জ্যোতিভূষণ চাকী
মৃচ্ছকটিক – দ্বিতীয় অঙ্ক
(প্রবেশ করে)
চেটী— মা আমাকে (বিশেষ) সংবাদ দিয়ে আর্যার কাছে পাঠিয়েছেন। তাই প্রবেশ করে তাঁর কাছে যাই। (পরিক্রমা করে দেখেন) এই যে আর্যা বসে আছেন। মনে মনে কী যেন ভাবছেন। যাই এগিয়ে যাই।
(তারপর আসনস্থা উৎকণ্ঠিতা বসন্তসেনা ও মদনিকার প্রবেশ)
বসন্তসেনা— চেটী, তার পর?
মদনিকা— আর্যে, আপনি তো কিছুই বলছেন না, তবে আর ‘তারপর’ এ কথা জিগ্যেস করছেন কেন?
বসন্তসেনা— আমি কী বলেছি?
চেটী— ‘তার পর’।
বসন্তসেনা— (ভ্রুকুঞ্চন করে) ও তাই তো।
( এগিয়ে এসে )
প্রথমা চেটী–মা আদেশ করছেন স্নান সেরে আপনি দেবতার পুজোয় বসুন।
বসন্তসেনা—চেটী, গিয়ে মাকে বল্ আমি আজ স্নান করব না। বামুনমশাই পুজো করুন।
চেটী— আর্যা, যা আদেশ করেন।
মদনিকা—আর্যে, দোষদর্শিতা[১] নয়, স্নেহই আমাকে জিগ্যেস করতে বাধ্য করছে। বলুন তো ব্যাপার কী?
বসন্তসেনা— মদনিকা! আমাকে কেমন দেখছিস বল্ তো?
মদনিকা— আপনার অন্যমনস্কতা দেখে বুঝছি হৃদয়গত কাউকে আপনি কামনা করছেন।
বসন্তসেনা— তুই ঠিক ধরেছিস। পরের হৃদয়বোধে নিপুণা তুই যে মদনিকা।
মদনিকা— কী আনন্দ আমার, কী আনন্দ। তরুণজনের মহোৎসব কামদেবকেই আপনি অনুগৃহীত করলেন। তাহলে এবারে আর্যা বলুন, তিনি রাজা না রাজার প্রিয় কেউ, যাকে সেবা করবেন আপনি!
বসন্তসেনা— সেবা করতে চাইনে আমি, চাই আনন্দনিবিড় হতে।[২]
মদনিকা— আপনি কি বিদ্যাবিশেষে অলঙ্কৃত কোনো ব্রাহ্মণ যুবককে কামনা করছেন?
বসন্তসেনা— ব্রাহ্মণ আমার পূজনীয়।
মদনিকা— তবে কি এমন কোনো বণিকযুবা আপনার অভিলষিত যে বহু নগরে গিয়ে প্রচুর ধন অর্জন করেছে?
বসন্তসেনা—ওলো, গভীর প্রেমবদ্ধ প্রণয়ীজনকে পরিত্যাগ করে বণিকজন প্রবল বিরহবেদনা সৃষ্টি করে।
মদনিকা— আর্যে, তিনি রাজা নন, রাজবল্লভ নন, ব্রাহ্মণ নন, বণিকও নন। তাহলে আপনি কাকে কামনা করছেন?
বসন্তসেনা— ওলো, তুই আমার সঙ্গে কামদেবায়তন-উদ্যানে গিয়েছিলি।
মদনিকা— হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।
বসন্তসেনা— তবুও কিছুই জানিস না এইভাবে আমাকে জিগ্যেস করছিস?
মদনিকা— বুঝেছি। তিনিই কি? আপনি আশ্রয় চাইলে যিনি অনুগ্রহ করেছিলেন? বসন্তসেনা— তাঁর নাম কী?
মদনিকা— তিনি তো বণিক্-চটিতে বাস করেন।
বসন্তসেনা— ওলো, আমি নাম জিগ্যেস করেছি।
মদনিকা— আর্যে, তিনি হলেন সার্থকনামা শ্রদ্ধেয় চারুদত্ত।
বসন্তসেনা— (সহর্যে) সাবাস মদনিকা সাবাস। তুই ঠিক জেনেছিস।
মদনিকা— (স্বগত) এখন এইভাবে বলি। (প্রকাশ্যে) আর্যে, তিনি তো দরিদ্র একথা সবাই বলে।
বসন্তসেনা— এই জন্যেই তো চাই তাঁকে। দরিদ্র আসক্তা বলে গণিকাদের অখ্যাতি ঘুচে যায়।
মদনিকা— আর্যে, মধুকরীরা কি হীনপুষ্প আম্রতরুর সেবা করে?
বসন্তসেনা— এই জন্যেই তো তাদের মধুকরী বলে।
মদনিকা— আর্যে, তিনি যদি আপনার অভিলসিতই হন তাহলে অবিলম্বে অভিসারে যাচ্ছেন না কেন?
বসন্তসেনা—চেটী, হঠাৎ অভিসারে গেলে, যথাযোগ্য প্রতিদান দিতে না পেরে, তিনি হয়তো আর দেখাই দেবেন না। আমি এই ব্যাপারটাই এড়াতে চাচ্ছি।
মদনিকা— এই জন্যেই কি আপনি তার হাতে গয়নাগুলো গচ্ছিত রাখলেন?
বসন্তসেনা— ওলো, তুই ঠিক ধরেছিস।
(নেপথ্যে )
কর্তা, দশমোহরের পণে বদ্ধ এই জুয়াড়িটি পালিয়ে যাচ্ছে। ধর্, ধর্। দূর থেকে তোকে দেখছি কিন্তু।
(পর্দা নাড়িয়ে প্রবেশ করে, উত্তেজিতভাবে)
সংবাহক– আশ্চর্য, জুয়াড়িদের অবস্থাটা সত্যিই বেদনাদায়ক। নববন্ধন থেকে মুক্ত গর্দভীর মতো গর্দভী৩ (জুয়ার কড়ি) আমাকে তাড়না করেছে, কর্ণনিক্ষিপ্ত শক্তি (একঘ্নী) যেমন ঘটোৎকচকে তাড়না করেছিল[৪], আমাকেও তেমনি শক্তি[৫] (জুয়ার চাল বিশেষ) তাড়না করছে ॥ ১ ॥ জুয়াড়িদের সর্দার[৬] লেখার কাজে ব্যস্ত দেখে দ্রুত পালিয়ে পথে এসে পড়েছি।
এখন কার শরণ নেব? ॥ ২ ॥
এখন জুয়াড়িসর্দার আর জুয়াড়ি আমাকে খুঁজতে থাকুক, ইতিমধ্যে আমি উল্টো পায়ে শূন্য মন্দিরে ঢুকে দেবীমূর্তি বনে যাই।
(নানারকম অভিনয় করে সেইভাবে থাকল। )
(তারপর মাথুর এবং জুয়াড়ীর প্রবেশ)
মাথুর— কর্তা! দশ মোহরের পণে বাঁধা জুয়াড়ি পালাল, পালাল। ধর্, ধর্। দাঁড়া, দাঁড়া। দূর থেকে দেখতে পেয়েছি তোকে।
জুয়াড়ি— যদি এখন পাতালেও যাস, বা ইন্দ্রকেও শরণ নিস, সভিক (জুয়াড়িসর্দার) ছাড়া শিবও তোকে বাঁচাতে পারবেন না।।৩।।
মাথুর— ওরে শোন্, সহজ সরল জুয়াড়িসর্দারকে ঠকিয়ে ভয়ে-কাঁপা দেহ নিয়ে উঁচু-নিচু মাটিতে পায়ে পায়ে হোঁচট খেতে খেতে, কুল ও মানকে অত্যন্ত কলঙ্কিত করে কোন চুলোয় পালাচ্ছিস্?
জুয়াড়ি— (পায়ের চিহ্ন দেখে) এই যাচ্ছে। এই পায়ের চিহ্ন মিলিয়ে গেল।
মাথুর— (দেখে, চিন্তা করে) এ কী উল্টোদিকে পায়ের ছাপ দেখছি! প্ৰতিমাশূন্য মন্দির। (চিন্তা করে) ধূর্ত জুয়াড়ি উল্টো পদক্ষেপে মন্দিরে ঢুকেছে।
জুয়াড়ি— অনুসরণ করি তাহলে।
মাথুর— তাই করি।
(দুজনে মন্দিরে প্রবেশ করেছে এমন অভিনয় করে, পরস্পরকে ইঙ্গিত করে)
জুয়াড়ি— এ কী! কাঠের প্রতিমা দেখছি।
মাথুর—ওরে, না না। পাথরের প্রতিমা। (নানাভাবে নাড়া দিয়ে ইঙ্গিত করে) ঠিক আছে। এসো। পাশা খেলা যাক।
সংবাহক— (পাশাখেলায় ইচ্ছাজনিত বিকার সংবরণ করে মনে মনে) ওরে—
পাশার ছকে পড়ার শব্দ কপর্দকহীন মানুষের মন হরণ করে, ঢাকের শব্দ যেমন ভ্রষ্ট-রাজ্য রাজার মন হরণ করে তেমনি ॥ ৫ ॥
জানি সুমেরুচূড়া থেকে লাফিয়ে পড়ার মতো এই জুয়াখেলা আর আমি খেলব না। তবু কোকিলের (রবের) মতো মধুর এই পাশার দান দেবার শব্দ আমার মন হরণ করছে[৭] ॥ ৬॥
জুয়াড়ি— আমার দান। আমার দান।
মাথুর— না না। আমার দান। আমার দান।
সংবাহক— (অন্যখান থেকে হঠাৎ এসে) আমার দান।
জুয়াড়ি—পেয়েছি মানুষটাকে।
মাথুর— এখনই দাও।
সংবাহক— দেব। অনুগ্রহ করুন।
মাথুর—ওরে, এখনই দে।
সংবাহক— আমার মাথা ঘুরছে। (মাটিতে পড়ে গেল)
(দুজনে তাকে মারতে লাগল)
মাথুর— জুয়াড়িচক্রের নামে তোকে বাঁধছি।
সংবাহক— (উঠে সবিষাদে) কী, জুয়াড়িচক্রের নামে বদ্ধ হচ্ছি। হায়! এটা জুয়াড়িদের এমন এক নিয়ম যা লঙ্ঘন করা যায় না। কিন্তু দেব কোত্থেকে?
মাথুর— অঙ্গীকার কর, অঙ্গীকার।
সংবাহক— তাই করি। (জুয়াড়িকে স্পর্শ করে) তোমাকে অর্ধেকটা দেব, অর্ধেকটা ছেড়ে দাও।
জুয়াড়ি— তাই হোক।
সংবাহক— (সভিকের কাছে এসে) অর্ধেকটা প্রতিশ্রুতি দিলাম, অর্ধেকটা ছেড়ে দিন।
মাথুর— বেশ, তাই হোক।
সংবাহক— আর্য, অর্ধেক আপনি ছাড়লেন?
মাথুর— ছাড়লাম।
সংবাহক— (জুয়াড়ির প্রতি) আপনিও অর্ধেকটা ছেড়েছেন?
মাথুর— ছাড়লাম।
সংবাহক— এখন তাহলে যাই?
মাথুর— সেই দশটি মোহর দাও। কোথায় যাচ্ছ?
সংবাহক— দেখুন দেখুন মশাইরা, দেখুন। এই এক্ষুণি আমি অর্ধেকটার জন্যে প্রতিশ্রুতি দিলাম, বাকি অর্ধেক মকুব করা হল। তবুও ইনি এক্ষুনি তা আমার কাছে চাচ্ছেন। যা আমি দিতে অক্ষম।
মাথুর— (ধরে) ওরে ধূর্ত! আমি মাথুর। বোকা নই। আমাকে এভাবে ঠকানো যাবে না। পণের দশটি মোহর এক্ষুনি দে।
সংবাহক— কোত্থেকে দেব?
মাথুর— তোর বাপকে বেচে শোধ দে।
সংবাহক— আমার বাপ কোথায়?
মাথুর—মা-কে বেচে শোধ দে।
সংবাহক— আমার মা কোথায়?
মাথুর— নিজেকে বিক্রি করে শোধ দে।
সংবাহক– অনুগ্রহ করুন। আমাকে রাজপথে নিয়ে চলুন।
মাথুর— এসো দেখি।
সংবাহক— তাই হোক।
(পরিক্রমা করল) মশাইরা, দশটি মোহর দিয়ে আমাকে এই জুয়ার সর্দারদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিন। (— দেখে, শূন্যে তাকিয়ে) কী বলছেন? কী— করতে পার? আমি আপনার বাড়ির চাকর হতে পারি। এ কী? উত্তর না দিয়েই চলে গেলেন যে! আর একজনকে বলি। (আবার একই কথা বলল।) ইনিও আমাকে অবজ্ঞা করেই চলে গেলেন। হায় চারুদত্তের অবস্থা পড়ে যাওয়ায় আমার এই দশা হয়েছে।
মাথুর—দাও বলছি।
সংবাহক—কোত্থেকে দেব? (পড়ে গেল)
(মাথুর টানতে লাগল)
সংবাহক– মশাইরা, রক্ষা করুন, রক্ষা করুণ।
(দর্দুরকের প্রবেশ)
দর্দুরক— জুয়া হল পুরুষের কাছে সিংহাসনহীন রাজ্য।
রাজার মতো জুয়াড়ি কারো কাছ থেকে পরাজয়কে তুচ্ছ করে, সবসময় টাকা নেয় আর দেয়, আর ভালো টাকার সুখ দেখলে তাকে ধনীরাও খাতির করে।।৭।।
তাছাড়া—
জুয়াতেই পাওয়া যায় টাকা, জুয়াতেই পাওয়া যায় স্ত্রী ও বন্ধু। দান ও ভোগ সম্ভবপর হয় জুয়ারই দৌলতে। আর সমস্ত নষ্ট হয় জুয়ারই ফলে ॥ ৮ ॥
তাছাড়া–
‘ত্রেতা’৮ চালে সব হারলাম। ‘পাবরে’রণ ভুল দানে শরীরটা গেল শুকিয়ে ‘নর্দিত’[১০] আমাকে পথে বের করল। আর ‘কট’[১১] আমার সর্বনাশ করে ছাড়ল ॥ ৯ ॥
(সামনে তাকিয়ে) আমাদের আগেকার জুয়াড়িসর্দার মাথুর এই দিকেই আসছে। একে এড়াবার আর উপায় নেই। নিজেকে অবগুণ্ঠিত করি।
(নানাভাবে অভিনয় করে দাঁড়িয়ে রইল। চাদর দেখে।)
এই পরিচ্ছদটির সুতো বেশিরভাগই নেই। শতছিদ্রে অলঙ্কৃত এটি। এই পরিচ্ছদটি পরিধানের অযোগ্য। ভাঁজ করে রাখলেই এটি ভালো দেখায় ॥১০।। এ লোকটা করবেই-বা কী?
আমি তো এক পা শূন্যে আর এক পা মাটিতে রেখে যতক্ষণ রোদ ততক্ষণ থাকতে পারি।
মাথুর— দাও, দাও।
সংবাহক— দেব কী করে?
মাথুর— (টানতে লাগল )
দর্দুরক—একি! সামনে কী? (আকাশে) কী বললেন?
এই জুয়াড়িকে সর্দার নির্যাতন করছে, কিন্তু একে ছাড়াবার কেউ নেই? এই দর্দুরকই তাকে ছাড়াবে! (এগিয়ে এসে)। সরে যাও সরে যাও। (দেখে) এই সেই ধূর্ত মাথুর, আর এই বেচারা সংবাহক! যে সারাদিন নিশ্চলভাবে মাথা ঝুলিয়ে থাকে না। (হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে) যার পিঠে ইট পাটকেলে ছড়ে যাওয়ার দাগ নেই, আর যার ঊরুর ভেতরটা লেলিয়ে দেওয়া কুকুর খাবলে খায় না।[১২] অতি দীর্ঘ এবং কোমল সেই মানুষটি সর্বদা জুয়ায় মেতে থাকে যেন ॥১২।।
যা হোক মাথুরকে শান্ত করি। (এগিয়ে কাছে এসে)। মাথুর, আমি অভিবাদন করছি।
মাথুর— (প্রত্যভিবাদন করল)
দর্দুরক— ব্যাপার কী?
মাথুর— এই লোকটি দশ মোহর ধারে।
দর্দুরক— এ তো সামান্য টাকা।[১৩]
মাথুর— (দর্দুরকের বগল থেকে চাদরটা টেনে বের করে) দেখুন মশাইরা, দেখুন। যার গায়ে ছেঁড়া ত্যানা সে কিনা দশ মোহরকে বলছে সামান্য টাকা!
দর্দুরক— ওরে মূর্খ! আমি একটা যা ‘কটে’র চালেই দশ মোহর দিতে পারি। যার আছে সে কি তা কোলে বয়ে দেখায়?
ওরে, তুই নীচ কুলে জন্মেছিস, নিপাত যাবি তুই। দশ মোহরের জন্যে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মানুষকে মেরে ফেলছিস তুই ॥ ১৩ ॥
মাথুর— মশাই আপনার কাছে এই দশ মোহর তুচ্ছ হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা অনেক ধন।
দর্দুরক— যদি তাই হয় তবে শোনো। একেই আরও দশ মোহর দাও। ওদের সঙ্গে খেলুক সে।
মাথুর— কী হবে তাতে?
দর্দুরক— যদি জেতে তবে দেবে।
মাথুর— যদি না জেতে?
দর্দুরক— তাহলে দেবে না।
মাথুর— এভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না। ধূর্ত, একথা যখন বলছ তুমিই দাও তাহলে। নামকরা জুয়াড়ি আমি মাথুর শুধু শুধুই জুয়া খেলি? আমি কাউকে ভয় করি না। ধূর্ত, তুমি বেইমান।
দর্দুরক— কী বললি, কে বেইমান?
মাথুর— তুই।
দর্দুরক— তোর বাপ।
মাথুর— খানকির বেটা, এইভাবেই জুয়া খেলেছিস তুই?
দর্দুরক— হ্যাঁ, এইভাবেই খেলেছি।
মাথুর— ওরে সংবাহক, দশ মোহর দে।
সংবাহক— আজই দেব। এখনই দেব। (মাথুর টানছে)
দর্দুরক— মূর্খ, আমার চোখের আড়ালে তুই একে হেনস্তা করতে পারিস। চোখের সামনে নয়।
(মাথুর সংবাহককে টানতে টানতে নাকে ঘুষি মারল। দর্পরক এগিয়ে এসে বাধা দিল। মাথুর দর্দুরককে আঘাত করল, দর্পরক প্রত্যাঘাত করল)
মাথুর— ওরে খানকির বাচ্চা, ফল পাবি I
দর্দুরক— ওরে তুই আমাকে (আজ) রাস্তায় মারলি। কিন্তু কাল যদি রাজকুলে মারতিস তাহলে দেখাতাম।
মাথুর— আমি দেখতে রাজি।
দর্দুরক— দেখাবি কী করে?
মাথুর— (চোখ বড়ো করে, এইভাবে দেখাব )
(দদুরক মাথুরের চোখে ধুলো ছুড়ে সংবাহককে পালাতে ইশারা করল। মাথুর চোখ বন্ধ করে মাটিতে পড়ে গেল। সংবাহক পালাল।)
দর্দুরক— (স্বগত) প্রধান জুয়াড়িসর্দারকে শত্রু করলাম। তাই এখানে আর থাকা উচিত নয়। আমার প্রিয়বন্ধু শর্বিলক বলেছে, আর্যক নামে এক গোয়ালার ছেলে কাল রাজা হবে— সিদ্ধাচার্যেরা এমন ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। আমার সঙ্গে আর সকলে তাকেই অনুসরণ করছে। আমিও তার কাছেই যাই।
(নিষ্ক্রান্ত)
সংবাহক— (সভয়ে পরিক্রমা করে এবং দেখে) এই যে পাশ-দরজা খোলা কার-বা বাড়ি, এখানেই ঢুকে পড়ি। (প্রবেশ অভিনয় করে। বসন্তসেনাকে দেখে আর্যে, আমি শরণাগত।
বসন্তসেনা— শরণাগতকে অভয় দিচ্ছি। চেটী পাশদরজা বন্ধ করো।
বসন্তসেনা— কাকে ভয় তোমার?
সংবাহক— পাওনাদারকে।
(চেটী তাই করল)
বসন্তসেনা— চেটী, পাশদরজা খুলে দাও এখন।
সংবাহক— (স্বগত) পাওনাদারকে ভয় ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখলেন ইনি। ঠিকই বলা হয় যে মানুষ নিজের শক্তি বুঝে ভার নেয়, তার কখনও স্খলন হয় না, বনে গেলেও সে বিপন্ন হয় না ॥ ১৫ ॥
এই সত্যের প্রমাণ আমি নিজেই।
মাথুর— (চোখ পরিষ্কার করে, জুয়াড়িকে) ওরে, দে, দে।
জুয়াড়ি— কত্তা, আমরা যখন দর্দুরকের সঙ্গে ঝগড়া করছিলাম সেই সময়ে সে পালিয়েছে।
মাথুর— ঘুষিতে সেই জুয়াড়ির নাক ভেঙেছে। তাই এসো, রক্তের অনুসরণ করি।
(রক্ত অনুসরণ করে)
জুয়াড়ি— কত্তা, বসন্তসেনার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।
মাথুর— তাহলে আমাদের দশ মোহর খোয়াতেই হল।
জুয়াড়ি— চলুন, রাজকুলে নালিশ করি গিয়ে।
মাথুর— এই ধূর্ত বেরিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। তাই পথ আগলেই ধরতে হবে ওকে।
বসন্তসেনা— (মদনিকাকে ইঙ্গিত করল)
মদনিকা— আপনি এলেন কোথা থেকে? কে আপনি? কার সেবক আপনি? আপনার বৃত্তি কী? আপনার কাকেই-বা ভয়?
সংবাহক— শুনুন আর্যা, পাটলিপুত্রে আমার জন্মভূমি। গ্রামের মোড়লের ছেলে আমি। আমার বৃত্তি সংবাহকের।
বসন্তসেনা— আর্য একটি সুকুমার কলা শিক্ষা করেছেন।
সংবাহক— আর্যে, কলা হিসেবেই শিখেছিলাম, কিন্তু এখন এটা আমার পেশা।
চেটী— একটু বিষণ্ন উত্তরই আপনি দিলেন বলব। তারপর— ‘আর্যে, তারপর, বাড়িতে বসে পর্যটকদের মুখে (এই দেশ সম্বন্ধে) শুনে এই দেশটি দেখতে এলাম। এখানে উজ্জয়িনীতে এসে আমি এক সজ্জন ব্যক্তির সেবা করলাম। তিনি সুদর্শন ও প্রিয়ভাষী, দিয়ে কখনও বলেন না, অপকার করলে তা ভুলে যান, বেশি বলে আর কী হবে? ঔদার্যে তিনি পরকেও আপন বলে মনে করেন, এবং যে তার শরণ নেয় তিনি তাঁর প্রতি সদয় হন।
চেটী— আর্যার অন্তরে যিনি আছেন তাঁর গুণ চুরি করে উজ্জয়িনীকে অলঙ্কৃত করছেন?
বসন্তসেনা— ঠিক বলেছ চেটী, ঠিক বলেছ। আমিও মনে মনে একথা ভাবছিলাম।
চেটী— আর্য! তারপর!
সংবাহক— দয়া করে তিনি যে বিপুল দান করতেন তাতেই—
বসন্তসেনা— তাতেই তাঁর ভগ্নদশা?
সংবাহক— যা বললেন, আর্যা জানলেন কী করে?
বসন্তসেনা— জানবার কী আছে? গুণ আর বিভব একত্র দুর্লভ। সেইসব পুকুরই জলে ভর্তি যাদের জল পানের অযোগ্য।
চেটী– আর্য! তাঁর নাম কী?
সংবাহক— আর্যে, কে সেই ধরিত্রীর শশাঙ্কের নাম না জানে। তিনি পুণ্যনাম শ্রদ্ধেয় চারুদত্ত।
বসন্তসেনা— (সহর্ষে আসন থেকে নেমে) এ গৃহ আপনার নিজের বলে জানবেন। চেটী এঁকে আসন দাও। শ্রমে ক্লান্ত ইনি।
(চেটী তাই করল)
সংবাহক— (স্বগত) এ কী! শুধু আর্য চারুদত্তের নাম করতেই এমন আদর? ধন্য চারুদত্ত ধন্য। পৃথিবীতে শুধু তুমিই বেঁচে আছ। আর সবই শুধু শ্বাস নেয় মাত্র।
(বসন্তসেনার পায়ে পড়ে) না, না, আর্যা আপনি বসুন আসনে।
বসন্তসেনা— (আসনে বসে) আর্য, তিনি ধনী (হতে পারেন) কী করে?
সংবাহক— সজ্জনের সম্পদই হল অতিথিপরায়ণতা, ক্ষণস্থায়ী সম্পদ নেই কার? যে অন্যের সম্মান দিতে জানে বিশেষ সম্মানও সে জানে (পায়) ॥ ১৫ ॥
বসন্তসেনা— তারপর?
সংবাহক— তারপর তিনি আমাকে সবেতনে পরিচারক হিসেবে রাখলেন। যখন তাঁর শুধু সুনামটুকুই সার তখন আমি বৃত্তিহিসেবে জুয়াকেই বেছে নিলাম। তারপর দুর্ভাগ্যক্রমে জুয়ায় আমি দশ মোহর হেরেছি।
মাথুর— আমার সর্বনাশ হল, আমার সব লুট হল।
সংবাহক— এই ওরা দুজন— সর্দার আর জুয়াড়ি। আমাকে খুঁজছে ওরা। সব শুনে এখন আপনি যা করার করুন।
বসন্তসেনা— মদনিকা, পাখিরা যে গাছে বসে সে গাছ যখন জীর্ণ হয়ে পড়ে তখন তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। চেটী, তুই গিয়ে সর্দার আর জুয়াড়িকে এই বালাটা দিয়ে বলবি ইনিই (সংবাহকই) দিলেন।
(তিনি হাত থেকে অলঙ্কার খুলে চেটীকে দিলেন)
চেটী— (গ্রহণ করে) আপনি যা বলেন। (নিষ্ক্রান্ত )
মাথুর— আমার সর্বনাশ হল, আমার সব লুট হল!
চেটী— এরা দুজন যেভাবে উঁচু দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, ভাবছে এবং দরজার দিকে তাকিয়ে যেভাবে কথা বলছে তাতে মনে হচ্ছে এরা দুজনেই সেই সর্দার আর জুয়াড়ি। (কাছে এসে) আর্য, নমস্কার।
মাথুর— সুখী হও।
চেটী— আর্য, আপনাদের মধ্যে সর্দার কে?
মাথুর— হে তনুমধ্যা! কটাক্ষে দৃষ্টিপাত করে রতিরঙ্গে দষ্ট অধরে উচ্চারিত মধুরবচনে (আমাদের) কার সঙ্গে কথা বলছ? আমার অর্থ নেই, অন্যের কাছে যাও।
চেটী— এভাবে কথা বলছ যখন তখন তুমি জুয়াড়ি হতে পার না। তোমার কাছে টাকা ধারে এমন কেউ আছে কি?
মাথুর— হ্যাঁ আছে। সে আমার কাছে দশ মোহর ধারে। তার কথা কেন?
চেটী— তার জন্যে আর্য এই হাতের গয়নাটি দিয়েছে। না, না, তিনিই দিয়েছেন।
মাথুর— (সহর্ষে গ্রহণ করে)। তুমি সেই কুলীনের পোকে গিয়ে বলবে তোমার ঋণশোধ। এসো আবার জুয়া খেলো। (নিষ্ক্রান্ত)
চেটী— (বসন্তসেনার কাছে এসে) আর্যে, সর্দার আর জুয়াড়ি সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছে।
বসন্তসেনা— তাহলে আর্য, এবার আপনি গিয়ে আপনার স্বজনদের আশ্বস্ত করুন।
সংবাহক— আপনি বললে আপনার পরিচারিকাকে এই কলা[২০] শিখিয়ে যেতে পারি
বসন্তসেনা— আর্য! যাঁর জন্যে আপনি এই কলা শিখেছেন, যাকে আগে সেবা করেছেন, তাঁকেই সেবা করুন।
সংবাহক— (স্বগত) আর্যা নিপুণভাবে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। (প্রকাশ্যে) আর্যে, এই জুয়াড়ি হবার অবমাননায় বিরক্ত হয়ে আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু হব। আপনি এ কথাগুলো মনে রাখবেন।
বসন্তসেনা— আর্যে, হঠাৎ কিছু করবেন না।
সংবাহক— আর্যে, আমি সংকল্প করেছি।
(পরিক্রমা করে)
জুয়া আমাকে এমন অবস্থায় এনেছিল যাতে আমি সকলের সামনে অপমানিত হয়েছি। এখন আমি রাজপথে মাথা উঁচু করে চলব ॥ ১৭ ॥
(নেপথ্যে কলরব)
সংবাহক— (শুনে) ব্যাপার কী? (আকাশে) কী বলছ? বসন্তসেনার খুন্টমোডক[২১] নামে দুষ্ট হাতিটি বেরিয়ে পড়েছে। ও, তাহলে আমি গিয়ে আপনার গন্ধ-গজ দেখব। অথবা আমার এতে কী এসে যায়? আমি বরং যা সংকল্প করেছি তাই করব।
(প্রস্থান)
(তারপর পর্দা নাড়িয়ে জমকালো পোশাকপরা আনন্দিত কর্ণপূরকের প্রবেশ কর্ণপূরক— আর্যা কোথায়?
চেটী— তোমার এমন কী উত্তেজনার কারণ যে সামনেই উপবিষ্টা আর্যাকে দেখতে পাচ্ছ না?
কর্ণপূরক— (দেখে) আর্যে, প্রণাম।
বসন্তসেনা— তোমার মুখ দেখে তোমাকে খুব খুশি মনে হচ্ছে! ব্যাপার কী?
কর্ণপুরক– (সবিস্ময়ে) আর্যে, আজ কর্ণপুরকের পরাক্রম আপনি দেখলেন না, বঞ্চিতই হলেন বলব।
বসন্তসেনা— কর্ণপূরক, কী কী?
কর্ণপূরক— শুনুন আর্যে, আপনার খুন্টমোডক নামে দুষ্ট হাতিটি আজ বন্ধনস্তম্ভ ভেঙে মহামাত্রকে নিহত করে ভীষণ সংক্ষোভ সৃষ্টি করে রাজপথে বেরিয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে লোকেরা চিৎকার করে উঠল—
শিশুদের সরাও, শিগগিরই গাছে বা বাড়ির ছাদে ওঠো। দেখছ না ওই দুষ্ট হাতিটা এইদিকেই আসছে?
তা ছাড়া—
পায়ের নূপুরদুটি পথে পড়েছে। রত্নখচিত মেখলা ভেঙে গেছে। ছোট ছোট মণিতে গাঁথা সুন্দরতর বলয়গুলোরও সেই দশা ॥ ১৯ ॥
তারপর সেই দুষ্ট হাতিটা একটা বৌদ্ধ ভিক্ষুর উপর এসে পড়ল— উজ্জয়িনীনগরী দিয়ে ধাবমান হাতিটিকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন শুঁড়, পা আর দাঁত দিয়ে প্রস্ফুটিত-পদ্ম কোনো সরোবরে সাঁতরে চলেছে। ভিক্ষুকে দেখে সে তার দিকে জলকণা ছিটিয়ে দিল। ভয়ে তার হাত থেকে দণ্ড, পাত্র ও কমণ্ডলু আগেই পড়ে গিয়েছিল। তাকে সে দুই দাঁতের মধ্যে উপরে তুলে নিল দেখে লোকেরা আবার চিৎকার করে উঠল— হা! ভিক্ষুটি নিহত হতে চলেছে।’
বসন্তসেনা— (সসম্ভ্রমে) হায় কী সর্বনাশ, কী সর্বনাশ!
কর্ণপূরক— বিচলিত হবেন না। শুনুন, আর্যে, ঝুলন্ত ভাঙা শিকলের মালা বয়ে ছুটছিল সে, ভিক্ষুকে তুলে ধরেছিল দুই দাঁতের ফাঁকে— এই অবস্থায় হাতিটাকে দেখে আমি কর্ণপূরক— না, না, আপনার অন্নদাস— এঁকেবেঁকে এগিয়ে সেই জুয়াড়িকে (ভিক্ষুকে) চিৎকার করে ডেকে, একটা দোকান থেকে লোহার দণ্ড নিয়ে সেই দুষ্ট হাতিটাকে? দৃ আহ্বান করলাম।
বসন্তসেনা— তারপর?
কর্ণপূরক— বিন্ধ্যপর্বতের চূড়ার মতো সেই ক্রুদ্ধ হাতিটাকে আঘাত করে দুই দাঁতের মধ্যে ঝুলন্ত ভিক্ষুকে মুক্ত করলাম ॥ ২০।।
বসন্তসেনা— তুমি খুব ভালো কাজ করেছ, তারপর?
কর্ণপূরক— তারপর অসমভাবে ভার-চাপানো নৌকোর মতো সমস্ত উজ্জয়িনী এক দিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, সাবাস কর্ণপূরক সাবাস! তারপর আর্যে, একজন মানুষ তার অলঙ্কারের শূন্য স্থানগুলো স্পর্শ করে শূন্যে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই চাদরটি আমার উপর ছুড়ে দিলেন।
বসন্তসেনা— কর্ণপূরক, দেখ তো ওই চাদরে যুঁইফুলের গন্ধ আছে কিনা
কর্ণপূরক— হাতির মদগন্ধে[২০] কিসের গন্ধ তা ধরতে পারছি না।
বসন্তসেনা— কোনো নাম আছে কিনা দেখেছ?
কর্ণপূরক— হ্যাঁ, নাম আছে বটে। আপনিই পড়ুন।
বসন্তসেনা— আর্য চারুদত্তের।
(চাদরটা তাঁকে দিল)
চেটী— কর্ণপূরক, এই চাদরটিতে আমাদের আর্যাকে বেশ মানিয়েছে।
কর্ণপূরক— হ্যাঁ, মানিয়েছে বটে।
বসন্তসেনা— কর্ণপূরক, এই তোমার পারিতোষিক। (অলঙ্কার দিলেন)
কর্ণপূরক— (মাথায় করে নিয়ে এবং প্রণাম করে) সত্যিই এখন চাদরটিতে আপনাকে চমৎকার মানিয়েছে।
বসন্তসেনা– আর্য চারুদত্ত এখন কোথায় থাকতে পারেন জানো?
কর্ণপূরক— এই পথেই তিনি বাড়ি রওনা হয়েছিলেন।
বসন্তসেনা— চেটী, উপরের অলিন্দে উঠে আর্য চারুদত্তকে দেখি চলো।
(সকলের প্রস্থান)
॥ দ্যূতকরসংবাহক-নামে দ্বিতীয় অঙ্ক সমাপ্ত ॥
—
টীকা
১. মূলের ‘পুরোভাগিতা’ শব্দের দুটি অর্থ সম্ভব : ১. প্রগল্ভতা ২. দোষদর্শিতা। আমরা দ্বিতীয় অর্থটি নিয়েছি। মালতীমাধবে (১.২০) পুরোভাগে শব্দটি দোষদর্শী অর্থে গৃহীত : ‘প্রায়ঃ সমানবিদ্যা পরস্পর পুরোভাগাঃ।
২. ‘আর্থিকতা’ অতিক্রম করে তাঁর সঙ্গসুখ অনুভবই প্রণয়িনী বসন্তসেনার উদ্দেশ্য। ‘রন্তুম্’ কথাটির এই তাৎপর্য।
‘ওলো, আমি প্রেম করিতে চাই। (দেহ দিয়া) সেবা করিতে চাই না’– ড. সুকুমার সেন, ভারতীয় সাহিত্যের ইতিকথা।
কেউ কেউ বলেন ‘রন্তুমিচ্ছামি থেকে ভর্তৃদারিকা কাম্যতে’ পর্যন্ত পাঠ প্রক্ষিপ্ত। তাঁদের মতে কোনো নারী নিজের কাম-ভাব ওই ভাষায় (‘রভুমিচ্ছামি’) প্রকাশ করে না। তাঁদের মতে ‘রন্তুম্’ কথাটির অর্থ ‘রতিরঙ্গে মাততে চাই’।
৩. গর্দভী— অর্থ : অর্থ ১. রাসভী ২. ওই নামের জুয়াখেলার কড়ি। ড. সুকুমার সেন বলেন ‘দ্বিতীয় গন্দহীএ’ পদটির মানে করা হয় ‘জুয়ার কড়ি’। এ অর্থ সঙ্গত নয়। বাংলা ‘ঘাড়’ তুলনীয়। –ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস।
৪-৫. শক্তি— অর্থ : ১. ওই নামের অস্ত্র ২. ওই নামের জুয়াখেলার কড়ি।
রাক্ষসী হিড়িম্বার গর্ভজাতা ভীমপুত্র ঘটোৎকচ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীম পরাক্রমে যুদ্ধ করে, বহু শত্রু বিনাশ করে। এর মায়াযুদ্ধ ও অমিতবীর্যে বিপক্ষদল আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে ঘটোৎকচের পরাক্রম সহ্য করতে না পেরে কৌরবদের কাতর অনুরোধে কর্ণ অর্জুনবধের জন্যে রক্ষিত ইন্দ্রদত্ত শক্তি’-অস্ত্র নিক্ষেপে ঘটোৎকচকে বধ করেন।
৬. সভিক কথাটির ব্যুৎপত্তি = সভা + ঠন্ (ইক)। ‘সভা’ বলতে এখানে দ্যূতসভা বোঝাচ্ছে, সভিক হল দ্যূতসভার পরিচালক। বিভিন্ন দ্যূতভবনে অনুষ্ঠিত দ্যূতসভাগুলো রাজ-অনুমোদিত ছিল। সভিক সেই সভার অধ্যক্ষতা করত। তার নিজেরই কিছু প্রাপ্য থাকত আর রাজকোষেও কিছু দেয় থাকত। হিসাবপত্র তাকে রাখতেই হত। তাই সভিকের ‘লেখকব্যাপৃত’ রূপটি বাস্তবানুগ। ‘লেখক’ অর্থ এখানে নথিপত্র— documents.
৭. জুয়াড়ির মনস্তত্ত্ব এই শ্লোকটিতে কী আশ্চর্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে! এই প্রসঙ্গে দ্যূতসম্পর্কিত বৈদিক সুক্ত স্মরণীয় :
প্রাবেপা মা বৃহতো মাদয়ঙিত প্রবাতেজা ইরিণে বর্রতানাঃ।
সোমস্যেব মৌজবতস্য ভক্ষো বিভীদকো জাগৃবিমহ্যমচ্ছান্ ॥ ১ ॥
–বড়ো বড়ো পাশাগুলো যখন ছকের উপর ইতস্তত সঞ্চালিত হয়, দেখে আমার বড়োই আনন্দ হয়। মুজবান নামক পর্বতে যে চমৎকার সোমলতা জন্মে তার রস পান করতে যেমন প্রীতি জন্মে, বিভীতকাষ্ঠনির্মিত অক্ষ আমার পক্ষে তেমনি প্রীতিকর এবং আমাকে তেমনিই উৎসাহিত করে।
যদাদীধ্যে ন দবিষাণ্যেভিঃ পরয়দ্ভোবহীয়ে সখিভ্যঃ।
ন্যুপ্তাশ্চ বভ্ৰবো বাচক্ৰমত এমীদেষাং নিষ্কৃতং জারিণীব ॥ ৫ ॥
আমি যখন মনে ভাবি, আর এ পাশাখেলা করব না তখন খেলার সঙ্গীদের দেখলে তাঁদের নিকট হতে সরে যাই। কিন্তু পাশাগুলো সুন্দর পিঙ্গলমূর্তিতে ছকের উপর বসে আছে দেখে আর থাকতে পারি না। ভ্রষ্টনারী যেমন উপপতির নিকট গমন করে, আমিও তেমন খেলার সঙ্গীদের ভবনে গমন করি।
(ঋগ্বেদ ১০.৩৪। ১. ও ৫)
৮-১১. ত্রেতা, পাবর, নর্দিত ও কট— কড়ির বিশেষ বিশেষ চালের নাম। উত্তরভারতে এগুলোর নাম যথাক্রমে তীরা, দূয়া, নান্দী (নক্কী) ও পূরা। Wilson এগুলোর অনুবাদ করেছেন যথাক্রমে Tray, Deuce, Ace এবং doubets (four) শব্দ দিয়ে।
১২. পরপর দুটি শ্লোক থেকে মনে হয় দর্পরকের মতো জুয়াড়ি এবং শর্বিলকের মতো চোরেরা নানারকম নির্যাতন সহ্য করার উপযোগী করে নিজেদের তৈরি করত।
১৩. ‘কল্য’ অর্থ প্রভাত, ‘বর্ত’ অর্থ আহার (বর্ততে অনেন ইতি)। কল্যবর্ত = প্রাতরাশ। ‘প্রাতরাশ’ খুব হালকা আহার। এর থেকে অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘সামান্য বা তুচ্ছ কিছু’।
১৪. মূল শব্দটি খণ্ডিতবৃত্ত। বৃত্ত = চরিত্র। খণ্ডিতবৃত্ত অর্থ যে নিজের চরিত্র-বিরোধী, অর্থাৎ বৃত্তিগতভাবে যা যার করা উচিত সে তা না করে যদি কোনো অসদুপায় অবলম্বন করে তবে তাকে খণ্ডিতবৃত্ত বলা হবে। জুয়াড়ি হিসেবে ‘দর্দুরকের যা কর্তব্য সে তা করছে না,— মাথুরের এই বক্তব্য।
১৫. ‘পূজাবিশেষমপি জানাতি’ বাক্যটিকে প্রশ্নাত্মক ধরলে ভালো হয়।
১৬. অসম্মতি প্রকাশের কৌশলটি লক্ষণীয়।
১৭. চলিত ভাষায় বলা যেতে পারে ‘খোঁটাভাঙা’। যে যে-কাজ করছে তা-ই দিয়েই তার নামকরণ করা হয়েছে।
১৮. হাতির উৎকট মদগন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে, তাই চাদরটায় জুঁইফুলের গন্ধ আছে কিনা তা কপূরক বুঝতে পারছে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন