দেবারতি মুখোপাধ্যায়
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের এই ‘স্বাবলম্বন’ গ্রামের সঙ্গে গ্রামবাংলার আর পাঁচটা পল্লিগ্রামের তেমন কোনও তফাত নেই। কাঁচা পথ। মাঝে মাঝে ইতস্তত বাড়ি। উঁচু উঁচু গাছ। নীল আকাশ। নরম রোদের সকাল। রংমাখানো সূর্যাস্ত। রাতের স্বচ্ছ আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা চাঁদ।
পার্থক্য কেবল দুটো। এখানে পাখি বেশ কম। কাকের কা কা, চড়াইয়ের কিচিরমিচির নেই। পশ্চিমাকাশে সূর্য যখন লালচে সিঁদুরমেখে অপেক্ষা করে, কোনও পাখির ঝাঁকই তখন ডানা ঝাপটে বাসায় ফেরে না। দ্বিতীয় তফাত জমির উর্বরতায়। লবণাক্ত মাটি। সেই মাটি দেড় দু’হাত খুঁড়লেই জায়গায় জায়গায় হাজার বছরের জমাট বাঁধা প্রবাল। আগ্নেয় শিলা। সাদা মাটি। কালো মাটি। কৃষ্ণকালো ছত্রাক। অদূরের সমুদ্রের লাল খয়েরি সাদা নুড়ি যোগ দিয়েছে মাটিতে।
বালিমেশানো সেই জমিতেই গড়ে উঠেছে প্রাক্তন অপরাধীদের খুদি খুদি সংসার। নীলার জীবন দ্রুত বদলে চলেছিল। ওর জীবনপটের রং কিছুটা পালটে গিয়েছিল কলকাতায় গিয়ে, তারপর ভবিতব্যের ইচ্ছায় বিধাতা যেন থেমে গিয়েছিলেন, নামিয়ে রেখেছিলেন ইজেল আর রং তুলি।
আবার আঁকতে শুরু করেছেন। গৌরীপ্রসন্নর মতো মানুষের সংস্পর্শে থাকা মানেই আলোর কাছাকাছি থাকা। নীলা তা প্রতিদিন অনুভব করছিল। গোটা স্বাবলম্বন গ্রামে জেঁকে বসেছে অশিক্ষা, দুর্নীতি আর স্খলন। গৌরীপ্রসন্ন যেন একার কাঁধে তুলে নিয়েছেন দায়িত্বের জোয়াল।
গাঁয়ে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আর কিছু না হোক, কাঠের অভাব নেই। রাশি রাশি কাঠচেরাইয়ের কল বসে চলেছে একে একে। প্যাডক। হলক। গর্জন কাঠ। সেই কাঠ দিয়েই তৈরি হয় একের পর এক কোঠাবাড়ি। স্বাবলম্বন গ্রামের অনেক পুরুষই কাঠভিত্তিক পেশার সঙ্গে যুক্ত। চেরাই কাঠ প্লাইউড দেশলাই কাঠি। অন্যদিকে সরকার ঢালাও গরু মোষ ছাগল দিয়েছে। কেউ কেউ পশুপালন করেও ভাল রোজগার করে। এছাড়া নারকেল তেল, সর্ষের তেলের ঘানি, হুঁকো তৈরি, সাহেবদের বাংলোর জন্য পাপোশ, তোয়ালে বোনা, এসবও আছে।
আর আছে মাছ ধরা। মুরগি চাষ। নুন তৈরি। জাহাজে মাল ওঠানো নামানো। মুদিখানা। কাজ আছে নানারকম। একেবারে গোড়ার দিকে এসে থিতু হওয়া পুরুষরা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে গত কয়েক দশকে। সারাদিন তারা কাজ করে। বিকেল পার হলেই চলে আসে চণ্ডীমণ্ডপের আখড়ায়। চণ্ডী নামেই, সেখানে পুজোর চেয়ে খেউর হয় বেশি। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, পার্সি সবাই গোল হয়ে বসে। জমাটি আড্ডা। কোন কড়া সাহেব নতুন এসেছে জেলে। কোন কয়েদি ফাঁসিতে ঝুলেছে। কোন সাহেবের বাংলোয় মেমসাহেবের উটকো বাতিক। ব্যারি সাহেবের দুই শাগরেদ খোয়েদাদ খাঁ আর গোলাম রসুলের নতুন কোনও কীর্তি। রগড়ের তুফান ওঠে মণ্ডপে।
তবে সব কথানদীই শেষে গিয়ে মেশে রতিসাগরে। ‘স্বাবলম্বন’ গ্রামের দশ ভাগ পুরুষ। একভাগ মহিলা। নয়ভাগ পুরুষ ঈর্ষাকাতর নয়নে তাকিয়ে থাকে বাকি একভাগের প্রতি। রসিকতায় উপহাসে দুর্দমনীয় শ্লেষ ছিটকে বেরোয়। রাতের আঁধারে বিবাহিত প্রতিবেশীর বাড়িতে চুড়ির রিনঝিন শব্দে বা মেয়েলি গুনগুনে খিদে বেড়ে যায় উপবাসী পুরুষের। সকলেই প্রাক্তন অপরাধী, রক্ত টগবগ করে উঠতে সময় লাগে না। এখানে চুরিচামারি তেমন নেই, কিন্তু খুনখারাপি আছে।
গৌরীপ্রসন্ন আসার পরেরদিনই নীলাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘এখানে অনেক বিকৃত লোকজন আছে। আলো নিভলে সাবধানে থাকিস।’
নড়বড়ে কাঠের বাড়ি। পেছনে ঘন জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কত সাবধানে আর থাকা যায়? গৌরীপ্রসন্ন প্রায় প্রতিসন্ধ্যাতেই ইদানীং চলে যান শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তীর বাড়ি। দু’জনে মিলে একটা স্কুল খুলেছেন গ্রামেই। যে ক’টা বাচ্চা আছে, তারা তো পড়েই, জেলের সুপার মারে সাহেবের নির্দেশে সপ্তাহে একদিন কয়েদিদেরও পড়াতে যেতে হয়। সেই নিয়েই দু’জনের জোর আলোচনা চলে এখন।
বাড়িতে নীলা রান্না সারে। তারপর চুপচাপ বসে থাকে জানলার পাশে। সামুদ্রিক জোলো বাতাস এসে ওর ত্বককে ভিজিয়ে দেয়।
তবে কোনও কোনও দিন সন্ধ্যায় গৌরীপ্রসন্ন সবাইকে নিয়ে আসর বসান চণ্ডীমণ্ডপে। সে এক অন্যরকম আসর। গৌরীপ্রসন্ন গল্প বলেন। দেশ-বিদেশের গল্প। আন্দামানের ইতিহাস। ভারতের ইতিহাস। অনন্ত বামুন, শ্যামলালরা অবাক চোখে শোনে। নীলা যমুনার মতো কয়েকটা মেয়েকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে।
সেদিন বিকেলে আসর জমে উঠেছিল। অনন্ত বামুন নাকে নস্য নিয়ে টিকি দুলিয়ে বলছিল, ‘যতই আমরা ফিরিঙ্গিদের বদনাম করি, এই আন্দামান তো তারাই খুঁজে বের করেচে, এ-কতা অস্বীকার করার তো কোনও উপায় নেই।’
‘কে বলল তোমায় এ-কথা?’ গৌরীপ্রসন্ন বাধা দিলেন, ‘ইউরোপের ইতিহাসবিদরা আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করার ক্রেডিট নেয় বটে, তবে তা মিথ্যে। ইউরোপিয়ানরা মোটেই এই অঞ্চল আবিষ্কার করেনি।’
‘তবে?’
‘এখানকার ইতিহাস বহু প্রাচীন। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে ব্রহ্মদেশ, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া এইসব দেশ থেকে রাজা আর বণিকরা এখানে আসত মানুষ ধরতে।’
‘মানুষ ধরতে?’
‘হুঁ। তখন ক্রীতদাস ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। এখানকার শক্তপোক্ত চেহারার উলঙ্গ মানুষগুলোর দাসবাজারে ছিল ভীষণ চাহিদা। কিন্তু তাদের ধরে নিয়ে যেতে হলে মোকাবিলা করতে হত বিষাক্ত তিরধনুকের সঙ্গে। ঘন দুর্ভেদ্য অরণ্যের আড়াল থেকে সেই তিরের আঘাতে পর্যদস্ত হতে হতে শেষমেশ আনা হলে লাগল বিরাট বিরাট জাল। সেই জাল ছুঁড়ে ধরে ফেলা হত দ্বীপপুঞ্জের নিরপরাধ নির্দোষ মানুষগুলোকে। তারপর তাদের জায়গা হত দেশ-বিদেশের বিখ্যাত সব দাসবাজারগুলোয়। পুরুষদের মাপা হত শ্রমের নিক্তিতে, আর নারীদের চেহারার ভিত্তিতে।’ গৌরীপ্রসন্ন একটানা বলে নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।
যমুনা রাগের চোটে বলে উঠেছিল, ‘আচ্ছা জ্যাঠামশাই, সূর্যকে যে রাক্ষসটা মাঝে মাঝে গপ করে গিলে নেয়, সে ওই দেশগুলোকে গিলে ফেলে না কেন?’
‘আবার ওসব আজেবাজে বকছিস তুই, যমুনা। তোকে তো সেদিনও বললাম, কোথাও কোনও রাক্ষস নেই। ওটা সূর্যগ্রহণ। চাঁদ সূর্যের সামনে চলে আসে, তাই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়।’ গৌরীপ্রসন্ন বিরক্ত হন। অশিক্ষা তিনি মেনে নিতে পারেন, কিন্তু কুশিক্ষা তাঁর কাছে বিষের মতো। আর সেই কুশিক্ষা ছোট থেকে এই মানুষকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও তার সেই ভুল ভাঙতে চায় না। তিনি চেষ্টা করে চলেন, তবু যমুনারা ছোট থেকে মা ঠাকুমার কাছে শুনে আসা বুলিই আউড়ে যেতে থাকে।
রাগ হলেও গৌরীপ্রসন্ন তা সংবরণ করেন। আজকাল মেয়েরা তবু তো গল্পের আসরে আসছে। ফটিক, সুবীরদের মতো কামুকদের অশালীন ইঙ্গিত সহ্য করে এই দ্বীপে তাদের যুঝতে হয় প্রতিটা দিন। তারপরও তারা এখানে আসছে, পুরুষদের সঙ্গে এই একই রোয়াকে বসছে। জানার ইচ্ছে থেকে। এও বা কম কথা কী।
যে মেয়েরা এসে আসরে বসে, তারা ঘোমটার আড়াল থেকে চুপ করে শোনে। কিন্তু নীলা চুপ থাকতে পারে না। গৌরীপ্রসন্ন কথা বলেন খুব পরিশীলিত উচ্চারণে, থেমে থেমে। তাঁর বলার ভঙ্গিমায় অনেকরকম ওঠাপড়া নীলাকে কলকাতার কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
শুনতে শুনতে ও বলে উঠেছিল, ‘আন্দামান নামের মানে কী?’
‘সে লম্বা গল্প। দাসবাজারে বণিকদের মধ্যে নানারকম আলাপ পরিচয় চলত। রামায়ণের গল্প শুনে সেই বিদেশি বণিকরা ভাবল, দ্বীপপুঞ্জের এই আদিবাসী মানুষগুলো বুঝি হনুমানেরই বংশধর। তারা দ্বীপের নাম রাখল ‘হন্দুমান’। তারপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচশো বছর। ইউরোপের নাবিকরা জাহাজ নিয়ে বেরিয়েছে। রোমান গবেষক টলেমি নাবিকদের কাছ থেকে বিবরণ শুনে শুনে এঁকে ফেলেছেন পৃথিবীর মানচিত্র। তাতে তিনি এই দ্বীপগুলোর নাম রাখলেন ‘অঙ্গমান’। আরও হাজার বছর কাটল। সেই অঙ্গমান ইটালির ভূ পর্যটক মার্কোপোলোর লেখায় হল ‘আন্দামান’। কালে কালে এখন তা ‘আন্দামান’। গৌরীপ্রসন্ন নীলার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
নীলা আবার প্রশ্ন করল, ‘তবে সাহেবরা এখানে কবে এল?’
‘সাহেবরা তো প্রথমে এদিকে নজরই দেয়নি। ভারতবর্ষ নিজেই এতবড় দেশ, তাকে কবজা করতেই জায়গায় জায়গায় একের পর এক যুদ্ধ চলছে। পায়ের কাছে এই গুঁড়ি গুঁড়ি দ্বীপগুলোয় নজর দেওয়ার সময় কোথায়? এদিকে প্রথম নজর দিলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। তাও প্রায় দেড়শো বছর হল।’ গৌরীপ্রসন্ন কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, ‘তুই … তুমি বাস্তিল দুর্গের নাম শুনেছ গিন্নি?’
আসরের বাকিদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল কথোপকথন। নীলা দু’পাশে মাথা নাড়ল, ‘না। শুনিনি।’
‘ফ্রান্স বলে একখানা দেশ আছে ইউরোপে। সেখানে ছিল বাস্তিল দুর্গ। গোটা দেশের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ। অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষই কোনও আয়কর দিত না। আর যারা আয়কর দিত তারা কোনও সুবিধা ভোগ করতে পারত না। যারা প্রতিবাদ করত তাদের বন্দি করে রাখা হত বাস্তিল দুর্গে। অত্যাচার চলত চরম। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। একবার কেউ সেখানে প্রবেশ করলে জীবন নিয়ে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকত না। ভেতরেই মেরে ফেলা হত। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই দেশের মানুষ দুর্গ ঘেরাও করে। তাদের দাবি ছিল সাতজন রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। সরকার তাতে রাজি হয় না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী! বিক্ষুব্ধ জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাস্তিল দুর্গে। দুর্গের সৈন্যরাও ভিতর থেকে কামান দাগাতে থাকে। প্রচুর মানুষ মারা যায়। কিন্তু সেই দুর্গও ধ্বংস হয়।’ গৌরীপ্রসন্ন বললেন, ‘যে-বছর বাস্তিল দুর্গ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মানুষ, সেই বছরই এখানে বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিশ তাঁর দুই বিশ্বস্ত কর্মচারীকে পাঠালেন। বললেন, ‘যাও। পাকাপোক্ত উপনিবেশ গড়ে তোলার আগে একবার সরেজমিনে তদন্ত করে এসো দেখি।’
যমুনা, শ্যামলালরা উসখুস করছিল, কিন্তু গৌরীপ্রসন্নের গল্প বলার ঢঙে আবার তারা উৎসাহী হয়ে উঠল, ‘তারপর কী হল, জ্যাঠামশাই?’
‘তখন ইউরোপীয় বণিকরা জাহাজে চেপে চষে ফেলছে পৃথিবীর এ’প্রান্ত থেকে ও’প্রান্ত। ফরাসি, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ জাহাজ এসে ভিড়ছে ছোট বড় বন্দরগুলোয়। সমুদ্রে যাতায়াতের পথে নারকেল গাছে ভরা এই শান্ত স্নিগ্ধ দ্বীপগুলো তাদের নজর এড়ায়নি।’ গৌরীপ্রসন্নের উদাস দৃষ্টি বহু দূরে, ‘তা বড়লাটের হুকুমমাফিক হাইড্রোগ্রাফার মিঃ আর্চিবল্ড ব্লেয়ার আর সার্ভেয়ার জেনারেল মিঃ কোলব্রুক এলেন আন্দামানে। তাঁরা দেখেশুনে বুঝলেন, কাজটা মোটেই সহজ নয়। উপনিবেশ করব বলেই তো করা যায় না, গোটা অঞ্চলটাই যে ঘন জঙ্গলে ঢাকা। এইসব জঙ্গল সাফ করা, রাস্তাঘাট তৈরি করা, বাড়ি বানানো, এসব কি মুখের কথা নাকি? করবেই বা কারা? এখানে লোক বলতে তো আদিবাসীরা। তারা এখন আর আগের মতো তিরধনুক নিয়ে তেড়ে আসে না ঠিকই, কিন্তু তারা বশংবদ হয়ে কাজও করবে না। ব্রিটিশ কর্মচারী যারা সঙ্গে এসেছিল, তারা ক’দিন থেকেই বেঁকে বসল। স্যাঁতসেঁতে জঙ্গল, বিষাক্ত পোকামাকড়, নানারকমের জ্বরজারি।’
‘এখনই বা কী অবস্থা পালটেচে?’ হাত ঘুরিয়ে মুখ বাঁকাল অনন্ত বামুন।
‘হাইড্রোগ্রাফার ব্লেয়ার ফিরে গিয়ে সব দিক উল্লেখ করে রিপোর্ট জমা দিয়ে দিলেন। তাতে আন্দামানের কী উন্নতি হল জানি না, তবে তাঁর নামটি ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে রইল ‘পোর্ট ব্লেয়ার’ হয়ে।’
‘বোঝো!’
‘তারপর আবার অনেকদিন কেটে গেল। সরকার একরকম ভুলেই গিয়েছিল আন্দামানের কথা। সিপাহি বিদ্রোহ হতে তারপর আবার এখানে কয়েদি পাঠানো শুরু হল। তারাই সব সাফ করেছে। অনন্ত, তুমি যতই মুখ বেঁকাও, যে আন্দামানকে আজ দেখছ, তা অনেক ঘষামাজা করা। প্রথমদিককার সেই বন্দিদের কথা ভুলো না। জাহাজঘাটার রহমানভাইকে শুধোলেই সব জানতে পারবে।’ গৌরীপ্রসন্ন উঠে পড়েছিলেন, ‘যাই। সন্ধ্যাহ্নিকের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমরাও সব বাড়ি যাও এবার।’
অন্ধকার ঝুপ করে নেমে আসে এই দ্বীপে। দূরের সমুদ্রের লাইটহাউসের আলো জ্বলতে থাকে মুক্তোর মতো।
নীলাও উঠে পড়ে স্বামীর পিছু নিতে যেতেই শেখরের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল সেদিন। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে শেখরদা ওর সঙ্গে একটা কথাও বলেনি।
শেখরদা নাকি খুলনা থেকে প্রথমে ঢাকায় গিয়েছিল, পুলিনবিহারী দাসের অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে চলে আসে কলকাতায়, যোগ দেয় যুগান্তরে। বোমা বাঁধতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল হয় আন্দামানে। শেখরদা যখন এখানে চলে আসে, তখন সবে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দানা পাকাচ্ছে বাংলায়। এই সবই সে জেনেছে গৌরীপ্রসন্নর থেকে।
নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। ও বিয়ের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে মানেই সেটা শেখরদা’র জন্য, এটা যেন শেখরদা ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু কেন? শেখরদা নিজের মনেই সেই কল্পনার রাজ্য না বানালে এতদিনে নীলা নিজের গাঁয়ের দুটো সুখদুঃখের কথা বলতে পারত তার সঙ্গে।
ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গিয়েছিল ও, হঠাৎ হাত ধরে হ্যাঁচকা টান। যমুনা।
‘সামনে দিয়ে সাপ চলে যাচ্ছে, আর তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখচিস লো?’
সত্যিই তো! হাতের লণ্ঠনটা উঁচু করে তুলে ধরতেই দেখা গেছিল সাপটাকে। সরসর করে এঁকেবেঁকে ঢুকে যাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে। চিরিক করে জিভ বের করে এদিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল।
নীলার গা শিরশির করে উঠেছিল। এ যেন ওদেরই দেশ, কিছু মানুষ এসে জোর করে ভাগ বসিয়েছে।
যমুনা লণ্ঠন হাতে হাঁটছিল। ও ও পাশাপাশি চলছিল। যমুনা কত কী ঘর গেরস্থালির কথা বলে চলেছিল, নীলা হুঁ হাঁ করছিল।
দূরে কালো দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সেলুলার জেল। ওর মন পড়ে ছিল সেখানে।
ইন্দ্রদাদাকে কীভাবে খবর পাঠানো যায়?
মেয়েটা যখন হাঁটতে শুরু করেছিল, তখন ছিল নরম আলোয় মাখা শীতের সকাল। হাওড়ার শিবপুরের দিকটা এখনও বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কুয়াশা জমাট বেঁধে ছিল গাছের ফাঁকে ফাঁকে। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ঘাসের শিষে জমে থাকা শিশিরবিন্দু সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল মুক্তোর মতো। হাঁটতে হাঁটতে ওর নাকে আসছিল খেজুরের রসের মিষ্টি গন্ধ। বুক ভরে সেই ঘ্রাণ নিচ্ছিল ও।
পাশ দিয়ে ঠনঠন ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছিল একের পর এক শিবপুর লাইন থেকে আসা ট্রাম। ওকে একাকী ক্লান্তপায়ে হাঁটতে দেখে ট্রামের কনডাক্টর জোরে জোরে হাঁকছিল, ‘হাওড়া পুল। হাওড়া পুল। উঠে আসুন দিদিমণি!’
রাস্তার ধারের দু’-একটা দোকানদারও জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল। একজন শহুরে পোশাকপরিহিতা তরুণী এভাবে দীর্ঘপথ হেঁটে চলেছে দেখাটা একটু অস্বস্তিকর বইকি! কিন্তু মেয়েটা কারুর অনুরোধেই দৃকপাত করেনি। সে টানা হেঁটে চলেছিল।
তারপর কেটে গেছে প্রায় দেড়ঘণ্টা। এখনও হাঁটছে মেয়েটা। তবে গতি কমেছে অনেকটাই। সূর্য অনেকটা উঠে এসেছে মাথার ওপর। টানা হাঁটায় ডিসেম্বরের এই ঠান্ডাতেও মেয়েটার কপালে, চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এত হাঁটার অভ্যেস তার কোনওকালে নেই। পায়ের শিরায় টান ধরছে বারবার। শেষে এমন অবস্থা হল, ছ’-সাত পা হাঁটতে না হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে। গোড়ালির কাছের শিরাটা যেন জ্বলে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। থেকে থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে।
অবশেষে সুকিয়া স্ট্রিটে ঢুকে কিছুক্ষণ দম নিল সে। তারপর সামনের তিনতলা বাড়িটায় ঢুকে পড়ল। এই বাড়িটা ওর পিতৃবন্ধুর ভদ্রাসন। কিন্তু আশৈশব এখানে এত ভালবাসা, এত আন্তরিকতা ও পেয়েছে যে, মাঝেমধ্যে ভুলে যায় এটা ওর নিজের বাড়ি নয়!
একতলা থেকে ঘটাং ঘটাং মেশিন চালানোর শব্দ ভেসে আসছে। গেঞ্জি মোজা তৈরির কারখানা সেটা। সেটা পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠেই ও খুড়িমাকে দেখতে পেল।
হেমাঙ্গিনী তাকিয়ায় আধশোয়া হয়ে বসে উল বুনছিলেন। ওকে দেখে স্মিতমুখে বললেন, ‘আরে লীলা যে! আয়। ভেতরে আয়।’
লীলা এগিয়ে গেল। শীতের রুক্ষ হাওয়ায় ফেটে যাওয়া ঠোঁটটা একবার জিভ বুলিয়ে নিল ও। এই পালঙ্ক, এই জানলা, এই গরাদ সব ওর বড় চেনা। এখন ওর একুশ বছর বয়স। ওর মা যখন হঠাৎ ওদের চার ছোট ছোট ভাইবোনকে রেখে অকালে চোখ বুজেছিলেন, বাবা প্রথমে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। তখন হেমাঙ্গিনী যেভাবে ওদের বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, তা মায়ের চেয়ে কম কিছু নয়। মাসের পর মাস তখন ওরা থেকেছে এই বাড়িতে।
কাছে যাওয়ামাত্র হেমাঙ্গিনী ভ্রু কুঁচকোলেন, ‘মুখচোখের এই হাল কেন? সকাল থেকে কোথায় ঘুরছিলি?’
‘বলছি। একটু জল দাও না!’
‘তুলসী! ও তুলসী!’ হেমাঙ্গিনী হাঁক পাড়লেন।
পরিচারিকা ছুটে আসামাত্র হেমাঙ্গিনী বললেন, ‘ক’টা লুচি ভেজে নিয়ে আয় তো।’
‘আচ্ছা মা।’ পরিচারিকা প্রস্থানোদ্যত হতে হেমাঙ্গিনী বলেন, ‘আর আগে লীলাকে একটু জল দিয়ে যা। ইশ, কেমন দেখাচ্ছে দেখো!’
ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হল লীলা। এতক্ষণ হেমাঙ্গিনী একটাও কথা বলেননি। শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছেন। এবার প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলি? দেখে তো কলেজ মনে হচ্ছে না!’
‘না। আজ কলেজ যাইনি।’ লীলা অনেকটা দম নিয়ে বলল, ‘শিবপুরে গিয়েছিলাম।’
‘শিবপুর!’
‘হ্যাঁ। উল্লাসদার বাড়ি।’
‘কেমন অবস্থা দেখলি ওদের?’ হেমাঙ্গিনী কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ল। আলিপুর জেলে যেদিন উল্লাসের মা মুক্তকেশী দেখা করতে গিয়েছিলেন পুত্রের সঙ্গে, সেদিন হেমাঙ্গিনীও ছিলেন, লীলার বড়দিদি শোভনাও ছিল সঙ্গে।
আলিপুর বোমা মামলা নিয়ে তখন সারা দেশ উত্তাল, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোর সাহস দেখে সবাই বিস্মিত। বিচারে উল্লাসকর আর বারীনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। বাকি সবার আন্দামানে নির্বাসন।
মুক্তকেশীকে সেদিন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন হেমাঙ্গিনী। কত বড় জমিদারবাড়ির বউ, স্বামী নামকরা অধ্যাপক। অথচ কী অনাড়ম্বর! একটা নরম আটপৌরে শাড়ি। মাথায় ঈষৎ ঘোমটা। চারদিকে সার্জেন্ট থিকথিক করছে। হেমাঙ্গিনীদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। মুক্তকেশী তাঁর এক জ্ঞাতিপুত্রকে নিয়ে ঢুকেছিলেন জেলারের দপ্তরে।
ফিরেছিলেন প্রায় চল্লিশ মিনিট পর। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঠোঁট কাঁপছে। হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন, ‘কতক্ষণ বসিয়ে রাখল জানেন দিদি। ছেলেটার সঙ্গে দেখা করলাম পাঁচ মিনিটের জন্য!’
‘কী বলল উল্লাস?’ হেমাঙ্গিনীর গলায় কষ্ট দলা পাকাচ্ছিল। গত কয়েকবছর ধরে প্রায় প্রতিদিন তাঁর বাড়িতে এসেছে উল্লাস। আমোদ করেছে। আবদার করেছে। দরাজ গলায় গান গেয়েছে। উল্লাস তাঁর ছেলের মতো। সেই উল্লাসকে কিনা ফাঁসিতে ঝুলতে হবে? একটা বাইশ-তেইশ বছরের তরতাজা ছেলে, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, মেধায় উজ্জ্বল। রাষ্ট্র কিনা তাকে হত্যা করবে? ক্রোধে হেমাঙ্গিনীর শরীরের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, সামনের ক’টা পুলিশকে তখুনি দুটো থাপ্পড় কষান।
মুক্তকেশী অবশ্য অনেক ধীরস্থির ছিলেন। চারপাশের হইহট্টগোলের মধ্যে গাড়িতে উঠে চোখ মুছেছিলেন, ‘ছেলেটা অনেক রোগা হয়ে গেছে দিদি। খেতে পায় না তো ঠিকমতো! আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তোর ভয় করছে না?’
‘কী বলল তখন?’
‘হা হা করে হেসে উঠল। বলল, মা, আমি হলাম সিংহীর বাচ্চা। তোমার দুধ খেয়ে বড় হয়েছি, ভয় কীসের?’ মুক্তকেশী উৎগত অশ্রু সংবরণে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিলেন।
সেদিনের কথা মনে পড়তে আজও হেমাঙ্গিনীর চোখে জল এল। উল্লাসের ফাঁসি শেষমেশ হয়নি। যদিও সে কিছুতেই হাইকোর্টে আপিল করতে চায়নি, চিৎকার করে বলেছে, যে বিচারব্যবস্থাই মানি না, তার আবার আপিল কী?
শেষে অনেক বোঝানোয় আপিলে সই করেছিল।
আপিলের রায় বেরিয়েছিল মাসকয়েক পর। উল্লাস আর বারীনের ফাঁসির আদেশ বদলে গিয়েছিল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। বালকৃষ্ণ হরিকানে ছাড়া পেয়ে গেল। হেমচন্দ্র আর উপেনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর বহাল রইল। হৃষীকেশ ইন্দু বিভূতির দশ বছর। বীরেন সুধীর অবিনাশের সাত বছর।
রায় শুনে সামান্য স্বস্তি পেলেও মনখারাপ যায়নি। আন্দামান হল কালাপানি। সে এক ভয়ংকর জায়গা। ওখান থেকে নাকি কেউ বেঁচে ফেরে না। উল্লাসদের ওখানে নিয়ে গিয়ে কি সবার অজান্তে মেরে ফেলবে?
উল্লাসরা জাহাজে উঠেছে দিনকয়েক আগে। এরমধ্যে কি মুক্তকেশীর সঙ্গে একবার দেখা করে আসা উচিত ছিল না? মনে মনে হেমাঙ্গিনী নিজেকে তিরস্কার করলেন। অধীর গলায় তিনি আবার বললেন, ‘কেমন দেখলি ওর মা’কে?’
‘ওই আর কী! জ্যাঠামশাই কলেজ যাননি। চুপ করে বসেছিলেন বারান্দায়। আর জ্যাঠাইমা ছিলেন ঠাকুরঘরে। আমায় দেখে শুধোলেন, ওরা পৌঁছেছে কি না।’ বলতে বলতে লীলা আবার শুকনো ঠোঁট চেটে নেয়, ‘আরেকটু জল দাও না খুড়িমা!’
হেমাঙ্গিনী জল দিতে বলে সন্দিগ্ধ চোখে তাকান, ‘তোকে এত বিধ্বস্ত লাগছে কেন?’
লীলার নীরবতায় উত্তরের অপেক্ষা না করেই তারপর বলে ওঠেন, ‘তুই কি শিবপুর থেকে হেঁটে এলি নাকি!’
লীলা ধীরে ধীরে ওপর নীচে মাথা নাড়ল।
‘সেকিরে! এতটা রাস্তা!’ হেমাঙ্গিনী আর কিছু বলতে পারলেন না, শুধু লীলার হাতখানা জড়িয়ে ধরলেন।
মা মরা মেয়েরা এমনিই গভীর অনুভূতিপ্রবণ হয়। সহজে নিজের আবেগ প্রকাশ করার কোনও জায়গা থাকে না বলে মনের মধ্যে সব চাপতে চাপতে তারা বাইরের আবরণটাকে শক্ত করে ফেলে। ভেতরের নরম মনটা কেউ দেখতে পায় না। কিন্তু খুব কাছের কেউ যদি একটা আলতো টোকা দেয়, মুহূর্তে সেই শক্ত খোলস ভেঙে পড়ে।
লীলারও তাই হল। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে থাকা মেধাবী তরুণীটির এতক্ষণের সংযম বাঁধভাঙা কান্নায় ভেসে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘উল্লাসদা আর ফিরবে না, খুড়িমা! সেলুলার জেলে গেলে কেউ ফেরে না। তাছাড়া, ওকে তো চেনোই। দুমদাম মাথা গরম করে। তেমন কিছু করলেই ওরা ওখানে …!’
হেমাঙ্গিনীর চোখদুটো আদ্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি কাঁদলেন না। স্থির থেকে তিনি লীলার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। কাঁদুক মেয়েটা। দীর্ঘক্ষণ ধরে কাঁদুক। বুকের ভেতরের পাথরটাকে হালকা করা ওর ভীষণই দরকার।
এই তো মাত্র বছরকয়েক আগের কথা। তাঁর এই বাড়ির বৈঠকখানায় প্রথম দেখেছিলেন উল্লাসকরকে। বড় বড় চোখের হুল্লোড়ে আবেগপ্রবণ ছেলেটাকে প্রথম দেখাতেই যেন কত আপন মনে হয়েছিল।
হেমাঙ্গিনীর নিজের জীবনও একটা রহস্য উপন্যাসের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর কিছু নয়। একসময়ে তিনি ছিলেন বাল্যবিধবা। আর কয়েকবছর আগে হলে হয়তো বাকি জীবনটা তাঁর হেঁশেল আর ঠাকুরঘরেই কেটে যেত। কিন্তু বিদ্যাসাগরমশাইয়ের জন্য তা হয়নি। হেমাঙ্গিনী দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন ব্রাহ্ম নেতা সুন্দরীমোহনকে।
লীলার বাবা বিপিন চন্দ্র পাল আর হেমাঙ্গিনীর স্বামী সুন্দরীমোহন দাশ। দু’জনে হরিহর আত্মা বলতে যা বোঝায়, তাই। বিপিন আর সুন্দরীমোহন, দু’জনেরই আদি বাড়ি পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টে। বিপিনের গ্রাম পৈল। সুন্দরীমোহনের ডিগালি। দু’জনেই জমিদারতনয়। কলেজে পড়তে কলকাতায় এসে শিবনাথ শাস্ত্রীর সংস্পর্শে আসা। বাড়ির যাবতীয় আপত্তি অগ্রাহ্য করে দু’জনেই তারপর ব্রাহ্ম হয়েছেন। ত্যজ্যপুত্রও হয়েছেন দু’জনেই।
তারপর থেকে দু’জনের জীবন দু’দিকে বয়েছে। বিপিন ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের সাহিত্যের ছাত্র। যেমন ভাল বলতেন, তেমন ভাল লিখতেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর বক্তৃতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। পাশ করে বেরিয়ে দেশের নানা জায়গায় চাকরি করেছেন বিপিন। কটক। শ্রীহট্ট। কলকাতা। ব্যাঙ্গালোর। বোম্বাই। মাদ্রাজ। তুখোড় ছাত্র ছিলেন। বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড আমেরিকাও ঘুরে এসেছেন। বিপিনের দেশজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার পর। এখন তাঁর বক্তৃতা থাকলে সেই সভা উপচে পড়ে।
যদিও জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর এখন দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কুড়ি বছর হয়ে গেল, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়েছে, কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি বলতে গেলে। কংগ্রেসের পুরনোদিনের নেতারা কেউই দেশ থেকে ইংরেজকে তাড়াতে চান না। বোম্বাই লবির ফিরোজ শাহ মেহতা বা দীনশা ওয়াচারা ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থনই করেন। শুধু মাঝেমধ্যে শাসননীতির একটু আধটু সমালোচনা করেই তাঁদের দায় শেষ। আগে বিপিনও তাঁদের দলেই ছিলেন, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, তাঁর বিরক্তি বাড়ছে। এইরকম ভিখিরির মতো নিজের দেশে বসবাস করার পক্ষপাতী নন তিনি। ইংরেজদের না হটালে কোনও সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁর মতো মত পোষণ করেন অনেকেই। মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক বা পাঞ্জাবের লালা লাজপত রাইয়ের সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর প্রায়ই পত্রালাপ চলে। কাগজে লেখালিখি। আলোচনা। পুরনোপন্থী কংগ্রেস নিয়ে আর কিচ্ছু হওয়ার নয়।
এই নিয়ে সুন্দরীমোহনের বাড়িতে বসে নিত্য আলোচনা। বিপিনের মতো সুন্দরীমোহন সাহিত্য পড়েননি, পড়েছিলেন ডাক্তারি। সঙ্গে তালিম নিয়েছেন লাঠিখেলা আর কুস্তির। কলকাতা কর্পোরেশনের ডাক্তার ছিলেন, কিছুদিন আগে প্লেগ নিয়ে ইংরেজ ওপরওয়ালার সঙ্গে মতবিরোধ হল, দুম করে চাকরি ছেড়ে দিলেন। তারপর থেকে প্রাইভেট প্যাকটিস করছেন। গাইনোকলজিস্ট হিসেবে বেশ সুনাম হয়েছে শহরে। সঙ্গে তিনি নীরবে করে চলেছেন নানারকম কর্মকাণ্ড। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত আসেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। গত কয়েকবছর ধরে আসছিলেন অরবিন্দ ঘোষও।
সুন্দরীমোহন বাড়িতে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বহু ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছেন। কেউ কলেজ পড়ায়া। কেউ কাজ খুঁজছে। তাঁদের জন্য নিজের খরচে বাড়ির একতলায় বানিয়ে দিয়েছিলেন গেঞ্জি মোজা তৈরির কারখানা। তাতে অবশ্য এখনও অবধি লাভের মুখ দেখা তো দূর, লোকসানই বেড়ে চলেছে। গ্রামের ছেলেরা লেখাপড়া শিখেছে, মাল বেচতে তো শেখেনি। কারখানায় অনেক টাকা ঢুকে গেছে। তবে তা নিয়ে সুন্দরীমোহন একেবারেই ভাবিত নন।
বিপিনচন্দ্র আর সুন্দরীমোহন, দুই বন্ধুই যেমন আবেগপ্রবণ, তেমনই সাহসী। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে বিপিনচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর আশ্রিতা বাল্যবিধবা নৃত্যকালীকে। বিয়ের ন’বছর পর কলেরায় আক্রান্ত হয়ে নৃত্যকালী যখন মারা গেলেন, কোলে তখন ছোট্ট ছোট্ট চারটি শিশু। শোভনা। ইন্দিরা। নিরঞ্জন। লীলা। তাদের নিয়ে বিপিনচন্দ্র অকূল পাথারে পড়লেন। তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়ান। কে দেখবে শিশুগুলোকে! বাধ্য হয়ে তিনি আবারও এক বিধবা রমণীকে বিয়ে করলেন। বিরাজমোহিনী। বিপিনচন্দ্র আর বিরাজমোহিনীর চারটে ছেলেমেয়ে হয়েছে। জ্ঞানাঞ্জন। প্রেমাঞ্জন। অমিয়া। বীণা। অতগুলো ভাইবোন মিলে সকলে মিলেমিশে থাকে।
অন্যদিকে সুন্দরীমোহনও বিয়ে করেছেন বিধবা হেমাঙ্গিনীকে। হেমাঙ্গিনী সাধারণ নারী নন। আসামের এক রেলস্টেশনে এক ইংরেজ প্লান্টার অসভ্যতা করছিল মেয়েদের সঙ্গে, তাকে সবার সামনে সজোরে লাথি কষিয়েছিলেন হেমাঙ্গিনী। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সমস্ত কর্মকাণ্ড নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনিও। বাড়ির সব আশ্রিত ছেলেরা তাঁকে মায়ের মতো ভালবাসে, যমের মতো ভয়ও পায়। একইসঙ্গে হেমাঙ্গিনী স্নেহশীলা, আবার প্রয়োজনে বিদ্রোহিণী বীরাঙ্গনাও।
বিপিনচন্দ্র আর সুন্দরীমোহন যেমন হরিহর আত্মা, বিপিনচন্দ্রের ছেলেমেয়েরাও মাসের পর মাস এই বাড়িতেই থাকে। বিশেষত শোভনা আর লীলা। হেমাঙ্গিনী খুড়িমার কাছে থেকে থেকে ওদেরও ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠছে।
এই বাড়িতেই হেমাঙ্গিনী প্রথম দেখেছিলেন উল্লাসকরকে। ঘরশুদ্ধ লোককে সে মাতিয়ে রাখে। আজ গান গাইছে তো কাল পুতুল নিয়ে এসে ভেন্ট্রিলোকুইজমের খেলা দেখাচ্ছে। এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে বক্তৃতা শুনতে। একবার মিনার্ভা থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বক্তৃতা দেবেন স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে, ভিড়ে ভিড়াক্কার, ভলান্টিয়ারের দুর্ব্যবহার সোজা ঘুসি চালিয়ে দিয়ে জেলে চলে গেল। পরে আবার মধ্যরাতে তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন বিপিনচন্দ্র। সেই রাতটা উল্লাস আর শিবপুরের বাড়িতে ফিরল না, থেকে গেল হেমাঙ্গিনীর কাছে। কত গল্প। আড্ডা। গান। ছেলেটা রবিবাবুর গানের ভক্ত ছিল।
নিজের মনে নিজেই তিরস্কার করলেন হেমাঙ্গিনী। ছি ছি! ‘ছিল’ বলছেন কেন? ‘আছে’। উল্লাস আছে। উল্লাসের মতো ছেলেদের যে থাকতেই হবে! অমন আবেগ। অমন দেশপ্রেম।
বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে তখন বাংলা উত্তাল। পুরোদস্তুর পশ্চিমি পোশাকে অভ্যস্ত ছেলেটা রাতারাতি তুলে নিল দেশি খদ্দর। সে কী আবেগ তখন! শয়তান কার্জন বাংলাকে কেটে দু’টুকরো করে দিয়েছে। বিপিনচন্দ্র সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘ইংরেজদের চাকরি, আদালত, স্কুল, কলেজ, ব্যবসা সব বয়কট করতে হবে। সবকিছু বর্জন করলে ব্যবসায়ীরাই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য। স্টার থিয়েটার, টাউন হলে চলছে পরপর সভা। একদিকে কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা কুমুদিনী, পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে খায়রুন্নেসা এগিয়ে এসে মেয়েদের আহ্বান জানাচ্ছেন বিলিতি শাড়ি ছেড়ে স্বদেশি পোশাক পরার জন্য। অন্যদিকে চলছে সুরেন্দ্রনাথ, বিপিন চন্দ্র, অরবিন্দের জ্বালাময়ী বক্তৃতা। রক্ত নেচে উঠছে সকলের।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘শুধু ম্যাপে একটা দাগ টেনে দিলেই কি আমরা দু’টুকরো হয়ে যাব নাকি! মনে মনে আমরা যদি এক থাকি, কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’ প্রায় প্রতিদিন একটা করে স্বদেশি গান লিখতে লাগলেন রবিবাবু। সহজ সরল ভাষায় গান লিখলে সেই গানের মধ্য দিয়ে দেশপ্রেম সকলের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সেটাই হল। অসম্ভব জনপ্রিয় হল সেইসব গান। সতীশ মুখার্জির ডন সোসাইটি ঠিক করল, রবিবাবুর এইসব গানগুলো শেখানো হবে। অমৃতবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদনা। শয়ে শয়ে ছেলেমেয়ে শিখতে চায়। এদিকে আসন মাত্র কুড়িটা। উল্লাস সেদিন এসে হেমাঙ্গিনীর পায়ে পড়ে গেল।
‘দোহাই খুড়িমা! আমায় শেখার ব্যবস্থা করে দাও!’
‘কেন রে উল্লাস? তুই তো এমনিতেই বেশ গাস!’
‘তুমি বুঝতে পারছ না খুড়িমা! নতুন গানগুলো না শিখতে পারলে আমার জীবন বৃথা! তুমি তো অনেককে চেনো।’
‘আমি আবার কাকে চিনি?’
‘বাহ, তুমি ঘরের মধ্যে থেকে যেভাবে স্বদেশি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছ, তা বুঝি জানি না? হাজার হাজার মেয়ে-বউকে উদ্বুদ্ধ করছ। তুমি একটা চিঠি লিখে দিলেই আমার একটা হিল্লে হয়ে যাবে গো!’
হেমাঙ্গিনীর চিঠি নিয়ে উল্লাস সটান গিয়ে ভর্তি হয়ে শিখে ফেলেছিল একের পর এক নতুন গান। একেকটা যেন ফুসফুসে জমা হওয়া টাটকা রক্ত!
তারপর নিষিদ্ধ হল বন্দে মাতরম। বন্দে মাতরম গাইবার অপরাধে একের পর এক জায়গায় ছাত্রদের হেনস্থা করতে শুরু করল ব্রিটিশ সরকার। উল্লাসের নিজের কলেজ প্রেসিডেন্সিতে প্রফেসর রাসেল তো বহুদিন ধরে বাঙালি ছাত্রদের অপমান করে আসছেন। উল্লাস রাসেলের ওপর রাগে ফেটে পড়ত।
‘ওকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না! যা তা বলে, জানো খুড়িমা? আমাদের নামে নোংরা অপবাদ দিয়ে কমপ্লেইন অবধি করেছে কলেজ কমিটিতে।’
তারপর যেদিন ছোটলাট ব্যামফিল্ড ফুলারের আদেশে মাদারিপুর স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে চাবুক মারা হল ‘বন্দে মাতরম’ গাইবার অপরাধে, সেদিন উল্লাসের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ইংরেজ পুলিশ নাকি সেই স্কুলের হেড মাস্টারকেও হেনস্থা করেছে। এত স্পর্ধা?
দাঁড়াও।
পুরনো চটিজোড়া থলিতে পুরে পরের দিন উল্লাস চলে গেল কলেজে। একদিকে উল্লাসের বন্ধু সত্যানন্দ, দ্বারিকানাথরা কী একটা প্রশ্ন করে মনোযোগী করে রাখল, পেছন থেকে উল্লাস প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল প্রফেসর রাসেলকে। তারপর উপর্যপরি লাথি। চটি দিয়ে মার। পিঠে। মাথায়। হাতে। প্রতিটি মারের সঙ্গে ‘বন্দে মাতরম’।
ফিরে এসে কী আনন্দ তার! প্রেসিডেন্সির অধ্যাপককে এভাবে প্রকাশ্যে প্রহার? কোনওদিনও এমন ঘটনা ঘটেনি তার আগে। আগুনের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। কলেজের দেওয়ালে আলকাতরায় লেখা নানা স্লোগান। কলেজ কর্তৃপক্ষ আতঙ্কিত। রাসেলকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলেজ ক্যাম্পাসে চলছে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ প্রহরা। গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে। চলছে দীর্ঘক্ষণ জেরা। কিন্তু এতকিছু করেও বের করা যায়নি, কার কাজ।
ওদিকে খবর পেয়ে সুন্দরীমোহন আর হেমাঙ্গিনীর বাড়িতে সেদিন চলে এসেছিলেন উল্লাসকরের নিরীহ অধ্যাপক বাবা দ্বিজদাস দত্ত। তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। একইসঙ্গে চিন্তিত।
‘ছি ছি। যাইহোক, তিনি একজন শিক্ষক!’
‘যে শিক্ষক উঠতে বসতে জাত তুলে চরিত্র তুলে অপমান করেন, তিনি মোটেই শিক্ষক নন।’ আহত বাঘের মতো জবাব দিয়েছিল উল্লাস।
কথার তরজা আরও এগোত, কিন্তু নিরস্ত করেছিলেন বিপিনচন্দ্র আর সুন্দরীমোহন। কাজটা অত্যন্ত হঠকারী হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এবার কী করণীয়? গোয়েন্দা পুলিশ যেভাবে তদন্ত চালাচ্ছে, আজ হোক কাল হোক, উল্লাস ধরা পড়বেই।
হেমাঙ্গিনী বলেছিলেন, ‘বিলেত পাঠিয়ে দিলে হয় না?’
বিপিনচন্দ্র সুন্দরীমোহন আর দ্বিজদাসেরও মনঃপূত হল প্রস্তাবটা। দ্বিজদাস নিজেও ইংল্যান্ড থেকে এগ্রিকালচার পাশ করে এসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘সেটাই ভাল হবে। ওখানে আমার অনেক জানাশোনা আছেন।’
‘হ্যাঁ। আমিও সুপারিশপত্র লিখে দেব। ওখানকার কলেজে ভর্তি হতে কোনও সমস্যা হবে না।’
বিপিনচন্দ্র কথা শেষ করতে পারেননি, উল্লাস আপত্তি তুলেছে, ‘কী বলছেন বিপিনকাকা! যাদের বিরুদ্ধে লড়ছি, যাদের আমি ঘৃণা করি, তাদের দেশেই গিয়ে কিনা কলেজে পড়ব? কক্ষনও নয়। আমি বিলেত যাব না কিছুতেই!’
উল্লাসের বাবা দ্বিজদাস ছেলেকে অনেক বুঝিয়েও পারেননি। শেষে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। শেষে বিপিনচন্দ্রই খোঁজখবর নিয়ে উল্লাসকে পড়তে পাঠিয়েছেন বোম্বাইতে, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।
উল্লাস অনিচ্ছাসত্ত্বেও গেছে। কিছুদিন বাদেই ফিরে এসেছে। দেশ স্বাধীন করার পোকা যাকে একবার কামড়েছে, তার কি আর অন্য কিছুতে মন বসে? উল্লাস বাড়িতেই একখানা ল্যাবরেটরি তৈরি করে ফেলেছে। আর সেখানে তৈরি করতে শুরু করেছে বোমা। নাইট্রোগ্লিসারিন আর পিকরিক অ্যাসিড। এমন বোমা, যা টলিয়ে দেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য!
‘খুড়িমা!’
ভাবতে ভাবতে চিন্তার কোন অতলে চলে গিয়েছিলেন হেমাঙ্গিনী, সম্বিত ফিরল লীলার ডাকে।
‘জানো খুড়িমা! গেল বছর শীতে আমি একদিন খেজুর গুড় খেতে চেয়েছিলাম। এক হাঁড়ি খেজুরের রস সেই শিবপুর থেকে আমাদের কাঁসারিপাড়ার বাড়িতে মাথায় করে বয়ে এনেছিল উল্লাসদা! সেদিন নাকি নৌকা বন্ধ ছিল। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। এতদূর কেউ হাঁড়ি মাথায় করে নিয়ে আসে? উল্লাসদা হা হা করে হেসেছিল। কী বলেছিল, জানো?’
‘কী?’
‘বলেছিল, কেমন মর্নিং ওয়াক হয়ে গেল বলো! মাথায় খেজুরের রস। আর হৃদয়ে অন্য রস …!’ বলতে বলতে এতক্ষণের চেপে থাকা কান্না আর সংবরণ করতে পারল না লীলা। হাতদুটো মুখে চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমি আজ শিবপুর থেকে হেঁটে এলাম খুড়িমা। খালি হাতে। তবু আমার পা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।’
হেমাঙ্গিনী মুখে আঁচল চাপা দিলেন। ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখে লীলাকে টেনে নিলেন বুকে।
বিপিন ঠাকুরপোর এই শান্তশিষ্ট মেধাবী কন্যাটি কবে ওই পাগলটার প্রেমে পড়েছিল, কে জানে! গোড়ায় হেমাঙ্গিনী টের পাননি। পরে একদিন বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লাস দরাজ সুরে রবিবাবুর গান গাইত। বন্ধু সত্যানন্দের কাছ থেকে নিয়ে আসত নিত্যনতুন বই। তারপর দু’জনে মিলে পড়ত। আলোচনা করত। উল্লাস দারুণ মিমিক্রি করত। লীলা সে-সব দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ত।
হেমাঙ্গিনী রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘কাঁদিস না মা! ও ঠিক ফিরে আসবে। তোর ভালবাসার টান ওকে ফিরিয়ে আনবেই। তুই কথাটা মিলিয়ে নিস!’
লীলা স্বভাব শান্ত। কিন্তু এখন ওর আবেগের বাঁধ ভেঙে গেছে। ভেজা চোখে ও তাকাল, ‘ওখানে ডাকে চিঠি পাঠালে জেলের লোকেরা ছিঁড়ে ফেলে, খুড়িমা! তাই … তাই আমি একটা উপায় বের করেছি।’
‘কী উপায়?’
‘তোমার জনার্দনকে মনে আছে?’
‘কে জনার্দন?’
‘আমাদের পুরনো বাড়ির পাশে ভাড়া থাকত।’
হেমাঙ্গিনী চমকে উঠে বললেন, ‘সেই দুশ্চরিত্র মাতালটা? যার বউ …!’
‘হুঁ। সেই বউটা এখন কোথায়, জানো?’
‘কোথায়?’
লীলা চোখ মুছে হেমাঙ্গিনীর দিকে তাকাল, ‘আন্দামানে।’
সন্ধ্যাবেলা বাড়ির উঠোনের একফালি তুলসীমঞ্চে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে এসে নীলা ঘরে ঘরে ধুনো দিচ্ছিল। পেছনেই জঙ্গল, এখানে মশার উপদ্রব প্রচণ্ড। ধুনো না দিলে অতিষ্ঠ করে তোলে। ম্যালেরিয়া, পাক্কা জ্বর লেগেই থাকে। কিছুদিন আগেই নাকি কালাজ্বরের প্রকোপে পল্লি প্রায় উজাড় হয়ে গিয়েছে। এছাড়া নোনা জল মিশে আন্ত্রিক, কলেরা, রক্ত আমাশার উৎপাত তো আছেই।
না আছে কোনও হাসপাতাল। না আছে কোনও পাশ করা ডাক্তার। মান্ধাতার আমলের এক বুড়ো ডাক্তার রয়েছে, সে নাকি জেল থেকে বেরিয়ে আগে জাহাজের খালাসির কাজ করত। একবার কলকাতা থেকে এক ডাক্তার এসেছিলেন জেলের কয়েদিদের দেখতে, তাঁর কাছে ক’টা বক্তৃতা শুনে আর কিছু ওষুধপত্রের নাম লিখে নিয়ে সে-ই এখন স্বাবলম্বন গ্রামের চিকিৎসার সর্বেসর্বা। সেই বুঁদোডাক্তারই সকলের অগতির গতি।
ধুনো দেওয়া শেষ করে পিছু ফিরতেই নীলা চমকে উঠল। দরজার কাছে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। না। দাঁড়িয়ে নেই। ক্রমশ এগিয়ে আসছে। নীলার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, ‘কে? যমুনা?’
কোনও উত্তর নেই।
নীলা চোখ সরাল না। যমুনা নামের প্রতিবেশিনী বধূটি মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে এমন ঠাট্টা করে। মেয়েটা খুব সহজ সরল। কবে কোনকালে পেটের জ্বালায় পাশের বাড়ি থেকে দুটো মিষ্টি চুরি করে খেয়েছিল।
নীলা প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলেছিল, ‘মিষ্টি খেয়েছিলে বলে জেল?’
যমুনা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল, ‘ওটা তো অজুহাত গো! সৎমা দেকল, এই সুযোগ। মোটা পণ ছাড়া বে’ হবে না। ওদিকে তার নিজের পেটের চারটে শত্তুর আচে, তাদেরও তো পার করতে হবে! এমনিতেই একবেলা খেতাম। খিদের জ্বালায় এর ওর বাড়ি থেকে খাবার চুরি করতুম, তা সৎমা জানত। কেউ বোধহয় সেসব দেকেই বুদ্ধি দিয়েচিল। পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে ষড় করে থানায় তুলে নিয়ে গেল। তারপর মিথ্যে মিথ্যে করে আরও অনেক চুরির অপবাদ চাপাল। জেলে চলে গেলাম।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী! একদিন সকালে জেল থেকে মুরগির পালের মতো জাহাজে তুলল। একেনে আসতে হবে। এসে গেলাম।’
সেদিন নীলা চুপ করে ভাবছিল। যমুনার স্বামী পরেশরাম জাহাজে খালাসির কাজ করে। স্বাবলম্বন গ্রামের সবাই জানে, সে একটা পাক্কা শয়তান। এমন কোনও দোষ নেই, যা লোকটার নেই। রোজগারের টাকা একদিনেই শেষ করে ফেলে। সকলের কাছে ধার। প্রায় সন্ধ্যাতেই ওদের বাড়ি থেকে যমুনার আর্তনাদ ভেসে আসে। নেশা করে এসে পরেশরাম বেধড়ক পেটায় স্ত্রীকে। কে কী বলবে? এখানে না আছে কোনও আত্মীয়স্বজন, না আছে কোনও কুটুম্ব। এখানে সবই ছাড়া ছাড়া। ও মৃদুস্বরে বলেছিল, ‘বে’ করার আর লোক পেলি না?’
যমুনা কোলের মেয়ের মুখে স্তনবৃন্ত গুঁজে দিতে দিতে ম্লান হেসেছিল, ‘সবই কপাল গো দিদি!’
ছায়ামূর্তিটা দীর্ঘতর হতে নীলা বর্তমানে ফিরে এল। যমুনার আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ, কারণ গতকাল থেকে তার শরীর বেশ খারাপ। বারেবারে বমি। খিদে নেই। দুপুরবেলা নীলা গিয়ে খাবার দিয়ে এসেছে।
তবে? কে এল? চাঁদুমাসি? মাঝেমাঝেই চন্দ্রপ্রভা আর তার কয়েকজন সঙ্গীসাথী এসে জুলুম চালায়। যমুনার কাছে শুনেছে, কোনও নতুন মেয়ে বিয়ে হয়ে এলেই নাকি ওরা অমন করে। সোজা এসে হেঁশেলে ঢুকে যায়। নানারকম হুকুম করে। সঙ্গে আদিরসাত্মক রসিকতা, অশ্লীল ইঙ্গিত তো আছেই। ওদের দলে ভিড়লে তবেই মিলবে ছাড়, নাহলে ওই লাঞ্ছনা চলতেই থাকবে। আগেরদিন ইচ্ছে করে নীলাকে অন্যমনস্ক করে দিয়ে দুটো রান্নার পদে গোবর ফেলে দিয়ে খাবারগুলো নষ্ট করেছে। আজ আর নীলা তেমনটা কিছুতেই হতে দেবে না।
তবে ওরা এলে বাড়ির বাইরে থেকেই হুজ্জতি লাগিয়ে দেয়। অন্য কোনও লোক বদমতলবে ঢুকছে না তো?
দুরু দুরু বুকে তক্তার পাশে রাখা কঞ্চিটা হাতে নিয়ে ও এগিয়ে গেল।
‘কে?’
পুরুষকণ্ঠে উত্তর ভেসে এল, ‘আমি।’
নীলা কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারল। শেখর যতক্ষণে ঘরে ঢুকে এল, ততক্ষণে ও কঞ্চিটা নামিয়ে ফেলেছে নীচে। পিদিমের আলো উঁচু করে দেখল, শেখরের চুল উসকোখুসকো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। প্রদীপের হলুদ আভায় সে প্রথমে কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে রইল।
ভরভরন্ত মুখ। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। হাতে শাঁখা পলা। কাপড়ের নীচ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে অলক্তকরঞ্জিত পা দুটো। শেখর জোর করে চোখ সরাল। সামনের মেয়েটি সম্পর্কে ওর জেঠিমা হয়। সেই সম্বোধনই কি করা উচিত?
‘কেমন আছিস, নীলু?’
নীলু! এই ডাকটা কতদিন পর শুনল নীলা? নীলু নামটা শুনলেই যেন মন ছুটে চলে যায় সেই খুলনার শ্রীফলতলা গ্রামে। এক্কাদোক্কা। কুতকুত। কানামাছি। জোল্লাভাতি। কতরকম খেলা। ইন্দ্রদাদা।
নিজের মনেই হেসে ফেলল নীলা। ভাগ্যের কী অদ্ভুত পরিহাস! ওদের ওই ছোট্ট গ্রাম শ্রীফলতলা, সেখানকার তিনজনই আজ এই কালাপানির নোনা দ্বীপে।
না। তিনজন কি না এখনও অবশ্য ও জানে না। দীর্ঘশ্বাস চেপে ও বলল, ‘ভাল। বোসো।’
শেখর আড়ষ্টভাবে দরজার পাশে রাখা কেদারাটায় বসল। একটা সময় ছিল, যখন এই শেখরদার সঙ্গে নিত্যদিন ঝগড়া বাধত নীলা আর জগুর। শেখর বরাবরই ডানপিটে গোছের। নিন্দুকেরা বলত, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। সত্যিই যেন তাই। ভবানী বাঁড়াজ্জের মতো হাড়কৃপণ বৈষয়িক লোকের ছেলে যে অমন দয়ালু হবে, কে জানত? শেখরদাদা আর ইন্দ্রদাদা ছিল হরিহর আত্মা। অথচ দু’জনের স্বভাবে কোনও মিলই ছিল না। শেখরদা হুল্লোড়ে। ইন্দ্রদাদা শান্ত। পুকুরের মতো স্নিগ্ধ।
শেখর ওর চোখের দিকে তাকাল, ‘জ্যাঠা বলল, তুই আমায় ডেকেছিস!’
‘হ্যাঁ।’
‘কী দরকার, বল।’
নীলা ভনিতা না করে বলল, ‘যমুনা বলচিল, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে ঝি লাগবে। আমায় এট্টু কাজে লাগিয়ে দেবে?’
‘ঝি?’ শেখর বিস্মিত চোখে তাকাল, ‘তুই ঝিয়ের কাজ করবি কেন? জ্যাঠা তো ছাত্র ঠেঙিয়ে ভালই মাসোহারা পান সরকারের থেকে।’
‘আমার সময় কাটে না সারাদিন।’ নীলা কাঁধ ঝাঁকাল, ‘তুমি তো পানিওয়ালার কাজ করো। অনেকের সঙ্গে চেনাপরিচিতি আছে। যদি কাউকে বলে…!’
শেখর কিছু না বলে চুপ করে রইল। নীলা তাকে পানিওয়ালা বলল বটে, কিন্তু সে নিজে মোটেই জল দেয় না বাড়িতে বাড়িতে। তার অধীনে এখন তিনজন ছোকরা আছে। তারা সেই কাজ করে। এখানে পানীয় জলের বড় কষ্ট। সেলুলার জেল তৈরি হওয়ার আগে যখন বন্দিরা মুক্ত থাকত, তখন তারাই পানিঘাটা থেকে জল সরবরাহের কাজ করত। কিন্তু এখন তা আর হয় না।
পানিঘাটা রয়েছে এক দ্বীপে, সেখান থেকে জল নিয়ে পৌঁছে দিতে হয় অন্য দ্বীপগুলোয়। সাহেবদের আবাস রস আইল্যান্ড থেকে হ্যারিয়েট হিলের চূড়া, সেলুলার জেল থেকে ভাইপার আইল্যান্ড। শেখরের তত্ত্বাবধানে লোটা লোটা পানি পৌঁছয় সর্বত্র। বেশ লাভজনক এই ধান্দা।
জেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে কিছুদিন এদিক ওদিক কাজ করেছিল শেখর। কাঠচেরাই কল। চাষবাস। সরকারের দেওয়া ক’টা ছাগল ও পুষেছিল। কিন্তু সে-সবে মন লাগেনি। ওর স্বভাব চঞ্চল। একজায়গায় থিতু হয়ে বসে কাজ করা পোষায় না। তারপর কয়েকমাস রিকশা চালাচ্ছিল। রস আইল্যান্ডে এক মেমসাহেবকে নিয়ে পাহাড়ের উঁচু নিচু পথে ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু সেও বড় একঘেয়ে।
অবশেষে জাহাজঘাটার এক বুড়ো এই বুদ্ধি দিল। সে বুড়োর নাম রহমান। আন্দামানে একেবারে প্রথমদিককার আমদানি সে। যৌবনে সে ছিল সিপাহি বিদ্রোহের সৈনিক। দীর্ঘদিন জেল খাটার পর মুক্তি পেয়ে জাহাজঘাটাতেই সে দোকান খুলে বসেছে। শাঁখের মালা। ঝিনুক। প্রবালের খেলনা। এসবের পসরা সাজিয়ে বসে নিত্যদিন।
সেই রহমানচাচাই বলেছিল, ‘পানিওয়ালেকা ইজারা লিজিয়ে শেখরভাই। প্যায়সা আয়গা ছপ্পর ফাড়কে।’
রহমানচাচা ভুল কিছু বলেনি। এই কয়েকদিনেই শেখরের ভাল লাভ হচ্ছে। যোগাযোগও হয়েছে বিস্তর। নীলাকে সাহেবদের বাড়ি কাজে লাগানো ওর কাছে কোনও ব্যাপার না। কিন্তু ও দৃঢ়ভাবে মাথা ঝাঁকাল, ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাড়িতে কাজ করা যাবে না।’
‘কেন?’
‘কোলফিল্ড সাহেব লোক ভাল না, নীলু। চরিত্রের দোষ আছে।’
নীলা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল শেখরের দিকে। তারপর হাসল, ‘শেখরদা, আমি আর সেই শ্রীফলতলা গাঁয়ের ছোট নীলু নেই। আমি নিজেও পোড়খাওয়া মাগি, খুনের আসামি। দোষ কি আমার নেই?’
শেখর হাতদুটো মাথার পেছনে হেলান দিল, ‘তুই খুন করেছিস, সেটা আমি নিজের চোখে দেখলেও বিশ্বাস করব না নীলু! গাঁয়ের বকনা বাছুর, নেড়ি কুকুর, ছাগলগুলোর প্রতি তোর যা মায়া ছিল, তা আর কারুর মধ্যে দেখিনি। সবাইকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতিস তুই।’
নীলা ম্লান হাসল, ‘মানুষ কি চিরকাল একরকম থাকে শেখরদাদা? থাকে না। মানুষ বদলে যায়। আজ যার জন্য মায়া উপচে পড়ে, কাল তার জন্য ছিটেফোঁটাও টান থাকে না। আজ যে তোমায় পাগলের মতো ভালবেসে হাতটা এসে ধরে, কাল সে তোমায় তার জীবনে নাও চাইতে পারে। আজ যাকে দেখে তোমার মুখে হাসি ফোটে, কাল তার চোখের জলে তোমার কোনও ভ্রুক্ষেপ নাই হতে পারে। মানুষ বদলায়, শেখরদাদা। মানুষের মন বদলায়। চারপাশের পৃথিবী তাকে কোমলতা দিলে সে কোমল হয়। রুক্ষতা দিলে রুক্ষ। মায়া মমতা ভালবাসা ভারি সুন্দর জিনিস, শেখরদাদা। কিন্তু চিরকালীন নয়। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির সঙ্গে পালটায়। আমিও পালটে গেছি।’
শেখর নীলার জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই সত্যিই খুন করেছিলি, নীলু?’
নীলা সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল, ‘তুমিও কি সত্যিই বোমা ফেলেছিলে?’
‘না। ফেলতে পারলাম কই। আনাড়ি হাতে তৈরি, বোমা তো ফাটেইনি রে। তবু বোমা নকল হলেও ষড়যন্ত্রটা তো নকল ছিল না, তাই তো এখানে আসা। আমার কথা ছাড়। তুই বল। সত্যিই খুন করেছিলি?’
শেখরের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল, নীলার চোখে হু হু করে জল এসে গেল। মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ও বলল, ‘করেছিলাম তো বটেই। নিজেকেই নিজে খুন করেছিলাম। শ্রীফলতলা গাঁয়ের সেই নীলাকে টুঁটি টিপে খুন করেছিলাম, শেখরদাদা!’
‘আর সেই বাচ্চাটাকে?’
নীলা লালচোখে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত আগে যে গালে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু, এখন সেখানে টলটল করছে হাসি। চোখের পাতায় আটকে রয়েছে কয়েকটা মুক্তো। স্মৃতি উল্কার গতিতে পিছিয়ে যাচ্ছিল। আন্দামান। বঙ্গোপসাগর। স্মৃতিকোষ পিছিয়ে যাচ্ছে। কলকাতার সেই ঘিঞ্জি গলি। ফুটিফাটা টিনের চালের বাড়ি। পাওনাদারদের তাগাদা। কুপ্রস্তাব। এক থালা গরম ভাতের জন্য কচি স্বরের কান্না।
দুটো ছোট ছোট হাত। ছোট্ট একটা শরীর।
আবহাওয়া খুব ভারী হয়ে উঠছিল, ঘরের ভেতর ভ্যাপসা গরম। শেখরের ইচ্ছে করছিল, নীলার পাশে পাশে বাইরের উন্মুক্ত বীথিকায় হাঁটতে। কোনও কথা নয়। শুধু পথ চলা।
কিন্তু আজ আর তা সম্ভব নয়। নীলা অন্যের স্ত্রী। ও আবার বলল, ‘বল না! তুই নাকি তোর সতীনের বাচ্চাটাকে …।’
‘ওসব কথা থাক শেখরদা। আমি বাইরে বেরিয়েছি শুধু সংসার করতে নয়।’
‘তবে?’
নীলা ওর চোখে চোখ রাখল, ‘তোমাদের কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়তে।’
ইন্দুভূষণ গোগ্রাসে খাচ্ছিল। একটা নারকেল মালার অর্ধেক আয়তনের টিনের কৌটো বারবার উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছিল মুখগহ্বরে। যদি আর কয়েক ফোঁটাও পেটে যায়। কিন্তু, না। কৌটোটার মধ্যে আর একটুও কিছু পড়ে নেই।
হতাশ হয়ে ইন্দু কৌটোটাকে সরিয়ে রাখল। সকালবেলাটা ওর চরচরিয়ে খিদে পায়। খুলনায় থাকতে ভোরবেলা কয়েক ক্রোশ হনহন করে হেঁটে আসত। মা দুধ চিঁড়ে আমসত্ত্ব মেখে রাখতেন, মুহূর্তের মধ্যে এসে থালা সাফ করে দিত। তারপর কলকাতায় এসে যখন চলে এল মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে, সেখানেও হেঁটে এসে গরম গরম রুটি খেত।
আর এখানে? যেসময়টায় ওর পেট আগুনের মতো জ্বলছে, তখন বরাদ্দ শুধু এক কৌটো কঞ্জি। কঞ্জি মানে ভাতের মাড়। তাতে না আছে নুন। না আছে কোনও স্বাদ। খেতে গেলে বমি এসে যায়।
তবু খেতে হয়। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। ওর কুঠুরির নম্বর ৩১৫৫৫। সেলের দু’পাশে দুই সাধারণ বন্দি। একজনের নাম মকবুল। অন্যজন হল ফণীভূষণ। তবে এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। ফণীভূষণ সাধারণ কয়েদি হলেও সে একসময় যুগান্তর দলে কয়েকদিন ভিড়েছিল।
ইন্দুভূষণ তো শুনেই অবাক, ‘সেকী! তুমি তাহলে আমাদের হেমদাদাকে আগে থেকেই চেনো?’
‘হ্যাঁ।’ ফণীভূষণ গলায় ঢকঢক করে কঞ্জি ঢালার আগে ফিচেল হাসে, ‘কিন্তু পরে অন্যদিকে মন চলে গিয়েছিল। ধরা পড়েছি লোভে পড়ে ডাকাতি করতে গিয়েই। তবে তাতে একরকম ভালই হয়েছে।’
‘কী ভাল হল?’
‘বাহ, আমি যদি রাজবন্দি হয়ে এখানে আসতুম, তবে কি তোমার সঙ্গে দেখা হত? তোমাকে ওই মুলুকে, আমাকে এই মুলুক রেখে দিত। ঠিক কথা কি না বলো।’
‘ঠিক।’ ইন্দুভূষণের সেদিন মজাই লাগছিল।
‘তবে? তুমিও ভূষণ। আমিও ভূষণ। তুমি হলে চাঁদের, আমি হলুম গিয়ে সাপের।’ ফণীভূষণ চোখ টিপেছিল, ‘চুপচাপ দেখতে থাকো।’
কী দেখবে, সেদিন বোঝেনি ইন্দু। বুঝেছিল বেশ কয়েকদিন পর। এই মকবুল আর ফণীভূষণ হল রাজবন্দিদের মধ্যে যোগসূত্র। শুধু রাজবন্দি নয়। বাইরের গ্রামে যে মুক্ত কয়েদিরা সংসার করছে, তাদের সঙ্গেও এদের নিয়মিত যোগাযোগ।
ফণীভূষণ ওর বেশ খেয়াল রাখে। ঘোরে ফেরে আর বলে, ‘ও চাঁদের ভূষণ, কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
ইন্দু হতাশ মুখে দু’দিকের দেওয়ালের দিকে তাকাল। ফণীভূষণ আর মকবুল নেই। কাজ থেকে এখনও ফেরেনি। ওরা থাকলে হয়তো কিছু একটা হিল্লে হলেও হতে পারত।
খিদে অর্ধেক মিটলে কেমন যেন ঘুম পায়। কিন্তু এখন ঘুমনোর উপায় নেই। এখুনি ওকে যেতে হবে তেলের ঘানিতে সর্ষে পেষাই করার কাজে। সে এক ভয়ানক কাজ। দেশে থাকার সময় ও কোনওদিনও জানতই না যে তেলের ঘানি দু’রকমের হয়। হাতঘানি আর গোঘানি। যেদিন ওর হাতঘানিতে ডিউটি পড়ে, সেদিন সারাদিন ধরে একটা সেলের মধ্যে ঢুকে ঘানির কলের চাকা ঘুরিয়ে যেতে হয়। কলটা লাগানো থাকে বাইরের দেওয়ালে, সেখানে কতটা তেল হচ্ছে না হচ্ছে, সর্ষে আছে না নেই, ভেতর থেকে কিছুই দেখা যায় না। অক্লান্তভাবে ভেতর থেকে চাকা ঘোরাতে হয়। দিনের শেষে দশ পাউন্ড তেল না হলেই শাস্তি।
হাতঘানি তবু একরকম, গোঘানির কথা ভাবলে ও মধ্যরাতেও আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। ছোটবেলায় কলুর বাড়িতে কতবার গেছে, দেখেছে ঘানিতে ঘুরছে গরু। কোনওদিনও ভেবেছে, সেই গরুর জায়গায় তেল পিষতে হবে ওকে? জোয়ালের মতো একটা প্রকাণ্ড বাঁশ, সেই বাঁশ দু’জনকে বেঁধে নিতে হবে কোমরে, তারপর সমানে ঘুরে যেতে হবে। প্রচণ্ড সেই চাপে কোমরের হাড় ভেঙে যায় প্রায়। ওদিকে পেছন থেকে ঠেলবে একজন। সর্ষে খোঁচাবে আরেকজন।
প্রথম যেদিন ইন্দু এসেছিল, দেখেছিল, পাঞ্জাবের দশাসই চেহারার কয়েদিরাও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে এই গোঘানিতে। থামার উপায় নেই। প্রতিদিন ত্রিশ পাউন্ড তেল বের করতেই হবে। সামনে সর্বক্ষণ প্রহরায় দু’জন পাঠান পেটি অফিসার। ঘুরতে ঘুরতে একমুহূর্তের জন্য থামলেই নাকে ঘুসি। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। পাঞ্জাবি পাঠান বেলুচি হিন্দি মিশ্রিত সেই অকথ্য সম্বোধনে শরীর না চললেও চালাতে হয়।
প্রথমদিন কাজ ভাগবাঁটোয়ারার সময় ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিল ফণীভূষণ। ওর দিকে আলতো ঝুঁকে ফিসফিস করেছিল, তোমার তো এখনও কুড়ি হয়নি?’
‘না। সবে উনিশ পুরেছে গো।’
‘তবে তোমার চিন্তা নেই। ইংরেজ জেলের নিয়ম হল, কুড়ি বছরের নীচে কঠিন পরিশ্রমের কাজ দেওয়া হবে না।’
কিন্তু কোথায় বাঁচল ইন্দু? ইংরেজদের নিয়মকানুন একদিকে, আর কালাপানির জেল অন্যদিকে। এ এক আলাদা পৃথিবী, যেখানে মানবিকতা, সহানুভূতি, ন্যায়ের কোনও সমীকরণই খাটে না। এখানে সাধারণ কয়েদিরা অসুস্থ হলে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় জেলের হাসপাতালে। কিন্তু রাজবন্দিদের জন্য সেইসব ব্যবস্থা নেই। একদল শিক্ষিত ভদ্রঘরের ছেলে দেশনেতাদের কথায় উজ্জীবিত হয়ে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এই ছিল তাদের দোষ। যেভাবে হোক, তাদের মেরুদণ্ডের হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে হবে।
জেলের ডাক্তার প্রথমদিন রুটিন পরীক্ষা করে বারীন আর অবিনাশের রিপোর্টে লিখেছিলেন, ‘poor physique– fit for light labour –convalescent gang.’ দু’জনেই রোগাপাতলা। বাকি সকলের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল hard labour. কুড়ি বছরের নীচে hard labour না দেওয়ার আইনে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ইন্দুসমেত সকলের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছিল। গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল কাঠের ফলকে। তাতে লেখা ‘D’।
‘D’ মানে কী গো হেমদাদা?’ ইন্দুভূষণ সেদিন সবার আড়ালে সতর্কচোখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হেমদাদাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘Dangerous’. হেমদাদা আবার তেরচা হেসেছিল, ‘যারা আমাদের উসকালেন, তাঁরা এখন দেশে বসে মৌজ করছেন। কেউ কেউ সাধু হয়েছেন। আর আমরা এখন এখানে কিনা ডেঞ্জারাস। নামেই ডেঞ্জারাস আসলে লেজ নাড়া কুত্তা।’
জাহাজে ওঠার পর থেকেই ইন্দু লক্ষ্য করেছিল, হেমদাদার অসম্ভব রাগ জন্মেছে নেতাদের ওপর। বারবার বলছিল, ‘তোরা একেকটা নির্বোধ শিরোমণি।’
‘কেন গো হেমদাদা?’
‘এই কচি বয়সে নেতাদের কথায় বোমা বাঁধতে লেগে পড়লি। কই, কোনও নেতা জেল খাটতে এসেছে? আসেনি। নিজেদের ছেলেমেয়েদের কাউকে পাঠিয়েছে সাহেবদের গায়ে বোমা ফেলতে? পাঠায়নি। কিন্তু তোরা দ্যাখ। ক্ষুদিরাম নামের বাচ্চা ছেলেটা ট্রেনিং নেই কিছু নেই, বোমা ফেলতে চলে গেল। নেতারা একবারও ভাবলেন যে, ওইটুকু দুধের ছেলেটাকে পাঠাব কেন? আবেগ আর ভালবাসা দিয়েই কি সব হয়? আবেগ আছে, ভালবাসা আছে, এদিকে শিক্ষা নেই, যুক্তি নেই, তাদের বলির পাঁঠাই হতে হয়। যেমন তোরা হয়েছিস।’
ইন্দুভূষণ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘কেন, বারীনদা তো এসেছে আমাদের সঙ্গেই!’
‘এসেছে বলিস না। বল ফেঁসেছে। ভুল করে ফেঁসে গেছে। তার সেজদাদার মতো সেয়ানা তো নয়, তাই।’
ইন্দুভূষণের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। হেমদাদা বারীনদাদাকে নিয়ে নিন্দেমন্দ করছেন তবু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু বারীনদাদার সেজদা’কে নিয়ে? আসমুদ্র হিমাচল যাঁকে সম্মান করে, সেই অরবিন্দ ঘোষকে?
ওয়ার্ডারের ক্রমাগত তর্জন-গর্জনে ও বাস্তবে ফিরে এল। ম্লানমুখে ওয়ার্ডারের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে লাগল বাইরের করিডরের দিকে। তেলের ঘানিতে ঘোরার সময় যে অসহ্য কষ্ট হয়, তার একটা উপায় বাতলেছিল কাল উল্লাসদাদা। ভোরবেলা প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়ে জমাদারদের চোখ এড়িয়ে যতটুকু আকারে ইশারায় কথা হয়, তার মধ্যেই ফিসফিস করেছিল।
‘কষ্ট যা হয়, তা তোর শরীরে। স্থূল দেহে। স্থূল দেহ থেকে সূক্ষ্ম দেহটুকুকে আলাদা করে ফেলবি। তাহলেই দেখবি, কোনও কষ্ট হবে না।’
অত নজরদারির মধ্যে এর বেশি কথা এগোয়নি। সূক্ষ্ম দেহ মানে তো মন। শারীরিক জ্বালাযন্ত্রণা হওয়ার সময় মনকে আলাদা করবে কী করে? গভীর চিন্তায় মনকে ব্যস্ত রেখে।
ইন্দু ঘানিতে গিয়ে নিজের কোমরে দড়ি বেঁধে নিল। তারপর সেই দড়ির গিঁট দিল ঘানিতে আটকানো বাঁশে। বাকি তিনজন কয়েদিও এসে পড়েছে। এরা কেউই রাজবন্দি নয়। ব্যারি সাহেবের কড়া হুকুম, রাজবন্দিদের এমনভাবে ডিউটি ফেলতে হবে, যাতে তারা কাছাকাছি আসতে না পারে। উল্লাসদাদারা আজ কোনদিকে কে জানে? ইন্দু এদিক ওদিক চেয়ে থেমে গেল। আজ ঘানির ডিউটিতে যমদূতসম প্রহরী মহম্মদ শাহ। সে জুলজুল করে দেখছে ইন্দুর দিকে। দেখুক। ইন্দু ধীরে ধীরে ঘানি টানার কাজ শুরু করল।
কী ভাববে ও? মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ির কথা ভাবলে কেমন হয়? কী মজার আর রোমাঞ্চের যে ছিল দিনগুলো!
কলেজ স্কোয়্যারে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিকেলে গিয়ে বসে থাকত ইন্দু। তেমনই কথায় কথায় আলাপ একদিন হয়েছিল বারীনদাদার সঙ্গে। ওর আগ্রহ দেখে বারীনদাদা ওকে নিয়ে গিয়েছিল মুরারিপুকুরে।
৩২ নম্বর মুরারিপুকুর। মানিকতলার কাছেই। সদর রাস্তা থেকে গলি। কয়েক পা এগোলেই প্রকাণ্ড জায়গা জুড়ে আমবাগান। মাঝে একটা পাকা বাড়ি। বাগানবাড়িতে ঢোকার আগে গেট। গেটের দু’ধারে পিলার।
‘এটা কার বাড়ি গো?’
‘আমার পিতৃদেবের।’ বারীনদা হেসেছিল।
‘তুমি নাকি বিলেতে জন্মেছ?’
‘তোরা যাকে বিলেত বলিস, তাতে জন্মেছি কি না জানি না, তবে ইংল্যান্ডের একটা গ্রামে জন্মেছি বটে।’
ইন্দুভূষণ চুপ করে গিয়েছিল। বারীনদাদা ধনীপরিবারের সন্তান। ওর মতো অস্তাচলের প্রাচীন কুসংস্কারে নিমজ্জিত জমিদারবংশ নয়, শিক্ষিত উদারমনা উচ্চবিত্ত পরিবার। বারীনদাদার বাবা ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ নামকরা ডাক্তার, বিলেতে প্যাকটিস করেছেন বহুবছর। একসময় ইন্দুদের খুলনাতেও ডাক্তারি করেছেন। ডাঃ কে ডি ঘোষের নামে লোকে কপালে দু’হাত ঠেকায়। বারীনদাদার মা’ও বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক রাজনারায়ণ বসুর কন্যা। বারীনদাদার মেজদা মনোমোহন ঘোষ ইংরেজির পণ্ডিত, প্রেসিডেন্সিতে পড়ান। আর সেজদাদা অরবিন্দকে তো আসমুদ্রহিমাচল চেনে। একদিকে গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ফরাসি জানা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। অসাধারণ বাগ্মী। স্কুল-কলেজের কত ছেলে যে তাঁর বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দিয়েছে!
কত আলোকপ্রাপ্ত পরিবারের সন্তান বারীনদাদা। ইন্দু শ্রদ্ধাভরে আড়চোখে তাকায়। এমন একটি মানুষের সাহচর্য পাচ্ছে ও। এ কি কম সৌভাগ্যের কথা?
বাগানবাড়িতে ঢুকে ও আরও অভিভূত হয়ে পড়েছিল। বারীনদাদা এখানে এক অদ্ভুত আশ্রম গড়েছে। কুড়ি-পঁচিশজন ছেলে থাকে। নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে তারা। একদিকে নিজেরা তরিতরকারির চাষ করে, হাঁস মুরগি পোষে। অন্যদিকে বেদ পড়ে। বেদের আদর্শে চলে নিজেদের চরিত্রগঠন। শরীরচর্চা। ধর্মশাস্ত্র আলোচনা। ইতিহাস।
একে একে আলাপ হয়েছিল উপেনদাদা, অবিনাশদাদার সঙ্গে। শেষে উল্লাসদাদা। উল্লাসদাদার হা হা করে উদাত্ত হাসি, প্রাণখোলা গান আর আমুদে স্বভাবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ইন্দুর সে বড় আপন হয়ে গিয়েছিল।
বারীনদাদা আগেই ওকে জানিয়েছিল, পাড়ার লোকের চোখে ধুলো দিতেই এই আশ্রম। আসলে এটা হল গুপ্ত বোমা কারখানা।
‘বোমা?’ ইন্দু অবাক চোখে তাকিয়েছিল, ‘এখানে বোমা তৈরি হয়?’
‘হুঁ।’ বারীনদা চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে ওর চোখে চোখ রেখেছিল, ‘উল্লাসকে দেখছ তো? ওর শিবপুরের বাড়িতে ছোটখাট একটা কেমিস্ট্রির ল্যাব আছে। ও-ই শেখায়। এছাড়া আমাদের আরেকজন ফ্রান্সে গেছে বোমা বাঁধা শিখতে। লোকে জানে অবশ্য সে আঁকা শিখতে গেছে। হেমচন্দ্র। সে ফিরে এলে আরও ভাল বোমা বাঁধা যাবে।’
‘এইসব বোমা নিয়ে কী করা হয়?’ ঢোঁক গিলেছিল ইন্দু।
‘যারা আমাদের শত্রু, তাদের ওপর ফেলা হয়।’ বারীনদা তীক্ষ্ণচোখে ওর দিকে চেয়ে ছিল। যেন জল মাপছিল। বুঝতে চাইছিল ইন্দুর ভেতরটাকে। বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই চারপাশে।
ইন্দু বলেছিল, ‘ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজার কয়েকদিন আগে যে দার্জিলিং থেকে কলকাতায় এলেন, চন্দননগরে নাকি রেললাইনের পাশে বোমা ফেটেছিল, তোমরা করেছিলে?’
‘চন্দননগর নয়, মানকুণ্ডু।’ বারীনদা কিছু বলার আগেই পাশ থেকে উল্লাসদা চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘আমি বারীন উপেন হৃষীকেশ সত্যানন্দ আর নরেন। প্রথমে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে গেলাম চন্দননগর। সেখানে থেকে রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম মানকুণ্ডুতে। নির্জন জায়গা খুঁজতে হচ্ছিল। তা কৌতূহলী লোকজনের তো অভাব নেই। মাইন যে বসাব, একখানা ভাল জায়গা খুঁজে পেলাম না। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছিল। ট্রেন আসার হুইসলও বেজে গিয়েছে।’
‘তারপর?’ উত্তেজনায় ইন্দুর গলা কাঁপছিল।
‘ট্রেন যখন এসেই পড়েছে, বাধ্য হয়ে তার ওপরেই ক’টা ডিনামাইটের স্টিক ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। ফটফট করে ফেটেছিল। ক্ষতি কিছু হল না।’ উল্লাসদা বলল, ‘ছোটলাট দিব্যি কলকাতায় চলে এলেন। দু’দিন থাকবেন কলকাতায়। তারপর আবার যাবেন বিহার। আমরা তখন আবার গেলাম মানকুণ্ডুর ওখানটা। ফাঁকা জায়গা খুঁজে রেললাইনে স্লিপারের তলায় বসিয়ে দিলাম মাইন। ট্রেনের চাকা গড়িয়ে এলেই লাটসাহেব স্বর্গে। থুড়ি হেভেনে।’
‘তারপর ট্রেন এল?’
‘না। সে রাতে ট্রেনই এল না।’
যাহ।’ ইন্দুর কচি মুখটা নিভে গেল, ‘সব চেষ্টা জলে গেল।’
বারীনদা ওকে দেখছিল, ‘যদি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাও, এত অল্পেই হাল ছাড়লে চলবে না ভায়া! তুমি কি ভাবছ একবারেই সাফল্য আসবে? সাফল্য কখনও সহজে আসে না। হাজারখানা চেষ্টার ইট দিয়ে আস্তে আস্তে তৈরি হয় সাফল্য। পূর্ণ হয় অভীষ্ট। অ্যান্ড্রু ফ্রেজার তারপর আবার গেল উড়িষ্যায়। তিনদিন পর যখন কলকাতা ফিরছে, আমরা ঠিক করলাম মাইন বসাব খড়গপুরের কাছে। জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। নাম নারায়ণগড়। ট্রেন আসার আগের দিন পাঁচঘণ্টা ধরে মাইন বসাল উল্লাস। সঙ্গে বিভূতি আর সত্যানন্দ। পরেরদিন ট্রেন যখন আসবে, ফিউজ লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেই ট্রেন যাবে উড়ে।’
‘তারপর?’
‘পরেরদিন সকাল থেকে উল্লাসের এল ধুম জ্বর। চোখ লাল। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। এদিকে ও যাবেই। আমি কিছুতেই ওকে যেতে দিলাম না। বিভূতি আর প্রফুল্ল গেল। আসল কাজ তো উল্লাস সেরেই এসেছিল। শুধু ফিউজে আগুন দেওয়া। তাই হল। মাইনে চাকা পড়তেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ইঞ্জিন লাফিয়ে উঠল এক হাত।’ বারীনদার মুখে বিমর্ষতার ছায়া পড়ল, ‘কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। ট্রেন লাইন থেকে সরল না। থেমে গেল। স্লিপারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো। বিরাট গর্ত হয়ে গেছে লাইনের নীচে।’
‘তারপর কী হল?’
‘লাটসাহেবের ট্রেন বলে কথা। সঙ্গে সঙ্গে খড়গপুর থেকে এক্সপার্টরা চলে এল। তারা দেখেই বুঝল, এ রীতিমতো প্ল্যান করে করা। ছোটলাটের বাঁচার কথাই ছিল না। বেঁচে গেছে এটাই আশ্চর্য। তদন্ত শুরু হল। আটজন কুলিকে অ্যারেস্ট করা হল। তারা নাকি আবার অপরাধ কবুলও করে ফেলল।’ বারীনদা হেসে ফেলল, সরকারের ‘ব্রিটিশদের বিচারব্যবস্থা বুঝতে পারছ কেমনতরো?’
পাশ থেকে উল্লাসদা মাথা নাড়ল, ‘জনসাধারণকে কনভিন্স করার জন্য অতগুলো নির্দোষ মানুষকে জোর করে এবার জেল খাটাবে। ওদের তো কোনও দোষ নেই!’
বারীনদা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, ‘বড় কাজ করতে গেলে অত ভাবলে চলে না! ইন্দ্রভূষণ, তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল তুমি পারবে। তাই তোমায় নিয়ে এসেছি। সবই তো দেখলে বুঝলে। এখানে আমরা নিজেরা রাঁধি। নিজেরা খাই। হাতে পয়সা নেই। কিছু ধনী ব্যক্তি আমাদের সাহায্য করেন। তাই নিয়েই চলছে। তুমি যদি চাও, তোমার মেসের পাট চুকিয়ে এখানে চলে আসতে পারো। আগুপিছু ভাবলে চলবে না। ভারতমায়ের জন্য কাজ করতে হবে। পিছিয়ে গেলে হবে না। দীক্ষা নিতে হবে আমাদের মন্ত্র আদর্শে। বলো, তুমি কি পারবে?’
বলাবলির কিছু ছিল না সেদিন ইন্দুর। রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। একদিনের মধ্যে বাগানে চলে এসেছিল ও। শুরু হয়েছিল নতুন জীবন।
তন্ময় হয়ে ভাবছিল ইন্দুভূষণ। সূক্ষ্ম শরীরটাকে স্থূল শরীরের আঘাতজর্জরতা থেকে যেন আলাদা করে ফেলতে পেরেছিল ও। মনে হচ্ছিল, আর কোনওদিন কোনও চাবুকের ঘা, লাথি, ঘুসি যন্ত্রণা দিতে পারবে না ওকে। ব্যথা হলেও তা মস্তিষ্কের অনুভূতির কোষে পৌঁছতে দেবে না। আরও পিছিয়ে গেলে কেমন হয়? শ্রীফলতলার বাড়ি? স্কুল? খেলার মাঠ?
উহ! উহ!
নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে এল ওর। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, ওর পায়ের বুড়ো আঙুলদুটো যেন থেঁতলে যাচ্ছে। বাস্তবে ফিরে এসে নীচে তাকাল ও। সত্যিই তাই। থেঁতলে গেছে আঙুলদুটো। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।
সামনে দাঁড়িয়ে লাঠি ঠুকছে মহম্মদ শাহ। ভাবনার জগতে পুরোপুরি ডুবে গিয়ে ইন্দু দাঁড়িয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য।
চোখাচোখি হওয়ামাত্র ওর বাঁদিকের চোয়াল বরাবর ধেয়ে এল প্রকাণ্ড একটা ঘুসি!
ঠিক সকাল আটটার সময় সেন্ট্রাল টাওয়ারে ঘণ্টা বাজে। ঢং ঢং। পুষ্প ছুটতে ছুটতে যখন হাসপাতালে ঢোকে, ততক্ষণে কম্পাউন্ডার লালমোহন সাহা চলে এসেছে। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মেজাজ বিগড়ে যায়, মনে হয় সারাদিনের জন্য দিনটা খারাপ হয়ে গেল। লালমোহন সাহাও তেমনই একজন। রোগা লম্বাটে গড়ন। কুতকুতে ধূর্ত চোখ। মুখে সবসময় একটা বাঁকা হাসি। পুষ্পকে ঢুকতে দেখেই সে অবজ্ঞার হাসি হাসল, ‘কীরে লবাবের বেটি। এতক্ষণে আসার সময় হল?’
পুষ্প না শোনার ভান করল। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হাসপাতালের একদিকের ছাদ ফেটে সেখান দিয়ে জল ঝরছে। নোনাধরা দেওয়াল। কে বলবে, মাত্র কয়েকবছর হল এই হাসপাতাল তৈরি হয়েছে।
বৃষ্টির ফোঁটা টপটপ করে পড়ছে একজন রুগির পেটের ওপর। ও দ্রুত এগিয়ে গেল। রুগিটা ঘুমোচ্ছিল, পেটের কাপড় ভিজে যে সপসপে হয়ে উঠেছে, সে খেয়াল নেই। ও ঝুঁকে পড়ে বেডটাকে সরাতে যেতেই সে জেগে উঠল।
পুষ্পর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। এই মুহূর্তে যে সাতজন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, তারা সবাই খুনের আসামি। কিন্তু এই লোকটা যেন ভয়ংকর। যতবার চোখাচোখি হয়েছে, যেন মনে হয়, চোখ দিয়ে চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে পুষ্পর গোটা শরীরটা। ও দ্রুত সেখান থেকে সরে এল। লালমোহনের কাছে এসে বলল, ‘ছ’নম্বরের জামাটা ভিজে গেছে। পালটাতে হবে।’
‘তো পালটাতে হবে তো কম্পাউন্ডার কী করবে?’ খ্যাঁক করে উঠল লালমোহন, ‘তুই রয়েচিস কী জন্য?’
পুষ্প ঢোক গিলল। বছরদুয়েক হল, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ওকে এই হাসপাতালে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাবাকে ওর মনে পড়ে না। মা’র মুখটা আবছা ভাসে স্মৃতিপটে। মা নাকি বাবার গলায় ভোজালির কোপ দিয়েছিল দেশে। তারপর ওকে কোলে নিয়ে জাহাজে উঠেছিল। এখানে আসার পর বেশিদিন বাঁচেনি মা। ঘং ঘং করে কাশত। সমুদ্রপাড়ের বালি বাতাসে উড়ে এলে সেই কাশির মাত্রা বেড়ে যেত। সঙ্গে রক্ত। তারপর একদিন মরে গেল। তখন ওর বয়স পাঁচও পোরেনি। জমাদার দীনবাঈ গিয়ে সাহেবকে বলল, ‘পুষ্প আমাদের কাছেই থাকুক। ও আমাদের বিটির মতো। আমরা ঠিক মানুষ করে দেব।’
তারপর কেটে গেছে প্রায় একযুগ। সেদিনের শিশু পুষ্প আজ সতেরোর যুবতী। মানুষ কি হয়েছে ও? কে জানে! তবে, এই সতেরো বছরের জীবনে বহু অমানুষকেই যে দেখে ফেলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ছোট থেকে মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করতে ভালবাসত ও। জেলের বয়স্কা কয়েদিদের থেকে শিখেছিল নানারকম টোটকা। পথ্য।
যেদিন স্রেফ একখানা নরুন দিয়ে দীনবাঈ জোশীর বাহুমূলে হওয়া প্রকাণ্ড ফোঁড়াটাকে ও কেটেকুটে ঠিক করল, সেদিন দীনবাঈ ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, ‘তু তো কামাল কর দিয়া রে মুলগি!’
পাশ থেকে দীনবাঈয়ের সর্বক্ষণের অনুচর শবনম অনুযোগ করেছিল, ‘বাহ মুলগি কেন হবে, ওর নাম তো পুষ্প!’
‘তু চুপ হো যা বুরবক কাঁহিকা! হামারা গাঁওমে লড়কিকো বোলতি হ্যায় মুলগি। সমঝি?’ দীনবাঈ এক দাবড়ানি দিয়ে পুষ্পর দিকে ফিরেছিল, ‘পুষ্প হাসপাতালে কাম করলে বড়িয়া হবে। সেদিন লালমোহন বলছিল, কোনও ধাই নেই। খুব অসুবিধা।’
তার কয়েকমাস আগেই হাসপাতালের একমাত্র ধাত্রী নিজেই রক্ত আমাশায় ভুগে মারা গিয়েছিল। তার জায়গায় কাজে বহাল হয়েছিল পুষ্প। হাসপাতাল অবশ্য নামেই। জেলের সবথেকে ভঙ্গুর বাড়িটাকে হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে। কোনও মেরামতি নেই। চারজন মাত্র লোক। ডাঃ টেম্পল হলেন হাসপাতালের প্রধান। তিনি পাশ করা ডাক্তার, ইংল্যান্ড থেকে চাকরি পেয়ে এখানে এসেছেন। আন্দামানে বদলি হওয়া ইস্তক তিনি খুবই বিরক্ত, হাসপাতালে আসেন খুব কম।
কম্পাউন্ডার লালমোহন সাহা প্রাক্তন কয়েদি, এখন স্বাবলম্বন গ্রামে থাকে। ওষুধের জোগান আর রুগিদের স্বাস্থ্যের হিসেব রাখা তার কাজ। আর আছে ভীম, সেও অতি ভীষণ চেহারার প্রাক্তন আসামি, তার কাজ হল, এত্তেলা এলে কোনও অসুস্থ বন্দিকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালে নিয়ে আসা। বাকি সব কাজ, ঘর সাফসুতরো থেকে রুগিদের শৌচ সবকিছুর ভার পুষ্পর ওপর।
লালমোহন মুখঝামটা দিলেও পুষ্প সঙ্গে সঙ্গে গেল না। ছ’নম্বরের রুগিটা একটা কামুক পশু। গতকাল শৌচ করার নাম করে পুষ্পকে ডেকেছিল। পুষ্প যাওয়ামাত্র ইচ্ছে করে উঠে বসার নাম করে পুষ্পর বুকে হাত দিচ্ছিল। পুষ্প তৎক্ষণাৎ সরে আসায় বেশি কিছু করতে পারেনি।
বছরখানেক আগেও এমন পরিস্থিতির শিকার হলে পুষ্প কেঁদে ফেলত। ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ত। কিন্তু এই একবছরে ও অনেকটাই পাল্টেছে। প্রথম প্রথম এমন অভিজ্ঞতা হলে ফিরে গিয়ে কান্নাকাটি করত। দীনবাঈ তখন ওকে বোঝাত, ‘বেওকুফ লড়কি, কাঁদছিস কেন রে? শোন, এই যে বিশাল পৃথিবীটা দেখছিস, এটা সবার জন্য। মরদদেরও জন্য। আমাদেরও জন্য। কিন্তু এতকাল মরদরাই সব মধু পিয়েছে, এবার আমরা তাদের মধুতে ভাগ বসাতে গেলে লড়তে তো হবেই। হ্যায় না!’
পুষ্প ভেজাচোখে ঘাড় নেড়েছিল। দীনবাঈ এমন বদমেজাজি, জেলের কর্মীরা তো বটেই, সাহেবরাও ওকে সমঝে চলে। পাঠান প্রহরীরা আড়ালে ডাকে, ডাকুনি। যেমন কর্কশ কথাবার্তা, তেমনই রুক্ষ চলাফেরা। কিন্তু সেই ‘ডাকুনি’র মধ্যে একটা অন্যরকম হৃদয় যে আছে, তা পুষ্প টের পেয়েছিল ছোট থেকেই। ও কান্না থামিয়ে ঘাড় নেড়েছিল, ‘কিন্তু আমি লড়ব কী করে? আমার কি বন্দুক আছে? তোমার মতো একখানা লাঠিও তো নেই চাচি।’
‘লাঠি তো আমার এখন আছে রে মুলগি! আগে কি ছিল?’ দীনবাঈ হেসেছিল, ‘প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম, এই জেল, এই বিল্ডিং, কিচ্ছু ছিল না। মরদরা জংলি জানোয়ারের মতো আমাদের ছিঁড়েখুঁড়ে দিত। কত আউরত মরে গেছে। কিন্তু আমি মরিনি। যারা মরে যায়, তারা হেরে যায়, বুঝলি?’
‘অনেক রুগি … অনেক রুগি অসভ্যতা করে গো মাসি! ইচ্ছে করে বুকে হাত দেয়। আরও অনেকরকম নোংরামো।’
‘সে তো করবেই। কিন্তু তাতে তোর কী এল গেল?’
‘আমার ইজ্জত নিয়ে ভয় হয়।’
‘তোর ইজ্জত কি অন্যের হাতে থাকে নাকি রে বেওকুফ!’ ভ্রু কুঁচকে বলেছিল দীনবাঈ, ‘কেউ তোর সঙ্গে বদতমিজি করলে তোর ইজ্জত যেতে যাবে কেন? মরদরা ভাবে, এইসব করলেই বুঝি আমরা লড়াইয়ে হেরে যাব। গলত বাত। ইজ্জত থাকবে তোর মনে। তোর নিজের কাজে। বুঝলি। জিসমে নয়! যেদিন তুই নিজে কোনও খারাব কাম করবি, সেদিন তোর ইজ্জত যাবে। তার আগে নয়। নিজের লাঠি নিজেকেই বানাতে হয়, পুষ্প।’
তারপর থেকে ক্রমশ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে উঠেছে পুষ্প। চোখে চোখ রেখে যুঝতে শিখেছে প্রতিকূলতার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাতে ন্যাকড়া আর কুঁজো নিয়ে সে এগিয়ে গেল ছ’নম্বর রুগির দিকে।
লোকটা বছর পঞ্চাশের লালচোখের দাগি আসামি। জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন কাটে তার নারীবর্জিত জীবন। পুষ্পর মতো উদ্ভিন্নযৌবনা দেখে গতকালও তার চিত্ত বিচলিত হয়েছে, আজও হল। হাসপাতালে শৌচাগার বলে কিছু নেই। জেলের প্রকোষ্ঠে যেমন রাতের বেলায় মাটির ঘট রাখা থাকে, এখানে তেমনই মাটির কুঁজো।
লোকটা ওকে দেখে যেন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ওর হাত ধরে কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে বসল। কুঁজোটা তার সামনে রাখতেই প্রস্রাবের নাম করে আড়াল সরিয়ে পুষ্পর হাতটা চেপে ধরল নিজের পুরুষাঙ্গের ওপর।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এক মুহূর্তের জন্য পুষ্প স্থবির হয়ে গেল, তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে সজোরে একখানা লাথি কষাল ও, লোকটার যৌনাঙ্গ লক্ষ্য করে, ‘জানোয়ার শালা!’
লোকটার যেন শ্বাস আটকে গেল, তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘মর গিয়া!’
অদূরেই লালমোহন বসে জাবদা খাতায় হিসেব করছে, সে এদিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। যেমন হিসেব কষার, কষতে লাগল। এই কালাপানির দ্বীপে হাসপাতালও যেমন নামেই, তেমনই চিকিৎসা, রুগির ভালমন্দ সবকিছুই খাতায় কলমে। কে মরল, কে বাঁচল, কিছুতেই কারুর যায় আসে না।
পুষ্প কিছুই হয়নি এমন ভান করে পাঁচ নম্বর রুগির কাছে গেল। তার ক্ষতস্থানটাকে যত্ন নিয়ে ড্রেসিং করল। তারপর হনহন করে হেঁটে চলে এল লালমোহনের সামনে। বলল, ‘ডাক্তারসাহেব এখনও এলেন না যে আজ?’
‘কেন, তার কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে নাকি? তুই আদার ব্যাপারি, জাহাজ কখন এল গেল, তা নিয়ে তুই কী করবি?’ লালমোহন ফুঁসে উঠল।
পুষ্প বিরক্ত হল, ‘উফ বলো না। তিন নম্বরকে যে ওষুধটা দিতে বলে গেছিলেন, ওটা তো তিনদিন দিলাম। আর তো নেই। আজ তাহলে কী দেব? সেটা শুধোব।’
লালমোহন হেলেদুলে উঠল। তার চেয়ারের পেছনে অন্ধকার আলমারি। তার কাচ ভাঙা। হাতড়ে হাতড়ে একটা কালো শিশি বের করল।
পুষ্প দেখেই চিনতে পারল। কার্মিনেটিভ মিক্সচার। ও বলল, ‘পেটের ব্যামো নয়গো। জ্বর। সর্দিকাশি।’
‘মেলা বকিস নে।’ টেবিলে শুয়ে থাকা একটা তামার পাত্র এগিয়ে দিল লালমোহন, ‘এতে গুলে খাইয়ে দে!’
পুষ্প কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। হাসপাতালে প্রায়দিনই কোনও ওষুধ থাকে না। রুগি মরো মরো হোক কি জ্বরে কাহিল, লালমোহনের ওই একটাই ওষুধ। সবাইকেই এক মিক্সচার গুলে খাওয়ানো হয়। প্রায় দিনই রুগি মারা যাচ্ছে। সামান্য অসুস্থ রুগিও এই হাসপাতালে এসে আর জেলে ফিরতে পারে না। এখান থেকেই লাশ চলে যায় সমুদ্রতীরে। সেখানে রাতের অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। পুষ্প বয়সে অভিজ্ঞতায় কম হলেও বোঝে, মানুষের প্রাণের মূল্য এখানে কতটা ঠুনকো।
ওকে নীরবচোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে লালমোহন বলল, ‘হাড়ে দুবেবা গজিয়ে গেল নাকি? যা আমার সামনে থেকে। নতুন সাহেব আসবে। অনেক কাজ। জ্বালাতন করিস না।!’
‘নতুন সাহেব? টেম্পল সাহেব চলে গেচেন?’ পুষ্প অবাক।
‘হুঁ। বিলেত থেকে নতুন ডাক্তার আসচে।’ লালমোহন নাক টানল, ‘খুব রাগী নাকি!’
‘রাগী হোক বা শান্ত হোক, রুগিদের কতা কি চিন্তা করবেন? নাকি এই টেম্পল সাহেবের মতো চোখে ঠুলো এঁটে বসে রইবেন?’
লালমোহন অবাক চোখে তাকাল, ‘তোর সাহস তো বড় কম নয়! সাহেবদের নিন্দে করচিস!’
‘নিন্দে করব কেন?’ পুষ্প থামল না, ‘যা দেখচি, সেটাই বলছি। যে জলে রুগিদের জামা ধুচ্চি, সেই জলই খাওয়াতে হচেচ। আবার সেই জলেই বাসন মাজা। এতে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। আর কী মশা দেখেচ? পেটের রোগ নিয়ে এলেও ম্যালেরিয়া হয়ে যাচেচ। বড়বড় বিছে ঘুরচে। সাপেরও উৎপাত। আমি কত বলেচি। এট্টু কার্বলিক অ্যাসিড দিলেও আমি তা দিয়ে ধুতে পারি।’
‘তুই মাইনে পাচ্চিস তো?’ মাঝপথে হাত নেড়ে ওকে থামাল লালমোহন।
‘তুমিই তো দাও। পাব না কেন?’
‘ব্যস। মাইনে নিয়ে খুশি থাক।’ লালমোহন আর কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসে উপস্থিত হল আসফান্দ। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ডার।
পুষ্পর দিকে একবার আলগোছে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘একত্রিশ নম্বরের কয়েদি কাল থেকে বাহ্য করচে। এখন আর উঠতে পারচে না। ওষুধ দাও।’
লালমোহন কিছু বলার আগেই পুষ্প বলল, ‘একেনে আনতে হবে রুগিকে। দাঁড়ান, আমি ভীমকে খবর দিচ্চি। ভীম। অ ভীম!’
‘তুই থামবি?’ লালমোহন রোষকষায়িত নেত্রে পুষ্পর দিকে তাকাল। তারপর হাতের শিশিটা আসফান্দের হাতে ধরিয়ে দিল, ‘জলে গুলে খাওয়াও। ঠিক হয়ে যাবে।’
আসফান্দ যেতে না যেতে লালমোহন খিঁচিয়ে উঠল, ‘আমি তোকে শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্চি পুষ্প। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবি না। এমন নালিশ করব, জাহাজঘাটায় বসে শেষে ভিক্ষে করতে হবে। জানিস না, রাজবন্দিদের হাসপাতালে আনা যায় না!’
‘শরীর খারাপ হলেও না?’
‘মরতে বসলেও না। যদি পালায়, কে ঝুঁকি নেবে?’
‘সে তো এরাও পালাতে পারে। এরা বুঝি কেউ কম যায়? কেউ তিনটে খুন করেছে। কেউ দশটা ডাকাতি। পালানোর হলে আমাদের গলায় দুটো কোপ দিয়ে এরা পালিয়ে যেতে পারে।’ পুষ্প তর্ক চালিয়ে যাচ্ছিল, ‘সেখানে রাজবন্দিরা তো লেখাপড়া জানা ভদ্দরলোক!’
লালমোহন চোখ সরু করল, ‘কী ব্যাপার বল দিকি! আজকাল দেকচি বড্ড বেশি বুলি ফুটেচে তোর। একেনে ডিউটি মিটলেই তো টো টো করে ঘুরিস। কার সঙ্গে মিশচিস?’
‘সবার সঙ্গেই মিশি।’
‘উঁহু। গতিক সুবিধের লাগচে না।’ লালমোহন ঝুঁকে এল, ‘গাঁয়ে যে মেয়েটা নতুন বে’ হয়ে এসেচে, তার সঙ্গে জেলে তোর আগে থেকেই আশনাই ছিল, না? সে বুঝি এসব শেকাচেচ তোকে?’
‘নীলাদিদি? নীলাদিদি শেকাতে যাবে কেন? আমি বাইরে কাজ করি। সে কী করে? সে এসবের জানেই বা কী?’
‘আগে হয়তো জানত না। এখন জানে ভালই। ঘাগু লোককে বে’ করেচে।’ বলতে বলতে লালমোহন কৌতূহলী চোখে তাকাল, ‘আচ্ছা, মেয়েটা তো শুনিচি দেকতে শুনতে ভালই। ওই বুড়োকে কেন বে’ করল রে? জানিস কিচু?’
‘না’ পুষ্প সংক্ষেপে জবাব দিয়ে কাজের ভান করে রুগিদের কাছে চলে এল। চারনম্বর রুগি আবার বমি করেছে। বমিতে মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে। পুষ্প নির্বিকার মুখে তাকে পরিষ্কার করতে লাগল।
সত্যি কথা বলতে কী, লালমোহনের প্রশ্নের উত্তর ওরও সঠিক জানা নেই। নীলাদিদিকে ও দেখছে অনেকদিন হল। দিদির মুখে বিষাদ আর আলো একইসঙ্গে খেলা করে। এমন আলোআঁধারি ও কখনও কারুর মুখে দেখেনি। দিদি প্রথমে বিয়ে করতে চায়নি। ওয়ার্ডাররা অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু লাভ হয়নি।
কিন্তু যেদিন পুষ্প সেই পেয়ারামাখাটা নিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ বলল, ‘আমি বিয়ে করব!’
না। হঠাৎ নয়। সেদিন পুষ্প গিয়েছিল গোলাম রসুলের কোয়ার্টারে। গোলাম রসুল নিজে যমদূত হলেও ওর বোন সালমা ভারি ভাল মেয়ে। কোয়ার্টারের বাগান থেকে দু’জনে পেয়ারা পেড়েছিল একগাদা। কীসে করে অত পেয়ারা আনবে? চোখে পড়েছিল কিছু হাতে লেখা কাগজ। তাতে মুড়ে পেয়ারামাখা নিয়ে এসেছিল পুষ্প।
ওর এখনও স্পষ্ট মনে আছে। নীলাদিদি পেয়ারা খেতে খেতে থেমে গিয়েছিল। ভিজে যাওয়া কাগজটা চোখের সামনে নিয়ে এসে বলেছিল, ‘দ্যাখ। সামনের পনেরো তারিখে মহারাজা জাহাজ এসে দাঁড়াবে জাহাজঘাটায়। গোলাম রসুল তারই লিস্টি বানিয়েছে দেখচি।’
‘হুম। কাজপাগল লোক তো। সালমা বলে, বাড়িতে এসেও নাকি কাজ নিয়ে বিড়বিড় করে।’
‘এবারের জাহাজে অনেক কয়েদি আসচে কলকাতা থেকে। মেয়ে কয়েদি আসচে। রাজবন্দিও আসচে কয়েকজন।’ নীলাদিদি গভীর মনোযোগ দিয়ে কাগজটা দেখছিল। পুষ্পর হাসপাতালে যাওয়ার ছিল, ও চলে এসেছিল। নীলাদিদিদেরও সবাইকে সার বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাইরের করিডরে। সেদিন গৌরীপ্রসন্ন জ্যাঠার আসার কথা ছিল। নতুন সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেবের স্ত্রীর নির্দেশ, মহিলা কয়েদিদের সপ্তাহে দু’দিন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দিতে হবে। গৌরীজ্যাঠা আর শ্যামাপ্রসাদ জ্যাঠা তাই দু’দিন করে মেয়েদের গল্প শোনান। উৎসাহ দেন। তবে অর্ধেক মেয়ের তাতে মন নেই। কেউ শিখতে চায় ব্রতকথা। কেউ পাঁচালি। কেউ ওইসময় সখীদের পেয়ে দুলে দুলে গল্পে মাতে।
সেদিন রাতেই পুষ্প খবর পেয়েছিল, নীলাদিদি বিয়েতে মত দিয়েছে।
কাকতালীয়? কে জানে! তখন জিজ্ঞেস করলে নীলাদিদি কিছু বলেনি। বলেছিল অনেকদিন পর। একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে বলেছিল, ‘শেখরকে চিনিস?’
‘জলের ব্যাপারি করে তো? কয়েকমাস আগে ছাড়া পেয়েচে?’
‘হুঁ। ওকে এটা দিয়ে দিস!’ নীলা চলে যেতে যেতে আবার পিছু ফিরেছিল, ‘আর শোন। হাসপাতালে তো অনেক আসামি আসে। ইন্দ্র রায়চৌধুরী নামে কেউ এলে আমায় বলিস তো!’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন