নকশা-কাটা কবজ – ৮

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

রাজু টেবিলেও ওপর তার পা দুটি তুলে খবরের কাগজটি মেলে ধরে। তারা কয়েকজন মিলে এই অ্যাপার্টমেন্টে মেস করে থাকে। এই মেসের কোনো একজন কোনো এক সময়ে একটা খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করত বলে এখানে তার জন্য একটা ফ্রি পত্রিকা দেওয়া হতো। সেই মানুষটি অনেক দিন হলো এই মেস ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু হকার এখনও নিয়মিতভাবে তার ভাগের খবরের কাগজ দিয়ে যাচ্ছে। কেউই হকারকে খবরটা দেয় নাই, একটা মাগনা পত্রিকা খারাপ কী? খবর পড়া যায়, টেবিলেও ওপর বিছিয়ে তার ওপর কালিমাখা ডেকচি রাখা যায়। গভীর রাতে তেলাপোকা বের হলে খবরের কাগজ পাকিয়ে সেটা দিয়ে তেলাপোকাও মারা যায়। খবরের কাগজের ব্যবহারের কোনো শেষ নেই।

রাজু খবরের কাগজের ওপর চোখ বুলায়। বিদ্যুৎ ঘাটতির ওপর একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হচ্ছে হেড লাইন। রাজু কয়েক লাইন পড়ে হাল ছেড়ে দেয়। সরকারে নীতির সমালোচনা করতে চাইছে কিন্তু সরাসরি বলতে সাহস পাচ্ছে না। তাই ধরি মাছ না ছুঁই পানি জাতীয় প্রতিবেদন। ভেতরে নানা ধরনের সংখ্যা এবং ডলারের হিসাব। রাজু রাজনীতির খবর একটু পড়ল। রাজনৈতিক নেতাদের সাহস একটু বেশি, তারা খোলামেলাভাবে গালিগালাজ করতে পারে। আগে ভাবত শুধু আমাদের দেশের নেতারা এ রকম কাঁচা খিস্তি করে এখন দেখেছে সব দেশের নেতারাই একরকম। খবরের কাগজের মাঝখানে বুদ্ধিজীবীদের কলাম, এটি খুবই বিচিত্র। বুদ্ধিজীবীরা সবাই সবকিছু জানে, কেমন করে এটি হতে পারে সেটি একটি রহস্য। লেখাপড়ার একটা পৃষ্ঠা থাকে, সেখানে গাইড বই থেকে প্রশ্ন আর উত্তর দেওয়া থাকে। রাজু খেলাধুলা আর সিনেমার পৃষ্ঠাতে চোখ না বুলিয়েই উল্টে যায়। আন্তর্জাতিক খবরগুলো সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। মফস্বলের খবর সাধারণত খুন-খারাবির খবর এবং দুর্ঘটনার খবর। চোখ বুলিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে কোনার একটা খবরে চোখ পড়ে। খবরের শিরোনাম, ‘গোরস্থানে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু”।

রাজু খবরটিতে চোখ বুলিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে বসে। সে তখন আবার খবরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। সেখানে লেখা :

নিজস্ব প্রতিবেদক : কুসুমডাঙ্গা এলাকায় সরকারি গোরস্থানে গত মঙ্গলবার একটি রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় গ্রামের মতিউর রহমান (২৭) নামের একটি যুবকের মৃতদেহ গোরস্থানের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাওলানা ভোররাতে একটি খুঁড়ে রাখা কবরের পাশে খুঁজে পান। মতিউর রহমানের মৃতদেহ ছিল পুরোপুরি রক্তশূন্য এবং তার দেহের ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ড ও যকৃৎ ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। স্থানীয় থানার ওসি বলেছেন মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে এখানে জনশ্রুতি আছে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে একজন পিশাচ সাধকের দেহে জিগিরা নামক অপদেবতা ভর করলে তাকে কৌশলে এখানে কবরস্থ করা হয়। মতিউর রহমান কৌতূহলী হয়ে এই কবর খুঁড়ে অপদেবতাকে মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় তার এই পরিণাম ঘটে। অপদেবতা জিগিরা স্থানীয় এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করেছে বলে আশেপাশের গ্রামে নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।

স্থানীয় কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই জনশ্রুতি পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক এবং গ্রাম্য কুসংস্কার। মতিউর রহমানের মৃত্যুর পিছনে স্থানীয় দুষ্কৃতকারী এবং বন্য পশুর ভূমিকা থাকতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।

রাজু ভুরু কুঁচকে খবরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরানো ঢাকার ফুটপাথ থেকে সে যে পুরাতন বই আর নোট বই কিনেছিল, সেখানেও জিগিরা নামে একটি অপদেবতার কথা বলা হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল সম্ভবত জিগিরাকে কোনো প্রেতসাধক বন্দি করে রেখেছে। এই খবরের তথ্য অনুযায়ী জিগিরা শেষ পর্যন্ত বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছে!

রাজু একটা নিশ্বাস ফেলল, সে মিলিয়ার সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছিল, মনে আছে সে মিলিয়াকে জিগিরা নামটাও বলেছিল এবং ভূতের সর্দার হিসেবে জিগিরা সর্দার নাম নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। মিলিয়া এক সপ্তাহ আগে শাফকাতের সাথে আমেরিকা চলে গেছে। দেশে থাকলে তাকে জিগিরার এই খবরটি পড়ে শোনানো যেত।

আমেরিকা যাওয়ার পর রাজুর আর মিলিয়ার সাথে যোগাযোগ হয়নি। মিলিয়ার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, ওখানে সে ভালোই আছে। আমেরিকায় তার বাসার ভেতরের ছবি পাঠিয়েছে। রাজু আগ্রহ নিয়ে ছবিটা দেখেছে, কয়েক দিনের জন্য মেয়েটার সাথে একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে আবার সে দূরে চলেও গেছে। আর কোনোদিন হয়তো দেখাও হবে না। কী কারণ কে জানে, রাজুর মনে হয় শাফকাতের সাথে মিলিয়ার জীবনটা খাপ খাবে না। সে মিলিয়া কিংবা শাফকাত কাউকেই ভালো করে চেনে না। কিন্তু তারপরও এ রকম কেন মনে হয় কে জানে!

রাজু খবরটা দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকের তারপর হঠাৎ করে সে একটা বিচিত্র সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে কুসুমডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে নিজের চোখে সবকিছু দেখে আসবে! খবরের কাগজে প্রতিদিন আরো কত বিচিত্র খবর ছাপা হয়, এর আগে কখনোই সেই সব খবর যাচাই করার জন্য তার কোনো কৌতূহল হয় নাই। আজকে হঠাৎ করে তার কৌতূহল কেন হলো সে জানে না।

* * *

বাস থেকে নেমে রাজু একটা রিকশা নিয়ে কবরস্থানে চলে এসেছে। খবরের কাগজে খবরটা পড়ে সে যে রকম উত্তেজিত হয়ে চলে এসেছে গ্রামের মানুষের মাঝে সে রকম কোনো উত্তেজনা নেই। রিকশা থেকে নেমে রাজু এদিক-সেদিক তাকাল, এক কোনায় গাছপালা দিয়ে ঢাকা একটা ছোট ঘর। ঘরের পাশে একটা এঁদো ডোবা। একজন থুথুড়ে বুড়ো সেই ডোবায় থালা-বাসন ধুচ্ছে। রাজু অনুমান করল এই বুড়ো মানুষটি নিশ্চয়ই খবরের কাগজের সেই মাওলানা, যে মৃত যুবকটিকে প্রথম দেখেছিল। বুড়ো মানুষটি নিজেই তার থালা-বাসন ধুচ্ছেন দেখে রাজু আরো অনুমান করে নিল, মানুষটি এত বয়সেও একা থাকেন, নিজের কাজ নিজে করেন।

রাজু কীভাবে এই বুড়ো মানুষটির সাথে আলাপ শুরু করবে বুঝতে পারল না। তাই কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করে ডোবার কিনারায় দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “হুজুর, আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

বুড়ো মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, কানে হাত দিয়ে বলল, “কী বলছো বাবা?”

বোঝা গেল মানুষটি কানে কম শোনেন। রাজু তখন আরো খানিকটা নেমে মৌলভি সাহেবের কাছাকাছি গিয়ে বলল, “হুজুর, আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?”

“তুমি কে বাবা? সাম্বাদিক?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “জি না হুজুর, আমি সাংবাদিক না।”

“তাহলে কী নিয়ে কথা বলতে চাও?”

রাজু একটু মাথা চুলকে বলল, “মনে করেন এই যে কবরস্থানে একটা মার্ডার হলো সেটা নিয়ে।”

মৌলভি সাহেব একটা নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, “আমি যা জানি সব তো বলে ফেলেছি বাপ। পত্রিকায় চলে এসেছে। আমার তো নূতন কিছু বলার নাই।”

রাজু অপরাধীর মতো বলল, “আপনাকে নিশ্চয়ই সবাই কয়দিন থেকে ডিস্টার্ব করছে। আমি আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই আর কয়টা প্রশ্ন করতে চাই।”

“কী দেখাবে বাবা?”

“একটা নোট বই। অনেক বছর আগে একজন পিশাচ সাধনা করত, সে তার নোট বইয়ে কিছু কথা লিখেছে, সেইটা আপনাকে দেখাতাম।”

মৌলভি সাহেবের মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ রাজুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “আজকালকার শিক্ষিত মানুষ তো এইগুলা বিশ্বাস করে না। কলেজের মাস্টার বলেছে আমি নাকি ভুয়া কথা বলি—”

রাজু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “আমি সেইটা একবারও বলি নাই হুজুর। আমি বরং একটা জিনিস দেখাব -”

মৌলভি সাহেব বললেন, “তুমি আমার বারান্দায় বসো। আমি থালা-বাসন পাকঘরে রাইখা আসি।”

মৌলভি সাহেবের বারান্দায় একটা নড়বড়ে বেঞ্চ আছে, রাজু সেখানে বসল। একটু পরে মৌলভি সাহেব এসে বেঞ্চের অন্য মাথায় গিয়ে বসলেন। রাজু তাকে নোট বই দেখাবে সেই জন্য মৌলভি সাহেব একটা চশমা পরে এসেছেন।

রাজু তার ব্যাকপেক থেকে পুরান ঢাকার ফুটপাথ থেকে কেনা নোট বইটা বের করে বলল, “হুজুর আমি পত্রিকায় দেখেছি এইখানে যে মানুষটা মারা গেছে তার লাশটাতে কোনো রক্ত ছিল না—”

মৌলভি সাহেব বললেন, “থাকবে কেমন করে। জিগিরা সত্তর-আশি বছর থেকে না খাওয়া। তার পেটে খিদা। মতির মতো এই রকম জোয়ান মানুষের রক্ত যদি না খায় তাহলে খাবে কী?”

“জিগিরাটা কী, সেটা একটু বলবেন?”

“পিশাচ। খালি পিশাচ না, পিশাচের বাবা! তারে আগে কেউ বান্ধতে পারে নাই। আমার বাপজান বান্ধছিল। হে নিজে বান্ধে নাই, তারে এক বুজুর্গ জিন সাহায্য করছিল—”

রাজু এই বৃদ্ধ মৌলভি সাহেবের কোনো কথাই বুঝতে পারল না, পিশাচের বাবা পিশাচকে কেমন করে বাঁধে, মৌলভি সাহেবের বাবা কীভাবে সেটি করেছিলেন, সেই অসাধ্য কাজে কেমন করে একজন বুজুর্গ জিন চলে এসেছে সবই রহস্যময়। কিন্তু রাজু এই বৃদ্ধের কথায় বাধা দিলো না। কিছুক্ষণ কথা শুনলে মনে হয় তার কথার অর্থ বের হতে থাকবে।

রাজু বলল, “হুজুর, আমার একটা জিনিস এখনও পরিষ্কার হয় নাই। জিগিরাকে কি চোখে দেখা যায়?”

মৌলভি সাহেব মাথা নাড়লেন, বললেন, “না, তারে চোখে দেখা যায় না। তবে ওই কবজটা থাকলে সেইটা যদি পাকসাফ হয়ে হাতে নেও তাহলে হয়তো দেখা যেতেও পারে। আমার বাপজান বলছিল।”

রাজু এবারে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন কবজটা?”

“যেই কবজের জন্য মতি কবর খুঁড়েছে।”

“মতি কবজের জন্য কবর খুঁড়েছে?”

মৌলভি সাহেব হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, “লোভ। বুঝছো তুমি—মানুষের লোভ খুব খারাপ জিনিস। সবচেয়ে বড় পাপ। মহাপাপ। মতি লোভে পড়ল, ভাবল কবর খুঁড়ে কবজটা বের করে নিবে—আরে বেকুব আমি তোরে এত করে বললাম—”

মৌলভি সাহেব হঠাৎ থেমে গেলেন। রাজু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী বলছিলেন হুজুর?”

“বলছিলাম এই কবজ জিগিরাকে লপ সিয়াংয়ের লাশের মাঝে বাইন্ধা রাখছে। কবজ সরাইলেই জিগিরা ছাড়া পাইব। ছাড়া পাওয়ার পর জিগিরা কি দেরি করছে? করে নাই। লপ সিয়াংয়ের লাশ লইয়া মতির উপরে লাফাই পইড়া তারে কামড়াইয়া খাইয়া ফালাইছে।”

রাজু এবারে মৌলভি সাহেবের কথা খানিকটা বুঝতে পারল এবং বোঝার পর দিনদুপুরেই তার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাজু এবারে আস্তে আস্তে বলল, “হুজুর।”

মৌলভি সাহেব রাজুর দিকে তাকালেন, বললেন, “বলো।”

“ওই কবজটা এখন কোথায় আছে?”

“কে বইলতে পারে?”

“পাওয়া যায় নাই?”

“নাহ্। যে বয়ামের ভেতর ছিল সেই বয়ামটা পাওয়া গেছে। মুখ খোলা, ফাটা—কিন্তু কবজ নাই।”

“বয়ামটা কোথায় পাওয়া গেছে?”

মৌলভি সাহেব হাত দিয়ে দেখালেন, “ওই দূরে খেজুর গাছটা দেখছো?”

“জি দেখেছি।”

“তার তলায়।”

“কবজটা কি ভালো করে খুঁজেছে?”

“খুঁজে নাই মানে? মাটির মাঝে সবাই তন্নতন্ন করে খুঁজছে, পায় নাই।”

“কোথায় আছে আপনার মনে হয়?”

“পিশাচের ক্ষমতা নাই এই কবজ ছোঁয়। পিশাচ নেয় নাই। মানুষ ছাড়া আর কারো এইটা রাখার ক্ষমতা নাই। আমার বাপজানও হাত দিয়ে ছোঁয় নাই।”

“তাহলে?”

“মনে হয় জিন নিয়ে গেছে।” হঠাৎ করে মৌলভি সাহেবের মনে হলো রাজু তাকে কিছু একটা দেখাতে চেয়েছিল, আলাপে আলাপে সেইটার কথা ভুলেই গিয়েছেন। এবারে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমারে কী দেখাবা বাবা?”

রাজু এবারে হাতে ধরে রাখা নোই বইটা খুলল, বুক মার্ক দিয়ে রাখা পৃষ্ঠাটা বের করে বলল, “এই দেখেন হুজুর, এইখানে একজন জিগিরার কথা লিখেছে।”

মৌলভি সাহেব নোট বইয়ের দিকে তাকালেন কিন্তু তার চোখে চশমা থাকার পরেও ভালো করে দেখতে পারলেন না। বললেন, “কী লেখা বাবা?”

রাজু তখন পড়ে শোনাল, “নিম্নশ্রেণির পিশাচ বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধরিয়া আসিতেছে। মদ্যপান করিয়া এবং গোমাংস ভক্ষণ করিয়া চলিয়া যাইতেছে। জিগিরাকে ক্রমাগত আহ্বান করা হইতেছে কিন্তু জিগিরার কোনো সাক্ষাৎ নাই। মৃতদেহের পর মৃতদেহ পচিয়া-গলিয়া শেষ হইতেছে, জিগিরা আসিতেছে না। সম্ভবত কোনো সপ্তম মাত্রার প্রেতসাধক তাহাকে বন্দি করিয়াছে…”

রাজু থামল এবং মৌলভি সাহেব তার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, “এইটা কে লিখছে?”

কোনো নাম নাই।”

“কত সালের লেখা?”

“বাংলা তেরশ আটচল্লিশ।”

মৌলভি সাহেব মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঠিকই লিখছে। আমার বাপজান তখনই জিগিরারে বন্দি করছে।” মৌলভি সাহেব অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়তে থাকলেন।

রাজুর মনে হলো মৌলভি সাহেব যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, এখন তাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তার যেসব বিষয় নিয়ে কৌতূহল ছিল, সেই বিষয়গুলো মোটামুটি জেনে গেছে। একটা রহস্যময় কবজ আছে সেই ব্যাপারটা নূতন, সেই কবজ রহস্যময়ভাবে হারিয়েও গেছে! রাজু এবারে বিদায় নেওয়র জন্য উঠে দাঁড়াল, বলল, “হুজুর, যদি অনুমতি দেন তাহলে যাই।”

মৌলভি সাহেবও কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “যাও বাবা। যাওয়ার আগে তোমারে একটা কথা বলি।”

“বলেন হুজুর।”

মৌলভি সাহেব বললেন, “পৃথিবীতে মানুষ যে রকম আছে, সেই রকম পিশাচ আছে, তাদের দুনিয়া আছে। তাদের দেইখা মানুষ ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কিছু নাই, মানুষ যদি সাহস করে কোনো পিশাচের বাবাও তারে কিছু করতে পারবে না। বুঝেছো?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “জি বুঝেছি।”

রাজু মনে মনে হাসল, মৌলভি সাহেবের ধারণা সেও একজন পিশাচ সাধক হওয়ার চেষ্টা করছে।

মৌলভি সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সে হঠাৎ থেমে গেল, বলল, “হুজুর একটা শেষ কথা।”

মৌলভি সাহেব বললেন, “কী কথা?”

রাজু বলল, “আমি কবজটা একটু খুঁজে দেখি?”

“দেখো।”

“যদি পাই তাহলে কী করব?”

মৌলভি সাহেব তার দাঁতহীন মুখে হাসলেন, বললেন, “নিয়া যাইও। কবজ যে পাবে সে-ই মালিক।”

রাজু বিদায় নিয়ে কবরস্থানে নেমে গেল। হেঁটে হেঁটে সে কবরস্থানটা দেখে। একটা-দুইটা ইট দিয়ে বাঁধাই করা। অন্যগুলো বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরাও। পুরানো কবরগুলো ভেঙে গেছে। খেজুর গাছের কাছাকাছি একটা লিচু গাছের নিচে কিছু মাটি কুপিয়ে রাখা আছে, জায়গাটা দড়ি দিয়ে ঘেরাও। নিশ্চয়ই এখানে মতির মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

রাজু জায়গাটা কিছুক্ষণ দেখল, তারপর হেঁটে হেঁটে খেজুর গাছটার কাছে গেল। এর নিয়ে কাচের বয়ামটা পাওয়া গেছে, মুখ খোলা এবং ফাটা। মানুষজন আশেপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, পায় নাই। রাজু এক জায়গায় পড়েছিল হারিয়ে যাওয়া জিনিস নাকি চোখ দিয়ে খুঁজতে হয় না, এটা খুঁজতে হয় মস্তিষ্ক দিয়ে।

রাজু কি মস্তিষ্ক দিয়ে খুঁজবে? যেহেতু মাটিতে খুঁজে পায় নাই, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় না যে এটা মাটিতে পড়ে নাই? এটা কোনো একটা গাছের ফাঁক-ফোকরে পড়ে সেখানে আটকা পড়ে আছে? রাজু কি আশেপাশের গাছগুলো খুঁজে দেখবে? এই খেজুর গাছটা দিয়েই কি শুরু করবে?

রাজু খেজুর গাছটার দিকে এগিয়ে যায়। গাছটার পুরানো পাতার গোড়ায় একটা কবজ সহজেই আটকে থাকতে পারে। রাজু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এবং হঠাৎ করে চমকে ওঠে। সত্যিই একটা পাতার খাঁজে একটা কবজ আটকে আছে। চারকোনা কবজ, সোনালি রং, ওপরে বিচিত্র নকশা। এই কবজটির জন্য হতভাগ্য মতির প্রাণ গিয়েছে!

রাজু এগিয়ে গেল, কাঁপা হাতে সে কবজটি তুলে নেয়। হঠাৎ করে রাজুর চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। সে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোভাবে খেজুর গাছটা ধরে সে নিজেকে সামলে নিল। রাজু অবাক হয়ে দেখে তার পরিচিতি জগৎটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। কোথাও কোনো আলো নেই, চারপাশে গভীর অন্ধকার। অসংখ্য মানুষের হাহাকারের মতো একটি শব্দ শুনতে পায়—তার মাঝে অসংখ্য ছায়ামূর্তি তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাজু একটা চাপা আর্তচিৎকার করে তার হাত থেকে কবজটা নিচে ফেলে দিলো। খুব ধীরে ধীরে তখন চারপাশ আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। রাজু কয়েকটা বড় নিশ্বাস নেয়। কবজটা খেজুর গাছের গোড়ায় পড়ে আছে, এখন তার সেটা হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাহস নেই।

সে তার ব্যাকপেকটা খুলে নিচে রাখে, তারপর একটা কাঠি দিয়ে কবজটাকে ঠেলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।

.

রাজুর জীবনটা ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য রকম হয়ে গেল।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন