৩৫. চেম্বারে ঢুকতেই বোস সাহেব

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

পরদিন চেম্বারে ঢুকতেই বোস সাহেব হাসিমুখে বলে, উড ইউ লাইক এ ট্রিপ টু নর্থ বেঙ্গল?

দীপনাথ একটু হকচকিয়ে যায়। শিলিগুড়ি! এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?

সে কোনও জবাব দেওয়ার আগেই বোস সাহেব বলে, এবার অবশ্য একদম ইন্ডিপেডেন্ট ট্যুর। সঙ্গে আমি থাকছি না।

তবে?

তবে আবার কী? আপনার দায়িত্ব বাড়ছে। আমি আর আগের মতো ট্যুরে যেতে পারছি না। অফিসটাকে ঢেলে সাজাতে হবে অ্যান্ড আই অ্যাম ডগ টায়ার্ড! টুর এখন থেকে আপনার।

সব ট্যুর?

সব না হলেও কিছু।

নর্থ বেঙ্গল আমার ফেবারিট–

বোস হাত তুলে কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তাকে থামায়। বলে, আমি জানি। নর্থ বেঙ্গলে যেতে পারলে যে আপনি কত খুশি হন তা আপনার চোখমুখ দেখেই বুঝেছি।

থ্যাংক ইউ।

ইটস অল ইন দি জব। আমার কোনও কেরামতি নেই। আরও তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আসছেন। আমি তাদের রিক্রুট করিনি, করেছে কোম্পানি। তাবা গুজরাট, পাঞ্জাব এবং কেরালার লোক। বাঙালি কেবল আপনি।

আমি? আমি তো এখনও–

বোস সাহেব আবার হাত তোলে, কথাটা এখনও শেষ হয়নি চ্যাটার্জি। যা বলছিলাম। আপনিই চারজনের মধ্যে একমাত্র বাঙালি এবং মোস্ট প্রোবলি একমাত্র ইনএফিসিয়েন্ট লোক।

দীপনাথ এটা ঠাট্টা কি না না-বুঝে একটা গাড়লের হাসি হাসল।

তবে এও জানি অন্যে যখন টু্যরের নামে দু’হাতে টাকা লুটবে তখন আপনিই একমাত্র পাইপয়সারও ডিটেলস হিসেব দেবেন। তাই বলছি আপনার ইনএফিসিয়েন্সির তুলনা হয় না।

এটা কি কমপ্লিমেন্ট বোস সাহেব?

না।–বলে বোস তার বাঁ ধারে আলাদা করে রাখা একটা সাদা খাম তুলে তার হাতে দিয়ে বলে, এটা কমপ্লিমেন্ট নয়। জাস্ট দি রিকগনিশন।

দীপনাথ খামটা খুলল। আমেদাবাদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরস তাকে কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার করেছে। খবরটা বহুবার বোস সাহেবের কাছে শুনেও তেমন বিশ্বাস হয়নি। বাংগালোরের ফাঁকড়া থাকায় বরং কথাটা শুনলে মন খারাপ হত। কিন্তু এখন চিঠিটা হাতে পেয়ে তার সমস্ত শরীর মন মাথা ভেসে যাচ্ছে আনন্দে শিহরনে। মোটামুটি বড় একটা কোম্পানির সে জোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। মাইনে দেড় হাজার এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে।

এতটা আশা করেনি দীপনাথ। বিভ্রান্তভাবে সে বোস সাহেবের দিকে চেয়ে থাকে।

বোস সাহেব বলে, বসুন।

দীপনাথ পুতুলের মতো বসে।

বোস সাহেব তার কাচের গেলাস থেকে খানিকটা জল খেয়ে একটা খাস ছেড়ে বলে, আমি জানি, গতকাল পর্যন্তও আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করতেন না। ভাবতেন আই অ্যাম জাস্ট টেকিং ইউ টু এ ট্র্যাপ।

দীপনাথ কিছু বলতে যায়, বোস সাহেব আবার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, অ্যান্ড আই ডিজার্ভড দ্যাট। আমি আপনার সঙ্গে কথার খেলাও কিছু কম খেলিনি।

দীপনাথ চুপ করে থাকে। হাতের চিঠিটার দিকে আর-একবার তাকায়, ভাজ করে পকেটে রাখার কথা মনে হয় না। কেবল চেয়ে থাকে। তারপর বলে, বাংগালোের কি তা হলে ক্যানসেলড?

হুঁ। তবে বাংগালোর নিয়ে তো আমার কোনও প্রবলেম ছিল না। আমার প্রবলেম যেটা সেটা রয়েই গেল।

কী?–দীপু ঝুঁকে বসে।

মণি। আমার স্ত্রী।

আমরা কিছুই করতে পারি না মিস্টার বোস?

বোস মাথা নাড়ে, না। নেক্সট মানথ উই আর গোয়িং টু কোর্ট।

কোর্ট, বোস সাহেব? কোর্ট?

কোর্ট। মিউচুয়াল করে নিচ্ছি। তারপর কোম্পানির কাজে একটু বাইরে যাব। শীতের আগেই।

কোথায়?

মিডল ইস্ট। তারপর আমেরিকা। লম্বা টুর। ভালই হবে। দি উন্ডস উইল বি হিলড।

দীপনাথ এবার চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রাখে।

বোস হাসে হঠাৎ। বলে, ইজ দি পেমেন্ট অলরাইট?

খুব ভাল। আনএক্সপেক্টেড।

বোস সাহেব মাথা নেড়ে বলে, দ্যাটস ফুলিশনেস। আমার কাছে বললেন ভালই, খবরদার আর কাউকে বলবেন না। নাথিং ইজ টু গুড অ্যাজ ফার অ্যাজ ইউ ক্যান স্ট্রেচ দেম।

আপনাকেই বলছি।

আমাকেও নয়। আমি ম্যানেজমেন্টের লোক।

দীপনাথ হাসে।

বোস সাহেব মুখটা একটু গম্ভীর করে বলে, একটা কথা বলে রাখি। আপনার কোয়ালিফিকেশন খুব জেনারেল ধরনের বলে আপনার পে অন্য তিনজনের চেয়ে খানিকটা কম। বাকি তিনজন বেসিক স্যালারি পাবে রাউন্ড অ্যাবাউট টু থাউজ্যান্ড।

পাক, আমার অভিযোগ করার কিছু নেই।

থাকলেও আপাতত কিছু করা যেত না। আমি বেশি চাপাচাপি করিনি। তা হলে ম্যানেজমেন্ট অন্যরকম সন্দেহ করত।

ঠিক আছে।

বোস মাথা নেড়ে বলে, ঠিক নেই। আমি জানি। তবে আমি তো থাকছিই। বছর খানেকের মধ্যেই সকলের স্ট্যাটাস সমান করব। কথা দিচ্ছি।

দীপনাথের কাছে চাকরির আনন্দ অনেকটাই বিস্বাদ হয়ে গেছে। বোস আর মণিদীপার বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, সেটা তার চাকরি পাওয়ার চেয়েও গুরুতর ঘটনা।

দীপনাথ বলে, আমি মিসেস বোসের কাছে শেষবারের মতো একটু যাব?

বোস অবাক হয়ে বলে, নিশ্চয়ই যাবেন। ইউ নিড নো পারমিশন। কিন্তু কেন?

আর একবার চেষ্টা করব।

বোস হাসে। নিজের মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে স্নান ও সুন্দর হাসিটি ঝুলিয়ে রেখেই বলে, ড়ুয়িং গুড টু আদারস? ইউ আর রিয়েলি ইম্পসিবল। আপনাকে তো বলেইছি, প্রবলেমটা ইমোশনাল নয়। হার্ড ফ্যাক্ট।

জানি। খানিকটা বুঝতেও পারি। কিন্তু আমার মনে হয় প্রবলেমটা তেমন জটিল কিছু নয়। হয়তো আপনাদের সম্পর্কের একটা ছোট্ট কোনও আনঅ্যাডজাস্টমেন্ট আছে। আর সেইটেই এখন ফেঁপে ফুলে উঠেছে।

বোস আনমনে মধ্য-দুরত্বের শূন্যে চেয়ে কী যেন ভাবছিল। দীপনাথের কথাটা শুনে বলল, হতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি কাজকর্ম নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে, নিজের স্ত্রীকে নিয়ে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করার সময় পাইনি। চিন্তা করার দরকার হয়নি এতকাল।

এখন কি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন মিস্টার বোস?

বোস সাহেব চমক্কার করে হাসল। ইদানীং বোসের হাসিতে একটা বিষাদ যুক্ত হওয়াতেই বোধহয় হাসিটা ফোটে ভাল।

বোস সাহেব বলে, ইন ফ্যাক্ট, আমার কাছে ডোমেস্টিক অ্যান্ড কনজুগাল প্রবলেমগুলো ভীষণ ফরেন। দীপা এমন সব প্রবলেম তৈরি করে যেগুলো আমি বুঝতেই পারি না। ম্যাজিসিয়ানরা যেমন শুন্যে টুপি থেকে খরগোশ বের করে, দীপাও তেমনি আউট অফ নাথিং ক্রাইসিস তৈরি করতে পারে।

কীরকম ক্রাইসিস?

বলতে গেলে মহাভারত। আমার অত মনেও থাকে না। আই হ্যাভ মোর ইমপর্ট্যান্ট থিংস টু থিংক অ্যাবাউট। বিয়ে করুন, আপনিও জানতে পারবেন।

বিয়ে সবাই করে, কিন্তু সকলের তো আপনাদের মতো প্রবলেম দেখা দেয় না।

সেটাও সত্যি। আমরা বোধহয় একটু বেশি আপ-স্টার্ট।

না, না, তা নয়। আপনারা চমৎকার একটি দম্পতি। আমি তো জানি।

বাইরে থেকে বোধহয় ভালই দেখায় আমাদের। যাকগে, ওসব কথা থাক। ডিভোর্স হলে আমি বা দীপা কেউই বোধহয় খুব কিছু লুজ করব না।

বিয়ে ভেঙে-যাওয়াটা একটা সোশ্যাল স্ক্যান্ডাল, আপনিই সেদিন বলেছিলেন।

নিশ্চয়ই। স্ক্যান্ডাল এড়ানোর জন্য আমি দীপার সঙ্গে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এ যেতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, লেট আস লিভ টুগেদার লাইক কো-টেনান্টস।

উনি কী বললেন?

দীপা গায়ে জ্বালা ধরানো হাসি হেসেছিল। কিন্তু চ্যাটার্জি, আমার অনেক কাজ আছে। এসব এখন থাক।

দীপনাথ উঠল। বলল, আমি নতুন পোস্টে কবে জয়েন করব?

আজই।

নর্থ বেঙ্গল কবে যেতে হবে।

তিন-চার দিনের মধ্যেই।

আসছি বোস সাহেব।

শুনুন, আপনি আজ জয়েন করলেও আজই আপনাকে কোনও কাজ দেওয়া হবে না। আপনি এখন চলে যেতে পারেন। সামনের মাস থেকে কাজের প্রেশার বাড়বে। ততদিন একটু বিশ্রাম করে নিতে পারেন।

আচ্ছা। একটা কথা, আমি কি আমার আত্মীয় এবং বন্ধুদের জানাতে পারি যে, আমি এ চাকরিটা পেয়েছি?

নিশ্চয়ই। আপনার চাকরি একদম পাকা।

থ্যাংক ইউ।—বলে দীপনাথ বেরিয়ে আসে।

একটু অন্যমনস্ক ছিল বলে অফিসের চারদিকে লক্ষ করেনি। বেরোবার মুখে রঞ্জন এসে ধরল, কী দাদা! কতবার যে ইশারা করলাম, দেখতেই পেলেন না?

দীপনাথ থতমত খেয়ে বলে, একটু অন্য কথা ভাবছিলাম।

সে তো বুঝতেই পারছি। খবর কী বলুন তো? আমরা তো শুনছি আপনি কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হচ্ছেন।

হ্যাঁ। আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেলাম।

অভিনন্দন না কী যেন জানাতে হয়! তাই জানাচ্ছি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। আজ একটা কাজ আছে রঞ্জন, চলি।

আমার কেসটা একটু দেখবেন। এখন তো আপনি টপ-বসদের একজন।

নিশ্চয়ই। পরে কথা হবে।

বেরিয়ে এসে নীচের ফটকে দাঁড়িয়ে দীপনাথ দেখে, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। দরজায় ভিড় জমে আছে। বেরোনো যাবে না। কিন্তু অফিসেও ফিরে যেতে ইচ্ছে করল না তার। চুপচাপ ভিড়ের একটু পিছনে দাঁড়িয়ে রইল। মনে অজস্র কথার ঝড়।

আধ ঘণ্টায় কলকাতাকে ড়ুবিয়ে, গাড়িঘোড়া বন্ধ করে দিয়ে বৃষ্টি থামল।

রাস্তায় বেরিয়ে দীপনাথ ঠিক করতে পারছিল না কোথায় যাবে। মণিদীপা, প্রীতম কিংবা বাবা। ভেবে দেখল অনেকক্ষণ। মণিদীপা হয়তো বাড়িতে নেই এখন। প্রীতম সম্ভবত ঘুমোচ্ছ। তা ছাড়া খবরটা সকলের আগে বাবাকেই দেওয়া উচিত। বহুদিন হল বাবার সঙ্গে দেখা হয় না।

সজলকে একটা এয়ারগান দেওয়ার কথা ছিল। নিউ মার্কেটে গিয়ে একটা এয়ারগান কিনল দীপনাথ। তারপর ভাবল, সকলের জন্যই কিছু নেওয়া উচিত। সুতরাং বউদির জন্য একটা রঙিন শাড়ি, বাবা আর মেজদার জন্য ধুতি, মঞ্জু আর স্বপ্নার জন্য দুটো ম্যাক্সি কিনে নিল। পকেটে গত মাসে পাওয়া আটশো টাকার অনেকটাই অবশিষ্ট ছিল।

 

রতনপুর পৌঁছোতে বিকেল। কলকাতার কংক্রিট থেকে এই সবুজ গাছপালার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়লে মনটা জুড়িয়ে যায়।

পথটা হেঁটেই পার হয় দীপনাথ, সমস্ত শরীর আর মন দিয়ে চারদিককাব প্রকৃতি থেকে স্নিগ্ধতা শুষে নিতে নিতে। অল্প দূরে মাঠের ধারে সূর্য নামছে। পাখির ডানার শব্দ। গাছপালায় বাতাস লাগছে এসে।

বাড়িটা ভারী নিঃঝুম। ঢুকতেই প্রথমে শ্রীনাথের ভাবন-ঘর। দরজায় তালা ঝুলছে। ভিতরবাড়ি পর্যন্ত অনেকটা পথ। হাঁটতে হাঁটতে দীপনাথ চারদিকে চেয়ে দেখছিল পুকুরপারের ঝোপড়াটায় খ্যাপা নিতাই না কে একটা লোক থাকে। সেদিক থেকে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল মাত্র, কিন্তু কোনও মানুষের সাড়া নেই।

খানিক ঘেউ ঘেউ করে কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে সঙ্গ ধরে।

উঠোনে পা দিয়ে দীপনাথের একটা কেমন যেন লাগে। বাড়িটা নিস্তব্ধ, নিরানন্দ। লোকের মানসিকতা কি বাড়ির চেহারাতে ফুটে ওঠে? কে জানে! কিন্তু পশ্চিমের রাঙা রোদে ভেসে-যাওয়া মস্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে দীপনাথের মনে হয়, এ বাড়িতে যেন বিষাদ ঘনিয়ে আছে। বাবা কি তা হলে নেই!

বউদি! ও বউদি!

বড় ঘর থেকে তৃষা বেরিয়ে আসে, ওমা! বড় ঠাকুরপো! এসো, এসো।

শঙ্কিত চোখে তৃষার দিকে চেয়ে দীপনাথ বলে, বাবা! বাবা কোথায়?

বাবা বেড়াতে গেছেন। সারাদিন বসে থাকেন তো। আজকাল তাই বিকেলের দিকে রিকশায় করে বেড়াতে পাঠিয়ে দিই। বোসো, এক্ষুনি এসে যাবেন।

খুব বিশেষ মানুষ ছাড়া তৃষা নিজের ঘরে কাউকে বসায় না। দীপনাথকে বসাল। বলল, এতদিন পরে মনে পড়ল?

মনে রোজই পড়ে। সময় হয় না।

কলকাতার লোকদেরই যত সময়ের অভাব। না?

কথাটা মিথ্যে নয়। আচ্ছা বউদি, বাড়িটা আজ এরকম লাগছে কেন বলো তো?

কীরকম?

ঠিক বোঝাতে পারব না। খুব আনহ্যাপি যেন।

যাঃ। আনহ্যাপির কী আছে!

বাচ্চাগুলো কোথায়?

এ সময় ওরা বাড়িতে থাকে নাকি? খেলতে-টেলতে গেছে। ওসব কী এনেছ অত?

দেখো তো এই শাড়িটা কেমন?–বলে তৃষার শাড়িটা পলিথিনের প্যাকেট থেকে বের করে দীপনাথ।

বাঃ, বেশ শাড়ি। কার জন্য কিনলে?

তুমি পরবে।

আমি! আমি কি আজকাল রঙিন শাড়ি পরি নাকি! পাগল কোথাকার।

কেন, রঙিন শাড়ি পরলে কী হয়?

যাঃ, ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে না। তা ছাড়া তোমাকে এসব পাকামি করতে কে বলেছে? আমার জন্য শাড়ি আনার কী দরকার পড়ল হঠাৎ বলো তো? বিয়ে-টিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি?

না, তবে বিয়ের পথ পরিষ্কার হয়েছে। আমি একটা দেড় হাজারি চাকরি পেয়েছি।

ওমা! তাই নাকি! তা হলে পাত্রী দেখি?

দীপনাথ স্মিতমুখে চেয়ে বলল, তোমার হাতে অনেক পাত্ৰী আছে জানি। ধীরে সুস্থে দেখো। আগে রঙিন শাড়ির প্রবলেমটা মিটুক। তুমি রঙিন শাড়ি পরবে না কেন?

বয়স হচ্ছে না!

লাজুক ভাব করে তৃষা বলে। মল্লিনাথ ছাড়া বোধহয় দীপনাথই একমাত্র পুরুষ যাকে খুব কাছের লোক বলে ভাবতে পারে তৃষা। এই দেওরটির মুখোমুখি হলে তার সব কঠোরতা কোমল হয়ে আসে, বুকের জ্বালাগুলো মিইয়ে যায়।

তোমার কত বয়স?

কে জানে বাবা! শুধু জানি, ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, আমিও বুড়ি হচ্ছি।

তোমার দ্বিগুণ বয়সের মহিলারা কত ঝলমলে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, দেখো না?

কলকাতায় ওসব কেউ মাইন্ড করে না। কিন্তু এ তো কলকাতা নয়! গা গ্রামকে তো জানো না! এখানে নিন্দে রটে।

সেটা তোমার ইমাজিনেশন। গা গ্রামও আর আগের মতো শরৎচন্দ্রের যুগে পড়ে নেই। বুড়োমিটা একটু কমাও। যাও গিয়ে শাড়িটা পরে এসো।

আচ্ছা আচ্ছা হবে ’খন। আগে জিরিয়ে নাও, চা করতে বলে আসি।

ভ্রুকুটি করে দীপনাথ বলে, আগে শাড়ি পরবে, তারপর আমি এ বাড়িতে জলগ্রহণ করব। যাও।

তৃষা হাসে না। মলিন এক মুখ করে খানিকক্ষণ দেওরের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর মৃদু স্বরে বলে, আচ্ছা, পরছি।

তৃষার মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ কষ্ট হল দীপনাথের। বউদিকে সে কোনওদিন ঠিক এরকম বিষাদ-প্রতিমা দেখেনি। তৃষা কোথাও কখনও হার মানে না, ভেঙে পড়ে না।

সে বলল, তোমার কী হয়েছে বলো তো!

কিছু না গো।–বলে তৃষা জোর করা হাসি হেসে চলে যেতে যেতে দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, রঙিন শাড়ি পরে আসছি, তখন দেখো কেমন ঝলমলে আর হাসিখুশি দেখায়।

বলেই চলে গেল।

মল্লিনাথের ঘরটায় একা বসে চারদিক দেখে দীপা খাটের পাশেই বন্দুক রাখার র্যাকে মল্লিনাথের পুবনো বন্দুকটা ফিরে এসেছে। কৌতূহলী দীপনাথ উঠে গিয়ে বন্দুকটা তুলে নেয়। ঘঁাচা ইস্পাতের সিকিম জিনিস। প্রচণ্ড ভারী। ঘোড়ার কাছে লোহার ওপর নানা কারুকার্য করা। কুঁদোর গায়ে একটা খোদাই করা পেতলের পাতে ইংবিজিতে লেখা এম এন চ্যাটার্জি। বন্দুকটা ভেঙে ব্যারেলের ফুটোয় চোখ রাখে দীপনাথ। সদ্য পরিষ্কার করা বর্তুল আয়নার মতো ইস্পাতে ঝকমকিয়ে উঠল আলো আর প্রতিবিম্ব।

আপনার চা।

একটু চমকে ওঠে দীপনাথ। বউদির ঝি বৃন্দা।

রেখে যাও।

বলে বন্দুকটা আবার সোজা করে কাধে তুলে দেয়ালের দিকে তাক করে দীপনাথ। বড়দার হাত ছিল পরিষ্কার। শুধু বন্দুকের টিপ কেন, কোন দিকটাতেই বা খামতি ছিল বড়দার! বিশাল চেহারার অতি সুন্দর পুরুষ, দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, সাহসী, ডানপিটে। যেখানেই গেছে সেখানেই সহজাত কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। কারও কাছে মাথা নোয়ায়নি। শুধু একটু চরিত্রের দোষ ছিল। মদ আর মেয়েমানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা কেন করল না তা সঠিক বোঝা যায় না। যখন উত্তরবাংলায় ছিল তখন মাঝে মাঝেই পিসির বাড়িতে হানা দিয়েছে। হইচই ফুর্তি করতে খুব ভালবাসত। দীপনাথ তখন রামকৃষ্ণ ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করে। স্বাস্থ্যখানা বরাবর পেটানো ছিল। মল্লিনাথ তার কাঁধে থাবড়া মেরে বলত, তুই হবি আমার মতো। স্বাস্থ্য না হলে কি পুরুষকে মানায়?

ঘোর-ঘোর হয়ে এসেছে ঘরখানা। বন্দুকটা কোলে নিয়ে প্রায় জুড়নো চায়ে চুমুক দিতে দিতে জলজ্যান্ত চোখের সামনে যেন দেখতে পেল মল্লিনাথকে। দীপনাথ গভীর একটা শ্বাস ফেলে বলল, অত স্বাস্থ্য ছিল তোমার, তাও বাঁচলে কই? তুমি বেঁচে থাকলে আমাদের একটা আশ্রয় থাকত। বাড়িঘরের আশ্রয় নয়, মনের আশ্রয়।

টুক করে ঘরের আলো জ্বলে উঠল। খুব জোরালো নয়, নিস্তেজ হলুদ আলো। সেই আলোয় তৃষা সামনে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখে হেসে বলল, নাও, হল তো!

দীপনাথ দেখে, হলুদে খয়েরিতে ছাপা সুন্দর শাড়িতে বউদির বয়স কম করেও দশ বছর কমে গেছে। কিন্তু হাসিটি সত্ত্বেও মুখ এত মলিন যে শাড়িটাকে ছদ্মবেশ বলে মনে হয়।

তৃষা চোখ নামিয়ে শাড়িটা একবার দেখে বলল, বুড়ো বয়সের এত সাজগোজ কে দেখবে বলো তো!

মেয়েরা নিজেদের জন্যই সাজে।

তোমাকে বলেছে!

ঠিক আছে, তুমি না হয় আমার জন্যই সেজো। তোমাকে বুড়ি দেখতে আমার ভাল লাগে না।

এ কথায় তৃষা যেন কিছুক্ষণ নিজেকে খুঁজে পেল না। শক্ত মেয়ে হরিণীর মতো চকিত চোখে চারদিক দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ চোখ পড়ায় ভ্রু কুঁচকে বলল, কী সর্বনাশ! তুমি যে বন্দুক নিয়ে বসে আছ। কিন্তু ভাই, আমি তো রোহিণী নই।

দীপনাথ হেসে বলে, আমারই-বা কোন গোবিন্দলাল হওয়ার দায় ঠেকেছে।

দীপনাথ বন্দুকটা আবার র্যাকে তুলে রেখে বলল, শিলিগুড়িতে থাকতে এই বন্দুকটা কয়েকবার চালিয়েছি। হঠাৎ হাতের কাছে পেয়ে একটু দেখছিলাম। এটা যত্ন করে রেখো।

যত্নেই আছে। এতদিন থানায় জমা ছিল। নিয়ে এসেছি।

ভাল করেছ। বাবা ফিরেছে?

না। উনি বোধহয় শিমুলতলায় বুড়োদের আড্ডায় বসেছেন।

বাবাকে চাকরির খবরটা দিতেই আসা।

আজই চলে যাবে নাকি?

যাব না?

খুব যদি জরুরি কাজ না থাকে তবে থেকে যাও না রাতটা!

কেন বলো তো?

কেন আবার! তুমি এলে আমরা কত খুশি হই জানো না? ছেলেটা তো বড় কাকা বড় কাকা করে অস্থির। আমাকেও জ্বালিয়ে খায়। সবাইকে বলে তুমি নাকি দারুণ ভাল বক্সিং জানো, আরও কী কী সব যেন। বলে, বড় কাকা একাই পঞ্চাশজন গুন্ডাকে মেরে পাট করে দিতে পারে।

বহুকাল বাদে এমন হোঃ হোঃ করে হাসল দীপনাথ। বলল, ব্যাটা বোধহয় খুব অ্যাডভেঞ্চারের বই-টই পড়ে।

ভীষণ। আর দিনরাত্তির কেবল মারপিটের গল্প।

ওর জন্য এয়ারগান এনেছি।

কত কী এনেছ পাগল! কত টাকা নষ্ট হল।

আমার মাইনে দেড় হাজার, মনে রেখো।

দেড় হাজার!–বলে একটা শ্বাস ছাড়ে তৃষা। বলে, সংসারী হলে বুঝতে এই বাজারে দেড় হাজার কিছুই নয়। এখন থেকে কিছু কিছু করে জমাও।

তুমি সত্যিই বুড়ি হয়েছ।

সেই মেয়েটার কী খবর বলো তো! যাকে একদিন সঙ্গে করে এনেছিলে!

মেয়ে নয়, বউ। বসের বউ।

ওই হল। সে কেমন আছে?

ভাল না।

কেন?

স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।

তৃষা একটু চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ বলে, সত্যি বলো তো ঠাকুরপো, ডিভোর্সের কারণ তুমি নও তো?

দীপনাথ চমকে তাকায়, কী যা-তা বলছ?

আর-একদিন ঠাট্টা করেছিলাম, তুমি রেগে গিয়েছিলে। আজ কিন্তু ঠাট্টা করছি না। আমার সত্যিই ধারণা, ও মেয়েটা তোমাকে অসম্ভব ভালবাসে।

দূর! আমাকে দেখলেই যা-তা বলে। কথায় কথায় অপমান করে, তুমি একটি বুদ্ধ!

তৃষা হাসল, তা হলে বলি, এবার ঠিক জানলাম মেয়েটা তোমার প্রেমে পড়েছে। নইলে অপমান করত না।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতে
২. ০২. দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে
৩. ০৩. শিলিগুড়ির হোটেল সিনক্লেয়ার
৪. ০৪. এই শীতে অন্ধকার বারান্দায়
৫. ০৫. তৃষা বিছানা ছাড়ে শেষ রাতে
৬. ০৬. মালদা থেকে গভীর রাতে দার্জিলিং মেল
৭. ০৭. প্রীতমের ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলায়
৮. ০৮. বিয়ের পর যখন অরুণ এ বাড়িতে আসত
৯. ০৯. দীপের ঘুম ভাঙল
১০. ১০. রেসের মাঠে
১১. ১১. এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি
১২. ১২. কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে
১৩. ১৩. বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল
১৪. ১৪. চাবিটার কথা
১৫. ১৫. শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
১৬. ১৬. রবিবার দিনটা দীপনাথের নিরঙ্কুশ ছুটি
১৭. ১৭. সজল এসে প্রণাম করে
১৮. ১৮. তৃষা দীপনাথকে বসিয়ে রেখে
১৯. ১৯. তুমি বেলুন ফোলাবে
২০. ২০. হাসিমুখে, স্নিগ্ধ মনে
২১. ২১. কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে
২২. ২২. রতনপুরে পাঁচখানা নতুন সাইকেল রিকশা
২৩. ২৩. আমি যদি এই কোম্পানি ছেড়ে দিই
২৪. ২৪. পরদিন অফিসে এসেই দীপনাথ শুনল
২৫. ২৫. দীপ একটু থতমত খেয়েছিল
২৬. ২৬. গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে দীপনাথ
২৭. ২৭. বেজি জাতটা কিছুতেই পোষ মানে না
২৮. ২৮. আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছিল সজল
২৯. ২৯. শ্রীনাথ বাড়ির ফটক পেরিয়ে
৩০. ৩০. বোসোহেবের মুখে খুব ছেলেমানুষি হাসি
৩১. ৩১. হুইলচেয়ারে
৩২. ৩২. টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে নামবার মুখে
৩৩. ৩৩. ট্রেনের কথা একদম খেয়াল থাকে না
৩৪. ৩৪. দৈহিক দিক থেকে পঙ্গু
৩৫. ৩৫. চেম্বারে ঢুকতেই বোস সাহেব
৩৬. ৩৬. ওপরে আজকের তারিখ
৩৭. ৩৭. অন্ধকার উঠোন ভরতি জোনাকি
৩৮. ৩৮. রাতের নিস্তব্ধতায় নানা গ্রামীণ শব্দ
৩৯. ৩৯. শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে
৪০. ৪০. প্রীতম কখনও দুরে কোথাও যায়নি
৪১. ৪১. কলকাতায় এবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে
৪২. ৪২. কতকাল পরে রেলগাড়ি দেখছে প্রীতম
৪৩. ৪৩. পরদিন ভাইবোনে অফিসে বেরোল
৪৪. ৪৪. বেয়ারাকে কিছু বলতে হয়নি
৪৫. ৪৫. পুরনো গোয়ালঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকে
৪৬. ৪৬. মরা বা জ্যান্ত
৪৭. ৪৭. নিজের ঘরে দু’জনকে বসাল তৃষা
৪৮. ৪৮. এ বাড়িটা অভিশপ্ত কি না
৪৯. ৪৯. ঝোপড়ার দরজায় দীপনাথ
৫০. ৫০. কথা শুনে একটু গম্ভীর হতে গিয়ে
৫১. ৫১. প্রীতম জিজ্ঞেস করে
৫২. ৫২. দক্ষিণের খোলা বারান্দায়
৫৩. ৫৩. বিলু কোনওদিনই খুব সুন্দরী ছিল না
৫৪. ৫৪. টেলিফোন রেখে মণিদীপা
৫৫. ৫৫. সাড়ে তিন ভরি আছে
৫৬. ৫৬. তৃষা তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখছিল
৫৭. ৫৭. একদিন বিকেলে দুই বুড়োর দেখা
৫৮. ৫৮. কুঠে সামন্তর বাড়িটা
৫৯. ৫৯. ফেয়ারলি প্লেসে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে হাতাহাতি
৬০. ৬০. সাতসকালে কে যেন
৬১. ৬১. কোনও মহিলা যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চায়
৬২. ৬২. মণিদীপা অনেক পুরুষকে পার হয়ে
৬৩. ৬৩. নিজের টেবিলে এসে অপেক্ষা
৬৪. ৬৪. এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে আজ ভারী লজ্জা আর অস্বস্তি
৬৫. ৬৫. শরীরে আবদ্ধ এই জীবন
৬৬. ৬৬. গীতা পড়তে পড়তে
৬৭. ৬৭. চিত্রার বিয়ে কেমন হল
৬৮. ৬৮. তৃষা যখন তার জন্য চা করতে গেল
৬৯. ৬৯. দীপনাথ কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে
৭০. ৭০. অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বিকেলে
৭১. ৭১. বহুদিন বাদে ছবির কাছে
৭২. ৭২. প্রীতম নিজে থেকেই মাস দুই আগে
৭৩. ৭৩. এক-একটা সর্বনাশের সময় আসে
৭৪. ৭৪. প্রীতমের বাবা-মা আরও বুড়ো
৭৫. ৭৫. আকাশে অনেক ওপরে
৭৬. ৭৬. অন্ধকারে জল ভেঙে
৭৭. ৭৭. মালটিন্যাশনাল কোম্পানির যত দোষ
৭৮. ৭৮. সানফ্লাওয়ারের শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিশাল রিসেপশন
৭৯. ৭৯. শমিতা চিৎকার করেই অজ্ঞান
৮০. ৮০. ঘুম থেকে উঠে বিলুর হাতে
৮১. ৮১. পৃথিবীর রং অনেকটাই পালটে গেছে
৮২. ৮২. কী খাচ্ছে, রান্না কেমন হয়েছে
৮৩. ৮৩. সুখেনের সঙ্গে সন্ধেটা কাটল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন