জ্যোতিভূষণ চাকী
মৃচ্ছকটিক – সপ্তম অঙ্ক
(তারপর চারুদত্ত ও বিদূষকের প্রবেশ)
বিদূষক— দেখুন দেখুন, পুরনো বাগান পুষ্পকরণ্ডকের মাধুর্য দেখুন।
চারুদত্ত— বয়স্য! সত্যই তাই। কারণ গাছগুলো বণিকের মতো শোভা পাচ্ছে, ফুলগুলো পণ্যের মতোই সজ্জিত। ভ্রমরেরা বিচরণ করছে, তারা যেন শুল্ক আদায় করতে বেড়িয়েছে ॥ ১ ॥
বিদূষক— বিনা অলঙ্করণেই রমণীয় এই শিলাতলে বসুন আপনি
চারুদত্ত— বয়স্য! বর্ধমানক দেরি করে ফেলেছে।
বিদূষক— বর্ধমানককে তো বলেছিলেম— বসন্তসেনাকে নিয়ে শিগিরই চলে এসো।
চারুদত্ত— তাহলে দেরি করছে কেন? তার সামনে কি অন্য গাড়ি পড়ল যাকে কাটিয়ে যেতে অবকাশের অপেক্ষায় আছে অথবা, অক্ষটি ভেঙে যাওয়ায় তাকে তা বদলাতে হচ্ছে, না কি লাগামই ছিঁড়ে গেল, না কি পথের মাঝখানে কাঠ পড়ে থাকায় তাকে অন্য পথের সন্ধান করতে হচ্ছে, না কি ইচ্ছেমতো বলদদুটোকে চালাতে দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যগতিতে আসছে সে ॥ ২ ॥
(ব্যস্ত আর্যকসহ গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে)
চেট— চল্, বলদজোড়া, চল্।
আর্যক— (স্বগত) রাজপুরুষদের দেখে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ছি, পায়ে শিকল থাকায় পলায়ন এখন সম্পূর্ণ হয়েছে বলা চলে না, সজ্জনের গাড়িতে চড়ে গোপনে চলেছি, এ অবস্থায় নিজেকে মনে হচ্ছে কোকিলের মতো, বায়সীরা যাকে নীড়ে রক্ষা করছে[১] ॥ ৩ ॥
দেখছি নগর থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছে। তাই এখন এই গাড়ি থেকে নেমে এই গভীর কুঞ্জে প্রবেশ করব, নাকি এই গাড়ির মালিককে দেখব? অথবা, কুঞ্জে না হয় নাই গেলাম। শোনা যায় আর্য চারুদত্ত শরণাগতবৎসল। তাই তাঁকে চোখে দেখেই যাব। সেই সজ্জন আমাকে সম্প্রতি বিপদ থেকে সদ্যমুক্ত জেনে সুখীই হবেন। সেই মহাত্মার গুণেই আমি (এখনও) এমন-হাল-হওয়া ধারণ করে আছি ॥ ৪ ॥
চেট— এই সেই উদ্যান। এগিয়ে যাই। (এগিয়ে) আর্য মৈত্রেয়।
বিদূষক— শুনছেন? আপনাকে খোশ্খবর দিচ্ছি। বর্ধমানক কথা বলছে। বসন্তসেনাও নিশ্চয় এসেছেন।
চারুদত্ত— আমার কাছে এ খবর আনন্দের, সত্যই আনন্দের।
বিদূষক— বাঁদীরব্যাটা! এত দেরি করলি কেন শুনি?
চেট— আর্য মৈত্রেয়, রাগ করবেন না। গাড়ির গদি আনতে ভুলে গিয়ে অনর্থক যাতায়াত করতে হল বলে দেরি করে ফেলেছি।
চারুদত্ত— বর্ধমানক, গাড়ি ঘোরাও। বন্ধু মৈত্রেয়, বসন্তসেনাকে নামিয়ে আনো।
বিদূষক— ওঁর পা-দুটি কি শিকলে বাঁধা যে উনি নিজে নামতে পারবেন না? (উঠে এবং গাড়ির আবরণ মোচন করে) ও মা কে? বসন্তসেনা না, এ যে বসন্তসেন!
চারুদত্ত— বয়স্য, আর পরিহাস কোরো না। প্রীতি সময়ের অপেক্ষা করে না। বরং নিজেই নামিয়ে আনছি। (এই বলে উঠলেন)
চারুদত্ত— (গাড়িতে উঠে দেখে) সে কী! তা হলে ইনি কে?
হাতির শুঁড়ের মতো বাহু, সিংহের মতো উঁচু আর চওড়া কাঁধ, প্রশস্ত আর সমান বুক, আনত চোখ দুটি রক্তিম আর চঞ্চল— এমন আকৃতি যার সেই মহাত্ম। এমন দশায় কেমন করে পড়লেন যা তাঁর মোটেই যোগ্য নয়, কারণ তিনি পায়ে আঁটা একটি শিকল বহন করছেন ॥ ৫ ॥
আপনি কে বলুন তো?
আর্যক— আমি শরণাগত গোপালতনয় আৰ্যক।
চারুদত্ত— ঘোষপল্লি থেকে এনে রাজা পালক যাঁকে বন্দি করে রেখেছিলেন?
আর্যক— আজ্ঞে হ্যাঁ।
চারুদত্ত— ভাগ্যই আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে, আপনি আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এসে পড়েছেন। আমি বরং প্রাণ ত্যাগ করব তবু শরণাগত আপনাকে ত্যাগ করব না।। ৬।।
(আর্যক আনন্দের অভিনয় করল)
চারুদত্ত— বর্ধমানক, এর পা থেকে শিকল খুলে দাও।
চেট— তাই করছি, আর্য। (তাই করে) আর্য, শিকল খুলেছে।
আর্যক— কিন্তু ভালোবাসায় গড়া এর চেয়ে বেশি শক্ত অন্য শিকল পরানো হল।[২]
বিদূষক— শিকলগুলো নাও। ওঁকে মুক্ত করা হয়েছে। এবারে আমরা চলি।
চারুদত্ত— না না, এত তাড়া কিসের?
আর্যক— বন্ধু চারুদত্ত, আমিও প্রীতিবশতই আপনার গাড়িতে চড়েছিলাম, ক্ষমা করবেন।
চারুদত্ত— নিজে থেকেই আপনি যে প্রীতি দেখিয়েছেন তাতে আমি অলঙ্কৃত হলাম।
আর্যক— এবারে আপনি অনুমতি দিন আমি যেতে পারি।
চারুদত্ত— আসুন।
আর্যক— যা হোক, এবারে নামি।
চারুদত্ত— বন্ধু, নামবেন না। আপনার শিকলগুলো কেবল খোলা হয়েছে, আপনি দ্রুত চলতে পারবেন না। এ অঞ্চলে গাড়িটাও কিছুটা আস্থার সৃষ্টি করবে, রাজপুরুষেরা অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। তাই গাড়িতেই চলুন।
আর্যক— আপনি যেমন বললেন তাই হোক।
চারুদত্ত— কথাপ্রসঙ্গে আমাকে মনে পড়বে আশা করি।
আর্যক— আমি নিজের আত্মাকে ভুলতে পারি?
চারুদত্ত— পথ চলার দেবতারা আপনাকে রক্ষা করুন।
আর্যক— আপনিই আমাকে রক্ষা করেছেন।
চারুদত্ত— নিজের ভাগ্যেই আপনি রক্ষা পেয়েছেন।
আর্যক— তবু আপনিই তার হেতু ॥ ৭ ॥
চারুদত্ত— যেখানে ‘পালক’ ক্ষমতায় আসীন সেখানে সত্যিকারের নিরাপত্তা কিছুই নেই, তাই অবিলম্বে আত্মগোপন করুন।
আর্যক— হ্যাঁ, তাই করব, তবে আবার দেখা হবার জন্যেই। (প্রস্থান )
চারুদত্ত— রাজার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ করে এখানে আর তিলার্ধ থাকাও ঠিক নয়। মৈত্রেয়, শিকলটা পুরনো কুয়োতে ফেলে দাও। কারণ রাজারা চরদের চোখে সব দেখে ফেলেন[৩] ॥ ৮ ॥
(বাঁ চোখ নাচছে এমন অভিনয় করে)
বন্ধু মৈত্রেয় আমি বসন্তসেনাকে দেখার জন্যে উৎসুক। দেখো-
সেই কান্তাকে না দেখে আমার বাঁ চোখ স্ফুরিত হচ্ছে, অকারণে ভীত আমার মন ব্যথিত হচ্ছে ॥ ৯ ॥
তাই এসো। যাই (পরিক্রমণ)
আমার সামনেই একজন বৌদ্ধ শ্রমণকে দেখছি— এ যে অশুভ লক্ষণঃ। (চিন্তা করে) সে এই পথে আসুক, আমরা বরং এইখানে (আর একটি পথে) যাই।
(প্রস্থান)
॥ ‘আর্যকাপহরণ’ নামে সপ্তম অঙ্ক সমাপ্ত॥
—
টীকা
১. স্বমপত্যজাতমন্যৈদ্বৈজৈঃ পরভৃতাঃ খুল পোষয়ন্তি। –কোকিলেরা নিজের বাচ্চাদের অন্যকে দিয়ে পালন করিয়ে নেয়।
কোকিলদের এই অভ্যাস সম্বন্ধে একটি সমীক্ষা :
‘Much has been written on the Cuckoo’s parasitic habits, but there is considernale disagreement, even between observers. The female appears to lay on egg directly in the selected nest, then removes one of the host’s eggs with her beak, so that the total number of eggs remains the same. Yet it has been reported that if the nest is too small or too fragile she lays her egg on the ground and then carries it to the selected nest.
[Larousse Encyclopedia of Animal life, P- 424 ]
২. আর্যক তার কৃতজ্ঞতাকে সুন্দর করেই প্রকাশ করল, আসন্ন প্রত্যুপকারের ছায়াপাতও ঘটল তার এই কথাগুলোতে।
৩. তুলনীয় :
যস্মাৎ পশ্যতি দূরস্থাঃ সর্বানর্থান্নরাধিপাঃ।
তারেণ তস্মাদুচ্যন্তে রাজানশ্চারচক্ষুষঃ॥ –রামায়ণ
(যেহেতু রাজারা দূর থেকে চরদের মাধ্যমে সব বিষয় দেখেন সেই জন্যে রাজাদের ‘চারচক্ষু’ বলা হয়)
৪. বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর দর্শন অশুভসূচক বলে মনে করা হত। ‘কাষায়ীগুড়তক্র- পঙ্কবিধবাকুব্জা ন দৃষ্টাঃ শুভাঃ’। শুধু কি কাষায় পরিচ্ছদ পরিহিত বলেই বৌদ্ধভিক্ষুদর্শন অশুভসূচক নাকি অন্য কোনো সংস্কার এতে আছে? কিন্তু যে চারুদত্ত এত উদার এবং সহিষ্ণু তিনি এ সংস্কারের বশীভূতই-বা হবেন কেন? তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্ম তো সে সময়ে সমাদৃত। নাটকেও তার আভাস আছে। ‘He who is familiar with the moral teachings of Buddhism will not miss to see in this drama clear traces of moral teachings of Buddhism. — History of Indian literature III, Winterntg, P-232
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন