মুহম্মদ জাফর ইকবাল
বয়স্ক ডাক্তার চশমার ওপর দিয়ে রাজুর দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “ইয়াং ম্যান, তুমি পুরোপুরি সুস্থ। তুমি এখন যেতে পারো।”
রাজু বলল, “থ্যাংক ইউ ডাক্তার সাহেব।”
“আমি ডাক্তার। তোমার শরীরের চিকিৎসা করার কথা। তোমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার কৌতূহল দেখানোর কথা না। কিন্তু তারপরও আমি খুবই কিউরিয়াস। ওই রাতে কি হয়েছিল বলবে?”
রাজু অস্বস্তি অনুভব করে, ওই রাতের ঘটনার আগে আরও অনেক কিছু ঘটেছে এবং সব ঘটনার পুরোটুকু না জানলে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কিন্তু সেই রাতের ঘটনার কথা কেউ কিছু বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার কথাও না। কাজেই রাজু প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল, বলল, “আসলে আমার কিছু পরিষ্কার মনে নেই। যেটুকু আবছা আবছা মনে আছে সেটা সত্যি ঘটেছে নাকি আমি কল্পনা করেছি তাও জানি না—”
বয়স্ক ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কম বয়সি সহকারি মেয়েটি বলল, “স্যার, ওখানে যারা ছিল তাদের সবার শরীরে হ্যালোসিনেজিক রিএজেন্ট পাওয়া গেছে। ঘরের ভেতর মালসায় আগুন জ্বালিয়ে এর ধোঁয়া তৈরি করেছে। সবার একধরনের ইলিউসান হয়েছে স্যার।”
বয়স্ক ডাক্তার তার সামনে রাখা কাগজটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, সেটা দেখেছি। কিন্তু পুলিশ বলেছে সেখানে একটা কোল্ড স্টোরেজে একটা ডেডবডি পেয়েছে—সেখানে ব্ল্যাক আর্ট চর্চা হতো—হিউম্যান স্যাক্রিফাইসের প্রমাণ আছে—”
রাজু বলল, “আমি পুলিশ রিপোর্টটা দেখি নাই। পুলিশ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, আমি যা জানি বলেছি।”
বয়স্ক ডাক্তার হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, “একসময়ে বইপত্রে পড়েছি ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে এই ব্ল্যাক আর্টের চর্চা করে। আমাদের দেশেও যে এগুলো হতে পারে—”
সহকারী মেয়েটি বলল, “স্যার, এটা গ্লোবালাইজেশানের যুগ। যেটা ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে আছে সেটা আমাদের এখানেও চলে আসে।”
বয়স্ক ডাক্তার বললেন, “বেছে বেছে শুধু খারাপ জিনিস কেন আসে? ভালো জিনিসগুলো কেন আসে না?”
রাজু দুর্বলভাবে বলল, “ভালো জিনিসগুলোও নিশ্চয়ই আসে।”
বয়স্ক ডাক্তার হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, “যাই হোক, ইয়াং ম্যান, তুমি এখন বাসায় যেতে পারো। আশা করছি এ রকম ঝামেলায় তোমাকে আর পড়তে না হয়।”
রাজু তার বাম হাতের ব্যান্ডেজটায় হাত দিলো, সে যেটা শুনতে চাইছে ডাক্তাররা সেটা নিয়ে এখনো কিছু বলছে না। রাজু ব্যান্ডেজটায় হাত দেওয়ার পর বয়স্ক ডাক্তারের সেটা মনে পড়ল, ড্রয়ার খুলে একটা জিপলক ব্যাগ বের করে বললেন, “আর হ্যাঁ, এই যে একটা মিস্টিরিয়াস কবজ— এটা তোমার হাত থেকে সার্জারি করে বের করেছি। ওই বদমাইশগুলি এটা কেন তোমার হাত কেটে ঢুকিয়েছিল?”
ডাক্তার মনে করছেন এটা ব্ল্যাক আর্টিস্টরা তার হাতে ঢুকিয়েছে। এটা যে সে নিজেই একজন রহস্যময় মানুষকে তার হাতের ভেতর ঢোকাতে দিয়েছে সেটা জানেন না, জানার প্রয়োজনও নেই। কাজেই রাজু না জানার ভান করল, বলল, “আমি ঠিক জানি না কীভাবে হাতে ঢুকিয়েছে।” তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি কি এটা পেতে পারি?”
ডাক্তার সাহেব এগিয়ে দিলেন, বললেন, “নাও। তোমার শরীরে ছিল, কাজেই এটা তোমার প্রোপার্টি। স্যুভেনির হিসেবে রেখে দিও।”
সে নিজে যখন এটাকে তার হাত দিয়ে স্পর্শ করেছিল তখন তার অত্যন্ত বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ডাক্তারদের সে রকম কোনো অভিজ্ঞতা কি হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে কেউ সেটি নিয়ে কিছু বলছে না কেন?
বয়স্ক ডাক্তারের হাত থেকে জিপলক ব্যাগটা নেওয়ার সময় রাজু হঠাৎ করে কারণটা বুঝতে পারল—ডাক্তারের হাতে গ্লাভস। ডাক্তারদের কেউ এটা খালি হাতে স্পর্শ করেনি। ভাগ্যিস করেনি।
রাজু জিপলক ব্যাগটা হাতে নিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে সেটি প্রথম বার দেখার একটু অভিনয় করল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনাদের অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব। আমি এখন আসি?”
রাজু কম বয়সি সহকারী ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো।
* * *
রাজু জিপলক ব্যাগটি নিয়ে তার বিছানায় বসেছে। আজকে সে মিলিয়ার সাথে কথা বলতে চায়। ব্যাগ থেকে কবজটি বের করে হাতের মুঠিতে চেপে ধরে সে মিলিয়ার কথা চিন্তা করতে থাকে। সে আশেপাশে অন্য অনেক ছায়ামূর্তিকে দেখতে পায় কিন্তু মিলিয়াকে দেখতে পায় না। যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ মিলিয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, মিলিয়া ফিসফিস করে বলে, “রাজু! ডেকেছিস আমাকে?”
মিলিয়ার প্রতিচ্ছবিটি তার সামনে তৈরি হতে থাকে, খুব ধীরে ধীরে মনে হয় তার গলার স্বরটিও অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
রাজু বলল, “হ্যাঁ মিলিয়া, আমি তোর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। তুই কোথায়?”
মিলিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছি রাজু।”
রাজু একটু হতাশার মতো শব্দ করল, বলল, “চলে যাচ্ছিস?”
“হ্যাঁ রাজু। সবাইকে যেতে হয়। প্রথম প্রথম মনে হয় এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কখনো যেতে পারব না। তারপর ধীরে ধীরে মায়া কেটে যায় রাজু। মনে হয় পৃথিবীটাই সব নয়। পৃথিবীর বাইরেও একটা জগৎ আছে-”
“সেই জগৎটা কেমন মিলিয়া?”
মিলিয়া হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “সেটা তুই এখনই কেন জানতে চাইছিস? যখন তুই এখানে আসবি তখন তুই নিজেই সেটা দেখবি! অপেক্ষা কর।”
রাজু কেমন যেন একটু নিঃসঙ্গ অনুভব করে, বলে, “তুই চলে যাবি মিলিয়া?”
“আমি চলে গেছি রাজু।”
রাজু প্রসঙ্গ পাল্টাল, বলল, “তোকে কথা দিয়েছিলাম শাফকাতকে শাস্তি দেবো। আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি মিলিয়া। পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করেছে। বিচারের জন্য আমেরিকা পাঠাবে—”
“হ্যাঁ, জানি।”
“তুই খুশি হয়েছিস মিলিয়া?”
মিলিয়া আবার একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল। তারপর বলল, “এখানে সবকিছু অন্য রকম রাজু। এখানে পৃথিবীর কোনো কিছু আর গুরুত্বপূর্ণ না। শাফকাতের শাস্তি হলো আর না হলে এখন আর কিছু আসে-যায় না—আমার কাছে এখন শাফকাতের কোনো গুরুত্ব নেই—মনে হয় তাকে চিনিই না!”
“আশ্চর্য!”
“হ্যাঁ। আশ্চর্য। এই জগৎটাকে একটা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হলে কি বলতে হবে জানিস? বলতে হবে, প্রশান্তি
“প্রশান্তি?”
“হ্যাঁ। প্রশান্তি। এখানে শুধু প্রশান্তি।”
দুইজন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “রাজু, আমাকে বিদায় দে। আমি যাই?”
রাজু হঠাৎ করে তার বুকের ভেতর একধরনের শূন্যতা অনুভব করে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে তার আর কোনোদিন মিলিয়ার সাথে দেখা হবে না। মিলিয়া চিরদিনের জন্য তার প্রশান্তির জগতে হারিয়ে যাবে। যে জগৎ সম্পর্কে সে কিছু জানে না!
রাজু ফিসফিস করে বলল, “বিদায় মিলিয়া। যেখানেই থাকিস, তুই ভালো থাকিস।”
কেউ রাজুর কথার উত্তর দিলো না।
* * *
দরজায় শব্দ শুনে রাজু বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দিলো। দরজা খোলার আগেই হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল এই গহিন রাতে কে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। তার ধারণা সত্যি। ঘরের বাইরে অন্ধকার জায়গাটিতে দীর্ঘদেহী একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা।
রাজু বলল, “আপনি এসেছেন?”
“হ্যাঁ বাবা। আমি তোমাকে শুকরিয়া জানাতে এসেছি। তুমি জানো না পৃথিবীর কত বড় একটা কাজ তুমি করেছো।”
“আপনি সাহায্য করেছেন বলে করতে পেরেছি।”
“সবাই পারে না। তুমি পেরেছো।” মানুষটি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “আমি কবজটি নিতে এসেছি বাবা। এই কবজটি মানুষের কাছে থাকার কথা না।”
রাজু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে বুঝতে পারল, আসলেই এই কবজটি মানুষের কাছে থাকার কথা না। কবজটি তার কাছে একটি নেশার মতো— সে সারাক্ষণ অপেক্ষা করে থাকে কখন রাত হবে আর কখন সে হাতের মুঠিতে চেপে ধরে পরাবাস্তব জগতে উঁকি দেবে। কখন সেই জগতের রহস্যময় ছায়ামূর্তিদের সাথে কথা বলবে। পরাবাস্তব সেই জগতের সাথে সম্পর্ক শেষ করে তার বাস্তব জগতে ফিরে আসার সময় হয়েছে।
রাজু ঘরের ভেতর থেকে জিপলক ব্যাগটি হাতে নিয়ে এসে সেটি মানুষটির দিকে এগিয়ে দেয়। দীর্ঘদেহী মানুষ কিংবা প্রাণীটি সেটি হাতে নিয়ে বলল, “আবার যদি দরকার হয়, আমি সেটা কোনো মানুষের কাছে নিয়ে যাব।”
“আপনি মানুষ না?”
“আমাকে এটা জিজ্ঞেস না করলে বাবা। দরজাটা বন্ধ করে দাও। ঘুমাও বাবা, অনেক রাত হয়েছে।”
রাজু ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। হঠাৎ করে বুঝতে পারল আসলেই তার চোখে ঘুম আসছে।
গভীর ঘুম।
গভীর গভীর ঘুম।
সে টলতে টলতে তার বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন