দেবারতি মুখোপাধ্যায়
চারদিকে ফিসফাস। গুঞ্জন। সেলুলার জেলে আলিপুর বোমা মামলার রাজবন্দি ইন্দ্রভূষণ রায়চৌধুরীর নিষ্প্রাণ মৃতদেহটাকে একটা বড় কাপড়ে বেঁধে বের করে নিয়ে আসা হচ্ছিল সেলুলার জেল থেকে।
মধ্যরাত। অন্যদিন এই সময়ে সারাদিন গুরু পরিশ্রমে সব কয়েদি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে।
কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। যতই কুঠুরে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করা হোক, সবাই বিনিদ্র নয়নে জেগে আছে।
.
একজন সাধারণ কয়েদি শৌচ করতে গিয়ে বলল, ‘বিকেলেও তো ওকে দেকলুম! নারকেল ছোবড়ার ধুলোয় মেখে টলতে টলতে যাচ্ছিল। ঘাড়ে একখানা বস্তা ছিল, কাঁধেও আরেকখানা ছিল।
‘হুঁ, আমিও দেকেচি। পায়ের ডান্ডাবেড়িটাও খুলে দেয়নি। হাত নিয়েই কিছুই করতে পারছিল না, তার মধ্যে যদি পা’ও বেঁধে দেয়, তবে কী করবে?’
প্রথম কয়েদি চারপাশ দেখে নিয়ে চোখ নাচাল, ‘সত্যিই ওর গলার হাঁসুলিতে কোনও কাগজ বাঁধা ছিল?’
‘সেইটেই খেয়াল করতে পারচি নে।’ দ্বিতীয় কয়েদি মাথা চুলকোয়, ‘তবে মনে হচেচ, ছিল।’
.
প্রায় আধঘণ্টা পর সেলুলার জেলের পেছনের দরজা দিয়ে ইন্দুভূষণের লাশটাকে বের করে নিয়ে আসা হল। সামনে তিনজন, পেছনে তিনজন সিপাই বইছে কাপড়ে মোড়া মৃতদেহটাকে।
জেলার ব্যারি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিলেন। স্প্রিং দেওয়া কলের পুতুলের মতো তাঁর দু’পাশে হাঁটছিল খোয়েদাদ খাঁ আর গোলাম রসুল। দু’জনেই মুখই যন্ত্রের মতো। ভাবলেশহীন।
ব্যারি বারবার কপালের ঘাম মুছছিলেন। যেভাবে হোক, আজ রাতের মধ্যেই এই ডেডবডিটার একটা গতি করতে হবে। জেলের ডাক্তার এরমধ্যেই এসে Hanged himself by suicide সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন।
তবু সাবধানের মার নেই। সকাল হলে এই নিয়ে আরও চেঁচামেচি হতে পারে।
এমনিতেই হাসপাতালের কম্পাউন্ডার লালমোহন সাহা আজ বিকেলে ছুটতে ছুটতে রস আইল্যান্ডে গিয়ে খবর দিয়েছিল, আজ রাতে নাকি সেলুলার জেলে বোমা পড়বে। ব্যারি বিশ্বাস না করলেও একেবারে উড়িয়ে দেননি।
না, বোমা পড়েনি। কিন্তু এখন ব্যারির মনে হচ্ছে, এর চেয়ে বোমা পড়াও বুঝি ভাল ছিল।
ব্যারি স্থূল দেহটাকে নিয়ে সমুদ্রের তীরে হাঁটতে হাঁটতে বুকে একখানা ক্রস আঁকলেন। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে ডানদিকে তাকালেন, ‘গোলাম রসুল।’
‘জ্বী সার!’
‘স্টিমারটাকে নিয়ে আসতে বলো।’
জেলের নিজস্ব একটা ছোট স্টিমার নোঙর করা থাকে পেছনের গেটে। সেটা মাঝেমধ্যে বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়।
সারেঙ শান্তিরাম প্রস্তুত হয়েই ছিল, ইন্দুভূষণের মৃতদেহটা স্টিমারে তোলা মাত্র সে ব্যারির দিকে তাকিয়ে লম্বা সেলাম ঠুকল।
‘সেলাম সাহেব!’
ব্যারি অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নাড়লেন। ওয়ার্ডে ঢোকার সময় হোতিলাল, সাভারকরদের দৃষ্টি চোখ এড়ায়নি তাঁর। হোতিলাল যদি গোপনে এই নিয়েও একখানা চিঠি ছেড়ে দেয়?
সমুদ্রের কনকনে বাতাসেও ব্যারি ঘেমেনেয়ে উঠলেন। হ্যারি কোলফিল্ড ঠিকই বলেছে। সাবধানের মার নেই। কাল সকালেই একটা এনকোয়ারি কমিটি বসিয়ে দিতে হবে। যাতে পরে দেশে হইচই হলে এই কমিটির রিপোর্ট পেশ করা যায়।
কী বলা যায়? কেন সুইসাইড করেছে?
ভাবতে ভাবতে ব্যারির হঠাৎ উল্লাসকরের মুখটা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ। মাথা খারাপ। ওই অসভ্য ইতর উল্লাসকরের যেমন মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তেমনই এও পাগল হয়ে গেছিল।
সুইসাইড করল কেন?
কেউ যখন পাগল হয়, তার কাজকর্মের তল অন্য কেউ কী করে পাবে?
ব্যারি নিজের মনে বিড়বিড় করে ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন। ইন্দুভূষণের লাশ নিয়ে নৌকো ছেড়ে দিয়েছে। সারেঙ ছাড়াও সেই স্টিমার রয়েছে দু’জন মেথর। তারা সঙ্গে এনেছে খানকয়েক পাথর।
সেই পাথরগুলো তারা লাশের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধছে। হাত। পা। গলা।
নৌকো যখন ভাসতে ভাসতে মাঝসমুদ্রে যাবে, তখন সেই দু’জন মেথর উঠে দাঁড়াবে। লাশটাকে দু’দিক থেকে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে সমুদ্রের গভীর জলে।
ব্যারি একটা চুরুট ধরিয়েছিলেন। চুপচাপ দেখতে দেখতে তাঁর হঠাৎ চোখ পড়ল খোয়েদাদ খাঁ-র দিকে।
সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে ক্রমশ ঢেউয়ের ওঠানামায় দূরে চলে যেতে থাকা স্টিমারের দিকে।
‘কী ভাবছ, খোয়েদাদ!’ ব্যারি প্রশ্ন না করে পারেন না।
খোয়েদাদ খাঁ যেন শুনতেই পেল না। তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবছে সে। শুধু ভাবছে না, বিড়বিড়ও করছে।
চোখের দৃষ্টি কেমন অপ্রকৃতিস্থ।
চোখের কোণে কি জল চিকচিক করছে?
অন্ধকারে ভাল দেখতে পেলেন না ব্যারি।
অনেকক্ষণ পর খোয়েদাদ মুখ খুলল। বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! ছেলেটা… ছেলেটা বড় ভাল ছিল, হুজৌর!’
দূরে তখন নৌকোটা একটা বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। খুলনার শ্রীফলতলা গ্রামের রায়চৌধুরী বাড়ির ছেলে ইন্দ্রভূষণ ভাসতে ভাসতে চলে গেছে অনেকদূর। অবশেষে সে মুক্তি পেয়েছে সেলুলার জেল থেকে।
আর কিছুক্ষণ মাত্র। তারপরই তার শীর্ণ ক্লিষ্ট দেহখানা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে সমুদ্রে।
তার আত্মা অনেকক্ষণ আগেই গিয়ে মিলেছে পরমাত্মার সঙ্গে, এবার নশ্বর দেহটাও মিশে যাবে জলে। হয়তো কোনও ক্ষুধার্ত জলজ প্রাণীর খিদে মিটবে।
সমস্ত যন্ত্রণা, গ্লানি, দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে সে।
গৌরীপ্রসন্ন যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন রাত শেষ প্রায়। আর একটু পরেই পূর্বদিক লাল হয়ে উঠবে।
শান্ত নিস্তব্ধ স্বাবলম্বন গ্রাম। কিছু দূরে আজ যে কতকিছু একসঙ্গে ঘটে গেছে, তার আঁচ সেভাবে এসে পড়েনি এই দরিদ্র গ্রামে। শুধু ফটিককে কারা যেন গলা কেটে খুন করে গেছে, সেটাই কে এসে জানিয়েছে চণ্ডীমণ্ডপে।
তাতে নব্বইভাগ লোকই মনে মনে খুশি।
মেয়েদের মনে স্বস্তি!
শেখর, শ্যামলালের মতো ছেলেদের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি এখনও। সেলুলার জেলের দিক থেকে এখনও মাঝে মাঝেই হুইসলের শব্দ বেজে উঠছে। দূর থেকে কার যেন বিকট হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
শ্যামাপ্রসাদ গৌরীপ্রসন্নকে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। রাতের দিকে এদিকে শিয়ালের উৎপাত আছে খুব। একা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শ্যামাপ্রসাদের হাতে একখানা লাঠি। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, ‘একদিকে ভালই হল, জানো গৌরী!’
‘কী ভাল হল?’
‘হাসপাতালের ওই কম্পাউন্ডার ব্যাটা … কী যেন নাম … লালমোহন … সে পুষ্পকে যখন সকালে ডেকে নিয়ে যেতে এসেছিল, তখনই কিছু আঁচ করেছিল। তড়িঘড়ি গিয়ে লাগিয়েছিল সাহেবদের কাছে। ওরা এমনিতেই মনিটর করছিল। জাহাজে ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস মাইন ফাটেনি!’
‘মাইনে আগুন দেওয়ার আগেই তো আমাদের কাছে খবর চলে এল। সারা জেল জেগে উঠেছে। আজ আর অপারেশন হবে না।’ গৌরীপ্রসন্ন ভারাক্রান্ত স্বরে বললেন, ‘রাজবন্দিরা বলাবলি করছে, ছেলেটা নাকি নিজে আত্মহত্যা করেনি। ওকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে।’
‘সেকি!’
‘হ্যাঁ। মাটি থেকে প্রায় চোদ্দো ফুট উঁচুতে ঘুলঘুলি, তাতে দু’টো লোহার শিকে আঁটা ছিল দড়িটা। নিজে নিজে কেউ অত ওপরে হাত পেতে পারে? যেখানে অনবরত ওয়ার্ডারদের টহলদারি চলছে? তার ওপর ব্যারি দেখতে এসে একটা কাগজ আত্মসাৎ করেছে, অনেকেই দেখেছে। সেটা সুইসাইড নোট হতে পারে।’
‘আলিপুর মামলার কনভিক্ট বলে কথা। দেশে খবর পৌঁছলে দ্যাখো না কী হয়! অরবিন্দ ঘোষের দল। তবে এখানকার প্রশাসন খবরটাকে ধামাচাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। একেবারেই না পারলে সুইসাইড বলে চালাবে। আহাগো, শুনছি মাত্র বাইশ বছর বয়স ছিল ছেলেটার। কত কী করতে পারত।’ শ্যামাপ্রসাদ দুঃখে মাথা নাড়লেন, ‘ওদের আরেকটা ছেলে… খুব ব্রাইট.. উল্লাস।’
‘উল্লাসকর দত্ত।’
‘হ্যাঁ। সে তো পোর্ট মোয়াটে কাজ করছিল। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে শুনলাম। পাগলের মতো হাসছে। হেসেই চলেছে। তাকে নাকি এই সপ্তাহের শেষেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে মাদ্রাজের পাগলা গারদে।’
গৌরীপ্রসন্ন চুপ করে রইলেন। মাসখানেক ধরে বিপিন পালের মেয়ে লীলা চিঠিতে বারেবারে জানতে চাইছে তার ভালবাসার মানুষটার কথা। মেয়েটা উল্লাসকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। যেদিন থেকে উল্লাসের অসংলগ্নতার সংবাদ পেয়েছেন, গৌরীপ্রসন্ন চিঠিতে এড়িয়ে গেছেন সেই প্রসঙ্গ। ভেবেছেন, সাময়িক উত্তেজনায় অমন হচ্ছে, উল্লাসকর সুস্থ হবে দ্রুত। হলেই তিনি লীলাকে জানাবেন। কিন্তু না। আজ নাকি উল্লাসকরকে একেবারে উন্মাদ অবস্থায় পাওয়া গেছে। জেলের ডাক্তার দেখে বলেছেন, উল্লাসকর নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।
গৌরীপ্রসন্ন মৃদুস্বরে বললেন, ‘কবে নিয়ে যাওয়া হবে ওকে?’
‘জানি না। আগে তো আজকের ঝড় সামলাতে দাও এদের! ছেলেটার মুখটা মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠছে। হীরের টুকরো ছেলেগুলোর কী অবস্থা করেছে এরা!’ গৌরীপ্রসন্নর বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন শ্যামাপ্রসাদ, ‘নাহ। চলি। আমাদের লড়াই জারি থাকল। বন্দেমাতরম!’
‘বন্দেমাতরম! সেলুলার জেলের পাঁচিল একদিন ভাঙবেই শ্যামাপ্রসাদ। আজ হোক বা কাল।’
গৌরীপ্রসন্ন বাড়িতে ঢুকলেন। নীলা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাটা দিন যা গেছে, নীলা কোথায়, রস আইল্যান্ড থেকে কখন ফিরেছে, ফিরে কোথায় কার সঙ্গে গেছে, কোনও খবরই রাখতে পারেননি গৌরীপ্রসন্ন।
দরজাটায় আলতো চাপ দিতেই খুলে গেল। অবাক হলেন গৌরীপ্রসন্ন। নীলা দরজা না বন্ধ করেই শুয়ে পড়েছে?
কয়েক পা এগোতেই অবাক হলেন গৌরীপ্রসন্ন। ঘরে নীলা নেই।
বিছানার ওপর একখানা কাগজ চাপা দেওয়া। সমুদ্রের দিক থেকে হাওয়া বইছে।
কাগজটা দুলে দুলে উঠছে বাতাসে।
হতভম্বমুখে কাগজটা তুলে নিলেন গৌরীপ্রসন্ন।
.
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
জ্যাঠামশাই,
আমি নীলামণি, অভিশপ্ত নীলকান্তমণি। নীলা কারুর সয় না। আমি যাকে কাছে টানি, সে-ই শেষ হয়ে যায়। চাঁদুমাসি, যমুনা, দীনবাঈ এদের সক্কলের জন্য আপনাকে এখনও অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে। সেই যে কোন দেশের গল্প বলেছিলেন? সে-দেশের লোকেরা দুর্গটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল? একদিন এই সেলুলার জেলও তেমনভাবেই মাটিতে মিশে যাবে। কৃষ্ণসিন্ধুকীতে আর কোনও মেয়েকে যেন ঘর ছেড়ে এসে প্রতিদিন ইজ্জত বিসর্জন না দিতে না হয়। যমুনার মেয়ে সরস্বতী যেন মানুষ হয়। আর আপনি পারলে পুষ্পকে লেখাপড়া শেখাবেন। ওর নার্স হওয়ার খুব ইচ্ছে। আর ওকে বলবেন, ফণীভূষণ ছেলে কিন্তু মন্দ নয়।
জ্যাঠামশাই, আমাদের মিথ্যে সংসার আজ শেষ হল। আমায় মুক্তি দিয়ে আপনি যে দয়া দেখিয়েছিলেন, তা আমি কোনওদিনও ভুলব না। আমার এক দিদি কলকাতায় আমায় পাঁক থেকে তুলে এনে বসিয়েছিল জলে। আর আপনি আমায় সেই কাদামাখা জল থেকে আলোয় এনেছেন।
দয়া করে আমায় খুঁজবেন না। সাবলন গাঁয়ের ঘরে ঘরে, আমার দেশের গাঁয়ে গাঁয়ে আপনার মতো পুরুষ আরও আসুক। আমার প্রণাম নেবেন।’
আপনার অযোগ্য গিন্নি।
বিমূঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন গৌরীপ্রসন্ন। তাঁর হাত সরে না। পূর্বদিকের আকাশ পরিষ্কার হতে থাকে। সূর্যদেবের আগমনের পূর্বাভাসে চারপাশ সজীব হয়ে ওঠে। দিনের প্রথম বাতাস ভেসে আসে সমুদ্র থেকে।
লবণাক্ত সেই বাতাসে স্বাবলম্বন গ্রাম আড়মোড়া ভাঙার প্রস্তুতি নেয়।
স্বাবলম্বন গ্রামে গৌরীপ্রসন্ন ভৌমিকের ভদ্রাসন থেকে অনেক দূরে এক আলো ঝলমল স্টিমারঘাট। জেটি আর বার্জ পেরিয়ে অন্ধকার জলের ওপর পাতা তক্তার নড়বড়ে সাঁকো।
সেই সাঁকো বেয়ে স্টিমারে উঠেই যেন এক অন্য জগৎ। কাঠের মোটা তক্তা। ইস্পাতের মেঝে। রেলিং লাগানো সরু সিঁড়ি। দোতলায় পরিচ্ছন্ন ডেক। কমিশনারের স্টিমার, তাই ডেকে পাতা সুদৃশ্য চেয়ার। ডেকের পাশে কেবিন। সারেঙের একফালি চিলেকোঠা। অদূরে বাবুর্চির রসুইখানা। একতলায় ইঞ্জিনের ঘর।
চারদিকে আঁকাবাঁকা সাপের মতো কিলবিল করছে পাইপলাইন।
জুলিয়া ডেকের রেলিংয়ে দু’হাতে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর চোখের সামনে উন্মুক্ত সুবিশাল সমুদ্র বিদায় জানাচ্ছিল তাঁকে। তাঁর স্বামী বিদায়ক্ষণেও ব্যস্ত, আজকের ঘটনায় সারারাত জাগতে হয়েছে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহে সবেমাত্র এসে পৌঁছেছেন জাহাজে। বিশ্রাম নিচ্ছেন কেবিনে।
.
ইঞ্জিন ঘর থেকে ভট ভট আওয়াজ আসতে লাগল। তক্তার সাঁকো খুলে গুটিয়ে নেওয়া হল। ঘড়ঘড় করে শব্দ হতে লাগল নোঙর তোলার।
স্টিমার এগোতে শুরু করেছে। আকাশে পূর্বদিকে ক্ষীণ হয়ে জাগছে কমলা আলো। শুরু হচ্ছে আরও একটা নতুন দিন। জুলিয়া সেই সাগরের বুকে সেই অনন্যসুন্দর সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বুকের ক্রশটা ধরে অস্ফুটে বললেন, ‘হোলি জেসাস!’
তাঁর মনে পড়ে গেল প্রিয় কবি মিল্টনের একটা কবিতা। নিজের মনেই তিনি আবৃত্তি করতে লাগলেন। থেমে থেমে। কবিতার প্রতিটি শব্দ নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিচ্ছিলেন তিনি।
Woods and groves are of thy dressing
Hill and dale doth boast thy blessing.
Thus we salute thee with our early song
And welcome thee– and wish thee long!
খালাসিরা সার্চলাইট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছায়াপথের মতো আলো ফেলছে সমুদ্রে। সেই ছায়াপথে গোল হয়ে ঘুরছে জলের পোকাগুলো। যেন অতল জলের কোন ঘূর্ণিপাক। স্টিমারের সামনের জল সমুদ্রের বুক চিরে ছুটে চলেছে সাদা ফেনা তুলে।
জুলিয়া ঝুঁকে পড়লেন রেলিংয়ে ভর দিয়ে। হাওয়ায় তাঁর বাদামি চুল উড়ছে। নীচের ইঞ্জিন ঘরে বয়লারের লকলকে আগুনে কয়লা দিচ্ছে একজন খালাসি। আর সঙ্গে তালে তালে হাপরের মতো ওঠানামা করছে স্টিম ইঞ্জিনের জোড়া জোড়া ডানাগুলো।
.
স্টিমার যত এগোচ্ছে, পূর্বদিক তত ফরসা হচ্ছে।
জুলিয়া চুপচাপ দেখতে থাকেন ভোররাতের প্রকৃতিকে। দেখতে দেখতে তাঁর ঘোর লেগে যায়। দূরে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। সমুদ্রের নীল রঙে মিশে যাওয়া সবুজের সারি। উঁচু নিচু পাহাড়।
স্বাবলম্বন গ্রাম।
ফিকে হয়ে আসে সেলুলার জেলের উঁচু সেন্ট্রাল টাওয়ার। হাজার হাজার চোখের জল মিশে যাওয়া কান্না। রক্ত। ঘাম।
দূরে সরে যায় যমুনা। চন্দ্রপ্রভা। জুঁইবালারা।
ক্ষীণ হতে থাকে কৃষ্ণসিন্ধুকী।
জুলিয়ার নাকে মিলে মিশে যায় জ্বালানি তেল কয়লা আর রসুইঘরের মশলা মেশানো এক অদ্ভুত গন্ধ!
সামনে লম্বা পথ। নতুন শহর। বোম্বাই!
.
জুলিয়া পিছু ফিরে ডাকেন, ‘ক্যারোলিন! ক্যারোলিন!’
বারদুয়েক ডেকেও সাড়া না পেয়ে পিছু ফিরে অবাক হলেন জুলিয়া। তাঁর মেয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসেছে তাঁর দিকে। উত্তেজিত চোখ মুখ। আধো আধো স্বরে ইংরেজিতে বলছে, ‘মা, আমি একটা কথা শিখেছি, বলব?’
‘বলো ডিয়ার!’ জুলিয়া মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দেন।
ক্যারোলিন মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দেয়, ‘বন্ডে মাটরম!’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন