৮. বিভীষিকাময় ১০ অক্টোবর

দীনেশচন্দ্র সিংহ

অষ্টম অধ্যায় – বিভীষিকাময় ১০ অক্টোবর : হত্যা-লুন্ঠন-ধর্ষণ-ধর্মান্তর : নোয়াখালির দাঙ্গা

১৯৩৭ সালে বাংলায় মুসলিম লীগ শাসন কায়েম হতেই নোয়াখালি জেলায় স্থানে স্থানে হিন্দুদের উপর একশ্রেণীর মুসলমান নির্যাতন শুরু করে। ঐ নির্বাচনে গোলাম সরওয়ার নামে এক লীগ সদস্যের উস্কানিমূলক বক্তৃতাই এসব সাম্প্রদায়িক অশান্তির মূল। সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুসলিম লীগের সদস্য হবার দরুন তার সকল অপকর্মেই সরকার চোখ বুজে থাকে। সে সময় হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ ছাড়া অন্য কোনও দলই হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কোনও প্রতিবাদ করেনি। সমকালীন পত্রপত্রিকায় এসব হিন্দু নির্যাতনের কাহিনী কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছিল।

নোয়াখালি দাঙ্গার আগেও পূর্ববঙ্গে বিচ্ছিন্ন ভাবে হিন্দুদের উপর আক্রমণ

কবিগুরুর মর্মবেদনা : মুসলমান নেতাদের কাছে ব্যর্থ আবেদন

অবশ্য ১৯৪৬-এর ১৫/২০ বছর আগে থাকতেই পূর্ব ও উত্তর-বঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দুরা গুণ্ডাশ্রেণীর মুসলমানদের হাতে কারণে অকারণে নির্যাতিত হচ্ছিল। কোন কোনও স্থানে এই নির্যাতন ও অত্যাচার এমন বীভৎস আকারে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল যে স্বয়ং কবিগুরু পর্যন্ত ধৈর্যহারা হয়েছিলেন এবং হিন্দুদের অসহায়ভাবে মার খেতে দেখে ধিক্কার দিয়েছেন; কখনো বা প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়েছেন। সমকালীন সংবাদপত্রে রবীন্দ্রনাথের ক্ষোভ ও বেদনা যেভাবে ব্যক্ত হয়েছিল, তার কিছু নমুনা দেওয়া গেল।

“৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১/ ২১ ভাদ্র ১৩৩৮

বাঙ্গলায় নৃশংসতার তাণ্ডব
ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অশ্রদ্ধার কারণ

পাপ দূরীকরণে মুসলমান সম্প্রদায়কে আহ্বান – রবীন্দ্রনাথের আবেদন

বাঙ্গলার বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি যে নৃশংস অত্যাচার-উৎপীড়ন অনুষ্ঠিত হইতেছে, ঐ সম্বন্ধে কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিম্নোক্ত মর্মে এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়াছেন :

বাঙ্গলার বিভিন্ন স্থানে পর পর যে সকল নৃশংস অত্যাচার-উৎপীড়ন অনুষ্ঠিত হইতেছে, উহা কেবল যে, আমাদিগকে দুঃখিতই করিয়াছে তাহা নহে, অসহনীয় লজ্জার বোঝাও আমাদের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছে। ইহা অতীব দুঃখের বিষয় যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা ছিল এই সকল অত্যাচার-উৎপীড়নে তাহা ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। বার বার অনায়াসে গ্রামের পর গ্রামে শহরের পর শহরে এই সকল নৃশংসতার অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ সরকারের নৈতিক মর্যাদা অতিমাত্রায় আহত হইয়াছে।

কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যেরই কোন দল বিশেষকে যখন আমরা আমাদেরই মধ্যে বিদ্বেষের আগুন উস্কাইয়া তুলিতে ও আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে চিরদিনের মত কলঙ্কিত করিতে দেখি, তখন লজ্জায় সঙ্কোচে আমরা নির্বাক হইয়া পড়ি। এতৎ সম্পর্কে আমি সমবেত চেষ্টা দ্বারা নিজদিগকে রক্ষা করিবার কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে, বলিতে ইহাই বুঝাইতে চাই যে একটি কার্যতৎপর নীতিসঙ্ঘ গঠন করিয়া আমাদের দেশের সকল সম্প্রদায়ের জনসাধারণকে রক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। উত্তেজনা-অন্ধ আত্মঘাতী দল এই সকল নৃশংস অত্যাচার-উৎপীড়ন দ্বারা আমাদের দেশের সকল সম্প্রদায়েরই অত্যাচারী ও অত্যাচারিত সকলেরই সর্বনাশ সাধন করিয়া থাকে, শান্তি ও সভ্যতার ভিত্তিমূল বিধ্বস্ত করিয়া থাকে।

বহু দূরে অবস্থিত এক দ্বীপের অধিবাসীর পক্ষে চিরকালের জন্য ভারতের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত রাখা সম্ভবপর হইবে না, ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা ভারতীয় হিন্দুমুসলমান একই দেশমাতৃকার সন্তান। চিরকাল পাশাপাশি বাস করিয়া এই সম্মিলিত রাজতন্ত্র গড়িয়া তুলিব, জয়-পরাজয়ের সমান অংশ সমভাবে বাঁটিয়া লইব। এই নিদারুণ সঙ্কট মুহূর্তে আমাদের পরস্পর পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিলে চলিবে না। সমস্ত সাধু-মুসলমানগণকে তাঁহাদের মহান ধর্মের নামে, তাঁহাদের কৃষ্টি ও সভ্যতার নামে ও বিপন্ন মানব-সমাজের নামে আমি আমাদের সহিত সহযোগিতা করিয়া, যে পাপ ক্রমে বৃদ্ধি পাইয়া আমাদিগের উন্নতির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থতায় ডুবাইয়া দিয়া সমস্ত জগতের চক্ষে আমাদিগকে হীন ও উপহাসাস্পদ করিয়া ফেলিবে বলিয়া আশঙ্কা করা যাইতেছে, উহার উচ্ছেদ সাধনে যত্নবান হইতে অনুরোধ করিতেছি।

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩১/ ২৯ ভাদ্র ১৩৩৮

চট্টগ্রামের অনাচারে কবির দুঃখ – শ্রীযুত সেনগুপ্তের নিকট তার

গত ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চট্টগ্রামে শ্ৰীযুত যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের নিকটে নিম্নমর্মে তার প্রেরণ করিয়াছিলেন :

আমি বুঝিতেছি যে, অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। দেশের ভবিষ্যৎ দুর্দিন ও অকথ্য অনাচারের কথা চিন্তা করিয়া আমার মনে দারুণ কষ্ট হয়। আমি সব সময়েই এ সম্পর্কে চিন্তা করিতেছি। আমার বর্তমান স্বাস্থ্য লইয়া আপনার প্রস্তাব মত কোন সভায় যোগদান করা অসম্ভব।

১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১/৩০ ভাদ্র ১৩৩৮

চট্টগ্রামের বিপন্ন হিন্দু – রবীন্দ্রনাথের সহানুভূতি

চট্টগ্রামে সম্প্রতি হিন্দুদিগের প্রতি যে অমানুষিক অত্যাচার হইয়াছে, উক্ত ঘটনায় কবি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিচলিত হইয়াছেন। তিনি চট্টগ্রামের উৎপীড়িত অধিবাসীদিগের সাহায্য কল্পে অগ্রসর হইয়াছেন। ফ্রী প্রেস সানন্দে জানাইতেছেন যে, কবি রবীন্দ্রনাথ গত সোমবারের গীত উৎসবের উদ্বৃত্ত টাকা হইতে উক্ত উৎপীড়িতদের সাহায্যার্থে ১০০০ টাকা দিবেন এরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন।”—ফ্রী প্রেস।

সমগ্র পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের অসহায়ভাবে মুসলমানদের হাতে নিপীড়িত হওয়ার এক করুণ চিত্র বর্ণিত হয়েছে তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায়—

১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩১/১ আশ্বিন ১৩৩৮

উপদ্রুত-হিন্দু

চট্টগ্রামের উপদ্রুত হিন্দুদের সাহায্যের জন্য কবি রবীন্দ্রনাথ অভিনয়লব্ধ অর্থ হইতে সহস্ৰ মুদ্রা দান করিবার সঙ্কল্প করিয়াছেন। সংখ্যাল্প ও নানাভাবে দুর্বল হিন্দুর উপর এই অকথ্য পীড়নের সংবাদে কবির হৃদয় ব্যথিত হইয়াছে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভাও সমগ্র হিন্দুসমাজকে চট্টগ্রামের হিন্দুদিগকে সাহায্য করিবার জন্য আহ্বান করিয়াছেন এবং অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা দেখিতেছেন। আমরা কিছুদিন পূর্বে বঙ্গীয় সঙ্কটত্রাণ সমিতিকে এই দুর্বিষহ সঙ্কটে অবিলম্বে সাহায্য প্রেরণ করিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম, কিন্তু তাঁহারা এ পর্যন্ত সে বিষয়ে নীরব রহিয়াছেন।

পাবনা, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে কয়েক বৎসরের লুঠতরাজ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হইতে ইহা স্পষ্টই বোঝা যাইতেছে যে, উত্তর ও পূর্ববঙ্গের সংখ্যাল্প শতধাবিচ্ছিন্ন হিন্দুরা আত্মরক্ষায় অক্ষম। ধর্মের ধুয়া ছলনা মাত্ৰ-রাজনৈতিক কারণই মুখ্য। রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা আজ রাষ্ট্রনীতিতে প্রবল হইয়া যে ভেদবাদের সৃষ্টি করিয়াছে, যেভাবে বিদ্বেষ মর্মান্তিক করিয়া তুলিতেছে, এ সকল তাহারই অভিব্যক্তি। ইহার জন্য শাসকবর্গকে দোষ দিবার চেষ্টা নিষ্ফল। পরাধীন জাতির কোন অংশ যদি ভ্রান্ত স্বার্থবুদ্ধিতে পরিচালিত হইয়া এইরূপ নিষ্ঠুর আত্মঘাতী নীতি অবলম্বন করে, তাহা এক কূট চাতুরী হিসাবে গ্রহণ করা রাজনীতিতে একান্ত দুর্নীতি নহে। এজন্য শাসকবৃন্দকে দায়ী করিয়া অথবা লজ্জা দিয়া কোন ফল লাভ হইবে না! বিলাপ করিলে, ন্যায়ধর্মের দোহাই পাড়িলে, ‘তৃতীয় পক্ষ’ কিম্বা “মস্তিষ্কে”র চিত্তে করুণা বা অনুতাপের উদয় হইবে, ইহা আকাশকুসুম প্রত্যাশার মতই অলীক। আজ স্পষ্টভাবে স্বীকার করিতে হইবে, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের মধ্যে পাপ আছে— এবং তাহা আছে বলিয়াই এককে অপরের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা সহজ! এই পাপ যতদিন দূর না হইবে, ততদিন এই শ্রেণীর উৎপাত ও লাঞ্ছনার জন্য দেশকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে!

কি কৌশলে, কি উপায়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রশমিত হইতে পারে, এবং এই শ্রেণীর পৈশাচিক অত্যাচার নিবারিত হইতে পারে, তাহা লইয়া দেশের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক চিন্তা করিতেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার কোন মীমাংসা হইল না। শীঘ্র যে হইবে, সে ভরসাও অল্প।

পূর্ববঙ্গের অবস্থাই অতি শোচনীয়। পাবনা হইতে চট্টগ্রাম কোথাও হিন্দু আত্মরক্ষা করিতে পারে নাই। কেবল তাহাই নহে—এই সকল উপদ্রব ক্রমে অধিকতর পৈশাচিক ও নিষ্ঠুর হইয়া উঠিতেছে এবং আশ্চর্য ও ক্ষোভের বিষয় এই যে, দুষ্কৃতকারীদের দমন ও শাসন সম্পর্কেও কি কর্তৃপক্ষ ও কি স্থানীয় জননায়কগণ দুইপক্ষই উদাসীন।

সর্বত্রই দেখা যায়, বিশেষভাবে চট্টগ্রামের পর আরও স্পষ্টভাবেই দেখা যাইতেছে, লুণ্ঠিত সম্পত্তি উদ্ধার অথবা হরণকারীদের অভিযুক্ত করা সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য নাই। আমাদের নেতৃস্থানীয় যাঁহারা, তাঁহারা মনে করিতেছেন, পীড়িত হিন্দুদের পক্ষে পীড়া গোপন করাই আজিকার দিনে বুদ্ধিমানের কার্য। অপর দিকে অনেক সমদর্শী মুসলমান নেতা দাঙ্গা ও লুণ্ঠনের নিন্দা করিতেছেন। কিন্তু তথাপি এই সকল ঘটনার পুনরভিনয় হইতেছে।

যাহারা লুণ্ঠন করিয়াছে এবং করিতেছে তাহারা ক্রমে দেখিতেছে, ইহা বেশ লাভজনক ব্যবসায়। ঢাকায়, কিশোরগঞ্জে অতি অল্প লোকই শাস্তি পাইয়াছে, লুণ্ঠিত দ্রব্যের অতি সামান্য অংশেরও পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় নাই। এমতাবস্থায় পূর্ববঙ্গের শহরগুলি এবং সমৃদ্ধ হিন্দু গ্রামগুলি লুণ্ঠন করিবার প্রলোভন হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষত এমন ধারণাও যখন অপ্রতুল নাই যে, শাসকগণ এরূপক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক স্নেহ প্রদর্শন করিতে কার্পণ্য করিবেন না।

ঘটনা-পরম্পরার তিক্তস্মৃতি হইতে আমরা বারম্বার বলিয়াছি, —আজ হিন্দু সমাজকে উপদ্রুত হিন্দুদের রক্ষার উপায় বিধান করিতে হইবে। সমগ্রের সাহায্য ও সহানুভূতি ব্যতীত হিন্দু আত্মরক্ষা করিতে পারিবে না। আমরা সকলের প্রতি দয়াহীন আত্মপরায়ণ, সামাজিক কর্তব্যবোধহীন এবং বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকিব—আর আমাদিগকে রক্ষা করিবে পুলিশ, এমন ভ্রান্তধারণা পোষণ করার মত মূঢ়তা আর নাই! সংখ্যাল্প বলিয়া নহে, এই মূঢ়তাই হিন্দুকে আজ বিপন্ন করিয়া রাখিয়াছে। বিশেষত বাঙ্গালী হিন্দুর শিক্ষা ও চরিত্রগত এক অতি নিন্দনীয় ত্রুটি,—তাহাকে উদারতার নামে মনে ও মুখে এমন ভণ্ড করিয়া তুলিয়াছে যে, সে নানা বড় বড় কথার আবরণে, উপস্থিত বিপদের দায়িত্ব এড়াইয়া ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ হইতে চাহে এবং সমষ্টির বেদনা ভুলিতে চেষ্টা করে।

বাঙ্গালী হিন্দুসমাজ কত ভীত, আর্ত ও জীবস্মৃত চট্টগ্রামই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাহার সর্বনাশের কথা, সবখানি কথা সে মুখ ফুটিয়া বলিতেও পারে না! রাজদ্বারে অভিযোগ করিবার কথা স্মরণ করিতেও সে অধিকতর বিপদের ভয়ে শিহরিয়া উঠে! মুখে অস্বীকার করিলেও, সে জানে এমনি কীটতুল্য দয়ার পাত্র হইয়া কোন জাতি, কোন সম্প্রদায় পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিবার দাবি করিতে পারে না! মাটি আঁকড়িয়া মুখ বুজিয়া পড়িয়া থাকিলেও, মরিতেই হয়। পূর্ববঙ্গের ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুসমাজ যে ধীরে ধীরে মরিতেছে তাহা তাহারাও বুঝিতে চাহে না—বাহিরের বিশাল হিন্দুসমাজও ভাবিতে চাহে না। এই শোচনীয় আত্মবিস্মৃতি হিন্দু-সমাজকে সর্বত্রই করুণার পাত্র করিয়া তুলিয়াছে!

এই আত্মবিস্মৃতির মোহ হইতে হিন্দুকে সচেতন করিয়া তুলিবার জন্যই হিন্দু-সংগঠন আন্দোলন। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সামাজিক আবর্জনা ও ভেদনীতি পরিহার সম্পর্কে সমগ্র সমাজকে অবহিত করিয়া তুলিবার জন্য হিন্দু মহাসভার আন্দোলন এখনও বাঙ্গালী হিন্দু তেমনভাবে গ্রহণ করে নাই। এবং তাহা করে নাই বলিয়াই আজ চট্টগ্রামের সাহায্য প্রত্যাশী উপদ্রুত হিন্দু সমগ্র সমাজের নিকট বিশেষ সাহায্য ও সহানুভূতি পাইতেছে না। কেবল পরের দোষের প্রতি অহোরাত্র সচেতন থাকিয়া সমালোচনা করাই হিন্দুকে রক্ষা করার পথ নহে, ইহা অতি-বুদ্ধিমান বাঙ্গালী হিন্দু প্রধানগণ যত শীঘ্র বুঝিতে পারেন, দেশের পক্ষে ততই কল্যাণ। (আনন্দবাজার পত্রিকা)

মুসলমানদের বাঙ্গালীয়ানা লোপ

তখনও বাংলার মুসলমানদের আচার-আচরণে পুরো ইসলামীয়ানার প্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড এ ওয়ার্ড বা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাঁদের ফলে বাংলার রাজনীতি মুসলমানদের করতলগত হবার পরেই তাদের মধ্যে উৎকট ইসলামীয়ানার প্রভাব পড়তে দেখা যায়। গান্ধীভক্ত সাহিত্যিকের কলমে তার চিত্র পাওয়া যায় :

“সাম্প্রদায়িক রোয়েদাঁদের চার বছরের ভিতরেই মুসলিম মানসে একটা ভাব বিপ্লব ঘটে যায়। হিন্দুয়ানীর কোনো ধারই তারা ধারবে না। সেটা যদি হয় বাঙালীয়ানা তা হলেও না। উচ্চপদস্থ নিম্নপদস্থ সব স্তরের মুসলমানকে আমি ধুতি পরতে দেখেছিলুম। নামও অনেকের হিন্দু নাম। কিন্তু ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যেন মুসলিম আমলের পুনরারম্ভ (অন্নদাশঙ্কর রায় –যুক্তবঙ্গের স্মৃতি)

.এই শাসকসুলভ মানসিকতার প্রথম অভিব্যক্তি ঘটে ক্ষমতাসীন হবার দু’বছরের মধ্যে হতভাগ্য নোয়াখালির হিন্দুদের উপর।

নোয়াখালিতে হিন্দুদের অবস্থা

১৯৪৬-এর দাঙ্গার আগে

“আমরা সম্প্রতি নোয়াখালির একজন প্রতিষ্ঠাবান্ কংগ্রেস-কর্মীর নিকট হইতে নোয়াখালির হিন্দুদের অবস্থা সম্বন্ধে ইংরেজীতে লিখিত একটি বিবৃতি, তথাকার একজন ব্যবস্থাপক সভার মুসলমান সদস্যের হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ-উত্তেজক ও ভয়প্রদর্শক একাধিক বক্তৃতার রিপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র পাইয়াছি। লেখক স্বয়ং আমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া অনেক কথা জানাইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, তিনি কলিকাতার প্রধান প্রধান কাগজের সম্পাদকদিগকে এবং কোন কংগ্রেস-নেতাকে এই সকল কাগজপত্র দিয়াছেন। বিষয়টি মহাত্মা গান্ধীরও গোচর করিয়াছেন। যদি সমুদয় কাগজ গান্ধীজী দেখেন, তাহা হইলে তিনি কি বলেন ও করিবেন, জানিতে ইচ্ছা হয়।

ব্যবস্থাপক সভার জনৈক মুসলমান সদস্যের বক্তৃতার যে নমুনা দেওয়া হইয়াছে, তাহা প্রবাসীতে ছাপিবার যোগ্য নহে। এরূপ বক্তৃতার কথা জেলার ও ডিবিজনের কর্তৃপক্ষ অবগত থাকা সত্ত্বেও সে ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ হইতে কোন মকদ্দমা বা অন্য ব্যবস্থা হয় নাই, আমাদিগকে প্রদত্ত কাগজগুলিতে ইহা লিখিত আছে। তাহাতে নানাবিধ ভয় প্রদর্শনের ও তদনুরূপ অত্যাচারের বর্ণনাও আছে। ব্যবস্থাপক সভার উল্লিখিত মুসলমান সদস্য প্রকাশ্য বক্তৃতায় ইহা বলিয়াছে বলিয়া কাগজগুলিতে দেখিলাম যে, তাহার প্রভাবে নোয়াখালির একজন হিন্দু জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটকে বদলী হইয়া রাইটার্স বিল্ডিঙে কেরানী (অর্থাৎ সেক্রেটরী) হইতে হইয়াছে! ইহা কি সত্য? এই সমুদয়ের সত্যাসত্য নির্ধারণের নিমিত্ত প্রকাশ্য তদন্তের জন্য কমিশন নিযুক্ত হওয়া একান্ত আবশ্যক।

দৈনিক কাগজে দেখিলাম, ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমুখ হিন্দু নেতাদের কুমিল্লা সফর কালে তথায় যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে— যাহার মধ্যে কতিপয় মুসলমান ছাত্রও জড়িত আছে, ঐ সম্পর্কে তদন্তের জন্য বাঙ্গলার প্রধান মন্ত্রী মিঃ ফজলুল হক ২রা অক্টোবর রাত্রিতে কুমিল্লা রওনা হইয়া গিয়াছেন।

এ. পি.) ইহা সত্য হইলে, বঙ্গের প্রধান মন্ত্রী কিসের তদন্ত করিতে গিয়াছেন? হিন্দু নেতাদের একজন সঙ্গী যে আহত হইয়াছিলেন, সেই বিষয়ের? না, শান্তিভঙ্গকারী মুসলমান জনতাকে যে পুলিস তাড়া করিয়াছিল, তাহার? নোয়াখালির সব ব্যাপার কুমিল্লার ঘটনাটার চেয়ে সহস্রগুণ অধিক সঙ্গীন ও গুরুতর; অতএব তাহার তদন্ত অবিলম্বে হওয়া আবশ্যক। অন্যান্য মন্ত্রীরাও এই বিষয়টিতে মনোযোগ করিলে ভাল হয়।

অবশ্য কুমিল্লার ঘটনাটার জন্য দোষী ব্যক্তিদের সম্বন্ধেও সমুচিত ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক।

(প্রবাসী—কার্তিক ১৩৪৬)

নোয়াখালির অবস্থা

নোয়াখালির হিন্দুদের নানা অভিযোগের কথা খবরের কাগজে প্রকাশ পাইয়াছে। তৎসমুদয়ের যথাযোগ্য অনুসন্ধান এবং, প্রমাণিত হইলে, প্রতিকারের চেষ্টা অপেক্ষা ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও প্রধান মন্ত্রী সেগুলা উড়াইয়া দিতে চাহিতেছেন মনে হইতেছে।

নোয়াখালি মহকুমার মুসলমান হাকিমের বদলীর হুকুম সরকারী গেজেটে বাহির হয়। তাহার পর আইনসভার একাধিক মুসলমান সদস্যের তদ্বিরে বদলী স্থগিত আছে! হাকিমটির জায়গায় কাজ করিবার যোগ্য অন্য হাকিম নাকি পাওয়া যাইতেছে না—তিনি এত বেশী লায়েক! অথচ তাঁহার উপরওআলা তাঁহার যোগ্যতার বিরুদ্ধে কিছু লিখিয়াছিলেন কি না আইন-সভায় জিজ্ঞাসা করায় উত্তর দেওয়া হইয়াছে, এ রকম সব চিঠি গোপনীয় (Confidential)। এর মানে যা, তাই!! বঙ্গের মন্ত্রীদের কীর্তি অতুলনীয় হইয়াছে কি না, তাহা ভাবিবার বিষয় হইয়াছে।

(প্রবাসী—মাঘ, ১৩৪৬)

নোয়াখালির হিন্দুদের উপর অত্যাচারের পুনরভিযোগ : হিন্দুদের পাশে শ্যামা প্রসাদ

“খবরের কাগজে এবং আইন-সভায় ও অন্যত্র বক্তৃতায় এইরূপ অভিযোগ একাধিক বার করা হয় যে, নোয়াখালির হিন্দুদের উপর নানাবিধ অত্যাচার হইয়াছে। অভিযোগসমূহের তদন্তের দাবিও করা হয়। তদন্ত এ পর্যন্ত হয় নাই। কেবল হইয়াছে এই যে, স্বরাষ্ট্র-মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আইন-সভায় একটি বক্তৃতায় অভিযোগগুলি উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করেন। সেই বক্তৃতাকে উপলক্ষ্য করিয়া এবং তাহার উত্তরে শ্রীযুক্ত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত বিজয়চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি দীর্ঘ বিবৃতি দৈনিক কাগজে প্রকাশ করিয়াছেন। ইহাতে শুধু সাধারণ ভাবে অত্যাচারের অভিযোগ করা হয় নাই, বহু দৃষ্টান্তও দেওয়া হইয়াছে এবং খাজা নাজিমুদ্দিনকে অনেকগুলি চোখা প্রশ্নও করা হইয়াছে। তদন্তের দাবি পুনর্বার করা হইয়াছে। খাজা সাহেবের আগেকার বক্তৃতায় তদন্তের দাবি উড়িয়া যায় নাই। তিনি আবার একটা বক্তৃতা করিলেও পুনরুত্থাপিত দাবি উড়িয়া যাইবে না। নিরপেক্ষ প্রকাশ্য তদন্ত চাই। মন্ত্রীরা তদন্তের ব্যবস্থা করুন। গবর্ণর বাহাদুরও সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার নিমিত্ত তাঁহার বিশেষ দায়িত্ব ও ক্ষমতা শিকায় তুলিয়া না রাখিয়া স্মরণ, পালন ও প্রয়োগ করিলে প্রশংসাভাজন হইবেন।”

বিবৃতির শেষ কিয়দংশ দৈনিক “ভারত” হইতে নিচে উদ্ধৃত হইল।

“কোন অঞ্চলস্থিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা রক্ষার অক্ষমতা সম্পর্কিত গুরুতর অভিযোগ কোন গবর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে আনা হইলে, সেই গবর্ণমেন্টের কোনো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মন্ত্রী যে তদন্ত করিতে অসম্মত হইতে পারেন, তাহা আমরা ভাবিতেই পারি না। এইরূপ ক্ষেত্রে তদন্তে অসম্মতির অর্থই হইতেছে নিজের নিন্দাবাদ নিজেই করা।

আমরা মনে করি নোয়াখালিতে যে অবস্থার উদ্ভব হইয়াছে, সেইরূপ অবস্থায় শুধু তদন্তের দাবি উত্থাপন করিয়া ক্ষান্ত হইলেই কর্তব্য সম্পন্ন করা হয় না; অত্যাচারিতদের দুর্গতি দূরীকরণার্থ দেশের সর্বত্র হইতে যাহাতে সাহায্য আসিতে পারে, তজ্জন্য জনমতকে জাগ্রত করিতে হইবে। গবর্ণমেন্ট যদি তাহাদিগকে রক্ষা করিতে অক্ষম হন, তাহা হইলে তাঁহারা যেন হিন্দুদিগের রক্ষার ভার হিন্দুর উপরই ন্যস্ত করেন, যেন এই কাজে তাঁহারা হিন্দুদের বাধা না দেন। আমরা মনে করি, উপদ্রুত অঞ্চলে অস্ত্রশস্ত্র রাখা সম্পর্কে বিধানাবলীর কঠোরতা হ্রাস করিয়া হিন্দুদিগকে উহা রাখিবার অনুমতি দিলেই এই কাজ করা হইবে। নিশ্চয়ই যে গবর্ণমেন্ট তাহাদের নিরাপত্তা ও বৈধ অধিকার রক্ষায় অক্ষম হইয়াছেন, সেই গবর্ণমেন্টের নিকট হইতে তাহারা এই অনুগ্রহটুকু দাবি করিতে পারে।

স্বাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
বি. সি. চট্টোপাধ্যায়”

ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্যে আরও বলেন :

“হিন্দু-মুসলিম মতানৈক্য সমস্যার সমাধানকল্পে একটি সম্মেলন আহ্বানের জন্য প্রধান মন্ত্রী উদ্বিগ্ন হইয়াছেন। প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিই একটি স্থায়ী ও সম্মানজনক আপসের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না। কিন্তু ব্যাপার হইতেছে ইহাই যে শুধু মাত্র মিষ্ট এবং আশ্বাসবাণীতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন সাধন হইবে না। হিন্দুদের প্রতি যে অবিচার করা হইয়াছে—বিশেষতঃ সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার দ্বারা যে পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে হিন্দুদের অন্তঃকরণ তিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। আমাদিগকে যদি ‘একটি পরিষ্কার শ্লেটে’ অঙ্ক কষিতে হয়, তাহা হইলে বহু দাগকে মুছিয়া ফেলিতে হইবে। কেবলমাত্র বাক্যের দ্বারা নহে, কার্যের দ্বারা আমরা অন্তঃকরণের পরিবর্তন দেখিতে পাই। গোল টেবিল বৈঠক আহ্বানের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পরেও আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, হিন্দুদের অভিযোগ সম্পর্কে ন্যায়সম্মত মতামত প্রকাশের ব্যাপারে এখনও ভারতশাসন-আইনের প্রয়োগ অব্যাহতরূপে চলিতেছে। নোয়াখালি-সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশ নিষিদ্ধ করিবার প্রচেষ্টা হইয়াছে। অবিলম্বে এই সমস্ত ব্যাপারের অবসান হওয়া সঙ্গত। নোয়াখালির ব্যাপার আজ নিখিল বঙ্গীয় সমস্যারূপে পর্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু মন্ত্রিসভা এবং তাহার সমর্থকবৃন্দ জোরপূর্বক ঘোষণা করিতেছেন যে, নোয়াখালিতে অস্বাভাবিক ব্যাপারের কোন অনুষ্ঠান হয় নাই। আমরা দৃঢ়তার সহিত ইহার নিন্দাবাদ করিতেছি এবং বলপূর্বক এইরূপ ঘোষণার প্রচেষ্টা আর যাহাতে না হয়, সেই জন্য দাবি জানাইতেছি। শান্তি, ঐক্য এবং ন্যায়ের নবযুগ প্রবর্তনে প্রকৃতই যদি আমরা উদ্বিগ্ন হইয়া থাকি, তাহা হইলে সততা এবং সাহসের সহিত সত্য ঘটনার সম্মুখীন হইতে হইবে।

স্বাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।”
(প্রবাসী ফাল্গুন, ১৩৪৬)

ঢাকার দাঙ্গা : শ্যামাপ্রসাদের ঢাকা পরিদর্শন : সরকারের বাধাদান

হিন্দুদের উপর নির্যাতনের মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময় তখন আত্মদ্বন্দ্বে দীর্ণ বাংলার কংগ্রেস নেতাদের ছিল না। গান্ধীপন্থী আর সুভাষপন্থী যেই হোক, তারা কে কত বেশি মুসলিমপ্রেমী তার প্রমাণ দিতেই ব্যস্ত। ১৯৪১ সালে ঢাকা শহর ও পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দুদের উপর চলে অমানুষিক অত্যাচার। সেদিন ঢাকার হিন্দুদের পাশে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছাড়া আর কোনও হিন্দু নেতাকে দেখা যায় নি। তিনি সরকারী নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেই বিমান থেকে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকা

পরিদর্শন করেন এবং যে দৃশ্য দেখেছেন তা স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করেন :

“I went there as the first Hindu non-official from ou__de. It was at first suggested by the Governor that the Muslim ministers, against whom there were allegations of instigating and fomenting the riots, would not go to Dacca; nor should I, the situation being left in charge of the local officers.”

কিন্তু গভর্ণরের অভিপ্রায়কে আমল না দিয়ে “Fazlul Haq, the Nawab of Dacca and Shahabuddin however, went to Dacca.” তখন শ্যামাপ্রসাদকেও নিরস্ত্র করা গেল না। তিনি ঢাকা ছুটলেন— “I followed Haq in a private plane driven by a Marwari friend, Lohia.” তিনি উপর থেকে দেখলেন “Before I got down I could see the whole city in flames.”

কিন্তু বিমান থেকে অবতরণেও তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। “Blair, Com-missioner, at first would not allow me to enter Dacca as I was like a red rag to the bull, and the Muslims would become uncontrollable if I remained there. I told him the Governor knew I was coming and he had no right to stop me. However I was ultimately allowed to go.”

ঢাকায় অবস্থানকালে শ্যামাপ্রসাদ নিজ কার্যকলাপ সম্পর্কে লিখেছেন–“I stayed there four or five days. We organised the Hindus, arranged for relief, and helped to bring pressure on the officials so that they would not show any partiality.”

কিন্তু ঢাকা শহরে হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গায় খুব সুবিধা না করতে পারায় গুণ্ডার দল মুসলিম লীগের উস্কানিতে আবার কয়েকদিন পর ঢাকার গ্রামাঞ্চলের হিন্দুদের উপর চড়াও হল। শ্যামাপ্রসাদ লিখেছেন :

“Early in April, that is a fortnight later, a terrible devas-tation took place in the rural areas in the Narayangunge sub-division. Nearly eighty villages were burnt and looted, about 3000 people fled for their lives to the nation State of Tippera. Hindus were about fifteen percent here, Muslims fifty five percent. Leaflets were circulated that Pakistan had come, Muslim rule had been re-established and Hindus if they chose to live, must live as converts to Islam.” Fresh conversions took place.” ( Leaves from A Diary -Dr. S. P. Mukherjee)

সুতরাং প্রথমে নোয়াখালি, পরে ঢাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ দাঙ্গায় হাত পাকিয়ে, এবার পূর্ণোদ্যমে পূর্ববঙ্গের বিশেষত নোয়াখালি জেলার হিন্দুদের উপর সর্বাত্মক আক্রমণের অপেক্ষায় রইল।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের অভূতপূর্ব জয়লাভের পর পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপর নতুন করে জুলুমবাজি শুরু হয়। এ সম্পর্কে নমুনা হিসাবে দু’টি ঘটনার উল্লেখ থেকে গোটা পরিস্থিতি অনুধাবন করা সহজ হবে।

(ক) টাঙ্গাইলের হিন্দুদের দুর্দশা

Professor Nirmal Kumar Bose’s Diary and Gandhi Bose papers, in the Asiatic Society, Calcutta; Gandhi Papers, Vol. II (1945 to 1947), Ms, -E-83, In 1946-pp. 139-203; ‘Communal Rule in Bengal : Some Facts and Figures : 1937 46 in retrospect’ Typed Copy, 469. অধ্যাপক নির্মল কুমার বসুর ডায়েরী থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল। ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দে, হিন্দু -মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর নিকট যে সব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় : “In many portions of Bengal, the cultivators are Muslims and the proprietors Hindus. Recently in some places, the Muslim tillers have refused to till the land under Hindu owners. What should the Hindu owners should do under the circumstances? (Gandhi-Bose paper,” Vol-II, P-139)

১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দের ৫ জানুয়ারী কংগ্রেস কর্মীরা মহাত্মা গান্ধীকে বলেন, পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক অবস্থার অবনতি হওয়ায় হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছে। মসজিদের সামনে বাজনা বন্ধ নিয়েও বিরোধ হচ্ছে (Ibid; pp143-145) ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারী বরিশাল থেকে কংগ্রেস নেতা সতীন সেন মহাত্মা গান্ধীকে একই মনোভাব ব্যক্ত করে লেখেন, মুসলিম লীগ আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে (Ibid; p-185) ময়মনসিংহের টাঙ্গ াইল কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধীকে লেখা হয় : “Some interested people of scheduled caste, specially Namasudras are trying to induce the scheduled caste people to go against the caste Hindus. These are being done in connection with election campaign Agents of Muslim League are trying to stop to cultivate lands owned by the caste Hindus. In many places they have become successful. Please show us how to deal with this problem.” (Ibid, P-187)

(খ) ঢাকায় হিন্দুদের ধর্মকর্মে বাধা

১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দের ৪ জানুয়ারী বিক্রমপুরের (ঢাকা) কংগ্রেস কর্মীরা মহাত্মা গান্ধীকে লেখেন : “The communal situation in Eastern Bengal, particularly Dacca, is worsening day by day. In almost all the riots in Bengal the Hindus suffer the most…. In many places in East North Bengal, the immersion ceremony of images could not be held owing to the demand of the Moslems to stop music before mosques. Formerly they demanded the stopping of music only during prayer-time, but now they demand it for all time. This has been the cause of disturbances almost every year. Please advise us what to do in the matter” (Ibid, pp-199-203).

এসব ছোটখাট ঘটনার কিছুদিন পরেই ঘটে কলকাতার দাঙ্গা ( ১৬ই আগস্ট ‘৪৬); এবং তার প্রায় দু’মাস পরে ১০ই অক্টোবর থেকে ঘটে নোয়াখালি-ত্রিপুরার দাঙ্গা।

পূর্ববঙ্গের অবস্থা ভয়াবহ : বারোজ / ওয়াভেল

কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গার মধ্যবর্তী কালে মফঃস্বল বাংলার শহরগুলির হিন্দুরা বিশেষত পূর্ববঙ্গের, যে কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল, বারোজ গোপন পত্রে ওয়াভেলকে তা অবহিত করেন। ওয়াভেল আবার পেথিক-লরেন্সকে পূর্ববঙ্গে আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে জানান :

“Burrows in his last letter points out how little attention has been attracted to the riots in the mofussil towns of Bengal where there have been 300 killed. I am afraid Eastern Bengal is a really dangerous spot, and if “direct action” by the Muslim League started, a large number of Hindus there would be massacred. Communal tension and

bitterness is acute everywhere in India and unless we can get a settlement with the League, the consequences may be very serious.” (From Wavell to Pethick-Lawrence; dt. 10.9.46)

কিন্তু ঐ পূর্বাভাসই সার। সতর্কতামূলক কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ক্ষমতায় আসীন মুসলিম লীগ। নির্যাতিত হচ্ছে হিন্দু। তাতে আহ্লাদ ব‍ই আফসোসের কিছু নেই ব্রিটিশের। সুতরাং ঝড় আছড়ে পড়ল পূর্ববঙ্গের, বিশেষত নোয়াখালি-ত্রিপুরার একাংশে হিন্দুদের উপর।

বিভীষিকাময় ১০ অক্টোবর : নোয়াখালির দাঙ্গা

Done page 196

১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্টের রক্তস্নাতা কলকাতার পর বাঙালী হিন্দুর জীবনে আর একটি দুঃস্বপ্নময় স্মরণীয় শোকদিবস ঐ বছরেরই ১০ই অক্টোবর। শহুরে হিন্দুদের জীবনে নারকীয় বিভীষিকা সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ সরকার ও তার পোষা গুণ্ডাবাহিনীর শকুনদৃষ্টি পড়ল বাংলার শান্তিনিকেতন পল্লীগ্রামের হিন্দুদের শান্তিময় জীবনকে তছনছ করার দিকে। ১৬ই আগস্টের কলকাতার দাঙ্গার বদলা হিসাবে নোয়াখালিতে হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গার ষড়যন্ত্র শুরু হয় অব্যবহিত পরেই।

“Guilty Man of 1946” নামে পরিচিত “Great Calcutta Killing”-এর নায়ক বাংলার প্রধানমন্ত্রী মিঃ সুরাবর্দী তাঁর শাসনযন্ত্রের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সহায়তায় পরিচালিত কলকাতার দাঙ্গার হিসাব-নিকাশ করে দেখল যে, দাঙ্গায় মুসলমানদের ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। তখন মুসলমান সমাজের কাছে নিজের মুখরক্ষা ও ক্ষতিপূরণের জন্য কুকর্মের ক্ষেত্ররূপে বেছে নিল অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৮২%) অথচ ক্ষুদ্রতম ও দুরধিগম্য নোয়াখালি জেলাকে। সেখানে হিন্দুরা অতি সংখ্যালঘু (১৮%) এবং মুসলমানদের ভালমানুষির উপর একান্ত নির্ভরশীল। বিচ্ছিন্নভাবে স্বল্প সংখ্যায় দূর দূরান্তরে বসবাসকারী হিন্দুদের উপর একতরফাভাবে আক্রমণের এমন সুযোগ আর কোথাও নেই। নোয়াখালি জেলার দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকার লাগোয়া পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুর, চৌদ্দগ্রাম, ফরিদগঞ্জ, লাকসাম, হাজিগঞ্জ, কচুয়া ও দেবীদ্বার থানার হিন্দুদের অবস্থা এবং অবস্থানও একই রকম। নোয়াখালির সঙ্গে তারাও একই সঙ্গে আক্রমণের শিকার।

দাঙ্গার নায়ক গোলাম সরওয়ার

নোয়াখালি দাঙ্গার কুখ্যাত নায়ক গোলাম সরওয়ার দাঙ্গা বাধাবার কাজে কোমর বাঁধে। কলকাতার দাঙ্গার দু’ এক সপ্তাহের মধ্যেই নোয়াখালিতে দাঙ্গার পরিবেশ তৈরিতে স্থানীয় প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায় মুসলিম লীগের আশ্রিত গুণ্ডাশ্রেণীর লোকজন বিসমিল্লাহ্ বলে কাজে নেমে পড়ে। মসজিদে মসজিদে অশিক্ষিত ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলবীর দল ধর্মকথার পরিবর্তে উপস্থিত মুসলমান জনতাকে কাফের হিন্দুদের খতম করার ফতোয়া দিতে থাকে। পবিত্র শরিয়তী প্রথায় পরিচালিত ও পরিকল্পিত পাকিস্তানে কাফের হিন্দুদের যেন কোন চিহ্ন না থাকে সে সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ ওয়াজ দিয়ে তীব্র উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। হাটে বাজারে মুসলমান হেটো-কবিগণ কলকাতার দাঙ্গা নিয়ে সত্য মিথ্যায় পরিপূর্ণ উত্তেজক ছড়া ও কবিতার বই পাঠ করে মুসলিম জনতাকে কলকাতার বদলা নিতে ও পাকিস্তান হাসিল করতে প্ররোচিত করে। অনেক হাট-বাজারে “শিখ আইয়ে, শিখ আইয়ে” জিগির তুলে হিন্দুদের দোকানপাট লুট করতে থাকে। ইতিমধ্যে সুরাবর্দীর তরফ থেকে থানা ও পুলিশ প্রশাসনে মুসলিম লীগপন্থী পুলিশ দারোগায় ভর্তি করা হয়।

এই দাঙ্গায় যে সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও পরিবারের উপর আক্রমণ করে হিন্দু সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে তাদের নিশ্চুপ ও নির্বাক করে আপামর হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার চালান হয়, তার মধ্যে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করা গেল :

নোয়াখালির ঐতিহাসিক দাঙ্গা

“১৯৪৬ সালের ১০ই অক্টোবর লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিন। ১৬ই আগস্ট কলিকাতার হাঙ্গামার পর নোয়াখালির লীগ কর্মী গোলাম সরওয়ার, রসিদ আহম্মদ, কাসেম, আকবর ইত্যাদির হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রচার কার্য শুরু হইল। এই প্রচারের ফলে নোয়াখালির সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া অতিমাত্রায় বিষাক্ত হইয়া উঠিল। দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার মধ্য দিয়া দুর্গোৎসবের নিরানন্দ দিনগুলি কাটিয়া গেল। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন আগত। কোন হিন্দুর মুখে হাসি নাই। পূজার ফুলপত্র সংগ্রহে বালক-বালিকাদের পর্যন্ত আগ্রহ নাই। প্রভাত সূর্য থাকিয়া থাকিয়া মেঘের আড়ালে মুখ ঢাকিয়া রাখে। মাঝে মাঝে বাতাস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আকাশে-বাতাসে যেন মৃত্যুর করাল ছায়া পড়িয়াছে। হঠাৎ আকাশ-বাতাস কম্পিত করিয়া চারিদিক হইতে ধ্বনি উঠিল “আল্লা হো আকবর, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।” সেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একতরফা যুদ্ধ নোয়াখালিতে শুরু হইল। চারিদিক হইতে দলে দলে মুসলমান শ্যামপুরের গোলাম সরওয়ারের বাসস্থল “মিঞার ডায়েরা”র অভিমুখে ছুটিল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে গুজব রটাইয়া দিল যে কলিকাতা হইতে একদল শিখ নোয়াখালি গিয়া ‘মিঞার ডায়রা’ আক্রমণ করিয়াছে। ইহা মুসলমানদের পীঠস্থান স্বরূপ। সরওয়ারের পিতা, পিতামহ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং ‘ফকির’ বা সাধুর মত জীবন যাপন করিতেন। হিন্দুরাও ‘মিঞার ডায়েরার’ প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল।”

সাহাপুর বাজার লুট : কালীমন্দির বিধ্বস্ত

“শিখেরা ডায়েরা আক্রমণ করিয়াছে’ এই গুজব শুনিয়া দলে দলে মুসলমান তথায় সমবেত হইল। সেখান হইতে জনতা গোলাম সরওয়ারের নির্দেশে নিকটবর্তী সাহাপুর বাজারে গেল। কাসেমও তাহার ফৌজ (এই নামেই অভিহিত হইত) লইয়া ঐ স্থানে উপনীত হইল। বাজারের প্রকাণ্ড কালীগাছ দলিত ও অগ্নিসংযোগে হতশ্রী হইল। তৎপর লুঠ-তরাজ। ‘মালাউনের (হিন্দুদের তাহারা এই আখ্যায় অভিহিত করিত) রক্ত চাই’ ইত্যাদি ভীতিপ্রদ ও আক্রমণাত্মক ধ্বনি দিতে লাগিল। স্থানীয় হিন্দু ভীত ও সন্ত্রস্ত মনে নিজ নিজ গৃহে নীরবে আশ্রয় গ্রহণ করিল। এইভাবে সাহাপুর বাজারে লীগ সংগ্রামীদের মহড়ার কাজ বেশ কিছুক্ষণ চলিয়াছিল।”

নারায়ণপুরে নাজিরের কাছারীতে ধ্বংসলীলা

“তৎপর কাসেমের ফৌজ’ বিদ্যুৎ গতিতে দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখে নারায়ণপুর গ্রামে নাজিরের কাছারীর অভিমুখে ছুটিল। সেখানে কল্যাণনগর হইতে আর একটি দল আসিয়া মিলিত হইল। ঐ স্থানের জমিদার সুরেন্দ্রনাথ বসু। তাঁহার ভ্রাতা শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু কলিকাতা হাইকোর্টের এডভোকেট। সুরেন্দ্রবাবু তেজস্বী স্বদেশপ্রেমিক জমিদার। জনহিতকর বহু প্রতিষ্ঠানের সহিত সংশ্লিষ্ট। তৎকালে তিনি কাছারী বাড়ীতে কয়েকজন কর্মচারী লইয়া বাস করিতেছিলেন। তাঁহার ‘মালখানায়’ সর্বদা একটি বন্দুক, কিছু গোলা-গুলি ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র মজুত থাকিত। তিনি ন্যায়-পরায়ণ, দক্ষতা ও সততার সহিত জমিদারী শাসন পরিচালনা করিতেন। কতিপয় অসৎ প্রজা তাঁহার উপর সন্তুষ্ট ছিল না। আজ সেই সুযোগ উপস্থিত হইলে তাহারা সদলবলে কাসেমের সঙ্গে মিলিত হইয়া সুরেন্দ্রবাবুকে আক্রমণ করিল। সুরেন্দ্রবাবু একাকী বন্দুক হস্তে এই আক্রমণের মোকাবিলা করিলেন। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? গোলাগুলি ফুরাইয়া আসিল। তাঁহার গুলিবর্ষণ হইতে প্রাণ বাঁচাইবার জন্য আক্রমণকারীরা ঢেউ-টিন সম্মুখে রাখিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা যুঝিয়াছিল। অতঃপর হিংস্র ঘাতক দূর হইতে সুরেন্দ্রবাবুকে লক্ষ্য করিয়া মাছমারা শাণিত লৌহশলাকাযুক্ত ‘কোঁচ ও টেটা’ ছুঁড়িতে লাগিল। তিনি ক্ষত-বিক্ষত দেহে ধরাশায়ী হইলেন। আততায়ীরা অর্ধমৃত অবস্থায় তাঁহাকে হাত-পা বাঁধিয়া জ্বলন্ত অনলে নিক্ষেপ করিল। সুরেন্দ্রবাবু ও তাঁহার সঙ্গী জনকয়েক বিশ্বস্ত কর্মচারী নোয়াখালিতে Direct Action-এর প্রথম বলি। নাজিরের কাছারীর আক্রমণের কথা শুনিয়া নিকটবর্তী পাঁচঘরিয়া গ্রামের নির্ভীক কবিরাজ রাজকুমার পাল অগ্রসর হইতেছিলেন। কিন্তু বাড়ীর অল্প দূরে পথিমধ্যে কয়েকজন দুর্বৃত্ত কর্তৃক নৃশংসভাবে নিহত হইলেন। কবিরাজ মহাশয় সুরেনবাবুর প্রিয় ও বিশ্বাসভাজন ছিলেন। লক্ষ্মীপূর্ণিমার দিন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে হিন্দুদের মন গভীর দুঃখের আর্তিতে ও নৈরাশ্যে ভরিয়া গেল। পলাইবারও পথ নাই। পথঘাট লীগের স্বেচ্ছাসেবকগণ কর্তৃক অবরুদ্ধ।”

পরদিন করপাড়া আক্রান্ত : রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীকে সপরিবারে হত্যা

“গোলাম সরওয়ারের বাড়ী হইতে করপাড়া চৌধুরী বাড়ীর দূরত্ব এক মাইলের বেশী নহে। পূজার ছুটিতে বর্ধিষ্ণু চৌধুরী বাড়ীর উকিল-মোক্তার, অধ্যাপক সরকারী কর্মচারী আপন আপন কর্মস্থল হইতে বাড়ী আসিয়াছে। উকিল রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর উপর গোলাম সরওয়ারের জাতক্রোধ। তিনি একাধিক বার সরওয়ারের দুষ্কার্যের বিরুদ্ধে জেলাশাসকের নিকট অভিযোগ করিয়াছেন। তাঁহার আরও একটি অপরাধ এই–গোলাম সরওয়ারের একমাত্র সহোদর ভাই অন্যায়ভাবে পৈতৃক-সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইয়াছিল; আইনের আশ্রয়ে ইহার প্রতিকারের জন্য অসহায় ভাইটি খ্যাতনামা উকিল রাজেন্দ্রলালের সাহায্যপ্রার্থী হইয়াছিল। তৃতীয়তঃ, রাজেন্দ্রবাবু জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি। এইসব কারণে সরওয়ার রাজেন্দ্রবাবুকে বিষনজরে দেখিত।”

এখানে একটু পূর্ব-ইতিহাস জানা প্রয়োজন। অতি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ত্রিশের দশকে নোয়াখালিতে ‘কৃষক সমিতি’ স্থাপিত হয়। কিন্তু অনতিকাল-মধ্যে সমিতির নেতৃত্ব অধিকার করল কুখ্যাত গোলাম সরওয়ার, সুচতুর রসিদ আহম্মদ ও মোক্তার মজিবর রহমান। এদের পক্ষপুটাশ্রয়ে থেকে চোর-গুণ্ডা ও ডাকাতের দল হিন্দু তালুকদার মহাজনদের পরিবর্তে সাধারণ হিন্দুদের উপর চড়াও হয়। হিন্দুদের গৃহ লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হতে থাকে। স্থানে স্থানে হিন্দুনারী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। এদের এই দুষ্কার্যের প্রতিকারে প্রভাবশালী হিন্দুরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যে আন্দোলন করেন এবং প্রতিকার করতে সমর্থ হন তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন খ্যাতনামা উকিল রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী। দিল্লীতে কেন্দ্রীয় আইন সভায়ও তার ঢেউ ওঠে।

রাজেন্দ্রলাল ছিলেন জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি। নোয়াখালিতে কৃষক সমিতির আড়ালে থেকে গুণ্ডাশ্রেণীর মুসলিম লীডারগণ হিন্দু নরনারী ও ধন-সম্পত্তির উপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার প্রতিকার হিন্দুগণ তথাকথিত অহিংসার পূজারী কাপুরুষ ও ভেড়ুয়া কংগ্রেসীদের কাছে পায়নি। সেই দুর্দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ। স্বয়ং ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী নোয়াখালি গিয়ে হিন্দুদের পাশে দাঁড়ান। সরওয়ার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কুকীর্তি সভ্য জগতে প্রচার করেন এবং প্রতিবিধান করেন। রাজেন্দ্রলালের উপর সরওয়ারের রাগের অন্যতম কারণ ছিল এই।

যা হোক, “লক্ষ্মীপূর্ণিমার পরদিন (১১ই অক্টোবর) সরওয়ারের বিরাট ‘মিয়ার ফৌজ’ করপাড়া চৌধুরী বাড়ী আক্রমণ করিল। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসী ত্র্যম্বকানন্দ তখন ঐ বাড়ীতে ছিলেন। রাজেন্দ্রবাবু বন্দুক হস্তে এবং ত্র্যম্বকানন্দ খড়গহস্তে আততায়ীদের বাধা দিতে লাগিলেন। সারাদিন লড়াই চলিল। তখন মুসলমানদের রমজানের মাস, সূর্য ডুবিবার পূর্বেই সরওয়ারের সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হইয়া নিজগৃহে ফিরিল।

পরদিন তাহারা প্রভাতী নামাজ সারিয়া আল্লার নামে কোমর বাঁধিয়া দ্বিগুণ উৎসাহে আবার করপাড়া অভিমুখে রওনা হইল। পূর্বদিনের সংগ্রামের পর রাত্রির অন্ধকারে ত্র্যম্বকানন্দ সহ চৌধুরী বাড়ীর কতিপয় স্ত্রী-পুরুষ প্রাণ হাতে করিয়া নিরাপদ আশ্রয় স্থানের সন্ধানে বহির্গত হইলেন। তাঁহাদের কেহ কেহ রক্ষা পাইলেন। রাজেন্দ্রবাবু পূর্বদিনের ন্যায় আজও রণসাজে সজ্জিত হইয়া বাড়ীতে যাঁহারা ছিলেন সকলকে লইয়া ছাদের উপর উঠিলেন। দালানের কপাট-জানালা বন্ধ করিয়া, সিঁড়ি বাহিয়া ছাদে উঠিবার পথটিও বন্ধ করিয়া দিলেন। ছাদের উপর হইতে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িতে লাগিলেন। দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ আক্রমণকারীদল এখানেও ঢেউ-টিনের আচ্ছাদনে দেহরক্ষা করিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। দালানের সান্নিধ্য লাভ করিয়া উহাতে কেরোসিন তৈল ঢালিয়া অগ্নি সংযোগ করিল। অন্যত্র যাইবার সকল পথ অগ্নিময়—আততায়ীরা কেহ পার্শ্ববর্তী নারিকেল গাছ বাহিয়া, কেহ বা বাঁশের নির্মিত ম‍ইয়ের সাহায্যে ছাদের উপর উঠিল। তারপর যাহা ঘটিল সহজেই অনুমেয়। ইহার সাক্ষী রহিল রাজেন্দ্রবাবু ও অন্যান্যের রক্তরঞ্জিত নারিকেল বৃক্ষ ও ছাদের রক্তমাখা উন্মুক্ত বক্ষঃস্থল। রাজেন্দ্রবাবু, ত্বদীয় অগ্রজ চিন্তাহরণ রায় ও অনুজ সতীশ রায় সহ বাইশ জন নৃশংসভাবে নিহত হন।”

“তিন মাস পর গান্ধীজী এই বাড়ী পরিদর্শনে এসে দাঙ্গার স্মৃতিচিহ্ন প্রত্যক্ষ করেন। ১১ই জানুয়ারী, ১৯৪৭ সাল গান্ধীজী আমার জন্মভূমি লামচর কেন্দ্রে আসিয়া সদলবলে উপস্থিত হইলেন। অপরাহ্ণে লামচর হাই-স্কুলের প্রাঙ্গণে প্রার্থনা সভায় অন্যূন ২ সহস্ৰ লোক উপস্থিত হইল। সভাস্থলে আসন গ্রহণের পূর্বে ২২ জন নারীপুরুষের অর্ধগলিত দেহ, কাহারও কঙ্কালমাত্র আজিমপুর মাঠের জলাভূমি হইতে সেদিনই দিবাভাগে উদ্ধার করিয়া স্কুল প্রাঙ্গণে আনীত হইয়াছিল। …… স্থানীয় জনসাধারণ এই মৃতদেহগুলি আমার আত্মীয় ও প্রতিবেশী রাজেন্দ্রলাল চৌধুরী মহাশয়ের বাড়ীর স্ত্রী-পুরুষের মৃতদেহ বলিয়া সনাক্ত করেন। গভীর রাত্রিতে প্রার্থনার পর লামচর চৌধুরী বাড়ীর পূর্বদিকে খোলা জায়গায় হিন্দু ধর্মানুসারে শবদেহগুলি দাহ করা হয়।”

(নোয়াখালিতে গান্ধীজী—মনোরঞ্জন চৌধুরী)

সায়েস্তানগরে : চিত্ত দত্তরায়ের আত্মাহুতি

“দাঙ্গার তৃতীয় দিনের (১২ই অক্টোবর) মহাবলি রায়পুর থানায় সায়েস্তানগরের স্বর্গীয় রায় বাহাদুর প্যারীলাল রায়ের দৌহিত্র চিত্তরঞ্জন দত্ত রায়চৌধুরী। রায় বাহাদুরের ‘চকমিলান’ প্রকাণ্ড বাড়ী। রক্তপিপাসু দুর্বৃত্তদল আক্রমণ করিল চিত্তরঞ্জনের বাড়ী। এই প্রকাণ্ড বাড়ীতে চিত্তরঞ্জন স্ত্রী-পুত্র, বৃদ্ধা মাতা ও দাস-দাসী লইয়া বাস করিতেন। দুর্বৃত্তদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ভৃত্যগণ পলায়ন করিল। চিত্তরঞ্জন পরিবারস্থ সকলকে ছাদের উপর তুলিয়া বন্দুক হস্তে একাকী দাঁড়াইয়া আততায়ীদের উপর গুলি করিতে থাকেন। অবশেষে আততায়ীদের সংখ্যাধিক্যে তাঁহার নিজ গোলাগুলি নিঃশেষ হইলে, বিজ্ঞানের ডিগ্রীধারী যুবক কৌশলে পাম্প ব্যবহার করিয়া পুকুর হইতে জল উঠাইয়া প্রতিপক্ষের গোলাগুলি প্রতিহত করিতে লাগিলেন। সর্বশেষে নিরুপায় হইয়া চিত্তরঞ্জন স্বহস্তে তাঁহার বৃদ্ধা মাতা ও সন্তানদের নিজ বন্দুকের গুলিতে হত্যা করিয়া নিজেও শেষগুলিতে আত্মহত্যা করিয়া আত্মবিসর্জন দিলেন। চিত্তরঞ্জনের আত্মাহুতি রাজপুত বীরদের পবিত্র আত্মবিসর্জনের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। চিত্তরঞ্জন সপরিবারে মরিলেন, তবুও আত্মসমর্পণ করিলেন না। তাঁহার স্ত্রী একটি শিশুসন্তানসহ কোনরূপ রক্ষা পাইয়াছেন।”

গোপাইরবাগে পৈশাচিক কাণ্ড

“রামগঞ্জ থানার সোমপাড়া বাজারের নিকটবর্তী গোপাইরবাগ একটি গণ্ডগ্রাম, ঐখানে কাসেমের বাড়ী। ঐ গ্রামে বৈশ্যবারুজীবী রামরাম, কালীকমল ও শশী পাটোয়ারী তিন ভ্রাতার এক প্রকাণ্ড পরিবার দাঙ্গার অন্যতম পাণ্ডা কাসেমের নিকট প্রতিবেশী। এই বাড়ীটি গোপাইরবাগ দাসেদের বাড়ী নামে পরিচিত। কাসেমের পরিচালনাধীন লীগের গুণ্ডাদল দাসেদের বাড়ী চড়াও করিল। ঐ বাড়ীর বাইশ জন প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় আক্রমণকারীদের বাধা দিল। বেশ কিছুক্ষণ মারামারি ও ধ্বস্তাধ্বস্তির পর অমিত শক্তিশালী দুষ্কৃতকারিগণ দাস পরিবারের উনিশজনকে একত্রে হত্যা করিল এবং উনিশজন কুলনারীকে একসঙ্গে বিধবা করিল। দাঙ্গার কিছুকাল পরে ব্যারিস্টার শ্রী এন. সি. চ্যাটার্জী, কংগ্রেস নেত্রী শ্রীমতী সুচেতা কৃপালনী (উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী) এবং গান্ধীজী স্বয়ং সদলবলে এই ঘটনাস্থল ও অপরাপর স্থানসমূহ প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।”

নোয়াখোলা চৌধুরীবাড়ীতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড

“তের চৌদ্দ বৎসরের একটি ছাত্র ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসিয়া আসন্ন পরীক্ষার পাঠ প্রস্তুত করিতেছিল। এমন সময় হঠাৎ একদল মুসলমান গুণ্ডা তার ঘরে প্রবেশ করিয়া শাণিত ছুরিকার এক আঘাতে তাহার মস্তক দেহচ্যুত করিল। সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কৃতকারীরা সমস্ত বাড়ী লুন্ঠন, গৃহাদি ভস্মীভূত এবং একে একে সকল পুরুষকে হত্যা করিল। একটি বৃহৎ ও বর্ধিষ্ণু পরিবার শ্মশানে পরিণত হইল। এই ঘটনার দুই এক দিন পূর্বে যাহারা স্থানান্তরে গিয়াছিল তাহারা প্রাণে বাঁচিল।

আমার বাবা-কাকা— পরিবারের মোট আটজন খুন হয়েছিল। মা-কাকীরা দুদিন জঙ্গলে পালিয়েছিলেন। আমাদের ঘরবাড়ি, গোলার ধান কিছুই ছিল না। এই তো, আর কী বলি!”

কথকের নাম শিবপ্রসন্ন নারায়ণ চৌধুরী। বাড়ি ছিল নোয়াখালির রামগঞ্জে; গ্রামের নাম নোয়াখোলা। ১৯৪৬ সালে তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। দাঙ্গার পরই তাঁরা কলকাতায় চলে আসেন। মা কি পরে কিছু বলতেন? মায়ের মুখে আর কী শুনেছেন তিনি?—শিবপ্রসন্ন দুটি হাত জোড় করে বলেন, ‘মা এই নিয়ে পরে আর একটি কথাও বলেন নি। তিনি আর মাত্র এক বছর বেঁচেছিলেন। আমি আর কিছু জানি না।’ জোড়হস্ত শিবপ্রসন্ন বুঝিয়ে দেন, তিনি আর কিছু বলতে চান না।”

গোবিন্দপুরে পৈশাচিক কাণ্ড

“বেগমগঞ্জ থানায় গোবিন্দপুরে যশোদা পালদের এবং তাহাদের কর্মচারী ভারত ভূঁঞার বাসস্থান। দুর্বৃত্তদল তাহাদের বাড়ী আক্রমণ করিল। ১৬ জন জীবন্ত মানুষকে হাত-পা বাঁধিয়া আগুনে নিক্ষেপ করিয়া লম্বা লাঠির দ্বারা চাপিয়া ধরিয়া পোড়াইয়া মারিয়া ফেলে। এই পৈশাচিক ফাণ্ড কে বর্ণনা করিবে?”

এই গ্রাম দর্শনে গান্ধীজীর প্রতিক্রিয়া :
আপনাকে ছাই ছাড়া দেবার কিছু নেই

“২রা ফেব্রুয়ারি রবিবার সকালে আমিষাপাড়া হইতে রওনা হইয়া গান্ধীজী সাতঘরিয়া পৌঁছেন। পথে গান্ধীজীকে ‘ভৌমিকবাড়ী’ ও ‘পালবাড়ী’র ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়। দুইটি বাড়ীই সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত করা হইয়াছে। দুইখানি বাড়ীতেই বড় বড় পাকা ঘর ছিল। হাঙ্গামার সময় এই দুইখানি বাড়ীতে মোট ১৯ জনকে হত্যা করা হয়।

গান্ধীজী প্রথম যে বিধ্বস্ত বাড়ীতে যান, সেই বাড়ীর একজন লোক গান্ধীজীকে বলেন, গান্ধীজীকে তাঁহার দেওয়ার মত ভস্ম ছাড়া আর কিছুই নাই। হাঙ্গামার সময় তাঁহার বাড়ীতে ৯ জন প্রাণ হারাইয়াছে। গান্ধীজী ইহার উত্তরে বলেন, “আমার হৃদয়ের আকুল আবেদন ভগবানের কাছে, মানুষের কাছে নয়। মানুষকে কাঁদাইবার জন্য আমি এখানে আসি নাই।”

নন্দীগ্রাম লণ্ডভণ্ড

“নন্দীগ্রামে প্রসিদ্ধ নাগেদের বাড়ী, পোস্ট অফিস ও শ্রীরমণীকান্ত নাগের প্রতিষ্ঠিত উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় ভস্মীভূত হইল। নাগেদের বাড়ীতে ঐ অঞ্চলের বহু আশ্রয় প্রার্থীকে সমবেত করিয়া সশস্ত্র পুলিশ পাহারা দিয়াছিল। এই আশ্রয় শিবিরে লেখকও (নলিনীরঞ্জন মিত্র) দুইতিন দিন ছিলেন। একদিন গোলাম সরওয়ারের ফৌজ এই আশ্রয় শিবির আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইল; কিন্তু পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে অবশেষে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল। কিন্তু গ্রামে প্রবেশ করিয়া কয়েকটি বাড়ীতে যথেচ্ছ লুঠতরাজ ও কয়েকজনকে হত্যা করিয়া প্রস্থান করিল। বৃদ্ধ কুঞ্জ কর্মকারকে হাত-পা বাঁধিয়া অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। বাসুদেব বাড়ীর জনৈক প্রতিরোধকারী শিক্ষককে হত্যা করিবার সময় তাঁহার স্ত্রী বাধা দিলে স্ত্রীকে মাটিতে শোয়াইয়া তাহার বুকের উপর স্বামীকে বসাইয়া হত্যা করা হল। এইরূপ জায়গায় জায়গায় জল্লাদদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কয়েক দিন চলিয়াছিল।

দালালবাড়ীর ধ্বংসসাধন

দালাল বাজারে স্বর্গীয় বিখ্যাত জমিদার নরেন্দ্রকিশোর রায়দের বাড়ী একটি সুরক্ষিত দুর্গ বিশেষ ছিল। নেপালী বন্দুকধারী প্রহরী। বাড়ীতে ছয় সাতটি উন্নত ধরনের বন্দুক। তবুও এই বাড়ী রক্ষা পাইল না। দুর্বৃত্তগণ এই বাড়ী ধ্বংস করিয়াছে প্রকাশ্য সংগ্রামের দ্বারা নহে, কৌশল ও চতুরতার দ্বারা। জমিদার বাবুদের বিশ্বস্ত কয়েকজন প্রজা, পাইক-পেয়াদা ও বরকন্দাজ পর পর আসিয়া জানাইল যে, চারিদিকের অবস্থা বড়ই সঙ্কটজনক। বহুস্থান হইতে বহু দল সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া আগ্নেয়াস্ত্র সহ পরের দিনই ঐ বাড়ী আক্রমণ করিবে। গৃহস্বামীরা নিরুপায় ভাবিয়া সেই রাত্রেই প্রজাবৃন্দকে তাহাদিগকে লক্ষ্মীপুর থানায় কিংবা ভবানীগঞ্জ স্টীমার ঘাটে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য বলিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নৌকার ব্যবস্থা হইল। নগদ টাকা-কড়ি, সোনার গহনা ঘরে যাহা ছিল, তৎসমূদয় এবং বন্দুকগুলি লইয়া বাবুরা নৌকায় উঠিলেন। কিয়দ্দূর গেলে রাত্রির অন্ধকারে একদল লোক অতর্কিতে নৌকা আক্রমণ করিয়া বন্দুক ও সোনাদানা নগদ টাকা-কড়ি আত্মসাৎ করিয়া বাবুদের ছাড়িয়া দিল। বাবুরা কোন প্রকারে প্রাণ বাঁচাইয়া রিক্ত হস্তে লক্ষ্যস্থানে গিয়া পৌঁছিলেন। অতঃপর নির্জন বাড়ীর মূল্যবান বহু আসবাবপত্র লুণ্ঠিত হইল, মহাপ্রভুর বিখ্যাত মন্দির বিধ্বস্ত ও জমিদারী সংক্রান্ত কাগজপত্র ভস্মীভূত হইল। মন্দিরের পূজারী শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়া দুর্বৃত্তদের অস্ত্রাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহে অবশেষে তাঁহার চির আরাধ্য দেবতার পদতলে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইলেন। কুঠার শাবলের সাহায্যে প্রাসাদোপম অট্টালিকাসমূহ এক বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হইল। বিখ্যাত ব্যারিস্টার শ্রীনির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জী এই ধ্বংসস্তূপ দেখিয়া বলিয়াছিলেন, “মনে হয়, এখানে ফ্লাণ্ডার্সের বোমা বর্ষিত হইয়াছে।”

নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা

“প্রত্যক্ষ সংগ্রামীরা দিনের পর দিন তড়িৎগতিতে লীগের কর্মসূচী হিন্দুর রক্তে রূপায়িত করিতে লাগিল। অন্যদিকে লীগপন্থী শঠেরা নিরীহ হিন্দুদের বাড়ী বাড়ী ঘুরিয়া আশ্বাস দিল ‘ভয় নাই, আমাদের প্রাণ থাকিতে তোমাদের গায়ে কেহ হাত দিতে পারিবে না। তোমরা ঘর-বাড়ী ছাড়িয়া কোথাও যাইও না, তাহা হইলে পথে-ঘাটে মারা পড়িবে।’ এরূপ কত আশ্বাসই না দিয়াছে। কার্যতঃ শুধু আশ্বাস দেয় নাই, নিরাপদ স্থানে পৌঁছাইয়া দিবে এই প্রতিশ্রুতিতে রাত্রির অন্ধকারে নৌকায় উঠাইয়া কিয়দ্দূর নিয়া গহনাপত্ৰ -টাকাকড়ি আত্মসাৎ, করিয়া অবশেষে হত্যা করিয়াছে। নন্দীগ্রামের নিকটবর্তী কালিকাপুরের যতীন্দ্রবাবু ও সতীন্দ্রবাবু, নাওড়ির যশোদা দাস, শরৎ দাস ও তাহার ভাই, আবিরপাড়ার চন্দ্রশেখরবাবু, শিবপুরের সতীশবাবু (পুলিশ কর্মচারী) ও আরো অনেকে এইভাবে বিশ্বাসঘাতকের হাতে প্রাণ হারাইয়াছে।

ছাত্রের হাতে শিক্ষক নিহত

“বেগমগঞ্জ থানায় বটগ্রামের পাঠশালায় জনপ্রিয় বৃদ্ধ গুরুমহাশয় অক্ষয় চক্রবর্তী। গ্রামের বহু হিন্দু-মুসলমান তাঁহার ছাত্র। গুরুমহাশয়কে বাঁচাইবার জন্য কতিপয় গুরুভক্ত তাঁহাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিল। কিন্তু বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ দুর্গা নাম ছাড়িতে পারিলেন না। তিনি একখানা পত্রের প্রারম্ভে ‘শ্রীদুর্গা’ লিখিয়াছিলেন। ঐ পত্রখানা পোস্ট অফিসে লীগ পাণ্ডাদের হাতে ধরা পড়ে। উহা আনিয়া গুরুমহাশয়কে ঘর হইতে ডাকিয়া পুকুরপাড়ে নিয়া ‘শ্রীদুর্গা’ লেখার জন্য কৈফিয়ৎ তলব করা হয়। পরিশেষে এই অপরাধে তাঁহাকে হত্যা করা হয়।

করপাড়ার অশীতিপর বৃদ্ধ হরিশ পণ্ডিত। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে তাঁহারও বহু ছাত্র। গোলাম সরওয়ারও পণ্ডিত মহাশয়ের প্রাক্তন ছাত্র। পরিণামে সরওয়ারের নিয়োজিত লোকেরই হাতে হরিশ পণ্ডিতের নিধন এক মর্মন্তুদ ঘটনা।

আরো কয়েকজন শিক্ষকও গুণ্ডা ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হইয়াছিলেন, কিন্তু প্রাণে বাঁচিয়া গিয়াছেন। লেখকও তাহার জীবনের জন্য দুইজন নিরক্ষর মুসলমান যুবকের নিকট চিরঋণী।”

(নোয়াখালীর ইতিকথা : নলিনীরঞ্জন মিত্র
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক–খিলপাড়া হাই স্কুল, নোয়াখালী)

ভূলতে চাইলেও ভোলা যায় না : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

১৬ই অক্টোবর ১৯৪৬। ভোরে ঘুম থেকে জেগেই, যারা আবার চিরনিদ্রায় আশ্রয় নিয়েছে, সেদিন তারা জানতেও পারেনি কি ছিল তাদের অপরাধ।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নোয়াখালির রামগঞ্জ থানার অধীনস্থ গ্রামগুলিতে শুরু হয় হত্যা, নিপীড়ন, নারী-ধর্ষণ ও অগ্নিকাণ্ড, যেন রক্তাগুনের হোলী উৎসব।

মর্মভেদী আর্তনাদ, অগ্নির লেলিহান শিখা ও পোড়া দুর্গন্ধে দিগদিগন্ত ব্যাপৃত প্রতিধ্বনিত।

নিরীহ, নিরপরাধ, নিরস্ত্র হতচকিত বিহ্বল মানুষকে যে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে, অথবা ভাতের থালার সামনে থেকে তুলে এনে, শ্বশুর-স্বামী, পুত্র কন্যার সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে গণধর্ষণ করতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন হত। কিন্তু তবুও তা নিষ্ঠুর সত্য।

দিনের পর দিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যে বীভৎস বর্বরতার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, সেক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ ক্ষমার নামান্তর।

গ্রামকে গ্রাম ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ ও নামান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ ইসলাম ধর্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই ধর্মানুযায়ী নূতন নাম পেয়েছেন সবাই।

আমি তখন রামগঞ্জ থানার অধীন সাহাপুর হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। থাকি খালিশপাড়া (মামাবাড়ী) রমণীমোহন চক্রবর্তীর বাড়ীতে।

ধর্মান্তরকরণের পর আমার নাম হয়েছে ‘মৌলভী হায়দার আলি চৌধুরী ঠাকুর।’ নামগুলি আমাদের নিজেদের পছন্দ করতে হয়েছে। আমরা (মামাবাড়ীর) সকলে ইতিহাস থেকে একটা একটা নাম বেছে নিই। চৌধুরী ঠাকুর ও মৌলভী আমাদের বংশ মর্যাদা ও উচ্চবর্ণের পরিচয় হিসাবে তারাই দিয়েছে।

যতদূর মনে পড়ছে অক্টোবরের শেষ দিকে অর্থাৎ ২৮/২৯ তারিখ হবে। তারা আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে, আমাদের বাড়ীতে ও গ্রামে (খালিশ পাড়া) কোন ঘটনা ঘটে নাই। আমরা শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে বাস করছি।

পরে জেনেছি এর পিছনে একটা গুজব কাজ করেছে। নোয়াখালির গ্রাম্য ভাষায় লোহার রডকে শিক বলে। এক ওয়াগন রড চৌমুহনী স্টেশনে আসে। সেই কথাটাই মুখে মুখে রটে যায় চৌমুহনীতে এক গাড়ী শিখ সৈন্য এসেছে।

অবশ্য আরো একটা কারণ ছিল। পরম শ্রদ্ধেয় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কয়েক হাজার হিন্দুমহাসভার ভলান্টিয়ার পাঠান যাদের গোয়ালন্দে আটকে রাখেন লীগ সরকার। সেই হিন্দু মহাসভার ভলান্টিয়াররা বহু লোককে (হিন্দু দুর্গতদের) থাকার আশ্রয় দিয়েছিলেন গোয়ালন্দে।

তখন (ঘটনার সময়) নোয়াখালি জেলার গ্রামে গঞ্জে একটি ছড়া মুখে মুখে ঘুরে ফিরেছে। ছড়াটি :

“হুনছেন নিও মিঞা ভাই—
গোলাম সারোয়ার মিঞার মতন
খাট্টি মাইনষ আর নাই।”

এই গোলাম সরোয়ারই ছিল সকল বর্বরতা ও হত্যাকাণ্ডের নায়ক। কার্যতঃ আমরা বন্দী ছিলাম প্রায় ১০ দিনের মত। প্রতিদিন আমাদের নামাজ পড়তে হতো—আজান দিতে হতো যথানিয়মে; তা প্রত্যক্ষ করতো একজন গোঁড়া মুসলমান অথবা মৌলভী। পরে সুযোগমত ঘুরে ঘুরে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে জানতে পারি সব বর্বরোচিত হিংস্রঘটনা ও নিজে চোখে দেখতে পাই দৃশ্যাবলী।

শ্রীপ্রিয়কুমার চক্রবর্তী
বাটানগর, দঃ ২৪ পরগনা,
২৮/৩/৯২

আর একজন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা

আমি শ্রীহরিভূষণ দাস (কবিরাজ)। আমার বাড়ী ছিল নোয়াখালি জিলার রামগঞ্জ থানার অধীন সিন্দুরপুর গ্রাম। আমি বাড়ী থেকে কবিরাজী চিকিৎসা করি। ইংরাজী ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে নোয়াখালি রায়ট আরম্ভের কয় দিন পূর্ব হইতে মুসলমানগণ হাটে বাজারে সভা করে। একদিন আমি খিলপাড়া ও অন্যান্য গ্রাম থেকে রুগী দেখিয়া আসার সময় সোমপাড়া বাজারে সভা হইতে দেখি। হাজার হাজার উত্তেজিত মুসলমান চারদিকে। আমি তখন ধানহাটার কাছে দাঁড়াই। দেখি সোমপাড়া বাজারের উপেন ডাক্তারকে সভাপতি করে সভা চলছে। তার অবস্থা বলির পাঁঠার মত। কাসেম মিয়া (মুসলিম-লীগের পাণ্ডা) বক্তৃতা করছে। সে বলে— ভাইছাবরা, গরু পালে মুসলমানরা—দুধ খায় কারা? এই হিন্দুরা। হাঁস পালে মুসলমানরা—আণ্ডা খায় কারা? এই হিন্দুরা। বলে সে উপেন ডাক্তারের গালে এত জোরে এক চড় মারে যে ডাক্তার চেয়ার সমেত কাৎ হয়ে পড়ে যায়। তিনি মানী লোক। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমার জানাশুনা কিছু লোক আমাকে বলে—খাড়াই, কি দেখেন, তাড়াতাড়ি পালান। তখন আমি প্রাণপণে বাড়ীর দিকে ছুটতে থাকি।

এইভাবে বাড়ী আসিয়া আটকা পড়ি। বাড়ির বাইর হইবার উপায় নাই। চারদিকে মুসলমানে ঘিরিয়া আছে। ৩/৪ দিন পর পাড়ার মুসলমানগণ বলে— আমরা তোমাদের পাহারা দিব। আমাদের পনের শত টাকা দিতে হবে। তখন আমরা বাড়ির সব পরিবার মিলে চৌদ্দ শত টাকা দেই। এর ফল হল বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। বুধবার দিন নাজিরের কাছারীতে সুরেন্দ্রবাবুকে ও আরও অনেককে কেটে ফেলে। তারপর ৪দিন বাদ দা কাটারি বল্লম খড়গ নিয়া আমাদের বাড়ী আক্রমণ করে। তখন বেলা অনুমান ৯-১০টা। আমরা বৌ-ছেলেমেয়ে সকলে বাড়ী হইতে ছাড়া বাড়ীর (পরিত্যক্ত ও বনজঙ্গলপূর্ণ) দিকে ছুটিতে থাকি। এমন সময় হাজিল মিয়া মোষ-কাটা খড়গ দিয়ে আমার গলায় কোপ দেয়। তখন মুনছুর পাটারী ওর হাতে একটা লাঠি দিয়া বাড়ি মারে। সেই কারণে আমার গলায় কোপটি লাগে নাই। একজন আমার পেটে টেডা (মাছ মারা যন্ত্র) ঢুকাইতেছিল। বলি আমার লগে পয়সা কড়ি যা আছে লইয়া যাও। তারপর আমার হাতের অঙ্গুরী, আমার স্ত্রীর হার-গয়না ও অন্যান্য মেয়েদের গয়না নিয়ে যায়। তারপর আমাদের জুড়ার বাড়ী বলে একটি ছনখোলা (উলুবন) আছে। কাদের মিয়া বলে একজন মুসলমান সকলকে ঐ ছনখোলায় লুকাতে বলে। আর আমি জলে ঝাঁপ দিয়া পড়ি। সেখানে আমার এক কাকা ও দাদা কচুরিপানার ভিতর নাক জাগাইয়া পড়ে আছে দেখি। এর উপর একটি সাপ গায়ের উপর দিয়া চলিয়া যায়। আমি হাতেপায়ে এক মাঠ ধানগাছের ভিতর দিয়া মুসলমান চৌধুরী বাড়ী গিয়া ওদের ঘরের পিছনে একটি কাঁঠাল গাছে উঠিতে চেষ্টা করি। কিন্তু হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাই। আবার উঠি। এর মধ্যে ওদের বাড়ীর বৌঝিরা বলে—কবিরাজবাবু, আমাদের বাড়ী থাকিবেন না। তাহা হইলে আমাদের বাড়ী পোড়াইয়া দিবে।

কয়েকদিন আগে হইতে স্নান খাওয়া নাই। আমার কাপড়ের খোঁটে বাঁধা ১৮২ টাকা ছিল। তাহা মোহুরী বৌয়ের হাতে দিই। এদিকে গাছের উপর থেকে দেখিতে পাই আমাদের বাড়ী হইতে ধান পাট সুপারী নারিকেল টাকা গয়না, বাক্স ট্রাঙ্ক সব লুট করিয়া নৌকা করে নিয়া যাইতেছে।

তারপর বৈকাল অনুমান সাড়ে চারটে কি পাঁচটা, তখন চৌধুরী বাড়ীর হারু মুসলমান—সে আমায় বলে, চলেন আপনাকে নৌকা করে বা দিয়া আসি। নৌকা যখন আমাদের বাড়ীর কাছে তখন খুব হল্লা চিৎকার শুনা যাইতেছে। বনজঙ্গল থেকে বাড়ীর লোকজন সব বাড়ী ফিরে আইছে। আমি বাড়ী গিয়া দেখি আমার এক জ্যাঠতুত ভাই ডাঃ বগলা দাস—তার বহুদিন ছেলেমেয়ে হয় নাই— এই ঘটনার ১১দিন আগে একটি ছেলে হয়েছে। সদ্যপ্রসূতী মা ছেলেকে নিয়ে পালাতে কষ্ট হচ্ছে বলে অন্য একজন স্ত্রীলোকের হাতে দেয়। তার হাত থেকে ছেলে পড়ে যায় ও জলে ডুবে যায়। সে তাকে জল থেকে তুলে এক জঙ্গলে বসে বাচ্চা নিয়া কাঁদছে। পরে খোঁজ পাওয়া গেল। যাক্ বাচ্চাটি বেঁচে গেল (এখন সে ঠাকুরপুকুরে আছে)।

এদিকে এক মুসলমান এসে সংবাদ দিল আমাকে, মুকুন্দ ভট্টকে (প্রতিবেশী) ও বগলা ডাক্তারকে আগে কেটে ফেলবে। এরপর অন্যদের কাটবে। সন্ধ্যার পর আমি আর মুকুন্দ ভট্ট বাড়ী হইতে মুসলিম লীগ অফিসের দিকে যাবার সময় মুকু পাটারীর হাতে পড়ি। সে তার বাড়ী নিয়া কাটবার লোকদের সংবাদ দিতে যায়। অবস্থা বুঝিতে পারায় তারই বাড়ীতে অন্য ঘরে ছায়েদুল্লা পাটারীর ঘরে যাই। কারণ তার স্ত্রীর খুব অসুখ। আমি তার চিকিৎসা করিতেছি। তার বিছানা ছেড়ে নড়িবার ক্ষমতা নাই। আমাদের দেখে কাঁদিতে কাঁদিতে বলে ছায়েদুল্লা বাজারে গেছে। আপনারা বসেন। কতক্ষণ বসার পর আমরা আর স্থির থাকিতে না পারায় ঘরের পিছনে খালে ঝাঁপ দিয়া পালাব এমন সময় ছায়েদুল্লা এসে পড়ে। পরে নৌকা করে সে রহমান শেখের বাড়ী নিয়া যায়। রহমান আমাদের একঘরে একটি পাটি পেতে দেয় এবং দুইখানা খেজুর গাছ কাটা ছেনী (হেঁসো) দিতে চায়। আমরা বলি তার আমাদের দরকার নাই। সে তখন নিজে একখানা ছেনী নিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে। পরের দিন আমরা দুইজন আর শোয়া থেকে উঠিতে সাহস পাইতেছি না। এমত অবস্থায় ভাল কিছু মুসলমান আসিয়া আমাদের শোয়া থেকে উঠায়।

তাদের পরামর্শে আমরা মুসলমান হতে রাজী হলে তারা আমাদের মসজিদে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের কলমা পড়তে হয়। তাদের দেওয়া টুপি পরে আমরা মুসলমান হলাম এবং প্রাণে বেঁচে গেলাম। তারপরের কথা তো সবই জানা আছে।

শ্রীহরিভূষণ দাস (কবিরাজ)
নঙ্গী ধর্মতলা
বাটানগর, দঃ ২৪পরগনা
২৫/১২/৯৭

নোয়াখালি জেলার উপদ্রুত এলাকার হিন্দুদের উপর এই একতরফা উৎপীড়ন নিরবচ্ছিন্নভাবে ১০দিন ধরে চলে। হাঙ্গামার খবর যাতে বাইরে প্রকাশ না পায়, তজ্জন্য সরকারী পর্যায়ে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রথম খবর কলকাতায় এসে পৌঁছায় ৫ দিন পর—তাও অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকরভাবে। ক্রমে ঘটনার ভয়াবহতা প্রকাশ পেলে সারা দেশের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা নোয়াখালি ছুটে যান। কংগ্রেস সভাপতি আচার্য জে. বি. কৃপালনী বিমানযোগে দাঙ্গাবিদ্ধস্ত এলাকা পরিদর্শন করে নিম্নোক্ত বিবৃতি দেন :

রাষ্ট্রপতি (কংগ্রেস সভাপতি) কৃপালনীর বিবৃতি

রাষ্ট্রপতি আচার্য কৃপালনী নোয়াখালির উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করিয়া ফিরিয়া আসিবার পর তথাকার অবস্থা সম্পর্কে ২৬শে অক্টোবর এক সাংবাদিক সম্মেলনে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। অবস্থা স্বচক্ষে পরিদর্শন করিয়া ও বিভিন্ন সূত্র হইতে স্বয়ং তথ্য সংগ্রহ করিয়া আক্রমণের উদ্যোক্তা, তাহাদের উদ্দেশ্য ও অনুসৃত কর্মপন্থা এবং ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে তিনি কতকগুলি সিদ্ধান্তে আসিয়া উপনীত হন। তিনি বলেন, তাঁহার গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ সত্য ও সঠিক; সাক্ষীদিগকে তাঁহাদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দিলে নিরপেক্ষ ট্রাইবুন্যালের সম্মুখে তাঁহার সিদ্ধান্তগুলির সত্যতা অতি সহজে প্রমাণিত হইতে পারে।

আচার্য কৃপালনী নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহে পৌঁছেন :

(১) নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলায় হিন্দুদের উপর পূর্ব হইতেই পরিকল্পনা করিয়া আক্রমণ চালানো হয়। মুসলিম লীগ সাক্ষাৎভাবে এই আক্রমণ না বাধাইলেও মুসলিম লীগের প্রচারকার্যের ফলে ইহা সংঘটিত হইয়াছে। স্থানীয় লোকদের সাক্ষ্য হইতে ইহাই প্রমাণিত হইয়াছে যে, এই আক্রমণে বিভিন্ন গ্রামের বিশিষ্ট লীগ-নেতাদের অনেকখানি হাত ছিল।

(২) বিপদের আশঙ্কা জানাইয়া কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হইয়াছিল। সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহের বিশিষ্ট হিন্দুরা প্রথমে মৌখিকভাবে পরে লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করিয়াছিলেন।

(৩) যে আয়োজন উদ্যোগ চলিতেছিল, তাহার সহিত কয়েকজন মুসলমান সরকারী কর্মচারীর যোগাযোগ ছিল। কয়েকজন উৎসাহ দিয়াছিলেন।

মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে একটা বিশ্বাস ছিল যে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোন কিছু করিলে গভর্নমেন্ট কিছু বলিবেন না।

(৪) কয়েক শত লোকের এক-একটা দল বিভক্ত হইয়া হিন্দু-গ্রাম অথবা হিন্দু-মুসলমানমিশ্রিত গ্রামের হিন্দু বাড়ীগুলি আক্রমণ করাই ছিল আক্রমণকারীদের কার্যপদ্ধতি। দলে এক-একজন দলপতি ও মুখপাত্র থাকিত। তাহারা প্রথমে মুসলিম লীগের এবং কোথাও কোথাও বা কলিকাতার দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের নাম করিয়া চাঁদা আদায় করিত। এইভাবে জবরদস্তি করিয়া তাহারা বহু টাকা আদায় করে এবং আদায়ের পরিমাণ কোথাও কোথাও দশ হাজার টাকাও ছাড়াইয়া যায়। চাঁদা দিয়াও হিন্দুরা নিস্তার পায় নাই। চাঁদা আদায় করার পর ঐ দলই বা পরবর্তী দল আসিয়া হিন্দু-বাড়ীগুলি লুঠ করিতে থাকে। অধিকাংশ লুণ্ঠিত বাড়িতেই আগুন ধরাইয়া দেওয়া হয়। দুর্বৃত্তেরা কেবলমাত্র নগদ টাকা, অলঙ্কার ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য লুন্ঠন করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, গৃহস্থদের ব্যবহারে যাহা কিছু লাগিতে পারে—আহার্য, বাসনপত্র, কাপড়চোপড় কিছুই বাদ দেয় নাই। অনেক স্থলে লুণ্ঠিত গরুবাছুর ইত্যাদি গৃহপালিত জন্তুগুলিও নিজেরাই তাড়াইয়া লইয়া যায়। কোথাও কোথাও কোন কোন বাড়ী লুঠ করার আগে বাড়ীর লোকজনদের ইসলামধর্ম গ্রহণ করিতে বলা হয়। কিন্তু ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াও তাঁহারা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ হইতে রেহাই পান নাই।

(৫) আক্রমণকারী জনতা মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, মারকে লেঙ্গে পাকিস্তান ইত্যাদি মুসলিম লীগের ধ্বনি করে।

হিন্দুদের এই কথাও বলা হয় যে, কলিকাতার দাঙ্গায় নিহত মুসলমানদের প্রতিশোধ তুলিবার জন্যই এই হত্যা, লুণ্ঠন ও গৃহদাহ চালানো হইতেছে। যাহারা বাধা দেয়, তাহাদের সকলকেই কোতল করা হইয়াছে। দুর্বৃত্তদের হাতে বন্দুক থাকায় কোথাও কোথাও বাধাদানকারীদের গুলি করিয়া মারা হইয়াছে। এই সকল বন্দুক হয় মুসলমান জমিদারদের ছিল, আর না হয় হিন্দুদের নিকট হইতে অপহরণ বা বলপূর্বক কাড়িয়া লওয়া হইয়াছিল। কোথাও কোথাও হিন্দুরা বাধাদান না করা সত্ত্বেও নিহত হইয়াছে।

আমার হাতে সময় অল্প থাকায় কত লোক নিহত হইয়াছে তাহার সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয় নাই। আমার বিশ্বাস গভর্নমেন্টও সংখ্যা নির্ণয় করেন নাই। জনৈক সরকারী কর্মচারী আমাকে বলেন যে, মাত্র একশত জন মারা গিয়াছে। আরও উচ্চপদস্থ অপর একজন সরকারী কর্মচারী আমাকে বলেন যে, নিহতের সংখ্যা ৫ শতের কাছাকাছি হইবে।

(৬) পার্শ্ববর্তী মুসলমান গ্রামসমূহের অধিবাসীরাই লুঠতরাজ, গৃহদাহ, হত্যাকাণ্ড ও পাইকারীভাবে ধর্মান্তরিতকরণ চালায়। যে যে গ্রামে হিন্দু মুসলমান একত্রে বাস করিত, সেই সেই গ্রামের মুসলমানরাই হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই সকল কাজে যোগ দেয়। যাহারা এই সকল কাজে যোগদান করিয়াছিল, তাহাদের অনেককেই আক্রান্ত ব্যক্তিরা সনাক্ত করিতে পারিবে। তাহারা আমাকে বহু নামের তালিকা দিয়াছে। বাহির হইতে যদি কোন লোক আসিয়াও থাকে, তাহাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।

(৭) লুঠতরাজ, গৃহদাহ ও হত্যাকাণ্ডের পরও ইসলামধর্ম গ্রহণ না করা পর্যন্ত হিন্দুদের বিপদ কাটে না। প্রাণের দায়ে বাধ্য হইয়া হিন্দুরা পাইকারীভাবে ইসলামধর্ম গ্রহণ করে। নূতন ধর্মগ্রহণের চিহ্নস্বরূপ তাহাদের গ্রামের মুসলমানদের ব্যবহৃত সাদা টুপি পরিতে দেওয়া হয়। টুপিগুলির অনেকগুলিই নূতন এবং এইগুলিতে পাকিস্তানের মানচিত্র এবং পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ এবং ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ছাপ মারা ছিল।

হিন্দুদের শুক্রবারের জুম্মা নমাজে লইয়া যাওয়া হয় এবং তাহাদের নমাজ ও কলমা পড়িতে বাধ্য করা হয়। মহিলাদের শাঁখা ভাঙ্গিয়া ও সিঁদুর মুছিয়া ইসলামে দীক্ষা দেওয়া হয়। ধর্ম পরিবর্তনের চিহ্নস্বরূপ তাহাদের পীর কর্তৃক মন্ত্রপূত বস্ত্র স্পর্শ করিতে বলা হয়। মহিলাদের কলমা পাঠ করিতে হয়। হিন্দুগৃহে সমস্ত দেবমূর্তি ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছে এবং উপদ্রুত অঞ্চলের সমস্ত হিন্দু দেবালয় লুণ্ঠিত ও অগ্নিদগ্ধ করা হইয়াছে।

(৮) বলপূর্বক অনেকগুলি বিবাহও হইয়াছে। বর্তমানে এইরূপ বিবাহের সংখ্যা নিরূপণ করা অসম্ভব। শ্রীযুক্তা কৃপালনীর নিকট হইতে বিস্তৃত রিপোর্ট পাইয়া নোয়াখালির ইউরোপীয় ম্যাজিস্ট্রেট একটি বালিকাকে উদ্ধার করেন। দত্তপাড়ায় একটি উদ্ধার-শিবিরে জনৈক স্ত্রীলোক শ্ৰীযুক্তা কৃপালনীকে সমস্ত ঘটনা বলিয়াছিলেন। বহু নারী অপহৃতা হইয়াছে। কিন্তু আমার হাতে সময় অল্প বলিয়া আমার পক্ষে তাহার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয় নাই।

(৯) ধর্ষিতার সংখ্যা নির্ণয় করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু অনেক স্ত্রীলোক শ্ৰীযুক্তা কৃপালনীর নিকট তাহাদের প্রতি অত্যাচারের নিদর্শনস্বরূপ বিবাহিত জীবনের প্রতীক শাঁখা ভাঙ্গিয়া দেওয়ার এবং সিঁদুর মুছিয়া দিবার কাহিনী বর্ণনা করিয়াছেন। একস্থানে দুর্বৃত্তেরা স্ত্রীলোকদের মাটিতে ফেলিয়া পায়ের আঙ্গুল দিয়া তাহাদের সিঁদুর মুছিয়া দেয়।

(১০) এই সকল অঞ্চলের হিন্দুরা ইসলামধর্ম গ্রহণ করুক বা না করুক কোন অবস্থাতেই নির্ভয়ে বাস করিতে পারিতেছে না।

(১১) লীগ প্রহরীরা উপদ্রুত গ্রামসমূহের প্রবেশপথগুলি আগলাইয়া আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে নবদীক্ষিতদের ছাড়পত্র লইয়া গ্রামের বাহিরে যাইতে দেওয়া হইয়াছে। এই সকল ছাড়পত্র আমি দেখিয়াছি।

(১২) হাঙ্গামার সময় যাহারা উপদ্রুত গ্রামের বাহিরে ছিল, তাহারা নিজেদের গ্রামে যাইতে সমর্থ হয় নাই।

(১৩) বহু পরিবারের পুরুষ-স্ত্রীলোক বালক-বালিকা নিখোঁজ। তাহাদের সন্ধান লইবার কোন উপায় নাই। গ্রামের পোস্ট-অফিসসমূহেও কোন কাজ হইতেছে না।

(১৪) হাঙ্গামার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। তাহারা এখন টহল দিতেছে। তাহারা বলে যে, একমাত্র আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া তাহাদের প্রতি গুলি চালাইবার হুকুম ছিল না এবং এখনও নাই। তাহাদের আত্মরক্ষার কোনো প্রয়োজন দেখা দেয় নাই, কারণ তাহারা হাঙ্গামাকারীদের কাজে বাধা দেয় নাই।

২০শে তারিখ পর্যন্ত যে অগ্নিসংযোগ চলিতেছিল তাহার প্রমাণ আমি দিতে পারি। আমি ১৯শে ও ২০শে তারিখে বিমান হইতে চাঁদপুর ও নোয়াখালি অঞ্চলে আগুন জ্বলিতে দেখি। প্রধানমন্ত্রীও ২০শে তারিখে এই আগুনগুলি দেখিয়াছিলেন। কেবলমাত্র ভস্মীভূত গৃহ এবং অসহায় হিন্দুদের আমি দেখিতে পাই। সর্বস্বান্ত হিন্দুদের পরিধেয়ও নাই, খাদ্যও নাই।

আমি সরকারী কর্মচারীদের মুখেই শুনিয়াছি যে, ২৫শে তারিখ পর্যন্ত নোয়াখালি অঞ্চলে মাত্র ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে।

একটি প্রশ্নের উত্তরে আচার্য কৃপালনী বলেন যে, পূর্ববঙ্গে যাহা ঘটিতেছে তাহা অর্থনৈতিক কারণে ঘটিতেছে না। কারণ একটিও ধনী মুসলমানের গৃহ লুণ্ঠিত হয় নাই। তাঁহার নিকট ইহা সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক এবং সম্পূর্ণ একতরফা বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছে।

উপসংহারে তিনি প্রত্যেক বাঙালী হিন্দুকে শান্ত ও সংযত থাকিতে অনুরোধ করিয়া বলেন যে, পূর্ববঙ্গের উপদ্রুত অঞ্চলের মর্মান্তিক ঘটনাবলী ভাষায় বর্ণনার অতীত হইলেও তাঁহারা যেন প্রতিশোধের কথা চিন্তা না করেন।

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতি : দাঙ্গার ভয়াবহতা

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার উপদ্রুত অঞ্চলে সফর করিয়া আসিয়া এক বিবৃতিতে বলেন যে, ব্যাপক ভাবে ধর্মান্তরিত করাই সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল। যে সহস্র সহস্র নর-নারীকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হইয়াছে, তাঁহারা হিন্দু ছিলেন, তাঁহারা এখনও হিন্দু এবং আমৃত্যু হিন্দু থাকিবেন। তাঁহারা কিছুমাত্র প্রায়শ্চিত্ত না করিয়া হিন্দু সমাজে পুনরায় ফিরিয়া আসিতে পারিবেন।

ডঃ মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতি নিম্নে দেওয়া হইল :

“নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলায় উপদ্রুত অঞ্চলের ঘটনাবলীর মধ্যে এমন একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যাহা ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। অবশ্য ইহাকে কোনক্রমেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা চলে না। ইহা সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্ঘবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত আক্রমণ। এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিতকরণ এবং লুণ্ঠন, গৃহদাহ এবং সমস্ত বিগ্রহ ও দেবমন্দির অপবিত্রকরণ। কোন শ্রেণীর লোককেই রেহাই দেওয়া হয় নাই। যাহারা অপেক্ষাকৃত ধনী, তাহাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা আরও কঠোর হয়। হত্যাকাণ্ডও পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল; কিন্তু যাঁহারা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং যাঁহারা প্রতিরোধ করেন, প্রধানতঃ তাঁহাদের জন্যই এই ব্যবস্থা ছিল। নারীহরণ, ধর্ষণ এবং বলপূর্বক বিবাহও এই সকল কুকার্যের অঙ্গ ছিল। কিন্তু এই প্রকার নারীর সংখ্যা কত, তাহা সহজে স্থির করা সম্ভব নহে। যে সকল ধ্বনি উচ্চারিত হয় এবং যে সকল কার্যপদ্ধতি অবলম্বিত হইয়াছিল তাহাতে দেখা যায় যে, এ সমস্তই সমূলে হিন্দু-লোপ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটি পরিকল্পনার অন্তর্গত ছিল। মুসলিম লীগের জন্য এবং ধর্মান্তরিতকরণ অনুষ্ঠানের ব্যয় ইত্যাদি অন্যান্য কারণে চাঁদা চাওয়া হইয়াছিল। ইহা হইতে দেখা যায় যে, আক্রমণকারিগণ ও তাহাদের দলপতিরা মুসলিম লীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল। তাহা ছাড়া তাহারা আরও জানিত যে, প্রদেশে তাহাদের নিজেদের গভর্নমেন্ট রহিয়াছে এবং তাহাদের স্ব-সম্প্রদায়ভুক্ত স্থানীয় রাজকর্মচারীরাও সাধারণতঃ তাহাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এই প্রকার ধারণার বশবর্তী হইয়া কুকার্যে তাহাদের সাহস আরও বাড়িয়া যায়।

****

এই সকল কুকীর্তির নায়ক একদল গুণ্ডা ছিল অথবা তাহাদের অধিকাংশই বাহির হইতে আসিয়াছিল—এরূপ বলিলে মিথ্যা বলা হইবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকরা এইসব পৈশাচিক কাণ্ড করে এবং সাধারণভাবেই এই সকল কার্যের প্রতি লোকের সহানুভূতি ছিল। কয়েক ক্ষেত্রে মুসলমানরা লোকের প্রাণ বাঁচাইতে সাহায্য করিয়াছে; কিন্তু তাহাদের সংখ্যা অতি নগণ্য।

এভাবে যাহাদের জীবন রক্ষা পায়, তাহারা পলায়নে অসমর্থ হইলে তাহাদিগকে ধর্মান্তরিত হইয়া গ্রামে থাকিতে হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে এবং তাহাদের ধনসম্পত্তিও লুন্ঠন হইতে রক্ষা পায় নাই। ভাবী বিপদের আশঙ্কা পূর্বাহ্ণেই কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা হইয়াছিল। কিন্তু যাহারা দিনের পর দিন বিদ্বেষ ও হিংসা প্রচার করিতেছিল, সেইসব প্রকাশ্য প্ররোচকদের কার্যকলাপ বন্ধ করিতে তাঁহারা চেষ্টা করেন নাই। যখন সত্যসত্যই হাঙ্গামা বাধিয়া উঠিল এবং কয়েকদিন যাবৎ চলিতে লাগিল, কর্তৃপক্ষ তখন লোকের ধন-প্রাণ রক্ষা করিতে অপারগ হইলেন। এই অক্ষমতা দ্বারা তাঁহারা নিজেরাই নিজেদের নিকট ধিকৃত হইয়াছেন এবং স্ব স্ব পদে বহাল থাকা সম্বন্ধে অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়াছেন। বস্তুতঃ তাঁহারা যতক্ষণ উপস্থিত থাকিবেন, ততক্ষণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা সহজ হইবে না। এই প্রকার একটা অঘটন ঘটিয়া যাইবার পরও নোয়াখালিতে মাত্র প্রায় ৫০ জনকে এবং ত্রিপুরায় জনকতককে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে।

সহস্ৰ সহস্ৰ লোক বিপজ্জনক এলাকার অন্তঃস্থল হইতে পলাইয়া গিয়া অত্যাচারীদের নাগালের ঠিক বাহিরে জেলার ভিতরেই আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। তাহাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। যে সকল স্থান এখনও উপদ্রুত হয় নাই, সেই সকল স্থান হইতেও অধিবাসীরা হাজারে হাজারে পলাইয়া আসিয়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে আশ্রয় লইয়াছে। কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ইত্যাদি স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হইয়াছে। সর্বশ্রেণীর স্ত্রী-পুরুষ শিশুসহ এই সকল আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতের সংখ্যা ৫০ হাজার হইতে ৭৫ হাজার হইবে।

এই সকল লোক ছাড়া আরও প্রায় ৫০ হাজার বা ততোধিক লোক এখনও বিপজ্জনক এলাকায় রহিয়াছে। এই এলাকাকে বেওয়ারিশ এলাকা বলা যাইতে পারে। এই এলাকায় অবরুদ্ধ ব্যক্তিদিগকে একদিনও বিলম্ব না করিয়া উদ্ধার করিতে হইবে। তাহাদের সকলকেই ধর্মান্তরিত করা হইয়াছে এবং তাহারা এখনও অত্যাচারীদের হাতের মুঠার ভিতরে। তাহারা এখন নামেমাত্র মানুষ। তাহাদের আধ্যাত্মিক মৃত্যু ঘটিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশ‍ই সর্বস্বান্ত এবং তাহাদের শরীর, মন দুই-ই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। তাহাদের মধ্যে তপসিলী বা অন্যান্য শ্রেণী-নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণীর হিন্দু আছে। তাহাদের উপর যে অপমান ও নির্যাতন চলিয়াছে, তাহার সীমা নাই। তাহাদের নাম পরিবর্তন করা হইয়াছে, তাহাদের স্ত্রীলোকেরা অপমানিত হইতেছে, তাহাদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠিত হইয়াছে, তাহাদের মুসলমানের মত পোশাক পরিতে, আহার করিতে ও জীবনযাত্রা যাপন করিতে বাধ্য করা হইতেছে। পরিবারের পুরুষদিগকে মসজিদে যাইতে হয়। মৌলভী বাড়ীতে আসিয়া তাহাদিগকে শিক্ষা দেয়। আহার্যের জন্য—এমন কি অস্তিত্ব পর্যন্ত টিকাইয়া রাখিবার জন্য তাহাদিগকে তাহাদের অবরোধকারীদের দয়ার উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হয়। তাহারা যাহাতে তাহাদের সমাজ হইতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতে পারে, সেজন্য তাহাদিগকে দ্রুত পরিবর্তনের ভিতর দিয়া লইয়া যাওয়া হইতেছে। তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া গেলেই তাহাদের আত্মসমৰ্পণ সম্পূর্ণ হইবে।

তাহারা প্রতিবাদ করিতে সাহসী হয় না; এমন কি বাহির হইতে যেসব হিন্দু তাহাদের গৃহে আসে, তাহাদের সহিত তাহারা দেখা পর্যন্ত করিতে সাহস করে না—যদি না আগন্তুকদের সহিত সশস্ত্র প্রহরী থাকে। পূর্বে যাহারা নেতৃস্থানীয় হিন্দু ছিল, তাহাদের পুরাতন এবং নূতন উভয়বিধ নাম ব্যবহার করিয়া প্রচারপত্র বিলি করা হইতেছে যে, তাহারা নূতন ধৰ্ম গ্ৰহণ করিয়াছে এবং সকলকে ভবিষ্যতেও বর্তমানের মত অবস্থায় থাকিতে অনুরোধ করিতেছে, তাহারা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া মহকুমা হাকিমদের নিকট আবেদন পাঠান হইতেছে। বাহিরে যাইতে হইলে তাহারা স্থানীয় মুসলিম নেতাদের স্বাক্ষরিত ছাড়পত্র লইয়া বাহিরে যাইতে পারে। আমরা যখন নোয়াখালির নিকট চৌমূহনীতে ছিলাম তখন তাহাদের কয়েকজন তথায় উপস্থিত হইতে সমর্থ হয়। দুইজন মুসলিম লীগ মন্ত্রী ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের সহিত তথায় আলোচনা করিতেছিলেন। আগন্তুকরা তাঁহাদের সম্মুখেই নিজেদের মর্মবিদারী কাহিনী বর্ণনা করে।

এখন সর্বাপেক্ষা জরুরী সমস্যা হইতেছে যে বহুসংখ্যক লোক এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মুষ্টির ভিতরে রহিয়াছে, তাহাদিগকে উদ্ধার করা। গ্রামগুলি পাহারা দিয়া রাখায় এবং রাস্তাঘাট বন্ধ করিয়া রাখায় এতদিন কাহারও পক্ষে উপদ্রুত এলাকায় প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ছিল। এখন মিলিটারী উপদ্রুত এলাকায় যাতায়াত করিতে থাকায় ঐ এলাকায় যাতায়াত ক্রমশঃ সহজ হইয়া আসিতেছে। কিন্তু কেবল যাতায়াত করিলেই চলিবে না, ঐ সঙ্গে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদিগকে প্রত্যেকটি গ্রামে প্রবেশ করিয়া অবরুদ্ধ এলাকায় সহস্র-সহস্ৰ হতবল হিন্দুর মনে বিশ্বাস ও নিরাপত্তার ভাব ফিরাইয়া আনায় সাহায্য করিতে হইবে।

সামরিক কর্তৃপক্ষ উপদ্রুত প্রত্যেকটি গ্রামে প্রবেশ করিবেন সিদ্ধান্ত করায় ভালই হইয়াছে। একে তো যাতায়াতের অসুবিধার জন্য তাঁহারা ইচ্ছামত দ্রুত যাতায়াত করিতে পারিবেন না, তদুপরি উপদ্রুত অঞ্চল হইতে যদি কয়েকজন স্থানীয় সরকারী কর্মচারীকে সরানো না হয়, তবে সামরিক কর্তৃপক্ষও পুরোপুরি কাজ করিতে পারিবেন না। অবিলম্বে পিটুনী-করও বসাইতে হইবে। ১৯৪২ সালের আন্দোলনের সময় কেবলমাত্র হিন্দুদের উপর পাইকারী জরিমানা ধার্য হইয়াছিল। বর্তমান দুর্বিপাকে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়কে রক্ষা করিতে না পারায়ও পিটুনী-কর ধার্য করা সঙ্গত। বিষয়টি যখন আমি কয়েকজন স্থানীয় সরকারী কর্মচারীর সহিত আলোচনা করিতেছিলাম, তখন আমাকে বলা হয় যে, অনেক মুসলমান তাহাদের প্রতিবেশীকে সাহায্য করিয়াছিল। এ সম্বন্ধে আমার প্রস্তাব এই যে, কেহ যদি কর মকুবের দরখাস্ত করে, তবে দরখাস্তকারীকে প্রমাণ করিতে হইবে যে, সে সত্যই তাহার প্রতিবেশীকে সাহায্য করিয়াছিল। পাইকারী জরিমানালব্ধ অর্থ এবং সরকারী তহবিল হইতেও দুর্গতদিগকে যতদূর সম্ভব শীঘ্র ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।

****

আমাদের সহস্র সহস্র ভ্রাতা-ভাগিনী এইভাবে নতিস্বীকারে বাধ্য হইয়া হিন্দু সমাজের গণ্ডীর বাহিরে চলিয়া গিয়াছেন বলিয়া আমি মনে করিতে পারি না। তাঁহারা হিন্দু ছিলেন,তাঁহারা এখনও হিন্দু এবং তাঁহারা আমরণ হিন্দু থাকিবেন। আমি প্রত্যেককেই বলিয়াছি, হিন্দুসমাজে ফিরিয়া আসিতে হইলে তাহাদিগকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে—কোন ব্যক্তিই এরূপ কোন কথা তুলিতে পারিবেন না। এই নির্দেশের বহুল প্রচার করিতে হইবে। প্রায়শ্চিত্তের কথা উঠিতেই পারিবে না।

যখনই কোন মহিলাকে উপদ্রুত অঞ্চল হইতে উদ্ধার করা হইবে, বলপূর্বক তাঁহাকে বিবাহ করা হইলেও তিনি বিনা বাধায় স্বীয় পরিবারে ফিরিয়া যাইবেন। যে সকল কুমারী উদ্ধার হইবে, যতদূর সম্ভব তাহাদিগকে বিবাহ দিতে হইবে। যদি হিন্দুসমাজও দূরদৃষ্টির সহিত বর্তমান বিপদ উত্তীর্ণ না হইতে পারে, তবে ইহার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।

আমরা চৌমুহনী ও নোয়াখালিতে উদ্ধার, সাহায্য ও পুনর্বসতির জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক একটি কমিটি গঠন করিয়াছি। উপযুক্ত প্রহরায় ৫ জন করিয়া স্বেচ্ছাসেবকের দশটি দল উপদ্রুত অঞ্চলের অভ্যন্তরে যাত্রা করিবে।

আমি এই বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থা মাত্র বিবৃত করিয়াছি। আমরা যা যা দেখিয়াছি ও শুনিয়াছি, সভ্য শাসনের ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। বাংলার অন্যান্য অংশে অবস্থা অতি উত্তেজনাপূর্ণ এবং কলিকাতাসহ কয়েক স্থানেই হাঙ্গামা চলিতেছে। শাসনযন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে এবং ইহার জন্য গভর্নর ও মন্ত্রিসভাই দায়ী। আমরা বারবার সতর্ক করিয়াও বিফল হইয়াছি। আমরা ভালভাবেই দেখিতে পাইতেছি যে, বর্তমান শাসন অব্যাহত থাকিলে এই প্রদেশে ধনপ্রাণ আরও বিপন্ন হইবে।

এই বিপদের সময় হিন্দুদিগকে এ কথাটি হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে যে, তাহারা যদি সঙ্ঘবদ্ধ না হয়, তবে তাহাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইবে। সম্ভবতঃ বিধাতার ইহাই অভিপ্রায় যে, বিশৃঙ্খলা এবং ধ্বংস হইতেই হিন্দুদের সত্যকার জাগরণ আসিবে।

এই দুঃসময়েও আমরা যেন ভুলিয়া না যাই যে, আমরা ৩ কোটি হিন্দু বাংলাদেশে বাস করিতেছি। আমরা যদি সঙ্ঘবদ্ধ হই এবং আমাদের একটি অংশ যদি কোন বিপদেই ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দৃঢ় সঙ্কল্পের সহিত সঙ্কটের সম্মুখীন হইতে প্রস্তুত হয়, তবে আমরা সমস্ত আক্রমণকারীকে পরাভূত করিয়া আমাদের মাতৃভূমিতে আমাদের সম্মানের আসন পুনরধিকার করিতে পারিব।”

প্রথমে কলকাতা—পরে নোয়াখালি; ক্রমে সমগ্র বঙ্গদেশ। একই ইতিহাস। হিন্দুদের স্বেদ অশ্রু ও রক্তক্ষরণের ইতিহাস। মা-বোনের ইজ্জত হানির ইতিহাস। আর তার বিনিময়েই আমাদের স্বাধীনতা। চলছে তারই ৫০ বর্ষ বা সুবর্ণ-জয়ন্তী পালনের তোড়জোড়। সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত ১৬ আগস্ট ও ১০ অক্টোবর। তারও তো ‘Black Golden Jubilee’ বা ‘কালা সুবৰ্ণ-জয়ন্তী’ পালিত হওয়া উচিত। কিন্তু সে ইতিহাস ভুলিয়ে রাখার, ভুল ব্যাখ্যার চলছে সযত্ন প্রয়াস। চলছে জিন্না ও সুরাবর্দীকে মহান মহাত্মা বানাবার প্রচেষ্টা। তার জন্য কলম ও ব্রাস হাতে নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হিন্দু দুর্বুদ্ধিজীবীর দল— যাদের পকেট নাড়া দিলেই পেট্রো-ডলার ঝনঝনিয়ে উঠবে। কিন্তু ইতিহাস কি কাউকে ক্ষমা করে?

নির্যাতিত মা-বোনেদের পাশে

নোয়াখালির হিন্দুদের জীবনে চরম সঙ্কট মুহূর্তে, বিশেষতঃ নারীজাতির উপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা শুনে যে ক’জন মহৎপ্রাণা মহিলা মানইজ্জতের ভয় না করে, স্বামী-সংসারের দিকে না তাকিয়ে অকুতোভয়ে দুর্বৃত্ত কবলিত এলাকায় নির্যাতিতা-মা-বোনেদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের চোখের জল মুছিয়েছেন, মনে সাহস জুগিয়েছেন, বাংলার সেসব নির্ভেজাল অগ্নিকন্যাদের মধ্যে ছিলেন সুচেতা কৃপালনী, অশোকা গুপ্ত, স্নেহরানী কাঞ্জিলাল, বীণা দাস, কমলা দাশগুপ্ত, বেলা মিত্র, বকুল গুহরায়, মালতী চৌধুরী, কল্যাণী দত্ত প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সুচেতা কৃপালনী নোয়াখালির উপদ্রুত এলাকা ঘুরে এসে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতে সেখানকার অভ্যন্তরীণ অবস্থার খাঁটি চিত্র পাওয়া যায় :

শ্ৰীযুক্তা সুচেতা কৃপালনীর নিদারুণ অভিজ্ঞতা

শ্ৰীযুক্তা সুচেতা কৃপালনী অত্যাচারের কিছুদিন পরই (২০শে অক্টোবর) সেবাকার্যের জন্য সেখানে উপস্থিত হন। নোয়াখালিতে কিছুদিন সেবাকার্যে রত থাকিবার পর তিনি কর্মোপলক্ষে দিল্লী যান। তিনি পুনরায় ২রা ডিসেম্বর নোয়াখালিতে ফিরিয়া যান। নারীর অসম্মানে দুঃসহ বেদনায় ও ক্ষোভে-অপমানে ব্যথিত চিত্ত লইয়া তিনি নারী উদ্ধার ও নিপীড়িত নারীদের অশ্রুজল মোচন করিবার উদ্দেশ্যে নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া ভয়াবহ সুদূর পল্লী অঞ্চলে সেবাকার্যে আত্মনিয়োগ করেন।

দ্বিতীয়বার নোয়াখালিযাত্রার পূর্বে শ্রীযুক্তা কৃপালনী বলেন যে, নোয়াখালি হইতে চলিয়া আসার ইচ্ছা তাঁহার মোটেই ছিল না। তথায় ব্যাপকভাবে লুঠতরাজ, নারীহত্যা ও গৃহে অগ্নিসংযোগ বন্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নরনারী তথায় নিজেদের অতি সামান্য মাত্রায় নিরাপদ মনে করিতে পারিতেছে না। এমন কি গান্ধীজী স্বয়ং জানাইয়াছেন, তিন সপ্তাহ অবস্থানের পরও কোনরূপ আলোকের সন্ধান পাইতেছেন না।

শ্রীযুক্তা কৃপালনী বলেন, “আমি দেখিয়াছি বহু গ্রামে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রাদায়ের সমস্ত নরনারীকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হইয়াছে। এইভাবে ধর্মান্তরিত নরনারীদের বহু মেয়েকে অপর সম্প্রদায়ের লোকের সহিত বিবাহ দিতে বাধ্য করা হইয়াছে অথবা তজ্জন্য চাপ দেওয়া হইতেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোক হিসাবেই তাঁহারা স্বগ্রামে বসবাস করিতে পারেন। তাঁহাদের অপর সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণে যোগ দিতে এবং শাস্ত্রনিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করিতে বাধ্য করা হইয়াছে।

“উপদ্রুত অঞ্চল হইতে আমি আজ দূরে অবস্থান করিতেছি বটে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের হতভাগ্য নরনারীদের চিন্তায় আমার মন আচ্ছন্ন। তাঁহাদের উপর অত্যন্ত নির্মম অত্যাচার চলিয়াছিল এবং অদ্যাবধি তাঁহারা বহুবিধ দুঃখকষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করিতেছেন। গান্ধীজীর নির্দেশানুসারে আমি ২রা ডিসেম্বর নোয়াখালি যাত্রা করিতেছি এবং নোয়াখালি ও তৎসন্নিহিত স্থানসমূহের অবস্থার উন্নতি না ঘটা পর্যন্ত আমি তথায় থাকিব।

“সফরকালে আমি প্রায় একমাস যাবৎ নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার উপদ্রুত অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করিয়া তথাকার অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছি। কিন্তু বড়ই দুঃখের সহিত আমাকে জানাইতে হইতেছে যে, তথায় অবস্থানকালে কোনরূপ উন্নতি ঘটে নাই। প্রায় চারি শত গ্রামে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নরনারী বসবাস করিতেছেন বটে, কিন্তু আসলে তাঁহারা বন্দী-জীবন যাপন করিতেছেন। সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নরনারীদের অবাধ গতিবিধি রোধ করার জন্য তাঁহাদের গৃহের সন্নিকটে প্রহরী মোতায়েন রাখা হইয়াছে।

সাধারণতঃ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন লোকের ক্ষেত্রে উল্লিখিত ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়। দুর্বৃত্তদল মনে করে ইহারা বাহিরে যাইতে সক্ষম হইলে অভ্যন্তরভাগে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলী প্রকাশ হইয়া পড়িবে।

“বিক্ষিপ্ত নরহত্যা, নারীর উপর অত্যাচার; বলপূর্বক অর্থ আদায় এখনও চলিতেছে। সৈন্য ও পুলিস বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নরনারীর বিশেষ কোনরূপ উপকার সাধিত হইতেছে না— কারণ অধিকাংশ দুর্বৃত্ত ও তাহাদের নেতারা এখনও পর্যন্ত অবাধে চলাফেরা করিতেছে।

“দুর্বৃত্তদের মধ্যে অনেকেই গ্রামের প্রতিপত্তিশালী ও নেতৃস্থানীয় লোক, স্কুলের শিক্ষক, আইনজীবী ও ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য ইত্যাদি আছেন। সুতরাং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের জব্দ ও পীড়ন করা তাহাদের পক্ষে অত্যন্ত সহজসাধ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা ঘটনা সম্পর্কে থানায় এজাহার দেওয়াতে বাদীকে কঠোর নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছে।

“কাহাকেও গ্রেপ্তার করিতে পুলিস একান্ত নারাজ। আমি অনেক ক্ষেত্রেই পুলিসের সহিত দুর্বৃত্ত-সর্দারের বিশেষ গলাগলি ভাব দেখিয়াছি। এই অবস্থা বিদ্যমান বলিয়াই আমি তথায় থাকাকালেও দেখিয়াছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নরনারীগণ দলে দলে বাড়ীঘর ত্যাগ করিয়া যাইতেছেন। সেবা-প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রথম হইতেই ইহা উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নরনারীর মনে আস্থার মনোভাব ফিরাইয়া আনিতে হইলে উক্ত সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকগণের তথায় যাইয়া বসবাস ও তাহাদের মধ্যে কাজ করা অতীব প্রয়োজন।

কিন্তু ইহাও সম্ভব হয় নাই। উপদ্রুত অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদল থাকিলে উপকার হইবে এই বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের স্থানীয় অধিবাসী ও কর্তৃপক্ষ মোটেই উপলব্ধি করতে পারেন নাই। আজে বাজে আপত্তি তুলিয়া তাহারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের গ্রাম হইতে বিতাড়িত করিত। এমন কি, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক নিহতও হইয়াছেন। তাঁহাদের মৃতদেহ পাওয়া সত্ত্বেও কোনরূপ তদন্তকার্য পরিচালিত হয় নাই।

ধর্ষিতা ও অপহৃতা নারীর সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। তবে অনুসন্ধানের ফলে আমি জানিতে পারিয়াছি যে, তাঁহাদের সংখ্যা বহু। সুদূর পল্লী-অঞ্চলে এখনও অনুরূপ ঘটনা ঘটিতেছে। কতক সংবাদপত্রে এই মর্মে এক সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে যে, আমি বহু অপহৃতা নারীকে উদ্ধার করিয়াছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমি একটি অপহৃতা বালিকাকে মাত্র উদ্ধার করিয়াছি।

বহু অপহৃতা নারীকে দূরদেশে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাস হয়। অপহৃতাদের উদ্ধারকার্যে কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা প্রদান না করিলে আমার মনে হয়, অধিকাংশ অপহৃতা নারীর উদ্ধারসাধন সম্ভব হইবে না। অবশ্য এতাবৎ তদ্রূপ সহযোগিতা দানের কোনরূপ আভাস পাওয়া যায় নাই।

কিছুকাল পূর্বে নোয়াখালির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত বলিয়া একটি বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল। প্রকাশ, উহাতে নোয়াখালির শোচনীয় ঘটনাবলীর কতক তথ্যাদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়াছিলেন। এই বিবৃতির প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হইলে পত্রের দ্বারা তিনি আমাকে জানান যে, তাঁহার উক্তির ভুল অর্থ করা হইয়াছে। তাঁহার পত্রের কতকাংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হইল : ‘প্রদত্ত রিপোর্টে আমাকে ইহা বলিতে বাধ্য করা হইয়াছিল যে, নারীহরণ ও বলপূর্বক বিবাহ প্রদানের সংখ্যা নিতান্ত অল্প এবং এই ধরনের কোন সংবাদ তাঁহাকে জানানো হয় নাই। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তদ্রূপ কোন বিবৃতি প্রদান করি নাই। আপনিও জানেন, আরতি নাম্নী বলপূর্বক বিবাহিতা একটি বালিকাকে আমি স্বয়ং ২৫শে অক্টোবর উদ্ধার করিয়াছি। আমার যতদূর স্মরণ আছে, মনে হয়, রিপোর্টার আমাকে প্রশ্ন করেন যে, ধর্ষিতা ও অপহৃতা নারীর সংখ্যা সম্ভবত অল্প-উত্তরে আমি জানাই যে, তাহাদের সংখ্যা জানা যায় নাই। সম্ভবত আমি তাঁহাকে জানাইয়াছিলাম যে, উক্ত রূপ ঘটনা কমই হইয়াছে বলিয়া আমি আশা করি—আরতি নাম্নী বালিকাটিকে উদ্ধারের বিষয় আমি তাঁহাকে জানাইয়াছিলাম কিনা তাহা আমার মনে নাই।’

হত্যা, লুণ্ঠন ও গৃহে অগ্নিসংযোগ ব্যতীত বহু স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বয়কট করা হইতেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষকদের উৎপাদিত দ্রব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোকেরা কিনিতে চাহে না বলিয়া বিক্রীত হয় না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ দোকানদারের দোকানপাট ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। যে কয়েকটি অবশিষ্ট আছে উহাতে ক্রেতার অভাব। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের অপর সম্প্রদায়ের দোকানদারের নিকট হইতেই দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে হয়। দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে গেলে প্রায়ই তাঁহাদের ফিরাইয়া দেওয়া হয়। অথবা অত্যধিক মূল্য দিতে হয়। কোন এক গ্রামে একটি দিয়াশলাই আট আনা মূল্যে তাঁহাদের ক্রয় করিতে হয় বলিয়া আমি অবগত হইয়াছি।

“সুতরাং পূর্ববঙ্গের বর্তমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতিসাধন করিতে হইলে অতীত ঘটনাবলী এবং বর্তমানে যে সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে সেই সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনোভাবেরও আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। অধিক কি, স্বয়ং গান্ধীজী তিন সপ্তাহ অবস্থানের পরও কোনরূপ আলোকের সন্ধান প্রাপ্ত হন নাই। বাংলা সরকারের শুধু মৌখিক সহযোগিতার পরিবর্তে কার্যকরী সহযোগিতা পাইলেই তিনি সফলকাম হইতে পারিবেন। উক্তরূপ সহযোগিতা প্রাপ্তির ফলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের স্থানীয় নরনারী সঙ্গত আচরণ করিতে আরম্ভ করিবেন। অন্যথায় পূর্ববঙ্গ দুষ্টক্ষতস্বরূপ থাকিয়া যাইবে।”

বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসারী কমিটি ১৫ই অক্টোবর সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য নিম্নোক্ত বিজ্ঞপ্তি দেন :

বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কংগ্রেস দলের নেতা শ্রীযুক্ত কামিনীকুমার দত্ত ও বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের কংগ্রেসদলের সহকারী নেতা শ্রীযুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যুক্তভাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতির নিকট এক ‘তার’ করেন। বঙ্গীয় প্রেস এ্যাডভাইসারী কমিটি উহার মর্ম প্রকাশ করেন।

তারে বলা হয় যে, নোয়াখালি জেলার রামগঞ্জ থানার অধীন কয়েকটি গ্রামে আগুন লাগাইয়া দেওয়ায় নিরীহ গ্রামবাসীদের প্রাণ ও সম্পত্তি নাশ হইয়াছে। বেগমগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর থানার কোনও কোনও অঞ্চলেও হাঙ্গামা দেখা দিয়াছে। সহস্র সহস্র গুণ্ডাপ্রকৃতির লোক গ্রামবাসীদের আক্রমণ করিয়া তাহাদিগকে গোহত্যা করিতে ও নিষিদ্ধ খাদ্য ভক্ষণ করিতে বাধ্য করিয়াছে। তাহাদের ঘরবাড়ী সব জ্বালাইয়া দেওয়া হইয়াছে। শত শত গ্রামবাসীকে পোড়াইয়া মারা হইয়াছে ও আরও শত শত লোককে অন্যভাবে হত্যা করা হইয়াছে। বহু স্ত্রীলোককে অপহরণ করা হইয়াছে ও বলপূর্বক বিবাহ করা হইয়াছে। উপদ্রুত গ্রামসমূহে উপাসনা-স্থানগুলি সবই অপবিত্র করা হইয়াছে। অসহায় গ্রামবাসিগণ ত্রিপুরা জেলাতে চলিয়া আসিতেছে। নিরীহ গ্রামবাসীদের প্রাণনাশ ও সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংস নিবারণ করার জন্য জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট ও নোয়াখালির পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট কিছুই করেন নাই। প্রায় দুইশত বর্গমাইল পরিমিত উপদ্রুত অঞ্চলে কাহাকেও যাইতে দেওয়া হইতেছে না, ঐ এলাকা হইতে কাহাকেও আসিতেও দেওয়া হইতেছে না। এই সকল অঞ্চলে যাইবার পথগুলিতে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত গুণ্ডারা সতর্ক পাহারা দিতেছে। এখনও যে সকল লোক বাঁচিয়া আছে ও যে সকল স্ত্রীলোককে অপহরণ করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে উদ্ধার করা একান্ত প্রয়োজন। সামরিক সাহায্য ব্যতীত তাহাদের উদ্ধার করা অসম্ভব। পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা জেলায় গোলযোগ বিস্তৃতি লাভ করিতেছে, ফলে ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক হইয়া উঠিতেছে। ১০ই অক্টোবর হইতে এই গোলযোগ আরম্ভ হয় ও সুসংগঠিত পরিকল্পনানুযায়ী নরহত্যা, লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের তাণ্ডব চলে। নোয়াখালি, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম জেলায় অবিলম্বে সৈন্য মোতায়েন করা একান্ত প্রয়োজন। উদ্ধার ও পুনঃসংস্থাপন আশু কর্তব্য। কয়েকটি স্থানের অধিবাসীদের যেরূপ ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করা হইয়াছে, যে বিপুল সংখ্যক লোক নিহত হইয়াছে, যে বিরাট পরিমাণ ক্ষতি হইয়াছে ও যে সংখ্যক স্ত্রীলোক অপহৃতা হইয়াছে, তাহাতে কলিকাতার দাঙ্গা নিতান্ত তুচ্ছ বলিয়া মনে হইবে। সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, নোয়াখালির আরও কয়েকটি থানায় হাঙ্গামা ছড়াইয়া পড়িতেছে। ত্রিপুরা জেলার হাজিগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, ও লাকসাম থানার কোনও কোনও স্থানেও গোলযোগ দেখা দিয়াছে। যে পুলিস ও সৈন্যদল মোতায়েন করা হইয়াছে তাহা নিতান্তই অপ্রচুর। গুণ্ডার দল সংবাদ আদান-প্রদানের সকল পথ বিচ্ছিন্ন করিয়াছে ও রাস্তাঘাট, সেতুসমূহ ধ্বংস করিয়া চলিতেছে। অবিলম্বে এই ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসলীলা বন্ধ না করা হইলে চট্টগ্রাম বিভাগ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইয়া যাইবে। উপদ্রুত অঞ্চলসমূহে সামরিক আইন জারী করা একান্ত প্রয়োজন।

খবর এল দিল্লীতে

বহির্বিশ্বের লোক এই নৃশংস ঘটনার কথা জানতে পারে পাঁচদিন পর। দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকার হিন্দুদের আত্মীয়-স্বজন যাঁরা এলাকার বাইরে ছিলেন, তাঁরা দিল্লীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান পণ্ডিত নেহরুর কাছে টেলিগ্রাম করেন। তিনি সেগুলি বড়লাট লর্ড ওয়াভেলের কাছে পাঠিয়ে লেখেন :

“I have been receiving daily telegrams from East Bengal and sometimes from Calcutta giving distressing accounts of the conditions there. There have been details of stabbings and murder and looting round about Dacca and elsewhere. People have also come to me who have given exceedingly painful reports of these happenings. It is possible that in their excitement they have exaggerated. But what struck me most was that some of these persons talk to me as the victims of Hitler used to talk in the early thirties. I have not thought it worth-while to trouble you with these reports as my previous references to Bengal have not borne fruit.”

বাংলায় হিন্দুরা কেমন অসহায় এবং তাদের বিপদে নেহরুজীও যে সাহায্যের হাত বাড়াতে কেমন অসহায় পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদের স্থূলাক্ষর বাক্যটিতে তা প্রকাশ পেয়েছে।

কলকাতায় দুঃসংবাদ বয়ে আনেন স্বামী ত্র্যম্বকানন্দ

বহির্বিশ্বে নোয়াখালির এই নারকীয় দাঙ্গাহাঙ্গামার খবর প্রথম প্রকাশ করেন সম্ভবত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসী স্বামী ত্র্যম্বকানন্দ। ঘটনাচক্রে তিনি ঐ সময় নোয়াখালি জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি রামগঞ্জ থানার করপাড়া গ্রামের রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী মহাশয়ের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। বাইশ জন স্ত্রী পুরুষ সহ বিরাট চৌধুরী পরিবার সবংশে গুণ্ডাদের হাতে নিহত হয়। তারপর ত্র্যম্বকানন্দজীর কাহিনী-

“১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দে নোয়াখালির কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সুপরিকল্পিত এই নৈরাজ্যে সহস্র সহস্র হিন্দু নিহত, অত্যাচারিত বা ধর্মান্তরিত। অগণিত সাধ্বী নারী লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা, অপহৃতা বা বলপূর্বক বিবাহিতা। হিন্দুদের ঘরবাড়ী লুণ্ঠিত, বিধ্বস্ত, অগ্নিদগ্ধ। সেই দুর্যোগের দুর্দিনে স্বামী ত্র্যম্বক” “ন্দজী করপাড়ার জমিদার শ্রীরাজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ীতেই ছিলেন। প্রথম আক্রমণ হয় উক্ত জমিদার বাড়ীতে। সারাদিনের প্রতিরোধে এই মৃত্যুশঙ্কাহীন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীই বিপন্নের পাশে। অবশেষে প্রতিরোধ ভাঙ্গিয়া পড়ে। চলিতে থাকে অবাধ হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারীনিগ্রহ। অন্ততঃ দশ সহস্ৰ সাম্প্রদায়িক গুণ্ডার গগনভেদী চীৎকার—”হাঁদুর মাথা চাই।” কিন্তু এ যাত্রাও বাঁচিলেন দৈবানুগ্রহেই। লক্ষ্মী পূর্ণিমার নির্মল শারদ আকাশে কোথা হইতে সহসা আসিল দুর্যোগবাহী ঘনকৃষ্ণ মেঘ। প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত। দুর্বৃত্তেরা বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। সেই সুযোগে কৌপীন মাত্র সম্বল করিয়া রণক্লান্ত সন্ন্যাসী ধানখেতের ভিতর দিয়া সারারাত্রি সাঁতরাইয়া রামগঞ্জ থানায় আশ্রিত। কোন প্রকারে কলিকাতা আসিয়া এই দুঃসংবাদ সংবাদপত্রের বিবৃতিতে প্রথম প্রকাশ করেন। তৎকালে এই ঘটনার বেদনার্ত প্রতিক্রিয়া সারা ভারতে পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল এবং পরিস্থিতির উন্নতির জন্য স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীজী নোয়াখালি ছুটিয়া গিয়াছিলেন।”(প্রণব-মাঘ, ১৩৯০)

নেহেরুকে হারাণচন্দ্র ঘোষচৌধুরীর তারবার্তা

ঐ চিঠি লেখার সময়েই নোয়াখালির একমাত্র হিন্দু এম. এল. এ. হারানচন্দ্র ঘোষচৌধুরী মশাই নেহরুজীকে ট্রাঙ্কল’ করেন। তাতে তিনি প্রকৃত ঘটনার খানিকটা বিস্তৃত বিবরণ জানতে পারেন। সেকথা উল্লেখ করে নেহরুজী লিখেছেন :

I am now writing to you because I have just received a trunk call from Calcutta from Haran Chandra Ghosh, M.L.A. He states that these stabbings and murder and looting have spread to Noakhali District in Bengal, and he mentions a number of towns and villages which are seriously affected. He further stated that families of middle-class people have been murdered including the President of the local Bar Association.

I do not know what I can do in this matter. But I hope you will realise how exceedingly distressing this is for all of us.

কী নিদারুণ দৃশ্য! নেহরুজী নির্বাক দর্শকমাত্র। বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর কিছুই করার ছিল না; ওয়াভেলের কাছে নালিশ জানান ছাড়া। তিনি নেহরুজীকে জানালেন যে গভর্নর হাবার্টকে এ ব্যাপারে লিখেছেন। হার্বাট অবশ্যই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি লিখেছেন; এবং সুরাবর্দী নিশ্চয়ই তা বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করেছেন!

দিল্লীতে শরৎচন্দ্র বসুকে তার নোয়াখালি থেকে

যা হোক, ঐ দিনই শরৎ বসু মশাইও (তখন কেন্দ্রে মন্ত্রী) নোয়াখালি থেকে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের টেলিগ্রাম এবং সেগুলি ওয়াভেলের কাছে পাঠিয়ে প্রতিকার প্রর্থনা করেন :

“I enclose herewith two telegrams from Noakhali 14 October 1946 (East Bengal) received by me this evening— one from Kshitis Roy, Chairman, Municipality, Kirti Ghosh, Vice-Chairman, and Dr. Sudhip Roy, Secretary, Hindu Sabha and the other from Profulla Bhoumik, Manager, Bhulua. The telegrams speak for themselves. It appears that the Government of Bengal have entirely failed to give protection to innocent citizens of Noakhali and that whole families have been murdered. May I request you to take immediate action?

Thanking you,

Enclosure 1 to No. 452

Telegram from Mr. Kshitis Roy, Chairman, Municipality, Kirti Ghosh, Vice chairman, Dr. Sudhir Roy, Secretary, Hindu sabha, to Sarat Bose, Member, Interim Government, New Delhi.

Organised hooliganism, loot, arson, murder, forcible conversion going on large scale in Ramganj Thana, portion of Bagumaganj, Lakhipur. Rai Sahib Rajendralal Roy with entire family, Zaminder Surendra Bose and many other notable persons murdered. Communication to Thanas, Headquarters made impossible. No police help available. Unless immediate military help rendered, entire Hindu Population will be extinct.

Enclosure 2 to No. 452

Telegram from Mr. Prófulla Bhoumik, Manager, Bhulua, to Mr. Sarat Bose, Member, Interim Government, New Delhi.

Whole of Noakhali District devastated. Respectable Hin-dus including President, District Board [? District Bar Association], killed. Several thousand Hindus’ houses burnt, looted; ladies, girls taken away forcibly. Forcibly conversion. Police helpless. Military urgently needed. Pray save livings and destitutes.”

যে সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে এসব টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল, তাঁরা সবাই নোয়াখালি হিন্দু সমাজের নেতা ও প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি।

দাঙ্গা নয়, ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের রূপরেখা

নোয়াখালি থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে পালিয়ে আসা যে মানুষগুলি সেদিন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরই একজন ফণিভূষণ শূর জানিয়েছিলেন, “আমাদের গ্রাম হাজিগঞ্জে দাঙ্গার নেতৃত্ব দিয়েছিল পেশাদারী মুসলমানরা, ওদের প্রত্যেকের হাতে ছিল লম্বা তরোয়াল। ওদের নির্দেশেই খুন, ধর্ষণ, অপহরণ সংগঠিত হয়েছিল”।

এখানেই শেষ নয়। “দাঙ্গার এই নিখুঁত পরিকল্পনাকে আরো নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করবার উদ্দেশ্যে নোয়াখালির দাঙ্গা পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মুসলমান সৈন্যদের উপর। সেনাবাহিনীর রণকৌশলের সমস্ত শিক্ষা নোয়াখালির হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লীগ নেতারা কলকাতা দাঙ্গার চরম প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। দাঙ্গা-বিদ্ধস্ত নোয়াখালি ঘুরে এসে সাংবাদিকরা জানিয়েছিলেন, “the heads of miscreants were Ex-servicemen and they organised the raids in military fashion………The people knew how to dig up roads and cut communication.”

অর্থাৎ পেশাদারিত্বের সার্থক প্রয়োগ করা হল ‘নোয়াখালি দাঙ্গা’য়। পথের জায়গায় জায়গায় গর্ত খুঁড়ে, কিংবা খাল এবং নদীগুলিতে নৌকার সাহায্যে ব্যারিকেড তৈরি করে আক্রান্ত হিন্দুদের পালিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। “হিন্দুরা যেন পালিয়ে যেতে না পারে তাই রাস্তাগুলি খুঁড়ে রাখা হয়েছিল, জলপথে ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়েছিল, এবং যেসব জায়গা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ রয়েছে, সেখানে সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীরা পাহারা দিচ্ছিল”। বাংলার লীগ মন্ত্রিসভার প্রধান সুরাবর্দী স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, “Some canals in the affected areas had been damaged and roads cut.”

সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর, ১০ই অক্টোবর, ১৯৪৬, নোয়াখালি দাঙ্গার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ঘটল। ভয়াবহ সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হল হিন্দুদের উপর। নোয়াখালি ও ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুন, লুঠ, ধর্ষণ ও অপহরণ চলল বাধাহীনভাবে। প্রশাসন জেগে ঘুমিয়ে রইল। অসহায় আতঙ্কিত হিন্দুরা পালাতে শুরু করল প্রাণ বাঁচাতে।

দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ১০ই অক্টোবর। কিন্তু রাজ্য সরকার দাঙ্গার খবর প্রথম প্রকাশ করল ১৫ই অক্টোবর। অর্থাৎ দাঙ্গা শুরু হওয়ার পাঁচ দিন পরে এবং সেটাও যথাসম্ভব চেপে গিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে।

‘নোয়াখালি দাঙ্গা’ সম্পর্কে স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় প্রাথমিক রিপোর্ট লেখা হল, “বাংলা সরকার প্রাথমিক খবরে জানতে পেরেছে যে নোয়াখালি জেলায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে। দাঙ্গাকারীরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রাম আক্রমণ করছে। গত বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ১০ই অক্টোবর থেকে এই খুন ও লুঠ শুরু হয়। জোর করে ধর্মান্তরকরণ এবং ধর্মীয় স্থান অপবিত্র করবার খবরও এসে পৌঁছেছে। ব্যাপক হত্যালীলা চলছে। জীবন্ত মানুষকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছে। জেলার বার কাউন্সিলের সভাপতি ও তাঁর পরিবারের সবাইকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।”

সরকারের এই খবর black out করবার নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অমৃতবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হল, “নোয়াখালি থেকে রক্ত হিম করা খবর আমাদের দপ্তরে এসে পৌঁছেছে। সরকারী ও বেসরকারী উভয়ের বক্তব্য থেকেই এটা পরিষ্কার যে, এই দাঙ্গা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। পরিকল্পনা অনুসারেই গত বৃহস্পতিবার থেকে খুন ও লুঠ শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা ভাবতে অবাক লাগছে যে, এই ধরনের এক অভূতপূর্ব দাঙ্গার খবর প্রথম প্রকাশিত হল পনেরই অক্টোবর, অর্থাৎ দাঙ্গা শুরু হওয়ার পাঁচদিন পরে। রহস্যজনকভাবে, বাংলা সরকারের “Director of Publicity” দ্বারা প্রকাশিত Press note এত সংক্ষিপ্ত (laconic) ছিল যে এর থেকে কোনভাবেই দাঙ্গার ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভব নয়।”

“কিন্তু এই দীর্ঘ পাঁচদিন এভাবে সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখবার কৈফিয়ত কে দেবে? আর যাই হোক, নোয়াখালি নিশ্চয়ই পেশোয়ার বা কুইট্টা নয়। কলকাতা থেকে মাত্র কয়েকঘণ্টার পথ। তবে কি রাজ্য সরকার জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এই ক’দিন কোন সংবাদ পায়নি? এবং যদি পেয়ে থাকে তবে রাজ্য সরকার এই ক’দিন কী করেছে?”

শুধু খুন বা লুঠ নোয়াখালি দাঙ্গার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। এ ছিল ভবিষ্যৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রূপরেখা কী হবে তার একটা ছোট্ট প্রদর্শন। জেলার সমস্ত হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে নোয়াখালিকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে চেয়েছিলেন লীগের নেতৃবৃন্দ। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এই বল্গাহীন সন্ত্রাসের। তৎকালীন বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য কংগ্রেস নেতা কামিনীকুমার দত্ত নোয়াখালি দাঙ্গার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, “that the appar-ent object behind the disturbances was to make the entire district exclusive to the Muslim majority community.”

নোয়াখালিকে ‘দার-উল-ইসলামে’ পরিণত করবার জন্য একদিকে যেমন খুন, লুঠ, সন্ত্রাসের বল্গাহীন রাজত্ব কায়েম করা হল, অন্যদিকে তেমনি বারো থেকে বিয়াল্লিশ বৎসরের সমস্ত হিন্দুনারী ধর্ষণ বা অপহরণের শিকার হল। ভাগ্যবতী যে ক’জন পালিয়ে আসতে পেরেছিল তাদের চোখেও ছিল মৃত্যুর বিভীষিকা। ‘হয় কোরান নয় মৃত্যু’ অবলম্বন করে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হল। এমনকি, তাদের দিয়ে গো-হত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সেই গো-মাংস তাদের খাওয়ানো হল। হিন্দুদের সমস্ত ধর্মীয় স্থানগুলি অপবিত্র করা হল। দাঙ্গার রিপোর্ট করতে গিয়ে স্টেটস্ম্যান পত্রিকা লিখেছিল : “in an area of about 200 miles the inhabit-ants surrounded by riotous mobs, are being massacred, their houses being burnt their womenfolk were forcibly carried away and thousands being subjected of forcible conversion. Thousands of hooligans attacked the villages. Compelled the Hindus to slaughter their cattle and eat.”

“All places of worship in the affected villages have been desecrated. “

কিন্তু পুলিশ ও প্রশাসন হিন্দু জনসাধারণকে রক্ষা করতে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে, নোয়াখালির জেলা শাসক এবং পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ঐ বর্বরতা বন্ধ করতে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেন নি। (The District Magistrate and the Police Superintendent of Noakhali took no step to prevent it) ।

ভি.পি.মেনন ‘নোয়াখালি দাঙ্গা’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “It was an organised attack engineered by the Muslim League and carried out with the connivance of the muslim administrative officials.”

(মায়ের ডাক)

ওয়াভেলকে নেহরু : সর্বভারতে নেতৃত্বদানকারী বাংলায় গুণ্ডারাজ কায়েম হয়েছে

১৬ অক্টোবর নেহরুজীর সীমান্ত প্রদেশে উপজাতি অঞ্চল পরিদর্শনে যাবার কথা। ১৫ অক্টোবর তিনি পুনরায় ওয়াভেলকে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে পূর্ববঙ্গ, বিশেষ করে নোয়াখালি সম্পর্কে তাঁর গভীর উদ্বেগের কথা জানান :

15 October, 1946

“Thank you for your letter of today’s date about East Bengal.

I am going to the Frontier tomorrow morning, but my mind is full of what is happening in East Bengal. Both the reconstitution of the Interim Government, important as it is, and my Frontier visit, which I have looked forward to for so long, have suddenly become of secondary importance. Indeed I have come seriously to think whether it serves any useful purpose for me to be in the Interim Government if an important part of India sinks to barbarism or something much worse. The accounts we have received and are receiv-ing from hour to hour are incredible and yet there can be little doubt that they are largely true. A vast area of Bengal has ceased to have any Government functioning, any secu-rity, and has just become the happy hunting ground of the worst elements in the community. Mass slaughter, arson, burning of human beings, rape, abduction on a large scale, forcible conversions and all manner of other horrible things are happening. ‘

ঘটনার দু’তিন সপ্তাহ আগে থেকেই যে অবস্থা ঘোরাল হয়ে আসছে তার যথেষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া সত্ত্বেও সুরাবর্দী পরিচালিত লীগ সরকার কোনই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি— এই অভিযোগ করে নেহরুজী লেখেন— নোয়াখালিতে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে কেমন গুণ্ডারাজ কায়েম হয়েছে :

‘For at least two or three weeks past we have been receiving warnings that this was going to happen in East Bengal. Indeed it began in Dacca some time back. Instead of being stopped in time it was allowed to grow and it is now spreading to other districts. Bengal, which has long led India in many ways, is rapidly becoming a shambles and a ruin. It is a small matter to discuss legal responsibili-ties when such a horrible catastrophe overtakes a people. It is evident that the Bengal Government is completely incapable of controlling the situation. Indeed, many people think that they have no desire to control it. You have told us that this is the domain of Provincial Autonomy and that for the rest it is a special responsibility of the Governor and the Viceroy. It may be so, but I should like to know how that responsibility is discharged either by the Provincial Govern-ment or the Governor when these conditions that are worse

than war are allowed to prevail over wide areas and for indefinite periods. It would appear that not only Govern-ment but also general and special responsibilities have all ceased to function in these parts of Bengal. Only the gangster, the hooligan and other anti-social elements function there.’

জনগণকে কি কৈফিয়ত দেব? – নেহরু

হয় প্রতিকার, নয় রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে পড়াই বাঞ্ছনীয় : নোয়াখালির বুকেই দেশভাগের বীজ বোনা হয়

দুই মাস আগে কলকাতায় এবং তারপর নোয়াখালি জেলায় যেভাবে নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, নারী নির্যাতন চলছে তাতে বাংলায় কোনও সভ্য শাসন আছে বলে মনে হয় না অথচ তাতে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাক দর্শকমাত্র : ভীতি ও সন্ত্রাসের লীলাক্ষেত্র বাংলা-

“Surely it serves little purpose to say that all this is due to communal friction and to divide up the blame between various parties or groups. Conditions are difficult in various parts of India, but it has become the special province of Bengal to indulge in this horror and frightfulness. There was the famine three years ago. There was the Calcutta killing two months ago and there is now this mass slaughter, etc., in Noakhali and surrounding districts which, if reports are correct, is far worse than the Calcutta killing. Law and special and other responsibilities have no meaning when they become completely incapable of controlling such a situation. It is a terrible responsibility for all those in charge. But it is also a terrible responsibility for us and we too have to answer before the people of India. What is the good of our forming the Interim Government of India if all that we can do is to watch helplessly and do nothing else when thousands of people are being butchered and subjected to infinitely worse treatment?

I am greatly perturbed. I feel that we must face this issue somehow or else we retire from the public scene.”

এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির নীরব সাক্ষী হয়ে থাকার চেয়ে সরকার থেকে সরে যাওয়াই উচিত বলে নেহরুজী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বস্তুত কংগ্রেস নেতাদের মনে নোয়াখালির ঘটনার পর থেকেই দেশভাগের চিন্তাভাবনা শুরু হয়।

বাংলায় সরজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণে প্যাটেলকে বাধাদান

নেহরুর পর সর্দার প্যাটেলের পালা। ১৬ অক্টোবর প্যাটেল ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করে হিন্দুদের মনে আস্থা সঞ্চারের আশায় বাংলায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ওয়াভেল তাতে সম্মতি দিতে নারাজ। তাতে নাকি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অমর্যাদা হবে। প্যাটেল তখন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব। অথচ লীগ শাসিত বাংলায় আসায় তাঁর অধিকার নেই :

“Patel then said that he proposed to go to Bengal himself. I said quite firmly, No, that he was not to go; it was a provincial matter and interference from the Centre would be quite out of order. He said that if I had not been going to Bombay he would have suggested that I should go myself. I said that while I was always prepared to go anywhere where I could be of service, I did not propose to ‘interfere with the Governor’s functions unless the situation really required it.”

এভাবেই নেহরু-প্যাটেলদের মনে দেশভাগের অনিবার্যতা সম্পর্কে চিন্তা দানা বাঁধতে থাকে।

অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেবার পরেও মুসলিম লীগের পত্রপত্রিকায়, নেতাদের বক্তৃতায়, যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিষোদগার করা হচ্ছিল তার প্রতি ওয়াভেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দু’পক্ষকেই দোষারোপ করে নিজের দায়িত্ব এড়ালেন :

“Patel then produced this morning’s copy of Dawn, and pointed out to me the photographs there of the murdered Pathans in Bombay, and asked how it was possible to keep communal peace when this sort of thing went on. I said that I entirely agreed that such provocation was deplorable, but it was not confined to one side only.”

বারোজ কলকাতার দাঙ্গায় ঘুমে : নোয়াখালির দাঙ্গায় প্রমোদভ্রমণে

১৬ আগস্ট লাটভবন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মুসলিম লীগের গুণ্ডা-বাহিনী যখন নরক গুলজার করছিল, তখন বারোজ সাহেব সুখনিদ্রায় বিভোর ছিলেন। আবার ১০ অক্টোবর থেকে যখন নোয়াখালিতে হিন্দুদের উপর নির্বিচার অত্যাচার চলছিল, তখন তিনি দার্জিলিং-এর মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ায় অবসর নিচ্ছিলেন। তবু দেখা যাচ্ছে দাঙ্গার সপ্তম দিবসে তিনি বিলাতে ভারত সচিব লর্ড পেথিক-লরেন্সের কাছে নোয়াখালির পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নোক্ত গোপন রিপোর্ট পাঠান :

IMMEDIATE CONFIDENTIAL : DARJEELING, 16 October 1946, 7-20 P.M. Received: 16 October, 10-45 P.M.

No. 2”. Disturbances in south-east Bengal.

The communal situation deteriorated in the district of Noakhali generally during the past fortnight. Mass meetings have been held at important places urging Muslims to enroll in a national guard. Some of the speeches were violent in character. A strong movement for economic boycott of Hindus developed and Muslims found purchasing from Hindus were beaten up.

The situation was at first thought to be particularly bad in sub-division of Feni, and troops (one company) were moved there from Chittagong about October 9th and armed police were asked for from outside the district.

Actually trouble did not develop in Feni but broke out on October 10th in police station of Ramganj in north-west corner of Noakhali. Trouble spread from there and situation as it now presents itself appears to be as follows: large bands of Moslem hooligans are moving about terrorising Hindus and committing acts of arson, loot and murder, kidnapping and forcibly converting Hindus. Villages have been cordoned and booty and money extracted under threats. The gangs appear to be organised. Roads have been cut in places and communication, difficult at any time at this period of the year, has become even more difficulty. Diffi-culty of movement (largely by boat) has hampered operations. The areas affected in Noakhali district are police stations of Ramganj, Lakshmipur and part of Begumgunj, Sonaimuri and Senbag. The trouble has spread to southern part of the Tippera in police stations of Hajiganj and Faridganj where there has been looting and arson on a wide scale. Refugees have left the affected areas in large num-bers. 2,000 refugees are being provided [for] at Comilla and another 1000 are being sent by special train from Chaumohani in Noakhali district. Relief arrangements are being made and extra food is being despatched to the tip. Up to date some 250 additional armed police have been sent to affected areas and two companies of troops are also operating there. The Minister for Civil Supplies, who has great influence locally, has left for Noakhali. The Inspector-General of Police and Senior staff Officer of Bengal Area flew to Chittagong today to pick up the Commissioner and from there they will proceed to affected area to concert plans with local officers.’

অকর্মণ্য গভর্নরের বিরুদ্ধে প্যাটেলের অভিযোগ

আর ওয়াভেলের ঔদাসীন্য ও একদেশদর্শী মনোভাবে বীতশ্রদ্ধ সর্দার প্যাটেল ১৯ অক্টোবর তারিখে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের কাছে তাঁর হতাশা ও বিরক্তি প্রকাশ করে এবং নোয়াখালির পরিস্থিতি বর্ণনা করে এক চিঠি লেখেন :

“You will, I am sure, remember that, when you were here, we had a long conversation on the likelihood of com-munal trouble in India, in case there was no settlement with the Muslim League. I told you that there was no possibility of any trouble except in Bengal and Sind, and you told me, ‘You need not be afraid of Bengal, as we have a Governor who would immediately put section 93 into operation in case of any serious trouble’. You have heard, I believe, of the “Great Calcutta Killing.” Those who have seen the thing can alone realise what it was. But now what is hap-pening in Eastern Bengal is much worse and the Calcutta incident pales into insignificance before Noakhali.”

বাংলার গভর্নর স্যার ফ্রেডেরিক বারোজ যে কেমন দায়িত্বহীন, বাস্তববুদ্ধি-বিবর্জিত এবং মুসলিম লীগ সরকার সম্পর্কে দুর্বলচিত্ত, সর্দার প্যাটেল সেকথা জানাতে ভোলেননি :

“My point just now is that the Governor did nothing to prevent the mischief if he had wished to avoid it. At least that is the general impression. I will not bother you with the details, but I am just sending you a copy of a letter which Jawaharlal wrote to the Viceroy on the eve of his departure to the Frontier. I am also enclosing a copy of a letter from another friend who has been a Member of the Working Commitee for many years.

Would you believe that the Governor of Bengal has, all throughout these terrible happenings, been enjoying the bracing climate of a hill-station known as Darjeeling?”

বাংলার হিন্দুরা ধনে প্রাণে মারা যাচ্ছে, তাদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠিত, মা-বোনেরা লাঞ্ছিত, পরিবার-পরিজন নির্যাতিত— ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব হিসাবে বিপন্ন নরনারী প্রাণ রক্ষার্থে মান রক্ষার্থে তাঁর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছে অথচ তিনি কিছু করতে পারছেন না—এর চেয়ে মর্মপীড়া আর কি হতে পারে? সর্দার প্যাটেল তাঁর সেই মর্মবেদনা প্রকাশ করেই পেথিক-লরেন্সকে লিখেছেন :

“I myself received many letters and telegrams from the terror-stricken people of the unfortunate area. Similar warnings were addressed to the Viceroy and the Governor but the Provincial Autonomy serves as a screen to prevent Government action. You would realise how difficult it is for

an Indian Home Member to sit in his office quietly day by day, when innumerable piteous appeals and complaints are received for some kind of help which would give these unfortunate and helpless victims some protection.”

দাঙ্গার নেতা ইউনিয়ন-প্রেসিডেন্টের হাতেই রিলিফ বণ্টনের চাবিকাঠি

দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে গিয়ে কি রকম অসহযোগিতা ও অসুবিধার মধ্যে পড়েছিলেন তারও প্রমাণ পাওয়া যায় স্বেচ্ছাসেবীদের স্মৃতিকথা থেকে। দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকার সমস্ত ইউনিয়ন-বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মুসলমান। সাহায্য বণ্টনের ব্যাপারে সরকার তাঁদের বিরাট ভূমিকা নির্ধারণ করেছেন। বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা পরিচালিত হয়েছে, তিনিই আবার ‘মালাউন’দের সরকারী সাহায্য বণ্টনে কলকাঠি নাড়ার অধিকারী। এরকম একটি ঘটনার বিবরণ দেওয়া গেল :

“রিলিফের কাজের ধরন-ধারন বলতে বলতে অনেকদূর এসে পড়েছি। তখনও কিন্তু গ্রামের লোক সন্দিগ্ধভাবে দেখে নিচ্ছে সরকারি সদিচ্ছা কতদূর। এছাড়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দারুণ দাপট ও ক্ষমতা দেওয়া ছিল। যাতে অনায়াসেই কোনও হোল্ডিংকে বাতিল করে দিতে পারতেন। এমনটি হয়েছিল আমাদের শিবিরেরই একজন বিধবার ক্ষেত্রে। বোর্ডের প্রেসিডেন্ট বলেন, ওঁর কী দরকার? একা মানুষ একপাশে পড়ে থাকবেন, ভাশুর-দেওর দেখবে। অথচ তাঁর একখানি ঘরও ছিল, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তারই গরুটিকে মেরে ফেলে ‘ধর্মান্তর’ করার পর সকলকে গোমাংস খেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাছাড়া তিনি নিঃসন্তান ছিলেন না। একটি মেয়ে ছিল, বিবাহিতা অবশ্য।

আমাদের কর্মীরা প্রবল বাধা দিয়েছিল। মেয়েদের অধিকার, শেষপর্যন্ত ক্ষতিপূরণের দাবি অগ্রাহ্য করা যায়নি। রিলিফ অফিসার মঞ্জুর করেছিলন। সারা তল্লাটে সাড়া পড়ে গিয়েছিল AIWC-র নারীর অধিকারের আওয়াজ তোলায়। সুবিধা হয়েছিল জামান সাহেবের সরকারি অর্ডারের ব্যাখ্যা পেয়ে, তা না-হলে হয়ত সহজে ক্ষতিগ্রস্ত লোকেদের সুবিচার পাওয়া শক্ত হত।” প্রথমে গান্ধীজীর ও পরে ঠক্কর বাপার নির্দেশে স্বেচ্ছাসেবীরা শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরে আনার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের বাড়ি গিয়ে সখ্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাদের সে সাধু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে :

মুসলমানদের মন পাইনি—অশোকা গুপ্ত

“ঠক্করবাপা বলেছিলেন শুধু আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাই নয়, আতঙ্কগ্রস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের মনে নিরাপত্তার ভাব জাগিয়ে তোলাই কর্তৃপক্ষের (সরকারের) বর্তমানে প্রধান কর্তব্য। তৎকালীন সরকার সেটা করে উঠতে পারেননি। গান্ধীজীর মতো শান্তিকামী নেতা ও মিশনের শত শত সর্বভারতীয় সেবাকর্মীদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও। আমরা যারা সাধারণ কর্মী প্রতিটি গ্রামে দল নির্বিশেষে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে কাজের চেষ্টা করতাম। রিলিফের মালপত্র তোলা, আনা, নৌকা ভাড়া করা সবই গ্রামের সকলের সম্মতি নিয়ে সংখ্যাগুরু লোকেদের যাতে ভাল পারিশ্রমিক দেওয়া যায় সে চেষ্টাই করতাম। বাড়ি গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে শিশুদের খাদ্য, শাড়ি প্রভৃতি বিতরণ করেছি। কিন্তু সত্যি সত্যি মন পাইনি।”

মেয়েদেরই যখন এরকম মনোভাব তখন পুরুষদের কথা বলাই বাহুল্য। বিধর্মী হিন্দুর বাড়ি লুন্ঠন, গৃহদাহ, নারীহরণ কোরানের নির্দেশ মতোই করেছে। তাতে তাদের মনে পাপবোধ নেই। তার উপর তাদের মন-মস্তিষ্ক দখল করে রয়েছে ‘পাকিস্তান’।

এদের পশু বললে পশুকে হেয় করা হয়

নোয়াখালির দাঙ্গায় পীড়িত মানুষদের সাহায্য সাহায্য করবার জন্য বেসরকারীভাবে বেশ কিছু ‘রিলিফ কমিটি’কে পাঠানো হয়েছিল। মিস মুরিয়াল লিস্টার ছিলেন এই রকম একটি ‘রিলিফ কমিটি’র সদস্যা। ১৯৪৬-এর ৬ই নভেম্বর একটি রিলিফ সেন্টার থেকে মিস লিস্টার লিখেছিলেন, “দুর্দশা সবচেয়ে শোচনীয় ছিল নারীদের। এদের মধ্যে অনেকেই স্বচক্ষে আপন স্বামীকে নিহত হতে দেখেছে এবং তারপর বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর স্বামীর হত্যাকারীদেরই কোন একজনকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। নারীদের চোখে ছিল মৃতের চাহনি। সে চাহনি হতাশার অভিব্যক্তি নয়। কারণ হতাশারও একটা ক্রিয়া আছে। এ যেন সম্পূর্ণ মসীলিপ্ত অন্ধকার। গোমাংস ভক্ষণ ও ইসলামের প্রতি আনুগত্যের শপথ বহু লোকের উপর জোর করে চাপানো হয়েছিল। এবং তা না করলে মৃত্যুই ছিল দণ্ড।” (“Worst of all was the plight of women. Several of them had to watch their husbands being murdered and then be forcibly converted and married to some of those responsible for their death. Those women had a dead look. It was not despair, nothing so active as that. It was blackness….the eating of beef and declaration of allegiance to Islam has been forced upon many thousands as the price of their lives.”)

মিস্টার সিম্পসন, আই. সি. এস. ‘নোয়াখালি দাঙ্গা’র ভয়াবহ অবস্থা তদন্ত করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রামাণ্য সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, যে একটি এলাকায় তিনশোর বেশী এবং আর একটি এলাকায় চারশোর বেশী অসহায় নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

বাম হাতে মেয়ের অলঙ্কার ডান হাতে বাবার মুণ্ড

যে জান্তব বর্বরতার সাহায্যে নোয়াখালিতে দাঙ্গা সংগঠিত করা হয়েছিল তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। স্টেটস্ম্যান পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক নোয়াখালির দাঙ্গাবিদ্ধস্ত এলাকার “রিপোর্ট” করতে গিয়ে যে পৈশাচিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন তা মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি স্টেটস্ম্যান পত্রিকায় তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন : “নোয়াখালির রামগঞ্জ থানার একটি বাচ্চা মেয়ে আমাকে ঘটনাটি বলেছিল। ১০ই অক্টোবর সকালে একদল লোক ঐ মেয়েটির বাড়ীতে এসে মুসলীম লীগের তহবিলে পাঁচশ টাকা চাঁদা চায়। চাঁদা না দিলে বাড়ীর সবাইকে খুন করা হবে বলে ওরা হুমকি দেয়। প্রাণের ভয়ে মেয়েটির বাবা ওদের পাঁচশ টাকা দিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ বাদে ওরা আবার আসে, সঙ্গে এক বিরাট জনতা। ঐ বাড়ির জনৈক অভিভাবক, যিনি আবার পেশায় মোক্তার, ঐ উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে এগিয়ে যান। কিন্তু তিনি কোন কথা উচ্চারণ করবার আগেই তাঁর মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর গুণ্ডারা পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক লোকটিকে (মেয়েটির দাদু) খুন করে। এবার মেয়েটির বাবার পালা। মেয়েটির বাবাকে তাঁরই সদ্য খুন হওয়া বাবার মৃতদেহের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়। তখন মেয়েটির মা তাঁর স্বামীকে বাঁচাবার জন্য স্বামীর দেহের উপর শুয়ে পড়েন এবং ওদের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইতে থাকেন। কিন্তু তাতে ওরা ক্ষুব্ধ হয়ে ঐ মহিলার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং তাঁর অচৈতন্য দেহ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এইবার আবার ওরা মেয়েটির বাবাকে মারতে উদ্যোগী হয়। মেয়েটি ভয়ে এতক্ষণ ঘরের কোণে লুকিয়ে ছিল। বাবার প্রাণ বাঁচাবার জন্য সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ঘাতকের হাতে নিজের গায়ের সমস্ত গহনা খুলে দিয়ে তাকে কাকুতি-মিনতি করে তার বাবাকে না মারার জন্য। ঐ ঘাতক তখন বাঁহাতে মেয়েটির কাছ থেকে গহনাগুলি গ্রহণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই ডান হাতের দা দিয়ে মেয়েটির বাবার মাথা তাঁর দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে।”

বর্বর বড়লাটের ইতর উক্তি

“ভাইসরয় শুধু যে আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেছিলেন তাই নয়, মুসলমানদের হাতে হিন্দু মেয়েদের এই অসম্মানকে তিনি খুব “স্বাভাবিক” বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। “স্বাভাবিক”, কারণ “মুসলমান বাড়ীর মেয়েরা হিন্দু বাড়ীর মেয়েদের মত এত সুন্দরী নয়।” (large scale abduction of Hindu women (by Muslims) was quite natural since Hindu women were more handsome than Muslim women). হিন্দু মেয়েদের প্রতি তাই মুসলমানদের লোভ থাকা স্বাভাবিক।” (নোয়াখালি : নোয়াখালি— শান্তুনু সিংহ)

বিঃ দ্রঃ দাঙ্গা সম্পর্কিত ইংরেজী উদ্ধৃতিগুলি ‘Transfer of Power’ থেকে গৃহীত।

সকল অধ্যায়

১. ভূমিকা (শ্যামাপ্রসাদ ও বঙ্গবিভাগ)
২. ১. বাংলার সীমা চৌহদ্দী
৩. ২. ভাগের রাজনীতি–১ম পৰ্ব
৪. ৩. ভাগের রাজনীতি—২য় পর্ব
৫. ৪. ভাগের রাজনীতি–৩য় পর্ব
৬. ৫. অরাজনৈতিক ৭৭নং বাড়িটি
৭. ৬. ‘অখণ্ড ভারত অমর রহে’
৮. ৭. প্রত্যক্ষ সংগ্রাম : নৃশংস ১৬ আগস্ট
৯. ৮. বিভীষিকাময় ১০ অক্টোবর
১০. ৯. আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি
১১. ১০. পৈশাচিক বর্বরতা : পাঞ্জাবের দাঙ্গা
১২. ১১. বিভক্ত ভারত, অবিভক্ত বাংলা
১৩. ১২. যুক্ত বঙ্গ পরিকল্পনা বানচালে শ্যামাপ্রসাদের মরণপণ সংগ্রাম
১৪. ১৩. বিভাগ-পরবর্তী পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-শিখ নরমেধ যজ্ঞ
১৫. পরিশিষ্ট – বাংলা ভাগ না হলে বাঙালী হিন্দু যেত কোথায়?
১৬. শ্যামাপ্রসাদের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী
১৭. তথ্যসূত্র ও স্বীকৃতি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন