দেবারতি মুখোপাধ্যায়
নীলা কমিশনারের বাংলো থেকে বেরিয়ে আসার আগে জুলিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। শেষবারের মতো। বলল, ‘মেমসাব! আমি যাই?’
জুলিয়া মিষ্টি হেসে তাকালেন ওর দিকে। আজ ক্যারোলিন মায়ের কোলে কোলে ঘুরছে। চারদিকে বাক্সপ্যাঁটরা বাঁধা হয়ে পড়ে আছে। জামাকাপড়। খেলনা। জুলিয়ার আঁকার ক্যানভাস। ইজেল। আজ রাত ফুরোলেই কমিশনারের স্পেশাল জাহাজ ছাড়বে রস আইল্যান্ড থেকে। মেজর পোর্টওয়েল সপরিবারে পাড়ি দেবেন সুদূর বোম্বাই শহরে।
আবার একটা অজানা শহর। নতুন পরিবেশ। নতুন লোকজন। জুলিয়ার মনের ভেতর মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। সেটা চেপে রেখে তিনি বললেন, ‘তোমার কাজ তো এখনও শেষ হয়নি, ব্লু!’
নীলার এখন আবদুলকে লাগে না। ও ইংরেজি বুঝতে পারে বেশ। অবাক চোখে ও বলল, ‘আমার তো আর কোনও কাজ নেই মেমসাব!’
জুলিয়া কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। তারপর হেসে ফেললেন। বললেন, ‘তুমি যে বলেছিলে, আমায় তোমাদের গ্রাম ঘোরাতে নিয়ে যাবে?’
নীলা হাসল, ‘সেই সময় তো পেলাম না মেমসাব!’
জুলিয়া এবার এগিয়ে এলেন ওর কাছে, তারপর আশপাশের সমস্ত পরিচারককে অবাক করে দিয়ে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন।
কোল থেকে ক্যারোলিনকে নামিয়ে জড়িয়ে ধরলেন নীলাকে।
নীলা কিছুক্ষণের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
‘Blue, I will miss you’ জুলিয়া বেশ কয়েক সেকেন্ড ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ভাঙা বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে বললেন, ‘আমি কত জায়গায় ঘুরেছি ব্লু। কতরকম মেইড, কতরকম সারভেন্ট। তোমার মতো মেয়ে আমি একটাও দেখিনি। এত রুচিশীল। এত সাহসী। অথচ ভেতরে এত নরম।’
নীলা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। জীবনের একেকটি অনন্য অভিজ্ঞতা ওকে অসাধারণ পাঠ দিয়ে যাচ্ছে। গৌরীপ্রসন্ন, ইন্দ্রদাদারা শিখিয়ে গেছে, পুরুষ মানেই অত্যাচারী নয়।
জুলিয়া শেখালেন, ব্রিটিশ মানেই খারাপ নয়। ব্যতিক্রম আছে। সর্বত্র। আর ব্যতিক্রম আছে বলেই পৃথিবী এখনও সুন্দর। এখনো সূর্য চাঁদ আকাশে ওঠে। অস্ত যায়। প্রকৃতি নিজের কাজ করে। নীরবে।
নীলার চোখে জল এসে গেছিল, ও বলল, ‘আপনিও খুব ভাল, মেমসাব! ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনি সুখে থাকুন। ক্যারোলিন খুব ভাল মানুষ হোক। আর আপনি অনেক ভাল ভাল ছবি আঁকুন। সংসার যেন আপনার আঁকার হাতটাকে না থামিয়ে দেয়।’
নীলার মুখ থেকে এমন কথা শুনে জুলিয়া অবাক হয়ে গেলেন। থেমে থেমে বললেন, ‘তুমি খুবই আলাদা, ব্লু! Very very different তুমি … তুমি আমার সঙ্গে যাবে?’
‘আপনার সঙ্গে?’ নীলা অবাক, ‘না মেমসাব, আমার ঘর আছে। পরিবার আছে। আমি কী করে …!’
‘হুম।’ জুলিয়া ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, ‘I understand . তুমি আমার কাছে কী চাও, বলো।’
‘কিছু চাই না মেমসাব!’ নীলা ভেজা চোখে হাসল, ‘আসি।’
ক্যারোলিনের গাল টিপে আদর করে বেরিয়ে এল ও। অন্য সমস্ত পরিচারকদের মতো বকশিস চায় না ও।
জুলিয়া তার চেয়ে অনেক দামি জিনিস ওকে এর মধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন। সুন্দর স্মৃতি। পৃথিবীর কোনও বাজারে তা কিনতে পাওয়া যায় না।
রস আইল্যান্ড থেকে স্টিমারে চেপে নীলা যতক্ষণে জাহাজঘাটায় এসে নামল, ততক্ষণে ওদিকে রাতপ্যাঁচার মতো নিঃশব্দে কয়েকজন এগিয়ে চলেছিল সেলুলার জেলের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাচীর লক্ষ্য করে।
গৌরীপ্রসন্ন, শ্যামাপ্রসাদ গল্প করার ছলে বসে আছেন জেলের বাইরের প্রবেশপথে। গেটের সিপাহিরা সকলেই চেনা, তাদের সঙ্গে আসর জমাচ্ছেন। আজকের আসরের সবচেয়ে মুচমুচে বিষয় হল, মারে সাহেবের বাড়ির অনুষ্ঠানের দিনই কমিশনারের বদলি কেন? এতে কি ব্যারি আর মারের কোনও কলকাঠি রয়েছে?
অন্যদিকে রহমান রয়েছে জাহাজঘাটায়। কোথাও কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। সাহেবরা সকলেই মত্ত রস আইল্যান্ডে বিবাহবাসরে। জেলের ওয়ার্ডাররাও আজ অনেকটা ছুটির মেজাজে, বিয়ের মোচ্ছবের খাওয়াদাওয়া নিয়ে নানা গুজবে তাদের জিভ থেকে জল ঝরেছে। এখন তারাও ক্লান্ত হয়ে কেউ টুলে বসে ঢুলছে। কেউ হাই তুলতে তুলতে অলস পায়চারি করছে।
জেলের ভেতরে ফণীভূষণ আর মকবুলও অপেক্ষা করছিল ধৈর্য ধরে। সন্ধের অন্ধকারে তারা বসেছিল ওয়ার্ডের ছোট সবজি বাগানে। এই বাগান হেমদাদাদের বানানো। ছোট পুদিনার খেত। বেগুন গাছ। কুমড়ো গাছ। প্রতিদিন ওই একই স্বাদহীন কঞ্জি আর লপসি থেকে মুক্তি পেতে নিজেদের এই বাগান করার সিদ্ধান্ত।
এই নিয়ে ব্যারিসাহেব কম আপত্তি করেননি।
কিন্তু শেষ কয়েকমাসে তিনি একটু হলেও শুধরে ছিলেন। হোতিলালের চিঠির পর যাবতীয় জবাবদিহি, ইনস্পেকশনের ঝড় তাঁর ওপর দিয়েই গেছে।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও মাঝে মাঝেই লিখে চলেছেন দ্বীপান্তরের রাজবন্দিদের দুর্দশা নিয়ে। বাধ্য হয়ে ব্যারি সম্ভবত উপলব্ধি করেছেন, বেশি ঘাঁটিয়ে এদের লাভ নেই।
জেলের পেছনের অরণ্য দিয়ে অনেকদূর হেঁটে গেলে সমুদ্র পড়বে। সে তো আন্দামানের যে কোন জায়গা থেকে হাঁটতে শুরু করলেই শেষ হবে সাগরে। সবই তো দ্বীপ। কিন্তু সেই অরণ্যে ধৈর্য ধরে আজ অপেক্ষা করছেন হেমচন্দ্র, উপেন, উল্লাসরা। প্রত্যেকে নিজের কাজের জায়গা থেকে এসে একজোট হয়েছে। জেল থেকে বাকি রাজবন্দিরা এলেই তাদের নিয়ে চড়ে বসা হবে ডিঙি নৌকোগুলোয়।
তারপর পাড়ি দিতে হবে দূরের জাহাজের দিকে।
ওয়ার্ডে ফণীভূষণ আর মকবুল চুপচাপ বসেছিল বাগানে। এখানে একটা ঘুলঘুলিতে চোখ রাখলে দেখা যায় দূরের অরণ্য। সেখানে প্রথমে তিনটে মশাল জ্বলে উঠবে।
সেটাই সংকেত।
বাইরে ওয়ার্ডার পায়চারি করছে। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো একবার ডানদিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে বাঁ দিকে।
এমনসময় ঢং ঢং করে সেন্ট্রাল টাওয়ারে আটটার ঘণ্টা বাজল। এই সময় ওয়ার্ডারদের ডিউটি বদল হয়। এক ওয়ার্ডার রেজিস্টারে সই করে ডিউটিতে ঢোকে, অন্যজন বেরোয়।
সেই ফাঁকে মকবুল চোখ রাখল ঘুলঘুলিতে।
ওই তো! ওই তো জ্বলছে তিনখানা মশাল! খুব অস্পষ্ট তবুও দৃঢ়। মকবুলের চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জঙ্গলের অন্যপ্রান্ত থেকে মশালের আলো উল্লাসরাও দেখতে পেয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন, কীভাবে খুব উত্তেজনার মুহূর্তেও নাড়ি অচঞ্চল রাখতে হয়। বারীন আর হেমচন্দ্র নিজেদের মধ্যে একবার চোখাচোখি করলেন। দু’জনেই অভিজ্ঞ বিপ্লবী নেতা। মনে মনে তাঁরা একবার ছকে নিলেন গোটা পরিকল্পনাটা। আর মাত্র এক ঘণ্টা।
আসছে! ওরা আসছে!
পাঁচিল বরাবর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠবে গোটা সেলুলার জেল। পাঁচিলের দেওয়ালগুলো ধসে পড়বে। ওয়ার্ডার, জমাদারদের হুড়োহুড়ি। ছুটোছুটি। অথচ জেলার সুপার বা কর্তাব্যক্তিরা সবাই রস আইল্যান্ডে প্রমোদে মত্ত। গোটা জেলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। তারই মাঝে পাঁচিল পেরিয়ে পালানো। মকবুল ছবির মতো ছক কষে দিয়েছে। পশ্চিম দিক বরাবর কিছুটা ছুটলেই সমুদ্রের খাঁড়ি। সেখানে নোঙর করা থাকবে চার-পাঁচটা নৌকো। নৌকো করে সোজা চলে যাওয়া ভাইপার দ্বীপের কাছাকাছি। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ‘মহারাজা’ জাহাজ। যে জাহাজে করে একদিন ওরা এসেছিল এখানে। সেই জাহাজে করেই পালানো।
যতক্ষণে লাইটহাউস থেকে ‘মহারাজা’র পলায়ন নিয়ে খবর আসবে, ততক্ষণে পাখিরা অনেক দূরে উড়ে যাবে।
মনে মনে পুরোটা আউড়ে নিয়ে হেমচন্দ্র বারীনের দিকে তাকালেন। সকলেই জানে, হেমচন্দ্র বারীনের সিদ্ধান্তগুলো পছন্দ করেন না। বারীন আবেগপ্রবণ হয়ে যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ফল ভুগতে হচ্ছে উল্লাস, উপেন, ইন্দুভূষণের মতো তরুণ ছেলেগুলোকে। এমন কথা হেমচন্দ্র প্রকাশ্যেই বলেছেন বহুবার। কিন্তু তাই বলে শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তো এসব ভাবলে চলে না। নিজের লোক ভুল হলে তাকে তিরস্কার করতে হবে, কিন্তু বিপদে তাকে আগলাতে হবে, লড়তে হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
হেমচন্দ্র বললেন, ‘উল্লাস কোথায় গেল!’
‘পাশেই তো ছিল।’ বারীন চাপাস্বরে ডাকলেন, ‘উল্লাস! অ্যাই উল্লাস!’
কোনও উত্তর নেই। মশালের আলো জ্বলে আবার নিভে গেছে। এমন নিকষ কালো অন্ধকার, নিজের হাতটাকেও দেখা যাচ্ছে না।
হেমচন্দ্র কী বলতে যাবেন, হঠাৎ উল্লাস খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমি একবার আসছি, বুঝলে।’
‘কোথায়? কোথায় যাচ্ছিস?’
‘লীলাকে নিয়ে আসি। ও তো পোর্ট মোয়াটে একা একা পড়ে আছে। জানবেও না আমি জাহাজে চেপে কলকাতা ফিরে গেছি। বিপিনকাকার কাছে মুখ দেখাব কী করে?’
বারীন বললেন, ‘কীসব উল্টোপাল্টা বকছিস? এখানে লীলা আসবে কোত্থেকে?’
হেমচন্দ্র পাশ থেকে নীচুস্বরে বললেন, ‘এখন কথা বাড়িও না ভায়া। ওর মাথাটা ক’দিন ধরেই দেখছি গোলমাল করছে। চুপ করে যাও।’
‘মাথার গোলমাল, সেকী!’ বারীন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘চন্দননগরে নেমেই তবে ডাক্তার দেখাতে হবে, হেমদাদা। সেখানটা ফরাসিদের দখলে, ইংরেজরা চট করে আমাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না।’
হেমচন্দ্র বিরক্তমুখে চুপ করে গেলেন। যাই হয়ে যাক, বারীনের এই ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ স্বভাব আর গেল না। আন্দামান থেকে সরকারি জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে বাংলায় ঢোকা কি মুখের কথা? হেমচন্দ্র অত্যন্ত সন্দিহান এই অপারেশনের ব্যাপারে। তবে হ্যাঁ। চন্দননগর না যাওয়া যাক। এখান থেকে বেরিয়ে মাদ্রাজ হোক বা বোম্বাই কোনও একদিকে পাড়ি তো দেওয়া যাবে। সকলেই অকুতোভয়। জীবনের বিভীষিকাময় অধ্যায় তারা কাটিয়ে ফেলেছে এখানে। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? অপারেশন সাকসেসফুল হলে ভাল, নাহলে আবার এই নরকেই ফিরতে হবে। আর কিছু তো হওয়ার নেই।
.
কিন্তু ইন্দ্র ছেলেটা এখন কেমন আছে? বেচারা খুব ভুগছে।
হেমচন্দ্রের মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা ছেলে। মুরারিপুকুরে কেমন তরতাজা ছিল, আর এখন কী হল।
উল্লাসও তো তাই। আলিপুর কোর্টে শুনানি চলার সময় একদিন জজসাহেব কী যেন প্রশ্ন করেছেন উল্লাসকে, সে সটান বলে দিয়েছিল, সে পুলিশ ইন্সপেক্টরের ভুঁড়ির মাপ নিতে ব্যস্ত ছিল, তাই জজসাহেবের প্রশ্ন শুনতে পায়নি।
নিজের অজান্তেই হেমচন্দ্রের মুখে হাসি খেলে গেল। উল্লাস বেপরোয়া। উল্লাস আদুরে। উল্লাস মানেই প্রাণচঞ্চলতা।
অমন মেধাবী টগবগে ছেলেটা কি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে? ও নাকি এখানে লীলাকে দেখছে। হ্যালুসিনেশন? না অন্য কিছু!
হেমচন্দ্রের চিন্তায় পুকুরের বড় মাছের ঘাইয়ের মতো ঘুরেফিরে আসে একই কয়েকটা চিন্তা।
ইন্দ্র ছেলেটা বেচারা আরও ছেলেমানুষ, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। ওর হাতদুটো নিয়ে কবে থেকে ভুগছে, তবু তারই মধ্যে গাধার খাটুনি খাটতে হচ্ছে ছেলেটাকে। বড়দাদারাও কেউ নেই জেলে, ও কি দাদাদের ওপর অভিমান করল?
আর তো মাত্র কয়েকঘণ্টা! এখান থেকে পালাতে পারলে আর কিছু না হোক, ছেলেটার চিকিৎসাটা করাতেই হবে।
.
ওদিকে জেলের মধ্যে বসে প্রতীক্ষা করছিল মকবুল ও ফণীভূষণও। শেষ এক বছর ধরে ওরা দু’জন অনেক খেটেছে আজকের রাতটাকে সফল করার জন্য। সাধারণ বন্দিদের ওপর শিথিল নজরদারিকে কাজে লাগিয়ে এমন কিছু নেই যা করেনি। একজন আন্দামান এসেছিল খুন করে, অন্যজন ছিনতাই করে। দু’জনেই একাধিকবার জেলখাটা আসামি।
অথচ এই গ্রীষ্মের জ্যোৎস্নাভরা রাতে যে দুটো মানুষ জেলের এই ছোট্ট সবজিবাগানে বসে আছে, তাদের মন অন্যকিছুতে তন্ময় হয়ে রয়েছে।
‘আচ্ছা মকবুল।’ ফণীভূষণ হঠাৎ বলে, ‘ওরা তো চলে যাবে। আমরা কী করব?’
‘কী করব মানে?’ মকবুল অবাক হয়, ‘আমরাও পালাব জাহাজে চেপে। তেমন কথাই তো হয়ে আছে।’
‘কিন্তু আমরা তো রাজবন্দি নই রে। আমাদের পালানোর কি অধিকার আছে? ওরা দেশের জন্য লড়েছে। আমরা কী করেছি?’ ফণীভূষণ উদাস চোখে বলল।
এই নিয়ে পুষ্প প্রায়ই তাকে খোঁটা দেয়। বলে, ‘কাক যতই ময়ূরের পেখম পরুক, সে কাকই থাকে। ময়ূর হয় না। তুমিও হলে সেই পেখমধারী কাক। নিজেকে ময়ূর ভেব না।’
মকবুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার মাথায় যুক্তি বুদ্ধি চিরকালই কম খেলে। কিন্তু আজ বলে ওঠে, ‘আমরা কি আর সেই আগের আমরা আচি নাকি?’
‘নেই?’
‘না। আমরা তো কবেই রাজবন্দি হয়ে গেচি। মনে মনে। তুমি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলো তো, তুমি দেশকে মা ভাবো না?’
ফণীভূষণ কথা খুঁজে পেল না। আগে রাজবন্দিদের এই ‘দেশ আমাদের মা’ নিয়ে ও কম রঙ্গরসিকতা করত না। মাটি আবার মা হয় নাকি?
কিন্তু এই ইন্দুভূষণ, উপেনদের সঙ্গে দিনের পর দিন থেকে কী যে হয়েছে, ভারতমা বললেই বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠছে কেন? ওর ওপর নির্দেশ আছে, সব রাজবন্দিকে নিয়ে ঠিকমতো নৌকোঘাটে পৌঁছে দিতে হবে।
নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে ও ফিরে আসবে। সেটাই ভাল হবে। মকবুল যা করে করুক।
ফণীভূষণ আরও কীসব ভাবছিল, হঠাৎ ডাক এল, ‘চলো চলো।’
‘কিধার?’
‘হাসপাতাল। তুমহারা ড্রেসিং হোগা।’
ফণীভূষণের ড্রেসিং করার কিছুই নেই, তার মানে পুষ্প ডাকছে কোনও প্রয়োজনে।
ও বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে মকবুলকে বলল, ‘আমায় মনে হয় ওখান থেকেই চলে যেতে হবে। যদি ফিরে আসতে না পারি, ইন্দুভূষণকে সাবধানে নিয়ে যাস। বেচারা হাত নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে।’
‘তুমি কিছু ভেব না। আমি ঠিকঠাক নিয়ে যাব।’
নীলা জাহাজঘাটা থেকে দ্রুত গতিতে হাঁটছিল। রহমানচাচা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। দূরের দ্বীপের কাছে অন্ধকারে কালো দৈত্যের মতো নিশ্চল অপেক্ষায় রত মহারাজা জাহাজ। তাতে করে পালাবে রাজবন্দিরা। নীলার কাজ হল, তাদের ঠিকমতো নৌকো উঠিয়ে জাহাজের কাছাকাছি যেতে সাহায্য করা। তারপরই তার কাজ শেষ। ফিরে যাবে স্বাবলম্বন গ্রামে।
কয়েক পা এগোতেই বালি থেকে যেন ফুঁড়ে উঠে এল ফণীভূষণ।
‘তুমি? তোমার তো এখনও জাহাজের ওখানে থাকার কথা!’ নীলা চাপা স্বরে বলল।
‘তোমাকে খুব দরকারি একটা খবর দিতে এতদূর এলাম।’ ফণীভূষণ ফিসফিস করল, ‘তোমার ইন্দ্রদাদা … সে যায়নি গো!’
‘কী বলছ তুমি!’ নীলার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।
‘হ্যাঁ। সে খুব অসুস্থ। হাতভর্তি ঘা। জ্বর। আজই পুষ্প তার চিকিচ্ছে করে এসেচে। এই কথা বলতেই পুষ্প আমায় পাঠাল! আজ সেও পালাবে বাকিদের সঙ্গে।’
‘সত্যি বলছ তুমি?’ নীলা আকুল হয়ে দু’হাতে ঝাঁকায় ফণীভূষণকে, ‘কিন্তু… কিন্তু শেখরদা যে বলেছিল …!’
‘শেখর মিথ্যে কথা বলেচে। নীলা, তুমি গাঁয়ে ফিরে যেও না। জাহাজে চলে যাও!’ ফণীভূষণ বলল, ‘আমি তোমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, চলো!’
নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ওর মাথা কাজ করছে না। সমুদ্রের ঝড়ের মতো অবিশ্বাসের দোলাচলে তার মনটা দুলছে ভীষণভাবে।
‘দেরি করো না নীলা। চলো!’
নীলা প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। এই ফণীভূষণ লোকটা রাজবন্দি নয়। ফটিক সুবীরদের মতোই সাধারণ দাগি আসামি। ইদানীং পুষ্পর পেছনে পড়ে থাকে।
.
ফটিকরা যদি একে পাঠায়? এই দ্বীপে নীলা আর কাউকে বিশ্বাস করে না।
.
মন শক্ত করে ফেলল ও, ‘না। তুমি চলে যাও। আমি যাব না।’
‘যাবে না কেন?’
‘আমার ইচ্ছে।’ নীলা ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘তুমি যাও।’
ফণীভূষণ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। এই নীলা যেন ওর কাছে অপরিচিত। একে বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই। ফণীভূষণ আর সেই চেষ্টা করল না। যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই নিঃশব্দে ফিরে গেল।
জাহাজঘাটা থেকে কিছুদূর এলেই নারকেল গাছের সারি। উদভ্রান্ত নীলা উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক হাঁটল, তারপর একটা নারকেল গাছের নীচে বসে পড়ল ধপ করে।
অন্ধকারে দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ওর চোখে হু হু করে জল এসে গেল।
শেখরদা! শ্রীফলতলা গ্রামের সমাজপতি ভবানী বাঁড়াজ্জের ছেলে শেখরদা। সে এমন করতে পারল? ইন্দ্রদাদা এখানে আছে জেনেও নীলাকে বিভ্রান্ত করল?
.
কতক্ষণ ও একভাবে বসে ছিল, জানে না। সম্বিত ফিরে পেতেই ও যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়াল। না। নৌকোঘাটে ওকে যেতেই হবে। ইন্দ্রদাদার সঙ্গে ও যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে ভাববে পরে। কিন্তু এই অভিশপ্ত দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিরাপদে ইন্দ্রদাদাকে জাহাজে তুলে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব ঈশ্বর ওর হাতেই দিয়েছেন।
তা ওকে পালন করতেই হবে।
আঁচলটাকে কষে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে তিরের বেগে ছুটতে শুরু করল নীলা। বালির ওপর দিয়ে জোরে ছোটা সহজ ব্যাপার নয়। পা আটকে যাচ্ছে বারবার।
পড়ে থাকা কাঁটায় ছড়ে যাচ্ছে পা। শাড়ি আলুথালু। রহমানচাচা বলেছিল, যখনই পথ খুঁজে পাবি না, সমুদ্রের সাহারা নিবি। সাগরের তীর বরাবর ছুটবি।
নীলাও তাই ছুটছিল।
.
একটা গাছে ঠোক্কর খেয়ে আবার ছুটতে যেতেই হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে ওকে জাপটে ধরল। নীলা বুঝে ওঠার আগেই ওর মুখে ঢুকিয়ে দিল একদলা ন্যাকড়া।
নীলা ছটফট করে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। অন্ধকারে ছায়ামূর্তি কে, তা বোঝা যাচ্ছে না। ন্যাকড়ার দুর্গন্ধে বমি আসছিল ওর।
‘চোপ মাগি। অনেকদিন ধরে তোর নখরা দেকছি। মেয়েমানুষের এত জিদ্দিবাজি ভাল না। চল, আজ সারা রস আইল্যান্ড তোর সুখ নেবে।’
ফটিকের কথা শেষ না হতেই সুবীর বলে উঠল, ‘কিন্তু তার আগে মহরত করব আমরা। কী বলো ফটিকদা?’
‘সে আর বলতে! শালির তেজটা আগে কমাতে হবে। সুবীর, তুই পা দুটো চেপে ধর।’
সুবীর পায়ের দিকে গিয়ে দাঁড়াতেই নীলা শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে দুটো পা জোড়া করে একখানা লাথি কষাল। অপ্রত্যাশিত সেই পদাঘাতে সুবীর ছিটকে পড়ল বালির চরে।
‘রন্ডি শালি!’ ফটিকের রাগ সীমা ছাড়াল। অনেকদিন ধরে তক্কে তক্কে রয়েছে সে। আজ শিকার একেবারে মুখের সামনে, কিছুতেই ফসকানো চলবে না। নীলার চুলের মুঠি ধরে সজোরে একটা থাপ্পড় মারল সে। প্রবল সেই আঘাতে নীলার চোখে যেন অন্ধকার নেমে এল। ন্যাকড়াটা বেরিয়ে এল। মুখ থেকে বেরোল আর্তনাদ, ‘উহ মাগো!’
কিন্তু তা সত্ত্বেও ও থামল না। ফটিকের হাত সাঁড়াশির মতো চেপে বসেছিল ওর শরীরে। নীলা নিজের দুটো দাঁতের সারি বসিয়ে দিল সেই হাতের ওপর।
প্রাণপণ সেই কামড়। ফটিকের বজ্রবন্ধনী ক্রমে শিথিল হতে লাগল। যতক্ষণ না নিজের জিভে রক্তের স্বাদ পেল, নীলা দাঁত সরাল না।
.
নির্জন বালুকাতট। দূরে ফেনিল সমুদ্রে আপন মনে খেলে চলেছে জলোচ্ছাস। উঁচু উচু নারকেল গাছের সারি। পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে চাঁদ।
সেই চাঁদের নরম আলোয় নীলা দেখল, ফটিক ওকে ছেড়ে দিয়েছে। ওর দুটো কবজি থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।
রক্ত ঝরছে নীলার মুখ থেকেও। এই অন্ধকারের মধ্যে ওকে দেখে মনে হচ্ছে, গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা রক্তখেকো কোনও প্রেতাত্মা!
কয়েক সেকেন্ড মাত্র। ফটিক পকেটে হাত দিল। সেখান থেকে বের করে আনল চকচকে একটা ছুরি। কেটে কেটে বলল, ‘তোর খুব তেজ, না! দাঁড়া, আগে তোর তেজ কমাই। তারপর তোর সঙ্গে খেলব।’
কথাটা বলে ফটিক ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল নীলার ওপর, ছুরিটা বসিয়ে দিতে চাইল ওর উরুতে।
কিন্তু পারল না। কারণ ততক্ষণে ফটিকের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। হাতদুটো ধড়ফড় করে কাঁপছে। আলো আঁধারিতে এমন অভিব্যক্তির কারণ বুঝতে পারে না নীলা। ভাল করে দেখতে তবে ঠাহর হয়। ফটিকের গলায় চেপে বসেছে একটা দড়ি। সেই দড়ির মরণফাঁদ যত দৃঢ় হচ্ছে, তত ছটফটানি বাড়ছে ফটিকের।
কয়েকটা মুহূর্ত জল থেকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করল ফটিক। সেই অবস্থাতেও কাঁপতে থাকা হাতে হাতের ছুরি দিয়ে কাটতে চেষ্টা করছিল দড়িটা।
ঠিক সেইসময় কে যেন পেছন থেকে এসে কোপ দিল তার গলায়।
‘আঁক’ করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল।
‘মরে গেল?’ আর্তনাদ করে নীলা বসে পড়ল ফটিকের সামনে। গলার নলি কেটে দু’ফাঁক। সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত।
কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গেল দেহটা।
নীলা পাগলের মতো নাড়ি দেখতে চেষ্টা করল, পুষ্পর শেখানো মতো। না। নাড়ি নেই।
আঁতকে উঠল নীলা। এরা কারা? অন্ধকারে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সুবীর ছেলেটা বোধ হয় ভয় পালিয়েছে।
নীলা টলতে টলতে মাটিতে বসে পড়ল।
.
আর ঠিক তখনই প্রথম ছায়ামূর্তি একটা অদ্ভুত কথা বলে উঠল।
‘ওই আবাগীর বেটি, এতে কি আমার পাপ এট্টু হলেও ধুয়ে মুছে সাফ হল?’
নীলা প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল, ‘চাঁদুমাসি!’
যেটাকে নীলা ছোরা ভেবে ভুল করেছিল, সেটা আসলে আঁশবঁটি। চন্দ্রপ্রভা বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রহমান চাচা। সে-ই দড়ি ধরে টান মারছিল।
চাচা তো অন্ধ, সে কী করে ফাঁস পরাল?
আর চাঁদুমাসি … চাঁদুমাসি বঁটির কোপ বসিয়েছে ফটিকের গলায়?
নীলা থরথর করে কাঁপছিল।
‘কীরে বল না। চুপ করে আচিস কেন রে মুখপুড়ি!’ চন্দ্রপ্রভা আবার বলল। তার হাতের আঁশবঁটি থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরছে, ‘অনেক … অনেক লোকের, অনেক মেয়ের সর্বনাশ করে এই লোকটা। মা-মেয়ে কাউকে ছাড়েনি। যদি পাপ সাফ হয় ভাল, নাহলে দুনিয়া থেকে একটা পাপ বিদেয় করতে পেরেছি, এটাই আমার শান্তি!’
নীলার গলা ধরে এল। একটা ঢোঁক গিলে ও বলল, ‘তোমার পাপ অনেক আগেই সাফ হয়ে গেছে মাসি!’
‘কবে?’
‘যেদিন তুমি আমার বাড়ি এসে চোদ্দোশাক খেলে।’
‘কেন?’
নীলা একটু থামল। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘আমি জানতাম, তোমার সেইদিন আমায় অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। শ্যামলাল আগেই সাবধান করেছিল আমায়। কিন্তু তুমি নিয়ে যাওনি।’
চন্দ্রপ্রভা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নীলার দিকে। কুতকুতে চোখের প্রৌঢ়াটির শরীরে মনে অনেক আঘাত। অনেক আঁচড়। সেইসব আঁচড়ের ক্ষত না থাকলেও দাগ রয়ে গেছে।
নীলা ভাঙা গলায় বলল, ‘লোকটাকে মারলে কেন গো মাসি!’
‘না মারলে আমাদের সবাইকে ওর হাতে মরতে হত রে! আমরা সবাই এতদিন একটু একটু করে মরেছি। আর পারছি না। তাতে আমার পাপের বোঝা বাড়লে বাড়বে। কেন, সেদিন যে তোর সোয়ামি চণ্ডীমণ্ডপে কেষ্টঠাকুরের গল্প শোনাচ্চিল? আমি তো গেচিলাম। কৃষ্ণ শিশুপাল না কোন এক রাজার নিরানব্বইটা অপরাধ ক্ষমা করেচিলেন। একশোবারের বার তার মাথা কেটে চিলেন। বল, কাটেননি? সে ঠাকুর বলে অত সয়েচে, আমিও তো এতদিন সয়েচি রে! তুই সেদিন কী যেন বললি, কৃষ্ণসিন্ধুকী না কী …!’
চন্দ্রপ্রভার মতো নীরস মানুষও কাঁদছিল। নীলা ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরল।
‘যা হয়েছে হয়েছে। কেঁদো না চাঁদুমাসি! সামনে আমাদের অনেক বড় কাজ!’
.
কোথা থেকে কী হল কে জানে, চন্দ্রপ্রভা জড়িয়ে ধরল নীলাকে। নীলা বাধাও দিল না, কোনও কথাও বলল না।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল রহমান চাচা, ‘ফণীভূষণ ব্যাটা আমার কাছেও এসেছিল। ওই লড়কা সত্যিই এখানে আছে। দেরি করিস না আর। ফেরিঘাটে চলে যা। ওখানে তোর জন্য দীনবাঈ অপেক্ষা করছে।’
নীলা সচকিত হয়ে উঠল, ‘দীনবাঈয়ের সঙ্গে কোথায় যাব?’
‘পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে।’
‘পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে! সেখানে আমি ঢুকব কেমন করে! ফেরিঘাটে অপেক্ষা করলেই তো হয়।’
‘যদি সে না বেরিয়ে আসতে পারে? তবে তুই কী করবি?’ রহমান চাচা বলল, ‘দীনবাঈ তোকে নিয়ে যাবে। ওর কাছে ঝাড়াদারদের জামা আছে। তোকে লড়কা সেজে ঢুকতে হবে বেটি! পারবি তো?’
আবেগে নীলার কথা বন্ধ হয়ে গেল।
পারবে ও? এতবছর পরে ইন্দুদাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে?
দম আটকে মরে যাবে না তো উত্তেজনায়? এতদিন পর ইন্দুদাদা ওকে দেখে কী বলবে? না। নীলা ওকে কোনও কথা বলতে দেবে না, অনেক কথা বাকি আছে, কিন্তু সেসব কিছু হবে জাহাজে চড়ার পর। নীলার কাজ শুধু ইন্দুদাদাকে টেনে বাইরে বের করে আনা।
ভাবতেই হাসি পেল নীলার। কতবছর আগে ইন্দুদাদা ওকে পক্ষীরাজ ঘোড়ার উলটো গল্প শুনিয়েছিল। রাজকন্যা ঘোড়ায় চেপে গিয়েছিল বন্দি রাজপুত্রকে উদ্ধার করতে। নীলা আষাঢ়ে গপ্পো বলে উড়িয়ে দিয়েছিল।
আজ কি সেই উলটো গল্প সত্যি হওয়ার দিন?
বিহ্বল নীলা ধীর পায়ে হেঁটে চলেছিল চন্দ্রপ্রভার সঙ্গে।
এতকিছুর পরেও আকাশে চাঁদ একইরকমভাবে লুকোচুরি খেলছে মেঘের আড়ালে। নীচে দুই অসমবয়স্কা নারীর বালিচরে হাঁটা দেখে সে হাসছে নীরবে। তার আলোয় মাখামাখি করে দিচ্ছে গোটা সমুদ্রপ্রান্তর।
লীলাকে সেজেগুজে ঘরে ঢুকতে দেখে হেমাঙ্গিনী হাসলেন, ‘আয়।’
হেমাঙ্গিনীর পাশে বসে আছেন আরেকজন মহিলা। তাঁর চেহারা বেশভূষা যেমন সম্ভ্রান্ত, মুখের হাসিটিও তেমন অভিজাত। কিন্তু তাতে অহমিকার লেশমাত্র নেই, আলোকিত হয়ে রয়েছে আন্তরিকতা।
ইনি ব্রাহ্ম সমাজের এক বিখ্যাত মানুষ, সকলেই প্রায় চেনে। অবলা বসু। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী।
তবে সেটা তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়।
লীলা মাথা নীচু করে প্রণাম করল। অবলা তাকে দু’হাত ধরে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চিবুকে হাত দিয়ে আদর করলেন। তারপর স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘কতদিন পর দেখলাম তোকে। কেমন আছিস?’
‘ভাল খুড়িমা। তুমি কেমন আছ? খুড়োমশাই?’
‘আমরা দু’জন নিজেদের কাজ নিয়ে ভালই মেতে আছি রে। উনি রয়েছেন ওনার গবেষণা নিয়ে, আমি রয়েছি ব্রাহ্ম গার্লস নিয়ে।’ অবলা মিষ্টি হাসলেন, ‘তুই কেমন আছিস বল। বাবা-মা ভাল আছেন?’
‘হ্যাঁ। আমি এখন এ-বাড়িতেই আছি কিছুদিন।’ লীলা হাসল, ‘খুড়োমশাই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিএসসি পেলেন। তাঁকে আমার প্রণাম জানিও।’
‘তুই গিয়েই প্রণাম করে আসিস নাহয়? কতদিন তো যাস না। তবে গেলে ওনার দেখা পাবি না ধরে নিয়েই যেতে হবে।’
‘কেন?’
‘বাহ, বিজ্ঞান মন্দির নিয়ে উনি যে দিনরাত মেতে রয়েছেন। খরচ তুলতে বক্তৃতা দিচ্ছেন এদিক ওদিক। তবুও কত ধারদেনা হয়ে যাচ্ছে।’ অবলা হাসলেন, ‘তোর পড়াশুনো কেমন চলছে।’
‘ভাল।’
‘ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে আছে?’
‘নাগো। আমার ইচ্ছে এগ্রিকালচারের দিকে। দেখি কী হয়!’
হেমাঙ্গিনী এতক্ষণ চুপ করে কথোপকথন শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘তুই কোথাও বেরোচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ।’ লীলার হাসিখুশি মুখটা ম্লান হয়ে এল, ‘পোস্ট অফিসে যাচ্ছি খুড়িমা। প্রায় একমাস হয়ে গেল ওদিক থেকে কোনও চিঠি পাইনি। না নীলা, না গৌরীপ্রসন্ন। কী হল বলো তো?’
‘অত ভাবিস না। কোনও কারণে হয়তো ব্যস্ত আছে।’
‘হুম। তাই হবে।’ লীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বেরিয়ে গেল।
.
লীলা বেরিয়ে যেতে অবলা বললেন, ‘তুমি কি খবরটা শুনেছ হেম?’
‘কী খবর দিদি?’
‘আমি এখনও নিশ্চিত জানি না, কিন্তু শুনলাম, উল্লাসকরের শরীরটা নাকি ভাল নেই ওখানে।’
‘সেকি!’ চমকে উঠলেন হেমাঙ্গিনী, ‘তুমি কেমন করে জানলে?’
‘মাদ্রাজে আমার এক বন্ধু আছে। সে ওখানকার ডাক্তার। উল্লাসকরকে নাকি আন্দামান থেকে মাদ্রাজে পাঠানোর ভাবনাচিন্তা চলছে। ও এইটুকুই খবর পেয়েছে। কী অসুস্থতা, সেটা বিশেষ বলতে পারল না। তবু আমি অন্য সূত্র থেকে জানার চেষ্টা করছি।’
হেমাঙ্গিনীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। অবলাই প্রথম মেয়েদের মধ্যে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। তখনও কলকাতায় মেয়েরা ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেত না। অবলার বাবা দুর্গামোহন দাস তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সুদূর মাদ্রাজে। কিন্তু সেখানে অবলার শরীর বারবার খারাপ হচ্ছিল। ফাইনাল ইয়ারের আগে তিনি পড়া ছেড়ে চলে আসেন। বিয়ে করেন জগদীশচন্দ্রকে। তার বছরকয়েক পর ব্রাহ্ম সমাজেরই নেতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির স্ত্রী কাদম্বিনী ডাক্তার হয়েছেন।
অবলা যদি পড়া না ছাড়তেন, তিনিই হতেন প্রথম মহিলা ডাক্তার। তবে অবলা মোটেই বসে নেই, তিনি নানারকম কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।
অবলা বললেন, ‘আচ্ছা, অরবিন্দ ঘোষ কোথায়? সেই যে তাঁকে সরকার গ্রেফতার করতে পারল না, তারপর থেকে কোনও খবরই তো নেই!’
‘শুনেছি তিনি এখন পণ্ডিচেরীতে সবার চোখের আড়ালে যোগ সাধনা করেন।’ হেমাঙ্গিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেও বলে ফেললেন, ‘আর উনি যে ছেলেগুলোকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তারা জেলে পচছে।’
অবলা নিরুত্তর রইলেন।
হেমাঙ্গিনী কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা লুকোতে পারলেন না, ‘তুমি উল্লাসের একটু খোঁজ নাও দিদি।’
‘হ্যাঁ নিচ্ছি। মাদ্রাজে তো আমাদের সময় মেয়েদের কোনও হস্টেল ছিল না। আমি এক সাহেবের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকতাম। ডঃ জেনসেন। তাঁর ছেলে মাদ্রাজেই কার্গো শিপে কাজ করে। আমি তাকেও চিঠি লিখেছি। যদি সে কিছু জানতে পারে। কেন, উল্লাসের পরিবার যদি সরকারকে চিঠি লেখে, ওরা তো জানাতে বাধ্য!’
‘পরিবার বলতে ওর বুড়ো বাবা-মা। দু’জনে এমনিই খুব দুঃখে আছে দিদি। ভালমন্দ না জেনে তাঁদের দুঃখ বাড়ানো ঠিক নয়।’ হেমাঙ্গিনী ঘাড় নাড়লেন, ‘তাছাড়া অন্য কেউ হলে এত চিন্তা হত না। উল্লাস যে সকলের চেয়ে আলাদা, দিদি! কখন রাগের মাথায় জেলের কোন সাহেবকে কী করে বসবে, সেই ভয়েতেই আমরা কাঁটা হয়ে থাকি।’
অপেক্ষা করতে করতে মকবুলের চোখ লেগে এসেছিল আলগা। হঠাৎ জেলের প্রতিটি দেওয়াল বিদীর্ণ করে ভীষণ জোরে সাইরেন বাজতে শুরু করল। একবার দু’বার। সাইরেন বেজেই চলেছে। ওয়ার্ডাররা ছুটোছুটি শুরু করল।
কী হল? ওরা কি এরই মধ্যে চলে এল? কিন্তু মাইন ফাটার কোনও শব্দই তো শোনা যায়নি!
বুটেদের ছোটাছুটি বাড়তে থাকে। উদভ্রান্ত ওয়ার্ডার টিন্ডেল আর জমাদারদের আনাগোনা। জুতোর শব্দ। লাঠির ঠোক্কর। ফিসফিসানি।
মকবুল দিশেহারা চোখে দেখে। ক্রমশ ও উতলা হয়ে ওঠে। এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ কোন জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় জেলের সমস্ত প্রহরীরা জেগে উঠেছে। সাইরেন বাজছে নানারকম।
আসফান্দ ওয়ার্ডার ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিল। মকবুলকে দেখে বলল, ‘ঝুল রহা হ্যায়। ঝুলছে।’
‘ঝুলে পড়েছে? কে ঝুলে পড়ল?’
উত্তর মেলে না। দৌড়োদৌড়ি বাড়তে থাকে। এই রাত্রেই নাকি রস আইল্যান্ড থেকে ছুটে আসছেন সুপার আর জেলার। আসছেন মেজ সেজ সবরকম কর্তারা। গোটা জেলে হুলস্থুল।
মকবুল হতভম্ব মুখে বসে পড়ে।
তবে তো আজকের পরিকল্পনা ব্যর্থ!
***
ওদিকে দীনবাঈ, জুঁইবালা আর নীলা অপেক্ষা করছিল মহিলা জেলের পেছনের দিকে। নীলার পরনে সাফাইকর্মীর পোশাক। দীনবাঈ পরিয়ে এনেছে। নীলাকে দূর থেকে বটেই, সামনে এলেও কেউ মেয়ে বলে চট করে বুঝে উঠতে পারবে না।
এই জায়গাটা খুবই নিরাপদ। সেখান থেকে অন্ধকারে ডানদিকে এগোলেই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড। চাঁদুমাসি নীলাকে দীনবাঈয়ের হাতে সঁপে দিয়ে বলেছে, ‘যাওয়ার সময় দেখা করে যাবি।’
এমন সময় ঝড়ের মতো সেখানে এল শেখর। বলল, ‘কী ব্যাপারটা হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’
‘কিঁউ?’ দীনবাঈয়ের চোখে প্রশ্ন।
‘জেলে অনেক হইচই হচ্ছে। কিছু একটা হয়েছে। অথচ এখনও তো মাইন ফাটেনি।’
কথা বলতে বলতে নীলার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নীলা চোখ সরিয়ে নিল।
.
শেখর নীলাকে একটু তফাতে নিয়ে এল, ‘রাগ করিস না। মান ভাঙানোর সময় এটা নয়।’
‘বলতে লজ্জা করছে না তোমার? মান? মান লোকে তার ওপর করে, যাকে সে মন দিয়েছে। তোমায় আমি কোনওদিনও কিছুই দিইনি। হ্যাঁ, গ্রামের দাদা বলে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আজ বুঝলাম, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ শুধু গল্পেই হয়। বাস্তবে নয়।’
শেখর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল নীলার দিকে। তারপর হঠাৎ হাত চেপে ধরল, ‘আমি … আমি ইন্দ্রর কোনও ক্ষতি চাইনি নীলু! আমি ওকে জাহাজে তুলে দেব, কিন্তু তুই আমার হবি, কথা দে!’
‘এসব কী বলছ তুমি, শেখরদা!’ রাগে ঘৃণায় নীলা কান চাপা দেয়।
‘ঠিকই বলছি। আমি জানি, গৌরীজ্যাঠার সঙ্গে তোর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নয়। হলেও আমার কিছু যায় আসে না।’ শেখর লালচোখে তাকাল, ‘ইন্দ্র একখানা কাপুরুষ। হুজুগে পড়ে বিপ্লবীদের দলে ভিড়ে গিয়েছিল। সব খবর আছে আমার কাছে। এখানে আসার পর দিনরাত খালি কাঁদে। আর আমি দিনরাত এক করে লড়ছি। তোর কি তফাত চোখে পড়ে না?’
নীলা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘পুরুষমানুষ বুঝি কাঁদতে পারে না? পুরুষমানুষ মানেই তাকে কাউকে কাঁদাতে হবে? রাগ দেখাতে হবে? গায়ে হাত তুলতে হবে? গালাগাল করতে হবে? না শেখরদাদা। পুরুষমানুষের আসল পৌরুষ কী, জানো? তার মায়ায়, মমতায়। তার নরম মনে। তোমরা ভাবো বুঝি, নরম মন মানেই মেয়েলিপনা। তা নয়। যে পুরুষ যত নরম, তার শরীরে যত ধৈর্য, যত দয়া, সে তত বেশি করে পুরুষ। অন্তত আমার কাছে। বউয়ের ওপর বীরত্ব দেখানো বীরপুরুষ জীবনে অনেক দেখেছি, আর তেমনটি চাই না। ছায়া দেওয়া গাছের চেয়েও মেয়েদের বেশি দরকার পড়ে পাশে হাঁটার জন্য এক বন্ধুর। ইন্দ্রদাদা যতদিন আমার জীবনে ছিল, সে আমার তেমনই এক বন্ধু ছিল। এই বন্ধুত্বের মানেটুকু বুঝলে আজ আমাকে এত বড় ধোঁকা দিতে না তুমি।’ নীলা একটানা বলে হাঁপাতে লাগল।
শেখর নিরুত্তর রইল। তারপর বলল, ‘ঝোঁকের বশে ভুল হয়ে গেছে। আমায় ক্ষমা করে দে।’
‘আমার ক্ষমায় কী আসে যায়? তুমি আগে যমুনার কাছে ক্ষমা চাও, শেখরদা। দুধের শিশুর মা’কে অবধি তুমি ছাড়োনি।’
শেখর আরক্তমুখে বলল, ‘শরীর সবসময় কি কথা শোনে?’
নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘মানুষের সঙ্গে অন্য সব জন্তুজানোয়ারের কি তফাত জানো? মানুষের আছে সংযম, যা অন্য কারুর নেই। সেই সংযমই যদি রাখতে না পারো, তবে আর কথা বাড়িও না।’
দু’জনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। জেলের দিকে কোলাহল বাড়ছে ক্রমশ।
নীলা ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল। কখন ইন্দ্রদাদাকে দেখবে? মনে মনে ও বেশ বুঝতে পারছিল শেখরের মনের দোলাচল। শেখরদা মানুষটা হয়তো একেবারে খারাপ নয়। মানুষের ভেতরে ভাল খারাপ দুই থাকে। ভাল মানুষের মধ্যের শয়তানও মাঝে মাঝে জেগে ওঠে। তবে তারা সেই শয়তানকে সময়মতো ঘুম পাড়িয়ে দিতেও জানে।
শেখরদা কি তেমন করতে পারবে?
.
ওর চোখের সামনে ফটিকের সেই মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্যটা ভেসে উঠল হঠাৎ করে। খুব অবসন্ন লাগছে। খুব।
.
কিছুটা ইতস্তত করে নীলা শেখরের দিকে ফিরে তাকাল, ‘এই এতবড় দ্বীপে তুমি আমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধু শেখরদা। আমার শ্রীফলতলার মাটির গন্ধ পাই তোমায় দেখলে। তুমি সেই গন্ধটা আমার থেকে কেড়ে নিও না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি।’
‘আমার মরা মায়ের দিব্যি, আমি আর কোনওদিনও এমন করব না নীলু!’ শেখর চঞ্চল হয়ে উঠল, ‘কিন্তু ওরা এখনও তো এল না।’
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দীনবাঈ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হুড়মুড় করে ছুটে এল একটা লোক। শ্যামলাল।
.
এসেই সে হাউমাউ করে উঠল, ‘সবেবানাশ হয়ে গেছে।’
‘কী হয়েছে? মাইন কি ফাটেনি?’
‘না। তার আগেই জেলের সব সাইরেন বেজে উঠেছে।’
‘কেন?’
‘একজন বন্দি তার কুঠুরিতে গলায় দড়ি দিয়েছে।’
‘সেকী!’
‘হ্যাঁ। রাজবন্দি।’
‘কী নাম?’
‘নাম? নামটা … নামটা …!’ শ্যামলাল মাথা চুলকোয়, ‘যাহ, ভুলে গেলাম।’
‘এতো ভাল মওকা!’ দীনবাঈ নীলার দিকে তাকাল, ‘ওখানে এখন হালহকিকত বিগড়ানো। কেউ ভাল করে খেয়াল করবে না। চল, তোর নাগরকে গিয়ে নিয়ে আসি!’
নাগর! নীলার মুখে লালচে আভা জমা হল।
নীলা আড়ষ্টপায়ে দীনবাঈয়ের সঙ্গে ঢুকল পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে। একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ চারপাশে। মহিলা জেলের আদলেই এই ওয়ার্ড, তবে এখানে ভিড় অনেক বেশি। দীনবাঈ ঢুকল কেজো পায়ে, ঢোকার সময় দুটো প্রহরীর সঙ্গে রগড় করল, তারপর নীলাকে সঙ্গে নিয়ে গটগট করে হেঁটে এল পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে।
সেখানে বেশ ভিড়। জেলের কর্মীদের মধ্যে ফিসফাস চলছে। নীলার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে শব্দ হচ্ছিল, কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। দীনবাঈ ফিসফিস করল, ‘কত নম্বর বললি?’
‘৩১৫৫৫.’
‘এই ঝামেলার মধ্যে কাজটা সহজ হয়ে গেল মনে হচ্ছে। তুই সিধে হাঁট। অমন ডরপোকের মতো হাঁটছিস কেন?’
নীলা নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করছিল। ওর পরনে সাফাইকারীর খাকি হাফপ্যান্ট আর জামা। ঢোলা জামায় নিজের নারীত্বকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় ও হাঁটছে ঈষৎ ঝুঁকে। চুল গুটিয়ে ঘাড়ের কাছে বেঁধে তার ওপর পরেছে টুপি।
.
দীনবাঈ এদিক ওদিক খুঁজছিল। ওয়ার্ডের ভেতরে আলো খুবই কম। এই অন্ধকারে কারুর মুখই ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না তো সেলের নম্বর।
কী করা যায়? উদভ্রান্তমুখে হাঁটতে হাঁটতে ওরা দু’জনে একটা জটলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বারো-পনেরোজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সেখানে।
নিজের কাজের চেয়েও কিছু কিছু সময়ে উদগ্র হয়ে ওঠে কৌতূহল। দীনবাঈ নীলার হাত ধরে ঠেলেঠুলে ঢুকল সেখানে। একে ওকে ঠেলে চলে গেল গরাদের একেবারে সামনে।
নীলা দীনবাঈয়ের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ রাখল কুঠুরিতে। এমন একটা কুঠুরিতে সেও বন্দি ছিল দীর্ঘদিন।
কুঠুরির ভেতরটা অন্ধকার, অন্য সময় কিছু দেখা যায় না। কিন্তু এখন দরজা খুলে সেখানে বসানো রয়েছে মস্ত একখানা হ্যাজাক। সেই হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে কুঠুরিটি।
লম্বাটে আয়তাকার কুঠুরি। লম্বালম্বি এগিয়ে দেওয়াল। সেই দেওয়ালে ঝুলছে একটা মানুষ। তার গলাতে একটা দড়ি শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে। দড়ির অপর প্রান্ত বাঁধা রয়েছে কিছু ওপরের ঘুলঘুলিতে। দড়ি? নীলা ভাল করে দেখে বুঝল, কয়েদির জামা ছিঁড়ে বানানো হয়েছে দড়িখানা।
বীভৎস দৃশ্য সামনে। নীলা একবার দেখেই চোখ বুজে ফেলল। যে মানুষটা ঝুলছে, তার ঘাড় ভেঙে গেছে। জিভ বেরিয়ে এসেছে অনেকখানি। শীর্ণ পা দুটো ঝুলছে শূন্যে। সামান্য গতিতে দুলছে তার গলায় বাঁধা হাঁসুলিটা, যাতে লেখা রয়েছে। হাঁসুলিতে আটকানো রয়েছে একটা চিরকুট।
নীলার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছিল। আজ রাত্রে এই নিয়ে সে দুটো মৃতদেহ দেখল। ও কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, তার আগেই হুলস্থুল বেঁধে গেল। পেটি অফিসার আসতে সবাই শশব্যস্তে জায়গা করে দিল।
দীনবাঈ রয়েছে ওইপাশে, নীলা সরে এল এপাশে। পেটি অফিসার গরাদের তালা খুলল। খোলামাত্র দু’জন জমাদার ঢুকে গেল ভেতরে।
পেছন থেকে একটা রব এল, ‘জেলার সাহেব আসছেন!’
জেলার ব্যারি সাহেব বুটে মসমস শব্দ তুলে এগিয়ে এলেন। তাঁর সাজপোশাক অন্যরকম। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিবাহবাসর থেকে আচমকা উঠে আসতে হয়েছে তাঁকে।
মুখে অবিশ্বাস বিরক্তি আর ভয় খেলা করছে একসঙ্গে।
কী হবে এখন? আলিপুর বোমা মামলার বিখ্যাত রাজবন্দি সুইসাইড করেছে। এতবড় বিপদে জেলার ব্যারি এর আগে কখনও পড়েননি। বোটে আসতে আসতে তিনি খবর নিয়েছেন। যে ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে, সে নাকি কিছুতেই কাজ করতে চাইছিল না। পাহারাদাররা নাকি মারধর করেছিল। খেতেও দেয়নি।
তাই বলে সে কিনা জেলের মধ্যে গলায় দড়ি দেবে?
এবার কী হবে?
এর মধ্যেই সুপারিন্টেন্ডেন্ট মারে সাহেবের কাছে খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রস আইল্যান্ড থেকে এখন তিনি আসতে পারবেন না। তাঁর সহকারী জানিয়েছে, তিনি আকণ্ঠ মদ্যপান করেছেন। ঘুমিয়ে নিয়ে তিনি আসবেন কাল সকালে। কোলফিল্ডেরও তাই অবস্থা। নড়নচড়নের ক্ষমতা নেই।
তখন অবধি কি লাশটাকে এভাবেই ঝুলিয়ে রাখা হবে?
ব্যারির মাথা কাজ করছিল না। এমনিতেই নানা পত্রাঘাতে তিনি সরকারের নিশানায় আছেন। তিনি নাকি মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালান জেলে। এমন অভিযোগ বারবার পৌঁছেছে দপ্তরে।
এবার কী হবে? সারা দেশ তো জ্বলে উঠবে।
না না, তার আগেই যা করার করতে হবে।
ঝুলতে থাকা ছেলেটার নিথর দেহটার কাছে এগিয়ে এলেন ব্যারি। ছেলেটার মুখ থেকে ফ্যানা বেরিয়ে এসেছে।
হাতদুটোয় ছেঁকে ধরেছে মাছি।
কোনও কষ্ট নেই। যন্ত্রণা নেই। ছেলেটার মুখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি।
মুখে রুমাল চাপা দিয়ে দেখছিলেন ব্যারি, হঠাৎ চোখে পড়ল লাশটার গলার হাঁসুলিতে বাঁধা একটা চিরকুট।
সুইসাইড নোট? ভয়ে ব্যারির বুকটা দুলে উঠল। সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে, যেন কেউ দেখেনি, এইভাবে খুব স্বাভাবিকভাবে কাগজটা টেনে নিলেন তিনি, ঢুকিয়ে দিলেন নিজের কোটের পকেটে।
পেছনে কয়েদিদের মধ্যে গুঞ্জন যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটা ছেলে রাগে ফুঁসে উঠল হঠাৎ, ‘জেলার সায়েব! আপনি কী লুকোলেন? দ্যাকান। আমাদের দ্যাকান।’
দুটো ওয়ার্ডার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে গিয়ে আটকাল। সে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাওয়া হল বাইরে। লোকজনের কলরব বাড়ছে।
সবার ভেতরে চেপে রাখা আগুন কি ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে?
.
নীলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, দীনবাঈ ওর কানের গোড়ায় ফিসফিস করল, ‘আর দেরি করলে হবে না। তুই খুঁজতে আরম্ভ কর। এই মওকা। সবাই এদিকেই চোখ লাগিয়ে বসে আছে। তুই চলে আয় আমার সাথে।’
নীলা বাইরে বেরিয়ে আসতে যাবে, এমন সময় ওকে প্রায় ঠেলে দিয়ে কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়াল একটা ছেলে। সে হাঁপাচ্ছে। চোখ টকটকে লাল। তার মুখ ফ্যাকাসে। চিৎকার করে সে বলল, ‘ইন্দ্রদাদা! তুমি মরে গেলে?’
কে মরে গেছে? কে?
নীলা ঝট করে মুখ ঘোরাল।
ছেলেটা আবার চেঁচাল, ‘আমাদের কথা একবারও ভাবলে না ইন্দ্রদাদা!’
নীলা কাউকে ভ্রুক্ষেপ করল না। খামচে ধরল ছেলেটার জামা, ‘কী নাম বললে? কী নাম?’
ছেলেটার মুখের ভাঁজগুলো বেঁকেচুরে যাচ্ছে কান্না চাপার চেষ্টায়। ধরা গলায় সে বলল, ‘ইন্দ্রভূষণ রায়। আমাদের ইন্দ্রদাদা! ই-ইন্দ্রদাদা জেলের মধ্যেই ঝুলে পড়ল। অনেক কষ্ট সয়েচে, আর পারেনি।’
নীলার মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। চারদিক যেন সাদা হয়ে গেল হঠাৎ।
এই নিরস নিকষ জেলের সব দেওয়াল নিমেষে ফুঁড়ে যেন উড়ে এল হাজার হাজার শকুন।
তারা গোল হয়ে ঘুরতে লাগল নীলার ওপর।
চারদিকে বিচিত্র সব শব্দ।
পেছন থেকে আরেকজন হিন্দিতে চিৎকার করে উঠছে, ‘নিজেই ঝুলেছে না মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে? স্পষ্ট দেখলাম, জেলার সাহেব নিজের পকেটে একটা কাগজ ঢুকিয়ে নিল।’
সামনের ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে বলছে, ‘তুমি নিজের চোখে দেখলে সাভারকরভাই? আমরা এর বদলা নেব। কাউকে ছাড়ব না! বন্দেমাতরম!’
‘বন্দে-এ-এ-এ-মাতরম!’
জেলের মধ্যে স্লোগান পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছিল।
নীলার কানে অবশ্য এসব কিছুই পৌঁছচ্ছিল না। ভোঁ ভাঁ।
কানে যেন তালা লেগে যাচ্ছে! জাহাজ নোঙর করছে। উনুনে গরম ভাত ফুটছে। মাঠে গোল্লাছুট খেলার হইহই।
চিৎকার।
জনার্দন টলতে টলতে বাড়ি ফিরছে। হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ফুলির কান্না মিশে যাচ্ছে ক্যারোলিনের কান্নার সঙ্গে। জুলিয়া হাসছেন। হি হি।
তাঁর হাসির শব্দের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে যমুনার কান্নামাখা হাসি।
ওই তো! ওই তো গরাদের ওপাশে শূন্যে ঝুলতে থাকা ইন্দ্রদাদা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখ খুলেছে কেমন।
ভাঙা ঘাড় তুলে দেখছে ওকে। গলায় কালো দাগ।
বলছে, ‘নীলু! তুই এসেছিস? নিয়ে চল। নিয়ে চল আমায়!’
এসে পড়েছে লীলাদিদি আর শোভনাদিদিও। তারা দু’জনে মিলে হাসিমুখে হাত ধরছে নীলার, ‘রবিবাবুর নতুন বইয়ের এই কবিতাটা পড়েছিস?’
নীলা ঘাড় নাড়ছে, ‘কই নাতো! কোন কবিতা?’
লীলাদিদি আবৃত্তি করছে,
আরও আঘাত সইবে আমারো
আরো কঠিন সুরে জীবন তারে ঝংকারো ।।
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে, বাজেনি তা চরম তানে
নিঠুর মূর্ছনায় যে গানে মূর্তি সঞ্চারো।
কবিতাটা কেমন গোল হয়ে ঘুরছে বনবন করে। ঘুরতে ঘুরতে সেটা হয়ে গেল একটা গান।
লীলা আর শোভনা গান গাইছে। নীলা ঠোঁট মেলাচ্ছে।
গানের ধ্বনি এসে মিশে যাচ্ছে ওর কর্ণকুহরে।
কিন্তু সব শব্দ ছাপিয়ে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে অন্য একটা শব্দ। পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটছে!
টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ…।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন