মৃচ্ছকটিক – চতুর্থ অঙ্ক

জ্যোতিভূষণ চাকী

মৃচ্ছকটিক – চতুর্থ অঙ্ক 

(চেটীর প্রবেশ) 

চেটী— মা আর্যার কাছে যেতে বললেন। এই তো আর্যা মদনিকার সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর চোখ একটা ছবির ওপর। কাছে যাই। (যেতে থাকে)

(বসন্তসেনা ও মদনিকার প্রবেশ) 

বসন্তসেনা— ওলো মদনিকা, ছবিটা অবিকল চারুদত্তের মতো, তাই না? 

মদনিকা— একেবারে অবিকল। 

বসন্তসেনা— জানলি কী করে? 

মদনিকা— ছবিটার দিকে কী রকম অনুরাগ নিয়ে চেয়ে আছেন, এতেও বুঝব না?

বসন্তসেনা— বাহ্ গণিকার বাড়িতে থেকে থেকে বেশ তো মন জুগিয়ে কথা বলতে শিখেছিস। 

মদনিকা— বা রে, গণিকার বাড়িতে থাকলেই বুঝি মন জুগিয়ে চলতে হয়? আপনার চোখ আর মন যেভাবে ছবিটার ওপরে পড়ে আছে তার কী কারণ তা না জিগ্যেস করলেও চলে। 

বসন্তসেনা— ওলো, সখীদের ঠাট্টার হাত থেকে বাঁচতে চাইছি। 

মদনিকা— না আর্যা, ঠিক তা নয়। সখীর সঙ্গে সখীর মনের মিল থাকবেই। 

প্রথম চেটী— (কাছে এসে) আর্যা, মা আদেশ করলেন, ‘পাশের দরজায় ঢাকা গাড়ি তাইতে যাও।’ 

বসন্তসেনা— ওলো, চারুদত্ত কি আমায় নিতে পাঠিয়েছেন? 

চেটি— আর্যা, তিনি গাড়ির সঙ্গে দশ হাজার মোহরের গয়না পাঠিয়েছেন। 

বসন্তসেনা— তিনি আবার কে? 

চেটী— তিনি হলেন রাজার শালা সংস্থানক। 

বসন্তসেনা— (রেগে) দূর হ! আর কক্ষনো বলবি না ও কথা। 

চেটী— শান্ত হন, শান্ত হন, আর্যা। আমায় খবরটা দিতে বলেছেন, তাই— 

বসন্তসেনা— তোর এই খবরটার ওপরেই আমার রাগ হচ্ছে। 

চেটী— তা হলে মাকে গিয়ে কী বলব? 

বসন্তসেনা— বলবি, মা যদি আমার মরা মুখ দেখতে না চান তবে যেন আর কখনো এমন আদেশ না করেন। 

চেটী— যে আজ্ঞে। (প্রস্থান) 

(শর্বিলকের প্রবেশ) 

শর্বিলক— রাত্রিকে অপবাদ দিয়ে, নিদ্রাকে জয় করে আর রাজার রক্ষীদের বোকা বানিয়ে শেষ রাত্রে সূর্যোদয়ের সময়কার চাঁদের মতো মলিন হয়ে আমি এখানে এসেছি ॥ ১ ॥ 

তাছাড়া— 

যখনই কেউ আমায় ছুটতে দেখে আমার দিকে তাকিয়েছে, কিংবা তাড়াতাড়ি আমার কাছে এসেছে তখন আমি তাদের সবাইকে দেখেই ভয় পেয়েছি— এর কারণ আমার নিজেরই সন্দিগ্ধ মন। মানুষের নিজের দোষই তাকে ভীরু করে রাখে[১] ॥ ২ ॥ 

মদনিকার জন্যেই আমার এই দুঃসাহসের কাজ। কোনো কোনো জায়গায় চাকর-বাকরের সঙ্গে কোনো লোক কথা বলছে শুনে এড়িয়ে গেছি, কোনো বাড়িতে কেবল স্ত্রীলোক আছে বলে ছেড়ে দিয়েছি, রাজার রক্ষীরা কাছাকাছি এলে কাঠের খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে গেছি। এই ধরনের নানা আচরণে আমি রাতকে দিন করেছি ॥৩॥ 

(পরিক্রমা করে) 

বসন্তসেনা— ওলো, এই ছবিটা আমার ঘরে বিছানার উপরে রেখে তাড়াতাড়ি একটা পাখা নিয়ে আয়। 

মদনিকা— যাচ্ছি। (ছবি নিয়ে চলে যায়) 

শর্বিলক— এই তো বসন্তসেনার বাড়ি। তা হলে প্রবেশ করি (তাই করে) এখন মদনিকাকে পাই কোথায়? 

(পাখাহাতে মদনিকার প্রবেশ) 

শর্বিলক— (দেখতে পেয়ে) এই তো মদনিকা আসছে! গুণে মদনদেবকেও পরাস্ত করে মূর্তিমতী রতিদেবীর মতো শোভা পাচ্ছে এই আমার মদনিকা। ভালোবাসার আগুনে আমার হৃদয় পুড়িয়ে আবার তাকে চন্দনের প্রলেপে শান্ত করে দেয়।। ৪॥ 

মদনিকা— 

মদনিকা— (দেখে) এ কী! এ যে শৰ্বিলক; এসো, এসো। ব্যাপার কী! এদিকে কোথায় চলেছ? 

(পরস্পর অনুরাগের সাথে দেখে) 

বসন্তসেনা— মদনিকা এত দেরি করছে কেন? তাই তো, গেল কোথায়? চলে গেল নাকি? (জানালা দিয়ে দেখে) এ কী! এ যে একজন পুরুষমানুষের সঙ্গে কথা বলছে দেখছি। যেভাবে লোকটিকে অনুরাগের দৃষ্টি দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাতে মনে হয় লোকটি ওকে বন্ধন থেকে মুক্ত করতে চায়। ঠিক আছে, ওরা রসালাপ করুক। ওদের প্রেমনিবেদনে কেউ যেন বাধা সৃষ্টি না করে। আমি আর ডাকব না ওকে। 

মদনিকা— শর্বিলক, বল কী ব্যাপার। 

(শর্বিলক ভয়ে ভয়ে চারিদিক দেখে)

কী হয়েছে, শর্বিলক? মনে হচ্ছে, তুমি যেন ভয় পেয়েছ! 

শর্বিলক— তোমাকে, একটা গোপন কথা বলছি, তা জায়গাটা নির্জন তো?

মদনিকা— হ্যাঁ। 

বসন্তসেনা— (স্বগত) গোপন কথা! তা হলে না শোনাই উচিত। 

শর্বিলক— আচ্ছা মদনিকা, আমি যদি দাম দিই তা হলে বসন্তসেনা কি তোমায় ছেড়ে দেবেন? 

বসন্তসেনা— আমার সম্বন্ধে কথা! তা হলে নিজেকে লুকিয়ে রেখে এই জানালা দিয়ে শুনি। 

মদনিকা— শর্বিলক, আমি আর্যাকে জিগ্যেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন— ‘আমার ইচ্ছে হলে আমার সব পরিচারক-পরিচারিকাদেরই কোনো দাম না নিয়েই ছেড়ে দিতে পারি।’ আচ্ছা, শর্বিলক, তোমার এত অর্থ কোথায় যে আমাকে আর্যার কাছ থেকে মুক্ত করবে? 

শর্বিলক— ওগো, ভীতু মেয়ে, আমি গরিব, কিন্তু তোমাকে ভালোবাসি বলেই গত রাত্রে একটা দুঃসাহসের কাজ করে ফেলেছি ॥ ৫ ॥ 

বসন্তসেনা— দেখে মনে হচ্ছে লোকটি শান্তশিষ্ট। কিন্তু ওর ওই দুঃসাহসের কাজের ব্যাপারটা শুনে ভয় হয়। 

মদনিকা— শর্বিলক, একটা সামান্য মেয়ের জন্যে তুমি দুটো জিনিসকে বিপদে ফেলেছিলে। 

শর্বিলক— দুটো জিনিস কী কী? 

মদনিকা— তোমার দেহ আর চরিত্র। 

শর্বিলক— আরে বোকা মেয়ে সাহসেই লক্ষ্মী বাস করেন।[২] 

মদনিকা— শর্বিলক, এখন পর্যন্ত তোমার চরিত্রে কোনো দোষ ঘটেনি, কিন্তু আমার জন্যে একটা অপরাধের কাজ করা কি তোমার উচিত হয়েছে?

শর্বিলক— আমি কখনো পুষ্পিতা লতার মতো গয়না-পরা মেয়েদের চুরি করি না, ব্রাহ্মণের সম্পদ[৩] কিংবা যজ্ঞের সোনা চুরি করি না। অর্থের জন্যে আমি কখনো ধাত্রীর কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিই না। চুরি করার সময়েও আমার মন কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা বিচার করে ॥ ৬ ॥ 

কাজেই বসন্তসেনাকে বলো— 

‘দয়া করে আমার ভালোবাসার খাতিরে যেন আপনারই দেহের মাপে তৈরি— এই অলঙ্কার গোপনে পরবেন। 

মদনিকা— দেখ শর্বিলক, গয়না পরা আর গোপনে এ দুটো জিনিস একসঙ্গে হয় না। কই, আনো দেখি, একবার গয়নাগুলো দেখি। 

শর্বিলক— এই যে অলঙ্কার। (সসঙ্কোচে হাতে দেয়) 

মদনিকা— (ভালো করে দেখে) এ অলঙ্কার যেন আগে কোথাও দেখেছি! কোথায় পেলে, বলো তো? 

শর্বিলক— সেসব শুনে লাভ নেই, এগুলো ধরো এখন। 

মদনিকা— (রেগে গিয়ে) আমাকে যদি এতই অবিশ্বাস তবে আমাকে মুক্ত করতে চাও কেন? 

শর্বিলক— সকালে বাজারে শুনলাম এগুলো নাকি বণিক চারুদত্তের। 

(বসন্তসেনা ও মদনিকা দু’জনেই মূর্ছার অভিনয় করে)

শর্বিলক— শান্ত হও মদনিকা! তুমি এখন মুক্ত, তবু তুমি কেন বিচলিত হচ্ছ, কেন তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হতাশায় কাঁপছে, তোমার চোখ উত্তেজনায় ঘুরছে কেন? আমার প্রতি তোমার কি করুণা নেই? 

মদনিকা— (সুস্থ হয়ে) বীরপুরুষ, এই কুকর্ম করতে গিয়ে সে বাড়ির কাউকে মেরেটেরে ফেলনি তো? 

শর্বিলক— ওগো, মদনিকা, শলিক কোনো ভীত বা নিদ্রিত মানুষকে আঘাত করে না। আমি কাউকে মারিওনি, আঘাতও করি নি। 

মদনিকা— সত্যি বলছ? 

শর্বিলক— সত্যি। 

বসন্তসেনা— (সংজ্ঞালাভ করে) আহ্! বাঁচলাম। 

মদনিকা— এটা তবে সুসংবাদ আমার কাছে। 

শর্বিলক— (ঈর্ষান্বিত হয়ে) সুসংবাদ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? 

পূর্বপুরুষদের ন্যায়নিষ্ঠ আচরণে যে বংশ ধন্য সেই বংশে জন্মেও আমি পাপের কাজ করেছি, কারণ আমার হৃদয় তোমার প্রেমে মুগ্ধ। কামনার আগুনে আমার গুণ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আমি এখনো মান বিসর্জন দিইনি। তুমি আমাকে বন্ধু বলছ, আবার অন্য পুরুষের প্রতিও আসক্তি দেখাচ্ছ ॥ ৯ ॥ 

(অর্থপূর্ণভাবে ) 

পৃথিবীতে উচ্চ বংশের যুবকেরা যেন ফলবান বৃক্ষ। গণিকারূপী পাখিরা সেই সব ফল খেয়ে খেয়ে তাদের শেষ করে দেয়॥ ১০॥ 

আর এই প্রেম হল আগুন, প্রণয় জ্বালানি এবং কামলীলা তার শিখা। মানুষ এতে তার যৌবন ও সম্পদ আহুতি দেয়। ১১॥ 

বসন্তসেনা— (হেসে) ওর এই আবেগ ভুল জায়গায়। 

শর্বিলক— আমার মতে, যারা স্ত্রীলোককে অথবা সম্পদকে বিশ্বাস করে তারা সবদিক দিয়েই বোকা। স্ত্রীলোক আর সম্পদ সাপিনীর মতোই কুটিলভাবে চলে॥ ১২॥ 

স্ত্রীলোককে ভালোবাসা ঠিক নয়, স্ত্রীলোক তার প্রতি আসক্ত মানুষকে অপমান করে। যে স্ত্রীলোকের হৃদয়ে প্রেম আছে তাকেই কেবল ভালোবাসা উচিত, যে স্ত্রীলোকের হৃদয়ে তা নেই তাকে ত্যাগ করাই উচিত ॥ ১৩ ॥

এ কথা খুব সত্যি যে— 

এসব মেয়েমানুষেরা টাকার জন্যেই হাসে, টাকার জন্যেই কাঁদে! এরা নিজেদের প্রতি পুরুষকে বিশ্বস্ত করে তোলে, কিন্তু নিজেরা পুরুষকে অবিশ্বাস করে। কাজেই উঁচু বংশের সচ্চরিত্র লোকের উচিত এদের শ্মশানের ফুলের মতো এড়িয়ে চলা ॥১৪॥ 

মেয়েদের স্বভাব সাগরের ঢেউয়ের মতো চঞ্চল, তাদের অনুরাগ সন্ধ্যার মেঘের রেখার মতোই ক্ষণিকের, মেয়েমানুষ পুরুষের অর্থ শুষে নিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে বর্ণহীন অলক্তের মতো ত্যাগ করে ॥ ১৫ ॥ 

স্ত্রীলোকেরা সত্যিই চপল— 

একজন পুরুষকে হৃদয়ে নিয়ে আর একজনকে কটাক্ষে আহ্বান জানায়, একজনকে অনুরাগসূচক হাবভাব দেখিয়ে একজনকে দেহ দিয়ে কামনা করে[৪] ॥ ১৬ ॥ 

একজন খুব সত্যি কথা বলেছেন— 

পাহাড়ের চূড়ায় পদ্মফুল হয় না, গাধা ঘোড়ার বোঝা বইতে পারে না, যব বুনলে ধান হয় না, ঠিক তেমনি গণিকালয়ের স্ত্রীলোকেরা খাঁটি হয় না[৫] ॥ ১৭॥ ওরে দুরাত্মা চারুদত্ত, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। (কয়েক পা এগিয়ে যায়) 

মদনিকা– (বস্ত্রাঞ্চল ধরে) কী সব আবোল-তাবোল বকছ, অকারণে রাগ করছ।

শর্বিলক— অকারণে কেন? 

মদনিকা— এই গয়না আর্য বসন্তসেনার। 

শর্বিলক— তাতে কী হয়েছে? 

মদনিকা— এই গয়না চারুদত্তের কাছে গচ্ছিত ছিল। 

শর্বিলক— কী জন্যে? 

মদনিকা— (কানে কানে) এর জন্যে। 

শর্বিলক— (লজ্জায়) হায়! কী কষ্ট! 

গ্রীষ্মে তাপিত হয়ে ছায়ার জন্যে যে শাখার আশ্রয় নিলাম, অজ্ঞতার বশে আমি সেই শাখাকেই নিষ্পত্র করলাম ॥ ১৮ ॥ 

বসন্তসেনা— এ সত্যি দুঃখিত। তা হলে না জেনেই কাজটা করে ফেলেছে।

শর্বিলক— মদনিকা, তা হলে এখন কী করা উচিত। 

মদনিকা— এ ব্যাপারে তুমি যা ভালো বোঝ! ‘ মি অভিজ্ঞ লোক।

শর্বিলক— তা নয়, বুঝলে— 

এ সব স্ত্রীলোকেরা স্বভাবতই অভিজ্ঞ কিন্তু পুরুষের অভিজ্ঞতা শাস্ত্র থেকে পাওয়া ॥ ১৯ ॥ 

মদনিকা— শর্বিলক, যদি আমার বুদ্ধি নাও তো এ অলঙ্কার সেই মহানুভবকেই ফিরিয়ে দিয়ে এস। 

শর্বিলক— তিনি যদি রাজদ্বারে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন? 

মদনিকা— চাঁদের কি তাপ থাকে? 

বসন্তসেনা— সুন্দর বলেছ, মদনিকা, সুন্দর বলেছ! 

শর্বিলক— আমার এই দুঃসাহসের কাজের জন্যে আমার দুঃখ বা ভয় কোনোটাই হচ্ছে না। তবু তুমি আমাকে সেই ভালো মানুষটির গুণের কথা কেন বলছ? এই জঘন্য কাজটাই আমাকে লজ্জা দিচ্ছে। রাজা আমাদের মতো ধূর্ত লোকদের কী করতে পারেন? ॥ ২০ ॥ 

তবুও এটা নীতিবিরুদ্ধ। অন্য কোনো উপায় ভাবো। 

মদনিকা— তা হলে আর একটা উপায় আছে। 

বসন্তসেনা— আর একটা উপায়! সেটা কী হতে পারে? 

মদনিকা— সেই আর্যের (চারুদত্তের) লোক হয়ে এই অলঙ্কার আর্যার (বসন্তসেনার ) কাছে নিয়ে যাও। 

শর্বিলক— যদি তাই করি, তাহলে কী হবে? 

মদনিকা— তা হলে তুমি চোর হলে না, আর্যেরও ঋণ রইল না, আর আর্যাও তাঁর গয়না পেয়ে গেলেন। 

শর্বিলক— কিন্তু এতে বিপদ আছে। 

মদনিকা— না গো, মশাই না! আর্যার কাছেই নিয়ে যাও। বরং না গেলেই বিপদ!

বসন্তসেনা— সাবাস, মদনিকা, সাবাস! ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকের মতোই বলেছ।

শর্বিলক— তোমার কথা শুনে আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল। রাত্রিবেলায় চাঁদ ডুবে গেলে পথ দেখবার লোক পাওয়াই শক্ত ॥ ২১ ॥ 

মদনিকা— তা হলে তুমি কামদেবের মন্দিরে একটু বোসো, আর্যাকে তোমার আসার খবরটা দিই গে। 

শর্বিলক— ঠিক আছে! 

মদনিকা— (এগিয়ে গিয়ে) আর্যা, চারুদত্তের কাছ থেকে একজন ব্রাহ্মণ এসেছেন।

বসন্তসেনা— ওলো, নরুদত্তের লোক চিনলি কী করে? 

মদনিকা— ওমা, নিজের লোককে চিনব না? 

বসন্তসেনা— (নিজের প্রতি মাথা নেড়ে ও হেসে) ঠিক বলেছিস। (প্রকাশ্যে) তা ভেতরে নিয়ে আয়। 

মদনিকা— তাই যাচ্ছি। (কাছে গিয়ে) শর্বিলক, ভেতরে এস। 

শর্বিলক— (বিচলিতভাবে এগিয়ে যায়) আর্যার মঙ্গল হোক।

বসন্তসেনা— নমস্কার। আর্য বসুন। 

শর্বিলক— বণিক (চারুদত্ত) বলে পাঠিয়েছেন— আমার বাড়িটা ভাঙাচোরা, এই পেটিকা রক্ষা করা কঠিন। কাজেই দয়া করে এটা ফেরত নিন। (মদনিকার হাতে দিয়ে চলে যেতে চায়) 

বসন্তসেনা— আর্য, আমারও একটি প্রতিবার্তা তাঁকে পৌঁছে দেবেন। 

শর্বিলক— (স্বগত) সর্বনাশ। তাঁর কাছে কে যাবে? (প্রকাশ্যে) আপনার বার্তাটি কী? 

বসন্তসেনা— মদনিকাকে গ্রহণ করতে হবে। 

শর্বিলক— আর্যা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। 

বসন্তসেনা— আমি পারছি। 

শর্বিলক— আপনি কী বলতে চান— 

বসন্তসেনা— চারুদত্ত আমায় বলছেন যে যিনি আমাকে গয়না দিতে আসবেন তাঁর হাতে আমি যেন মদনিকাকে সমর্পণ করি। কাজেই বুঝতে পারছেন, তিনিই মদনিকাকে আপনার হাতে দিতে চান। 

শর্বিলক— (স্বগত) এই রে, আমি ধরা পড়ে গেছি! (প্রকাশ্যে) সাধু, আর্য  চারুদত্ত, সাধু। 

মানুষের উচিত সর্বদা গুণী হবার চেষ্টা করা। গরিব হলেও গুণী লোক গুণহীন ধনীর মতো নয় ॥ ২২॥ 

তাছাড়া— 

মানুষের উচিত গুণের অধিকারী হতে চেষ্টা করা, কারণ গুণ দিয়ে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই। গুণ আছে বলেই চাঁদ শিবের অলঙ্ঘ্য ললাটে উঠতে পেরেছে। 

বসন্তসেনা— গাড়ির চালক কোথায়? 

(গাড়ি নিয়ে[৬] আসে) 

চেট–আর্য, গাড়ি প্রস্তুত। 

বসন্তসেনা— ওলো, মদনিকা আমার দিকে ভালো করে তাকা। তোকে দান করলাম। নে এবার গাড়িতে ওঠ। আমাকে মনে রাখিস, বুঝলি? 

মদনিকা— (কেঁদে) আর্যা আমাকে ত্যাগ করলেন। (পায়ে লুটিয়ে পড়ে)

বসন্তসেনা— এখন থেকে তুই-ই প্রণামের যোগ্য হলি।[৭] নে ওঠ, গাড়িতে গিয়ে বোস। আর, আমাকে ভুলিস না যেন। 

শর্বিলক— আর্যা, আপনার মঙ্গল হোক। ওগো, মদনিকা— এঁর দিকে শুভদৃষ্টিপাত করো। এঁকে মাথা নত করে প্রণাম জানাও। এঁর কৃপাতেই তুমি দুর্লভ বধূআখ্যার অবগুণ্ঠন লাভ করলে ॥ ২৪ ॥ 

(মদনিকাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে রওনা দেয়)

(নেপথ্যে ) 

যে আছ, শোন। নগরপাল আদেশ করেছেন : ‘রাখালবালক আর্যক রাজা হবেন’— জ্যোতিষীর এই ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করে ভীত রাজা পালক তাকে ঘোষপল্লী থেকে ধরে এনে ভয়ঙ্কর কারাগারের নরকে বন্দি করে রেখেছেন। কাজেই যে যেখানে আছ, সবাই সাবধান। 

শর্বিলক— (শুনে) কী! রাজা পালক আমার বন্ধু আর্যককে বন্দি করে রেখেছেন, আর এদিকে আমি কিনা স্ত্রীকে নিয়ে— ওহ্ কী হতভাগা আমি! না— 

পৃথিবীতে দুটো জিনিস মানুষের খুবই প্রিয়, বন্ধু আর স্ত্রী। কিন্তু এখন আমার কাছে বন্ধু শত শত সুন্দরী স্ত্রীর চেয়েও দামী ॥ ২৫। 

বেশ, নেমেই যাই (নেমে যায়) 

মদনিকা— (চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাত জোড় করে) এ আবার কী হল? আমাকে তবে কোনো গুরুজনের কাছে পাঠিয়ে দাও। 

শর্বিলক— বাহ্। তুমি ঠিক বলেছ, প্রিয়া। (চেটের প্রতি) ওহে, তুমি বণিক রেভিলের বাড়ি চেন? 

চেট— আজ্ঞে, হ্যাঁ।

শর্বিলক… আমার স্ত্রীকে তাহলে সেখানেই নিয়ে যাও। 

চেট— আর্যের যা আদেশ। 

মদনিকা— আর্য যা বলছেন তাই হোক। তবে আর্য, তুমি সাবধানে থেকো। 

(প্রস্থান) 

শর্বিলক— আমি এখন— 

আমার বন্ধুর মুক্তির জন্যে রাজা উদয়নের পক্ষে যৌগন্ধরায়ণের মতো জ্ঞাতিদের, বিজ্ঞ লোকেদের, বাহুবলে যাঁরা খ্যাত হয়েছেন তাঁদের আর রাজা অপমান করেছেন বলে যেসব রাজকর্মচারীরা ক্রুদ্ধ তাঁদের সবাইকে উত্তেজিত করে তুলব ॥ ২৬ ॥ 

শুধু তাই নয়— 

রাহু যেমন চাঁদকে আবদ্ধ করে তেমনি যেসব অসৎ শত্রুরা ভয় পেয়ে অকারণে আমার প্রিয় বন্ধুকে আটকে রেখেছে তাদের ওপর হঠাৎ হানা দিয়ে আমি রাহুমুখে স্থিত চন্দ্রবিম্বের মতো আমার বন্ধুকে উদ্ধার করব ॥ ২৭ ॥ 

(প্রস্থান) 

(চেটের প্রবেশ) 

চেট— আর্যা, কী সৌভাগ্য আপনার! আর্য চারুদত্তের কাছ থেকে একজন ব্রাহ্মণ এসেছেন আপনার কাছে। 

বসন্তসেনা— সত্যি, আজকের দিনটি খুব সুন্দর। ওলো, তোরা কেউ তাঁকে সসম্মানে বন্ধুলের সঙ্গে এখানে নিয়ে আয়। 

চেটী— আপনার যা আদেশ। 

(প্রস্থান) 

(বন্ধুলসহ বিদূষকের প্রবেশ 

বিদূষক— হা! হা! রাক্ষসরাজ রাবণ তপস্যা করে পাওয়া পুষ্পক রথে চেপে যাওয়া-আসা করতেন, আর আমি সামান্য এক ব্রাহ্মণ কোনো তপস্যা না করেই কেমন দিব্যি একদল পুরুষ আর মহিলার সঙ্গে চলেছি। 

চেটী— মশাই, বাড়ির দরজাটার দিকে চেয়ে দেখুন। 

বিদূষক— (বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখে) আহা, বসন্তসেনার বাড়ির দরজাটার দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়! জল দিয়ে ধুয়ে গোবর লেপন করা হয়েছে। নানারকম সুগন্ধি ফুলে মেঝে সাজানো। হাতির দাঁতের তোরণটি যেন আকাশ দেখার কৌতূহল নিয়ে অনেক উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় মল্লিকার মালা দুলছে— মনে হয় বুঝি হাতির শুঁড় দুলছে। মহামূল্য রত্নখচিত হাতির দাঁতের তোরণে সৌভাগ্যসূচক পতাকা উড়ছে— যেন হাওয়ায় দুলতে দুলতে আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। তোরণের থামের নিচে বেদির দু’পাশে স্ফটিকের তৈরি মঙ্গলকলস, তার উপর হলদে রঙের আমের শাখা। সোনার কপাট মহাসুরের বুকের মতো দুর্ভেদ্য, তাতে ঘন ঘন পেরেক লাগানো। এই দরজা গরিব লোকের মনে আশা জাগিয়ে আবার দুঃখ দেয়। এমনকি উদাসীনের দৃষ্টিকেও আকৃষ্ট করে। 

চেটী— আসুন, আসুন দয়া করে প্রথম মহলে আসুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও দেখে) আহা, অপূর্ব। এই প্রথম মহলে চাঁদ কিংবা শাঁখের বরণ, মৃণালের মতো চকচকে চুনকামকরা নানা ধরনের রত্নখচিত সোনার সিঁড়িযুক্ত সারি সারি প্রাসাদ দেখছি। মুক্তোর মালায় সাজানো স্ফটিকের জানালা যেন প্রাসাদগুলোর চাঁদমুখ—যা দিয়ে ওরা সারা উজ্জয়িনী নগরটিকে দেখছে। আবার শ্রৌত্রিয় ব্রাহ্মণের মতো দারোয়ানেরা দিব্যি ঘুমোচ্ছে। কাকেদের দই আর কলমা চালের ভাত খেতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা লোভী হলেও চুনমাখানো মনে করে সে ভাত খাচ্ছে না। এরপর কোথায় যেতে হবে, বলো। 

চেটী— আসুন, এই যে দয়া করে দ্বিতীয় মহলে আসুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও চারদিক দেখে) আহা! অপূর্ব! ঘাস-ভূষি খেয়ে পুষ্ট তেল-কুচকুচে শিঙওয়ালা গাড়িটানা সব বলদ দেখছি। এখানে আবার একটা মোষ, সৎকুলজাত অপমানিত মানুষের মতো ভোস ভোস করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে। এদিকে আবার যুদ্ধশেষে মল্লবীরের ঘাড় মলে দেবার মতো একটি মেয়ের ঘাড় মলে দেওয়া হচ্ছে। ওদিকে আবার অশ্বদের কেশবিন্যাস করে দেওয়া হচ্ছে। আস্তাবলে চোরের মতো একটি বানর আষ্টেপিষ্টে বাঁধা। (অন্যদিকে তাকিয়ে) এখানে মাহুতেরা দেখছি হাতিকে তেলমাখা ভাতের পিণ্ড খাওয়াচ্ছে। বলো, এবার কোথায় যেতে হবে। 

চেটী— আসুন, তৃতীয় মহলে আসুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও চারিদিক দেখে) বাহ্! এই তৃতীয় মহলে দেখছি ভদ্র-সন্তানদের বসবার জন্যে আসন সাজানো হয়েছে। বেদিকার উপরে অর্ধ-পঠিত পুস্তক ও মণিখচিত পাশায় গুটি পড়ে আছে। এদিকে আবার রতিশাস্ত্রে বিজ্ঞ গণিকা ও বৃদ্ধ রসজ্ঞেরা নানা রঙের চিত্রফলক হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর পর কোথায় যেতে হবে বলো। 

চেটী— আসুন, এই চতুর্থ মহলে আসুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও চারিদিক দেখে) বাঃ বাঃ, চমৎকার! চতুর্থ মহলে দেখছি যুবতীদের করাঘাতে মৃদঙ্গ বেজে উঠছে, মেঘগর্জনের মতো কী গম্ভীর ধ্বনি! স্বর্গের পুণ্যশেষে খসে-পড়া নক্ষত্রদের মতো করতালগুলো নেমে এসে কেমন তালে তালে পড়ছে। ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো বাঁশি-তবলা কেমন মধুরভাবে বেজে উঠছে। এখানে আবার ঈর্ষা-প্রণয়-ক্রুদ্ধা কামিনীর মতো বীণাটিকে কোলে নিয়ে নখের আঘাতে বাজানো হচ্ছে। এখানে ফুলের মধুপানে মত্ত ভ্রমরের মতো গণিকাকন্যারা কামনামদির নৃত্যে মেতে উঠেছে। আর বাতাস ধরে রাখবার জন্যে বাতায়নে জলের কলসিগুলো উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এর পর কোথায় যেতে হবে বলো। 

চেটী— এবার চলুন পঞ্চম মহলে। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও দেখে) এই পঞ্চম মহল তো দেখছি মনমাতানো হিঙ্ আর তেলের গন্ধে ভুরভুর করছে, এই গন্ধে কাঙালের ক্ষিধে বেড়ে যায়। সদা-উত্তপ্ত রন্ধনশালাটি যেন হাঁসফাঁস করছে, উনুনগুলোর নানা আকারের রন্ধ্রপথ দিয়ে নানাজাতীয় সুবাস বের হচ্ছে। এত নানা ধরনের খাবার তৈরি হচ্ছে যে আমার লোভ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ওদিকে আবার কসাই-বালকটি কাটা-পশুর পেটের মাংস ছেঁড়া কাপড়ের মতো কচলে-কচলে ধুচ্ছে। রাঁধুনি নানাধরনের খাবার তৈরি করছে— মিষ্টি বানাচ্ছে, পিঠে ভাজছে। (স্বগত) ও আমাকে তাড়াতাড়ি পাতা ধুয়ে নিয়ে পেটপুরে খাবার অনুরোধ কখন জানাবে! (অন্যদিকে তাকিয়ে) সত্যি বলতে কি, গৃহের এই স্থানটি বন্ধুল আর নানা অলঙ্কারে ভূষিতা গণিকারা গন্ধর্ব-অপ্সরাদের মতো যেন স্বর্গ রচনা করেছে। আচ্ছা, তোমরা— যারা বন্ধুল বলে পরিচিত তারা কে বলো দেখি? বন্ধুলেরা— আমরা হস্তীশাবকের মতো ঘুরিফিরি, অন্য লোকের গৃহে পালিত হই, পরের খাবার খেয়ে বাঁচি, অন্য মানুষের ঔরসে অপরিচিতা নারীর গর্ভে জন্ম নিই, পরের ধন ভোগ করি, আমাদের নিজেদের কোনো গুণ নেই।। ২৮ ॥

বিদূষক— ওগো, এরপর কোথায় যাব চলো। 

চেটী— আসুন, আসুন, এই ষষ্ঠ মহলে আসুন।

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও চারিদিক দেখে) মরি মরি! এই ষষ্ঠ মহলে এইসব অপূর্ব শিল্পকীর্তির নিদর্শন তোরণগুলো স্বর্ণখচিত নীল রত্নে মণ্ডিত হয়ে ইন্দ্রধনুর মতো শোভা পাচ্ছে। মণিকারেরা প্রবাল, পুষ্পরাগ, ইন্দ্রনীল, কর্কেতরক, পদ্মরাগ, মরকত প্রভৃতি রত্ন নিয়ে পরস্পর পরামর্শ করছে, সোনায় মণি বসানো হচ্ছে, সোনার অলঙ্কার তৈরি হচ্ছে, লাল রেশমি সুতোয় বাঁধা হচ্ছে মুক্তোর অলঙ্কার, বৈদুর্যমণি ধীরে ধীরে মাজা হচ্ছে, শাঁখা কাটা হচ্ছে, প্রবাল শাণে ঘষা হচ্ছে, ভিজে কুঙ্কুম্ শুকোতে দেওয়া হয়েছে, কস্তুরী ভিজোনো হচ্ছে, চন্দন বাটা হচ্ছে। গণিকারা তাদের কামার্ত পুরুষদের কর্পূর মেশানো পান দিচ্ছে—কটাক্ষ হানছে, হাসছে; তৃপ্তিসূচক শব্দ করে অনবরত মদ্যপান করে চলেছে। এইসব দাস-দাসীরা ও পুরুষেরা তাদের স্ত্রী, সম্পত্তি ও শিশু-সন্তানদের ছেড়ে এখানে এসে গণিকাদের উচ্ছিষ্ট মদ্য পান করছে। এরপর কোথায় যেতে হবে বলো। 

চেটী— আসুন, একবার সপ্তম মহলে চলুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও দেখে) কী আশ্চর্য। এখানেও এই সপ্তম মহলে দেখছি পায়রাজুটিরা পরস্পরকে চুম্বন করে কেমন সুখ অনুভব করছে! খাঁচার মধ্যে শুকপাখি দই-ভাতে উদর-পূর্ণ ব্রাহ্মণের মতো বেদমন্ত্র পাঠ করছে। এদিকে আবার কয়েকটি ময়না-শালিক প্রভুর আদুরে দাসীর মতো কী সব বিড়বিড় করে বকে চলেছে। কোকিলেরা নানা ফলের রসাস্বাদে কণ্ঠকে ভিজিয়ে নিয়ে কুট্টিনীর মতো তারস্বরে চিৎকার করছে। সারি সারি খাঁচা ঝুলছে। ‘লওয়া’পাখিদের লড়াইয়ের জন্যে উত্তেজিত করা হচ্ছে, কপিঞ্জল-পাখিরা আলাপন করছে। খাঁচায় পায়রা বসে আছে। নানান মণিমাণিক্যে চিত্রিত গৃহপালিত ময়ূরটি আনন্দে নাচতে নাচতে পেখম মেলে রৌদ্রতপ্ত প্রাসাদটিকে যেন চামর দিয়ে বাতাস করছে— (অন্যদিকে তাকিয়ে) এখানে দেখছি জমাট বাঁধা জ্যোৎস্নার মতো রাজহংসেরা সুন্দরী যুবতীদের পেছনে পেছনে যেন তাদের পদ-গতি শিখে নেবার জন্যে হাঁটছে। আর এখানে এইসব পোষা সারসেরা বৃদ্ধের মতো চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। আহা অপূর্ব! গণিকারা নানা পাখির এক বিরাট সমাবেশে কী সুন্দর প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। সত্যি বলতে কি, এই গণিকালয়টি আমার কাছে নন্দনকাননের মতো মনে হচ্ছে। চলো, কোথায় যেতে হবে। 

চেটী— আসুন, এবার অষ্টম মহলে আসুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও দেখে) আচ্ছা, ওই যে লোকটি রেশমি চাদর গায়ে আর নানা বিচিত্র অলঙ্কার পরে কেমন যেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে থেমে থেমে চলাফেরা করছেন— উনি কে? 

চেটী— ইনি হলেন মনিবকন্যার ভাই। 

বিদূষক— আচ্ছা, কতটা তপস্যা করলে বসন্তসেনার ভাই হওয়া যায়? না এ আমি কী বলছি! কারণ, যদিও তাঁর দেহ রাজকীয় ও জমকালো পোশাকে আবৃত এবং সুবাসযুক্ত তবু তিনি শ্মশানে জাত পুষ্পিত, সুগন্ধি ও আকর্ষণীয় চাঁপাগাছের মতোই সকলের অনাদৃত ॥ ২৯ ॥ 

(অন্যদিকে চেয়ে) আর ওই যে উঁচু আসনে বসে ফুলের কারুকার্যখচিত চাদর গায়ে, তেলে চোবানো চুকচুকে জুতো পরা—ইনি আবার কে? 

চেটী—ইনি হলেন আমাদের মনিবকন্যার মা। 

বিদূষক—এই কুৎসিত ডাইনির পেটটি কী বিরাট! এই শিবমূর্তিটিকে দ্বারের শোভার জন্যেই কি এখানে রাখা হয়েছে? 

চেটী— আমাদের মাকে নিয়ে ওভাবে পরিহাস করবেন না। উনি ‘চাতুৰ্থিক’ পালাজ্বরে ভুগছেন। 

বিদূষক—ওগো ‘চাতুৰ্থিক’! এই ব্রাহ্মণটিকে একবার কৃপা করো।

চেটী— তা হলে মরবে যে! 

বিদূষক— (পরিহাসপূর্বক) এ ধরনের মোটা আর ভুঁড়িওয়ালা লোকদের মরণই ভালো। সোমসুধারস পান করে করে মায়ের আমার এই করুণ অবস্থা। মা যদি আমার দেহ রাখেন তাহলে হাজার শেয়ালের ভোজ হবে ॥ ৩০ ॥ 

ও মেয়ে, তোমাদের বাণিজ্য জাহাজ-টাহাজ কি বিদেশে যাতায়াত করে?

চেটী— মোটেই না।

বিদূষক— দেখো দেখি, এ আবার কী জিজ্ঞাসা করছি। নির্মল প্রেমের জলে 

কাম-সমুদ্রে তোমাদের স্তন, নিতম্ব, জঘনাদিই তো মনোহর জলযান। সে যাই হোক, বসন্তসেনার এই আটমহলা বাড়ি দেখে আমার মনে হচ্ছে, বুঝি তিন ভুবন এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। প্রশংসার বাণী আমি খুঁজে পাচ্ছি না, একে গণিকালয় বলব, না কুবেরের বাড়ি বলব জানি না। হ্যাঁ, তোমাদের মনিবকন্যাটি কোথায়? 

চেটী— তিনি ওই বাগানে আছেন, দয়া করে চলুন। 

বিদূষক— (প্রবেশ করে ও দেখে) আহা! কী অপূর্ব! বাগানটি সত্যি বড়ো চমৎকার। কত রকমের গাছের বাহার, কত বিচিত্র সব ফুল ফুটে রয়েছে। নধর বৃক্ষের তলায় যুবতীদের জঘনের মাপমতো সব দোলনা ঝুলছে। সত্যিকথা বলতে কি, চম্পা, যুঁই, শেফালি, মালতী আর নবমল্লিকা প্রভৃতি নানান ফুলের সমারোহে বাগানটি যেন নন্দনকাননের শোভা ধারণ করেছে। (অন্যদিকে চেয়ে) এদিকে আবার নতুন সূর্যের মতো উজ্জ্বল রক্ত-লাল পদ্মে দিঘিটি আবৃত। তা ছাড়া— অশোকের গাছে গাছে নবীন পুষ্পপত্রের উদ্গমের ফলে মনে হচ্ছে বুঝি সংগ্রামী কোনো মল্লের রক্তাক্ত সুশোভন শরীর ॥ ৩১ ॥ তা, তোমাদের মনিবকন্যাটি কোথায়? 

চেটী— নিচের দিকে তাকান— ওঁকে দেখতে পাবেন। 

বিদূরক— (দেখে অগ্রসর হয়ে) কল্যাণ হোক। 

বসন্তসেনা— এ কী! মৈত্রেয়মশাই যে! (উঠে) আসুন, আসুন। এই যে আসন গ্রহণ করুন। 

বিদূষক— আপনি বসুন। 

(উভয়ে বসে)

বসন্তসেনা— বণিকপুত্রের কুশল তো?

বিদূষক— হ্যাঁ, তিনি কুশলেই আছেন? 

বসন্তসেনা— মৈত্রেয়মশাই, এখন গুণ যাঁর কিশলয়, বিনয় শাখা-প্রশাখা, সুযশ কুসুম আর মূলটি হল বিশ্বাস, যার ফল ধরে নিজের গুণে— এমন বৃক্ষে বন্ধু-বান্ধব-রূপ পাখিরা কি সুখে বাস করে? ॥ ৩২ ॥ 

বিদূষক—(স্বগত) হতচ্ছাড়া বেটী ধরেছে ঠিক? (প্রকাশ্যে) তা করে বৈ কি ॥

বসন্তসেনা— এখন আগমনের হেতু? 

বিদূষক—তা হলে শুনুন, মহাশয়া। মাননীয় চারুদত্ত শিরস্পর্শ করে আপনাকে এই বার্তা জানাতে বলেছেন— 

বসন্তসেনা— (জোড়হাতে) কী তাঁর বার্তা? 

বিদূষক— তিনি জানিয়েছেন— ‘আমি সেই অলঙ্কারগুলো নিজের দ্যুতক্রীড়ায় হারিয়েছি, সেই জুয়াড়িও রাজার কাছে কোথায় চলে গেছে জানি না।’

চেটী— আপনার সৌভাগ্য, মা, আর্য চারুদত্ত জুয়াড়ি হয়েছেন। 

বসন্তসেনা— (স্বগত) এও কি সম্ভব! চোরে চুরি করে নিয়ে গেছে তবু নিজের মহত্ত্বে বলছেন কিনা— ‘দ্যুতক্রীড়ায় হারিয়েছি।’ এই জন্যেই তো তাঁকে আমি ভালোবাসি। 

বিদূষক—ক্ষতিপূরণস্বরূপ দয়া করে এই রতুহারটি গ্রহণ করুন। 

বসন্তসেনা— (স্বগত) অলঙ্কারগুলো দেখাব? না, এখনই নয়।

বিদূষক— আপনি কি তবে এই রত্নহার গ্রহণ করবেন না? 

বসন্তসেনা— (হেসে, সখীর মুখের দিকে চেয়ে) নেব না কেন, মৈত্রেয়মশাই? (রতুহার নিয়ে নিজের পাশে রেখে, স্বগত) আম্রতরু পুষ্পহীন হয়ে গেলেও তা থেকে মধুবিন্দু ঝরে। (প্রকাশ্যে) জুয়াড়ি চারুদত্তকে আমার নাম করে বলবেন আজ সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। 

বিদূষক— (স্বগত) সেখানে গিয়ে না জানি কী আবার আদায় করার মতলব! 

(প্রকাশ্যে) আচ্ছা, বলে দেব। (স্বগত) বলব— যদি বাঁচতে চাও তো এই গণিকাবেটীর সঙ্গ ছাড়ো। 

বসন্তসেনা— ওলো, অলঙ্কারগুলো ধর্, চারুদত্তের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

চেটী— এদিকে দেখুন মা, দেখুন। অকালে ঝড় উঠছে। 

(প্রস্থান) 

বসন্তসেনা— মেঘ জমুক, আঁধার নামুক, অবিরাম বর্ষণ হোক। আমার হৃদয় প্রিয়-সঙ্গের জন্যে উতলা হয়েছে, আজ আর কোনোকিছুই গ্রাহ্য করব না। ওলো, তাড়াতাড়ি হারটা নিয়ে আয়। ॥ ৩ ।। 

(সকলের প্রস্থান) 

॥ ‘মদনিকা ও শর্বিলক’ নামক চতুর্থ অঙ্কের সমাপ্ত ॥ 


টীকা

১. তুলনীয় : Thus conscience does make cowards of us all. 

(হ্যামলেটের স্বগতোক্তি) Hamlet-III, Sec I, 183 
‘স্বৈর্দোষৈভবতি হি শঙ্কিতো মনুষ্যঃ’ 

এই উক্তিটি ভাসের চারুদত্তে আছে প্রায়-অনুরূপ অন্য একটি শ্লোকের অংশ হিসেবে : 

যঃ কশ্চিত্বরিতগতিং নিরীক্ষতে মাং 
সম্ভ্রান্তো দ্রুত মুপসপাতি, স্থিতো বা।
সৰ্বাংস্তাস্তুলয়তি দোষতো মনো মে 
স্বৈর্দোষৈভবতি হি শঙ্কিতো মনুষ্যঃ। (চারুদত্ত ৪-৬) 

(সজ্জলক বসন্তসেনাকে চুরি-করা গয়না দিতে গিয়ে এই শ্লোকটি বলেছে) 

২. ভাসের চারুদত্তে সজ্জলক (মৃচ্ছকটিকে শর্বিলক) চেটীকে বলছে : উন্মুত্তিকে! সাহসে খলু শ্রীবসতি। 

তুলনীয় : উদ্যোগ : প্রস্তুত : কম্মাস্ত্রীণা সন্তোষমিচ্ছতি। (পঞ্চরাতম্ ২.৮) 

৩. ব্রাহ্মণের সম্পদ হল দক্ষিণা মাত্র। তাও সে অর্থ সৎকর্মেই ব্যয়িত হত। তাই ব্রাহ্মণের ধন চুরি করা মহাপাপ বলে গণ্য হত : তার শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠোর : 

দেবস্বং ব্রাহ্মণস্বং বা লোভে নোপহিনস্তি যঃ। 
স পাপাত্মা পরে লোকে গৃধ্রাস্থিষ্টেন জীবতি ॥ (মনুসংহিতা ১১.২৬) 

৪. তুলনীয় : 

‘স্ত্রী বহুরূপা নিজা কস্য’ (শার্ঙ্গধর) 

৫. শ্লোকটি মিশ্রছন্দে রচিত : প্রথম তৃতীয় ও চতুর্থটি বংশস্থ, শুধু ২য়টি উপেন্দ্রবজ্ৰা। এ ধরনের উপজাতি দেখা যায় না। প্রথম পঙ্ক্তির শেষ অক্ষরটিতে লঘু আছে, ওটিকে দীর্ঘ করে উচ্চারণ করতে হবে। 

৬. মঞ্চটি বেশ বড়ই কল্পনা করতে হবে। এ বিষয়ে Wilson -এর মন্তব্য : The intro- duction of this kind of stageproperty is so constant and essential that it must have been real and shows that the place appropriated to the representation must have been level and spacious.

৭. মদনিকা এখানে ব্রাহ্মণপত্নী হল, তাই, এখন সে শ্রদ্ধেয়। 

ভাসের চারুদত্তে বসন্তসেনা মদনিকাকে বলছে : 

‘আর্যা খল্বিদানীমসি সংবৃত্তা’। 

চতুর্থ অঙ্কের শেষ প্রসঙ্গত ভাসের চারুদত্তের সঙ্গে মৃচ্ছকটিকের তুলনামূলক আলোচনা এসে পড়ে। ভাসের চারুদত্ত চতুর্থ অঙ্কেই শেষ। শেষ হচ্ছে এইভাবে :

গণিকা— এহি ইমং অলঙ্কারং গহ্নিঅ অয্য চারুদত্তং অভিসরিস্যামো।

চেটী— অজ্জু এ! তহ। এদং পুণ অভিসারিআসহাঅভুদং দুদ্দিনং উন্নমিদং। এই দুর্দিনের বর্ণনা দিয়েই মৃচ্ছকটিকের পঞ্চম অঙ্ক শুরু। চারুদত্ত আকাশে তাকিয়ে বলছেন— উন্নমত্যক্কালদুর্দিনম্। পঞ্চম থেকে দশম অঙ্ক পর্যন্ত শূদ্রকের নিজস্ব সৃষ্টি, আর্যক-পালক ঘটনাবিন্যাসও তাঁর নিজস্ব। কিন্তু প্রথম চারটি অঙ্কে শূদ্রক সম্পূর্ণভাবে ভাসের অনুসরণ করেছেন। চতুর্থ অঙ্ক পর্যন্ত মৃচ্ছকটিককে বলা যেতে পারে ভাসের চারুদত্তের বর্ধিত সংস্করণ। অনেক শ্লোকই হুবহু নিয়েছেন। অবশ্য যোগও করেছেন অনেক বেশি শ্লোক। চতুর্থ অঙ্ক পর্যন্ত চারুদত্তের শ্লোকের সংখ্যা ৫৫ আর মৃচ্ছকটিকের ১৪১। অনেক কথাই তিনি নিয়েছেন কিন্তু একটু পূর্ণাঙ্গ করে নিয়েছেন। যেমন, 

চারুদত্তে 

শকার— (বিলোক্য) ভাবে! ণট্‌ঠা ণট্‌ঠা
মৃচ্ছকটিকে 

শকার— ভাবে, ভাবে! বলিয়ে ন্ধু অন্ধআলে মাশলাশি-পরিশ্টা বিঅ মশী-গুডিআ দীশন্দী জ্জেব পণটা বশস্তসেণিতা। 

চারুদত্তে গণিকার প্রাসাদ বর্ণনা মাত্র চারটি পঙ্ক্তিতে শেষ আর মৃচ্ছকটিকে তা সম্পূর্ণ অঙ্কটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে। 

শুধু দৈর্ঘ্যে বা সংযোজনে নয়, ভাবে ও কল্পনায় মৃচ্ছকটিকে শূদ্রক অনুপম কবিত্বশক্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। 

চারুদত্তে নান্দীশ্লোক নেই কিন্তু শূদ্রক তা রেখেছেন! ভাস সূত্রধারের মুখে শুধু প্রাকৃত রেখেছেন, শূদ্রক প্রথমে সংস্কৃত তারপর প্রাকৃত দুটোই রেখেছেন। প্রাকৃতের বৈচিত্র্যও মৃচ্ছকটিকে অনেক বেশি। মৃচ্ছকটিকের প্রাকৃত চারুদত্তের প্রাকৃতের চেয়ে অর্বাচীন কালের বলেই মনে হয়। 

কোনো কোনো পণ্ডিত অবশ্য মনে করেন মৃচ্ছকটিকই পূর্ববর্তী, চারুদত্ত তার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মাত্র। এ তর্ক আজও মেটেনি। আমরা শুধু এই বলব চতুর্থ অঙ্কে চারুদণ্ডেও তার সরল মাধুর্য আমাদের তৃপ্ত করে। 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন