দীনেশচন্দ্র সিংহ
প্রথম অধ্যায় – বাংলার সীমা চৌহদ্দি : যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ : বাংলায় ‘ভাগ করে শাসন কর’ নীতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ : মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় শাসক মহলে উল্লাস
রঙ্গ ও ব্যঙ্গের রাজা কবি ঈশ্বর গুপ্ত যখন লিখেছেন “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গ ভরা”, তখন কিন্তু গুপ্ত কবি ঘুণাক্ষরেও বাংলার ভবিষ্যৎ ভৌগোলিক ভগ্নদশার প্রতি ইঙ্গিত করেননি; বা বাংলার বিকলাঙ্গ ভবিষ্যতের কোনও আভাস দেননি। তাই কবির কাব্যের কথা মনে পড়লে এখন আমাদের কাটা ঘায়ে হুল ফোটে।
কাব্যের কথা থাক। মূল বক্তব্যে আসা যাক। তার আগে বঙ্গ বা বাংলা বা ইংরেজীতে ‘Bengal’ নামে পরিচিত অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিচয় ও প্রদেশরূপে গঠনের ইতিহাস জানা দরকার। মোগল-পাঠান যুগের সুবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার কথা ছেড়ে দিই। ইংরেজ শাসকগণ ১৮৫৪ সালে বর্তমান বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও অখণ্ড বঙ্গদেশ নিয়ে বাংলা প্রেসিডেন্সী (Bengal Presidency) নামে এক বৃহৎ প্রদেশ গঠন করে। এর আয়তন ছিল ২,৫৩,০০০ বর্গমাইল, লোকসংখ্যা ৪ কোটি ৬০ লক্ষ। বড়লাট স্যার জন লরেন্সের শাসনকালে (১৮৬৩-৬৯) উড়িষ্যা অঞ্চল প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। তখন কথা ওঠে সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বাংলা প্রেসিডেন্সীর আয়তন হেঁটে বোম্বাই বা মাদ্রাজের মতো করা হোক। বড়লাট এই অভিমতের সঙ্গে একমত না হয়ে বলেন, বাংলার কিছু অংশ যেমন আসাম ও তার সন্নিহিত জেলাগুলিকে প্রেসিডেন্সী থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
১৮৭৪ সালে বাংলাভাষী শ্রীহট্ট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলাসহ আসাম এক চীফ কমিশনার-শাসিত প্রদেশ বলে ঘোষিত হয়। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ও নগণ্য, অস্বাস্থ্যকর ও জঙ্গলাকীর্ণ প্রদেশে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য কোনও পদস্থ সিভিলিয়ান যেতে উৎসাহবোধ করেন না। তখন চীফ কমিশনার উইলিয়ম ওয়ার্ড ১৮৯৬ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাংলার এতগুলি উন্নত জেলাকে অনগ্রসর আসামের সঙ্গে যুক্ত করার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি ওঠে। ফলে এ প্রস্তাব কিছুদিনের জন্য ধামাচাপা পড়ে।
এভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তি ঘটে। ততদিনে পূর্ববঙ্গে শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটেছে। এতদিন চাকুরিক্ষেত্রে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকেদেরই একাধিপত্য ছিল। এখন পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোক কর্মপ্রার্থী হয়ে কলকাতামুখী। তারা ঘরে ফেরার সময় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কলকাতা শহরে যে সামাজিক জাগরণ ও রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চার হয়েছে তার সুর এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও তার কারণ এবং কারা সেজন্য দায়ী ও কি তার প্রতিকারের পন্থা, সে সম্পর্কে যেসব খোলামেলা আলোচনা চলছে তারই বাণী। পূর্ববঙ্গের স্বভাব-উগ্র হিন্দু যুবকগণ জেলা ও শহর ছাড়িয়ে গ্রামগ্রামান্তরে সেই সুর ও বাণী ছড়িয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের অগ্রবর্তী বাহিনীর ভূমিকা পালন করতে থাকে।
সমাজজীবনে যে কিঞ্চিৎ কম্পন শুরু হয়েছে, সাহিত্যে নাটকে ও সংবাদপত্রে তার প্রতিফলন ঘটছে। এখানেই শাসকগোষ্ঠীর ভয়। এই মৃদু কম্পনেই তারা শঙ্কাবোধ করল। অদূর ভবিষ্যতে যে এই মৃদু কম্পন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে পর্যবসিত হতে পারে, তা অনুধাবন করার মতো দূরদৃষ্টির অভাব তাদের ছিল না। সুতরাং স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবাগ্নি সৃষ্টির আগে তা পায়ে দলে নিভিয়ে দেবার পন্থা অবলম্বন করাই তারা শ্রেয় মনে করল।
ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সবিস্ময়ে দেখল তাদের বিরুদ্ধে যেমন কলমবাজিতে, তেমনি গলাবাজিতে সারা ভারতে বাঙালীরাই উচ্চকণ্ঠ এবং অগ্রগণ্য। শাসনযন্ত্রের সর্বক্ষেত্রে যেমন তাদের একচ্ছত্র প্রাধান্য, তেমনি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টিতেও তারা মুক্তকণ্ঠ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাঙালী হিন্দুর একাধিপত্যের অন্যতম কারণ শুধু শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকাই নয়, ভৌগোলিক অখণ্ডতাও তাদের শক্তিসামর্থ্যের অন্যতম উৎস। পূর্বদিকে শ্রীহট্ট-কাছাড়-গোয়ালপাড়া এবং পশ্চিমে মেদিনীপুর মানভূম-সিংভূম-পূর্ণিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বাঙালী হিন্দুর অখণ্ড অবস্থানই তাদের সর্বক্ষেত্রে সার্বিক একাধিপত্যের কারণ। শিক্ষাগত দিক থেকে পশ্চাৎপদ এবং সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের পক্ষে বাঙালী হিন্দুর সঙ্গে এঁটে ওঠা দুষ্কর। শিক্ষাগত ও আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসরতা হেতু হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ মুসলমানদের অসন্তোষকে কাজে লাগাতে ভেদবুদ্ধি বিশারদ ব্রিটিশ প্রশাসন এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে না কোনমতে। তারা বাঙালী হিন্দুদের ভৌগোলিক দিক থেকে দ্বিখণ্ডিত করার তাগিদ অনুভব করে। তা না হলে সঙ্ঘবদ্ধ বাঙালী হিন্দু একদিন পূর্ণশক্তিতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলে তা রোধ করা মহা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়ে এলেন লর্ড কার্জন। কার্জনের আগমনের আগে থেকেই সুবৃহৎ বাংলা প্রেসিডেন্সীর ও আসাম সহ পূর্বাঞ্চলের সীমানা পুনর্বিন্যাসের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। পূর্ববর্তী রাজপুরুষগণ যেখানে শাসনশৃঙ্খলার স্বার্থে এবং বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধার কথা মাথায় রেখে সীমানা হেরফেরের কথা ভেবেছিলেন, লর্ড কার্জন তার সঙ্গে হিন্দুদের ক্ষমতা খর্ব করার কথাটি মনে রেখে কাজের দিকে এগোলেন। যেহেতু বাংলার বুকেই কলকাতা শহরে ভারতের রাজধানী তথা শাসনকেন্দ্র ও বাণিজ্যকেন্দ্র, সুতরাং বাঙালী সমাজে উত্তেজনার উত্তাপ রাজধানী শহরের বুকে সমবেত সারা ভারতের জনসমষ্টির মধ্যে সংক্রামিত হবার আশঙ্কা তাদের মনে দানা বাঁধতে থাকে। তার প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে বাংলার অঙ্গচ্ছেদ করে বাঙালীকে সংখ্যাগত দিক থেকে দুর্বল ও রাজনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে তোলাই তারা সঙ্গত পন্থা মনে করে। ফলে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই পুনরায় বঙ্গভঙ্গের প্রশ্ন মাথা চাড়া দেয়। বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে দুদে সিভিলিয়ান স্যার হেনরি কটনের মতামত থেকেই এসব বক্তব্যের সমর্থন মেলে :
“The object of the measure was to shatter the unity and to disintegrate the feelings of solidarity which are estab-lished in the Province of Bengal. It was no administrative reason that lay at the root of the scheme. It was a part and parcel of Lord Curzon’s policy to enfeeble the growing powers and to destroy the political tendencies of a patriotic spirit.”
১৯০০ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন আসাম পরিভ্রমণে যান। সেখানে চা-বাগানের মালিকগণ—ইউরোপীয় তো বটেই, তাঁর কাছে চা রপ্তানির সুবিধার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে তোলার দাবি জানান। কার্জনের মনে এক দুষ্ট অভিসন্ধি খেলে। তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারার কথা চিন্তা করলেন। অর্থাৎ ইংরেজদের অর্থনৈতিক স্বার্থে বাংলার পূর্বাংশ আসামের সঙ্গে যুক্ত করার এবং সে সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দুদের এক বৃহৎ অংশকে মূল বাংলা ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতলব আঁটেন। বাহ্যত প্রশাসনিক স্বার্থে বাংলার আয়তন হ্রাস করার কথা বলে বেড়ালেন। সেন্ট্রাল প্রভিন্সের চীফ কমিশনার প্রস্তাব দিলেন উড়িষ্যা ও সম্বলপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বাংলার আয়তন হ্রাস করা হোক। অন্যান্য আমলারাও আলাদা প্রস্তাব দিলেন। কার্জন তখন মিঃ ফ্রেজারকে (ইতিমধ্যে তিনি বাংলার ছোটলাট হয়ে এসেছেন) এই বিষয়ে বিস্তৃত খসড়া তৈরি করতে বলেন। এভাবে ছোটলাট ভৌগোলিক বিভাজনের কাজে হাত দিলেন, আর বড়লাট মানসিক বিভাজনের জমি তৈরির কাজে মন দিলেন।
যা হোক, খসড়া তৈরি হল। “ঠিক হল-চট্টগ্রাম বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ঢাকা ও মৈমনসিং জেলা আসামে যাবে; ছোটনাগপুর যুক্ত হবে মধ্য-প্রদেশের সঙ্গে; বিনিময়ে বাংলা পাবে সম্বলপুর ও গঞ্জাম। “এতে বাংলার লোকসংখ্যা কমবে এক কোটি নয় লক্ষ, আসাম প্রশাসনের সুবিধা বাড়বে, উড়িষ্যাবাসীরা এক শাসনাধীনে আসবে।”
এ পর্যন্ত মন্দের ভাল। কিন্তু এর সঙ্গে নতুন যে দুটি কারণ দেখান হল সে দুটিই মারাত্মক; ভবিষ্যৎ দুরভিসন্ধির পূর্বগামিনী ছায়া বলা যেতে পারে। কারণ দুটি হল : (ক) কলকাতার বিপজ্জনক প্রভাব থেকে পূর্ববঙ্গ মুক্ত হবে, (খ) মুসলিম অধিবাসীদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা সম্ভব হবে
এতদিন বাংলার সীমানা পুনর্বিন্যাস নিয়ে শলাপরামর্শ, জল্পনা-পরিকল্পনা চলছিল মূলত শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এবার তার সঙ্গে যে নতুন দুটি কারণ যোগ করা হল, তাতেই এসব চিন্তাভাবনার পেছনে রাজশক্তির সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রথম পরিচয় পাওয়া গেল।
বলা বাহুল্য, পূর্ববঙ্গের জমিদার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও সংবাদ-পত্রসমূহ বাংলার আয়তন সঙ্কোচনের প্রস্তাবের প্রতিবাদে মুখর হল। শাসকগোষ্ঠী বলল এদের স্বার্থে ঘা লাগবে বলেই এরা চেঁচাচ্ছে; সুতরাং প্রস্তাব সঠিক এবং তা কার্যকরী করা হবে। শাসকগোষ্ঠীর অনুমান আংশিক সত্য হলেও বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যাই যদি বাংলার সীমানা পুনর্বিন্যাসের একমাত্র কারণ হতো, তা হলে আরো সহজপথে তারা সে সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। যেমন, তারা বাংলাভাষী অঞ্চলকে না ছেঁটে, অতি সহজে হিন্দি ও ওড়িয়াভাষী অঞ্চলগুলি বিচ্ছিন্ন করতে পারতেন। ক্যাম্বেল ও কটন প্রমুখ আমলারা সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন। কিন্তু রিজলে ও অন্যান্য কূটবুদ্ধিসম্পন্ন আমলাদের পরামর্শে তা গ্রাহ্য হয়নি। কারণ এসব প্রস্তাব পরিকল্পনার যিনি মূল হোতা, তাঁর অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নরূপ।
উদ্ধতস্বভাব কার্জন বাঙালীদের প্রতিবাদে কর্ণপাত করা প্রয়োজন মনে করেননি। অস্থায়ী ভারত সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি তাঁর উষ্মা চেপে না রেখে সরাসরি বাঙালী চরিত্রের উপর কটাক্ষ করে লেখেন :
“বাঙালীরা নিজেদের এক মহাজাতি বলে মনে করে এবং এক বাঙালীবাবুকে লাট সাহেবের গদিতে বসাতে চায়….. বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব তাদের এই স্বপ্নের সফল রূপায়ণে বাধা দেবে। আমরা যদি তাদের আপত্তির কাছে নতিস্বীকার করি তবে ভবিষ্যতে কোনদিনই বাংলা ভাগ করতে পারব না এবং আপনারা ভারতের পূর্বপার্শ্বে এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা এখনি প্রবল এবং ভবিষ্যতে বর্ধমান বিপদের উৎস হয়ে থাকবে।”
কার্জনের আশঙ্কা এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে কোন ভুল নেই। বাংলার অবস্থা ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। সে-সঙ্গে বাড়ছে প্রশাসনের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর করে শিক্ষা সঙ্কোচনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে আচার্য হিসাবে কার্জন বাঙালীর চরিত্রের উপর কটাক্ষ করে আবারও তাঁর গায়ের ঝাল মেটালেন। শাসকগোষ্ঠীর কিন্তু কামনা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের মতো পূর্বাঞ্চলেও একটি বশংবদ মুসলিম কর্তৃত্বাধীন প্রদেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু যতদিন বঙ্গভাষাভাষী এলাকা অবিভক্ত থাকবে, ততদিন হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে যাবে। তাতে শাসকগোষ্ঠীর অভীষ্ট সিদ্ধ হবে না। তাই তারা হঠাৎ মুসলমানদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ও ধর্মীয় বিরোধ এবং অর্থনৈতিক অসাম্যকে রাজনৈতিক রঙে রঞ্জিত করে সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন জোগাতে থাকে।
কার্জন ভাবলেন তাঁদের এই মনোগত অভিপ্রায় পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতাদের কর্ণগোচর করা দরকার। তিনি ১৯০৩ সালে পূর্ববঙ্গ সফরে বের হলেন এবং বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবে মুসলমানদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হলেন। একদিকে ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে তিনি আশ্বস্ত করলেন এই কথা বলে যে অবিলম্বে বঙ্গবিভাগ না করলে “ভারতের পূর্বাংশে এমন একটি দুর্ধর্ষ শক্তিকেই দৃঢ় ও শক্তিশালী করা হইবে যাহা ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান অশান্তির নিশ্চিত উৎস হইবে।” অপরদিকে তিনি মুসলমানদের আশান্বিত করে ঢাকার বক্তৃতায় ঘোষণা করলেন— মুসলিমদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদা প্রদেশ গঠনই তাঁর লক্ষ্য। ঢাকার নবাবের বাড়িতে সমবেত মুসলিম নেতাদের তিনি বলেছিলেন— “আমি আপনাদের একটি মুসলিম প্রদেশ দিচ্ছি।” মুসলিম নেতারা সোল্লাসে এই প্রস্তাবে তাদের সম্মতি দান করেন এবং কার্জনকে মোবারকবাদ জানালেন। ইতিমধ্যে ফ্রেজার, রিজলে ও ইবেটসন প্রমুখ রাজপুরুষদের পরামর্শক্রমে কার্জন বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনাকে আরোও ব্যাপক রূপ দান করেন। সর্বশেষ ব্যবস্থামতে : ৩০ বছর পূর্বেকার ব্যবস্থামতো বাংলাভাষী শ্রীহট্ট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলা তো আসামের সঙ্গে যুক্ত রয়েই গেছে; নতুন ব্যবস্থায় পুরো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাও তার সঙ্গে যুক্ত হল এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম (Eastern Bengal and Assam) নামে নতুন এক প্রদেশ গঠিত হল। আর প্রেসিডেন্সী ও বর্ধমান বিভাগ এবং দার্জিলিং জেলা সমেত বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে Bengal বা বঙ্গদেশ নামে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর বাকী অংশ পরিচিত হল। বাংলার মাটি নিয়ে এই ছিনিমিনি খেলার পরিণতি হল বাংলাভাষী এলাকাটি প্রায় দশ আনি ছয় আনি হারে দ্বিধাবিভক্ত হল। আর তার ফলে শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ অভিলাষ পূর্ণ হল; অর্থাৎ বাঙালী হিন্দুরা নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে সংখ্যালঘু, মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। অনুরূপভাবে বঙ্গ প্রদেশেও (Bengal) বাঙালী হিন্দুরা হল সংখ্যালঘু; হিন্দী ও ওড়িয়াভাষীরা সমবেতভাবে সংখ্যাগুরু।
বাংলার সীমানা নিয়ে এই কাটাছেঁড়া, জোড়াতালি তালিমালি একেবারে উদ্দেশ্যবিহীন ছিল না। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী তাদের এই পরিকল্পনার কথা গোপনও রাখেনি। রিজলের লেখা থেকে এই দুরভিসন্ধির আসল রহস্য জানা যায় :
“সংযুক্ত বাংলা শক্তিশালী। বিভক্ত বাংলা ভিন্ন ভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হবে। কংগ্রেস নেতারা এ ভয় করছেন। তাঁদের আশঙ্কা নির্ভুল, এবং এই প্রস্তাবের বড়োগুণ, আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ রাজত্বের বিরোধী এক সুসংহত দলকে টুকরো করে দুর্বল করে দেওয়া।”
ব্রিটিশ শাসকশ্রেণীর মুখপত্র সেকালের স্টেটসম্যান পত্রিকা কোনও ভণিতা না করেই অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বাংলা ভাগের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে লিখেছে :
“The object of the Partition was to foster in Eastern Bengal the growth of a Mahomedan power which, it is hoped, will have the effect of keeping in check the rap-idly growing strength of the Hindu Community.”“
কার্জন ঢাকার নবাবকে এক লক্ষ পাউন্ড নামমাত্র সুদে ধার দিয়ে (যা ঘুষের নামান্তর) বঙ্গভঙ্গের পক্ষে টানলেন। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে শুধু বাংলার মাটিই ভাগ হয়নি, হিন্দু মুসলমানে মানসিক বিভাজনের পথও খোলা হল।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হল। কংগ্রেস নেতাদের (দু’চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই হিন্দু) অজস্র প্রতিবাদ সভা নিষ্ফল হল। অখণ্ড বঙ্গভাষা সাহিত্য শিল্প-সংস্কৃতির দোহাই কোন কাজে এল না। অরন্ধন, রাখী বন্ধন, বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথায় কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করলেন না। কলকাতায় যখন শোকের ছায়া, ঢাকায় তখন আনন্দোচ্ছ্বাস। বিক্ষুব্ধ বাঙালীর হৃদয় নিংড়ান ব্যথা প্রকাশ পেল রবীন্দ্রনাথের গানে :
বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
এক হোক, এক হোক, এক হোক হে ভগবান।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে সামান্য দু’চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া মুসলমান সমাজ সামিল হল না। ইংরেজের মন্ত্রণায়, মুসলিম নেতাদের প্ররোচনায় তারা আন্দোলন থেকে শুধু দূরে সরেই রইল না, পটুয়াখালি, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে বসল। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতিধ্বনি তাদের কণ্ঠে ফুটল ভিন্ন ভাষায় :
বাংলার মাটি বাংলার পানি
খোদা তোমার মেহেরবানী
ভাগ কর, ভাগ কর, ভাগ কর হে রহমান।
মাটি ভাগ হল, মন ভাগ হল। তাতেও শাসকগোষ্ঠীর স্বস্তি নেই। এবার মুসলমানদের রাজনৈতিক বিভাজনে তারা হাত দিল। মুসলমানদের আলাদা রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হল।
১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হলে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের উল্লাস চেপে রাখতে পারেনি। ভারতবৈরী আগা খাঁ এবং ঢাকার নবাব সলিমুল্লার অশুভ যোগসাজসে মুসলিম লীগ পার্টি প্রতিষ্ঠার পর বড়লাট লর্ড মিন্টো এক পত্রে আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করে লেখেন :
“I must send your Excellency a line to say that a very big thing has happened today a work of statesmanship that will affect India and Indian history for many a long year. It is nothing less than the pulling back of sixty-two millions of people from joining the ranks of the seditious opposition.”
“আমি আপনাকে….জানাতে চাই যে আজ একটি খুব বড় ঘটনা ঘটিয়াছে—আজ এমন এক রাজনীতিক কাজ হইয়াছে, যাহার প্রভাব ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের উপর বহু বৎসর ব্যাপী প্রবল থাকিবে। ইহার ফলে ছয় কোটি লোককে (অর্থাৎ মুসলমানকে রাজদ্রোহীদের (অর্থাৎ হিন্দুদের) দল হইতে ছিনাইয়া লওয়া হইয়াছে।” বস্তুত ঐদিন থেকে হিন্দু-মুসলমানে চিরস্থায়ী বিরোধ ও বিচ্ছেদের বীজ উপ্ত হল; এবং মুসলিম রাজনীতি সাম্রাজ্যবাদের দালাল এই অপবাদ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি কোনও দিন। তা নির্জলা সত্যও বটে।
যা হোক, অবশেষে হিন্দুদের অহিংস ও সহিংস আন্দোলনে উত্যক্ত ব্রিটিশ সরকার ৬ বছর পর নাকে খত দিয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে, ‘settled fact’-কে ‘unsettle’ করতে বাধ্য হল। অমিত শক্তিধর ব্রিটিশ সরকারকে বিজিত জাতির কাছে এমন নতি স্বীকার করতে হয়নি কোথাও।
কিন্তু দুষ্টবুদ্ধি তখনো তাদের বাঙালী হিন্দুর ক্ষতিসাধন থেকে বিরত করেনি। এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জমিও তারা তৈরি করে রাখল। বিভক্ত বাংলাকে জোড়া দেবার নামে তারা বিহার-উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করল। তার সঙ্গে মানভূম, সিংভূম, সাঁওতাল পরগনা ও পূর্ণিয়ার বিরাট বাংলাভাষী এলাকা বিহারের সঙ্গেই যুক্ত করে রাখল। এভাবে বাংলার পূর্বাংশে বিশাল এলাকা রইলো আসামের সঙ্গে; আর পশ্চিমাংশে বিরাট এলাকা রয়ে গেল বিহারের সঙ্গে। কার্যত ভাঙা বাংলাকে জোড়া দেবার নামে তিন খণ্ডে ভাগ করা হল। বাংলার সীমানা নিয়ে বারংবার এরূপ যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের পরিণতি হল ব্রিটিশের ইচ্ছাপূরণ। অর্থাৎ বিভক্ত বাংলার দুই অংশে যেমন হিন্দুদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছিল, বাংলার মূল ভূখণ্ডে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে সংযুক্ত করেও বাঙালী হিন্দুদের সংখ্যালঘু করে রাখা হল। বঙ্গভঙ্গ রদে বেখুশ মুসলমানদের কিছুটা খুশি করা গেল; কিন্তু বাঙালী হিন্দুর উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে রইল বিদেশী ব্রিটিশ ও স্বদেশী মুসলমান সম্প্রদায়।
ব্রিটিশ সরকার এই অপমানের জ্বালা ভুলতে পারেনি। এই অপমানের পর কোনও বড়লাটের পক্ষেই কলকাতায় বসে ভারত শাসন করা সম্মানজনক মনে হল না। সুতরাং কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাঙ্গালীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাকেও খর্ব করা হল। আর ৪০ বছর পরে ভারতভাগের প্রাথমিক মহড়াও বাংলাভাগের উপর দিয়েই অনুষ্ঠিত হল।
ভাঙা বাংলা জোড়া লাগল। সে আবেগে অনেকেই আপ্লুত হলেন। কিন্তু সে-সঙ্গে বাঙালী হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সর্বনাশের বীজও যে পোঁতা হল সেকথা অনেকেই বুঝতে পারেননি। যাঁরা বুঝেছেন তাঁরা হায় হায় করলেন। বিভঙ্গ অঙ্গ জোড়া দেওয়া হল বটে, কিন্তু তাকে ত প্রতিবন্ধী করে রাখলই, উপরন্তু তার মস্তকের মুকুটও কেড়ে নেওয়া হল। বাংলাকে এভাবে হতশ্রী করার বিরুদ্ধে স্বয়ং বড়লাটের সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এক অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যানসেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় :
“Bengal has been for more than a century the leading province of India; Calcutta has been the Capital in name, no less than in fact of a great empire and now these high distinctions are all at once passing away from us. Calcutta, Bengal, are discrowned and cannot help feeling desolate. The gloom of grievous bereavement lies heavy in our minds; we feel like men who have ‘fallen from their high estate’ ……”(Ccnvocation Address, 1912 ) .
যা হোক, বাংলা ও বাঙালীকে পঙ্গু করার খেলায় প্রথম রাউন্ডে হেরে গিয়েও ফলাফলের কারচুপি করে ব্রিটেন জিতে গেল এবং ভবিষ্যতে খেলাটা ভারত বনাম ব্রিটেনের মধ্যে সঙ্ঘটিত না হয়ে, কংগ্রেস বনাম মুসলিম লীগ তথা হিন্দু বনাম মুসলমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবার পথ পরিষ্কার করে রাখল; আর ব্রিটিশ প্রশাসন স্থান নিল রেফারীর। বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে হিন্দুদের থেকে আলাদা করে রাখার এই যে প্রক্রিয়া শুরু হল, তার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। সেসব ঘটনা ক্রমশ প্রকাশ্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন