কৃষ্ণসিন্ধুকী – ১৫

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

‘পূজনীয় লীলাদিদি।

 বাইরে বেরিয়েচি, আজ তার তিন মাস পুরল। এতদিন জেলের খুপরিতে বন্দি ছিলাম। দ্বীপটাকে ভাল করে দেখতে পাইনি। এখন দেখি। আমাদের এখানকার এই ‘সাবলন’ গ্রাম খুব শান্ত, জানো। কাত্তিক মাস শুরু হয়েচে সবে। আমাদের দেশের মতো এখানে পেকে আসা ধান নেই, তাই ধানের ওপর শেষ রাতের শিশিরও নেই। কিন্তু খাল আছে। বিল আছে। সেই খালপাড়ে সারি সারি নারকেল গাছ আচে, জানো! আর আছে যখন তখন বৃষ্টির ভিজে গন্ধ। ভোরবেলা উঠে যখন উঠোন ঝাঁট দিই, সারারাত ভিজে হোগলাপাতাগুলো নুয়ে থাকে। উঠোনের এক কোণে মটর শাক আর লাউশাক পুঁতেছিলাম। সঙ্গে শশা। কুমড়ো। আর ডেঙোডাটা। তারা আমায় দেখে মুচকি মুচকি হাসে। বলে, এই দ্যাখো তোমার শ্রীফলতলা গ্রাম। কিন্তু তখনই ভুল ভেঙে দেয় দূরের সমুদ্রের হু হু গর্জন। লোনা হাওয়ায় চুল ঘেঁটে যায়। আমি তখন হেঁশেলে ঢুকি। আমার হেঁশেলের মাথায় ছাদ নেই, গোলপাতার ছাউনি। তবু নিজের সংসার। উনুন। পাঁজাভর্তি কাঠ। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে নিয়ে আসি শাপলা। কলমি। হিঞ্চে। দুপুরে খেতে বসে আনন্দে চোখ ভিজে যায়।

ভাবচ এমন লিখচি কী করে? রোজ ওনার কাচে পড়তে বসি যে। বর্ণপরিচয়। যোগ বিয়োগ। উনি আমায় ইংরেজিও শেকাচেচন জানো দিদি। তোমার মতো। আমি গোটা গোটা করে আমার নাম লিখতে পারি এখন। আর তখন তোমার কথা বড় মনে পড়ে।

পাশের বাড়ির যমুনা কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে ওর কোলের মেয়েটাকে রেখে যায়। তার নাম সরস্বতী। সে টলে টলে হামা টানে। ধুপ করে পড়ে যায় কাঠের পাটাতনে। আমি গিয়ে কোলে নিলেই হাপুস কাঁদে। তখন আমার অনেক দূরে মন চলে যায়।

এই দ্যাকো। কী লিখতে বসেছিলাম আর কীসব ছাইপাঁশ লিখে চলেচি। উনি পাক্কা খবর এনেচেন, দেবরাজ সত্যিই এসেচে গো। আনন্দ নিয়ে এসেচে। আমি কাজ খুঁজচি। বাড়ি বসে সময় কাটে না। পরের মাসে তোমায় আবার চিঠি লিকব। আমার প্রণাম নিও।

‘নীলা।’

দু’পৃষ্ঠার চিঠি। অজস্র বানান ভুল। অসংলগ্ন বাক্য। তবু যেন অপরূপ লেখা। পড়া শেষ করে লীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বিকেলবেলা। ছাদের পাঁচিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর মন চলে যায় কোন সুদূরে। ওই যে কমলা রঙের সূর্যটা, সেটা কি আন্দামানেও একইরকম দেখতে? নিজের অজান্তেই ওর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে।

চিঠিটা এসেছে সুদূর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। গৌরীপ্রসন্ন আগেই লিখেছিলেন, ডাক জাহাজে ওঠার আগে চিরুনিতল্লাশি হয়। কেউ চিঠির মধ্যে দিয়ে কিছু পাঠাচ্ছে কি না। চিঠি পড়ানো হয় জেলের দেশীয় কর্মচারীদের দিয়ে। বেশি ঘনঘন একই ঠিকানায় চিঠি গেলে নজরদারি জোরদার হয়।

লীলা চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘কিন্তু সে তো কয়েদিদের জন্য! আপনারা তো মুক্ত!’

গৌরীপ্রসন্ন বোধহয় উত্তর লেখার সময় হেসে উঠেছিলেন, ‘বাড়ির পোষা কুকুরের গলায় যদি চেন নাও থাকে, তবু সে মুক্ত নয়। আন্দামান নিজেই হল Penal Settlement. বন্দি উপনিবেশ। এখানে আমরা যারা বাইরে ঘরবাড়ি করে সংসার করছি কিংবা যারা সেলুলার জেলে রয়েছে, কেউই মুক্ত নয়। নজরদারি থাকেই। তবে চিন্তা নেই। লখিন্দরের লোহার বাসরেও ফুটো ছিল।’

লীলা আবার চিঠিটার দিকে তাকাল। কোনও সন্দেহ নেই, এই কয়েকদিনেই বাসরঘরে ফুটো করার কৌশল নীলাকে গৌরীপ্রসন্ন শিখিয়ে দিয়েছেন। নাকি নীলা নিজে নিজেই শিখেছে? কে জানে! এত বড় চিঠির কেবল শেষের দুটো বাক্য গুরুত্বপূর্ণ।

দেবরাজ সত্যিই এসেচে গো। আনন্দ নিয়ে এসেচে।

দেবরাজ মানে ইন্দ্র। ইন্দ্র রায়চৌধুরী। আনন্দ হল উল্লাস। লীলার উল্লাসকর। উত্তেজনায় লীলার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। যাক। সমুদ্রযাত্রায় কোনও বিপদ হয়নি। ওরা ঠিকমতো পৌঁছেছে। উচ্ছাস ওর শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ছিল।

‘কীরে, কী লিখেছে চিঠিতে?’ ওর বড়দি শোভনা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। বিকেলবেলা কলকাতার বাড়ির ছাদগুলোয় দাঁড়ালে কত কী যে দেখা যায়। কাছেই চৌধুরীদের বাড়ি। তার ছাদে কয়েকটা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। পাশের বাড়ির ছাদে ওড়ানো হচ্ছে পায়রা। নীচে পাড়ার রক। সেখানে কয়েকজন গুলতানি করছে।

কোথা থেকে দমকা বাতাস এসে ওদের চুল উড়িয়ে দিল।

‘নীলু বিয়ে করে সংসার পেতেছে। গৌরীপ্রসন্নবাবুকে।’

শোভনা চোখ বড় বড় করল, ‘সেকিরে! সত্যি তোর এলেম আছে!’

লীলা মাথা নাড়ল, ‘এলেম বলিস না দিদি। নীলু নিজেও কম জেদী না। কীভাবে নাকি জানতে পেরেছিল, আলিপুর মামলার আসামিরা আন্দামানে যাচ্ছে। অমনি বেরিয়ে এল। দিদি, তোর মনে আছে সেদিনের কথা?’

‘আছে।’ শোভনা একটা পেয়ারায় কামড় দিল, ‘ভাবলেই এখনও বুক কাঁপে।’

লীলা চোখ বন্ধ করল। এখন ওরা চলে এসেছে হাজরা পার্কের এই বাড়িতে। আগে থাকত হেদুয়ার কাছে কাঁসারিপাড়ায়। ওদের পাশেই মাটির ঘর। সেখানে থাকত জনার্দন বলে সেই লোকটা। মায়াদয়াহীন পাষণ্ড বলতে যা বোঝায়, লোকটা ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যথেচ্ছ মদ্যপান করে নর্দমায় লাট হয়ে থাকা, বউকে নিয়মিত মারধর করা, পতিতাপল্লিতে গিয়ে পড়ে থাকা কোনও গুণই তার বাকি ছিল না। বাড়ির দুটো বউই পড়ে গিয়ে মরেছিল বটে, তবে লীলার স্থির বিশ্বাস তাদের নেশার ঘোরে জনার্দনই খুন করেছিল।

লীলাদের ব্রাহ্ম সংস্কৃতিময় বাড়ির গা ঘেঁষে ছিল ওদের ঘর। লীলা শোভনা নিরঞ্জনরা যখন গান গাইত বা নাটক করত, কখনও কখনও সে’সব ভেদ করে আসত নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ। লীলা শোভনাদের বাবা বিপিনচন্দ্র প্রতিবাদ করতে গেছেন। লাভ হয়নি কিছুই। কংগ্রেসের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার বক্তৃতা শুনলে উপচে পড়ে সভা, তাকে পাত্তাও দেয়নি জনার্দন। ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। সে নিজের পয়সায় মদ গিলে এসে নিজের বউকে পেটাচ্ছে। কার কী বলার আছে? অবাক করার মতো বিষয় হল, ওর বউরাও ওকেই সমর্থন করেছে। একহাত ঘোমটা টেনে বিপিনচন্দ্রকে বলেছে, ‘আপনার কী দরকার বাবু? আমারই সোয়ামি তো!’

বিপিনচন্দ্র অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন। লীলাদের বলেছেন, ‘তোরা দেখতে পাচ্ছিস? নারীমুক্তির আন্দোলন কবে থেকে শুরু হয়েছে। বিদ্যাসাগরমশাই, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিরা সারাজীবন লড়ে গেলেন মেয়েদের জন্য।’

‘তুমিও তো লড়ছ বাবা। না জাগিলে ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগে না। তুমিই বলেছ।’

‘বলেছি ঠিকই, কিন্তু মেয়েদের একটা বড় অংশ নিজেরাই নিজেদের স্বামীর সম্পত্তি মনে করছে, দেখছিস তো। তাদের ‘আমিত্ব’ বোধটাই জাগেনি। নিজেরা না পাল্টালে বাইরে থেকে কী করে কেউ তাদের পাল্টাবে?’

লীলা শোভনারা তর্ক করেছে, ‘ব্রাহ্মসমাজের মেয়েদের সঙ্গে ওদের গোলালে তো চলবে না বাবা। ওদের বড় হয়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমরা বুঝব না। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ওদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।’

‘তবে তোরাই টেনে বের কর ওদের এই শৃঙ্খল থেকে। দেশোদ্ধারের আগে নিজের পাড়াটাকে উদ্ধার কর। আর তার জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় কী বল তো?’

‘শিক্ষা।’ কলেজ ছাত্রী লীলা আর শোভনা সেদিন সমস্বরে উত্তর দিয়েছিল।

তার কয়েকমাসের মধ্যেই জনার্দনের দ্বিতীয় বউ রহস্যজনকভাবে পা পিছলে পড়ে মারা গিয়েছিল। রেখে গিয়েছিল কোলের একরত্তি মেয়েটাকে।

জনার্দন কালবিলম্ব করেনি। কয়েক মাসের মধ্যে যখন তৃতীয় বউকে ঘরে আনল, তখন প্রথম প্রথম লীলা শোভনা অবাক হয়েছে। এই বউটা একটু অন্যরকম যেন। দুপুরবেলায় সংসারের কাজ সামলে সতীনকন্যাকে নিয়ে সে দাওয়ায় বসে। গুনগুন সুরে গান গায়।

কিছুদিনের মধ্যে আলাপ হয়ে গেছিল। আলাপ থেকে পরিচয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা।

লীলা আর শোভনা বিস্মিত হয়েছিল এটা দেখে যে, জনার্দন তৃতীয়পক্ষটি করেছে একেবারেই অন্যরকম। আগের দুটো বউয়ের মতো নয়, পূর্ববঙ্গের এই কিশোরী মেয়েটি ভদ্র, অক্ষরজ্ঞানও আছে। নাম নীলামণি। খুব শীঘ্রই ওদের কাছে সে হয়ে উঠল নীলু।

প্রতিবেশী এই শিক্ষিতা দুই তরুণীকে নীলু সম্ভ্রমের চোখে দেখে। বলে, ‘তোমরা এখনও আইবুড়ো আছ, বাপ-মা কিছু বলে না?’

‘কী বলবে?’ লীলা আর শোভনা হেসে গড়িয়ে পড়ত, ‘আমরা তো পড়াশুনো করছি। এরপর চাকরি করব।’

‘চাকরি!’ নীলু যেন বিস্ময়ে মাটিতে পড়ে যাবে, ‘এখানে মেয়েমানুষরা চাকরি করে?’

‘করবে না কেন? মেয়েমানুষ হোক ছেলেমানুষ হোক, নিজের পায়ে তো সবার দাঁড়ানো উচিত। তাই না?’ শোভনা সগর্বে বোন লীলার দিকে তাকিয়েছিল, ‘ও তো ফার্স্ট হয় প্রতিবছর। বৃত্তিও পেয়েছে।’

‘তোমরা ইংরেজি পড়তে পারো? আমাদের গাঁয়ের ইন্দ্রদাদাও পারত!’

‘তুই শিখবি?’

জনার্দন সারাদিন বাড়িই থাকত না প্রায়। সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে যেত। ফিরত মধ্যরাতে চূড়ান্ত অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়। যেটুকু উপার্জন করত, বাড়ি ফেরার আগেই তা শেষ করে দিত। নীলু ওর সতীনের মেয়েটিকে নিয়ে সারাদিন ওদের বাড়িতেই থাকত প্রায়। বিশেষ করে লীলার বড় নেওটা ছিল নীলু। লীলা কলেজ যেত। পেছন পেছন ও-ও যেত।

লীলা হাসত। বলত, ‘আমি তো ক্লাসে ঢুকে যাব। তুই কী করবি?’

‘আমি গাছতলায় বসে থাকব।’

ভোরবেলায় উঠে ঘরের সব কাজ সেরে ফেলত নীলা। তারপর চলে আসত আলোকপ্রাপ্তা এই তরুণীদের কাছে। লীলা শোভনারা গান করত, ও মুগ্ধচোখে শুনত। কখনও কখনও গুনগুনও করত। বাড়ির লাইব্রেরির মোটা মোটা বইগুলোয় ভয়মিশ্রিত চোখে হাত দিত। বানান করে পড়ার চেষ্টা করত।

অসম্ভব বুদ্ধিমতী ছিল। পলকে কথা বুঝে ফেলত। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে লীলার। বিপিনচন্দ্র বাড়ি নেই, একজন বাড়ি এসে একটা বড় উপহার দিয়ে গেলেন। প্যাকিং খুলে দেখা গেল, স্বামী বিবেকানন্দের ভারী সুন্দর একখানা তৈলচিত্র।

নীলু মুগ্ধচোখে দেখছিল, ‘ইনি কে গো?’

‘স্বামী বিবেকানন্দ।’

নীলার কী যেন মনে পড়ে গিয়েছিল। থেমে থেমে বলেছিল, ‘যিনি আত্মনির্ভর হওয়ার কথা বলেন? বলেন অন্যের কথা ভাবতে হবে? অন্যের দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে?’

লীলা প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল, ‘তুই জানিস? কী করে জানলি!’

‘একজন বলেছিল আমায়। অনেকদিন আগে।’ নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘আচ্ছা উনি তো কলকাতাতেই থাকেন, তাই না? আমায় একদিন নিয়ে যাবে গো দিদি, এট্টু প্রণাম করে আসব?’

লীলা মাথা নেড়েছিল, ‘উনি তো আর পৃথিবীতে নেই রে।’

‘সেকি!’ নীলা হতাশ মুখে তাকিয়েছিল।

‘তবে সিস্টার নিবেদিতা আছেন। তোকে নিয়ে যাব একদিন। তোকে একদিন বেলুড় মঠেও নিয়ে যাব। যাবি?’

‘বেলুড় মঠ!’ নীলার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠত।

নীলার সতীনের মেয়েটার নাম ছিল ফুলি। ফুলিকে ও যেন অন্ধের যষ্টির মতো আঁকড়ে ধরেছিল। থেকে থেকে বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাত, ‘আমি তো পারিনি। ফুলিকে আমি তোমাদের মতো করে বড় করব গো দিদি!’

‘খুব ভাল কথা তো! পাঁচবছর পেরোক, ইস্কুলে ভর্তি করে দিবি। আমি বাবাকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেব।’ লীলা বলত, ‘তোরই বা আর কত বয়স। তুইও তো ভর্তি হতে পারিস!’

নীলা ম্লান হাসত। আর হাসলেই ওর গালে কিংবা চিবুকে ফুটে থাকা কালশিটেগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত। জনার্দন ওকে নিয়মিত মারত। প্রতিবাদ করার কথা বললে ও বলত, ‘কী হবে গো দিদি? থাকতে তো হবে এখানেই! আমার বাবা তো আর নিয়ে যাবেন না।’

‘আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব? তোকে যদি কোনও মেয়েদের বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া যায়?’

নীলা ভাবত। তারপর বলত, ‘তাহলে ফুলিকে উনি মেরে ফেলবেন গো! আমার মেয়েটা আরেকটু বড় হোক।’

যেদিন সেই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটেছিল, লীলা সেদিন ছিল না বাড়িতে। স্বদেশি আন্দোলনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আসর বসত সুন্দরীমোহন দাশের বাড়িতে। প্রায়দিনের মতো সেই রাত্রেও লীলা থেকে গিয়েছিল হেমাঙ্গিনীর কাছে। শোভনার ততদিনে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিয়ে হয়েছে উল্লাসকরেরই মামাতো দাদার সঙ্গে। শোভনা ছিল শ্বশুরালয়ে।

কী হয়েছিল আজও জানা যায় না, তবে সেই কালরাত্রি কেটে যখন ভোর হয়েছিল, নীলার কোমরে দড়ি দিয়ে থানার পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। জনার্দনই খবর দিয়েছিল থানায়। মধ্যরাতে জনার্দন যখন বাড়ি ফিরে খেতে চেয়েছে, নীলা নাকি খেতে দেয়নি। উল্টে দুর্ব্যবহার শুরু করে। কথাকাটাকাটি বাড়তে বাড়তে একসময় সে সতীনের মেয়েটির গলায় বঁটির কোপ বসিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ফুলির মৃত্যু হয়।

কাঁসারিপাড়ায় দু’একঘর শিক্ষিতবাড়ি বাদ দিলে অধিকাংশই ছিল খেটে খাওয়া নিম্নবিত্তের বাস। আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল সেখানে। নীলাকে যখন পুলিশের গাড়িতে তুলছে, তখন নাকি প্রতিবেশী বউরা ওর গায়ে থুতু ছেটাচ্ছিল। খবর পেয়ে লীলা যখন ছুটতে ছুটতে এসেছিল, ততক্ষণে নীলা থানার হাজতে। লীলা থানায় গিয়েও দেখা করতে পারেনি। দু’দিন পর কোর্টে তোলা হয়েছিল ওকে। শুরু হয়েছিল শুনানি। লীলা প্রতিদিন যেত। যতক্ষণ শুনানি চলত, এজলাসে বসে থাকত । আর শুনানি শেষে যখনই নীলাকে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, লীলা সমস্ত পুলিশি বাধা পার করে চিৎকার করত, ‘তুই চুপ করে আছিস কেন, নীলু? কেন সত্যিটা বলছিস না? কেন?’

নীলা উত্তর দিত না। যেন দেখতেই পাচ্ছে না, এমন ভান করে উঠে পড়ত পুলিশের গাড়িতে। উদভ্রান্ত লীলা কী করবে বুঝতে পারছিল না। বিপিনচন্দ্রের যথেষ্ট পরিচিতি। বাঘা বাঘা আইনজীবী তাঁর বন্ধু। একবার অনুরোধ করলে তাঁরা নিখরচাতেই নীলার জন্য লড়তে পারেন। কিন্তু সবাই একবাক্যে বলে দিয়েছেন, আগে আসামিকে নিজের দোষ অস্বীকার করতে হবে। সে নিজেই যদি বারবার বলে, ‘হ্যাঁ, আমি খুন করেছি,’ কোনও আইনজীবীরই ক্ষমতা নেই তাকে বাঁচানোর।

কিন্তু সেটাই করত নীলা। প্রতিটা শুনানিতে মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে থাকত ও। ইংরেজ বিচারপতি জিজ্ঞেস করলেই বলত, ‘আমিই ফুলিকে মেরেছি।’

বলার সময় ওর মুখে ফুটে উঠত অসম্ভব এক তাচ্ছিল্য। ব্যঙ্গ। উপহাস।

জজসাহেব নিজেও কি কিছু আঁচ করেছিলেন? সেইজন্যই কি শিশুহত্যার মতো গুরুতর অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন?

কে জানে!

যেদিন রায় ঘোষণা হল, শুধুমাত্র সেইদিন পুলিশের ঘেরাটোপে বাইরে বেরনোর সময় সোজাসুজি নীলা তাকিয়েছিল ওর দিকে।

লীলা এগিয়ে গিয়েছিল। বিপিনচন্দ্র পালের কন্যাকে অনেকেই চেনে, দু’দণ্ড কথা বলতে পুলিশ বাধা দেয়নি। ভিজে চোখে লীলা বলেছিল, ‘কেন করলি এমন?’

নীলার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছিল একচিলতে হাসি!

লীলা আবার বলেছিল, ‘তুই বলতিস না, লীলার বোন নীলা! বোন হয়ে দিদির এই কথাটা শুনলি না?’

নীলা সজলচোখে তাকিয়েছিল, ‘শুনে কী করতাম দিদি? হয়তো ছাড়া পেতাম! তারপর? বাপ-মা ঘরে নিত? থাকতাম কোথায়? খেতাম কোথায়? শেষে গিয়ে লাইনে নাম লেখাতে হত।’

‘আমরা কি মরে গেছিলাম রে?’

দৃঢ় মাথা নেড়েছিল নীলা, ‘না দিদি। নীলা কারুর সয় না। দেখলে না, যাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলাম, তাকে চোখের সামনে কেমন দু’টুকরো …!’ বলতে বলতে আর সামলাতে পারেনি ও, ডুকরে কেঁদে উঠেছিল ও।

পুলিশরা আর ঝুঁকি নেয়নি। একেই আদালতে ভিড় উপচে পড়ছিল মেয়ে খুনি দেখার জন্য। টানতে টানতে নীলাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল জেলে।

যাওয়ার আগে পেছন ফিরে নীলা চিৎকার করেছিল, ‘পারলে আমার ইন্দ্রদাদাকে একটু খুঁজো দিদি! ওরও তো বেলুড়মঠে আসার কথা ছিল।’

ইন্দ্রদাদার কথা প্রায়ই বলত নীলা। ওদের গ্রামের ছেলে। ‘ইন্দ্রদাদা’ নামটা উচ্চারণ করলেই ওর মুখে লজ্জার রং খেলে যেত। লীলা রসিকতা করত, ‘তুই কি ইন্দ্রদাদাকে ভালবাসতিস নাকি রে?’

‘যাহ কী যে বলো!’

নীলার হাজতবাসের বছরখানেক পর একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই তার ইন্দ্রদাদাকে খুঁজে পেয়েছিল লীলা। উল্লাসকর একটা রোগাপ্যাংলা ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছিল হেমাঙ্গিনীর কাছে।

‘এ আমাদের বাগানে নতুন এসেছে, খুড়িমা। তোমায় প্রণাম করতে নিয়ে এলাম। অ্যাই ইন্দু, প্রণাম কর। ইনি আমাদের আরেক মা।’ উল্লাসকর এসেই হইচই লাগিয়ে দিল।

ছেলেটির বয়স সতেরো-আঠারো হবে। খুবই কৃশকায়। তবে মুখখানি বড় মায়াভরা। সরল উজ্জ্বল চোখ। ঢিপ করে প্রণাম করতেই হেমাঙ্গিনী ঝুঁকে চিবুকে হাত ছিয়েছিলেন, ‘ওমা এ তো দুধের ছেলে রে। কী নাম তোমার?’

‘ইন্দ্রভূষণ রায়চৌধুরী।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘আজ্ঞে, খুলনা।’

‘খুলনায় তো আমার ননদের বিয়ে হয়েছে। খুলনার কোথায় গো?’

‘শ্রীফলতলা গ্রাম, খুড়িমা।’

লীলা পাশে বসে হারমোনিয়ামে রবিবাবুর নতুন গান তুলছিল। গ্রামের নামটা শোনামাত্র ও চমকে উঠেছিল, ‘শ্রীফলতলা গ্রাম? তুমি … তুমি নীলুকে চেনো?’

ইন্দ্রভূষণ নীরবচোখে তাকিয়ে আছে দেখে লীলা দ্রুত বলেছিল, ‘নীলামণি চক্রবর্তী। কলকাতায় বিয়ে হয়েছে।’

ইন্দ্রভূষণ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাসিমুখে মাথা নেড়েছিল, ‘নীলুকে চিনব না? ও তো আমার গাঁয়েরই মেয়ে। কিন্তু ওর যে যশোরে বিয়ে হয়েছিল? ওহ, মনে পড়েছে। বলেছিল বটে। ওর স্বামী চাকরি করত কলকাতায়। আপনি ওকে চেনেন?’

চাকরিই বটে। পতিতাপল্লির দালালির চাকরি। লীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। শয়তানটা বহালতবিয়তে মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর যে নির্দোষ? সে কি না পচছে জেলের অন্ধকারে। উফ, মেয়েদের জীবন কতটা সস্তা!

ইন্দ্রভূষণ আবার জানতে চেয়েছিল, ‘বলুন না, আপনি কি নীলুকে চেনেন? কোথায় থাকে ও?’

লীলা একটা জোরে শ্বাস নিয়েছিল। নীলার গ্রামে কি তার এই পরিণতির কথা গিয়ে পৌঁছেছে? সম্ভবত না। ও দু’দিকে মাথা নেড়েছিল, ‘আগে চিনতাম। এখন ঠিক জানি না, কোথায় থাকে।’

কথা হয়তো আরেকটু এগোত, কিন্তু যেখানে উল্লাসকর উপস্থিত থাকত, ওর হুল্লোড়ে অন্য যে কোনও কথা একটু পরেই থেমে যেত। উল্লাস হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে একটা গান ধরেছিল।

‘মিলে সব ভারতসন্তান

একতান মন-প্রাণ

গাও ভারতের যশোগান

ভারতভূমির তুল্য আছে কোন স্থান?

কোন অদ্রি অভ্রভেদী হিমাদ্রী সমান?’

চোখ বুজে মনপ্রাণ দিয়ে এমনভাবে গানটা গাইছিল উল্লাস, সবাই আবেগে স্থির হয়ে গিয়েছিল। এই গানটি খুব সাড়া ফেলেছে। লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রথম ভারতীয় আইসিএস। বিদেশি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী হয়েও তিনি দেশমাতৃকার প্রতি ভালবাসা দেখাতে ভয় পাননি। গানটা এখন লোকের মুখে মুখে ঘুরছে।

হেমাঙ্গিনী চিরকালের মায়াবতী, উঠে গিয়ে হাত রেখেছিলেন উল্লাসের পিঠে। উল্লাস লীলার দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। বোধহয় লীলার চোখে খুঁজতে চাইছিল মুগ্ধতাকে। কিন্তু লীলা তখন অন্য চিন্তায় বিভোর।

এই কি সেই ইন্দ্রদাদা, যাকে কিশোরী নীলা নীরবে ভালবেসেছিল?

.

লীলার গভীর চিন্তার জাল ছিন্ন করে শোভনা বলল, ‘আচ্ছা, তুই কী করে আন্দামানে নীলার খোঁজ পেলি?’

‘আমি তো ওর খবর রাখতাম নিয়মিত। আলিপুর জেলে দু’বার দেখা করতেও গেছিলাম। যখন আন্দামান পাঠানোর লিস্টে ওর নাম এল, উল্লাসদা’ই খবর দিয়েছিল এসে। আন্দামানের জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য জোর করে মেয়ে কয়েদিদের পাঠানো হচ্ছিল। উল্লাসদা অনেক চেষ্টা করেছিল ওর নামটা কাটাতে। পারেনি। তারপর যখন ওর নিজেরই সেখানে চলে যেতে হল…!’ বলতে বলতে লীলার গলা ভারী হয়ে এল। বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে ও আঁচলচাপা দিল।

শোভনা এগিয়ে এসে ছোটবোনকে জড়িয়ে ধরল বুকে। উল্লাস সম্পর্কে ওর দেওর। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ভাই। উল্লাসের মতো কপটতাহীন আবেগপ্রবণ সরল মনের ছেলে ও আর দ্বিতীয় দেখেনি। লীলা আর উল্লাস যতটা না ছিল প্রেমিক প্রেমিকা, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল বন্ধু। কতদিন ও দেখেছে, উল্লাস আবৃত্তি করছে। লীলা তন্ময় হয়ে শুনছে। কিংবা নতুন কোনও বিদেশি বই। রাষ্ট্রস্বাধীনতার চিন্তা।

শোভনা দূরে তাকাল। শেষ বিকেলের আলোয় চারদিক লাল হয়ে রয়েছে। কাঁসারিপাড়ার বাড়ি থেকে জাহাজের মাস্তুল দেখা যেত। এখানে তা দেখা যায় না বটে, তবে দিন শেষের এই সময়টাতে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা উড়ে যায়। তাদের ছোট্ট শুভ্র শঙ্খের মতো শরীরগুলোও লালচে আভায় কেমন মায়াবী দেখাচ্ছে।

দিদির বুকে অঝোরে কাঁদছে লীলা। শৈশবে মাতৃহারা ওর এই জীবনে মায়ের মতো বলতে দু’জন। শোভনা আর হেমাঙ্গিনী। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ও বলল, ‘আমার খুব চিন্তায় হয় বড়দি। রাতে ঘুম আসে না। ও এমনিতেই আগুপিছু না ভাবে না। ওখানে শুনেছি পান থেকে চুন খসলে ফাঁসিতে চড়ায়। তারপর লাশ ফেলে দেয় সাগরে।’

‘এত ভেঙে পড়লে হয়? নীলুর কথা ভাব। ওইটুকু মেয়ে জেল থেকে বেরিয়েছে কত বড় পরিকল্পনা নিয়ে। তুই-ই ওর সবচেয়ে বড় ভরসা। আয়, নীচে যাই। ওর চিঠির উত্তরটা লিখে ফেলি দু’জনে।’

লীলা তবু কেঁদে চলেছিল, ‘উল্লাস কি ফিরে আসবে না?’

অস্তায়মান সূর্যদেবকে সাক্ষী করে শোভনা কম্পিতস্বরে বলল, ‘আসবে। উল্লাস ঠিক ফিরে আসবে। একদিন তোরা ঠিক সংসার পাতবি। সংসার পাতবি আমাদের স্বাধীন ভারতবর্ষে। দেখে নিস!’  

 ১৬

অনেকগুলো দিন কেটে গেল, অনেক চেষ্টা করেও নীলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাংলোয় কাজে ঢুকতে পারল না। শেখর জানিয়েছে, সেখানে সবকিছুরই লোক রয়েছে। শেখর সত্যিই চেষ্টা করেছিল নাকি নীলাকে স্তোকবাক্য দিয়েছিল কে জানে! নীলা ছটফট করে। প্রতিবেশিনী যমুনার মেয়েটাকে নিয়ে সময় বেশ কেটে যায় বটে। গৌরীপ্রসন্ন কলকাতা থেকে ডাকে বই আনান। সেগুলোও পড়ার চেষ্টা করে লীলা। সময় লাগলেও হাল ছাড়ে না।

কিন্তু এইভাবে অবসরযাপনের জন্য সে তো জেল থেকে বেরোয়নি! পুষ্প এলেই ও কপট রাগ দেখায়, ‘তুইও তো আমায় একটা কাজ দেকে দিতে পারিস।’

‘কোতায়?’

‘যে দ্বীপে সাহেবরা থাকে, সেকানে।’

‘ওকানে তো আমি কাউকে চিনিনে গো নীলাদিদি।’ পুষ্প বলে, ‘তুমি হাসপাতালে কাজ করবে আমার সঙ্গে? টেকো সাহাকে বলে দেখব তাহলে।’

‘টেকো সাহা কে?’

জেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার। লালমোহন সাহা। ভারী বদ লোক। ‘তুমি হাসপাতালে কাজ করবে?’

‘না। ওকানে কাজ করে আমার কোনও লাভ নেই। তুই তো আচিসই।’ নীলা বলে, ‘তবে তোকে যে কাজটা করতে বলেচিলাম, সেটা তুই আজও করলি না।’

পুষ্প দুঃখী মুখে বলে, ‘আমি চেষ্টা কি করি না নীলাদিদি? সবসময়েই করি। কিন্তু টেকো সাহার নজর এড়িয়ে ঠিক সুবিধে হয় না। যেচে জিজ্ঞেস করলে তো সন্দ করবে। ব্যাটা তো সাহেবদের চামচা।’

নীলা ওর হাত চেপে ধরে, ‘দোহাই পুষ্প। তোর পায়ে পড়ি। ইন্দ্র রায়চৌধুরী। একবার দ্যাকনা ভাই, কোন ওয়ার্ডে থাকে!’

 ম্যাজি

প্রায় আটমাসের মাথায় শেখর নীলাকে কাজে ঢোকাতে পারল। ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোয় হল না, তবে তারই পাশে এক ব্রিটিশ অফিসারের বাড়িতে। তিনি এখানকার জয়েন্ট কমিশনার। নাম মেজর পোর্টওয়েল। পোর্টওয়েলের ছোট্ট সংসার। তিনি। তাঁর স্ত্রী। এবং একটিমাত্র ফুটফুটে শিশুকন্যা। বয়স চারবছর। নীলাকে নিযুক্ত করা হল তারই দেখভালের জন্য।

প্রথম যেদিন কাজ শুরু, সেদিন পূর্ব আকাশে সূর্যের আগমনের আগে ঘুম থেকে উঠে সংসারের সমস্ত কাজ সেরে ফেলল ও। তারপর স্নান সেরে প্রস্তুত হয়ে বৈঠকখানায় অঘোরে নিদ্রারত গৌরীপ্রসন্নকে ও ডাকল।

‘জ্যাঠামশাই। আমি যাচ্ছি।’

গৌরীপ্রসন্ন ধড়মড় করে উঠে বসলেন। এই মানুষটিকে কাছ থেকে যত দেখছে নীলা, শ্রদ্ধায় মন পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তান। বাবার সংস্কৃত টোল ছিল। সংস্কৃত শিক্ষার পাশাপাশি গৌরীপ্রসন্ন ইংরেজি ফারসিও শিখেছিলেন। কিন্তু যৌবনে ডাকাতি করতেন। ধনী বাড়ি থেকে সর্বস্ব লুঠ করে বিলিয়ে দিতেন গরিবদের মধ্যে। গোটা দল ধরা পড়ার পর সকলেরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। শুধু গৌরীপ্রসন্নর হয় দ্বীপান্তর। কারণ তিনি জজসাহেবের প্রশ্নের উত্তরে ভরা এজলাসে বলেছিলেন, তিনি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। দরিদ্র কৃষক জমিতে উদয়াস্ত খেটে ফসল ফলায়, তাই অন্ন জোটে না। এদিকে তারই দেওয়া খাজনায় মহল ওঠে জমিদারের। এই বৈষম্য কেন?

সাধারণ চোর ডাকাত খুনিরা বিপজ্জনক নয়। সমাজ পালটানোর কথা বলা মানুষরা হল বিপজ্জনক। ব্রিটিশ সরকার ঝুঁকি নেয়নি। গৌরীপ্রসন্ন হাতকড়া পরে জাহাজে উঠেছিলেন। পেছনে রয়ে গিয়েছিল তাঁর তরুণী স্ত্রী। পুত্র। কন্যা। সেলুলার জেল তখনও তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন জেল খেটে গৌরীপ্রসন্ন যখন বাইরে বেরিয়েছিলেন, তখনও কি তিনি সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখতেন? নীলার আর প্রশ্ন করা হয়নি।

গৌরীপ্রসন্ন বললেন, ‘আমি দিয়ে আসি তোকে, চল!’

‘আমি একাই যেতে পারব।’

‘সে পারবি না কেন?’ হাসলেন গৌরীপ্রসন্ন, ‘কিন্তু প্রথম দিন। রস আইল্যান্ড অনেক দূর। জাহাজঘাটা থেকে ছোট স্টিমার ছাড়ে। প্রথমদিন তোকে না দেখিয়ে দিলে বুঝবি কী করে! লোকেও ভাববে, দেখেছ, বুড়ো মাস্টার বিয়ে করে এনেই যুবতী বউকে একা একা কাজে পাঠিয়ে দিয়েছে। চল!’

সাতসকালেই জাহাজঘাটায় ভিড়। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের যে ক’টা দ্বীপে ব্রিটিশরা উপনিবেশ গড়েছে, সেগুলোর মধ্যে পরিবহণ ব্যবস্থা পুরোটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে জলপথের ওপর। গৌরীপ্রসন্ন ওকে ভাল করে সব বোঝাচ্ছিলেন। কোন দিক দিয়ে এলে সুবিধা। কোথা থেকে টিকিট কাটতে হবে। রস আইল্যান্ড থেকে শেষ স্টিমার ছাড়ে বিকেল চারটেয়। সেই স্টিমারের ভোঁ শুনলেই কাজ থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে হবে। সব বোঝানোর পর একটা দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন গৌরীপ্রসন্ন।

‘রহমানভাই! ভাল আছেন?’

দোকানদার রহমান উবু হয়ে বসে নিজের সব পসরাগুলোকে স্পর্শ করে করে দেখছিল। নানারকম শাঁখ। প্রবাল। ঝিনুকের খেলনা। বয়স আশি পেরিয়েছে, বছরকয়েক আগে কী এক অসুখে তার দুটো চোখই প্রায়ান্ধ হয়ে গিয়েছে, তবু তাতে সওদা করতে কোনও অসুবিধা হয় না। গৌরীপ্রসন্নর গলা শুনতে পাওয়ামাত্র সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে বড়খুরদার! শাদীকে বাদ আপ গায়েবই হো গয়ে!’

গৌরীপ্রসন্ন হাসলেন, ‘এই যে আমার স্ত্রীকে নিয়ে রস আইল্যান্ডে যাচ্ছি। আজ থেকে কমিশনার সাহেবের বাংলোয় কাজে লাগবে।’

‘বহত বড়িয়া । আপকা নাম ক্যা হ্যায় বিটিয়া?’

‘নীলামণি।’

গৌরীপ্রসন্ন মৃদু হাসলেন, ‘প্রণাম কর।’

নীলা পিঠে আঁচল জড়িয়ে রহমানচাচার পা ছুঁল।

‘সুহাগিন রহো।’ রহমান হাত রাখল নীলার মাথায়।

রহমানের দোকানে কিছুক্ষণ গল্পগুজবের মধ্যেই স্টিমারের বাঁশি বেজে উঠল। গৌরীপ্রসন্ন নীলাকে নিয়ে দ্রুত পা চালালেন। ভোঁ ভোঁ শব্দ আর সারেঙের হুইসল বেজে স্টিমার ছেড়ে দিল।

নীলা চুপ করে বসেছিল। সমুদ্রের হাওয়া এসে ওর চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। এই স্টিমারে যারা যাচ্ছে, সকলেই প্রায় খেটে খাওয়া শ্রেণি। রস আইল্যান্ডে কাজ করতে যায়। বেশ ভিড়। গৌরীপ্রসন্ন দাঁড়িয়ে আছেন। স্টিমারের দুলুনিতে নিজের ভার সামলাচ্ছিলেন। নীলার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বললেন, ‘আসা-যাওয়ার পথে কোনওরকম দরকারে রহমানভাইয়ের কাছে চলে যাবি।’

‘ইনিও কি আমাদের দলে?’ স্টিমারের ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে নীলা চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

গৌরীপ্রসন্ন ভর্ৎসনার চোখে তাকালেন। স্টিমারে নানারকম লোক রয়েছে। এই স্টিমারের প্রতিটি ইঞ্চিতে কান রয়েছে।

বুঝতে পারামাত্র নীলা জিভ কাটল। দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘রহমানচাচাও কি আপনার সময়েই এসেছিলেন?’

‘না। আমার থেকে অনেক আগে এসেছিল রহমান ভাই। লখনউয়ের লোক। উনি কিন্তু রাজবন্দি।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। ওয়াহাবি আন্দোলনের বিপ্লবী। ওয়াহাবি আন্দোলন কী, জানিস?’

‘না।’ দু’দিকে মাথা নাড়ল নীলা।

‘ওয়াহাবিরা দেশ থেকে ইংরেজ শাসন সরিয়ে আগের মতো মুসলিম শাসন কায়েম করতে চেয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহের বছর কয়েক পরে ওদেরও জাহাজে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এখানে।’

‘সেলুলার জেলে?’

‘তখন জেল কোথায়? আন্দামানে তখন একখানা পাকা বাড়িও ছিল না। চারদিকে সাপখোপ আর বিষাক্ত জন্তুজানোয়ার। জারোয়া, ওঙ্গেরা তো আছেই। তার কয়েকবছর আগেই এসেছে সিপাহি বিদ্রোহের বন্দিরা। তাদের দিয়ে সবে তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট। জঙ্গল সাফ হচ্ছে। রহমানচাচাদের এসে তাদের সঙ্গেই হাত লাগাতে হয়েছিল। চাচার কাছে অনেক পুরনো গল্প জমা আছে। যাকগে। ওই দ্যাখ। দূরে দেখা যাচ্ছে রস আইল্যান্ড।’ গৌরীপ্রসন্ন একটানা বলে হাঁপাতে লাগলেন।

নীলা তাকাল। নীল জলরাশির মধ্যে দূরে হঠাৎ উদয় হয়েছে একখণ্ড স্থল। সবুজে ছাওয়া অতি মনোরম দৃশ্য। বিশ্বচরাচরের বাইরে একটা অন্য পৃথিবী যেন। ও ফিরে তাকাল, ‘ওখানে কি অনেক খেজুরগাছ আছে?’

‘খেজুরগাছ? কেন?’ গৌরীপ্রসন্ন অবাক হলেন।

‘আইল্যান্ড মানে তো দ্বীপ। রস আইল্যান্ড মানে রসের দ্বীপ? খেজুরের রস পাওয়া যায়?’

গৌরীপ্রসন্ন হা হা করে হাসলেন, ‘এ রস সে রস নয়। ড্যানিয়েল রস ছিলেন সার্ভেয়র। তিনিই এই দ্বীপটাকে প্রথম সার্ভে করেছিলেন। তাঁর নামে নাম।’

‘ওহ!’

‘এখন সব সাহেব কর্তারা এখানেই থাকেন।’

‘পোর্ট ব্লেয়ারেই তো সেলুলার জেল। আরও সব অফিস। ওরা তো ওখানেই থাকতে পারে।’

গৌরীপ্রসন্ন মনে মনে নীলার বুদ্ধির তারিফ না করে পারলেন না। মেয়েটার পর্যবেক্ষণ শক্তি থেকে ধী ক্ষমতা সবই প্রবল। বললেন, ‘সেলুলার জেলের পাঁচিল পেরোলেই সমুদ্র। তার ওপারেই এই রস আইল্যান্ড। কর্তারা থাকতে চেয়েছিলেন সুন্দর শান্ত পরিবেশে, যাতে প্রতিদিন সুন্দর নৌকাবিহার করে কাজে আসতে পারেন। প্রথমদিককার বন্দিরা অনেক খেটে ঘন জঙ্গল কেটে এই রস আইল্যান্ড তৈরি করেছিল। বুঝলি?’

‘ঘন জঙ্গল আছে নাকি?’

‘এখন কিছুই নেই। পুরো দ্বীপটাই খুব সাজানোগোছানো। বিশাল বিশাল বাংলো। বড় গির্জা। সাহেব মেমদের নাচার জন্য বলরুম। বেকারি। কবরস্থান। জিমন্যাসিয়াম। কী নেই!’ গৌরীপ্রসন্ন ম্লান হাসলেন, ‘আন্দামানের সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপে তুই এবার থেকে সারাদিন থাকবি।’

স্টিমার ধীরে ধীরে নোঙর করছে রস আইল্যান্ডে। মানুষজন স্টিমার থেকে নেমেই পড়ি কি মরি করে ছুটছে যার যার কাজে। নীলা ভাল করে ঘোমটা টেনে গৌরীপ্রসন্নর হাত ধরে সাবধানে নেমে এল।

হঠাৎ দুটো পরিচিত কণ্ঠস্বর।

‘কীগো খুড়ো, এখানে কী করতে?’

স্বাবলম্বন গ্রামের ফটিক সামন্ত আর সুবীর মালাকার। দু’জনেই অবাক চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। প্রশ্নটা তারা গৌরীপ্রসন্নকেই করেছে বটে, কিন্তু তাঁদের দৃষ্টি পাশে দাঁড়ানো নীলার দিকে।

গৌরীপ্রসন্ন অপ্রসন্নমুখে উত্তর দিলেন, ‘এই। পরিবারকে একটু দেখিয়ে দিতে এলাম।’

‘কীসের দ্যাকানো?’ সুবীর সঙ্গে সঙ্গে শুধোয়।

গৌরীপ্রসন্ন ইতস্তত করেন, ‘আজ থেকে এখানে এক সাহেবের বাড়িতে ঠিকে কাজ করবে।’

ফটিক আর সুবীরের চোখদুটো চকচক করে উঠল। একজন রস আইল্যান্ডে রিকশাচালক। অন্যজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাংলোর ঠিকে কর্মী।

 দু’জনের মধ্যে আরও একটি সাদৃশ্য আছে। সাড়ে আটটাকা মনোনয়ন ফি দিয়ে দু’জনেই নীলাকে বিয়ের জন্য আবেদন করেছিল।

ফটিক হলুদ দাঁত বের করে বলল, ‘ইকিগো খুড়ো! বড় মুখ করে বে’ করলে, আর সেই বে’র জল শুকোতে না শুকোতেই বউকে কামাতে পাঠাচ্চ? এ কেমনধারা সোয়ামি গো তুমি! তোমার যে পয়সার এত অভাব, তা তো জানতুম না!’

সুবীর মাথা নাড়ল, ‘নাহয় তোমার মতো পেটে বিদ্যে নেই খুড়ো। বামুনও নই। সেদিন কী সব যেন বলচিলে? শিবঠাউরের জন্য টোপর বানানো না কী? যাই করি, নতুন বউয়ের কামানো পয়সায় খেলে আমি গলায় আঙুল দিয়ে বমি করতুম।’

এখানে আবহাওয়া ভারী অপ্রতুল। চড়চড় করে রোদ উঠে গেছে এরমধ্যেই। গৌরীপ্রসন্ন উত্তর না দিয়েই নীলাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন।

সুবীর পিছু পিছু যায়, ‘আহা অমন সোনার অঙ্গ রোদে গলে যাবে গো। রিকশায় পৌঁচে দেব?’

ওরা ফিরে তাকায় না। উত্তরও দেয় না।

ধূর্ত ফটিক সুবীরকে সামলায়, ‘চেঁচাসনি। থাম। ইদিকে চলে আয়।’

‘থামব কেন?’ ফুঁসে ওঠে গোঁয়ার সুবীর। সাড়ে আটটাকার শোক সে এখনও ভুলতে পারেনি। নিজের পুরুষকার তার সঙ্গে মিশে জন্ম নিয়েছে এক বিষম ক্রোধ।

‘ধুর বোকা! সময় কি চলে যাচেচ নাকি?’ ফটিক মিটিমিটি হেসে তাকে সরিয়ে নিয়ে আসে, ‘ওই দেমাকি মাগিকে আজ নাহয় ওই ঘাটের মড়া এসে দিয়ে যাচেচ। রোজ তো দেবে না। তকন ওর খেয়াল কাদের রাকতে হবে?’

‘কাদের?’

সুবীরের নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হয় ফটিক, ‘আমাদের!’

সুবীর এবার বুঝতে পারে। দুই দীর্ঘ উপোসী পুরুষের বিশ্রী হাসিতে চাপা পড়ে যায় সমুদ্রের গর্জন।

১৭

ফণীভূষণ খুব মুষড়ে পড়েছে। প্রাতঃকৃত্য থেকে ফিরে এসেই সে ওয়ার্ডারকে ভাঙা হিন্দিতে অনুরোধ করছে, ‘ও ভাই। পেটি অফিসারকে বলে আমার এই সপ্তাহের ডিউটিটা পালটে দাও না।’

ওয়ার্ডার লালচোখে ফুঁসে উঠেছে, ‘চোপ শালে! অফসারকে অউর কোঈ কামধান্দা নেহি?’

ফণীভূষণ ম্লানমুখে বসে থাকে। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে, ‘গেল হপ্তায় কত ভাল ছিলাম। ছোবড়া পেটানোর কাজ ছিল। নারকেল ভর্তি বস্তা নাও আর হাতে নাও বালতি, নিজের ঘরে এসে আরামসে কাজ করো। কোনও ঝুটঝামেলা নেই। তা না, এই রোদ্দুরে এখন বনবাদাড়ে ছোটো!’

পাশের সেলের ইন্দুভূষণ ওর বিলাপ শুনে হেসে ফেলল, ‘ছোবড়া পেটানো কবে থেকে আরামের কাজ হল ভাই?’

ফণীভূষণ বলল, ‘রোদ্দুরে ঘোরার চেয়ে তো ভাল!’

ওয়ার্ডার লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এদিক ওদিক টহল দিচ্ছিল। ফণীভূষণের অসন্তাোষ শুনে শব্দ করে হেসে উঠল। ঠিক তখনই পেছনে যমদূতের মতো কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

‘ইতনা খুশ কিউ? ক্যা হুয়া?’

ওয়ার্ডারের প্রাণ উড়ে গেল। পেটি অফিসার খোয়েদাদ খাঁ!

জেলের কয়েদি তো দূর, একটা কর্মীও নেই যে খোয়েদাদ খাঁর নামে কাঁপে না। পাঠান পেটি অফিসার খোয়েদাদ হল ব্যারি সাহেবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর। যেমন ধর্মভীরু, তেমনই একগুঁয়ে। ব্যারি সাহেব ধরে আনতে বললে সে বেঁধে আনে। তাকে যেমন ভীষণদর্শন দেখতে, তেমনই বিকট তার ব্যবহার। বেঁটে, রোমশ, গাড়ে গর্দানে চেহারা। জোড়া ভ্রু। বাঁকা বাঁকা বড় বড় দাঁত। হাতে তার বিখ্যাত লাঠি।

ওয়ার্ডার বলল, ‘দেখুন না সাব, এই ছেলেটা তখন থেকে আমায় পরেশান করছে!’

‘কিঁউ?’

‘ও জঙ্গলে কাম করতে যাবে না। নবাবের মতো সেলে বসে ছোবড়া পেটাবে!’

খোয়েদাদ খাঁ লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে এল ফণীভূষণের সেলের সামনে। ইশারায় খুলে দিতে বলল দরজা। ফণীভূষণের বুকে দ্রিমি দ্রিমি শব্দ হচ্ছিল। খোয়েদাদ খাঁ-র লাঠির প্রতিটি ঠোক্করের সঙ্গে সঙ্গে যেন লাফিয়ে উঠছিল ওর হৃৎপিণ্ডটা।

খোয়েদাদ খাঁ এসে দাঁড়াল ওর একেবারে সামনে, ‘ক্যা হুয়া রে?’

ফণীভূষণ কাঁপা গলায় বলল, ‘আ-আমায় যে কোনও কাজ দিন, জঙ্গলে পাঠাবেন না হুজুর।’

‘কিউ? জঙ্গলমে তেরা মা’কা লন্ডা রহতা হ্যা ক্যা?’

অশ্রাব্য গালিগালাজ সয়ে গেছে সব কয়েদিরই। ফণী বলল, ‘আমার রোদে কষ্ট হয়। গরম লাগে।’

‘গরমি!’ খোয়েদাদ খাঁ এমন অদ্ভুতভাবে তাকাল, যেন সামনে সেলুলার জেলের সেলে ও একটা পেঙ্গুইন দেখতে পেয়েছে।

‘হ্যাঁ সাব। আপনি ব্যারি সাহেবকে একটু বলুন না আমায় যেন সেলে কাজ দেয়।’

‘ব্যারি সাহেবকে?’ খোয়েদাদ খাঁর কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন নরম হয়ে আসে, ‘ঠিক হ্যায়। চল তু মেরে সাথ।’

ফণীভূষণ উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে এগোয়। আর সঙ্গে সঙ্গে খোয়েদাদ খাঁর লাঠিতে আটকে ধড়াম করে উল্টে পড়ে নিরেট মাটিতে। মুখ দিয়ে আর্তনাদ বেরোয়, ‘উহ!’

খোয়েদাদ খাঁ হা হা করে হাসে, ‘তোর শওখ তো বড় কম নয়! ব্যারি সাহেব কি তোর বাপের নৌকর নাকি? চল নিকাল হিঁয়াসে!’

‘ক-কসুর হো গিয়া সাব!’ ফণীভূষণ দ্রুত কুঠুরি থেকে বেরোয়। ওয়ার্ডারের পিছু পিছু। এই সপ্তাহটা পুরোটাই ওর বাইরে কাজ। সকালে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে এক বাটি কঞ্জি গেলা। তারপর ল্যাঙট এঁটে চলে যাওয়া জঙ্গলে। ওয়ার্ডাররা জঙ্গলে পৌঁছে দিয়ে চলে আসে। আবার নিতে যায় বিকেলে। তাই বলে পালানোর কোনও উপায় নেই। একে তো পায়ে পরানো থাকে ডান্ডাবেড়ি। তার ওপর ওই দুর্ভেদ্য অরণ্যের গভীরে ঢুকে পড়লে বন্য প্রাণীর কবলে পড়া। জলে ঝাঁপ দিলে হিংস্র হাঙর। আর ভাগ্যের জোরে হাঙরের পেটে না গেলে তো কথাই নেই। অন্য দ্বীপে গিয়ে উঠলেই জারোয়াদের বিষাক্ত তিরে মৃত্যু।

এখানকার জঙ্গলে নানারকমের গাছ। বন্দিদের কাজ হল সেই গাছের ছাল ছাড়িয়ে আঠা বের করা। দিনের শেষে কুড়ি আউন্স আঠা বের করতেই হবে।

ফণীভূষণ ডান্ডাবেড়ি পরে পা ফাঁক করে করে হাঁটছিল। পেছন থেকে ওকে লাঠির গুঁতো দিচ্ছিল ওয়ার্ডার। জঙ্গলের মুখে এসে পিছু ফেরার আগে ওয়ার্ডার বলল, ‘ঠিক সে কাম কর!’

ফণীভূষণ আবার মুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘এট্টু দ্যাখো না, যদি আমায় সেলে বসিয়ে…!’

‘ভাগ শালা!’ ওয়ার্ডার হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। জঙ্গলে আরও অনেকেই কাজ করছে। কেউ কাঠ কাটছে। কেউ ছাল ছাড়াচ্ছে গাছের। কিন্তু প্রত্যেক বন্দির মধ্যে রাখতে হবে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব। দূরে দূরে রয়েছে পাহারাদাররা। রাজবন্দিদের ক্ষেত্রে সতর্কতা অনেক বেশি। ফণীভূষণ রাজবন্দি নয়। সাধারণ কয়েদি। তার ওপর জঙ্গলে এসেছে অনিচ্ছায়। ব্যাটা কুঁড়ে। এর ওপর নজর রেখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ওয়ার্ডার অন্যদিকে এগিয়ে যায়।

নিস্তব্ধ নিশ্চল অরণ্য। শুধু মাঝেমাঝে পাখির ডাক। আর কাঠ কাটার যান্ত্রিক শব্দ। ফণীভূষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে গাছের ছাল ছুরি দিয়ে খুঁটে খুঁটে বের করছিল। দীর্ঘদেহী ঘন নাম না জানা বুনো বৃক্ষ।

ঠিক পনেরো মিনিট পর সেই গাছের ওপর থেকে একটা চিরকুট পড়ল নীচে।

ফণীভূষণ দ্রুত কাগজটা তুলে নিল।

‘কাল চারখানা রসবড়া বানিয়েচিলাম। তিনখানা শক্ত ঢিবি, কামড়ানো যায়নিকো। একখানা খেয়েচি কিন্তু ময়দাটা বেশি হয়ে গেচল, মচমচে হয়নিকো।’

ফণীভূষণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সকালবেলা যখন আজ পায়খানায় গিয়েছিল, খোয়েদাদ খাঁর হুকুমে ওকে বসতে হয়েছিল দুই রাজবন্দির জোড়ার মাঝে। অন্য ওয়ার্ডে শুধু সান্ধ্য প্যারেডের সময় জোড়ায় থাকতে হয় কিংবা জেলার বা সুপার এলে। কিন্তু খোয়েদাদ খাঁ সবেতেই এক কাঠি সরেস। এখানে সবসময় একজোড়া রাজবন্দির মাঝে থাকে একজন সাধারণ বন্দি। আজ ওর একপাশে ছিল কয়েদি নম্বর ৩১৫৫২, অন্যপাশে ৩১৫৫৫. প্রথমজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। অন্যজনের চলছে দশবছরের কারাদণ্ড। উল্লাসকর দত্ত। ইন্দুভূষণ রায়।

ফণীভূষণ চোখ বন্ধ করে কী ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর হাতের কাটারিটা দিয়ে জোরে একটা খোঁচা মারল নিজের হাতের কবজিতে। অনেকটা ক্ষত হয়ে দরদর করে রক্ত ঝরতে শুরু করল। ও জোরে শ্বাস নিল। তারপর জোরে চিৎকার করল, ‘আ-আ-আ!’

দ্রুত দু’জন পাহারাদার ছুটে এল দূর থেকে। রক্ত বেরোচ্ছে গলগল করে।

‘হায় আল্লাহ!’ পাহারাদারদুটো কী করবে বুঝতে পারল না। কোনও কাপড় নেই ওদের কাছে। একজন বলল, বন্দির জামা ছিঁড়ে বেঁধে দেওয়া হোক ক্ষতস্থান।

কিন্তু ফণীভূষণের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ‘আহ … মরে যাচ্ছি … আহহ!’

আরেকজন পাহারাদার মাথা নাড়ল, ‘জরুরত নেই। মর জায়ে তো জাদা ঝামেলা। চল, হাসপাতাল লে চলতে হ্যায়।’

‘সে তো পেটি অফিসারের হুকুম লাগবে!’

‘তুই হুকুমৎ লিয়ে আয়, আমি একে লিয়ে যাচ্ছি।’

পনেরো মিনিট পরে ফণীভূষণের ক্ষতস্থানে পুষ্প যখন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে, ফণীভূষণ চোখ বুজে ছিল। পুষ্প ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কীগো? তোমার কি বমি পাচেচ? গা গুলোচেচ? চোক বন্দ করচ কেন? চোক খোলো।’

ফণীভূষণ খুব কষ্টে চোখের পাতাগুলো খুলল। একটা মেয়ে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ও কেমন হয়ে গেল। পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল মুখ। পাতলা ঠোঁট। চাপা গায়ের রং। টিকলো নাক। কোঁচকানো চুলের গুচ্ছ উড়ছে কপালের ওপর। ও ফিসফিস করল, ‘কে তুমি?’

‘আমি পুষ্প। এই হাসপাতালের নার্স।’ শেষ শব্দটায় জোর দিল পুষ্প। নিজেকে নার্স বলতে ওর ভাল লাগে। গৌরীজ্যাঠা বলেছেন, ওকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হতে হবে। তিনি নাকি বিরাট বড় এক নার্স ছিলেন।

ফণীভূষণ আলতো হেসে চোখ বুজল। ওর হঠাৎ খুব আনন্দ হচ্ছে। স্বাবলম্বন গ্রামের গৌরীপ্রসন্ন ভৌমিক ওকে যে কাজের ভার দিয়েছেন, তার জন্য ওকে হাসপাতালে আসতে হবে। বারবার আসতে হবেই। তাই বলে বারবার তো আর নিজের হাতে নিজেই কোপ দেওয়া যায় না। তবে জ্বরজাটি হতে দোষ কী?

চোখ বোজা অবস্থাতেই ও ফিসফিস করল, ‘পুষ্প! আজ সন্ধ্যেয় আরেকজন রুগি আসবে তোমার কাছে। নম্বর ৩১৫৪৯. তাকে বোলো, কাজ এগোচ্ছে ভালভাবেই। একটা রসবড়া খাওয়াও গেছে। তবে শক্ত। বানাতে বানাতে মচমচে হবে, তাই না!’

পুষ্প শুনতে না পাওয়ার ভান করে ভাবলেশহীন মুখে বলল, ‘হাসপাতালে রাজবন্দিদের নম্বর পালটে দেয় অনেকসময়। নামটা বলে রাকো।’

পাশের বেডের রুগি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার পায়ে শক্ত করে দড়ির পাক দেওয়া। বিষাক্ত এক সাপ কামড়েছে। ফণীভূষণের মনে পড়ে গেল ভাইপার আইল্যান্ডের কথা। ভাইপার আইল্যান্ড এখানকারই এক দ্বীপ। সেলুলার জেল তৈরির আগে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ফাঁসি দেওয়া হত ওই দ্বীপে। আবার ভাইপার নামে একধরনের নাকি বিষাক্ত সাপও আছে।

ফণীভূষণ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ঘনিয়ে আসছে কালবৈশাখী ঝড়। যার আঁচ এখনও কেউ পায়নি। পাঁচশোর কাছাকাছি ছোট-বড় দ্বীপ। নব্বইভাগ দ্বীপেই মানুষের পা পড়েনি। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ওরা কোন দ্বীপের জঙ্গলে বোমা বানাচ্ছে? ফণীভূষণ এখনও সেই হদিশ পায়নি। তবে পেয়ে যাবে শীগগির। রাজবন্দিদের সঙ্গে হাত মেলালেও ব্যাটাদের মন থেকে সন্দেহ এখনও পুরোপুরি যায়নি।

নিজেদের মধ্যে একান্ত গল্পগুজবে মকবুল মাঝেমাঝে সেই কথা তোলে, ‘ফণীদাদা, যদি ওরা জানতে পারে, আমাদের এসব বিপ্লব, দেশপ্রেম সব মিছে কতা। যদি বুঝে যায়, আমরা আসলে ওদের ঢাল করে এখান থেকে পালাতে চাই?’

‘বুঝলে বুঝবে। তাতে কী এসে যাবে?’ ফণীভূষণ ঠোঁট উলটোয়, ‘ওদের এখন আমাদেরকে বেশি প্রয়োজন। আর একবার এই নরক থেকে বেরিয়ে গেলে কীসের রাজবন্দি, আর কীসের ফৌজদারি বন্দি, সব চাল ডাল এক বরাবর হয়ে যাবে।’

এই সপ্তাহে ওর জঙ্গলে ডিউটি। কাজ অনেকটা এগিয়ে রাখতে হবে। তার পরের সপ্তাহে মকবুলের ডিউটি পড়লে খুব ভাল হয়।

পুষ্প আবার ডাকল, ‘কীগো, গা গুলোচেচ নাতো?’

ফণীভূষণ চোখ খুলে পুষ্পর গভীর চোখে চোখ রাখল। দিঘির মতো কালো সেই চোখে জ্বলজ্বল করছে প্রশ্ন।

ও বলল, ‘সন্ধেবেলা যে আসবে, তার নাম বারীন ঘোষ। আর আমার নাম ফণীভূষণ। দুটো নামই মনে রেকো।’

১৮

রস আইল্যান্ড থেকে দিনের শেষ স্টিমারটা ছাড়ার পাঁচ মিনিট আগে একবার ভোঁ বেজে ওঠে। আর তক্ষুনি নীলা পড়ি কি মরি করে দৌড়ে বেরোয় কমিশনার সাহেবের বাংলো থেকে।

কমিশনার সাহেবের স্ত্রী তখন বসে থাকেন বাগানে। মেমসাহেবের বয়স আন্দাজ ত্রিশ। কিন্তু তার রোগাটে গড়নের জন্য বাইশ তেইশের বেশি মনে হয় না। তাঁর নাম জুলিয়া।

পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় জুলিয়া বই পড়েন। কখনও রং তুলি ইজেল দিয়ে আপনমনে ছবি আঁকেন। কোনও বিকেলে বেড়াতে আসেন প্রতিবেশিনী কোনও সম্ভ্রান্ত মহিলা। সামনে তখন সাজানো থাকে টি সেট। সদ্য আভেন থেকে বের করে আনা কেক। গরম স্ন্যাকস। বাবুর্চিরা একের পর এক খাবার পরিবেশন করে যায়। নীলা তখন মেমসাহেবের চোখের সামনেই ক্যারোলিনের সঙ্গে খেলে।

ক্যারোলিন কমিশনার সাহেবের একমাত্র কন্যা। বয়স দু’বছর। সবুজ গালিচার মতো মাঠে নীলা তাকে বল ছুঁড়ে দেয়। সে যখন গুটিগুটি পায়ে এসে বলটাকে ধরে, তাকে মনে হয় তুলোর একটা পুতুল।

নভেম্বর মাসের শেষাশেষি। যদিও এই সমুদ্র উপকূলের দ্বীপে ঠান্ডা তেমন পড়ে না বললেই চলে, তবু গাছের পাতায় হালকা কাঁপন ধরে। ত্বকে আসে রুক্ষতা। সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে সেইটুকুতেই তুষ্ট থাকতে হয়।

আজ কমিশনারের বাংলোয় ঘুরতে এসেছেন মেজর ফোর্ডের স্ত্রী। মেজর ফোর্ড এই আন্দামানেরই কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরগ্রহণের পর আর ফিরে যাননি স্বদেশে। অনেকেই এখানে পাকাপাকি রয়ে যান। আমোদ প্রমোদের সমস্ত উপকরণই রয়েছে এখানে। আর রয়েছে অপর্যাপ্ত খিদমত খাটার লোক। সারারাত পাখা টানা থেকে শুরু করে কাপড় কাচা। জল ভরা। জ্বালানির কাঠ কেটে আনা। দেশীয় বন্দিদের দিয়ে এমন কোনও কাজ নেই, যা করানো যায় না। বাবুর্চি খানসামা কোচোয়ান আয়া এরা তো আছেই, এছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকজন শুধুমাত্র ফাইফরমাশ খাটার লোক। সকলেই প্রাক্তন বন্দি।

এমন সুখ নিজেদের দেশে গেলে থোড়াই মিলবে। মিঃ অ্যান্ড মিসেস ফোর্ড একডজন পরিচারক পরিবৃত্ত হয়ে সুখেই থাকেন। তাঁদের একমাত্র ছেলে গেছে লন্ডনে, সেখানে চাকরি করে।

চায়ের কাপে একবার আলতো চুমুক দিয়ে দূরে নীলার দিকে তাকালেন প্রৌঢ়া মিসেস ফোর্ড। বললেন, ‘কিছু মনে করো না জুলিয়া! তোমার মেয়ের ন্যানি যাকে রেখেছ, সেই মেয়েটি ভাল তো?’

জুলিয়া জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন, ‘হ্যাঁ। এই তো বেশ কয়েকমাস হল কাজ করছে। কেন বলুন তো, মিসেস ফোর্ড?’

‘না, আমার ছেলে যখন ছোট ছিল, এখানে একটা মহিলাকে আয়া রেখেছিলাম। ওহ জেসাস, কী নোংরা ভাবতে পারবে না। যখন তখন আমার ছেলেকে টাচ করত। কী ডার্টি। তার ওপর আমার ছেলে তো এইসব নেটিভ ল্যাঙ্গোয়েজ শিখে যাচ্ছিল, জানো!’ এতবছর পরেও স্মৃতি রোমন্থনে মিসেস ফোর্ড শিউরে উঠলেন যেন।

জুলিয়া হাসলেন, ‘বাচ্চার দেখভাল করতে গেলে তাকে টাচ তো করতেই হবে, মিসেস ফোর্ড!’

‘সে তুমি যাই বলো না কেন, আরেকটু বড় হোক তোমার মেয়ে, বুঝবে। এসব নেটিভ আয়াগুলোর কম্পানি মোটেও ভাল নয়। বাই দ্য ওয়ে, একে জোগাড় করলে কোথা থেকে? কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছ?’

জুলিয়া দূরে তাকালেন। ওঁর শিশুকন্যা খিলখিল করে হাসতে হাসতে নীলার বুকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। নীলা তাকে জড়িয়ে ধরছে, আলতো হাতে ঝেড়ে দিচ্ছে জামায় লেগে থাকা ঘাসের টুকরো।

জুলিয়া বললেন, ‘নো মিসেস ফোর্ড। ও এক্স কনভিক্ট। এখন ছাড়া পেয়ে বিয়ে করেছে। থাকে ওই নতুন গ্রামে।’

‘হোলি জেসাস!’ চোখ কপালে তুললেন মিসেস ফোর্ড, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে তো জুলিয়া? এক্স কনভিক্ট? আন্দামানের প্রিজনে এসেছে মানে মার্ডার টার্ডারের মতো মেজর কিছু ক্রাইম করেছিল। তুমি এরকম একজন মহিলার কাছে নিজের মেয়েকে দিয়েছ, আর ইউ ম্যাড জুলিয়া?’

‘কবে কোন অপরাধ করেছিল বলে কি মানুষ পালটাতে পারে না? মেয়েটা কাজ করছে তিন-চারমাস হল। কখনও কোনও বেচাল দেখিনি মিসেস ফোর্ড। ক্যারোলিন তো এখন ওকে না দেখতে পেলেই কান্না জুড়ে দেয়। খাওয়া থেকে ঘুম, সব ওর কাছে। মেয়েটা ভাল গায়, জানেন। কথা বুঝতে পারি না, কিন্তু সুরগুলো মনকেমন করা। ওর গান শুনলেই ক্যারোলিন পা দিয়ে তাল ঠুকতে শিখেছে।’ জুলিয়া হাসলেন, ‘আর আমিও এতদিন পর একটু নিজের মতো সময় পেয়েছি। আঁকি। বই পড়ি।’

মিসেস ফোর্ড নিরুত্তর রইলেন। তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন।

জুলিয়া সেটা বুঝে আবার বললেন, ‘এই মেয়েটি একটা দুটো ইংরেজিও বলতে পারে, জানেন মিসেস ফোর্ড।’

স্বস্তির বদলে মিসেস ফোর্ডের মুখে ভয়ার্ত ভাব ফুটে উঠতে দেখে জুলিয়া দ্রুত বললেন, ‘না না। মেয়েটা রাজবন্দি নয়। সে’সব দেখে নিয়েছি রেজিস্টারে।’

‘যা ভাল বোঝো। বাচ্চাটা তোমার এটা মনে রেখো।’ কাপটা রেখে গাত্রোত্থান করলেন মিসেস ফোর্ড, ‘আজ উঠি। শনিবার বলরুমে আসছ তো?’

‘যাব মিসেস ফোর্ড।’ জুলিয়া কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলেন। তাঁর স্বামী মেজর পোর্টওয়েল যখন কলকাতা থেকে হঠাৎ এখানে বদলি হলেন, সবাই ভেবেছিল জুলিয়া বুঝি স্বামীর সঙ্গে আসবেন না। সেটাই অধিকাংশ মেমসাহেবরা করে থাকেন। কলকাতার অত জাঁকজমক বাহুল্য ছেড়ে কে-ই বা পাণ্ডব বর্জিত দ্বীপে আসতে চায়! যতই বিনোদনের উপকরণ থাকুক, কলকাতার সঙ্গে কি তুলনা চলে?

কিন্তু জুলিয়া এসেছিলেন। সঙ্গে এসেছিল তাঁর তিনখানা ট্রাঙ্ক ভর্তি বই আর ছবি আঁকার সরঞ্জাম। পার্টি, নাচগান হইহুল্লোড় তাঁর কোনওদিনই ভাল লাগে না। ভেবেছিলেন, সমুদ্রের ধারে বসে একান্তে ছবি আঁকবেন।

কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে তার উলটো। কলকাতা ছিল প্রকাণ্ড শহর। সেখানকার নাচের পার্টিতে কে গেল, কে গেল না, তাই নিয়ে কেউ অত মাথা ঘামাত না। কিন্তু এই রস আইল্যান্ডে এমনিই গুটিকয়েক মহিলা। তাঁদের একটা পরিমণ্ডল আছে। তাঁরা প্রতিবারই জুলিয়াকে ডাকাডাকি করেন। কখনও না গেলে নানারকম কথা ওঠে। যত যাইহোক, সকলেই বড়কর্তাদের স্ত্রী। মেলামেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রশাসনিক পদোন্নতি ও রাজনীতির নানা অঙ্ক। ইচ্ছা না থাকলেও জুলিয়াকে যেতে হয় সেখানে। মেজর পোর্টওয়েল আবার স্বভাবে স্ত্রীর ঠিক বিপরীত। নাচ-গান হইচই তিনি খুবই পছন্দ করেন। তবে, স্ত্রীকে নিজের পছন্দমতো চলতে জোরাজুরি করেন না।

প্রস্থানোদ্যত অতিথিকে গেট অবধি এগিয়ে দিতে এলেন জুলিয়া। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ফোর্ডের রিকশা। রস আইল্যান্ডের উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে সম্ভ্রান্ত মহিলারা ক্যানোপি ঢাকা রিকশাতেই চলাচল করেন বেশি।

রিকশায় উঠতে গিয়ে মিসেস ফোর্ড আবার পিছু ফিরলেন, ‘ভাল কথা। মারিয়ার কাণ্ড শুনেছ?’

‘না। কী?’ জুলিয়া কৌতূহলী হলেন। মারিয়া এখানকার ম্যাজিস্ট্রেট হ্যারি কোলফিল্ডের স্ত্রী।

চোখমুখে কৌতুক আর একরাশ লজ্জা ফুটিয়ে বলে উঠলেন মিসেস ফোর্ড, ‘সেই যে নেটিভ সারভেন্টটা… ইরফান না কী নাম, তার সঙ্গে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থায় ধরা পড়েছে বেডরুমে। কী লজ্জাকর ব্যাপার বলো তো! শুনছি নাকি হ্যারি মারিয়াকে ডিভোর্স দেবে।’

এইসব প্রসঙ্গ শুনতে জুলিয়ার একেবারেই ভাল লাগে না। তবু শেষ কথায় তিনি একটু বিস্মিত হলেন, ‘ডিভোর্স দেবে? সেকি!’

‘তা দেবে না? বউ যদি ব্যভিচার করে, হাজব্যান্ড তাকে ঘরে বসে বসে পুষবে নাকি?’

জুলিয়ার নাক অজান্তেই কুঁচকে গেল। নাহ, কিছুতেই তিনি এখানকার মহিলাদের সঙ্গে নিজের মানসিকতাকে মেলাতে পারছেন না। সে-কারণে মেশার ইচ্ছেটাও দিনদিন চলে যাচ্ছে তাঁর।

ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর স্ত্রীকে পোষেন? স্ত্রী কি বিড়াল বা কুকুরের মতো কোনও পোষ্য প্রাণী?

বিরক্তি গোপন করে তিনি বললেন, ‘হ্যারি নিজে কী করেন, সেটা কি ভেবে দেখেছেন?’

মিসেস ফোর্ড এবার রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করলেন। এই মেয়েটা একটু বেশিই ঠ্যাঁটা প্রকৃতির। কথা বলে সুখ হয় না মোটে। হ্যাঁ, শুধু রস আইল্যান্ড কেন, গোটা আন্দামান জানে যে হ্যারি কোলফিল্ডের চরিত্রের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। অসংখ্য প্রেম তো আছেই, তার সঙ্গে আছে বন্দিনীদের রাতের আঁধারে তুলে এনে সম্ভোগ। এই কুকার্যে তাঁর সঙ্গী অনেকে। বিশেষ করে সেই যে ফটিক নামের ঘিনঘিনে লোকটা।

কিন্তু তাই বলে মারিয়া এমন করবে? ছেলেরা যা করে, মেয়েদের কি তা সাজে?

কথা না বাড়িয়ে তিনি রিকশায় উঠে পড়লেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুলিয়া হাঁক দিলেন, ‘নীলা! হেই নীলা!’

নীলা ক্যারোলিনকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এল। মেমসাহেবের ইংরেজি কথা ও আকারে ইঙ্গিতে বোঝার চেষ্টা করে। লীলাদিদি শোভনাদিদির কাছে শেখা ইয়েস নো, থ্যাঙ্ক ইউ, সিট, গো অবধি শেখা বিদ্যে ওর। মেমসাহেবের খাস ভৃত্য হল আবদুল। আবদুল দোভাষীর কাজ করে সব পরিচারকের ক্ষেত্রেই।

ও ছুটে এসে মাথা ঝোঁকাল, ‘ইয়েস মেমসাব!’

জুলিয়া হেসে ফেললেন। নীলা এরমধ্যেই নবাবি কায়দায় সেলামের আদবকায়দা রপ্ত করেছে। জুলিয়া একাধিকবার বলেছেন যে এসবের প্রয়োজন নেই। ক্যারোলিনকে ভালবাসলে যত্ন করলেই হবে। কিন্তু নীলা মেয়েটার মধ্যে সব কিছু শেখার একটা অদ্ভুত আগ্রহ আছে। আবদুল যখন ওর বাংলাটা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দেয়, তখন ও গভীর মনোযোগের সঙ্গে শোনে। এছাড়াও ওর নানা প্রশ্ন। জুলিয়ার প্রতি ভয়মিশ্রিত আড়ষ্টতা ভাবটা এখন অনেকটাই কেটেছে।

জুলিয়া বললেন, ‘তুমি বেরিয়ে পড়ো। এখুনি ভোঁ বাজবে।’

নীলা মাথা নাড়ল, ‘আচ্ছা মেমসাহেব।’

জুলিয়া ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘তোমার স্বামী তো মাস্টার, তাই না নীলা?’

‘ইয়েস মেমসাব।’

‘তোমার নামের মানে আমি সেদিন আবদুলকে জিজ্ঞেস করছিলাম। ও বলল, ব্লু। তুমি নীল রঙের মতোই সুন্দর। তোমার স্বামী নিশ্চয়ই তোমায় খুব ভালবাসেন।’ জুলিয়া কৌতুকমাখা হাসেন।

নীলা লজ্জা পেল, ‘আজ্ঞে আমার স্বামী গাঁয়ে ইশকুল খুলেচেন। জেলেও পড়াতে যান। তবে হপ্তায় একদিন।’

জুলিয়া কী যেন ভাবছিলেন, ‘আমি কলকাতায় ছিলাম দু’বছর। জানো। কিন্তু কখনও গ্রাম দেখিনি। ভারতবর্ষের গ্রামগুলো কি আমাদের ইংল্যান্ডের গ্রামের মতোই?’

নীলা কী বলবে বুঝতে পারল না। ইংল্যান্ডের গ্রাম সে নিজেও দেখেনি, কী করে জানবে দুটো এক কি না? কিন্তু উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকাটা ওর স্বভাব নয়।

ও তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমাদের গাঁগুলোয় অনেক সবুজ। গাছপালা। পুকুর। ধানখেত। হাট। মাটির কুঁড়ে। পাখির ডাক। এখানে সবই আচে। কিন্তু হ্যাঁ, দেশের গাঁয়ের মতো নয়।’

‘তোমার দেশ কোথায়?’

নীলার মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জন্মভূমির স্মৃতির বোধ হয় অন্য একটা তরঙ্গ থাকে। মস্তিষ্কে সংকেত পাওয়ামাত্র তা আনন্দে ভরিয়ে তোলে শরীরের প্রতিটি কোষকে। ও বলে, ‘খুলনা বলে একটা জায়গা আচে। তার শ্রীফলতলা গাঁয়ে।’

‘সেখানে বুঝি অনেক পাখি আছে?’

‘অনেক! শালিক। দোয়েল। বসন্তবৌরি। বাবুই। এছাড়া কাক চড়াই এসব তো আছেই।’

‘এই পাখিগুলোকে কেমন দেখতে, তুমি আমায় বলতে পারবে?’ জুলিয়া ব্যাখ্যা করলেন, ‘আসলে আমি একটা গ্রামের ছবি আঁকতে চাইছি। আমাদের ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইড নয়। ইন্ডিয়ার গ্রাম। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না কীভাবে আঁকব।’

নীলা হেসে ফেলল। তারপর সুর করে গড়গড়িয়ে বলে গেল,

‘আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি

সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ,

তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি

তাহার গানে আমার নাচে বুক।

তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া

চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,

যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া

কোলের ‘পরে নিই তাহারে তুলে।’

জুলিয়া মুগ্ধচোখে শুনছিলেন। নীলা থামতেই বলে উঠলেন, ‘What a wonderful poetry! তোমায় আমি এবার থেকে ব্লু বলে ডাকব। তোমার আপত্তি নেই তো?’

নীলা দু’পাশে ঘাড় নাড়ল।

‘এই পোয়েট্রিটা কে লিখেছেন?’

নীলা হাসল, ‘রবিবাবু বলে একজন কবি আচেন কলকাতায়। তিনিই লিকেচেন।’

‘তুমি আবৃত্তি করতে পারো, ব্লু?’

নীলা বলল, ‘আমার দুই দিদি ছিল কলকাতায়। তারাই শিকিয়েচিল মেমসাব। রবিবাবু খুব ভাল কথাও বলেন। দিদিরা শুনতে যেত।’

জুলিয়া বললেন, ‘রবিবাবু মানে রবীন্দ্রনাথ টেগোর? যদি তিনি হন, তাঁকে আমি দেখেছিলাম কলকাতায়, একটা অনুষ্ঠানে। খুব সুন্দর দেখতে।’

নীলা চুপ করে রইল। রবিবাবুর পুরো নাম ও জানে না। কিন্তু সেই অক্ষমতা প্রকাশ করা যাবে না। এই মেমসাব একেবারেই অন্য বাংলোর মালকিনদের মতো নয়। মিষ্টি করে কথা বলেন। কখনও চেঁচামেচি করেন না। তেমন গুছিয়ে সংসারও করতে পারেন না। আনমনে ভাবেন। খিলখিল করে বাচ্চাদের মতো হাসেন। আর ছবি আঁকেন।

নীলার তখন লীলাদিদিকে মনে পড়ে যায়। ওর খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করে এই মেমসাবকে। কিন্তু পরক্ষণেই ও নিজেকে সংবরণ করে। ওর এই কুড়িবছরের জীবনে এতদিন কোনও লক্ষ্য ছিল না। গৌরীজ্যাঠা বলেন, লক্ষ্যহীন মানুষ হল সমুদ্রে দিক হারানো নাবিকের মতো। এতদিন সেভাবেই দিশেহারা হয়ে ছুটে বেরিয়েছে নীলা। কিন্তু আর নয়। যেদিন জেলে ঢুকেছিল, ভেবেছিল গরাদের অন্তরালেই কাটবে বাকি জীবন। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে ছিল অন্য।

খবরের কাগজে যেদিন দেখেছিল, আলিপুর বোমা মামলার ‘গোলাওয়ালা’রা আসছে আন্দামানে, আগুপিছু না ভেবেই ঠিক করেছিল, যেভাবে হোক জেলের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। বাঁচাতেই হবে ইন্দ্রদাদাকে।

মুক্ত আকাশের তলায় এসে যখন একবার দাঁড়াতে পেরেছে, সেই লক্ষ্য থেকে ও কিছুতেই বিচ্যুত হবে না। শেষ স্টিমারের ভোঁ বেজে উঠতে ও ক্যারোলিনকে একবার আদর করেই বেরিয়ে পড়ল।

কমিশনার সাহেবের বাংলোটা রস আইল্যান্ডের একেবারে এক প্রান্তে। বাংলোর পাশ দিয়েই উঠে গেছে পাহাড়। পুরো প্রাসাদোপম বাড়িটাই উঁচু পাথরের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদর ও খিড়কির দুটো প্রকাণ্ড প্রবেশপথেই সশস্ত্র প্রহরা। নীলা গেট দিয়ে বেরিয়ে ছুটছিল, গেটের বুড়ো সিকিউরিটি গার্ড রমেশ চাচা মজা করে চেঁচাল, ‘ওই তো কালো ধোঁয়া উঠছে। যাহ, জাহাজ ছেড়ে দিল। আজ রাত তোকে এখানেই থাকতে হবে রে বেটি!’

নীলা ছুটতে ছুটতে কপট রাগের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল পেছনে।

এই কুড়িবছরের জীবনে কতরকমের পুরুষের সংস্পর্শে আসতে হল ওকে। জনার্দনের মতো পশু। যে নেশার ঘোরে নিজের মেয়েকে খুন করে নির্লজ্জভাবে সেই দায় বউয়ের ওপর চাপায়। ফটিক কিংবা সুবীরের মতো নারীমাংসলোভী কামুক। যারা প্রতিদিন ফেরিঘাটে নীলাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে।

কিন্তু বিপরীতে তো গৌরীপ্রসন্নর মতো মানুষরাও রয়েছেন! যিনি কখনও স্বামীর অধিকার ফলাতে আসেননি নীলার ওপর। কিংবা শেখর। যার মনে নীলার প্রতি প্রবল অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও কখনও বেচাল হয়নি। প্রকৃত বন্ধুর মতো তার পাশে থেকেছে। কিংবা এই রমেশ চাচা।

কিংবা ইন্দ্রদাদা? যে কিনা প্রথম কিশোরী নীলার মধ্যে সঞ্চারিত করেছিল নিজেকে জানার জিজ্ঞাসাকে? নীলার বুকটা কেঁপে উঠল।

আসলে ইন্দ্রদাদাই ঠিক বলেছিল। আত্মার কোনও পুরুষ-নারী ভেদাভেদ করা পাপ। মালিন্য পুরুষ বা নারীর মধ্যে থাকে না। থাকে শরীরের খাঁচার ভেতরের মনটার মধ্যে। আত্মার মাঝে।

ভাবতে ভাবতে স্টিমারে পা দেয় নীলা। ওর জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল ছোট্ট ফেরিটা। ওঠামাত্র ছেড়ে দেয়। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে স্টিমারে উঠে নীলা প্রতিদিন একটু জিরিয়ে নেয়। পশ্চিমে ঢলতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে ঝালিয়ে নিতে চায় বোধ হয় সবকিছু।

এতদিনে ও যে কিছুই করেনি তা নয়। ভারতের মূল ভূখণ্ডের পায়ের কাছে এই বন্দি উপনিবেশে গৌরীপ্রসন্ন, শেখরের মতো কয়েকজন ষড়যন্ত্রের যে বিশাল জাল বিছিয়েছে, তাতে নীরবে সুতো বাঁধার মতো কাজ করে চলেছে নীলা বা পুষ্পর মতো মেয়েরা। সঙ্গে রয়েছে বেশ কয়েকজন কয়েদি। অনেক হয়েছে শোষণ। অত্যাচার। গত অর্ধশতকে ঝরেছে বহু প্রাণ। এই বিলাসবহুল রস আইল্যান্ড, পোর্ট ব্লেয়ার কিংবা চ্যাথাম আইল্যান্ডের প্রতিটি ইট কাঠ রাস্তার মধ্যে মিশে গেছে বিপ্লবীদের শ্রম। লাঞ্ছনা। অপমান। সবকিছুর উত্তর দেওয়ার সময় এসেছে।

স্বাবলম্বন গ্রাম হোক বা জেলের কয়েদি, স্কুল চালানোর অছিলায় গৌরীপ্রসন্ন সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেন বিপ্লবের চেতনা। অনেক হয়েছে। এবার জেহাদ ঘোষণা করতে হবে। ধ্বংস করে দিতে হবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, তার সব চিহ্ন। গৌরীপ্রসন্ন বলেন Dictatorship of Proletariat. প্রলেতারিয়েত কারা? খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের পরিশ্রমে, রক্তে, ঘামে ভর দিয়ে আয়েশ করছে শাসকরা।

গৌরীপ্রসন্ন বোঝান, কীভাবে একদিন সব প্রলেতারিয়েতরা একত্র হবে। সেদিনই সূচনা হবে সাম্রাজ্যবাদের পতন। ধ্বংস হবে সব কিছু। দেশ চালাবে এই প্রলেতারিয়েতরাই।

নীলা অত কিছু বোঝে না। সে শুধু স্বপ্ন দেখে, দেশ একদিন স্বাধীন হবে। স্বাধীন দেশ মানে দেশের সব মানুষই স্বাধীন। শুধু পুরুষরাই নয়, মেয়েরাও স্বাধীন হবে। কোনও মেয়েকে ওর মতো নির্যাতন সহ্য করতে হবে না। সব মেয়েরাই লীলাদিদি, শোভনাদিদির মতো আলোয় বাঁচার সুযোগটুকু পাবে।

কিন্তু বৃহত্তর পরিকল্পনার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে ছোট্ট একটুখানি ব্যক্তিগত স্বার্থ। নীলারও রয়েছে। আন্দামানের এতগুলো দ্বীপের মধ্যে কোন দ্বীপের জঙ্গলে বোমা তৈরি চলছে ও জানে না। আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খোঁজ নিয়ে লাভও নেই। কিন্তু যেদিন সবক’টা বোমা একসঙ্গে ফাটবে, সেদিন ভেঙে যাবে কারাগারের শিকল। যে জাহাজগুলোয় বন্দি করে আনা হয়েছে এত বিপ্লবীকে, সেই জাহাজেই পালাবে তারা। আর তখনই নীলা আবার দেখতে পাবে ওর ইন্দ্রদাদাকে।

কেমন দেখতে হয়েছে এখন ইন্দ্রদাদা? গোঁফ দাঁড়িতে কল্পনা করতে গিয়ে নীলা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। খাড়া হয়ে ওঠে রোমকূপ।

আর ঠিক তখনই ওর গায়ে আলতো হাত রাখে।

নীলা চমকে ওঠে। ফটিক সামন্ত। রূঢ় স্বরে ও বলে, ‘গায়ে হাত দিচেচন কেন?’

‘বাবা! পাছা ন্যাংটা, এদিকে মাথায় ঘোমটা।’ ফটিক ফিকফিক করে হাসে, ‘অবিশ্যি রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। ওই বুড়ো ভাতারকে কারুর ভাল লাগে? তা, আমরা তো রয়েচি।’

প্রায়দিনই ফটিক আর ওর কয়েকটা চ্যালা এই অসভ্যতা করে। স্টিমারের বাকি লোকগুলো কেউ রগড় দেখে, কেউ নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকে। যেন এগুলো খুব স্বাভাবিক। এমনিতেই এই স্বাবলম্বন গ্রামের মেয়েদের মধ্যে সতীসাবিত্রী খুব কমই রয়েছে, আর তাদের মধ্যে যারা কাজে বেরিয়েছে, তারা একেবারে ঘোষিত সহজলভ্যা, এমনই ধারণা চারপাশে। স্টিমারে হোক বা জাহাজঘাটা, নারীদের এমন লাঞ্ছনা যেমন প্রায়ই দৃশ্যমান, তেমনই যেন সহজ ও স্বাভাবিক।

তবে হ্যাঁ, নীলার মতো সুন্দরী যুবতী যেহেতু বেশ অপ্রতুল, লোকগুলো এদিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের সেই চোখে ক্রোধের লেশমাত্র নেই।

রয়েছে উপভোগের উল্লাস।

ফটিক আরও কাছে এগিয়ে এল।

১৯

‘যদি আলো না ধরে, ওরে ও অভাগা
যদি ঝড় বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে
একলা জ্বলো রে!’

উল্লাস গুনগুন করে গাইছিল। সমান্তরালে ধ্যান করছিল কূটস্থে মন একাগ্র করে। কিন্তু তাতেও হয়েছে মুশকিল। মন একাগ্র করতে বসলেই সব মনঃসংযোগ গিয়ে এক হয় লীলার পানপাতার মতো মুখটায়। কতদিন লীলাকে দেখেনি। আসার সময় কথা হয়েছিল, লীলা প্রতিদিন ওকে চিঠি লিখবে। ডাকে ফেলতে হবে না। চিঠিগুলো নিজের কাছেই রেখে দেবে। উল্লাস যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরবে, তখন সব চিঠি একসঙ্গে পড়বে।

লীলা ধরা গলায় বলেছিল, ‘তোমার তো যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছে। তুমি কি আর ছাড়া পাবে কখনও?’

‘আলবাত পাব লীলা। আর যদি না পাই, জেল ভেঙে বেরিয়ে আসব আমি, তোমার জন্য!’ উল্লাস বলেছিল।

সত্যিই কি জেল থেকে ছাড়া পাবে ও আর কোনওদিন? কে জানে!

ওপাশের দেওয়াল থেকে টক টক আওয়াজ হল। উল্লাস কানখাড়া করে রইল। হেমচন্দ্রদাদার জবাব নেই। এই জেলখানার মধ্যেও দেওয়ালে টোকা দিয়ে সংকেত পাঠানো যায় বেশ। আগে আলিপুর জেলেও ওরা এই কায়দায় কথা বলত। প্রথম প্রথম বুঝতে অসুবিধা হত। কিন্তু কয়েকদিন পর সবারই বেশ রপ্ত হয়ে গেছে। তবে এখানে পাশাপাশি কুঠুরিতে কোনও রাজবন্দিকে রাখেনি। তাতে কী হয়েছে? হেমচন্দ্রদাদা অনেক মামুলি কয়েদিদের হাত করে নিয়েছেন। বাকি কথাবার্তা হয় বাইরে পাথর ভাঙতে বা ঘানিতে গেলে।

আবার টকটক শব্দ হচ্ছে। উল্লাস দ্রুত দেওয়ালের দিকে এগোল। সেখানে সে মর্স কোডগুলো লিখে রেখেছে।

টক টক টকাটক টক টক …

উল্লাস দ্রুত বুঝে ফেলল। কাজ ভালই এগোচ্ছে। ওর রেসিপিতে আন্দামানের মুক্ত বন্দিরা বোমা বাঁধতে শিখে গেছে বেশ। উল্লাসে ওর মন নেচে উঠল।

কুঠুরিতে ইদানীং কয়েকজন পাঞ্জাবি তরুণের বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। হোতিলাল। বাবুরাম। লাধারাম। এরা সকলেই উচ্চশিক্ষিত। সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিল। খোয়েদাদ খাঁ-র ওয়ার্ডাররা শ্যেন দৃষ্টি রাখে, যাতে ‘গোলাওয়ালা’দের নিজেদের মধ্যে কথা তো দূর, দৃষ্টিবিনিময়ও না হয়।

অন্যভাষী রাজবন্দিদের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম সামান্য হলেও শিথিল।

ওদের দলে নন্দগোপাল চোপড়া নামক ছেলেটি সম্প্রতি এসেছে। সে পাঞ্জাবি ক্ষত্রিয়। যেমন দীর্ঘকায়, তেমনই সুপুরুষ। এলাহাবাদ থেকে একখানা সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোয়, তার নাম স্বরাজ্য। নন্দগোপাল ছিল সেই পত্রিকার সম্পাদক। পরপর তিনখানা সংখ্যায় সে তিনটে সম্পাদকীয় লিখেছিল। দ্বীপান্তরের সাজা দিয়ে তাকে সেলুলার জেলে পাঠানো হয়েছে। শুধু সে একা নয়। নন্দগোপাল, হোতিলাল, বাবুরাম আর লাধারাম চারজনই কোনও না কোনওসময়ে ছিল সেই ‘স্বরাজ্য’ পত্রিকার সম্পাদক। কয়েকটা করে সংখ্যা বেরোতে না বেরোতেই তাঁদের ঠাঁই হয়েছে এখানে। প্রথমে এসেছে হোতিলাল আর বাবুরাম। কয়েকমাস আগে এসেছে লাধারাম। আর গত সপ্তাহে এসেছে নন্দগোপাল।

সব শুনে উল্লাস বিস্মিত হয়ে বলেছিল, ‘একিহে ভায়া! শুধু এডিটোরিয়াল লিখেছ বলে কালাপানির জেল?’

‘হুঁ।’ নন্দগোপাল মিটিমিটি হাসে, ‘তিনমাসে তিনটে এডিটোরিয়াল লিখেছিলাম। একেকটা লেখার জন্য দশবছর। মোট ত্রিশ বছরের জেল।’

‘রাম রাম! আমরা কোথায় এখানে রোয়াব নিয়ে থাকছিলাম, গোলাগুলি চালিয়ে, বোমা বেঁধে এখানে আসার পারমিট পেয়েছি, আর সেখানে তোমরা কিনা …!’

নন্দগোপালের মুখে সবসময়েই হাসি লেগে থাকে। এখনও সে হাসছিল। হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা, তোমরা সবাই তো সেই আলিপুর কেসের কনভিক্ট, তাই না। তোমাদের অনেককে তো সেই বাগানবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের মধ্যে একজনকে আবার তোমরাই নাকি আলিপুর জেলের মধ্যেই গুলি করে মেরেছিলে, এ কথা কি সত্যি?’

‘আলবাত সত্যি। গদ্দারিটা করেছিল নরেন। নরেন গোস্বামী। আমরা সবাই তখন আলিপুর জেলে বন্দি রয়েছি। বিচার চলছে। কার কপালে ফাঁসি, আর কার কপালে কালাপানি রয়েছে, কিছুই জানি না। এমন সময় নরেন ব্যাটা চুপিচুপি সরকারের সঙ্গে মিশে গেল।’

হোতিলাল ভার্মা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার প্রশ্ন করল, ‘কেন?’

‘বড়লোকের ছেলে। কিছুটা হুজুগে মেতে বিপ্লব করতে এসেছিল। জেলখানার অত কষ্ট বোধ হয় আর সইতে পারছিল না।’ উল্লাস হাই তুলল, ‘আমাদের প্রচুর বোমা কার্তুজ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। আরও অনেক ছেলের বাড়িতে সেগুলো লুকানো ছিল। নরেন গোপনে ইংরেজদের সঙ্গে আঁতাত করল। রাজসাক্ষী হবে। আমাদের সবকিছু ও বলে দেবে।’

‘বিনিময়ে?’

‘বিনিময়ে আবার কী, মুক্তি!’

‘তোমরা কী করলে?’

‘কী আবার করব। জেলের ওয়ার্ডারদের একটু বখশিস দিয়ে ভেতরে রিভলভার আনিয়ে নিলাম। চন্দননগরের সুধাংশু গোপনে রিভলভার দিয়ে গেল বারীনদার হাতে। তার ঠিক সাতদিন পর শ্রীশচন্দ্র পাঠাল আরও একখানা। একটা রিভলভার দেওয়া হল কানাইলালকে। অন্যটা গেল সত্যেনের কাছে। ঠিক পরের দিন নরেন যখন জেলেরই হাসপাতালে ঢুকছে, দু’জনে মিলে সোজা গুলি করল। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল জেলের গার্ডরা। কিছুক্ষণ দু’তরফেই ফায়ারিং চলল। কিন্তু কিছু করা গেল না। নরেনের লাশটা একটা নর্দমায় মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল।’ উল্লাস আবার হাই তুলল।

‘তোমরা তো সত্যিই ডেঞ্জারাস!’ এবার লাধারাম অভিভূত চোখে বলল, ‘আর সত্যেন কানাই?’

‘ওদের ফাঁসি হয়ে গেল। কানাই স্বীকার করেছিল যে সে খুন করেছে, কিন্তু বন্দুক কোথা থেকে পেয়েছে বলেনি। আর সত্যেন কিচ্ছু স্বীকার করেনি। কিন্তু ফাঁসি হল ওদের দু’জনেরই। কানাইয়ের বডি নিয়ে শোভাযাত্রারও পারমিশন মেলেনি। টালির নালার পাশের গলি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কেওড়াতলায়। তবু গোটা কলকাতা সেদিন ভেঙে পড়েছিল সেখানে। রাস্তা, আশপাশের বাড়ি, থিকথিক করছে ভিড়। সবাই নাকি পুষ্পবৃষ্টি করছিল। বাড়ির মা-বোনেরা হাতে ফুলের মালা, ঘি চন্দন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বয়স্করা গীতাপাঠ করছিল। রাস্তায় সারসার গাড়ি দাঁড়িয়ে।’

উল্লাস উদাস চোখে বলে চলেছিল। কল্পনায় যেন সব কিছু সজীব হয়ে উঠেছিল ওর স্মৃতিতে। টানা টানা চোখদুটো চলে গিয়েছিল সুদূর অতীতে, ‘আমরা জেলে বসেও সব খবর পাচ্ছিলাম। মানুষের আবেগ সেদিন বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তার ঠিক এগারোদিন পর সত্যেনেরও ফাঁসি হল, কিন্তু ইংরেজরা আর ওর বডিকে বাইরে নিয়ে গেল না। জেলের ভেতরেই পুড়িয়ে দিল। সত্যেনের পোড়া মাংসের গন্ধ এসে লাগছিল আমাদের সবার নাকে।’

বাবুরাম এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। সে নীরবে পাহাড় কেটে চলেছিল। আজ ওদের ডিউটি পড়েছে জেলের বাইরে। পাহাড় কেটে সমুদ্রে ফেলতে হবে। একটা ছোট লাইন পাতা হয়েছে, সেই লাইন দিয়ে ঠেলাগাড়ি করে কাটা পাথর আর মাটি নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে সমুদ্রে। এইভাবে সারাদিন ধরে পোর্ট ব্লেয়ারের অসমতল উঁচুনিচু রাস্তা পাথর কেটে সমতল করতে হবে।

বাবুরাম ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে কপাল থেকে ঘাম মুছল, তারপর বলল, ‘সারাদিন কাম না করে গুলতানি করছ। সন্ধেবেলা কী জুটবে মনে আছে তো?’

‘কী?’ নন্দগোপাল কৌতূহলী চোখে তাকাল। সে নতুন এসেছে। আজ থেকেই তার ডিউটি শুরু হয়েছে।

উল্লাস বলল, ‘দিনের শেষে কাজের কোটা শেষ না হলে শাস্তি অর্ধেক খাবার আর ক্রশ বার।’

‘ক্রশ বার! সেটা কী?’

‘দু’পা ফাঁক করে বেড়ি বেঁধে দেবে। ওইভাবেই থাকতে হবে দিনের পর দিন।’ উল্লাস বলল, ‘ভয় পেয়ো না। একটা টেকনিক আছে। শিখিয়ে দেব।’

‘কী টেকনিক?’

‘একধরনের প্রাণায়াম করবে। শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম। কষ্ট হবে না।’

‘ব্যায়াম? ব্যায়াম করতেও তো কষ্ট!’ নন্দগোপাল এবার একটা প্রকাণ্ড হাই তুলল, ‘অত খাটতে পারব না।’

তারপর নন্দগোপাল একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। এবড়োখেবড়ো রাস্তার একপাশে হেলেদুলে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ল। শুধু তাই নয়, ধুলোমাখা পাথরের ওপর পাশবালিশের মতো করে চাপিয়ে দিল পা।

‘একি! নন্দগোপাল, তোমার কি মাথা খারাপ হল নাকি? এখুনি ওঠো, প্রহরীরা চলে এলে খুব মারবে।’ হোতিলাল অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু কে শোনে কার কথা, মিনিটদুয়েকের মধ্যে নন্দগোপালের নাক ডাকার ভুরুক ভুরুক শব্দ শুরু হয়ে গেল।

উল্লাস কিছু বলবে কী, নন্দগোপালের কাণ্ডকারখানা দেখে ও হেসেই অস্থির। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে কাজ এগোবে কী করে? ও একটু দূরে সরে এল। প্রচণ্ড রোদের তাপ। তারমধ্যে এই ভয়ংকর পরিশ্রমের কাজ। উল্লাস কাজে ফাঁকি দেয় না। তার শক্তপোক্ত চেহারা, নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকু পারলে দিয়ে ও প্রতিদিনের কাজের ‘কোটা’ পূরণ করে। সে হল অরবিন্দ ঘোষের শিষ্য। পেটি অফিসারদের ধমকের সামনে মাথা নোয়ালে চলবে কেমন করে?

পাথর ভাঙতে ভাঙতে উল্লাস হঠাৎ দেখে, মকবুল নামের ছোকরাটা আসছে। সঙ্গে ইন্দ্রভূষণ। দু’জনের হাতেই কাঠ কাটার কুঠার।

ইন্দ্রভূষণের মুখখানা অমন কাঁদোকাঁদো কেন?

চোখাচোখি হতে মকবুল বলল, ‘ইন্দুদাদাকে আজ আবার চাবুক মেরেচে।’

উল্লাসের মাথায় চড়াক করে রক্ত চড়ে গেল। এত বড় স্পর্ধা? রাজবন্দিকে চাবুক মারা? ও জ্বলন্ত স্বরে বলল, কে? কে মেরেছে?’

মকবুল চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করে, ‘খোয়েদাদ খাঁ।’

‘কেন মেরেছে?’

‘ইন্দুদাদা খুব আস্তে আস্তে কাঠ কাটচিল কিনা। দাদার হাতে কী সব ঘা বেরিয়েচে, কুঠার ভাল করে ধরতেই তো পারচে না। কী করে কাঠ কাটবে?’

রাগে শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দু টগবগ করতে শুরু করে উল্লাসের। কী ভেবেছে এরা? একে তো ‘কোটা’ পূরণ করলে নিষ্কৃতি নেই, ভাগের দুধটুকু অবধি কেড়েকুড়ে খেয়ে নেয় পেটি অফিসারগুলো। তার ওপর একজন অসুস্থ, কোথায় তার চিকিৎসা করবে, তা না … চাবুক মারছে?

ও বলল, ‘ইন্দ্র, তুই কিছু বললি না?’

‘বলব না আবার? আজ আমার সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয়ে গেছে।’ ইন্দু ফুঁসে উঠল, ‘কিন্তু তাতে কি ওদের কিছু যায় আসে? আচ্ছা উল্লাসদাদা, এখানে যে এরা এমন ভয়ানক অত্যাচার চালায়, তা কোনওভাবে দেশের নেতাদের কানে তোলা যায় না?’

কার কানে তোলা যাবে? কী করেই বা যাবে! যা করার, নিজেদেরই করতে হবে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়ে যায় উল্লাসের। হ্যাঁ। নন্দগোপালই ঠিক। যেমন কুকুর, তেমন মুগুর।

হাতের শাবলটা সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় উল্লাস। আজ থেকে একটাও কাজ করবে না ও। কী করে ওরা, ও দেখে নেবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন