নকশা-কাটা কবজ – ১৪

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

রাজু গাছপালা ঢাকা একটা পুরানো বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে একটা বড় লোহার গেট। এই গেট দিয়ে তাকে ভিতরে ঢুকতে হবে। কেমন করে ঢুকতে হবে জানে না। রাজুকে যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবে গেটে শব্দ করল। গেটের অন্য পাশে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল। ছোট একটা খুপরির মতো অংশ খুলে যায়। সেখানে একজন মানুষের মুখ দেখা গেল। মানুষটি পাথরের মতো মুখে বলল, “কোড নম্বর?”

রাজুর কানের কাছে ফিসফিস করে অদৃশ্য কিছু বলল, “জিরো জিরো ফাইভ থ্রি সেভেন ওয়ান—”

রাজু ঠিক সেভাবে উচ্চারণ করল, “জিরো জিরো ফাইভ থ্রি সেভেন ওয়ান।”

পাথরের মতো মুখের মানুষটি সরে যায়, খুপরির ঢাকনাটিও বন্ধ হয়ে গেল। একটু পর ঘর্ঘর শব্দ করে গেটটা খুলে যায়। রাজু ভেতরে পা দিলো, সাথে সাথে পিছনের গেটটা আবার ঘর্ঘর শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়। রাজুর বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। সে কি এখান থেকে বের হতে পারবে?

গেটের পাশে একজন দুটো কুকুর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাজু কুকুর চেনে না তাই বুঝতে পারল না কুকুর দুটো ডোবারম্যান। কিন্তু তাদের হিংস্র চোখ এবং চাপা গর্জন শুনে তার বুক হিম হয়ে যায়।

রাজু জোর করে বুকের ভেতর থেকে তার আতঙ্কটুকু ঠেলে বের করে দেয়, তারপর সামনে হাঁটতে থাকে। খোয়া বাঁধানো পথ, পথের দুই ধারে গাছ। গেটের কাছে আলো জ্বলছে। এ ছাড়া আর কোনো আলো নেই, সেই আলোতে পুরো এলাকাতে একটা অদ্ভুত আলো-আঁধারি পরিবেশ।

রাজু হেঁটে যেতে থাকে, রাস্তাটা ঘুরে একটা বিশাল প্রাসাদের মতো বাসার সামনে শেষ হয়েছে। বাসার সামনে সিঁড়ি। সিঁড়িতে পা দিয়ে সে ওপরে উঠে যায়। সামনে বিশাল একটা কাঠের দরজা। দরজায় বিচিত্র নকশা কাটা। দরজায় শব্দ করার জন্য একটা ধাতব নকার। রাজু নকার দিয়ে ঠকঠক করে শব্দ করল।

আবার একটা চৌকোনা খুপরির মতো অংশ খুলে যায়। একজন ভাবলেশহীন মানুষের মুখ দেখা গেল, মানুষটি চাপা খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল, “পাসওয়ার্ড?”

রাজুর কানের কাছে আবার একটা অদৃশ্য পাসওয়ার্ড বলে দেয়, “ড্রল ইজিগার।”

রাজু যন্ত্রের মতো বলল, “ড্রল ইজিগার।”

মুখটি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং খুপরির ঢাকনাটা বন্ধ হয়ে যায়। এক মুহূর্ত পরে দরজাটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। রাজু ভেতরে ঢুকল। মানুষটি বলল, “আমার সাথে আসেন।”

রাজু মানুষটার পিছনে পিছনে যায়। মানুষটি একটা ঘরের সামনে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে গেল। রাজু ঘরের ভেতর উঁকি দিলো, ঘরে সারি সারি আলখাল্লা ঝুলছে। রাজু বুঝতে পারল তাকে একটা আলখাল্লা বেছে নিতে হবে। সে ঘরের ভিতরে ঢুকল। তার শরীরের সাথে মানানসই একটা আলখাল্লা গায়ে দিয়ে সে বের হয়ে আসে। আলখাল্লার ওপরে বড় হুড, সেটা দিয়ে তার চেহারা প্রায় পুরোটা ঢেকে গেল।

রাজু ঘর থেকে বের হওয়ার পর মানুষটি আবার তাকে নিয়ে হাঁটতে থাকে, একটা বড় করিডোরের শেষে সে দাঁড়িয়ে যায়। এর ভেতরে এই মানুষটির ঢোকার অনুমতি নেই। রাজু দরজা খুলে নিঃশব্দে পা দিলো।

বড় একটি হল ঘর। চারপাশে কংক্রিটের দেওয়াল। দেওয়ালে বিচিত্র কারুকাজ। নিচে নকশা কাটা টাইলস। ঘরের মাঝামাঝি উঁচু পাথরের বেদি। বেদিকে ঘিরে অনেকগুলো পাত্র। তাদের ভেতর নানা ধরনের পানীয়। ঘরের কোনায় কোনায় বড় বড় কলসি। সেখান থেকে নানা ধরনের গাছ-লতাপাতা বের হয়ে আছে।

ঘরে কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই, চারপাশে কংক্রিটের দেওয়ালে সাথে রাখা চারটি মশাল জ্বলছে। আগুনের শিখায় ঘরের সবকিছু ধিকিধিকি করে নড়ছে বলে মনে হয়। ঘরের মাঝামাঝি বড় মাটির মালসা। সেখান থেকে সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে। ঘরে সেই ধোঁয়ার ঝাঁঝালো কটু গন্ধ।

তবে ঘরের সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে একজন ভীত-আতঙ্কিত কিশোরী। কালো কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা, শুধু মাথাটি বের হয়ে আছে। কপাল এবং গালে টকটকে লাল রং মাখানো। তার চুলগুলো ছড়ানো এবং মাথায় টকটকে লাল জবা ফুল।

মেয়েটিকে একটি ভারি কাঠের চেয়ারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। মেয়েটি ভয়ে-আতঙ্কে কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে গেছে।

রাজু মাথা ঘুরিয়ে তাকাল এবং দেখল বেদিটাকে ঘিরে কালো আলখাল্লা পরে বেশ কয়েকজন মানুষ মাথা নিচু করে বসে আছে। তাদের কারো কারো সামনে একধরনের বাদ্যযন্ত্র এবং তারা হাত দিয়ে সেটি বাজাচ্ছে। ঘরের ভেতর একধরনের আদিম উল্লাসের মতো শব্দ।

রাজু কী করবে বুঝতে না পেরে ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা মানুষদের পাশে বসে গেল। তারা যেভাবে মাথা দুলিয়ে কিছু একটা জপ করছে ঠিক সেভাবে সেও জপ করার ভঙ্গি করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর আরো কয়েকজন মানুষ এসে যোগ দেয়, কালো আলখাল্লা এবং লম্বা হুডের কারণে দেখে বোঝা যায় না কে পুরুষ এবং কে নারী তবে মানুষগুলোর ভেতর পুরুষ এবং নারী দুই-ই আছে রাজু সেটা বুঝতে পারে।

রাজু হঠাৎ করে ঘরে উপস্থিত মানুষগুলোর ভেতর একধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। তারা নিজেদের ভেতর ফিসফিস করে কথা বলছে, একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। রাজু অনুমান করল মানুষগুলো বুঝে গেছে যে এখানে বাইরের একজন ঢুকে গেছে।

মাথায় উঁচু লাল টুপি পরা একজন মানুষ একটা ঘণ্টায় শব্দ করে উঠে দাঁড়াল। সবাই মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকায়। লাল টুপি পরা মানুষটা হিসহিস করে হিংস্র গলায় বলল, “আমাদের সংগঠনের সদস্য তেরো জন, কিন্তু এখানে চৌদ্দ জন এসেছে। কে বাইরে থেকে এসেছে বিনা অনুমতিতে? কার এত বড় দুঃসাহস?”

রাজু বুকের ভেতর একধরনের আতঙ্ক অনুভব করল। সে ধরা পড়ে গিয়েছে, এখন সে কী করবে?

লাল টুপি পরা মানুষটি নিশ্চয়ই এই দলটির দলপতি। সে কঠোর গলায় বলল, “সবাই উঠে দাঁড়াও। সবই হুড খোলো।”

মানুষগুলো দাঁড়ায়। তারপর হুড নামিয়ে নিজের চেহারা দেখাতে শুরু করে। রাজু নিজের হুড নামানো মাত্রই সবাই বিস্ময়ের শব্দ করে ছিটকে পিছনে সরে যায়। শুধু শাফকাত হতবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখতে দেখতে তার চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। হিংস্র গলায় বলল, “তুই? তুই এখানে?”

রাজু একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “তুমি? তুমিও এখানে?”

দলপতি এগিয়ে আসে, গলা উঁচু করে বলল, “তুমি একে চিনো?”

শাফকাত দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “হ্যাঁ, খুব ভালো করে চিনি। এই হতভাগা হচ্ছে আমার ওয়াইফের বয়ফ্রেন্ড!”

রাজু বলল, “ছিঃ শাফকাত! ছিঃ!”

দলপতি বলল, “এই ছেলে এখানে কীভাবে ঢুকেছে? একে কোড নাম্বার আর পাসওয়ার্ড কে দিয়েছে?”

শাফকাত একটা কুৎসিত গালি দিয়ে বলল, “কীভাবে জানি এই হতভাগার সুপার ন্যাচারাল ওয়ার্ল্ডের সাথে যোগাযোগ আছে—একে শেষ করতে হবে—

মানুষগুলি হতবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকায়।

শাফকাত এদিক-সেদিক তাকায়, তারপর হল ঘরের কোনায় ফায়ারপ্লেসের কয়লা খোঁচানোর জন্য রাখা ভারী লোহার রডটা ধরে নিয়ে হিংস্র মুখে কুৎসিত গালি দিতে দিতে রাজুর দিকে এগিয়ে আসে।

রাজু স্থির চোখে শাফকাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা এখন তাকে মেরে ফেলবে, পিটিয়ে মেরে ফেলবে। সে এখন কী করবে? কিছু বোঝার আগে লোহার রডের প্রচণ্ড আঘাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শাফকাত প্রচণ্ড আক্রোশে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে—তার লাথি খেয়ে রাজু গড়িয়ে যায়। মনে হয় তার নিশ্বাস আটকে গেছে, দুই হাতে ভর দিয়ে সে উঠতে চায়, কিন্তু শাফকাতের লাথির পর লাথি খেয়ে সে উঠতে পারে না। তার চোখ-মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মুখের ভেতর রক্তের লোনা স্বাদ।

রাজু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার নাকি অনেক ক্ষমতা, তার শক্তি অপরিসীম, সে নাকি অন্ধকার জগতের জিগিরাকে মোকাবেলা করবে? কিন্তু কোথায় তার শক্তি? কোথায় তার ক্ষমতা? শাফকাতের প্রচণ্ড আঘাতে রাজুর চারপাশে অন্ধকার হয়ে যায়। সে অচেতন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

লাল উঁচু টুপি পরা দলপতি এগিয়ে এসে শাফকাতকে বলল, “একে এখনই জানে মেরে ফেলো না। জিগিরাকে এই ছেলেটিকেও উপহার দিতে পারব। প্রভু জিগিরা নিশ্চয়ই দুইটি জীবন্ত মানুষকে বেশি পছন্দ করবেন।”

শাফকাত থামল। অচেতন রাজুকে আঘাত করে লাভ নেই—সে এখন কিছু টের পাবে না।

দলপতি বলল, “সবাই নিজের জায়গায় ফিরে যাও। আমাদের প্রভু জিগিরাকে ডেকে আনার সময় হয়েছে।

চেয়ারে বেঁধে রাখা মেয়েটির পাশে আরেকটি চেয়ার এনে সেখানে রাজুকে বেঁধে রাখা হলো। অচেতন রাজুর নাক-মুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে মেঝেটা ভিজে যেতে থাকে।

বেদি ঘিরে কালো আলখাল্লা পরা মানুষগুলো একটা আদিম সংগীতের সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে নৃত্য করতে করতে অন্ধকার জগতের প্রভু জিগিরাকে ডাকতে থাকে। তাদের নৃত্য উদ্দাম থেকে উদ্দাম হতে থাকে। মনে হয় নরকের দরজা খুলে যাবে এই হল ঘরটিতে।

.

রাজুর মনে হলো কেউ একজন তাকে ডাকছে, রাজু চোখ খুলতে চেষ্টা করে, পারে না। আবার অচেতন হয়ে যাচ্ছিল তখন শুনতে পায় তাকে কেউ উদ্বিগ্ন গলায় ডাকছে, “রাজু! এই রাজু! ওঠ! চোখ খুলে তাকা।”

মিলিয়ার কণ্ঠস্বর। রাজু চোখ খুলে তাকাল, ধীরে ধীরে মনে পড়ল সে কোথায়। হঠাৎ করে আতঙ্কে সে শিউরে ওঠে।

সামনে পাথরের বেদিতে আগুন জ্বলছে, সেই আগুনের পিছনে একটি জন্তু। মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়। চোখ দুটি ধকধক করে জ্বলছে। মুখের গহ্বর থেকে লকলকে লাল জিভ বের হয়ে জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ছে। ধারালো সারি সারি দাঁত।

রাজু অর্ধচেতন হয়ে প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে থাকে—এ রকম কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়—নিশ্চয়ই এটি চোখের ভুল—কোনো একধরনের বিভ্রান্তি। রাজু প্রাণপণ চেষ্টা করে জেগে থাকার। সে তার চেতনা হারাতে চায় না। ঘরের মাঝে অনেকে কথা বলছে—কে বলছে সে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু শুনতে পাচ্ছে।

“হ্যাঁ, প্রভু আমাদের শক্তি দাও। শক্তি দাও।”

“ক্ষমতা দাও। প্রভু ক্ষমতা দাও।”

“মানুষের ওপর অধিকার দাও।”

“স্বাস্থ্য দাও। সম্পদ দাও, আয়ু দাও, দীর্ঘায়ু দাও।”

“তুচ্ছ মানুষকে পদানত করার ক্ষমতা দাও।”

“চোখের দৃষ্টি দিয়ে মানুষকে বশীভূত করার ক্ষমতা দাও।”

“যৌবন দাও। পৃথিবীকে ভোগ করার ক্ষমতা দাও।”

“আলোর জগতের ওপর অন্ধকার জগৎ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা দাও। হে প্রভু, আমরা তোমার অনুসারী, তুমি তোমার অনুসারীদের প্রতি কৃপা করো। কৃপা করো প্রভু জিগিরা। কৃপা করো।”

রাজু দেখল কুৎসিত জন্তুটির লকলকে জিভ নড়ে উঠছে—তার গলার ভেতর থেকে প্রতিধ্বনির মতো একধরনের শব্দ বের হয়ে আসে। সেটি বলল, “দেবো। দেবো। সব দেবো। তোরা আমাকে কী দিবি?”

রাজু দেখল, দলপতি মাথা নিচু করে বলল, “প্রভু, তোমার জন্য আমরা দুটি জীবন্ত মানুষ উৎসর্গ করতে চাই প্রভু। তোমার সামনে তারা আছে। তুমি আমাদের উৎসর্গ গ্রহণ করো।”

কুৎসিত জন্তুটি তার হাত তুলে উৎসর্গ গ্রহণ করার ইঙ্গিত করল। আবার তাঁর ধারালো দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া জিভ নড়ে ওঠে, প্রতিধ্বনির মতো কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সেটি বলে ওঠে, “আমার কবজ কই? ধ্বংস কর-”

দলপতি দাঁড়িয়ে যায়, মাথা নিচু করে বলে, “কবজ এনেছি প্রভু। কবজ এনেছি। আমরা সেই কবজ ধ্বংস করে পৃথিবীকে আপনার জন্য নিরাপদ আবাসস্থল করে দেবো প্রভু। আমরা আপনার সামনে সেই কবজ ধ্বংস করব—”

একজন ছুটে গিয়ে রাজুর বয়ামে রাখা কবজটি একটা পাথরের টেবিলের ওপর ঢেলে বের করে আনে। আরেকজন ছোট একটা অক্সি এসিটিলিন সিলিন্ডারের মুখে আগুন দেয়, সেখান থেকে নীলাভ জ্বলন্ত শিখা শব্দ করে বের হতে থাকে।

দলপতি বলল, “অনুমতি দিন প্রভু, কবজ ধ্বংস করি। আপনার সামনে ধ্বংস করি”

প্রাণীটি হিসহিস করে বলল, “কর। ধ্বংস কর।”

কালো আলখাল্লা পরা একজন অক্সি এসিটিলিন সিলিন্ডার থেকে বের হওয়া জ্বলন্ত শিখাটি কবজের ওপর রাখে। রাজুর বাসায় রান্না করার মহিলা রোগশোক, বালা-মুসিবত দূর করার জন্য ফুটপাথ থেকে কেনা কবজটি চোখের সামনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। দলপতি মাথা নিচু করে বলে, “আমরা কবজটি ধ্বংস করেছি প্রভু। এই পৃথিবীকে আপনার জন্য নিরাপদ করে দিয়েছি প্রভু। এখন আমাদের শক্তি দিন প্ৰভু।”

প্রাণীটি মুখ ওপরে তুলে অট্টহাসি করার মতো একটা শব্দ করল। তারপর বেদির ওপর থেকে শ্বাপদের মতো লাফ দিয়ে নিচে নেমে দুই পা এবং এক হাতের ওপর ভর দিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। তার লকলকে জিভটি মুখ থেকে বের হয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেল। প্রাণীটি মেয়েটির দিকে ঝুঁকে পড়ল—আর একটি মুহূর্ত, তারপরই মেয়েটির কণ্ঠনালী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। মেয়েটি ভয়াবহ আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে।

রাজু ঘোলা চোখে মাথা তুলে প্রাণীটির দিকে তাকাল। তারপর তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, “থামো।”

হল ঘরের সবাই চমকে উঠে রাজুর দিকে তাকায়। হঠাৎ রাজুর মনে হতে থাকে, তার শরীরে অচিন্তনীয় শক্তি এসে ভর করতে শুরু করেছে। মনে হতে থাকে ইচ্ছা করলেই সে পুরো পৃথিবী ছারখার করে দিতে পারবে। রাজু একটা ঝটকা মেরে তার হাত মুক্ত করে নেয়, তারপর সেই হাতটি বীভৎস প্রাণীটির দিকে তাক করে ধরে।

রাজু অনুভব করে কোনো একটি বিস্ময়কর জগৎ থেকে তার হাতে শক্তি এসে জমা হচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সেই শক্তি বজ্রের মতো তার হাত থেকে বের হয়ে এই প্রাণীটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। রাজু চিৎকার করে তার হাতটাতে ঝাঁকুনি দিতেই মনে হলো সেখান থেকে নীলাভ একটা আলোর ঝলক ছুটে বের হয়েছে, তার আঘাতে জিগিরা ছিটকে পিছনে গিয়ে পড়ে।

হল ঘরের মানুষগুলো বিস্ময়ের শব্দ করে, তাদের ভেতর একসাথে অবিশ্বাস এবং আতঙ্ক, কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

জিগিরা একধরনের জান্তব শব্দ করে ওঠার চেষ্টা করে। রাজু চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে, দাঁড়াতে চেষ্টা করে। হঠাৎ তার মাথা ঘুরে ওঠে। মনে হয় সে বুঝি পড়ে যাবে। চেয়ারটা ধরে সে নিজেকে সামলে নেয়। তখন কিশোরী মেয়েটিকে সে দেখতে পায়—তার মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক।

রাজু ফিসফিস করে বলল, “তোমার কোনো ভয় নাই মেয়ে। তোমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না—আমি আছি।”

রাজু দুই পা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির বাঁধন খুলে তাকে মুক্ত করে দিলো। মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে রাজুর পিছনে লুকিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

রাজু আবার নিচু গলায় বলল, “তোমার কোনো ভয় নাই।”

রাজু এবারে চারিদিকে তাকাল, আলখাল্লা পরা মানুষগুলো বেদির পিছনে দাঁড়িয়ে আছে—তারা বিড়বিড় করে কিছু একটা মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। জিগিরা টলতে টলতে দাঁড়াল, তার শরীরটা কেমন যেন মোচড়াতে লাগল, তারপর দুই পা আর এক হাতে ভর দিয়ে আবার তার দিকে ছুটে আসতে থাকে। মুখটা খুলে রেখে সবগুলো দাঁত বের করে রেখেছে।

রাজু এতটুকু বিচলিত না হয়ে তার হাতটা সামনে তুলে ধরে এবং মনে হলো অদৃশ্য কোনো দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে জিগিরা আছড়ে পড়ল।

রাজু আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, মেয়েটি তাকে ধরে দাঁড়া করিয়ে দিল। রাজু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাংকু মেয়ে। থ্যাংকু।”

মেয়েটি বলল, “আমার নাম কুসুম।

“থ্যাংকু কুসুম।”

“এরা আপনার কিছু করতে পারবে না। না?”

“না পারবে না।”

“আপনার অনেক ক্ষমতা?”

“সেইটা জানি না—” রাজু হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “কুসুম তুমি ওই দেওয়াল থেকে মশালটা এনে দিতে পারবে?”

কুসুম দেওয়ালটার দিকে তাকাল। সে এখনও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে কিন্তু তারপরও সাহস করে বলল, “পারব।”

“যাও, এনে দাও।”

কুসুম ছুটে গেল এবং দেওয়ালে গেঁথে রাখা মশালটা খুলে দৌড়ে এসে রাজুর হাতে দিলো। রাজু তখন জ্বলন্ত মশালটি নিয়ে জিগিরার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে মাঝে মাঝেই টলে পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু মেয়েটা তাকে ধরে আবার সোজা করে দিচ্ছিল।

জিগিরা পিছিয়ে যেতে থাকে—মুখ দিয়ে জান্তব গর্জন করতে করতে সেটি ফাঁদে আটকা পড়া পশুর মতো ছোটাছুটি করে। রাজু তাকে এক কোনায় আটকে ফেলে মশালের আগুনটি তার দিকে ঠেসে ধরে চিৎকার করে বলল, “জাহান্নামের প্রাণী তুই জাহান্নামে যা—”

জিগিরার শরীরটা থরথরে করে কাঁপতে থাকে। কালো ধোঁয়ায় পুরো হল ঘরটা ঢেকে যায়। ঝাঁঝালো ধোঁয়ার কটু গন্ধে সবাই খকখক করে কাশতে থাকে।

রাজু এবারে ঘুরে আলখাল্লা পরে থাকা মানুষদের দিকে তাকাল— তাদের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে হাতের একটা ঝটকা দিতেই মানুষগুলো লুটোপুটি খেয়ে প্রচণ্ড বেগে পিছনে ছুটে গিয়ে দেওয়ালে আছড়ে পড়ে। রাজু তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “শাফকাত! শাফকাত কোথায়?”

মেঝেতে পড়ে থাকা শাফকাত কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। রাজু তার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টির সামনে শাফকতা দুমড়ে-মুচড়ে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়। রাজু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাছে গেল, পা দিয়ে তার মাথাকে ধাক্কা দিয়ে সোজা করে বলল, “আমি তোমাকে পা দিয়ে পিষে ফেলব? মানুষ যেমন করে একটা বিষাক্ত পোকাকে পিষে ফেলে?”

শাফকাত হাত জোড় করে বলল, “ক্ষমা চাই। ক্ষমা চাই আমি—ক্ষমা করো আমাকে।”

রাজু হিংস্র মুখে বলল, “মিলিয়াকে খুন করেছিল কে?”

শাফকাত মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় বলল, “আমি। আমি খুন করেছিলাম।”

“কেন খুন করেছিলে?”

শাফকাত মাথা নাড়ল, “জানি না—আমি জানি না—”  

“তুমি পুলিশের কাছে যাবে? খুলে বলবে সবকিছু?”

“বলব। আমি বলব।”

রাজু হাসল, বলল, “আমি জানি তুমি বলবে। আমি যদি চাই তাহলে এখনই তোমার নিজের চোখ তুলে ফেলবে। যদি চাই তুমি তাহলে এখনই গলায় দড়ি দেবে। কিন্তু আমি তোমার গলায় দড়ি দিতে চাই না শাফকাত— আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই—বিচারের জন্য। বুঝেছো?”

শাফকাত হাঁটু ভেঙে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “বুঝেছি। আমি বুঝেছি।”

রাজু তার হাতের মশালটি বেদির দিকে ছুড়ে দেয়। সামনে রাখা তরলগুলোতে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

রাজু কুসুমকে ধরে বলল, “চলো কুসুম আমরা যাই। আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।”

“চলেন যাই ভাইজান।”

“আমার নাম রাজু।”

“চলেন যাই, রাজু ভাইজান।”

রাজুকে ধরে ধরে কুসুম বাইরে নিয়ে যেতে থাকে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন