জ্যোতিভূষণ চাকী
মৃচ্ছকটিক – পঞ্চম অঙ্ক
(তারপর আসনস্থ উৎকণ্ঠিত চারুদত্তের প্রবেশ
চারুদত্ত— (উঁচু দিকে তাকিয়ে) অসময়ে দুর্যোগ ঘনালো। কারণ—
যা ময়ূরেরা পেখম মেলে দেখছে, মানসসরোবরের উদ্দেশ্যে প্রস্থানে উন্মুখ হংসদল১ যা অনুমোদন করছে না, সেই অকাল-মেঘ একইসঙ্গে আকাশ এবং উৎকণ্ঠিত প্রেমিকের হৃদয় আচ্ছন্ন করছে।। ১।।
তাছাড়া—
জলে-ভেজা মহিষের উদরের মতো ভ্রমর-নীল মেঘ শোভা পাচ্ছে। বিদ্যুৎপ্রভায় তার হলুদরঙের রেশমি চাদর তৈরি হয়েছে। সংলগ্ন বলাকা-পঙ্ক্তিরূপ শঙ্খ ধারণ করেছে সে। সে যেন দ্বিতীয় বিষ্ণুর মতো৩
আকাশ আক্রমণ করতে চলেছে।। ২॥
তাছাড়া—
চক্রধারী বিষ্ণুর মতো একখণ্ড মেঘ উঠে আসছে। বিষ্ণুদেহের মতো তা শ্যামবর্ণ, বক্র বলাকার পঙ্ক্তিতে তার শঙ্খ রচিত হয়েছে, বিদ্যুৎ-তন্তুই তার পীতবস্ত্র ॥ ৩ ॥ মেঘের গর্ভ থেকে বৃষ্টিধারা গলিত রজতের সিঞ্চিত ধারার মতো ঝরে পড়ছে। আকাশপটের ছিন্ন সূত্রের মতো সেই ধারা, বিদ্যুৎরূপ প্রদীপের শিখায় যা চকিতে দেখা যাচ্ছে, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ॥ ৪ ॥ বায়ু মেঘমালাকে বিশ্লিষ্ট করে দেওয়ায় আকাশ যেন চিত্রমালায় ভূষিত হয়েছে। কখনও মনে হচ্ছে যেন চক্রবাকমিথুন সংলগ্ন হয়েছে, কখনও-বা মনে হচ্ছে উড়ন্ত হাঁসের দল, কোথায় বিক্ষিপ্ত মীন ও মকরের ঝাঁক, কোথাও বা সমুচ্চ সৌধমালা— এইভাবে মেঘ নানা আকৃতিতে রূপ নিচ্ছে ॥ ৫ ॥ এই মেঘে অন্ধকার আকাশ যেন ধৃতরাষ্ট্রের সেনার মতো। আনন্দিত ময়ূর যেন শক্তিগর্বে অতিগর্বিত দুর্যোধনের মতো চিৎকার করছে। কোকিল কুহুধ্বনি ত্যাগ করছে, পাশাখেলায় পরাজিত যুধিষ্ঠির যেন (মৌন হয়ে) বনপথ ধরেছেন। সম্প্রতি হাঁসেরা পাণ্ডবদের মতো বন থেকে অজ্ঞাতবাসে গিয়েছে।। ৬।।
(চিন্তা করে) অনেকক্ষণ হল মৈত্রেয় বসন্তসেনার কাছে গিয়েছে। এখনও তো এল না।
(প্রবেশ করে )
বিদূষক— ইস্! গণিকাদের কী লোভ এবং অসৌজন্য! একটা অন্য কথাও বলল না। তার স্নেহের অনুরূপ কিছু বলে রত্নহারটি নিল।
এত ধনদৌলত থাকা সত্ত্বেও একটিবার তো বলল না— আর্য মৈত্রেয়, বিশ্রাম করুন। অন্তত এক গেলাস জল খেয়ে যান। এই বাঁদীরবেটী গণিকার মুখদর্শন যেন আমাকে আর না করতে হয়। (সখেদে) মূল নেই অথচ পদ্মচারা গজাচ্ছে, স্যাকরা অথচ চোর নয়। গাঁয়ের পঞ্চায়েত অথচ ঝগড়া নেই সেখানে, গণিকা অথচ লোভ নেই তার— এমনটা যে হয় না, একথা লোকে ঠিকই বলে। তাই প্রিয়বয়স্যের কাছে গিয়ে এই গণিকার আসক্তি থেকে ওঁকে নিবৃত্ত করি। (পরিক্রমা করে দেখে) এ কী, প্রিয়বয়স্য যে বাগানে বসে আছেন! কাছে যাই তাহলে, (কাছে গিয়ে)। কল্যাণ হোক আপনার। সমৃদ্ধিলাভ করুন আপনি।
চারুদত্ত— (দেখে)। এই যে আমার বন্ধু মৈত্রেয় এসেছ। বন্ধু, স্বাগত। বোসো।
বিদূষক— বসেছি।
চারুদত্ত— বন্ধু, যে কাজের ভার দিয়েছিলাম তার কথা বলো।
বিদূষক— ও কাজ ভেস্তে গিয়েছে।
চারুদত্ত— তিনি কি রত্নহার গ্রহণ করেননি?
বিদূষক— আমাদের কি সেই ভাগ্য?
নবকমলের মতো কোমল অঞ্জলি মাথায় করে গ্রহণ করেছেন।
চারুদত্ত— তাহলে ভেস্তে গেল বলছ কেন?
বিদূষক— ভেস্তে গেল ছাড়া কী বলব?
যা আমরা খাইনি পরিনি, যা চোরে নিয়ে গেল, সেই অল্প দামের সোনার বাক্সটার বদলে কিনা আপনি হারালেন রত্নহার— যা চতুঃসমুদ্রের সার!
চারুদত্ত— বন্ধু, ওকথা বোলো না।
যে-আস্থা অবলম্বন করে আমার কাছে তিনি তা গচ্ছিত রেখেছিলেন সেই মহাপ্রত্যয়ের মূল্য দিয়েছি ॥ ৭॥
বিদূষক— বয়স্য, আর এটাও আমার রাগের আর এক কারণ যে তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে সখীকে ইঙ্গিত করে আমাকে যেন উপহাস করলেন। তাই আমি ব্ৰাহ্মণ হয়ে এখন আপনার কাছে মাথা নত করে অনুরোধ করছি, বহু অনর্থের মূল এই গণিকায় আসক্তি থেকে আপনি নিবৃত্ত হোন। গণিকা হচ্ছে জুতোয় ঢুকে-পড়া ঢিলের মতো, অনেক কষ্টে যা বের করতে হয়। তাছাড়া, বন্ধু! গণিকা, হাতি, কায়স্থ, ভিক্ষু, গুপ্তচর এবং গাধা— এরা যেখানে বাস করে সেখানে দুষ্টেরাও জন্মায় না।
চারুদত্ত— বন্ধু, এসব নিন্দা করে আর লাভ নেই। আমার অবস্থাই তো আমাকে নিবৃত্ত করেছে। দেখ—
(ক্লান্ত) ঘোড়া দ্রুত ছুতে বেগের আশ্রয় নেয়, কিন্তু শক্তির অভাবে তার পা তাকে ততটা বইতে পারে না। তেমনি মানুষের বাসনারাশি সর্বত্রই যেতে চায়, কিন্তু খিন্ন হয়ে তারা আবার হৃদয়েই প্রবেশ করে ॥ ৮ ॥
তা ছাড়া, বন্ধু—
যার ধন আছে সেই অঙ্গনা তারই, ধনেই তাঁকে পাওয়া যায়। (স্বগত) না, গুণেই তাঁকে পাওয়া যায়। (প্রকাশ্যে) ধন আমাকে পরিত্যাগ করেছে তাই, তাঁকেও আমি ত্যাগ করেছি ॥ ৯ ॥
বিদূষক— (নিচে তাকিয়ে। স্বগত) তিনি যে ঊর্ধ্বদৃষ্টি দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন তাতে মনে হচ্ছে আমি নিবারণ করায় তাঁর উৎকণ্ঠা (অনুরাগ) আরও বেড়ে গেল। প্রেমের গতি যে বক্র একথা ঠিকই বলা হয়ে থাকে। (প্রকাশ্যে) বয়স্য! তিনি বলেছেন— ‘চারুদত্তকে বলবেন আজ সন্ধ্যায় আমি তাঁর ওখানে আসব।’ মনে হয় রত্নহার পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট হননি, আরও কিছু চাইতেই তিনি আসবেন।
চারুদত্ত— বয়স্য, আসুন, পরিতুষ্ট হয়েই যাবেন তিনি।
চেট— (প্রবেশ করে)— শুনুন সকলে।
মেঘ যতই বর্ষণ করছে আমার পিঠের চামড়াও ততই ভিজে উঠছে আর ঠাণ্ডা হাওয়া যতই বইছে, আমার হৃদয়ও তত কাঁপছে ॥ ১০ ॥
(জোরে হেসে)
সাতটি ফুটো-ওয়ালা বাঁশি বাজাই আমি, ঝংকারতোলা সাততারের বীণাও বাজাই আমি। গাধার মতো গান গাই আমি। তুম্বুরই হোন, আর নারদই হোন, আমার গানের কাছে তাঁরা কে ॥ ১১ ॥
আর্যা বসন্তসেনা আমাকে আদেশ করেছেন- কুম্ভীলক, যাও আমার আসার কথা চারুদত্তকে বলো গিয়ে। যাই তাহলে আর্য চারুদত্তের বাড়ি যাই।
(পরিক্রমা করল। প্রবেশ করে এবং দেখে)
এই যে, চারুদত্ত বাগানেই আছেন। আর এই দুষ্ট বামুনটাও আছে দেখছি। কাছেই যাই। সে কী! বাগানের দুয়োর যে বন্ধ। যাক ওই দুষ্ট বামুনটাকেই ইশারা করি। (কাদার ঢেলা ছুড়ল)
বিদূষক— এ কী! কে এখানে এসে আমাকে কাদার ঢেলা ছুড়ে মারছে, আমি যেন বেড়ায়ঘেরা কদবেল গাছ।
চারুদত্ত— বাগানবাড়ির ছাতে খেলা করতে করতে পায়রারা হয়তো ফেলেছে।
বিদূষক— হতচ্ছাড়া বাঁদীরবেটা পায়রা! দাঁড়া আমি এই লাঠিটা দিয়ে দালান থেকে তোদের পাকা আমের মতো মাটিতে ফেলছি! (লাঠি উঁচিয়ে দৌড়ল)
চারুদত্ত— (পৈতে টেনে) বয়স্য, বোসো। কী হবে ওর সঙ্গে লেগে? বেচারা পায়রাটি দয়িতার সঙ্গে থাকুক না।
চেট— এ কী! পায়রাই দেখছে দেখি, আমাকে তো দেখছে না। যা হোক। আর একটা কাদার ঢেলা ছুড়ে মারি। (তাই করল)।
বিদূষক— (চারদিক দেখে) আরে! এ যে কুম্ভীলক! ওর কাছেই যাই তাহলে।
(এসে, দুয়ার খুলে) কুম্ভীলক, ভেতরে এসো, স্বাগত জানাচ্ছি তোমাকে।
চেট— (প্রবেশ করে) আর্য, নমস্কার।
বিদূষক— ওহে! এমন দুর্যোগে অন্ধকারের মধ্যে তুমি কোথায় এসেছ?
চেট— তিনি এসেছেন যে।
বিদূষক— তিনি কে?
চেট— এই যে তিনি।
বিদূষক—ওরে বাঁদীরবেটা, দুর্ভিক্ষের দিনে ভিখিরির মতো তুই ‘এষ সা এষ সা’ (এই যে তিনি, এই যে তিনি) বলে শোষাচ্ছিস কেন?
চেট— তুমিও ‘কা’-’কা’ (কে-কে) করে কাকের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?
বিদূষক— বেশ! বল্ তাহলে।
চেট– (স্বগত) তা হলে এইভাবেই বলি। (প্রকাশ্যে) তোমাকে একটা হেঁয়ালি শুধোই।
বিদূষক— (বলতে পারলে) আমি তোমার মাথায় পা রাখব!
চেট—বেশ! কোন ঋতুতে আমের মুকুল ধরে বলো তো!
বিদূষক— ওরে বাঁদীর-বেটা! গ্রীষ্মে।
চেট— না, না।
বিদূষক— (স্বগত) কী বলি তাহলে? (চিন্তা করে) চারুদত্তের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি। (প্রকাশ্যে) ওরে, একটু দাঁড়া। (চারুদত্তের কাছে গিয়ে) হে বন্ধু, জিগ্যেস করছি কোন সময়ে আমের মুকুল ধরে বলুন তো।
চারুদত্ত— মূর্খ, বসন্তে।
বিদূষক— (চেটের কাছে গিয়ে) মূর্খ, বসন্তে।
চেট— এবারে দ্বিতীয় প্রশ্ন করছি। সুসমৃদ্ধ গ্রামকে কে রক্ষা করে?
বিদূষক— কেন, রথ্যা ( সৈনিকদের গাড়ি)
চেট― (সহাস্যে) হল না, হল না।
বিদূষক— সংশয়েই পড়লাম দেখছি। (চিন্তা করি) যাই চারুদত্তকেই আবার জিগ্যেস করি। (আবার ফিরে চারুদত্তকেই জিজ্ঞেস করল।)
চারুদও— বন্ধু! সেনা।
বিদূষক— (চেটের কাছে এসে) ওরে— বাঁদীরবেটা! ‘সেনা’।
চেট— দুটো একসঙ্গে বলো তো।
বিদূষক— সেনাবসন্তে।
চেটী— উল্টিয়ে বলো
বিদূষক— (দেহটা ঘুরিয়ে নিয়ে) সেনাবসন্তে।
চেট— ওরে মূর্খ! ওই বর্ণগাঁথা পদদুটো ওল্টাও।
বিদূষক— বসন্তসেনা।
চেট— তিনিই এসেছেন।
বিদূষক— তাহলে চারুদত্তকে বলি গিয়ে। (কাছে এসে) সেই ধনী মানুষটি আপনার কাছে এসেছে।
চারুদত্ত— আমাদের বংশে ধনী মানুষ আবার কে?
বিদূষক— বংশে না থাকলেও, দ্বারে আছেন। বসন্তসেনা এসেছেন।
চারুদত্ত— বয়স্য, আমাকে কি প্রতারণা করছ?
বিদূষক— যদি আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, তাহলে এই কুম্ভীলককে জিজ্ঞাসা করুন। ওরে বাঁদীর-বেটা! এদিকে আয়।
চেট— (এগিয়ে এসে) আর্য, প্রণাম।
চারুদত্ত— ভদ্র! স্বাগত। বলো সত্যিই কি বসন্তসেনা এসেছেন?
চেট— বসন্তসেনা সত্যই এসেছেন এখানে।
চারুদত্ত— (সহর্ষে) ভালো সংবাদ পেলে আমি কখনও নিষ্ফল হতে দিই না (অর্থাৎ সুসংবাদবাহীকে আমি পুরস্কৃত করি)। এই পারিতোষিক নাও তুমি (উত্তরীয় দিলেন)
চেট— যাই, আর্যাকে বলি গিয়ে। (নিষ্ক্রান্ত হল)
বিদূষক— আচ্ছা, আপনি কি জানেন এই দুর্যোগে তিনি কেন এসেছেন?
চারুদত্ত— বন্ধু, তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
বিদূষক— কিন্তু আমি বুঝতে পারছি। রত্নহারটি কম দামের, স্বর্ণভাণ্ডটি বেশি দামের। তাই পরিতুষ্ট না হতে পেরে আর কিছু চাইতে এসেছেন।
চারুদত্ত— পরিতুষ্ট হয়েই যাবেন তিনি।
(তারপর উজ্জ্বল অভিসারিকার বেশে বসন্তসেনা ও তাঁর সঙ্গে ছত্রধারিণী এবং বিট প্রবেশ করল)।
বিট— (বসন্তসেনাকে উদ্দেশ্য করে) ইনি পদ্মহীন লক্ষ্মী কামদেবের ললিত অস্ত্র। কুলস্ত্রীদের দুঃখ৫ এবং কামরূপ রম্যবৃক্ষের ফল স্বরূপা। রতিকালে লজ্জা প্রকট করে যখন উনি অভিরাম গতিতে চলেন তখন প্রিয় বণিকদল রতিক্ষেত্ররূপ রঙ্গমঞ্চে তাঁকে অনুসরণ করেন ॥ ১২ ॥
বসন্তসেনা— দেখো দেখো!
বিরহী-বনিতাদের হৃদয়-অনুকারী (বিদীর্ণ) মেঘরাশি গর্জন করছে। শৈল-শিখরে তাদের ছায়া এসে পড়েছে। এদের গর্জনে হঠাৎ উড়ে আসা ময়ূরেরা যেন মণিময় তালপাখায় আকাশকে হাওয়া করছে ॥ ১৩ ॥ বৃষ্টিধারায় আহত কাদায় মুখ-লেপা ব্যাঙেরা জল পান করছে। কামাতুর ময়ূরেরা মুক্তকণ্ঠে কেকাধ্বনি তুলছে। কদমফুলকে প্রদীপের মতো দেখাচ্ছে। কুলঘ্ন মানুষ যেমন করে সন্ন্যাসকে আচ্ছন্ন করে কলঙ্কিত করে, মেঘ চাঁদকে যেন তেমনি ক’রে আচ্ছন্ন করেছে। নিচুবংশে জাত যুবতীর মতো বিদ্যুৎও একখানে থাকছে না ॥ ১৪॥
বসন্তসেনা— ভদ্র! আপনি ঠিকই বলেছেন। এই—
(মেঘ)-গর্জনে মুহুর্মুহু আমাকে নিবারণ করে রাত্রিরূপিণী সপত্নী যেন কুপিতা হয়েই আমার পথরোধ করে চলছে, রে মূঢ়ে, ঘনসংলগ্ন-পয়োধরা, আমার সঙ্গে কান্ত যখন রতিরঙ্গে মত্ত তখন তোমার এখানে আসার প্রয়োজন কী? ॥ ১৫ ॥
বিট— হ্যাঁ, তাই বটে। একে তুমি তিরস্কার করো।
বসন্তসেনা— এ অনড়, স্ত্রীলোকের স্বভাব যা তাই৬, একে আর তিরস্কার করে কী হবে? দেখুন, ভদ্র—
মেঘ বর্ষণ করুক, অথবা বজ্রপাত করুক। অভিসারিকারা শীতাতপ গণনা করে না ॥ ১৬ ॥
বিট— বসন্তসেনা! দেখো দেখো। এই যে একজন—
বাতাসে যার বেগ বর্ধিত হয়েছে, স্থূল ধারা যার বাণরাশি, গর্জন যার পটহনাদ, স্ফুরিত বিদ্যুৎ যার পতাকা সেই মেঘ, নগরমধ্যে হীনবল শত্রুর কাছ থেকে রাজা যেমন কর গ্রহণ করে তেমনি করে মেঘ ও আকাশে চাঁদের কর (কিরণ) গ্রহণ করছে অর্থাৎ চাঁদকে আচ্ছন্ন করছে ॥ ১৭ ॥
বসন্তসেনা— হ্যাঁ, তাই। এই আর একজন
যারা গজেন্দ্রের মতো কৃষ্ণবর্ণ, যাদের উদর স্ফীত ও লম্বিত, তড়িৎ এবং বলয়পঙ্ক্তিতে যারা চিত্রিত সেই সব গর্জনশীল মেঘখণ্ড যখন মনকে শল্যবিদ্ধ করে ফেলেছে তখন, হায়! হে হতভাগা দুষ্টবুদ্ধি বক, প্রোষিতভর্তৃকাদের বধনির্দেশে পটহধ্বনির মতো তুমি ‘প্রাবৃট্’ ‘প্রাবৃট’’ (বর্ষা বর্ষা) বলে কাটাঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছ যেন? ॥ ১৮ ॥
বিট— বসন্তসেনা, সত্যিই তাই। আর একটা জিনিস দেখুন। বলাকারূপ শ্বেত-উষ্ণীষ এবং বিদ্যুৎরূপ চামর ধারণ করে আকাশ মত্তহস্তীর সাম্যগ্রহণে ইচ্ছুক হয়েছে ॥১৯॥
বসন্তসেনা— ভদ্র! দেখুন দেখুন।
সিক্ত তমালপত্রের মতো কৃষ্ণবর্ণ এই মেঘরাশি আকাশে সূর্যকে সম্পূর্ণ পান করেছে (গ্রাস করেছে), উইয়ের ঢিবিগুলো বৃষ্টিধারায় আহত হয়ে শরাহত হাতির মতো ভেঙে পড়েছে। (মেঘরাশি) বিদ্যুৎকে কাঞ্চনদীপিকার মতো প্রাসাদ-সঞ্চারিণী এবং জ্যোৎস্নাকে দুর্বলভর্তৃকা স্ত্রীর মতো সবলে অপহরণ করেছে। ২০ ॥
বিট— বসন্তসেনা, দেখো দেখো—
বিদ্যুৎরূপ গুণে (জ্বললে) আবদ্ধ হাতির মতো পরস্পরের প্রতি ধাবমান এই ধারাবর্ষী মেঘেরা যেন ইন্দ্রের আদেশে পৃথিবীকে রুপোর রশিতে উপরে তুলছে ॥ ২১ ॥
আরও দেখো—
প্রচণ্ড ঝটিকায় ধ্বনিত মহিষকুলের মতো নীলবর্ণ বিদ্যুৎরূপ পাখার বলে জলধির মতো আকাশে সঞ্চরমাণ এই চঞ্চল মেঘরাশি ধারাসম্পাতে নব-শ্যামল শস্যাঙ্কুরবর্তী মৃৎসুরভি এই ধরিত্রীকে যেন মণিময় শরে বিদ্ধ করছে ॥২২ ॥
বসন্তসেনা— ভদ্র! আরও দেখুন—
দিমণ্ডলকে কাজলের মতো কালো করে দিয়ে মেঘ উঠে আসছে। ময়ূরেরা ‘এসো এসো’ বলে উচ্চ কেকাধ্বনিতে তাকে ডাকছে। উড়ে এসে বকপক্তি যে তাকে আবেগের সঙ্গে গাঢ়ভাবে আলিঙ্গন করছে, পদ্ম ছেড়ে কষ্টে উঠে এসে হাঁসেরা অত্যন্ত উদ্বেগ নিয়ে তাকে দেখছে ॥ ২৩ ॥
বিট— তাই বটে। আরও দেখ—
পৃথিবী এখন যেন ধারাসম্পাতে রচিত সৌধের ভিতরে নিশ্চল হয়ে নিদ্রা যাচ্ছে। পদ্মফুলরূপ তার চোখও নিশ্চল হয়েছে। পৃথিবী দিন ও রাত্রিকে হারিয়েছে। বিদ্যুৎ-স্ফুরণের দরুন ভিতরের অন্ধকার ক্ষণকালের জন্যে কাটছে বলে আবার দেখা যাচ্ছে। দিঙমণ্ডলরূপ তার মুখ অবগুণ্ঠিত। মেঘের আবাস ওই বিস্তীর্ণ আকাশে অগণিত মেঘের এক ছত্র-আচ্ছাদন রচিত হয়েছে ॥ ২৪ ॥
বসন্তসেনা— ভদ্র, সত্যিই তাই। দেখুন দেখুন—
অসজ্জনে কৃত উপকারের মতো তারারা বিনষ্ট হয়ে রয়েছে; কান্তবিযুক্তা নারীর মতো দিকগুলো শোভা পাচ্ছে না; মনে হচ্ছে, দেবরাজ ইন্দ্রের অস্ত্রে অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে দ্রবীভূত হয়ে আকাশ জলরূপে ঝরে পড়ছে ॥ ২৫ ॥
আরও দেখুন—
প্রথম সম্পদলাভে পুরুষ যেমন করে তেমনি মেঘ নানা রূপ ধারণ করছে— এই উঠছে, এই পড়ছে, এই ঝরে পড়ছে, এই গর্জন করছে, এই অন্ধকার ঘনিয়ে তুলছে ॥ ২৬ ॥
বিট— তাই বটে।
আকাশটা যেন বিদ্যুতে বিদ্যুতে জ্বলছে। শত শত বলাকার দরুন যেন হাসছে, ধারাশরবর্ষী ইন্দ্রধনু উদিত হওয়ায় যেন নাচছে, বজ্রের উচ্চ ধ্বনির দরুন যেন চিৎকার ঝরছে, ঝড়ে যেন টলছে, ঘন কালো সাপের মতো মেঘগুলোর দরুন যেন ধূম উদ্গিরণ করছে বলে মনে হচ্ছে ॥ ২৭ ॥
বসন্তসেনা— মেঘ তুমি নির্লজ্জ, কারণ—
প্রিয়গৃহে চলিতা আমাকে গর্জনে ভয় দেখিয়ে ধারাহস্তে (বৃষ্টিধারারূপ হস্তে) ) তুমি আমাকে স্পর্শ করছ ॥ ২৮ ॥
হে ইন্দ্র, আমি কি তোমার প্রতি পূর্বে কখনও অনুরাগে আসক্ত হয়েছি যে তুমি মেঘগর্জনরূপ সিংহনিনাদ করছ? ধারাসম্পাতে এই প্রিয়বাঞ্ছিতা আমার পথরোধ করা তোমার উচিত নয় ॥ ২৯ ॥
তা ছাড়া—
হে ইন্দ্ৰ, তুমি যেমন অহল্যার জন্যে ‘আমি গৌতম’ একথা বলেছিলে তেমনি, আমারও দুঃখ (এ দুঃখ তুমি হৃদয়ঙ্গম করো)। হে (পরদুঃখে) উদাসীন, মেঘ সরিয়ে নাও ॥ ৩০ ॥
তাছাড়া—
হে ইন্দ্র, তুমি গর্জনই কর আর বর্ষণই কর বা শত শত বজ্রপাত ঘটাও, দয়িতের মিলনে যে নারীরা চলেছে তাদের তুমি বাধা দিতে পারবে না ॥ ৩১ ॥
মেঘ যদি গর্জন করে করুক, কারণ পুরুষেরা নিষ্ঠুর। কিন্তু অয়ি বিদ্যুৎ। তুমিও অঙ্গনাদের দুঃখ বোঝ না? ॥ ৩২ ॥
বিট— ভদ্রে, না না, তুমি তিরস্কার কোরো না। এ (বিদ্যুৎ) যে তোমার উপকারিণী। কারণ, ঐরাবতের বুকে চঞ্চল স্বর্ণরজ্জুর মতো, পাহাড়চূড়োয় নিহিত পতাকার মতো, ইন্দ্রভবনের (আকাশের) দীপিকার মতো এ (বিদ্যুৎ) তোমাকে প্রিয়তমের আবাস দেখিয়ে দিচ্ছে ॥ ৩৩ ॥
বসন্তসেনা— ভদ্র! সত্যই তাই। এই সেই গৃহ
বিট— সকল কলায় অভিজ্ঞ তোমাকে উপদেশ দেবার কিছু নেই। তবু স্নেহ কিছু বলিয়ে নিচ্ছে। এখানে প্রবেশ করে মোটেই বেশি কোপ প্রকাশ করবে না। যদি কুপিতা হও প্রেম রইবে না। আবার কোপ ছাড়া কাম কোথায়? কুপিতা হও, তাকেও কুপিত করো, কিন্তু প্রসন্নও হোয়ো, প্রিয়কে প্ৰসন্ন ও কোরো ॥ ৩৪ ॥
তাই হোক। ওহে শোনো, আর্য চারুদত্তকে বলো— কদম্ব ও নীল যে-সময়ে প্রস্ফুটিত হয়ে সুগন্ধ ছড়ায় সেই মেঘমেদুর সময়ে সে কামার্তা ও আনন্দিতা হয়ে প্রিয়ের আবাসে এসেছে। জলে তার চূর্ণকুন্তল সিক্ত। বিদ্যুৎ এবং মেঘগর্জনে সে তার চরণদুটি প্রক্ষালনে রতা, যে চরণদুটির নূপুর কদমে ক্লিন্ন ॥ ৩৫
চারুদত্ত— (শুনে) বয়স্য, জেনে এসো ব্যাপারটা কী?
বিদূষক— আপনার যে আদেশ। (বসন্তসেনার কাছে এসে, সাদরে) আপনার মঙ্গল হোক।
বসন্তসেনা— আর্য, নমস্কার। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। (বিটের প্রতি) এই ছত্রধারিণী শুধু আপনারই হোক।
বিট— (স্বগত) এইভাবে সুন্দর করে আমাকে বিদায় দেওয়া হল। (প্রকাশ্যে) তাই হোক, শ্রীমতী বসন্তসেনা।
সগর্ব মায়া, ছল ও মিথ্যার যা জন্মভূমি, শাঠ্যই যার আত্মা, সম্ভোগক্রীড়া যাকে নিজের ঘর বানিয়েছে সেখানে রমণসুখের সংগ্রহ গণিকারূপ বিপণির পণ্যের সামান্য বিনিময় দাক্ষিণ্য সহকারে সিদ্ধ হোক ॥ ৩৬ ॥
(বিটের প্রস্থান)
বসন্তসেনা— আর্য মৈত্রেয়, আপনাদের দ্যূতকর কোথায়?
বিদূষক— (স্বগত)— আশ্চর্য! ‘দ্যূতকর’ একথা বলে ইনি প্রিয় বয়স্যকে অলঙ্কৃতই করলেন।
(প্রকাশ্যে) শ্ৰীমতী! ইনি এই শুষ্ক উদ্যানে।
বসন্তসেনা— আর্য! ‘শুষ্ক উদ্যান’ বলতে কী বোঝায়?
বিদূষক— যেখানে খাওয়ার বা পান করার কিছুই নেই।
(বসন্তসেনার স্মিতহাস্য)
বিদূষক— তাহলে শ্রীমতী প্রবেশ করুন।
বসন্তসেনা— (জনান্তিকে)— এখানে প্রবেশ করে আমি কী বলব।
চেটী— দ্যূতকর! আপনার কাছে এই সন্ধ্যাটি সুখকর তো!
বসন্তসেনা— আমি কি তা বলতে পারব?
চেটী— অবস্থাগতিকে ভালোই পারবেন।
বিদূষক— শ্রীমতী প্রবেশ করুন।
বসন্তসেনা— (প্রবেশ করে এবং কাছে গিয়ে, ফুলের আঘাত করে) ওগো দ্যূতকর, সন্ধ্যাটি আপনার কাছে সুখকর তো?
চারুদত্ত— (দেখে)— ও, বসন্তসেনা এসেছে। (সহর্ষে উঠে) প্রিয়ে!
আমার সন্ধ্যা সর্বদাই বিনিদ্রভাবে কাটে, রাত্রিও সর্বদা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই কেটেছে। হে বিশাললোচনে! তোমার সঙ্গে মিলিত হয়েছি বলে আজকে আমার এই সন্ধ্যা দুঃখ দূর করেছে ॥ ৩৭ ॥
তাই তোমাকে স্বাগত জানাই। এই যে আসন। বোসো এখানে।
বিদূষক— এই যে আসুন। বসুন আপনি। (বসন্তসেনা বসলেন, তারপর সবাই বসলেন)
চারুদত্ত— বয়স্য, দেখো দেখো—
কর্ণান্তবিলম্বী বর্ষাবারিবর্ষী কদম্বে এঁর যৌবরাজ্যে বৃত রাজতনয়ের মতো একটি স্তন অভিষিক্ত হয়েছে ॥ ৩৮ ॥
তাই, হে বয়স্য! বসন্তসেনার পরিচ্ছদ দুটি সিক্ত, অন্য একজোড়া সুন্দর পরিচ্ছদ এনে দাও।
বিদূষক— আপনার যা আদেশ।
চেটী— আর্য মৈত্রেয়, আপনি থাকুন। আমিই আর্যার পরিচর্যা করছি।
বিদূষক— (চারুদত্তকে, জনান্তিকে) বয়স্য, আমি এঁকে কিছু জিগ্যেস করব।
চারুদত্ত— তাই করো।
বিদূষক— (প্রকাশ্যে) আপনি এই জ্যোৎস্নাহীন দুর্যোগের অন্ধকারে এলেন কেন বলুন তো?
চেটী— এই ব্রাহ্মণ কী সরল!
বসন্তসেনা— বরং ‘চতুর’ এ কথাই বলো।
চেটী— আর্য জিগ্যেস করতে এসেছেন সেই রত্নহারের দাম কত?
বিদূষক— (জনান্তিকে) আমি তো বলেই ছিলাম রত্নহারটি অল্প দামের আর স্বর্ণভাণ্ডটা অনেক দামের। তাই সন্তুষ্ট হতে না পেরে ইনি অন্য কিছু চাইতে এসেছেন।
চেটী— ওই হারটি তো আর্য নিজের মনে করে জুয়ায় খুইয়েছেন। এখন সেই রাজদূত সভিক জুয়ার সর্দার কোথায় গেল তা জানা যাচ্ছে না।
বিদূষক— আপনি শুধু আমি যা বললাম তারই পুনরুক্তি করছেন।
চেটী— তাকে যতক্ষণ খুঁজে না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ এই রত্নভাণ্ডটি রাখুন।
(বিদূষক চিন্তামগ্ন হলেন)
চেটী— আর্য দেখি একদৃষ্টে দেখছেন এটি। আপনি কি আগে দেখেছেন নাকি? বিদূষক—এর শিল্পনৈপুণ্য আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে।
চেটী—আর্য, আপনার চোখ আপনাকে ঠকিয়েছে। এটি সেই সুবর্ণভাণ্ড।
বিদূষক— (সানন্দে) বয়স্য! এই সেই সুবর্ণভাণ্ড যা আমাদের বাড়ি থেকে চোরে নিয়ে গিয়েছিল।
চারুদত্ত— বয়স্য! গচ্ছিত প্রত্যর্পণের যে ছলনার কথা আমরা ভেবেছিলাম তাই দেখি আমাদের দিকে ঘুরিয়ে ধরা হয়েছে! একি সত্যি, না কৌতুকমাত্র?
বিদূষক— বন্ধু, আমার বামনাইয়ের দিব্যি, সত্যি
চারুদত্ত— এ আনন্দের, সত্যিই আনন্দের।
বিদূষক– (জনান্তিকে) আচ্ছা, জিগ্যেস করছি কোত্থেকে চোর পেল এটা?
চারুদত্ত— না পাবার কী আছে?
বিদূষক— (চেটীর কানে কানে)) এটা কি সেইরকম?
চারুদত্ত— কী বলা হচ্ছে শুনি! আমি কি বাইরের লোক?
বিদূষক— সেই রকমই।
চারুদত্ত— ভদ্রে! এটা কি সত্যিই সেই স্বর্ণভাণ্ড?
চেটী— আর্য, হ্যাঁ, সেই ভাণ্ডই।
চারুদত্ত— ভালো খবর পেলে (তাকে আমি নিষ্ফল করি না, উপহার না দিয়ে আমি পারি না)। তাই উপহার হিসেবে এই আংটিটি নাও।
বসন্তসেনা— (স্বগত) এই জন্যেই তো তুমি আমার প্রার্থিত
চারুদত্ত— (জনান্তিকে) হায়! ধনহীন লোকের প্রথমত, জীবন থেকেই-বা লাভ কী? কারণ—প্রতিকারের শক্তি নেই ব’লে তার ক্রোধ এবং অনুগ্রহ দুই-ই ব্যৰ্থ হয়ে যায়।। ৪০ ।।
তাছাড়া—
ডানাভাঙা পাখি, শুকিয়ে যাওয়া গাছ, জলহীন সরোবর, বিষদাঁত ভেঙে যাওয়া সাপ আর গরিব মানুষ— এরা সংসারে একই রকম ॥ ৪১ ॥
তাছাড়া—
গরিব মানুষেরা শূন্যগৃহের মতো, নির্জলা কুয়োর মতো, শীর্ণ তরুর মতো। কারণ— পূর্বপরিচিত মানুষদের সঙ্গে মিলনে (দুঃখ) বিস্মৃত হলেও আনন্দের সময়টি ব্যর্থ হয় ॥ ৪২ ॥
বিদূষক— দুঃখ করবেন না বেশি। (প্রকাশ্যে সপরিহাসে) শ্রীমতী! আমার স্নানবস্ত্রটি ফিরিয়ে দিন।
বসন্তসেনা— আর্য চারুদত্ত এই রত্নহারটি দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করাটা কি ঠিক হয়েছে?
চারুদত্ত— (সঙ্কোচের হাস্যে) বসন্তসেনা। দেখো দেখো!
কে সত্য ঘটনাটি বিশ্বাস করত? প্রত্যেকেই আমাকে লঘু করেই দেখত। গৌরবহীন দারিদ্র্য এ সংসারে সংশয়েরই উদ্রেক করে ॥ ৪৩ ॥
বিদূষক— চেটী, তুমি কি এখানেই ঘুমোবে?
চেটী— (সহাস্যে)! আর্য মৈত্রেয়! এবারে আপনি নিজেকে অত্যন্ত সরল বলে প্রমাণিত করলেন।
বিদূষক— বয়স্য! আবার দেখি ধারাসারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। জমিয়ে বসা লোকদের তাড়ানোর জন্যেই বোধহয় মেঘের এই কাণ্ড!
চারুদত্ত— তুমি ঠিকই বলেছ। মেঘের অন্তরাল ভেদ করে জলধারা ঝরছে, মৃণালদণ্ড যেমন পঙ্কের অন্তরাল ভেদ করে প্রবেশ করে তেমনি।
এই বারিধারা যেন চাঁদের দুঃখে দুঃখিত আকাশের অশ্রুধারার মতোই ঝরছে ॥৪৪॥
তাছাড়া—
বলরামের পরিচ্ছেদের মতো প্রতীয়মান মেঘেরা বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ছে, তারা যেন মহৎজনের মনের মতো পবিত্র, আর ভয়ঙ্কর বলে যেন অর্জুনের শরবর্ষণের মতো। দেখে মনে হচ্ছে মেঘেরা যেন ইন্দ্রের মুক্তাসঞ্চয় বর্ষণ করে চলেছে। ৪৫।
প্রিয়ে, দেখো দেখো!
মেঘেদের বর্ণ পিষ্টতমালপাতার মতো, সুরভি ও শীতল সান্ধ্য বায়ুতে তারা বীজিত। এমন মেঘে আচ্ছন্ন অম্বরকে মেঘসমাগমে প্রণয়িনীর মতো বিদ্যুৎ ইচ্ছামতো আলিঙ্গন করছে, প্রিয়তমা কান্তকে যেমন আলিঙ্গন করে তেমনি ॥ ৪৬ ॥
(বসন্তসেনা শৃঙ্গারভাবের অভিনয় করে চারুদত্তকে আলিঙ্গন করল)
চারুদত্ত— (স্পর্শ সুখ অভিনয়ে প্রকাশ করে আলিঙ্গন করে হে মেঘ আরও গম্ভীরভাবে গর্জন করো। তোমারই অনুগ্রহে আমার অনঙ্গপীড়িত দেহ (প্রিয়া) স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে যেন কদম্বপুষ্পে পরিণত হয়েছে ॥ ৪৭ ॥
চারুদত্ত— বয়স্য! বাঁদীরবেটা বর্ষাকাল, তুই অত্যন্ত অনার্য বলে প্রতিপন্ন হলি। কারণ শ্রীমতীকে বিদ্যুৎস্ফুরণে ভয় দেখাচ্ছিস।
চারুদত্ত— ভর্ৎসনা করা অন্যায় হবে তোমার। অবিরত বর্ষণ দিয়ে এই দুর্যোগ শতবর্ষ বিরাজিত থাকুক। বিদ্যুৎও স্ফুরিত হতে থাকুক। যেহেতু আমাদের মতো লোকের কাছে দুর্লভ এই প্রিয়া আমাকে আলিঙ্গন করছে ॥ ৪৮ ॥
তাছাড়া, বয়স্য—
তাদের জীবনই ধন্য গৃহে আগত কামিনীদের বৃষ্টিশীতল আর্দ্রদেহে যাদের দেহ আলিঙ্গিত হয় ॥ ৪৯ ॥
প্রিয়া বসন্তসেনা!
এই চন্দ্রাতপটি ছিন্ন হওয়ায় স্তম্ভগুলো তা কোনো রকমে ধরে রেখেছে। কারণ পাদপীঠের প্রান্তগুলো শিথিল হয়ে পড়েছে। আর এই চিত্রিত দেয়ালটি রঙের প্রলেপ ফেটে ফেটে যাওয়ায় বৃষ্টিধারায় একেবারে ভিজে উঠেছে ॥ ৫০ ॥
(উঁচুদিকে তাকিয়ে) এ কী, ইন্দ্ৰধনু উঠেছে দেখছি! প্রিয়ে দেখো দেখো— আকাশ যেন হাই তুলেছে। বিদ্যুৎ যেন তার জিভ। বাহু যেন ওই ইন্দ্রধনু[১০], প্রশান্ত চিবুক যেন ওই মেঘরাশি ॥ ৫১ ॥
তাই এসো, এবারে ভিতরে যাই।
(উঠে পরিক্রমা করল)
বৃষ্টিধারা তালপাতায় পড়ছে তীব্রভাবে, শাখায় পড়ছে মন্ত্রভাবে, শিলায় পড়ছে রুক্ষভাবে, আর জলে পড়ছে প্রচণ্ডভাবে। তালের সঙ্গে বাদিত সংগীতবীণার মতোই যেন সেই বৃষ্টিধারার ধ্বনি ॥ ৫২ ॥
॥ ‘দুর্দিন’ নামে পঞ্চম অঙ্ক সমাপ্ত ॥
—
টীকা
১. তুলনীয় :
তচ্ছ্রত্বা তে শ্রবণসুভগং গর্জিতং মানসোৎকাঃ।
সম্পৎস্যন্তে নভসি ভবতো রাজহংসাঃ সহায়াঃ ॥—মেঘদূত ১.১১
‘হংস’ শব্দটির সম্বন্ধে টীকায় Wilson বলেছেন :
‘The wild grey goose, which bird is supposed to migrate annually to the Himalaya Mountains, particularly to the Manasa Lake, whence it is termed Manasaukas, ‘the dweller of Manasa.’
মি. মুরক্র্যাফটের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন :
‘Mr. Moorcroft in his adventurous visit to the lake in 1812, found the birds in vast flocks along the beach and on the water, and concluded from what he saw, that they were accustomed to frequent the lake and breed in the swell of the rivers of Hindusthan and the inundation of the plains conceal their usual food.’ তুলনীয় :
২. তুলনীয় :
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যনথাবৃত্তি চেতঃ।
কণ্ঠাশ্লেষপ্রণয়িনিজনে কিং পুনদূরসংস্থে ॥ –মেঘদূত ১.৩
৩. মেঘ যেন দ্বিতীয় বিষ্ণু। পৌরাণিক আখ্যানটির ইঙ্গিতও আছে এই উপমায়। বামনরূপী বিষ্ণু বলির দর্প খর্ব করার জন্যে ত্রিপাদভূমি চেয়েছিলেন। বলি তাঁর প্রার্থনা পূরণে সম্মত হলে বিষ্ণু বিরাটদেহ ধারণ করে একটি পদক্ষেপে পৃথিবী এবং আর- একটিতে আকাশকে আবৃত করেছিলেন, আর-একটি পদক্ষেপ বলির মাথায় রেখে তাঁকে পাতালে পাঠিয়েছিলেন।
৪. সদ্য প্রেমরোগে যিনি রঞ্জিত তাঁর এই উপযুক্ত কথাই বটে। ‘তপস্বী’ কথাটা এখানে ‘নির্দোষ’ অর্থে প্রযুক্ত।
৫. কারণ তাঁর অসাধারণ রূপ তাদের স্বামীদের ঘরছাড়া করতে পারে।
৬. এ কথাটা স্ত্রীলোকের মুখে মানায় কি? বিট বললেই তো ভালো শোনাত।
৭. ‘প্রাবৃট্’– এই পাদটি যেন যকের ধ্বনিরই অনুকারী।
৮. বাক্যটি প্রবাদবাক্যে পর্যবসিত।
তুলনীয় :
ক্ষতে ক্ষারমিবাসহ্যং জাতং তস্যৈব দর্শনম্।— উত্তররামচরিতম্ ৪.৭
৯. তুলনীয় :
তৎসম্পর্কাৎপুলকি, কমিব প্রৌঢ়পুষ্পৈঃ কদস্বৈঃ।— মেঘদূত ৬.২৫
১০. হাই তোলার সময় লোকে অনেক সময় হাতও তোলে। তাই রামধনুকে আকাশের হাত হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন