কৃষ্ণসিন্ধুকী – ২০

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

দরমার বেড়া দেওয়া মাটির ঘর। সূর্যের আলো সরাসরি এসে ধাক্কা দেয় সারাদিন ধরে, তাই এই সন্ধ্যাবেলাতেও সেই উত্তাপ যায়নি পুরোপুরি।

চন্দ্রপ্রভা ঘরের সামনের একফালি উঠোনে সন্ধে দিচ্ছিল। গা ধুতে যাওয়ার আগে বাইরের দালানে রেখে দিয়েছে একখানা পিতলের গাড়া। এক ঘটি জল। আর একখানা লাঠি।

কর্তা সন্ধেয় চণ্ডী মণ্ডপ থেকে এসে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যান। তা, এই তল্লাটে বুনো জন্তুজানোয়ারের তো অভাব নেই।

ঘরের কুলুঙ্গিতে একখানা পেতলের প্রদীপে জ্বলছে রেড়ির তেল। সেই আলোয় চন্দ্রপ্রভার মুখখানা দেখাচ্ছে গর্জনতেলে মাখা প্রতিমার মতো। সন্ধে দেওয়া সেরে সে ধীরেসুস্থে ঘরে প্রবেশ করল।

আর তখনই তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল কেউ। চন্দ্রপ্রভা চমকে মুখ ফেরানোমাত্র প্রতিপক্ষের নিবিড় নিষ্পেষণে তার ওষ্ঠাধর নীরব হয়ে গেল। পেছন থেকে তার গলায় নেমে এল একখানা রজনীগন্ধার মালা।

চন্দ্রপ্রভা বাঁকা হাসল। তারপর গেয়ে উঠল,

‘আর মালা চাই না, আর মালা চাই না।

বাসি ফুল নিয়ে যা ফিরে, ওলো বুড়ো ময়না।’

ফটিক ফিচেল হাসল, ‘বুড়ির রাগ হল নাকি?’

‘না, আমি আর রাগ করে কী করব?’ চন্দ্রপ্রভা মুখ সরিয়ে নিয়ে ঝঙ্কার দিল, ‘এখন ওই ছুঁড়িকে দেকে তো তোমার মনে রাগরাগিণীরা গান গেয়ে উটচে!’

‘বেড়ে বললে তো!’ ফটিক হা হা করে হাসতে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই সেদিনের বিকেলের কথাটা মনে পড়তে ওর মুখ থেকে হাসি অন্তর্হিত হয়ে গেল। গৌরীপ্রসন্ন বুড়োকে যে মেয়েটা বিয়ে করেছে, সে মোটেই কোনও হেঁজিপেঁজি নয়। স্বাবলম্বন গ্রামের প্রতিটি রমণীই জেলখাটা ঘাগু মহিলা, পয়সার লোভ দেখিয়ে তাদের বশ করা কোনও ব্যাপার না। কিন্তু এই মেয়েটা সেই প্রবাদকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে।

বারবার।

মুখে আলগা হাসি ফুটিয়ে ফটিক বলল, ‘তবু তো ভাল, মাগি পাছা দেকচি। অন্যদের মতো প্যাংলা ছোঁড়াগুলোর পেছনে ছুটচি না।’

চন্দ্রপ্রভা মুখেচোখে কৌতূহল ফুটিয়ে কাছে ঘনিয়ে এল, ‘হ্যাঁগা, জাহাজের সারেঙ শান্তিরাম, সে নাকি কোন মুদ্দোফরাশের ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকেচিল?’

‘হুঁ।’

‘ছ্যা ছ্যা! জানাজানি হতে মারধর খেয়েচে?’

‘খাবে না তো কি জামাই আদর দেবে নাকি?’ ফটিক পিচ করে একদলা থুতু ফেলল জানলা দিয়ে, ‘এইসব অসৈরণ কাণ্ডকারখানায় তোল্লাই দিতে আচে? শান্তিরাম ব্যাটা ঘাটের মড়া, ক’দিন পর চিতেয় উঠবে, তবু এসব নোংরামি গেল না। কত বললাম, যে মাগিগুলো নতুন আসচে, তাদের দিকে ছিপ ফ্যাল। তা অত ধইরযি নেই! ছেলেছোকরা নিয়ে টানাটানি।’

‘যাই বলো আর তাই বলো।’ চন্দ্রপ্রভা ঠোঁট ওলটাল, ‘তুমি এখন গাঁয়ের মেয়েদের রঙ্গরসিকতার বস্তু হয়েচ। সবাই তোমার নাম শুনলেই মুকে আঁচল চাপা দিয়ে হাসে।’

‘কেন?’ ফটিক ভ্রু কোঁচকাল। লোকে তাকে নিয়ে নিন্দেমন্দ করুক, তাতে তার কিছু আসে যায় না। আড়ালে কুৎসা করাটাকে সে উপভোগ করে। কারণ, সামনে সবাই তাকে সমঝে চলে। রস আইল্যান্ডে জেলের সুপার মারে সাহেবের বাড়ির খিদমতগার বলে নয়, অমন সাহেবদের চাকরবাকর এই গাঁয়ের ঘরে ঘরে।

ফটিককে সমীহ করার কারণ হল, সে যে মেয়েছেলে সাপ্লাইয়ের দালাল, তা অজানা কারুরই নেই। রস আইল্যান্ডে বেশ কিছু নারীমাংসলোভী সাহেব আছেন, তাঁদের সকলের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য দালাল এই ফটিক সামন্ত। স্বাবলম্বন গ্রামের স্বাধীন মেয়েদের তো বটেই, ফটিকের শরণাপন্ন হলে যে মহিলা জেলখানার বন্ধ গরাদের আড়াল থেকেও মেয়েদের পাওয়া যাবে, তা সেখানকার সাহেবদের কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’। হ্যারি কোলফিল্ড, জর্জ পোর্টওয়েলদের মতো কর্তারা যার ধুরন্ধর ধূর্ততার প্রশংসা করেন, তাকে নিয়ে গ্রামের দু’আনার মাগিগুলো নাকি রঙ্গ করছে?

চন্দ্রপ্রভা রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘নতুন যে মেয়েটা গাঁয়ে বউ হয়ে এল, ওই যে, যার পাছা দেকে তুমি নাকি সমুদ্দুরে উলটে যাও প্রতিদিন, সে নাকি সবার সামনে লঞ্চে তোমার নাকে বেশ করে ঝামা ঘষে দিয়েচে?’

কথাখানা বলে চন্দ্রপ্রভার ভারী তৃপ্তি হল। লম্পট ফটিক যখন ওর এই প্রায় প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছনো বহুভোগ্যা শরীরটার ওপর হামলে পড়ে, মাঝে মাঝে ওর মনে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে, হেঁশেল থেকে বঁটিটা নিয়ে এসে গলায় বসিয়ে দিতে। ঠিক যেমন কোপ বহু বহু বছর আগে সে দিয়েছিল একটা দু’পেয়ে জন্তুর গলায়।

চন্দ্রপ্রভাদের গাঁয়ে তখন পালাগানের আসর বসত। একবার একটা পালা এসেছিল, লোকের মুখে মুখে ফিরছিল। পতিঘাতিনী সতী পালা। বিষ্ণুপুরের রাজা রঘুনাথ সিংহ প্রেমে পড়েছিলেন বাইজি লালবাঈয়ের। কিন্তু রানি চন্দ্রপ্রভা স্বামীর এই পরকীয়া মেনে নিতে পারেননি। রানিরই নির্দেশে জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল রাজা ও লালবাঈকে। স্বামীকে মেরে পরে আবার স্বামীরই চিতায় পুড়ে রানি চন্দ্রপ্রভা হয়েছিলেন ‘পতিঘাতিনী সতী’।

চন্দ্রপ্রভা যখন ওর স্বামীকে খুন করেছিল, সকলেই রানির সঙ্গে ওর নামের সাদৃশ্য দেখে বলেছিল, ও-ও পতিঘাতিনী সতী। চন্দ্রপ্রভা তাতে একমত হয়নি। পতিঘাতিনী হতে পারে, কিন্তু সতী নয়। সতী হওয়ার কোনও সাধই তার নেই। এ-কথা সে বহুবার এখানে এসেও বলেছে। ভীমি বা শবনমের মতো মেয়েরা অবাক হয়েছে। তাতে ওর রাগ আরও বেড়ে গেছে। মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছে, ‘সতী হওয়ার দায় কি শুদু মেয়েমানুষের একার নাকি? আমরা কি অসতী একা একা হই? তারা সব সুখ একা নেবে কেন? আমরা অসতী হলে তারাও অসৎ।’

এ-কথা কারুরই অবিদিত নয় যে, ওর মতো যে মেয়েরা আন্দামানে একেবারে প্রথমদিকে এসেছিল, যাদের জোর করে সরকার একদিন জাহাজে তুলে দিয়েছিল অচেনা কিছু দাগি অপরাধীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার জন্য, তাদের সকলকেই থিতু হওয়ার আগে বহু পুরুষের বাহুলগ্না হতে হয়েছে। কখনও বলপূর্বক, কখনও পরিস্থিতির চাপে পড়ে।

তখন যারা মরে গেছে তাদের কথা মিটে গেল, কিন্তু চন্দ্রপ্রভা, দীনবাঈয়ের মতো যারা মরেনি, তারা তো এখন বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। অতীতের দগদগে অভিজ্ঞতার ক্ষত অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। সেদিনের বহুভোগ্যা আজকের ডাঁটো গৃহকর্ত্রী।

কিন্তু চন্দ্রপ্রভার ভাগ্যে তা নেই। চন্দ্রপ্রভার স্বামী হরিহর মাটির মানুষ। সে জেলখানার পাকশালায় রান্না করত। জেলের রান্নাঘরের অবস্থা ভয়ানক বললেও কম বলা হয়। অর্ধেক দিন রান্নার নারকেল তেল বা সর্ষের তেল ফুরিয়ে গেলে কেরোসিন তেল দিয়ে রান্না করতে হত। রাঁধুনিদের পরিচ্ছন্নতার কোনও বালাই নেই। নোংরা জামাকাপড়, ঘেমো গায়ে তারা যখন পুঁইশাক বা কচুর ডাঁটা রাঁধত, সেই রান্নার মধ্যে ঘাস, ডালপালা থেকে সমুদ্রের বালি, আরশোলার নাদি কিছুই বাদ যেত না।

হরিহরের দোষ বলতে, কলকাতা থেকে দু’জন ফুড ইন্সপেক্টর এসেছিল জেলখানার খাবার খতিয়ে দেখতে। কর্মীরা সবাই মুখে কুলুপ আঁটলেও সে সব সত্যি কথা বলে দিয়েছিল। কয়েদিদের জন্য যতটা খাবার বরাদ্দ, তার অর্ধেকও যে দেওয়া হয় না, আর যেটুকু দেওয়া হয়, সেটাও অস্বাস্থ্যকর, তা ভীতু স্বরে জানিয়েছিল সে।

ফলাফল কিছুই হয়নি। ওই দুই ইন্সপেক্টরকে সেদিন রাতে ব্যারি সাহেব রস আইল্যান্ডের আমোদ প্রমোদের ক্লাবে তুষ্ট করেছিলেন দামি মদিরা ও জেলখানার দুই বন্দিনীকে দিয়ে। তাঁরা পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে পরেরদিন জাহাজে উঠেছিলেন। কলকাতায় পৌঁছে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে হরিহরকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জেলখানায়। অপরাধ গুরুতর। সে নাকি খাবারে বিষ মেশাতে গিয়েছিল, দু’জন সাক্ষ্য দিয়েছে।

হরিহর জেল খেটেছিল দু’মাস। তারপর বাইরে বেরিয়েছিল। অবশ্য তার মধ্যে চন্দ্রপ্রভাকে বেশ কয়েকবার যেতে হয়েছিল ফটিকের কাছে। চন্দ্রপ্রভা যুবতী হলে রস আইল্যান্ডে গেলে হয়তো সুরাহা মিলত। কিন্তু যেখানে সামান্য ইশারায় সাজানো প্লেটের মতো পাওয়া যায় তন্বী উদ্ভিন্নযৌবনা, সেখানে পৃথুলা মধ্যবয়স্কার সঙ্গ সাহেব কর্তারা চাইবেনই বা কেন?

ফটিক এমন একটা লোক, যার কোনও বাছবিচার নেই। নারীদেহ পেলেই হল। দু’মাস পর বলেকয়ে ফটিকই হরিহরকে জেল থেকে বের করে এনেছিল।

কিন্তু সে-সবের পর পেরিয়ে গেছে বছরদুয়েক। এখনও ফটিকের কামনা চরিতার্থ করে যেতে হচ্ছে চন্দ্রপ্রভাকে। হরিহর সবই বোঝে। কিন্তু সে মুখ খোলে না। ফটিকের নিয়মিত সাহচর্যে চন্দ্রপ্রভাও অনেক পালটে গেছে।

চন্দ্রপ্রভা আরও কী সব ভাবছিল, ফটিকের কথায় ওর চিন্তার গতি ছিন্ন হল।

‘এসব আজগুবি কতা কোত্থেকে শুনিস তোরা?’ ফুঁসে উঠেছে ফটিক, ‘ফটিক সামন্ত অমন হাজার মেয়েছেলেকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচতে পারে।’

‘সে যাই বলো, ও মেয়ের তেজ আচে। অ্যাদ্দিন হয়ে গেল, এট্টু টসকাতে দেকলুম না। ডাঁট কী, যেন নবাবের বেটি। আমরা সব চাকরবাকর। ওর চোকে পড়ি না। দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না।’

‘তা তোরা কী করচিস? নোড়া দিয়ে বিষদাঁতগুলো ভেঙে দিতে পারচিস না?’

‘দেব দেব।’ চন্দ্রপ্রভা চুপ করে যায়। নীলামণির বিষদাঁত ভাঙার চেষ্টা কি ও করেনি? অনেকবার করেছে। মেয়েটা যেন কেমনধারা, কিছুতেই পোষ মানানো যাচ্ছে না। সেদিন সাবিত্রী একটা অদ্ভুত খবর এনেছিল। যদিও কেউ বিশ্বাস করেনি। নীলামণি আর ওর বুড়ো বর নাকি আলাদা শোয়। ও শোয় ভেতরের ঘরে, আর ওর বর দালানে।

তারপর গতকাল কাত্যায়নী আরও সাংঘাতিক একটা কথা বলল। নীলামণি মেয়েটা নাকি বাড়ি থাকলেই দুপুরবেলা মোল্লাপাড়ার বাচ্চাগুলোকে খাওয়ায়। এই গাঁয়ের মুসলমানদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী। প্রতি মাসেই তাদের কেউ না কেউ মাছ ধরতে গিয়ে সমুদ্রে নিখোঁজ হয়। তাদের বাচ্চাগুলো পথে পথে ঘোরে। চন্দ্রপ্রভারা সবাই দেখে। কখনও দু’-এক পয়সা ছুঁড়েও দেয়।

কিন্তু নিজের বাড়ির দালানে বসে খাওয়ানো?

মাগো! মেয়েটার কি জাত যাওয়ার ভয়ও নেই?

ফটিক বলল, ‘কবে আর দিবি? ওদিকে হ্যারি সাহেব আমার মাতা খেয়ে নিল!’

‘কেন?’

‘কেন আবার! বে’র দিন দেখেচে তো মেয়েটাকে। ব্যস। এবার চাই। তাও তো জানে না, রস আইল্যান্ডেই কাজে লেগেছে।’ ফটিক হাই তোলে, ‘তিনরাত্তির হলেই চলবে। ভাল পয়সা পাবি।’

‘মনে হয় না যেতে রাজি হবে।’

ফটিক এগিয়ে এল। চন্দ্রপ্রভার বাহুমূলে একটা অশ্লীল চুমু খেয়ে বলল, ‘হরিণ কখনও বাঘের কাছে যেতে রাজি হয়? রাজি অরাজির কিছু না। গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

‘কী গোলকধাঁধায় ঘোরাব শুনি? মেয়েটা অনেক ঘোড়েল।’ বলতে বলতে চন্দ্রপ্রভা থেমে যায়।

একমাত্র যমুনার সঙ্গেই নীলামণি মেশে। যমুনার কোলের মেয়েটার ওপর খুব দরদ।

২১

কয়েকদিনের মধ্যেই সেলুলার জেলের প্রায় সব ওয়ার্ডার জেনে গেল নন্দগোপাল আর উল্লাসের বিদ্রোহের কথা।

নন্দগোপালের আদবকায়দাই অন্যরকম। যেদিন তাকে প্রথম জেলের ঘানিতে ডিউটি দেওয়া হল, সে মিষ্টি হেসে বলল, ‘এত খাটতে পারব না!’

খাটতে পারব না? এসব আবার কী কথা? ওয়ার্ডাররা দৃকপাত না করে চলে গেল। নন্দগোপাল খুব ধীরে ধীরে ঘানি চালাতে লাগল। একটু করে চালায়, আবার অনেকক্ষণ জিরোয়। সকাল দশটার ঘণ্টা যখন ঢং ঢং করে বাজল, ততক্ষণে কিছুই প্রায় তেল বের হল না। দশটা থেকে বারোটা আহার আর বিশ্রাম। কিন্তু বিশ্রাম করলে কাজের কোটা পূর্ণ হবে কী করে? কয়েদিরা পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই কোনওমতে স্নান সেরে নাকেমুখে দুটো ভাত গুঁজে আবার কাজে চলে আসে।

কিন্তু নন্দগোপাল ধীরেসুস্থে স্নান করল। তারপর খেতে বসল। একেকটা গ্রাস মুখে পোরে, অনেকক্ষণ ধরে চিবোয়। ওয়ার্ডার আর পেটি অফিসারদের তো চক্ষুস্থির! তারা এসে চোটপাট করতে শুরু করল। বাপ-মা তুলে অশ্রাব্য গালাগাল।

‘উঠো! উঠো!’

কে শোনে কার কথা! নন্দগোপাল হাসি হাসি মুখে চিবিয়ে যেতে লাগল।

ওয়ার্ডার আর পেটি অফিসাররা কী করবে বুঝতে পারল না। এমন কয়েদি আজ অবধি সেলুলার জেলে আসেনি। তর্ক করে না, পায়ে ধরে না, কান্নাকাটিও করে না। খালি মিটিমিটি হাসে। কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করে তারা খোদ ব্যারি সাহেবকে এত্তেলা পাঠাল।

সবাই ভয়ে জড়সড়। দিনের মাঝখানে জেলার ব্যারি সাহেবের আগমন মানে প্রচণ্ড শারীরিক অত্যাচার। বাবুরাম হোতিলাল আর লাধারাম তিরস্কার করল, ‘তোর সবেতেই বাড়াবাড়ি! এবার খা চাবুকের বাড়ি!’

ব্যারি সাহেব এলেন। লালচোখে জানতে চাইলেন, ‘কাম কৌন করেগা?’

‘তা আমি কী করে জানব সাহেব, আমি তো খাচ্ছি!’

‘এত ধীরে ধীরে খাচ্ছ কেন?’ ব্যারিসাহেবের রক্তচাপ ক্রমেই বাড়ছিল।

নন্দগোপাল আবার হাসল, ‘আমাদের আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কী বলে জানেন সাহেব? একেকটা গ্রাস বত্রিশবার করে চিবোতে হয়, তবেই ভাল হজম হয়।’

‘এই … এই … তুমি কিন্তু আইন ভাঙছ। নতুন এসেছ, তাই হয়তো জানো না এখানে rule violation-এর শাস্তি কী!’

‘আমি আইন ভাঙছি?’ নন্দগোপাল কৌতুকময় চোখদুটো কপালে তুলে ফেলল, দশটা থেকে বারোটা আহার আর বিশ্রামের আইন তো আপনাদেরই করা। এই সময়ের মধ্যেও কাজ করতে বলছেন, ‘তবে আইনটা কে ভাঙছে সাহেব?’

ব্যারি সাহেব কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর ঘাড়ে গর্দানে শরীরের ওপর বসানো মাথাটা রাগে দপদপ করছে। অদ্ভুত সংযমে তিনি সেই রাগকে সংবরণ করছেন। সামনেই বড়দিন আসছে। এই সময়টা তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করেন।

এই ব্যারির এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এবারের বড়দিন আসার আগেই তাঁর হাতে এই ছেলেটা না খুন হয়ে যায়! প্রথমদিকে কত ছেলেকে পান থেকে চুন খসলে পরপারের টিকিট ধরিয়েছেন। তারপর লাশ ডুবে গেছে সমুদ্রে। কাক-পক্ষীতেও টের পায়নি।

একেও কি তেমনই কিছু দাওয়াই দিতে হবে?

নিজেকে সংবরণ করলেন ব্যারি। ছেলেটা কোনও পাতি আসামি নয়, খবরের কাগজের সম্পাদক। এখান থেকে কোনওভাবে খবর পৌঁছলে দেশে আগুন জ্বলে যাবে।

দূর থেকে বাকি কয়েদিরা রগড় দেখছে। এই প্রথম ব্যারি সাহেব হাতে চাবুক নিয়েও নিশ্চল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। কলের পুতুলের মতো তাঁর প্রকাণ্ড ভুঁড়িটা উঠছে আর নামছে।

উল্লাসের দারুণ আনন্দ হচ্ছিল। বদমাশ ব্যারি নিজের আইনের প্যাঁচে নিজেই জড়িয়েছে। আনন্দে সে দূর থেকে শিস দিয়ে ফেলল।

‘অ্যাই! কৌন! শালা কুত্তেকা আউলদ!’

ব্যারি সাহেবের ওয়ার্ডার ছুটে যায় লাঠি হাতে। কিন্তু কে শিস দিয়েছে, কী করে বুঝবে? সবাই মুখ ফিরিয়ে মন দিয়েছে কাজে।

প্রায় মিনিটখানেক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর ব্যারি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘দিনের শেষে আমি আবার আসব। যদি কোটা না শেষ হয়, তখন মজা বুঝবে!’

দূর থেকে ব্যারি সাহেবকে চলে যেতে দেখল উল্লাস। রাগের আড়ালে ব্যারির মুখে যে এই প্রথম দুশ্চিন্তার এক করাল ছায়া পড়েছে, তা ওর চোখ এড়াল না।

উল্লাসের হঠাৎ মনে পড়ে গেল বছরকয়েক আগের এক বিকেলের কথা। ও আর লীলা ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। লীলা বলছিল, এক ভারতীয় উকিল নাকি দক্ষিণ আফ্রিকায় অদ্ভুতভাবে আন্দোলন করা শুরু করেছেন। সেই আন্দোলনে কোনও বন্দুক নেই, বোমা নেই, চিৎকার নেই।

‘ধুর! সে আবার আন্দোলন হল নাকি?’ উল্লাস প্রথমে উড়িয়ে দিয়েছিল, জোসেফ ম্যাজিনির Faith and Future পড়েছ? ম্যাজিনি সেখানে লিখেছেন, Terrorism is the last weapon of disarmed patriotism . যতই মিটিং মিছিল করো, ডেপুটেশন জমা দাও, ওইসব আন্দোলনে কোনও লাভ নেই। একদিন না একদিন হাতে বন্দুক তুলে নিতেই হবে।’

লীলা বলেছিল, ‘মিটিং ডেপুটেশন নয়। অন্যরকম আন্দোলন। তার নাম Passive Resistance . শান্তভাবে আইন অমান্য করা। কাজ বন্ধ করে দেওয়া। ভদ্রলোক দক্ষিণ আফ্রিকায় শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। খুব শিগগির নাকি দেশে ফিরে আসবেন।’

‘বাঙালি?’

‘গুজরাটি। নাম মোহনদাস গান্ধী।’ বিকেলের বাতাসে চুল ঠিক করতে করতে ওর দিকে তাকিয়েছিল লীলা, ‘আচ্ছা, তোমরাও তো এমন কিছু ভাবতে পারো! দিনরাত খালি বোমা আর বন্দুক। আমার ভয় করে।’

আজ এতদিন পর লীলার কথা মনে পড়তে কেমন অস্থির হয়ে উঠল উল্লাস। আজকাল শরীর কেমন যেন আনচান করে ওর। প্রচণ্ড পরিশ্রমে আর পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে দিনদিন ওর শরীরটা ভেঙে পড়ছে। তবু অরবিন্দদাদার শেখানো প্রাণায়াম করতে ভোলে না ও। নাড়িশোধন। ভ্রামরী। কুম্ভক। যখন বাহ্য কুম্ভক করে, একেকদিন যেন মনে হয়, ও শূন্যে উঠে যাচ্ছে। লোহার গরাদগুলো মুছে যাচ্ছে একে একে। হঠাৎ করেই ভেসে আসে সেই ছেলেটার মুখ।

ক্ষুদিরাম।

বারীনদাদা আদেশ দিয়েছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের মুন্ডু চাই। বন্দেমাতরম বলার অপরাধে বাচ্চা ছেলেকে চাবুক মারার শাস্তি দিচ্ছে, স্বদেশি কাগজের সম্পাদকদের ধরপাকড় করছে, কিংসফোর্ডকে মারতেই হবে।

কিন্তু কীভাবে মারা হবে? কিংসফোর্ড থাকে গার্ডেনরিচে। দারুণ একখানা বোমা বানিয়ে ফেললেন হেমদাদা। একটা প্রকাণ্ড মোটা হাজার পাতার আইনের বই। হারবার্ট ব্রুমের লেখা। সেই বইয়ের মধ্যে চৌকো করে কেটে ঢোকানো হল টিনের কৌটো। তাতে ভরে দেওয়া হল এক পাউন্ড পিকরিক অ্যাসিড। স্প্রিং দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা হল যে, বই খুললেই বোমা ফাটবে।

ডাকপিয়ন সেজে পরেশ বইটা দিয়ে এল কিংসফোর্ডের বাড়িতে।

কিন্তু কিছুই খবর এল না। বইটা বোধ হয় খোলাই হয়নি। মাঝখান থেকে কিংসফোর্ড বদলি হয়ে গেল মজঃফরপুরের জেলা জজ হয়ে। এবার তিনখানা বোমা বানাল হেমদাদা। একখানা পরীক্ষা করে দারুণ ফল পাওয়া গেল। কিন্তু কে যাবে কিংসফোর্ডকে মারতে?

প্রফুল্ল চাকীকে পাওয়া গেল। ঠিক করা হল, অন্য দল থেকে এমন কাউকে নেওয়া হবে, যাতে ধরা পড়লে কেউ কারও খবর না দিতে পারে। রোগাপাতলা চেহারার ক্ষুদিরামকে দেখে সবাই অবাক। হেমচন্দ্রর কেমন চেনাচেনা লেগেছিল, ‘এই ছেলেটা বছরচারেক আগে আমায় একবার মেদিনীপুরের রাস্তায় ধরেছিল। পিস্তল চাইছিল। সে কী ঝুলোঝুলি!’

উল্লাস বলেছিল, ‘চারবছর আগে তো এ নেহাতই শিশু! পিস্তল নিয়ে কী করবে?’

‘ঠিক এই কথাটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছিল, সাহেব মারবে। সাহেবরা নাকি দেশের খুব ক্ষতি করছে। ওদের তাড়াতে হবেই।’ হেমচন্দ্র বিরক্তমুখে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা অনাথ। আবেগে ভেসে রয়েছে। ওকে কি না পাঠালেই নয়?’

কেউ পাঠাচ্ছে সে তো পরের কথা। ক্ষুদিরাম নিজেই তো টগবগ করে ফুটছে। মজঃফরপুরের ট্রেনে ওঠার আগে বায়না ধরল, ‘আমায় তোমরা একবার এই কলকাতা শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবে?’

সেদিন উল্লাস আর সত্যানন্দ ওকে নিয়ে সারাদিন কলকাতা ঘুরেছিল। তারপর টিনের সুটকেসে বোমা ভরে উঠে পড়ল ট্রেনে। প্রফুল্লর নাম ক্ষুদিরামকে বলা হয়েছিল দীনেশ। দেওয়া হয়েছিল একটা রিভলভার। তারপরেও উল্লাসের কাছে চুপিচুপি আরেকখানা রিভলভার চেয়েছিল ক্ষুদিরাম।

‘আমার দু’হাতে রিভলভার চালাতে খুব ভাল লাগে। দাও না উল্লাসদাদা। আমার বাঁ হাতেও টিপ ভাল, দেখবে?’

এইসব মনে পড়লেই উল্লাসের চোখদুটো জ্বালা করে। যাওয়ার দিন স্কট লেনে অরবিন্দবাবুর কাছে ও-ই তো নিয়ে গিয়েছিল ক্ষুদিরামকে। অরবিন্দ আশীর্বাদ করেছিলেন। কিন্তু কী হল?

যত অতীত রোমন্থনে ডুবতে থাকে, তত যেন নিজের শরীরটাকে ভরশূন্য মনে হয় উল্লাসের। যোগের কিছু বিশেষ ক্রিয়ায় শরীরের ভর নাকি একেবারে কমে যায়। ওরও কি তেমনই কিছু হচ্ছে? ওর দেহ কি এবার শূন্যে ভেসে উঠবে?

উল্লাসের চোখের সামনে রামধনু খেলা করতে থাকে। লাল নীল সবুজ হলুদ। বেনিয়াসহকলার নানা তরঙ্গ এসে ধাঁধিয়ে দেয় ওর অন্তরকে। ওর চোখদুটো আশায় জ্বলে ওঠে।

আর তো মাত্র কয়েকদিন। তারপর একদিন পরপর বিস্ফোরণ ঘটবে এই সেলুলার জেলে। ওরা সবাই পালিয়ে যাবে জাহাজে চেপে। সোজা চলে যাবে কলকাতা। লীলার কাছে।

লীলা কেমন আছে? এই চিন্তা মনে আসামাত্র উল্লাসের শ্বাসপ্রশ্বাস আরও ঘন হয়ে উঠতে থাকে। মনে হয়, বহুদূর থেকে যেন ওর কানে ভেসে আসছে লীলার কণ্ঠস্বর। লীলা কি গান গাইছে?

‘যদি তোর ডাক শুনে না আসে তবে একলা চলো রে!’

কণ্ঠস্বরটা কি জোরে হচ্ছে ক্রমশ? লীলা কি আন্দামানে এসেছে?

দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে উল্লাস চেঁচিয়ে উঠল, ‘লীলা-আ-আ-আ!’  

২২

কলকাতা জুড়ে আজ উৎসবের ঢেউ। ঘরের ক্লাব মোহনবাগান আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে উঠেছে। বিপক্ষে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট।

শিল্ডের উনিশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একটা ভারতীয় দল উঠেছে ফাইনালে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ চলে এসেছে খেলা দেখতে। মাঠে উপচে পড়ছে ভিড়। কোনও জায়গাই খালি নেই। টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছে দেদার। একটাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে পনেরো টাকায়। এছাড়া মাঠের চারপাশের গাছের ডাল, পাঁচিল সব ভরে গেছে। ছোট ছোট ছেলেগুলো গাছের ডালে উঠে কাপড় দিয়ে নিজেকে বেঁধে নিচ্ছে শক্ত করে।

চারদিকে উত্তেজনা।

লীলা পোস্ট অফিস থেকে ফিরছিল। ফি সপ্তাহে ওকে পোস্ট অফিসে আসতে হয়। সুন্দরীকাকা আর হেমাঙ্গিনী খুড়িমার বড় ছেলে প্রেমানন্দ আমেরিকায় ফার্মাসি নিয়ে পড়তে গেছেন। তাঁর কোনও চিঠি এল কি না লীলা খোঁজ নিয়ে যায়। তাছাড়া সুন্দরীকাকার নামে বহু চিঠিপত্র তো আসেই, হেমাঙ্গিনী নিজেও একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। ‘সঙ্গীতসুধা’। সেই বইয়ের পাঠকদেরও চিঠি আসে মাঝেমধ্যে।

বেশ কিছু চিঠি নিয়ে লীলা বেরিয়ে এল। না। নীলার কোনও চিঠি আসেনি।

লীলার মনে উদ্বেগের মেঘ ক্রমেই জমাট বাঁধছিল। নীলার কি কোনও বিপদ হল? শেষ দিকের কিছু চিঠিতে ইশারায় জানিয়েছিল এক বিরাট পরিকল্পনার কথা। বেশ কিছু মুক্ত কয়েদি বোমা তৈরি করছে কোন এক গোপন দ্বীপে। একদিন সব বোমা একসঙ্গে ফেলা হবে সেলুলার জেলে। তারপর? তারপর সরকারি জাহাজে করে পালানো।

লীলা চমকে উঠেছে পড়ে। এ তো ভয়ংকর ব্যাপার। এই পরিকল্পনা কি বারীন উল্লাসদের?

নীলা নিজেই জানিয়েছে, না। আন্দামানে বহু মুক্ত কয়েদি আছে, যারা দেশকে স্বাধীন করতে চায়। বিপ্লবীদের গরাদের আড়াল থেকে বের করে আনতে চায়। এসব তাদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তবে জেলের রাজবন্দিরা বোমার আদবকায়দা শেখাচ্ছেন নাকি।

লীলা জিজ্ঞেস করেছে, ‘তুই ইন্দ্রর খোঁজ পেয়েছিস?’

তারপর থেকে আর কোনও চিঠি আসেনি।

মাঠে খেলা শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। লীলা আকাশে অনেক ঘুড়ি দেখতে পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারল, তাতে খেলার খবরাখবর লিখে ওড়ানো হচ্ছে। যাতে সবাই জানতে পারে।

ইস্ট ইয়র্কশায়ার মারাত্মক ভাল দল। তাদের সঙ্গে খেলে জেতা কি সহজ ব্যাপার নাকি?

লীলার মনে পড়ে গেল, বাবা মোহনবাগান দলের কথা বলছিলেন। অরবিন্দ ঘোষের ভাই অভিলাষও খেলছে। অভিলাষকে লীলা চেনে অনেক ছোট থেকে। সে পড়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে। কিন্তু তাকে দেখবে কী করে? মাঠের ত্রিসীমানায় যাওয়ার উপায় নেই। অনেক দূর থেকেই সবাই চেঁচাচ্ছে। হইহই করছে।

মাঠের পাশের রাস্তা ভিড়ে ভিড়াক্কার। এক মুসলমান বৃদ্ধ বসে নামাজ পড়ছিলেন, লীলা জিজ্ঞেস করতে তিনি আলোকিত মুখে তাকালেন, ‘ইস্ট ইয়র্কশায়ার একটা গোল করেছিল, সেটা শিবদাস ভাদুড়ি শোধ দিয়েছে। খেলা এখন ড্র চলছে।’

‘আর কতক্ষণ বাকি শেষ হতে?’

‘মাত্র দু’মিনিট। সেইজন্যই তো আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছি।’ বৃদ্ধ ম্লান মুখে কথাটা বলেই আবার বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে লাগলেন।

লীলার ফুটবলে খুব বেশি উৎসাহ নেই। কিন্তু ওর মনে পড়ে গেল উল্লাসের কথা। সে নিজে যেমন ভাল খেলত, তেমনই ছিল ফুটবল নিয়ে আগ্রহ।

অনেক জেলখানাতেই কয়েদিদের নানারকম খেলায় উৎসাহ দেওয়া হয়। সেলুলার জেলে কি উল্লাস ফুটবল খেলতে পারে? অজান্তেই লীলার চোখদুটো ভিজে গেল।

পাশেই ঢাক বাজছে। কাঁসরঘণ্টা থেকে শাঁখ, কিছু বাঁকি নেই। লীলা মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। হাজার হাজার লোক উত্তেজনায় আবেগে ফুটছে। দেড়শো বছর ধরে যাদের পায়ের তলায় রয়েছে, খেলার মাঠে তাদের হারানো কি সহজ কথা? লোকে বলাবলি করছে, ‘যাই বলো, ভূতি সুকুল আর হাবুল সরকারকে আজ ছোঁয়া যাচ্ছে না।’

‘তা কেন? মনোমোহন মুখুজ্জেই বা কম কীসে? ফিরিঙ্গিদের আপিসে চাকরি করে ছোকরা, শুনচি নাকি অফিসে লুকিয়ে খেলতে এসেচে। ঝামা ঘষে দিল কেমন দেকলি তো! এদের খালি পায়ের দাপটে ফিরিঙ্গিদের বুট ভয়ে পালাচেচ।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘মেরে দে। ব্যাটাদের আচ্ছা করে শায়েস্তা কর!’

তৃতীয়জন ঘাড় নেড়ে কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় একজন চোঙা মুখে বলতে লাগল, ‘গো-ও-ল গো-ও-ল! মোহনবাগানের অভিলাষ ঘোষ গোল দিয়েছে! খেলা শেষ। মোহনবাগান ২-১ এ জিতেছে!’

সবাই হঠাৎ করে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। আবেগ ও উল্লাসের বিস্ফোরণ ঘটল যেন!

লোকজন জামা ছিঁড়ে পতাকার মতো ওড়াতে লাগল। জয়ধ্বনি ও চিৎকারে কান পাতা দায়।

মোহনবাগান জিতে গেছে? সাহেবদের হারিয়েছে? এও কি সম্ভব? কিছু মানুষ গড়াগড়ি দিচ্ছে। একদল গলাজড়াজড়ি করে গানই গাইতে আরম্ভ করে দিয়েছে।

‘জেগেছে আজ দেশের ছেলে পথে লোকের ভিড়,
অন্তঃপুরে ফুটল হাসি বঙ্গরূপসীর।
গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,
আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।
আজকের এই বিজয়বাণী ভুলবে নাকো দেশ,
সাবাশ সাবাশ মোহনবাগান! খেলেছ ভাই বেশ!’*

[* কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এই জনপ্রিয় গানটি লিখেছিলেন মানসী পত্রিকায়। মানসী পত্রিকার ১৯১১ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায় গানটি প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের গতি অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় ‘Poetic License’ নিয়ে গানটি এখানে খেলার দিনই গীত রূপে উদ্ধৃত করা হল।]

লীলা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে ভেবেছিল। অভিলাষের মুখোমুখি হলে পিঠ চাপড়ে গাল টিপে দেবে। কিন্তু এই ভিড়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস হল না ওর। লোকজন আনন্দে পাগলের মতো করছে। গত কয়েকবছরের বঙ্গভঙ্গ, ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি, এতগুলো ছেলের কালাপানিতে নির্বাসন, সব কিছুর যেন কড়ায় গণ্ডায় হিসেব দেওয়া হয়েছে আজ।

শিবদাস, মনোমোহন, অভিলাষরা যেন বিদেশি সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছে, যদি খেলার মাঠে তোমাদের হারাতে পারি, তবে স্বাধীনতার যুদ্ধেও হারাতে পারব।

দরকার শুধু জোটবদ্ধ থাকা।

দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে লীলার মনে হল, বারীন, উপেন, হেমচন্দ্র, উল্লাসকরের সঙ্গে এই ফুটবল পাগল ছেলেগুলোর খুব একটা পার্থক্য নেই! দু’তরফই নিজেদের জান-প্রাণ লাগিয়ে দিয়েছে দেশের জন্য।

এইসময় উল্লাস থাকলে কী করত? উল্লাস যা আবেগপ্রবণ ছেলে, হয়তো মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের জড়িয়ে জাপটে একাকার করে দিত।

লীলার চোখদুটো ভিজে গেল।

কত কী একা একা দেখে ফেলছে লীলা। অথচ কথা ছিল একসঙ্গে দেখার। হাতে হাত রেখে অনুভব করার!

নীলা চিঠিতে লিখেছিল। সব রাজবন্দি নাকি একসঙ্গে পালিয়ে আসবে।

কবে আসবে? উল্লাসরা সকলে বিপ্লবের মন্ত্রদীক্ষা নিয়েছিল। সেইসময় শপথ করেছিল, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ বিবাহ করবে না।

লীলা নিজের মনেই ঢোক গিলল। এখন তার বয়স তেইশ বছর। এই বয়সে বাঙালি ঘরের মেয়েদের একাধিক সন্তান হয়ে যায়। তারা হয়ে ওঠে পাকা গৃহিণী। লীলার প্রত্যেক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে।

তবে লীলা ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যা। এখানে সতেরো-আঠেরোয় আজকাল বিয়ে হচ্ছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলেও লীলার বিবাহের বয়স আর দু’-এক বছর পরেই অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।

হোক। ভারতবর্ষ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিন যদি ওর ষাট বছরও পেরিয়ে যায়, তবুও ও অপেক্ষা করবে উল্লাসদা’র জন্য।

কী মনে হল, লীলা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হাত মুঠো করে ওপরে তুলল।

‘বন্দেমাতরম!’

জনতা যেন অপেক্ষা করছিল এমনই এক রক্তগরম করা স্লোগানের। সবাই চিৎকার করে উঠল, ‘বন্দে-এ-এ মাতরম!’

২৩

শেখর শেষবেলায় জাহাজঘাটায় রহমানের দোকানে বসেছিল। পশ্চিম আকাশে সমুদ্রশেষের দিগন্তে গাঢ় কমলা রঙের সূর্যটা ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছিল। গোধূলিলগ্নের নরম আলো এসে পড়ছিল বন্দরের সমস্ত ব্যস্ত কিংবা অলস মানুষের মুখে।

শেখর একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। নীলা ওকে জানিয়েছে, ওর সাহসের উৎস লুকিয়ে আছে জেলের ভেতরে। ওর ইন্দ্রদাদা রয়েছে সেখানে।

প্রথম জানতে পেরে বিস্মিত হয়েছিল শেখর, ‘তুই … তুই ইন্দ্রকে ভালবাসতিস?’

ভালবাসার কথা শুনলে আগে কিশোরী নীলার মুখে সিঁদুরের রং লাগত। এখন লাগে না। পৃথিবীর কর্কশতম রূপ ওকে ঘৃণা আর ভালবাসা দুটো শব্দকেই স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখিয়েছে। ও বলল, ‘হ্যাঁ। বাসতাম।’

‘তো গাঁয়ে থাকতে বলিসনি কেন?’

‘বললে কে শুনত? ওকানে অন্য নিক্তিতে বিয়ের জল মাপা হয়।’ নীলা কথা ঘোরাতে চেয়েছিল, ‘ওসব কথা থাক। তুমি কি ইন্দ্রদাদাকে একবারও দেকতে পেয়েচ?’

‘না। সে এসেছে নাকি?’

‘নিশ্চয়ই এসেচে।’

.

 রস আইল্যান্ড থেকে স্টিমার ছেড়ে দিয়েছে। নীলা এখনই নামবে জাহাজঘাটায়। শেখর অলসভাবে উঠে দাঁড়াল। ইন্দ্রকে সে’ও বহুবছর দেখেনি। রোগাসোগা চেহারার ছেলেটার মধ্যে নীলা কী দেখেছিল যে এতদিন পরেও তাকেই মন দিয়ে রয়েছে?

শেখরের গলার কাছটা কী যেন দলা পাকায়।

রহমান চাচা প্রবাল গোছাচ্ছে। আন্দামানের সমুদ্রে যে কতধরনের প্রবাল পাওয়া যায়, তার কোনও হিসেব নেই। আকার, রং আর রোশনাইয়ের বৈচিত্র্য দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার, রহমান চাচা মসৃণ হোক বা রুক্ষ, যে কোনও প্রবালের ওপর কাঁপা কাঁপা হাত বুলিয়ে তার নাম, প্রজাতি এমনকি রংও নির্ভুল বলে দিতে পারে।

শেখর অনেকবার জানতে চেয়েছে।

‘কী করে পারো চাচা। তুমি তো চোখে কিছুই দ্যাখো না বলো।’

‘সহি বাত হি তো হ্যায়। আঁখোসে দিখ নেহি পাতে হ্যায়।’

‘তবে?’

রহমান চাচা হাসে, ‘নিজের অউলাদকে দেখতে না পেলেও মেহসুঁস কি করতে পারব না? এরা কি বে-জান? সব জিন্দা হ্যায়। শ্বাস লেতে হ্যায়। এহসাস দিলাতে হ্যায়। রাতকে খামোশিমে যখন দুকানের দরওয়াজা ফেলি, ইয়ে লোগ নিজের পেহচান দিয়ে যায়। হামার সাথে কখনও কাঁদে, কভি মুসকুরায়ে। আপনা কাহানি বলতে থাকে।’

‘কী কাহানি?’

‘সে অনেককিছু। উয়ো সব ছোড়ো। কাম কিতনা দূর?’

‘চলছে।’

‘হুম থেমে যেন না থাকে। ইধারমে হামিও জাহাজের ক’জন খালাসিকে পটিয়ে নিয়েছি।’

শেখর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আচ্ছা চাচা, তোমরা যে সতেরোজন একসঙ্গে এসেছিলে, তাদের মধ্যে কি তুমি একাই জিন্দা আছ?’

‘আল্লাহ! তা কেন? আরও ইধার উধার আছে জরুর।’

‘কই, তোমার বন্ধু কাউকে তো দেখতে পাই না!’

‘যাকে দিখা নেহি যাতা, সেও ভি থাকে শেখরভাই!’ রহমান চাচা বলতে বলতে হাসে, ‘বিটিয়া এলি নাকি?’

শেখর পেছন দিক ফিরে বসেছিল। মুখ ঘুরিয়ে অবাক হল। নীলা এসে দাঁড়িয়েছে। ঘর্মাক্ত মুখ। লম্বা বেণি আলুথালু হয়ে লেপ্টে রয়েছে গায়ে।

রহমান চাচা চোখে দেখতে পায় না, তবু কারুর অস্তিত্ব কী করে টের পায়?

নীলা হাসল, ‘আমায় ছাড়া কী গল্প হচ্চিল গো চাচা?’

‘এই বুঢঢার আর কী গল্প আছে পুরনো কাহিনি ছাড়া?’ রহমানের মুখে হাসি খেলে গেল, ‘তবে আজ নতুন খবর আছে। আমার এক জিগরি দোস্ত খত লিখেছে দেশ থেকে।’

‘চিঠি? কে তোমার দোস্ত? সে কি এখানেই থাকত?’

‘হ্যাঁ।’ রহমান আলখাল্লার জেব থেকে একটা চিঠি বের করে এগিয়ে দিল।

শেখর হাতে নিল। বানান করে পড়ল, ‘মৌলানা মহম্মদ জাফর থানেশ্বরী।’

‘থানেশ্বরী ছিল আমাদের ওয়াহাবি আন্দোলনের খুব বড় নেতা। সারা উত্তর ভারত চষতে পারত। কিন্তু আমাদেরই একজন গদ্দারি করল, টাকার লোভে। থানেশ্বরী ধরা পড়ে গেল। পড়ালিখা রইস আদমি, আন্দামানে এসে চিফ কমিশনার সাহেবের মীর মুন্সি হয়েছিল। পেহলে এক কাশ্মিরী বন্দিনীকে শাদী করল।’

‘তারপর?’

‘লেকিন উয়োহ বেচারি বাচ্চা পয়দা করতে হুয়ে মারা গেল। ফির শাদী কিয়া এক ব্রাহ্মণের বিটিয়াকে, সে বিটিয়াও কয়েদি ছিল এখানে। ছাড়া পেয়ে সে নিজের মুলুকে দেশে ফিরে গেছে, বিশ পঁচিশ সাল হল। শুনেছি সেখানে গিয়ে কিতাবও লিখেছে।’ রহমান বিড়বিড় করে, ‘আমায় মাঝে মাঝে চিঠি লেখে।’

‘তোমার দোস্তরা দেশে ফিরে গেছে। ছাড়া পেয়ে তুমি কেন যাওনি কেন চাচা?’

রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, ‘কার কাছে যাব? দেশ মানে কী রে বেটি? মাটি? নিজের লোক ছাড়া কয়েক টুকরো মাটি কি দেশ হয়?’

‘তা তোমার এখানেও কি নিজের লোক আছে? শাদীই তো করোনি!’ নীলা তর্কের সুরে বলে।

রহমান চাচা অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে বসে আছে। তার পিঠে বহু পুরনো কিছু কাটা দাগ।

নীলা বলে, ‘তোমার পিঠে ওগুলো কীসের দাগ?’

শেখর ইঙ্গিতে নীলাকে থামাতে চায়। মেয়েটা মাঝেমাঝে ছেলেমানুষের মতো প্রগলভ হয়ে ওঠে। তখন ওকে থামানো দায় হয়। রহমান চাচার ওই ক্ষতগুলোর পেছনে কোনও করুণ ইতিহাস আছে। শেখর তা ঘাঁটাতে চায় না।

কিন্তু আজ রহমান চাচা হাসে, ‘একবার ভাগে থে হিঁয়াসে। গাছের ভেলায় চেপে। তখন জারোয়ারা এইগুলো তোউফা দিয়েছিল। হা হা!’

শেখর এবার কৌতূহলী হয়ে ওঠে, ‘আচ্ছা তোমাদের দলেই কি সেই দুধনাথ তিওয়ারি ছিল?’

মুহূর্তে রহমানচাচার মুখ থেকে হাসি উবে যায়। মুখচোখ শক্ত করে বলে, ‘উস বেইমানকা নাম মাত লেনা।’

নীলা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

শেখর বলে, ‘জেলে থাকতে শুনেছিলাম। দুধনাথ তিওয়ারিও প্রথম দিককার একজন কয়েদি ছিল। রহমান চাচাদের সঙ্গেই গাছের ভেলায় চড়ে পালিয়েছিল।’

‘তারপর?’

‘জারোয়াদের তিরে আহত হলেও পরে জারোয়ারাই নাকি তাকে নৌকোয় তোলে। নিজেদের দ্বীপে নিয়ে যায়। শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলে। বাকিটা চাচা-ই ভাল বলতে পারবে।’

রহমান চাচা বলে, ‘দুধনাথের তবিয়ত ঠিক হওয়ার পর, জারোয়াদের সঙ্গেই থাকতে শুরু করে। উয়োহি লোগদের মতো নাঙ্গাও থাকতে শুরু করেছিল। শুরুয়াত মে জারোয়ারা ওকে সন্দেহ করত। লেকিন উয়োহ বান্দা ওদের সঙ্গে এমন মিশে গেছিল, যে কুছু মাহিনা বাদ জারোয়ারা ওকে আপন করে নেয়।’

‘হুঁ, তারপর জারোয়াদের সর্দার তার মেয়ের সঙ্গে দুধনাথের বিয়েও দেয়।’

রহমান চাচা বাধা দিল, ‘এক নেহি, দো। দো লড়কিকো শাদী কিয়া উসনে।’

‘হ্যাঁ। দুটো জারোয়া মেয়েকে একইসঙ্গে বিয়ে করেছিল দুধনাথ। কিন্তু দেড়বছর পরে জারোয়ারা যখন ব্রিটিশদের আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল, ওই দুধনাথই পালিয়ে এসে ব্রিটিশদের সেই খবর দিয়ে দিল।’

নীলা বলল, ‘জারোয়ারা আক্রমণের ছক কষছিল কেন?’

‘বাহ, ইংরেজরা আদিবাসীদের মেয়েদের ইজ্জত লুটত যে। সুযোগ পেলেই। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। আগেও অনেকবার লড়াই হয়েছে। কিন্তু সেবারে জারোয়ারা খুব ভালভাবে প্যাঁচে ফেলতে পারত। কিন্তু দুধনাথের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অ্যাবারডিনের সেই যুদ্ধে জারোয়ারা বেশি সুবিধা করতে পারেনি। তবে দুধনাথকে ব্রিটিশ সরকার ইনাম দিয়েছিল মুক্তি দিয়ে। দুধনাথ কলকাতা চলে গিয়েছিল।’

‘একবার ফিরসে উয়োহ আয়া থা।’ রহমান ফুঁসে উঠল, ‘তখন জারোয়া লোগ ওকে থুকে ছিল। পোয়াতি বিবিকো ছোড় কর ভাগা থা উয়োহ ইবলিশ।’

নীলা চুপ করে শুনছিল। চাচা থামতে ও ম্লান হাসল, ‘যুদ্ধ হোক বা ক্ষমতার লড়াই, সবেতে সহজ শিকার হল মেয়েরা। তাই না চাচা?’

‘এ-কথা কেন বলছিস?’ শেখর বলে।

‘নয় কেন? তুমি চিন্তা করে দ্যাখো, ইতিহাসে যত যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বিপ্লব হয়েছে, সবচেয়ে বেশি তার মাশুল দিতে হয়েছে মেয়েদের। ইজ্জত দিয়ে, প্রিয়জনদের দিয়ে। আর সেদিক থেকে দেখলে ইংরেজ হোক বা বামুন, কায়েত হোক বা আরবি, সব সমান। সবাই সমান।’

শেখর আর রহমান চাচা দু’জনেই নির্বাকচোখে তাকিয়ে রইল কথাটা শুনে।

নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সমুদ্রের সামনে দিয়ে চলমান নীলাকে মনে হচ্ছিল কোনও অপরূপ গুহামানবী। ধূমকেতুর মতো সে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে।

শেখর চোখ নামিয়ে নিল।

টক টক টকাটক টক টক …

২৪

কুঠুরির দেওয়ালে শব্দ হচ্ছিল খুব ধীরে ধীরে। পাশের সেলের মকবুল সংকেত পাঠাচ্ছে। কিন্তু যাকে পাঠাচ্ছে সে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। ক্লান্তিতে।

রাত প্রায় শেষের দিকে। চাঁদ মুখ লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে। সারারাত ধরে ঢেউয়ের নীরব আস্ফালন দেখিয়ে সমুদ্র নিজেও বুঝি কিছুটা ক্লান্ত। পরিষ্কার হতে শুরু করেছে পূর্ব দিকের আকাশ। শেষরাত্রির একটা গা শিরশির করা বাতাস বয়ে আসছে সমুদ্র থেকে। দূরের লাইটহাউসের ওপর জ্বলা মৃদু আলো যেন থিতিয়ে যাচ্ছে রাতশেষের মহাসাগরে।

ইন্দুভূষণ ভোররাত্রির নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল। সমুদ্রঘেঁষে উঠেছে সেলুলার জেলের প্রাচীর। ঢেউয়ের শব্দ তরঙ্গ কুঠুরির মধ্যে ভেসে এলেও তার সুষুপ্তি দশায় কোনও অনুরণন জাগাতে পারছিল না মস্তিষ্কে। ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সুষুপ্তি থেকে সুপ্তির দেশে উন্নীত হচ্ছিল। আসছিল স্বপ্ন দেখার পর্যায়ে।

আর তখনই এই প্রায়ান্ধকার অপরিষ্কার কুঠুরির মধ্যেও ইন্দু সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা আবার দেখছিল।

এক তরুণী। কোন জাদুবলে তার মুখ ঢাকা থাকে অবগুণ্ঠনে। সে যেন বহুদূর থেকে ওকে ডাকছে।

ইন্দুভূষণ প্রতিবারই প্রাণপণে চেষ্টা করে তরুণীটির সম্বোধনকে বুঝতে। কিন্তু কোনওবারই সফল হয় না। শুধু সেই সম্বোধনের আদ্য দুই অক্ষর যে ‘ইন্দু’ তা সে বুঝতে পারে। ইন্দুভূষণ অস্থির হয়ে ওঠে। অধীর স্বরে বলতে চায়, ‘কে তুমি?’

কিন্তু চাওয়াটাই সার। ওর কণ্ঠনালি দিয়ে কোনও শব্দই বেরোয় না।

মেয়েটা সমুদ্রের ওপর দিয়ে ছুটে আসে। প্রচণ্ড ঢেউ তাকে গ্রাস করতে চায়। কিন্তু পারে না। মেয়েটা প্রাচীর, প্রতিরক্ষা সব পার করে এগিয়ে আসে ৩১৫৫৫ নম্বর সেলের দিকে। কোন জাদুবলে যেন খুলে ফেলে গরাদ। দেবীর মতো এসে হাত বাড়িয়ে দেয় বন্দি ইন্দুভূষণের দিকে। বের করে নিয়ে যেতে চায় এই নরক থেকে।

শীর্ণ ক্লিষ্ট রিক্ত ইন্দুভূষণ প্রাণপণে ধরতে চায় সেই হাত।

কিন্তু তার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। ওয়ার্ডারদের চিৎকারে।

‘সুবা হো গয়া। উঠো!’

আজকেও ইন্দুভূষণ ধড়মড় করে উঠে বসল। কিন্তু ওয়ার্ডারদের ধমক ছাপিয়ে ওর কানে ভেসে এল কোলাহল। কোথায় যেন খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। কিছুক্ষণ মনোযোগ দেওয়ামাত্রই ইন্দুভূষণ বুঝতে পারল। সর্বনাশ। ব্যারি সাহেব এসেছেন যে! এই সময়ে তো আসার কথা নয়। হঠাৎ কী এমন হল?

পাঞ্জাব থেকে আসা নন্দগোপাল চোপড়া এর মধ্যেই জেলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। সে নিজের মর্জিমতো কাজ করে। দিনের শেষে নির্দিষ্ট কোটার অর্ধেকও পূরণ হয় না। পেটি অফিসাররা প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করত, ‘বাকি কাজটা কে করবে?’

নন্দগোপাল ঠোঁট উল্টে বলত, ‘যার খুশি সে করুক। আমি তো আর কলুর বলদ নই! একে তো দিনে ছ’পয়সারও খোরাকি পাই না। তিরিশ পাউন্ড তেল পিষব কী করে?’

জমাদার, টিন্ডেল, পেটি অফিসাররা প্রথম প্রথম অনেক তর্জন গর্জন করেছে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট মারে সাহেবকে গিয়ে নালিশও ঠুকেছে। মারে সাহেব নন্দগোপালকে পায়ে ডান্ডাবেড়ি বেঁধে কুঠুরিতে বন্ধ করে দিয়েছেন। খাবারও অর্ধেক করে দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। নন্দগোপাল মন্ত্রসিদ্ধ মহাপুরুষের মতো নিশ্চল প্রতিক্রিয়াহীন। খেতে দিলে খায়। না খেতে দিলে চুপচাপ শুয়ে থাকে। নন্দগোপালের প্রতিবাদের এই অভিনব পন্থা অনেককে সাহস জুগিয়েছে। উল্লাসকর, হোতিলালরাও কাজ করতে অস্বীকার করেছে। শাস্তিও পেয়েছে নানারকম। কখনও অর্ধাহারে, কখনও প্রায় অনাহারে থাকা। কখনও দিনের পর দিন ডান্ডাবেড়ি, হাতকড়িতে থাকা।

কিছুতেই কিছু হয়নি। উলটে হোতিলাল সেলুলার জেলের এই ভয়ংকর পরিবেশ, অমানুষিক অত্যাচার নিয়ে তিন পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখে ফেলেছে। চিঠির তলায় নিজের সেল নম্বর দিয়ে সই করেছে। তারপর দিয়ে দিয়েছে ফণীভূষণকে। ফণীভূষণ সেই চিঠি নিয়ে গিয়ে দিয়েছে পুষ্পকে। পুষ্প ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছে কলকাতায়। ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে।

ইন্দুভূষণদের কারুরই জানা নেই, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় হোতিলালের সেই চিঠি পরপর তিন কিস্তিতে ছেপেছেন। সারা দেশে হইচই পড়ে গেছে। ছি ছি! ব্রিটিশরা নাকি ন্যায়পরায়ণ জাতি। তার এই নমুনা? রাজবন্দিদের এমন নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয়? তাও আবার অপর্যাপ্ত? এমন অমানুষিক পরিশ্রম? রাজবন্দিদের প্রায় সকলেরই চেহারা পরিণত হয়েছে কঙ্কালে। এমন অত্যাচার? আরও বড় ব্যাপার হল, নতুন কমিশনার সেই ভিত্তিতে ব্যারির কাছে শো কজ পাঠিয়েছেন।

ইন্দুভূষণ ঢোক গিলল। ওকে সেল থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছে। জোড়ায় জোড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বাইরের করিডরে। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বারীনদাদা। ইশ, কী চেহারা হয়েছে বারীনদাদার! একেই বারীনদা আর অবিনাশদা দুর্বল ছিল বলে ওদের জন্য প্রতিদিন বারো আউন্স করে দুধ বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু বারীনদা’র বরাদ্দের সেই দুধ প্রতিদিন যায় খোয়েদাদ খাঁ-র পেটে। এ এখানকার এক জঘন্য অলিখিত নিয়ম।

ইন্দুভূষণ আবার আড়চোখে তাকাল। লেংটির তলা দিয়ে বারীনদার কঙ্কালসার পা দুটো বেরিয়ে রয়েছে। কে বলবে, এই পা একসময় গোটা কলকাতা শহর চষেছে। উদ্বুদ্ধ করেছে কত তরুণকে!

চোখাচোখি হতে বারীনদা হাসল। হাসিখানা একই রয়ে গেছে। ইশারায় বলল, ‘বুলডগ ব্যারি আজ খুব খেপেছে!’

ব্যারি সাহেব একটা লাঠি নিয়ে ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে চলেছেন। পেছনে বশংবদ ভৃত্যের মতো চলেছে খোয়েদাদ খাঁ ও গোলাম রসুল। ব্যারি সাহেবের মুখটা রাগে টকটকে লাল হয়ে গেছে। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছেন, ‘হাম সবকো মিট্টিমে মিলে দেগা! এত সাহস?’

সবাই চুপ।

ব্যারি আবার চেঁচালেন, ‘কৌন হ্যায় হোতিলাল? কৌন?’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর হোতিলাল মাথা তুলল, ‘হাম হ্যায় হোতিলাল, হুজৌর!’

ব্যারি সাহেব কিছুক্ষণ জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন হোতিলালের দিকে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘শালা ঝুটা কাহিকা!’

প্রায় আধঘণ্টা চলল ব্যারি সাহেবের তর্জন গর্জন। সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করল খোয়েদাদ খাঁ আর গোলাম রসুল। কিন্তু বারীন হেমচন্দ্র উল্লাসের মতো সিনিয়র নেতারা খুব ভালভাবে বুঝতে পারছিল, এই হুঙ্কারের পেছনে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ম ভয়টাকে। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, ব্যারি একটু হলেও টাল খেয়েছে। নন্দগোপাল, উল্লাসদের প্রকাশ্য জেহাদ, হোতিলালের চিঠি পাঠানোয় এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, ওর এই স্বেচ্ছাচারী অত্যাচারের দিন ফুরিয়ে আসছে।

ব্যারি সাহেব চলে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতে কে যেন সুর করে গেয়ে উঠল।

‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!’

ব্যারি সাহেব চমকে তাকালেন। তিনি যেন স্বকর্ণকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই গানটা মাসখানেক আগে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে প্রথম গাওয়া হয়েছে। তারপর থেকে ধীরে কিন্তু দৃঢ়গতিতে এই গানটা ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি প্রদেশে, এমন সংবাদ তাঁর কাছে ছিল। কিন্তু আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ একটা সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী। সেখানে কী করে আগমন ঘটল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের? ডাকে আসা চিঠিগুলো কি ঠিকমতো পরীক্ষা করা হচ্ছে না? ব্যারি জ্বলন্তচোখে তাকালেন খোয়েদাদ খাঁ-র দিকে। কেমন যেন অশনিসংকেত পাচ্ছিলেন ব্যারি। তাঁর সামনে দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার স্পর্ধা এতদিন তো কারুর হয়নি!

ক্রোধের চূড়ান্তে পৌঁছেও তিনি নিজেকে সংবরণ করলেন। বন্দিদের কাছে নিজের বিচলিত দশা প্রকাশ করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

ব্যারি সাহেব চলে যেতে ইন্দুভূষণ বারীনের কানে ফিসফিস করল, ‘গানের গলাটা উল্লাসদার, তাই না?’

‘তা নয় তো আর কে।’

‘উল্লাসদাদাকে নাকি ইট তৈরির কাজে দিয়েছে?’

‘হুঁ। আজ সকালেই অর্ডার বেরিয়েছে। আমাকেও কাজ দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে। রাজমিস্ত্রির কাজ।’ বারীনদা নিস্পৃহভাবে বলল।

‘আমাকেও এমন কোনও কাজ দিতে বলো না গো বারীনদা! ব্যারি সাহেব আমায় প্রতিদিন জঙ্গলে পাঠাচ্ছেন।’

‘ভাল তো। এই চার দেওয়ালের বাইরে তো বেরোতে পারছিস!’

‘নাগো। গাছের ছাল ছাড়িয়ে আঠা বের করতে হয়। কী বিষ সেই আঠায়। আমার দুটো হাত দ্যাখো, ঘায়ে ভর্তি হয়ে গেছে।’ ইন্দুভূষণ কাতর স্বরে বলল, ‘সারারাত চুলকোয়। রস বেরোয়।’

‘তুই টিন্ডেলদের বল। হাসপাতালে নিয়ে যাবে।’ বারীনদা সতর্ক চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিল, ‘আর তো মাত্র কয়েকদিন। খুব শিগগির এই অভিশপ্ত জেল বোমায় উড়ে যাবে।’

‘কী বলছ গো!’

‘হুম। সেরকম ব্যবস্থাই হচ্ছে। দেওয়ালের সংকেতগুলো বুঝতে পারছিস না?’

ওয়ার্ডারদের নজর পড়তেই বারীনদা চুপ করে যায়।

পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড থেকে হাসপাতাল সাকুল্যে পাঁচ মিনিটের পথ। রাজবন্দিদের সেখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। অগত্যা ওষুধ নিয়ে পুষ্পকেই আসতে হয়।

 কয়েক ডজন লোলুপ চোখের মাঝখান দিয়ে হেঁটে এসে পুষ্প দু’হাতের দগদগে ঘা দেখে শিউড়ে ওঠে, ‘মাগো!’

‘বাঙালি?’ ইন্দুভূষণ হাসে।

‘হ্যাঁ।’ পুষ্প ড্রেসিং করতে করতে বলে, ‘তোমার নাম কী?’

‘ইন্দুভূষণ রায়।’

পুষ্প প্রথমে চমকে উঠেও সামলে নেয়। নীলাদিদি যার কথা প্রতিদিন বলে, সে ইন্দুভূষণ নয়, ইন্দ্র। রায়ও নয়। রায়চৌধুরী।

পুষ্প আর কথা বাড়ায় না। নীরবে নিজের কাজ করতে থাকে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন