নকশা-কাটা কবজ – ৯

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

রাজু যখন তার মেসে ফিরে এসেছে তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে তার মেসের আরেকজন বোর্ডার জহির চেয়ারে দুই পা তুলে বসে ভাত খাচ্ছে। চেয়ারে পা তুলে বসা যথেষ্ট কষ্টকার ব্যাপার কিন্তু জহির খুব সহজেই এভাবে বসতে পারে।

রাজুকে দেখে সে তার হাত চাটতে চাটতে বলল, “কী ব্যাপার রুমমেট, এত কাহিল লাগছে কেন?”

এক রুমে থাকলে তাকে রুমমেট বলা যায় কিন্তু তারা ভিন্ন রুমে থাকে, তারপরও একে অন্যকে রুমমেট ডাকে। রাজু বলল, “আসলেই কাহিল। সারাদিন জার্নি করে এসেছি।”

“কোথায় গিয়েছিলেন?”

সে যে কুসুমডাঙ্গার কবরস্থানে গিয়েছিল সেটি তো আর বলা যায় না, তাই বলল, “গ্রামে একটা কাজ ছিল।”

জহির আর উৎসাহ দেখাল না, বলল, “ও।”

রাজু নিজের ঘরে ঢুকে ব্যাকপেকটা টেবিলের ওপর রাখে। এর ভেতরে একটা রহস্যময় কবজ আছে। কবজটাকে কোথায় কীভাবে রাখবে সে এখনও বুঝতে পারছে না। কয়দিন আগে একটা জেলির বয়াম কিনেছিল। অনেকখানি খাওয়া হয়েছে—বাকিটুকু খেয়ে ফেলে সেখানে রেখে দিতে পারে।

রাজু তাদের ডাইনিং রুমে গেল, মেসের বোর্ডারদের জন্য একটা পুরানো ফ্রিজ আছে, সেটা মাঝে মাঝেই পুরানো গাড়ির মতো শব্দ করে। ফ্রিজে খাবারদাবার খুব ঠান্ডা হয় না, সেটা নিয়ে তারা মাথাও ঘামায় না। রাজু ফ্রিজ খুলে জেলির বয়ামটা বের করল, মেসের অন্য বোর্ডাররাও খেয়ে জেলি মোটামুটি শেষ করে এনেছে। রাজু বয়ামটা ভালো করে ধুয়ে ঘরে নিয়ে আসে—টেবিল ল্যাম্পের ওপর রেখে ভালো করে শুকিয়ে সে তার ব্যাকপেকটা খুলে ভেতরে তাকাল। ব্যাকপেকের নিচে এক কোনায় কবজটা কেমন জানি জ্বলজ্বল করছে। রাজু হাত দিয়ে না ধরে ব্যাকপেকটা কাত করে কবজটা টেবিলের ওপর বের করে আনে। টেবিল ল্যাম্পটা কাছে এনে সে সাবধানে কবজটা লক্ষ করে। চারকোনা কবজটাও ওপরে নকশাকাটা, মনে হয় কোনো একটা প্রাণীর প্রোফাইলের ছবি। নকশা দেখলে সেটাকে প্রাচীন মিসরীয় বলে মনে হয়। আসলেই কি এটি এত প্রাচীন মিসরীয় একটা কবজ? মিউজিয়ামে রাখার মতো কিছু?

রাজু তার কলমটি দিয়ে খোঁচা দিয়ে উল্টো দিকেও ভালো করে লক্ষ করে, সে হিরোগ্লিফিক অক্ষর চেনে না কিন্তু মনে হয় সেখানে হিরোগ্লিফিকে কিছু একটা লেখা।

হঠাৎ করে রাজুর মনে হলো কেউ একজন তার পিছনে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। রাজু পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে পিছনে ঘুরলেই সে তাকে দেখতে পাবে—তার ভেতরে একটা আতঙ্ক এসে ভর করে। নিশ্বাস আটকে রেখে রাজু খুব সাবধানে তার মাথা ঘুরাল—না, পেছনে কেউ নেই। সে তার বুকের ভেতর থেকে খুব সাবধানে এক নিশ্বাস বের করে দেয়। কিন্তু তার বিচিত্র অনুভূতি হয়, তার মনে হতে থাকে ঘরের ভেতর আর কেউ আছে, কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এত বাস্তব একটি অনুভূতি যে নিজের অজান্তেই মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

সে রীতিমতো জোর করে তার বুকের ভেতর থেকে আতঙ্কটা প্রায় ঠেলে বের করে দিলো। তারপর একটা কাগজ ভাঁজ করে সাবধানে কবজটা তুলে নিয়ে জেলির বয়ামে রাখল। কবজটা বয়ামের নিচে পড়ে একটা মৃদু শব্দ করে ভেতরে কয়েকবার জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে থেমে গেল। রাজু নিশ্বাস বন্ধ করে বয়ামটার মুখ বন্ধ করে সেটাকে সাবধানে শেলফে তুলে রাখে। এই রহস্যময় তাবিজটার জন্য একজন মারা গিয়েছে। কবরস্থানের মৌলভি সাহেবের গল্পটি সত্যি হয়ে থাকলে জিগিরা নামে একটা ভয়ংকর পিশাচকে এই কবজটি সত্তর বছর একটা লাশের ভেতর আটকে রেখেছে-কাজেই এটাকে তার সাবধানে রাখতে হবে।

রাজু বাথরুমে গিয়ে সময় নিয়ে গোসল করল। একটু দেরি হলে পানি চলে যায়, তাই রাজু প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছিল হঠাৎ করে পানি বন্ধ হয়ে যাবে—কিন্তু তার কপাল ভালো পানি বন্ধ হলো না। বাথরুমের জ্বলে ওঠা আয়নায় চুল আঁচড়ানোর সময় হঠাৎ করে তার মনে হলো তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে এবং আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।

রাজু ঝট করে ঘুরে তাকাল—না, কেউ নেই। কীভাবে থাকবে? মনের ভুল, কিন্তু একটু পরপর মনের ভুল কেন হচ্ছে? মনে হয়ে কবজ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা তার মনের ওপর অনেক বড় একটি চাপ ফেলেছে।

রাজু আজকে বাস থেকে নেমে একটা রেস্টুরেন্টে বসে খেয়ে এসেছে। এমনিতেই সারাদিন বাসে যাওয়া-আসা করে শরীর ক্লান্ত—তাই দেরি না করে মশারি টানিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে

গভীর রাতে হঠাৎ করে রাজুর ঘুম ভেঙে যায়। কেন ঘুম ভেঙে গেছে সে নিজেও বুঝতে পারে না—রাজু চোখ খুলে তাকাল। জানালা দিয়ে রাস্তার আলো ঘরের ভেতর এসে পড়েছে। সেই আবছা আলোতে সে স্পষ্ট দেখল ঘরের ভেতর কেউ একজন হাঁটছে। রাজু লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কে?”

কেউ কথার উত্তর দিলো না। কিন্তু হঠাৎ করে তার ঘরের দরজা দড়াম করে খুলে যায় এবং কেউ একজন বিকট চিৎকার করে ভিতরে ঢুকে তার মশারি টেনে ছিঁড়ে ফেলে লাফিয়ে বিছানাও ওপর উঠে তাকে চেপে ধরে।

ভয়াবহ আতঙ্কে রাজুও চিৎকার করে ওঠে এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারে মানুষটি জহির, তাদের অ্যাপার্টমেন্টের বোর্ডার। জহির থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।

“কী হয়েছে? কী হয়েছে?” বলে রাজু কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে তার টেবিল ল্যাম্পটি জ্বালাল।

জহির এখনও থরথর করে কাঁপছে, অবিশ্বাস্য আতঙ্কে তার মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য। রাজু জহিরকে ধরে কয়েকবার ঝাঁকাল এবং শেষ পর্যন্ত জহির একটু শান্ত হলো। রাজু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

জহির ভয়ার্ত চোখে রাজুর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি বিশ্বাস করবেন না—আমার ঘরে—আমার ঘরে-”

রাজু কথাটা শেষ করে দেয়, “কিছু একটা দেখেছেন?”

“হ্যাঁ। রাত্রে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল। কেন ঘুম ভেঙেছে জানি না। ঘর একেবারে ঠান্ডা। আমি চোখ খুলেছি, চোখ খুলে দেখি—” জহিরের কথা আবার আটকে যায়।

“চোখ খুলে কী দেখেছেন?”

“আমার মুখের উপর একটা মাথা। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নাক নাই, সেখানে একটা গর্ত—”

রাজু কথা না বলে জহিরের দিকে তাকিয়ে রইল। জহির বলল, “আমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে আর সেটা—সেটা—” জহির কথা বন্ধ করে ঢোঁক গিলল।

“সেটা কী?”

“সেটা বিছানা থেকে নেমে লাফ দিয়ে জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে রইল। মুখ দিয়ে শব্দ করছিল—তখন আমি—তখন আমি—“

রাজু জহিরের কথা শেষ করে দেয়, “আমার কাছে এসেছেন?”

“হ্যাঁ।”

রাজু বলল, “চলেন আপনার রুমে। গিয়ে দেখি—”

জহির জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না। আমি আমার রুমে যাব না। মরে গেলেও যাব না।”

রাজু বলল, “ঠিক আছে, আমি যাই। দেখে আসি।”

জহির ভয়ে ভয়ে বলল, “আপনি যাবেন?”

“হ্যাঁ।”

রাজু বিছানা থেকে নেমে জহিরের ঘরে গেল, দেওয়ালে সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। জহিরের বিছানা লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে কিন্তু কোথাও কিছু নেই। থাকবে সেটা রাজু আশাও করে নাই।

জহির তার ঘর থেকে একটা কম্বল আর বালিশ নিয়ে রাজুর ঘরে চলে এলো। আজকে সে রাজুর ঘরে মেঝেতে ঘুমাবে। শুধু তা-ই না, সারা রাত আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

কাজেই বাকি রাতটা রাজুকে আধা জেগে আধা ঘুমে কাটাতে হলো।

পরদিন ভোরে জহির এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে গেল।

* * *

কয়েক দিনের মাঝে রাজুদের বিল্ডিংয়ের প্রায় সব ভাড়াটে বিল্ডিং ছেড়ে চলে গেল! জহির যে রকম গভীর রাতে তার মুখের ওপর ভয়ংকর একটি ছায়ামূর্তি দেখেছে সে রকম সবাই কিছু-না-কিছু দেখেছে। রাজুরও মনে হয় রাতে তার ঘরের ভেতর অদৃশ্য কিছু ঘোরাঘুর করে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো কারো কোনোরকম ক্ষতি না করছে রাজু ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সহ্য করতে রাজি আছে। তার ঘুরে ফিরে কবরস্থানের সেই সহজ-সরল মৌলভি সাহেবের কথা মনে পড়ে, সে চলে আসার সময় বৃদ্ধ মানুষটি তাকে বলেছিলেন যে, মানুষ যদি সাহস করে পিশাচের সামনে দাঁড়ায় তাহলে পিশাচের বাবারও সাধ্য নাই মানুষের ক্ষতি করে! কথাটি তার পছন্দ হয়েছে। এই কথার ওপর সে ভরসা করতে চায়।

তবে এ কথাটিও সত্যি, সে যে কবজটি জেলির কৌটায় ভরে তার শেলফে রেখেছে সেটি সত্যিকার অর্থেই রহস্যময়। সে যখন হাত দিয়ে ধরেছিল তখন সত্যি সত্যি তার মাথা ঘুরে উঠেছিল, সত্যি সত্যি মুহূর্তের জন্য সে একটা বিস্ময়কর জগৎ দেখেছিল—যেখানে অসংখ্য ছায়ামূর্তি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে ব্যাপারটি আরো একবার দেখতে চায়, আরো একবার সে এই রহস্যময় কবজটাকে হাতের মুঠোয় ধরতে চায়। রাজু মাঝে মাঝেই কবজটি বের করে সেটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে—এর মাঝে কী রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে! কিন্তু এখন পর্যন্ত সে কবজটি হাতের মুঠোয় চেপে ধরার সাহস পায়নি।

ঘুমানোর আগে আজকেও রাজু জেলির কৌটাটা হাতে নিয়ে বসে ছিল তখন হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হলো। রাজু তাড়াতাড়ি জেলির কৌটাটা শেলফে বইয়ের পেছনে আড়াল করে রেখে দরজা খুলল। এই বাসার বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে-মুখে একধরনের হতাশ ভাব। রাজু দরজা থেকে সরে বাড়িওয়ালাকে ভিতরে ঢুকতে দিলো। বাড়িওয়ালা ঢুকে এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “আপনি এখনও আছেন? সবাই তো আমার বিল্ডিং ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”

রাজু বলল, “আমি এখনও আছি।”

বাড়িওয়ালা বলল, “আর কয়দিন। তারপর আপনিও নিশ্চয়ই চলে যাবেন। আমি দোষ দেই কেমন করে। মনে হয় আমিও বাসা ছেড়ে পালাই! দিন-রাত আয়াতুল কুরসি পড়ি—আর বুকে ফুঁ দিই।”

রাজু কেমন জানি অপরাধী অনুভব করে। কবজটি ঘরে ঢোকানোর পর থেকে এই অবস্থা। নানা রকম ভৌতিক ঘটনা ঘটছে। দোষটি তার। মনে হয় কবজটি অন্য কোথাও রেখে আসতে হবে—বাড়িওয়ালার সব ভাড়াটেকে এই বিল্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি ঠিক হচ্ছে না।

রাজু জিজ্ঞেস করল, “ঠিক কী দেখে সব ভাড়াটে চলে যাচ্ছে?”

“রাত্রে নানা রকম শব্দ হয়। দরজা-জানালা খুলে যায় আবার বন্ধ হয়।” বাড়িওয়ালা কেমন জানি শিউরে উঠে বলল, “কেউ কেউ এদেরকে দেখতেও পায়—ভয়ংকর অবস্থা।”

রাজু কিছু না বলে মাথা নাড়ল। দেখা এবং শোনার বিষয়টা হ্যালুসিনেশন হতে পারে। কিছু না থাকলেও একজনের মনে হতে পারে কিছু একটা দেখেছে। তবে দরজা-জানালা খোলা আর বন্ধ হওয়ার ব্যাপারটি হ্যালুসিনেশন হতে পারবে না। দরজা-জানালা খুলতে আর বন্ধ করতে হলে বাইরের থেকে কোনো শক্তিকে দরজা-জানালা ধরে টানাটানি করতে হবে—সরাসরি বিজ্ঞানের লঙ্ঘন।

বাড়িওয়ালা বলল, “আমি ঠিক করেছি শাকিনবাড়ির পীর সাহেবকে এনে বাড়ি বন্ধন দিব। শুনেছি পীর সাহেব নাকি খুবই গরম পীর। তবে—”

“তবে কী?”

পীর সাহেব অনেক টাকা চাইছেন।”

রাজু জিজ্ঞেস করল, “উনি কি কাজের গ্যারান্টি দিবেন?”

বাড়িওয়ালা রাজুর মুখের দিকে তাকাল, বোঝার চেষ্টা করল সে ঠাট্টা করছে কি না। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই সব কাজে কি কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে? পারে না।”

রাজু মাথা নাড়ল। পৃথিবীর কোন কাজে কে গ্যারান্টি দিতে পারে?

.

গভীর রাতে হঠাৎ করে রাজুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘরটা বরফের মতো ঠান্ডা রাজু নিঃশব্দে শুয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল কেন তার ঘুম ভেঙেছে। সে কি কোনো শব্দ শুনেছে?

রাজু অন্ধকারের মাঝে শুয়ে থাকে। হঠাৎ করে মনে হলো কেউ ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় সরে গেছে। তার বুকের ভেতর একটা আতঙ্ক এসে ভর করে। রাজু বিড়বিড় করে নিজেকে বোঝাল যে সে ভয় পাবে না। তার ঘরে কিছু একটা ছোটছুটি করলে করুক, সেটি তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাই সে কিছুতেই ভয় পাবে না।

রাজু একটা চাপা শব্দ শুনতে পেল, মনে হলো কেউ যেন নিশ্বাস ফেলেছে। রাজু তার চোখ বন্ধ করে ফেলে, বিড়বিড় করে নিজেকে বলে, “আমি যখন চোখ খুলব তখন সবকিছু দূর হয়ে যাবে। ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।”

রাজু একটু পরে চোখ খুলল, না ঘরে কেউ নেই। সে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে থাকে, কোনো শব্দ নেই, কোনো অস্পষ্ট ছায়া নেই কিন্তু তবু তার মনে হয় ঘরের ভেতর আর কেউ আছে।

রাজু এবার বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করল, “ঘরের ভেতর কি কেউ আছে?”

কোনো শব্দ হলো না। রাজু আবার বলল, “ঘরের ভেতর কি কেউ আছে? আছে?”

রাজুর মনে হলো অস্পষ্ট একটা শব্দ হলো। রাজু আবার বিড়বিড় করে বলল, “ঘরের ভেতর কেউ থাকলে কোনো একটা শব্দ করো।”

মনে হলো তার চেয়ারটা একটু নড়ার শব্দ হলো।

“আবার একটু শব্দ করো। প্লিজ।”

তার চেয়ারটা একটু নড়ে উঠল। প্রথমে অল্প একটু তারপর হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দ করে চেয়ারটা ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে গেল, ভয়ংকর শব্দ করে সেটি ঘরের দেওয়ালে আছড়ে পড়ল।

রাজু চমকে উঠে বিছানায় বসে যায়—তারপর মশারির ভেতর থেকে হাত বের করে ঘরের লাইট জ্বালাল। তার মনে হতে লাগল, লাইট জ্বালাতেই সে দেখবে চেয়ারের মাঝে কেউ একজন বসে আছে। উলঙ্গ দেহ, গায়ে কোনো লোম নেই। তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে।

কিন্তু রাজু দেখল চেয়ারে কেউ বসে নেই। ঘরে কেউ নেই। রাজুর হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করতে থাকে। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, “না, আমি ভয় পাব না। আমি কিছুতেই ভয় পাব না।”

কিন্তু তবু তার ভয় করতে থাকে।

রাজু মনে মনে ঠিক করে ফেলল, সে এই কবজটি কুসুমডাঙ্গার কবরস্থানের মৌলভি সাহেবকে দিয়ে আসবে। পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে, যার সমাধান হবে না। অনেক রহস্যকেই রহস্য হিসেবে থেকে যেতে দিতে হবে।

.

ভোরবেলা রাজু খবরের কাগজের মফস্বল পাতায় একটি খবর দেখল। খবরটির শিরোনাম : “গোরস্থানের ইমাম দুর্বৃত্তের কবলে”। ভেতরের খবর এ রকম :

সম্প্রতি কুসুমডাঙ্গা গ্রামের গোরস্থানের দায়িত্বে থাকা ইমামের বসতবাড়ি থেকে বয়োবৃদ্ধ ইমামকে কিছু দুর্বৃত্ত অপহরণ করে। গভীর রাতে এক বা একাধিক দুর্বৃত্ত তার বসতবাড়িতে গিয়ে বাড়িটি তছনছ করে এবং বয়োবৃদ্ধ ইমামকে অপহরণ করে।

বাড়ি থেকে কোনো কিছু হারানো গিয়েছে কি না সে ব্যাপারে এখনও কেউ নিশ্চিত নয়। ইমাম সাহেবকে পরদিন ভোরে রেলস্টেশনে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার জ্ঞান এখনও ফিরে নাই।

এখানে উল্লেখ্য যে, কয়েক দিন পূর্বে এই গোরস্থানে একজন যুবককে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে।

রাজু খবরটি পড়ে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে থাকে। এই বৃদ্ধ মানুষটির অত্যন্ত সাদামাটা ঘর তছনছ করে একটি মাত্র জিনিসই খোঁজা সম্ভব। সেটি হচ্ছে এই রহস্যময় কবজটি। কবজটি যে সে খুঁজে পেয়েছে এবং সেটি যে তার শেলফে রয়েছে, সেটি সম্ভবত কেউ জানে না। কিন্তু মৌলভি সাহেবকে অপহরণ করে তার কাছ থেকে রাজু সম্পর্কে কিছু তথ্য বের করে এই দুর্বৃত্তের দল যদি তার এই মেসে হানা দেয়, তাহলে কী হবে?

বিষয়টি অশরীরী বা ভৌতিক থাকা এক ব্যাপার কিন্তু সেটি যদি অপহরণ, খুন, জখম এই দিকে মোড় নেয়, সেটি সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার।

এই রহস্যময় কবজটি দিয়ে রাজু এখন কী করবে সেটি বুঝতে পারল না।

* * *

গভীর রাতে রাজু ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে। সে অত্যন্ত বিচিত্র একটি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। স্বপ্ন দেখেছে মিলিয়া তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ে হাইমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “রাজু, আমাকে মেরে ফেলেছে! মেরে ফেলেছে!”

রাজু ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে স্পষ্ট অনুভব করে সত্যি সত্যি তার বুকের ওপর মাথা রেখে মিলিয়া কাঁদছে। এমনকি মিলিয়ার মাথার চুলের গন্ধ পর্যন্ত সে পাচ্ছে। পুরোপুরি জেগে ওঠার পর সে বুঝতে পারল এটি একটি স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নটি এত বাস্তব যে রাজু অল্প অল্প কাঁপতে থাকে।

তার অত্যন্ত বিচিত্র একটি অনুভূতি হয়। তার মনে হতে থাকে এই ঘরের ভেতর মিলিয়া ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। মনে হতে থাকে সে একটু চেষ্টা করলেই মিলিয়ার কান্না শুনতে পারবে।

কিন্তু কী ভয়ানক একটি স্বপ্ন! সত্যিই কি মিলিয়াকে কেউ মেরে ফেলেছে? এটি কীভাবে সম্ভব?

রাজু তার মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করে দেবার চেষ্টা করল—কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সে স্পষ্ট অনুভব করতে থাকে মিলিয়া নেই।

মিলিয়াকে কেউ মেরে ফেলেছে।

কে মেরে ফেলেছে?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন