উদ্যাপন (স্বপ্নে আজ দেখেছি তোমাকে)

বিষ্ণু দে

স্বপ্নে আজ দেখেছি তোমাকে।
মরণের বিবর্ণ চাদর
দীর্ঘ তোমার তনুখানি
শীতল কোমল অন্ধকারে
স্পর্শ ক’রে ছড়ায় আদর।
স্বপ্নে আজ দেখেছি তোমাকে,
রাত্রি মোর অর্ধ ঘুমঘোর।

মৃদু স্নেহে খুলি আবরণ
দেখি হিমশুভ্র মুখখানি,
শীতল কোমল অন্ধকারে
পাণ্ডু আভা ফেলেছে মরণ,
শীতল শিথিল বুকখানি।

নির্নিমেষে দেখি দুমিনিট
স্তব্ধতার শব্দ মাঝে একা,
প্রশান্তিই দিয়েছে মরণ,
ওষ্ঠে নেই নিষ্ঠুরতা কীট।
বিচলিত, শেষ করি দেখা।

ফিরে আসি নিঃশব্দে শয্যায়
নিঃশব্দে শুনেছি হৃদ্-ভাষা,
বেদনা ও প্রশান্তি হাশিশ্
ঢেলে দিই নিঃশব্দে সেথায়।

নেই আর আদিতম আশা।
তোমাকে যে লেগেছিল ভালো,
মনোহীন মৃত তনু নয়,
দেহে তব গোধূলির ছায়া,
নিবু নিবু বাসনার আলো,
রাত্রিদিন অবসাদময়।

তোমার ও ক্ষীণ ওষ্ঠাধরে
শ্লেষবাক্য মুগ্ধ করেছিল।
করেছিল মনেও চুম্বন,
ওষ্ঠাধর হাস্য-সুখ-ভরে
ওষ্ঠাধরে লুব্ধ ধরেছিল।

পৃথিবীর জনতার গ্লানি
স্পর্শ তো করেনি আমাদের।
মেরুদেশে আমাদের বাসা,
অতিরিক্ত নেই জনপ্রাণী,
বাঁধি বাসা মানস-লোকের।

সে জগৎ মুছে গেছে হায়
আমার স্বপ্নের আদি লোকে।
পৃথিবীর গূঢ় প্রতিশোধ!
দেখিলাম মৃত্যুর ছায়ায়—
চিত্তে হানে উলঙ্গতা ও কে।

তোমাকে যে লেগেছিল ভালো,
দিনরাত্রি ছিল অতৃপ্তি যে,
সেই ক্ষোভ সে লোভ আমার
জীবনে যে জ্বেলেছিল আলো।
স্বপ্নে তারা হারায় দীপ্তি সে।

তোমার মৃত্যুর সেতুপথে
চিত্ত লভে প্রিয় অন্ধকার।
অচঞ্চল মুক্তির আস্বাদ—
নিদ্রা আনে নবহর্ষরথে
নবজাত পৃথিবী আমার।

প্রভাতের প্রথম প্রহরে
সেই নববিশ্ব যাবে ধুয়ে?
আলোকের শ্রাবণ-ধারায়
মধ্যাহ্নের খররৌদ্রকরে
আমেরিকা ঝরে যাবে ভুঁয়ে?

তোমাকে শুধিয়ে লিখি তাই
তুমি কি মরণপারে গিয়ে
ইচ্ছা কর দেহান্তর পেতে,
তুমি কি আসবে রূপ ধ’রে?
তোমাকে শুধিয়ে লিখি তাই,
প্রেম আসে প্রেতলোকে যেতে?

১৯২৯

সকল অধ্যায়

১. পলায়ন (শফরী চোখের সরল চাহনি)
২. কাব্যপ্রেম (তোমাকেই ঘিরে চলে রক্তস্রোত)
৩. উদ্যাপন (স্বপ্নে আজ দেখেছি তোমাকে)
৪. প্রেম (ফিরাও তোমার দৃষ্টি ফিরাও আমার চোখ হতে)
৫. “অর্ধেক কল্পনা” (যেদিন জাগেনি বিশ্বে প্রাণস্পন্দে আদিম উৎসব)
৬. প্রত্যক্ষ (সেইদিন দেখেছি তোমাকে)
৭. বজ্রপাণি (কাল রজনীতে এসেছিল যবে বৈশাখী পূর্ণিমা)
৮. অভীপ্সা (এ আকাশ মুছে দাও আজ)
৯. অর্ধনারীশ্বর (সম্মুখে দুঃস্বপ্নরুক্ষ অসিধার কঠিন আকাশ)
১০. সমুদ্র (ভাসিয়েছি প্রেম আজ নীলিমার অন্ধকার জলে)
১১. সাগর উত্থিতা (সবুজ সমুদ্রে ওঠে অগণন ঢেউ)
১২. উর্বশী (আমি নহি পুরূরবা)
১৩. পর্যাপ্তি (যাক, আজ দূরে যাক তারা)
১৪. সন্ধ্যা (বামদিকে গিরিশৃঙ্গ আকাশকে করেছে আহত)
১৫. উর্বশী ও আর্টেমিস (সন্ধ্যার বর্ণের ছটা রয়েছে তো তবু)
১৬. ছেদ (আমার হৃদয় হিম-অবজ্ঞায় করেছি বিকল)
১৭. রাত্রিশেষে (আকাশের দুর্গে নেই পলাতকা অমাবস্যা আজ)
১৮. অতিক্রম (রাত্রির বিশাল মুখ বাতায়নে উঁকি দেয় কালো)
১৯. প্রত্যাবর্তন (আহা ষড়ঋতু! বনভবন!)
২০. প্রজ্ঞাপারমিতা তাকে করে আশীর্বাদ
২১. ভয় (বট আর অশথের ছায়াঘন কালো ভয়গুলি)
২২. এপ্রিল (শুভ্রকেশ ঢেউ ছেড়ে, সমুদ্রের আলিঙ্গন ছিঁড়ে)
২৩. গ্রীষ্ম (ঘন গ্রীষ্মতাপ)
২৪. আলোক ছড়াও (শীতের উন্মুক্ত রৌদ্র কালো তার কেশে)
২৫. সোহবিভেত্তস্মাদেকাকী বিভেতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন