মৃচ্ছকটিক – নবম অঙ্ক

জ্যোতিভূষণ চাকী

মৃচ্ছকটিক – নবম অঙ্ক 

(তারপর শোধনকের প্রবেশ) 

ন্যায়ালয়ের কর্মকর্তারা আমাকে আদেশ দিয়েছেন- শোনক, বিচারমণ্ডপে গিয়ে আসনগুলো সাজাও। তাই এখন গিয়ে বিচারমণ্ডপটা সাজিয়ে ফেলি (পরিক্রমা করে এবং দেখে) 

এই যে বিচারমণ্ডপ। প্রবেশ করি তাহলে। বিচারমণ্ডপটি একেবারে নির্জন করিয়ে নিয়েছি। আসনও সাজিয়েছি। যাই এখন বিচারকদের খবর দিই গে। (পরিক্রমা করে) এ কী! রাজশ্যালক মানে, সেই দুষ্ট এবং দুশ্চরিত্র লোকটা এদিকেই আসছে। তার দৃষ্টিপথ এড়িয়ে যাই। (একান্তে দাঁড়িয়ে রইল) 

(তারপর উজ্জ্বলবেশধারী শকারের প্রবেশ) 

আমি সলিল, জল এবং পানীয়ে[১] স্নান ক’রে যুবতী স্ত্রী ও নারীদের সঙ্গে গন্ধর্বের মতো সুসজ্জিত অঙ্গে উপবন কাননে বসে এলাম[২] ॥ ১ ॥ 

এই আমি চুলে গিঁট দিলাম, এই ঝুঁটি করে বাঁধলাম। এই তা লম্বা, এই কোঁকড়ানো, এই খুলে দিলাম, এই তা চুড়োয় জড়ালাম। আমি হলাম গিয়ে চিত্রবিচিত্র রাজার-শালা[৩]! ॥ ২ ॥ 

তা ছাড়া, বিষগ্রন্থিতে ঢুকে পড়া পোকার মতো পথ খুঁজতে খুঁজতে একটা প্রশস্ত পথ পেয়ে গেলাম। এই কুকীর্তিটা চাপাব কার ঘাড়ে? (স্মরণ করে), ও মনে পড়েছে। দরিদ্র চারুদত্তের ঘাড়েই এই কুকীর্তিটা চাপিয়ে দেব। তাছাড়া সে দরিদ্র। দরিদ্রে সবই সম্ভব। যা হোক, বিচারমণ্ডপে গিয়ে আগে এই বলে নালিশটা রুজু করি যে চারুদত্ত বসন্তসেনাকে গলা টিপে হত্যা করছে। বিচারমণ্ডপে যাই তাহলে। (পরিক্রমা করে দেখে)। এই যে বিচারমণ্ডপ, এইখানে প্রবেশ করি। (প্রবেশ করে দেখে) এ কী! আসন সাজানো হয়েছে দেখছি। যাক্ যতক্ষণ কর্মকর্তারা না আসছেন ততক্ষণ এই দূর্বাচত্বরে কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করি। (সেইভাবে অবস্থান করল)

শোধনক— (অন্যদিকে পরিক্রমা করে। সামনে তাকিয়ে)। এই যে বিচারকেরা আসছেন। কাছে যাই তা হলে। (কাছে গেল) 

(তারপর শ্রেষ্ঠী কায়স্থাদি পরিবৃত্ত হয়ে বিচারকদের প্রবেশ) 

বিচারকেরা— শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থমশাই! 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— আদেশ করুন আর্য। 

বিচারক— দেখুন! বিবাদনিষ্পত্তিটা অন্য নানা ব্যাপারের ওপর নির্ভরশীল বলে বিচারকদের পক্ষে অন্যের মনকে ঠিকমতো বোঝা সত্যিই কঠিন। 

লোকেরা (বাদী ও প্রতিবাদী) যা ন্যায় থেকে অনেক দূরে এমন কাজ গোপন করে (বিচারের জন্যে) উপস্থিত করে। স্বার্থ আছে বলে নিজেরা নিজেদের দোষ তো বিচারালয়ে বলে না। বাদী ও প্রতিবাদী দুই পক্ষ তার (সেই দোষের) বলকে আরও বাড়িয়েই দেয় যা রাজাকে স্পর্শ করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে বিচারকের অপযশটাই সুলভ। যশ দুর্লভ বললেই হয় ॥ ৩ ॥

তা ছাড়া, 

ন্যায়কে অবজ্ঞা করে কুপিত লোকেরা সত্য গোপন করে অন্যের বিরুদ্ধে নালিশ করে। বিচারালয়ে নিজেদের দোষ তারা নিজেরা বলে না। বাদীপ্রতিবাদীর দোষের সংস্পর্শে এসে সজ্জনেরাও[৪] ন্যায়ভ্রষ্ট হয়ে পাপ করেন এ-ও সত্য। সংক্ষেপে, বিচারকদের অপযশই জোটে, যশ তাঁদের কাছে অনেক দূরের ব্যাপার[৫] ॥ ৪ ॥ 

এই জন্যেই বিচারককে হতে হবে শাস্ত্রজ্ঞ, প্রতারণা ধরায় কুশলী, তাঁকে হতে হবে সুবক্তা এবং অক্রোধী, শত্রুমিত্র এবং স্বজনের স্বরূপ জেনেই তিনি রায় দেবেন, তিনি হবেন দীনের পালক এবং ধূর্তের পীড়ক, ধার্মিক হবেন তিনি, সুযোগ থাকলে[৬] লোভে পড়বেন না তিনি। আসল সত্য নির্ণয়ে তাঁকে হতে হবে একাগ্রচিত্ত, সেইসঙ্গে রাজার ক্রোধকেও দূর করবেন তিনি ॥ ৫ ।।

শ্রেষ্ঠী এবং কায়স্থ— আপনার ক্ষেত্রেও কি গুণ দোষ বলে নিন্দিত হবে? তাই যদি হয় তাহলে চন্দ্রলোকেও অন্ধকার আছে বলতে হবে। 

বিচারক— ভদ্র শোধনক, বিচারমণ্ডপের পথ দেখাও। 

শোধনক— আসুন আসুন মাননীয় বিচারকমশাই। (এই বলে পরিক্রমা করল)

শোধনক— এই যে বিচারমণ্ডপ। বিচারকেরা প্রবেশ করুন। 

(সকলে প্রবেশ করলেন) 

বিদূষক— ভদ্র শোধনক, বাহিরে বেরিয়ে দেখুন তো কারা বিচারপ্রার্থী হয়ে এসেছেন?

শোধনক— আপনার যে আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত হয়) শুনুন মশাইরা বিচারকেরা জিগ্যেস করছেন— আপনারা কে কে বিচারপ্রার্থী হয়ে এসেছেন? 

শকার— (সানন্দে) বিচারকেরা এসে গেছেন তাহলে। (সগর্বে পরিক্রমা করে) এই যে আমি শ্রেষ্ঠ পুরুষ, মনুষ্যরূপী বাসুদেব, রাষ্ট্রীয় শ্যালক, রাজশ্যালক বিচারপ্রার্থী হয়ে এসেছি। 

শোধনক— (সভয়ে) এ কী! প্রথমেই রাজশ্যালক বিচারপ্রার্থী। যাক আর্য, একটু অপেক্ষা করুন। আমি গিয়ে বিচারকদের বলছি। (এসে) শ্রদ্ধেয় মহোদয়েরা! রাষ্ট্রীয় শ্যালক বিচারপ্রার্থী হয়ে আদালতে এসেছেন। 

বিচারক— সে কী? প্রথমেই রাষ্ট্রীয় শ্যালক বিচারপ্রার্থী? এ যেন সূর্যোদয়েই গ্রহণ লাগে— যা কোনো মহাপুরুষের পতনের সূচনা করছে। শোধনক, আজ মামলার শুনানি একটু গোলমেলে হবেই। ভদ্র, বেরিয়ে গিয়ে বলুন— তিনি যেতে পারেন, আজ তাঁর নালিশ শোনা সম্ভব হবে না। 

শোধনক— আর্য যা বলেন। (বেরিয়ে এসে শকারের কাছে গিয়ে) আর্য! বিচারকেরা বললেন- আজ আপনি আসুন। আজ আপনার মামলার শুনানি সম্ভব নয়। শকার (সক্রোধে)— কী! আমার নালিশ শোনা হবে না? যদি শোনা না হয়, তাহলে আমি ভগ্নীপতি রাজা পালককে জানিয়ে দেব এবং ভগ্নীকে ও মাকে বলে এই বিচারককে তাড়িয়ে তার জায়গায় অন্য বিচারককে বসাব। (গমনোদ্যত হল)

শোধনক— আর্য! রাষ্ট্রীয় শ্যালক, একটু দাঁড়ান। আমি গিয়ে বিচারকদের বলি। (বিচারকের কাছে গিয়ে) এই রাষ্ট্রীয়-শ্যালক ক্রুদ্ধ হয়ে বলছেন—

বিচারক— এই মূর্খের পক্ষে সবই সম্ভব। ভদ্র, গিয়ে বলুন— আসুন, আপনার নালিশ শোনা হবে। 

শোধনক— (শকারের কাছে এসে) আর্য বিচারকেরা বললেন— আসুন, আপনার নালিশ শোনা হবে। তা হলে আর্য প্রবেশ করুন আপনি। 

শকার— প্রথমে তাঁরা বললেন আমার নালিশ শুনবেন না, এখন বলছেন শুনবেন। তাই বেশ বোঝা যাচ্ছে বিচারকেরা বেশ ভয় পেয়েছেন। তাই, যা আমি বলব তা-ই সত্যি বলে প্রতিপন্ন করিয়ে নেব। যা হোক, ভিতরে প্রবেশ করি। 

(ভিতরে এসে, এগিয়ে) 

আমি ভালোই আছি, তবে আপনাদের (ইচ্ছেমতো) ভালো থাকতেও পারি, না-ও পারি। 

বিচারক— (স্বগত) বিচারপ্রার্থী হলেও তার সেই স্থায়ী অভ্যাসগুলো গেল না। 

(প্রকাশ্যে) বসুন। 

শকার— ওহ্, এ তো আমার নিজেরই জায়গা; তাই যেখানে খুশি বসি। (শ্রেষ্ঠীকে) এখানে বসছি। (এই বলে মাটিতে বসল) (শোধনককে) এই এখানে বসছি। (বিচারকের মাথায় হাত রেখে) এইখানেই বসছি। (এই বলে মেঝেতে বসল) বিচারক— আপনি বিচারার্থী। 

শকার— হ্যাঁ। 

বিচারক— বলুন কী ব্যাপার। 

শকার— ব্যাপারটা আপনার কানে কানে বলব। পানপাত্রের মতো বড়ো বংশে 

আমার জন্ম। আমার বাবা রাজার শ্বশুর, রাজা আমার বাবার জামাই, আমি রাজার শালা, রাজা আমার বোনের স্বামী। ॥ ৬ ॥ 

বিচারক— সব জানি। কুলের উল্লেখ করে কী হবে, চরিত্রই এখানে বড়ো কথা। ভালো জমিতে কাঁটাগাছও খুব বেড়ে ওঠে ॥ ৭ ॥ 

কাজের কথা বলুন। 

শকার— এই বলছি। কিন্তু জানবেন অপরাধী সাব্যস্ত হলেও তিনি (রাজা) কিছু বলবেন না! সেই ভগ্নীপতি পরিতুষ্ট হয়ে আমার বিলাসভ্রমণের জন্যে এবং দেখাশোনা করার জন্যে সমস্ত বাগানের সেরা ‘পুষ্পকরওক’ নামে পুরনো বাগানটা আমাকে দিয়েছেন। আমি রোজ তা দেখাশোনা করবার জন্যে যাই— ঠিকমতো জলনিকাশ করাই, ঝাঁট দেওয়াই, প্রয়োজনমতো ছাঁটাই করি, দেখি গাছগুলো ঠিকমতো বাড়ছে কিনা। দৈবযোগে, আমি সেখানে একটি রমণীর মৃতদেহকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম— না, দেখলাম না।

বিচারক— কী করে বুঝলেন মৃতদেহটি রমণীর? রমণীটি কে? 

শকার— হে বিচারকবৃন্দ! শত স্বর্ণালংকারে ভূষিত নগরীর ভূষণস্বরূপা সেই রমণীকে চিনব না? কোনো এক দুর্জন তুচ্ছ সোনার লোভে সেই নির্জন পুষ্পকর ক উদ্যানে প্রবেশ করে বাহুপাশে শ্বাসরোধ করে বসন্তসেনাকে হত্যা করেছে, আমি–না, কিন্তু— (এই অর্ধেকটুকু বলেই মুখ ঢাকল) 

বিচারক— নগরীবাসীদের কী অসাবধানতা! শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ! অভিযোগ অংশ— ‘আমি না’ এই কথাটি প্রথমে লিখে রাখুন। 

কায়স্থ— আপনি যা আদেশ করেন। (তাই লিখে) আর্য লিখেছি। 

শকার— (স্বগত) ভিখারি তাড়াতাড়ি গরম পায়েস খেতে গিয়ে যেমন সর্বনাশ ডেকে আনে আমিই তেমনি আমার সর্বনাশ ডেকে আনলাম। যাক্ এইভাবে বলি। (প্রকাশ্যে) হে বিচারকবৃন্দ! আমি বলতে যাচ্ছিলাম আমিই দেখেছি। এ নিয়ে এত বিচলিত হচ্ছেন কেন? (যা লেখা হয়েছিল সে পা দিয়ে মুছে দিল) বিচারক আপনি কী করে জানলেন যে টাকার জন্যে তাকে বাহুপাশে (শ্বাস রোধ করে) মারা হয়েছে? 

শকার— শুনুন, আমি তার গলা দেখে বুঝেছি, গলাটা ছিল কেমন ফোলা ফোলা। আর ফাঁকা (অলঙ্কারহীন) গয়না-পরা। অন্য অঙ্গগুলো দেখে তা বুঝেছি। কারণ সেসব জায়গায় গয়না আর নেই। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— তা সম্ভব বটে। 

শকার— (স্বগত) ভাগ্যক্রমে আবার যেন জীবন ফিরে পেলাম। কী আনন্দ! শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— প্রমাণের জন্যে এ মামলাটা কার ওপর বর্তাবে? বিচারক মামলা দু’রকম। 

শ্রেষ্ঠ ও কায়স্থ— কীরকম? 

বিচারক— বাক্য অনুসারে (জবানবন্দিতে) এবং অর্থানুসারে (ঘটনা অনুসারে)। যেটা বাক্য অনুসারে সেটা বাদী-প্রতিবাদীদের বক্তব্য থেকে নিষ্পত্তি হবে। আর যা ঘটনার ওপর নির্ভরশীল তা বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে বিচারকই মীমাংসা করবেন।

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— তাহলে এ মামলাটা বসন্তসেনার মায়ের ওপরই বর্তাবে, অর্থাৎ (এ প্রসঙ্গে মাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।) 

বিচারক— হ্যাঁ তাই, ভদ্র শোধনক, আপনি বসন্তসেনার মাকে ডেকে আনুন তো। দেখবেন উনি যেন খুব ভয় না পান। 

শোধনক— এই যাচ্ছি। (বেরিয়ে গণিকামাতাকে নিয়ে প্রবেশ করে) আসুন আর্যা।

বৃদ্ধা— আমার মেয়ে তার কোনো বন্ধুজনের বাড়ি গিয়েছে, যৌবন উপভোগ করতে। এই আয়ষ্মান বলছেন বিচারক ডেকেছেন। তাই আমার মনে হচ্ছে মূৰ্চ্ছা যেন আমাকে আচ্ছন্ন করছে। আমার বুক কাঁপছে। আর্য বিচারমণ্ডপের পথ বলে দিল আমাকে। 

শোধনক— আসুন, আর্যা, আসুন। 

(উভয়ের পরিক্রমা) 

এই যে বিচারমণ্ডপ। আর্যা এইখানে প্রবেশ করুন। 

(দুজনের প্রবেশ) 

বৃদ্ধা— (এগিয়ে এসে) ভদ্রমহোদয়দের কল্যাণ হোক। 

বিচারক— ভদ্রে, স্বাগত। আপনি বসুন। 

বৃদ্ধা— বসছি (বসলেন)। 

শকার— (গাল দেওয়ার ভঙ্গিতে) বৃদ্ধকুট্টিনী! এসেছ তা হলে, কী বলো?

বিচারক—আপনিই কি বসন্তসেনার মা? 

বৃদ্ধা— হ্যাঁ। 

বিচারক— আচ্ছা, বসন্তসেনা এখন কোথায় গিয়েছেন? 

বৃদ্ধা— বন্ধুর বাড়ি। 

বিচারক— বন্ধুর নাম কী? 

 বৃদ্ধা— (স্বগত) হায় ধিক, হায় ধিক! সে তো খুবই লজ্জার কথা। (প্রকাশ্যে) সাধারণ কোনো লোক একথা জিগ্যেস করতে পারে, কিন্তু বিচারক পারেন না। 

বিচারক— লজ্জা করবেন না; একটা আইনগত প্রয়োজন আছে বলেই জিগ্যেস করছি। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— আইনগত প্রয়োজনেই এই প্রশ্ন। এতে দোষ নেই। বলুন।

বৃদ্ধা— কী বললেন? আইনের প্রয়োজন? তাহলে শুনুন মশাইরা, তিনি হলেন বণিক বিনয়দত্তের পৌত্র, সগরদত্তের পুত্র, তাঁর নাম চারুদত্ত, যাঁর নাম উচ্চারণেই মঙ্গল, যিনি শ্রেষ্ঠিচত্বরে বাস করেন। সেখানেই আমার কন্যা যৌবনসুখ উপভোগ করছে। 

শকার— শুনলেন আপনারা? একথাগুলো লিখে রাখুন। চারুদত্তের সঙ্গে আমার বিবাদ। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— চারুদত্ত তাঁর বন্ধু এতে কোনো ক্ষতি নেই। 

বিচারক— তাহলে এখন সাক্ষ্যের জন্যে চারুদত্তের দরকার হবে। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— হ্যাঁ তাই। 

বিচারক— ধনদত্ত, এই মামলার প্রথম অংশ হিসেবে লিখুন— বসন্তসেনা আর্য চারুদত্তের বাড়ি গিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় আর্য চারুদত্তকেও আমাদের ডাকতে হচ্ছে। অবশ্য আইনই ডাকছে। ভদ্র শোধনক, যান। আর্য চারুদত্তকে সসম্মানে ডেকে আনুন। দেখবেন তিনি যেন স্বচ্ছন্দে আসেন, বিচলিত বা উদ্বিগ্ন না হয়ে পড়েন। বলবেন- বিচারক আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী 

শোধনক— আপনার যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত হয়ে চারুদত্তকে নিয়ে প্রবেশ করে) আসুন আর্য।

চারুদত্ত— (চিন্তা করে) আমার কুল ও শীল ভালো করে জেনেও রাজা যে আমাকে ডাকলেন তাতে মনে হচ্ছে আমার অবস্থাবিপর্যয়ে তিনি আমার প্রতি সন্দিগ্ধ ॥ ৮ ॥ (চিন্তা করে, মনে মনে) বন্ধনমুক্ত সে (আর্যক) পথে এসে পড়লে আমি তাকে গাড়িতে করে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছি এ কথা গুপ্তচর-চক্ষু (গুপ্তচরেরাই রাজার চোখ) রাজার কানে এসেছে, তাই আমি এইভাবে অভিযুক্ত হয়ে (বিচারালয়ে) চলেছি ॥ ৯॥ 

অথবা, এসব ভেবে কী হবে? বিচারমণ্ডপেই যাই। ভদ্ৰ শোধনক, বিচারালয়ের পথ দেখিয়ে দিন। 

শোধনক— আসুন, আৰ্য। 

(দুজনে পরিক্রমা করলেন) 

কাক কর্কশ স্বরে ডাকছে[৮]। অমাত্য ভৃত্যেরা (আর্দালিরা) বারবার হাঁক দিচ্ছে। আমার বাঁ চোখ প্রবলভাবে স্পন্দিত হচ্ছে। এইসব কুলক্ষণ আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ॥ ১০ ॥ 

শোধনক— আসুন আর্য, ধীরেসুস্থে আসুন।

চারুদত্ত— (পরিক্রমা করে, সামনে তাকিয়ে কাক শুকনো গাছে বসে সূর্যের দিকে মুখ করে আমার দিকে বাঁ-চোখ হানছে, নিশ্চয় কোনো বিপদ আসন্ন ॥ ১১ ॥ 

(আবার অন্যদিকে তাকিয়ে) এ কী! এ যে সাপ! বাটা কাজলের মতো কালোরঙের এই প্রকাণ্ড সাপটা সরোষে আস্ফালন করছে। আমার দিকেই তার চোখ, লক্লকে জিভ বের করছে, চারটে সাদা দাঁত আছে তার। পেটটা বাঁকা আর ফুলে-ওঠা। আমার পথ জুড়ে ঘুমিয়েছিল সাপটা[৯] ॥ ১২ ॥ আমার পা পিছলে যাচ্ছে কিন্তু মাটি তো তেমন ভিজে নয়, আমার (বাঁ) চোখ নাচছে, বাঁ হাতও বার বার কাঁপছে। আবার এদিকে এক পাখি ডেকেই চলেছে। এসব কিছু মহাভয়ঙ্কর মৃত্যুই সূচিত করছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই ॥ ১৩। 

দেবতারা সবদিক দিয়ে মঙ্গল করুন! 

শোধনক— আসুন আর্য। এ যে বিচারমণ্ডপ, আপনি প্রবেশ করুন। 

চারুদত্ত— (প্রবেশ করে, চারদিকে তাকিয়ে) বাহ্ বিচারমণ্ডপটি কী অপূর্ব সুন্দর! উগ্র উপাদান আছে বলে রাজার এই বিচারালয়কে সমুদ্রের মতো দেখাচ্ছে। চিন্তামগ্ন মন্ত্রীরা হল এর জল; দূতেরা হল এর শঙ্খসমাকুল তরঙ্গ; নিকটস্থ গুপ্তচরেরা হল হাঙর ও কুমির; নাগ ও অশ্বেরা হল হিংস্র জন্তু স্থানীয়, বাদী-প্রতিবাদীরা হল কঙ্কপাখির দল, কায়স্থেরা হল সর্প। এর তটভূমি দণ্ডবিধিতে ভগ্ন (অর্থাৎ দণ্ডবিধিরূপ নদীর জলধারায় ভগ্ন) ॥ ১৪॥ 

যা হোক। (প্রবেশ করে মাথায় আঘাত অভিনয় করে, চিন্তা করে) এ কি, এ যে আর এক দুর্লক্ষণ। বাঁ চোখ নাচছে, কাক ডাকছে, সাপ পথ আগলে আছে। দৈব আমার মঙ্গল করুন। প্রবেশ করি তাহলে ॥ ১৫ ॥ 

(প্রবেশ করলেন) 

বিচারক— এই সেই চারুদত্ত। যিনি উন্নতনাসা এবং অপাঙ্গদীর্ঘ নেত্র ধারণ করছেন। এরকম মুখ কখনও অকারণ দূষণের আবাস হতে পারে না। হাতি, গরু, ঘোড়া এবং মানুষের ক্ষেত্রে আকৃতি কখনও সুচরিত্রবিরোধী হয় না[১০] ॥ ১৬ ॥

চারুদত্ত— বিচারকমহোদয়েরা! আপনাদের মঙ্গল হোক। কর্মীবৃন্দ! আপনাদের কুশল তো? 

বিচারকেরা— (সসম্ভ্রমে) আর্য, স্বাগত। ভদ্র শোধনক, ওঁর জন্যে আসন আনো।

শোধনক— (আসন এনে) এই আসন। আর্য, এখানে বসুন। (চারুদত্ত বসলেন

শকার— (সক্রোধে) ও, নারীহন্তা তুমি এসেছ তা হলে। কী চমৎকার ব্যবস্থা! কী চমৎকার ধর্মসম্মত আচার! নারীহন্তাকে কিনা আসন দেওয়া হচ্ছে! (সগৰ্বে) বেশ। দেওয়া হোক। 

বিচারক— আর্য চারুদত্ত! আপনার কি এই ভদ্রমহিলার কন্যার সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় বা প্রীতি আছে? 

চারুদত্ত— কার? 

বিচারক— এঁর।

চারুদত্ত— (উঠে) আর্যে, অভিবাদন করি 

(বসন্তসেনার মাতাকে দেখালেন) 

বৃদ্ধা— বৎস, দীর্ঘজীবী হও। (স্বগত) এই সেই চারুদত্ত। কন্যার যৌবন তাহলে যোগ্যপাত্রেই নিবেদিত। 

বিচারক— আর্য, গণিকা আপনার মিত্র? (চারুদত্ত লজ্জার অভিনয় করলেন)

শকার— নিজে তাকে অর্থের জন্যে হত্যা করে এখন এ কুকর্ম লজ্জায় বা ভীরুতায় গোপন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজা তা গোপন করবেন না (অর্থাৎ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবে) ॥ ১৭ ॥ 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— আর্য চারুদত্ত, আপনি বসুন, লজ্জা করবেন না। এ হল আইনসম্মত পদ্ধতি মাত্ৰ। 

চারুদত্ত— (সলজ্জভাবে) হে বিচারকবৃন্দ, একজন গণিকা আমার মিত্র, একথা আমি উচ্চারণ করি কী করে। তবে এক্ষেত্রে যৌবনেরই দোষ, আমার চরিত্রের নয়।

বিচারক— মামলায় নানা বিঘ্ন। হৃদয়ে স্থিত লজ্জা দূর করুন। সত্য কথা বলুন, বিলম্ব করবেন না। এখানে কোনো কপটতার স্থান নেই ॥ ১৮ ॥ 

লজ্জা করবেন না। মামলাই আপনাকে প্রশ্ন করছে। 

চারুদত্ত— বিচারক মহোদয়, কার সঙ্গে আমার মামলা?

শকার— (উদ্ধতভাবে) আমার সঙ্গে তোমার মামলা। 

চারুদত্ত— আপনার সঙ্গে আমার মামলা অত্যন্ত দুঃসহ। 

শকার— ওরে নারীঘাতক, ওইরকম শতরত্নভূষিতা বসন্তসেনাকে হত্যা করে এখন কপট ধূর্তের মতো তা গোপন করবার চেষ্টা করছিস? 

চারুদত্ত— আপনি বাজে কথা বলছেন। 

বিচারক— আপনি ওঁর কথা ধরবেন না, সত্য কথা বলুন। গণিকা কি আপনার মিত্র?

চারুদত্ত— হ্যাঁ। 

বিচারক— আর্য, বসন্তসেনা কোথায়? 

চারুদত্ত— বাড়ি গিয়েছেন। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— কেমন করে গেলেন? কখন গেলেন? তাঁর সঙ্গে কে গিয়েছে?

চারুদত্ত— (স্বগত) কীভাবে গিয়েছেন আমি তা দেখিনি তাই কেমন করে বলব? 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— আর্য, বলুন। 

চারুদত্ত— বাড়ি গিয়েছেন। আর কী বলব? 

শকার— তুমি তাকে আমার পুরনো উদ্যান পুষ্পকরওকে নিয়ে গিয়ে টাকার জন্যে জোর করে বাহুপাশে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করেছ। আর এখন বলছ তিনি বাড়ি গিয়েছেন? 

চারুদত্ত— আহ্, কী বাজে কথা বলছেন? এ মিথ্যা। কারণ মেঘের জলে আপনি সম্পূর্ণ সিক্ত নন, তবু নীলকণ্ঠ পাখির পাখার মতো আপনার কালো মুখ কালো হয়ে উঠেছে[১১]। হেমন্তপদ্মের মতো নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে ॥ ১৯ ॥ 

বিচারক— (জনান্তিকে) চারুদত্তের ওপর দোষারোপ যেন হিমালয়কে ওজন করতে যাওয়ার মতো, বায়ুকে ধরতে যাওয়ার মতো ॥ ২০ ॥ 

(প্রকাশ্যে) ইনি আর্য চারুদত্ত। ইনি এমন কুকাজ করবেন কেন? 

(উন্নতনাসা ইত্যাদি শ্লোক উচ্চারণ করলেন 

শকার— আপনারা পক্ষপাতিত্ব করে মামলা পরিচালনা করছেন দেখছি।

বিচারক— দূর হও, মূর্খ। তুমি নীচ হয়ে বেদার্থ বলছ অথচ তোমার জিভ খসে পড়ছে না, মধ্যাহ্নের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছ তবু সহসা তোমার দৃষ্টি লোপ হচ্ছে না, প্রদীপ্ত অগ্নির মধ্যে হাত দিচ্ছ তবু তা দগ্ধ হচ্ছে না। চারুদত্তকে সুনাম থেকে ভ্রষ্ট করতে চলেছ, তবু পৃথিবী তোমার দেহ গ্ৰাস করছে না[১২] ॥ ২১ 

আর্য চারুদত্ত কেমন করে কুকাজ করবেন? যিনি সমুদ্রের শুধু জলটুকুই অবশিষ্ট রেখেছেন, যিনি অকল্পনীয় ধন দান করেছেন, সেই মঙ্গলের একমাত্র আধার মহাত্মা অর্থের জন্যে এমন পাপ কেন করবেন যা নীচ লোকের পক্ষেই করা সম্ভব।। ২২ ॥ 

বৃদ্ধা— হতভাগা! গচ্ছিত স্বর্ণভাণ্ড রাত্রে চুরি গেল বলে সম্প্রতি যিনি চতুঃসমুদ্রের সারভূতা রত্নাবলি দান করতে পারেন, তুচ্ছ অর্থের জন্যে তিনি কি এই কুকর্ম করতে পারেন? 

বিচারক— আর্য চারুদত্ত, তিনি কি পায়ে হেঁটে গেছেন না গাড়িতে করে গেছেন?

চারুদত্ত— তাঁর যাওয়া আমি দেখিনি। তাই তিনি হেঁটে গেছেন না গাড়িতে গেছেন তা জানি না। 

(সক্রোধে প্রবেশ করে)

বীরক— পদাঘাতের অপমানের (চন্দনকের বিরুদ্ধে) তীব্র বিদ্বেষ বুকে বয়ে ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে রাত কেটেছে। যাই, বিচারমণ্ডপে প্রবেশ করি। 

(প্রবেশ করে ) 

ভদ্রমহোদয়দের মঙ্গল কামনা করি। 

বিচারক— এ যে নগররক্ষাধিকর্তা বীরক দেখছি। বীরক, এখানে এলে কেন?

বীরক— ওহ্, আর্যক বাঁধন ভেঙে বেরোবার পর যে হৈচৈ হল তারই মধ্যে তাকে খুঁজতে খুঁজতে একটা বন্ধ গাড়ি যেতে দেখে আমি সন্দিগ্ধ হয়ে ‘তুমি গাড়িটা দেখলেও আমিও একবার দেখব’ একথা বলামাত্র সর্দার চন্দনক আমাকে লাথি মেরেছে। একথা শুনে এখন আপনারা যা হয় বিচার করুন। ॥ ২৩ ॥ 

বিচারক— ভদ্র, আপনি জানেন কি গাড়িটা কার? 

বীরক— এই আর্য চারুদত্তের। চালক বলল : বসন্তসেনা ভিতরে আছেন এবং তাকে পুষ্পকরওক উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 

শকার—আবার আপনারা (একই কথা) শুনলেন! 

বিচারক— হায়, নির্মল জ্যোৎস্নাছড়ানো চাঁদ রাহুগ্রস্ত হল। কুল ভেঙে পড়ায় স্বচ্ছ জল পঙ্কিল হল ॥ ২৪ ॥ 

বীরক, আমরা পরে তোমার অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। এখন বিচারালয়ের দুয়ারে যে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে তাতে চড়ে পুষ্পকরণ্ডক উদ্যানে যাও, গিয়ে দেখ সেখানে কোনো স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পড়ে আছে কিনা। 

বীরক— আপনার যা আদেশ। 

(প্রস্থান করল, প্রবেশ করে) 

আমি গিয়েছিলাম সেখানে। সেখানে একটি স্ত্রীলোকের শব দেখলাম, শিয়াল-কুকুরে খাচ্ছে। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— কী করে বুঝলেন স্ত্রীলোকের দেহ? 

বীরক— চুল, বাহু, হাত ও পায়ের অবশিষ্ট অংশ দেখলাম যে। 

বিচারক— হায় ধিক! মামলা কী অদ্ভুত জিনিস! 

যত সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে চাচ্ছি ততোই তা গোলমেলে হয়ে উঠছে। হায়! আইনের প্রমাণগুলো খুবই স্পষ্ট। গরু পাঁকে পড়লে যেমন অবসন্ন হয়, আমার বুদ্ধিও সেইরকম অবসন্ন ॥ ২৫ ॥ 

চারুদত্ত— (স্বগত) ফুলের প্রথম প্রস্ফুটনের সময়ে যেমন ভ্রমরেরা মিলিত হয়ে মধু পান করতে আসে, মানুষের বিপদের সময়েও তেমনি ছিদ্রের মধ্য দিয়ে অকার্য দ্বিগুণিত হয়॥ ২৬। 

বিচারক— আর্য চারুদত্ত, সত্য বলুন। 

চারুদত্ত— পরগুণে ঈর্ষান্বিত দুরাশয়, ক্রোধান্ধ ও অন্যের প্রতি জিঘাংসাপরায়ণ কোনো মানুষ স্বভাবদোষে যদি মিথ্যাকথা বলে সেটাই কি গ্রাহ্য হবে? তা বিচার করে দেখা হবে না? ॥ ২৭। 

তাছাড়া, 

যে আমি কুসুমিত লতাকেও ফুল তোলার জন্যে আকর্ষণ করেও ফুল তুলি না, সেই আমি কেমন করে ভ্রমরপক্ষের মতো বর্ণবিশিষ্ট সুদীর্ঘ কেশ আকর্ষণ রোরুদ্যমানা নারীকে হত্যা করব? ॥ ২৮ ॥ 

শকার— বিচারকমশাইরা, আপনারা কি পক্ষপাতিত্ব নিয়ে মামলা পরিচালনা করেন! তা না হলে এই নীচ চারুদত্তকে এখন আসনে বসিয়ে রেখেছেন কেন?

বিচারক— ভদ্র শোধনক, উনি যা বলছেন তাই করো। 

(শোধনক তাই করল) 

চারুদত্ত— বিচার করুন বিচারকমণ্ডলী, বিচার করুন। 

শকর— (স্বগত, সহর্ষে নৃত্য করে) আহা, এই আমি আমার নিজের পাপ অন্যের মাথায় চাপালাম। তাই এখন যে জায়গায় চারুদত্ত বসেছিল সেই জায়গায় বসব। (তাই করে) চারুদত্ত, তাকাও, আমার দিকে তাকাও। বলো, তাহলে বলো যে তুমিই তাকে হত্যা করেছ। 

চারুদত্ত— বিচারকমণ্ডল! (‘পরগুণে ঈর্ষান্বিত’-৯.২৭ ইত্যাদি পূর্বোক্ত শ্লোক উচ্চারণ করলেন। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, স্বগত) মৈত্রেয়, এ কী হচ্ছে? আজ তো আমার সর্বনাশ হতে চলেছে। নির্মল দ্বিজকুলে জাতা হায় ব্রাহ্মণী! হায় রোহসেন! আমার বিপদ তুমি দেখছ না। তুমি তো শুধু মিথ্যা খেলা নিয়েই মেতে আছ ॥ ২৯॥ 

আমি রোহসেনের খবর নেবার জন্যে মৈত্রেয়কে পাঠিয়েছি, যে গয়নাগুলো তিনি তাকে সোনার খেলনাদি বানাবার জন্যে দিয়েছিলেন তা ফেরত দেবার জন্যে। তার দেরি হচ্ছে কেন? 

(তারপর অলঙ্কার নিয়ে বিদূষকের প্রবেশ)

বিদূষক— আর্য চারুদত্ত অলঙ্কার দিয়ে আমাকে বসন্তসেনার কাছে পাঠিয়েছেন, বলেছেন— ‘আর্য মৈত্রেয়, বসন্তসেনা বৎস রোহসেনকে তাঁর নিজের গয়না দিয়ে সাজিয়ে তার মায়ের কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁর দেওয়াটা ঠিকই হয়েছে কিন্তু আমরা তো আর নিতে পারি না। তাই এগুলো তাঁকে ফেরত দিয়ে এসো।’ তাই আমি বসন্তসেনার কাছেই যাচ্ছি। (পরিক্রমা করে, দেখে আকাশে) এ কী বন্ধু রেভিল যে! তোমাকে এত উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে কেন! (শুনে) কী বললে? প্রিয় বয়স্য চারুদত্তকে বিচারালয়ে ডাকা হয়েছে? তাহলে এ তো সামান্য ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়। (চিন্তা করে) তাহলে পরে বসন্তসেনার কাছে যাব। আগে বিচারালয়েই যাই। (পরিক্রমা করে, দেখে) এ যে বিচারমণ্ডপ! যাই ভিতরে প্রবেশ করি। (প্রবেশ করে) কল্যাণ হোক বিচার-মণ্ডলীর। আমার প্রিয় বন্ধু কোথায়? 

বিচারক— এই যে তিনি। 

বিদূষক— বন্ধু, কল্যাণ হোক। 

চারুদত্ত— তাই হোক। 

বিদূষক— খবর সব ভালো তো? 

চারুদত্ত— তাই হোক। 

বিদূষক— বয়স্য। আপনাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে যেন। আপনাকে (এখানে) ডাকাই-বা হল কেন? 

চারুদত্ত— বয়স্য। নৃশংস ও পরলোক সম্বন্ধে অজ্ঞ আমি একটি স্ত্রীলোককে হত্যা করেছি, যিনি রতির সঙ্গে প্রায় অভিন্ন বললেই চলে। বাকিটা ইনি বলবেন ॥ ৩০ ॥ 

বিদূষক— কী? কী? 

চারুদত্ত— (কানে কানে) এই, এই। 

বিদূষক— কে বলছে একথা? 

চারুদত্ত— (ইশারায় শকারকে দেখালেন) মৃত্যুদেবতার হেতুভূত এই নির্দোষ মানুষটি। 

বিদূষক— (জনান্তিকে) একথা কেন বলেননি যে বাড়ি চলে গিয়েছে। 

চারুদত্ত— বললেও, আমার অবস্থাদোষের দরুন তা গ্রাহ্য হয়নি। 

বিদূষক ওহে ভদ্রমহোদয়েরা! যিনি উপনগরী, মঠ, উদ্যান, তড়াগ, কূপ এবং যূপ স্থাপন করে উজ্জয়িনী নগরীকে সাজিয়েছেন। তিনি কি দরিদ্র বলেই, তুচ্ছ অর্থের জন্যে এই কুকর্ম করবেন? (সক্রোধে) ওরে কুলটাপুত্র, রাজশ্যালক সংস্থানক, ওরে উচ্ছৃঙ্খল! নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ! ওরে বহু সোনায় সাজা বাঁদর! বল্ বল্ আমার কাছে বল। আমার যে প্রিয়বয়স্য কুসুমিত মাধবীলতাকেও আকর্ষণ করে পাতা না ছেঁড়ে এই ভয়ে ফুল তোলেন না তিনি কেমন করে এই ইহলোক ও পরলোকের বিরুদ্ধ কুকর্ম করবেন? দাঁড়া, কুট্টনীর পো, দাঁড়া। আমি তোর মনের মতোই কুটিল এই দণ্ডকাঠ দিয়ে তোর মাথাটাকে শতখণ্ড করছি! 

শকার— (সক্রোধে) মশাইরা শুনুন শুনুন। চারুদত্তের সঙ্গে আমার বিবাদ বা মোকদ্দমা। তাহলে এই কাকের পায়ের মতো মাথাওয়ালা এই লোকটা আমার মাথাটা শতখণ্ড করবে কেন? এ হতে পারে না রে দাসীর ব্যাটা দুষ্ট বামুন! 

(বিদূষক তার দণ্ডকাষ্ঠ উঠিয়ে আগে যা বলেছিল বলল। শকার রাগে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে মারল। বিদূষকও শকারকে মারল। দুজনেই মারামারি করতে লাগল। বিদূষকের বগল থেকে গয়নাগুলো পড়ে গেল)। 

শকার— (সেগুলো নিয়ে, দেখে ভয় পেয়ে) – 

দেখুন মশাইরা, দেখুন। এগুলো সেই বেচারীর গয়না। (চারুদত্তকে সম্বোধন করে, চারুদত্তকে দেখিয়ে) এই তুচ্ছ অর্থের জন্যে একে মারা হয়েছে। 

(বিচারকেরা মুখ নিচু করে থাকলেন 

চারুদত্ত— (জনান্তিকে)— ঠিক এই সময়ে দেখা গয়নাগাটিগুলো আমার দুর্ভাগ্যবশ্যই পড়ে গেল এবং আমার সর্বনাশও করবে এরা ॥ ৩১ ॥ 

বিদূষক—আসল কথা কেন বলছেন না? 

চারুদত্ত— বয়স্য— রাজার চোখই দুর্বল, তা কখনও এ ব্যাপারে যা সত্য তাকে দেখতে পারবে না। বললেও তা হবে নিছক আত্ম-অবমাননা, যা কলঙ্কময় মৃত্যুর মতোই ॥ ৩২ ।।

বিচারক— হায়! কী দুঃখ। মণ্ডলগ্রহ যার বিরোধী এমন অতিদুর্বল বৃহস্পতির পাশে ধূমকেতুর মতো এ আর এক গ্রহ উত্থিত হল[১৪] ॥ ৩৩ ॥ 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— (দেখে। বসন্তসেনার মাকে উদ্দেশ্য করে) 

আর্যা, ভালো করে দেখুন তো এই গয়নাগুলো একই কিনা। 

বৃদ্ধা— (দেখে) এক রকমই বটে। তবে সেগুলোই নয়। 

শকার— আহ্ বৃদ্ধ কুট্টনী! তোমার চোখ দুটো বলে দিয়েছে, তবে তোমার কথা গোপন করার চেষ্টা করেছে। 

বৃদ্ধা— তুমি দূর হও, দুষ্ট। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— ঠিক করে বলুন, এগুলো সেগুলোই কিনা। 

বৃদ্ধা— শিল্পীকুশলতায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বটে, তবে এগুলো সেগুলো নয়।

বিচারক— ভদ্রে! এই গয়নাগুলো চিনতে পারেন? 

বৃদ্ধা— আমি তো বলছি, চিনি না, সত্যই চিনি না। একই কারিগর গড়েছে এমনও হতে পারে। 

বিচারক— দেখ, শ্রেষ্ঠী, কৃত্রিম আকারে এবং অলঙ্কারের সৌন্দর্যাদিগুণে ভিন্ন জিনিসও একরকম দেখায়। কারণ শিল্পীরা কিছু দেখে তার অনুকরণ করে। শিল্পকৌশলের দরুনই এই সাদৃশ্য দেখা যায় ॥ ৩৪ ॥ 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— তা হলে ওগুলো আর্য চারুদত্তের। 

চারুদত্ত— না, না, আমার নয়। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— তা হলে কার? 

চারুদত্ত— এগুলো এঁর কন্যার। 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— এগুলো তাঁর দেহবিচ্ছিন্ন হল কী করে? 

চারুদত্ত— এইভাবে গিয়েছে, হ্যাঁ, বলছি— 

শ্রেষ্ঠী ও কায়স্থ— আর্য চারুদত্ত, এ ব্যাপারে সত্য বলবেন। দেখুন দেখুন— সত্য-ভাষণেই সুখ পাওয়া যায়, সত্যভাষণে পাপ হয় না। ‘সত্য’ শব্দের দুটি অক্ষর সত্যিই অক্ষর অর্থাৎ অবিনশ্বর। মিথ্যাভাষণে সেই সত্য গোপন করবেন না ॥ ৩৫। 

চারুদত্ত— এই গয়নাগুলো সেই গয়না কিনা তা জানি না। তবে আমার বাড়ি থেকে আনা হয়েছে তা জানি। 

শকার— উদ্যানে প্রবেশ করিয়ে প্রথমে হত্যা করেছ। এখন ছলকপটতা করে তা গোপন করছ। 

বিচারক— আর্য চারুদত্ত, সত্য বলুন। এখন নিশ্চিত আপনার সুকুমার অঙ্গে কর্কশ কশাঘাত পড়বে তার সঙ্গে আমাদের মনোরথও পড়বে (মাটিতে; অর্থাৎ আপনাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা হবে ব্যর্থ) ॥ ৩৬ ॥ 

চারুদত্ত— নিষ্পাপদের বংশে জাত আমার মধ্যে পাপ নেই। আর যদি সেই পাপ আমাতে সম্ভব বলে মনেই করা হয় তা হলে নিষ্পাপ হয়েই-বা আমার লাভ কী? ॥ ৩৭। 

(স্বগত) বসন্তসেনাবিরহিত জীবন দিয়েই-বা কী করব? (প্রকাশ্যে) ভদ্রমহোদয়েরা, বেশি আর কী বলব? নৃশংস ও ইহকালপরকাল সম্বন্ধে অজ্ঞ আমি তাহলে এই বিশেষ স্ত্রীরত্নটিকে— বাকিটা এ বলবে। ॥ ৩৮ ॥

শকার— হত্যা করেছি। বলো আমি মেরেছি। 

চারুদত্ত— এই তো তুমিই বললে। 

শকার— শুনুন শুনুন মশাইরা, এ-ই মেরেছে। এ নিজেই সংশয় দূর করেছে। এই দরিদ্র চারুদত্তের প্রাণদণ্ড দেওয়া হোক। 

বিচারক— শোধনক, এই রাষ্ট্রীয় যেমন বলেছেন তাই করো। হে রাজপুরুষেরা! চারুদত্তকে গ্রেফতার কর। 

(রাজপুরুষেরা তাই করল) 

বৃদ্ধা— প্রসন্ন হোন, মহোদয়গণ। (গচ্ছিত স্বর্ণভাণ্ড রাতে চুরি গেল বলে সম্প্রতি যিনি… ইত্যাদি পূর্বোক্ত কথাগুলো উচ্চারণ করলেন)। যদি মেরেই থাকে আমার কন্যাকে মেরেছে। আয়ুষ্মান বেঁচে থাকুক। তা ছাড়া। বাদী-প্রতিবাদী নিয়ে মামলা। আমি প্রতিবাদিনী। তাই বলছি এঁকে ছেড়ে দিন 

শকার— দূর হ গর্ভদাসী! তোর ওকে দিয়ে কী দরকার? 

বিচারক— আর্যে আপনি যান। হে রাজপুরুষেরা, তোমরা এঁকে বাহিরে নিয়ে যাও। 

বৃদ্ধা— হায় বাছা! (কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন) 

শকার— (স্বগত) আমাকে যা করা উচিত ছিল আমিই উল্টো ওকে তাই করলাম। এখন যাই। (প্রস্থান) 

বিচারক— আর্য চারুদত্ত, আমরা শুধু রায় দিতে পারি, বাকিটা নির্ভর করবে রাজার ওপর। তবুও শোধনক রাজা পালককে জানাও— 

ইনি পাপ করেছেন। কিন্তু মনু বলেছেন বিপ্র অবধ্য। তাই অক্ষত ধনসমেত তাকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করা যেতে পারে ॥ ৩৯ ॥ 

শোধনক— আপনার যা আদেশ। 

(নিষ্ক্রান্ত হয়ে আবার প্রবেশ করে। অশ্রুসিক্ত হয়ে) 

রাজা পালক বললেন— তুচ্ছ অর্থের জন্য যে বসন্তসেনাকে হত্যা করেছে ওই গয়নাগুলো তার গলায় বেঁধে দাও এবং ঢেঁড়া পিটিয়ে তাকে দক্ষিণদিকের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে অবমাননাকর দণ্ড[১৫] দাও। 

চারুদত্ত— রাজা পালক কী অবিমৃষ্যকারী! 

অথবা— 

এই রকম বিচারব্যবস্থার অগ্নিতে মন্ত্রীরা নিক্ষেপ করার ফলে রাজারা সঙ্গত কারণেই শোচনীয় অবস্থায় পড়েন ॥ ৪০ 

তাছাড়া— 

যারা সাদা-কাক আছে তা বিশ্বাস করে এবং যারা রাজার প্রশাসন ব্যবস্থাকে দূষিত করে এমন লোকেরা (বিচারকেরা) হাজার হাজার নিষ্পাপকে হত্যা করে এবং করছে ॥ ৪১ ॥ 

বন্ধু মৈত্রেয়, যাও। আমার মাকে আমার শেষপ্রণাম জানাও। আর আমার পুত্র রোহসেনকে পালন করো। 

বিদূষক— মূল ছিন্ন হলে পাদপকে আর কে পালন করবে? 

চারুদত্ত— না, তা বোলো না। 

যারা লোকান্তরিত, পুত্রই তাদের প্রতিনিধি। তাই আমার ওপর তোমার যে প্রীতি ছিল আমার পুত্রকেও তাই দিয়ো ॥ ৪২ ॥ 

বিদূষক— হে বন্ধু, দীর্ঘকাল তোমার প্রিয় বন্ধু হয়ে এখন তোমার বিচ্ছেদে আমি প্রাণধারণ করতে পারব কি? 

চারুদত্ত— রোহসেনকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যাও।

বিদূষক— হ্যাঁ, সেটা ঠিক। 

বিচারক— ভদ্র শোধনক, একে[১৬] সরিয়ে নিয়ে যাও। 

(শোধনক তাই করল) 

বিচারক— এখানে কে আছ? চণ্ডালদের আদেশ দাও। 

(চারুদত্তকে একা রেখে আর সকলের প্রস্থান) 

শোধনক— এদিকে আসুন, আর্য।

চারুদত্ত— (করুণভাবে, ‘হে মৈত্ৰেয়— ৯/২১ ইত্যাদি পাঠ করলেন। আকাশে) আমার বিচারে বিষ, জল, তুলাদণ্ড ও অগ্নিপরীক্ষার প্রার্থনা করার পর সেইভাবে আগে দেখে নিয়ে না হয় আজ আমার দেহে করাত চালানোর আদেশ দিতে। [১৭] কিন্তু (তা না করে যখন) যখন আমার শত্রুর কথার ওপর নির্ভর করেই আমাকে হত্যা করছ তখন পুত্র-পৌত্রদের নিয়ে নরকে যাবে ॥ ৪৩ ॥ 

(সকলের প্রস্থান) 

॥ ‘ব্যবহার’ নামে নবম অঙ্ক সমাপ্ত ॥ 


টীকা

১. পুনরুক্তি শকারের বা বাগ্‌বিভ্ৰম। 

২. নারী যুবতী বা এদের গন্ধর্বের (পুংলিঙ্গ) সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের দুর্ভাবনার কারণ সেই কারণ বক্তা স্বয়ং শকার। 

৩. চুলের মতো ঘটনার গতিকেও শকার ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে চায়! 

৪. সজ্জন বলতে বোঝাচ্ছে সেইসব সদ্বুদ্ধিপরায়ণ উপদেষ্টাদের। সজ্জন হয়েও এঁরা বাদী-প্রতিবাদীর মিথ্যাভাষণাদি দোষ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেন না।

৫. পরপর দুটি শ্লোকই অর্থের দিক থেকে অভিন্ন। এ ধরনের পুনরুক্তি যে রসাপকর্ষক তা বলাই বাহুল্য। 

৬. তুলনীয় : 

বিকারহেতৌ হেতৌ যতি বিক্রিয়ন্তে যেষাং ন চেতাংসি তএব ধীরাঃ (কুমার ১৫৯)

৭. রাজার ক্রোধ থেকে নিজে বাঁচতে যিনি বিচারদক্ষ তিনি ন্যায়পরায়ণ হবেন কী করে? রাজার স্বার্থবিরোধী কোনো ন্যায়কেই তো তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না।

৮. বাশতি— রব-করা অর্থে ‘বাশ্’ ধাতুকে পরস্মৈপদে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাশধাতু আত্মনেপদী : ক্রূরা ধাঙ্ক্ষা ববাশিরে (ভট্ট ১৪, ৭৬) 

প্রতিভয়ং ববাশিরে (রঘু ১১, ৬১) 

তবে বাশং করোতি এক কথায় ‘বাশতি’ এমন হতে পারে। 

৯. উজ্জয়িনীর রাজপথে দিনের বেলায় সাপ উজ্জয়িনীর গৌরব বাড়ায় না বলাই বাহুল্য। কিন্তু নাট্যকার পরস্পর অশুভ সঙ্কেতের একটি প্রদর্শনী সাজাতে গিয়ে সম্ভাব্যতার দিকে চেয়ে দেখেননি। 

১০. তুলনীয় : 

‘সেয়মাকৃতি র্ন বাভিচরতি শীলম্।’— দশকুমারচরিতম্ 

‘যথাকৃতিস্তত্র গুণা বসন্তি।’— বিদ্ধশালভঞ্জিকা 

১১ তুলনীয় : 

ললাটং স্বিদ্যতে চাস্য মুখং বৈবৰ্ণমেতি চ। 
অভিযোগে চ সাক্ষ্যে বা দুষ্টঃ স পরিকীর্তিতঃ ॥ –যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা 

(অভিযোগে বা সাক্ষ্যদানের সময়ে যার কপাল ঘামে ভিজে ওঠে, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় সে দুষ্ট বলে খ্যাত)। 

১২. তুলনীয় : 

উপকারিণি হি বিশ্রদ্ধে শুদ্ধমতৌ যঃ সমাচরতি পাপম্। 
তং জনসত্যসন্ধং ভগবতি বসুধে কতং বহসি।— হিতোপদেশ 

[ নির্মলচিত্ত বিশ্বস্ত উপকারীর সঙ্গে যে পাপাচরণ করে, অয়ি ভগবতি বসুধে! অসত্যসন্ধ সেই মানুষটিকে কেন বহন করছ? ] 

১৩. মাথায় যার কাকপদের মতো ^ চূড়া বাঁধা। (কাকপদ = পরিত্যক্ত বর্ণাদির সূচক-চিহ্ন ‘^’) অথবা কাকের পায়ের মতো কেশবিন্যাস যার মাথায়। 

১৪. তুলনীয় : 

উপপ্লবায় লোকানং ধূমকেতুরিবোথিতঃ।— কুমারসম্ভব 

(লোকেদের দুর্বিপাকের জন্যে ধূমকেতুর মতো উদিত)। 

১৫. ‘নিকার’ কথাটির অর্থ চরম অবমাননা, এখানে ‘অঙ্গচ্ছেদ-দণ্ড’ অর্থে প্রযুক্ত। 

১৬. ব্রাহ্মণার্থক ‘বটু’ প্রায়ই অবজ্ঞার্থে ব্যবহার হয়! 

১৭. এগুলো নির্দোষিতা প্রমাণের বিভিন্ন পরীক্ষা। 

তুলনীয় : 

তুলাগ্ল্যাপো বিষং কোশো দিব্যানীহ বিশুদ্ধয়ে। 
মহাভিযোগেম্বেতানি শীর্ষকস্থেহপি যোক্তরি ॥ যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা ২.৯৫ 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন