দেবারতি মুখোপাধ্যায়
ঘড়িতে ভোর পাঁচটা। ঝনাৎ ঝনাৎ করে জেলখানার দরজা খুলে গেল। কুঠুরি থেকে বেরিয়ে বারান্দা এসে বসতে লাগল বাইরের বারান্দায়। এখন ‘গিনতি’ চলবে। কয়েদিদের গলার হাঁসুলিতে খোদাই করা নম্বর ধরে ধরে হিসেব মিলিয়ে নেওয়া হবে।
গোনার পর্ব মিটলে শুরু হবে শৌচপর্ব।
সারাদিনে এই সময়টুকুতেই নিজেদের মধ্যে যা একটু কথা বলার সুযোগ মেলে। তাও আকারে ইঙ্গিতে, ফিসফাস করে, ওয়ার্ডারদের নজর এড়িয়ে।
টিনের সারি দিয়ে দশটা পায়খানা। জোড়ায় জোড়ায় চলেছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। প্রকৃতি ডাকুক না ডাকুক। প্রত্যেক জোড়ার জন্য বরাদ্দ দু’মিনিট। তার মধ্যে মিটলে ভাল, নাহলে চেপে বসে থাকতে হবে সেই সকাল দশটা অবধি।
দ্বিতীয় জোড়ার প্রথম ছেলেটি উবু হয়ে বসে অনুচ্চ স্বরে পাশের জনকে টিনের দেওয়ালের এপার থেকে জিজ্ঞেস বলল, ‘হরিনাথদাদা কোথায়? তাকে তো দেখচি নে!’
দ্বিতীয়জন প্রাতঃকৃত্য সারতে সারতে জবাব দিল, ‘ওকে মেয়ে জেলখানায় নিয়ে যাবে আজ শুনলাম।’
‘মেয়ে জেলখানায়? কেন?’
‘আজ বে আচে। ওদিকে অনন্ত বামুন কাল রাত থেকে বমি করচে। ওঠার খ্যামতা নেই। একটা বামুন ঠাউর তো লাগবে বে দিতে গেলে। তাই হরিনাথ বে দেবে।’
‘বাবা ফণিদা! তুমি তো দেকচি সব খবর রাখো।’
‘রাখতে হয়।’ ফণীভূষণ নামক ত্রিশ-বত্রিশের যুবকটি গম্ভীরমুখে বলে, ‘ওয়ার্ডারদের সঙ্গে যখন জমাদার, টিন্ডেলদের রগড় চলে, তখন কানদুটো খোলা রাখতে হয়। কেন মকবুল, তুই রাখিস না?’
‘ইনশা আল্লাহ, সারাদিন খেটে খেটে হাড় মাস কালা, সেলে গিয়ে চোখ খুলতে পারি না, তায় কিনা আড়ি পাতব।’ মকবুল মুখ বেজার করল।
‘সেকিরে, তোর এই অল্প বয়স, এতেই এত নেতিয়ে পড়লে চলবে?’
মকবুল নামক অল্পবয়সী ছেলেটা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, বাইরে থেকে জমাদার চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাই। তোদের হাগতে পাঠিয়েছি, খোশগল্প করতে নয়। আর একবার যদি ফুসফুস করতে দেখি, চামড়া গুটিয়ে নেব। চল চল। জলদি কর!’
ফণীভূষণ উঠে দাঁড়ায়। শৌচ করতে করতে ভাবলেশহীন মুখে দেওয়ালের ওপাশে কথা ছুঁড়ে দেয়, ‘আজ দিনটা কিন্তু ইস্পেশাল।’
‘কেন? বিয়ে আচে বলে?’
‘ধুর ব্যাটা। সে তো ফি হপ্তাতেই কেউ না কেউ বে’ করার জন্য হামলে পড়ে। ওতে আবার ইস্পেশাল কী দেখলি?’ ফণীভূষণ বিরক্ত হয়। সামান্য দম নিয়ে বলে, ‘আজ ওরা আসচে। আর একটু পরেই জাহাজ ভিড়বে ঘাটে।’
‘কারা আসচে?’
ফণীভূষণ আড়চোখে একবার দেখে নেয় অদূরে দণ্ডায়মান প্রহরীদের, তারপর বলে, ‘গোলাওয়ালারা আসচে আজ। পাক্কা খবর আচে। তিনদিন আগে কলকাতা থেকে জাহাজ ছেড়েচে।’
মকবুল উত্তেজিত মুখে দেওয়ালের দিকে তাকায়। তার মলত্যাগ তখনও সম্পূর্ণ হয়নি, আকস্মিকতায় বহির্গমন মাঝপথেই আটকে যায়। বড়বড় চোখ করে বলে, ‘সেকি গো ফণীদা! এই পেত্থমবার এত বড়মানুষেরা এখানে আসচে, বলো!’
‘বড় ছোট জানিনে। শুঁটকে হোক কি পালোয়ান, বুলডগ ব্যারির কাচে সব সমান।’
‘বাবা! তুমি তো কাব্যি করতে শিকে গেলে গো ফণীদা!’ মকবুল হেসে ফেলে, ‘ব্যারি সাহেব তোমার এই কোবতে শুনলে ভিরমি খাবে। হে হে!’
‘অ্যাই … অ্যাই কুত্তেকে আউলাদ! জলদি কর!’
বাইরে থেকে আফগান ওয়ার্ডারদের ‘সুমধুর সম্ভাষণ’ ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। ফণীভূষণ আর দেরি করল না। আরও দেরি করলে এ’বেলার লপসি তো মিলবেই না, কাজের কোটাও শেষ হবে না। সেই শাস্তির দায় তখন মেটাতে হবে এক সপ্তাহ ধরে।
ফণীভূষণ বাইরে বেরনোর আগে ফিসফিস করে, ‘শুনেচি ওরা বারোজন আচে দলে। জাহাজের ভোঁ শুনতে পেলে বুঝবি এসে গ্যাচে। চলি!’
ভোরবেলা। সূর্যদেব পূর্বাকাশে আবির্ভূত হয়ে পত্নী উষার অনুগামী হওয়ার তোড়জোড় সবেমাত্র শুরু করেছেন। জেলের মহিলাবিভাগের সাতাশ নম্বর সেলের প্রায়ান্ধকার কুঠুরিতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে এক তরুণী।
বয়স তার একেবারেই অল্প। উনিশ-কুড়ি। নাম তার নীলামণি। সবাই ডাকে নীলা বলে। খর্বকায় পাতলা শ্যামলা গড়ন। নাকটা সামান্য চাপা। গোল মুখ। চোখদুটো বড় বড়। বুদ্ধিদীপ্ত।
ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধ। খাতায় কলমে পৌষমাস হলেও সমুদ্রতীরের এই দ্বীপপুঞ্জে শীত নেই বললেই চলে। ভ্যাপসা গরম। স্যাঁতসেঁতে ভাব। উদ্দাম বাতাস। আকাশে সুগম্ভীর মেঘ। সেই আকাশের নীচে সমুদ্র। ভাঁজ করা কাশ্মীরি পশমিনার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে নিদ্রায় মগ্ন রয়েছে সে। জলমগ্ন সেই পশমিনাটির গায়ে নীল রঙের নানা বৈচিত্র্য। নীল। গাঢ় নীল। ঘন সবুজ। কখনও বেগুনি।
জল এখানে এতরকমের রঙের খেলা দেখায়, আকাশের রামধনুটিও মাঝেমাঝে সেই পারদর্শিতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। প্রকাণ্ড সমুদ্রের মাঝে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতো ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ছোট-বড় দ্বীপ। সবমিলিয়ে প্রায় ছয়শোর কাছাকাছি দ্বীপ নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক এই দ্বীপপুঞ্জের সুখ-দুঃখের পরিবার।
যে দ্বীপে এই কাহিনি আরম্ভ হতে চলেছে, তার অবস্থান দক্ষিণ দিকে। যবে থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে সভ্য মানুষের পদধূলি পড়েছিল, তখন থেকেই এই দ্বীপটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বীপের একেবারে কেন্দ্রে আকাশের বুক চিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দানবসম অট্টালিকাটি। না। পুরাণের দানবের চেয়ে সমুদ্রেরই এক প্রাণীর সঙ্গে তার সাদৃশ্য বেশি। সেই সাদৃশ্য শুধুই শারীরিক নয়, আচরণগতও।
সামুদ্রিক সেই জীবটি হল অক্টোপাস। অক্টোপাস যেমন আটদিকে আটখানা পা প্রসারিত করে এগিয়ে চলে, ঠিক তেমনই এই অতিকায় মঞ্জিলটির সাতদিক থেকে বেরিয়েছে সাতখানা বাহু। শুধুমাত্র বাড়ির প্রবেশপথটির দুটি দাঁড়াসম বাহু আগন্তুককে আক্রমণ করতেই বোধ হয় প্রসারিত হয়ে রয়েছে। একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে একটি সুউচ্চ গম্বুজ। সেন্ট্রাল টাওয়ার।
শত্রুকে প্রতিহত করতে সামুদ্রিক অক্টোপাস যেমন কালি ছুঁড়ে মারে, ছদ্মবেশ ধারণ করে কিংবা রং পালটে ভয় দেখায়, ঠিক তেমনই নানা অদ্ভুত অবিশ্বাস্য পদ্ধতিতে অতিথিদের ভয় দেখাতে এই বাড়ির তুলনা গোটা বিশ্বে নেই।
এই সুবিশাল ভবনটি নির্মিত হয়েছে কয়েকবছর আগে। সামুদ্রিক অক্টোপাসের থেকে একখানি পা কম হলেও বিষের তীব্রতায় এই বিকলাঙ্গ ইট পাথরের অক্টোপাস মোটেই পিছিয়ে নেই, বরং এগিয়েই বলা চলে। দ্বীপপুঞ্জের প্রায় কুড়ি হাজার পাথর নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল এই বাড়ির নির্মাণকল্পে। সুদূর বার্মা থেকে আনা হয়েছিল বিশেষ ধরনের তামাটে ইট।
গত শতকের বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেনথ্যামের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘প্যান অপটিকন’ স্টাইলে বানানো এই রহস্যময় দুর্গ। কাঠামোটাই এমন, মাঝখানের সেন্ট্রাল টাওয়ার থেকে দেখতে পাওয়া যাবে প্রতিটি বাহু। জেলখানাটির নামটি ছোট কিন্তু চিত্তাকর্ষক। সুবিখ্যাতও বটে। ‘সেলুলার জেল’। আর তার সাতখানা বাহু হল সাতটি ওয়ার্ড। প্রতিটি ওয়ার্ডে পরপর কুঠুরি। বা ‘সেল’।
এই জেল ‘সার্থকনামা’, এখানে কোনও ব্যারাক নেই। নেই কোনও ডর্মিটরিও। এখানে একেকজন বন্দি থাকে একেকটা কুঠুরি অর্থাৎ ‘সেল’ এ। সেলের দেওয়ালে কোনও জানলা নেই, কেবলমাত্র অনেক উঁচুতে বায়ু চলাচলের জন্য রয়েছে একটি ‘ভেন্টিলেটর’ গর্ত। নেই কারুর সঙ্গে কারুর সাক্ষাৎ বা কথাবার্তার সুযোগ। প্রতিটি ওয়ার্ডে হ্যারিকেন লণ্ঠন হাতে অতন্দ্র প্রহরায় থাকে চারজন করে ওয়ার্ডার। কুঠুরিগুলোর সামনে দিয়ে যে চারফুট চওড়া বারান্দা চলে গেছে, সেই বারান্দায় ঘুরে ঘুরে নজর রাখাই তাদের কাজ। তিনঘণ্টা অন্তর তাদের পালা বদলায়।
নীলামণি নামক যে বন্দিনী জেলের কুঠুরিতে চুপ করে বসে আছে, তার চুল আগে মেঘের মতো ঘন ছিল, কিন্তু এখানে আসা ইস্তক সমুদ্রের লবণাক্ত বালিজলে স্নান করে সেই চুলের আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। পাতলা হয়ে গেছে অনেক।
সদ্য স্নান করে এসেছে সে। শরীরের ময়লার সঙ্গে ডলে ডলে তুলতে চেয়েছে ক্লেদ। গ্লানি। স্মৃতি। ভিজে চুল এলিয়ে পড়ে আছে। চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে পিঠ। একইসঙ্গে ওর গালও ভিজছে। অশ্রুতে।
ওর মনে পড়ে যাচ্ছে, একদশক আগের কথা। একজোড়া চোখ। উদাস। কিন্তু বড় উজ্জ্বল! বড় মায়াময়! শীতের টাটকা সবজির মতোসজীব একখানি হাসি। চঞ্চল পায়ে ধানখেতের আল ধরে উদ্দেশ্যহীন ছুটে যাওয়া।
‘ইন্দ্রদাদা-আ-আ-আ!’
মন চঞ্চল। ঘুরছিল এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায়। বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে আবার স্থির হল পাক্কা পাঁচ বছর আটমাস আগের এক গনগনে গ্রীষ্মের দুপুরে। আদালত চত্বর। লোকে লোকারণ্য এজলাস। দুধের শিশুকে খুন, তায় আবার হত্যাকারী অল্পবয়সী এক মেয়ে। ভিড় হবে না? মানুষ অবাক চোখে দেখছিল ওকে। ঘৃণা, রাগ, শাপ সবই ছিল। কিন্তু সব ছাপিয়ে সেখানে ছিল বিস্ময়।
হোক সৎ মা, তবু তো মেয়েমানুষ। মেয়েমানুষ এত পাষাণ হয়? হতে পারে?
.
হঠাৎ পেটি অফিসারের চিৎকারে ওর চিন্তার জাল ছিন্ন হল। কৃষ্ণবর্ণা পৃথুলা মহিলা পেটি অফিসার কুঠুরির দরজা খুলছে।
.
‘ও ছোড়ি! জলদি আ।’
তা নীলামণি সেই পেটি অফিসারের পিছু পিছু কুঠুরি ছেড়ে বেরোক, ততক্ষণে নজর দেওয়া যাক পুরুষ বিভাগের দিকে। আড়ে বহরে তা মহিলা বিভাগের দশগুণ। ভোররাতেও সেখানে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে ওয়ার্ডাররা।
এক পশতুন ওয়ার্ডার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে টহল দিচ্ছিল। তার নাম আসফান্দ। ডিউটি শেষ হতে আর মাত্র আধ ঘণ্টা বাকি। ঘুমে চোখ জুড়ে আসছিল আসফান্দের। কিন্তু বসার উপায় নেই। গুমটির পুলিশ সিপাই অনবরত একেকটা ব্লকের কাছে আসে আর যায়। কাছাকাছি আসামাত্র জোর হেঁকে রিপোর্ট দিতে হয়।
‘বিশ তালা বন্ধ। চার ওয়ার্ডার। সব ঠিক হ্যায়!’
আসফান্দ দ্রুত হাঁটছিল। ডিউটি খতম হওয়ার আগে এইসময় নানা কাজ থাকে। একটুও ঢিলে দিলে সিপাই ব্যাটাচ্ছেলেগুলো নালিশ ঠুকে দেবে পেটি অফিসারের কাছে। চোখ তো মানুষের নয়, যেন শিয়ালের। তখন একটানা আরও তিনঘণ্টা ডিউটির দায় এসে পড়বে ঘাড়ে। কিংবা আরও বড় পানিশমেন্ট আসতে পারে। গতকালই তো একজন ওয়ার্ডার টহল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য লণ্ঠন মাটিতে নামিয়ে একটু বসে পড়েছিল। তাকে আজকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাইপার আইল্যান্ডের ডিউটিতে। সেখানে এখনও কিছু কয়েদি আছে। প্রতি মাসে কিছুজন করে আমদানি হয় এই সেলুলার জেলে। সে আরেক হ্যাপার কাজ।
আসফান্দ ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। একেবারে শেষ কুঠুরির সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। লণ্ঠনটা উঁচু করে তুলে বাজখাঁই স্বরে ডাকল, ‘হরিনাথ! এ হরিনাথ!’
কুঠুরির ভেতরে যে লোকটা শুয়ে ছিল, সে ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল। আর তখনই বাধল বিপত্তি। কুঠুরির এককোণে রাখা ছিল মাটির ঘট। সেই মাটির ঘট উল্টে গেল। হরিনাথ স্প্রিং দেওয়া কলের পুতুলের মতো ছিটকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু তার আগেই যা হওয়ার হয়ে গেছে। লোহার গরাদের ওপাশ থেকে আসফান্দ চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘এহ হে ছ্যা ছ্যা! অন্ধা হ্যায় ক্যা তু?’
না। হরিনাথের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিদিনের ‘আদর’সম বেত্রাঘাতে প্রায়ই বিকল হয়ে পড়লেও অন্ধ সে এখনও হয়নি। কিন্তু গোটা জেলে রাত্রে কোনও আলোর ব্যবস্থা নেই। অন্ধকার কুঠুরিতে চোখের কতটুকুই বা কাজ থাকতে পারে? মাটির ঘট উল্টোলেই বা এত ছিছিক্কারের কী আছে?
আসলে প্রতিটা কুঠুরিরই এক কোণে বসানো এই মাটির ঘটগুলো হল এখানকার নৈশকালীন শৌচালয়। প্রতিটি সেলে এরকম একটা করে মাটির ঘট রাখা রয়েছে সেই মান্ধাতার আমল থেকে। প্রতি রবিবার আলকাতরা মাখিয়ে মাখিয়ে তার ভেতরের খোল প্রায় বুজে উঠেছে। রাত্রে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলে প্রথমে নিকষ কালো অন্ধকারে পা দিয়ে খুঁজে খুঁজে ঘটের মুখটা ঠিক করতে হয়। তারপরও শান্তি নেই। ঘটের মুখটা এতই ছোট, তাতে একইসঙ্গে প্রস্রাব ও মলত্যাগ করা সম্ভব নয়। তাই প্রথমে মূত্রের বেগ বন্ধ করে মলত্যাগ করতে হয়। তারপর আবার ঘটের মুখটা ঠিক করে প্রস্রাব করতে হয়। দৈবাৎ কখনও বা কোনও পেশির দুর্বলতায় মল ও মূত্র একসঙ্গে নির্গত হয়ে গেলেই মুশকিল, যে কোনও একটা পড়বে কুঠুরির মাটিতে। তাতে সেই দুর্গন্ধের মধ্যেই কয়েক হাত কুঠুরিতে শুয়ে থাকতে হবে তাই নয়, সকালে মেথর এসে দেখতে পেলেই রিপোর্ট করবে পেটি অফিসারকে। তাতে রয়েছে কড়া শাস্তি।
‘শালে নালায়েক! দিনভর টনাটন খাতে রহতে হো অউর বদবুদার ছোড়তে রহতে হো। বুরবক কাঁহিকা!’ আসফান্দের তর্জন গর্জন থামছিল না, ‘সুবেহ মে পেট সাফ করকে নেহি আ সকতে ক্যা?’
পুরীষ ও মূত্রে মাখামাখি শরীরে হরিনাথ অসহায়ভাবে বসেছিল। সে অতি সাবধানী, যখন তখন বেগ আসার ভয়ে খুব অল্প করে খায়। এখানে সমস্ত কয়েদিকে ভোর ছ’টার আগে অথবা সকাল দশটার পর পেচ্ছাপ পায়খানার কাজ সারতে হয় বাইরের শৌচালয়ে। সূর্যাস্তের পর তাও বন্ধ। বাকি সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হলে নিজের কুঠুরির মাটির ঘটই ভরসা। হরিনাথ পারতপক্ষে তাই অসতর্ক হয় না।
কিন্তু দু’দিন আগে তাকে এই নতুন কুঠুরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এসে থেকেই মলমূত্রে পূর্ণ ঘটের পাশে রাতদিন কাটাতে হচ্ছিল ওকে। কিছু করার নেই। এই দু’দিন মেথর আসেনি। ওর আগে যে থাকত এই সেলে, তার সম্ভবত পেটের ব্যামো ছিল। দু’দিনের পচা পুরীষের তীব্র দুর্গন্ধে হরিনাথের অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছিল।
আগে হলে এতক্ষণে ও হড়হড় করে বমিই করে ফেলত। দ্রুত গঙ্গাস্নান সেরে গায়ত্রী মন্ত্র জপ সেরে ফেলত।
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।
মন্ত্রোচ্চারণ শেষে ভ্রু মধ্যে শ্বেতচন্দনের ফোঁটা নিয়ে বসে পড়ত পুঁথি লেখার কাজে। নগ্নগাত্রে এলিয়ে থাকত সামবেদী দীর্ঘ উপবীতটা।
এখন ভাবলে ভ্রম লেগে যায় হরিনাথের। মনে হয়, সে বুঝি কোনও পূর্বজন্মের কথা! যেদিন কালাপানি পেরিয়ে হাতকড়ি পরে এসে নেমেছিল এই দ্বীপের বন্দরঘাটে, সেদিনই খুলে ফেলতে হয়েছিল পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সেই পৈতেটি। সঙ্গে ত্যাগ করতে হয়েছিল সম্মান। স্বপ্ন। আকাঙ্ক্ষা। মানুষ হিসেবে বাঁচার ন্যূনতম অধিকার।
ও কাতর স্বরে বলল, ‘তোমাদের তো কাল থেকে বলচি, মেথর আনাও। গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। শুতে গেলেও মাথায় ঠেকচে। তা আনালে না। এখন কী হবে?’
ততক্ষণে আসফান্দের পেছনে এসে উপস্থিত হয়েছে আরেকজন। কৃষ্ণবর্ণ কৃশকায় কুতকুতে চোখের লোকটিকে লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় দেখে হরিনাথের মুখ শুকিয়ে গেল। এই লোকটির নাম গোলাম রসুল। সে এই ওয়ার্ডের মুনশি, তার কাজ হল কয়েদিদের কাজকর্ম বুঝিয়ে দেওয়া, তদারক করা। কিন্তু সেই কাজের চেয়ে অন্য কাজে নিজের টিয়াপাখির মতো নাকটিকে গলাতে পারলেই গোলাম রসুল তৃপ্তি পায় বেশি। কয়েদিদের মধ্যে তার একটি গোপন নাম দেওয়া হয়েছে। ‘সাহেবের ছুঁচো’। শুধু নির্লজ্জ খিদমতগারির জন্যই নয়, তার গায়ে বিটকেল গন্ধ। পারতপক্ষে স্নান করে না। কেবল মাঝেমধ্যে রস আইল্যান্ডে সাহেবদের বাড়িতে গিয়ে মেমসাহেবদের তোষামোদ করে টুকটাক বেগার খেটে বিলেতের বাতিল সুগন্ধীর শিশি নিয়ে আসে।
কিন্তু চার নম্বর ওয়ার্ডের মনোরঞ্জন বাগচি ঠিকই বলে। ছুঁচো যদি আতর মাখে, তাতে কি আর গন্ধ ঢাকে?
কোন কয়েদি তেলের ঘানি টানতে টানতে একটু জিরোচ্ছে, কে ছোবড়া পেটাতে পেটাতে অন্যমনস্ক হয়ে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে অশ্রুপাত করছে, গোলাম রসুলের চোখ কোনও কিছু এড়ায় না। ছুটে গিয়ে সে নালিশ করে পেটি অফিসারকে বা জমাদারকে। গত পনেরো-কুড়ি-বছরে এভাবে যে কত লোককে সে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে, তার হিসেব তার নিজের কাছে না থাকলেও উল্টোদিকের লোকদের কাছে আছে।
হরিনাথ কানাঘুষোয় শুনেছে, যারা জেল থেকে ‘ফ্রি টিকিট’ পেয়ে বাইরের নানা দ্বীপপুঞ্জের টাপুগুলোয় রয়েছে, তারা নাকি সব ওঁত পেতে বসে আছে। গোলাম রসুলকে একবার বাইরে পেলেই মজা দেখাবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর আসে কই!
আসফান্দ কিছু বলার আগেই গোলাম রসুল খিঁচিয়ে উঠল, ‘ওয়ে মেরে লাটসায়েবকে পোতে রে। মেথর আনো বললেই সামনে হাজির করতে হবে কিনা! ওঠ। নাহাতে হোবে। এই আসফান্দ, দরজা খোল।’
হরিনাথ বিস্ময়ে পুলকিত হল। গোলাম রসুলের হল কী? শরীর টরির ঠিক আছে তো? এত দয়ামায়া কবে থেকে ওর মধ্যে জন্মাল যে, একজন বন্দি নোংরা মেখে শুয়ে আছে, আর তাকে দয়াপরবশ হয়ে স্নানে পাঠাবে?
আসফান্দ প্রকাণ্ড তালাটা খুলছিল। এখানে প্রতিটা গরাদের তালার অবস্থান এমন কায়দায় বানানো যে, কুঠুরির ভেতর থেকে সেই তালার নাগাল পাওয়া কোনও বন্দির পক্ষে সম্ভব নয়।
হরিনাথকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে গোলাম রসুল আবার তার দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে কাছে ঘনিয়ে এল, ‘কা হো, কালা হয়ে গেছিস কি? শুনাই নেহি দেতা হ্যায়? উঠ আও।’
হরিনাথ আনন্দে অন্যের বাসি পুরীষমাখা শরীরে উঠে দাঁড়াল। সকাল দশটার সময় স্নান করার নিয়ম। প্রতিটা ওয়ার্ডের বাইরে চওড়া পাকা নালি বানানো আছে। সেই নালির মুখে লাগানো থাকে মোটা জলের কল। উবু হয়ে বসে কল খোলামাত্র হুড়হুড় করে ঝরে সমুদ্রের নোনা জল। সেই নোনা জলেই স্নান সারতে হয়। তেল বা সাবানের বালাই নেই। এমনকি গামছাও দেওয়া হয় না। কেউ কেউ স্নান করে উঠে গায়েই জল শুকিয়ে নিয়ে কাজ চলে যায়। কেউ আবার ছেঁড়া পাজামা বা ন্যাকড়া খুব সন্তর্পণে নিজের কাছে রেখে দেয়। ওগুলো মহার্ঘ্য সম্পত্তি। একটু বেখেয়াল হলেই চুরি যাবে।
হরিনাথ খুব সাবধানে জাঙ্গিয়ার ভাঁজ থেকে তার ন্যাকড়াটা বের করল। তারপর ধীর পায়ে পিছু নিল আসফান্দ ওয়ার্ডারের।
জেলের মহিলা বিভাগে আজ সাজো সাজো রব। শালুক ফুলের মতো একধরনের ফুল এখানে খুব হয়। বড় বড় পাপড়ি, ভেতরটা সাদা আর গোলাপি। তাকে বলে পিন্মা ফুল। সেই পিন্মা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে মহিলা ডিভিশনের প্রবেশপথ। সেই প্রবেশপথ দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলে একখানা ঘর। তার ভেতরে কয়েকজন মহিলা ব্যস্ত পায়ে চলাফেরা করছে।
এক অল্পবয়স্কা তরুণী হাতে একখানা লালপেড়ে কাপড় আর কিছু ফুল নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। বয়স সতেরো-আঠারো। গায়ের রং শ্যামলা। কিন্তু মুখখানায় ভারী লাবণ্য। দরজার কাছাকাছি এসে তার ধাক্কা লেগে গেল এক বিপুলকায়া প্রৌঢ়ার সঙ্গে।
প্রৌঢ়া ইস্পাতখণ্ডে ঘর্ষণের মতো তীক্ষ্ণ সুরে খনখন করে উঠল, ‘আ মোলো যা। চোখের কি মাথা খেয়েচিস নাকি হতচ্ছাড়ি? নেয়ে এলুম, দিলি তো ছুঁয়ে?’
তরুণী থতমত মুখে বলে, ‘ছুঁলুম তো কী হল গো চাঁদুমাসি। তুমি একা নেয়েচ নাকি? আমিও তো সেই কোন ভোরে উঠে নাইলুম।’
‘সেই তো। তুমিও তো নাইলে। তা কোন জলে নাইলে শুনি?’
তরুণী বলে, ‘কেন? বাইরের হাউদির জলে রোজই তো নাই।’
চাঁদুমাসি এবার দ্বিগুণ তীব্রতায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কতা শোনো আবাগীর বেটির। ওরে আমি কি তোর মতো ওই কালাপানির নোংরা জলে নেয়ে এসিচি? হাগা কাপড়ে ওই তো চিরিক চিরিক নোনা জলে গা ধুয়ে আসিস। না আচে তেল। না জোটে সাবান। আর আমি যে সেই সাতসকালে উঠে সাবান দিয়ে গা ডললুম, তারপর নেয়ে মাধুরী গন্ধতেল মেখে এলুম, তোর নাওয়া আর আমার নাওয়া এক হল?’
তরুণী হেসে ফেলল, চাঁদুমাসিকে আরও চটিয়ে দিতে বলল, ‘এ তল্লাটটাই তো হল গিয়ে কালাপানি। তুমিও কালাপানিতে নেয়েচ, আমিও কালাপানিতে নেয়েচি। একই তো হল গো!’
রাগে আগুন হয়ে চাঁদুমাসি কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ভেতর থেকে আরেকজন মহিলা বেরিয়ে এল। তার বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ। শক্তসমর্থ গায়ের গড়ন। মাথার পেছনে খোঁপাখানা চুড়ো করে বাঁধা।
‘কী হল গো, চাঁদুদিদি, একেনে পা রেকেই কার ওপর এত চটলে?’
‘দ্যাখ না ভীমি, পুষ্প কেমন মুকে মুকে কতা কইচে।’ চাঁদু নামক প্রৌঢ়া রাগত মুখে বলে চলে, ‘সেদিনের ছুঁড়ির দেমাক দেখে বাঁচি নে। আমায় এসেচে কালাপানি শেখাতে। ওরে আমি যখন একেনে থাকতুম, তখন এই নাওয়াকে নাওয়া বলতুম না বুঝলি?’
‘আহা রাগ করো কেন চাঁদুদিদি। পুষ্প ছেলেমানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলেচে, ওর কতা ধরতে আচে নাকি? আজ শুভ দিন, অত চটতে নেই। তুমি হলে গিয়ে আমাদের অতিথি।’
চাঁদু কিছুটা শান্ত হয়। দম নিয়ে বলে, ‘সে বেটি কোতায়?’
‘এই তো। গায়ে হলুদ হয়ে গ্যাচে। বর এসে পড়ল বলে। এসো এসো। আমার সঙ্গে এসো।’
চাঁদুদিদি প্রায়ান্ধকার করিডরে প্রবেশ করতে করতে আড়চোখে তাকায়, ‘হ্যাঁ রে ভীমি, আজ যার বে’, সে নাকি প্রথমে রাজিই হচ্চিল না?’
‘হ্যাঁগো। অনেক বলে কয়ে সে বে’তে মত দিয়েচে।’
‘সেকি লো! বলি, একেনে আসা ইস্তক মেয়েরা গলায় ঝুলে বেরোতে পারলে বাঁচে, আর এ কেমনধারা মেয়েমানুষ! কী নাম লা?’
‘নীলামণি।’
‘বাঙালি?’
‘হুঁ।’
‘কায়েত?’
‘বামুন গো। চক্কোত্তি।’
‘অ!’ চাঁদুদিদির কৌতূহল কিছুটা নিবৃত্ত হয়, সে মন দেয় অন্যদিকে, ‘শোন। আজ নাকি ওরা আসচে?’
‘কারা গো?’
চাঁদুদিদির মুখের অভিব্যক্তি পালটে যায়। এদিক ওদিক একবার আলগোছে তাকিয়ে নিয়ে মাথা নাড়ে, ‘পরে বলব। এখন চল দিকি ভেতরে!’
.
কে এই চাঁদুদিদি? সাতসকালে কেনই বা সে স্নান টান করে চলে এসেছে মহিলা জেলে? বাকি তরুণী কিংবা প্রৌঢ়ারাই বা কে? কিছু আগে বর্ণিত ফণীভূষণ বা মকবুল নামক কিশোরটির পরিচয়ই বা কী? বন্দি হরিনাথ বা নীলামণির অপরাধই বা কী?
আর সেই ‘বারোজন গোলাওয়ালা’?
এত কিছু জানতে হলে একটু থামতে হবে। কখনও কখনও এগনোর জন্য যে দু’পা পিছনোরও প্রয়োজন পড়ে।
এতক্ষণে সহজেই অনুমান করা যায়, এই কাহিনির সময়পট বর্তমানকাল নয়। আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলের চারশোটা সেল ১৮৯৭ সালের মধ্যে তৈরি হয়ে গেলেও পুরোটা শেষ হতে হতে ১৯০৬ সাল হয়ে গিয়েছিল। অতএব এই কল্পকাহিনির সময়কালে বিংশ শতাব্দী সবেমাত্র সদ্যোজাত শিশুর মতো হামাগুড়ি দিতে শিখেছে।
আরও নির্ভুলভাবে বলতে গেলে বিংশ শতকের প্রথম দশক। ১৯০৯ সালের শেষের দিক।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক উত্তাল সময়। একদিকে বাংলা ভেঙে দু’ভাগ করার প্রতিবাদে দিকে দিকে জ্বলে উঠছে প্রতিবাদের আগুন, ‘বয়কট’ করা হচ্ছে বিদেশি দ্রব্য, রজনীকান্ত সেন গেয়ে উঠছেন, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই, দীনদুখিনী মা যে তোদের এর বেশি আর সাধ্য নাই’।
অন্যদিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে চরমপন্থীরা দল ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। অনেক হয়েছে নরমপন্থীদের প্রেয়ার। পিটিশন। অনুরোধ। উপরোধ। ওসব করে ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়ানো যাবে না। দেশ স্বাধীন করতে গেলে একটাই পথ। তা হল সশস্ত্র বিপ্লব।
জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটছে উল্কার গতিতে। উঠে আসছেন বাল গঙ্গাধর তিলক। লালা লাজপত রাই। বিপিন চন্দ্র পাল। অরবিন্দ ঘোষ। পাঞ্জাবে কৃষকরা জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। রাওয়ালপিণ্ডি, শিয়ালকোট থেকে কলকাতা, ঢাকা। দিকে দিকে চলছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রচার।
ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ড যখন এমনই উত্তাল, তখন তার একেবারে পায়ের কাছের দ্বীপ পুঞ্জটিতে বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা।
না। এই নিস্তব্ধতা শান্তির নয়। শ্মশানের।
তা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরো প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে। ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ। ইংরেজদের অপশাসন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে তরুণ সেনা মঙ্গল পাণ্ডে শহিদ হলেন ব্যারাকপুরে, সঙ্গে বপন করে দিয়ে গেলেন দেশব্যাপী সিপাহি বিদ্রোহের বীজ। শুরু হয়ে গেল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। মীরাট, ঝাঁসি, অযোধ্যা, কানপুর সবক’টা ক্যান্টনমেন্টে জ্বলতে লাগল প্রতিবাদের আগুন। ১১ মে হিন্দু মুসলমান সিপাইরা দিল্লি দখল করল। স্বাধীন ভারতের বাদশাহ ঘোষণা করল বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে। দেশের বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত সম্প্রদায় তখনও খুব একটা আমল দেননি। কিন্তু খেতমজুরই হোক বা সেনাবাহিনীর ফৌজি পোশাকে থাকা কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের দল তখনই বুঝতে পেরেছিল শত্রুর আসল উদ্দেশ্যকে। শত্রুর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকেও তারা ধরতে পেরেছিল নির্ভুলভাবে। সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার মুখপাত্র ‘পায়াম এ আজাদি’-র সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল,
‘ইংরেজ শাসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করবে হিন্দু ও মুসলমান ভাইদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার। তাদের এই শয়তানির ফাঁদে কেউ পা দেবেন না। সমস্ত তুচ্ছ ভেদাভেদ ভুলে একইসঙ্গে এই স্বাধীনতাযুদ্ধে লড়াই করুন।’*
[* Payam-e-Azadi, Azimullah Khan]
ভাবতে বিস্ময় লাগে, জনসংখ্যার তথাকথিত অশিক্ষিত একটা বড় অংশ অত আগে ‘Divide and rule’ বুঝে ফেলেছিল, অথচ… যাক সে কথা!
ইংরেজরা তো মহাপরাক্রমে সেই মহাবিদ্রোহ দমন করল, কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের কর্তাদের মনের মধ্যে একটা দীর্ঘমেয়াদি ভয় ঢুকে গেল। উপমহাদেশের পায়ের তলায় থাকা খিদমদগারিতে অভ্যস্ত চাবুক খাওয়া এই মানুষগুলো যে এমন সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ করতে পারে, এ যে ধারণার বাইরে!
বিদ্রোহ শেষ হলেও তাঁদের সেই ভয় মিটল না।
অনেক বিদ্রোহী সেনাকেই নাহয় মেরে ফেলা হয়েছে যুদ্ধে, কিন্তু অনেকে তো মারাও যায়নি! ভারতবর্ষেরই নানা শহরের জেলে বন্দি রয়েছে। ছাড়া পেয়ে যদি তারা আবার ঘোঁট পাকাতে শুরু করে? লোককে আবার উসকোয়?
কী হবে তখন?
দুশ্চিন্তায় বিলিতি কর্তামশাইদের রাতের ঘুম চলে যায়। মখমলের সোফায় দামি সুরার পাত্র হাতে বসেও সেই উদ্বেগ কাটে না।
কেউ বলে, ‘সবক’টাকে মেরে ফেললে কেমন হয়? কত কনভিক্টকেই তো ফাঁসিতে লটকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ভয়ও বাড়বে লোকজনের মধ্যে।’
অন্যরা মুহূর্তে নাকচ করে দেয় সেই পরিকল্পনা, ‘Are you mad ? যারা মরেছে মরেছে, কিন্তু যারা জেলে বন্দি, এখন তাদের মেরে ফেললে দেশের সব লোক আমাদের এগেইন্সটে চলে যাবে, এই সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না?’
ঠিক কথা। তবে উপায়?
উপায় একখানা জব্বর পাওয়া গেল। প্রায় ষাট বছর আগে দেশের পায়ের কাছে শুয়ে থাকা যে জায়গাটা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলে পরিত্যাগ করে আসা হয়েছিল, সেই সুদূর আন্দামানে একখানা Penal Settlement অর্থাৎ কিনা বন্দি উপনিবেশ বানালেই তো ল্যাঠা চোকে। সারাজীবনের জন্য এই বন্দিদের সেখানে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলে এরাও শায়েস্তা হবে, আবার মূল ভূখণ্ডের লোকজন তাদের হদিশও পাবে না।
প্রশাসন লুফে নিল এই প্রস্তাব। মহাবিদ্রোহের কয়েকমাসের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল ‘আন্দামান কমিটি’। তাদের সেই রিপোর্ট জমা পড়তে না পড়তে প্রায় হুড়মুড়িয়ে বন্দি পাঠানো শুরু হল।
মহাবিদ্রোহ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকমাস পর ১৮৫৮ সালের ১০ মার্চ কলকাতা থেকে ‘সেমিরামিস’ নামের এক জাহাজ গিয়ে পৌঁছল পোর্ট ব্লেয়ারে। দুশো জন হতভাগ্য সিপাহি বিদ্রোহের বন্দি গিয়ে পা রাখল আন্দামানে। পরের মাসেই আরও ১৭১ জন বন্দিকে পাঠানো হল করাচি থেকে। যে মানুষগুলো সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল, তাদের শেষ জীবন কাটতে লাগল ওই প্রতিকূল পরিবেশে জঙ্গল সাফ করে, পথঘাট বানিয়ে ও ওখানকার ইংরেজ অফিসারদের খিদমতগারি করে।
ভাবলেও গায়ের প্রতিটি রোমকূপ শিহরিত হয়ে ওঠে যে, যে দু’থেকে আড়াই হাজার* বিদ্রোহী রাজবন্দিকে তখন আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের কেউই জীবিত অবস্থায় ভারতবর্ষে ফিরে আসতে পারেননি। এমনকি তাঁদের সম্পর্কে কোনও তথ্যও ‘ডকুমেন্টেড’ রাখা হয়নি কোথাও। দিল্লির মহাফেজখানা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ, এমনকি খোদ আন্দামান সরকারের দপ্তরেও নেই। প্রথম যুগের সেই বিদ্রোহী রাজবন্দিদের নথি ব্রিটিশরা সুকৌশলীভাবে কোথাও রেখে যায়নি।
[Andamans and 1857’, Dr. N. H. Kulkarni]
আন্দামানে গিয়েই সেখানকার ভয়াবহ অবস্থা দেখে ২২৮ জন চেষ্টা করেছিলেন পালিয়ে যাওয়ার, তাঁদের মধ্যে ৮৬ জনকে ধরা পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর বাকিরা হয় আদিম অরণ্যে প্রবেশ করে বন্য মানুষদের হাতে প্রাণ দেন, কিংবা তাঁদের স্থান হয় সমুদ্রের ক্ষুধার্ত হাঙরদের পেটে। বলা বাহুল্য, বিনা দূরভাষ দূরদর্শন আন্তর্জালের যুগে তথাকথিত ‘ভদ্রসভ্য’ ইংরেজ জাতির সেই সুপরিকল্পিত নারকীয় পরিকল্পনার কথাও দেশের কেউ জানতেই পারেনি।
ব্যতিক্রম কেবলমাত্র একজন। সেই বীরপুরুষের নাম থানেশ্বরী। দেশে ফিরে এসে তিনি ভাগ্যিস একখানা ‘বিস্ফোরক আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন। নাহলে সেই কালো অধ্যায় কালাপানির অতলেই চাপা পড়ে থাকত।
ফিরে আসি ‘সেমিরাসিস’ জাহাজে চড়ে আন্দামানে পৌছনো সেই দুশো জন রাজবন্দির কথায়। তাঁদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে গেলেন একজন সাহেব। তাঁর নাম ড. ওয়াকার। সঙ্গে নাভাল অফিসার, ওভারসিয়ার আর নৌকর্মীদের পঞ্চাশ জনের একটা দল।
এই ড. ওয়াকারের মতো নিষ্ঠুর ও নৃশংস শাসক খুব কমই ছিল। পোর্ট ব্লেয়ারের উল্টোদিকের ‘রস আইল্যান্ড’ দ্বীপটি তাঁর বেশ মনে ধরল। জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে তিনি সেখানেই বানিয়ে ফেললেন আন্দামান বন্দি উপনিবেশের হেডকোয়ার্টার। বন্দিদের ভাগ করে পাঠিয়ে দেওয়া হল চ্যাথাম আইল্যান্ড, ভাইপার আইল্যান্ড, নর্থ বে ও আরও কিছু দ্বীপে। প্রতিটি দ্বীপই তখন দুর্ভেদ্য অরণ্যে পরিপূর্ণ। সারাদিন অকান্ত পরিশ্রমে জঙ্গল পরিষ্কার, রাস্তা তৈরির পর সেই সব দ্বীপে বন্দিদের স্থান হল মুক্ত আকাশের নীচে তাঁবুতে। বিষাক্ত বিছে, জোঁক, পোকামাকড় আর যখন তখন বৃষ্টির সহাবস্থানে তাঁদের দিন কেমন কাটতে লাগল, তা বলাই বাহুল্য।
যারা মারা গেছিলেন, তাঁরা একরকম বেঁচেই গিয়েছিলেন। কিন্তু যে রাজবন্দিরা বেঁচে রইলেন, তাঁদের জীবন নরক হয়ে উঠল। ম্যালেরিয়া ও ডিসেন্ট্রি রোগের প্রাদুর্ভাব তখন গোটা দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে। না আছে কোনও চিকিৎসাব্যবস্থা, না কোনও ওষুধপত্র। তাঁদের সামনে টোপ ঝোলানো হল, দশ বছর জেল খাটলে মিলবে ‘ফ্রি টিকিট’।
অর্থাৎ কিনা ‘ছুটি’।
তবে ছুটি শুনেই উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। ‘ছুটি’ মানে চার দেওয়ালের খুপরি থেকে মুক্তি, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে নয়। ‘ছুটি’ মানে সরকারের প্রত্যক্ষ বেগার খাটা থেকে মুক্তি, অমানুষিক পরিশ্রম থেকে নয়।
এই ‘ফ্রি টিকিট’ পাওয়া কয়েদিদের জন্য আন্দামানেই বানানো হল ‘স্বাবলম্বন গ্রাম’। টিকিটধারী কয়েদিরা জেলের তাঁবু থেকে মুক্তি পেয়ে চলে গেল সেই গ্রামে। তাদের জন্য সেখানে ঢালাও সুযোগ। স্বাধীনভাবে সেখানে বাঁশ আর জঙ্গলের পাতা দিয়ে নিজের কুঁড়েঘর বানাও, সেখানকার জমিতে চাষবাস করো, পশুপালন করো। আবার চাইলে কোনও ইংরেজ অফিসারের বাড়িতে বা সরকারি দপ্তরে কাজও করতে পারো। তবে যাই করো বাপু, এই ক’টা দ্বীপের মধ্যেই করো। ইহজীবনে আর তোমার দেশে ফেরা হবে না।
কিছুদিন এই পদ্ধতি চলার পরই ড. ওয়াকারের টনক নড়ল। তিনি ওপরমহলে চিঠি লিখলেন, ‘স্বাবলম্বন গ্রাম’ গড়ে তোলা তো হচ্ছে, কিন্তু মহিলা ছাড়া কোনও গ্রাম কি সম্পূর্ণ হয়? একা একা মদ্দা জোয়ানগুলো কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকবে কী করে? ওভাবে হয় নাকি? তাছাড়া দীর্ঘদিন পুরুষসংস্রবে থাকতে থাকতে এদের মধ্যে বিকৃতি জন্মাচ্ছে। সমকামিতা বাড়ছে।
ওপরমহল থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘কিন্তু উপায়টা কী? ওই বন্দিদের জন্য আমরা মহিলা কোথা থেকে জোগাড় করে আনব? কী যে ভুলভাল প্রস্তাব দাও তুমি ওয়াকার!’
ড. ওয়াকার দমলেন না। বিস্তারিতভাবে জানালেন তাঁর বক্তব্য, ‘কেন, এইসব কয়েদিদের পরিবারকে দেশ থেকে নিয়ে এলেই তো হয়। স্ত্রী পরিবার পরিজনের সঙ্গে থাকলে এদের মধ্যে উগ্রতা, হিংস্রতা কমবে। ভবিষ্যতে এই পেনাল সেটলমেন্টে কোন গন্ডগোল পাকানোরও আশংকা থাকবে না তেমন। কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে মেতে থাকবে। এভাবেই গ্রামগুলো সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।’
ব্রিটিশ সরকারের মনঃপুত হল এই পরিকল্পনা। আন্দামানে চালান দেওয়া কয়েদিদের পরিবার দেশের যেখানে যেখানে ছড়িয়ে আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। ওদিকে ওয়াকারও কথা বললেন ‘ফ্রি টিকিট’ কয়েদিদের সঙ্গে।
‘তোমরা চিঠি লেখো। বুঝিয়েসুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসো পরিবারকে। এখানে জমির ব্যবস্থা করে দেব আমরা। তোমরা থাকবে। চাষবাস করবে। এমনকি কোনও ট্যাক্স দিতে হবে না। জমির স্বত্বও থাকবে তোমার নিজের। তোমার অবর্তমানে তোমার বিধবা স্ত্রীর।’
কয়েদিরা তবু গাঁইগুঁই করে।
ড. ওয়াকার আরও বোঝান, ‘আচ্ছা নাও, প্রথম তিনবছর তোমাদের সংসার থিতু হওয়ার সব খরচাপাতি সরকারের। খুশি? নাও, চিঠিটা লিখে ফেলো।’
এত টোপ দিয়েও অধিকাংশকেই সম্মত করানো যায় না। ড. ওয়াকার এখন যতই জনহিতৈষী সাজুন, তাঁর দীর্ঘ কয়েক বছরের নির্মম অত্যাচার সবার মনেই দগদগে স্মৃতি হয়ে গেঁথে রয়েছে। তাছাড়া, এদিক ওদিক কান পাতলেই শোনা যায়, ব্রিটিশ অফিসারদের আদিবাসী রমণী বলপূর্বক তুলে এনে লালসা মেটানোর কেচ্ছা। পরিবারের সঙ্গে এতবছর দেখা হয়নি, আর কোনওদিনও হবেও না। তবু তারা নিজভূমে শান্তিতে আছে। এখানে নিয়ে আসার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারে না অনেকেই।
তবু তারই মধ্যে গুটি কয়েককে রাজি করানো গেল। তারা মধু ঢেলে ভালবাসা ভরে চিঠি লিখলে সেই চিঠি প্রশাসনের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হল তাদের পরিবারের কাছে। তাদের আন্দামানে আসার সব খরচ সরকারের।
কিন্তু এরপরেও ওয়াকারের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল না। তিনি আসলে মেমসাহেবদের সঙ্গে ভারতীয় নারীদের গুলিয়ে ফেলেছিলেন। সুদীর্ঘ অপেক্ষা শেষে স্বামীর বাহুডোরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষার থেকেও তাদের কাছে ‘জাত’ অনেক বড়। আর কে না জানে, কালাপানি পার হওয়া মানেই নিজের ধর্মটি খোয়ানো?
‘উঁহু। ওটি হবে না কো। সোয়ামি যেমন আচেন ওখানে তেমনই থাকুন, আমি এখান থেকে তাঁর জন্য সাবিত্রী ব্রত রাকচি, বিপত্তারিণী পুজো করচি, বট পূর্ণিমায় পুজো করচি, তাঁর ছেলেপিলেদের মানুষও করচি। এই বয়সে এসে আর জাত খোয়াতে পারব না বাপু!’
রঘুনাথ সিংহ নামে এক কয়েদির পরিবার প্রথমে রাজি হয়েছিল ‘আন্দামান’ এ যেতে, কিন্তু আন্দামান যেতে গেলে যে সমুদ্র পার হতে হয়, তা কে জানত? শোনামাত্র তারা সরকারি প্রতিনিধিকে বিদায় করল।
প্রায় শ’দেড়েক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাত্র তিনটি পরিবারকে নিমরাজি করানো গেল। ওয়াকার তো বটেই, ব্রিটিশ সরকারও মুষড়ে পড়ল। তাদের মধ্যে অন্য এক আশংকারও জন্ম নিল। মানুষের মনে সিপাহি বিদ্রোহের ক্ষত এখনও তাজা, এখন যদি তারা ‘কালাপানি পার করিয়ে ধর্মচ্যুত করা হচ্ছে’ মনে করে তেতে ওঠে, তবে মুশকিল।
কী দরকার মোটে তিনটে পরিবারের জন্য অমন ঝুঁকি নেওয়া?
ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনাটা বাতিল করে দিল। কিন্তু ড. ওয়াকার দমলেন না। মহিলা আমদানি না করলে ঠিকঠাক গ্রাম গড়ে তোলা যাচ্ছে না আন্দামানে। তিনি তখন প্রস্তাব দিলেন, দেশের নানা জেলে যে যাবজ্জীবন মহিলা কয়েদিরা আটক রয়েছে, তাদেরকেই নাহয় আনা হোক এখানে। তাদের দিয়েই এখানে গড়া হবে সংসার।’
তাই হল। তার পরের কয়েক দশক ধরে বাংলা, বোম্বে, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব ইত্যাদি জায়গার জেল থেকে জাহাজে চেপে আন্দামান আসতে শুরু করল দলে দলে মহিলা কয়েদিরা। প্রথমে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তাদের আনা হতে থাকলেও পরে সেই বিধিনিষেধও তুলে দেওয়া হল। যেভাবে হোক, যত পারা যায়, মেয়েদের পাঠাতে হবে আন্দামানে। ভারত ও আন্দামান, সব মিলিয়ে পাঁচ বছর জেল খাটলেই কেল্লাফতে। ‘স্বাবলম্বন’ গ্রামে তাকে বিয়ে দিয়ে দাও যে কোনও লোকের সঙ্গে।
একটা ছোট্ট তথ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যে বছর জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই ১৮৮৫ সালে আন্দামানে মোট মহিলা কয়েদি ছিল ৪৫৫ জন। আর তাদের মধ্যে সেই বছরে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৭১ জনকে।
এই কাহিনিটি শুরু হয়েছে ১৯০৯ সালে। তার প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে থেকে আন্দামানে মহিলা কয়েদিদের পাঠানো শুরু হয়েছিল। সেই যে খনখনে মেজাজের প্রৌঢ়া চাঁদুমাসি হেলেদুলে গিয়ে বসেছে মহিলা জেলে? সে হল একেবারে সেই প্রথম দিককার আমদানি। বছরকয়েক কালাপানিতে জেল খেটে সে বিয়ে করেছিল এখানকারই এক পুরুষ বন্দিকে। সেই বিয়ের তাও প্রায় কুড়ি বছর হল।
চাঁদুমাসির আসল নামটি জম্পেশ। চন্দ্রপ্রভা দাসী। তা কবেই সেই নাম ইতিহাসের গর্ভে তলিয়ে গেছে। এখন সেই নাম শুনলে সে নিজেও বুঝি চমকে উঠবে। তার পিতৃগৃহ ছিল পূর্ববঙ্গের বরিশালে। এই আন্দামানের নোনা বালুকাতটে সে যখন পা রেখেছিল, তখন তার বয়স ছিল চব্বিশ। কী এমন অপরাধে তার কারাদণ্ড হয়েছিল, তা পরে বলা যাবে। আপাতত চলে যাওয়া যাক মহিলা জেলের অভ্যন্তরে।
আগেই বলেছি, সেখানে আজ নীলামণির বিয়ে। একটু আগে গাত্রহরিদ্রা পর্ব মিটেছে। এখানে অনেক বন্দি তরিতরকারির বাগানে কাজ করে। সেখানকার হলুদ গাছের শিকড় বেটে সেই হলুদ বেশ করে মাখানো হয়েছে নীলার মুখে, হাতে, পিঠে। তারপর তাকে স্নান করানো হয়েছে ইঁদারার মিষ্টি জলে। আজকে সে ‘ভিআইপি’, তাই শুধু তার জন্য সাহেবের হুকুমে ব্রিটিশ কোয়ার্টার থেকে ভাল মিষ্টি জল দিয়ে গেছে পানিওয়ালা।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে হলুদখেলাও চলেছে বন্দিনীদের মধ্যে। এখানে আনন্দের উপলক্ষ খুব কম আসে, কোনও কারণে সেই মুহূর্ত এলে সকলে মিলে চেটেপুটে পেতে চায় সেই আনন্দের তারপর সবাই মিলে গলা জড়াজড়ি করে গেছে বাইরের হাউদিতে স্নান করতে।
নীলামণির মনটাও বোধ হয় এখন বেশ খুশি রয়েছে। আজ সে বহুবছর পর পরিষ্কার জলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছে। গুনগুন করে সে একটা গানও গেয়ে ফেলল।
জুঁইবালা নামের ওর সমবয়সী এক বন্দিনী জানতে চাইল, ‘কী গান গাইচিস লা?’
‘কিছু না।’ নীলামণি যেন লজ্জা পায়।
‘বাবা, লাজ দেখে আর বাঁচি নে।’ কথা শেষ করে জুঁইবালা সুর করে গেয়ে ওঠে,
‘আগে ভালবাসা জানাইলে প্রিয় বলে,
শেষে ছলনা করিয়া আমার মন নিলে।’
‘কী যে আজেবাজে বকচিস, তার নেই ঠিক।’ নীলামণি কপট রাগ দেখায়।
‘বটে? আজেবাজে আমরা বকচি, না তুমি?’ ঘরের কোণে এক কিশোরী বসে রজনীগন্ধা ফুলের মালা গাঁথছিল। এবার সে এগিয়ে আসে, ‘জুঁইদিদি তো ঠিকই বলেচে।’
‘কী ঠিক বলেচে শুনি? ভালবাসা আবার কী? কথাই বলিনি আজ অবধি!’ নীলামণি ঠোঁট উল্টোয়।
‘ওলে আমার খুকি রে!’ জুঁইবালা মুখ বেঁকায়, ‘হ্যাঁরে মিনতি! মনে আচে সেদিনের কতা? যেদিন নীলামণির ‘সম্বুর’ হল?’
‘তা আবার থাকবে না?’ মিনতি বশংবদ ভৃত্যের মতো চোখ ঘুরিয়ে বলে, তেরোজন এয়েচিল। তা নীলাদিদি অন্যদের দিকে ফিরেই তাকাল না। গটগট করে সোজা গিয়ে নিজের কচি নাগরকে বেছে নিল।’
কচি নাগর! ঘরশুদ্ধ সব মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠল। নীলামণির মুখ আরক্ত হয়ে গেল। আর কিছু না বলে সে অন্যদিকে তাকাল। তাকে পরানো হয়েছে একটা খুব জমকালো বেনারসী জরির ডুরে কাপড়। এখানে প্রতি মাসেই কোনও না কোনও মেয়ের বিয়ে হয়। সবাই এই কাপড়টাই পরে। বিয়ে মিটে গেলে আবার ফেরত দিয়ে দিতে হয়। শুধু কাপড় নয়, মাথার চেলি, বর কনের টোপর সব জমা পড়ে যায় ওয়ার্ডারদের রেজিস্টারে।
ছোটখাট নীলামণি অত ভারী শাড়ির মধ্যে যেন প্রায় হারিয়ে গেছে। মাথায় খোঁপা। তাতে আঁটা দুটো গোলাপফুল। আড়ষ্ট হয়ে সে বসে আছে একটা বেঞ্চিতে।
এই ব্রীড়াবনতা লজ্জাশীলা রূপ দেখলে কেউ বলবে, সে একজন খুনি? আদালতে রায় ঘোষণার পর দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দেখতে এসেছিল তাকে। যেন সে কোনও আশ্চর্য জীবই বটে। ‘মেয়েমানুষ’ নয় নির্ঘাত।
বটেই তো। মেয়েমানুষ হয়ে কেউ অমন কাজ করতে পারে? স্ত্রীজাতি হল ফুলের মতো কোমল। তাদের স্বভাব হবে নরম, লাজুক। সতীনের সঙ্গে মিলেমিশে সংসার করবে। বাচ্চাকাচ্চা সামলাবে। পতিসেবাই হবে তার পরম ধর্ম। পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিষ্ক্রিয়া।*
[* মনুসংহিতা – ২য়, ৬৭]
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অবশ্য সবই উলট পুরাণ। এখানে পুরুষ অনেক বেশি। মেয়ে খুব কম। ফলে মেয়েদের দাম অনেক। কোন মহিলা কয়েদি জেলযাপনের পাঁচ বছর পূর্ণ করলেই তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
নেহাত সাহেবদের নিয়ম নেই তাই, নাহলে এখানে দ্রৌপদী হয়ে পাঁচ স্বামী নিয়ে সংসার করতে চাইলেও পুরুষগুলো রাজি হয়ে যেত ঠিক।
নীলামণি মুখ টিপে সকলের অলক্ষ্যে হাসল। আজ তার মুক্তির দিন। তবে তার হাসির কারণ সেটা নয়।
মহিলা জেলের হেড জমাদার দীনবাঈ জোশী ত্রস্ত মুখে জেলের প্রবেশপথে দাঁড়িয়েছিল। এখুনি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর নতুন বরকে নিয়ে এসে পড়বেন। সব জোগাড়যন্ত্র সারা হয়ে গেছে। শুধু বিয়ের পুরুত এখনও এসে পৌঁছল না। কী করা যায়? মুনশি গোলাম রসুল যে বলল, ব্যবস্থা করছে? কই সে!
এখানে জাতপাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বিবাহ হল এখানে জেলখানার অসহনীয় অত্যাচার থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে নতুন সংসার পাতার লাইসেন্স মাত্র।
কিন্তু সেই বিয়েরও তো একজন পুরোহিত লাগবে।
রাগে দীনবাঈয়ের মেজাজ ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছিল। বাজখাঁই গলায় সে চিৎকার করল, ‘অ্যাই শবনম। শবনম! পানি লে আ!’
দীনবাঈ অতি ভীষণ মহিলা। তাকে দেখতে যেমন করালদর্শন যমদূতের মতো, তেমনই তার গলার আওয়াজ। এই ষাট-বাষট্টি বছর বয়সেও যখন একহাতে লাঠি অন্যহাতে লণ্ঠন নিয়ে ওয়ার্ডের এ’প্রান্ত থেকে হুংকার ছাড়ে, ও’প্রান্তের মেয়েরা ভয়ে কেঁপে ওঠে। সে নিজেও একসময় আন্দামান এসেছিল কয়েদি হয়ে। নিজের দুই সতীন আর সতীনদের দুই শিশুসন্তানকে একসঙ্গে বিষ খাইয়ে মেরেছিল দীনবাঈ। একসঙ্গে চারজনকে হত্যা করা দীনবাঈকে নিয়ে রাতারাতি গোটা দেশে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। নিম্ন আদালত তাকে ফাঁসির আদেশই শুনিয়েছিল, কিন্তু পরে বম্বে হাইকোর্টে সেই আদেশ বদলে যায় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে।
এখানে আসার পরেও নিজের মেজাজে নেতৃত্বের সহজাত ক্ষমতায় দীনবাঈ হয়ে উঠেছিল মহিলা প্রিজনারদের নেত্রী। তখন একেবারে গোড়ার দিক। তখনও তৈরি হয়নি সেলুলার জেল। আন্দামানের সাউথ পয়েন্টে ছোট ছোট তাঁবুতে খোলা আকাশের তলায় বন্দিদের থাকার ব্যবস্থা।
নারীদের নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। ভয়ংকর সব খুনি আসামি কিংবা একাকী এই দ্বীপান্তরে ডিউটিতে আসা ব্রিটিশ সিপাই, তাদের লোলুপ দৃষ্টি সারাক্ষণ গিলে খেত মেয়েদের। চারপাশে জঙ্গল। মাসে দু’মাসে এক-আধটা ধর্ষণ, অত্যাচারের ঘটনা ঘটতেই থাকত। কখনও ‘ঢালাও ফুর্তি’র জন্য কোনও কমবয়সি বন্দিনীকে নিয়ে দূরের কোনও দ্বীপে চলে যেত সিপাইরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে-সব মেয়েরা আর বেঁচে ফিরত না।
ওইসব অস্বস্তিকর কেসগুলো তড়িঘড়ি ধামাচাপা দেওয়া হত তখন। সরকারের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। কোনও খবর যেন সমুদ্র পেরোতে না পারে। দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দিনদিন শক্তিশালী হচ্ছিল। পুলিশ কুকুরের মতো ঘ্রাণ তাদের, খবর পেলে আর রক্ষা থাকত না।
জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ওয়াকার সাহেব অত্যন্ত নিষ্ঠুর হলেও নিজে ডাক্তার ছিলেন, মাঝেমধ্যে সেই অত্যাচারের বীভৎসতা দেখে তিনি নিজেও বিচলিত হয়ে পড়তেন। সিপাইদের ধমকধামক দিয়েও বিশেষ লাভ হত না। শেষমেশ জেলের অন্যান্য কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে তিনি ঠিক করেছিলেন, দীনবাঈয়ের মতো কিছু ডাকাবুকো পুরনো মহিলা কয়েদিকেই ওয়ার্ডার করে নেওয়া হবে। তারা অন্যান্য বন্দিনীদের অসুবিধা অভিযোগও বুঝতে পারবে, আবার পুরুষ সিপাইদেরও এদিক থেকে দূরত্বে রাখা যাবে বেশ।
তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ চল্লিশ বছর। আন্দামানের ভাইপার আইল্যান্ড, নেভি বে, ফিনিক্স, ডানডাস পয়েন্ট নামক বিভিন্ন দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই তাঁবুগুলো থেকে নিয়ে আসা হয়েছে বন্দিদের। তাদের দিয়ে ভাঙানো হয়েছে পাথর। বার্মা থেকে আনা তামাটে ইট দিয়ে তারা গড়ে তুলেছে সেলুলার জেলের দেওয়াল।
পোর্ট ব্লেয়ারের অ্যাবারডিনে আটলান্টা পয়েন্টে যতদিনে প্রকাণ্ড সেলুলার জেল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, ততদিনে দীনবাঈ নিজেও বোধ হয় ভুলে গেছে তার পূর্বজীবনকে। নিজের যোগ্যতায় ওয়ার্ডার থেকে টিন্ডেল, পেটি অফিসার হয়ে জমাদার পদে উন্নীত হয়েছে সে। পদমর্যাদা বেড়েছে। পেটে জমেছে চর্বি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তার তর্জন গর্জন আর হুঙ্কার।
দীনবাঈ গেটে দাঁড়িয়ে ক্রমশ বিরক্ত হচ্ছিল, শবনম জল নিয়ে আসতেই সে খরচোখে তাকাল, ‘তৈয়ার হুই ক্যা উয়ো লাড়কি?’
‘জ্বী। নেয়েচে। কাপড় পরে বসে আচে।’ শবনম ভয়ে ভয়ে বলল, ‘অনন্ত বামুন তো শুনলুম বিছানা থেকে উঠতে পারচে না। তবে কে বে’ দেবে গো?’
‘কেন, তুই?’ দীনবাঈ ক্রুর হাসে।
‘আমি!’
‘হ্যাঁ। অসুবিধা কী আচে। এখানে বামুনের মেয়ে দিব্যি মুদ্দোফরাশের গলায় মালা দিচেচ, আর মোছলমান মেয়েমানুষ বে দিতে পারবে না?’
শবনম নিরুত্তর থাকে। কিছু কিছু সময় দীনবাঈ এমন একেকটা কথা বলে, প্রত্যুত্তরের সাহস হয় না। কিছুক্ষণ পর সে বলে, ‘যদি অভয় দাও, একখান কতা কইব?’
‘রঙ্গ করিস কেন?’
‘বলচি, আজ যার বে, সেই মেয়েটা কেমনধারা, তাই না?’
‘কেন?’
‘না মানে …!’ শবনম কথা হাতড়ায়, ‘অন্য মেয়েদের সঙ্গে মেশে না তেমন।’
‘তাই নাকি?’ দীনবাঈ তীক্ষ্ণচোখে শবনমের দিকে তাকিয়ে দাবড়াই দেয়, ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এখুনি এসে পড়বেন, রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। আর তুই কিনা কোঁদলি করতে বসলি? যা শীগগির। সব সাফসুতরো আছে কিনা দ্যাখ। আমি যদি কোথাও একটুও গোলমাল দেখি…।’
শবনম আর এক দণ্ড দাঁড়ায় না। একরকম রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে যায় ভেতরে।
দীনবাঈ আবার বাইরে চোখ রাখে। দূরে পুরুষ জেল দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে টহল দিচ্ছে সেপাইরা। সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস এসে ঝাপটা মারে তার রুক্ষ মুখে। মুখে সে শবনমকে যতই ধমকাক, তার নিজের মনেও এমন ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দীনবাঈয়ের মনে পড়ে যায় কয়েক সপ্তাহ আগের সেই দিনটা। প্রতি মাসেই দু’একটা করে মহিলা কয়েদিকে বিয়ের জন্য সম্মত করানোটা ওর একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রেজিস্টার খুলে দেখতে হয়, কার কার পাঁচ বছর জেলযাপন পূর্ণ হল, তারপর তাদের সবার কাছ থেকে টিপসই নিয়ে সেই রিপোর্ট পেশ করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।
হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে ও সেদিন গিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা কুঠুরির সামনে। সঙ্গে ছিল ওয়ার্ডার হরিমতী। ফিসফিসিয়ে সে বলেছিল, ‘এই যে, এই মেয়েটারও গেলমাসে পাঁচ বচ্ছর পুরেচে।’
‘নাম কী?’
‘নীলামণি।’
নীলামণি ব্যস্ত ছিল তার সেলাই নিয়ে। সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল চট। সুচ। সুতো। প্রতিদিন খানকুড়ি করে বস্তা বুনতে হয়। তারপর সেই বস্তা চলে যায় জেলের তহবিলে। বিনিময়ে কয়েদির নামে জমা হয় কিছু ভাতা।
দীনবাঈ স্বভাবসিদ্ধ বাজখাঁই গলায় হাঁক পেড়েছিল, ‘অ্যাই মেয়ে! তোর পাঁচ সাল হয়ে গেছে। রেকর্ডও ভাল আছে। শাদি করনে কা ওয়াক্ত আ গয়া!’
নীলামণি মুখ তুলে তাকিয়েছিল। গরমে গালে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রয়েছে। চুলের বেণী আলুথালু ভাবে এলিয়ে রয়েছে পিঠে। বুঝি খানিক বিরক্তই হয়েছে কাজে ব্যাঘাত পেয়ে। কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে আবার মুখ নামিয়ে মন দিয়েছিল কাজে।
কোনও উত্তর না পেয়ে হরিমতী তড়িঘড়ি গর্জন করেছিল, ‘কী হল? জমাদার জিজ্ঞেস করছে, সাড়া দিচ্চিস না কেন?’
মেয়েটা কাজ করতে করতে মৃদু প্রতিবাদ করেছিল, ‘এখানে আমি এসেচি, বছরও তো ঘোরেনি!’
‘তুই কি আমাদের হিসেব শেকাবি নাকি?’ হরিমতী খেঁকিয়ে উঠেছিল, ‘দেশে তো জেলের মধ্যে চারবছর ছিলি? সবশুদ্ধ পাঁচ সাল হলেই শাদি করা যায়। করবি তো?’
‘না।’ দ্রুত মাথা নেড়েছিল নীলা।
দীনবাঈ অনেকখানি ভ্রু তুলে হরিমতীর দিকে তাকিয়েছিল, ‘বেওকুফ হ্যায় ক্যা?’
বেওকুফই বটে। মেয়েমানুষদের এই জেলখানা থেকে বেরনোর এটাই তো একমাত্র মওকা। এই সুযোগ কেউ প্রত্যাখ্যান করে?
নীলামণি তখনও কোনও সাড়াশব্দ দেয়নি। কিন্তু দীনবাঈ ছাড়ার পাত্রী ছিল না। তার ওপর স্পষ্ট আদেশ রয়েছে, পাঁচ বছর পূর্ণ হলেই মহিলা কয়েদিদের বিয়ের জন্য যেভাবে হোক রাজি করাতেই হবে। সেলুলার জেলে রাজনৈতিক বিপ্লবীদের পাশাপাশি রয়েছে ভয়ংকর সব দাগি আসামি। তাদের মধ্যে মারপিট, খুনজখম লেগেই থাকে। আর এইসব গন্ডগোলের অন্যতম কারণ হল সমকামিতা। মহিলাবর্জিত হয়ে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে নিজের সমকামী সঙ্গী খুঁজতে এদের মধ্যে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। প্রায়ই কোনও কিশোর শিকার হয় সেই লালসার। এদের সংশোধনের জন্য সর্বোত্তম উপায় হল সংসারী করে দেওয়া। সেইজন্যই তো এত কাণ্ড করে মেয়েদের এখানে আনা।
দীনবাঈ অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। সাতাশ নম্বর সেলের এই মেয়েটা যে একটু অন্যরকম, সেই রিপোর্ট তার কাছে ফিমেল ওয়ার্ডাররা আগেই দিয়েছিল। অন্য মেয়েদের মতো সবসময় হাহা হিহি করে না, চটুল রঙ্গরসিকতায় মজে না, বেঁকেচুরে কথা বলে না। সারাদিন হয় সেলাই করে, নয়তো বসে বসে কী ভাবে।
দীনবাঈয়ের কাছ থেকে শুনে অবাক হয়েছিলেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব।
‘ভাবে! ভাবে মানে?’
‘হ্যাঁ সাব। চুপচাপ ঠায় বসে থাকে। নড়ে চড়ে না।’
‘কাঁদে হয়তো!’
‘না সাব! চোখে কোনও দুঃখ থাকে না। কী চিন্তা করে বসে বসে। মাটিতে দাগও কাটে।’
সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেব তো বটেই, দীনবাঈও সেদিন চিন্তান্বিত হয়েছিল। মেয়েমানুষ ভাবছে, এ যেন সোনার পাথরবাটি। চিন্তাভাবনার জন্য যে মস্তিষ্ক প্রয়োজন, তা আবার এখানকার মেয়েদের হল কবে থেকে? পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে না তো? দিনের পর দিন ওইটুকু সেলে থাকতে থাকতে এখানে উন্মাদ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু না। তার পরে কয়েকদিন টানা মেয়েটার সেলের সামনে গিয়ে সে বুঝেছিল, মেয়েটা মোটেই পাগল নয়। তবে কিনা ঠিক স্বাভাবিকও নয়। সেলুলার জেলের পোষা কুকুরগুলোও জানে, পুরুষ কয়েদিরা দশ বছর ভালভাবে জেল খাটলে তাদের ‘ফ্রি টিকিট’ দেওয়া হয়, তারা নতুন জীবন শুরু করে স্বাবলম্বন গ্রামে গিয়ে। কিন্তু মেয়ে কয়েদিদের তো বিবাহ ছাড়া কোনও উপায় নেই জেল থেকে বেরনোর। তাই তো পাঁচবছর মিটলেই তারা উদগ্রীব হয়ে পড়ে।
এই চার দেওয়াল থেকে মুক্তি পাওয়া, নিত্যদিনের অমানুষিক পরিশ্রম, অপমান গ্লানি থেকে রেহাই পেতে নতুন জীবনসঙ্গীর সঙ্গে নতুন জায়গায় একচিলতে সংসার পাতার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বড় এই মহিলাদের জীবনে আর কী হতে পারে?
কিন্তু নীলামণি কিছুতেই সম্মত হয়নি।
ব্যাপারটা কী? মেয়েটা কি শাদিশুদা? হলেই বা কী! কত বিবাহিত মেয়েই তো এখানে এসে আবার নতুন সংসার পাতে। অন্য উপায়ও তো নেই কিছু। এখানকার সিংহভাগ মহিলা কয়েদিই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে এসেছে। যাদের মেয়াদ দশ বছর, তারাও ভাল করে জানে, এতবছর এই কালাপানির জেলে থেকে দেশে ফিরলে পরিবারের কেউ তাদের ফিরিয়ে নেবে না। নিজের লোকেদের কাছে সে দীর্ঘদিন আগেই মৃত।
তবে? তবে এই আঠারো-উনিশ বছরের পূর্ণযুবতীর সংসারের প্রতি অকালবৈরাগ্যের কারণ কী?
দীনবাঈয়ের কৌতূহল ক্রমশই বাড়ছিল। সে নিজে নিরক্ষর। এক পুরুষ টিন্ডেলকে ডেকে এনে সেরেস্তাখানায় নিয়ে গিয়ে খুলেছিল মেয়েটার ফাইল। টিন্ডেল লোকটি গোটা গোটা উচ্চারণে পড়েছিল।
‘নাম, নীলামণি চক্রবর্তী
পিতা/স্বামীর নাম, জনার্দন চক্রবর্তী
বয়স : ১৭ বৎসর ৩ মাস ১৮ দিন (সেলুলার জেলে পদার্পণের সময়কালে)
নিবাস: কলকাতা।
অপরাধ: শিশুহত্যা।’
মধ্যবয়স্ক টিন্ডেলটির মুখ কুঁচকে গিয়েছিল, ‘এহ, বাচ্চা খুন করেছিল।’
‘তো এ আর নতুন কথা কী!’ দীনবাঈ হাত উল্টে বলেছিল। তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে জানে, এখানকার মহিলা কয়েদি মানেই নয় স্বামীহন্তারক অথবা শিশুহত্যার মতো অপরাধের আসামি। ও বলেছিল, ‘বাপের নাম রয়েছে না সোয়ামির নাম?’
টিন্ডেল কর্মীটি আবারও ফাইলের দিকে চোখ ফিরিয়েছিল, ‘দুটোই। কোনটা বোঝা যাচ্ছে না।’
‘হুঁহ! কাজের ছিরি দ্যাখো। শায়েদ আইবুড়ো বেলায় পেট হয়ে গেছিল, সেই পাপকে জন্মের পর মেরেছে।’ দীনবাঈ নাক কুঁচকেছিল, ‘বেশরম গন্দি আউরত!’
সে দীনবাঈ যতই গালমন্দ করুক, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চাপ দিয়েই যাচ্ছিলেন। যেভাবেই হোক, এই মাসের কোটায় নীলামণিকে বিবাহে রাজি করাতেই হবে।
দীনবাঈ এমন সমস্যায় কখনও পড়েনি। অবাধ্য বন্দিনীকে শায়েস্তা করা তার কাছে বাঁয়ে হাত কা খেল। অনেক মেয়েই এখানে আসার পর প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। নারকেল কুরনো। নারকেল আর সিসলের আঁশ দিয়ে মাদুর পাপোশ বানানো। সর্ষে বীজ ঝাড়াই বাছাই করা। বস্তা বোনা। মহিলা জেলের করিডরগুলো সাফসুতরো করা। যার যা ডিউটি পড়ে প্রতি সপ্তাহে। সেইসব কাজের কোনওটাই হালকা নয়।
এত ধরনের পরিশ্রম, দিনের পর দিন অসূর্যম্পশ্যা হয়ে থাকতে থাকতে কেউ কেউ সেলের অন্ধকারে বসে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে থাকে। কেউ চিৎকার করে কাঁদে। কেউ দেওয়ালে মাথা ঠোকে। কেউ অন্য বন্দিনীর সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে চুলোচুলি শুরু করে। তাদের কী করে বাগে আনতে হয়, দীনবাঈ ওয়ার্ডারের তা ভালভাবে জানা আছে।
না। খুব বাড়াবাড়ি না করলে মারধর সে পছন্দ করে না। সে বিশ্বাস করে ‘পেটে মারা’য়। বেগরবাঁই করলেই খাওয়া বন্ধ করে দেয়। আন্দামানে পা দিয়ে যে কঞ্জি আর লপসি খেয়ে কয়েদিরা প্রথমদিকে বমি করে ফেলে, সেই খাবারই যখন বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন তারা এসে পায়ে পড়ে। দুদিন-তিনদিনের মধ্যে সেই আকুলিবিকুলি কাকুতিমিনতি পরিণত হয়ে পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটিতে। তারপর সেই কঞ্জি, সেই লপসিই খায় অমৃতের মতো।
কিন্তু এই নীলামণি নামের মেয়েটাকে কোনও কিছু করেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। মেয়েটা কারুর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে না, মেয়েলি চুলোচুলি, ঝগড়াঝাঁটিতে জড়ায় না, যা খাবার দেওয়া হয়, বিনাবাক্যবয়ে সোনামুখ করে খেয়ে নেয়, এমনকি কাজেও প্রতিদিনের ‘কোটা’ পূরণ করে ফেলে।
যার কোনও কিছুতেই গাফিলতি নেই, তাকে দীনবাঈ কী করে কবজা করবে? শুধুমাত্র বিয়ে করতে চায় না বলে তো কাউকে ‘পানিশমেন্ট’ দেওয়া যায় না।
চিন্তায় চিন্তায় দীনবাঈ জেরবার, এমনসময় গণপতি বাপ্পা মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন। একদিন হরিমতী এসে জানিয়েছিল, ‘ওই সাতাশ নম্বরের মেয়েটা নিজে থেকেই বে করতে চাইচে গো! ‘সম্বুর’ এ রাজি হয়েচে।’
নীলামণি স্বয়ংবরে সম্মত হয়েছে? এ যে মেঘ না চাইতেই জল! পুলকিত দীনবাঈ দেরি না করে দ্রুত এত্তেলা পাঠিয়েছিল জেলার সাহেবের কাছে।
তারপর ঝড়ের গতিতে এগিয়েছে বিয়ের প্রস্তুতি। আয়োজন করা হয়েছে নীলার ‘স্বয়ংবর’ এর। এখানে বিবাহ মানেই ‘স্বয়ংবর’।
জেলের বন্দিরা আড়ালে যতই হাসাহাসি করুক, ‘স্বয়ংবর’ ছাড়া আর কী? দীনবাঈ নিরক্ষর হতে পারে, দজ্জাল হতে পারে, কিন্তু তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয়। ভারতের পশ্চিম উপকূলে ওদের গ্রামের সবাই ছিল জেলে, কিন্তু গণপতি উৎসবের শেষদিনে গাঁয়ের মোড়ল যে নাটকের আয়োজন করত, তার প্রতিবছরের পালা ওর মনে আছে। রামলীলা, কীচক বধ, দ্রৌপদী আরও কত কী!
সেখানে দেখা রাজারাজড়াদের স্বয়ংবরের সঙ্গে এখানকার খুব বেশি তফাত নেই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন