দীনেশচন্দ্র সিংহ
একাদশ অধ্যায় – বিভক্ত ভারত, অবিভক্ত বাংলা : ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রয়াস : সুরাবর্দীর ফাঁদে শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায় বারোজের ঘটকালি
২০শে ফেব্রুয়ারী ’৪৭ তারিখের সরকারী ঘোষণায় কংগ্রেস-লীগ ক্ষমতা গ্রহণ সম্পর্কে একমত হতে না পারলে প্রদেশগুলির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইঙ্গিত দেখতে পেয়েই শিখেরা যেমন পাঞ্জাব ভাগের দাবি তুলেছে, সুরাবর্দীও বাংলায় মুসলিম লীগের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনায় উল্লসিত হয়ে ওঠেন এবং কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গে যুক্তবঙ্গ পরিকল্পনায় মেতে ওঠেন। ঘটকালির দায়িত্ব নিলেন গভর্নর বারোজ সাহেব।
২০শে ফেব্রুয়ারীর ঘোষণাতেই ভারতভাগের সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। জিন্নার তো আহ্লাদের সীমা নেই, কিন্তু পাঞ্জাবী হিন্দু-শিখেরা পাঞ্জাব ভাগের দাবি তুললে এবং কংগ্রেস সে দাবি সমর্থন করলে জিন্নার টনক নড়তে থাকে। দেশভাগের দাবিতে সারা ভারতে তিনি হিংসা-বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়েছিলেন; আর সে প্রজ্বলিত অগ্নি প্রদেশ ভাগের দাবি রূপে তার দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। কংগ্রেসের পাঞ্জাব ভাগ দাবির মধ্যে ভারতভাগের সম্মতির আঁচ পেয়েই শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা বাংলাভাগের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়; তাঁর পেছনে দাঁড়ান বাংলার বুদ্ধিজীবিগণ।
বাংলাভাগের দাবি জোরদার হতেই কিরণশঙ্কর রায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বারোজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন (৫ই মার্চ ‘৪৭)। বারোজ রায়ের কাছে ‘স্বাধীন বাংলা’ সম্পর্কে বাংলার হিন্দুদের মতামত জানতে চান। রায় তাঁকে জানান হিন্দুরা মুসলিম লীগ শাসনের উপর এমনই বিক্ষুব্ধ যে তারা স্বাধীন যুক্তবঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং বর্তমান লীগ সরকারকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করে সমান্তরাল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানাবে :
“ …. The Hindus would probably launch a passive resistance movement, refuse to pay any tax to the existing Govern-ment of Bengal and set up a parallel Government of their own to which they would pay taxes.”
বারোজ সুরাবর্দীর সাম্প্রতিক বক্তৃতা ও বিবৃতির উল্লেখ করে রায়কে বলেন– তাঁর ও তাঁর দলের উচিত হবে প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে সারা ভারতের ক্ষেত্রে যাই ঘটুক সে দিকে দৃপাত না করে, বাংলায় মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করে স্বাধীন যুক্ত বাংলা গঠনের চেষ্টা করা :
“(Burrows) suggested that the proper course for Mr. Roy and his party to adopt was to be reasonable and to meet the Chief Minister more than half-way so that a Coalition Govern-ment could be set up in Bengal irrespective of what happened in the rest of India to enable a peaceful transfer of power to be made.”
রায় জবাবে বলেন যদি তা করার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তিনি ও তাঁর দল খুশির উপর খুশি হবেন এবং মন্ত্রিসংখ্যা নির্ধারণ ও দপ্তর বণ্টনের দায়িত্ব তাঁরা বারোজের উপর ছেড়ে দিতে রাজী আছেন :
“Mr. K. S. Roy replied that if that could be accomplished he and those for whom he spoke would be more than satisfied and he added that they would be content to leave the issues of the number and distribution of portfolios in such a Coalition Government in the hands of the Governor.’
এ না হলে আর কংগ্রেসী হিন্দু! মুসলিম রাজনীতির রীতিচরিত্র সম্পর্কে কণামাত্র জ্ঞান থাকলে তিনি তৎকালীন পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসংখ্যা নির্ধারণ ও দপ্তর বণ্টনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বারোজের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে পারতেন না।
প্রায় এক বছর বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিম লীগের অত্যাচার ও নির্যাতন চলছে। গভর্নর বারোজের নাকের ডগায় যে নারকীয় কাণ্ড ঘটল এবং তখনও প্রতিদিনই ঘটছে, নোয়াখালি ত্রিপুরা ঢাকা চট্টগ্রামে তখনও হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গা সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি— প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও অরাজকতা দমনে বারোজ তাঁর অঙ্গুলি উত্তোলন করেন নি; নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেননি। এখন বাংলাভাগের দাবি জোরদার হতেই তিনি বাংলার অখণ্ড ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির জয়গান শুরু করেছেন। এ যেন মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী। আসল কথা বাংলায় ব্রিটিশের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবার আশঙ্কাতেই তিনি উদ্বিগ্ন; তাই সুরাবর্দীর কানে তিনি স্বাধীন বাংলার ফুসমন্তর দিলেন। সুরাবর্দী নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনায় তাতে মেতে উঠলেন।
বাংলায় মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনে সম্মত না হওয়ার জন্য আজকাল অনেকেই হিন্দু নেতাদের দোষারোপ করে থাকে। কিন্তু আদতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের খোদকার স্বয়ং জিন্নাই বাংলায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী মুসলিম লীগকে হিন্দুদের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনে অনুমতি দিতে রাজী ছিলেন না। ২৮শে মার্চ ‘৪৭ তারিখে ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী মিঃ এটলী ও অন্যান্য রাজপুরুষদের এক বৈঠকের কার্য বিবরণীতে দেখা যায় :
“This proposal had not, however, been acceptable to Mr. Jinnah, and the Congress demands had been excessive.”
কংগ্রেসের দাবি ‘excessive’ হওয়া স্বাভাবিক; কারণ হিন্দুদের গায়ের আঘাত তখনও শুকায়নি। বরং নিত্যনূতন আঘাত চলছেই। এমতাবস্থায় যুক্ত মন্ত্রিসভার সম্ভবনা দূর অস্ত্ :
“In the circumstances, the prospect of securing an effective coalition were remote.”
দাঙ্গাহাঙ্গামা সম্পর্কে সুরাবর্দীর দৃষ্টিভঙ্গীর তখনও কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তিনি বিহারের দাঙ্গা সম্পর্কে তদন্ত চান; কিন্তু নোয়াখালি ত্রিপুরার দাঙ্গা সম্পর্কে নিরুত্তর। মাউন্টব্যাটেন বারোজকে লিখছেন :
“I understand Suhrawardy has been pressing for enquiry into Bihar riots, but does not wish to accept simultaneous enquiry into East Bengal riots at Noakhali and Tipperah.” (1.4.47)
অথচ কে না জানে যে বিহারের কংগ্রেস সরকার ও কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কঠোর হস্তে বিহারের দাঙ্গা দমন করেন এবং পুলিশ ও মিলিটারির গুলিতেই ছয় শতাধিক হিন্দু নিহত হয়। আর কলকাতা ও নোয়াখালি-ত্রিপুরার দাঙ্গায় পুলিশ-মিলিটারির গুলিতে ৫০ জনও মুসলমান দাঙ্গাকারী মারা গেছে কিনা সন্দেহ দাঙ্গা দমনে দু’টি পরস্পর-বিরোধী রাজনৈতিক দলের পরিচালনাধীন প্রাদেশিক সরকারের শাসন ব্যবস্থার এই হল প্রকৃতিগত তফাত।
১২ই মার্চ ‘৪৭ তারিখে জিন্না বোম্বাইতে এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন ‘পাকিস্তান’ মেনে নেওয়া ছাড়া ভারতীয় সমস্যা সমাধানের বিকল্প কোনও পথ নেই :
“At a Press Conference in Bombay ( on 12. 3. 47) Mr. Jinnah was reported as saying that there was no other solution which would be a credit and honour to the millions of Muslims of India except Pakistan.
Mr. Jinnah continued: We have got to stand on our own legs. Our ideology, our goal, our basic and fundamental principles and our programmes are not only different from the Hindu Organisations but are in conflict. It is obvious, therefore, that the two cannot be put together and work in co-operation.
There is no common ground for co-operation or harmonious working…. Let us (Muslims ) move and move together and, Insha Allah, (God willing) we shall have Pakistan. “
একদা হিন্দু-মুসলিম মিলনের দূত বলে কথিত জিন্নার মুখে কি মধুর মিলনগীতি!
২৫শে মার্চ ‘৪৭ তারিখে মাউন্টব্যাটেন তাঁর পরামর্শদাতাদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে বলেন পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক শান্তির স্বার্থে ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাঞ্জাবকে সাময়িকভাবে তিনভাগে ভাগ করে তিনটি সরকারের হাতে শাসনভার অর্পণের প্রস্তাব নেহরু দিয়েছেন। এদিকে স্থায়ী বা অস্থায়ী যে কোনওভাবে পাঞ্জাব ভাগের বিরোধী মিঃ জিন্না। তিনি পুরো পাঞ্জাব মুসলিম লীগের শাসনাধীনে রাখতে চান। কিন্তু হিন্দু ও শিখেরা কোনও মতেই পুরো পাঞ্জাবের শাসনভার মুসলিম লীগের হাতে ছেড়ে দিতে রাজী নয়, কারণ তাদের হাতে হিন্দু শিখদের ধনপ্রাণের নিরাপত্তা নেই। সেই বৈঠকে মিঃ অ্যাবেল বলেন যে একবার পাঞ্জাব ভাগে রাজী হলেই আর বাংলাভাগ ঠেকান যাবে না :
“Mr. Abell gave his opinion that the partition of Bengal was almost bound to follow any partition in the Punjab.”
শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা বাংলাভাগের দাবিতে মুখর হতেই গান্ধীজী তাঁর ক্ষোভ গোপন রাখতে পারেন নি। আন্দোলন যখন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে; তখন তিনি ও শরৎ বসু একযোগে শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভার নিন্দা করতে লাগলেন। বারোজ ওয়াভেলকে জানাচ্ছেন :
“The movement for partitioning Bengal is gathering momentum. Hindu opinion is at present very divided. For once Sarat Bose and Gandhi see eye to eye, and both condemn the movement, of which Syamaprasad Mookerjee and the Hindu Mahasabha are the chief protagonists.” (19.3.47)
এদিকে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করলে স্বাধীন বাংলা যে এক সুখী সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, সুরাবর্দী সে সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগলেন। তাঁর দুজন সহকর্মীও তাঁর সঙ্গে সুর মেলালেন :
“Suhrawardy has made a number of speeches on the subject, his line being that Bengal must be independent of the Centre, that Hindu and Muslim Bengalis must work in harmony for the common prosperity of the Province and that one-party rule in this and other Provinces must end. His sentiments have been echoed by two of his colleagues..”
এ পর্যন্ত তো শুনতে বড় মধুর লাগে। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালী মিলেমিশে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলা গড়ে তুলবে— সুরাবর্দীর মুখে একথা শুনতে কার না আহ্লাদ হয়। কিন্তু তারপরেই ছোট অক্ষরে বিরাট ‘but’. এতদিন ধরে যে মুসলিম জনতাকে হিন্দুদের উপর যথেচ্ছাচারের অধিকার সমেত পাকিস্তান নামে শরিয়তী বাংলা গড়ে তোলার মাদক পান করান হয়েছিল, তাদের কর্ণে হঠাৎ এই সোনার বাংলার ডাক বেসুরো বাজারই কথা। ইসলামী বাংলায় হিন্দুরা ‘জিম্মি’ হিসাবেই থাকবে। ইচ্ছামতো তাদের বিষয় সম্পত্তি দখল করা যাবে, বাধা দিতে এলে কোতল করা যাবে, তাদের খুপসুরত মেয়ে বৌগুলিকে কেড়ে নেওয়া যাবে, তার জন্য থানা পুলিশ করার সাহস হবে না হিন্দুদের; হলেও শরিয়তী রীতি অনুযায়ী মুসলমান দারোগা তা কানে শুনবে না, মুসলমান জজসাহেব তা চোখে দেখবে না; এমন খোয়াবের পাকিস্তানের বদলে হিন্দুদের সঙ্গে মিলেঝুলে আজাদ বাংলা! যাদের দুশমন বলে বুকে ছোরা মারতে শেখান হয়েছিল, তাদের দোস্ত বলে বুকে জড়িয়ে ধরা! ব্যাপারটা যে মুসলিম লীগের চেলা চামুণ্ডাদের পক্ষে হজম করা বেশ শক্ত তা বারোজের নজর এড়ায়নি। তিনি লিখেছেন :
“…but I doubt if the rank and file of the Party have the vision to realise that they cannot hope by means of their present political power (which is to some extent the artificial creation of British rule) to dominate the Hindus with whom the economic power still rests’
কী সাংঘাতিক কথা! ব্রিটিশ শক্তির বিদায়লগ্নে বন্ধনী মধ্যস্থ বাক্যে বারোজ স্বীকার করলেন যে বাংলায় মুসলমানদের কৃত্রিম উপায়ে ক্ষমতাসীন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার অন্যায়ভাবে খর্ব করেছে-যা কালক্রমে হিন্দু মুসলমান বিভেদের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
যাহোক, মেকী হলেও সুরাবর্দীর এই হঠাৎ রাজনৈতিক উদারতায় মুসলিম লীগের দলপতিরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে বসেন। সুরাবর্দী তখন ঢোক গিলে বলেন যে বাংলায় লীগ-কংগ্রেস যুক্ত মন্ত্রিসভার কথা তিনি এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বলেছেন যে, তাহলে ভারতের অন্যান্য কংগ্রেসশাসিত প্রদেশেও কংগ্রেস-লীগ যুক্ত মন্ত্রিসভার পথ সুগম হবে :
“I see that possibly under pressure from the Party, Suhrawardy had to ‘explain’ that when he speaks of a League -Congress Coali-tion in Bengal, he is assuming Coalitions in other (Congress-dominated) Provinces too…”
২২ মার্চ বারোজ-কিরণশঙ্কর আলোচনার উপর এক ‘নোট’ তৈরি করেন বারোজের সেক্রেটারী মিঃ টাইসন। সেটি মাউন্টব্যাটেনের সেক্রেটারী মিঃ অ্যাবেলের কাছে পাঠান। তাতে তিনি বাংলায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠন সম্পর্কে হিন্দু মহাসভা নেতাদের আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন :
“As you probably know the proposal for a separate West Bengal is at present primarily a Hindu Mahasabha idea, the Congress Party is not yet committed to it and opinion among Hindus in Bengal is still very divided. So far as we know, K.S. Roy himself has not publicly committed himself to any scheme of this kind, though it is obvious from his visit to His Excellency he sees and is ready to exploit the bargaining value of the movement vis-a-vis Suhrawardy’s pleas for an independent Bengal in which the 45% Hindu element will have their fair share. “
বাংলাভাগের দাবির প্রতি কিছু সংখ্যক কংগ্রেস নেতারও যে মৌন সমর্থন রয়েছে তা অজানা ছিল না। কিন্তু তখনও ভারত ভাগ সম্পর্কে চূড়ান্ত এবং তার ফলশ্রুতি হিসাবে প্রদেশ তথা বাংলাভাগ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদের অভিমত জানতে না পারায় তারা প্রকাশ্যে সে আন্দোলনে সামিল হতে পারেননি। কিরণশঙ্কর বাংলাভাগ সম্পর্কে তাঁর মতামত প্রকাশ্যে না জানালেও সুরাবর্দীর স্বাধীন যুক্তবাংলায় ৪৫ শতাংশ হিন্দুর স্বার্থ সংরক্ষণে দর কষাকষির উদ্দেশ্যেই বাংলা ভাগ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ২৪শে মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের শেষ ভাইসরয় তথা গভর্নর জেনারেল হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুনের মধ্যে যে কোনওভাবে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফরমান নিয়ে এসেছেন। এদেশে এসেই একে এ ক তিনি ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ১লা এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে নেহরু ও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার ঘটে। আলোচনা প্রসঙ্গে পাঞ্জাব ও বাংলাভাগের প্রসঙ্গ ওঠে। এ প্রসঙ্গ মাউন্টব্যাটেন তাঁর ‘নোটে’ লেখেন :
“We next discussed the partition of the Punjab He linked the question of partition of Bengal with that of the Punjab. He had not yet had the opportunity of discussing with Mr. Gandhi his reasons for opposing the Congress resolutions on partition; but he realised that Mr. Gandhi was immensely keen on a unified India, at any immediate cost for the benefit or the long term future.”
গান্ধীজী তো আপাত যে কোনও মূল্যে ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখতে চান সুদূর ভবিষ্যতের মঙ্গলার্থে; কিন্তু সে মূল্যটি যে কি, তা তিনিও বাতলাতে পারেননি। তিনি তো বারে বারে জিন্নার কাছে ধর্না দিয়ে বৃথা কান্নাই কেঁদেছেন, মুসলমানদের চোখে জিন্নার দাম বাড়িয়েছেন, তাঁর অহমিকা বৃদ্ধিতে মদত দিয়েছেন; কিন্তু জিন্নার মন গলাতে পারেননি। উপরন্তু জিন্না তাঁকে হিন্দু নেতা বলে, কুচক্রী বলে, কটূক্তি করেছেন। ‘কায়েদে আজম” সম্বোধনের জবাব দিয়েছেন ‘মিঃ গান্ধী’ বলে।
৯ই এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে জিন্না ও মাউন্টব্যাটেন এক বৈঠকে মিলিত হন। মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় সমস্যার সমাধানকল্পে তাঁর মতামত জানতে চাইলে জিন্না বলেন :
“……no other solution except full Pakistan could possibly bring peace to India, since anything less would be sure to produce further strife and bloodshed.”
জিন্না নিজেই যেখানে বলছেন পাকিস্তান না হলে আরও সংঘর্ষ এবং রক্তপাত ঘটবে, সেখানে অন্য কে কি বললেন সে খোঁজে আর প্রয়োজন আছে কি? শুধুমাত্র সমতলবাসী রাজনীতি সচেতন মুসলমানরা নয়, সীমান্ত প্রদেশের উপজাতি মুসলমানরা যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই এবং যাদের শান্ত রাখতে ব্রিটিশ সরকারকে বৎসরে সাড়ে তিন কোটি টাকা উপজাতি সর্দারদের খেলাত দিতে হয়, তারাও পাকিস্তানী প্রেমে কেমন ডগমগ হয়ে পড়েছে তার উল্লেখ করে জিন্না সগর্বে বলেন :
“He (Jinnah) gave as an example the Islamic college, which though 15 miles from Peshawar in the jungle, and full of valuables and so on, one would have thought, a natural target for tribal raiders, had never been attacked in 30 years, simply because it was a Muslim College.”
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, এই সাক্ষাৎকারের কিছুদিন আগেই অন্তবর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান হিসাবে ঐ সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন এবং উপজাতি মুসলমানদের সঙ্গে মোলাকাত ও মহব্বত করতে গিয়ে জহরলাল ইটপাটকেল খেয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন—মুসলিম লীগের প্ররোচনাতেই।
জিন্না আরও বলেন, সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী থাকা চাই-ই, এবং সৈন্যবাহিনী ছাড়া কিছুই তাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না :
“He said that the “Begin all and ead all” of Pakistan was to have their own army, and nothing short of this could possibly satisfy them.”
খোদাতালা জিন্না ও পাকিস্তানের সে আশা সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ করেছেন। আজও পাকিস্তানে মিলিটারি ট্র্যাডিশন সমানভাবে চলছে!
ক্ষমতা হস্তান্তরের চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে অটুট রাখার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েও জিন্না আবার মাউন্টব্যাটেনকে অনুরোধ করেন তাকে যেন ‘পোকাকাটা’ (moth-eaten ) পাকিস্তান না দেওয়া হয় :
“Once more he appealed to me not to give him a moth-eaten Pakistan.”
তার উত্তরে মাউন্টব্যাটেনও আবার তাঁকে বলেন, তিনি দেশভাগ সম্পর্কে এখনও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না; কারণ যে যুক্তিতে তাঁকে ভারতভাগে সম্মত হতে হচ্ছে, সেই একই যুক্তি অগ্রাহ্য করে তিনি কিভাবে প্রদেশভাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন :
“……and once more I pointed out that although I had not made up my mind in any way whether to agree to partition or not, I sim-ply could not visualise being so inconsistent as to agree to the partition of India without also agreeing to partition within any provinces in which the same problem arose.”
জিন্না বুঝতে পারলেন মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেল নন— ইনি সব সময় অশোভনভাবে লীগের কোলে ঝোল টানবেন না। মাউন্টব্যাটেনের মানসিক প্রবণতা লক্ষ্য করে জিন্না নিজেকে বিপন্ন বোধ করলেন :
“He was most distressed at the way my mind was working.”
জিন্নাকে এই বিমূঢ় অবস্থায় ফেলে মাউন্টব্যাটেন তাঁকে বলেন, “আপনি আমাকে অখণ্ড ভারতের ভাবনা পরিহার করতে বাধ্য করছেন। এটা আমার কাছে অত্যন্ত শোকাবহ ব্যাপার। আমি তাঁর কাছে অখণ্ড ভারতের এক মনোহর ছবি তুলে ধরলাম— যেখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ৪০ কোটি ভারতবাসী এক কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একই একতা বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষেত্রে বলীয়ান হয়ে একক বৃহত্তম উন্নতিশীল দেশ হিসাবে দূরপ্রাচ্যে বিশ্বব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে :
“I told him that I regard it as a very great tragedy that he should be trying to force me to give up the idea of a united India. I painted a picture of the greatness that India could achieve, four hundred million people of different races and creeds, all bound together by a central Union Government, with all the economic strength that would accrue to them from increased industrialisation, playing a great part in world affairs as the most progressive single entity in the far east.”
কিন্তু বৃথা এ সাধনা ধীমান! ভবী ভুলবার নয়। জিন্না তাঁর দাবিতে অচল অনড়। মাউন্টব্যাটেন মন্তব্য করছেন জিন্না তাঁর মানসরাজ্য পাকিস্তান সম্পর্কে এক কল্প-জগতে বাস করছেন। তিনি যখন বাস্তবের মুখোমুখি হবেন তখন তাঁকে জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতের জন্য তৈরি থাকতে হবে। তিনি পরিষ্কার ভাষায় জিন্নাকে বলেছিলেন :
“You claim the right of a large minority people to partition on a big scale. If I grant you this, how can I refuse Congress, who will press for exactly the same right for the large Hindu minorities in the Punjab and Bengal to be partitoned? Mr. Jinnah’s main point being that I must make his Pakistan “viable’. (11.4.47).
জিন্না কোনও যুক্তি-তর্কের ধার ধারেন না। তাঁর একমাত্র কথা তাঁকে ‘সচ্ছল’ পাকিস্তান দিতে হবে।
এক সপ্তাহে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে জিন্নার ছ’বার সাক্ষাৎকার ঘটে। জিন্নাকে তিনি মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব সম্পর্কে আবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করেন। কিন্তু জিন্না ভারতভাগ করে পাকিস্তান বানানো ছাড়া আর কোনও প্রস্তাব বিবেচনা করতে নারাজ; পাকিস্তান পেতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ :
“He has made it absolutely clear that the Muslim League will not in any circumstances reconsider the Cabinet Mission plan and he is intent on having Pakistan”.
মাউন্টব্যাটেনের অন্যতম পরামর্শদাতা মিঃ ইজমে যখন তাঁর সামনে উভয়ের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি নকশাখানা তুলে ধরেন, তখন জিন্না বলেন— “That is your scheme, not mine.”
জিন্নাকে যখন তাঁর নক্শা এবং কিভাবে সে নক্শা বাস্তবায়িত করা হবে তা ব্য্যাখ্যা করতে বলা হল, তখন তিনি বললেন :
“You must carry out a surgical operation; cut India and its army firmly in half and give me the half that belongs to the Muslim League.”
অর্থাৎ আপনাকে অস্ত্রোপচার করতে হবে; ভারত ও তার সৈন্যবাহিনীকে আধাআধি ভাগ করুন এবং মুসলিম লীগের প্রাপ্য অর্ধাংশ আমাকে দিন।
মাউন্টব্যাটেন তখন তাঁকে বলছেন— আমি যদি ভারতভাগ প্রশ্নে আপনার যুক্তি মেনে নিই, তাহলে পাঞ্জাব ও বাংলাভাগের প্রশ্নে কংগ্রেসের যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারি না :
“I told him that if I accepted his arguments on the need for partition of India, then I could not resist the arguments that Congress were putting forward for the partition of the Punjab and Bengal.”
একথা শুনে জিন্না সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং পাঞ্জাব ও বাংলার অখণ্ডতা বজায় রাখার পক্ষে নানা যুক্তি দেখান। তিনি আরও বলেন, পাঞ্জাবী ও বাঙালীরা তাদের প্রদেশভাগ খুশী মনে মেনে নিতে পারে না।
প্রত্যুত্তরে মাউন্টব্যাটেন বলেন, আপনার যুক্তি আমাকে খুবই অভিভূত করেছে এবং সে জন্যই আমি বলি— The partition of India itself would be criminal (ভারত ভাগ করাই হবে অপরাধমূলক কাজ)।
অবশেষে মাউন্টব্যাটেন জিন্নাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে তাঁকে যদি ভারতভাগের সুপারিশ করতেই হয়, তাহলে পাঞ্জাব ও বাংলাভাগের সুপারিশও করতে হবে। কারণ, মুসলিম লীগ যেমন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ভাগ করে নিয়ে পাকিস্তান গড়তে চাইছে, তেমনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দু শিখরাও মুসলিম শাসনের হাত থেকে অব্যাহতি পেতে হিন্দু শিখ অধ্যুষিত এলাকা আলাদা করে নিয়ে ভারতের সঙ্গে থাকতে চাইছে এবং তার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছে :
“I warned him categorically that if I finally decide to recom-mend to his Majesty’s Government that there should be partition, then that principle would be allowed right through to the Provinces and that partition would follow the boundaries of the communal majorities; since I was convinced that the non-Muslim communities in the Punjab and Bengal would be just as likely to fight if put under Muslim domination as Muslim Leaguers would be likely to fight under Congress domination.”
সব শেষে মাউন্টব্যাটেন জিন্নাকে জানিয়ে দেন, যদি ভারত ভাগ করতেই হয় তাহলে খুব বেশি হলে “he would get Sind and Western Punjab for certain; the N. W. F. P. would be a doubtful starter, In the east … he
would get the most useless part of Bengal, without Calcutta and if he wished it, he could have Sylhet back from Assam.”
সুতরাং জিন্নার সামনে মাউন্টব্যাটেন শেষ মুহূর্তে দুটি বিকল্প প্রস্তাব রাখেন-
(i) The Cabinet Mission plan which gave him all five Provinces of Pakistan with complete autonomy and with only a very weak centre to which they would owe allegiance for three subjects which might be covered by the general term defence;
or
(ii) A very moth-eaten Pakistan, the eastern and northwestern frontier parts of which were unlikely to be economic proposition, and which would still have to come to some Centre for general defence subjects for a long while after we had left.
ভারতে সর্বোচ্চ ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধির মুখে একথা শোনার পর মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারেন জিন্নার আর ফেরার পথ নেই। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে মুসলমান জনতাকে যে পাকিস্তানী ভাইরাসে আক্রান্ত করিয়েছেন, তাদের সামনে প্রতিষেধক হিসাবে ভাঙা টুটা ছিন্ন ভিন্ন যে আকৃতিরই হোক ‘পাকিস্তানী বটিকা ছুঁড়ে দিতে হবে। তাই একজন অতি উচ্চাভিলাষী অথচ অপরিণামদর্শী ও পরাজিত অধিনায়কের মতো তিনি ভগ্নকণ্ঠে আকুতি জানালেন :
“I do not care how little you give me as long as you give it to me completely. “
জিন্নার তখন আর কোনও উপায় ছিল না। তিনি গান্ধী নন যে নিজের ভুল ও পরাজয় খোলাখুলি স্বীকার করে নেবেন। পাক-হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মুসলিম জনতার সামনে মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব তুলে ধরলে তারা তাঁকে ছিঁড়ে খাবে। তার চেয়ে তাদের সামনে পোকা-কাটা পাকিস্তান ফেলে দিয়ে বগল বাজিয়ে কোমর দুলিয়ে নাচতে দেওয়াই নিরাপদ—হলই বা তা নাকের বদলে নরুন : ভবিষ্যতে তো পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাঞ্জাব এবং তৎসহ সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের হিন্দু ও শিখদের বিপুল বিষয় সম্পত্তির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পথ খোলাই রইল। বিধর্মীর ধনসম্পদ ও নারীকে অপহরণ করলে তা তো ‘গণিমতে’র মাল বলে গণ্য এবং ইসলামী অনুশাসনে ভাগবাঁটোয়ারা করে ভোগ করলে পুণ্যকর্ম বলে স্বীকৃত।
আর যে সমস্ত মুসলমান ভারতে পড়ে থাকবে? তারা নিজের নাক কেটে পাকিস্তানের যাত্রা সুগম করেছে। বিশ্বে একটি নতুন ইসলামী রাষ্ট্রের তো জন্ম হয়েছে, তাতেই তাদের আনন্দ : কাদের জানি কি বধে আনন্দ!
জিন্নার সঙ্গে কয়েকবার ঘনিষ্ঠ আলাপ-পরিচয়ের পর মাউন্টব্যাটেন তাঁর যে চরিত্র অঙ্কন করে গেছেন, স্বল্প কথায় জিন্না চরিত্রের এমন অনবদ্য মূল্যায়ন আর কেউ করতে পারেনি :
“I regard Jinnah as a psychopathic case; in fact until had inet him I would not have thought it possible that a man with such a complete lack of administrative knowledge or sense of responsi-bility could achieve or hold down so powerful a position.”
বোঝাই যাচ্ছে মুসলমান সমাজে নেতৃত্ব দখল করার চাবিকাঠি মাউন্টব্যাটেনের মতো ঝানু রাজনীতিকেরও বুদ্ধির অগম্য।
১১ই এপ্রিল তারিখেও মাউন্টব্যাটেন জিন্নাকে দেশভাগের বিরুদ্ধে পাখিপড়া পড়িয়েছেন, অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছেন—The enormous advantages of retaining an undivided India. তা সত্ত্বেও তিনি কেন এ সুযোগ হাতছাড়া করছেন? — Why he could wish to throw away such advantages? কিন্তু জিন্না মাউন্টব্যাটেনের কোনও যুক্তিরই উত্তর দিতে পারেন নি — “Mr. Jinnah had not been able to address one single feasible argument in favour of Pakistan. In fact he had offered no counter arguments.”
মাউন্টব্যাটেন জিন্নাকে একথাও বলেছিলেন তিনি চাইলে তাকে তিনি অবিভক্ত ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধানের স্বীকৃতি আদায় করে দিতে এবং মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের গ্যারান্টি দিতেও রাজী আছেন -“He had assured Mr. Jinnah that he regarded himself as more or less the first head of the Indian State and that it was his sole intention to do whatever was best in the interest of the Indian people.”
কিন্তু বরফ গলেনি। হাল ছেড়ে মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন—Mr. Jinnah was a Psychopathic case. He was, whatever was said, intent on his Pakistan-which could surely only result in doing the Muslims irreparable damage. (মিঃ জিন্না মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। যে যাই বলুক তার পাকিস্তান চাই-ই, তাতে মুসলমানদের অপূরণীয় ক্ষতি হয় তো হোক)। আর মুসলমানরা এমন পাক-প্রেমান্ধ ও জিন্না-অনুরাগী যে, তারা আজও জিন্না তাদের যে ক্ষতি করে গেছে তা স্বীকার করতে নারাজ কেননা জিন্না তো একটা ইসলামী (এখন দুটো) রাষ্ট্র সৃষ্টি করে গেছে! ইসলামের এত বড় সেবকের কাজের বিচার করা কি চলে?
জিন্নার এই বিকৃত মানসিকতা লক্ষ্য করেই ভারত সচিব লর্ড প্রেথিক-লরেন্স জিন্নার সঙ্গে কথাবার্তার পর মন্তব্য করেছিলেন যে, জিন্নার প্রকৃতি হল ঠিক সেই লোকটির মতো, যে নিশ্চিত হত্যার হাত থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যা করতে দেওয়ার জন্য জেদাজেদি করে—”He seemed to the Secretary of State like a man who know that he was going to be killed and therefore insisted on committing suicide in order to avoid it.”
লর্ড ইজমে বলেছেন, মিঃ জিন্নার মন জুড়ে রয়েছে হিন্দুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও হীনদৃষ্টি। হিন্দুদের তিনি মনুষ্যেতর জীব মনে করেন এবং তাদের সঙ্গে মুসলমানদের বসবাস অসম্ভব বলে বিশ্বাস করেন। “The dominating feature in Mr. Jinnah’s mental structure was his loathing and contempt of the Hindus. He apparently thought that all Hindus were sub-human creatuers with whom it was impossible for the Muslim to live.”
সুতরাং তিনি দেশভাগ না করিয়ে ছাড়বেন না।
জিন্না তো তাঁর ভারতভাগের অশুভ দাবির আপাত সাফল্যে লম্ফঝম্পে, মেদিনী প্রকম্পিত করছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের চাপাচাপিতে কংগ্রেস শেষ মুহূর্তে আসামের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েও মন্ত্রী মিশনের প্রস্তাব নিঃশর্তে গ্রহণ করে দেশভাগ এড়াবার শেষ চেষ্টা করেছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বে হলেও নেহরু দেশভাগের আসন্ন বিপর্যয় এড়াতে অসমীয়াদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ‘গ্রুপ সি’তে বাংলার সঙ্গে আসামকে যোগদানে বাধ্য করতে রাজী হয়েছিলেন। আসামের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সারা ভারতের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছিলেন :
“Pandit Nehru gave a curt reply (to the members from Bengal) saying that Assam could not hold up the progress of the rest of India and support to Assam would mean refusal to accept the British Prime Minister’s statement of December and letting loose forces of chaos and civil war.”
ওদিকে গান্ধীজী কিন্তু অসমীয়া কংগ্রেস নেতাদের কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে বলেছিলেন।
হয় এদেশে থেকে যাও এবং শাসন কর, নইলে মুসলমানদের অংশ বুঝিয়ে দিয়ে কেটে পড় : মাউন্টব্যাটেনকে জিন্না
এদিকে মাউন্টব্যাটেন পর্যন্ত নানাভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অনুরোধ–উপরোধ এমনকি সতর্কীকরণ করেও জিন্নাকে মন্ত্রী মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারলেন না। ভারত সচিবের মতে :
“Mr. Jinnah was very bitter and determined. He seemed to the Secretary of State like a man who knew that he was going to be killed and therefore insisted on committing suicide in order to avoid it.”
(অর্থাৎ মৃত্যু অবধারিত জেনেও তা এড়াবার জন্য আত্মহত্যা করতে উন্মুখ।)
মাউন্টব্যাটেন তখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। জিন্না বললেন, দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও সমঝোতা অসম্ভব। তারা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশভাগ করে দিয়ে সরে পড়ুক। মুসলমানদের ভাগে যতটুকু পড়ে—তা যত ক্ষুদ্র হোক —তাতেই তারা দিনান্তে এক মুঠো খেয়ে ফকিরের জীবন যাপন করবে :
Mr. Jinnah replied that we (British) were gradually putting Muslims under the Hindu rule and that a settlement between the
two communities was quite impossible. If we were going we had better go at once, preferably after dividing the country between the two communities in any way we liked. Alternatively we should stay and continue to rule. He said we should give the Muslims their own bit of country however small it might be and they would be content to live there on one meal a day etc.
কিন্তু প্রদেশভাগের সিদ্ধান্ত যখন পাকাপাকিভাবে স্থির হয়ে গেল, তখন জিন্নার আত্মম্ভরিতার ফাঁপান বেলুন চুপসে গেল। তিনি অসহায়ের মতো মিঃ মিভিলের হাত ধরে কাতর কণ্ঠে মাউন্টব্যাটেনকে জানাতে বললেন :
“At the end of our talk he took my arm and said, I am not speaking as a Partition, but I beg you to tell Lord Mountbatten once again that he will be making a grave mistake if he agreed to the partition of Bengal and the Punjab. “I promised him I would pass on to you his message.” (20-5-47)
কিন্তু জিন্নার ভোলা উচিত হয়নি যে রক্ত অনেক দূর গড়িয়েছে। মুসলিম লীগের গুণ্ডাশাহী ও মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে প্রশ্রয় দিয়ে তিনি মুসলমান সম্প্রদায়ের ‘Sole Spokesman’ হবার মর্যাদা অর্জন করেছেন, ভারতভাগ না করলে ক্রমাগত ‘civil war’ এর হুমকি দিয়েছেন কিন্তু সেটা যে অনতিবিলম্বে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘uncivil war’-এ পর্যবসিত হয়ে পারস্পরিক সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দেবে তা আর ‘soul search’ করে দেখেননি। করলে জীবনের অন্তিম লগ্নে তাঁকে আর বোম্বাইর মালাবার হিসের প্রাসাদোপম সাধের বাড়ির জন্য আক্ষেপ করতে হতো না।
জিন্না কার্যত প্রদেশভাগ সমেত দেশভাগ স্বীকার করে নেওয়ায় সুরাবর্দী উঠে পড়ে লাগলেন অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গ প্রকল্প রূপায়ণে। বারোজ তো এ বিষয়ে ক্রমাগত দূতিয়ালী করেই যাচ্ছেন। বাংলা ভাগ হলে পূর্ববঙ্গ যে একটা গেঁয়ো বস্তিতে পরিণত হবে তাই তার দুশ্চিন্তা। ১৫ই এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে গভর্নরদের বৈঠকে বারোজের পক্ষ থেকে তাঁর সেক্রেটারী মিঃ টাইসন বলেন:
“It (East Bengal ) would become, in Sir Frederick Burrow’s words, a “rural slum”. Mr. Tyson said that the Muslims knew all this as well as the Hindus-so they felt that the object of the cry to partition Bengal was to ‘torpedo’ Pakistan. He could not think of any way in which it would be possible to “sell” Eastern Bengal as a feasible proposition.”
মুসলমানরা এখানেই ভুল করেছে। তারা বাঙালী হিন্দুর হৃদয়ের গভীর বেদনা পরিমাপ করতে পারেনি। হিন্দুরা পাকিস্তান ভণ্ডুল করার জন্য বাংলাভাগের দাবি তোলেনি; তুলেছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আর মুসলমানদের ‘পূর্ববঙ্গ’ প্রস্তাব বিকানোর কোন প্রশ্নই নেই; মিঃ জিন্না ইতিপূর্বেই বাংলাভাগ গিলে বসে আছেন। মাউন্টব্যাটেন বলছেন :
“His Excellency the Viceroy said that there was no question of trying to “sell” it. Mr. Jinnah had already virtually accepted the proposition. Anything that resulted in “torpedoing” Pakistan was of advantage in that it led the way back to a more common sense solution.”
মাউন্টব্যাটেন টাইসনের কাছে জানতে চাইলেন জিন্না খণ্ডিত পাকিস্তানগ্রহণে স্বীকৃত হয়েছেন জানতে পারলে বাংলার প্রধান মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে : “He asked what the Bengal Chief Minister’s reactions were likely to be when he heard that Mr. Jinnah had accepted a truncated Pakistan.”
টাইসন জানালেন এ খবর শুনলে সুরাবর্দী আতঙ্কিত হবেন এবং বাংলার স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রাখতে যতদূর সম্ভব চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। মাউন্টব্যাটেন তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে সুরাবর্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে বললেন :
“Mr. Tyson said that he thought that the Chief Minister would be very frightened and would go a long way to keep Bengal a separate unit. He was not, he believed, very keen to link us vith the North-West Muslim Provinces. He wanted to run Bengal as an independent Province with a Muslim Majority.”
এখানেই প্রশ্ন! সুরাবর্দী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে স্বাধীন বাংলা চান, কখনও বলেন না যে, জাতি বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালীর জন্য স্বাধীন বাংলা চান। উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম প্রদেশসমূহের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে তিনি যে উৎসাহী নন একথাও কখনও স্পষ্ট করে বলেননি। সুতরাং তাঁকে বিশ্বাস করতে হিন্দুদের বাধে বই কি। কারণ, মাত্র ১২ মাস আগে দিল্লীতে নব নির্বাচিত লীগ বিধায়কদের সম্মেলনে তিনি জোসের সঙ্গে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেছিলেন :
“The resolution presented by Shaheed Bhai (Suhrwardy) categorically or emphatically stated the demand for Pakistan. It said:
Whereas the Muslims are convinced that with a view to saving Muslim India from the domination of the Hindus and in order to afford them full scope to develop themselves according to their genius, it is necessary to constitute a sovereign independent state comprising Bengal and Assam in the North East Zone, and the Punjab, North West Frontier Province, Sind and Balucistan in the North West Zone”.
(Huseyn Shaheed Suhrawardy-A Biography-Begum Shaista Suhrawardy Ikramullah)
বারোজের শিক্ষা মতো তাঁর সেক্রেটারী মিঃ টাইসন কিন্তু তখনও স্বাধীন বাংলার পক্ষে ওকালতি করে যাচ্ছেন। তিনি অখণ্ড স্বাধীন বাংলা আর্থিক দিক থেকে কেমন সুদৃঢ় বনিয়াদের উপর দাঁড়াতে পারবে তার ফিরিস্তি দিয়ে বললেন :
“Mr. Tyson said that Bengal as an independent unit would be economically viable as it would receive jute and export duties as well as customs duties and income tax. He thought that the Muslim League Ministry would go a long way towards bringing in the Hindus on the basis that Bengal was to remain independent. If Bengal was not to be independent, the Muslim League Ministry would prefer to link themselves with Pakistan rather than with Hindustan. The Hindu minority in Bengal would of course prefer to go to Hindusthan.”
সব কথাই তো বলা হল, কিন্তু আসল প্রশ্নটি চাপা পড়ে গেল। বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান ভারত থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলায় এক-সঙ্গে বাস করতে পারবে; কিন্তু ভারতকে অবিভক্ত রেখে অবিভক্ত বাংলায় তাদের একত্রে বসবাসের পথে কাঁটা বিছানো হল কেন সে প্রশ্নের জবাব নেই। যেখানে মানসিক বিচ্ছিন্নতা এসে গেছে, সেখানে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা কি আর মিষ্টি কথায় ঠেকান যায়?
স্যার চন্দুলাল ত্রিবেদী বললেন—he did not believe that the Hindus in Bengal really wanted an independent Bengal. এটিই সাচ বাহ্। হিন্দুরা স্বাধীন বাংলা চায় না; ওটা চান বারোজ, ওটা চান সুরাবর্দী — “Mr. Tyson said that he believed that Sir Frederick Burrows would prefer an independent Bengal to a divided Bengal.”
আলোচনায় দাঁড়ি টেনে মাউন্টব্যাটেন বলেন :
“The crux of the matter was whether it was in the best interests of India to insist on the partition of Bengal or to allow it to be an independent nation. If Bengal was allowed the choice to remain independent, that would be helping towards the “Balkanisation” of India and going against everything that Congress stood for, and their sacrifice in agreeing to Pakistan. Mr. Jinnah would also object to an independent Bengal.”
জিন্না স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবে রাজী হবেন না বললেও কিছু দিন পরেই রাজী হয়ে গেলেন এবং কেন হলেন সে রহস্য ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
তবে ইতিমধ্যেই খণ্ডিত পাকিস্তান থেকে স্বাধীন যুক্তবঙ্গের নামে পূর্ব বঙ্গকেও বাদ দিতে জিন্না রাজী ছিলেন না। সুরাবর্দী এই প্রশ্নে জিন্নার সঙ্গে কথা বলার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া বারোজকে জানান। বারোজ সে কথা মাউন্টব্যাটেনকে জানান (১৮ এপ্রিল ‘৪৭)। তার থেকেই জিন্নার মনোভাব স্পষ্ট ধরা পড়ে :
“My Chief Minister informed me that while in Delhi this week he had put to Jinnah the strong pleas I had made to him that either the Cabinet Plan should be accepted and the League should enter the Constituent Assembly or that a very strong coalition govern-ment should be set up immediately in Bengal.”
কিন্তু জিন্না দুটি প্রস্তাবেই জল ঢেলে দিয়ে বললেন :
“Jinnah told Suhrawardy that he regarded the Cabinet plan as dead that he is not accepting the Congress invitation to discuss it and that he has no intension of entering Constituent Assembly.
As regards forming a Coalition Cabinet in Bengal, Jinnah’s view was that the proposal was premature.”
এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ঠুটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে, তার কাজকর্ম শিকেয় ওঠার মতো অবস্থা। মুসলিম লীগের অনবরত ‘রণং দেহি’ মনোভাব এবং একের পর এক নতুন নতুন দাবি উত্থাপন, প্রতিটি প্রশ্নের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার, মুসলমান কর্মচারীদের লীগ কর্মিসুলভ আচরণে এবং সরকারী কাজকর্মে অচলাবস্থা সৃষ্টিতে তিতবিরক্ত বল্লভভাই প্যাটেল ৬ই এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে মিঃ হেন্ডারসনকে এক চিঠিতে লেখেন :
“It appears that the Muslim League has stiffened rather than relaxed its attitude to Pakistan. Their mood is hardly one of compromise or conciliation. It is not a question of ‘give and take’ on both sides but the demand for ‘give’ on one side and ‘take’ on the other. Conciliation and compromise can only be achieved when the desire is mutual but if there is only one-way traffic, only either surrender or firm stand can bring about the close of this sorry episode.”
তদুপরি পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, আসাম প্রদেশে চলমান ঘটনাবলীর কথা উল্লেখ করে প্যাটেল বলেন যে ক্রমাগত “concession’ দেবার দিন শেষ হয়েছে। এবার নিতে হবে কঠোর সিদ্ধান্ত :
“Even otherwise, in view of the happenings in the Punjab änd the North West Frontier Province and the direct action launched
in the Frontier and Assam, opinion is fast crystallising that the days of concessions have passed. I hope His Majesty’s Govern –ment will understand this attitude and will not ask for any further concessions …. we must cry a halt some time.”
অবশেষে তিনি মোক্ষম কথাটিই পাড়লেন। লিগের গোঁয়ার্তুমিতে যদি কোনও উপায়েই ভারতকে অখণ্ডিত না রাখা যায়, তাহলে তথাকথিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ সমেত দেশভাগের অপ্রিয় সিদ্ধান্তই সরকারকে নিতে হবে :
“The moment has now come and if there could be no further agreement to a united India owing to League’s intransigence, there is no alternative but to divide. But such division can only be brought about if, in accordance with the same principle, the so called majority Provinces are divided into predominantly Hindu and Muslim areas.”
১৬ই এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে গভর্নরদের বৈঠকে মাউন্টব্যাটেনও মোটামুটি একই অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রদেশগুলিকে হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তান এই দুটি গণপরিষদের যে কোনও একটিতে যোগদানের স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে; কিন্তু শুধুমাত্র বাংলাকে আলাদাভাবে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রশ্ন কোনও যুক্তিতেই ওঠে না :
“He felt it would be most undesirable in many ways to give Bengal the opportunity to standing out independently.”
তার কারণও ব্যাখ্যা করে মাউন্টব্যাটেন বলেন—
“Although it was obviously in many ways desirable to adhere to the principle that Provinces should choose their own future, it would be necessary to be very cautious and not to encourage too many independent nations. He had, when first formulating the principle, not clearly realised this danger.”
ভাল কথা, মাউন্টব্যাটেন তাঁর ভুল “ঝতে পেরেছেন এবং তা স্বীকারও করেছেন। মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পিত নীতি কার্যে রূপায়িত হলে ভারত যে “Balkanisation”-এর পথে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেত, জহরলালই সৰ্বপ্ৰথম সেদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এদিকে বাংলায় কংগ্রেস-লীগ যুক্ত মন্ত্রিসভার প্রস্তাব জিন্না বাতিল করে দিলেও সুরাবর্দী-বারোজের প্রচেষ্টায় তাতে ভাঁটা পড়েনি।
সরকারী ফাইলপত্রে যাই থাকুক ব্রিটিশ রাজপুরুষদের ব্যক্তিগত রিপোর্ট বা নোটে অনেক সময় রাজনৈতিক ঘটনা ও পরিস্থিতির সঠিক প্রতিফলন ঘটে। ২৪শে এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে মাউন্টব্যাটেন তাঁর ব্যক্তিগত রিপোর্টে বাংলার প্রশাসনিক অবস্থার এক শোচনীয় চিত্র তুলে ধরেন :
“The Police situation in Bengal is particularly deplorable. In Calcutta there were recently 1200 policemen, mainly Gurkhas as recruitment from the plains had never been resorted to. When the Inspector General asked for an increase of 50 percent, Mr. Suhrawardy, the Chief Minister, insisted that they must all be Muslims. To speed up training it was decided that they must be ex-soldiers, and as there was none suitable in the province, 600 Punjabi Musulmans were secured from the Punjab. The latter were given preferential treatment by the Muslim Government, with the result that they have come into armed conflict with the Gurkha police men and I am afraid that the police situation may deteriorate.” বাঙালী যুবকদের উপর পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়
পুলিশী ব্যবস্থার কতদূর অবনতি ঘটেছিল তা কলকাতার প্রবীণ নাগরিকরা অনেকেই আজ স্মরণ করতে পারবেন। তাদের অত্যাচারে হিন্দু যুবকদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। তারা ভদ্র গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের শ্লীলতাহানি করতেও পেছ পা হয় নি। ১০০ নং হ্যারিসন রোডের ঘটনা এখনও পুরনো খবরের কাগজের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়। Calcutta Riot Enquiry Committee-র কার্যাবলীতে দেখা যায় :
A system crept up in the town of arresting young Bengali boys who will be able to give evidence upon identification (অর্থাৎ হিন্দু যুবকদের আটক করে তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দান থেকে বঞ্চিত করা)।
“Mr. Doha has been systematically arresting Hindu youths upon identification by one single Muslim. He declared that he would teach the Hindus a lesson by that process.”
এই পুলিশী অত্যাচার নিয়ে হৈ-চৈ পড়লে লীগ সরকার কাগজের উপর সেন্সর ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন :
The Muslim Government of Bengal has just imposed a pre-censorship on news comments criticising the activities of the police force in Bengal.”
আর এই পাঞ্জাবী মুসলমান পুলিশবাহিনী মার্চ মাসের পাঞ্জাবের দাঙ্গায় কি ভূমিকা নিয়েছিল তা দেখা যাক :
“Their (Hindu-Sikh Community) almost unanimous indictment is that the police took no steps to defend or save them and they accuse them in many cases of having even directed and participated in the attacks. When Pandit Nehru drove out of the Refugee Camp after his visit, the cry which went up from the multitude was “Punjab Police Murdabad.” I had never heard this before. I fear that the police in the rural areas have shown partial-ity….” (from an account by General Messervey, Goc-in-C. Northern Command).
এ তো গেল কর্মরত পুলিশের ভূমিকার কথা। এবার পেনশন-প্রাপ্ত প্রাক্তন সৈনিকদের —যাদের মধ্য থেকে সুরাবর্দী সাহেব কলকাতার জন্য ৬০০ পুলিশ সংগ্রহ করেছিলেন, পাঞ্জাবের হিন্দু-শিখ বিরোধী দাঙ্গায় ভূমিকার কথা শোনা যাক :
“There is little doubt, I fear, that ex-soldiers and pensioners, some of the latter even including VCOS and Hon. Commissioned officers, have been heavily involved in many areas…. The forfeiture of pension and grants of land in the bad cases should be an excellent deterrent.”
বাংলায় লীগ মন্ত্রিসভার সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীই যে কলকাতার সুদক্ষ পুলিশ প্রশাসনকে ধ্বংসের মুখে এনেছে, বারোজ সেকথা স্পষ্টভাষায় সুরাবর্দীকে জানিয়েছেন বলে মাউন্টব্যাটেনের নোটে উল্লেখ আছে :
“The Governor takes the view, and has told Suhwardy that the Bengal Ministry, by unfair treatment and taking a communal line, is fast ruining the one reliable police force that Calcutta possesses which has taken the Government through all the Calcutta troubles of the past two years…..”
ভাবতে অবাক লাগে এই অত্যাচারী পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা যায় বর্তমানে প্রগতিশীল লেখকদের কারও কারও রচনায় (দ্রষ্টব্য : ‘হস্তান্তর’— শংকর ঘোষ )
ঐ নোটে আর একটি অর্থপূর্ণ মন্তব্য চোখে পড়ে। জিন্নার সংসার সামলাতে ন তার ভগ্নী ফতিমা জিন্না। ভাইসরয়-পত্নী লেডি মাউন্টব্যাটেন তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কেমন মর্মাহত হয়েছেন, তাও তিনি উল্লেখ করেছেন :
“She (Lady Mountbatten) also saw Miss Jinnah alone who shocked her with her threats of civil war if Pakistan were turned down.”
মুসলিম মহিলারাও কেমন সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছিলেন, কেমন রক্ত পিপাসু ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন, তার আরও একটি প্রমাণ উদ্ধৃত করা গেল :
“সেই ছবিটার কথা মনে হত যখন অনিন্দ্যসুন্দর একটি মহিলা, স্নেহময়ী জননী, করাচিতে যার বাড়ির দ্বার আমার কাছে ছিল সর্বদা অবারিত। আমাকে বলতেন, ‘শিখ! আমার হাতে যদি থাকত তলোয়ার, আমি নিজ হাতে তাদের সবাইকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে পারতাম!” (পাকিস্তান : গোড়ার দিনগুলি— নির্মল সেনগুপ্ত)।
মুসলিম মহিলা সমাজেও হিন্দু-শিখ বিরোধী মনোভাব কেমন উগ্ররূপ ধারণ করেছিল তার আর বেশি প্রমাণ দেওয়ার দরকার আছে কি?
এবার ঘটল মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সুরাবর্দীর মোলাকাত ২৬শে এপ্রিল ‘৪৭। মাউন্টব্যাটেন ভারতীয় সমস্যা সমাধানে তাঁর চিন্তা-ভাবনার স্পষ্ট ধারণা সুরাবর্দীকে দিয়ে বললেন :-
“I told him that I was ardently against all forms of partition. I wanted above everything a united India. If I could not have a united India, then I would like the. Cabinet Mission plan. If I could not have the Cabinet Mission plan, I would then put it to the Provinces to decide. I had been called upon to partition the Punjab, Bengal and Assam, and I expressed my regret that these Provinces should be partitioned, but said that it was unavoidable.”
মাউন্টব্যাটেন যখন বললেন যে তিনি ভারত বা বাংলা যে কোন ধরনেরই বিভাগ-বিরোধী, সুরাবর্দী তখন তাঁকে বলেন যে বাংলার সমস্যা আলাদা। তাকে কিছুদিন সময় দিলে তিনি ভারত বা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে কিংবা বাংলাকে ভাগ না করে স্বাধীন ও অখণ্ড রাখতে জিন্নার সম্মতি আদায় করতে পারবেন :
“Mr. Suhrawardy told me that…. whether it (Bengal) was to join Pakistan, Hindustan or remain independent, he could tell me (Mountbatten) that given enough time he was confident that he could get Bengal to remain as a complete entity. He told me he could get Mr. Jinnah to agree that it need not join Paksitan if it was prepared to remain united.”
ঘটনাচক্রে ঐ দিনই (২৬শে এপ্রিল, ‘৪৭) মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে জিন্নার সাক্ষাৎকার ঘটে। মাউন্টব্যাটেন সরাসরি সুরাবর্দীর স্বাধীন বঙ্গ প্রসঙ্গ তুলে তাঁর মতামত জানতে চান— “I asked Mr. Jinnah straight out his views were about keeping Bengal united at the price of its remaining out of Pakistan.”
অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে ইতিমধ্যে ওস্তাদ ও স্যাঙাতের মধ্যে শলাপরামর্শ হয়ে গেছে। মাউন্টব্যাটেনের প্রশ্নের জবাবে জিন্না বিনা দ্বিধায় বলে ফেললেন যে “কলকাতা ছাড়া বাংলার কোনও মূল্য নেই; বাংলা অবিভক্ত অবস্থায় স্বাধীন থাকাই বাঞ্ছনীয়। আমি নিশ্চিত তারা আমাদের সঙ্গে দোস্তসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখবে।”
“He said, without any hesitation, “I should be delighted. What is the use of Bengal without Calcutta; they had much better remain united and independent; I am sure that they would be on friendly terms with us.”
জিন্নার অবচেতন মনের কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলার সঙ্গে ‘friendly terms’-এর ভাবার্থ কি তা স্পষ্ট হয়েছে বিলাতে মন্ত্রিসভার সামনে মাউন্টব্যাটেনের পেশ করা বক্তব্য থেকে। মাউন্টব্যাটেন বলেছেন :
“Mr. Jinnah considered that with its Muslim majority, an inde-pendent Bengal would be a sort of subsidiary Pakistan and was therefore prepared to agree to Mr. Suhrawardy’s plan.”
আমাদের দেশে বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংহতি ফিরিওয়ালা বুদ্ধিজীবীরা এবং কম্যুনিস্টদল এ সব ইতিহাস হয় জানেন না, না হয় না জানার ভান করেন ও পৃষ্ঠপোষকদের মন জোগান
‘Subsidiary Pakistan’ যে কি বস্তু তা স্বাধীন বাংলা হলে তারা বিহার উড়িষ্যার জঙ্গলে বসে বুঝতে পারতেন। কলকাতার বুকে বসে আর প্রগতিশীলতার ধ্বজা উড়াতে হতো না।
২৩শে এপ্রিল, ‘৪৭ তারিখে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটে। কথা প্রসঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ কংগ্রেস যে সব সময় হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন :
“Mr. S. P. Mukherjee explained to me (Mountbatten) the differences between the Hindu Mahasabha and the Congress, stressing that Congress by no means represented Hindus only, since they embraced all other creeds who wished to join the Con-gress which was purely a political party. Indeed, he said, Congress frequently did not look after the interests of the Hindus sufficiently.”
মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ করার কারণ ব্যাখ্যা করে শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন যে যদি মন্ত্রী মিশনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, তা হলে বাংলা ভাগ করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই :
“He then said that the main object of his visit was to convince me of the necessity for partitioning Bengal if the Cabinet Mission plan were to fail.”
শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগ সম্পৰ্কীয় কাগজপত্র ম্যাপ, নক্শা ইত্যাদির সাহায্যে মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করেন।
শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষ হবার কিছুক্ষণ পরেই মিঃ জিন্নাও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করতে যান। তিনি প্রথমেই বলেন যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানরা যেহেতু “অধিক প্রজননশীল” সেহেতু ১৯৪১ সালের লোক গণনার উপর ভিত্তি করে বাংলা ও আসামের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করলে মুসলমানদের প্রতি অবিচার করা হবে। জনৈক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি মুসলমানদের বর্ধিত জন্মহারের নিরিখে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা প্রসারণের যে যুক্তি খাড়া করেছে জিন্না সে কথাও তোলেন :
Mr. Jinnah said that Muslims were more virile than Hindus. Therefore there had been an enormous increase in the proportion of Muslims particularly in Bengal and Assam, since the 1941 census. ‘An unknown’ had applied his mind to the problem of the proportionate increases between previous censi, a rough estimate of the present proportions.
মাউন্টব্যাটেন জিন্নার এসব মনগড়া হিসাব বাতিল করে দেন। জিন্না তখন বাংলা ও আসাম ভাগের প্রশ্ন তোলেন। প্রদেশ ভাগ যে অত্যন্ত বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত এবং অশুভ ও অবাঞ্ছিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটাবে, সে সম্পর্কে ইনিয়েবিনিয়ে মাউন্টব্যাটেনকে বোঝাতে থাকেন :
“Mr. Jinnah said that the partition of provinces was a most dangerous proposition and bound to lead to trouble, as it was not based on “wisdom and foresight” but born of “bitterness and spitefulness”. It would” loose terrible forces” and was “suicidal”. It was a “most dangerous thing when an angry man lost his judgement.”
জিন্নার এই হুঁসিয়ারি ফাঁপা নয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন এবং পাঞ্জাব ভাগের সীমারেখা ঘোষিত হতে না হতে পাঞ্জাবে যে নরমুণ্ডে গেণ্ডুয়া ও নররক্তে হোলি খেলা শুরু হয়েছিল, জিন্না তার পূর্বাভাস দিয়ে রাখলেন এবং তিনি যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন মুসলিম লীগের রক্তলোলুপ পিশাচদল মাস দুই যেতে না যেতে তা কার্যে পরিণত করেছিল।
যা হোক, জিন্না প্রদেশ ভাগের বিরুদ্ধে যে সব যুক্তি খাড়া করেছিলেন, মাউন্টব্যাটেন দেশভাগের বিরুদ্ধেও ঠিক সেসব যুক্তি জিন্নাকে আবার শুনিয়ে দিলেন :
“His Excellency the Viceroy pointed out that all these “arguments” in favour of non-partition of provinces applied equally to the non-partition of India.”
দেশভাগের সমর্থনে জিন্নার সব যুক্তি ভণ্ডুল হয়ে যেতে তিনি বাংলাভাগে তফশিলী শ্রেণীর বিরাট ক্ষতির কথা তুললেন। বাংলা ভাগ হলে পশ্চিমবঙ্গের তফশিলীরা যে খুবই আতান্তরে পড়বে সে কথা ভেবে তাদের জন্য দরদে তাঁর প্রাণ আকুলি বিকুলি করে উঠল :
“Mr. Jinnah said that in Western Bengal the Cast Hindus were only 37% of the total Hindu population. The 63% Scheduled Caste Hindus would be ruined if they were cut off from those in Eastern Bengal. The idea made them shudder. “Any average man” should be asked.”
মাউন্টব্যাটেন তৎক্ষণাৎ জিন্নার মুখের উপর বলে দিলেন যে সেদিন সকালেই ডঃ মুখার্জী তাঁকে যা বলেছেন, জিন্না ঠিক তার বিপরীত কথাই শোনালেন :
“The Viceroy pointed out that these views were very different to those which had been expressed to him by Dr. Mukherjee earlier that day.”
জিন্নার তফশিলী-প্রীতি প্রসঙ্গে বাংলার তফশিলী নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ভূমিকার কথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য।
বাংলার হিন্দুদের চরম দুর্ভাগ্যের দিনে মুসলিম লীগ শিখণ্ডী হিসাবে পেয়েছিল যোগেন্দ্র মণ্ডল ও তার কয়েকজন সঙ্গীকে। কলকাতা ও নোয়াখালি-ত্রিপুরার দাঙ্গায় উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ নির্বিশেষে হিন্দুরা মুসলিম লীগ গুণ্ডাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিল; তফশিলী হিন্দুরা বরং বেশি নির্যাতিত হয়েছিল। কারণ, দরিদ্র ও অসহায় বিধায় তারাই জল্লাদ ও লুঠেরাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। নোয়াখালির একটি দাঙ্গা-বিধ্বস্ত তফশিলীপ্রধান গ্রামের করুণ চিত্র এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে যোগেন্দ্র মণ্ডলের মতো তফশিলী নেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসাবে নিম্নোদ্ধত বিবরণ অবশ্যই উল্লেখ করা যায় :
“পোড়া টিন, কিছু নতুন টিন, কিছু বাঁশ সব নিয়ে মোটামুটি ২-১টা করে ঘর উঠতে লাগল তফশিলী গ্রামেগঞ্জে। কিন্তু মনে মনে সকলেরই আতঙ্ক শেষ পর্যন্ত থাকা কি সম্ভব হবে? ঠক্করবাপা যখন চরমণ্ডলে এসেছিলেন তখনই তিনি বলেছিলেন, লিখেও গিয়েছিলেন তফশিলী হিন্দুরা পরিশ্রমী শান্তিপ্রিয় ও ধর্মভীরু। সবচেয়ে মানসিক আঘাত এরা পেয়েছিল ধর্মান্তরিত করায় ও মেয়েদের সম্মানহানি হওয়ায়। অথচ যারা থেকে গেল তারা ভয়ে ভয়ে কী কী ঘটেছিল খুব সঙ্গোপনে তাঁকে ও আমাদের বলত। থানায় এজাহারও নিত না, এরা দিতে যেতেও সাহস পেত না।
টুমচর সার্ভে আমারও একটা অভিজ্ঞতা। গান্ধীজীর নির্দেশেই আমি ও আমার সহকর্মীরা তফশিলী অধ্যুষিত গ্রামে যাই। তিনি বলেছিলেন ঠক্করবাপার নির্দেশে কাজ করতে। টুমচর বেছে নিই এই কারণে যে ওখান থেকে চরমণ্ডল ও চররুহিতা ৫-৬ মাইলের মধ্যে, আর টুমচর এই চরের গ্রামের মধ্যেই একদম শেষপ্রান্তে। তারপর সমুদ্র পর্যন্ত আর বসতি নেই।
চরমণ্ডল সম্বন্ধে ঠক্করবাপার বিবৃতি থেকে বলা ভাল : ‘চরমণ্ডল ও চররুহিতা’ দুটি গ্রামের মধ্যে চরমণ্ডলই বড়। দুটি গ্রামের বহু বাড়িই প্রথমে লুণ্ঠিত ও পরে ভস্মীভূত হয়েছে। হয়ত ৫০-৫২টি বাড়ি পোড়ানো হয়নি, কিন্তু লুণ্ঠিত হয়েছে। চরমণ্ডলের ৩০১ ও চররুহিতার ৫৭টি বাড়ির প্রত্যেকটির ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৩৩,৭০০ টাকা। প্রত্যেকেই বিত্তশালী চাষী গৃহস্থ। যারা নিম্নবিত্ত তাদেরও ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ১০০০ টাকা। এই দুটি গ্রামেরই ক্ষতির পরিমাণ হবে অন্তত ৫,৪৬,৫০৩ টাকা পর্যন্ত, গড়ে ১৭৪৫ টাকা। এই বিবৃতিতে দেখা যায় যে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে দুহাজার জনকে ও জোর করে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল ছয় জনকে ও খুন হয়েছিল একজন। দাঙ্গার ছয় সপ্তাহ পরেও তিনি দেখেছেন যে লোকে গ্রাম ছেড়ে পালাতে চাইছে। কারণ থানা এজাহার নেয় না, আবার নিলেও তাদেরই নানা অছিলায় ধরে নিয়ে যায়, নয়ত ভয় দেখায়।” (নোয়াখালির দুর্যোগের দিনে— অশোকা গুপ্ত)।
যোগেন্দ্র মণ্ডল তখন সুরাবর্দী মন্ত্রিসভার সদস্য। স্বজাতি ও স্বসম্প্রদায়ের উপর তারই মন্ত্রিসভার সদস্যদের উস্কানিতে যে অবর্ণনীয় অত্যাচার চলে ও ক্ষয়ক্ষতি করা হয় তার বিরুদ্ধে তিনি টু শব্দটি করেন নি—পাছে তাঁর গদি খোয়া যায়। উল্টে তিনি এবং তাঁরই দলের নেতা পি. এন. রাজভোজ অপরাধী মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন
“ঠক্করবাপার ক্যাম্পে আমি যখন রিপোর্ট করতে যাই, লিগপন্থীদের সহযোগী তফশিলী জাতি ফেডারেশন নেতা ‘রাজভোজ’ সেদিন পাশের গ্রামে সভা করেছিলেন। তার বক্তব্য ও উত্তেজনামূলক বিবৃতি শুনে আমি যখন দেখা করতে গেলাম বাপা স্মিত হেসে আমায় বললেন : জজ সাহেবের বিবি, কেন এসেছ? তার আগেই আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আমিও হেসে উত্তর দিলাম, সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে এসেছি, এখন বিচার করুন। আসলে উত্তেজনা দমন না করে ঐ ধরনের নেতা যোগেন্দ্রকুমার মণ্ডল-সহ সকলেই দুর্বৃত্তদের আড়াল করে চলেছিলেন, শাস্তির কোনও চেষ্টাই করছিলেন না।”
মুসলিম লীগ যখন—”আর একবার সাধিলেই খাইব’ এই নীতি অনুসরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কংগ্রেস তার “কোটা’য় একজন মুসলমান মন্ত্রী নেওয়ার প্রতিবাদস্বরূপ লীগও একজন হিন্দু মন্ত্রী নিয়ে চমক সৃষ্টি করে এবং যোগেন্দ্র মণ্ডলের চেয়ে গুণধর ব্যক্তি তারা তফশিলী সম্প্রদায়ের মধ্যেও খুঁজে পেল না।
মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে যেসব ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসাবে মনোনীত করা হয়, তার মধ্যে একমাত্র লিয়াকত আলি খান ছাড়া বাকিদের রাজনৈতিক জীবনাদর্শ দূরে থাক, ব্যক্তিগত চরিত্র ও সঙ্গ ভদ্র ও বিবেকবান ব্যক্তিদের কাম্য ছিল না। নেহরু-প্যাটেলরা চুন্দ্রীগড়-গজনফর-আবদুর রব নিস্তারের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে একই মন্ত্রিসভার সদস্য এটা দৃশ্যতই বেমানান। অথচ লীগের মধ্যেই এদের চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু জিন্না তাদের মনোনয়ন দিলেন না। কারণ, তাঁর উদ্দেশ্যই হল অন্তর্বর্তী সরকারকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে না দেওয়া। এবার এদের সাথে জুটলেন যোগেন্দ্র মণ্ডল। লীগ মনোনীত মন্ত্রীদের দক্ষতা ও গুণাবলী সম্পর্কে এক গোপন রিপোর্টে ওয়াভেল যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সম্পর্কে বলেছেন :
“Mandal, the League’s Scheduled Caste nominee, is Law Member (Personal comment omitted). He is usually travelling the country to attend Scheduled Caste political meetings; when he does come to the Cabinet he is silent or silly.”
আর সুরাবর্দীকে সরাসরি “gangster’ (গুণ্ডা) অ্যাখ্যা দিয়ে ওয়াভেল তার নোটে লিখেছেন :
“Mr. H.S.Suhrawardy -looking as much of a gangster as ever, described to me the measures he proposed for stricter enforcement of law and order.” (একজন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। আর সুরাবর্দী আইন শৃঙ্খলারক্ষা করবেন একথা শুনে সেদিন হয়তো ঘোড়াও হেসেছিল!) তফশিলীদের জন্য জিন্না তো কেঁদে ভাসালেন। তিনি যোগেন্দ্র মণ্ডলকে লীগ-প্রেমের নাগপাশে বেঁধে ফেলেন। যোগেন্দ্র মণ্ডলের হিন্দু ও হিন্দুত্ব-বিরোধী বক্তৃতায় লীগ খুবই উল্লসিত বোধ করে। সেসব বক্তৃতার ভাষাভঙ্গির সঙ্গে বর্তমান কালে কাসীরাম-মায়াবতীদের বক্তৃতা-বিবৃতির অদ্ভূত সাদৃশ্য দেখা যায়। হিন্দু রাজনীতিতে—বিশেষ করে বাংলায়—অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টিতে এবং বাংলা-ভাগের সময় হিন্দুদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতে মুসলিম লীগ যোগেন্দ্রবাবুকে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করে।
কিন্তু পূর্ববঙ্গের অন্যান্য তফশিলী নেতারা যোগেন্দ্রবাবুকে কি নজরে দেখতেন এবং তাঁর অনুসৃত নীতি সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করতেন, তার এক চমকপ্রদ বিবরণ মেলে মাউন্টব্যাটেনের স্টাফ্ মিটিং-এ প্রদত্ত ভাষণ থেকে :
“His Excellency the Viceroy said that he had been “attacked” at the Garden Party on 3rd May by two Scheduled Caste represen-tatives to the Constituent Assembly from Bengal, who had warned him against Mr. Mandal who they thought had been misleading him. They had stated that the Scheduled Castes on no account wanted separation from the Caste Hindus and were determined not to be left under the “brutal suppression and domination” of the Muslims. They firmly demanded partition and claimed that they did represent the views of the Scheduled Castes in Bengal. He (Mountbatten) asked them what would happen to the Scheduled Castes in Eastern Bengal. They had replied that they themselves lived in Eastern Bengal but did not intend to stay there, and they had suggested that all the seven million Scheduled Castes in East Bengal should be moved to West Bengal. They had confirmed the atrocities in Noakhali.”
নোয়াখালিতে তফশিলী সম্প্রদায়ের উপর নির্মম নির্যাতনের যে কথা ঠক্করবাপা ও সমাজসেবিকা অশোকা গুপ্ত বলেছেন তার সত্যতা তফশিলী নেতারাও স্বীকার করলেন। আর যোগেন্দ্রবাবুর দুর্বুদ্ধি ও ব্যক্তিগত স্বার্থ—পূর্ববঙ্গের বর্ণ হিন্দুদের কথা বাদ দিই, তাঁর স্বজাতি নমঃশূদ্রদের কি চরম সর্বনাশ সাধন করে, তার প্রমাণ ১৯৫০-এ বরিশালের দাঙ্গা। সে প্রসঙ্গ যথাস্থানে।
ভারতভাগের সিদ্ধান্ত ও সীমারেখা ঘোষণার দিন যত এগিয়ে আসছে, স্বাধীন বাংলার প্রবক্তারা ততই অধীর হয়ে পড়ছেন। সুরাবর্দী বাইরে লম্ফঝম্প করছেন; শরৎ বসু উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তড়পাচ্ছেন; আর কিরণশঙ্কর ক্রমেই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। বারোজ কিন্তু ভেতর থেকে মাউন্টব্যাটেনকে প্রভাবিত করার অবিশ্রাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২৬শে এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে ভাইসরয়ের ডেপুটি প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ ক্রিস্টি প্রাইভেট সেক্রেটারী মিঃ অ্যাবেলকে জানান যে, বারোজ মনে করেন বাংলা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে তা জিন্নার কাছে গ্রহণীয় কিনা জানা দরকার। সে সিদ্ধান্ত যদি জিন্নার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে পূর্ববঙ্গে র মুসলমানরা তা গ্রহণ করবে। জিন্না ও বাংলার মুসলমানরাও যদি সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে, তাহলে বাংলায় ভয়ানক বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না :
“…Viceroy should be satisfied that it is acceptable to Jinnah before it is presented as an award. If Jinnah accepts, it is practically certain that East Bengal Muslims will accept. If Jinnah and Bengal Muslims do not accept serious disorders in Bengal are highly probable.”
তারপর বারোজের ঝুলি থেকে আসল বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। তাঁর মতে কলকাতা নিয়ে কি সিদ্ধান্ত হয় তার উপরই জিন্নার মতিগতি নির্ভর করছে। তাঁকে খুস রাখার জন্য কলকাতাকে হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ কিংবা মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ-কোনও বঙ্গেরই অন্তর্ভুক্ত না করে, উভয় বাংলার যৌথ সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করে আলাদা শাসন ব্যবস্থার সুপারিশ করেন বারোজ। কারণ, কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিসাধনে পূর্ববঙ্গের দানও অনেকখানি :
“Jinnah’s attitude is likely to be strongly influenced by arrangement contemplated for Calcutta. On communal majority formula Calcutta should go with West Bengal but East Bengal contributes largely to Calcutta’s prosperity and economy of East Bengal is dependent on access to Calcutta and share of its revenues. Governor therefore, considers that interim arrangement for administration of Calcutta should be mandatory in announcement. এই গাওনা গেয়ে বারোজ সাহেব অত্যাসন্ন সরকারী ঘোষণার সঙ্গে নিম্নোক্ত পংক্তিটি সংযোজন করার সুপারিশ করেন :
“If it is decided to divide the Province of Bengal the present area of Calcutta, as defined in the Calcutta Police Act and the Calcutta Suburban Police Act, will not be included in either of the two half Provinces. Pending the establishment of an executive authority for the administration of Calcutta, by agreement between the two Constituent Assemblies concerned; Calcutta shall be administered by a Council consisting of an equal number of persons elected by each Constituent Assembly, under a Chairman elected by Council itself.”
কি নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব বারোজের! হিন্দুদের রক্তে অর্থে পরিশ্রমে ও দানে ধ্যানে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ সোনার বাংলায় পরিণত; শিক্ষাদীক্ষা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও দেশের জন্য স্বার্থত্যাগে আত্মত্যাগে সারা ভারতে শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত; সেই সোনার বাংলা থেকে হিন্দুদের উচ্ছেদ করে নির্বাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে র প্রাণকেন্দ্র শতকরা ৭৫ জন হিন্দুর বাসভূমি কলকাতাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে রাখার মতলব ভাঁজা হচ্ছে।
দিল্লীতে মাউন্টব্যাটেন চালাচ্ছেন বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ সমেত ভারত ভাগের চূড়ান্ত পরিকল্পনা রূপায়ণের প্রচেষ্টা। আর এদিকে বারোজ সাহেব বাংলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে সুরাবর্দীর ইচ্ছে মতো স্বাধীন যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন অনলসভাবে।
২৮শে এপ্রিল ‘৪৭ তারিখে মাউন্টব্যাটেন বারোজকে জানান যে আসন্ন ঘোষণাপত্রে বাংলা সম্পর্কে তাঁর প্রস্তাব মতো কোনও আলাদা ব্যবস্থা সংযোজন
করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া, কলকাতাকে ‘মুক্ত শহর’ বলে ঘোষণা করাও ঠিক হবে না। কারণ, তা করলে হিন্দুদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাছাড়া পাকিস্তানকে হৃষ্টপুষ্ট সুগঠিত করে গড়াও তাঁর দায়িত্ব নয় :
“I do not like the idea of free city. It goes against all the principles on which the rest of the plan is based, it leaves Calcutta cut off from Muslim Bengal, it will not be acceptable to the Hindus and I do not see how we can enforce it or prevent a fight for the city next year. Besides which, it is not for me to make Pakistan into a sensible scheme.”
সে সঙ্গে তিনি মুসলমানদের হক্কের পাওনা থেকে তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন বলে বারোজকে আশ্বাস দিলেন :
“I want it to be seen for what it is, while giving the Muslims everything to which they are entitled, and every chance to work out their own salvation.”
মাউন্টব্যাটেন তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি হিন্দুপ্রধান খুলনা জেলা, তার লাগোয়া ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ সাব-ডিভিশন, যশোহরের হিন্দু সংখ্যাগুরু এলাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পাকিস্তানে যাবার ব্যবস্থা করেন। তদুপরি গণভোটের কলাকৌশলে আসাম থেকে শ্রীহট্টকে কেটে এনে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে জিন্নাকে পূর্বাঞ্চলেও ‘viable’ পাকিস্তান দান করেন।
মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে স্পষ্ট কথা শোনার পরেও বারোজের উৎসাহে ভাঁটা পড়েনি। তিনি একদিকে সুরাবর্দী, শরৎ বসু, কিরণশঙ্করকে তাতাচ্ছেন; অন্যদিকে মাউন্টব্যাটেনকে প্রভাবিত করতে অসুস্থ শরীরে দিল্লী ছুটছেন। হয় যুক্তবঙ্গ নয় কলকাতাকে মুক্ত শহর—এ দুটির একটা করতে তার চেষ্টার ত্রুটি নেই। মাউন্টব্যাটেনকে তিনি বোঝালেন বাংলার পাট উৎপাদনকারী জেলাগুলি সব পড়বে পূর্ববঙ্গে আর পাটকলগুলি সব পশ্চিমবঙ্গে হুগলীর দু’পাড়ে। ইংরেজ মালিকানাধীন পাটকলের সংখ্যা ৮০টিরও বেশী। শ্রমিকের সংখ্যাও বেশীর ভাগ হিন্দু। পাটশিল্পে হিন্দুরা প্রচুর অর্থ লগ্নী করেছে। পূর্ব বাংলা যদি পশ্চিমবঙ্গে পাট রপ্তানি বন্ধের হুমকী দেয় এবং ইংরেজ মালিকগণ যদি তাদের কারখানা পূর্ববঙ্গে সরিয়ে নেবার তোড়জোড় করে এবং সে খবর যদি উপযুক্ত সময়ে ‘লিক’ করে দেওয়া হয়, তা হলেই বেয়াড়া হিন্দুদের বাংলাভাগ আন্দোলনের দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া যাবে এবং তারা যুক্তবঙ্গ পরিকল্পনা সমর্থন করতে বাধ্য হবে। আলোচনার এই গতিপ্রকৃতিতে খুশি হয়ে বারোজ তো কলকাতায় ফিরে এলেন। ২রা মে ‘৪৭ তারিখে মাউন্টব্যাটেন বারোজকে যে চিঠি লেখেন তাতেই তাঁর ও বারোজের মধ্যে আলোচনার পূর্ণচিত্র পাওয়া যায়—মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন :
“You pointed out to me that Eastern Bengal would be in a bad way after partition because all the jute factories were located in Calcutta in Western Bengal. It has since occurred to me that Calcutta could be completely huffed by Eastern Bengal if ap-proaches were made at once to the various jute factories (most of which are in British hands and, I believe, cotrolled from Dundee) to transfer their machinery to a suitable location in Eastern Bengal so that the jute and factories would be in the same half Province.” হিন্দুদের ভড়কে দেওয়ার জন্যই যে পাটকল সরাবার মন্ত্রণা করা হয়েছে, জ্ঞানপাপীরা তাও অস্বীকার করেননি :
“This would be such a serious matter for Calcutta that if it could be converted into a live threat by being allowed to ‘leak’, I feel it might well influence the Hindus to accept independent unity rather than Partition.
This is only one of many schemes that could be thought out to frighten off those who wish Partition.”
তা হলে হিন্দুদের ভয় দেখাবার আরো অস্ত্র আছে। তার একটি হল বাংলা ভাগের প্রশ্নে ভোট নেওয়া। এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেন বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের প্রশ্নে নিম্নোক্ত পয়েন্টে বারোজের মতামত জানতে চান :
a) desirability
b) feasibility
c) risk of riots during election
d) additional delay likely to be caused before decision is known.
e) any other points.
তবে কলকারখানা সরান কিংবা নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো দীর্ঘমেয়াদী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী পন্থার চেয়ে সুরাবর্দীকে রাজী করিয়ে যদি কংগ্রেসীদের যুক্ত নির্বাচনের টোপ ও মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করা যায়; ও ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায়; তা হলেই বারোজ অর্ধেক কেল্লা ফতে করবেন বলে মাউন্টব্যাটেন আশা প্রকাশ করেন :
“I am quite certain in my own mind that if Suhrawardy can be persuaded to form a Coalition Government and offer joint electorate to the non-Muslim Communities you will be half-way home in keeping Bengal united.”
শুধু বারোজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা চিঠিচাপাটি নয়, মাউন্টব্যাটেন জিন্না-লিয়াকত আলিকেও গোপনে স্বাধীন যুক্তবাংলা প্রস্তাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করান :
“I told Jinnah and Liaquat Ali Khan today in confidence, that you were strongly in favour of a united Bengal and had agreed that this could only be achieved if they were allowed to be indepen-dent. I explained to them my idea of allowing the vote of indepen-dence to be taken first and they both appeared to be in complete agreement that this was the best course for the future prosperity of Bengal.”
জিন্না-লিয়াকত কোম্পানী তো রাজী হবেনই। কলকাতাহীন পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানভুক্তির চেয়ে কলকাতা সহ সারা বাংলা মুসলিম সংখ্যাধিক্যে স্বাধীন হলে তা যে প্রকারান্তরে “Subsidiary Pakistan” হবে তা তাঁরা আগেই ভেবে রেখেছেন। আর, স্বাধীন বাংলার টোপ গিলে সারা বাংলা যে ‘Virtual Pakistan’-এ পরিণত হবে, তা তো ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলেই রেখেছেন।
সুতরাং শুরু হল কংগ্রেসের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে এই প্রস্তাবের সমর্থন জোগাড় করা। শরৎ বসু তো টোপ গিলে বসেই আছেন; আর কিরণশঙ্কর রায় চলেছেন দুই নৌকায় পা দিয়ে। তাঁর দলবলকে স্বাধীন বঙ্গের সমর্থনে সামিল করতে কলকাতায় বারোজ ক্রমাগত ফুসলিয়ে যাচ্ছেন আর দিল্লীতে সে ভার নিলেন মাউন্টব্যাটেন।
৩রা মার্চ ‘৪৭ তারিখে কিরণশঙ্কর রায় মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করেন। তার আগেই বাংলা ভাগের দাবি করে বাংলার বিধানসভা ও বিধান পরিষদের ৭৪ জন হিন্দু সদস্যের (কংগ্রেস) স্বাক্ষর সম্বলিত এক দাবিপত্র মাউন্টব্যাটেনের কাছে পেশ করা হয়েছিল। রায় মাউন্টব্যাটেনকে জানান যে তাড়াহুড়ায় তিনি আরও সদস্যের সই সংগ্রহ করতে পারেননি, তবে শীঘ্রই তা দাখিল করতে পারবেন।
“He regretted there were only 74 signatures on it at present because in their haste they had not been able to collect the signatures of all eligible persons but these could be produced.”
কিরণশঙ্করের সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পারেন তিনি নরম প্রকৃতির ভাল মানুষ এবং পূর্ববঙ্গের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুরাগী সন্তান। বাংলা ভাগের সম্ভাবনায় এবং তাঁর বাড়িঘর জমিদারী সবই পাকিস্তানভুক্ত হবার একান্ত আশঙ্কায় বড়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কিরণশঙ্করের মানসিক উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার সুযোগ নিয়ে মাউন্টব্যাটেন তাঁর সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে কথা বলতে থাকেন :
“I asked him straight out if he was in favour of unity or partition for Bengal. He replied that he had always been strongly in favour of unity and he had only been driven to recommending partition by the intransigence of the Muslim League and pressure from Congress.”
রায় এখানে মুসলিম লীগের একগুঁয়েমি এবং কংগ্রেসের চাপের কথা বললেন, কিন্তু মুসলিম লীগ শাসনে হিন্দুদের চরম দুর্দশার কথা বললেন না। যা হোক, মাউন্টব্যাটেন তাঁর সংবেদনশীল মনে সুড়সুড়ি দিয়ে যেতে থাকেন। তিনি বাংলা-ভাগের এক সর্বনাশা ছবি তার সামনে তুলে ধরেন এবং পাটকলগুলি পূর্ববঙ্গে স্থানান্তরিত করে নিলে পূর্ববঙ্গের আর্থিক অবস্থা আরো ভাল হবে জানান। তাতে রায় বলেন, একজন পূর্ববঙ্গবাসী হিসাবে তাতে তিনি খুশিই হবেন :
“I asked him if he had thought of the terrible consequences for Bengal as a whole. I painted a picture of the disastrous consequences to both East and West Bengal. I pointed out that though many people believe that East Bengal would fare worst they appeared to have overlooked the ease with which the jute factories could be transferred to eastern Bengal areas. He agreed that it was so and said that he was glad of it since he himself was a resident of East Bengal.”
এভাবে রায়কে ভাবাবেগে কাবু করে মাউন্টব্যাটেন সাম্রাজ্যবাদী ভেদনীতি প্রয়োগ করলেন।
তিনি যে নিজে পূর্ববঙ্গের অধিবাসী হয়েও পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বাংলাকে ধ্বংসের বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল রক্ষা করে তার হিন্দুপ্রেমের পরিচয় দিচ্ছেন, তার জন্য তাঁকে অভিনন্দনও জানালেন! সে কথা শুনে রায় কাঁধ ঝাঁকালেন :
“I congratulated him on his Hindu patriotism at being prepared to see the Province destroyed to save a Hindu majority in West Bengal at the expense of the Hindus like himself living in East Bengal. He shrugged his shoulders.”
পূর্ববঙ্গের হিন্দু ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য কি জঘন্য প্রচেষ্টা!
তারপর কিভাবে যুক্তবঙ্গ পরিকল্পনার পক্ষে হিন্দু জনপ্রতিনিধিদের টানা যায় তার কলাকৌশল রায়কে বোঝালেন। তিনি প্রথমে যুক্ত ও স্বাধীন বাংলার নামে বাংলাকে অবশিষ্ট ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে কৌশল ফেঁদেছেন, সেকথা জানালেন :
“I then told him what my general plan was on the partition of Bengal. I told him that the intention was that the Bengal represen-tatives of the Constituent Assembly should first sit together and vote on what the future Bengal should be if it remained united : whether it should opt for (a) Independence, (b) Pakistan or (c) Hindusthan.
নিখুঁত কৌশল বটে। গণ পরিষদে বাংলা থেকে মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা তো এমনিতেই বেশি। তার সঙ্গে যোগেন্দ্র মণ্ডলের অনুসারী হিন্দু তফশিলী এবং বাংলা ভাগের বিরোধী আরো দু’এক জন পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুর সমর্থন আদায় করা অসম্ভব নাও হতে পারে। আর এদিকেও পশ্চিমবঙ্গে শরৎ বসুর মতানুসারী দু’একজন হয়তো মিলে যেতে পারে। সুতরাং স্বাধীন বঙ্গের নামে বোরখাবৃত পাকিস্তান সহজেই হাসিল হয়ে যাবে।
মাউন্টব্যাটেন তো কিরণশঙ্কর রায়কে জপিয়েই যাচ্ছেন—যাকে বলা যায় স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে মস্তক ধোলাই। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলা স্বাধীন হবার সিদ্ধান্ত নিলে পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে তিনি রায়কে তার মনের ইচ্ছে জানাতে থাকেন। তিনি স্থির করেছেন আরেক দফা ভোট নেওয়া হবে—তাতে বাংলা ভাগ হবে, কি যুক্ত থাকবে—তার উপর ভোট গ্রহণ হবে এবং বলাই বাহুল্য সংখ্যাগুরু মুসলমান প্রতিনিধিদের ইচ্ছানুসারে যুক্ত বাংলার পক্ষেই ভোট পড়বে। তারপরও পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বাংলায় পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে গণভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা হতে পারে। কিন্তু জনমত যাচাইয়ের নামে এসবই যে জোরজবরদস্তি ও কারচুপির মাধ্যমে স্বাধীন যুক্তবাংলার পক্ষে ভোট আদায় করে পাকেপ্রকারে পুরো বাংলায় পাকিস্তান-মার্কা শাসনব্যবস্থা কায়েম করা, তা বুঝতে বাকী থাকে না। কারণ, মাত্র একবছর আগের নির্বাচনে মুসলিম লীগের হাতে মুসলিম লীগ বিরোধীদের কি হেনস্থা হয়েছিল, তা তো সবারই জানা। সুতরাং বাংলা ভাগের পক্ষে যারা ভোটে দাঁড়াবে, তাদের করুণ পরিণতির কথা না বলাই ভাল।
মাউন্টব্যাটেন তো কিরণশঙ্কর রায়কে জলবত্তরলং সব বুঝিয়ে উভয় পদ্ধতি সম্পর্কে রায়ের মতামত জানতে চাইলেন। রায় পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে না বুঝেই বলে উঠলেন “দুটো পদ্ধতিই উত্তম” তারপর :
“I asked him which of these two methods he preferred. He seemed to think that the issue was now so clear before every body that either method would give a true reflection of opinion.”
এরপর উভয়ের কথোপথন :
Mountbatten-What the chances of Bengal remaining united were in his opinion?
K. S. Roy-Unless the Muslim Leaghe were prepard to come forward with some offer to the Hindus, the chances were slim.
Mountbatten-Whether the offer of joint electorate would satisfy the Hindus?
K. S. Roy (with enormous enthusiasm ) -Most certainly. If you give us that you can practically count on unity.
তারপর মাউন্টব্যাটেন কিরণশঙ্করের সামনে যুক্ত নির্বাচনের গাজরে ঝুলিয়ে বললেন had already recommended Mr. Suhrawardy to consider offering joint electorate but that he was doubtful of being able to carry all his party with him.”
সেটিই সমস্যা; সুরাবর্দী না হয় কলকাতার মুসলমান বলে গদি হারাবার ভয়ে যুক্ত নির্বাচন সমর্থন করতে বসেছেন; কিন্তু তাঁর দলবল বিশেষত পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগুরু জঙ্গী মুসলিম লীগ সদস্যরা তা মানবে কেন? বিশেষত লীগের সভাপতি মৌলানা আক্রম খাঁ যেখানে যুক্ত নির্বাচন ও স্বাধীন বঙ্গ প্রস্তাবের ঘোর বিরোধী। তবে যুক্ত নির্বাচন মেনে বাংলা ভাগ না ঠেকালে যে দুর্দশার সম্মুখীন হতে হবে, সে কথা ব্যাখ্যা করে তিনি তাদের পথে আনতে চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন। তারপর মাউন্টব্যাটেন বললেন যে ২০শে মে নাগাদ সরকারী সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার আগেই আশা করি সুরাবর্দী যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনের অভিপ্ৰায় ঘোষণা করবেন :
“I also told him that I hoped that Mr. Suhrawardy might consider offering a form of coalition government before the announcement of H. M. G’s decision was made on or about the 20th May.”
প্রথমে যুক্ত নির্বাচন, তার সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রিসভা : যেন এক হাতে লজেন্স আরেক হাতে বাতাসা; শুনে নাকি কিরণশঙ্কর উৎসাহে উত্তেজনায় নেচে উঠলেন এবং এমতাবস্থায় তাঁর কি করণীয় তা জানতে চাইলেন। তিনি কয়দিন দিল্লী থাকবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু তাঁকে তৎক্ষণাৎ কলকাতায় ফিরে যেতে এবং দার্জিলিং গিয়ে বারোজের সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দিলেন মাউন্টব্যাটেন :
“Mr. Roy got more and more excited as the meeting progressed. He told me that he had intended staying in Delhi until the announcement was made, but he now want to have my advice as to what he ought to do. I advised him strongly to go straight back to Calcutta and see Suhrawardy and then go on to Darjeeling and see the Governor. “You have not a moment to loose”, I told him; upon which he got up dramatically, shook me warmly by the hand and left the room. “
কিরণশঙ্কর নাকি নাটকীয় আবেগে মাউন্টব্যাটেনের হাত জড়িয়ে ধরেন এবং ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যান।
এসব কথা যদি সত্য হয় তবে রাজনীতিতে বাংলার কংগ্রেসীরা যে কেমন ছেলেমানুষ ও অপরিণামদর্শী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিরণশঙ্কর ভাবপ্রবণ কবি মানুষ এবং সহজবিশ্বাসী; কিন্তু তখনো পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর যেভাবে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলছে সেসব জেনেও নিজের জমিদারি রক্ষা ও মন্ত্রিত্বের আশায় তিনি যদি সুরাবর্দীদের ভাল-মানুষিতে ভুলে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে তাদের রাজনৈতিক শৈশবত্ব কাটেনি। কলকাতায় তাঁর আর একজন দোসর ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু। তিনিও কলকাতা নোয়াখালি ত্রিপুরা ঢাকার ঘটনা বিস্মৃত হয়ে ডেপুটি প্রধান মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রিত্বের আশায় সুরাবর্দীর “স্বাধীন বাংলা বটিকা’ সেবন করে বসলেন! দু’মাসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব হারিয়ে কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের ওপর গোঁসা হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু সুরাবর্দীর সঙ্গে যুক্তবঙ্গ স্বাধীনবঙ্গ নিয়ে তাঁর ধিনধিন নাচানাচি বাঙালী হিন্দুর হৃদয়ের ক্ষতস্থানে নুনের ছিটা ও লেবুর রসসিঞ্চনের মতোই জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই তো তিনি জনসভায় এসে তাঁর সাধের স্বাধীন বঙ্গের পক্ষে প্রচারকার্য চালাতে সাহস পাননি।
এই স্বাধীন বঙ্গের আর এক সমর্থক ও প্রচারক ছিলেন হঠাৎ হিন্দু -মুসলিম ঐক্যের অবতার বনে যাওয়া আবুল হাসিম। এই ভদ্রলোক বর্ধমানের অধিবাসী, বাংলার মুসলিম লীগের জঙ্গী ও জবরদস্ত সম্পাদক। এর সম্পাদকীয় তত্ত্বাবধানেই কলকাতার দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। রিপন স্ট্রীটের বাসিন্দা আবুল হাসিম নাকি তার দুই শিশুপুত্রের হাত ধরে ১৬ আগস্ট বিকাল বেলা ময়দানে মুসলিম লীগের মিটিং-এ মজা দেখতে যান এবং তখন পর্যন্ত জানেন না যে সমগ্র মধ্য ও পূর্ব কলকাতা একপক্ষীয় হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গায় জ্বলছে। অথচ পুলিশ রিপোর্টেও প্রকাশ সকাল নয়টা নাগাদ রিপন স্ট্রীটে, ওয়েলেসলি স্ট্রীট এবং মল্লিক বাজারে — stabbing going on. (ছোরা মারা চলছে)।
এদের জ্ঞানপাপী বা মিথ্যাবাদী কোনও বিশেষণে বিশেষিত করলেও এদের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ করা হয় না। ইনি যখন দেখলেন বাংলা ভাগ হলে তার বর্ধমান জেলা পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়বে, তখনই তিনি স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাবে তাধিন তাধিন নেচে উঠলেন। অথচ যখন সমগ্র বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার সম্ভাবনা ছিল, তখন সেই পাকিস্তানের কি রূপরেখা তিনি অঙ্কন করেছিলেন তা তার বয়ানেই শোনা যাক :
“For Jinnah there was to be one Hindustan and one Pakistan: For Hashim, it was not so simple. His version presented in a widely circulated pamphlet, ‘Let Us Go to War”, (1945) stated in part :
Free India was never one country. Free Indians were never one nation ….Liberated India must necessarily be…. a subcontinent having complete independence for every nation inhabiting it Muslim India to a man will resist all attempts of the Congress to establish dictatorship in India of any coterie, group or organisation. Pakistan means freedom for all. Muslims and Hindus alike. And the Muslims of India are determined to achieve it, if necessary through bloodbath…. Muslims of India are opposed to every kind of domination and exploitation-British or India. In Pakistan there will be just and equitable distribution of the rights and privileges of the state amongst all its citizens irrespective of caste, colour and creed. And it is not the contemplation of the Muslims to reserve any advantage for themselves except their right to govern their own society according to the laws of the Shariat.”
এ যে একেবারে নিরামিষ গোস্ত! একদিকে Bloodbath-এর (রক্তস্নান) হুমকি, অপরদিকে শরিয়তী শাসনের কসম। এ অপূর্ব হালুয়া যদি বিশ্বের বাজারে বিকাত, তা হলে সারা পৃথিবীতে মুসলমান রাষ্ট্র থেকে অমুসলমানরা বিলুপ্ত হয়ে যেত না।
আসলে ভারতভাগের যথার্থ প্রতিক্রিয়ায় প্রদেশভাগের দাবি উচ্চারিত হতেই যাদের পায়ের তলার মাটি সরতে শুরু করেছে তারাই হঠাৎ রঙ্ বদলিয়ে অনুরাগের ফাগ ছড়াতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। লড়কে লেঙ্গের ছোরা ফেলে বাউলের একতারা নিয়ে মিলনগীতি গাইতে দেখলে উদ্দেশ্য যে মহৎ নয়, সে প্রশ্ন মনে জাগে বই কি! অবিশ্বাসের রাজনীতির জন্ম দিয়ে তার জনকত্ব এত সহজে অস্বীকার করা যায় কি?
স্বাধীন বাংলার পক্ষে যে চারজন রাজনীতিক সামিল হয়েছেন তার দু’জন হিন্দু, দু’জন মুসলমান। এদের কারো পাওয়ার আশা, কারো হারাবার ভয়। যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম রাজনীতি সমস্ত নষ্টের গোড়া, তা উৎপাটন করার কোনও সঠিক পথনির্দেশ তাঁরা করতে পারেন নি। তাই হিন্দুরা তাঁদের এই অবান্তর প্রস্তাবে উল্লসিত হবার মতো কিছু পায় নি।
যাহোক, দেখা যাচ্ছে দিল্লীতে কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ডকে এড়িয়ে কলকাতায় স্বাধীন ও যুক্ত বাংলা গড়ার উদ্দেশ্যে জোর শলাপরামর্শ চলছে। একদিকে শরৎবসু-কিরণশঙ্কর, অপরপক্ষে সুরাবর্দী-আবুল হাসিম-ফজলুর রহমান প্রমুখ। ঘটকের ভূমিকায় বারোজ। তাঁরা স্বাধীন বংলার গণপরিষদ কিরূপ হবে, আইন সভার সদস্য কিভাবে নির্বাচিত হবে, মন্ত্রিসভা কেমনভাবে গঠিত হবে, চাকরিবাকরি কি হারে বণ্টিত হবে . ইত্যাদি বিষয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে মাউন্টব্যাটেন তাঁর ৩রা জুনের ঘোষণার চূড়ান্ত রূপদান ও অনুমোদনের জন্য লণ্ডনে গেছেন। আর বারোজ কলকাতা থেকে তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন যেন বাংলা সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়। সরকারি ঘোষণায় যেন বাংলার ব্যাপারে কোনও উল্লেখ না থাকে :
(i) To omit any reference in statement to be made on june 2nd to possibility that Bengal may be partitioned and
(ii) to omit any reference to ultimate status or constitutional connection of future Bengal, tacitly leaving these to Bengal Constituent Assembly which Coaltion Cabinet will get elected.
অর্থাৎ বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সমগ্র ব্যাপার ধোঁয়াশায় রেখে কেবলমাত্র ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা করতে পরামর্শ দিলেন।
২১শে মে ‘৪৭ তারিখে বারোজ আবার মাউন্টব্যাটেনকে টেলিগ্রাম করে সুখবর জানান যে আলোচনা সফল হবার পথে। সুরাবর্দী কিরণশঙ্কর একমত হয়েছেন এবং শরৎ বসুও সম্মতি জানিয়েছেন :
“Suhrawardy today confirms that there there is agreement between himself and Kiransankar Roy to form coalition in Bengal on terms practically identical with those given in my telegram 125 of May 19th and that Sarat Chandra Bose is not opposed.”
শরৎ বসুর কথা বাদ দিই; কারণ তিনি তখন নিজেই নিজের পার্টি। কিন্তু কিরণশঙ্কর দলীয় হাই কম্যাণ্ডের সঙ্গে কোনও কথাবার্তা না বলে কি করে স্বাধীন বাংলার পক্ষে সম্মতি দিয়েছিলেন এটাই বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। সুরাবর্দী তো তাঁর ‘One man High Command’ মিঃ জিন্নাকে কলাকৌশল বুঝিয়ে দিয়ে তাঁর সম্মতিও আদায় করতে সক্ষম হবেন জানেন; কিন্তু কিরণশঙ্কর তখনও জানেন না কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ড মুসলিম লীগের সঙ্গে তাঁর এই গোপন আঁতাত অনুমোদন করবে কিনা। কেননা দেখা যাচ্ছে ১১ই মে ‘৪৭ তারিখেই নেহরু মাউন্টব্যাটেনকে স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে কংগ্রেসের অমতের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বাংলাভাগের ক্ষতিকর পরিণতির কথা স্বীকার করেও, কলকাতা বন্দর সমেত সমগ্র বাংলা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, সমগ্র পূর্ব-ভারতের স্বার্থহানির কথাও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন :
“Pandit Nehru said that it was obvious that the division of
Bengal was harmful from many points of view, but exactly the same argument applied to the cutting off Bengal from India. Calcutta was the port for the whole of Northern India; if Bengal was independent, Calcutta would wither away.”
নেহেরু আরও বলেন বাংলায় প্রবল দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটেছে; তা সত্ত্বেও তিনি প্রদেশভাগের প্রস্তাব করছেন না। কিন্তু কংগ্রেস বাধ্য হয়েছে প্রদেশ-ভাগের সুপারিশ করতে। পাঞ্জাব ও বাংলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে তিনি রাজী আছেন; কিন্তু পশ্চিমবাংলার হিন্দুদের মনোভাবকেও তো অগ্রাহ্য করা যায় না। বাংলার অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। শতকরা একজন হিন্দুও স্বাধীন বাংলার সমর্থক জুটবে কিনা সন্দেহ। গত ৬ মাসে কলকাতা তো অর্ধ ধ্বংসাবস্থায় পৌঁছেছে :
“Pandit Nehru went on to say that he considered that there had been quite enough rioting in Bengal without the suggestion that the Province should be partitioned; however Congress had been forced to recommend partition. He personally hoped that the conception of partition would recede. He would be willing to consider special arrangement with Bengal and the Punjab, but the feeling of the people in Western Bengal was an important factor. The situation in Bengal had become intolerable for them. There was not likely to be more than one percent of non-Muslims who would agree to independence; Calcutta had been half-ruined in the last six months.
১ মে’র ১৫ দিন পর এবং সরকারী ঘোষণার ৬ দিন আগে স্যার মিভিল নেহরুর কাছে স্বাধীন বাংলার কথা তোলেন। ২৭ মে তারিখে মেভিল এক চিঠিতে মিঃ অ্যাবেলকে নেহরুর তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়ে লেখেন :
“In the course of a talk I had with Nehru last night, I asked him how he viewed the discussion now going on about an independent Bengal. He reacted strongly and said there was no chance of the Hindus there agreeng to put themselves under permanent Muslim domination which was what the proposed agreement really amounted to.
অপ্রিয় সত্য কথাটি নেহৰু বিনা দ্বিধায় বলেছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মনোভাব এবং ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন বাংলায় তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যে ইঙ্গিত দিলেন, সে কথাগুলিই ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী গত চার মার্স ধরে অক্লান্তভাবে বাংলার হিন্দুদের কাছে বলে আসছিলেন এবং তারই ফলে হিন্দুদের মনে এমন বিরূপ মনোভাব গড়ে উঠে যে, শতকরা একজন হিন্দুও যুক্ত বাংলার সমর্থনে দাঁড়ায় নি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন