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সিমি। সেদিনের পর থেকে সিমি বা পলির সঙ্গে বলতে গেলে দেখাই হয়নি ওর। গোটা হোস্টেলের তিনতলার ঘরগুলো জুড়ে থাকা সিমি, পলি, ঊর্ণা আর সাহানা বাস করেছে এক-একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।

আর এক অভিশপ্ত ভূখণ্ডের মতো একাকী হাসপাতালে পড়ে থেকেছে মিতু।

সাহানা বলল, ‘নাহ। আজ তেমন খিদে নেই। তুই খেয়েছিস?’

‘হ্যাঁ।’ ম্লানমুখে বলল সিমি, ‘মিতুদির অপারেশন কবে?’

‘বোধহয় পরশু।’ সাহানা আকাশের দিকে দেখতে দেখতে বলল, ‘এখন প্রেসারটা একটু কমতির দিকে, তাই ডাক্তাররা দুদিন সময় নিচ্ছেন। তুই কখন ফিরলি পার্লার থেকে?’

সিমির মুখটা কালো হয়ে গেল। নীচু গলায় বলল, ‘আজ বেরোইনি। কাজটা বোধহয় চলে গেল গো, সাহানাদি!’

‘কেন?’ সাহানা ভ্রূ কুঁচকাল, ‘কী হয়েছে?’

সিমি বলল, ‘মিতুদিকে যে-রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, তার পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হওয়ায় কাজে যাইনি। ভেবেছিলাম অনেকদিন ছুটি নিইনি, তাই একটা ছুটি নিই। সেদিন সন্ধেবেলাতেই পুলিশ এসেছিল পার্লারে, জানো! আমাদের চারজন মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমি সেদিন যাইনি।’

‘সে কী!’ সাহানা হতভম্ব হয়ে গেল। সিমি যে পার্লারে ম্যাসাজ করার কাজ করে, সেখানে যে অনেকরকম অবৈধ কাজ হয়, তা ও জানে। সিমিই বলছিল একদিন। সেদিন মিতুও ছিল।

সিমি কথায় কথায় বলেছিল, ‘আমাদের তো কোনো মাইনে সিস্টেম নেই পার্লারে। ম্যাসাজ পিছু টাকা। একটা দু-ঘণ্টার ম্যাসাজ করলে পাই একশো টাকা।’

‘অ্যাঁ!’ মিতু অবাক হয়েছিল শুনে সেদিন, ‘মাত্র! বডি ম্যাসাজ করতে তো দেড়-দু-হাজার টাকা লাগে জানি!’

‘সে তো পার্লার নেবে। দু-হাজার কেন, তেমন তেমন ম্যাসাজ পাঁচ হাজারেরও হয়। কিন্তু যত টাকারই হোক, আমরা পাই একশো টাকা।’

‘দু-ঘণ্টা ম্যাসাজে একশো টাকা? এতে তোদের পোষায় কী করে?’ সাহানা বলেছিল।

‘পোষায় না তো।’ একমুহূর্তের জন্য সেদিন সাহানার চোখে চোখ রেখে মুখ নামিয়ে নিয়েছিল সিমি, ‘বাধ্য হয়ে ম্যাসাজঘরের অন্ধকারে অন্য কাজ করতে হয়। কী করব। পেট তো চালাতে হবে! সেখানে যা বকশিশ পাই, পুরোটাই নিজের থাকে। পার্লারের মালিক সব জানে। কিন্তু কিছু বলে না। কারণ এই লোভেই ম্যাসাজের ভিড় হয় পার্লারে। পলিদি’দেরও তাই।’

‘সে কী রে!’ সাহানা অবাক হয়েছিল সেদিন।

সিমি কোনো কথা বলেনি, নিজের ওড়নার একপ্রান্ত পাকাচ্ছিল আঙুল দিয়ে।

সেই কথাগুলো মনে পড়তে সাহানা সিমির দিকে তাকাল, ‘কী করবি এখন? অন্য পার্লারে চেষ্টা করবি?’

‘সে তো করাই যায়। কিন্তু বিশ্বাস করো সাহানাদি, এইসব নোংরা কাজ আর ভালো লাগে না।’ সিমি বলল, ‘মাধ্যমিকের পর পাড়ার দিদির কথায় ম্যাসাজ ট্রেনিং নিয়েছিলাম, তখন যদি জানতাম আসল কাজের বদলে এখানে এইসব করে পয়সা উপায় করতে হয়, থোড়াই শিখতাম! এখন আমি আর পলিদি আলোচনা করি, যা হয়েছে হয়েছে, আর পাঁক ঘাঁটতে পারছি না। অন্য কিছু করব। কিন্তু কী করব? পেটে বিদ্যেও তো নেই তেমন!’

সাহানা চুপ করে রইল। সিমি দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও একটা আলগা চটক আছে। গায়ের রং ফর্সা। আর নাক-চোখ-মুখ যাই হোক, রং ফর্সা হলেই ভারতবর্ষের মতো দেশে মেয়েরা সুন্দরী তকমা পেয়ে যায়। সিমির চুলগুলো স্ট্রেইট করা, গাঢ় খয়েরি রঙে রাঙানো। পার্লারের মেয়েরা যেমন সেজেগুজে থাকে, সিমিও তেমনই। রোগাটে গড়ন। চোখে সবসময় কাজল। মুখে সস্তা মেক-আপ।

সিমির বাড়ি বারাসতের দিকে। ওর বাবা-মা কেউ নেই। মারা গেছে অনেক আগে। এক দাদা বিয়ে করে সংসার করছে। অবিবাহিতা বোন সেই সংসারে গলগ্রহ।

সাহানা বলল, ‘তাহলে? কী করবি?’

‘দেখি! তখন যদি ম্যাসাজ ট্রেনিং না নিয়ে বিউটিশিয়ান কোর্স করে রাখতাম, এই অসুবিধায় পড়তে হত না সাহানাদি।’ সিমি বলল, ‘যাই হোক। আমি কাল ভাবছি একবার মিতুদিকে দেখতে যাব। তুমি নিয়ে যাবে আমায়?’

২৪

শিখণ্ডী যে এক চান্দ্রমাস অরণ্যে দিনযাপন করেছিলেন, সেই ত্রিশটি দিনে কম্পিল্য কিন্তু নিস্তরঙ্গ ছিল না।

সদ্যপরিণীতা স্ত্রীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত শিখণ্ডী উত্তেজনার বশে রাজধানী ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন গভীর অরণ্যের দিকে। তবে তার পূর্বেই দ্রুপদ কিঞ্চিৎ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। মহাদেবের আশীর্বাদের অলৌকিকত্বে আর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেননি তিনি। বরং অনভিপ্রেত কিছু ঘটলে যাতে তিনি সে-বিষয়ে তৎক্ষণাৎ অবগত হতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রাসাদের এক বিশ্বস্ত রক্ষীর ওপর আদেশ ছিল মাঝেমধ্যে শিখণ্ডী’র ওপর নজর রাখার। সেই রক্ষী তাঁকে গোপনে অনুসরণ করেছিল, দেখে এসেছিল পর্ণকুটির।

শিখণ্ডী’র এই ‘বনবাসে’ রানি প্রশতী ভেঙে পড়লেও দ্রুপদ খুব বেশি বিচলিত হননি। শিখণ্ডী’র মনের অবস্থা তিনি অনুভব করতে পারছিলেন। এই অপমান সহন করার জন্য সবার কাছ থেকে দূরে গিয়ে নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়া যে নিতান্তই প্রয়োজন, তাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। শিখণ্ডী’র ব্যক্তিগত ভৃত্য সুবলের কাছ থেকে নিয়মিত সংবাদ আহরণ ছাড়া অন্য কিছু করেননি দ্রুপদ।

খুব বেশি কিছু করার অবস্থাতেও ছিলেন না দ্রুপদ। এই ত্রিশটি দিন তিনি দুশ্চিন্তার বিষে ছটফট করেছেন।

হস্তিনাপুরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার স্বপ্নটি তিনি দীর্ঘদিন ধরে মনে-মনে লালন করে আসছিলেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য তাঁর তূণীরে এক ভয়ংকর তির সংযোজিত হয়েছিল। দশার্ণরাজ্যের সঙ্গে শিখণ্ডী’র মাধ্যমে স্থাপিত বৈবাহিক সম্পর্ক দ্রুপদকে নতুন করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার আগ্রাসী যুদ্ধনীতি ও রণপাণ্ডিত্যের কথা কারও অজ্ঞাত নয়। তাঁকে পাশে পাওয়া মানে বিপক্ষের ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করা, একথা দ্রুপদ বোঝেন।

সেই আকাঙ্ক্ষার যে এমন ভয়ংকর পরিণাম হবে, দশার্ণ যে এইভাবে বন্ধুর পরিবর্তে রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো শত্রুতে পরিণত হবে, তা দ্রুপদের অনুমান করা উচিত ছিল!

আক্ষেপে নিজের মস্তকে আঘাত করেন দ্রুপদ। শিখণ্ডী বিবাহে অনিচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও বহুবছর আগে অরণ্যমধ্যে মহাদেবের মুখে শোনা সেই আশ্বাসবাণীর ভরসায় তিনি এই বৈবাহিক সম্পর্কে অগ্রসর হয়েছিলেন।

কিন্তু মহাদেবের সেই বাণী সত্য হয়নি! ফুলশয্যার রাতে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় শিখণ্ডীকে। দশার্ণের রাজকন্যা রাজ্যত্যাগ করামাত্র রাজপ্রাসাদে তো বটেই, পাঞ্চালের সর্বত্র শিখণ্ডীকে নিয়ে প্রচলিত হয়েছে নানা কথা ও কুৎসা। বহিঃশত্রু তো আছেই, পাঞ্চাল রাজ্যবাসীরাও সম্ভবত ভবিষ্যতে মানবে না শিখণ্ডীকে।

উপরন্তু, রাজ্যের অর্ধাংশ হারিয়ে দুর্বল পাঞ্চালের ওপর উদ্যত হয়েছে দশার্ণ রাজ্যের শত্রুতারূপী খড়গ!

এই একমাস গভীর চিন্তন ও পরিকল্পনায় মগ্ন থেকেছেন দ্রুপদ। মহামন্ত্রী চিত্রবানের সঙ্গে বহু আলোচনার পরেও কোনো সমাধান খুঁজে পাননি তিনি। অসহায় হয়ে চিত্রবানকে বলেছিলেন দ্রুপদ, ‘যে-কোনো মূল্যে আমি কুরুবংশের সর্বনাশ দেখতে চাই, চিত্রবান! অস্ত্রগুরু দ্রোণের আদেশে তারা যেভাবে আমাকে ও আমার রাজ্যকে লাঞ্ছিত করেছে, তার প্রতিশোধ না নিলে আমার পূর্বপুরুষদের কাছে আমি ঘৃণার পাত্র হয়েই থাকব। কিন্তু এই প্রতিহিংসার তাড়নায় আমি পাঞ্চালের এ কী সর্বনাশ ডেকে আনলাম!’

‘প্রতিশোধ যে শুধুমাত্র রণাঙ্গনেই নেওয়া যায়, তা তো নয় মহারাজ।’ শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন চিত্রবান, ‘মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করে, ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের মধ্যে মানুষকে ঠেলে দিয়ে, তাকে অন্তর্দীর্ণ করে দিয়েও তো প্রতিশোধ নেওয়া যায়। এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেলে আপনি না হয় তেমন কিছুর সন্ধান করুন, যা দশার্ণ-র তুলনায় শ্রেষ্ঠতর আয়ুধ।’

দ্রুপদ বুঝতে পারেননি চিত্রবানের বক্তব্যের মর্মার্থ। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কোন আয়ুধের কথা বলছেন?’

‘কুরুবংশ এক বিপুলায়তন প্রস্তর-ফলকের সদৃশ, মহারাজ।’ চিত্রবান বলেছিলেন, ‘দ্রোণাচার্যের ইন্ধনে সংঘটিত যুদ্ধে সেই সম্পূর্ণ ফলকটির সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই আমাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। কিন্তু যে-কোনো ফলকে এমন একটি অংশ থাকে, যেখানে আঘাত করলে সুবিশাল এবং আপাত অভেদ্য বস্তুটিও চূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। তেমন এক দুর্বল অংশ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা দিয়ে ওই প্রস্তর-ফলকটিকে বিদীর্ণ করে দেওয়া যায়। তারপরে ওই বংশের অবলুপ্তি সময়ের অপেক্ষা মাত্র।’

‘কী সেই দৌর্বল্য?’ সচকিত হয়েছিলেন দ্রুপদ।

‘হস্তিনাপুরের বর্তমান শাসক এখন ধৃতরাষ্ট্র। তিনি জন্মান্ধ। তাঁর ভ্রাতা পাণ্ডু ইতিমধ্যেই পরলোকগত। আর এক ভ্রাতা বিদুর দাসীপুত্র, তাই যোগ্যতম হলেও ভাগ্যের পরিহাসে তাঁর সিংহাসনে বসার প্রশ্ন নেই। পিতামহ ভীষ্ম প্রতিজ্ঞাপাশে আবদ্ধ। তাহলে এর পর হস্তিনাপুরের উত্তরাধিকারী হবে কে? পাণ্ডুর প্রথম পুত্র যুধিষ্ঠির? নাকি ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্যোধন?’

দ্রুপদ চিন্তা করে বললেন, ‘দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে অগ্রজ কে?’

‘যুধিষ্ঠির।’ চিত্রবান বললেন, ‘দুর্যোধন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সমবয়সি। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী সিংহাসনে যুধিষ্ঠিরের অধিকারই স্বীকৃত হওয়া উচিত। কিন্তু মহারাজ, দুর্যোধন ও তাঁর ভ্রাতারা এই বিধান মানতে ইচ্ছুক নন। আমি জানতে পেরেছি, শৈশবেই মধ্যমপাণ্ডব ভীমকে বিষমিশ্রিত খাদ্যের সাহায্যে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল দুর্যোধন। অচেতন ভীম জলে ডুবে যায়। নাগরাজ বাসুকীর আশীর্বাদ না থাকলে সে বেঁচে ফিরত না। এই বিরোধ প্রতিদিন তীব্রতর হয়ে উঠছে।’

‘আপনার ইঙ্গিত আমি অনুধাবন করতে পারছি।’ দ্রুপদ বললেন, ‘কিন্তু এই অন্তর্কলহকে কীভাবে ব্যবহার করব আমরা?’

চিত্রবান বললেন, ‘গুপ্তচরের মাধ্যমে আরও একটি তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ হিসেবে যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ তথা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীরূপে ঘোষণা করবেন। কিন্তু এতে তাঁর নিজের বিন্দুমাত্র সম্মতি নেই। মহানুভবতা এবং ন্যায়পরায়ণতা দেখানোর তাগিদে ও বিদুরের চাপে তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে দুর্যোধনের সমস্ত দুষ্কর্মে তাঁর নীরব ও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছে। কৌরবদের মাতা গান্ধারী গান্ধার দেশের রাজকন্যা, গান্ধাররাজ সুবলের তনয়া। তাঁর ভ্রাতা শকুনি দুর্যোধনকে সর্বক্ষণ ইন্ধন জোগান। আমি জানি মহারাজ, কয়েক দশকের মধ্যেই এই বিভেদ বিশাল আকার ধারণ করে কুরুবংশের দুটি শাখাকে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুযুধান করে তুলবে। আর এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করতে হবে আপনাকে।’

‘আমাকে!’ বিভ্রান্ত দ্রুপদ বললেন, ‘কীভাবে?’

‘আপনাকে পিতার কর্তব্য পালন করতে হবে, মহারাজ।’ নিম্নকণ্ঠে বললেন চিত্রবান, ‘আমি এক ক্ষত্রিয় দম্পতি ও তাঁদের দুই শিশুকে চিনি। কৃষ্ণবর্ণ হলেও শিশুদুটি অতি সুন্দর। স্বামী আমাদেরই সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধা ছিলেন, কৌরব বাহিনীর সঙ্গে সমরে মৃত্যুবরণ করেছেন। একাকী স্ত্রী দুই শিশুকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। গতকাল তিনি তীব্র অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন। শিশুপুত্র ও কন্যা এখন অনাথ, অসহায়।’

‘রাজকোষ থেকে তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করুন।’ বিরক্তমুখে বললেন দ্রুপদ, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী পশুপতিকে জানালেই তিনি সব ব্যবস্থা করবেন। শিশুদুটিকে আশ্রিতদের আবাসে প্রেরণ করা হবে দ্রুত। তাদের কথা এই আলোচনায় আসছে কেন?’

‘আসছে, কারণ এই শিশুদুটিকে আপনি দত্তক নিতে চলেছেন।’

‘কী?’

দ্রুপদের মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করার আগেই চিত্রবান বললেন, ‘প্রকাশ্যে প্রচার করুন, দ্রোণের অপমানের প্রতিশোধ নিতে ভীষণ এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন আপনি। সেই যজ্ঞের অগ্নি থেকেই জন্ম নিয়েছে এই পুত্র ও কন্যা। ওই দুই শিশুর পরিচিতি সম্বন্ধে রাজ্যে কেউই কিছু জানে না, তাই কেউ তাদের চিনতে পারবে না। তারই সঙ্গে প্রচার করুন যে যজ্ঞকালে দৈববাণী হয়েছে, ওই পুত্রই হবে দ্রোণের মৃত্যুর কারণ!’

দ্রুপদ দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এমন মিথ্যা প্রচার করে আমার লাভ?’

‘দৈববাণী নিয়ে সমাজে এক অন্ধবিশ্বাস প্রচলিত আছে, মহারাজ।’ চিত্রবানের মুখে তির্যক হাসি দেখা দিল, ‘তা নাকি সত্য হয়ই। এই কথা ঠিকই বাতাসে ছড়াবে, শোনার পর দ্রোণ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন। আপনিও সেই পুত্রটিকে রণকুশল করে তুলবেন। জানবেন, ভীষ্ম অজেয় এবং প্রায় মৃত্যুঞ্জয়ী হলেও দ্রোণ তা নন। সেই বালকটিই আপনার পুত্র হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ এনে দেবে।’

‘সাধু প্রস্তাব!’ দ্রুপদের চোখের গভীরে তুষানলের মতো দীপ্ত হয়ে ওঠে প্রতিশোধস্পৃহা, ‘কিন্তু কুরুবংশের গভীরে ওই চ্যুতিকে গভীর ও প্রসারিত করে তোলায় আমার অনুঘটন কার্যটি কীভাবে সম্পন্ন হবে? আমার যে পূর্বপুরুষদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল হস্তিনার সিংহাসন থেকে, যাঁরা নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় এসে নিজ বাহুবলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই পাঞ্চালরাজ্য, তাঁদের অবমাননার প্রতিশোধ আমি কীভাবে নেব?’

‘বলছি মহারাজ! কয়েক বছর মাত্র! তারপর ওই পালিতা শিশুকন্যাটির জন্য আপনি স্বয়ম্বর সভা আয়োজন করবেন।’ ধীর লয়ে বললেন চিত্রবান, ‘তার বিবাহ হবে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গে। আয়োজন সেভাবেই সম্পন্ন হবে। অর্থাৎ সেই সভায় দুর্যোধন ও অন্যান্য দেশের রাজপুত্ররাও আমন্ত্রিত হবেন। কিন্তু শুধুমাত্র রাজকন্যার দ্বারা এক রূপবান বা গুণবান পুরুষের চয়নই সেই বিবাহের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হবে না। তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে শরসন্ধানের কোনো এক কঠিন পরীক্ষা। তিরন্দাজরূপে অর্জুন বিশ্বে অদ্বিতীয়। প্রতিযোগিতায় তাঁর জয়লাভ এবং আপনার জামাতা হওয়া নিশ্চিত। কিন্তু এর ফলে দুর্যোধন ও অন্যান্য কৌরবরা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠবে। কালক্রমে দেখবেন, ওই কন্যাই কুরুবংশের ধ্বংসের কারণ হবে।’

স্তম্ভিতদৃষ্টিতে চিত্রবানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন দ্রুপদ। তাঁর মনে হল, এমন অসম্ভব ক্ষুরধার কূটনৈতিক বুদ্ধি যে ব্যক্তির রয়েছে, তাঁকে মহামন্ত্রী হিসেবে পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়।

কিন্তু এর মধ্যে নিহিত আছে ভবিষ্যতের প্রবল বিপদের সম্ভাবনা। অতি বুদ্ধিমান ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পাঞ্চালের প্রতিটি দুর্বলতা জানেন চিত্রবান। আজ তিনি পাঞ্চাল তথা দ্রুপদের প্রতি বিশ্বস্ত রয়েছেন।

কিন্তু আগামীকাল যদি তাঁর মনোভাব পরিবর্তিত হয়?

অনেকক্ষণ নির্বাক রইলেন দ্রুপদ। তারপর ঈষৎ স্খলিতকণ্ঠে বললেন, ‘চমৎকার পরিকল্পনা, মহামন্ত্রী। কিন্তু দশার্ণের আক্রমণ থেকে পাঞ্চালকে রক্ষা করতে না পারলে তো এর কোনো মূল্যই নেই। সেজন্য প্রয়োজন শিখণ্ডী’র পৌরুষ। সেটি কীভাবে সংগ্রহ করব? নাকি শিখণ্ডী’র মতো দেখতে কোনো অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষের সন্ধানও আছে আপনার কাছে?’

‘বিকল্পের প্রয়োজন নেই, মহারাজ। ওদিকে আমার প্রখর দৃষ্টি ছিল।’ চিত্রবান মৃদু হাসলেন, ‘শিখণ্ডী পুরুষত্বের পরীক্ষায় সসম্ভ্রমে উত্তীর্ণ হবেন। পৌরুষে দীপ্ত হয়ে তিনি কম্পিল্য অভিমুখে যাত্রা করেছেন, এ-কথা আমি জানি। দৈববাণী নয়, বরং গুপ্তচরের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই আপনাকে কথাটি জানাচ্ছি। দশার্ণকে নিয়ে আর উদবিগ্ন হবেন না।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন