নকশা-কাটা কবজ – ২

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

খাটিয়াটা নামিয়ে রেখে মতি ঘাড় থেকে গামছাটা নিয়ে নিজেকে বাতাস করে। এই শীতের রাতেও সে ঘেমে উঠেছে। মানুষ মরে গেলে তার ওজন কি বেড়ে যায়? শুকনো খিটখিটে নাসির মুন্সীর কাফন দিয়ে ঢাকা লাশটা আনতে তার মতো এ রকম হাট্টাকাট্টা জোয়ান মানুষের এত পরিশ্রম হয়েছে কেন কে জানে।

নাসির মুন্সীর আত্মীয়স্বজন বেশি নাই, খিটখিটে স্বভাবের ছিল বলে গ্রামের মানুষের সাথে সম্পর্কও ভালো ছিল না। মরে যাবার পরও মানুষজন সেটা ভুলে নাই—তাই লাশটাকে কবরস্থানের আনারও লোক কম পড়ে গেছে। তখন মতিকে খবর দেওয়া হয়েছে। ভালো কাজে তাকে কেউ ডাকাডাকি করে না, পরিশ্রমের কাজ হলে গ্রামের মানুষের সবার আগে তার কথা মনে পড়ে। তাদের দোষ দেওয়া যায় না—তার বিশাল পাথরের মতো শরীর, কাজেই পরিশ্রমের কাজে তার ডাক পড়তেই পারে।

মতি সাথে আরো যারা খাটিয়া ঘাড়ে করে এনেছে তারা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। মাটিতে বসে তারা মুখ বড় করে খুলে শ্বাস নিচ্ছে। একজন বলল, “নাসির মুন্সী কি ভাত খাইতো নাকি সিসা খাইতো? এই রকম ওজন জন্মে দেখি নাই।”

একজন মৃত মানুষের পাশে বসে ঠাট্টা-তামাশা করা ঠিক না, তারপরেও কয়েকজন হাসির মতো শব্দ করল। মুরব্বি ধরনের একজন বলল, “নাউজুবিল্লাহ। মুর্দার সামনে এইটা কী রকম কথা?”

মতি একটা বিড়ি জ্বালিয়ে লম্বা টান দিলো। বলল, “দেরি কইরেন না, মৌলভি সাহেবরে খবর দেন।”

কররস্থানের এক পাশে মৌলভি সাহেবের বাড়ি, বাড়ির সামনে ছোট একটা নামাজঘর, পিছনে পুকুর। অবশ্য পুকুর না বলে সেটাকে এঁদো ডোবা বলা উচিত। ছোট টিনের ঘরের চারপাশে গাছপালা, জায়গাটাকে দিনের বেলাতেই অন্ধকার করে রাখে। এই নিশুতি রাতে পুরো জায়গাটাতে জমাট বাঁধা অন্ধকার, কেমন যেন থমথম করছে।

নাসির মুন্সীর দূর সম্পর্কের ভাই বিড়বিড় করে একটা দোয়া পড়তে পড়তে মৌলভি সাহেবের বাড়ির দিকে গেল। বাইরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে উঁচু গলায় ডাকল, “হুজুর। মৌলভি সাহেব, দরজা খোলেন।”

মৌলভি সাহেবের বয়স হয়েছে, কানে কম শোনেন। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পর একটা হারিক্যান হাতে ঝুলিয়ে দরজা খুলে বের হলেন। মৌলভি সাহেব মনে হয় চোখেও কম দেখেন, হারিক্যানটা ওপরে তুলে দেখার চেষ্টা করলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কেডা? মুর্দা আনছো নাকি?”

“জে হুজুর। ভাইসাব ইন্তেকাল করেছেন।”

মৌলভি সাহেব বিড়বিড় করে ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন পড়লেন। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “গোর দেওয়ার জায়গা আর নাই। পুরান কবরের ওপরে দিতে হবে। আপনাদের ভাই-বেরাদরের গোর আছে এইখানে?”

“জে না হুজুর।”

“আসেন দেখি জায়গা পাই নাকি।”

মৌলভি সাহেব হারিক্যান হাতে টুকটুক করে হেঁটে কবরস্থানের দিকে গেলেন। এই কবরস্থানের প্রত্যেকটা কবর তার নখদর্পণে। বুড়ো হয়ে অনেক কিছু ভুলে গেছেন কিন্তু কোনটা কার কবর সেটা ভুলেন না। আস্তে আস্তে পা ফেলে সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলতে থাকেন। একটা ঝাপড়া লিচু গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় নাসির মুন্সীর ভাই বলল, “এইখানে তো ফাঁকা জায়গা আছে।”

মৌলভি সাহেব মাথা নাড়লেন, “নাহ্। এইখানে গোর দেওয়া যাইব না।”

“কেন? কারো জন্য রিজার্ভ?”

“নাহ। জায়গাটা গরম।”

নাসির মুন্সীর ভাই অবাক হয়ে বলল, “গরম?”

মতি বিড়ি টানছিল বলে মুরব্বিদের পিছন পিছন আসছিল। এইবারে বিড়িটা হাতের তালুতে লুকিয়ে একটু এগিয়ে আসে জিজ্ঞেস করল, “গরম মানে কী?”

মৌলভি সাহেব একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুমি জানো না গরম মানে কী?”

মতি সরল মুখ করে মাথা নাড়ল, বলল, “না মৌলভি সাহেব, গোর কেমন করে গরম হয় জানি না।”

মৌলভি সাহেব একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “গরম মানে কি জানতে চাও, তাহলে মাঝরাতে একলা এইখানে আইসো।”

“কী হয় তখন?”

“তুমি নিজেই শুনবা।”

মতির কৌতূহল এবারে যথেষ্ট বেড়ে গেল, সে প্রায় অনুনয়ের স্বরে বলল, “কী শুনব হুজুর?”

“মাটির তলা থেকে ধুপ ধুপ শব্দ হয়।”

মতি অবাক হয়ে বলল, “কী বলেন হুজুর?”

“এখন ত্যানাগো কথা বাদ দাও। নাউজুবিল্লাহ।”

মৌলভি সাহেব তার হারিক্যান হাতে করে টুকটুক করে খালি জায়গা খুঁজতে লাগলেন। বিড়বিড় করে অনেকটা আপন মনে নিজের সাথে কথা বলছিলেন। খুব ভালো করে লক্ষ করলে তার কথা একটু একটু বোঝা যায়। মৌলভি সাহেব এই কবরস্থানে গোর দেওয়া মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন, কথা শুনলে মনে হবে যাদের গোর দেওয়া হয়েছে সবাই বুঝি তার কথা শোনার জন্য জেগে আছে।

মৌলভি সাহেব পুরো কবরটা ঘুরে আবার লিচু গাছের জায়গাটায় ফিরে এলেন। কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “এইখানেই গোর দেও।”

ইদরিস মিয়ার দূর সম্পর্কের ভাই বলল, “আপনি যে বললেন জায়গাটা গরম?”

“বেশি বামে যাবা না। ডান দিকে চেপে রেখে গোর খুঁড়লে ঠিক আছে। গরম বাম দিকে।”

“কিন্তু—”

“ডরের কিছু নাই। আমি আছি। সুরা জিন পইড়া ফুঁ দিমু, আসমান-জমিন বান্ধা হইয়া যাইব।”

ইদরিস মিয়ার ভাই তবু ইতস্তত করতে লাগল। মৌলভি সাহেব হারিক্যান নিয়ে হেঁটে হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে যেতে যেতে বললেন, “গোর খুঁড়বা কে? আহ আমার লগে, কোদাল-খোন্তা নিয়ে যাও।”

মতি মৌলভি সাহেবের পিছু পিছু যেতে থাকে। একটু পরে সে কোদাল নিয়ে ফিরে আসে।

হুজুর বাম দিকে চেপে রেখে গোর খুঁড়তে বলেছিলেন। কিন্তু মতি সেটা না করে ডান দিকে চেপে মোটামুটি ফাঁকা জায়গাটাতেই খুঁড়তে শুরু করে। সাথে আর যারা এসেছে তারাও হাত লাগায়। দেখতে দেখতে কবর গভীর হতে থাকে।

হঠাৎ করে মতি কবর খোঁড়া থামিয়ে দিয়ে হাত তুলে বলল, “স-স-স-স—থামো।”

সবাই থেমে গেল। একজন জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে?”

“শোনো—”

“কী শুনব?”

“শব্দ শোনো না?”

সবাই এবার কান পেতে শোনার চেষ্টা করল এবং হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পেল ধুপ ধুপ করে একটা শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ হওয়ার পর শব্দটা থেমে গেল।

একজন ভয়ে ভয়ে বলল, “কিসের শব্দ?”

কেউ তার কথার উত্তর দিলো না। নিঃশব্দে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ আবার শব্দটা শুরু হয়, এবার আগের থেকে আরেকটু জোরে। মতির মনে হলো এই কবরটার খুব কাছাকাছি ডান দিক থেকে শব্দটা আসছে। সে গলা উঁচিয়ে নাসির মুন্সীর ভাইকে ডাকল, “চাচাজি—”

নারিস মুন্সীর ভাই এগিয়ে আসে, “কী হইছে?”

“হারিক্যানটা দেন।”

“হারিক্যান?”

“জে।”

“কেন?”

মতি অনেকটা ধমকের সুরে বলল, “শব্দ শুনেন না?”

নাসির মুন্সীর ভাই কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। ধুপ ধুপ শব্দ শুনে সে ভীত গলায় বলল, “ইয়া মাবুদ! কিসের শব্দ?”

মতি আবার বলল, “হারিক্যানটা দেন।”

নাসির মুন্সীর ভাই হারিক্যানটা এগিয়ে দেয়। মতি হাতে হারিক্যানটা নিয়ে অর্ধেক খোঁড়া কবরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে। কবরের ডান দিকের মাটি থেকে শব্দটা আসছে! ভালো করে তাকালে মাটিটাতে একটা কম্পন চোখে পড়ে। প্রত্যেক বার ধুপ করে শব্দ হওয়ার সাথে সাথে একটুখানি মাটি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে। মতি মাটিটা স্পর্শ করল, মনে হলো মাটির অন্য পাশ থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিচ্ছে।

মতির সাথে আরো যে দুইজন ছিল, তারা জোরে জোরে কলমা পড়তে থাকে। একজন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মৌলভি সাহেবরে ডাকেন। জলদি ডাকেন।”

মতি কোদালটা হাতে নিয়ে কবরের ভেতরের ডান দিকের মাটিতে কোপ দিয়ে খানিকটা মাটি সরিয়ে ফেলল।

পাশে দাঁড়ানো লোকটা মতির হাত ধরে ফেলল, ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করো মতি ভাই?”

“দেখি।”

“কী দেখো?”

কে শব্দ করে।” মতি তার কোদাল দিয়ে কোপ দিয়ে আরো খানিকটা মাটি সরিয়ে ফেলল।

পাশে দাঁড়ানো মানুষটি মতির হাত ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল। কাতর গলায় বলল, “সর্বনাশ মতি ভাই। এই কাজ করবা না।”

ধুপ ধুপ শব্দটা এবারে বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে শব্দটা ডান দিক থেকেই আসছে। মতি ঝটকা মেরে হাত ছুটিয়ে নিয়ে কোদাল দিয়ে আরেকটা কোপ দিয়ে বেশ বড় একটা মাটির টুকরো নামিয়ে ফেলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী হবে করলে?”

“আল্লাহ্র দুনিয়ায় অনেক কিছু আছে মতি ভাই। সবকিছু দেখতে হয় না।”

মতি কোদাল দিয়ে আরেকটা কোপ দিয়ে বলল, “দেখলে কী হয়?”

“সবকিছু দেখার মতো না মতি ভাই। জায়গাটা গরম। তুমি বিপদের জায়গায় হাত দিতেছো।”

“দিলে আমি দিতাছি। তোমার ভয় লাগলে যাও। আমি দেখতে চাই কে শব্দ করে, কীভাবে শব্দ করে।”

মানুষটি এবারে মতি হাত ছেড়ে দিয়ে হাঁচড়পাঁচড় করে মাটি আঁকড়ে কোনোমতে অর্ধেক খোঁড়া কবর থেকে বের হয়ে গেল। তারপর দৌড়ে গেল মৌলভি সাহেবকে খবর দিতে। ওপরে যারা ছিল তারাও পিছু পিছু গেল। কারো এখন একা থাকার সাহস নাই। মতি কবরের ভেতর খুঁড়ছে এবং এখানে তার সঙ্গী কবরের পাশে খাটিয়াতে শোওয়া সাদা কাফনে ঢাকা নাসির মুন্সীর লাশ। কবরের ভেতরে রাখা হারিক্যানের আলো বের হয়ে এসে অন্ধকারকে দূর করতে পারছে না। মনে হয় জায়গায় জায়গায় জমাট বাঁধা অন্ধকার। গাছের পাতা বাতাসে নড়ছে, তার একধরনের শির-শির শব্দ।

মতির ভিতরে ভয়-ডর বলে কিছু নেই নেই। তারপরও আজকে হঠাৎ তার বুকের ভেতর একটা আতঙ্ক ধক করে ওঠে। মতি তার বুকের ভেতর থেকে আতঙ্কটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আবার কোদালটা হাতে নিয়ে মাটি কুপিয়ে একটা সুরঙ্গের মতো করতে থাকে। অন্য পাশে ঠিক কী জিনিসটা শব্দ করছে সে দেখতে চায়।

কয়েকটা কোপ দেওয়ার পর হঠাৎ মাটিটা ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে একটা পুরনো কাঠের দেওয়াল বের হলো। কাঠ পচে নরম হয়ে গেছে। কোদাল দিয়ে ধাক্কা দিতেই কাঠ ভেঙে পড়ে। ভাঙা অংশটাতে একটা ফাঁকা জায়গা বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ভক করে একটা বিকট দুর্গন্ধ তার নাকে ধাক্কা দেয়। মতি মাথাটা সরিয়ে এনে গামছা দিয়ে নাকটা ঢেকে নেওয়ার চেষ্টা করল এবং তখন হঠাৎ করে সে একটা বিচিত্র ব্যাপার লক্ষ করল। পুরো কবরস্থানটা আশ্চর্য রকম নীরব, কেমন যেন থমথম করছে। ঝিঁঝিঁ পোকার যে কর্কশ ডাক পুরো এলাকাটাকে জীবন্ত করে রেখেছিল, হঠাৎ করে সেগুলো থেমে গেছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে একটা বিস্ময়কর নীরবতা।

মতি এক হাত দিয়ে গামছাটা নাকে চেপে অন্য হাতে হারিক্যানটা ধরে সুরঙ্গ শেষের গর্তটাতে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল। আবছা অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যায় না, তখন হঠাৎ করে কিছু একটা নড়ে ওঠে এবং মতি একজন উলঙ্গ মানুষকে দেখতে পেল। একটা কবরের মতো ছোট জায়গায় মানুষটি গুটিশুটি মেরে বসে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মতিকে দেখে মানুষটি তার জিভ বের করে ঠোঁটটা চেটে নেয়, তখন মুহূর্তের জন্য তার ধারালো দাঁত দেখা গেল।

মতি অমানুষিক একধরনের আতঙ্কে তার মাথা বের করে নেয়, তার মনে হতে থাকে এক্ষুনি বুঝি গর্ত থেকে মানুষটা বের হয়ে তার গলা কামড়ে ধরবে। সে পাগলের মতো দুই হাত দিয়ে মাটি তুলে গতটা বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। ঠিক তখন সে অনেক মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পেল, মৌলভি সাহেব অন্য সবাইকে নিয়ে ছুটে আসছেন। উচ্চ কণ্ঠে কোনো একটা দোয়া পড়তে পড়তে হাত দিয়ে অদৃশ্য কোনো একটা কিছুকে ঠেলে সরানোর মতো ভঙ্গি করে তার বয়সের তুলনায় অনেক ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে কবরের পাশে দাঁড়ালেন। মতি তখন তার কোদালটা একটা অস্ত্রের মতো করে ধরে রেখে নিজের হাতে তৈরি করা সুরঙ্গটার দিকে তাকিয়ে আছে। মাটি দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা করার জন্য সুরঙ্গটার অন্য মাথা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

মৌলভি সাহেব এবং অন্যদের দেখে মতি একটু সাহস ফিরে পায়। সে কোদালটা শক্ত করে ধরে রেখেই কাঁপা গলায় বলল, “হুজুর, এইখানে একটা গর্ত— ‘“

মৌলভি সাহেব তীব্র গলায় বললেন, “আমি কিছু শুনবার চাই না। তুমি চুপ করো। চুপ।”

মতি বিড়বিড় করে বলল, “আপনি বিশ্বাস করবেন না হুজুর—আমি দেখেছি—”

মৌলভি সাহেব চিৎকার করে বললেন, “চুপ—চুপ—একটা কথা না। একটা কথাও না—”

মতি চুপ করে গেল। তার শরীরটা তখনও একটু একটু করে কাঁপছে।

মৌলভি সাহেব উবু হয়ে বসে খানিকটা মাটি হাতে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে সেখানে ফুঁ দিলেন, তারপর সেটা কবরের ভিতর ছিটিয়ে দিলেন, তারপর মতিকে বললেন, “তুমি বের হও।”

মতি কোদালটা একজনকে দেয়। আরেকজন তার হাত থেকে হারিক্যানটা নেয়। তখন সে দুই হাতে ভর দিয়ে কবর থেকে বের হয়ে এলো।

মৌলভি সাহেব কোদালটা নিয়ে তার দুর্বল শরীর দিয়ে সেটা দিয়ে মাটি তুলে কবরের ভেতর ফেলতে লাগলেন এবং বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগলেন।

মতি বলল, “কোদালটা দেন, আমি মাটি ফেলি।”

মৌলভি সাহেব কোদালটা দিলেন, বললেন, “ভরাট করো। কুনু তাড়াহুড়া নাই, সময় নেও কিন্তু ঠিক করে ভরাট করো। মনে রাখো সবাই অনেক বিপদের মাঝে আছে। আমার ক্ষমতা কিন্তু বেশি না— টুকটাক বিপদ ঠেকাতে পারি। বড় বিপদ ঠেকাতে পারি না। বড় বিপদ যেন না হয়।”

বিপদ বলতে কী বোঝাচ্ছেন মতি সেটা আর জিজ্ঞেস করল না। মাটি দিয়ে কবরটা ভরাট করতে লাগল। অন্য আরেকজন আরেকটা কোদাল নিয়ে মাটি ভরাট করতে শুরু করে। মাটি ফেলতে ফেলতে মতির বারবার মনে হতে থাকে এক্ষুনি বুঝি মাটি ফুঁড়ে সেই উলঙ্গ মানুষটা বের হয়ে আসবে।

যতক্ষণ মাটি দিয়ে কবরটা ভরাট করা হলো মৌলভি সাহেব কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর কবরের ওপর দুইটা বাঁশ আড়াআড়িভাবে রাখলেন। আরো কিছু দোয়া-দরুদ পড়ে কবরের ওপর মাটি ছড়িয়ে দিয়ে একসময় মতির দিকে তাকালেন।

মতি লক্ষ করল কবরস্থানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আবার ফিরে এসেছে। মৌলভি সাহেব কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “বাবা তোমার নাম কী?”

“মতি।”

“বাবা মতি, তুমি আজকে খুব বিপদের একটা কাজ করেছো। অনেক অনেক বড় বিপদ।”

“কেন? বিপদ কেন?”

“শোনো বাবা, তুমি ভিতরে কী দেখেছো সেটা কাউরে কোনোদিন বলবা না। কোনোদিন বলবা না। আমারে কথা দাও।”

মতি বলল, “জে হুজুর কথা দিলাম।”

“আমারে ছুঁয়ে কথা দাও।’“

মতি বড় হুজুরের হাতটা স্পর্শ করে নিচু গলায় বলল, “কথা দিলাম হুজুর।”

“এখন চলো, মুর্দার জন্য আরেকটা গোর খুঁড়ি।”

.

নাসির মুন্সীকে কবর দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ভোর হয়ে গেল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন