হোগলকুড়িয়ার গুহ পরিবার

লোকনাথ ঘোষ

হোগলকুড়িয়ার গুহ পরিবার

পারিবারিক নথিপত্র বিশ্বাস করলে বলতে হয় যে, যশোহরের প্রতাপাদিত্যের কোন জ্ঞাতি, সম্ভবত, কোন ভাই থেকে এই বংশের উদ্ভব। মানসিংহের বিজয় ও প্রতাপাদিত্যের জীবন ও শোচনীয় ভাগ্য বিপর্যয়ে পরিবারটিরও অবনতি শুরু হয়; তখন বংশের বিভিন্ন শাখা দেশের নানা স্থানে পূর্বের তুলনায় কিছুটা দারিদ্র্য নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানাও যায় না। বংশলতিকার এসব কাহিনী ছেড়ে দিয়ে, প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, এই গুহ পরিবার কলিকাতা আসে আজ (১৮৮১) থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগে। তখন এঁদের অবস্থা এখনকার মতো ছিল না। তখন এঁরা ছিলেন গরীব, অন্তত সে সময় তাঁরা জনগণের মধ্যে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। এই বংশের পরিচিতির শুরু শিবচন্দ্র গুহ থেকে। আদর্শবান, পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী শিবচন্দ্র ব্যবসায় বুদ্ধিতে সুদক্ষ ছিলেন।

ব্রজনাথের পুত্র শিবচন্দ্রের জন্ম ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। ব্রজনাথের অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না; সে কারণে এবং সে-যুগের রীতির জন্য শিবচন্দ্রের পক্ষে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা সম্ভব হয় নি; মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি মেসার্স ল্যাকারস্টীল অ্যান্ড কোম্পানির অফিসে কেরাণীর চাকরি পান। এই পদে তিনি তিন চার বছর মাত্র কাজ করেন; তবে এর মধ্যেই তিনি বুদ্ধিমত্তা সহকারে কাজ করার জন্য মালিকদের স্নেহ ও অনুগ্রহ অর্জনে সক্ষম হন। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায় বেড়ে ওঠায় শিবচন্দ্রকে করা হয় কোম্পানির বেনিয়ান; তখন তাঁর বয়স আঠার বছর। বয়স কম, বেনিয়ানের কাজে অভিজ্ঞতা আরও কম, শিক্ষাও অল্প, কিন্তু বয়সোচিত উৎসাহ, উদ্দীপনা ও তীক্ষ্ণ বাস্তব বুদ্ধি দ্বারা কাজ করে তিনি সে-সব অভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। তেত্রিশ বছর যাবৎ এই কাজ করে তিনি শিখেছিলেনও অনেক; কার্যত এই পেশায় তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত হন। একান্ন বছর বয়স হবার পূর্বেই তিনি দু-তিনটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বেনিয়ান হন। ল্যাকারস্টীল কোম্পানি দেউলিয়া হবার (১৮৪৭) পরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বেনিয়ান হন। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বেনিয়ান হবার ফলে অর্জিন অভিজ্ঞতা ও সুযোগ নিয়ে তিনি নিজেই একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন; এর থেকে তাঁর লাভ বেনিয়ানের রোজগার অপেক্ষা অনেক বেশি হতে থাকে। শীঘ্রি তিনি বিশেষ ধনী হয়ে ওঠেন। সৎ ভাবে তিনি যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন, দীনদুঃখী আর্তের দুঃখ মোচনে এবং ধর্ম কার্যে তার অধিকাংশই তিনি ব্যয় করেন। তাঁর যা সামাজিক মর্যাদা ছিল, দানধ্যান ছিল তার তুলনায় অনেক বেশি। ধর্মানুষ্ঠানও তিনি করতেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসাবেই। স্থূলকায় হলেও তিনি তুলাব্রত করে স্বীয় ওজনের সমপরিমাণ চাঁদি ব্রাহ্মণদিগকে দান করেন, আবার নিষ্ঠাবান হিন্দু হিসাবে তিনি বারো মাসের তেরো পার্বণ নিষ্ঠাসহকারে পালন করতেন। দেবদ্বিজে তাঁর ভক্তি ছিল অচলা। তাঁর ভক্তিশ্রদ্ধার মধ্যে লোক দেখান কোন ভাব ছিল না। ভীম ঘোষ লেনে তিনি একটি শিবমন্দির ও নিস্তারিণী (কালী) মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, এঁদের নৈমিত্তিক পূজার্চনা, আনুষঙ্গিক ব্যয় ও মন্দিরদ্বয়ের সংরক্ষণের জন্য তিনি সম্পত্তি উৎসর্গ করেন। ২৪ পরগণা ও খাস কলকাতা শহরে তিনি জনহিতার্থে পুষ্করিণী খনন করান। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো খুব উদার বা প্রগতিশীল ছিল না, কিন্তু তাঁর নিষ্ঠা, সততা ও ব্যবসায়ে তীক্ষ্ণ বাস্তব বুদ্ধির প্রশংসা সকলেই করতেন। মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে তাঁকে অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট করা হয়েছিল। মৃত্যুকালে তাঁকে গঙ্গাতীরবর্তী নিজের বাগানবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখানে ১৮৭৪-এর আগস্ট মাসে ৮১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তাঁর দুই পুত্র, বাবু অভয়চরণ গুহ ও বাবু তারাচাঁদ গুহকে। এঁরা দুজনেই পিতার মতো বেনিয়ান এবং সম্ভ্রান্ত। ব্যবসায় ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত স্থান ও প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য তাঁদের উন্নতি অনেক সহজ হয়েছে। পিতার জীবিতকালে বাবু অভয়চরণ তিন চারটি ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানের বেনিয়ান ছিলেন, এখনও তিনি সেইভাবেই কাজ করছেন। পিতার মতো তিনিও একই সঙ্গে বেনিয়ান, ব্যবসায়ী। এঁরই প্রচেষ্টায় পৈতৃক সম্পত্তি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই ভাই নদীয়ায় একটি জমিদারীও কিনেছেন; এছাড়া কলকাতার ইংরেজ পল্লীতে তাঁদের পঁচিশখানা বড় বড় বাড়ি আছে। অভয়চরণের দুই পুত্র ভবাণীচরণ ও অম্বিকাঁচরণ, আর তারাচাঁদের একমাত্র পুত্র বরদাপ্রসাদ। অভয়চরণ অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটও। তিনি এতই সুপরিচিত যে তাঁর সম্বন্ধে আর অধিক লেখা বাহুল্য হবে।

সকল অধ্যায়

১. নবাব আমির আলি খান বাহাদুর
২. পারশ্যের কলিকাতাস্থ কনসাল, মানকজী রুস্তমজী মহাশয়
৩. পাথুরিয়াঘাটা ও চোরবাগানের মল্লিক পরিবার
৪. কলুটোলার মতিলাল শীল ও তাঁর পরিবারবর্গ
৫. শ্যামবাজারের দেওয়ান কৃষ্টরাম বসুর পরিবারবর্গ
৬. রেভারেন্ড কৃষ্টমোহন ব্যানার্জী, এল এল ডি
৭. জোড়াসাঁকোর রায় কৃষ্ণদাস পাল বাহাদুর, সি আই ই
৮. বড়বাজারের দেওয়ান কাশীনাথের পরিবারবর্গ
৯. সুকিয়াস স্ট্রিটের পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সি আই ই
১০. পাথুরিয়াঘাটার অনারেবল অনুকূলচন্দ্র মুখার্জী
১১. হাটখোলার দত্ত পরিবার
১২. ঠনঠনিয়ার দিগম্বর মিত্র, সি এস আই
১৩. ঝামাপুকুরের বাবু দুর্গাচরণ লাহা এবং তাঁর দুই ভাই
১৪. কুমারটুলির গোবিন্দরাম মিত্র ও তাঁর পরিবার
১৫. জোড়াসাঁকোর বাবু হরচন্দ্র ঘোষ
১৬. পাথুরিয়াঘাটার দেওয়ান রামলোচন ঘোষের পরিবারবর্গ
১৭. টনটনিয়ার ঠেনঠনিয়া বাবু রামগোপাল ঘোষ
১৮. সিমলার রামদুলাল দে-র পরিবারবর্গ
১৯. বাগবাজারের মহারাজা রাজবল্লভের পরিবারবর্গ
২০. জোড়াবাগানের দেওয়ান রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশ
২১. জানবাজারের পিরিতরাম মাড়ের পরিবারবর্গ
২২. বাগবাজারের নন্দলাল বসু ও পশুপতিনাথ বসু
২৩. বড়বাজারের মল্লিক পরিবার
২৪. সুকিয়াস স্ট্রিটের রাজা রামমোহন রায়ের পরিবারবর্গ
২৫. রামবাগানের রসময় দত্তের পরিবারবর্গ
২৬. জোড়াসাঁকোর দেওয়ান শান্তিরাম সিংহীর পরিবারবর্গ
২৭. শোভাবাজারের রাজপরিবারবর্গ
২৮. মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর
২৯. বড় তরফ : রাজা গোপীমোহন দেব বাহাদুর
৩০. রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, কে সি এস আই
৩১. রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ দেব, বাহাদুর
৩২. রামকোমল সেন
৩৩. হরিমোহন সেন
৩৪. মুরলীধর সেন
৩৫. হরিমোহন সেনের পুত্রগণ
৩৬. নরেন্দ্রনাথ সেন
৩৭. বিহারীলাল গুপ্ত
৩৮. পিয়ারীমোহন সেন
৩৯. কলুটোলার সেন পরিবার
৪০. রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেব বাহাদুর
৪১. ছোট তরফ : রাজা রাজকৃষ্ণ দেব বাহাদুর
৪২. রাজা কালীকৃষ্ণ দেব, বাহাদুর
৪৩. কুমার অপূর্বকৃষ্ণ দেব, বাহাদুর
৪৪. মহারাজা কমলকৃষ্ণ দেব, বাহাদুর
৪৫. মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুর
৪৬. রাজা হরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুর
৪৭. রাজা সীতানাথ বোস বাহাদুর
৪৮. কুমারটুলি বনমালী সরকারের পরিবারবর্গ
৪৯. নবীনচন্দ্র সেন
৫০. কুমারটুলি বেণীমাধব মিত্রের পরিবারবর্গ
৫১. মহারাজা রমানাথ ঠাকুর সি এস আই
৫২. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫৩. দ্বারকানাথ ঠাকুর
৫৪. অনারেবল প্রসন্নকুমার ঠাকুর সি এস আই
৫৫. প্রমোদকুমারের বিবাহ উৎসব
৫৬. রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর
৫৭. দি অনারেবল মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর সি এস আই
৫৮. কৃষ্ণবিহারী সেন
৫৯. কেশবচন্দ্র সেন
৬০. কলকাতার শেঠ ও বসাকগণ
৬১. রাজা সুখময়ের পরিবারবর্গ (পাথুরিয়াঘাটা)
৬২. ঠাকুর পরিবার
৬৩. ডা: যদুনাথ মুখার্জি, কলিকাতা
৬৪. ঈশানচন্দ্র ব্যানার্জি ও মহেশচন্দ্র ব্যানার্জি
৬৫. (সিমলা) কাঁসারীপাড়ার হরচন্দ্র বসুর পরিবারবর্গ
৬৬. বাগবাজারের গোকুলচন্দ্র মিত্রের পরিবারবর্গ
৬৭. হোগলকুড়িয়ার গুহ পরিবার
৬৮. আরপুলির ঘোষ পরিবার
৬৯. বাগবাজারের দেওয়ান দূর্গাচরণ মুখার্জীর পরিবারবর্গ
৭০. তালতলার ডা: দূর্গাচরণ ব্যানার্জি
৭১. সিমলার বসু পরিবার
৭২. মাননীয় দ্বারকানাথ মিত্র, ভবানীপুর
৭৩. হরিশচন্দ্র মুখার্জি (সম্পাদক, হিন্দু পেট্রিয়ট)
৭৪. পাইকপাড়া রাজ পরিবার
৭৫. রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাহাদুর এল এল ডি, সি আই ই (শুরাহ্ রাজপরিবার)
৭৬. দি অনারেবল রমেশচন্দ্র মিত্র ও তাঁর পরিবারবর্গ
৭৭. অনারেবল শম্ভুনাথ পন্ডিত (ভবানীপুর)
৭৮. বাগবাজারের গুহ বা সরকার পরিবার
৭৯. কাঁটাপুকুর, বাগবাজারের দেওয়ান হরি ঘোষের পরিবারবর্গ
৮০. জোড়াসাঁকোর তারকনাথ প্রামাণিক
৮১. শ্যামবাজারের তুলসীরাম ঘোষের পরিবারবর্গ
৮২. কামারপুকুরের সেন পরিবার
৮৩. রামচন্দ্র রায় (আন্দুলের রাজপরিবার)
৮৪. বাবু ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
৮৫. বাগবাজারের সোম পরিবার
৮৬. আপার চিৎপুর রোডস্থ নতুনবাজারের সান্ডেল পরিবার
৮৭. দরমাহাটার রসিকলাল ঘোষের পরিবারবর্গ
৮৮. শোভাবাজারের নন্দরাম সেনের পরিবারবর্গ
৮৯. বাগবাজারের নিধুরাম বসুর পরিবারবর্গ
৯০. জোড়াসাঁকোর পাল পরিবার
৯১. চোরবাগানের পিরারীচরণ সরকার ও তাঁর পরিবারবর্গ
৯২. দর্জিপাড়ার রাধাকৃষ্ণ মিত্রের পরিবারবর্গ
৯৩. (কলকাতার) রাজন্দ্রেনাথ মিত্রের পরিবারবর্গ
৯৪. অধ্যাপক ক্ষেত্রমোহন গোস্বাসী
৯৫. কাশিমবাজারের রাজপরিবার
৯৬. মহারাণী স্বর্ণময়ী সি আই
৯৭. রায় রাজীবলোচন রায় বাহাদুর
৯৮. বাবু রামদাস সেন, মজিদার, বহরমপুর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন