৩০. বোসোহেবের মুখে খুব ছেলেমানুষি হাসি

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

আজ বোসোহেবের মুখে খুব ছেলেমানুষি হাসি দেখল দীপ। একটা ভোলা টাইপ করা চিঠি টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে বোস বলে, ম্যানেজমেন্ট আমার প্রোপোজাল মেনে নিয়েছে।

দীপ চিঠিটা ভদ্রতাবশে তুলল, তাকিয়ে দেখল, কিন্তু পড়ল না। তার দরকারও নেই। চিঠিটা আবার টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, তা হলে বাঙ্গালোরে?

ইটস ড্রপড ন্যাচারেলি।

ভাল।—খুব উদাস গলায় বলে দীপনাথ।

খুশি হলেন না?

দীপ একটু অবাক হয়ে বলে, আমার খুশি-অখুশির ব্যাপার তো নয় বোসোহেব।

কিন্তু আপনি বোধহয় চেয়েছিলেন আমি বাঙ্গালোরে না যাই।

দীপ মাথা নেড়ে বলে, ঠিক তা নয়। তবে আমি নিজে যেতে চাইনি।

বোস একটু যেন ম্লান হয়ে বলে, তাই হবে। আমিই হয়তো ভুল ভেবেছিলাম।

দীপ স্থির চোখে চেয়ে বলে, আর-একজনও বোধহয় চাননি। মিসেস বোস।

ওর কথা বাদ দিন। ওদিকটা নিয়ে আমি ভাবছি না। মিসেস বোসও আপনার মতোই। আমি যাই ক্ষতি নেই, তবে উনি যাবেন না।

দীপনাথ এসব কথায় খুশি হচ্ছে না। বোস সাহেব বলেছিল, কোম্পানি আপগ্রেডেড হলে তাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার করা হবে। সে বিষয়ে বোস এখনও কিছু বলেনি। দীপ চক্ষুলজ্জায় নিজেও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। সে শুধু বলল, আপনি বাঙ্গালোরে না গেলে মিসেস বোসের সঙ্গে আপনার ব্রিচটা আবার মিলে যাবে।

থ্যাংকস ফর ইয়োর ইনফরমেশন, মিসেস বোসের সঙ্গে আমার কোনও ব্রিচ নেই।

যাক, দাম্পত্য কলহ তা হলে মিটেছে। দীপ নিশ্চিন্ত হয়ে একটু শ্বাস ছাড়ে।

কলহও মেটেনি। যারা কখনও কোনওদিন জোড়া লেগেছিল তাদের মধ্যেই ব্রিচ হয়। আমরা কোনওদিনই’ ততটা ঘনিষ্ঠ নই।

দীপনাথ এর কী জবাব দেবে? তবু ভেবেটেবে বলে, মনের মিলটা তো স্বর্গ থেকে হয়ে আসে না। ওটাও আমার মনে হয় প্র্যাকটিসের ব্যাপার।

বোসোহেব মিসেস বোসের প্রসঙ্গ আজকাল একদম পছন্দ করে না। তবু এ কথায় খুব কৌতুকের মুখ করে বলে, সেটা কীরকম?

এক সময়ে ভালবাসা হত প্লাবনের মতো, ঝড়ের মতো চোখাচোখি হতে না হতেই প্রেম। কিন্তু সে যুগ তো আর নেই। এখন কেউ চোখ বুজে ভাবাসে না। তবে ভালবাসার চেষ্টা করতে করতে একদিন হয়তো বেসে ফেলে।

কথাটার মধ্যে একটা হয়তো থেকে যাচ্ছে দীপনাথবাবু!

তা থাকছে। আজকাল খবরের কাগজে এত বউ খুনের কথা পড়ি যে ভালবাসার মধ্যে একটা হয়তো আপনা থেকেই এসে যায়।

বউ খুনের ঘটনা পড়েন। কিন্তু বর খুনের কথাও যে আছে। সেটা খবরের কাগজে বেরোয় না। আর সত্যিকারের ফিজিক্যাল খুনও ঘটে না। কিন্তু এক ধরনের মানসিক স্লো-পয়জনিং ঘটে। তাতে পুরুষদের ভিতরটা আস্তে আস্তে মরে যায়।

বলে বোস একটু হাসে। খুবই ম্লান, মড়ার মুখের হাসির মতো হাসি। এয়ার কন্ডিশনারের মৃদু শব্দটা না থাকলে এখন ঘরখানা খুবই নিস্তব্ধ লাগত দীপনাথের। কারণ তার নিজের ভিতরটাও এ সময়ে বড় নিস্তব্ধ। মুখে কোনও কথা আসছে না।

অনেকক্ষণ বাদে বোস সাহেব বলল, আপনি তা জানেন? জানেন না। আপনি তো আবার বিয়ে করেননি, এসব অভিজ্ঞতাও নেই।

দীপনাথ মৃদু স্বরে বলে, আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে অবশ্য আমার নাক গলানো উচিত নয়।

বোস মাথা নেড়ে বলে, ইউ আর এ ফ্যামিলি-ফ্রেন্ড, দেয়ারফোর ইউ আর উইদিন আওয়ার ফ্যামিলি। নাক গলালে দোষ দেব না। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের প্রবলেমটার মধ্যে কোনও মিষ্ট্রিও নেই। একদম খোলাখুলি গরমিল। কোনও প্যাঁচওয়ার্কও নেই। বয়-বেয়ারা-বাবুর্চি থেকে শুরু করে বাইরের লোকও সবাই জানে।

আমি কিন্তু এতকাল টের পাইনি।

তা হলে আপনি আমাদের দিকে মনোযোগ দেননি কখনও।

তা হবে।

আমাদের সমস্যাটা খুবই আন-ইমোশনাল। হার্ড ফ্যাক্ট। এর কোনও সমাধানও হয় না।

তা হলে কী হবে?

ডিভোর্স হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। আমরা হয়তো চিরকাল এমনি থেকে যাব। কিছুই বলা যায় না।

ডিভোর্স করলে মিসেস বোস কী করবেন? ওঁর পক্ষে তো আবার বিয়ে করা সম্ভব নয়।

অসম্ভব কিছু নয়। তবে আমার বিশ্বাস ডিভোর্স করলে উনি পুরোপুরি ওঁর রোমান্টিক পলিটিকস নিয়ে মাতবেন।

তারপর?

তারপর কী হবে তা নিয়ে একদিন চলুন লটারি করব।

বোসোহেব কথাটা বলেই হেসে ফেলে। সঙ্গে দীপও। বোসোহেব মাথা নেড়ে বলে, বাইরে থেকে কিছুতেই ঠিক বোঝা যায় না মিস্টার চ্যাটার্জি। আপনি ওয়েলউইশার, কাজেই আপনি তো ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করবেনই। আই নো ইউ টু বি এ ভেরি নাইস ম্যান। দুনিয়াতে ভাল লোকের খুব অভাব। আপনি সেই দুর্লভদের একজন।

দীপ একটু লাল হয়। মনে মনে ভারী ছোট হয়ে যায় নিজের কাছে। ভিতরটা ছটফট করে তার। কিছুদিন আগেও সে নিষ্কলঙ্ক ভাল লোকই ছিল। মনে পাপ থাকলেও কাজে কখনও বেচাল কিছু করেনি সে। হঠাৎ সেদিন–

মানুষ কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার সময় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে ঠিকই, কিন্তু আমার এ কথাটা মোটেই বাড়াবাড়ি নয় দীপনাথবাবু।

বলে বোস একটু স্মিত চোখে দীনাথকে দেখে। তারপর বলে, আমি খুব ব্রড-মাইন্ডেড। মিসেস বোস যদি আমাকে অ্যাকসেপ্ট করতে পারেন তা হলে আমি সব মেনে নেব। কাজেই আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না। আপনি বরং মিসেস বোসকে একটু ট্রাই করুন। ওই খুঁটিটাকেই নড়ানো শক্ত। তবে আপনি পারলেও পারতে পারেন। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আপনাকে পছন্দ করি। মিসেস বোসও সেদিন বলছিলেন—

অসময়ে রসভঙ্গ হল। বোসের চেম্বারের দরজা খুলে বেয়ারা ঢুকে স্লিপ দিল। ভিজিটার।

মিসেস বোস তার সম্পর্কে কী বলেছে তা শোনা হল না দীপনাথের। উঠল।

চলে যেতে যেতেই দীপনাথ একটু থমকে সংকোচ ঝেড়ে চোখ বুজে জিজ্ঞেস করল, তা হলে আমিও এই অফিসেই থাকছি তো?

বোস বিস্মিত মুখ তুলে বলে, অফ কোর্স। কোথায় আর যাবেন?

না, জিজ্ঞেস করলাম আর কী।

এ ফানি কোশ্চেন। এই অফিস তো এখন আপগ্রেডেড। আমার ক্ষমতাও বেড়েছে। আপনি অন্য কোথাও চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার কেসটা উইথ টপ প্রায়োরিটি দেখছি।

দীপনাথ মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল। পাশ কাটিয়ে কোট-প্যান্ট পরা একজন ভিজিটার ঢুকে গেল চেম্বারে।

দীপনাথের আজকাল কাজ নেই। বোস ইচ্ছে করেই কাজ দিচ্ছে না। বসিয়ে বসিয়ে ভাউচারে প্রায় আটশো টাকা পাইয়ে দিয়েছে গত মাসে। হয়তো এটা তাকে খুশি রাখার চেষ্টা। তবে একজন বস-মার্কা লোকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে একটু বাধো বাধো লাগে দীপের।

সে গিয়ে আবার রঞ্জনের মুখোমুখি বসে। রঞ্জনেরও কাজ নেই। খুটখাট করে ঢিমাতালে কী যেন একটু টাইপ করছিল। দীপ বসতেই অভ্যাসবশে হাত মুঠো করে মুখের সামনে মাউথপিসের মতো ধরে বলল, কোম্পানি তা হলে জাতে উঠল?

উঠল বলেই তো মনে হচ্ছে।

আমাদের গ্রেড কী হবে শুনেছেন কিছু?

না। মোটে তো চিঠি এল। আরও ফর্মালিটি আছে।

কিছু একটা হলে বাঁচা যায়।

বিয়ে করবে নাকি?

না, না, ওসব নয়। বিয়ে একটা ফালতু জিনিস। উটকো ঝামেলা।

তবে?

তবে আবার কী? মাইনে বাড়লে সংসারের কিছু সুবিধে হবে।

সে তো বটেই।

রঞ্জন শুকনো মুখ করে বলল, চাকরি পাওয়ার পরই মা একটা ইনসিয়োর করিয়েছে দশ হাজার টাকার। সঙ্গে ব্যাংকে একটা রেকারিং ডিপোজিটও। মা তো জানে না, প্রিমিয়াম বা মান্থলি ডিপোজিট দেওয়া কত কষ্টের। ভাবছিলাম, দুটোই ছেড়ে দেব।

মাইনে তো বাড়বেই। ছেড়ো না। একটু ধৈর্য ধরো।

রঞ্জন মুঠোর আড়ালে হাসল, ওই একটা জিনিস আর শেখাতে হবে না দাদা। ধৈর্য জিনিসটা শিখেই মায়ের পেট থেকে পড়েছি। নইলে এতদিন বেঁচে আছি কী করে?

আচমকাই দীপ জিজ্ঞেস করে, তুমি কখনও পলিটিকস করোনি রঞ্জন?

আমি? না তো? তবে ছাত্র ছিলাম যখন, তখন একটু-আধটু করতাম। সেটা কিছু না। কেন বলুন তো?

এমনি আজকালকার ছেলেরা তো করে।

রঞ্জন আবার একটু হাসল। বলল, করে বটে, তবে কেরিয়ারের জন্য। আমার বয়সি ছেলেদের বেশিরভাগেরই কোনও সত্যিকারের পলিটিকস নেই। নকশালদের শুধু ছিল। আর তো সব–

কথাটা রঞ্জন শেষ করে না। বোধহয় দীপনাথের রাজনীতির বোধ সম্পর্কে কিছু জানে না বলেই সতর্ক হয়ে গেল।

দীপনাথ বলে, পলিটিকস করলে সিরিয়াসলিই করা ভাল। নইলে একদম ওটাকে এড়িয়ে চলতে হয়।

হঠাৎ পলিটিকসের কথা তুললেন যে!

আজকাল যারা পলিটিকস করে তাদের মধ্যে খুব মহৎ মানুষ কাউকে দেখতে পাই না কেন বলো তো? ভারতবর্ষে এতগুলো নেতা আছে অথচ তাদের কারও ওপব ভক্তি হয় না। এটা ভেবে খুব অবাক লাগছিল বলে তোমাকে জিজ্ঞেস করছিলাম।

ভক্তি হবে কী করে? আমি তো আপনাকে বললামই যে পলিটিকস আজকাল কেরিয়ার ছাড়া কিছুই নয়। আই এ এস বা ডব্লু বি সি এস-এর মতো, কিংবা তার চেয়েও খারাপ।

একটু অন্যমনস্কভাবে দীপনাথ বলে, কিন্তু ছদ্মবেশে কেউ নেই তো? হয়তো তেমন কোনও নেতা আছেন যিনি এখনও আমাদের কাছে তেমন পরিচিত নন, হঠাৎ দুম করে একদিন বেরিয়ে গোটা দেশের খোলনলচে পালটে দেবেন।

দাদা কি নেতাজির কথা বলছেন নাকি?

আরে না। ভাবছি, তেমন কেউ সত্যিই আছে কি না।

নেই। ওরকম কেউ থাকলে এদ্দিন চুপ করে বসে থাকত না।

হয়তো আছে। তুমি জানো না, আমিও জানি না।

থাকলে আছে। ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আপনার কী হয়েছে বলুন তো?

আপনার চাকরির কী হল? বস কথা দেয়নি? দিয়েছে। বলেছে হবে।

ওঁকে বিশ্বাস করবেন না। আমার দাদা হলেও বলে দিচ্ছি, ও মাল অত সহজ নয়। যা করতে চান কাগজে কলমে লিখিয়ে নেবেন।

সেইরকমই কিছু করতে হবে দেখছি।-আনমনে দীপনাথ বলে।

হ্যাঁ, ডেফিনিটলি করাবেন। আপনি একটু ভোলেভালে টাইপের আছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার বস এমন একখানা চিজ, যে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে রং পালটে ফেলবে।

দীপনাথ নিজের সম্পর্কে রঞ্জনের মন্তব্যটা শুনে সামান্য করুণার হাসি হাসে। ভোলেভালে কাকে বলে তা অবশ্য সে জানে না। তবে যদি হদা বোঝায়, তবে বলতে হবে, দীপনাথ হাঁদা নয়, আবার খুব চালাকও নয়। তার মগজের চেয়ে হৃদয় বেশি ক্রিয়াশীল, এটাই যা ঝামেলার। যথেষ্ট লোভ বা আকাঙক্ষা তার নেই। আর থাকলেও সে খুব বেশি স্বার্থপর হতে কখনও পারে না। নির্লজ্জ হতেও নয়।

রঞ্জন বলল, সেদিন হঠাৎ এক কাণ্ড হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি সন্ধেবেলা মণিদীপা বউদি একখানা ঝরঝরে গাড়ি চালিয়ে আমাদের বাসায় হাজির।

দীপনাথ মণিদীপা নামটির আকস্মিক উচ্চারণে হঠাৎ কেমন স্থবির হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, তাই নাকি?

আমরা তো সব হাঁ! জীবনে কখনও আসেনি, একমাত্র বিয়ের পর একদিন জবরদস্তি নিমন্ত্রণ খেতে আসা ছাড়া। আমাদের ঠিকানাও ওর জানার কথা নয়।

কী বলল?

সে অনেক কথা। বাবার জন্য ফল-মিষ্টি সব এনেছিল। তারপর আমাকে ডেকে খুব সেধে সেধে কথা বলল। কত মাইনে পাই, কতদিন চাকরি, পার্মানেন্ট কি না, অফিসে ইউনিয়ন আছে কি না। ফালতু বাত সব। শেষমেশ হঠাৎ আপনার কথা তুলল।

দীপনাথের গলার কাছে অস্বস্তি হতে থাকে। সে অস্পষ্ট স্বরে বলে, আমার আবার কী কথা?

প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আমি আপনাকে চিনি কি না। চিনি বলায় জানতে চাইল, আপনি কত মাইনে পান, চাকরি পার্মানেন্ট হয়েছে কি না। এতসব ফালতু কথা। তবে শেষে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি লোকটা কেমন।

বলো কী? তুমি কী বললে?

যা সত্যি তাই বললাম। বললাম, দীপনাথ চাটুজ্জের কোনওকালে উন্নতি হবে না। লোকটার অ্যামবিশন নেই। উনিও দেখলাম কথাটা মেনে নিলেন।

দীপনাথ হাসল। মানুষ নার্ভাস হলে যেমন হাসে। তারপর বলল, আমি যে অপদার্থ এটা দেখছি সবাই জেনে গেছে। তোমার বউদি আর কী বলল?

অনেক পলিটিক্যাল পয়েন্ট তুলল। মনে হল আমাকে ওর দলে ভেড়াতে চাইছে। যাহোক ভ্যাজর ভ্যাজর অনেকক্ষণ শুনতে হল। বস কাম দাদার বউ, চটাতে তো পারি না। মনে মনে হাসছিলাম। বড়লোকদের পক্ষে গরিবদের জন্য দুঃখ বোধ করা কত সোজা। আমি নিজে গরিব হয়েও কিন্তু গরিবদের পছন্দ করি না।

দীপনাথ খামোখা লজ্জা পেল। বলল, তোমার বউদি আমার সম্বন্ধে আর কিছু বলেনি তো!

না, আর কী বলবে? আপনার কথা বলতে বলতে বিপ্লব-টিপ্লবের কথায় চলে গেল।

দীপনাথ মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হয়। মণিদীপা তাকে মুখের ওপর চুকলিখোর বলেছিল সেদিন টেলিফোনে। রঞ্জনকেও বলে দিতে পারত যে, তার সব কথা দীপনাথ মণিদীপাকে বলেছে। যা হোক এইটুকু করুণা মণিদীপা তাকে করেছে।

দীপনাথ উঠে পড়ল। বলল, বাইরে থেকে ঘুরে আসি।

বাইরে আজ সাংঘাতিক রোদ। যা গরম পড়েছে!

কোনও কাজ নেই, ঘুরেই আসি। বস যদি খোঁজ করে তবে বোলো লাঞ্চের আগেই এসে যাব।

দীপনাথ বেরিয়ে এল এবং প্রচণ্ড রোদ আর গরম গলা টিপে ধরল তার।

কিন্তু শরীরের অস্বস্তি বা অসুবিধের কথা ভাবছিল না দীপনাথ। সে ভাবে তার পতনের কথা। এত সহজে তার পদস্খলন ঘটবে এটা সে কোনওদিন ভাবেনি। তার ভিতরে একটু ইস্পাত ছিল। অত প্রিয় সিগারেট সে ছেড়ে দিয়েছিল কেবল ইচ্ছাশক্তির জোরে। শরীরের জোর আসল নয়, আসল হল মনের জোর। সেদিন রাত্রে বীথির শোওয়ার ঘরে সেই জোরটা কোথায় গেল তা আজও আর খুঁজে পায়নি দীপনাথ।

ব্যাপারটার মধ্যে কোনও পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। সুখেনকেও খামোখা দোষ দিয়ে লাভ নেই। সুখেন তো আর বীথির দালাল নয়। সেই রাতের ঘটনার পর সুখেন আর ফিরে আসেনি বীথির বাসায়। একা বিকশা করে বোর্ডিং-এর ঘরে ফিরল দীপনাথ। সুখেন সে রাত্রে বোর্ডিং-এও ফিরল না। ফিরল পরদিন রাত্রে। প্রথম চোখে চোখে তাকাচ্ছিল না। দীপনাথও লজ্জায় ঘেন্নায় কেন্নো হয়ে যাচ্ছিল।

ভাগ্যি ভাল কলেজের পড়ুয়া ছেলেটা সেদিনই তার মেদিনীপুরের বাড়িতে গেছে। একা ঘরে সুখেনকে পেয়ে অনেক রাত্রে দীপনাথ বলল, ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?

সুখেন করুণ মুখ করে বলল, ব্যাখ্যার কিছু নেই। আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হত। তাই—

আমার জন্য কষ্ট হবে কেন? আমি কি দুঃখে আছি?

ঠিক তা বলা যায় না। তবে আপনি সেদিন বন্ধু হলেন তো! আমার আর কোনও বন্ধু নেই। আপনাকে বন্ধু পেয়ে সেদিন কী যে আনন্দ হচ্ছিল।

আমি তো তেমন কেওকেটা কেউ নই। বন্ধু হলেও অতি সাধারণ বন্ধু। রাস্তাঘাটেও এরকম আকছার বন্ধু মেলে।

যাঃ, কী যে বলেন! আপনি কত সুপুরুষ. স্মার্ট, কত সৎ মানুষ। এরকম লোক কই?

এই প্রশংসায় মোটেই খুশি হয়নি দীপনাথ। রূঢ় গলায় বলেছে, আমি যদি অত ভালই তা হলে আমাকে এরকম গাড্ডায় নিয়ে ফেললেন কেন?

বললাম যে আপনার জন্য কষ্ট হয়।

মানেটা একটু বুঝিয়ে বলুন।

সুখেন যে খুব ভাল বোঝাতে পারে তা নয়। একটু এলোমেলোভাবে বলল, দেখলেই বোঝা যায় এই বয়স পর্যন্ত আপনার মেয়েমানুষের অভিজ্ঞতা হয়নি।

তাতে কী?

ওটা না হলে মানুষের মনের আড় ভাঙে না।

শুধু সেই জন্য?

না, আমি ভাবছিলাম, আপনি তো আমার বন্ধু হলেন, বন্ধুর একটু সেবা দিই।

বীথি কি ভাড়াটে মেয়ে?

ঠিক তা নয়। কথাটা ঠিক বুঝবেন না। ও একটু ওইরকম, কিছু মানে-টানে না।

টাকাপয়সা নেয়?

কেন, আপনার কাছ থেকে নিয়েছে নাকি?–বলে জিভ কেটে সুখেন বলল, ছিঃ ছিঃ।

না, আমার কাছ থেকে নেয়নি।

নেওয়ার কথা নয়।

আপনি বোধহয় ওর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রেখেছিলেন।

সুখেন লাজুক হেসে বলে, তাই।

কিন্তু ওর সঙ্গেই আপনার বিয়ের কথা আছে না?

আছে।

এরকম মেয়েকে জেনেশুনে বিয়ে করবেন?

সেইজন্যই তো আপনার পরামর্শ চেয়েছিলাম।

আমি পরামর্শ দেওয়ার মালিক নই।

আলবত মালিক। আমি আপনাকে বুজম ফ্রেন্ড হিসেবে মানি। যা বলবেন তা-ই হবে।

এ ব্যাপারে আমার কিছু বলা সাজে না। আমি কিছু বুঝতেই পারছি না। প্রস নয়, চাকরি করে, দেখতে সুন্দর, বড়সড় ছেলে আছে, স্বামী জেল খাটছে, সব মিলিয়ে মহিলা খুবই অদ্ভুত। আমি হলে বিয়ে করার সাহস পেতাম না।

হ্যাঁ, একটু অন্যরকম।

খুবই অন্যরকম। ওর সঙ্গে আপনি জুটলেন কী করে?

জুটে যায়।–উদাস গলায় বলে সুখেন।

বীথি এত সহজে অচেনা লোককে শরীর দেয় কী করে? ওর ঘেন্না করে না? ভয় করে না?

আপনাকে ঘেন্না?–অবাক হয়ে সুখেন বলে, আপনার মতো এরকম ভদ্রলোক ও আর পেয়েছে নাকি? আজ সন্ধেবেলাই তো আপনার কত প্রশংসা করছিল।

রাগে তেতে উঠলেও প্রশংসার কথায় একটু থমকে গেল দীপনাথ। বলল, কীরকম?

আপনার সম্পর্কে আমি যা ভেবেছি ওরও ধারণা তাই। আজ অনেকক্ষণ আপনার কথা হল।

আমি তো কিছুই নই। একটা লম্পট চরিত্রহীন।

ছিঃ ছিঃ, ওকথা বলবেন না। পুরুষমানুষের কোনও কলঙ্ক নেই।

ওটা আপনার ধারণা, আমার নয়।

তা হলে বরং আমার কান মলে দিন।-বলে বাস্তবিকই মাথাটা এগিয়ে দিল সুখেন।

সুখেনের সঙ্গে পারা যায় না। কাজেই হাল ছেড়ে দিল দীপনাথ। বীথির সঙ্গে সেই সম্পর্কের কথা ভেবে আজও সে কোনও সুখ পায় না। বরং নিজের ভিতরটা কোনও মহামূল্যবান হারানোর দুঃখে হাহাকারে ভরে ওঠে।

আর কোনওদিন সে বীথির কাছে যাবে না।

রোদের রাস্তায় আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সে ঘটনাটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল। এই রহস্যময় নোংরা শহর তার ভাল লাগছে না। একদম ভাল লাগছে না।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতে
২. ০২. দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে
৩. ০৩. শিলিগুড়ির হোটেল সিনক্লেয়ার
৪. ০৪. এই শীতে অন্ধকার বারান্দায়
৫. ০৫. তৃষা বিছানা ছাড়ে শেষ রাতে
৬. ০৬. মালদা থেকে গভীর রাতে দার্জিলিং মেল
৭. ০৭. প্রীতমের ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলায়
৮. ০৮. বিয়ের পর যখন অরুণ এ বাড়িতে আসত
৯. ০৯. দীপের ঘুম ভাঙল
১০. ১০. রেসের মাঠে
১১. ১১. এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি
১২. ১২. কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে
১৩. ১৩. বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল
১৪. ১৪. চাবিটার কথা
১৫. ১৫. শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
১৬. ১৬. রবিবার দিনটা দীপনাথের নিরঙ্কুশ ছুটি
১৭. ১৭. সজল এসে প্রণাম করে
১৮. ১৮. তৃষা দীপনাথকে বসিয়ে রেখে
১৯. ১৯. তুমি বেলুন ফোলাবে
২০. ২০. হাসিমুখে, স্নিগ্ধ মনে
২১. ২১. কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে
২২. ২২. রতনপুরে পাঁচখানা নতুন সাইকেল রিকশা
২৩. ২৩. আমি যদি এই কোম্পানি ছেড়ে দিই
২৪. ২৪. পরদিন অফিসে এসেই দীপনাথ শুনল
২৫. ২৫. দীপ একটু থতমত খেয়েছিল
২৬. ২৬. গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে দীপনাথ
২৭. ২৭. বেজি জাতটা কিছুতেই পোষ মানে না
২৮. ২৮. আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছিল সজল
২৯. ২৯. শ্রীনাথ বাড়ির ফটক পেরিয়ে
৩০. ৩০. বোসোহেবের মুখে খুব ছেলেমানুষি হাসি
৩১. ৩১. হুইলচেয়ারে
৩২. ৩২. টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে নামবার মুখে
৩৩. ৩৩. ট্রেনের কথা একদম খেয়াল থাকে না
৩৪. ৩৪. দৈহিক দিক থেকে পঙ্গু
৩৫. ৩৫. চেম্বারে ঢুকতেই বোস সাহেব
৩৬. ৩৬. ওপরে আজকের তারিখ
৩৭. ৩৭. অন্ধকার উঠোন ভরতি জোনাকি
৩৮. ৩৮. রাতের নিস্তব্ধতায় নানা গ্রামীণ শব্দ
৩৯. ৩৯. শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে
৪০. ৪০. প্রীতম কখনও দুরে কোথাও যায়নি
৪১. ৪১. কলকাতায় এবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে
৪২. ৪২. কতকাল পরে রেলগাড়ি দেখছে প্রীতম
৪৩. ৪৩. পরদিন ভাইবোনে অফিসে বেরোল
৪৪. ৪৪. বেয়ারাকে কিছু বলতে হয়নি
৪৫. ৪৫. পুরনো গোয়ালঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকে
৪৬. ৪৬. মরা বা জ্যান্ত
৪৭. ৪৭. নিজের ঘরে দু’জনকে বসাল তৃষা
৪৮. ৪৮. এ বাড়িটা অভিশপ্ত কি না
৪৯. ৪৯. ঝোপড়ার দরজায় দীপনাথ
৫০. ৫০. কথা শুনে একটু গম্ভীর হতে গিয়ে
৫১. ৫১. প্রীতম জিজ্ঞেস করে
৫২. ৫২. দক্ষিণের খোলা বারান্দায়
৫৩. ৫৩. বিলু কোনওদিনই খুব সুন্দরী ছিল না
৫৪. ৫৪. টেলিফোন রেখে মণিদীপা
৫৫. ৫৫. সাড়ে তিন ভরি আছে
৫৬. ৫৬. তৃষা তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখছিল
৫৭. ৫৭. একদিন বিকেলে দুই বুড়োর দেখা
৫৮. ৫৮. কুঠে সামন্তর বাড়িটা
৫৯. ৫৯. ফেয়ারলি প্লেসে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে হাতাহাতি
৬০. ৬০. সাতসকালে কে যেন
৬১. ৬১. কোনও মহিলা যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চায়
৬২. ৬২. মণিদীপা অনেক পুরুষকে পার হয়ে
৬৩. ৬৩. নিজের টেবিলে এসে অপেক্ষা
৬৪. ৬৪. এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে আজ ভারী লজ্জা আর অস্বস্তি
৬৫. ৬৫. শরীরে আবদ্ধ এই জীবন
৬৬. ৬৬. গীতা পড়তে পড়তে
৬৭. ৬৭. চিত্রার বিয়ে কেমন হল
৬৮. ৬৮. তৃষা যখন তার জন্য চা করতে গেল
৬৯. ৬৯. দীপনাথ কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে
৭০. ৭০. অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বিকেলে
৭১. ৭১. বহুদিন বাদে ছবির কাছে
৭২. ৭২. প্রীতম নিজে থেকেই মাস দুই আগে
৭৩. ৭৩. এক-একটা সর্বনাশের সময় আসে
৭৪. ৭৪. প্রীতমের বাবা-মা আরও বুড়ো
৭৫. ৭৫. আকাশে অনেক ওপরে
৭৬. ৭৬. অন্ধকারে জল ভেঙে
৭৭. ৭৭. মালটিন্যাশনাল কোম্পানির যত দোষ
৭৮. ৭৮. সানফ্লাওয়ারের শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিশাল রিসেপশন
৭৯. ৭৯. শমিতা চিৎকার করেই অজ্ঞান
৮০. ৮০. ঘুম থেকে উঠে বিলুর হাতে
৮১. ৮১. পৃথিবীর রং অনেকটাই পালটে গেছে
৮২. ৮২. কী খাচ্ছে, রান্না কেমন হয়েছে
৮৩. ৮৩. সুখেনের সঙ্গে সন্ধেটা কাটল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন