জ্যোতিভূষণ চাকী
মৃচ্ছকটিক – ষষ্ঠ অঙ্ক
চেটী— এ কী, এখনও তো আর্যা জাগলেন না। যাই, ভিতরে গিয়ে জাগাই।
(পরিক্রমার অভিনয় করল)
[ তারপর আবৃতাদেহা প্রসুপ্তা বসন্তসেনার প্রবেশ ]
(দেখে)— উঠুন দেবী! ভোর হয়েছে।
বসন্তসেনা— (জেগে উঠে) সে কী, রাত থাকতে ভোর হবে কেমন করে?
চেটী— আমাদের কাছে এ ভোর, আপনার কাছে এখনও রাতই।
বসন্তসেনা— চেটী! তোমাদের সেই দ্যুতকর কোথায়?১
চেটী— দেবী! বর্ধমানককে আদেশ দিয়ে আর্য চারুদত্ত পুরনো বাগান পুষ্পকরণ্ডকেই গিয়েছেন।
বসন্তসেনা— তিনি কী আদেশ দিয়ে গেছেন?
চেটী― রাতেই গাড়ি ঠিক করে রাখো, বসন্তসেনা যেন চলে যান।
বসন্তসেনা— ওলো, আমাকে কোথায় যেতে হবে?
চেটী— দেবী! যেখানে চারুদত্ত গেছেন, সেখানে।
বসন্তসেনা— (চেটীকে আলিঙ্গন করে) ওলো, রাতে তাকে ঠিক দেখতে পাইনি। আজ দুচোখ ভরে দেখব। ওলো, আমি কি ভিতরের চতুঃশালায় প্রবেশ করেছি?
চেটী— শুধু ভিতরের চতুঃশালায় নয়, আপনি সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করেছেন।
বসন্তসেনা— চারুদত্তের পরিজনেরা কি দুঃখিত হয়েছেন?
চেটী— দুঃখিত হবেন
বসন্তসেনা— কখন?
চেটী— যখন আপনি চলে যাবেন।
বসন্তসেনা— তখন তো সবার আগে আমার দুঃখ হবে।
(সানুনয়ে) ওলো! আমার এই রত্নহারটা নে। গিয়ে আমার বোন আর্যা ধৃতাকে দিবি। ববি আমি যখন গুণের মূল্যে কেনা চারুদত্তের দাসী, তখন আপনারও দাসী। তাই এই রত্নহার আপনারই কণ্ঠে শোভা পায়।
চেটী― দেবী! তাহলে চারুদত্ত তাঁর ওপর রাগ করবেন।
বসন্তসেনা— যা, রাগবেন না।
চেটী― (নিয়ে) আপনার যা আদেশ।
(এই বলে চেটীর নিষ্ক্রমণ ও পুনঃপ্রবেশ) দেবী! আর্যা বললেন— আমার স্বামী প্রসন্ন হয়ে এটা আপনাকে দিয়েছেন, এটা আমার নেওয়া ঠিক নয়। আর্যা জানুন, আমার স্বামীই আমার বিশেষ অলঙ্কার[৩]!
(তারপর চারুদত্তের ছেলেকে নিয়ে রদনিকার প্রবেশ
রদনিকা— আয় বাছা! গাড়িটা নিয়ে খেলি আমরা।
ছেলেটি— (কাঁদোকাঁদো হয়ে) রদনিকা! এই মাটির গাড়ি দিয়ে কী করব আমি? আমাকে সোনার গাড়িটা দাও।
রদনিকা— (সবিষাদে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে) এখন আমরা সোনাদানা কোথায় পাব, বাছা! বাবার অবস্থা ফিরুক, তারপর সোনার গাড়ি নিয়ে খেবি।—
ওকে একটু ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখি। বরং আমি বসন্তসেনার কাছে যাই।
(কাছে গিয়ে) দেবী! প্ৰণাম।
বসন্তসেনা— এসো এসো, রদনিকা! তা ছেলেটি কার? গায়ে গয়নাগাটি কিছু না থাকলেও ওর চাঁদমুখ আমাকে আনন্দ দিচ্ছে।
রদনিকা— এটি হল আর্য চারুদত্তের ছেলে, নাম রোহসেন।
বসন্তসেনা— আয় বাছা, আমাকে আলিঙ্গন কর। (কোলে বসিয়ে) ওর বাবার রূপেরই প্রতিচ্ছবি।
রদনিকা— শুধু রূপে নয়, আমার মনে হয় চরিত্রেও। আর্য চারুদত্ত ওকে নিয়েই নিজেকে মাতিয়ে রাখেন।
বসন্তসেনা— কিন্তু ও কাঁদছে কেন?
রদনিকা— ও প্রতিবেশী এক গৃহস্থের ছেলের ছোট্ট একটা সোনার গাড়ি নিয়ে খেলছিল। সে তা নিয়ে গেছে। তারপর আবার ঐটে চাওয়ায় আমি একটা মাটির গাড়ি গড়ে ওকে দিয়েছি। কিন্তু ও বলছে, ‘রদনিকা, এই মাটির গাড়ি দিয়ে আমি কী করব? আমাকে ওই সোনার গাড়িটা দাও।’
বসন্তসেনা— হায় হায়! একেও কিনা অন্যের জিনিসের জন্যে মন খারাপ করতে হচ্ছে! ভাগ্যের দেবতা! পদ্মপাতায় পড়া জলবিন্দুর মতো মানুষের ভাগ্য নিয়ে তুমি খেলছ! (সাশ্রুনেত্রে) বাছা, কেঁদো না, সোনার গাড়ি নিয়েই তুমি খেলবে।
ছেলেটি— ও কে, রদনিকা?
বসন্তসেনা— তোমার বাবার গুণের মূল্যে কেনা দাসী।
রদনিকা— ইনি তোমার মা হন।
ছেলেটি— রদনিকা, তুমি মিথ্যে কথা বলছ। ও যদি আমার মা হয় তাহলে গয়না-পরা কেন?
বসন্তসেনা— বাছা, সরলমুখে তুমি অতি করুণ কথা বলেছ। (আভরণ উন্মোচনের অভিনয় করে রোদন) এই আমি তোমার মা হলাম। এই গয়নাগুলো তুমি নাও। সোনার গাড়ি গড়িয়ে নাও।[৫]
ছেলেটি— তুমি যাও! আমি নেব না। তুমি কাঁদছ।
বসন্তসেনা— (চোখ মুছে) বাছা, আর কাঁদব না। যাও, খেলা করো। (অলঙ্কারে মাটির গাড়িটা ভরে দিয়ে) বাছা সোনার গাড়ি গড়িয়ে নিও।
(ছেলেকে নিয়ে রদনিকার প্রস্থান)
(শকটারোহণে প্রবেশ করে)
চেট— রদনিকা! রদনিকা! আর্যা বসন্তসেনাকে বলো— পাশের দুয়ারে ঢাকা-গাড়ি প্ৰস্তুত।
(প্রবেশ করে )
রদনিকা— দেবী! বর্ধমানক জানাচ্ছে পাশের দুয়ারে গাড়ি প্রস্তুত।
বসন্তসেনা– ওলো, একটু দাঁড়া, আমি প্রসাধনটা সেরে নিই।
রদনিকা— (প্রস্থান করে) বর্ধমানক, একটু অপেক্ষা করো। আর্যা প্রসাধনটা সেরে নিন।
চেট— আরে! এ কী! আমি দেখছি গাড়ির গদিটা নিতেই ভুলে গিয়েছি। যাই নিয়ে আসি গিয়ে। নাকে-দড়ি বলদগুলো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তাই, গাড়ি নিয়েই বরং যাই।
(চেটের প্রস্থান)
বসন্তসেনা— ওলো, আমার প্রসাধনের জিনিসগুলো এনে দে তো। প্রসাধনটা সেরে নিই।
(শকটারোহণে প্রবেশ)
চেট— স্থাবরক, রাজার শ্যালক সংস্থানক আমাকে আদেশ করেছেন— ‘স্থাবরক, গাড়িটা নিয়ে পুরনো বাগান পুষ্পকরণ্ডকে শিগগিরই এস।’ যাই, সেখানেই যাই— জদি ছোট্, বলদজোড়া, জদি ছোট্। (পরিক্রমা করে, দেখে) গ্রামের গাড়িগুলোতে পথটা আটকে আছে দেখছি। কী করি এখন? (উদ্ধতভাবে) সরে যাও, সরে যাও! (শুনে) কী বলছ? কার গাড়ি এটা! গাড়িটা রাজার শ্যালক সংস্থানকের। শিগগিরই সরে যাও। (দেখে) ব্যাপার কী! কে একজন সভয়ে আমাকে দেখে হঠাৎ জুয়ার-সর্দারের কাছ থেকে পালানো জুয়াড়ির মতো নিজেকে হঠাৎ আড়াল করে অন্যদিকে পালিয়ে গেল। কে লোকটা? যাক্ তা দিয়ে আমার দরকারটা কী? তাড়াতাড়ি যাব। গাঁয়ের লোকেরা, সরে যাও, সরে যাও! কী বলছ?— ‘একটু দাঁড়াও, চাকাটা একটু ঠেলে দাও?’ সাহস তো কম নয়? আমি হলাম গিয়ে রাজার শ্যালকের বীর ভৃত্য সংস্থানক, আর আমি কিনা তোর চাকা ঠেলব? অবশ্য, বেচারা একা! ঠিক আছে। এই করি তা হলে। গাড়িটাকে আর্য চারু দত্তের বাগানবাড়ির পাশদুয়ারে রাখি। (গাড়ি রেখে) এই আমি এসেছি।
(প্রস্থান)
চেটী— দেবী! গাড়ির চাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। গাড়িটা এসেই পড়েছে তা হলে।
বসন্তসেনা— ওলো, যা। মনটা চঞ্চল আমার, পাশদুয়োরটা কোন দিকে বল্!
চেটী– এদিকে আসুন, দেবী! এদিকে আসুন।
বসন্তসেনা— (পরিক্রমা করে) এবারে তুই বিশ্রাম কর্ গিয়ে।
চেটী— আপনি যা বলেন।
(প্রস্থান)
বসন্তসেনা— (ডান চোখ নাচছে তাই দেখিয়ে এবং গাড়িতে উঠে) এ কী! আমার ডানচোখ নাচছে কেন? চারুদত্তের দর্শনই অবশ্য অমঙ্গল দূর করবে।
(প্রবেশ করে)
চেট স্থাবরক— (পথ-আটকে থাকা) গাড়িগুলোকে কাটিয়েছি! এবারে এগিয়ে যাব। (আরোহণ ও চালনার অভিনয় করে) গাড়িটা ভারি মনে হচ্ছে যে! বোধহয় চাকা ঠেলার ধকলের জন্যেই এমন ভারি বলে মনে হচ্ছে। যা হোক, এগিয়ে যাই। চল্ বলদজোড়া, চল্।
(নেপথ্যে)
দ্বাররক্ষীরা! ওহে, যে যার চৌকিতে হুঁশিয়ার হও। এই গোয়ালার ছেলে (আর্যক) কারাগার ভেঙে প্রহরীকে হত্যা করে শিকল ছিঁড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তাকে ধরো, তাকে ধরো!
(তারপর পর্দা নাড়িয়ে একপায়ে শিকল জড়ানো অবগুণ্ঠিত চঞ্চল আর্যকের প্রবেশ ও পরিক্রমা)
চেট— (স্বগত) নগরীতে ‘বিরাট চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে, তাই শিগগির শিগগির যেতে হবে।
(প্রস্থান)
আর্যক— রাজার অবরোধরূপ বিপদ-মহাসমুদ্র পার হয়ে পায়ের প্রান্তে একমাত্র শৃঙ্খলপাশ বয়ে বন্ধনভ্রষ্ট হাতির মতো বিচরণ করছি আমি ॥ ১ ।।
সিদ্ধপুরুষের ভবিষ্যদ্বাণীতে ভয় পেয়ে রাজা পালক আমাকে ঘোষপল্লি থেকে ছিনিয়ে এনে মারাত্মক গুপ্তকারাগারে শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছিলেন। সেখান থেকে প্রিয় সুহৃদ্ শর্বিলকের অনুগ্রহে বন্ধনদশা থেকে মুক্ত হয়েছি আমি। (চোখের জল ফেলে) যদি আমার সে ভাগ্যই থাকে তাহলে আমার কী দোষ যে তিনি আমাকে বুনো হাতির মতো বেঁধে রাখবেন?
তাছাড়া, দৈবসিদ্ধিকে কেউ লঙ্ঘনও করতে পারে না। রাজা সকলেরই সেব্য। বলবানের সঙ্গে বিরোধের অবকাশই-বা কোথায়? ॥ ২ ॥
কিন্তু এখন হতভাগ্য আমি যাব কোথায়? (দেখে) এটা কোনো সজ্জনের বাড়ি। পাশের দুয়ারটি অবারিত দেখছি।
বাড়িটার ভগ্নদশা। ওর বিরাট কপাটটিতে আগল নেই, জোড়াগুলোয় চিড় ধরেছে। আমারই মতো দুর্ভাগা গৃহস্বামীটি নিশ্চয়ই দুর্দশার কবলে পড়েছেন। এখানে প্রবেশ করে থেকে যাই।
(নেপথ্যে)
চল্ চল্, বলদজোড়া, চল্।
আর্যক— (শুনে) একটা গাড়ি এগিয়েই আসছে দেখছি।
এটা কি কোনো উৎসবগামী গাড়ি? কোনো বাজে লোক হয়তো যাচ্ছে না এতে। না কি কোনো কনের গাড়ি? তাকে নিয়ে যাবার জন্যেই এসেছে হয়তো। নাকি ভাগ্যক্রমে এটা বাহিরে নিয়ে যাবার জন্যে কোনো বড় মানুষের চড়বার মতো গাড়ি? সঙ্গে লোকজন কেউ নেই বলে মনে হচ্ছে। গাড়িটা ফাঁকা, আমার অনুকূলে দৈবই হয়তো পাঠিয়েছে গাড়িটা।
(তারপর গাড়ির সঙ্গে প্রবেশ করে)
চেট বর্ধমানক— চমৎকার। আমি গাড়ির গদিটা নিয়ে এসেছি।
রদনিকা! আর্যা বসন্তসেনাকে বলো— তৈরি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আপনি আরোহণ করে পুরনো বাগান পুষ্পকরণ্ডকে আসুন।
আর্যক— (শুনে) বারবনিতার গাড়ি এটা। (নগরীর) বাইরে যাবার গাড়িও বটে। যাক চড়ে বসি।
(এই বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল)
চেট— (শুনে) হ্যাঁ, নূপুরের শব্দ। আর্যাই নিশ্চয়ই এসে পড়েছেন তাহলে। নাকে দড়ি থাকায় অসহিষ্ণু হয়েছে বলদ দুটি।[৬] পিছন দিয়েই উঠুন আপনি।
(আর্যক তাই করল)
চেট— পদচালনায় মুখর নূপুর শান্ত হয়েছে। গাড়িটা ভারি হয়েছে। মনে হয় এখন আর্যা উঠে বসেছেন। এবারে যাই। চল্ রে, বলদদুটি, চল্। (পরিক্রমা)
(প্রবেশ করে )
বীরক— ওহে, জয়, জয়মান চন্দনক, মঙ্গল, পুষ্পভদ্র এবং আর সবাই! তোমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াচ্ছ কেন? সেই গোয়ালার ছেলে যে কারাগারে আটক ছিল সে, রাজার হৃদয় এবং শৃঙ্খল দুটোই একসঙ্গে ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ॥ ৫ এই যে, তুমি এই মধ্যপথের পুব দুয়ারে থাকো। তুমি থাকো পশ্চিমের দুয়ারে আর তুমি থাকো দক্ষিণে, আর তুমি উত্তরে। আর এই যে প্রাকারখণ্ড, আমি তারই উপর উঠে চন্দনকের সঙ্গে চারদিক দেখছি। এসো চন্দনক, এসো। এইদিকে।
(উত্তেজিতভাবে প্রবেশ করে)
চন্দনক— ওহে বীরক, বিশল্য, ভীম, অঙ্গদ, দত্তকালক, দণ্ডশূর এবং আর সবাই— খুব বিশ্বস্ত হয়ে আয়, একটুও দেরি না, তাড়াতাড়ি চেষ্টা কর্ রাজলক্ষ্মী যাতে অন্য বংশে না যেতে পারে।। ৬ ।।
তাছাড়া- বাগানে, জুয়ার আড্ডায়, পথেঘাটে, নগরে, বাজারে, গোয়ালাদের বস্তিতে, যার ওপরে তোমাদের সন্দেহ হবে তাকেই পরীক্ষা করে দেখবে ॥৭॥
বীরক, আমাকে কোন দিকে লক্ষ রাখতে বলো, গোপনে বলো তো। কে এই বাঁধন ছিঁড়ে ঘোষেদের ব্যাটাকে নিয়ে পালালো? ॥ ৮ ॥
কার অষ্টম স্থানে রবি, কার চতুর্থ স্থানে চন্দ্র, কার ষষ্ঠ স্থানে শুক্রগ্রহ, আর কারই-বা পঞ্চম স্থানে মঙ্গলগ্রহ? ॥ ৯ ॥
বলো বৃহস্পতি কার জন্মরাশিতে ষষ্ঠ স্থানে আর শনি আছে নবম স্থানে। চন্দনক জীবিত থাকতে সে কে যে সেই গোয়ালার ব্যাটাকে হরণ করল? ॥১০॥
বীরক— ভট চন্দনক!
আমি তোমার হৃদয়ের নামে দিব্যি করে বলছি চন্দনক, কেউ নিশ্চয় সেই ঘোষের পো-কে নিয়ে পালিয়েছে। কারণ, সূর্য যখন অর্থোদিত ঠিক সেই সময়েই তাকে বন্ধনমুক্ত করা হয়েছে ॥ ১১ ॥
চেট— চল্, বলদজোড়া, চল্।
চন্দনক— (দেখে) দেখো দেখো! একটা গাড়ি রাজপথের মাঝখান দিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখো, কার গাড়ি, কোথায় পাঠানো হচ্ছে।
বীরক— (দেখে) গাড়োয়ান। গাড়িটা থামাও। কার গাড়ি, কে আছে ভিতরে? কোথায় যাচ্ছে সে।
চেট— এ গাড়ি আর্য চারুদত্তের। এতে আছেন বসন্তসেনা। চারুদত্তের সঙ্গে বিহারের জন্যে তাকে পুরনো বাগান পুষ্পকরওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বীরক— (চন্দনকের কাছে এসে) গাড়োয়ান বলছে আর্য চারুদত্তের গাড়ি। এতে রয়েছেন বসন্তসেনা। পুরনো বাগান পুষ্পকরওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
চন্দনক—— যাক তাহলে।
বীরক— না দেখেই ছাড়ব?
চন্দনক— হ্যাঁ।
বীরক— কার সুবাদে?
চন্দনক— আর্য চারুদত্তের সুবাদে।
বীরক— কে আর্য চারুদত্ত, বসন্তসেনাই-বা কে, যে না দেখেই ছাড়া হবে?
চন্দনক— সে কী! আর্য চারুদত্তকেও জানো না, বসন্তসেনাকেও? যদি আর্য চারুদত্তকে বা বসন্তসেনাকে না জানো তাহলে আকাশে জ্যোৎস্নামণ্ডিত চাঁদকেও জানো না!
গুণে যিনি পদ্মের মতো, শীলে যিনি চন্দ্রের মতো, যিনি দুঃখীদের মোক্ষস্বরূপ চারটি সমুদ্রের যিনি সারভূত রত্ন তাঁকে কে চেনে না? ॥ ১৩ ॥
এই নগরীর অলঙ্কারস্বরূপ দুটি শ্রদ্ধেয় মানুষ আছে— একজন বসন্তসেনা, আর একজন ধর্মনিধি চারুদত্ত ॥ ১৪॥
বীরক— চারুদত্তকে জানি, বসন্তসেনাকেও ভালোভাবে জানি, কিন্তু রাজকার্যের ব্যাপারে আমি নিজের পিতাকেও জানি না ॥ ১৫।
আর্যক— (স্বগত)— এ আমার পূর্বশত্রু, আর এ আমার পূর্ববন্ধু। কারণ—
এক কাজে নিযুক্ত হলেও এঁদের চরিত্রে মিল নেই, বিবাহে এবং চিতায় যেমন দুই অগ্নির মিল নেই ॥ ১৬ ॥
চন্দনক— আমি দেখলেই কি সেটা তোমার দেখা হবে না?
বীরক— যা তুমি দেখেছ তা স্বয়ং রাজা পালকও দেখেছেন একথা বলা চলে।
চন্দনক— ওহে জাঙাল ওঠাও ।
(চেট তাহাই করিল)
আর্যক— (স্বগত) রক্ষীরা দেখে ফেলবে না তো? খুবই দুর্ভাগ্য আমার তাই আমি নিরস্ত্র। অথবা—
আমি ভীমের অনুকরণ করব। আমার বাহুই হবে আমার অস্ত্র! বন্দি হয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ হবার চেয়ে যুদ্ধ করে মরাও ভালো ॥ ১৭ ॥
অথবা, হঠকারিতারও এটা সময় নয়।
(চন্দনকের যানারোহণ এবং পরিক্রমণের অভিনয়)
আমি শরণাগত।
চন্দনক— (সংস্কৃত আশ্রয় করে) শরণাগতের কোনো ভয় নেই।
আর্যক— যে শরণাগতকে ত্যাগ করে জয়শ্রী তাকে ত্যাগ করে, মিত্র স্বজনেরাও তাকে ত্যাগ করে। সে সর্বদা উপহাসের পাত্র হয়ে থাকে ॥ ১৮ ॥
চন্দনক— সে কী? ঘোষনন্দন আর্যক শ্যেনের ভয়ে ভীত পাখির মতো ব্যাধের হাতে পড়েছে। (চিন্তা করে) আর্য চারুদত্তের শকটে আছে নিরপরাধ শরণার্থী এই মানুষটি আমার প্রাণদাতা আর্য শর্বিলকের বন্ধু। অন্যদিকে রাজকর্তব্য! এখন এখানে কী করা উচিত? অথবা যা হবার হোক। প্রথমেই অভয় দিয়েছি। ভীতকে যে অভয় দেয় সেই পরোপকার-রসিকের যদি বিনাশও হয় হোক, সংসারে তা গুণই। (সভয়ে নেমে) আমি তাকে দেখেছি (অর্ধোক্ত রেখেই)— এবং তিনি বললেন, ‘আমি যে আর্য চারুদত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে রাজপথে অবমানিত হলাম, এটা কি ঠিক হল, এটা কি যুক্তিযুক্ত হল?
বীরক— চন্দনক, এখানে আমার সংশয়ের উদ্রেক হচ্ছে।
চন্দনক— তোমার সংশয়ের কারণ কী?
বীরক— ‘আমি আর্যকে দেখেছি’ এবং ঠিক তার পর-পরই ‘আর্যা বসন্তসেনা’– একথা বলবার সময় তোমার কণ্ঠ উত্তেজনায় ভাঙা-ভাঙা শোনালো— এখানেই আমার অবিশ্বাস।
চন্দনক— ওহে, এখানে তোমার বিশ্বাসের কী আছে? আমরা দক্ষিণদেশের অধিবাসী বলে অস্ফুটভাষী। খশ, খত্তি খড়, গড়ঠ, বিড, কণাট, কর্ণ, প্রাবরণ, দ্রাবিড়, চোল, চীন, বর্বর, খের, খান, মুখ, মধুঘাত প্রভৃতি ম্লেচ্ছ জাতিদের অনেক দেশের ভাষায় অভিজ্ঞ বলে আমরা যথেচ্ছভাবে বলি ‘দৃষ্ট’ বা দৃষ্টা’। ‘আর্য’ বা ‘আর্যা’।
বীরক— তা হোক, আমিও দেখব। এটা রাজার আদেশ। আমি রাজার বিশ্বস্ত
(অনুচর)।
চন্দনক— তাহলে আমি কি অবিশ্বস্ত হয়ে গেলাম?
বীরক— তবু, রাজাদেশ তো।
চন্দনক— (স্বগত) আর্য গোপালনন্দন আর্য চারুদত্তের গাড়িতে চড়ে পালাচ্ছে যদি একথা বলি তাহলে আর্য চারুদত্তকে শাস্তি দেবেন রাজা। তাই তো, কী করি এখন? (চিন্তা করে) কর্ণাটকেরা যেভাবে কলহ করে সেইভাবে কলহ শুরু করি। (প্রকাশ্যে) ওহে বীরক, আমি চন্দনক যা দেখেছি তুমি আবার তা দেখবে? তুমি কে?
বীরক— তুমিই-বা কে?
চন্দনক— পূজ্যমান এবং মান্যমান তুমি তোমার বংশকে স্মরণ করছ না।
বীরক— (সক্রোধে) বলো তো আমার কী বংশ
চন্দনক— কে বলতে পারে?
বীরক— বলো।
চন্দনক— না আমি বলব না। সৌজন্যের খাতিরে তোমার বংশ কী তা জেনেও বলব না। তা আমার মনেই থাকুক। কৎবেল ভেঙে আর কী হবে?
বীরক— না, বলো।
(চন্দনক আকারে-ইঙ্গিতে কী যেন বলল।)
বীরক— এর মানে কী?
চন্দনক— (এ সময়) তোমার হাতে থাকত একটা ভাঙা (শাণ) পাথরের টুকরো যা পুরুষের দাড়ি কামাতে লাগত, আর তোমার ব্যস্ত হাতে থাকত একটি কাঁচি। সেই তুমি আজ সেনাপতি হয়েছ! ॥ ১২ ॥
বীরক— ওহে চন্দনক, মান্যমান তুমিও নিজের জাতটিকে ভুলে যাচ্ছ।
চন্দনক— ওহে, চাঁদের মতো শুদ্ধ এই চন্দনকের জাতটি কী শুনি?
বীরক— কে জানে?
চন্দনক— বলো বলো।
(বীরক অভিনয় করে ইঙ্গিতে দেখাল)
চন্দনক— এর মানে কী?
বীরক— শোনো, শোনো, খুব বিশুদ্ধ তোমার জাত। মা হল ভেরী, বাবা হল ঢাক, করটক হল ভাই। ওহে দুর্মুখ, তুমিই কিনা সেনাপতি হলে! ॥ ১৩ ॥
চন্দনক— (সক্রোধে) আমি চন্দনক হলাম চর্মকার। তা হলে গাড়িটা দেখো এবারে।
বীরক— গাড়োয়ান, গাড়ি ঘোরাও, আমি দেখব।
(চেট তাই করল। বীরক গাড়িতে উঠতে চাইল। চন্দনক হঠাৎ চুল ধরে তাকে মাটিতে ফেলে পদাঘাত করল)
বীরক— (সক্রোধে উঠে) (রাজার) বিশ্বস্ত (কর্মী) আমি যখন রাজার হুকুম তামিল করছি সেই সময়ে তুই হঠাৎ আমার চুল ধরে আমাকে পদাঘাত করলি! শোন্ তা হলে। আমি যদি তোকে বিচারালয়ে দণ্ড না দেওয়াই তা হলে আমি বীরক নই।
চন্দনক— ওরে, রাজকুলে যা বা আদালতে যা, তোর মতো কুকুরকে দিয়ে কী হবে?
বীরক— বেশ, দেখা যাবে!
(প্রস্থান)
চন্দনক— (চারদিক দেখে) গাড়োয়ান, যাও। যদি কেউ জিগ্যেস করে তাহলে বোলো চন্দনক আর বীরকের দেখা গাড়ি যাচ্ছে।
মাননীয় বসন্তসেনা, এই অভিজ্ঞান আপনাকে দিলাম। (এই বলে খড়গ দিল)
আর্যক— (খড়গ নিয়ে সহর্ষে, মনে মনে) ওহো! আমি অস্ত্র পেয়েছি। আমার ডান হাত স্পন্দিত হচ্ছে। সবকিছুই আমার অনুকূলে হতে চলেছে। আমি বেঁচে গেলাম তবে ॥ ২৪ ॥
চন্দনক— আর্যে, আশা করি চন্দনককে আপনার মনে থাকবে, কারণ আমি আপনাকে যা বলেছি তা সত্য বলে প্রমাণও করেছি। আমি একথা কোনো লোভ নিয়ে বলছি না, বলছি প্রীতিরসে পূর্ণ হয়ে।
আর্যক— ভাগ্যক্রমে চাঁদের মতো চরিত্রের মহান চন্দনক আজ আমার বন্ধু হল। হ্যাঁ, যদি সিদ্ধাদেশ সত্যি হয় আমি চন্দনককে ভুলব না।
চন্দনক— শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, রবি ও চন্দ্র শত্রুপক্ষকে বধ করে তোমাকে অভয় দিন, দেবী পার্বতী শুম্ভনিশুম্ভ বধ করে দেবতাদের যেমন অভয় দিয়েছিলেন তেমনি।
(চেট গাড়ি নিয়ে চলে গেল)
চন্দনক— (নেপথ্যের দিকে তাকিয়ে) ওহো! সে চলে যাওয়ার পর পরই আমার প্রিয় বন্ধুও ঠিক তার পিছনে পিছনে সংলগ্ন হয়েই গেলেন।
প্রধান দণ্ডধারক এবং রাজার বিশ্বাসের পাত্র বীবককে আমি শত্রু করেছি। তাই আমিও ছেলেদের এবং ভাইদের নিয়ে তাকেই (শর্বিলককে) অনুসরণ করি।
॥ প্রহরণ-বিপর্যয় নামে ষষ্ঠ অঙ্ক সমাপ্ত ।।
—
টীকা
১. ঘটনাটা ব্যাখ্যাত হয়ে যাবার পরও বসন্তসেনা চারুদত্তকে ‘তোমাদের সেই দ্যূতকর’ বলে উল্লেখ করছেন কারণ ওই ঘটনার সঙ্গে মধুর স্মৃতি জড়িত।
২. ‘করণ্ডক’ মানে ঝাঁপি বা সাজি। ‘পুষ্পকরণ্ডক’-এর আক্ষরিক অর্থ ফুলের সাজি। বাগানটিতে প্রচুর ফুলের গাছ ছিল বলেই সম্ভবত ওই নাম।
৩. চারুদত্তের যোগ্য সহধর্মিণীই বটে। ধূতার মুখে যে বাণী উচ্চারিত হল তা যেন ভারতের হৃদয়-নিঃসৃত।
মনে পড়ে যাবে—
সীতা কহিলেন মাতা, সম্পদে কি কাম।
সকল সম্পদ মম দূর্বাদলশ্যাম ॥ (কৃত্তিবাসী রামায়ণ)
৪,৫. শিশুটির মায়ের গায়ে তো গয়না নেই, তিনি যে নিরাভরণা। তাই অত গয়না যার গায়ে তিনি কী করে মা হবেন? কবি কৌশলে যেমন চারুদত্তের সাম্প্রতিক দুর্দশার ইঙ্গিত দিলেন, তেমনি শিশুর একটি কথাতেই বসন্তসেনার মাতৃত্ব হল উদ্বোধিত। খুব স্বাভাবিক কারণেই তিনি গয়না খুলে বলতে পারলেন— ‘এ গয়নাগুলো তুমি নাও, সোনার গাড়ি বানিয়ে নাও।’ নাটকটির মৃচ্ছকটিক নামের উৎসও এই আশ্চর্য-মধুর মুহূর্তটি।
৬. নাকে দড়ি থাকায় তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে তাই এখানে গাড়িটা না রেখে যাওয়াই ভালো। তাই চেট গাড়ি নিয়েই আচ্ছাদন আনতে গেল। প্রবহণ-বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও সুকৌশলে করলেন কবি।
৭. শুম্ভ-নিশুম্ভ ছিল দুই দৈত্যভ্রাতা। সুদীর্ঘকাল তপস্যা করে তারা শিবকে সন্তুষ্ট করে এমন বর পেল যে শক্তি ও সম্পদে দেবতাদেরও ছাড়িয়ে গেল। তারা দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁদের বিব্রত করে তুলল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পরামর্শে দেবতারা দুর্গার শরণাপন্ন হলেন। দুর্গা তাদের দুজনকে এবং তাদের সেনাধ্যক্ষ চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন