কৃষ্ণসিন্ধুকী – ৫

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

জমাদার দীনবাঈ জোশী ভুল কিছু ভাবেনি। প্রাচীন যুগে রাজারা তাঁদের কন্যার স্বয়ংবর সভার সংবাদ জানিয়ে সত্যিই দূত প্রেরণ করতেন দেশবিদেশে। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে বিবাহযোগ্য রাজা, রাজকুমাররা আসতেন। যথাসময়ে রাজকন্যা বরমাল্য হাতে উপস্থিত হতেন সভায়। দুরুদুরু বক্ষে রাজারা অপেক্ষা করতেন, কার ভাগ্যে রয়েছে সেই কাঙ্ক্ষিত বরমাল্য।

অনেকসময় এই স্বয়ংবর সভায় আরোপ করা হত কোনও শর্তের। রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রকে হরধনু ভেঙে সীতাকে বিবাহ করতে হয়েছিল। মহাভারতেও দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে পেতে অর্জুনকে করতে হয়েছিল লক্ষ্যভেদ। তবে এই বিবাহযোগ্যা রাজকন্যারা ছিলেন পূর্ণ তরুণী, অন্তত ষোড়শবর্ষীয়া। প্রাচীন ভারতবর্ষে বাল্যবিবাহের কোনও অস্তিত্ব ছিল না।

কিন্তু তবে যে শাস্ত্রের সেই বিখ্যাত শ্লোক?

অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষা তু রোহিণী

 দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা ঊর্ধং রজঃস্বলা।

কন্যার অষ্টম বর্ষে সে হল ‘গৌরী’। নবম বর্ষে ‘রোহিণী’। দশম বর্ষে ‘কন্যা’ এবং তারপর রজঃস্বলা। যদি তারপরেও তার বিবাহ না দেওয়া হয়, বাবা-মা ও বড় ভাই নরকে পতিত হন। পরবর্তী শ্লোক আরও ভয়ংকর। অবিবাহিতা রজঃস্বলা কন্যার পূর্বপুরুষরা প্রতিমাসে অমর্ত্যলোকে সেই কন্যার ঋতুকালীন রক্তপান করেন।

প্রাচীন যুগের বিবাহপদ্ধতি ও শাস্ত্রের এই শ্লোক যে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে। সভ্যতা কি তবে পিছিয়েছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। নিঃসন্দেহে সভ্যতা তখন পেছনের দিকে হেঁটেছিল। স্বাধীন শিক্ষিতা অনবগুণ্ঠিতা ভারতীয় নারীদের নির্মমহাতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল অন্তরালে। শুরু হয়েছিল পেট থেকে বেরোতে না বেরোতেই মেয়েদের ‘পার’ করার প্রস্তুতি।

তবে সময়ের বিপরীতে হেঁটে সভ্যতার এই পশ্চাদগমন অকারণ নয়। পেছন দিকে হাঁটার কারণটি যেমন যুক্তিপূর্ণ তেমনই মর্মন্তুদ।

সেটি বলার আগে জানতে হবে এক ‘বিশেষ পেশা’র মানুষদের সম্পর্কে। এখন সেই পেশা বিলুপ্ত, কিন্তু পাঠান আমলে প্রায় তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলায় চালু ছিল এই পেশা। তাদের নাম ‘সিন্ধুকী’।

সহজভাবে বলতে গেলে ‘সিন্ধুকী’রা ছিল গুপ্তচর। কিন্তু সেই চরদের কাজ শত্রুরাজ্যের যুদ্ধনীতি বা গোপন পরিকল্পনা জানা ছিল না। তাদের কাজ ছিল কোথায় কোন হিন্দু পরিবারে সুন্দরী মেয়ে রয়েছে, সেই খোঁজখবর নিয়ে গিয়ে শাসকদের দেওয়া। কোথায় কোন সদ্যতরুণীর বিবাহবাসর বসেছে, গায়ের জোরে নববধূকে তুলে নিয়ে গিয়ে ‘লুটের মাল’ এ পরিণত করা। এই বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সুন্দরী হিন্দু ললনাদিগের খোঁজ করিবার জন্য ‘সিন্ধুকী’-রা পল্লীতে পল্লীতে ঘুরিয়া বেড়াইত।’

কিন্তু কাদের জন্য সিন্ধুকীরা পল্লিতে পল্লিতে সুন্দরী হিন্দু মেয়ে খুঁজে বেড়াত?

এর উত্তরে দীনেশচন্দ্র সেন জানাচ্ছেন, ‘মুসলমান রাজা ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ ‘সিন্ধুকী’ লাগাইয়া ক্রমাগত সুন্দরী হিন্দু ললনাগণকে অপহরণ করিয়াছেন, তাহাদিগকে নিকা করিয়া তাহাদের গর্ভে বহু সন্তান উৎপন্ন করিয়াছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে ময়মনসিংহের জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ানগণ এবং শ্রীহট্টের বানিয়াচঙ্গের দেওয়ানেরা এইরূপে যে কত হিন্দু রমণীকে বলপূর্বক বিবাহ করিয়েছেন তাহার অবধি নাই। পল্লীগীতিকাগুলিতে সেই সকল করুণ কাহিনী বিবৃত আছে।’*

[*বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন।]

তখন মধ্যযুগ। এদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু নারীকে ক্রীতদাসী হিসেবে কাবুল, কান্দাহার, গজনী, বাগদাদ এমনকি সুদূর দামাস্কাসে নিয়ে গিয়ে সেখানকার ক্রীতদাসের হাটে বেচে দেওয়া হতে লাগল। ধীরে ধীরে সিন্ধুকীদের এই দৌরাত্ম্যে ত্রাস ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আগে হিন্দু নারীরা ঘোমটা দিত না। আর্যদের পোশাকের মধ্যে ঘোমটার উল্লেখ নেই।

সেনরাজ লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ধোয়ী তাঁর ‘পবনদূত’ কাব্যে বিজয়পুরের মহিলাদের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে অবগুণ্ঠনের সেভাবে উল্লেখ ছিল না। অবগুণ্ঠন ছিল কুলমর্যাদার প্রতীক। মেয়েদের শাড়ির সঙ্গে ওড়না এবং ছেলেদের ধুতি ও তার সঙ্গে গায়ে উত্তরীয় ছিল রীতিসিদ্ধ পোশাক। কিন্তু অভিজাত পরিবারের বাইরে যে বৃহত্তর শ্রমজীবী সমাজ ছিল, সেই সমাজের মেয়েদের মধ্যে কুলমর্যাদার প্রতীক অবগুণ্ঠন ছিল না। সুযোগও ছিল না, দরকারও হয়নি।

মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি উমাপতি ধর তাঁর লেখায় গ্রামের এক পল্লিবালার বর্ণনা দিচ্ছেন এইভাবে,

দূরোদঞ্চিত বাহুমূলবিলসচচীন প্রকাশ স্তনা
ভোগব্যয়ত মধ্যলম্বিবসনানির্মুক্ত নাভিহ্রদা।
আকৃষ্টোজ্ঝিত পুষ্প মঞ্জরিরজঃ পাতাবরুদ্ধেক্ষনা
চিন্বত্যাঃ কুসুমং ধিনোতি সুদৃশঃ পাদাগ্রদুস্থা তনুঃ।

 .

একবসনা পল্লিবাসিনী বাঙালি নারী বনের মধ্যে ঢুকিয়াছেন ফুল আহরণের জন্য। একটু উঁচুতে নাগালের বাইরে গাছের ডালে ফুল ফুটিয়া আছে। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া বাহু উপরের দিকে তুলিয়া সুন্দরী ফুল পাড়িতেছেন। নাভিহ্রদ বসনমুক্ত, একদিকের স্তন প্রকাশিত।*

[অনুবাদ – বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব: অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়।]

এখানেও ঘোমটা দেওয়ার মতো কাপড়ের উল্লেখ নেই।

কিন্তু সিন্ধুকীদের ‘টার্গেট’ পূরণের চাপে মেয়েরা ঘোমটা দিতে শুরু করল। হিন্দু ধর্মে কোনও বৈদিক যজ্ঞই রাতে করা যায় না। বিবাহ হয় দিনের বেলায়। কিন্তু ‘সিন্ধুকী’ দের হাত থেকে ঘরের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য গোপনে রাতের অন্ধকারে যজ্ঞ সেরে বিয়ে দেওয়া হতে লাগল। মেয়েরা ‘নারী’ হয়ে ওঠার আগেই শুরু হল ‘গৌরীদান’। ধীরে ধীরে এই সবগুলোই কালের নিয়মে প্রথা হয়ে গেল। মানুষ প্রেক্ষাপট ভুলে গেল, ঐতিহ্য বিস্মৃত হল, আঁকড়ে ধরল শাস্ত্রের ‘অপভ্রংশ’ গুলোকে। বিশ্বাস করতে শুরু করল স্মার্ত পণ্ডিতদের লেখা নতুন অনুশাসনকে।*

[*গবেষক ধ্যানগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কাস্ট অ্যাণ্ড আউট কাস্ট’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ভারতে অত্যাচারী মুসলমান শাসন এদেশের হিন্দুদের নিজস্ব কিছু কিছু স্বাভাবিক ভাল ঐতিহ্যকে পরিত্যাগে বাধ্য করেছে।]

এই কাহিনির সময়কালে ‘সিন্ধুকী’ পেশাটি পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গেছে, এমনকি তাদের অস্তিত্বও মানুষ ভুলে গিয়েছে, কিন্তু রয়ে গেছে আরোপিত প্রথাগুলি। ‘স্বয়ংবর’ তো দূর, তখন সমাজে বহুবিবাহের চোটে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের নাভিশ্বাস উঠছে। বিদ্যাসাগর মশাই গত হয়েছেন বছর কুড়ি হল, তাঁর অপরিসীম তেজে তিনি বিধবাবিবাহ চালু করতে পেরেছিলেন, কিন্তু শতচেষ্টাতেও বহুবিবাহ রদ হয়নি।

এমন এক সময়ে ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ড থেকে কয়েকশো মাইল দূরের আন্দামানে পরিণত বয়স্কা নারীরা নিজের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, তাও আবার একাধিক পাত্রদের মধ্য থেকে নিজের পছন্দমাফিক, এ ‘স্বয়ংবর’ ছাড়া আর কী?

 সব জায়গাতেই চর আছে। তা সরকারের দফতরে হোক কিংবা জেলের মধ্যে। একেকটা করে মেয়ে পাঁচবছরের কোটা পূর্ণ করে, আর পুরুষ কয়েদিরা হামলে পড়ে। এখানে মধ্য চল্লিশের রমণীরও বিয়ে হয়ে যায়, সেখানে নীলামণির মতো পূর্ণযুবতীকে বিবাহ করার জন্য ভিড় তো হবেই।

নীলাকে বিয়ের জন্য অ্যাপ্লিকেশন পড়ল গুনে গুনে তেরোটা।

সেই আবেদনের মধ্যে দশটারও বেশি হত্যা করা খুনে ডাকাত থেকে শুরু করে বউকে পিটিয়ে মারা পাশবিক আসামি, শিশুকামী ধর্ষক সবরকমই আছে। সবাই নিজের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে অর্জিত জমানো তহবিল থেকে সাড়ে আট টাকা নিয়ে মনোনয়ন ফি পেশ করেছে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে। আবেদনে মুন্সিকে দিয়ে লিখিয়েছে, তার যা আয়, তাতে সে স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে সক্ষম। তাদের সবাইকেই উপস্থিত হতে হবে স্বয়ংবরে।

নীলামণির ‘স্বয়ংবর’ এর দিন মহিলা জেলে ভিড় উপচে পড়েছিল। মনোনয়ন পেশ করা পাত্রদের থেকে কৌতূহল বেশি ছিল অন্যান্য বন্দিনীদের। যবে থেকে নীলামণি এখানে এসেছিল, তবে থেকে তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেও কারুর বিশেষ সুবিধা হয়নি। নীলামণি মিষ্টভাষী, কিন্তু অত্যন্ত স্বল্পবাক। মেয়েমানুষ কথা কয় না, তাতে কি সুখ হয়? যত দিন গিয়েছে, নীলামণির স্বতন্ত্রতাই সবার থেকে তাকে আলাদা করে দিয়েছিল। তাই বাকি সকলের উত্তেজনা ছিল একটু বেশিই।

জুঁইবালা, মিনতি, ভীমির মতো প্রগলভ কয়েদিরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে চলেছিল।

‘মেয়েটা তো এমনিই ঘোড়েল, নিঘঘাত ওই জোয়ান মরদটাকে পচন্দ করবে, দেখিস!’

আরেকজন মাথা নাড়ে, ‘নারে, নীলামণি কতা কম কয়, কিন্তু মেয়েটা ভাল। দয়ামায়া আচে।’

‘মাগো! তোকে বুঝি নিজের ভাগের লপসিটা রোজ খাইয়ে দেয়, যে এমন গুণগান গাইচিস?’

তৃতীয়জন হেসে লুটিয়ে পড়ে, ‘তাই না তাই! বলি এখানে ভাল’টা কে?’

.

মেয়েদের গুঞ্জন চলছিল, ওদিকে তেরোজন পুরুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরা সবাই গত কয়েকবছরে জেলের সেল থেকে মুক্ত হয়ে ‘ফ্রি টিকিট’ নিয়ে চলে গিয়েছিল ‘স্বাবলম্বন’ গ্রামে। সেখানে সরকারের দেওয়া জমিতে তারা নিজের নিজের কুঁড়েঘর তুলেছে। কেউ জাহাজে মাল বোঝাইয়ের কাজ করছে, কেউ বনবিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে কাঠ মেশিনে কেটে তক্তা, বাটাম বা কড়িবরগা বানাচ্ছে, কেউ আবার চিরাচরিত মাছ বা নারকেলের ব্যবসা করে দু’পয়সা কামাচ্ছে।

হোক না এই দ্বীপপুঞ্জে বন্দি, এতবছর পর খোলা আকাশের নীচে হাতে পায়ে বেড়ি না পরে মুক্তি জীবনযাপন এদের কাছে স্বর্গবাস। কিন্তু সেই স্বর্গসুখ কি একা একা ভোগ করা যায়? না সেই ভোগে পূর্ণ আনন্দ মেলে? খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের দুশ্চিন্তা মিটতেই তাদের কাছে তাই মুখ্য হয়ে ওঠে জীবনসঙ্গিনী লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পেশকার লাইনে দাঁড়ানো ‘স্বাবলম্বী’ কয়েদিদের নাম নম্বর ঠিকানা রেজিস্টার থেকে মিলিয়ে নিচ্ছিল। তেরোজনের মধ্যে দশজনের বয়স চল্লিশের নীচে। বাকি তিনজন পঞ্চাশ পেরিয়েছে।

তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী যে, সে দাঁড়িয়েছিল ছ’নম্বরে। বয়স বড়জোর পঁচিশ। দোহারা দেহ এখানকার অপরিসীম দৈহিক পরিশ্রমে আরও সুগঠিত হয়েছে। গালে চাপ দাড়ি। রং শ্যামলা। চুল উসকোখুসকো। সে কিছুদিন মাত্র হল ছাড়া পেয়েছে জেল থেকে।

পেশকার লঘুচালে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘কীরে শেখর, বে’র জন্য ফি তো ভরেচিস। বউকে রাকবি কোতায়? মাথার ওপর ছাদই এখনও তুলতে পারলি নে।’

 শেখর নামক ছেলেটি কিছু বলল না। শুধু জিভটা বুলিয়ে নিল নীচের ঠোঁটে।

নীলামণি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাকাল শেখরের দিকে। শেখরও যেন একবার আলগোছে বুলিয়ে নিল তার নজর। দু’জনের এই চোখাচোখি নজর এড়াল না কারুর। জুঁইবালা ফিসফিস করল, ‘নীলামণি কি সোয়ামি আগে থেকেই বেছে রেখেচে নাকি?’

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এগিয়ে এলেন। দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গ, মুখে জ্বলন্ত চুরুট এই সাহেবের নাম হ্যারি কোলফিল্ড। কোলফিল্ড সাহেব অন্যান্য কর্তাদের মতো নিষ্ঠুর বা মেজাজী নন। কয়েদিদের প্রতি তিনি মোটামুটি সদয় ব্যবহারই করে থাকেন। কিন্তু তাঁর অসুখ অন্য। বন্দিনীদের প্রতি তাঁর একটু বেশিই পক্ষপাত। রস আইল্যান্ডের একান্তে তাঁর বাংলো। খাড়া পাহাড়ের শেষ প্রান্তে দেড় মানুষ উঁচু প্রস্তরপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা তাঁর বাসস্থানে প্রায় দিনই মধ্যরাত্রে পৌঁছে দেওয়া হয় কোনও না কোনও ‘ইচ্ছুক’ বন্দিনীকে।

না। তিনি ধর্ষকামী নন। কারুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। এই ব্যাপারে সাহায্যের জন্য তাঁর বিশ্বস্ত কিছু জমাদার, টিন্ডেল আর দেশীয় চর আছে। তারা কমবয়সী সুশ্রী বন্দিনীদের টোপ দেয়। রাতের অন্ধকারে সেই বন্দিনীরা যে মুহূর্তে কোলফিল্ডের অঙ্কশায়িনী হয়, ঠিক তখনই সেলুলার জেলের অফিসরুমে রেজিস্টার খাতায় তার জেলের মেয়াদের সময় পেন্সিলের কেরামতিতে ‘আড়াই বছর’ থেকে একলাফে হয়ে যায় ‘সাড়ে চার বছর’। সাহেবের থেকে মোটা বখশিসে টিন্ডেল বা জমাদাররাও খুশ, আবার কয়েদি মেয়েটিও কিছুদিনের মধ্যে মুক্ত হওয়ার স্বপ্নে খুশ।

কোলফিল্ড সাহেব নীলার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। মেয়েটি যে অপরূপ সুন্দরী তা নয়, আলগা একটা শ্রী রয়েছে। কিন্তু সবার চেয়ে যা মেয়েটিকে আলাদা করেছে, তা হল মেয়েটির চোখ, হাঁটাচলার ধরন। বুদ্ধিদীপ্ততা আর আত্মবিশ্বাস যেন ছলকে পড়ছে।

কোলফিল্ড সাহেবের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই মেয়েটির কথা তো কেউ একবারও তাঁর কানে তোলেনি?

পেশকার এগিয়ে এসে উঁচু গলায় বলল, ‘পরম প্রতাপান্বিত মহামহিম রাজীবলোচন বীরশ্রেষ্ঠ বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজসূর্য হিজ ম্যাজেস্টি সপ্তম এডওয়ার্ডের আদেশানুক্রমে, আন্দামান সেলুলার জেলের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্রাউনি ও মহামান্য জেলার ডেভিড ব্যারির সম্মতিতে এবং মাননীয় ম্যাজিস্ট্রেট কোলফিল্ড সাহেবের সগৌরব উপস্থিতিতে আজ মহিলা ডিভিশনের সাতাশ নম্বর সেলের ১৯৩২৪ নম্বর কয়েদি শ্রীমতী নীলামণি চক্রবর্তীর শুভ স্বয়ংবর আয়োজন করা যাইতেছে। মনোনয়ন পেশ করা পাত্ররা সারিবদ্ধ হইয়া দাঁড়ান। গোলমাল করিবেন না। মহিলা জেলের জমাদার দীনবাঈকে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে, সে যেন বন্দিনীকে লইয়া পরপর আগ্রহী পাত্রদের সম্মুখে দাঁড় হয় ও বন্দিনীকে নিজ পছন্দমাফিক পাত্র বাছিয়া লইতে সহায়তা করে। ঘোষণা শেষ হইল।’

এই স্বয়ংবরে মালা নেই। রয়েছে হলফনামা কাগজ। দীনবাঈ নীলামণির হাত ধরে এগোল। একই সারিতে পরপর তেরোজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে হলফনামাটা নীলামণির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাকে পচন্দ, তার হাতে কাগজটা ধরিয়ে দে।’

নীলামণি চোখ তুলে তাকাল। তেরোজন পাণিপ্রার্থী পুরুষ উৎসুক চোখে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। কেউ চোখের ইঙ্গিতে কিংবা আলতো হাসিতে নিজেকে সপ্রতিভ দেখানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ আবার ধ্যানমগ্ন বিশ্বামিত্রের মতো নিরাসক্ত মুখে জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সকাল থেকেই নীলামণির খুব হাসি পাচ্ছিল। অতিকষ্টে সে হাসি সংবরণ করছিল। ভাগ্যের কী আশ্চর্য পরিহাস! এক কালে তার ব্রাহ্মণ পিতা তার বিবাহের জন্য দুশ্চিন্তায় কত না নিদ্রাহীন রাত অতিবাহিত করতেন। ঘটক একেকটা সম্বন্ধ নিয়ে আসত। কোনও কুলীন পাত্রের ইতিমধ্যেই বিবাহের সংখ্যা একশো অতিক্রম করেছে, কোন পাত্র আবার বার্ষিক ‘ভিজিট’ এর বিনিময়ে শ্বশুরালয়ে পদধূলি দেওয়ার অগ্রিম শর্ত পাঠিয়েছে। অবশেষে নিজের চেয়েও বয়স্ক জামাতার হাতে কন্যাকে সঁপে ওর বাবা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

সেইসব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে নীলামণির হাসি আরও বেড়ে গেল। ওর বলতে ইচ্ছে হল, বাবা! আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন? আজ আমি কেমন রাজেন্দ্রাণীর মতো এসে দাঁড়িয়েছি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন, এখানে আমার চুল, পা, লক্ষণ কেউ দেখছে না। এখানে কাকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করব, সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে আমার!

‘কী হল? স্বপ্ন দেকচিস নাকি?’ পাশ থেকে দীনবাঈ ধমকে উঠেছিল, ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কি তোর জন্য সারাদিন একানে বসে থাকবেন? তাড়াতাড়ি নে।’

স্বপ্নই বটে। আকস্মিক সেই স্বপ্নভঙ্গে নীলামণি চমকে উঠেছিল। তারপর সোজা হেঁটে গিয়ে কাগজটা ধরিয়ে দিয়েছিল একেবারে ডানদিকে জড়সড় দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির হাতে।

জুঁইবালা, ভীমি, মিনতিরা তো বটেই, দীনবাঈ নিজেও চমকে উঠেছিল। এ আবার কী! এত জোয়ান থাকতে নীলামণি কিনা পছন্দ করল থুত্থুড়ে বুড়োকে?

বুড়োই তো! মাথার চুল প্রায় সাদা, পিঠ কুঁজো হয়ে গেছে। মুখের চামড়ায় সুস্পষ্ট বলিরেখা।

যে মধ্যবয়স্ক পুরুষ টিন্ডেল অফিসের রেজিস্টার থেকে নীলামণির বিবরণ শুনিয়েছিল, এ এবার ব্যথিত চোখে দীনবাঈয়ের দিকে তাকাল। তাঁর ভাবখানা এমন, ‘আমি তখনই বলেছিলুম, মেয়েটার মাথার ব্যামো আছে।’

দীনবাঈও অবাক। নীলামণি একটা উনিশ বছরের সদ্য যুবতী, তার পক্ষে তো যুবকদের মধ্যে কাউকে বেছে নেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। সে নিজের পিতামহের বয়সী একজনের হাতে কাগজ দিল কেন?

ম্যাজিস্ট্রেট কোলফিল্ড সাহেব কিছু বলার আগে দীনবাঈ নীলামণির কানের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে ধমকে উঠল, ‘চোকের কি মাতা খেয়েচিস নাকি? কাগজটা ফেরত নে।’

কিন্তু নীলামণি অবিচল কণ্ঠে বলল, ‘ফেরত নেব কেন!’

‘ফেরত নিবি না তো কি তুই ওই ঘাটের মড়ার গলায় মালা দিবি নাকি?’

নীলামণি সামান্য থামল। তারপর বলল, ‘আমার পছন্দে বিয়ে করতে বলেছ। আমি তাই করেছি।’

দীনবাঈ আর কিছু বলতে পারল না। জুঁইবালা, মিনতিদেরও মুখ মলিন হয়ে গেছে। এখানে এত ‘সম্বুর’ হয়েছে, কিন্তু এমন আশ্চর্য ঘটনা ওরা কখনও দেখেনি। পুষ্প বলে এক কিশোরী আছে। একমাত্র ওর সঙ্গেই নীলামণি স্নান বা অন্যান্য সময়ে দেখা হলে টুকটাক কথা বলে।

পুষ্প অস্ফুটে বলল, ‘যাহ। তবে যে নীলাদিদি ওই ছেলেটাকে টেরিয়ে টেরিয়ে দেকচিল?’

‘তা তো তুই-ই ভাল জানবি লো! রাতদিন তো নীলাদিদি নীলাদিদি করে হেদিয়ে মরিস। মাগো, এ কেমনধারা মেয়েমানুষ? জেনেশুনে বুড়োর গলায় ঝুলতে চায়?’ জুঁইবালা বিস্ময়ে গালে হাত দেয়।

সবাই অবাক হলেও মিনতির চোখে আশার আলো। চকচকে মুখে সে বলে, ‘আমার তো পাঁচ পুরতে তিনবচ্ছর লাগবে এখনও। তখনও কি ওই জোয়ান ছেলেটা আইবুড়ো থাকবে?’

কেউ মিনতিকে আশ্বাস দিল না। কে ওই সৌভাগ্যবান লোলচর্ম বৃদ্ধ যে এই বয়সে এক উদ্ভিন্নযৌবনার স্বামী হবে? দীনবাঈ তড়িঘড়ি গিয়ে পেশকারের হাতের কাগজে উঁকি দিয়েছিল।

নাম গৌরীপ্রসন্ন ভৌমিক। বয়স একাত্তর বৎসর। অপরাধ: স্বদেশি ডাকাতি।

দীনবাঈয়ের আর কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না সেদিন। তার মনে হয়েছিল, সেই বয়স্ক টিন্ডেলই ঠিক। নীলামণি মেয়েটির মাথায় গন্ডগোল আছে।

 উলু-লু-লু-লু-লু!

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসে পড়েছেন। সঙ্গে জেলার। কিছু সিপাই। একজন আনকোরা পুরোহিত। তিন-চারজন সাধারণ কয়েদি। আর মধ্যমণি হয়ে এসেছে সেই বৃদ্ধ পাত্র। তার মাথায় টোপর। মেয়েরা উলুধ্বনি দিচ্ছে।

দীনবাঈ শশব্যস্তে এগিয়ে এল।

পাত্রের বন্ধুস্থানীয় যে কয়েকজন বন্দি ‘স্পেশাল পারমিট’ করিয়ে আজ মহিলা জেলে এসেছে, তাদের মধ্যে একজন হল সুবীর মালাকার। নীলামণির স্বয়ংবরে সেও একজন পাত্র ছিল। তাকে ছেড়ে বৃদ্ধের গলায় মালা দেওয়ার শোক সে কাটিয়ে উঠলেও তার স্বর থেকে শ্লেষ যায়নি। সে সরস টিপ্পনি কাটল, ‘গৌরীখুড়ো, তোমার টোপরের তো আদ্ধেক জায়গা জেলের ধাড়ি ইঁদুরগুলো চিবিয়ে খেয়েচে।’

‘খেয়েছে তো কী হয়েছে? জিনিসটাকে যে এখনো টোপর বলে চেনা যাচ্ছে, সেটাই কি এই দ্বীপান্তরে যথেষ্ট নয়?’ গৌরীপ্রসন্ন গম্ভীরমুখে বললেন, ‘আর টোপর বানানোর ভার তো তোর। তুই বানাসনি কেন?’

‘আমার ওপর?’ সুবীর বিস্মিত, ‘বে’র আনন্দে মাথা টাতা খারাপ হল নাকি খুড়ো? আমি আবার কবে থেকে টোপর বানানোর কাজ নিলাম?’

‘তুই নিস কিংবা না নিস। জন্ম থেকেই সে ভার তোর ওপর চলে এসেছে।’ গৌরীপ্রসন্ন মৃদু হাসলেন, ‘মহাদেব নিজের বিয়ের জন্য বিশ্বকর্মাকে মুকুট বানাতে বলেছিলেন। কিন্তু বিশ্বকর্মা শিবঠাকুরের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। তাঁর বানানো মুকুট পছন্দ হয়নি ভোলানাথের। তখন মালাকার নামে একজন মানুষ জলাভূমি থেকে শোলাগাছ কেটে বানায় টোপর। তারপর থেকে মালাকাররাই সেই শোলার টোপর বানিয়ে আসত। বুঝলি?’

সুবীর মালাকার মুখ বেজার করল, ‘ওসব ছেঁদো কথা রাখো দিকি খুড়ো। সবসময় লেখাপড়ার গুমোর দেখিও না। তোমার স্যাঙাত কই গেল? তাকে তো সকাল থেকে দেখচি নে?’

‘কে? শেখর? সে আসবে। একটা কাজে গেছে।’ গৌরীপ্রসন্ন হরিনাথের দিকে তাকালেন, ‘মন্ত্র টন্ত্র সব জানিস তো? দেখিস বাপু, বিয়ে দিতে গিয়ে আমার শ্রাদ্ধ করে দিস না!’

‘তোমার যা বয়স, শেষেরটাই মানায় ভাল।’ সুবীর নিজের মনে বিড়বিড় করে। যবে থেকে এই বিয়ে ঠিক হয়েছে, তবে থেকে ওর মনমেজাজ ঠিক নেই। আন্দামানে বসে যুবতী পাত্রী পাওয়া আর লটারি লাগা একই ব্যাপার। নীলামণি নামক মেয়েটির স্বয়ংবরে শুধু ওর নিজেরই কড়কড়ে সাড়ে আট টাকা মনোনয়ন ফি নষ্ট হয়নি, আরও এগারোজনের হয়েছে। তবু যদি মেয়েটা ওরই মতো কোনও জোয়ানের গলার মালা দিত, তবে এতটা খারাপ লাগত না। ওদের সবাইকে টপকে কিনা গৌরীখুড়ো পাত্র হচ্ছে? কেন, কী আছে তার মধ্যে, যা ওদের কারুর মধ্যে নেই? সুবীর নিজে রস আইল্যান্ডে এক বুড়ো মেমসাহেবের রিকশা চালায়। সে-ই বা কম কীসে?

সাধে কি একটা কথা আছে, স্ত্রীলোক চরিত্র অতি দুর্জ্ঞেয়!

ভাবতে ভাবতে সুবীরের চোখ পড়ে সামনের দিকে। ওই তো! ওই তো শেখর ঢুকছে। ঠিক হয়েছে। ব্যাটা এমন হাবভাব দেখাচ্ছিল সেদিন, যেন ঘরে ঢুকেই মেয়েটা ওর হাতে কাগজ ধরাবে। পঁচিশ বছরের মদ্দাজোয়ান বলে কথা। বেশ হয়েছে। দিনরাত যে খুড়োর পেছনে স্যাঙাতগিরি করে চলে, সেই খুড়োই বাঁশটা দিয়েছে। উল্লাসে সুবীরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

পরক্ষণেই কেজো ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, ‘কীরে শেখর। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’

শেখর মাথা নাড়ে, ‘জাহাজঘাটায় গিয়েছিলাম।’

‘কেন, এই সাত সকালে?’

শেখর উত্তর দেয় না। ওকে ঢুকতে দেখে দীনবাঈ চেঁচায়, ‘এত দেরি কেন? তুমিই তো সাক্ষী হবে?’

‘আজ্ঞে।’

জেলের বিয়ের নিয়ম হল, বরের তরফে একজনকে গিয়ে আগেভাগে সইসাবুদ করতে হবে। সাক্ষী হতে হবে। শেখর নিজে ওই ছুঁড়িটাকে বিয়ে করার জন্য হেদিয়ে মরছিল, এখন সে-ই কিনা সাক্ষী হবে? রগড় আর কাকে বলে!

সুবীর মুখ বেঁকাল। গৌরীখুড়ো আর শেখর দু’জনেই রাজবন্দি। বিদ্যের অহংকারে মটমট করছে দু’জন। সুবীর নাহয় সই করতে জানে না, কিন্তু ওদের দলের কেউ কেউ তো দিব্যি পারে। কিন্তু রাজবন্দিরা সাধারণ বন্দিদের পাত্তাই দিতে চায় না।

ডাকাতি আর খুনের দায়ে দ্বীপান্তরের জেল খাটতে এসেছিল সুবীর। সেই রাতে কী যে হয়েছিল, জমিদারের চতুর্থপক্ষ কিছুতেই বিছেহারটা খুলে দিচ্ছিল না। মাথাটা দুম করে গরম হয়ে গিয়েছিল, কাটারির এক কোপে বউটার মাথাটা ধড় থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। আদালতে যখন জজসাহেব জিজ্ঞেস করছেন, তখনও ও ভয় পায়নি। বুক চিতিয়ে পুরোটা নিজেই বলেছিল। সাজা ঘোষণার পর পোড়া ল্যাটামাছ দিয়ে কালী মা’কে ভাল করে পুজো করে জাহাজে উঠেছিল। ওর বীরত্বের সঙ্গে এই মিনমিনে রাজবন্দিগুলোর তুলনা? জানে খালি গা গরম কথা বলে লোককে উসকোতে আর মিটিং মিছিল করতে। তাও যদি সাহেব মারা কোনও নামকরা রাজবন্দি হত। হুঁহ! যত্তসব!

.

সুবীর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমনসময় দুটো অল্পবয়সী মেয়ে হইহই করতে করতে ঘরে ঢুকে এল। সুবীর ওদের চেনে। পুষ্প আর মিনতি। মিনতির হাতে টাটকা ফুলের মালা। রজনীগন্ধার সুবাসে সারা ঘর ম ম করে উঠল।

দীনবাঈ হুকুম করল, ‘শুন পুষ্প, এই মরদকে সাথে নিয়ে অন্দরমে সাহেবকে পাস যা।’

ম্যাজিস্ট্রেট আর জেলার এসেই আগে ভেতরের ঘরে ঢুকে গিয়েছেন। সেখানে সই হবে। তারপর বিয়ের রীতিনীতি সারা হবে সকলের সামনে।

শেখর কোনও কথা না বলে পুষ্পর পিছু নিল। পুষ্প মেয়েটা বাচ্চা। ওর মা ছিল খুনের দাগি আসামি। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সময় কোলের একরত্তি মেয়েকে নিয়েই জাহাজে চেপেছিল। আন্দামানের নোনা জংলা আবহাওয়ার সঙ্গে যুঝতে না পেরে অনেকের মতো সে-ও মারা যায় কয়েকবছরের মধ্যে। তারপর থেকে পুষ্প জেলেই থাকে বটে, কিন্তু সারাদিন কাজ করে জেলের হাসপাতালে। ডাক্তারের পাশে পাশে থাকে। রুগীর সেবা করে, কাজকর্ম শেখে। ওসবে তার ভারী আগ্রহ।

দ্বীপের সর্বত্র ওর যাতায়াত অবাধ। প্রায়দিনই বিকেলে সে চলে যায় স্বাবলম্বন গ্রামের ছোট ছোট কুঠিগুলোয়। হাসিখুশি পুষ্পকে সবাই ভালবাসে।

এই ঘরের গোবরাট পেরিয়ে ও’ঘরে ঢোকার জায়গাটা আলো আঁধারি। পুষ্প হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, শেখর সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেনে ধরল।

পুষ্প চমকাল না। যেন সে প্রস্তুত হয়েই ছিল, ঘরে ঢোকার একেবারে আগের মুহূর্তে হাতের মুঠোর মধ্যে এতক্ষণ শক্ত করে ধরে থাকা চিরকুটটা গুঁজে দিল শেখরের হাতে।

শেখরের বুকের ভেতরটা দুলে উঠল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সামনে গিয়ে বিয়ের সাক্ষীর কলামে সই করতে যতটুকু সময় লাগে। বাষ্পচোখে নীলামণি চক্রবর্তী ও গৌরীপ্রসন্ন ভৌমিকের বিবাহচুক্তিতে witness কলামে স্বাক্ষর করে ও বাইরে বেরিয়ে এল।

বেরনোর সময় গৌরীপ্রসন্নর সঙ্গে চোখাচোখি হল।

‘কীরে, কোথায় চললি?’

‘আসছি!’

মহিলা জেলখানার পেছনেই সমুদ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বালুকাতটে। নোনা বাতাস এসে উড়িয়ে দিচ্ছে চুল। একদমে সেখানে ছুটে গিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল শেখর। হাতের তালুর মধ্যে ঘামে ভিজে উঠেছে চিরকুটটা।

‘মন খারাপ করো না শেখরদা। গৌরীজ্যাঠার সঙ্গে আলোচনা করেই এ বিয়েতে বসছি। জ্যাঠা আমায় মেয়ের মতো ভালবাসেন।’

মেয়ের মতো? শেখর হতভম্ব হয়ে গেল। এ’সবের মানে কী? শেখর চিরকুটে মুখ ফেরাল।

‘ভাবছ, কেন এমন করলাম? বাবা আমার কী নাম রেখেছিলেন, জানো? নীলকান্তমণি। কিন্তু নীলা সবার সয় না যে। সয়নি। আর, আজ ওরা আসছে। মনে রেখো, তোমার লক্ষ্য আমার মতো সামান্য নীলকান্তমণি নয়, শেখর। স্বাধীন ভারতবর্ষের বিশাল নীল আকাশ। কথা হবে। নীলা।’

শেখর চিরকুটটাকে আরও কয়েকবার পড়ল। ওর চঞ্চল নেত্রমণি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। ক্রোধ প্রশমিত হয়ে দুঃখে ভরে উঠল মনটা। ভারত মহাসাগরের তীরে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকা ঢেউগুলোর সঙ্গে সঙ্গত করে ওর মন চলে যাচ্ছিল বহুদূরে।

কিছু নারী এই পৃথিবীতে আছে, যাদের হৃদয় মহাসাগরের অতলান্তের অন্ধকারের চেয়েও বেশি রহস্যময়। নীলা তাদেরই একজন। যখন শ্রীফলতলা গ্রামের একরত্তি কিশোরী হয়ে খেলে বেড়াত, তখন থেকে দেখছে। কখনও পাহাড়ি জলপ্রপাতের মতো উচ্ছল, কখনও মাঝসমুদ্রের মতো শান্ত। নির্বিকল্প।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে তাকাতেই ও ফণীভূষণকে দেখতে পেল। দু’হাতে দুটো বড় বড় জলের বালতি। ওর এখন বারান্দা পরিষ্কারের ডিউটি চলছে। সমুদ্রের নোনা জল বালতি বালতি ভরে নিয়ে গিয়ে দোতলা আর তিনতলার বারান্দা নারকেল ছোবড়া দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে হয়। ফণীভূষণ তাই বাইরে জল ভরতে এসেছে।

শেখর সময় নষ্ট করল না। জেলবন্দি কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলা একেবারে মানা। তবু হাত পাঁচেক দূর থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘খবর শুনেছিস?’

‘শুনব না আবার! সারা আন্দামান জেনে গেল বলে!’

‘হ্যাঁ রে, অরবিন্দবাবুও আসছেন নাকি?’

‘না। ওরা অনেক চেষ্টা করেচিল। চিত্তরঞ্জন দাশ এমন সওয়াল করেচেন যে ফিরিঙ্গি জজসাহেবরা কিচুতেই কিচু করতে পারেনি।’

শেখরের চোখ মুখ উল্লসিত হয়ে উঠল, ‘সবাই ছাড়া পেয়ে গেছে?’

‘সবাই নয়। অরবিন্দ ঘোষ ছাড়া পেয়েচেন। তাঁর ভাই বারীন ঘোষ আর উল্লাসকরের ফাঁসির আদেশ হয়েচিল। কিন্তু তা রদ হয়ে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েচে। ওদের দু’জনেরই আজ আসার কথা।’

‘আর?’

‘হেমদাদা। উপেনদাদা। আরও তিন-চারজন আচেন। অত হাঁড়ির খবর জানি না। সবাই ওই আলিপুর বোমা মামলারই আসামি।’

‘হেমদাদা মানে হেমচন্দ্র কানুনগো? যিনি ফ্রান্স থেকে বোমা বানানো শিখে এসেছিলেন?’

ফণীভূষণ অবাক হল, ‘এত বছর ধরে এখানে পড়ে রয়েচ, তবু তো তুমি দাদা দেখচি সব খবর রাখো।’

‘রাখতে তো হবেই।’ শেখর নিঃশ্বাস ফেলল, ‘দেহটাই শুধু এখানে থাকে যে। কলকাতা থেকে মাসে দু’মাসে জাহাজে ডাক এলেই তক্কে তক্কে থাকি। সাহেবরা ক’দিন পরপরই সেগুলো ফেলে দেয়। অমনি খবরগুলো গিলি। জানিস, হেমদাদা আমায় খুব ভালবাসতেন। তখন সতীশ বসু সবে অনুশীলন সমিতি তৈরি করেছেন। লাঠিখেলা। ব্যায়াম। ড্রিল। তরোয়াল খেলা। কুস্তি। কত কী শিখতে হচ্ছে। হেমদাদা তখন থেকেই চেষ্টা করতেন, কী করে আরও ভাল বোমা বাঁধা শেখা যায়। নিজের বাড়িখানা অবধি বন্ধক রাখার কথা ভাবছিলেন।’

‘বন্ধক রেখে গেচিলেনও। রুশ সেনাদের থেকে বোমা তৈরি শিখে এসে কত ছেলেকে শিখিয়েচেন।’

শেখর চিন্তিত মুখে বলল, ‘আমরা রাজবন্দিরা এখানে এসেছি ঠিকই। কিন্তু এত বড় মাপের লোকেরা বোধহয় আন্দামানের মাটিতে এই প্রথম আসছে, বল?’

‘বড় ছোট জানি নে।’ ফণীভূষণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘হয়তো ইচ্ছে করেই ওনাদের এখানে পাঠাচেচ।’

‘ইচ্ছে করে কেন?’

‘বাহ। এ হল যমের ডেরা। একবার যদি এখানে কেউ ঢোকে, ব্যারি সাহেবের খপ্পর ছাড়িয়ে কোনওদিনও আর দেশে ফিরতে পারবে নাকি?’ ফণীভূষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আর এনারা না ফিরলে আমাদের আন্দোলনটা তো শেষ হয়ে যাবে, তাই না শেখরদা!’

‘অত সোজা নাকি রে? আন্দোলন হল ছাইচাপা আগুন। কখনও শেষ হয় না। ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে। অরবিন্দবাবু আছেন না!’

‘কিন্তু শুনেচি, অরবিন্দবাবুর আর এদিকে মন নেই।’ ফণীভূষণ মাথা নেড়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পারল না। কারণ তার আগেই ওর পিঠে এসে পড়েছে একটা কিল। পেছন ফিরতেই গালে একটা ঘুসি।

ওর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উচচতার দশাসই পাঠান প্রহরী মহম্মদ শাহ। জ্বলন্ত চোখে উর্দু মেশানো হিন্দিতে সে হিসহিসিয়ে বলে উঠল, ‘তোর সাহস তো কম না! কাজের ছুতোয় বাইরে এসে গুলতানি করছিস! চল শালা। তিনদিন ডান্ডাবেড়ি থাকবি।’

ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে বন্দরে। কলকাতা থেকে ডাকসাইটে বন্দিদের নিয়ে আসা ‘মহারাজা’ জাহাজ ভিড়ছে পোর্ট ব্লেয়ারে। জাহাজের নীচের তলায় একটা ঘরের মেঝের তক্তায় একটা শিকল লম্বাভাবে আটকানো। সেই শিকল থেকে দেড় দু’হাত অন্তর ঝুলছে একটা করে হাতকড়া।

সেই হাতকড়ায় কেউ বাঁধা নেই।

অথচ তিনদিন আগে কলকাতার খিদিরপুর ডক থেকে যখন এই জাহাজ ছেড়েছিল, তখন এই প্রতিটি হাতকড়াতেই একজন করে রাজবন্দির হাত আটকে দিয়ে ঘরের দরজায় তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল। জাহাজের খালাসিরা কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। এরা তো আর মামুলি রাজবন্দি নয়। কুখ্যাত চুয়াল্লিশ ডিগ্রির বন্দি বলে কথা! আলিপুর বোমা মামলার আসামি। এদের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বলে তাকে অবধি গুলি করে মেরেছে। তাও আবার আলিপুর জেলের মধ্যেই। একগাদা পুলিশের সামনে।

কলকাতার ডক থেকে এদের যখন জাহাজে তোলা হচ্ছিল, সরেজমিনে তদারক করতে ওই ভোর তিনটের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় গোরা সৈন্য একেবারে থিকথিক করছিল। ঘোড়সওয়ার পুলিশও ছিল প্রচুর।

জাহাজের বাকি দুটো ঘরের একটায় গরুর পালের মতো গাদাগাদি করে ঠুসে দেওয়া হয়েছিল সাধারণ ফৌজদারি মামলার দাগি আসামিদের। তারা সংখ্যায় জনা চল্লিশ। অন্য ঘরে রাখা হয়েছিল সাতজন মহিলা কয়েদিকে। সেই দুটো ঘরে কোনও হাতকড়ার ব্যবস্থা নেই। তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তাও নেই।

রাজবন্দিদের ঠিকঠাক ‘গিনতি’ করে সতর্কহাতে ঘর আটকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল খালাসিরা। একজন অন্যজনের কানে ফিসফিস করেছিল, ‘দেখলে কে বলবে বল, এরা অমন সাংঘাতিক কাজ করে এসেচে?’

সত্যি কথা বটে। ভদ্রলোকের মতো চেহারা সব। হাঁটুর ওপর অবধি ধুতি। ঊর্ধ্বাঙ্গে হাতকাটা পিরান। মাথায় পাগড়ি। পায়েও পরানো রয়েছে লোহার বেড়ি।

দ্বিতীয় খালাসি দুঃখী মুখে ফিসফিস করেছিল, ‘সাংঘাতিক কী বলচিস। এরা কত পণ্ডিত মানুষ, তা জানিস?’

‘বাহ, পণ্ডিত হলে বুঝি বোমা বাঁধে?’

‘বোমা কি এরা এমনি এমনি বেঁধেচে নাকি? দেশ থেকে ফিরিঙ্গিদের তাড়াতে বেঁধেচে। সব বড়ঘরের ছেলে। সারাজীবনের জন্য যমের দুয়ারে চলে যাচেচ, অথচ মুকে কোনও ভয় দেকলি?’

দু’জনের ফিসফিসানির মধ্যেই বন্ধ ঘর থেকে হঠাৎ ভেসে এসেছিল কোলাহল। খুব যেন চেঁচামেচি হচ্ছে! খালাসি দু’জন ভয়ার্ত মুখে ছুটে গিয়ে খবর দিয়েছিল ডেক অফিসারকে। সে ব্যাটা চুরুট মুখে চাবুক হাতে ঘরের তালা খুলতেই সবাই থ’।

দুর্দান্ত সব ‘গোলাওয়ালা’রা কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে গান জুড়েছিল। কেউ হাতকড়া লাগানো অবস্থাতেই বেঁকেচুরে কিংবা কাত হয়ে শুয়ে পড়ে গল্প করছিল, রঙ্গরসিকতায় হা হা করে হাসছিল। তাদের হাসির দাপটে যেন জাহাজের দুলুনি আরও বেড়ে চলছিল।

‘Whats happening here’ চিবিয়ে চিবিয়ে জড়ানো ইংরেজিতে প্রশ্ন করেছিল লালমুখো ডেক অফিসার।

একেবারে সামনের হাসি হাসি মুখের তরুণটি তৎক্ষণাৎ তুখোড় ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছিল, ‘আলিপুর জেলে সব দূরে দূরে ছিলাম। এতদিন পর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে সাহেব। একটু ফুর্তি, আড্ডা হবে না? তাও তো আমাদের বাকি দু’জন আসবে পরের জাহাজে।’

‘হ্যাঁ। উপেন আর সুধীর। তারা বেচারা এক যাত্রায় পৃথক হয়ে গেল। যাকগে, তোমরাও এসো। বসে পড়ো।’ ডানদিকে বসে থাকা তরুণটি দরাজ আহ্বান জানাল, ‘একটু গানবাজনা হোক।’

ডেক অফিসার বেকুব হয়ে গিয়েছিল। সুদীর্ঘ সময় ধরে সে কলকাতা থেকে আন্দামানে কয়েদি চালানের জাহাজে কাজ করছে। বন্দিরা জাহাজে উঠে কেমন থম মেরে বসে থাকে। জাহাজ দুলে ওঠা মাত্র কেউ কেউ তারস্বরে কান্না জুড়ে দেয়। কেউ মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে। কালাপানি পার মানে ধরেই নেওয়া যায় সে আর কোনওদিনও স্বদেশে ফিরতে পারবে না। পরিবারের মুখ দেখতে পারবে না। পৃথিবীতে এ যাবৎ যতগুলো বছর সে যাপন করে এসেছে, সেগুলো সব জোর করে মুছে ফেলতে হবে স্মৃতিকোষ থেকে। আর সেখানে পৌঁছে যে ভয়ংকর অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হবে, তার রঞ্জিত অতিরঞ্জিত মিথ ইতিমধ্যেই অনেকের কাছ থেকে শোনা, সেই ভেবেই অনেকের জামা ভিজে যায়। এর চেয়ে যে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া উত্তম, তা কে না জানে! খালাসিদের পা ধরে তারা কাঁদতে থাকে। সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সব জ্বালা জুড়োতে চায়। তখন কড়া নজর রাখতে হয়।

সেখানে এরা কিনা খোশগল্প জুড়েছে? ডেক অফিসার কী বলবে বুঝতে পারেনি। ইঙ্গিতে খালাসিদের সতর্ক থাকতে বলে চলে গিয়েছিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছিল হুল্লোড়। খালাসিরা কিছুক্ষণ দূর থেকে আমোদ দেখছিল। এই নিরস একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় আনন্দের সুযোগ মেলে কোথায়? ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তারাও এসে যোগ দিয়েছিল। খুলে দেওয়া হয়েছিল হাতকড়া। ঘরের মাঝামাঝি পাতা হয়েছিল কম্বল। তার ওপর গোল করে বসে শুরু হয়েছিল আড্ডা। ঘরের পাশের নর্দমা থেকে আসছিল প্রস্রাবের কটু গন্ধ। ওই খোলা নর্দমাই শৌচাগার। কেউ গেলে অন্যদের মুখ ফিরিয়ে থাকতে হয়। এতদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দে এসবেও কেউ ভ্রুক্ষেপ করছিল না।

প্রথমদিন খাবার বলতে দেওয়া হয়েছিল মুড়ি। চিঁড়ে। ছোলাভাজা। সঙ্গে গুড়। তেঁতুল। পাতিলেবু। লঙ্কা। সে’সব দেখে একজন তরুণ চোখ কপালে তুলেছিল, ‘একি হে! আমরা কি ঘোড়া নাকি?’

‘আজ্ঞে?’ খালাসি কিছু বুঝতে পারছিল না।

‘ওরে ভাই, এসব কে খায় দুপুরবেলা? চাট্টি ভাত এনে দাও না গো!’

‘ভাত!’ খালাসিরা ফ্যালফ্যাল চোখে এ অন্যের দিকে তাকিয়েছিল। একজন কিন্তু কিন্তু করে বলেছিল, ‘আজ্ঞে, ভাত আছে বটে।’

‘অ্যাই। অ্যাই। কীসব উল্টোপাল্টা বকচিস?’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক হিন্দু পুলিশ তেড়ে গিয়েছিল, ‘সে ভাত তো মোছলমানের রাঁধা। এরা সব ভদ্দরঘরের হিঁদু। জাত মারবি নাকি এদের? বেল্লিক কোথাকার!’

ভয়ে জড়সড় খালাসিটি কিছু প্রত্যুত্তর করার আগেই রাজবন্দি যুবকরা তর্ক জুড়েছিল, ‘অত সহজে আমাদের জাত যায় না গো। আমাদের ধর্ম লোহায় তৈরি। নিয়ে এসো চাচার রাঁধা ভাত। দুর্গানাম করে তাই খাব।’

তা তারা যতই বলুক, জাহাজের ধর্মপরায়ণ হিন্দু আর শিখ পুলিশরা অতবড় অনর্থ কিছুতেই হতে দেয়নি। প্রাণ গেলে ক্ষতি নেই, কিন্তু চোখের সামনে কারুর জাত যাওয়া তারা কী করে বসে বসে দেখবে? অগত্যা দুটো হিন্দু খালাসি ভাত রেঁধেছিল। তারপর কুমড়োর ঘ্যাঁট দিয়ে সেই ভাত পরম তৃপ্তি করে সবাই খেয়েছিল। ততক্ষণে এই দুর্ধর্ষ ‘বোমাওয়ালা’দের নিয়ে পুলিশ আর খালাসিদের সব সংশয় দূর হয়ে গিয়েছিল। ঘরের তালা খুলে তাদের নিয়ে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জাহাজের ডেকে। আলিপুর জেলে দীর্ঘ কারাবাস, তারপর জাজাজের খুপরিতে থাকা, এই সবকিছুর পর মুক্ত আকাশের নীচে এসে ওদের আবেগের সব বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল।

নোনা হাওয়ায় এক রাজবন্দি গান ধরেছিল,

‘এ দেশেতে এই সুখ হ’ল

আবার কোথা যাই না জানি।

পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা

জনম গেল ছেচতে পানি!’

ফিরিঙ্গি ডেক অফিসার অবধি গানটা মন দিয়ে শুনছিল। গান থামতেই সে মুগ্ধচোখে বলে উঠেছিল, ‘You are a wonderful singer !’

‘থ্যাঙ্ক ইউ সাহেব!’ তরুণটি ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসেছিল। জাহাজে ওঠা থেকে এই তরুণকে একবারের জন্যও গম্ভীর দেখেনি ডেক অফিসার। হাহাহিহি করছে, জোরে জোরে গেয়ে উঠছে।

বন্দি হয়েও এই ছেলেটির মনে যা ফুর্তি, তার সিকিভাগ খুশি ডেক অফিসারের মনে নেই।

‘টুমি সবসময় এত আনন্দে থাকো?’

‘ইয়েস সাহেব! আমার তো জন্মই হয়েছে আনন্দ করার জন্য।’ যুবক আলোকিত মুখে হাসে, ‘আমার নাম উল্লাসকর।’

ডেক অফিসার বিস্মিত হয়। এই তবে সেই ডাকসাইটে বিপ্লবী, যার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল? এ নাকি বোমা বানাতে সিদ্ধহস্ত। ভাবগতিক দেখে বোঝার উপায় নেই। ডেক অফিসার আর বসে থাকার উৎসাহ পায় না। শিক্ষার কাছে ঔদ্ধত্য ফিকে হয়ে যায়। বিশ্রামের অজুহাতে সে মানে মানে কেটে পড়ে।

ডেক অফিসার চলে যেতেই আরেকজন রাজবন্দি বলে ওঠে, ‘এটা কার লেখা গান রে উল্লাস? লালন ফকির?’

‘হুঁ।’

‘ওহ। কলকেতায় আর ভাল গান এখন আছে কোথায়? নয় ওই দাশু রায়ের পাঁচালি। নিধুবাবুর টপ্পা। গরানহাটির কীর্তন। আর নয়তো বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষী।’

ইদানীং জোড়াসাকোর রবিবাবুর গান খুব চলছে। এই গানটা শুনেছেন হেমদাদা?’

‘আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।

ভয় কোরো না, সুখে থাকো,

বেশিক্ষণ থাকব নাকো — এসেছি দণ্ড-দুয়ের তরে।’

দেখব শুধু মুখখানি, শোনাও যদি শুনব বাণী,

নাহয় যাব আড়াল থেকে, হাসি দেখে দেশান্তরে।’

হেমচন্দ্র কানুনগো মাথা দোলান, ‘এই গানটা কোথায় যেন শুনেছিলাম। মনে পড়েছে। একটা কাজে গিয়েছিলাম গ্রামোফোন কোম্পানিতে। সেখানেই নাকি রেকর্ড হয়েছে। বেদানা দাসী নামে কোন বাইজি গেয়েছে।’

উল্লাসকর মুচকি হাসল, ‘এটা কিন্তু রবিবাবুর লেখা।’

‘অ্যাঁ!’

‘হ্যাঁ গো দাদা। বাইজিপাড়ায় এখন রবীন্দ্রনাথের গান খুব চলছে। আরও অনেকগুলো রেকর্ড বেরিয়েছে। মানদাসুন্দরী, পূর্ণকুমারী, বেদানা, যে বাইজি যেমন সুরে ইচ্ছে গেয়ে দিচ্ছে। কথাও পালটে দিচ্ছে। এদিকে রেকর্ডও বেরিয়ে যাচ্ছে।’

‘বোঝো! এতে রবিবাবুর কোনও আপত্তি নেই?’ হেমচন্দ্র গলা নামালেন, ‘আমাদের অবিনাশ তো শুনেছি আগে ঠাকুরবাড়ি থেকে গিয়ে মাসে মাসে টাকা নিয়ে আসত।’

পাশ থেকে অবিনাশ মাথা নাড়ল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ দাদা। তখন আপনি ইউরোপে। রবিবাবুর দাদা সুরেনবাবু আর ভাইপো গগন অনেক সাহায্য করেছেন আমাদের। উল্লাস, তুইও তো গিয়েছিস ও’বাড়িতে।’

উল্লাসকর উদাসচোখে মাথা নাড়ল।

হেমচন্দ্র কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে বললেন, ‘রবিবাবুর গান খুব ভালবাসিস তুই, তাই না? যেদিন তোর ফাঁসির আদেশ দিল আলিপুর কোর্ট, সেদিনও তো রবিবাবুর গানই গেয়েছিলি। সেই গানটা একবার গাইবি?’

উল্লাসকর গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালবেসে!’

হেমচন্দ্রের গলার কাছটা কিছু পাকাচ্ছিল। তিনি ইতস্তত করে বিড়বিড় করলেন, ‘তোর মতো ছেলেগুলো এই ভালবেসেই মরে রে! ক্ষুদিরাম মরেছে। প্রফুল্ল মরেছে। তুইও…!’

গান শুনে ডেকের ওদিক থেকে সন্ত্রস্ত কর্মচারীদের এগিয়ে আসতে দেখে হেমচন্দ্র বরাভয় মুদ্রা দেখিয়ে তাদের নিরস্ত করলেন, ‘ভয় পেয়ো না বাপুরা। ও এমনি গান গাইছে! আপাতত ও দেশোদ্ধারে বেরোবে না। কোথায়ই বা বেরোবে। চারদিকে যে শুধুই জল!’

এভাবেই কেটে গেছে তিনদিন। যেদিন সকালে নীলামণি বিয়ে করে বরের হাত ধরে স্বাবলম্বন গ্রামে তার ছোট্ট কুঁড়ের সংসারে যখন পা রাখছে, ঠিক তখন জাহাজঘাটায় লম্বা ভোঁ বাজছে। ভিড়ে ভিড়। জেলার এসেছেন। জেলের ডাক্তার এসেছেন। এছাড়া থিকথিক করছে প্রহরী।

‘মহারাজা’ জাহাজ নোঙর করছে।

একটা স্টিম লঞ্চ একটা গাধা বোটকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাহাজের দিকে। সেই লঞ্চ চালাচ্ছে যে সারেঙ, সেও প্রাক সেলুলার যুগের আসামি। এখন স্বাবলম্বন গ্রামে থাকে। নাম শান্তিরাম।

শান্তিরাম ভাবলেশহীন মুখে লঞ্চ চালাচ্ছে বটে, কিন্তু উত্তেজনায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে।

না। ‘গোলাওয়ালা’দের নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই। তাঁর নজর সাতজন মহিলা কয়েদির দিকে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এই দ্বীপপুঞ্জে সংসার পাতলেও তাঁর কপাল মন্দ। রুগ্ন স্ত্রী জ্বরে ভুগে দু’বছর আগে মারা গেছে। এই আজব দ্বীপে বউ মরলে কপাল পোড়ে। জেলখানায় একটা করে মেয়ের বিয়ের ঘোষণা হয়, ও-ও বুক ঠুকে সাড়ে আটটাকা ফি দিয়ে নাম লেখায়। কিন্তু আজ অবধি পাঁচবার টাকা জলে গেল, কেউ ওর দিকে ফিরেই তাকায় না!

ওর অবস্থা দেখে গ্রামের অন্যরা মশকরা করে। বলে, ‘নিজের মুকটা একবার দেকেচিস? রাতদিন নোনা হাওয়ায় দাঁড় টেনে ঠিক যেন ভুসোকালি মাখা কাকতাড়ায়া। মাথায় যে’কটা পাকা চুল আছে, এক মাইল দূর থেকে গোনা যায়।’

‘সোনার আংটি আবার বাঁইক্কা!’ শান্তিরাম জোর গলায় তর্ক জোড়ে, ‘ভিইট্টা আসে। জমিন আসে। খাইতে পরতে দিইত্যে পারুম, হালায় ইডাই কি যথেষ্ট লয়? আমাগো দ্যাশ হইলে মাইয়ার গুষ্টির হিড়িক লাইগ্যা যাইত।’

‘তা যেত বটে। তার ওপর তুই ছিলি গে কুলীন কায়স্থ। ‘হাঁটু ভরি বস্ত্র দিহ, পেট ভরি ভাত’ দিতে পারলেই অ্যাদ্দিনে আধডজন বে’ করে ফেলতে পারতিস। কিন্তু এ তো আর তোর ‘দ্যাশ’ নয়। একেনে পুরুষের রূপ আর ট্যাঁকের জোর মাপার খ্যামতা মেয়েমানুষকে ফিরিঙ্গিরা দিয়েচে। একেনে তোর বে’ হবে বলে মনে হয় না।’ নাকে এক টিপ নস্যি নিয়ে মাথা নাড়িয়েছিল অনন্ত বামুন।

 ‘হবেক কি হবেক লাই দ্যাইখা যামু, অ’খন। হুঁ!’ শান্তিরাম সেদিন রেগেমেগে চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসছিল, এমন সময় ওর পিছু নিয়েছিল ফটিক সামন্ত। বলেছিল, ‘তোকে একখান উপদেশ দিই।’

‘তুমি আবার জ্ঞান দেবার কেডা?’ খেঁকিয়ে উঠেছিল শান্তিরাম। ফটিক ছাড়া পেয়ে বাড়ি বানিয়েছে ওর কয়েকমাস পরে। কোন কালে নাকি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, চেহারা দেখলে অবশ্য বিশ্বাস হতে চায় না। শুঁটকো খয়াটে গড়ন, বয়স বোঝা যায় না। কুতকুতে চোখ। রঙটা অবশ্য পরিষ্কার। ধূর্ততার ছাপ গোটা চেহারায়। রস আইল্যান্ডে সুপারিন্টেন্ডেন্ট মারে সাহেবের বাংলোতে ঝাড়পোঁছ করে বটে, লোকে বলে মেমসাহেবের সঙ্গে ফটিকের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

‘বলচি। শোন। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে বেঁকাতে হয়।’

‘বলো।’

‘এখন যে মেয়েগুলো বিয়ের পিঁড়িতে বসবে, তারা তোর গলায় মালা দেবে কেন?’ ফটিক চোখ ঘোরায়, ‘আহা, আমি জানি, তোর বয়স এখনও পঞ্চাশ পেরোয়নি, কিন্তু কত জোয়ানমদ্দ খালি আছে দ্যাক। তাদের ছেড়ে তোর গলায় মালা দেবে, এমন কি হয়? তার চেয়ে শোন, আমার কাছে খবর আচে।’

‘কী খবর?’

‘এই হপ্তায় কলকাতা থেকে যে জাহাজ আসছে, তাতে সাত আটটা মেয়ে আসচে। এক্কেরে পাকা খবর। সবকটাই ঘাগু মাগি, এখানে আসার এক-আধ বচ্ছরের মধ্যেই বিয়ের লিস্টিতে নাম ঢুকবে। তুই এখন থেকে যে কোনও একটাকে ধর।’

‘ধরুম মানে?’

‘আহ!’ ফটিক চোখ টিপেছিল, ‘পিরিতে ফাঁসা। পেটে বাচ্চা চলে এলে তোকে বাপবাপ করে বে’ করবে।’

‘ছি!’

‘ওরে আমার ধম্মপুত্তুর রে!’ ফটিক গর্জে উঠেছিল, ‘তবে আর কী! নিজে হাত পুড়িয়ে রাঁধ, আর প্রতিবার সাড়ে আটটাকা ভরতে থাক।’

‘তা কেন! গৌরীদাদাকে দ্যাখ নাই? আমার থেইক্কা কত্ত বুড়া। কেমন সোন্দর একখান মাগ জুটায়ে ফেললে!’ বলতে বলতে শান্তিরামের গলা দুঃখে বুজে এসেছিল। যত দিন যাচ্ছে, নারীসঙ্গবর্জিত জীবন তার কাছে দুঃসহ হয়ে উঠছে।

ফটিক চুপ করে গেছিল। নিন্দুকে বলে, আন্দামানে একখানা শুঁয়োপোকা মরলেও ফটিক সামন্তর কাছে খবর আসে। সেখানে ওই ছুঁড়ি কেন এত যুবক থাকতে ওই বৃদ্ধের গলায় মালা দিতে চলেছে, সেই খবর কি ফটিকের কাছে ছিল না? কে জানে!

শান্তিরাম মিনমিন করেছিল, ‘আর পিরিতে ফাঁসাব কী কইরা। ওরা তো আর আমাগো তরে ছাড়া বলদ নয়। থাকনের লিগ্যা তো জেলের ওই কয়েক ঘর।’

‘আইন যেমন আচে, আইনের ফাঁকও তেমনই আচে।’ ফটিক অশ্লীল চোখ টিপে তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে তুড়ি মেরেছিল, ‘দুটো টাকা ছাড়বি। সব ব্যবস্থা করে দেব’খন।’

 

সব মিটিয়ে নীলামণি যখন সদ্যবিবাহিত স্বামীর সঙ্গে ‘স্বাবলম্বন’ গ্রামে প্রবেশ করল, তখন সূর্যদেব মাথার ওপর অনেকটা উঠে এসেছেন। নবদম্পতির পিছু পিছু হেঁটে আসছিল চন্দ্রপ্রভা ও গ্রামের অন্যান্য বউরা। তারা অন্য সব বিয়ের মতো আজও সাতসকালেই চলে গিয়েছিল। তাদের কারুর হাতে শাঙ্খ। কারুর হাতে ফুল। কেউ উলু দিচ্ছে ক্রমাগত।

গৌরীপ্রসন্নর বাড়িটা একটেরে, গ্রামের এক প্রান্তে। পেছন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে ঘন অরণ্য। চন্দ্রপ্রভা আগে হেঁটে এসে বাড়ির সদরে অপেক্ষা করছিল, নীলামণি এসে পৌঁছতেই সে নববধূকে সাজানো বরণডালা দিয়ে বরণ করল। উলুধ্বনিতে মুখর চারপাশ। দ্বীপান্তর হলেও আন্তরিকতা ও আয়োজনের ত্রুটি নেই। নীলামণি ডান পা দিয়ে চালভর্তি ঘট উলটে থালায় আলতা পা রেখে তার নতুন সংসারে প্রবেশ করল। গৌরীপ্রসন্নর সঙ্গীরা হইহই করছিল। সুবীর। ফটিক। শ্যামলাল।

‘যাই বলো খুড়ো, হরিনাথ কিন্তু বে’টা বেড়ে দিয়েচে। আমি বলে চিন্তায় মরচিলাম, অনন্ত বামুন নেই, বে’ ঠিকমতো দিতে পারবে কি না! কিন্তু না। কেমন গড়গড় করে মন্তর পড়চিল বলো!’ কাঠুরে শ্যামলাল কলকল করে ওঠে।

‘হুঁ!’ ফটিক সামন্ত ঠোঁট উলটোয়, ‘বে ঠিক দিল না ভুল দিল কী এসে গেল। গৌরীখুড়ো কি তাতে সংসার করবে না? নাকি দেশের হাজার লোকের মতো একেনে লোকজন ছ্যা ছ্যা করবে!’

‘তা নয়। সবকিছুরই একটা নিয়ম-কানুন আচে!’

এখানে যেহেতু শাশুড়ি ননদ ভাজ এসবের বালাই নেই, নতুন কোনও মেয়ে বিয়ে হয়ে এলেই শ্বশ্রূমাতার ভূমিকাটি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে পালন করে চন্দ্রপ্রভা।

 মুখভর্তি পান নিয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘শোন ছুঁড়ি। একেনে আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। এ-জীবনে তো আর নিজের রক্তের মানুষদের কাচে যেতে পারবে না, তাই একেনেই নতুন সম্পক্ক পাতাতে হবে। সবাই তো পাপী, তাই একেনে কিচু নিয়ম আচে। অন্যের ঘরে নজর দেবে না। অন্যের সোয়ামিতে নজর দেবে না। আমি এসে দেকে যাব মাঝে মাঝেই। যা পাপ করে এসেচ, তা ভুলে যাবে। আর যে কোনও দরকারে এই যে এয়োদের দেকচ, এদের বলবে, কেমন?’

নীলা মাথা নাড়ল। চন্দ্রপ্রভার পেছনে যে ছ’-সাতটা বউ দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে একজন হাসিহাসিমুখে এসে ওর হাত ধরল, ‘আমার নাম যমুনা গো। তোমার ঘরের পাশেই আমার ঘর। বেশ দুটিতে এবার থেকে গল্প করব, কেমন? হি হি!’

যমুনার বয়স আন্দাজ পঁচিশ। মুখখানি লাবণ্যে ঢলোঢলো। তার কাঁখে একটা মাসখানেকের শিশু।

নীলা বলল, ‘এ কি তোমার ছেলে?’

‘নাগো মেয়ে।’ যমুনা মেয়ের গালে চুমু খায়, ‘ওর নাম হল সরস্বতী। সুন্দর না?’

 আরও কিছুক্ষণ কথা এগোত, কিন্তু শ্যামলাল নামক লোকটা মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে আসতে সবাই তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিষ্টিমুখ করে চন্দ্রপ্রভা ও তার সঙ্গিনীরা বিদায় নিল। গৌরীপ্রসন্নর সঙ্গীরাও একে একে চলে যেতে ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল।

দীর্ঘক্ষণ হট্টগোলের পরে হঠাৎ নৈঃশব্দ্যে কেমন অস্বস্তি জেগে ওঠে। এতক্ষণে নীলা তাকাল তার সইসাবুদ করে বিয়ে করা স্বামীর দিকে। অস্ফুটে বলল, ‘জ্যাঠামশাই, শেখরকে দেখতে পেলাম না যে!’

‘ও কি আর আসে?’ গৌরীপ্রসন্ন ম্লান হাসেন, ‘কোথায় মন খারাপ করে বনেবাদাড়ে ঘুরছে হয়তো। তুই ওর কাছে আমায় খারাপ করে দিলি রে মা!’

‘কী যে বলেন!’

‘ঠিকই বলছি নীলা। তোর এই বিয়েটা যে আসলে রান্নাবাটি খেলা, সেটা তো ওকেও বোঝাতে পারতিস। নাহয় ওর সঙ্গেই…!’

নীলা নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। সব কথা মুখে বলা যায় না। গৌরীপ্রসন্নর মতো পিতৃসম মানুষকে তো নয়ই। নীলা কি কোনওদিনও ভেবেছিল, ও বিয়ে করবে? ভাবেনি। দ্বীপান্তরে নির্বাসনের পর সারাজীবন অন্ধকার কুঠুরিতেই কাটিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিছু কিছু মানুষের জীবন ভরে থাকে রাশি রাশি অপ্রাপ্তিতে। মুঠো মুঠো বঞ্চনায়। নীলারও তেমনই। আগে দুঃখ হত। কষ্টে ভরে উঠত মনটা। এখন কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে। নিজের নিয়তিকে ও মেনে নিয়েছে। গৌরীপ্রসন্নকে বিয়ে করেছে শুধুমাত্র জেল থেকে বেরনোর জন্য। জ্যাঠা কোনওদিনই স্বামীর অধিকার ফলাবেন না।

কিন্তু শেখর? শেখর কোন যুগ থেকে ওকে ভালবাসে। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ের পর কি ও সেটাকে আর খেলা বলে ভাবত? না ভাবা সম্ভব!

নীলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাদের যে মন্ত্র পড়ে বিয়ে হল, এতে কি আমরা পাপ করলাম না জ্যাঠামশাই?’

‘আমাদের আবার পাপ কী, নীলা? যেদিন সব ছেড়েছুড়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম, আত্মশ্রাদ্ধ করে সব দায় চুকিয়েছি। আর তোর কথা যদি বলি, হরিনাথ যখন মন্ত্র পড়ছিল, তুই মনে মনে কী ভাবছিলি?’

নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ভাবছিলাম যে কাজে নামলাম, তাতে যেন সফল হই।’

গৌরীপ্রসন্ন হাসলেন। থেমে থেমে বললেন, ‘তবে আর কী! মন ছাড়া মন্ত্রের কোনও মানে নেই। আর তাছাড়া বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ছোটখাট আহুতি দিতেই হয়। ওতে কোনও পাপ হয় না।’

নীলা অধীর চোখে তাকাল, ‘ওরা কি এসে পড়েছে জ্যাঠামশাই?’

গৌরীপ্রসন্ন খরচোখে তাকালেন, ‘আমাদের এই কৃষ্ণসিন্ধুকীতে কিন্তু চরের অভাব নেই।’

‘কৃষ্ণসিন্ধুকী কী, জ্যাঠামশাই?’

‘ওহ তোকে বলতে ভুলে গেছি। আমি এই আন্দামানের নাম দিয়েছি কৃষ্ণসিন্ধুকী।’

‘কী খটোমটো নাম! এর মানে কী?’

‘বলব বলব। প্রথম দিনেই সব জেনে ফেললে পরে কী জানবি?’ গৌরীপ্রসন্ন হাসলেন, ‘শোন, জ্যাঠামশাই বলে ডাকিস না। এখানে দেওয়ালেরও কান আছে। প্রায় সন্ধেবেলা চণ্ডীমণ্ডপে আসর বসে। মেয়েবউরাও যায়। সেখানে এই জ্যাঠামশাই শুনলে পরেরদিনই তোকে আর আমায় একসঙ্গে কেটে ফেলবে।’

‘তবে?’

কিছুক্ষণ ভাবলেন গৌরীপ্রসন্ন, ‘আমি তোকে গিন্নি বলে ডাকব, কেমন?’

‘গিন্নি?’

‘হুঁ। সত্যিকারের বিয়ে হোক আর মিথ্যেকারের, এই বাড়ির তুই-ই তো এখন গৃহিণী। ন গৃহং গৃহমিত্যার্হগৃহিণী গৃহমুচ্যতে।’*

[*বাঙ্গালা ভাষা অভিধান, ১৫৪৭]

‘এটার মানে কী?’

‘সব গৃহ গৃহ নয়। যে গৃহে গৃহিণী থাকে, সেটাই শুধু গৃহ।’ গৌরীপ্রসন্ন ছাতাখানা টেনে নিয়ে দরজার দিকে এগোন, ‘যাকগে। আমি একটু বেরোচ্ছি। তুই নিজের মতো সব গুছিয়ে নে।’

‘কোথায় চললেন?’

গৌরীপ্রসন্ন প্রস্থানোদ্যত হয়েও পিছু তাকান, ‘ঘাটে জাহাজ ভিড়েছে খবর পেয়েছি। কিছু রাজবন্দি আসবে আজ।’

নীলার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কত বছর পর দেখা হবে? উঁহু। বছর নয়। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কত জন্ম যেন!

অথচ এখনও কত উজ্জ্বল! ভাবলেই মনে পড়ে যায়। খুলনার শ্রীফলতলা গ্রামের জমিদারবাড়ির ছোট ছেলে ইন্দ্রভূষণ ছিল ওর থেকে বছর দুয়েকের বড়। অতটুকু বয়সের পার্থক্যে কেউ দাদা বলে না। কিন্তু নীলার মা শিখিয়েছিল গ্রামের সব ছেলেকে ‘দাদা’ সম্বোধন করতে। নিজের দস্যি মেয়েটাকে অনেক চেষ্টা করেও ঘরে রাখত পারত না মা। নীলা ছিল বড় ডানপিটে। সারাদিন এর বাড়ির বাগান, ওর বাড়ির পুকুরঘাট, গ্রামের বাইরের শস্যখেতের আল ধরে ছুটোছুটি করে বেড়াত। মা বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। মেয়ে গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে দিনরাত খেলে। অগত্যা মায়ের কড়া নির্দেশ, ‘বড় হোক আর ছোট হোক, সব্বাইকে দাদা ডাকবি!’

তাতে নীলার আপত্তি কিছু ছিল না। খেলতে পারলেই হল। ডাকাডাকিতে কী যায় আসে? কখনও গোল্লাছুট। কখনও বউচি। কখনও কুতকুত। খেলায় মগ্ন থাকত সে। ওদের আট-দশজনের দলে ও আর জগু শুধু ছিল মেয়ে।

জগু ছিল ওর প্রাণের সই। জগদ্ধাত্রী। সে ছিল খেলাধুলোয় দারুণ দড়। সবাই ওকে ডাকত ‘খেলুড়ে জগু’। বিকেলের নরম আলোয় বর্ষার নরম মাটিতে দাগ কেটে বানানো হত কুতকুত খেলার ঘর। মোট সাত-আটটা ঘর কাটা হত। তারপর প্রথম ঘরে গুটি ফেলে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে সব ঘর পার হওয়া। তারপর ঘর কেনা। ঘর কেনার সময় দাঁত দেখা গেলেই সে বাদ।

নীলার চোখদুটো বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠল। মনে হয় যেন এগুলো সব গতজন্মের কথা। চোখ বুজলেই দেখতে পায়, বুক ভরে দম নিয়ে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে ও আর জগু টপকে যাচ্ছে একের পর এক ঘর। অন্যরা আগ্রহে দেখছে ওদের নৈপুণ্য। শুধুমাত্র একজন দেখছে না। ইন্দ্রদাদা।

ইন্দ্রদাদা ছোট থেকেই বড় আলাদা। খেলতে আসে ঠিকই, কিন্তু খেলাধুলোয় তার মন নেই। খড়ের গাদায় বসে সে আকাশপাতাল ভাবে। ধানের শিষ দাঁতের ফাঁকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিজের মনেই কবিতা আবৃত্তি করে। তার একমাত্র বন্ধু বলতে শেখর। শেখর নিজে খেলাধুলো করে, আবার ইন্দ্রর সঙ্গে বসে গল্পগুজবও করে। কিন্তু ইন্দ্রদাদা খেলায় ডাকতে এলে আসত ঠিকই, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার স্বস্থানে চলে যেত। নীলা আর জগু ইন্দ্রদাদার কাণ্ডকারখানা দেখে ভারী মজা পেত। পেছনে লাগতেও ছাড়ত না।

‘ও ইন্দ্রদাদা! তুমি সারাদিন কী ভাব গো? দুনিয়ার সব চিন্তা কি তোমার মাথায়?’

ইন্দ্রদাদা বড় বড় চোখ মেলে হাসত, ‘নাতো! চিন্তা করব কেন! দেখি।’

‘কী দ্যাকো?’

‘সবকিছু কেমন সুন্দর নিয়মে চলছে। সূর্য প্রতিদিন পুব আকাশে উঠছে। নদী বয়ে চলেছে। গাছ ছায়া দিচ্ছে। কত কিছু দেখেছে এরা। এদের সবার কাছে কত সময় দ্যাখ। অনেক অনেক বছর। কিন্তু আমাদের হাতে মাত্র কয়েকবছর। মানুষের প্রতি এমন অবিচার কেন হল বলতে পারিস? মাত্র এই ক’টা বছরের জীবন কেন? এত অল্পসময়ে কী করতে পারব?’

‘বাবা! কীসব ভাবনা গো তোমার! ওইজন্যই চুল পেকে গেচে!’

‘আমার চুল পেকে গেছে? কই?’ সহজ সরল ইন্দ্রদাদা মাথায় হাত দিয়ে খুঁজত কোথাও না থাকা পক্ককেশটিকে।

নীলা আর জগু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। তখন নীলার বয়স দশ। ইন্দ্রদাদা এগারো। সময় কাটছিল ওদের গ্রামের আঠারোবাঁকি নদীটার তিরতির করে বয়ে চলা স্রোতের মতো।

নীলা দশ পেরোতে না পেরোতেই ওর বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গ্রামে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না। কুলীন পাত্র বলে কথা। চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। তাতেও বেশ কিছুটা সময় যাবে। ছায়াসঙ্গিনী জগদ্ধাত্রীর বিয়ে হয়ে যেতে নীলার বাবা-মা আরও উতলা হয়ে উঠলেন।

বিয়ের পরের দিন ভারী বেনারসি আর স্বর্ণালংকারের মাঝে প্রায় হারিয়ে যাওয়া জগু জড়িয়ে ধরল প্রাণের সইকে। চোখ আর নাকের জল মাখামাখি করে বলল, ‘আর কি আমরা কুতকুত খেলতে পারব না কোনওদিন?’

এগারোয় পড়া নীলা সরল বিশ্বাসে সখীকে বুঝিয়েছিল, ‘দূর মুখপুড়ি, কেন পারব না! বাবাকে বলেচি, তোর গাঁয়েই আমায় বিয়ে দেবে রে!’

‘সত্যি!’ আলোকিত হয়ে উঠেছিল জগদ্ধাত্রীর মুখ।

‘সত্যি সত্যি সত্যি। কিছুদিন সবুর কর। আমি গেলেই আবার দুজনে খেলব’খন।’

বন্ধুর প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে জগদ্ধাত্রী সেদিন কান্না থামিয়েছিল। অজানা ভবিষ্যতের দিকে দুরুদুরু বুকে পাড়ি দিয়েছিল, নতুন করে কুতকুত খেলতে পারার স্বপ্নে।

বেচারি জগু! এখন ভাবলে হাসি পায় নীলার। জগু যার হাতের সিঁদুর পরে বিক্রমপুরের শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল, তিনি পঞ্চাশোর্ধ্ব। ততদিনে তিনটি কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। প্রথমা ভাগ্যবতী, কিছুদিনের মধ্যেই একমাথা সিঁদুর নিয়ে স্বর্গে গেছে। দ্বিতীয়টি মারা গেছে প্রসব করতে গিয়ে। তৃতীয়া বন্ধ্যা। চারবছরেও গর্ভসঞ্চারের কোনও লক্ষণই সে নিজের শরীরে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। কুলীন ব্রাহ্মণ, শেষে কি লুপ্তপিণ্ডোদক হয়ে মরতে হবে নাকি? ওইজন্যই একান্ত বংশধরের কামনাতেই বাধ্য হয়ে জগদ্ধাত্রীর স্বামীকে বিবাহ করতে হয়েছিল।

তা এগারো বছরের জগদ্ধাত্রী স্বামীর মনস্কামনা পূর্ণ করেছিল। পতিব্রতা এয়োস্ত্রীর মতো ঋতুদর্শনের মাসতিনেকের মধ্যেই সে ‘পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ কে সত্যি করে গর্ভবতী হয়েছিল। প্রথম দু’বছর চিঠিতে যোগাযোগ ছিল নীলার সঙ্গে। ততদিনে এক পুত্রসন্তান কাঁখে খেলুড়ে জগু আবার অন্তঃসত্ত্বা। ক্লান্ত। পরিশ্রান্ত। চিঠি লেখার সময় কই? ধীরে ধীরে সে হারিয়ে গেছে নীলার জীবন থেকে।

ততদিনে নীলার বাড়িতে ঘটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কুলীন প্রথা বাংলায় তখন ভীষণ আকার ধারণ করেছে। বল্লাল সেন রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন প্রায় সাতশো বছর আগে। ‘কুলীন’ অর্থাৎ সৎকুলোৎপন্ন। ন’টা গুণ থাকলে তবেই সে কুলীন। আচার। বিনয়। বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা। তীর্থদর্শন। নিষ্ঠা। বৃত্তি। তপ। দান। এর মধ্যে যে কোনও আটটা গুণ থাকলে সে হল সিদ্ধ-শ্রোত্রীয়। সাতটা থাকলে সাধ্য-শ্রোত্রীয়। আর তার কম হলে সেই অভাগা ব্রাহ্মণ হল গিয়ে কস্ত-শ্রোত্রীয়। অন্যদিকে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদেরও ভেঙে তিনভাগ করা হল। কুলীন। কাপ। মৌলিক। বিবাহের যে নিয়মকানুন স্থির করা হল, তা জিলিপির প্যাঁচকেও লজ্জা দেবে। শাস্ত্রের মতো নিয়মেও কালের অনুশাসনে বেনোজল ঢোকে। এখানেও ঢুকল। গুণ টুন চুলোয় যাক, যারা বংশপরম্পরায় কুলীন, তাদেরকেই জামাই করতে হবে। তবেই বংশের কৌলীন্য বজায় থাকবে।

জোগান কম। চাহিদা অনেক বেশি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। মেয়েদের জীবনে অন্ধকার নেমে এল। অন্যদিকে এক শ্রেণির কুলীন ব্রাহ্মণদের পেশাই হয়ে গেল বিয়ে করে রোজগার করা। মুমূর্ষু কুলীনের সঙ্গে একই পরিবারের দিদি, পিসি, ভাইঝি ইত্যাদি দশ-বারোটি কুমারীর বিয়ে দেওয়া হতে লাগল। সঙ্গে মোটা টাকা পণ। কুলীনদের বিয়ের সংখ্যা এত হয়ে গেল, যে তাঁরা খাতায় লিখে রাখতেন স্ত্রীদের নাম। শ্বশুরালয়। সেকালের সংবাদপত্র অনুসন্ধান বলছে, ‘পূর্ববঙ্গে বারোজন কুলীন আছেন। তাঁদের সর্বমোট ৬৫২টি বিবাহ। তাঁদের মধ্যে একজনের আশিটি বউ। অন্য এগারোজনের ৫৭২টি। সর্বশ্রেষ্ঠ কুলীনচূড়ামণিটির বয়স ৭০ বছর।’*

[* অনুসন্ধান। ২৯শে মাঘ। ১২৯৫]

বিংশশতকের গোড়ায় এসে এই কদর্যতা অনেকটাই কমেছিল এপার বাংলায়। ততদিনে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো আলোকবর্তিকারা অক্লান্ত সংগ্রামে অনেকটাই বদল আনতে পেরেছিলেন, অন্তত আইনকানুনের দিক থেকে। শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্র ভেঙেছিলেন বিদ্যাসাগর। স্ত্রী বন্ধ্যা হলে ঠিক আছে, নয়তো জীবিত স্ত্রী থাকতে বিবাহ করার প্রবণতা কমছিল কলকাতার দিকে।

 কিন্তু পূর্ববঙ্গে তখনও কুলীন প্রথা রমরম করে চলছে। এই সব কুলীনদের অধিকাংশের বাসই ছিল পূর্ববঙ্গে। যশোর। খুলনা। বিক্রমপুর।* সারা বাংলা তখন চষে বেড়ায় ঘটক-ঘটকীরা। এ-গ্রাম থেকে সে-গ্রাম। কোন গ্রামে কয় ঘর কুলীন রাঢ়ী, কোথায় কে ভঙ্গ কুলীন, কার কোন তরফে খুঁত, কোন বাড়িতে ক’জন কুমারী, সব হিসেব তাদের নখদর্পণে। প্রাচীনযুগে স্বয়ংবরা রাজকন্যার কানে কানে যেমন ভাট গড়গড় করে বলে যেত পাণিপ্রার্থীদের গুণাবলি, এখানেও ঘটকীদের ঠোঁটের ডগায় সব মুখস্থ থাকত।

[* তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার কালের কথা।]

নীলার কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা অনেক সন্ধান করেও কোনও যুবক কুলীন পাত্র খুঁজে পেলেন না। যশোরের এক ঘটক অনেকদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছিল এক সুপাত্রের কথা। পাত্রের বাড়ি যশোরে, কিন্তু সে কর্মসূত্রে থাকে কলকাতায়। হ্যাঁ, পাত্রের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, কিন্তু খাঁটি কুলীন। কোনও দোষ নেই বংশে। সবচেয়ে বড় কথা হল, দুই পত্নীই গত হয়েছে।

মধ্যবয়স্ক ঘটক চোখ বড়বড় করে ওর বাবাকে বোঝাচ্ছিল, ‘হাতের নক্কি পায়ে ফেলবেন না ঠাউরমশাই। নৈকষ্য কুলীন। কোনও খুঁত নাই।’

নীলার মা তবু আড়াল থেকে কিন্তু কিন্তু করছিলেন। স্ত্রীর ইঙ্গিতে নীলার বাবা বললেন, ‘আইবুড়ো পাত্র নেই?’

ঘটক মুখ বেঁকিয়েছিল, ‘খেতে পেলে যে দেকি শুতে চান ঠাউরমশাই! এত ভাল বংশ, আইবুড়ো থাকে কেউ? কোনও সতীনজ্বালাও নাই। আচে শুধু পেত্থম পক্ষের এক খুকি। দাবিদাওয়াও কম। মাইয়ার কী সৌভাগ্য ভাবুন!’

নীলার বাবা চুপ করে থেকে ভাবছিলেন। ঘটকের কথা মিথ্যা নয়। খাঁটি কুলীন পাত্র পাওয়া, তায় আবার ‘অসপত্ন’ অধিকারে, এ হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই ব্যাপার।

ঘটকী ব্যস্ততার ভান করে উঠে দাঁড়িয়েছিল, ‘নাহ, আপনার আপত্তি থাকলে আমি অন্য কোনও ঘরে দেকি কতা বলে। মেয়ের বয়স এমনিই এগারো পুরেচে, এর চেয়ে দেরি করলে কানা বেগুন জুটবে।’

নীলার বাবা সেদিন কোনও কথা দেননি। তাঁর নজর তখন অন্যদিকে। শ্রীফলতলা গ্রামের যে ক’টা কুলীন ঘর আছে, তার মধ্যে একটা বাড়িতে অবিবাহিত কিশোর পুত্র। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার চোখ আলোকিত হয়ে উঠেছিল। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মেয়ে, নিজের পাড়াগাঁয়ে বিয়ে হওয়ার চেয়ে খুশির কিছু আছে নাকি?

নীলার মা অবশ্য কিন্তু কিন্তু করছিলেন। ভবানী বাঁড়াজ্জে নৈকষ্য কুলীন বটে, কিন্তু লোক ভাল নয়। স্বোপার্জিত সম্পত্তি। এই তল্লাটের ইজারাদার। রাজস্ব আদায় থেকে শুরু করে শ্রীফলতলা বাজার আর আঠারোবাঁকি নদীর পারানিঘাটের ইজারাও নিয়েছেন সদ্য। শ্রীফলতলা বাজারের বিকিকিনির ওপর খাজনা আদায় করেন। ধান চালের ওপর পেয়ে থাকেন ‘কোহালী’। এক পুরুষে বড়লোক হলে যা হয়। হঠাৎ করে তিনিই এখন গ্রামের সমাজপতি হয়ে উঠেছেন। যেমন দাপট। তেমনই শোষণ। ওদিকে গ্রামের সাবেক ভূম্যধিকারী হল রায়চৌধুরী পরিবার। তাঁরা যেন ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছেন।

নীলার বাবা কিন্তু কিন্তু করে একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে ভবানী বাঁড়াজ্জের সামনে দাঁড়িয়েই পড়লেন। যুক্তকরে সলজ্জে নিজের আর্জি পেশ করলেন। কুলীনের মর্যাদা দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই, তবে যা আছে, সর্বস্ব দেবেন তিনি। বাঁড়াজ্জেবাড়ির বউ হলে তাঁর মেয়ের কপাল খুলে যাবে।

মখমলে মোড়া কামদার তাকিয়ায় আলবোলার ফরসি হাতে বসেছিলেন ভবানী বাঁড়াজ্জে। নীলার বাবার কথা শোনামাত্র বিগলিত মুখে বলেছিলেন, ‘এ-এই দ্যাকো, তুমি হলে আমার গাঁয়ের ভাইয়ের মতন। কিছু দেওয়াথোওয়ার কতা আসচে কোত্থেকে?’

‘মানে?’

‘দেবে … উম্ম ওই শাঁখাসিঁদুরটুকু। আর সঙ্গে এক কপর্দক কৌলীন্য মর্যাদা! পারবে তো?’

নীলার বাবা স্বকর্ণকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তবে যে লোকে বলে, ভবানী বাঁড়াজ্জে মন্দ লোক? তিনি দ্রুত বলেছিলেন, ‘এ যে আমার পরম সৌভাগ্য বাঁড়াজ্জেমশাই!’

কিন্তু তার পরের কথাটা শুনে যেন বাস্তবের মাটিতে একটা প্রচণ্ড আছাড় খেয়েছিলেন নীলার বাবা।

‘সৌভাগ্যর কিচু না ভায়া, তুমি গৌরীদানের পুণ্যি করতে চাও, আমি কি বারণ করতে পারি? নাহলে আমার এই বয়সে আবার পঞ্চমপক্ষ নেওয়ার ঝক্কি …!’

নীলার বাবা চমকে উঠেছিলেন। ভবানী বাঁড়াজ্জের শুধু চার পত্নীই নয়, একাধিক উপপত্নী। চারিত্রিক দুর্নাম তো আছেই। তিনি দ্রুত বলেছিলেন, ‘বাঁড়াজ্জেমশাই, আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে। আমি আপনার পুত্র শেখরের সঙ্গে …!’

পরবর্তী ঘটনাক্রম সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত। বাঁড়াজ্জেমশাইয়ের বিরক্ত ইঙ্গিতে গোমস্তার হস্তক্ষেপ এবং নীলার বাবার প্রস্থান। বাইরে নিয়ে এসে গোমস্তা নীলার বাবার কানে কানে বলেছিল, ‘বলি, মাতা টাতা খারাপ হল নাকি তোমার? নাকি, বাপ ঠাকুদ্দার ভিটে থেকে বাস ওঠাতে চাও?’

‘কেন? আমি তো বাঁড়াজ্জেমশাইয়ের ছেলের সঙ্গে বিবাহপ্রস্তাব…!’

‘তুমি প্রস্তাব দেবার কে হে? কোন হরিদাস পাল তুমি? বাঁড়াজ্জেমশাইয়ের ওই একখানা বংশের বাতি, তার বে’র বাজারে দর জানো? তোমার মতো হাঘরে’র ভিটের জামাই হবে কেন সে? যাও যাও। ঘর যাও!’

নীলার বাবা সেদিন কালোমুখেই ঘরে ফিরে গেছিলেন। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আর ঝুঁকি নিতে চাননি। সত্যিই নীলার সমবয়সিনীদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তারই মধ্যে। খুব বেশি খোঁজখবর নেওয়ার নেই, এই ঘটক অনেকের বিয়ে দিয়েছে। যশোরের সেই পাত্রর সঙ্গে মেয়ের বিবাহে সম্মতি দিয়ে দিলেন তিনি।

নীলার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই ছিল না। এ তো বাংলার গ্রাম্য মেয়েদের স্বাভাবিক ভবিতব্য। তাই কেউ জানতেও চায়নি। তারপরের দিন জগদ্ধাত্রীকে সে গোটা গোটা অক্ষরে চিঠি লিখল, ‘আমার বে’ তোর গাঁয়ে হচেচ না। যশোর থেকে বিক্রমপুর কি অনেক দূর? যতদূরই হোক, আমি তোর কাচে যাব। তবে তুই আগে বল, আমার বে’তে কতদিন আগে আসবি?’

তিনমাস পর বিয়ের দিনক্ষণ। আর সেই তিনমাসেই ভাগ্যবিধাতার কোন অদৃশ্য এক অঙ্গুলিহেলনে আমূল বদলে গেল নীলার জীবন। খুলনার রূপসা নদীতে বাইচ প্রতিযোগিতা ছিল বিখ্যাত। প্রতিবছরই হত। নীলা বায়না ধরেছিল, ক’দিন পর তো চলেই যাবে। বাইচ খেলা কোনওদিনও দেখেনি। একবারটি দেখে এলে হয় না?

বাবা মত দিয়েছিলেন জেঠিমার সঙ্গে যেতে। নীলা দেখতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু ভিড়ে ভিড়ে দেখা তো দূর, জেঠিমার হাত ছেড়ে হারিয়ে গিয়েছিল কোথায়। সে এক ভয়ংকর অবস্থা। রূপসা নদী থেকে ভেসে আসছিল কাঁসরের শব্দ। নৌকাবাইচের সরু লম্বা নৌকাগুলো রূপসা নদীর জল কেটে দ্রুত এগিয়ে চলেছিল। উৎসাহ দিতে বাজছিল ঢোলকরতাল। নীলা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় যায়। তার মধ্যে সদ্যকিশোরীর পেলব শরীরে ভিড়ের সুযোগে হাতড়াতে থাকা ক্লেদাক্ত হাতের তো অভাব নেই সমাজে।

চোখ ফেটে জল আসছিল ওর। কী দরকার ছিল গ্রাম থেকে এতটা পথ উজিয়ে বাইচ দেখতে আসার? এখন কী হবে?

হঠাৎ হালে পানি পাওয়ার মতো করে দেখতে পেয়েছিল গ্রামের ছেলে ইন্দ্রদাদাকে। আর কোনও দিকে না তাকিয়ে একছুটে গিয়ে হাতখানা ধরেছিল।

‘ইন্দ্রদাদা!’

ইন্দ্রদা চির উদাস চোখে তাকিয়েছিল, ‘কীরে নীলু! তুই এখানে? কার সঙ্গে এসেছিস?’

‘এসেচিলাম তো জ্যাঠাইমার হাত ধরে। কিন্তু হারিয়ে গেচি।’ কাঁদোকাঁদো গলায় বলেছিল নীলা।

‘ওহ! তা এখন কোথায় যাবি?’

‘কোথায় আবার? বাড়ি যাব।’

‘তো চল।’

ইন্দ্রদা ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে একটা তেলেভাজার দোকান থেকে অনেকটা চপ মুড়ি কিনেছিল। একটা ঠোঙা নীলার হাতে দিয়ে অন্য ঠোঙা থেকে মুঠো ভরে মুখে পুরতে পুরতে বলেছিল, ‘চল। হাঁটা দেওয়া যাক তবে!’

সত্যিই সেদিন কিছু হেঁটেছিল বটে ওরা দু’জন। শহরের অলিগলি পেরোলেই উন্মুক্ত প্রকৃতি। বসন্ত কাল। ঝকঝকে আকাশে রাজহাঁসের মতো চরছে মেঘ। পথের দু’পাশে তোরণের মতো সেজে থাকা গাছগুলোর ডাল দুলছে মৃদুমন্দ। পাশ দিয়ে মাঝেমাঝেই চলে যাচ্ছে গরুর গাড়ি। দক্ষিণ দিক থেকে বইছে একটা ঠান্ডা হাওয়া। কোথা থেকে যেন নির্লজ্জভাবে ডাকছে কোকিল।

বসন্ত প্রতিবছরই আসে।

কিন্তু এবার যেন একটু অন্যরকম!

নীলার কী হয়েছিল, ইতস্তত করে বলে ফেলেছিল, ‘তুমি যে এত লেকাপড়া করো ইন্দ্রদাদা, বড় হয়ে তুমি কি জজ হবে?’

‘জজ? হঠাৎ জজ হতে যাব কেন?’

‘তবে সারাদিন এত বই মুকে বসে থাকো যে! মিনতির দাদা বলচিল, তুমি ইশকুলে রোজ পড়া পারো।’

‘ধুর। বই পড়ার সঙ্গে জজ হওয়ার কী সম্পর্ক! ওসব শেখর হবে।’

‘শেখরদাদা? সে তো বাপের গদিতেই বসবে। বাপের মতোই হিসেবি হয়েচে।’

‘অত সহজে কাউকে দাগিয়ে দিসনি নীলু। শেখরের ওসব ভাল লাগে না। ওর খুব ইচ্ছে, কলকাতা যাওয়ার।’ ইন্দ্রদাদা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় চরতে থাকা একটা কুকুরছানা কোলে তুলে নিয়েছিল, ‘আমি এখনও ঠিকই করতে পারিনি রে, কী হব। আচ্ছা কিছু কি হতেই হবে সবাইকে? কিছু না হলে হয় না?’

‘তা আবার হয় নাকি? তারকজ্যাঠার কত আশা তোমায় নিয়ে… তুমি বড় হয়ে দেশের দশের একজন হবে, আমাদের শ্রীফলতলা গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল করবে।’ পাকা গিন্নির মতো বলে যাচ্ছিল নীলা।

‘বাবা ওরকম বলেন। আমার ইচ্ছে, আমিও বড় হয়ে কলকেতায় যাব।’

‘জজ হতে গেলে তো যেতেই হবে।’

‘না না। জজ নয়। কলকেতায় গিয়ে আমি … আমি স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করব।’

‘সোয়ামি? কার সোয়ামি গো? আমাদের গাঁয়ের তো কোনও মেয়ের এ’যাবৎ কলকেতায় বে’ হয়েচে শুনিনি!’

ইন্দ্রদাদা ভ্রু কুঁচকে হেসে বলেছিল, ‘কারুর সোয়ামি নয় রে! স্বামী বিবেকানন্দ একজন বাঙালি সন্ন্যাসী। আমেরিকায় গিয়ে হিন্দু ধর্ম নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। কলকেতার কাছেই বেলুড় বলে একটা গ্রাম আছে, সেখানে একটা মঠ খুলেছেন।’

‘সেকি গো ইন্দ্রদাদা! তুমি সন্ন্যাসী হয়ে যাবে নাকি? জেঠিমা তো তাহলে কেঁদে কেঁদে মরে যাবে গো!’

আজ যখন সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে নীলা, নিজের মনেই কুঁকড়ে যায়। ইন্দ্রদাদা ওর মতো অশিক্ষিত গ্রাম্য বালিকার প্রগলভতায়, অজ্ঞানতায় কি বিরক্ত হচ্ছিল? বোধ হয় না। কারণ তার পরের বাকিটা রাস্তা ইন্দ্রদাদা ওকে অনেক কিছু সহজ করে বুঝিয়েছিল। মানুষ হয়ে জন্ম মানেই শুধু আহার নিদ্রা মৈথুন নয়। এর বাইরেও একটা বিশাল জগৎ আছে। এই রক্তমাংসের শরীরের ভেতর লুকিয়ে আছে এক সূক্ষ্ম শরীর। তাকে দেখা যায় না। কিন্তু সে-ই প্রাণশক্তি। তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সেই অন্তরাত্মাকে মিলিয়ে দিতে হবে ঈশ্বরের সঙ্গে। পরমাত্মার সঙ্গে। তবেই তো মুক্তি!

সব যে সেদিন নীলা বুঝতে পারছিল তা নয়। বরং বেশিরভাগই ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তেমন কথা আগে কারুর কাছে ও শোনেনি। শুনতে যেন বড় ভাল লাগছিল।

ইন্দ্রদাদা বলে চলেছিল, ‘স্বামীজি বলেছেন, আত্মনির্ভর হতে হবে সবার আগে। তারপর ভাবতে হবে অন্যের কথা। অন্যের দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কীভাবে যে ঝাঁপাব, তার কোনও পথই দেখতে পাচ্ছি নে!’

নীলা চুপ করে হাঁটছিল, ইন্দ্রদাদা হঠাৎ ওকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুই কোনও পথ বাতলাতে পারিস?’

‘আমি? আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ, আমি আবার কী জানি গো!’ মা ঠাকুমা দিদিমার কাছ থেকে চিরাচরিত যে বাক্য শুনে বড় হচ্ছিল নীলা, সেটাই উগরেü দিয়েছিল।

কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধা হয়নি। ইন্দ্রদাদা ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘ইহহ, আত্মার আবার পুরুষ-নারী কী? ওসব কথা বলে আমার কাছে সুবিধে হবে না। তোর গল্প শুনতে ভাল লাগে?’

‘হুঁ। দুপুরবেলা ঠাকুমার কাছে বসে শুনি তো। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি। সাত ভাই চম্পা। পক্ষীরাজ ঘোড়া …!’

‘সবই তো সেই একধরনের গল্প। সব গল্পেই পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে রাজপুত্র গিয়ে উদ্ধার করছে রাজকুমারীকে। সব গল্পেই রাজকন্যা ভয়ে কাঁপছে। কেন, উলটো গল্প হতে পারে না বুঝি?’

নীলা হাঁ করে শুনছিল, ‘তাও আবার হয় নাকি! মেয়েমানুষ গিয়ে উদ্ধার করবে ব্যাটাছেলেকে?’

‘কেন, না হওয়ার কী আছে? তোরা মেয়েরা নিজেদের এত দুর্বল ভাবিস কেন? স্বামীজি বলেছে, এক ডানায় ভর দিয়ে কোনও পাখি উড়তে পারে না।’

‘মানে কী গো?’

‘মানে হল, আমাদের সমাজে পুরুষ আর নারী দুটো ডানার মতো । আর আমরা তো সকলেই আত্মা। আত্মার আবার পুরুষ নারী কী? দুটোই তো সমান! নাহলে পাখি উড়বে কেমন করে?’

‘ওমা! ছেলে আর মেয়েরা সমান? ছেলেরা তো সবকিছু পারে। মেয়েরা সে-সব কিছু পারে নাকি?’

‘মেয়েরা সন্তান জন্ম দিতেও পারে, পালন করতেও পারে। ছেলেরা কিন্তু দুটো পারে না। অনেককাল আগে জানিস, মায়েরাই সমাজের হর্তাকর্তা ছিল?’ ইন্দুদাদা ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘মেয়ে হোস কি ছেলে। এই জীবনে মানুষ হয়ে জন্মেছিস তো সময়টাকে সুদে-আসলে উশুল কর। পরের জন্মে ছাগল হবি না গরু, তার কোন ঠিক আছে?’

শুনতে শুনতে নীলার যেন কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছিল সেদিন। সুদে-আসলে সময় উশুল? এভাবে তো কেউ কোনওদিনও ওকে বলেনি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে এসেছে, শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। স্বামীর সেবা করতে হবে। হ্যাঁ, অক্ষরজ্ঞানটুকু আছে ওর। বাড়িতেই শিখেছিল। কিন্তু ওই অবধি।

ইন্দ্রদাদা নিজের মনে বলে যাচ্ছিল, ‘জানিস, আমার এক দিদি থাকে কলকাতায়। ওদের কিন্তু এখন আর এত অল্পবয়সে বিয়ে হয় না। আমার দিদি বেথুন স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ছে। অথচ আমাদের গাঁয়ের মেয়েগুলোকে দ্যাখ, দশ-বারো হতে না হতেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।’

বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলেছিল নীলা, ‘আমারও তো বিয়ে গো ইন্দ্রদাদা!’

ইন্দ্রদাদা অবাক চোখে তাকিয়েছিল, ‘কোথায়?’

‘যশোরে।’

‘ওহ!’ ইন্দ্রদা হেসেছিল, ‘তবে আর কী। মন দিয়ে সংসার করিস।’

গল্প করতে করতে গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন দু’জন। গ্রামে ঢুকেই যে পদ্মদিঘি, তার পশ্চিমপাড়ে এসে ইন্দ্রদাদা ঘুরে তাকিয়েছিল, ‘এখান থেকে বাড়ি যেতে পারবি তো?’

‘হ্যাঁ।’ কিশোরী নীলার বুকের ভেতরটা কেমন উথালপাথাল হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বড় ভুল হয়ে গেছে জীবনে সবকিছু। ও অধীর গলায় বলেছিল, ‘আমায় ওনার একটা বই দেবে ইন্দ্রদাদা?’

‘কার?’

‘সোয়ামি … কী যেন নাম বললে!’

‘বিবেকানন্দের বই? তুই পড়বি?’ জ্বলজ্বল হয়ে উঠেছিল ইন্দ্রদাদার চোখ, ‘বেশ। কাল সকালে এসে নিয়ে যাস।’

সকাল অবধি সবুর সয়নি নীলার। বাড়ি গিয়ে মা’কে বলেই একছুট্টে চলে গিয়েছিল রায়চৌধুরীদের বাড়িতে। সবাই অবশ্য রায়বাড়ি নামেই চেনে। ছোটবেলায় কত গেছে। হামা দিয়েছে। খেয়েছে।

ইন্দ্রদাদা শেখরদাদার সঙ্গে বসে গল্প করছিল। ওকে দুটো বই দিয়েছিল। ওইটুকুই।

জেঠিমার হাতের নাড়া খেয়ে বই বগলে রায়চৌধুরী বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটছিল, পিছু ডেকেছিল শেখরদা।

‘নীলু!’

‘হ্যাঁ শেখরদা। বলো!’ পেছন ফিরে নীলা একটু ভড়কে গিয়েছিল। শেখরের দৃষ্টি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক লাগেনি ওর। শেখরদা যেন মুগ্ধ চোখে দেখছে ওকে।

ওরা সবাই একেবারে শিশুবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে। কোলেপিঠে খেলেছে। কিন্তু কিশোরীবেলায় উপনীত হয়ে নীলা সেদিন উপলব্ধি করছিল, শেখরদা এভাবে ওর দিকে আগে কখনও তাকায়নি।

শেখরের চোখে যেন অনেকগুলো রং খেলা করছিল। মৃদুস্বরে বলেছিল, ‘তো-তোকে এগিয়ে দেব?’

‘না না!’ মেয়েদের ষষ্ঠেন্দ্রিয় ছেলেদের চেয়ে আগেই পরিণত হয়ে ওঠে। কোথা থেকে যেন একরাশ সংকোচ এসে জড়ো হয়েছিল নীলার মুখে। চোখদুটো খুঁজছিল অন্য একটা মুখকে।

কিন্তু না। যাকে চায়, তাকে পায়নি। স্বভাব উদাস ইন্দ্রদাদা আসেনি বাইরে।

আজও ভাবলে বিস্ময় জাগে নীলার। সেদিন যদি ও বাইচখেলা দেখতে না যেত? তবে কি ওর জীবনটা এভাবে বদলে যেত? যেমন ছিল, যেভাবে গত কয়েকশো বছর মেয়েরা বেঁচে এসেছে, সেভাবেই বাঁচত। কিন্তু না। নিয়তি কেন বধ্যতে। সবই বোধহয় ছিল পূর্বনির্ধারিত।

সেই বসন্তে ও প্রথম অনুভব করেছিল মনের শিরশিরানি। ছোট থেকে দেখতে থাকা ইন্দ্রদাদা হঠাৎই যেন নতুন রূপে দেখা দিয়েছিল ওর চোখে। ও আবিষ্কার করেছিল, ইন্দ্রদাদা আর যেন আগের মতো সেই নরমসরম নেই। হঠাৎ করে অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। গলার স্বরও ভাঙতে শুরু করেছে। গালে চিবুকে নরম রোমাগমনের পূর্বাভাস।

বই নিতে দিতে প্রায়ই যেত ও রায়বাড়িতে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল, আর যেন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারত না ইন্দ্রদাদার সঙ্গে। ইন্দ্রদাদা কত কী বলে যেত, ও নির্নিমেষ নয়নে শুধু চেয়ে থাকত।

বৈশাখের এক রাতে কপালে অপটু হাতের চন্দন, নাকে নথ, গায়ে বেনারসি জড়িয়ে নীলা যেদিন দাঁড়িয়ে পড়ল ছাঁদনাতলায়, ওর সখী জগু তখন আটমাসের ভরা পোয়াতি, সইয়ের বিয়েতে আসার ছাড়পত্র পায়নি। চারপাশের হইহট্টগোল, উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনির মাঝে উলটোদিকের লোকটার দিকে তাকাতেই ওর বুকটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠেছিল। দশাসই চেহারা। চোখদুটো রক্তবর্ণ। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিল না। ঊর্ধ্বাঙ্গের উড়নি থেকে শুরু করে গলার গোড়ের মালাটি অবধি কেমন যেন অসংবৃত। পাশের বন্ধু ধরে রেখেছিল। শুভদৃষ্টির সময় নীলার চোখদুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। হাতের নতুন শাঁখা পলা, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ সব ছাপিয়ে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল উদাস এক কিশোরের মুখ। অশ্রুগ্রন্থি থেকে প্রবল জলোচ্ছাস নেমেছিল। মনে হয়েছিল চিৎকার করে বলে, ‘ইন্দ্রদাদার সঙ্গে আমার বে’ দাও না গো!’

এতদিন পর সে-দিনের কথা মনে পড়ামাত্র আবারও চোখ জলে ভরে এল ওর। বারোয়ারি বেনারসির খুঁট দিয়ে অশ্রু মুছতে যাবে, এমন সময় দরজায় ঠকঠক।

গৌরীপ্রসন্ন ফিরে এসেছেন।

‘কীরে? এখনও ওইভাবেই বসে আছিস?’

নীলা কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়ায়, ‘ওদের দেখতে পেলেন?’

‘নাহ। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। আমাদের কাছে যেতেই দিল না। তবে সবাই নাকি একবারে আসেওনি শুনছি।’ গৌরীপ্রসন্ন বলতে বলতে সন্দিগ্ধমুখে ওর দিকে তাকালেন, ‘কেন বল তো? তোর মতলবটা কী? তুই বলেছিলি, দেশের জন্য কাজ করতে চাস। তাই তোকে বের করে এনেছি। ‘গোলাওয়ালা’দের নিয়ে তোর এত উৎসাহ কীসের? তুই কি ওদের কাউকে চিনিস?’

নীলা ফুসফুস ভর্তি করে নিঃশ্বাস নিল। তারপর দু’পাশে মাথা নাড়ল।

‘না!’  

যে যাই বলুক, পোর্ট ব্লেয়ার ভারি সুন্দর এক দ্বীপ। ঝকঝকে রোদ। সারি সারি নারকেল গাছ। কিছুদূর অন্তর ব্রিটিশ বাংলোবাড়ি। সামনে তাকালেই সবচেয়ে প্রথমে যা চোখে পড়ে, তা হল প্রায় আকাশ ঢেকে দৈত্যের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড এক ইমারত। সাতজন রাজবন্দি বিড়বিড় করে।

‘এই সেই সেলুলার জেল?’

‘হ্যাঁ।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিপাই হলুদ দাঁত বের করে, ‘এখানেই আপনাদের থাকতে হবে।’

‘বেশ!’

সঙ্গে আসা সাতজন মহিলা কয়েদিকে আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে মহিলা জেলের দিকে। সাতজন রাজবন্দি সেলুলার জেলের ফটক দিয়ে প্রবেশ করামাত্র তাদের পায়ের ডান্ডাবেড়ি কেটে দেওয়া হল। দীর্ঘ কয়েকদিন সেই শিকল বাঁধা ছিল। মুক্তির পর প্রত্যেকেই হাতে পায়ে আড়মোড়া ভেঙে শরীরের আড় কাটিয়ে নিতে চাইছিল।

ঠিক সেইসময় এগিয়ে এলেন এক শ্বেতাঙ্গ সাহেব। তাঁর চেহারার গড়নটি একটু অদ্ভুত। উচ্চতায় মেরেকেটে ফুটপাঁচেক, প্রস্থেও প্রায় ফুটচারেক। প্রকাণ্ড মধ্যপ্রদেশ। চাপা নাক। গোলগোল চোখ। লালচে মুখ। সেই মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ঠোঁটের কোনায় ঝুলছে একখানা চার ইঞ্চি বার্মা চুরুট।

‘এই কোটপ্যান্ট পরা কোলাব্যাঙটা কে গো উল্লাসদা?’

‘এখনও বুঝলি নে? ইহাই হইল সেলুলার জেলের সেই বিখ্যাত বুল ডগ ব্যারি।’ উল্লাসকর হাই তুলল।

প্রশ্নকর্তা ছেলেটি দমে গেল। সে উনিশ বছরের টগবগে তরুণ। যবে থেকে সেলুলার জেলের নাম সে শুনছে, তবে থেকেই এখানকার জেলার ডেভিড ব্যারির নাম শুনে চলেছে।

ওদিকে ডেভিড ব্যারি আলতো করে একবার চুরুটের ধোঁয়া টানছিলেন, আর তীক্ষ্ণচোখে সাতটা ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এই প্রথম তাঁর কাছে এত বড়মাপের বিপ্লবীরা এসেছে। আলিপুর বোমা মামলা বটে কথা। গোটা দেশ তো বটেই, ইংল্যান্ডেও তোলপাড় পড়ে গেছে এদের কাণ্ডকারখানায়। ওপর থেকে তাঁর কাছে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে, প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হবে। আসার পরেই এদের শিরদাঁড়াগুলো চুরমার করে দিতে হবে, যাতে কোনওভাবেই বেশি ওস্তাদি না করতে পারে।

বগলের লাঠিটাকে আরও চেপে ধরে চুরুটে দু’বার টান দিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে জড়ানো ইংরেজিতে বললেন, ‘অবশেষে তোমরা এসে পৌঁছলে! জেলের ওই ব্লকগুলো দেখতে পাচ্ছ তো?’

ডেভিড ব্যারি শেষ বাক্যটা বললেন একেবারে নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উনিশ বছরের তরুণটির দিকে উদ্দেশ্য করে। তিনি এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর তামাক মিশ্রিত মুখের দুর্গন্ধে ছেলেটার বমি এসে গেল। গত কয়েকদিনের সমুদ্রযাত্রার ধকল সামলে মনে হল ও এবার হড়হড় করে বমি করে ফেলবে। নাকমুখ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ও ওপর নীচে ঘাড় নাড়ল।

‘ভেরি গুড। তো শোনো, ওই ব্লকে আমরা সিংহদের পোষ মানাই, বুঝলে? বেশি ট্যাঁ ফো করার চেষ্টা কেউ করবে না।’ ডেভিড ব্যারি একটু থেমে হাসলেন, ‘ভাবছ, পাঁচিল এত নিচু কেন? চিন্তা নেই। ওই পাঁচিল পেরোতে পারলেও পালাতে পারবে না। এই জেলখানার চারপাশে হাজার মাইল সমুদ্র। জঙ্গলে জানোয়ার। আর রয়েছে জারোয়ারা। তার বিষমাখানো তিরের কথা শুনেছ নিশ্চয়ই? আমার নাম ডেভিড ব্যারি। যে ভাল, তার কাছে আমার মতো ভাল কেউ নেই। কিন্তু যে খারাপ, তার কাছে আমার চেয়ে বড় শয়তান আর কেউ নেই। এই যে দেখছ পোর্ট ব্লেয়ার, এর তিন মাইলের মধ্যে ভগবান আসেন না। এখানে আমিই ভগবান। হা হা!’

কথাগুলো একটানা বলে ব্যারি নিজেই বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করলেন। ছেলেটা লক্ষ্য করল, দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েদিরা। তাদের দেখলে কেমন যেন অমাবস্যার শ্মশানে নৃত্যরত অশরীরী মনে হচ্ছে। কঙ্কালসার চেহারা। প্রত্যেকের মাথা ন্যাড়া। সকলেই প্রায় উলঙ্গ। পরনে কেবল একখানা করে লেংটি।

ওদেরকেও কি এমন লেংটি পরে ঘুরতে হবে?

পরক্ষণেই ও নিজের মনকে প্রবোধ দিল। যে কাজে ও নিজেকে সঁপেছে, তার কাছে এগুলো কি খুবই তুচ্ছ নয়? কই, ওর পাশে তো উল্লাসদাদা ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝেমাঝে কাঁধ নাচাচ্ছে। আর এদিক ওদিক দেখছে। কই, সে তো এত কিছু ভাবছে না।

সত্যি! ওদের দলে উল্লাসদাদার মতো এমন অকপট আবেগপ্রবণ দামাল ছেলে আর একটাও নেই। হইহই করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হা হা করে হাসে। উদাত্তকণ্ঠে গান গায়। কোনও নাটকীয়তা নেই। সংকোচ নেই। আড়ম্বর বা ভনিতা নেই। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিপিন চন্দ্র পালরা যখন দেশ জুড়ে বক্তৃতার ঝড় তুলছেন, তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক রাসেল সাহেব একদিন ক্লাসে পড়ানোর সময় বাঙালিদের নিয়ে কীসব আজেবাজে কথা বলেছিলেন, উল্লাসদাদা বগলে করে একখানা ছেঁড়া চটি নিয়ে কলেজ গেল, গিয়ে বেশ করে চটিপেটা করল। কলেজ তাড়িয়ে দিল বটে, কিন্তু তাতে উল্লাসদাদার কী এল গেল! উল্লাসদাদা সরাইলের কালীকচ্ছ গ্রামের বিখ্যাত জমিদারবংশের ছেলে, ঠাঁট বাট অর্থ প্রতিপত্তি সবদিক থেকেই চাইলে পায়ের ওপর পা তুলে সারাটা জীবন মৌজ করতে পারত, কিন্তু করল কী!

ছেলেটা আবার সমীহের চোখে উল্লাসকরের দিকে তাকাল। যতই সে বারীনদা’র কাছে দীক্ষা নিক, মনে মনে ওর আদর্শ এই উল্লাসদাদা। দলের সবাই ওর এই পক্ষপাতের কথা জানে। কেউ কিছু বলে না। ও সকলের ছোট। সবাই ওকে স্নেহ করে।

ক্রমাগত তর্জন গর্জনে ছেলেটা আবার বাস্তবে ফিরে এল। ডেভিড ব্যারি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পেটি অফিসারের হাত থেকে রাজবন্দিদের নাম লেখা কাগজটা নিয়েছেন। নিয়মমাফিক নাম ডাকা হবে এবার। তারপরেই চলে আসবেন জেলের ডাক্তার। এক-একজন করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সেইমতো কাজ দেবেন।

কে কী কাজ পাবে? ছেলেটা উৎসুক চোখে ভাবছিল। উল্লাসদাদা আর ওর কুঠুরি পাশাপাশি থাকলে বেশ হয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেমন সুন্দর গল্প করবে!

কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে ব্যারি জিজ্ঞাসুচোখে পাশে দণ্ডায়মান পেটি অফিসারের দিকে তাকান, ‘আরও দু’জন গোলাওয়ালার আসার কথা ছিল যে! Where are they?

‘আজ্ঞে, তাদের রক্ত আমাশা হয়েছে। ডাক্তার পারমিট দেননি। পরের জাহাজে আসছে হুজুর!’ লম্বা সেলাম ঠুকে জবাব দিল পেটি অফিসার। তার চেহারাখানা দেখে ছেলেটার আক্কেল গুড়াম হয়ে গেল। বেঁটে ঘাড়েগর্দানে চেহারা। মুখ খুললেই বড় বড় বাঁকা দাঁতগুলো দৃশ্যমান হয়ে পড়ছে। জোড়া ভ্রু। কালো চাপ দাড়ি।

ত্বকের থেকে এক ইঞ্চি পুরু লোম চেহারাটাকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে।

ওর এমন হাঁ করে দেখাতে বোধহয় উল্লাসদাদা পাশ থেকে কিছু আঁচ করল। একটু ঝুঁকে ফিসফিস করল, ‘ও হল খোয়েদাদ খাঁ। এখানকার আরেকজন বিখ্যাত যমদূত। তা তুই অমন করে কী দেখছিস? প্রেমে পড়ে গেলি নাকি?’

উল্লাসদাদা এমন গম্ভীর মুখ করে হাসির কথা বলে! ছেলেটা হাসি চাপতে গিয়েও পারল না। ফিক করে হেসে ফেলল।

খোয়েদাদ খাঁ লাল চোখ পাকিয়ে এগিয়ে এল। ব্যারি সাহেবের সে বিশেষ পছন্দের পেটি অফিসার। কাল অনেক সন্ধ্যা অবধি গোপন মিটিং হয়েছে। ব্যারি সাহেব সব পেটি অফিসার আর টিন্ডেল জমাদারদের বলে দিয়েছেন, কোনও অবস্থাতেই যেন গোলাওয়ালারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পায়। নিজেদের কুঠুরিতে চলে যাওয়ার পর তো সেই সম্ভাবনাই নেই, কিন্তু এখনও সেই নিয়মের ব্যত্যয় হতে দেওয়া যায় না। খোয়েদাদ জলদগম্ভীর কণ্ঠে উর্দুমিশ্রিত হিন্দিতে চেঁচাল, ‘খামোশ!’

ব্যারি সাহেব গলা পরিষ্কার করে নিলেন। লিস্টে সাতজনের নাম পরপর লেখা। তিনি রোলকলের কায়দায় নাম পড়তে শুরু করলেন, ‘হেমচন্দ্র কানুনগো। বারীন ঘোষ। বিভূতিভূষণ সরকার। অবিনাশ ভট্টাচার্য। হৃষীকেশ কাঞ্জিলাল। উল্লাসকর দত্ত। ইন্দুভূষণ রায়।’

শেষ হাতটা তুলল উনিশ বছরের ছেলেটা। খাতায় কলমে তার নাম ইন্দুভূষণ রায় হলেও আসলে তার নাম ইন্দ্রভূষণ। পদবি রায়চৌধুরী। আর লোকের মুখে মুখে সে কখনও ইন্দ্র কখনও ইন্দু। রোগা ঢ্যাঙা চেহারা। গালে আলতো দাড়ি। শ্যামলা গাত্রবর্ণ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যা চোখে পড়ে, তা হল ইন্দুর চোখ।

উজ্জ্বল। বুদ্ধিভরা। তবে তার চেয়েও বেশি সেখানে খেলা করছে, মায়া।  

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন