নকশা-কাটা কবজ – ৩

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর সবাই বের হয়ে গেছে, ক্লাস রুমটা ফাঁকা। রাজু পিছনের দিকের একটা বেঞ্চে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছে। বইটা যথেষ্ট চমকপ্রদ, সমাজতন্ত্র ঠেকানোর জন্য ইন্দোনেশিয়ায় কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মারা হয়েছে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা শেষ করে লাতিন আমেরিকাকে কীভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে সেটা পড়তে শুরু করেছে তখন কেউ একজন তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে বলল, “কী পড়ছিস এত মনোযোগ দিয়ে?”

রাজু পিছনে ফিরে তাকাল, মিলিয়াকে দেখে বইটা বন্ধ করে হাসি হাসি মুখে বলল, “বই।”

মিলিয়া বলল, “আজকাল কেউ বই পড়ে নাকি?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্। পড়ে না।”

“তাহলে?”

“আমি আবার হিসাবের মাঝে পড়ি নাকি?”

মিলিয়া একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “কী বই?”

রাজু বইয়ের মলাট দেখাল, জন পার্কিন্সের লেখা ‘অর্থনৈতিক আততায়ীর স্বাকারোক্তি’। নীলক্ষেতে পুরানো বইয়ের দোকানে সস্তায় পেয়ে গেছে। মিলিয়া ভুরু কুঁচকে বলল, “জ্ঞানের বই? আঁতেল?”

রাজু উত্তর না দিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল। অপরাধ স্বীকারে করে নেওয়ার মতো হাসি।

“বিকালে কী করছিস?”

রাজু একটু অবাক হলো, জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“ফ্রি থাকলে তোকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।”

রাজু আরেকটু বেশি অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, “কার সাথে?”

“শাফকাতের সাথে।”

রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “শাফকাত? মানে তোর যার সাথে বিয়ে?”

“হ্যাঁ। আমার ফিয়ান্সে।”

“দেশে এসেছে?”

“হ্যাঁ।”

“বিয়ে করতে?”

মিলিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “মনে হয়।”

রাজু মিলিয়ার মুখের দিকে তাকাল, সেখানে এখন আনন্দের একটা আভা থাকার কথা ছিল—নেই।

রাজু জিজ্ঞেস করল, “এত মানুষ থাকতে তুই শাফকাতের সাথে আমার পরিচয় করাতে চাচ্ছিস কেন?”

মিলিয়া বলল, “তুই আঁতেল। শাফকাতও আঁতেল। সেই জন্য।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “তুই ভুল করছিস, আমি আঁতেল না।”

“আঁতেল হচ্ছে গালি, তাই যারা আঁতেল তারা কখনো স্বীকার করে না যে তারা আঁতেল।”

“তুই আমাকে গালি দিচ্ছিস?”

“সমস্যা আছে?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না সমস্যা নাই।” একটু হেসে বলল, “আঁতেল ছাড়া আর কোনটা গালি?”

মিলিয়া কোনোরকম চিন্তা না করে সাথে সাথে উত্তর দিলো, “ভিআইপি হচ্ছে গালি। সেলিব্রেটি হচ্ছে গালি।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ।” মিলিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “বিকেলে ফ্রি আছিস?”

আসলে রাজুর বিকেলে তার টিউশনিতে যাবার কথা, কিন্তু সেটা বলতে তার লজ্জা করল। বলল, “মোটামুটি।”

“তাহলে ক্যাম্পাসে থাকিস। তোকে তুলে নেব।”

“কোথায় নিবি?”

“কোনো একটা ক্যাফেতে।”

মিলিয়া চলে যেতে যেতে থামল, বলল, “তোর কোনো সমস্যা নাই তো?”

“ইংরেজিতে কথা বলতে হবে?”

“না। শাফকাত ভালো বাংলা জানে।”

“তাহলে কোনো সমস্যা নাই। শুধু একটা প্রশ্ন।”

“কী প্রশ্ন?”

“বেচারা আমেরিকা থেকে এসেছে তোর জন্য, এখন তোরা ঘুরে বেড়াবি, আমাকে তোদের মাঝখানে টেনে আনছিস কেন? কাবাব মে হাড্ডির মতো–”

মিলিয়া বলল, “তুই কয় রকম কাবাব খেয়েছিস? অনেক কাবাবে হাড্ডি থাকতে হয়, না-হলে খেতে টেস্ট হয় না।”

“ঠিক আছে। আমার কাজ হচ্ছে টেস্ট বাড়ানো?”

মিলিয়া হি হি করে হাসল। সে চলে যাবার পর রাজু আবার বইটাতে ফিরে গেল। কিন্তু বইয়ে মনোযোগ দিতে পারল না। এতদিন মিলিয়া মেয়েটির সাথে তার ভদ্রতার হুঁ-হাঁ ছাড়া সে রকম কথা হয় নাই। সেদিন বইয়ের দোকানে তার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে মনে হয় মেয়েটা তাকে অন্যভাবে দেখছে। শাফকাতের সাথে পরিচয় করানোর জন্য তাকে নিয়ে যাবে, ব্যাপারটা যথেষ্ট বিচিত্র। সে শাফকাতের সাথে কী নিয়ে কথা বলবে?

রাজু কিছুক্ষণ বই পড়ার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াল। সে যে মেয়েটিকে টিউশনি করায় তাকে বলতে হবে আজ বিকেলে সে আসতে পারবে না। মেয়েটা মনে হয় খুশিই হবে। লেখাপড়ার বিষয়টা মেয়েটা কিংবা তার বাবা-মা কেউ ধরতে পারেনি। তাদের ধারণা ভালো কলেজে ভর্তি করে অনেকগুলি টিউটর রেখে দিলেই লেখাপড়া ভালো হতে থাকে—নিজেকেও যে চেষ্টা করতে হয়, সেটা মনে হয় জানেই না।

.

মিলিয়ার টেলিফোন পেয়ে রাজু বের হয়ে এলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সে গাড়ির হর্ন শুনল, রাস্তার এক পাশে মিলিয়া তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাজু এগিয়ে গেল, ড্রাইভিং সিটে মিলিয়া স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে আছে, পাশের সিটে একজন সুদর্শন মানুষ, চোখে কালো চশমা। রাজু কাছে আসতেই মিলিয়া গাড়ির কাচ নামিয়ে বলল, “রাজু পিছনে ঢুকে যা।”

রাজু দরজা খুলে পিছনে ঢুকল। সিটের ওপর ব্যাগ আর কিছু প্যাকেট ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। সেগুলো সরিয়ে জায়গা করে রাজু বসে যায়। মিলিয়া শাফকাতকে বলল, “শাফকাত, এ হচ্ছে রাজু, আমাদের সাথে পড়ে।” তারপর রাজুকে বলল, “রাজু—”

রাজু কথা শেষ করতে দিলো না, বলল, “বুঝেছি, ইনি শাফকাত।”

শাফকাত পিছনে ঘুরে দুই সিটের মাঝখান দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য, রাজু হ্যান্ডশেক করল, মানুষটা সুদর্শন, পুরুষালি চেহারা কিন্তু হাতটা নরম তুলতুলে। শাফকাত বলল, “নাইস টু মিট ইউ। মিলু বলেছে তুমি নাকি খুব ব্রিলিয়ান্ট—”

মিলিয়ার নামটা মুচড়ে মিলু করে বলেছে—যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হলে মনে হয় এ রকম করার অধিকার হয়ে যায়। মানুষটা রাজুকে তুমি করে সম্বোধন করছে, তার মানে সেও কি তুমি সম্বোধন করবে? প্রথম দেখাতেই কেউ তাকে তুমি বলে সম্বোধন করলে রাজুর বিরক্তি হয়। রাজু অবশ্যি তার বিরক্তিটা বুঝতে দিলো না, হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মিলিয়া আমাকে ব্রিলিয়ান্ট বলেছে? আমি মনে হয় ব্রিলিয়ান্ট বানানও শুদ্ধ করে করতে পারব না।”

শাফকাত বলল, “এগুলো হচ্ছে ব্রিলিয়ান্ট হওয়ার লক্ষণ।”

মিলিয়া কোনো কথা না বলে গাড়িটাকে ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে সাবধানে রাস্তায় বের করে আনে। একটা রিকশাকে বিপজ্জনভাবে পাশ কাটিয়ে সে এক্সেলেটরে চাপ দিলো। শাফকাত তখন মাথা ঘুরিয়ে মিলিয়ার দিকে তাকাল, বলল, “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম—এক্সিট নিয়ে বের হওয়ার জন্য যেই ব্রেকে চাপ দিয়েছি গাড়িটা পুরো হান্ড্রেড এইটি ডিগ্রি ঘুরে গেল—”

রাজু একটা সূক্ষ্ম অপমান অনুভব করে। তাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে শাফকাত মিলিয়াকে তার অসমাপ্ত গল্পটি শোনাতে শুরু করেছে। তুষার ঝড়ের মাঝে গাড়ি চালাতে গিয়ে কী রকম বিপজ্জনকভাবে তার গাড়িটা রাস্তার মাঝে স্কিড করতে শুরু করেছে তার নিখুঁত বর্ণনা। পিছনের সিটে যে রাজু নামের একজন আস্ত মানুষ বসে আছে সেটা মনে হয় তারা ভুলেই গেছে।

রাজু তার ব্যাকপ্যাকটা থেকে জন পার্কিন্সের বইটা বের করে। চলন্ত গাড়িতে সে আগে কখনো বই পড়ার চেষ্টা করে নাই। কাজটা খুব সহজ নয়। কিন্তু এখন বই পড়াটি মূল উদ্দেশ্য নয়—তাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার অপমানটি থেকে নিজেকে রক্ষা করার একটি চেষ্টা। রাজু বইটি খুলে পড়ার চেষ্টা করে। পড়তে পারবে আশা করেনি কিন্তু সৌদি যুবরাজদের সাথে আমেরিকান এজেন্টদের রগরগে কাহিনিতে সে মোটামুটি ডুবে যেতে পারল।

“এই রাজু!”

মিলিয়ার ডাক শুনে রাজু মাথা তুলে তাকাল, বলল, “হ্যাঁ—”

“তুই বই পড়া শুরু করে দিয়েছিস? তোকে আনলাম কথা বলার জন্য।”

রাজু বই বন্ধ করতে করতে বলল, “আমি যে ব্রিলিয়ান্ট সেটা প্ৰমাণ করতে হবে না?” তারপর একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “তোরা কথা বলছিলি তাই ডিস্টার্ব করতে চাই নাই।’”

মিলিয়া কী বুঝল কে জানে, কথা না বাড়িয়ে বলল, “কোথায় যাব সেটা নিয়ে কারো কোনো সাজেশন আছে?”

রাজু আর শাফকাত প্রায় একসাথে বলল, “না। নাই।”

“ঠিক আছে, আমি তাহলে একটা পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাই। জায়গাটা কিন্তু নিরিবিলি না—হাউকাউ একটু বেশি।”

রাজু বলল, “হাউকাউ আমার জন্য সমস্যা না। আমার ভালোই লাগে।”

শাফকাত কোনো কথা বলল না, আঙুল দিয়ে জানালার কাচে টুকটুক শব্দ করতে লাগল।

.

ক্যাফেটাতে যথেষ্ট ভিড় কিন্তু মিলিয়া তার মাঝে একটা টেবিলের ব্যবস্থা করে ফেলল, বোঝা গেল এখানে সে প্রায়ই আসে এবং তাকে একটু আলাদাভাবে খাতির করা হয়। ছোট টেবিলটা ঘিরে তিনজন বসার পর রাজু শাফকাতকে আরেকটু ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেল। কালো চশমা পরে থাকার কারণে তার চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকু দেখে বোঝা যায় মানুষটা যথেষ্ট সুদর্শন। রাজু যে রকম শাফকাতকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ পেয়ে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, মনে হয় শাফকাতও তাকে সেভাবে দেখছে। মানুষের চেহারা সুন্দর হলেই যে তাকে দেখে স্বস্তি পাওয়া যায় তা নয়। ঠিক কী কারণ কে জানে, শাফকাতকে দেখে রাজু কেমন জানি অস্বস্তি অনুভব করে। ঠিক কী কারণে অস্বস্তি বুঝতে পারছিল না বলে তার অস্বস্তিটাও ছিল অস্বস্তিকর। বিশেষ করে চোখে কালো চশমা থাকার কারণে শাফকাত সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে না অনমনস্কভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সেটাও সে বুঝতে পারছিল না।

মিলিয়া এখানে নিয়মিত আসে, তাই সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই সবার জন্য কফি আর চিজ কেক অর্ডার দিয়ে দিয়েছে।

পানির বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে মিলিয়া বলল, “শাফকাত, তোমার যেসব প্রশ্ন আছে তুমি এখন ইচ্ছা করলে রাজুকে জিজ্ঞেস করতে পারো।”

রাজু হাসতে হাসতে বলল, “মিলিয়া, তোর কেমন করে ধারণা হয়েছে যে আমি শাফকাতের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব?”

মিলিয়া বলল, “পারবি। শাফকাত তো প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে প্রশ্ন করে, তুই প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে উত্তর দিবি! আমি প্যাঁচাতে পারি না।”

রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “আমার সম্পর্কে তোর এই ধারণা? আমি প্যাঁচাতে পছন্দ করি?”

মিলিয়া বলল, “হ্যাঁ। উত্তর জানার দরকার নাই—প্যাঁচাতে থাকবি।”

শাফকাত প্রথম বার তার কালো গগলস খুলে টেবিলে রাখল, রাজু দেখল তার চোখের রং ঠিক কালো নয়, কেমন যেন সবুজাভ—চোখের রং এ রকম হলে গ্রামে এটাকে বিড়াল-চোখা বলে। শাফকাত রাজুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল, বলল, “আমার প্রশ্নটা খুবই সোজা। জিজ্ঞেস করব?”

রাজু মাথা নাড়ল। শাফকাতের চেহারাটাকে এখন কেমন যেন নিষ্ঠুর মনে হতে থাকে। শাফকাত তার বিড়ালের মতো চোখে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা দেশ চালাতে ব্রিলিয়ান্ট মানুষের দরকার হয়। এই দেশের সব ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়েরা আমেরিকা চলে যায়। তাহলে দেশ চালায় কারা?”.

বাংলাতেই কথা বলেছে কিন্তু আড়ষ্ট উচ্চারণ, মনে হয় ইংরেজিতে বললেই বুঝতে সহজ হতো। রাজু উত্তর না দিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল। বলল, “পাস।”

মিলিয়া বলল, “পাস মানে?”

“তাস খেলিসনি? তাস খেলার সময় দান না দিলে বলতে হয় পাস। ঠিক সে রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে না চাইলে বলতে হয় পাস।”

শাফকাত একটু ঝুঁকে কেমন যেন কঠিন গলায় বলল, “কেন? প্রশ্নের উত্তর দিবে না কেন?”

রাজুর মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে বলল, “কারণ আমি যে উত্তরই দেই সেটা তোমার পছন্দ হবে না।”

“কেন?”

“কারণ তুমি হচ্ছ সেই মানুষ যার বিরুদ্ধে তুমি কমপ্লেন করছো। তুমি ব্রিলিয়ান্ট এবং তুমি দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গেছো।”

রাজুর মনে হলো শাফকাতের মুখটা মুহূর্তের জন্য একটু কঠিন হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলল, “মিলু ঠিকই বলেছে, তুমি প্যাঁচালো মানুষ!”

ঠিক তখন মিলিয়া একটা আর্ত শব্দ করল, “ইশ!”

“কী হয়েছে?” বলে রাজু মিলিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেওয়ালে ঝোলানো বড় টেলিভিশনটার দিকে তাকাল। সেখানে নিঃশব্দে রিয়াল মাদ্রিদ এবং লিভারপুলের প্লেয়াররা জীবনপণ করে খেলছে, ঠিক তার নিচে স্ক্রলিং করে লেখা হচ্ছে কলরাডোর একটা স্কুলে একজন ঘাতক গুলি করে ঊনপঞ্চাশ জন শিশু এবং শিক্ষককে মেরে ফেলেছে।

মিলিয়া প্রায় ফ্যাকাশে মুখে বলল, “শিশু? ঊনপঞ্চাশ?”

শাফকাত টেলিভিশনের দিকে তাকাল এবং তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। বিড়বিড় করে বলল, “আরেকজন হলে হাফ সেঞ্চুরি হতে পারত।”

শাফকাতের কথা শুনে রাজু কেমন যেন শিউরে ওঠে। এ রকম একটা ঘটনা শুনে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে? মিলিয়া শাফকাতের কথা শোনেনি, সে কেমন যেন অভিযোগের গলায় শাফকাতকে বলল, “এটা তোমাদের কেমন দেশ? দুই দিন পরপর কেউ-না-কেউ স্কুলের বাচ্চাদের গুলি করে মেরে ফেলে?”

ঠিক তখন ওয়েটার এসে তাদের টেবিলে কফি আর কেক দিয়ে গেল। শাফকাত কেকের প্লেটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “এটাকে বলে কোল্যাটারেল ড্যামেজ।

মিলিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী ড্যামেজ?”

শাফকাত চামচ দিয়ে এক টুকরা কেক ভেঙে নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, “কোল্যাটারেল ড্যামেজ। বড় একটা কিছু অর্জনের জন্য ছোট মূল্য দেওয়া।”

“বড় কিছু? এখানে বড় কিছু কী?”

“স্বাধীনতা, নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার।”

রাজু হঠাৎ করে বলল, “আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

শাফকাত বলল, “কথা ছিল আমি প্রশ্ন করব তুমি উত্তর দেবে। কিন্তু উল্টো তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে চাইছো? ঠিক আছে। করো।”

“আমি তোমাকে ছোট একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। দেখব তুমি তার উত্তর দিতে পারো কি না।”

“ধাঁধা? পাজল?” শাফকাত হাসল, বলল, “আই লাইক পাজল। করো জিজ্ঞেস করো।”

রাজু এক সেকেন্ড মনে মনে কিছু একটা ঠিক করে নিল, তারপর বলল, একজন যুবতী মেয়ের মা মারা গেছে। মায়ের ফিউনারেল হচ্ছে— তোমাদের দেশে যে রকম হয়, সবাই সেজেগুজে মৃত মানুষটিকে কফিনে ভরে কবর দিতে আসে। যুবতী মেয়েটি হঠাৎ একজন অত্যন্ত সুদর্শন মানুষকে দেখতে পেল, দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে গেল, তার মনে হলো এই মানুষটিকে না পেলে সে বাঁচবে না।”

রাজু একটু থামল, শাফকাত জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”

পরের সপ্তাহে যুবতী মেয়েটি তার বোনকে খুন করে ফেলল। কেন?”

মিলিয়া প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “নিজের বোনকে খুন করে ফেলল, কী সর্বনাশ!”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। বলতে হবে কেন?”

শাফকাত হা হা করে হেসে ফেলল, বলল, “কারণ তার বোনের ফিউনারেল হবে, তখন আবার সেই হ্যান্ডসাম মানুষটা আসবে, মেয়েটা তাকে দেখবে—”

রাজু বলল, “গুড। কারেক্ট অ্যানসার। সঠিক উত্তর।”

মিলিয়া বলল, “কী ভয়ংকর! কী জঘন্য কথা।”

শাফকাত ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি এই আজব পাজল কোথায় পেয়েছো?”

“কোনো একজনের কাছে শুনেছি। শতকরা একজন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। বলা হয়, শুধুমাত্র যারা সাইকোপ্যাথ তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। অন্যরা পারে না।”

শাফকাত স্থির দৃষ্টিতে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তুমি বলতে চাইছো আমি সাইকোপ্যাথ?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি বলতে চাইছি, যারা সাইকোপ্যাথ তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে—অন্যরা পারে না সেটা কেউ বলেনি। পারতেও পারে।”

শাফকাতের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, “মিলু ঠিকই বলেছে, তুমি আসলেই একজন প্যাঁচালো মানুষ।”

মিলিয়া নিঃশব্দে দুইজনের কথা শুনছিল, এবারে জিজ্ঞেস করল, “যাদের কোনো বিবেক নেই তাদেরকে বলে সাইকোপ্যাথ। তাই না? সাইকোপ্যাথরা নাকি নিজের মা’কেও কেটেকুটে বাজারে বিক্রি করে দিতে পারে। সত্যি নাকি?”

কেউ মিলিয়ার কথার উত্তর দিলো না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন