বর্ষশেষ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যাত্রা হয়ে আসে সারা, – আয়ুর পশ্চিমপথশেষে
                 ঘনায় মৃত্যুর ছায়া এসে।
      অস্তসূর্য আপনার দাক্ষিণ্যের শেষ বন্ধ টুটি
                ছড়ায় ঐশ্বর্য তার ভরি দুই মুঠি।
বর্ণসমারোহে দীপ্ত মরণের দিগন্তের সীমা,
          জীবনের হেরিনু মহিমা।
এই শেষ কথা নিয়ে নিশ্বাস আমার যাবে থামি–
          কত ভালোবেসেছিনু আমি।
অনন্ত রহস্য তারি উচ্ছলি আপন চারি ধার
          জীবন মৃত্যুরে দিল করি একাকার;
বেদনার পাত্র মোর বারম্বার দিবসে নিশীথে
          ভরি দিল অপূর্ব অমৃতে।
দুঃখের দুর্গম পথে তীর্থযাত্রা করেছি একাকী,
          হানিয়াছে দারুণ বৈশাখী।
কত দিন সঙ্গীহীন, কত রাত্রি দীপালোকহারা,
          তারি মাঝে অন্তরেতে পেয়েছি ইশারা।
নিন্দার কণ্টকমাল্যে বক্ষ বিঁধিয়াছে বারে বারে,
          বরমাল্য জানিয়াছি তারে।
আলোকিত ভুবনের মুখপানে চেয়ে নির্নিমেষ
          বিস্ময়ের পাই নাই শেষ।
যে লক্ষ্মী আছেন নিত্য মাধুরীর পদ্ম-উপবনে,
          পেয়েছি তাঁহার স্পর্শ সর্ব অঙ্গে-মনে।
যে-নিশ্বাস তরঙ্গিত নিখিলের অশ্রুতে হাসিতে,
          তারে আমি ধরেছি বাঁশিতে।
যাঁহারা মানুষরূপে দৈববাণী অনির্বচনীয়
           তাঁহাদের জেনেছি আত্মীয়।
কতবার পরাভব, কতবার কত লজ্জা ভয়,
          তবু কণ্ঠে ধ্বনিয়াছে অসীমের জয়।
অসম্পূর্ণ সাধনায় ক্ষণে ক্ষণে ক্রন্দিত আত্মার
          খুলে গেছে অবরুদ্ধ দ্বার।
লভিয়াছি জীবলোকে মানবজন্মের অধিকার,
          ধন্য এই সৌভাগ্য আমার।
যেথা যে অমৃতধারা উৎসারিল যুগে যুগান্তরে
          জ্ঞানে কর্মে ভাবে, জানি সে আমারি তরে।
পূর্ণের যে কোনো ছবি মোর প্রাণে উঠেছে উজ্জ্বলি
          জানি তাহা সকলের বলি।
ধূলির আসনে বসি ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে
          আলোকের অতীত আলোকে।
অণু হতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান,
          ইন্দ্রিয়ের পারে তার পেয়েছি সন্ধান।
ক্ষণে ক্ষণে দেখিয়াছি দেহের ভেদিয়া যবনিকা
          অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা।
যেখানেই যে-তপস্বী করেছে দুষ্কর যজ্ঞযাগ,
          আমি তার লভিয়াছি ভাগ।
মোহবন্ধমুক্ত যিনি আপনারে করেছেন জয়,
          তাঁর মাঝে পেয়েছি আমার পরিচয়।
যেখানে নিঃশঙ্ক বীর মৃত্যুরে লঙ্ঘিল অনায়াসে,
          স্থান মোর সেই ইতিহাসে।
শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ঠ যিনি, যতবার ভুলি কেন নাম,
          তবু তাঁরে করেছি প্রণাম।
অন্তরে লেগেছে মোর স্তব্ধ আকাশের  আশীর্বাদ;
          উষালোকে আনন্দের পেয়েছি প্রসাদ।
এ আশ্চর্য বিশ্বলোকে জীবনের বিচিত্র গৌরবে
          মৃত্যু মোর পরিপূর্ণ হবে।
আজি এই বৎসরের বিদায়ের শেষ আয়োজন–
           মৃত্যু, তুমি ঘুচাও গুণ্ঠন।
কত কী গিয়েছে ঝরে– জানি জানি, কত স্নেহ প্রীতি
          নিবায়ে গিয়েছে দীপ, রাখে নাই স্মৃতি।
মৃত্যু, তব হাত পূর্ণ জীবনের মৃত্যুহীন ক্ষণে,
          ওগো শেষ, অশেষের ধনে।

সকল অধ্যায়

১. প্রশ্ন
২. প্রণাম
৩. বিচিত্রা
৪. জন্মদিন
৫. পান্থ
৬. অপূর্ণ
৭. আমি
৮. তুমি
৯. আছি
১০. বালক
১১. বর্ষশেষ
১২. মুক্তি
১৩. আহ্বান
১৪. দুয়ার
১৫. দীপিকা
১৬. লেখা
১৭. নূতন শ্রোতা
১৮. আশীর্বাদ
১৯. মোহানা
২০. বক্‌সাদুর্গস্থ রাজবন্দীদের প্রতি
২১. দুর্দিনে
২২. ধর্মমোহ
২৩. ভিক্ষু
২৪. আশীর্বাদী
২৫. অবুঝ মন
২৬. পরিণয়
২৭. চিরন্তন
২৮. কণ্টিকারি
২৯. আরেক দিন
৩০. তে হি নো দিবসাঃ
৩১. দীপশিল্পী
৩২. মানী
৩৩. রাজপুত্র
৩৪. অগ্রদূত
৩৫. প্রতীক্ষা
৩৬. নির্বাক্‌
৩৭. প্রণাম
৩৮. শূন্যঘর
৩৯. দিনাবসান
৪০. পথসঙ্গী
৪১. অন্তর্হিতা
৪২. আশ্রমবালিকা
৪৩. বধূ
৪৪. মিলন
৪৫. স্পাই
৪৬. ধাবমান
৪৭. ভীরু
৪৮. বিচার
৪৯. পুরানো বই
৫০. বিস্ময়
৫১. অগোচর
৫২. সান্ত্বনা
৫৩. ছোটো প্রাণ
৫৪. নিরাবৃত
৫৫. মৃত্যুঞ্জয়
৫৬. অবাধ
৫৭. যাত্রী
৫৮. মিলন
৫৯. আগন্তুক
৬০. জরতী
৬১. প্রাণ
৬২. সাথী
৬৩. বোবার বাণী
৬৪. আঘাত
৬৫. শান্ত
৬৬. জলপাত্র
৬৭. আতঙ্ক
৬৮. আলেখ্য
৬৯. সান্ত্বনা
৭০. শ্রীবিজয়লক্ষ্মী
৭১. বোরোবুদুর
৭২. সিয়াম – ১
৭৩. সিয়াম – ২
৭৪. বুদ্ধদেবের প্রতি
৭৫. পারস্যে জন্মদিনে
৭৬. প্রাচী
৭৭. আশীর্বাদ
৭৮. আশীর্বাদ – ২
৭৯. লক্ষ্যশূন্য
৮০. প্রবাসী
৮১. বুদ্ধজন্মোৎসব
৮২. প্রথম পাতায়
৮৩. নূতন
৮৪. শুকসারী
৮৫. সুসময়
৮৬. নূতন কাল
৮৭. পরিণয়মঙ্গল
৮৮. জীবনমরণ
৮৯. গৃহলক্ষ্মী
৯০. রঙিন
৯১. আশীর্বাদী – ২
৯২. বসন্ত উৎসব
৯৩. আশীর্বাদ – ৩
৯৪. আশীর্বাদ – ৪
৯৫. উত্তিষ্ঠত নিবোধত
৯৬. প্রার্থনা
৯৭. অতুলপ্রসাদ সেন

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন