দীনেশচন্দ্র সিংহ
‘শ্যামাপ্রসাদ ও বঙ্গবিভাগ’—এই বিষয়টি সম্প্রতি জনমানসে যে আলোড়ন তুলেছে সে প্রেক্ষিতে গ্রন্থারম্ভে দু’চার কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। একথা সবারই জানা যে, কোনও রাজ্য বা রাষ্ট্রের চারটি দিক বা অঞ্চল থাকে। যেমন আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহার : তার পূর্ব-বিহার, পশ্চিম-বিহার, উত্তর-বিহার ও দক্ষিণ-বিহার নামে চারটি দিক বা অঞ্চল রয়েছে। কিন্তু আমরা এমন একটি রাজ্যে বাস করি যার পূর্বদিক বা পূর্বাঞ্চল নেই। আর এটি যেহেতু নিজেই পশ্চিমবঙ্গ, তাই পশ্চিম-বিহারের মতো তার আলাদা পশ্চিম দিক বা পশ্চিমবঙ্গনেই। ফলে দু’দিক হারা পশ্চিমবঙ্গ নামক পঙ্গু রাজ্যটির চৌহদ্দী দু’টি অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ— উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ।
কেন এই রাজ্যটির এরকম দুই-হারা চেহারা হল; কেন তার সুজলা সুফলা ও নদীমাতৃক দুই-তৃতীয়াংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তার সঠিক ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই জানা নেই। তাদের জানতেও দেওয়া হয় না। যারা জানতে চায় তাদের মনে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির ও প্রকৃত তথ্য চাপা দেবার সজ্ঞান অপপ্রয়াস দেখা যায়; এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবেই।
বেশিদিন আগেকার কথা তো নয়; মাত্র ৫৩ বছর হল ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছে; অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে দেশী শাসকদের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। অবশ্য ভারতীয় হিন্দুরা ইংরেজ শাসনের আগেও স্বাধীন ছিল না। কারণ, ইংরেজ যাদের হাত থেকে শাসনভার কেড়ে নেয় তারাও ছিল বিদেশী মুসলমান। তারা সাত শত বৎসর ভারত শাসন করেছে বটে; কিন্তু ভারতাত্মার সঙ্গে তাদের নাড়ীর বন্ধন ঘটেনি, তারা ভারতীয় হয়নি। বরং তাদের সংস্পর্শে এসে যেসব ভারতবাসী ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তারাও ভারতীয়ত্ব ত্যাগ করে নিজেদের ইরানী তুরানী আফগানীদের সমগোত্র ও বংশজাত বলে ভাবতে শিখেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির চাপে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলমানে স্থায়ী বিভেদ ও তিক্ততা সৃষ্টি করে মানে মানে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে হিন্দুদের মারমুখী মূর্তি দেখে এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ কাণ্ডের পর ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর আনুগত্যে ফাটল ধরায়, তারা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের শতবর্ষপূর্তি পর্যন্ত (১৯৫৭) এদেশের শাসনরজ্জু হাতে রাখা নিরাপদ মনে করেনি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত নির্ভুল। ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরকালে তাদের তিলমাত্র স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়নি; একবিন্দু রক্তপাতও হয়নি। তাই হয়তো এই ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে ‘বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা’ লাভ বলে বগল বাজান হয়! এবং তজ্জন্য অহিংসার প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বের প্রতি তাঁর ভক্ত ও স্তাবকবৃন্দ অহৈতুকী কৃতিত্ব জ্ঞাপন করে থাকে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পরে (এবং এখনও) লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নরনারী শিশুর নিষ্পাপ রক্তে পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও পঞ্চনদ এবং পূর্বাঞ্চলে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ও তাদের অসংখ্য শাখাপ্রশাখার জল যে রক্তরাঙা হয়ে গেল, সে রক্তের কি কোনও দাম নেই? থাকলে বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা লাভের মিথ্যা জয়ডঙ্কা বাজিয়ে এদের অতৃপ্ত আত্মার অবমাননা করা হতো না। কিন্তু জাতি হিসাবে আমরা যেহেতু কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হতে ভয় পাই, তাই মিথ্যার আবরণে আত্মতুষ্টি লাভে ও আত্মপ্রতারণায় আমাদের জুড়ি নেই।
(২)
অনেকেরই হয়তো স্মরণ থাকে না যে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের আগে পশ্চিমবঙ্গ নামে কোনও রাজ্যের আইনানুগ অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং এই খণ্ডরাজ্য সৃষ্টি হল কেন তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং এই রাজ্য সৃষ্টিতে ব্যক্তি হিসাবে যাঁর অবদান সর্বাধিক, জাতি ও দেশের স্বার্থে আত্মোৎসর্গকারী সেই মহান দেশপ্রেমী ভারতকেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিরলস সংগ্রামের কাহিনী জানতে চাওয়া বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ন্যায্য দাবি ও বটে। কিন্তু সরকারী নির্দেশে রচিত ইতিহাস পুস্তকে এসব বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্যই দেখা যায় না। বর্তমানকালে ইতিহাস আর গল্পকথা নয়; বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলে স্বীকৃত। অন্ধ আবেগ বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করলে তা সত্য ইতিহাস নিরূপণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনেকের হয়তো জানা নেই মুসলিম লীগের ভারত ভাগের দাবির (লাহোর, ২৩ মার্চ, ১৯৪০) বিরুদ্ধে প্রথম যে কণ্ঠটি প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল, সেটি ডঃ শ্যামাপ্রসাদের। লাহোরে লীগের দেশভাগের দাবি উত্থাপনের ১৫ দিনের মধ্যে শ্রীহট্টে অনুষ্ঠিত “সুরমা ভ্যালী অ্যাণ্ড শিলং হিল ডিট্রিক হিন্দু কনফারেন্সে” সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন—
“The dangers in front of us are many; the latest addition in the shape of a movement for Pakisthan should not be lightly brushed aside. This preposterous claim must be nipped in the bud by all lovers of Hindusthan.’
তারপর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর শ্যামাপ্রসাদ উত্তর বিহার, মহাকোশল, মাদুরা, বর্ধমান, লায়ালপুর, অমৃতসর, দিল্লী, গোরক্ষপুর, লুধিয়ানা, বিলাসপুর ইত্যাদি স্থানে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভা সম্মেলনে ভাষণদান প্রসঙ্গে পাকিস্তান প্রস্তাবের অসারতা এবং দেশভাগের বিষময় পরিণতি সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে জোরাল বক্তব্য রাখেন। তিনি মুসলিম লীগ নেতাদের ব্রিটিশের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে নিধে করেন; এবং বিভেদাত্মক মনোভাব ত্যাগ করে রাজনীতির মূলস্রোতে সামিল হতে আহ্বান জানান। এই উদ্দেশ্যে তিনি স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে মিঃ জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন-
“I met Jinnah also in Delhi and had a three hours talk with him. We spoke very frankly to each other. He was as adamant on his Pakistan as I was against it and we could not discover a point of contact. ….Cripps gave him something like Pakistan, though not exeactly what he wanted. His basis for settlement would now therefore be the acceptance of the principle of Pakistan here and now and then only he could talk of an interim settlement. I exposed to him the utter fallacy of his Pakistan logic, but it made no impression on him.”
শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। মিঃ জিন্না ভারত ভাগ করেই ছাড়বেন এবং ছাড়লেনও।
শ্যামাপ্রসাদ ভারত বা বাংলা কোনও বিভাগেরই সমর্থক ছিলেন না। এমন কি কলকাতার দাঙ্গায় হিন্দুরা চরম লাঞ্ছিত, নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরও তিনি বাংলা ভাগের দাবি করেননি। দাঙ্গার একমাস পর বাংলার আইনসভায় সুরাবর্দী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলোচনা কালেও তিনি বাংলা ভাগ তো দূরের কথা ভারত ভাগের পক্ষেও কোন কথা বলেন নি। বরং দাঙ্গায় নিহত হিন্দু-মুসলিম গরীব জনসাধারণের নির্মম হত্যার জন্য লীগ নেতাদের অভিযুক্ত করেন এবং গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করেন।
(৩)
একথা ভুললে চলবে না যে ১৯৪৬-এর কলকাতা ও নোয়াখালি-ত্রিপুরার দাঙ্গা বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে। দাঙ্গার জন্য অনুতাপ বা দুঃখপ্রকাশ এবং দাঙ্গাকারীদের সংযত করা তো দূরের কথা, মুসলিম নেতারা দেশভাগ ও পাকিস্তান আদায়ের জন্য উত্তরোত্তর জঙ্গী মনোভাব দেখাতে থাকে; ‘লড়কে লেঙ্গে’ মূর্তি ছেড়ে ‘মারকে লেঙ্গে’ মূর্তি ধারণ করে। ইতিমধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিহার, যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) পাঞ্জাব-সিন্ধু-সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে ও বীভৎস আকার ধারণ করে—যে নিষ্ঠুরতার নজির মানবজাতির ইতিহাসে মেলা ভার। দেশব্যাপী এই হানাহানি ও রক্তারক্তি থেকে রেহাই পেতে জাতীয় নেতারা ভারত ভাগে সম্মত হলেন।
ভারতভাগের অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ শ্যামাপ্রসাদ তখন বাংলা ভাগে সোচ্চার হলেন। তাঁর দাবি—যে হিন্দু-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হচ্ছে, সে একই ভিত্তিতে প্রদেশও ভাগ করতে হবে। গত্যন্তর না দেখে বাংলার কংগ্রেসও এ দাবিতে সামিল হল।
জিন্না তো খোয়াব দেখছিলেন তিনি ইংরাজের দাক্ষিণ্যে পুরো বাংলা-আসাম এবং পুরো পাঞ্জাব-সিন্ধু-সীমান্ত -বালুচিস্তান নিয়ে গঠিত বিশাল ইসলামী পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাহানশাহ্ বনে গদিতে বসবেন। ঘটনাচক্রে যখন তাঁর সে খোয়াব টুটে যেতে বসেছে, এবং বাংলা ভাগ হয়ে কলকাতা হাতছাড়া হতে যাচ্ছে, তখন তিনি ইংরেজ প্রভুদের পায়ে ধরনা দিয়ে পড়লেন এবং জোড়হস্তে মিনতি জানালেন—”দোহাই, আমাকে পোকাকাটা পাকিস্তান দেবেন না।” তখন বিলাত থেকে ইঙ্গিত পেয়ে মাঠে নামেন বাংলার গভর্নর বারোজ। তাঁর পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী ‘স্বাধীন যুক্তবঙ্গের’ ধুয়া তোলেন। পূর্বাপর ভালমন্দ না বুঝে তার সঙ্গে গলা মেলান শরৎচন্দ্র বসু; এবং কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্তচিত্তে কিরণশঙ্কর রায়। সুরাবর্দী জিন্নাকেও তালিম দিয়ে রেখেছেন তিনি যেন আপাতত পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন যুক্তবঙ্গে আপত্তি না করেন। জিন্নার ঘেউ ঘেউ রব হঠাৎ মিউমিউতে পরিণত হল। তিনি বিনয়ের অবতার সেজে বললেন—”What is the use of Bengal without Calcutta? They had much better remain united and independent: I am sure that they would be on friendly terms with us.”
“দ্বিতীয় বাক্যের শেষ অংশটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমার সন্দেহ নেই যে সুরাবর্দি-জিন্নাকে বোঝান ভাগাভাগি হলে হিন্দুরা কখনই কলকাতা ছাড়বে না। তাই আপাতত যুক্তবঙ্গ হোক। পরে পাকিস্তানে যোগ দিতে কতক্ষণ?” (অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী)। জিন্না-সুরাবর্দীর এই অভিসন্ধি যে অমুলক নয় তাও গোপন ছিল না—”Mr. Jinnah considered that, with its Muslim majority, an independent Bengal would be a sort of Subsidiary Pakistan and was therefore prepared to agree to Mr. Suhrawardy’s plan “ ( Mountbatten). জিন্না ও সুরাবর্দীর এই হঠাৎ রূপ বিবর্তনে আর যেই ভুলুক শ্যামাপ্রসাদ ভোলেননি। শ্যামাপ্রসাদ সমগ্র বাঙালী হিন্দুর মুখপাত্র হিসাবেই বলেছিলেন—”I can conceive of no other solution of the communal problem in Bengal than to divide the province…. We demand the creation of two provinces out of the present boundaries of Bengal-Pakistan or no Pakistan. It is a question of life and death for us, the Bengali Hindus. হিন্দু সমাজকে আহ্বান করে তিনি বলেন—”We want our homeland and we shall have it-let this be our motto. Now or Never-let this be our slogan.
সুতরাং জিন্না যখন খোস মেজাজে মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন— “You must carry out a surgical operation”, তখন জিন্না স্বপ্নেও ভাবেননি যে সে ছুরিকা শ্যামাপ্রসাদ তাঁর দিকে ঘুরিয়ে দিবেন এবং তাঁকে কাতরকণ্ঠে “ Please, do not give me moth eaten Pakistan” বলতে বাধ্য করবেন।
(৪)
ততদিনে গান্ধীজীর নোয়াখালি শান্তিমিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বারোজ সাহেব জানাচ্ছেন দাঙ্গার জন্য নোয়াখালি-ত্রিপুরার মুসলমানদের মনে তিলমাত্র অনুশোচনা নেই; এবং “একডজন গান্ধীর” পক্ষেও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শাস্তি ও সৌহার্দ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না :
“I do not get the impression that Moslems of South East Bengal are, generally speaking, now in the least repentant over the Noakhali -Tippera trouble….. It will take a dozen Gandhis to make the Muslim leopard and the Hindu kid lie down together again in that part of the world.” (মুসলমান চিতাবাঘ ও হিন্দু ছাগলছানা আবার একসঙ্গে পাশাপাশি বাস করবে না)
আজকাল মেকী ধর্মনিরপেক্ষীরা পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার হিন্দুদের একাংশের সঙ্কীর্ণ মনোভাবের ফলে বাংলা ভাগ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন; আর যত মানবতা উদারতার ছায়া দেখতে পান মুসলমানদের মধ্যে। এ মিথ্যা অভিযোগ তোলার আগে তাদের উচিত কলকাতার দাঙ্গার শিকার কয়েকটি হিন্দু পরিবারের—যেমন, বিখ্যাত গণিতজ্ঞ যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী, বিখ্যাত ‘ইম্প্রেসারিও’ হরেন ঘোষ (তাঁকে ধর্মতলা স্ট্রীটে ওয়াছেল মোল্লার বাড়ির নিচের তলায় স্টুডিও-তে টুকরো টুকরো করে কেটে ট্রাঙ্কের ভেতর পুরে রডন স্কোয়ারে ফেলে দেয়া হয়), বাগমারী ভিলার মল্লিক পরিবার, জ্যাকেরিয়া স্ট্রীটের পোদ্দার ও খৈতান পরিবার, ফিয়ার্স লেনের মল্লিক পরিবার, পার্ক সার্কাসে নিহত সাব-জজ বি. কে. রায়ের পরিবারের সদস্যদের ও বর্মন স্ট্রীটে আনন্দবাজার অফিসে ১৬-২০ জুলাই আটক ও বারবার আক্রান্ত কর্মীদের (কেউ যদি এখনো বেঁচে থাকেন) সঙ্গে যোগাযোগ করা। সে সঙ্গে নোয়াখালি জেলার করপাড়া, গোপাইরবাগ, নোয়াখোলা, গোবিন্দপুর, শায়েস্তানগর প্রভৃতি গ্রামে বীভৎস হত্যালীলা ও অত্যাচারের বিবরণ ঐ সব গ্রামের হতাবশিষ্ট যে সব ব্যক্তি এখনও পশ্চিমবঙ্গে বেঁচে আছেন, তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। তা হলেই তাঁরা বুঝতে পারবেন কেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা মুসলিম লীগের পৈশাচিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা অদূর ভবিষ্যতে আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা রাখতে একজোট হয়ে বাংলা ভাগের সমর্থনে শ্যামাপ্রসাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র হিন্দু কম্যুনিস্টরা। তারা ‘বিভক্ত ভারতে অবিভক্ত বাংলা’ বেনামে সম্পূর্ণ বাংলার পাকিস্তানভুক্তি চেয়েছিল।
এই যুক্তবঙ্গ প্রস্তাব যখন উত্থাপিত হয়, তখনও বাংলায় কয়েক হাজার হিন্দুর গায়ের ছোরা বল্লম ও তরোয়ালের আঘাত ও ক্ষত শুকায়নি। শত শত লাঞ্ছিতা হিন্দু মা-বোনের বোবা কান্না ও নীরব অশ্রুপাত থামেনি। অকালে অনাথ শিশু ও বিধবা মায়ের আর্তনাদে আকাশ বিদীর্ণ। সে সময় সুরাবর্দী-শরৎ বসুর স্বাধীন বঙ্গের শ্লোগান তাদের কাছে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ ও রসিকতা বলে গণ্য হয়েছিল। বাঙালীর এই বিরূপ মনোভাব আঁচ করতে পেরেছিলেন বলেই গান্ধীজী বলেছিলেন, “যদি বাংলা ভাগ হয় তবে তার জন্য মুসলমানরা, বিশেষত ক্ষমতাসীন মুসলিম সরকার দায়ী হবে। “If he were the Prime Minister of Bengal, he would plead with his Hindu brethren to forget the past. He would tell them he was as much a Bengali as they were. Difference in religion could not part the two.” যদি সুরাবর্দীর হৃদয়ে বাংলা ও বাঙালী, হিন্দু ও মুসলমানের জন্য সত্যিকার প্রেম থাকে তবে পাষাণও গলবে”– (অমলেশ ত্রিপাঠী)। কিন্তু নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিয়ে হিন্দুদের আলিঙ্গন করতে গেলে সুরাবর্দীদের ইসলামীয়ানাই অশুদ্ধ হয়ে যাবে যে! তাই গান্ধীজীর এসব হিতোপদেশ অরণ্যে রোদন মাত্র।
(৫)
“শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা” সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবু শরৎ বসু, শ্যামাপ্রসাদ ও ফজলুল হক মিলে হিন্দু মুসলমানের যুক্তভাবে বাংলা শাসনের তাই ছিল প্রথম ও শেষ প্রচেষ্টা। কিন্তু মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে তা সফল হতে পারেনি। এই মন্ত্রিসভার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে হক সাহেব বলেছিলেন-“শ্যামাপ্রসাদ মুসলিম বাংলার স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব নিয়াছেন; আর আমি নিয়াছি হিন্দু-বাংলার স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব।” অবিভক্ত বাংলার অন্যতম মুসলিম রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—”আমি শ্যামাপ্রসাদের সাথে কয়েকদিন মিশিয়াই বুঝিয়াছিলাম, তাঁর সম্বন্ধে হক সাহেব যা বলিয়াছেন তা ঠিক। সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে সত্যসত্যই তিনি অনেক কংগ্রেসী নেতার চেয়েও উদার। হিন্দু সভার নেতা হইয়াও কোনও হিন্দু নেতার পক্ষে মুসলমানদের প্রতি এমন উদার মনোভাব পোষণ করা সম্ভব, আমার এ অভিজ্ঞতা হইল প্রথমে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দেখিয়া।”
অবশ্য যেসব তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষী হিন্দু হিন্দুদের স্বার্থহানি করে আনন্দে নর্তন করে গায়ে প্রগতিশীলতার ছাপ্পা লাগায়, তাদের কানে এসব কথা মধু বর্ষণ করবে না জানি। এদের অনেকেই পুরো বাংলা পাকিস্তানে না যাওয়ায় মনমরা হয়ে আছেন। কিন্তু যদি তাই হতো তবে সেখান থেকে পালিয়ে কোন্ বনে বসে তারা সমাজতন্ত্রের বাঁশি বাজাতেন ও গণতন্ত্রের কাঁসী পেটাতেন, সে খেয়াল থাকে যেন। পাক-বাংলা থেকে পালিয়ে লাখে লাখে বাঙালী হিন্দু ভিন্ন রাষ্ট্র ভারতে ঢুকতে গেলেই খড়গপুর সীমান্তে উড়িয়ারা এবং আসানসোল সীমান্তে বিহারীরা লাঠিপেটা করে পগার পার করে দিত।
পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধিজীবী নামক নতুন প্রজাতির বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গ / পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশাগত হিন্দুদের বংশধর। এঁদের অনেককেই হাতে ধরে বা গর্ভে ধরে এঁদের পিতামাতা রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পেরিয়ে এই বঙ্গে পালিয়ে এসেছেন। এঁদের পিতামাতাকে এরা জিজ্ঞাসা করে দেখুন সেদিন তাঁরা যুক্ত বঙ্গ না চেয়ে বঙ্গভঙ্গের সমর্থন করেছিলেন কেন? কেন তাঁরা সেদিন অল্পবয়সী স্ত্রী, বিবাহযোগ্যা বোন, কিশোরী কন্যা, অনূঢ়া পিসি-মাসীকে নিয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় পড়ি-মড়ি করে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন, সে প্রশ্নের জবাব বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দা দিদা-দিদিমার কাছে পেতে পারেন। এঁরা এখন ঢাকায় গিয়ে পরের পয়সায় পাঁচতারা হেটেলে ওঠেন, দোস্তের সঙ্গে বসে তিন রকমের গোস্তের খানা খেয়ে হাত চাটেন, পদ্মার ইলিশের লটপটি খেয়ে আহ্লাদে লুটিপুটি খান এবং কলকাতায় ফিরে ধর্মনিরপেক্ষতার চোয়া ঢেকুর তোলেন। এঁরা ভুলেও একদা সুখশান্তির আগার পূর্ববঙ্গের বর্ধিষ্ণু হিন্দুগ্রাম ও বাড়িগুলির অবশিষ্ট হিন্দুরা কি সুখে দিন কাটাচ্ছে, সে খবর নেন না, নিতে চান না। কারণ, তা হলেই ধর্মনিরপেক্ষতার আচকান খসে পড়বে যে!
একথা ভুললে চলবে না যে ১৯৫০-এ পূর্ববঙ্গে নরমেধ যজ্ঞের হাত থেকে প্রাণ ও মান বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ নরনারী ঢেউয়ের মতো শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টায় রক্ষিত পশ্চিমবঙ্গেই আছড়ে পড়েছিল, আশ্রয় পেয়েছিল। সেদিন কিশোরী ও যুবতী বধূ, কন্যা বা বোনকে নিয়ে (তারা সবাই এখন ঠাকুমা দিদিমা বনে গেছে) ক্রমাগত বিনিদ্র রজনী যাপনের পর সীমান্ত পেরিয়ে তারা শিয়ালদহ স্টেশনে এসে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছিল। এরাই পরে যাদবপুর-টালিগঞ্জ-দমদম-ব্যারাকপুর-বেলঘরিয়া এবং ক্রমে সুন্দরবন থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত মাথা গোঁজার আস্তানা পেয়েছিল বা গড়েছিল। কেউ যদি জানতে চান তবে এরাই জানাতে পারবে চিরকাল অখণ্ড ভারত অখণ্ড বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা অথচ পরে অবস্থা বিপর্যয়ে বঙ্গভঙ্গের প্রবক্তা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে বাঙালী কেন তাদের পরিত্রাতার ভূমিকায় দেখে।
(৬)
স্বাধীন ভারতে, কি রাজ্যস্তরে কি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, ইতিহাস-বিকৃতি, তথ্যবিলোপ, সত্যের অপলাপ, মিথ্যার বেসাতি একশ্রেণীর সরকার ঘেঁষা ও পোষা ইতিহাস-জীবীর অন্যতম পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিকগণ নিজেদের কুকর্ম চাপা দিতে ও দুষ্কর্মের সাফাই গাইতে এদের তোষেণ ও পোষেণ। এরাও মনিবের মর্জিমতো লেজ নেড়ে নেড়ে নিজেদের আখের গোছান। তাই সারা দেশে চলছে মেকী ধর্মনিরপেক্ষতা-মার্কা ফরমায়েসী ইতিহাস রচনার রমরমা বাজার। তাতে আবার ইদানীংকালে অনেক কুকীর্তির মতো ইতিহাস-বিকৃতি এবং কারচুপিতেও পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে শীর্ষস্থানে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ইতিহাস শিক্ষকও আজকাল প্রচারের দৌলতে “প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের” তকমা পাচ্ছে। একদিকে স্বজাতি-স্বধর্মের নিন্দামন্দ করা, স্বদেশ স্বসমাজের কুৎসা গাওয়া, জাতীয় কৃষ্টি সংস্কৃতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অপরদিকে বিজাতি বিধর্মী শাসকদের হত্যা-লুণ্ঠন-অপহরণ-ধর্মান্তরকরণ ও মন্দির-মূর্তি ধ্বংসের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে গৌরবান্বিত করাই বাংলার তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের প্রগতিশীলতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিসের লোভে ও লাভে এরা নিজেদের বিবেকবুদ্ধিকে অন্ধকার জগতের কীটগুলির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে, বন্ধক রেখেছে, সেকথা অনুচ্চারিতই থাক। তবে অনেক সময় কারও কারও বচন-বাচনে ও আচরণে এদের অপহৃতা হিন্দু মেয়েদের অবৈধ সন্তান বলেই অনেকে মনে করেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্রকে আমরা অবশ্য উক্ত শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মাঝে ফেলছি না। কিন্তু বছর তিন আগে বাংলা ভাগ সম্পর্কে তাঁর কিছু হালকা মন্তব্যের উপর দু’এক কথা না বলে পারছি না। তিনি লিখেছেন—“আমাদের স্ব-ভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করতে সেই ১৯৪৭ সালে মুসলিম লিগের পাশাপাশি শ্যামাপ্রসাদবাবুর হিন্দুমহাসভার উৎসাহ কম ছিল না, হাইকমাণ্ডের আদেশ শিরোধার্যকারী কংগ্রেসী চাঁইরা তো ছিলেনই, বাংলাকে যে করেই হোক আস্ত রাখার প্রয়াসে শরৎ বসুর পাশে কেউই প্রায় ছিলেন না।” (ডুবতে রাজি আছি – অশোক মিত্র, আনন্দবাজার পত্রিকা, নববর্ষ ক্রোড়পত্র, ১৪০৪)। অশোকবাবু বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে কংগ্রেস, লীগ, হিন্দুমহাসভার নামোল্লেখ করলেন, কিন্তু তাঁর “একবার ছেড়ে দেওয়া ও পরে তেড়ে ধরা” কম্যুনিস্ট পার্টির ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেন না কেন? লজ্জায় না বিবেকের দংশনে? ঐ দুই বস্তু থাকলে তো কম্যুনিস্টহওয়া যায় না। ওগুলো তো ভদ্রতার লক্ষণ, আর কম্যুনিস্টরা যে ভদ্রলোক হয় না এ ফতোয়া তো অশোকবাবুই দিয়েছেন। “পাকিস্তান মানতে হবে, তবেই ভারত স্বাধীন হবে”—এই শ্লোগান সেদিন কারা তুলেছিল? হিন্দু মহাসভা তো দূরের কথা, কংগ্রেস যখন দেশভাগ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেনি, তখনই অশোক মিত্ররা ইংরেজের প্ররোচনায় মুসলিম লিগের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দেশ ভাগের সোচ্চার দাবি তুলেছিলেন। এখন সেসব কুকীর্তির কথা ভুলে যাবার ভান করলে ইতিহাস তো ছাড়বে না!
প্রসঙ্গটা যখন উঠলই, তখন আরেকটু পেছনের দিকে ফেরা যাক। চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই শুরু হল বাংলার হিন্দুদের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী বিদ্বেষ ও বিষোদ্গার। মোল্লা-মৌলবীরা মসজিদ-মাদ্রাসায় চালাল ধর্মীয় বিদ্বেষ। মুসলিম লীগ দল পত্রপত্রিকায় ও সভাসমাবেশে চালাল রাজনৈতিক বিদ্বেষ। আর কম্যুনিস্টরা বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে চালাল অর্থনৈতিক বিদ্বেষ। এই তিন ধরনের বিদ্বেষের সমাহার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ ধরে হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
দুর্মুর্খরা বলে “কংগ্রেস কম্যুনিস্ট দুই পাপ : বাংলার হিন্দুর অভিশাপ।” কথাটা একেবারে অমূলক নয়। বাংলায় মুসলমানদের হিন্দু বিদ্বেষে ইন্ধন জুগিয়েছে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীরা। অবিভক্ত বাংলার পূর্ব ও উত্তরাংশে কম্যুনিস্ট পার্টি বিভাগ-পূর্বকালে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এতদঞ্চলে মুসলমান চাষী-শ্রমিক ও মজুরদের পরমবন্ধু ছিল কম্যুনিস্ট পার্টি। মুসলিম লীগ দেখত মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ, কম্যুনিস্টরা দেখতে লাগল তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ। বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি সংগঠনে ও আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের উচ্চ বংশজাত, উচ্চ সংগতিসম্পন্ন ও উচ্চশিক্ষিত হিন্দু যুবক ও কর্মীদের মুখ্য ভূমিকা ছিল। তাদের আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল–জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, তে-ভাগা বর্গা ব্যবস্থা, লাঙ্গল যার জমি তার, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী ইত্যাদি। জমিদার জোতদার-মিল মালিকের বেশির ভাগ ছিল হিন্দু; অপরপক্ষে চাষী, প্রজা, শ্রমিক শ্রেণীর বেশির ভাগ ছিল মুসলমান। দেশভাগের সমর্থক ও পাকিস্তান দাবির প্রবক্তা কম্যুনিস্টরা মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির আশায় কিভাবে মুসলমানদের হিন্দুবিদ্বেষে বাতাস দিয়েছে দেখা যাক :
(ক) বৃহত্তর হিন্দুসমাজ কংগ্রেস সমর্থক, দেশভাগের বিরোধী। সাধারণ মুসলমান বুঝল হিন্দুরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাধাদানকারী। সুতরাং হিন্দুরা মুসলমানের শত্রু।
(খ) কম্যুনিস্টরা তে-ভাগা আন্দোলন করে মুসলমান বর্গাদারদের হিন্দু জোতদারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলল। মুসলমান বর্গাদার বুঝল হিন্দু জোতদার তাদের শত্রু।
(গ) কম্যুনিস্টরা মুসলমান প্রজাদের হিন্দু জমিদার-তালুকদারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। মুসলমান প্রজা বুঝল হিন্দুমাত্রই শোষক, সুতরাং তাদের শত্রু।
(ঘ) ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছিল মুখ্যত হিন্দু শ্রেণীভুক্ত। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকালীন অভাব-অনটন, মূল্যবৃদ্ধি, জিনিসের দুষ্প্রাপ্যতা, চোরাকারবার, মুনাফা শিকার ইত্যাদি অপকর্মে হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর ব্যবসায়ীরাই দুহাতে লুটেছে। কিন্তু মজুদদার মুনাফাশিকারী বলতেই কম্যুনিস্টরা অঙ্গুলি নির্দেশ করত হিন্দু ব্যবসায়ীদের দিকে। ফলে মুসলমানরা হিন্দু ব্যবসায়ীদেরই তাদের শত্রু বলে চিনে রাখল।
(ঙ) “লাঙ্গল যার জমি তার” শ্লোগানের ফলও একই। যেহেতু বেশীর ভাগ জমির মালিকানা হিন্দুদের হাতে, ভূমিহীন মুসলমান কৃষক বুঝল হিন্দুরাই তাদের বঞ্চনা করছে। সুতরাং তারা মুসলমানের শত্রু।
এভাবেই পুরো হিন্দু সমাজকেই কম্যুনিস্টরা মুসলমানদের কাছে শত্রুরূপে চিহ্নিত করে দিল। কম্যুনিস্টরা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীশত্রু চিহ্নিত করেছে। আর মুসলমানরা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তা গ্রহণ করেছে। সেখানে ধনী হিন্দু গরীব হিন্দু, বর্ণ হিন্দু বিবর্ণ হিন্দু, উচ্চ হিন্দু নিম্ন হিন্দুর মধ্যে কোন বাছবিচার করল না। কংগ্রেস-কম্যুনিস্ট নির্বিশেষে সবাইকে দেশছাড়া করে ছাড়ল।
(৭)
১৯৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়জয়কার। কংগ্রেস কার্যত হিন্দু প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত, কিন্তু সেকথা মানতে নারাজ। আবার ভাবের ঘরে চুরি। এদিকে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে রামধুন গেয়ে আর অহিংসা মন্ত্র আউড়ে আউড়ে গোটা হিন্দু জাতিকে তারা নিবীর্য-নপুংসকে পরিণত করেছে। সুতরাং মুসলিম লীগ গুণ্ডারা যখন ইসলামিক ঐতিহ্যানুসারে ছোরা-মারা রাজনীতি শুরু করল, অসহায় নিরস্ত্র নির্বিরোধ ভালোমানুষ হিন্দুরা কচুকাটা হল কলকাতা নোয়াখালি চট্টগ্রাম ঢাকা বরিশাল রাজশাহী পাবনা ময়মনসিংহ সর্বত্র। হিন্দুদের প্রাণ গেল, মান গেল, নারীর ইজ্জত গেল। কংগ্রেস ও গান্ধীজীর উপর ভরসা করে, এবং আত্ম-শক্তির অনুশীলন না করে হিন্দুরা হিংস্র মুসলমান গুণ্ডাদের সহজ শিকারে পরিণত হল। আগ্রাসী মুসলমানদের সামনে “ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম” ভাঁজা কোনও কাজেই লাগল না।
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কংগ্রেসের এই নিবীর্য নীতির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। হিন্দু মহাসভার সভাপতি হিসাবে তিনিও কংগ্রেসের মতো ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও পূর্ণ স্বাধীনতার প্রবক্তা ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের মতো তিনি একমুখে তিন কথা বলায় অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি সোজা কথাটি স্পষ্ট ভাষায় নির্ভয়ে বলতে কখনও দ্বিধা করতেন না। সে কারণেই কংগ্রেস, ব্রিটিশ, কম্যুনিস্টও মুসলিম লীগ কোনও দলই তাঁকে সহ্য করতে পারত না। দেশভাগে প্ররোচনা জোগানর জন্য তিনি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন; দেশভাগের শোচনীয় পরিণতি সম্পর্কে তিনি মুসলিম লীগের প্রতি বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন; দেশভাগ প্রশ্নে কংগ্রেসের “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” নীতিকে তিনি হিন্দুদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে ঘোষণা করেছেন। আর আজন্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার সহচর কম্যুনিস্ট দলের দ্বিচারী ভূমিকার মুখোশ খুলেছেন। এ কারণেই কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ এই চতুষ্পদ মিলে শ্যামাপ্রসাদকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে সমস্বরে হুক্কাহুয়া রব তুলেছে :
“…. Syamaprasad fought in his own way to achieve the twin objectives for which Congress also professed to fight: unity and complete independence. At no stage he was prepared for compromise on either of these basic national demands. Naturally he met the strongest opposition from the Muslim League. His towering personality was too strong to be ignored; so he was condemned as a communalist. It was natural for Jinnah and his British patrons to raise this mischievous slogan against him; but it is a pity that a section of the Hindus, whose legitimate rights he always tried to protect, echoed it.” (Prof. Anil Chandra Banerjee)
এই ‘a section of the Hindus ‘ হল চোরা সাম্প্রদায়িক কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট পাপীর দল। এই দুই দল চিরকাল মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে তুষ্ট করেছে, এখনও পুষ্ট করে চলেছে। আর নিজেদের গায়ের সাম্প্রদায়িকতার গলিত কুষ্ঠ চাপা দিতে হিন্দুদের সর্বক্ষণ সাম্প্রদায়িক বলে গাল পাড়ছে। তা না হলে কলকাতার দাঙ্গার পর সুরাবর্দী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাবের উপর ভোটদানে জ্যোতিবাবুরা বিরত থাকেন কোন্ যুক্তিতে? মুসলিম লীগ সরকারের বর্বরতার প্রতি মৌন সমর্থন জানিয়ে তারা মুসলমানদের মন রক্ষা করেছেন; নিজেদেরও বর্বরতার সমর্থক বলে পরিচয় দিয়েছেন। আর ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদ বাক্যানুসারে বি. জে. পি.-কে খেতে শুতে বর্বর বলে গালাগালি দিয়ে নিজেদের স্বভাবধর্ম রক্ষা করছেন।
এই হীন চরিত্র রাজনীতিকদের পোঁ ধরেছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর দল। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষী বুদ্ধিজীবীর হাই-ব্রীড ফলন চলছে যেন। ‘হৈল নাচে বোয়াল নাচে, হিয়ার লগে খইয়া পুঁটিও নাচে’ বলে নোয়াখালি জেলায় একটা কথা ছিল। তার অর্থ—শোল বোয়াল তো নাচেই, সে সঙ্গে খলসে পুঁটিও নাচে। পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে সেই দশা। রাঘব বোয়াল রুই কাৎলা বুদ্ধিজীবী তো আছেই, সে সঙ্গে বর্ষার ব্যাঙের মতো অলিতে গলিতে চ্যাঙ ব্যাঙ বুদ্ধিজীবীর ঘ্যাগোর ঘ্যাগোর শব্দে কানপাতা দায়। শয়নে-স্বপনে ঘুমে-জাগরণে হিন্দুত্বের নিন্দা না করে এরা পানি গ্রহণ করে না।
(৮)
আয়েষা জালাল, জয়া চ্যাটার্জী, শিপ্রা সরকার, শীলা সেন, সুমিত সরকার, অমলেন্দু দে, শৈলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ মহম্মদ আলি জিন্নাকে ‘মহাত্মা’ বানাবার, সুরাবর্দীকে বাঙালী দরদী সাজাবার, মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার ঠিকাদারি নিয়েছে যেন। কলকাতা দাঙ্গার জন্য এরা দাঙ্গাবাজ মুসলিম লীগের পক্ষে সাফাই গায় এবং দুদিন একতরফা মার খাবার পর হিন্দুরা রুখে দাঁড়াল বলে তাদের দোষারোপ করে। ভাবখানা এমন— যেন দাঙ্গা করা তো মুসলমানদের ধর্মগত অধিকার; হিন্দুরা প্রতিরোধের নামে মুসলমানদের ধর্মীয় জেহাদে বাধা দিয়ে অন্যায় করেছে! নোয়াখালি দাঙ্গার জন্য এরা মুসলমানদের দারিদ্র্যকে দায়ী করে। অর্থাৎ মুসলমান গরীব হলেই প্রতিবেশী হিন্দুর ধনপ্রাণ বিনষ্ট করার ও স্ত্রী-কন্যাকে অপহরণ করার জন্মগত অধিকার জন্মায় যেন—এমনই এদের প্রগতিশীল ভাষ্য! এদের মধ্যে আবার কোন কোন সমদর্শী মহাজন দাঙ্গার জন্য হিন্দু মুসলমান উভয়পক্ষকে সমভাবে দায়ী করে মুসলমান সম্প্রদায়ের নেকনজরে থাকার পথ খোলা রাখে। মুসলমানরা না হয় ছোরা তরোয়াল বল্লম কুকরি বোমা নিয়ে আক্রমণ করেছে; কিন্তু তা বলে লঙ্কাগোলা জল, তরকারি-কোটা বঁটি ও বিড়াল-মারা লাঠি দিয়ে তাদের প্রতিহত করা কি ঠিক হয়েছে হিন্দুদের পক্ষে!
মেকী ধর্মনিরপেক্ষীদের এসব অভিনব ভাষ্য শুনলে ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির নির্যাতিত হিন্দুদের প্রতি গান্ধীজীর হিতোপদেশের কথা মনে পড়ে অপমানিত, লাঞ্ছিত নোয়াখালির হিন্দু রমণীদের প্রতি গান্ধীজী হিতোপদেশ দিলেন—তারা যেন তাদের অত্যাচারীদের বাধা না দেয়। কারণ তা হলেই নাকি ঐসব মনুষ্যরূপী পশুদের মনে মানবতার উন্মেষ ঘটবে। তিনি বলেছিলেন— “মেয়েদের জানা উচিত কিভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তাদের খুব সাহসের সঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে এবং কোনো প্রকার ওজর-আপত্তি করা ঠিক হবে না। কেবলমাত্র তা হলেই তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার বন্ধ হবে।” আর নোয়াখালির হিন্দুদের প্রতি তাঁর অভিনব অহিংস হিতবাণী ছিল আরো মর্মপীড়াদায়ক। তিনি হিন্দুদের আহ্বান করে বললেন—”তারা যেন কখনোই অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ না করে। বরং তাদের উচিত একটিও শব্দ না করে হত্যাকারীর তরবারির দিকে মাথা এগিয়ে দেওয়া। তা হলেই দাঙ্গা থেমে যাবে।” (Statesman, 18-10-46 )
গান্ধীজীর এসব হিং-টিং-ছট্ উপদেশের মর্মোদ্ধার করা সাধারণের পক্ষে দুঃসাধ্য। তবে কি কলকাতা, কি নোয়াখালি কোথাও তিনি এই হত্যার রাজনীতির উদগাতাদের বিরুদ্ধে একটি নিন্দাসূচক কথা বলেননি। তাঁর যত আদেশ-উপদেশ সব অত্যাচারিত হিন্দুদের প্রতি। মুসলমানরা তাঁর কাছে খোদার বান্দা, ইসলামের সেবক, ইসলাম শান্তির ধর্ম, জিন্না কায়েদে আজম, সুরাবর্দী শহীদ এসব চাটুবাক্যে বিভূষিত।
গান্ধীজীর সুরে সুর মিলিয়েই যেন এসব হিন্দুদ্বেষী ঐতিহাসিকগণ মুসলিম ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এবং মুসলিম লীগ, জিন্না ও সুরাবর্দীর গায়ে লেপ্টে থাকা সাম্প্রদায়িকতার নোংরা জোব্বা সাফসুরত করার কাজে হাত লাগায়। সুরাবর্দীর ভগিনী বেগম ইক্রামুল্লা সুরাবর্দীর জীবনী লিখেছেন। তাতে কলকাতার পরেই বিহার দাঙ্গার কথা। নোয়াখালি দাঙ্গার উল্লেখমাত্র নেই— “The Calcutta riots were followed by the still more terrible Bihar riots….”
আয়েষা জালাল তাঁর ‘Sole Spokesman’ গ্রন্থে হিন্দু মহাসভার সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন-“an avowedly communal political organisation based on Hindu revivalism” বলে। আর ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর পরিচয় দিয়েছেন—”the symbol of Hindu fanaticism” বলে। অথচ মুসলিম লীগ কিংবা “Guilty man of 1946” সুরাবর্দীর পরিচয়দানকালে তার ডট-পেনের কালি শুকিয়ে গেছে। এই হল ধর্মনিরপেক্ষী ঐতিহাসিকদের চরিত্তির। এরা কেউ ইতিহাস বিনির্মাণ করছেন; কেউ সংশোধিত ইতিহাসের রায় লিখছেন, আবার কেউবা জিন্না-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন ভাবনা ভাবছেন। কিন্তু কালের কষ্টিপাথরে সেসব ধাপায় নিক্ষিপ্ত হবে। মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণও রেহাই পাননি।
(৯)
আজকাল অনেকেই দেশ ভাগের বেদনার কথা বলেন। সে বেদনা পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের মনে যেমন বেজেছে, আজ তা কয়জন অনুভব করতে পারে? পূর্ববঙ্গ তথা সদ্য রূপান্তরিত পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা অর্ধ শতাব্দী ধরে ঘরে ঘরে তেরঙা পতাকা উড়িয়েছে, শতসহস্র কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’ গেয়েছে, সারা ভারতের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যায় অন্তরীণ ও দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হয়েছে, জেল পুলিশ লাঠি-গুলি ফাঁসি হাসিমুখে সয়েছে। আর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ঘুম থেকে উঠে তারা দেখে “পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ” তাদের কাছে বিদেশ হয়ে গেছে। তারা ভিনদেশের বাসিন্দা—ভারতীয় বা বাঙালী নয়, পাকিস্তানী। চরকামার্কা তেরঙা ঝাণ্ডার বদলে চাঁদতারামার্কা পাকিস্তানী পতাকা তাদের ওড়াতে হয়েছে, গান্ধীজী নেতাজীর বদলে জিন্নার ছবিতে মালা পরাতে হয়েছে, বন্দেমাতরম্-এর বদলে আল্লা-হো-আকবর জিগির দিতে হয়েছে; ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। কি গভীর মনোবেদনায় তারা সেসব শোভাযাত্রায় বাধ্য হয়ে যোগদান করেছিল, তাদের মনের অবস্থাটা আজকের পাঠক একবার মনে মনে কল্পনা করুন তো! বাংলা ভাগে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা মুসলিম লীগের কবল থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আর পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘোর তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতঙ্কে দিন গুণছিল। তবু তারা বাংলা ভাগে উল্লসিত হয়েছিল। কারণ, বাংলার যেটুকু রক্ষা পেয়েছে তাই তাদের নিরাশার আশা:অকূলেতে কূল। পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনপ্রতিনিধিরা তাই বাম হাতে চোখের জল মুছে ডানহাতে বাংলা ভাগের দাবিপত্রে সই করেছিল।
অধুনা বাংলাদেশের তো বটেই এ বঙ্গেরও কিছু কিছু অর্বাচীন ব্যক্তি জানতে চায়—যে-হিন্দুরা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত জানপ্রাণ দিয়ে রুখেছিল, ১৯৪৭ সালে সেই হিন্দুরাই বাংলা ভাগের জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? এই কেন’র জবাব মিলবে বর্তমান গ্রন্থে। সে সঙ্গে মিলবে তৎকালীন বাংলার লাটসাহেব ফ্রেডেরিক বারোজের পরামর্শে কুচক্রী সুরাবর্দী স্বাধীন যুক্তবঙ্গের যে ফাঁদ পেতেছিলেন, এবং জননেতা শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায় বুঝে না বুঝে সে ফাঁদে পা দিয়ে বাঙালী হিন্দুর ষোলআনা সর্বনাশের পথ পরিষ্কারের কাজে হাত লাগিয়েছিলেন, তার কাহিনী। আরও মিলবে, তাঁদের এই অবিবেচনাপ্রসূত অপরিণামদর্শী প্রচেষ্টা বানচাল করে বাঙালী হিন্দুর পায়ের তলায় খানিকটা মাটি ঠিক রাখতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর অনলস সংগ্রামের ইতিহাস।
কিন্তু ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। তার এক মুখ বন্ধ করতে গেলে বিষফোঁড়ার মতো সাত মুখ ফোটে। “শ্যামাপ্রসাদ অন্তরের সঙ্গে যা সত্য বলে বিশ্বাস করতেন তা প্রকাশ করতে তিনি কোনোদিনই ভীত হতেন না। নির্বাক থাকলে নিষ্ঠুরতম মিথ্যাও প্রচার লাভ করে। ঘোরতর অন্যায় যখন অনুষ্ঠিত হয়, তখন সত্য একদিন নিজস্ব শক্তিতেই প্রকাশিত হবে, সেই বিশ্বাসে চুপ করে থাকা অন্যায়। শ্যামাপ্রসাদ একাজ কোনোদিনই করতেন না।” (ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ)।
তিনি বিশ্বাস করতেন ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন যুক্তবঙ্গ বাঙালীর মরণ-ফাঁদ। তাই তিনি সে পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে কোমর বেঁধে নামেন। মুখ্যত তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় কলকাতা সমেত হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবাংলাকে যুক্তবঙ্গ বেনামে পাকিস্তানভূক্তির পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদেরও পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মতো ছিন্নমূল হবার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ। বাঙালী হিন্দুর চরম দুর্যোগের দিনে বলতে গেলে পরিত্রাতারূপেই শ্যামাপ্রসাদ তাদের সামনে ‘মা ভৈঃ’ বলে দাঁড়িয়েছিলেন অকুতোভয়ে। মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে তারা তখন দিশাহারা। ব্রাহ্মবাদী বা সাম্যবাদী কোনও ধুতিপরা হিন্দুই সে বিষাক্ত দংশন থেকে রেহাই পায়নি। তাই দলমত নির্বিশেষে অনেকেই সে সময় তাঁর পাশে এসে সামিল হন; ব্যতিক্রম মুসলিম লীগের দোসর সাম্প্রদায়িক কম্যুনিস্টরা।
(১০)
শ্যামাপ্রসাদ পেশাদার রাজনীতিক ছিলেন না। দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে তিনি শিক্ষাক্ষেত্র ছেড়ে রাজনীতিক্ষেত্রে আসেন। তাঁর রাজনীতির মূল আদর্শ ছিল জনসেবা ও দেশের স্বার্থরক্ষা। যেখানেই এই আদর্শহানির সম্ভাবনা দেখা গেছে, সেখানেই তিনি ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনতার দরবারে এসে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৪২ সালে মেদিনীপুরবাসীর উপর ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের বর্বরোচিত অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি বাংলার অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঘৃণাভরে পদত্যাগ পত্রখানা ব্রিটিশ লাট স্যার জন হার্বাটের মুখের উপর ছুঁড়ে দেন। আট বছর পর ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপর মুসলিম লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে যে নির্বিচার হত্যা লুণ্ঠন গৃহদাহ ও নারী নির্যাতন চলে, তার বিরুদ্ধে নপুংসক নেহরু সরকার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় শ্যামাপ্রসাদ ঘৃণাভরে নেহরু মন্ত্রিসভার শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে সর্বহারা উদ্বাস্তুদের পাশে এসে দাঁড়ান। ক্ষমতা ও পদলোভী এই শিয়াল শকুনের দেশে নীতি ও আদর্শের সঙ্গে কোন প্রকার আপস না করে, পরপর দু’বার মন্ত্রিপদ ত্যাগ করে শ্যামাপ্রসাদ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
আর কাশ্মীর প্রশ্নে দেশের স্বার্থে তিনি যে নিজের জীবনটাই ত্যাগ করে গেলেন,সেই সর্বত্যাগী দেশপ্রেমিকের কথা কোন কোনও নিমকহারাম বাঙালী ভুললেও প্রকৃত দেশপ্রেমিক ভারতবাসী কোনও দিন ভুলবে না।
শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিত্বের এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। তিনি ‘ক্যাডারি’ করে ‘লীডার’ হন নি। নিজ ব্যক্তিত্বেই নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ক্ষুদ্রচেতা রাজনীতিজীবী (Politician) ছিলেন না। ছিলেন উদারপন্থী নীতিবাদী রাষ্ট্রনেতা (Statesman)। “ইংরাজীতে যাকে বলে Statesman তার শ্রেষ্ঠ রূপটি শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে পাওয়া যায়। যাঁরা Statesman তারা কাজ করেন রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তনের জন্য। সেই পরিবর্তনের আদর্শ তাঁদের নিজেদের আবিষ্কৃত নয়। যে চিন্তা ও ভাবের উপর তার প্রতিষ্ঠা তাঁর জন্ম দেয়; অন্য শ্রেণীর লোক, চিন্তা ও ভাবের যাঁরা স্রষ্টা। যাঁরা বড় Statesman এই চিন্তা ও ভাব তাঁদের কাজের প্রেরণা দেয়। এই চিন্তা ও ভাবের আদর্শকে রাষ্ট্রে ও সমাজে তাঁরা বাস্তবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। বাঙালাদেশ ও ভারতবর্ষে আধুনিক কালের চিন্তানায়কদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চিন্তার যা সর্বশ্রেষ্ঠ দান, শ্যামাপ্রসাদের মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেগুলি অনুপ্রবিষ্ট ছিল।” (অতুল গুপ্ত— ভূমিকা : “শ্যামাপ্রসাদের রচনা”)
এই প্রগাঢ় প্রজ্ঞা ও অনন্যসুলভ দূরদৃষ্টিই শ্যামাপ্রসাদকে বাংলাভাগের দাবিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর জন্মশতবর্ষে তাঁর সেই দূরদর্শী ভূমিকার কথা আত্মবিস্মৃত বাঙালীর সামনে তুলে না ধরলে তা হবে জাতীয় অবমাননা ও ঘোরতর অকৃতজ্ঞতার পরিচয়।
ঘরপোড়া বাঙালী হিন্দু পশ্চিমবঙ্গের আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখে আবার আতঙ্কিত হচ্ছে। সময় সময় মনে হয় পশ্চিমবঙ্গ কি ১৯৪৬-৪৭ সালের ঘোর তমসাচ্ছন্ন দিনগুলিতে ফিরে যাচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গবাসীর জীবনে সেই দুর্ভাগ্যের পুনরাবির্ভাব যেন না ঘটে সে বিষয়ে নিরন্তর সতর্কতা প্রয়োজন। কারণ, এক দিকে ছলে বলে কৌশলে পূর্ববঙ্গ তথা অধুনা বাংলাদেশ থেকে অবশিষ্ট হিন্দুরা ক্রমান্বয়ে বিতাড়িত হচ্ছে, অপরদিকে খাস পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিন্দুরা মানসম্মান রক্ষার্থে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ অঞ্চলে সরে যাচ্ছে। কিন্তু সরতে সরতে শেষ পর্যন্ত আর সরার জায়গা থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী এখনো আত্মসচেতন না হলে এবং পূর্ববৎ সংখ্যালঘু, তোষণবাদী রাজনৈতিক দলগুলির হাতে নিজেদের ভাগ্য সঁপে দিয়ে টি. ভি.-র সামনে সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে থাকলে, তাদের কপালে ১৯৪৬-৪৭’-এর রক্তাক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কেউ রোধ করতে পারবে না। এবারে তাদের পাশে ডঃ শ্যামাপ্রসাদের মতো বরাভয় মূর্তি নিয়ে দাঁড়াবার কেউ নেই। সেকথা মনে থাকে যেন।
অপ্রিয় সত্য বলতে শাস্ত্রে নিষেধ আছে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ও ইতিহাসের মর্যাদা রক্ষার্থে আমরা সেই নিষেধাজ্ঞা কিঞ্চিৎ অমান্য করতে বাধ্য হলাম। তাতে যদি কারও আঁতে ঘা লাগে তো লাগুক।
এই গ্রন্থ প্রণয়নে যে সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পেয়েছি, যাঁদের প্রণীত গ্রন্থাদি ও সম্পাদিত পত্রপত্রিকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি, বা বক্তব্যের সমর্থনে উদ্ধৃতি দিয়েছি, তাঁদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও বিনম্ৰ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বন্দে মাতরম্ : জয়তু শ্যামাপ্রসাদ
ডঃ দীনেশচন্দ্র সিংহ
জন্মাষ্টমী, ১৪০৭
.
“May the divine Mother banish fear, superstition and cow-ardice from the minds of all and lead us along the path of unity and righteousness and stimulate each of us, however humble or unworthy, to make his life’s offering at the altar of that Eternal Sakti that presides in all her glory and perfection over the destinies of our beloved Motherland.”
-Syamaprasad.
“A nation must first be physically strong and adequately armed before it can proclaim and defend moral doctrines. That nation is trully great which has force and strength at its disposal but never abuses them for the advancement of self-interest or self-aggrandisement.”
-Syamaprasad
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন