মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ক্যাম্পাসে গিয়ে কারো সাথে কথা বলার আগেই রাজু বুঝতে পারল মিলিয়া আসলেই মারা গেছে। তাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিচু গলায় বিষণ্ণ হয়ে নিজেদের ভেতর কথা বলছে। মিলিয়ার ঘনিষ্ঠ দুই-একজন মেয়ের চোখ লাল, তারা কান্নাকাটি করেছে এবং অন্য কয়েকজন তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। একজনের চোখে পানি এলেই সেটা দেখে অন্যদের চোখে পানি এসে যায়। কাজেই মিলিয়ার বান্ধবীদের চোখে পানি দেখে অন্য অনেকের চোখেই পানি চলে আসে।
কম বয়সি একটা মেয়ে একেবারে হঠাৎ করে এভাবে মারা গেলে সবাই সবচেয়ে আগে তার কারণটা জানতে চায়। এখানেও তাই হলো এবং তার মৃত্যুর ঘটনাটি জেনে সবাই আরো বেশি হতবাক হয়ে গেছে। শাফকাত আর মিলিয়া সমুদ্র তীরের একটা রাস্তায় ঘুরতে বের হয়েছিল। সুন্দর একটা জায়গায় তারা গাড়ি থামিয়েছে তখন হঠাৎ করে অন্য একটা গাড়িতে করে কালো একজন মানুষ তাদের গাড়ির সামনে রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। মানুষটি মিলিয়ার ব্যাগটি টেনি নিচ্ছিল, মিলিয়া মনে হয় একটু বাধা দিয়েছিল তখন মানুষটি কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করে মিলিয়ার মাথায় গুলি করে দিয়েছে। মানুষটি শাফকাতকেও গুলি করেছে, পায়ে লেগেছে বলে প্রাণে বেঁচে গেছে।
মিলিয়া সাথে সাথে মারা গেছে, শাফকাতের বিশেষ কিছু হয় নাই। হাসপাতালে পা ব্যান্ডেজ করে ছেড়ে দিয়েছে।
রাজু গল্পটি নিঃশব্দে শুনে গেল। আমেরিকায় বছরে দশ-বারো হাজার মানুষ গুলিতে মারা যায়—সেই দেশে সবার হাতে বন্দুক, কিছু একটা হলেই একজন আরেকজনকে গুলি করে দেয়। কাজেই ব্যাগ ছিনতাই করার জন্য একজনকে নির্বিকারভাবে গুলি করে গুলি করে মেরে ফেলা বিচিত্র কিছু নয়। গল্পের যে অংশটি বিচিত্র সেটি হচ্ছে খুনি মানুষটির গায়ের রং কালো! সেই দেশে কিছু একটা হলেই সবার প্রথমে দোষী মানুষের গায়ের রংটিকে দোষ দেওয়া হয়। গায়ের রং সাদা হলে সেটি গলা বাড়িয়ে কেউ বলে না, কালো হলে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়।
রাজুর মাথার ভেতরে এই বিষয়গুলো এসেছে কারণে সে এগুলো নিয়ে ভাবে, কিন্তু আজকে সেগুলো মোটেই তার ভাবনার বিষয় ছিল না। সে যে ভোরবেলা মিলিয়াকে স্বপ্নে দেখেছে যে সে কাতর গলায় কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলছিল যে একজন তাকে মেরে ফেলেছে, সেই বিস্ময়কর ঘটনাটিও তার মাথার মাঝে নেই। রাজুর চেতনাটি কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে, মিলিয়া নামের মেয়েটি পৃথিবীতে নেই, সে আর কখনো ফিরে আসবে না—এই বিষয়টি তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। তার ভেতরের অনুভূতিটি কি গভীর বেদনার নাকি গভীর শূন্যতার, সেটিও সে বুঝতে পারছে না। ঠিক কী কারণ জানে না, রাজুর মনে হতে থাকে, যদি আর একবার সে মিলিয়ার কণ্ঠস্বরটি শুনতে পারত তাহলে সে এই পৃথিবীতে কোনো কিছু চাইত না।
দশটার সময় তাদের একটি ক্লাস ছিল, ছেলেমেয়েরা স্যারকে বলল তার আজকে ক্লাসটি করতে চায় না, অনেকেই মিলিয়ার বাসায় গিয়ে তার মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে একটু দেখা করে আসবে। স্যার সাথে সাথে ক্লাস ছুটি দিয়ে দিলেন।
রাজু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে মিলিয়ার বাসায় গেল না। ক্যাম্পাসের ফাঁকা বারান্দায় রেলিংয়ের ওপর পা তুলে বসে রইল। তার ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে থাকে যে এক্ষুনি বুঝি মিলিয়া পিছন থেকে এসে তাকে কিছু একটা বলবে। রাজু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। সে নিজের ভেতর একধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। একসময় সে রেলিং থেকে পা নামিয়ে বারান্দা থেকে রাস্তায় নেমে আসে। প্রথমে ক্যাম্পাসের ভেতর ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করে তারপর ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। হেঁটে হেঁটে যদি ক্লান্ত হতে পারে, তাহলে হয়তো তার ভেতরকার অস্থিরতাটুকু কমবে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মনে হলো, তার কাছে যে রহস্যময় কবজটি আছে সেই কবজটি মুঠি করে চেপে ধরে সে অশরীরী জগতে উঁকি দেবে।
সেখানে কি সে মিলিয়াকে খুঁজে পাবে?
* * *
গভীর রাতে রাজু গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে তার বিছানায় বসেছে। তার মনে হয়েছে আজকে সে যখন কবজটি মুঠি করে ধরবে তখন তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে হবে। রাজু ঘরের আলো নিভিয়ে দিলো। জানালা খোলা তাই বাইরে থেকে আলো এসে ঘরটাকে আবছাভাবে আলোকিত করে রেখেছে।
রাজু বইয়ের শেলফ থেকে কবজের বয়ামটা তার সামনে রেখে তার ছিপিটা খুলেছে। তারপর বাম হাত দিয়ে বয়ামটি তার ডান হাতেও ওপর কাত করে কবজটি বের করল। কবজটি হাতের তালুতে স্পর্শ করা মাত্রই সে ধাতব কবজের শীতল স্পর্শ অনুভব করে। রাজু তার মুঠি বন্ধ করতেই তার মনে হলো কবজটি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শুধু তা-ই নয়, রাজুর স্পষ্ট মনে হলো কবজটি একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো তার হাতে নড়ছে। রাজু নিশ্বাস বন্ধ করে থাকে, যদি এটি বেশি উত্তপ্ত হয়ে যায় তাহলে সে ধরে রাখতে পারবে না তখন এটাকে তখন হাত থেকে ফেলে দিতে হবে।
রাজুর মনে হতে থাকে তার মাথা অল্প অল্প ঘুরছে, তার চেতনা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সে জোর করে চোখ খুলে রাখল এবং অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চারপাশের দৃশ্য কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। সে ঘরের দরজা, মাথার কাছের জানালা, পড়ার টেবিল, বুক শেলফ সবকিছুই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু সেগুলোকে বাস্তব জগতের মনে হচ্ছে না। সবগুলো যেন একটি পরাবাস্তব জগতের। রাজু জোর করে তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে মনে হয় তার চারপাশে অস্পষ্ট কিছু ছায়ামূর্তি এসে তাকে ঘিরে ধরছে। ধীরে ধীরে তারা স্পষ্ট হতে শুরু করে, রাজু তাদের চোখের তীব্র দৃষ্টি দেখতে পায়। ছায়ামূর্তিগুলো তাদের হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতে থাকে, রাজুর মনে হলো সে তাদের হাতের স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করেছে। রাজু দেখতে পায় ছায়ামূর্তিগুলো ফিসফিস করে কথা বলছে, সে তাদের অস্পষ্ট কথা শুনতে পায় কিন্তু তারা কী নিয়ে কথা বলছে সে বুঝতে পারে না। রাজু চারপাশে তাকায়। ছায়ামূর্তির সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। তাদের হাতগুলো ক্রমাগত তার দিকে আসছে। তাদের মুখের মাঝে একধরনের ব্যাকুল অভিব্যক্তি। রাজুর মনে হতে থাকে ছায়ামূর্তিগুলো বুঝি তার সাথে কথা বলতে চায়। তারা কী কথা বলবে?
রাজু আর সহ্য করতে পারল না, সে হাত থেকে কবজটি জেলির কৌটার মাঝে রেখে দিলো। সাথে সাথে চারপাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে 1 ছায়ামূর্তিগুলো মিলিয়ে যায়। রাজু আবার তার পরিচিত জানালা, পড়ার টেবিল, বুক শেলফ দেখতে পেল।
রাজু বিছানা থেকে উঠে ঘরের বাইরে গেল। পানির বোতল থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে এক ঢোকে পুরো পানিটা খেয়ে ফেলে। তারপর আবার তার বিছানায় বসে। আবার জেলির বয়াম থেকে কবজটি বের করে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ খুলে তাকাল। ধীরে ধীরে ছায়ামূর্তির সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সেগুলো আবার চাপাস্বরে তাদের কথা বলতে থাকে। রাজু অস্পষ্টভাবে তাদের কথা শুনতে পায় কিন্তু কথা বুঝতে পারে না। কণ্ঠস্বরে একধরনের হাহাকার শুধু শুনতে পায়।
হঠাৎ করে চারপাশের ছায়ামূর্তির মাঝে একধরনের অস্থিরতা লক্ষ করে। সেগুলো এদিক-সেদিক তাকায়, তাদের ভেতরে সুস্পষ্ট আতঙ্ক। কী জন্য তাদের ভেতর আতঙ্ক সে বুঝতে পারে না। রাজু ভালো করে তাকায় চারপাশের অস্পষ্ট জগৎটি ভালো করে বোঝার চেষ্টা করে। রাজু একটু অবাক হয়ে দেখল ছায়ামূর্তিগুলো হঠাৎ করে সরে যাচ্ছে, তার চারপাশ একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। কোনো একটা কারণে ছায়ামূর্তিগুলো ভয় পেয়েছে।
রাজু একটু পরেই কারণটা বুঝতে পারল। ভয়ংকর দর্শন একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। তার কুচকুচে কালো শরীর। ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি। হাতগুলো কিলবিল করে নড়ছে। শরীর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, সেই ধোঁয়ার বিচিত্র গন্ধ। প্রাণীটি মুখ দিয়ে অব্যক্ত শব্দ করছে। হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জন। রাজুর সামনে প্রাণীটি দাঁড়িয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে—রাজু আর্তচিৎকার করে হাত থেকে কবজটা ফেলে দেয়। সাথে সাথে সে ভয়ংকর প্রাণীটি অদৃশ্য হয়ে যায়। চারিদিক আবার আগের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রাজু কুলকুল করে ঘামছে। বুকের ভেতর ধকধক করে শব্দ করছে। সে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। আবার কবজটি ধরবে কি না বুঝতে পারছি না। কবজটি হাতে মুঠি করে ধরলে নিশ্চিতভাবেই সে একটা অশরীরী জগৎ দেখতে পাচ্ছে কিন্তু সেই জগতের সাথে সে যোগাযোগ করতে পারবে কি না বুঝতে পারছে না। রাজু মিলিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছিল কিন্তু এই বিশাল জগতে সে কি মিলিয়াকে খুঁজে পাবে?
রাজু অনেক কষ্ট করে সাহস সঞ্চয় করল তারপর আবার কবজটি মুঠিতে চেপে ধরল। আবার তার চারপাশে একটি অশরীরী জগৎ দেখতে পায়। দূর থেকে ছায়ার মতো কিছু একটা ভেসে আসে তারপর তাকে ঘিরে থাকে, কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের কথা সে বুঝতে পারে না। এই ছায়ামূর্তিগুলোর ভেতর একধরনের হাহাকারের মতো হতাশা আছে সেটি সে অনুভব করতে পারে কিন্তু তাদের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারে না।
রাজুর মনে পড়ল পুরানো ঢাকার ফুটপাথ থেকে সংগ্রহ করা নোট বইয়ে লেখা ছিল যখনই তার কোনো একটা বিদেহী আত্মার সাথে সংযোগ করতে হয়েছে তখনই সেই মানুষটি গভীরভাবে সেই বিদেহী আত্মার কথা চিন্তা করেছে। তখন সেই বিদেহী আত্মা তার সাথে যোগাযোগ করেছে। রাজু কি এখন গভীরভাবে মিলিয়ার কথা চিন্তা করে চেষ্টা করে দেখবে? কাজটি তো কঠিন কিছু নয়।
রাজু চোখ বন্ধ করে মিলিয়া কথা চিন্তা করতে থাকে। হাসি-খুশি একটি মেয়ে, জীবনের কোনো জটিলতা নিয়ে সে কখনো মাথা ঘামায়নি। রাজুর সাথে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কোনো কথা ছিল না, তবু কীভাবে জানি একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল—মনে হয় না হলেই ভালো ছিল, তাহলে রাজু হয়তো এত গভীরভাবে তার অভাবটা অনুভব করত না। রাজু চোখ বন্ধ করে মিলিয়াকে মনে মনে ডাকে, “মিলিয়া—মিলিয়া—তুই কোথায়? আয় মিলিয়া—আয় একটিবার দেখা দিয়ে যা—প্লিজ মিলিয়া—প্লিজ—”
রাজু কতক্ষণ মিলিয়াকে ডেকেছে সে জানে না, হঠাৎ করে সে একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেল—মিলিয়ার মতো কণ্ঠস্বর কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাস্য শূন্যতা, অচিন্তনীয় হাহাকার।
রাজু চোখ খুলে তাকায়, অবাক হয়ে দেখে ধবধবে একটা সাদা কাপড় পরে তার সামনে মিলিয়া দাঁড়িয়ে আছে, বাতাসে তার কাপড় উড়ছে, মাথার চুল উড়ছে। মিলিয়ার মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে, চোখগুলো ধকধক করে জ্বলছে। মিলিয়া কাঁদা গলায় বলল, “রাজু! রাজু তুই কোথায়?”
রাজু বলল, “এই তো। এই তো আমি।”
“আমার কী হয়েছে রাজু? আমি কেন কাউক দেখতে পাই না? আমি কোথায় রাজু?”
রাজু আবার ফিসফিস করে বলল, “এই যে মিলিয়া, আমি তোর সামনে! আমাকে দেখতে পাচ্ছিস না তুই?”
মিলিয়া ভাঙা গলায় বলল, “হ্যাঁ রাজু। আমি এখন দেখছি, তোকে দেখছি।” তারপর হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। রাজু কী করবে বুঝতে পারল না। নরম গলায় বলল, “কাঁদিস না মিলিয়া। প্লিজ তুই কাঁদিস না।”
মিলিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কেন আমাকে মেরে ফেলল? কেন? আমি কী করেছি বল?”
রাজু কী বলবে বুঝতে পারল না। মিলিয়া আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “তুই আমাকে বল রাজু—আমি শাফকাতের কী করেছি? কেন শাফকাত আমাকে মেরে ফেলল?”
রাজু একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে, “কে তোকে মেরে ফেলেছে? কে?”
মিলিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, “শাফকাত। কেন শাফকাত আমাকে মেরে ফেলল? কেন?”
রাজু থরথর করে কাঁপতে থাকে। কোনোমতে আবার বলল, “কে? কে তোকে মেরেছে?”
“শাফকাত। সমুদ্রের কিনারায় গাড়িটা পার্ক করে সে গাড়ির ড্যাশ বোর্ড থেকে একটা রিভলবার বের করেছে। তারপর আমার মাথার দিকে তাক করে ট্রিগার টেনেছে। গুলি করলে অনেক শব্দ হয়ে রাজু?”
রাজু কোনো কথা বলল না, থরথর করে কাঁপতে লাগল। মিলিয়া আবার বলল, “আমি কিন্তু কোনো শব্দ শুনিনি রাজু। কোনো শব্দ শুনিনি শুধু হঠাৎ করে সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেল। আমি দেখলাম চারিদিকে শুধু আলো আর আলো, আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে—কিছু দেখতে পারছি না। শুধু বুকের মাঝে কষ্ট। অনেক কষ্ট।” মিলিয়া আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, বলল, “যাকে আমি এত ভালোবেসেছি সে কেন আমার মাথার মাঝে গুলি করেছে? তুই জানিস রাজু? জানিস?”
রাজু কোনো কথা বলল না, অবাক হয়ে মিলিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মিলিয়া আবার ফিসফিস করে বলল, “মনে আছে রাজু, তুই বলেছিলি শাফকাত হচ্ছে সাইকোপ্যাথ? মনে আছে? আসলেই কি মানুষ কখনো সাইকোপ্যাথ হয়?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি না মিলিয়া। আমি জানি না।”
মিলিয়া একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল, বলল, “জানিস রাজু, এই জগৎটা অন্য রকম। এখানে নাকি কোনো দুঃখ নাই, কষ্ট নাই, রাগ নাই, হিংসা নাই—কিন্তু তাহলে আমার মনের মাঝে এত কষ্ট কেন? রাজু, আমার এই কষ্টটা দূর হবে কবে?”
রাজু কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু থেমে গেল। সে অবাক হয়ে দেখল ঠিক মিলিয়ার মতো ধবধবে সাদা পোশাক পরা একটা ছায়ামূর্তি মিলিয়ার পাশে ধীরে ধীরে রূপ নিতে শুরু করেছে। রাজু অবাক হয়ে দেখে ছায়ামূর্তিটির যেন একটি দেবীর প্রতিমূর্তি। মূর্তিটি খুব ধীরে ধীরে মিলিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে, “মা, তোর কষ্ট দূর হবে মা। অবশ্যই দূর হবে। মাত্র পৃথিবী থেকে এসেছিস তাই তোর বুকে এত কষ্ট। ধীরে ধীরে সব কষ্ট ভুলে যাবি। দেখবি তখন মনে হবে পৃথিবীর মানুষেরা কত অবুঝ—আয় তুই আমার সাথে। আমাদের ছেড়ে তুই একা একা কেন এখানে চলে এসেছিস?”
মিলিয়া ফিসফিস করে বলল, “রাজু আমাকে ডাকল-”
ধবধবে সাদা মূর্তিটি রাজুর দিকে তাকাল, বলল, “বাবা রাজু, তোমার অনেক ক্ষমতা বাবা। অনেক ক্ষমতা। তুমি ডাকলে সবাইকে আসতে হবে। তাই তুমি শুধু শুধু কাউকে ডেকো না। শুধু যখন প্রয়োজন হবে—
রাজু কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কে?”
“যখন সময় হবে তখন তুমি জানবে আমি কে।”
“মিলিয়া একটা ভয়ানক কথা বলেছে—মিলিয়া বলেছে—”
মহিলা হাত তুলে রাজুকে থামাল। বলল, “বাবা এগুলো তোমাদের পৃথিবীর কথা বাবা—আমরা পৃথিবীর কথা নিয়ে মাথা ঘামাই না। পৃথিবীর সব কথা পৃথিবীতে রেখে এখানে আসতে হয়। একদিন তুমিও আসবে—”
“কিন্তু কিন্তু—আমি মিলিয়ার সাথে কথা বলতে চাই।”
“বলবে। অবশ্যই বলবে বাবা। এখন সে খুব অস্থির। আমরা তাকে আগে শান্ত করি। তার বুকের হাহাকারটি দূর করি। তাকে একটু সান্ত্বনা দিই। শান্তি দিই।”
রাজু কী বলবে বুঝতে পারল না। মহিলাটি বলল, “তোমার অনেক ক্ষমতা বাবা। তুমি ডাকলে মিলিয়া আসবে। তোমার কোনো ভয় নেই বাবা।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।” তারপর মিলিয়ার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুই মনে দুঃখ পাস নে মিলিয়া। আমি শাফকাতকে ছাড়ব না। কিছুতেই ছাড়ব না।” রাজু হিংস্র গলায় বলল, “তোকে কথা দিচ্ছি মিলিয়া—কথা দিচ্ছি।”
* * *
পৃথিবীর অন্য প্রান্তে টেলিভিশনে প্রোগ্রাম দেখতে দেখতে সোফায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া শাফকাত হঠাৎ ভয়ংকর আতঙ্কে চিৎকার করে জেগে উঠল।
শাফকাত বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে অবাক হয়ে চারিদিকে তাকায়। কেন হঠাৎ করে সে এ রকম ভয়ংকর আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছে? কী হয়েছে তার?
কেন তার মনে হচ্ছে ভয়ংকর একটা বিপদ নেমে আসছে তার ওপর?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন