মহকুমা সদরের পরিচিতি

মির্জাপুর মাঠ, কয়লাঘাট থেকে সাউথ সেন্ট্রাল রোড, সারদাবাবু রোড পর্যস্ত এবং সারদাবাবু রোড থেকে ফেরী ঘাট রোড, ফেরীঘাট রোড পঞ্চবীথি হয়ে যশোর রোড ও যশোর রোড ডাকবাংলা হয়ে হেলাতলার পুবদিকে নদীর তীর পর্যন্ত মির্জাপুর বলে কথিত হোত। বর্তমান মির্জাপুর নামে পরিচিত বিস্তীর্ণ এলাকা তৎকালে মির্জাপুর মাঠের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম ভাগে ছিল। ফেরীঘাট রোডের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের জনবসতিপূর্ণ জায়গাগুলো নির্দিষ্ট এক একটা গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। ফেরীঘাট রোড ও দীনবন্ধু ঘোষ রোড, সাউথ সেন্টাল রোড এবং রূপসা খালের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা নীচু অনাবাদী জমি ছিল। বছরের অধিকাংশ সময় এই জমির অনেকাংশ পানির নীচে থাকতো। বাকী অংশে অবস্থান ভেদে কিছু কিছু ধানের চাষ হোত। উল্লেখ্য বিগত তিন দশক ধরে ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপে শহরে বাসস্থান সংকটের জন্যে পুকুর কেটে উল্লেখিত নীচু ও আবাদী জমি ভরাট করে বাসোপযোগী করা হয়েছে এখন এ এলাকা দেখলে পূর্বের অবস্থা অনুমান বরা যায় না তবে বর্ষাকালে এলাকার নীচু জায়গা ও রাস্তা পানিতে ডুবে যায়।

আলোচিত মির্জাপুর মাঠের বিস্তীর্ণ এলাকা মোটামুটি বাসোপযোগী ছিল। মহকুমা সদর স্থাপনকালে অপেক্ষাকৃত নদীর উঁচু তীর ধরে কয়েকটা মুসলমান পরিবার, বাইতী ও পরামানিকের বসতি এবং তার দক্ষিণে পঞ্চনীথি এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায় ও পশ্চিম সহ উত্তর পশ্চিম অংশে মুচিদের সংঘবদ্ধ বাস ভিন্ন মির্জাপুর মাঠের সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে বুনোদের (আদিবাসী) বসবাস ছিল। এ ছাড়া মির্জাপুর মাঠের মধ্যে অন্য কোন বসতির সন্ধান পাওয়া যায় না । আঠার শতকের গোড়ার দিকে মির্জাপুর মাঠ ও তার পার্শ্ববর্তী বেনেখামার, হেলাতলা শিববাড়ীসহ আরো কিছু জনপদ জনশূন্য হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, রাজনৈতিক ও দস্যুতস্করের উপর্যুপরি হামলা এর কারণ বলে অনুমিত হয়। বেশ কিছুদিন পরে পুনরায় এই সব এলাকায় বসতি গড়ে উঠতে থাকে এবং স্থান বিশেষ নতুন বসতির ফলে নাম করণে নতুন করে পরিচিত হয়। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নিরাপত্তা জনিত কারণে কোথাও কোথাও পুনঃ বসতি আর গড়ে ওঠেনি।

নবগঠিত মহকুমা সদরের কাছে পশ্চিমে বাঁশদহের কাজী সাহেবদের বসত বাড়ী (বর্তমান টাউন মসজিদের জায়গা) ও তারও পশ্চিমে জেলাজজ আদালতের পুবদিকে জজ সাহেবের কুঠির এলাকায় বাবুখান সাহেবদের বাড়ী ছিল। আদালত ভবনের জায়গায় বাবু গঙ্গাচরণ সেনের বসতি ছিল বলে জানা যায়। কংগ্রেস নেতা বাবু গঙ্গাচরণ সেন (নগেন সেনের পিতা) তারও পশ্চিমে নদীর পাড় ধরে সেনের বাজার এলাকা থেকে উঠে এসে পরামানিক ও বাইতি এবং উত্তর-পশ্চিম কোণে দেয়াড়া ও ডুমুরিয়া থেকে উঠে আসা মুচিদের (ঋষি সম্প্রদায়ের লোক) বাস ছিল। মির্জাপুর মাঠের সম্ভ্রান্তীয়দের বসতি এলাকার মধ্যে কিছু ফলের বাগান ও নদীর অপর পারের সমৃদ্ধ জনপদের ও লবণ এজেন্সীর লোকদের আম কাঠালের বাগান ছাড়া বাকী জায়গা ঝোপঝাড় ও আগাছায় পূর্ণ ছিল। বুনোরা বসতির সময় এই সব ঝোপঝাড় সাফ করে সামান্য তরিতরকারী ও আখের চাষ করতো।

খুলনা-যশোরে বেশ কয়েকটা মির্জাপুর নামের গ্রাম দেখা যায়। এই মির্জাপুর নামের গ্রামগুলির পরস্পরের সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন, তবে বারভূঁইয়াদের অন্যতম মহারাজ প্রতাপাদিত্যের যশোর রাজ্য মোঘল অধিকার ভুক্ত হলে (১৬০৪ খ্রীঃ) একজন ফৌজদার কর্তৃক এ রাজ্য শাসিত হয়। এ সময় ফৌজদার ও সুবেদারদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদের অনুগৃহীত ব্যক্তিগণ ছোট ছোট জায়গীর বা পত্তনি নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। মির্জা উপাধিযুক্ত মোঘল বসতির বা জায়গীরগুলো কোথাও মির্জাপুর কোথাও মির্জানগর নামে পরিচিত হয় বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়।

একটা পুরনো দলিল সূত্রে জানা যায় জনৈক মহম্মদ ফয়জুল্লাহ যশোরের খড়কিতে বসবাসরত মির্জা লাল মহম্মদের কোন ওয়ারেশ এর কাছ থেকে এখানে নদীপাড়ের শিববাড়ী এলাকার কিছু সম্পত্তি খরিদমূল্যে প্রাপ্ত হয়ে বসতি করেন এবং বসতি এলাকার নাম দেন মিয়া বাগ। উক্ত দলিলে মুদাফত মির্জা লাল মহম্মদের নাম উল্লেখিত হওয়ায় ধারণা করা চলে যে, অত্র এলাকা মির্জা লাল মহম্মদের পত্তনি বা জায়গীরভুক্ত ছিল। সম সময়ে এখানে কিছু মির্জার বসতি হয়। মির্জা লাল মহম্মদ যশোরের মোঘল ফৌজদার নূর-উল্লাহ খাঁর জামাতা ও প্রধান সেনাপতি ছিলেন। নূর-উল্লাহ খাঁ ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে ভদ্রা ও হরিহর নদীর মোহনায় ত্রিমোহনীতে কয়েকটি এলাকার ফৌজদার ও তিন হাজারী মসনবদার হিসেবে নবাবের মত বসবাস করতেন। লাল মোহাম্মদ একজন সিপাহী হিসাবে নূর উল্লাহর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যে নিজের প্রতিভার গুণে ফৌজদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নূর-উল্লাহ খাঁ এই প্রতিভাবান যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে সেনাপতিতে উন্নীত করেন ও মেয়ের সাথে বিয়ে দেন। লাল মোহাম্মদ দীর্ঘদিন যাবত সেনাবিভাগের দায়িত্ব পালন ও শ্বশুরের সাথে শাসন কাজে সহায়তা করেন। নূর উল্লাহর কর্মচারী রাজা রাম সরকারের কন্যার সাথে লাল খাঁর অপূর্ব এক প্রেম কাহিনী আজও মনিরাম ও কেশবপুর অঞ্চলে লোকমুখে শোনা যায়। সেনহাটিতে লাল খাঁ কর্তৃ ক খনিত বিরাট জলাশয় ‘লাল খাঁর দীঘি’ বা ‘সরকার ঝি’ নামের স্মৃতিবহন করছে। নূরউল্লাহ খাঁর একপুত্র পরে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। নূরউল্লা খাঁ ও লাল খাঁর বংশধরেরা পরবর্তীকালে যশোরের খড়কি অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখ্য শিববাড়ীর পশ্চিম পাশে নূরনগর গ্রাম ফৌজদার নূর উল্লাহ নামের স্মৃতি বহন করছে।

কথিত মির্জাপুর মাঠের মধ্যে কোথাও প্রাচীন বাড়ীর চিহ্ন বা কোন ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায় না। তবে বর্তমান মির্জাপুর এলাকায় পাঁচু বুনোদের বসতির পূর্বদিকে সি, এস ম্যাপে উল্লেখিত মির্জাপুর রোড নামে সরু আঁকা বাঁকা একটা পায়ে চলার রাস্তার পাশে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় পাতলা টালি ইটের খিলানযুক্ত মাটি সমান একটা পাকা কবরের চিহ্ন ছিল।

এ রাস্তার উত্তর পাশের প্রায় সব জমি বাগেরহাটের দশানীর জমিদার ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের দখলি থাকায় দক্ষিণপাশ দিয়ে কিছু জমি ছেড়ে সাধারণ চলাচল উপযোগী প্রশস্ত করে নেন। এ রাস্তায় উভয়পাশে মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠাকালে বা তার নিকটবর্তী সময়ে কয়েকঘর বুনো ছাড়া অন্য কোন লোকের বাস না থাকায় স্বাভাবিকভাবে এ কবরের কোন পরিচয় ছিলনা। তবে বুনোরা অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে ইটের গাঁথুনি ও তার পাশে বড় একটা করবীফুলের গাছের জন্যে জায়গাটা সম্মানের চোখে দেখতো। জেলা শহর প্রতিষ্ঠার পর এ জমির উত্তর পূর্ব দিকের জমিতে জমিদারের কাছারী হিসেবে একটা গোলপাতার ঘরে একজন নায়েব বাস করেন। সমসময়ে এ রাস্তার পাশে আরও অনেকে বসবাস শুরু করেন কিন্তু কেহই এ বিষয়ে কোন ঔৎসুক্য প্রকাশ করেননি। ১৯২১/২২ সালে কবরের উত্তর পাশে একজন মুসলমান আইনজীবী (লেখক পিতা) একটা বাড়ী খরিদ করে বসবাসকালে কবরটি দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্তু পরিচয় বিহীন কবরটি পূর্ব অবস্থায় থাকে। এই জমিসহ পাঁচুদের সমস্ত জমির মালিকানা জমিদারদের হাতে চলে যায়। অবশ্য এই কবর ও তার পাশের উচু জায়গা কেউ কোন ভাবে ব্যবহার করতোনা। ষাটের দশকে এজমি বিক্রীত হয়ে নতুন বাড়ীর ভিত খনন কালে অজ্ঞতা প্রসূত কারণে প্রাচীন স্মৃতির এই কবরটি ভিতের তলায় শেষ পরিণতি লাভ করে। পাকা কবরের অবস্থিতির জন্যে বোঝা যায় যে, এক সময়ে এখানে মুসলিম বসতি এবং এ কবর কোন সঙ্গতিপন্ন পরিবার প্রধানের ছিল ও তার বাসস্থান নিকটে কোথাও হওয়া স্বাভাবিক। উল্লেখিত কারণে এ ধারণা অমূলক নয় যে ত্রিমোহনী ও মির্জাপুরের মুঘোলদের সাথে এ অঞ্চলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল এবং মির্জা লাল খার দ্বারাই মির্জাপুরের পত্তন ও নামকরণ হয়েছিল। পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, আঠার শতকের গোড়ার দিকে (১৭১০ খ্রী:) যশোর ফৌজদারী তুলে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া যায়। সঙ্গত কারণেই সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফৌজদার নূরুল্লা খা যশোর থাকা কালে সুবেদার শায়েস্তা খান দুর্ধর্ষ মগ ফিরিঙ্গী দস্যুদের দমন ও বাংলা থেকে বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। বিস্তীর্ণ সুন্দরবন অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকা দস্যুরা সুযোগ বুঝে সহজ নদীপথে এসে লোকালয়ে আক্রমণ ও লুণ্ঠন অনেকদিন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিল। এ ছাড়াও ওই শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ বঙ্গে মারাঠা দস্যুদের আক্রমণ বাখেরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল বলে জানা যায়। সুতরাং এসব দস্যুদের হাত থেকে এ অঞ্চল মুক্ত ছিল সন্দেহাতীতভাবে এ কথা বলা কঠিন। তবে যে কোন কারণে হোক এ জায়গা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই জনশূন্য ও ফাঁকা জায়গা নিকটবর্তী জনপদের কাছে মির্জাপুরের মাঠ বলে কথিত ও পরিচিত হয়।

এই মির্জাপুর মাঠের উত্তর পুর্ব কোণেই মহকুমা প্রশাসকের অফিস বাসস্থানের জন্য খড়ের ঘর ভুলে যেখানে প্রথম কাজ করা হয়, সে যায়গায় ফাঁকা ও উলু খড়ের বন ছিল। ১৮৪৫ সালে এখানে মহকুমা প্রশাসকের দপ্তর ও বাসস্থানের জন্যে প্রথম পাকা দালান নির্মিত হয়। এই দালান শহর এলাকার প্রথম সরকারী পাকা বাড়ী ও রেল এলাকা সহ শহর মধ্যের দ্বিতীয় পাকা বাড়ী। বর্তমানে এই থাকাবাড়ী জেলা প্রশাসকের বাসস্থানরূপে ব্যবহৃত।

মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠার জন্য মহকুমা প্রশাসকের বাসভবনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা নতুন রাস্তা পশ্চিম দিক বরাবর বর্তমান জেলাজজ আদালত ও কালেক্টরেট ভবনের মধ্যবর্তী রাস্তা পর্যন্ত নির্মিত হয়। এ সময় বর্তমান জেলখানা ঘাটের এখানে ভৈরব নদীর পারাপারের একটা ঘাট ছিল এবং ঘাট সোজা দক্ষিণমুখী টুটপাড়া পর্যন্ত একটা চলাচলের রাস্তা ছিল। নহকুমা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে থেকে নতুন রাস্তা এই রাস্তার সাথে সংযোগ করে দেয়া হয়। নদীর পাড় থেকে এই দুই রাস্তার মধ্যবর্তী এলাকা নিয়ে প্রথম মহকুমা সদর গঠিত হয়। মহকুনা সদরের পশ্চিমদিকে বর্তমান জেলাজজ আদালতের পুবদিকে অপর একটা খড়ের ঘরে মুনসেফ আদালতের কাজ শুরু হয়। এর পশ্চিমদিকে বৰ্তমান টাউন জামে মসজিদ এর এখানে বাঁশদহের কাজি সাহেবদের বাড়ী ও তার পাশে মুনসেফ আদালতের জায়গায় ছিল বাবুখান সাহেবদের বাড়ী। সদর প্রতিষ্ঠাকালে এদের বাড়ী ও সম্পত্তি হুকুমদখল করা হয়। কাজি সাহেবরা জমি বাড়ী হুকুমদখলের পর উঠে এসে নিকটবর্তী মুন্সি পাড়ায় ও বাবুখান সাহেবরা সাউথ সেন্টাল রোড এবং বাবুখান রোডের মিলিত স্থানের দক্ষিণ পুবকোণে (বর্তমান পাইওনিয়র মহিলা মহাবিদ্যালয়) বসতি করেন। এ জায়গা তখন টুটপাড়া গ্রামের অন্তর্ভুক্ত ও উত্তর সীমানা ছিল। এবং এখান থেকে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ টুটপাড়ায় গিয়ে বাস করেন। এছাড়া গঙ্গাচরণ সেন মহাশরের মহকুমা সদরের পশ্চিমাংশে বর্তমান আদালত ভবন এলাকায় বসতির কথা শোনা যায়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন