জ্যোতিভূষণ চাকী
মৃচ্ছকটিক – দশম অঙ্ক
(তারপর চারুদত্তের প্রবেশ, সঙ্গে দুটি চণ্ডাল)
দুজনে— আমাদের মতলব তোমরা ধরতে পারছ না? আমরা দুজন বধ বা বন্ধনের জন্যে নতুন নতুন অপরাধীকে নিয়ে যাওয়ায় দক্ষ। শিগির শিগির মুণ্ডু কেটে ফেলায় এবং শূলে চড়ানোয় ওস্তাদ ॥ ১ ॥
সরুন মশাইরা, সরুন। এই আর্য চারুদত্ত —
যাঁকে করবীর মালা দেওয়া হয়েছে, যিনি এই আমাদের ঘাতকদুজনের জিম্মায় তেল-ফুরনো দীপের মতো ধীরে ধীরে দীপ্তি হারাচ্ছেন। ॥ ২ ॥
চারুদত্ত— (সবিষাদে)—
চোখের জলে ভেজা ধূলোয় ধূসরিত শ্মশানের ফলে বেষ্টিত, রক্তচন্দনে অনুলিপ্ত আমার এই দেহ এখানে কর্কশস্বরে-ডাকতে-থাকা কাকেরা পুজোর নৈবেদ্যের মতো খাবে বলে মনে করছে ॥ ৩ ॥
চণ্ডাল-দুজন— মশাইরা, সরুন, সরুন। মৃত্যুরূপ কুঠারে যাকে কাটা হচ্ছে সেই সৎপুরুষকে দেখে আর লাভ কী? সেই সৎ পুরুষ হলেন গাছের মতো যে-গাছে সুজনরূপ পাখির বাস ॥ ৪ ॥
এসো হে চারুদত্ত, এসো।
চারুদত্ত— পুরুষের ভাগ্য ব্যাপারটা সত্যিই অচিন্তনীয়[১]। কে ভাবতে পেরেছিল আমার এ দশা হবে?
আমার সারা গায়ে রক্তচন্দনের ছাপ এবং পিষ্টচূর্ণের মালা। আমি মানুষ বটে, কিন্তু এখন আমাকে (বলির) পশুই বানানো হয়েছে ॥ ৫ ॥
(সামনের দিকে তাকিয়ে) হায় মানুষের ভাগ্যবিপর্যয় কী শোচনীয়! যে দশায় আমি এসেছি তা দেখেই এই নগরবাসীরা ‘মর্ত্যের মানুষকে ধিক্’ একথা বলে আমাকে বাঁচাতে না পেরে সজল চোখে বলছে— ‘স্বর্গ লাভ করো’ ॥ ৬ ॥
চণ্ডাল-দুজন— সরুন, মশাইরা সরুন।
(বিসর্জনের জন্যে) নীয়মান ইন্দ্রধ্বজ, গাভীর প্রসব, তারাদের স্থানচ্যুতি এবং সৎপুরুষদের বিপত্তি— এই চারটি জিনিস দেখা উচিত নয় ॥ ৭॥
একজন— ওরে আহীন্ত, দেখ দেখ।
নগরীর যিনি প্রধানস্বরূপ ভাগ্যের নির্দেশে তাঁকে বধ করা হচ্ছে বলে আকাশ কি কাঁদছে অথবা বিনা মেঘে বজ্রপাত হচ্ছে? ॥ ৮ ॥
দ্বিতীয়জন— ওরে গোহ, বিনা মেঘে বজ্রও পড়ছে না, মহিলাবৃন্দরূপ মেঘ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছে অঝোর ধারে ॥ ৯ ॥
তাছাড়া—
বধ্যকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু পথের ধুলো উড়ছে না, কারণ— সকলেই কাঁদছে, তাদের চোখের জলে পথ সিক্ত ॥ ১০ ॥
চারুদত্ত— (দেখে, করুণভাবে)
সৌধস্থিত নারীরা জানালার অর্ধাংশ দিয়ে মুখ বের করে আমাকে লক্ষ্য করে ‘হায় চারুদত্ত’ এ-কথা বলে যেন জলনিষ্কাশন প্রণালী দিয়ে অশ্রুধারা বইয়ে দিচ্ছে (অর্থাৎ অঝোরধারে অশ্রুবর্ষণ করছে) ॥ ১১ ॥
চণ্ডাল-দুজন— এসো হে চারুদত্ত, এসো। এটা হচ্ছে ঘোষণার স্থান। ঢাক বাজা। ঘোষণা ঘোষিত কর।
দুজনে— শুনুন, মশাইরা শুনুন। বণিক বিনয়দত্তের নাতি সাগরদত্তের পুত্র এঁর নাম চারুদত্ত। কুকর্মকারী ইনি তুচ্ছ অর্থের জন্যে গণিকা বসন্তসেনাকে পুষ্পকরওক উদ্যানে এনে বাহুপাশে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন, এবং তারপর বা-মাল ধরা পড়েছেন এবং তিনি নিজেই দোষ স্বীকার করেছেন। তারপর রাজা পালক তাঁকে বধ করবার জন্য আমাদের আদেশ দিয়েছেন। যদি অন্য কেউ এই ধরনের অপরাধ করে, যা ইহলোক পরলোক কোনো লোকেই মঙ্গলকর নয়, তাহলে তাঁকেও এই দণ্ড দেবেন।
চারুদত্ত— (সবিষাদে, স্বগত)
আগে শতযজ্ঞে পবিত্র আমার যে বংশ যজ্ঞসভায় এবং ভক্তনিবিড় চৈত্যে বেদপাঠে উজ্জ্বল হয়ে থাকত আমার মরণদশায়, এইসব পাপী এবং ভিন্নধর্মী মানুষেরা সেই বংশের নাম ঘোষণাস্থানে উচ্চারণ করছে! ॥ ১২ ॥
(শিউরে উঠে এবং কান ঢেকে
হা প্রিয়া বসন্তসেনা!
চাঁদের পবিত্র কিরণের মতো শুভ্র তোমার দাঁত, প্রবালের মতো রক্তোজ্জ্বল তোমার অধর। তোমার মুখজাত অমৃত পান করে অসহায় আমি কেমন করে (এই) অপযশের বিষ পান করব? ॥ ১৩ ॥
দুজনে— সরুন, মশাইরা, সরুন।
এই গুণরত্নের আধার, সজ্জনদের দুঃখ (-নদী) পার হবার সেতু। সোনার তৈরি নয় অথচ (মূল্যবান) অলঙ্কার স্বরূপ এই মানুষটিকে আজ নগরী থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ॥ ১৪ ॥
তাছাড়া,
এই সংসারে মানুষ সুখীদের সুখের কথাই ভাবে। কিন্তু বিপন্ন মানুষের হিতকারী সত্যই দুর্লভ ॥ ১৫ ॥
চারুদত্ত— (চারদিক দেখে)
পরিচ্ছদের প্রান্ত দিয়ে মুখ ঢেকে বন্ধুরা ওই দূরে চলে যাচ্ছে। পরও সুখীমানুষের আপনজন হয়ে ওঠে কিন্তু বিপন্নের কেউ বন্ধু হয় না ॥ ১৬ ॥
চণ্ডাল-দুজন— (জনতাকে) সরিয়ে দিয়েছি।
রাজপথ এখন নির্জন। তাই বধ্যচিহ্নে চিহ্নিত একে নিয়ে চলো।
(চারুদত্ত নিশ্বাস ফেলে ‘মৈত্রেয়, আজ কেন?’ ইত্যাদি ৯/২৯ পাঠ করেন।)
হায় পিতা! হায় প্রিয় বন্ধু!
(নেপথ্যে)
চারুদত্ত— (শুনে, করুণভাবে)। হে স্বজাতিশ্রেষ্ঠ, তোমার কাছ থেকে আমি একটি অনুগ্রহ প্রার্থনা করি।
চণ্ডাল-দুজন— কী! আমাদের হাত থেকে তুমি দান নেবে।
চারুদত্ত—ভগবান্ না করুন। তবে চণ্ডাল না-দেখে বিচার-করা দুরাচার পালকের মতো (অত মন্দ) নয়। পরলোকে শান্তির জন্যে আমি ছেলের মুখ দেখতে চাই।
চণ্ডাল-দুজন— তা করতে পার।
হায় পিতা! হায়!
(নেপথ্যে)
চারুদত্ত শুনে করুণভাবে (‘হে স্বজাতিশ্রেষ্ঠ’ ইত্যাদি পাঠ)
চণ্ডাল-দুজনে— হে পুরবাসীগণ, একটু পথ, এই আর্য চারুদত্ত ছেলের মুখ দেখুন। (নেপথ্যের দিকে চেয়ে) আর্য! এদিকে আসুন, এদিকে আসুন।
(তারপর পুত্রসহ বিদূষকের প্রবেশ)
বিদূষক— তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো বাছা। তোমার পিতাকে বধ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বালক— হায় তাত, হায় পিতা!
বিদূষক— হায় প্রিয়বয়স্য! আমি আবার কোথায় তোমাকে দেখব?
চারুদত্ত— (পুত্র ও মিত্রকে দেখে) হায় পুত্র, হায় মৈত্রেয়। (করুণভাবে) কী কষ্ট! পরলোকে দীর্ঘকাল আমাকে পিপাসিত থাকতে হবে, কারণ মৃত্যুর পর আমার জলাঞ্জলি খুব সামান্যই হবে, (কারণ বালকের হাতদুটো যে খুবই ছোট) ॥১৭।। ছেলেকে কী দেব আমি? (নিজের দিকে তাকিয়ে, যজ্ঞোপবীত দেখে হ্যাঁ, একটা জিনিস তো আমার আছে—
মুক্তোর তৈরি নয়, সোনার তৈরি নয়, কিন্তু যা ব্রাহ্মণদের অলংকারস্বরূপ, যা দিয়ে দেবতা এবং পিতৃপুরুষদের অংশ (দেববলি এবং পিতৃপিণ্ডাদি) দান করা হয় (এই ব’লে যজ্ঞোপবীত দিলেন) ॥ ১৮ ॥
চণ্ডাল-দুজনে— এসো হে চারুদত্ত, এসো।
দ্বিতীয়— ওরে তুই আর্য চারুদত্তকে সম্মানবোধক পদ ছাড়া শুধু নাম ধরে ডাকছিস?
দেখ—
উত্থান ও পতনে, দিনে ও রাতে অপ্রতিরোধী গতিতে উদ্দাম কিশোরীর মতোই নিয়তি পুরুষের অনুসরণ করে ॥ ১৯ ॥
তাছাড়া—
তাঁর মর্যাদাদ্যোতক পদবিগুলো কি লুপ্ত হয়েছে? তাঁর কাছে কি মাথা নত করা উচিত নয়? রাহুগ্রস্ত চাঁদ কি মানুষের বন্দনীয় নয়! ॥ ২০ ॥
বালক— ওগো চণ্ডালেরা তোমরা আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
চারুদত্ত— বৎস!
গলায় করবীর মালা, কাঁধে শূল ও হৃদয়ে শোক ধারণ করে যজ্ঞে যূপকাষ্ঠের কাছে নিয়ে যাওয়া ছাগের মতো আজ আমি (চণ্ডালের পিছে পিছে) বধ্যভূমিতে[৪] যাচ্ছি।। ২১ ॥
চণ্ডাল— বালক!
আমরা দুজন চণ্ডালকুলে জাত হলেও চণ্ডাল নই। চণ্ডাল সেই পাপীরা যারা সজ্জনের নিগ্রহ করে ॥ ২২।।
বালক— তাহলে আমার বাবাকে তোমরা হত্যা করতে চলেছ কেন?
চণ্ডাল— হে দীর্ঘায়ু, এ ব্যাপারে রাজার আদেশই দোষী, আমরা নই।
বালক—— আমাকে বধ করো। বাবাকে ছেড়ে দাও।
চণ্ডাল— হে দীর্ঘায়ু। একথা বলে তুমি (আরও) দীর্ঘজীবী হও।
চারুদত্ত— (অশ্রুসিক্ত হয়ে পুত্রকে কণ্ঠে নিয়ে)
এ (পুত্র) হল সেই স্নেহসর্বস্ব জিনিস যা যেমন ধনীর তেমনি নির্ধনের I হল হৃদয়ের অনুলেপন, যদিও তাতে চন্দনও নেই, উশীরও নেই ॥ ২৩ ॥ (‘গলায় করবীর মালা’–২০/২১ ইত্যাদি শ্লোক আবার পাঠ করলেন। দেখে, স্বগত। ‘পরিচ্ছদের প্রান্ত দিয়ে’ ১/১৬ ইত্যাদি শ্লোক আবার পাঠ করলেন।)
বিদূষক— হে ভদ্ৰমুখ! আপনারা আমার প্রিয়বস্য চারুদত্তকে ছেড়ে দিন। আমাকে হত্যা করুন।
চারুদত্ত— ঈশ্বর না করুন! (দেখে, স্বগত) আজ বুঝছি। (‘পরও’–১০/১৬ ইত্যাদি পাঠ করলেন। প্রকাশ্যে সৌধগত—১০/১০ ইত্যাদি শ্লোক আবার পাঠ করলেন)
চণ্ডাল— সরুন, মশাইরা, সরুন। অযশের বশে যে সজ্জন জীবনের আশা ত্যাগ করেছেন, যিনি দড়িছেঁড়া সোনার কলসির মতো কুয়োয় ডুবছেন তাকে দেখছেন কেন? ॥২৪॥
আর-একজন— ওরে, আবার ঘোষণা কর্। (চণ্ডাল তাই করল)
চারুদত্ত— প্রতিকূল দৈবের বশে আমি তো এই শোচনীয় অবস্থায় এসেছি। যার চরম ফল আমার জীবনান্ত। কিন্তু সেই ঘোষণাটি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দিচ্ছে যে- ঘোষণাটিতে আমাকে শুনতে হবে তাকে (আমার প্রিয়তমাকে) আমি হত্যা করেছি ॥২৫॥
তারপর প্রাসাদস্থ বদ্ধ স্থাবরকের প্রবেশ) স্থাবরক— (ঘোষণা শুনে বেদনার্তভাবে) এ কি, নিষ্পাপ চারুদত্তকে বধ করা হচ্ছে? প্রভু আমাকে শিকলে বেঁধে রেখেছে। যাক চিৎকার করি— শুনুন, মহোদয়েরা, শুনুন! ব্যাপারটা এই এই পাপী আমি যান-পরিবর্তনের ফলে বসন্তসেনাকে পুষ্পকরণ্ডক নামে জীর্ণ উদ্যানে এনেছিলাম। তারপর আমার প্রভু ‘আমাকে চাইলি না’ এই বলে বাহুপাশে সবলে এঁকে হত্যা করেছেন, এই আর্য নন। কী! দূর থেকে বলছি বলে কেউ শোনেনি? কী যে করি? লাফিয়ে পড়ি তবে। (চিন্তা করে) যদি তাই করি তাহলে আর্য চারুদত্তকে বধ করা হবে না। যা হোক এই প্রাসাদের নতুন বানানো উঁচু চত্বর থেকে ভাঙা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ি। আমি মরলে কিছু এসে-যায় না। কিন্তু কুলপুত্ররূপ পক্ষীনিবাস আর্য চারুদত্তের মরা কিছুতেই চলবে না। এভাবে যদি আমি মরিও তাহলে আমার পরলোকে (স্বর্গলাভ) তো হবে। (লাফিয়ে পড়ে) আশ্চর্য! আমি মরিনি। আমার ডাণ্ডাবেড়িও শৃঙ্খল খুলে গিয়েছে। এবারে চণ্ডালদের ঘোষণাস্থানটি খুঁজি। (দেখে এবং কাছে গিয়ে) ওহে চণ্ডালেরা, যেতে দাও, যেতে দাও।
চণ্ডাল-দুজন— আরে? কে জায়গা ছাড়তে বলছে?
(চেট—শুনুন, শুনুন এই কথা শুনে আবার বলল)
চারুদত্ত— এ কী! এমন (অ-) সময়ে আমি যখন কালপাশে আবদ্ধ তখন, শস্য অনাবৃষ্টিতে বিপন্ন হলে দ্রোণমেঘের মতো কে উদিত হল? ॥ ২৬ ॥
আপনারা শুনলেন তো? আমি মৃত্যুভীত নই, যশ কলঙ্কিত হল বলেই আমার দুঃখ। আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মৃত্যু আমার কাছে হবে পুত্রজন্মের মতো (আনন্দপ্রদ) ॥ ২৭ ॥
তাছাড়া—
তার সঙ্গে শত্রুতা না করলেও নীচ এবং অল্পবুদ্ধি সে (শকার) আমাকে কলঙ্কিত করল। দূষিত সে বিষাক্ত শরে যেন আমাকেও দূষিত করল ॥২৮॥
চণ্ডাল-দুজন—স্থাবরক! তুমি সত্যি বলছ?
চেট— সত্যি। আমাকেও ‘কাউকেই কিছু বলতে পারবে না’ এই মনে করে প্রাসাদের নতুনগড়া প্রতোলিতে ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে আবদ্ধ করে রেখেছিল।
(প্রবেশ করে )
শকার— (সহর্ষে) আমার বাড়িতে আমি টক টক তেতো তেতো মাংস, শাক এবং মাছের ঝোল, পিঠে আর গুড়ের পায়েস দিয়ে ভাত খেয়েছি[৬] ॥ ২৯ ॥
(কান দিয়ে) ফাটা কাঁসার আওয়াজের মতো খখনে চণ্ডালের গলার স্বর কানে আসছে। যে রকম ঢেঁড়া আর ঢাকের বাদ্যি শুনছি তাতে মনে হচ্ছে দরিদ্র চারুদত্তকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই দেখি। শত্রুবিনাশে, সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে দারুণ আনন্দ হচ্ছে। কোনো বিষাক্ত গুল্মের মধ্যে লুকানো পোকার মতো, আমি বুদ্ধি করে দরিদ্র চারুদত্তের বিনাশ করলাম। এখন নিজের প্রাসাদের নতুন বানানো উঁচু চত্বরে উঠে নিজের পরাক্রম দেখব। (তাই করে এবং দেখে) হা হা! গরিব চারুদত্তকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাবার সময় যদি এমন লোকের ভিড় হয় তাহলে আমার মতো লোককে যখন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হবে তখন কী দারুণ ভিড় হবে? (দেখে) এই যে তাকে নতুন ষাঁড়ের মতো সাজিয়ে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমার প্রাসাদের নতুন গড়া উঁচু চত্বরের কাছে হঠাৎ ঘোষণা হতেই তা থামিয়ে দেওয়া হল কেন? (দেখে) এ কী! স্থাবরক চেটও দেখি এখানে নেই? সে-ই এখান থেকে গিয়ে গুপ্তকথা প্রকাশ করে দেয়নি তো? একেই বরং খুঁজে দেখি। (নেমে এগিয়ে গেল)
চেট (দেখে) মহোদয়গণ, এই তিনি এসেছেন।
চণ্ডাল-দুজন— সরে যাও, জায়গা দাও। দুয়ার বন্ধ করো। চুপ করে থাক। কারণ ওই যে ঔদ্ধত্যের শিং উঁচিয়ে ক্ষ্যাপা ষাঁড় আসছে! ॥ ৩০ ॥
শকার— ওহে জায়গা ছাড়ো, জায়গা ছাড়ো। (এগিয়ে) পুত্র স্থাবরক, এসো আমরা যাই।
চেট— অনার্য তুমি বসন্তসেনাকে হত্যা করেই খুশি হওনি, এখন হত্যা করতে চাও চারুদত্তকে, যিনি প্রাণীজনের কল্পতরুর মতো।
শকার— রত্নকুলের মতো? আমি (অর্থের জন্যে) স্ত্রী-হত্যা করি না।
সকলে— হ্যাঁ, তুমিই হত্যা করেছ। আর্য চারুদত্ত হত্যা করেননি।
শকার— একথা কে বলছে?
সকলে― (চেটকে দেখিয়ে) এই সজ্জন ব্যক্তি বলছে।
শকার― (ভীত হয়ে স্বগত) হায়। স্থাবরক চেটকে আমি ভালো করে বেঁধে রাখিনি কেন? সে-ই আমার কুকর্মের সাক্ষী। (প্রকাশ্যে) মহোদয়গণ! এ মিথ্যা। কারণ আমার এ দাসটি যখন আমার সোনা চুরি করেছিল তখন তাকে আমি মেরেছি, আঘাত করেছি, এবং বেঁধে রেখেছি। এখন এইভাবে শত্রু হয়ে উঠেছে বলে যে যা বলবে তাই হবে সত্যি? (আড়ালে চেটকে সোনার বালা দিয়ে ফিফিস্ করে) পুত্র স্থাবরক, চেট, এটা নিয়ে অন্য কথা বল্।
চেট— (গ্রহণ করে) দেখুন দেখুন মশাইরা, ইনি সুবর্ণের লোভ দেখাচ্ছেন।
শকার— (বালা কেড়ে নিয়ে) এই বালার জন্যেই ওকে শিকলে বেঁধে রেখেছিলাম। (সক্রোধে) ওহে চণ্ডালেরা, আমার সোনা চুরি করার সময় আমি সত্যিই তাকে মেরেছি এবং পিটিয়েছি। আমার কথা যদি বিশ্বাস না করেন, তাহলে তার পিঠ দেখতে পারেন।
চণ্ডাল— (দেখে) ইনি (শকার) যা বলছেন তা ঠিকই। বিক্ষুব্ধ হলে ভৃত্য কী না বলে?
চেট— হায়, দাসত্ব কী দারুণ অভিশাপ, দাসের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। (করুণভাবে) আর্য চারুদত্ত, এইটুকুই করতে পারলুম শুধু। (এই বলে পায়ে পড়ল)
চারুদত্ত— (করুণভাবে) ওঠো, তুমি বিপন্ন সজ্জনের প্রতি করুণা করেছ, হে ধর্মশীল, তুমি অকারণ বন্ধু হয়েই এসেছিলে! আমার মুক্তির জন্যে তুমি অনেক চেষ্টা করলে। দৈব সায় দিল না, আজ তুমি কীই-বা না করলে? ॥ ৩১ ॥
চণ্ডাল-দুজন— ভদ্র, এই চেটকে মেরে তাড়াও।
শকার— দূর হ’ তুই (তাড়াল)। ওহে চণ্ডাল, তোমরা দেরি করছ কেন, একে বধ করো।
চণ্ডাল— যদি তাড়া থাকে, আপনি নিজেই মারুন না।
রোহসেন— ওগো চণ্ডালেরা, তোমরা আমাকে মারো, বাবাকে ছেড়ে দাও।
শকার— ছেলেকে শুদ্ধ একে বধ করো।
চারুদত্ত— এ মূর্খ সব পারে। বাছা, তুমি মায়ের কাছে যাও।
রোহসেন— আমি গিয়ে কী করব?
চারুদত্ত— বৎস, আজ তুমি মাকে নিয়ে কোনো আশ্রমে যাও, পিতৃদোষে তোমারও এমন দশা না হয়। ৩২॥
বয়স্য, একে নিয়ে যাও।
বিদূষক— বন্ধু, তোমাকে ছাড়া আমি প্রাণধারণ করব তোমার কি ধারণা?
চারুদত্ত— তোমার জীবন তোমার আয়ত্তে। তাই তাকে ত্যাগ করা তোমার উচিত হবে না।
বিদূষক— (স্বগত) এ-কথা ঠিক। তবুও প্রিয় বন্ধু-বিরহিত হয়ে প্রাণধারণ করতে পারছি না। তাই আমি ব্রাহ্মণীর কাছে ছেলেকে সমর্পণ করে প্রাণত্যাগ করে প্রিয় বন্ধুর অনুগমন করব। (প্রকাশ্যে) বন্ধু, একে আমি এক্ষুণি নিয়ে যাচ্ছি।
(সে চারুদত্তকে কণ্ঠে আলিঙ্গন করল এবং পায়ে পড়ল)
(ছেলেটিও কাঁদতে কাঁদতে পায়ে পড়ল)
(চারুদত্ত ভীতির অভিনয় করলেন)
চণ্ডাল-দুজন— পুত্রসহ চারুদত্তকে বধ করো— রাজা আমাদের এমন আদেশ দেননি। চলে যাও বালক, চলে যাও। (নিষ্ক্রান্ত করালো) এই হল তৃতীয় ঘোষণার স্থান। ঢেঁড়ায় আঘাত করো।
(আবার ঘোষণা করল)
শকার— (স্বগত) ব্যাপার কী! নাগরিকেরা দেখি এটা বিশ্বাস করছে না? (প্রকাশ্যে) ওহে নচ্ছার চারুদত্ত, পুরবাসীরা বিশ্বাস করছে না, তাই নিজের জিভ দিয়েই বলো, ‘বসন্তসেনাকে হত্যা করেছি’।
(চারুদত্ত নীরব রইলেন)
ওরে চণ্ডাল, শুনছ? বজ্জাত চারুদত্ত কথা বলছে না। তাই তোমার ঢাকের কাঠি এই জীর্ণ বাঁশের টুকরোটা দিয়েই একে বারবার মেরে বলাও।
চণ্ডাল— (প্রহারের জন্যে হাত তুলে) ওহে চারুদত্ত, বলো!
চারুদত্ত— (করুণভাবে) বিপদরূপ মহাসমুদ্রের এই গভীর জলে পড়েও আমার মনে কোনো ভয় বা বিষাদ নেই। এই লোকনিন্দার আগুনই আমাকে দগ্ধ করছে যে এখন আমাকে বলতে হবে ‘আমিই প্রিয়াকে হত্যা করেছি’ ॥ ৩৩ ॥
(শকার আবার তা-ই বলতে লাগল)
শকার— পুরবাসীগণ! (‘নৃশংস আমি তাকে’–৯/৩০/৩৮ ইত্যাদি শ্লোক আবার পাঠ করলেন)
চারুদত্ত— ‘হত্যা করেছি।’
শকার— তাই হোক।
প্রথম-চণ্ডাল— ওরে আজ তোরই বধ করার পালা।
দ্বিতীয়-চণ্ডাল— ওরে, তোর।
প্রথম-চণ্ডাল—ওরে, আঁচড় কেটে দেখি। (নানারকম আঁচড় কেটে) ওরে, যদি আমারই বধ করার পালা হয় তা হলে একটু অপেক্ষা কর্।
দ্বিতীয়-চণ্ডাল— কেন?
প্রথম-চণ্ডাল— স্বর্গে যাবার সময় আমার পিতা আমাকে বলেছিলেন— পুত্র বীরক, যদি তোমারই বধ করবার পালা হয় তাহলে সহসা বধ্যকে বধ কোরো না।
দ্বিতীয়-চণ্ডাল— কেন বল্ তো শুনি?
প্রথম-চণ্ডাল—কখনও কোনো সজ্জন যদি অর্থ দিয়ে বধ্যকে মুক্ত করেন। কখনও রাজার পুত্র হলে আনন্দোৎসবের জন্যে সমস্ত বধ্যের মুক্তি হতে পারে। কখনও হাতি বন্ধন ভাঙলে যে চাঞ্চল্য দেখা দেয় তাতে বধ্য মুক্ত হতে পারে। কখনও-বা রাজার পরিবর্তন ঘটে, তাতেও সমস্ত বধ্যের মুক্তি হতে পারে।
শকার— কী কী? রাজার পরিবর্তন?
চণ্ডাল— ওরে, তাহলে বধ করবার পালা আমাদের কার কখন সেটা লিখে ফেলা যাক।
শকার— ওরে, এক্ষুনি বধ কর্ চারুদত্তকে।
চণ্ডাল— আর্য চারুদত্ত, রাজার আদেশই অপরাধী, আমরা চণ্ডালরা নই। তাই যা স্মরণ করার তা স্মরণ করো।
চারুদত্ত— ক্ষমতাবান পুরুষদের বাক্যে ভাগ্যদোষে যদিও কোনোভাবে আমি দোষী সাব্যস্ত হয়েছি তবুও যদি ধর্মের কোনো প্রভাব থাকে তা হলে তিনি (বাসবদত্তা) সুরলোকেই থাকুন বা যেখানেই থাকুন, তিনি নিজগুণে আমার কলঙ্ক ক্ষালন করুন।।৩৪।।
ওহে, আমাকে এখন কোথায় যেতে হবে?
চণ্ডাল— (সামনের পথ দেখিয়ে) এই যে দক্ষিণ শ্মশান দেখা যাচ্ছে যা দেখলেই বধ্যেরা তৎক্ষণাৎ (ভয়ে) মরে। দেখ দেখ—
উঁচুদিকে শরীর তোলা শিয়ালেরা শূলে ঝোলানো শরীরটাকে টানছে, আর (উপর দিকের) বাকি অংশ বিকট হাসির রূপান্তর বলে মনে হচ্ছে ॥ ৩৫ ॥
চারুদত্ত— হায়, হতভাগ্য আমার সর্বনাশ হল!
শকার— এখন যাব না। হত্যা করা হচ্ছে এমন অবস্থায় চারুদত্তকে দেখে যাব। (পরিক্রমা করে দেখে) এ কী, বসে পড়ল যে!
চণ্ডাল— চারুদত্ত, ভয় পেলে কী?
চারুদত্ত— (হঠাৎ উঠে) মূর্খ।
(আমি মৃত্যুভীত নই… ১০/২৭ ইত্যাদি শ্লোক পাঠ করলেন
চণ্ডাল— আর্য চারুদত্ত, আকাশতলবাসী চন্দ্রসূর্যও বিপন্ন হন, মরণভীরু মানুষজনের কথা আর কী বলব? এ সংসারে কেউ উঠে তারপর পড়ে, কেউ-বা পড়ে তারপর ওঠে!
শব উঠে আবার পড়ে বসনত্যাগের প্রক্রিয়াটা দেখিয়ে দেয়। একথা মনে রেখে নিজেকে আশ্বস্ত করো ॥ ৩৬ ॥
(দ্বিতীয় চণ্ডালের প্রতি) এটি হল চতুর্থ ঘোষণা স্থান। তাই ঘোষণা করি।
(আবার সেইভাবেই ঘোষণা করল)।
চারুদত্ত— হায় প্রিয়া বসন্তসেনা! (চাঁদের মতো পবিত্র— ১০/১৩ ইত্যাদি শ্লোক আবার পাঠ করলেন)
(তারপর সন্ত্রস্তা বসন্তসেনা ও ভিক্ষুর প্রবেশ)
ভিক্ষু— আশ্চর্য। অস্থানে মূর্ছিতা বসন্তসেনাকে আশ্বস্ত করে সঙ্গে নিয়ে যেতে যেতে আমি সন্ন্যাসগ্রহণে কৃতকৃত্য হলাম। উপাসিকা! আপনাকে কোথায় নিয়ে যাব?
বসন্তসেনা— আর্য চারুদত্তের বাড়িতে। চন্দ্রতুল্য তাকে দেখিয়ে আমাকে কুমুদিনীর মতো আনন্দ দিন।
ভিক্ষু— (স্বগত) কোন পথ দিয়ে যাব? (চিন্তা করে) রাজপথ দিয়েই যাই। উপাসিকা, আসুন। এই রাজপথ। (শুনে) এ কী! এই রাজপথে তুমুল কোলাহল শোনা যাচ্ছে কেন?
বসন্তসেনা— (সামনে দেখে) সামনে বিপুল জনতা যে! আর্য! ব্যাপার কী জানুন তো। উজ্জয়িনী যেন একটা জায়গায় উঁচু হয়ে উঠেছে, পৃথিবী যেন অসম ভারে ভারাক্রান্তা হয়েছেন?
চণ্ডাল— এই হচ্ছে শেষ ঘোষণাস্থান। ঢেঁড়ায় আঘাত হান্, ঘোষণা কর্। (তাই করে) ওহে চারুদত্ত, প্রস্তুত হও, ভয় পেও না, এক্ষুণি তোমাকে বধ করা হবে। হে দেবতারা!
ভিক্ষু— (শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে) উপাসিকা, আপনাকে চারুদত্ত হত্যা করেছে এই বলে চারুদত্তকে বধ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বসন্তসেনা— (সন্ত্রস্ত হয়ে) হায় ধিক্, হায় ধিক্। হতভাগিনী আমার জন্যে চারুদত্তকে বধ করা হচ্ছে। শিগির শিগগির পথ দেখিয়ে দিন।
ভিক্ষু— উপাসিকা, জীবিত অবস্থায় আর্য চারুদত্তকে আশ্বস্ত করতে শিগিরই চলুন, শিগিরই চলুন।
বসন্তসেনা— জায়গা দিন, জায়গা দিন।
চণ্ডাল— আর্য চারুদত্ত! প্রভুর আদেশই অপরাধী, আমরা নই। তাই যা স্মরণ করার তাই স্মরণ কর।
চারুদত্ত— কী আর বলব? (ক্ষমতাবান পুরুষদের— ১০-৩৪ ইত্যাদি শ্লোক আবার পাঠ করলেন)
চণ্ডাল— (খড়গ আকর্ষণ করে) চিৎ হয়ে সোজা হয়ে থাক, এক কোপে তোমাকে স্বর্গে পাঠাব। (চারুদত্ত সেইভাবে থাকলেন)।
চণ্ডাল— (প্রহারে উদ্যত। কিন্তু হাত থেকে খড়গপতনের অভিনয় করে) এ কী! যদিও আমি সরোষে বাঁট ধরে এটি আকর্ষণ করে মুষ্টিতে ধারণ করেছি তবু বজ্রতুল্য এই খড়গ কেন মাটিতে পড়ে গেল? ॥ ৩৭ ॥
এমন যখন হল তখন মনে হচ্ছে আর্য চারুদত্তকে নিহত হতে হবে না। সহ্যবাসিনী ভগবতী![৯] অনুগ্রহ করো! চারুদত্তের যদি মুক্তি হয় তাহলে তুমি চণ্ডালকুলকে অনুগৃহীত করবে।
অপরজন— যা আদেশ তাই করব।
(দুজনে চারুদত্তকে শূলে চড়াতে চাইল)
(চারুদত্ত ক্ষমতাবান্ পুরুষদের— ইত্যাদি শ্লোক পাঠ করলেন।)
ভিক্ষু ও বসন্তসেনা— (দেখে) ভদ্রমহোদয়েরা! এমন যেন না হয়, এমন যেন না হয়। মহোদয়েরা, এই আমি সেই হতভাগিনী যাঁর জন্যে (ওঁকে) বধ করা হচ্ছে।
চণ্ডাল— (দেখে) কেশভার কাঁধে লুটিয়ে পড়া এই মহিলাটি আবার কে, যিনি হাত তুলে ‘না, না, এমন যেন না হয়’ বলতে বলতে দ্রুত এদিকেই আসছেন? ॥৩৮ ॥
বসন্তসেনা— আর্য চারুদত্ত, এ কী হল? (এই বলে পায়ে পড়লেন )
চণ্ডাল— (সভয়ে সরে গিয়ে) এ কী! এ বসন্তসেনা? আমাদের কী ভাগ্য যে আমরা একজন নির্দোষ মানুষকে বধ করিনি।
ভিক্ষু— (উঠে) আহা চারুদত্ত বেঁচে আছেন।
চণ্ডাল— শতবর্ষ বাঁচবেন।
বসন্তসেনা— (সহর্ষে) আমিও যেন পুনর্জীবিতা হলাম।
চণ্ডাল— যাই এ ঘটনা যজ্ঞবাটিকায়-গত রাজাকে জানাই। (নিষ্ক্রমণ
শকার— (বসন্তসেনাকে দেখে সত্রাসে) আশ্চর্য! গর্ভদাসীকে বাঁচাল কে? আমার প্রাণ গেল তাহলে! যাক— পালাই। (পালাল)
চণ্ডাল— (এগিয়ে এসে) রাজা আমাদের এই আদেশ দিয়েছিলেন ‘যে তাকে (বসন্তসেনাকে) বধ করেছে তাকে বধ কর’। তাহলে রাষ্ট্রীয় শ্যালককেই এবারে খুঁজি আমরা। ( নিষ্ক্রান্ত )
চারুদত্ত— (সবিস্ময়ে) শস্ত্র যখন উদ্যত, আমি যখন মৃত্যুর মুখগহ্বরে তখন অনাবৃষ্টিহত শস্যে দ্রোণ-মেঘের বৃষ্টির মতো কোন্ নারী এল? ॥ ৩৯ ॥ (দেখে) এ কি দ্বিতীয় বসন্তসেনা? না কি সেই বসন্তসেনা যে স্বর্গ থেকে নেমে এল? না কি আমার ভ্রান্ত মন তাকে এইভাবে দেখছে? অথবা এমন কি হতে পারে যে বসন্তসেনা আদৌ মরেইনি, সেই বসন্তসেনাই এসেছে? ॥ ৪০ ॥
অথবা—
সে কি আমাকে জীবন দান করতে স্বর্গ থেকে এল? না কি এ অন্য কেউ এল, আকৃতিতে যে তারই মতো? ॥ ৪১ ॥
বসন্তসেনা— (সাশ্রুনেত্রে উঠে পায়ে পড়ল) আর্য চারুদত্ত, আমিই সেই পাপিনী যার জন্যে তুমি এই অবস্থায় এসেছ।
(নেপথ্যে )
আশ্চর্য আশ্চর্য! বসন্তসেনা জীবিত! (সকলে একথার পুনরুক্তি করল)
চারুদত্ত— (শুনে সহসা উঠে স্পর্শসুখ অভিনয় করে নিমীলিত চোখে আনন্দে গদ্গদস্বরে) তুমিই বসন্তসেনা?
বসন্তসেনা— আমিই সেই হতভাগিনী।
চারুদত্ত— (সহর্ষে) হ্যাঁ, বসন্তসেনাই। (সহর্ষে) আমি যখন মৃত্যুর কবলে তখন অশ্রুধারায় স্তনযুগলকে স্নান করিয়ে, বিদ্যার[১০] মতো তুমি কোথা থেকে এলে?। ৪২।
প্রিয়া বসন্তসেনা!
আমার যে দেহ তোমার কারণেই বিনষ্ট হচ্ছিল তা আবার তুমিই বাঁচালে। প্রিয় প্রিয়মিলনের কী প্রভাব! না হলে যে মৃত সে কখনও আবার বেঁচে ওঠে? ॥ ৪৩ ॥
তা ছাড়া, প্রিয়ে দেখ—
সেই রক্তবস্ত্র এবং মালা বধূমিলনে বরের সজ্জার মতোই দেখাচ্ছে। আর এই বধ্য পটহের বাদ্য যেন বিবাহের পটহবাদ্যের মতোই হল।।৪৪ ॥
বসন্তসেনা— তোমার অতি-ঔদার্যে তুমি কেমন করে নিজেকে এ অবস্থায় আনলে?
চারুদত্ত— প্রিয়ে, তোমাকে আমি হত্যা করেছি— এই বলে আমার প্রবল শত্রু পূর্ববদ্ধ শত্রুতায় নিজে নরকে যেতে যেতে আমাকে এই অবস্থায় ফেলেছে ॥ ৪৫ ॥
বসন্তসেনা— (কান ঢেকে) ভগবান না করুন। সেই রাজশ্যালকই আমাকে হত্যা করেছিল।
চারুদত্ত— (ভিক্ষুকে দেখে) ইনি কে?
বসন্তসেনা— সেই অনার্য আমাকে হত্যা করল আর আর্য আমাকে জীবন দান করলেন।
চারুদত্ত— নিঃস্বার্থ বন্ধু কে আপনি?
ভিক্ষু— আপনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমিই আপনার চরণসংবাহনার ভার নিয়েছিলাম, আমার নাম সংবাহক। জুয়াড়িরা আমাকে ধরেছিল কিন্তু এই উপাসিকা আমি আপনার সেবক জেনে একটি অলংকার দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন। তারপর জুয়ায় বিরক্ত হয়ে আমি বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়েছি। এই আর্যা, শকট-বিপর্যয়ে পুষ্পকরণ্ডক উদ্যানে গিয়েছিলেন। এবং সেখানে সেই দুশ্চরিত্র ‘আমাকে গণ্য করলে না’ এই বলে বাহুপাশে শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করলেন। এই অবস্থায় আমি এঁকে দেখলাম।
(নেপথ্যে কলরব)
দক্ষযজ্ঞবিনাশক বৃষভকেতুর[১১] জয় হোক, তারপর জয় হোক ক্রৌঞ্চপর্বতবিদারক ক্রৌঞ্চরিপু কার্তিকেয়ের,[১২] তারপর জয় হোক আর্যকের, যিনি প্রবল শত্রুকে বধ করেছেন এবং সমগ্র বসুন্ধরাকে জয় করেছেন, যার (যে বসুন্ধরার) শুভ্র পতাকা হল কৈলাসপর্বত ॥ ৪৬ ॥
(হঠাৎ প্রবেশ)
শর্বিলক— হে পুরবাসীরা! সেই দুষ্ট রাজা পালককে হত্যা করে তার রাজ্যে আর্যককে অভিষিক্ত করে, তারই শেষ আজ্ঞা মাথায় নিয়ে আমি (এখন) বিপন্ন চারুদত্তকে মুক্ত করব ॥ ৪৭ ॥
সেই শক্তি ও সুমন্ত্রণাহীন শত্রুকে বধ করে উৎকর্ষবলে সমস্ত পুরবাসীকে আশ্বস্ত করে, আমরা শত্রুর সমগ্র রাজ্য সার্বভৌমত্বসহ জয় করেছি, এ যেন ইন্দ্রেরই নিজের রাজ্য ॥ ৪৮ ॥
(সামনে দেখে) যা হোক। যেখানে লোক জমা হয়েছে তিনি সেইখানেই আছেন। মনে হয় রাজা আর্যকের (রাজত্বের) এই আরম্ভ চারুদত্তের জীবনলাভের মধ্য দিয়ে সার্থক হবে। (অত্যন্ত দ্রুত উপস্থিত হয়ে) সরে যাও, মূর্খেরা। (দেখে, সহর্ষে) চারুদত্ত বসন্তসেনাসহ তাহলে জীবিত আছেন? আমার প্রভুর ইচ্ছা সম্পূর্ণ হল।
সৌভাগ্যবশত গুণে (পক্ষে, দড়িতে) আকৃষ্ট সুশীলা (পক্ষে, সঘটিতা) নৌকার মতো প্রিয়তমা বসন্তসেনার সাহায্যে অপার বিপত্তিসাগর পার-হওয়া চারুদত্তকে দীর্ঘদিন পর গ্রহণমুক্ত জ্যোৎস্নাবদ্ধ চাঁদের মতো দেখছি ॥ ৪৯ ॥ কিন্তু মহাপাপ করে (তাঁর থেকে চুরি করে) এখন তার কাছে যাব কী করে? অথবা, ঋজুতা সর্বত্রই শোভা পায়। (প্রকাশ্যে উপস্থিত হয়ে যুক্ত করে আর্য চারুদত্ত!
চারুদত্ত— আপনি কে?
শর্বিলক— আপনার বাড়িতে সিঁধ কেটে গচ্ছিত ধন চুরি করেছিল আমি সেই মহাপাপী (এখন) আপনারই শরণ নিচ্ছি ॥ ৫০ ॥
চারুদত্ত— সখা, একথা বোলো না। তোমার সে কাজ আমার পক্ষে অনুগ্রহই হয়েছিল।
(গলা জড়িয়ে ধরলেন)
শর্বিলক— তাছাড়া—
সচ্চরিত্র আর্যক যজ্ঞবাটিকায় স্থির দুরাত্মা পালককে পশুর মতো বধ করে (নিজের) কুল ও মান রক্ষা করছে। ॥ ৫১ ।।
চারুদত্ত— কী?
শর্বিলক— আপনার গাড়িতে চড়ে একদিন আপনার শরণ নিয়েছিল সে আজ যজ্ঞস্থলে যে পালককে পশুর মতো হত্যা করছে ॥ ৫২॥
চারুদত্ত— শর্বিলক, পালক যাকে ঘোষপল্লি থেকে অকারণে এনে গুপ্তকক্ষে বন্দি করে রেখেছিল এবং তুমি যাকে মুক্ত করেছিলে এ কি সে-ই (আর্যক)?
শর্বিলক— আপনি যা বললেন তাই।
চারুদত্ত— আমার পক্ষে এ সুসংবাদও বটে।
শর্বিলক আর্যক উজ্জয়িনীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েই আপনার বন্ধু আপনাকে বেনানদীর তীরবর্তী কুশাবতী[১৩] নগরী অর্পণ করেছে। আপনি বন্ধুর এই প্রথম অনুরোধ গ্রহণ করুন। (কিছু দিয়ে) ওহে কে আছ? সেই পাপী রাষ্ট্রীয় শঠকে ধরে আনো।
(নেপথ্যে )
শর্বিলকের যা আদেশ।
শর্বিলক— আর্য, রাজা আর্যক জানাচ্ছেন— আপনারই সৌজন্যে আমি এই রাজ্য পেয়েছি। এ রাজ্য আপনি উপভোগ করুন।
চারুদত্ত— আমার গুণে এ রাজ্য উপার্জিত!
(নেপথ্যে)
ওরে রাষ্ট্রীয় শ্যালক, এসো এসো, নিজের কুকর্মের ফল ভোগ করো।
(তারপর পিছনে হাত-বাঁধা অবস্থায় প্রহরীবেষ্টিত শকারের প্রবেশ)
শকার— আশ্চর্য!
দড়ি-ছেঁড়া গাধার মতো আমি অনেকটা পূর্বেই পালিয়েছিলাম, কিন্তু বন্য কুকুরের মতো আবার আমাকে ধরে আনা হল ॥ ৫৩ ।।
(চারদিক দেখে) এই রাষ্ট্রীয় এখন চারদিকে প্রহরীবেষ্টিত। তাহলে অসহায় আমি কার শরণ নেব? যাই, সেই শরণাগতবৎসলের কাছেই যাই। (এগিয়ে এসে) আর্য চারুদত্ত, রক্ষা করুন, রক্ষা করুন! (এই বলে পায়ে পড়ল)
(নেপথ্যে)
আর্য চারুদত্ত, ওকে ছেড়ে দিন ওকে ছেড়ে দিন, একে বধ করতে দিন আমাদের।
শকার— (চারুদত্ত) হে অসহায়ের সহায়, রক্ষা করুন।
চারুদত্ত— (সদয়ভাবে) ভয় নেই, শরণাগতের ভয় নেই।
শর্বিলক— (অধৈর্যভাবে) আহ্! চারুদত্তের কাছ থেকে ওকে সরিয়ে নিয়ে যাও। (চারুদত্তকে) বলুন, এই পাপীকে কোন শাস্তি দেওয়া হবে? ওরা (চণ্ডালেরা) ওকে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে যাক। তারপর একে কি কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে? না শূলে চড়ানো হবে, না করাত দিয়ে কাটা হবে? ॥ ৫৪ ॥
চারুদত্ত— আমি যা বলব তাই কি করা হবে?
শর্বিলক— এ বিষয়ে সন্দেহের কী আছে?
শকার— প্রভু চারুদত্ত! আমি আপনার শরণাগত। রক্ষা করুন, রক্ষা করুন। আপনার পক্ষে যা শোভা পায় তাই করুন। আমি আর এমন কাজ করব না।
(নেপথ্যে পুরজন)
ওকে হত্যা করো। (এমন) পাপী বেঁচে থাকবে কেন?
(বসন্তসেনা বধ্যমালা চারুদত্তের গলা থেকে নিয়ে শকারের উপরে নিক্ষেপ করল)
শকার— গর্ভদাসীর কন্যা! প্রসন্ন হও, প্রসন্ন হও। আমি আর তোমাকে বধ করব না। আমাকে বাঁচাও।
শর্বিলক— ওরে, একে সরিয়ে নে। আর্য চারুদত্ত— এই পাপীকে কী করা হবে? চারুদত্ত— আমি যা বলব তা করা হবে?
শর্বিলক— এ বিষয়ে সন্দেহ কী?
চারুদত্ত— সত্যি?
শর্বিলক— সত্যি।
চারুদত্ত— যদি তাই হয় তাহলে শিগগিরই একে–
শর্বিলক— বধ করা হবে?
চারুদত্ত— না, না, মুক্তি দেওয়া হবে।
শর্বিলক— কেন?
চারুদত্ত— শত্রু যদি অপরাধ করে শরণপ্রার্থী হয়ে পায়ে পড়ে তাকে অস্ত্র দিয়ে মারতে নেই—
শর্বিলক- তা হলে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হোক।
চারুদত্ত— না, উপকার দিয়ে তাকে প্রত্যাঘাত করতে হবে ॥ ৫৫ ॥
শর্বিলক— কী আশ্চর্য। কী করব? আর্য বলুন।
চারুদত্ত— তাই, একে ছেড়ে দাও।
শর্বিলক— ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক।
শকার— (আশ্চর্য) পুনর্জীবিত হলাম। (রক্ষীদের সঙ্গে প্রস্থান )
(নেপথ্যে কলরব, পুনরায় নেপথ্যে)
আর্য চারুদত্তের বধূ আর্যা ধূতা অগ্নিতে প্রবেশ করছেন। তাঁর পায়ের কাছে আঁচলে ধরে থাকা ছেলেটাকে তিনি সরিয়ে দিচ্ছেন, জলভরা চোখে লোকেরা তাঁকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করছেন
(শুনে, নেপথ্যের দিকে তাকিয়ে)
এ কী চন্দনক? এ কী?
চন্দনক— (প্রবেশ করে) আপনি কি দেখেননি? মহারাজের প্রাসাদের দক্ষিণে বহু লোকের ভিড় জমেছে। (‘আর্য চারুদত্তের বধূ’ ইত্যাদি আবার পাঠ করল) আমি তাঁকে বলেছি, আর্যে, হঠকারিতা করবেন না, আর্য চারুদত্ত বেঁচে আছেন। কিন্তু দুঃখভারাক্রান্ত অবস্থায় কে শোনে আর কে বিশ্বাস করে?
চারুদত্ত— (সোদ্বেগে) আমি বেঁচে থাকতেও তুমি এ কী করতে চলেছ : (উঁচুতে তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে) চারুচরিতা! তোমার কাজ (মহত্ত্ব) ঠিক এ পৃথিবীতে মাপা যায় না। তবুও হে পতিব্রতা, স্বামীকে ছেড়ে পরলোকের সুখভোগ তোমার উচিত নয় ॥ ৫৬ ॥ (মূর্ছিত হলেন)
শর্বিলক— কী অঘটন! সেখানে (ধূতা দেবীর কাছে) আমাদের অবিলম্বে যাওয়া উচিত, অথচ এদিকে আর্য মূর্ছিত হলেন। হায় ধিক্, আমাদের চেষ্টা সবদিক দিয়ে ব্যর্থ হতে চলেছে দেখছি ॥ ৫৭ ।।
বসন্তসেনা— আশ্বস্ত হও, আর্য। সেখানে গিয়ে আর্যাকে রক্ষা করো। তা না হলে অধৈর্যে অনর্থ হতে পারে।
চারুদত্ত— (আশ্বস্ত হয়ে হঠাৎ উঠে) হায় প্রিয়ে, তুমি কোথায়? আমাকে প্রত্যুত্তর দাও।
চন্দনক— এদিকে আসুন, আর্য, এদিকে আসুন।
(সকলে পরিক্রমা করল)
(তারপর যথানির্দিষ্টা ধূতা, অঞ্চলসংলগ্ন রোহসেন এবং বিদূষক ও রদনিকার প্রবেশ)
ধূতা— (অশ্রুসিক্ত হয়ে) বাছা! আমাকে বাধা দিসনে। আমার ভয় হচ্ছে পাছে স্বামীর সম্বন্ধে দুঃসংবাদটা আমার কানে যায়। (তিনি উঠলেন, আঁচল মুক্ত করলেন এবং আগুনের দিকে চললেন)
রোহসেন— মা, আমার জন্যে অপেক্ষা করো। তুমি ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।
(তাঁর কাছে দ্রুত ছুটে এসে সে আবার আঁচল ধরল)
বিদূষক— আপনি ব্রাহ্মণী বলে, ঋষিরা পৃথকভাবে[১৪] আরোহণ করাকে পাপ বলে বিধান দিয়েছেন।
ধূতা— আমার স্বামীর সম্বন্ধে দুঃসংবাদ শোনার চেয়ে পাপ করাও ভালো।
শর্বিলক— (সামনে তাকিয়ে) আর্যা প্রায় আগুনের কাছে এসে পড়েছেন।
শিগগির, শিগগির।
(চারুদত্ত দ্রুত ছুটে চললেন)
ধূতা— রদনিকা, বালককে দেখো যাতে আমি যা ভাবছি তা করতে পারি।
চেটী— (করুণভাবে) আমিও আমার প্রভুপত্নীর কাছে যা শিখেছি তাই করতে যাচ্ছি।
ধূতা— (বিদূষককে দেখে) আর্য, আপনিই ওকে দেখবেন।
বিদূষক— (সাবেগে) কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে হলে ব্রাহ্মণের নেতৃত্বেই তা করতে হয়। তাই আমি আর্যার অগ্রবর্তী হব।
ধূতা— এ কী! দুজনেই আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করল। (বালককে আলিঙ্গন করে) বাছা তুমি নিজেই নিজেকে দেখো। যাতে আমাদের দুজনকে তিলাঞ্জলি দিতে পার। যিনি নাগালের বাইরে তাঁর ওপর কিছু আশা করে তো লাভ নেই (সনিশ্বাসে) আর্যপুত্র তো আর তোমাকে দেখবেন না!
চারুদত্ত— (শুনে, হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে) আমিই আমার পুত্রের ভার নেব। (এই বলে বালককে দু-হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন)
ধূতা— (দেখে) আশ্চর্য! আর্যপুত্রের গলার স্বর শুনছি মনে হচ্ছে। (তারপর ভালো করে দেখে সহর্ষে) কী ভাগ্য আমার! ইনি তো আর্যপুত্রই দেখছি। কী আনন্দ! কী আনন্দ আমার!
বালক— (দেখে, সহর্ষে) আশ্চর্য! বাবা, আমাকে আলিঙ্গন করছেন। মা, এবার তুমি খুশি তো? বাবা নিজেই আমার ভার নিলেন!
(এই বলে সে প্রত্যালিঙ্গন করল)
চারুদত্ত— (ধূতাকে) হায় প্রেয়সী! স্বামী জীবিত থাকতে এ ভয়ঙ্কর কাজ তুমি করতে চলেছিলে কেন? সূর্য অস্ত না যেতে কি পদ্মিনী নয়ন নির্মীলিত করে? ॥ ৫৮ ॥
ধূতা— আর্যপুত্র, এই জন্যেই তো তাকে অচেতন বলা হয়।
বিদূষক— (দেখে সহর্ষে) আশ্চর্য! এই দুটো চোখ দিয়ে প্রিয় বয়স্যকে দেখছি। পতিব্রতার কী শক্তি! অগ্নিতে প্রবেশের সংকল্প করেই তিনি প্রিয়সঙ্গ লাভ করলেন। (চারুদত্তকে) জয় হোক, প্রিয় বয়স্যের জয় হোক।
চারুদত্ত— এসো মৈত্রেয়। (এই বলে আলিঙ্গন করলেন)
চেটী— ঘটনার কী বিচিত্র গতি! আর্য, প্রণাম করি। (এই বলে চারুদত্তের পায়ে পড়ল)
চারুদত্ত— (পিঠে হাত দিয়ে) রদনিকা ওঠো। (এই বলে তাকে ওঠালেন)
ধূতা— (বসন্তসেনাকে দেখে) কী সৌভাগ্য! ভগিনী নিরাপদ।
বসন্তসেনা— এখন সত্যিই আমি নিরাপদ হলাম।
(পরস্পর আলিঙ্গনবদ্ধ হলেন)
শর্বিলক— সৌভাগ্যবশত আপনার বন্ধুবর্গ সবাই জীবিত।
চারুদত্ত— তোমারই অনুগ্রহে।
শর্বিলক— আর্যা বসন্তসেনা। পরিতুষ্ট রাজা আপনাকে ‘বধূ’ আখ্যাতেই অভিহিত করেছেন।
বসন্তসেনা— আর্য! আমি কৃতার্থ হলাম।
শর্বিলক— (বসন্তসেনাকে ঘোমটা পরিয়ে। চারুদত্তকে) এই ভিক্ষুর কী করা যায়?
চারুদত্ত— ভিক্ষু, তোমার কী ইচ্ছা?
ভিক্ষু— সম্প্রতি এরকম ভাগ্য পরিবর্তন দেখে প্রব্রজ্যায় আমার যে আসক্তি জন্মেছিল তা দ্বিগুণ হল।
চারুদত্ত— সখা, এর সংকল্প দৃঢ়। তাই ওকে দেশের সমস্ত বৌদ্ধ মঠের অধ্যক্ষ করা হোক।
শর্বিলক— আপনি যেমন বললেন।
ভিক্ষু— এ আমার পক্ষে সত্যিই আনন্দের। সত্যিই আনন্দের।
বসন্তসেনা— এখন আমার মনে হচ্ছে আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।
শর্বিলক— স্থাবরকের কী করা যায়?
চারুদত্ত— সচ্চরিত্র এই মানুষটি দাসত্ব থেকে মুক্ত হোক। আর এই চণ্ডালেরা সমস্ত চণ্ডালেরা অধিপতি হোক। আর রাষ্ট্রীয় শ্যালক আগে যে অধিকারে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাই থাকুক।
শর্বিলক আপনি যা বললেন তাই হোক। কিন্তু একে ছেড়ে দিন (আমার কাছে) আমি তাকে বধ করি।
চারুদত্ত— যে শরণাগত সে অভয় হোক। (শত্রু যদি— ১০।৫৫ ইত্যাদি পাঠ করলেন)
শর্বিলক— এবারে বলুন আর কী করলে আপনি খুশি হবেন?
চারুদত্ত— এর পরেও আর কী প্রিয় থাকতে পারে? আমার চরিত্রের বিশুদ্ধি রক্ষিত হল। আমার চরণে পতিত শত্রুকে মুক্তি দেওয়া হল। আমার প্রিয় বন্ধু আর্যক শত্রুর মূলোচ্ছেদ করেছে এবং সে এখন রাজা- পৃথিবীর শাসক। প্রিয়াকে (বসন্তসেনাকে) পেলাম, (তোমার) প্রিয়বন্ধুর (আর্যকের) সঙ্গে মিলিত তুমি আমার বন্ধু হলে, তোমার কাছে চাইবার মতো আর কী থাকতে পারে? ॥৫৯॥ কাউকে তুচ্ছ করে দেয়, কাউকে তুলে ধরে, কাউকে নিচে নামায়, কাউকে সংশয়িত অবস্থায় রাখে, এইভাবে ভিন্নধর্মী বস্তুর পরস্পর সান্নিধ্য ঘটিয়ে ভাগ্য মানুষকে লোকস্থিতির শিক্ষা দিয়ে কূপযন্ত্র এবং ঘটিকান্যায়ে[১৫] খেলা করে ।। ৬০ ।।
তবুও এই হোক—
(ভরতবাক্য[১৬])
গাভীরা দুগ্ধবতী হোক, বসুমতী শস্যসমৃদ্ধা হোক, মেঘ সময়মতো বর্ষণ করুক, সর্বজনের মনকে আনন্দ দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হোক। সমস্ত প্রাণী আনন্দিত হোক, ব্রাহ্মণেরা সম্মানিত হোক, সজ্জনেরা সমৃদ্ধিমান হোক ধার্মিক রাজারা শত্রু দমন করুন এবং পৃথিবী সুশাসন করুন ॥ ৬১ ॥
॥ ‘সংহার’[১৭] নামে দশম সর্গ সমাপ্ত ॥
॥ মৃচ্ছকটিক নাটক সমাপ্ত ॥
—
টীকা
১. তুলনীয় :
স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং পুরুষস্য ভাগ্যং!
দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ ॥
২. ‘উপপদ’ অর্থ নামের আগে ব্যবহৃত সম্মানসূচক বিশেষণাদি পদ, যেমন আৰ্য, ভদ্র, শ্রী ইত্যাদি। ‘নিরুপপদ’ অর্থ যেখানে এমন সম্মানসূচক পদ নেই।
৩. ‘কিশোরী’ পদের অর্থ তরুণ ঘোটকীও হতে পারে। কিন্তু এখানে প্রচলিত ‘বালিকা’ অর্থই সঙ্গত মনে হয়।
৪. মূলে আছে ‘আঘাত’ শব্দটি। ‘আঘাত’ মানে বধ্যভূমি।
আহন্যতে অত্র ইতি আ + হন্ + ঘঞ (অধিকরণে)।
৫. দ্রোণমেঘ— বিশেষ এক ধরনের মেঘ যা থেকে প্রচুর বর্ষণ হয় এবং তাতে প্রচুর শস্য জন্মায়। ৩৯ নং শ্লোকে এর পুনরুল্লেখ আছে।
৬. এই তালিকা থেকে তখনকার দিনের প্রিয় খাদ্য কী ছিল তা অনেকটা বোঝা যায়। মনে পড়ে যায় প্রাকৃতপৈঙ্গলের সেই বিখ্যাত শ্লোকটি। বাঙালি-জীবনের চিত্রটি যেখানে উদ্ভাসিত—
ওগ্গর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা
গাইক ঘিত্তা দুঁদ্ধ সজুত্তা
মোইলি মচ্ছা ণালিচ গচ্ছা
দিজ্জই কন্তা খাঅ পুণবন্তা।।
কলাপাতায় ভাত, গাওয়া ঘি, স্বাদু দুধ, মৌরলা মাছ, নালতে শাক— স্ত্রী দিচ্ছেন, পুণ্যবান স্বামী খাচ্ছেন।
৭. রত্নকুম্ভের মতো অর্থাৎ অত্যন্ত ধনবান্ ব্যক্তি।
৮. নগরের খলতন্ত্র থেকে মুক্তি পাবার জন্যে অরণ্যের আশ্রমে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পাচ্ছি। মনে পড়ে যাবে— Duke Senior-এর কথা :
Are not the woods
More free from peril than the envious court. (As you like it).
সেই সঙ্গে Forest of Arden Amiens-এর গান :
Here shall he see
No enemy.
But winter and rough weater.
৯. ‘সহ্য’ কুলপর্বতদের অন্যতম। মনে হয় সহ্যবাসিনী বলতে সহ্যপর্বতের অধিষ্ঠাত্রী চণ্ডাল-আরাধ্যা দুর্গাদেবীকেই বোঝাচ্ছে। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে ‘পার্বতী’ কথাটি পর্বতবাসিনী অর্থেই ব্যবহৃত।
১০. বিদ্যা বলতে এখানে ‘সঞ্জীবনী বিদ্যা’ বোঝাচ্ছে। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যই প্রথম এই বিদ্যার অনুশীলন করেন।
ড. সুকুমার সেন বলেন— ‘এখানে বিদ্যাসুন্দরের কাহিনীর ইঙ্গিত আছে অনুমান করি। তবে ‘বিদ্যা’ এখানে কোনো নায়িকা নয়, বিদ্যা-বিস্মৃত গুণীর সংকটাবস্থায় অকস্মাৎ স্মৃত-বিদ্যা’।
১১. দক্ষ তাঁর আয়োজিত বিরাট যজ্ঞে শিব ছাড়া সকলকেই নিমন্ত্রণ করলেন। সতী শিবের নিষেধ সত্ত্বেও এ যজ্ঞে এলেন, কিন্তু শিবনিন্দা শুনে অগ্নিতে জীবনাহুতি দিলেন। শিব সরোষে এসে যজ্ঞনাশ করলেন এবং মৃগরূপ ধারণ করে পলায়মান যজ্ঞকে বধ করলেন।
১২. কার্তিকেয় ক্রৌঞ্চপর্বত বিদীর্ণ করেন, তাই তাঁর নাম ক্রৌঞ্চদারণ।
১৩. কুশাবতীর আর-এক নাম কুশস্থলী, পুরাণ মতে রামপুত্র কুশ এই নগরী স্থাপন করেন।
এটি দক্ষিণ-কোশলের রাজধানী।
১৪. ‘পৃথক্চিতিং সমারুহ্য ন বিপ্রা গন্তুমর্হন্তি।’
১৫. কূপঘটিকান্যায়— কূপের চক্রলগ্ন রশি ঘটিকাসমেত কূপের জলে মজ্জিত হয়ে জলপূরিত হয়ে উঠে আসে, আবার রিক্ত হয়। শূন্যতা ও পূর্ণতা— অর্থাৎ দশা-বিপর্যয় বোঝাতে ‘কূপঘটিকান্যায়’ কথাটি প্রযুক্ত হয়।
তুলনীয় :
আপদ্গতং হসসি কিং দ্রবিণান্ধ মূঢ়
লক্ষ্মীঃ স্থিরা ন ভবতীতি কিমত্র চিত্রম্।
কিং ত্বং ন পশ্যসি ঘটীর্জলযন্ত্রচক্রে
রিক্তা ভবন্তি ভরিতা ভরিতাশ্চ রিক্তাঃ ॥ –প্রবন্ধচিন্তামণি
১৬. ‘সংহার’ কথাটির খাঁটি বাংলা করলে দাঁড়াবে ‘আমার কথাটি ফুরলো’। মৃচ্ছকটিক শেষ হল। কিন্তু তার অনুরণন বাজতে থাকল আমাদের মনে। এ নাটকের আশ্চর্য স্বাদুতাই এর কারণ!
সত্যিই অনন্য এই নাটকটি।
শুধু নাট্যশাস্ত্রের ‘প্রকরণ’ বললেই তার আত্মাটিকে ছোঁয়া যাবে না। এর স্বাতন্ত্র্য সর্বদেহে পরিব্যাপ্ত। সামাজিক নাটক হিসেবেও মৃচ্ছকটিকের গুরুত্ব অসীম।
নাটকের নায়ক চারুদত্ত, জাতিতে ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণ হলেও তিনি বসন্তসেনার প্রেমাসক্ত। বসন্তসেনা গণিকা; কিন্তু তাতে নাসিকাকুঞ্চনের অবকাশ নেই। প্রথমত গণিকা হলেও ওই বৃত্তিকে তিনি ঘৃণা করেন, দ্বিতীয়ত তিনি বিবাহিত জীবন চান; তাছাড়া, নাটকে তাঁর সম্পদ, প্রাচুর্য ও প্রতিষ্ঠার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তাতে সমাজে তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে সংশয় থাকে না। নাটকে দেখানো হয়েছে, ব্রাহ্মণ চারুদত্ত তাঁকে বিবাহ করেছেন— নবপ্রতিষ্ঠিত রাজা তাঁকে ‘বধূ’ রূপে সম্মানিত করেছেন।
সমাজের নিচু স্তরের কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ছবি নাটকে আছে। আছে জুয়াড়ি, সিঁধেল চোর; চৌর্যকর্মের বিভিন্ন উপকরণের উল্লেখ দেখে মনে হতে পারে এটি বিজ্ঞান হিসেবেই অনুশীলিত হত; নাটকে আছে খেলার বাস্তব দৃশ্য, আর আছে অত্যন্ত সাধারণ মানুষের দুঃখ-সুখের কথাবার্তা বা প্রেম বিনিময়ের কাহিনী। এমনকি সমগ্র নাটকের সংলাপও প্রাকৃতঘেঁষা। নাট্যকার অভিজাত ভাষা সংস্কৃতের চেয়ে প্রাকৃতের প্রতিই পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। নাটকের বৃহত্তর দৃশ্যগুলো সাধারণ জীবন থেকে আহৃত হয়েছে।
নাটক দেখে মনে হয় চারুদত্তের মতো অভিজাত ব্যক্তিও একটি গণিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কোনো ক্রমেই গোপনীয় মনে করতেন না। দ্যূতক্রীড়ার জন্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট স্থান ছিল— এইসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা রীতিমতো বিধিবদ্ধ। সমাজের কুক্রিয়াসক্ত নরনারীর মিলনস্থানেরও অভাব ছিল না, এমন একটি স্থান আমরা নাটকেই পেয়েছি।
সমাজের প্রসঙ্গেই আর একটি কথাও মনে পড়ে। এ নাটকের পরিকল্পনায় শূদ্রক গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করেছেন— নাটকের ভাবনা যেন দরবারি মঞ্চ থেকে পথের ধুলোয় নেমে এসেছে। সাহিত্যে কেবলই উদয়ন-বাসবদত্তা, দুষ্যন্ত-শকুন্তলা, বিক্রম-উর্বশীরাই অভ্যর্থিত হবেন কেন? মৃচ্ছকটিক নাটকে তাই এসে পড়েছে শর্বিলক-দর্পরকের দল, শকার-সংস্থাপকের দল। শুধু আসেনি— বলতে গেলে, তারাই আসর জমিয়ে রেখেছে।
সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে মৃচ্ছকটিক অলঙ্কারশাস্ত্রসম্মত সবরকম গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এ নাটকের বিদূষক তথাকথিত বিদূষক নয়, তার স্থান পূরণ করেছেন মৈত্রেয়; খাদ্যের জন্য স্পৃহা এঁরও আছে— তথাপি তিনি শুধু ভোজনবিলাসী নন, চারুদত্তের ইনি অকৃত্রিম বন্ধু— বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুবরণেও এঁর কুণ্ঠা নেই। এই নাটকে চারুদত্ত পুঁথির নায়ক নন, তিনি দোষেগুণে মণ্ডিত সাধারণ মানুষ-– সমাজের একটি বাস্তব চরিত্র।
অন্য কয়েকটি বিষয়েও শূদ্রক স্বতন্ত্র; নাট্যবস্তুর জন্যে তিনি রামায়ণ-মহাভারতের বা অন্য কোনো পুরাণের দ্বারস্থ হননি— ভাসের ‘দরিদ্র চারুদত্ত’ তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া অলঙ্কারশাস্ত্রের অনেক সূক্ষ্ম নিয়ম তিনি লঙ্ঘন করেছেন।
একটি প্রধান বিষয়ে নাট্যকার সমসাময়িক নাট্যকারদের সঙ্গে তুলনায় চিন্তার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগামী। আলোচ্য নাটকে প্রজাপুঞ্জের মধ্যে একটি ছোটখাটো বিপ্লবের প্রসঙ্গ আছে; বিপ্লবান্তে রাজা পালককে রাজ্যচ্যুত করে আর্যককে রাজপদে অভিষিক্ত করা হয়েছে। আর্যক রাজবংশের কেউ নন, অতি সাধারণ ‘গোপপুত্র’— একে বন্দিদশা থেকে মুক্ত ক’রে যে সিংহাসনে বসানো হল— গণশক্তির (?) এই বিজয়-ঘোষণায় কি রাজনৈতিক কোনো ইঙ্গিত নেই? এই ধরনের চিন্তার ক্ষেত্রেও নাট্যকার শূদ্রক স্বতন্ত্র— একথা স্বীকার করতে হয়। এতকাল কাব্যে ও নাটকে রাজাদের জয়-পরাজয়ের কাহিনী বিবৃত হয়েছে— কিন্তু মৃচ্ছকটিকের দর্শক নিশ্চয়ই এক পৃথক জগতের অস্তিত্ব অনুভব করবেন। এই জগতে পরিচিত মানুষের ভিড়, এর আস্বাদনও পৃথক।
মৃচ্ছকটিক নাটকের আলোচনার উপসংহারে আমরা ভরতবাক্যের মতোই বলি— রোহসেন, তুমি গঙ্গাযমুনার মতো দুই-মায়ের স্নেহধারায় পুষ্ট হতে থাক। স্বর্ণশকট চেয়েছিলে তুমি, ওই যুগল মাতৃস্নেহের স্পর্শে মৃচ্ছকটিকই স্বর্ণশকটিকায় পরিণত হোক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন