৩২. টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে নামবার মুখে

শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়

টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে নামবার মুখে দুটো জিনিস টের পেল দীপনাথ। এক হল, বাইরে হঠাৎ তেড়েফুড়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে, সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। দু’ নম্বর হল, তার প্যান্টের হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা খোয়া গেছে। দুটোই দুঃসংবাদ। দুটোর ওপরেই দীপনাথের কোনও হাত নেই। এই প্রচণ্ড ভিড়ের বাসে মানিব্যাগটা উদ্ধারের চেষ্টা পণ্ডশ্রম। বাইরের এই ঝড়বৃষ্টিতেই তাকে নামতেও হবে।

একেবারে কর্পদকহীন দীপনাথ বেকুবের মতো ভিড়ের বাস থেকে বৃষ্টির মধ্যে খসে পড়ল। দৌড় দৌড়। মোড়ের সিনেমা হলের লবি পর্যন্ত পৌঁছাতেই জামাপ্যান্ট ভিজে চুপসে গেল। ছাদের নীচে নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে সে রুমাল দিয়ে মাথা, ঘাড় মুখ মুছছিল যতখানি সম্ভব। মানিব্যাগটার জন্য রাগে গা চিড়বিড় করছে। খুব বেশি ছিল না, মেরেকেটে গোটা ত্রিশেক টাকা হবে। কিন্তু এখন মেসে ফেরার পয়সাটাও তার নেই। বোসের কাছ থেকে ধার করতে হবে।

কলকাতা শহরকে সে কতখানি ঘেন্না করে তা এই হঠকারী বৃষ্টির সন্ধ্যায় ভেজা গায়ে দাঁড়িয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিল। নিজের ওপর রাগে ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠছিল। হিপ পকেটে মানিব্যাগ রাখাটাই এক নম্বরের বোকামি। তার ওপর সে ভিড়ের বাসেও গাড়লের মতো অন্যমনস্ক ছিল। সেটা দু’নম্বর বোকামি।

বৃষ্টির তোড় কমে আসছিল, দীপনাথের রাগও ঠান্ডা হচ্ছিল ক্রমে। মনটা তেতো, বিরক্ত। কলকাতায় তার কম দিল হল না, তবু এখনও সে এ শহরে বাস করার যোগ্যতা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি।

ঘণ্টাখানেক বাদে যখন বৃষ্টি থামল তখন বাসে এত ভিড় যে কাছে যাওয়াই মুশকিল। তার ওপর খালের ওপর ব্রিজের মুখে এক নিশ্চল জ্যাম জমে গেছে। বাসে উঠবার পয়সা দীপনাথের নেই, উঠলেও সহজে পৌঁছানো যাবে না। সুতরাং দীপনাথ হাঁটা ধরল।

বোস সাহেবের বাড়ি পৌঁছবার পর তার দুঃখের ভরা পূর্ণ হল। রাঁধুনি নোকটা দরজা খুলে জানাল, মিস্টার বা মিসেস কেউই বাড়ি নেই। কখন ফিরবে বলা যাচ্ছে না।

এই অঞ্চলে দীপনাথের চেনাজানা কেউ নেই। একমাত্র উপায় হল বোস সাহেব বা মণিদীপার জন্য অপেক্ষা করা কিংবা রাঁধুনির কাছেই কিছু ধার চাওয়া। লোকটা দীপনাথকে চেনে।

দীপনাথ বলল, তা হলে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। জরুরি কাজ আছে।

রাঁধুনি বলল, বসুন, চা করে দিচ্ছি।

ভেজা জামাকাপড়ে দামি সোফাসেটে বসতে একটু দ্বিধা বোধ করে দীপনাথ। ভেবেচিন্তে সে একটা রেক্সিনে মোড়া চেয়ারে বসল। তারপর ম্যাগাজিন তুলে ছবি দেখতে লাগল।

নিজের মুখের ভাব কোনওদিনই গোপন করতে পারে না দীপনাথ। তার মন খারাপ থাকলে মুখের ভাবে অবশ্যই বিমর্ষতা ফুটে উঠবে। আরও ঘণ্টাখানেক বাদে যখন মণিদীপা ফিরল তখন দরজায় দাঁড়িয়েই তাকে দেখে উদ্বেগের গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

দীপনাথ খুব বেপরোয়া মতো একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, কোথায় কী হয়েছে! কিছু হয়নি তো।

মণিদীপা গম্ভীর হয়ে বলে, না হলেই ভাল।

দীপনাথ একঝলক চেয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। বহুকাল বাদে মণিদীপার সঙ্গে দেখা। এত সুন্দর দেখাচ্ছে। বোস সাহেব একে ডিভোর্স করবে কোন প্রাণে!

মণিদীপা ভিতরে গেল না। দীপনাথের মুখোমুখি বাইরের ঘরেই বসল। আজ তার সাজগোজ তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। হলুদ লাল কালো ড়ুরের একটা তাঁতের শাড়ি পরনে। চুল এলোখোঁপায় বাঁধা। বসে আর-একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে লাগল।

দু’জনের মধ্যে একটা অস্বস্তি আর সংকোচের বলয়। কেউ সেটা ভাঙতে চায় না। দীপনাথ সমস্ত অপমান মনে রেখেছে, কিছুই ভোলেনি। এই মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখলে বা টেলিফোনে এর গলার স্বর শুনলেও তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়। প্রতিশোধের কথা মনে থাকে না।

রান্নার লোকটা দীপনাথকে সযত্নে ট্রে-তে করে চা আর ঘরে তৈরি কেক দিয়ে মণিদীপার দিকে সসম্রমে চেয়ে বলল, টি মেমসাব?

মণিদীপা চোখ না তুলেই মাথা নাড়ল। খাবে না।

দীপনাথ সসংকোচে চায়ের কাপটার দিকে চেয়ে ছিল। কিছু বলার নেই, একটা জড়তা বোধ করছে।

মণিদীপা মাগাজিনটা মুখে ধরে রেখেই বলল, বোস সাহেবের সঙ্গে কোনও দরকার ছিল বুঝি?

ছিল একটু।

দরকারগুলো অফিসে মিটিয়ে নিলেই তো হয়। অফিস-আওয়ার্সের পরও কেন একজন লোককে এত দূর দৌড়ে আসতে হবে বুঝি না।

দীপনাথ বুঝতে পারল না, এটা মণিদীপার বিরক্তি না অনুকম্পা। হয়তো কোনওটাই নয়। সে বলল, অফিসের বাইরেও কাজ থাকে।

মণিদীপা ভ্রু কুঁচকে বলে, আপনি চা খান, জুড়িয়ে যাচ্ছে।

খাচ্ছি।-বলে দীপনাথ কাঁপে চুমুক দেয়।

কোম্পানি জাতে ওঠার পর বোধহয় আপনার কাজ আরও বেড়েছে।

বোস সাহেবের হয়তো বেড়েছে।—দীপনাথ বলল।

আপনার বাড়েনি?

না। আমি তো জাতে উঠিনি।—এই প্রথম বুদ্ধিমানের মতো একটা মন্তব্য করতে পেরে খুশি হল দীপনাথ।

কোনওদিন উঠবেনও না।

উঠব। যেদিন সর্বহারাদের একনায়কত্ব হবে।

ম্যাগাজিনটা টেবিলের ওপর ফটাস করে আছড়ে ফেলে সোজা হয়ে মণিদীপা ফুঁসে ওঠে, ওসব কি ইয়ারকির কথা?

দীপনাথ চমকে উঠলেও ঘাবড়ে যায়নি। এ মেয়েটাকে খোঁচা দেওয়া যে বিপজ্জনক তা সে জানে। কিন্তু খোঁচা যখন দিয়েই ফেলেছে তখন পিছু হটাও বোকামি। তাই সে মৃদু স্বরে বলল, সর্বহারার সবরকম কোয়ালিফিকেশন আমার আছে। অন্তত আজ এই মুহূর্তে আমি সর্বহারা।

মণিদীপা দুই বিশাল চোখে তাকে ভস্ম করে দিতে দিতে বলে, তার মানে?

একটু আগে বাসে আমার পকেটমার হয়েছে। মেসে ফেরার বাসভাড়া পর্যন্ত নেই।

দীপনাথ ভেবেছিল মণিদীপা হাসবে। কিন্তু হাসল না। চোখের দৃষ্টিতে ভসনা মিশিয়ে একটু তাকিয়ে থেকে বলল, কত গেছে?

বড়লোকের চোখে বেশি নয়। তবে গরিবের অনেক। প্রায় ত্রিশ টাকা।

কবে যে আপনাকেও চুরি করে নেয়! টাকাটা কোথায় ছিল?

হিপ পকেটে।

পুলিশে জানিয়েছেন?

দীপনাথ একটু অবাক হয়ে বলে, পকেটমার হলে কেউ পুলিশে যায় নাকি? এ রকম তো শুনিনি। গিয়েও লাভ হয় না।

তবু পুলিশকে জানানোটা নিয়ম।

খামোখা সময় নষ্ট। আমি ব্যাপারটা মেনে নিয়েছি। হয়তো এক গরিবের পকেট কেটে আর এক গরিবের কিছু উগকার হচ্ছে।

পকেটমাররা গরিব হবে কেন? ওদের বিরাট অর্গানাইজেশন থাকে। আপনি খুব সহজেই সব কিছু মেনে নেন। ওটা একদম ভাল নয়। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ যত সামান্যই হোক তার একটা মূল্য আছে, এটা মানেন তো?

আমাদের দেশে নেই।

কে বলল নেই?

আমিই বলছি!

আপনি কখনও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করেছেন জীবনে? না করলে বুঝবেন কী করে? প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের ক্ষমতা থাকলে এই ঝড়-বাদলের সন্ধেবেলা এত দূরে বসের বাড়ি বয়ে আসতেন না।

দীপনাথ একটু অধৈর্যের গলায় বলে, বোস সাহেবের কাছে তো আমি আসিনি! গরজটা আমারই।

কিসের গরজ?

আপনি সত্যিই বিয়েটা ভেঙে দিচ্ছেন?

মণিদীপা এ কথায় বোধহয় একটু হকচকিয়ে যায়। তারপর ভীষণ তেতো আর বিরক্ত গলায় বলে, এটা কি অন্যের ভীষণ পার্সোনাল ব্যাপারে হাত দেওয়া নয়?

দীপনাথ এ কথাটার জবাব তৈরি রেখেছিল। সে বলল, বিয়ে করা বা বিয়ে ভাঙা কোনওটাই খুব পার্সোনাল বিষয় হতে পারে না, মিসেস বোস। যদি হত তা হলে বিয়েতে সোশ্যাল গ্যাদারিং, পুরুত, ম্যারেজ রেজিস্ট্রার বা সাক্ষীর দরকার হত না।

আমি ওসব জানি না। প্রসঙ্গটা আমার কাছে ভাল লাগে না।

আমারও লাগে না। তবে আমি আপনাদের ভাল চাই বলেই জিজ্ঞেস করছি, বিয়েটা বাচানো কোনওভাবে সম্ভব কি না?

বোধহয় না।

কেন, মিসেস বোস?

বিয়েটা আমরা কেউই ভাঙছি না বোধহয়। আপনিই ভেঙে যাচ্ছে।

দীপনাথ আচমকা জিজ্ঞেস করল, সেদিন আপনি টেলিফোনে আমাকে বলেছিলেন, স্নিগ্ধদেবের কথা মিস্টার বোস জানেন না। কিন্তু কথাটা সত্যি নয়, মিসেস বোস। স্নিগ্ধদেব তাপনাদের এ বাড়িতে একসময়ে আসতেন। বোস সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল।

মণিদীপা হঠাৎ একটু অস্বস্তি বোধ করে। বিরক্তির ভাব দেখিয়ে ঠোঁট উলটে বলে, হতে পারে। আমার অত মনে নেই। তবে এর মধ্যে আবার স্নিগ্ধকে কেন?

দীপনাথ সামান্য ম্লান একটু হেসে বলল, আজকাল বারবারই কেন যেন স্নিগ্ধদেবের কথা আমার মনে হয়। ভাবি, মিঙ্গই হয়তো আমাদের আগামী দিনের নেতা, মুক্তিদাতা, দেশের হৃদয়।

মণিদীপা এ কথায় রাগ করবে না হাসবে তা ঠিক করতে সময় নিল। তারপর হেসেই ফেলল। বলল, হতেও পারে! ঠাট্টার ব্যাপার নয়।

আমি ঠাট্টা করিনি। যিনি আড়াল থেকে এত চোখা চালাক হাজির-জবাব একটি মহিলাকে চালাতে পারেন, তার ক্ষমতা অনেক।

দাঁতে দাঁত পিষে মণিদীপা বলে, আপনাকে এ খবর কে দিয়েছে যে, স্নিগ্ধ আমাকে চালায়?

আমাকে স্নিগ্ধদেবের ঠিকানাটা দেবেন?

কেন?–বড় চোখে চেয়ে সন্দিগ্ধ গলায় মণিদীপা জানতে চায়।

আমি তার সঙ্গে দেখা করব।

কেন দেখা করবেন?

আমি জানতে চাই কেন আপনাদের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।

স্নিগ্ধ তা কী করে বলবে? আপনার কি সন্দেহ যে, আমি স্নিগ্ধর সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করি?

না। প্রেম করার হলে আপনি প্রকাশ্যেই করতেন।

এটা কি কমপ্লিমেন্ট?

ধরে নিতে পারেন।

বেশ ধরলাম। তা হলে আপনি বা আপনার স্পাইনলেস বস ভাবেন না যে, আমি স্নিগ্ধর সঙ্গে প্রেম করি?

না, ভাবি না।

তা হলে ডিভোর্সের ব্যাপারেই বা স্নিগ্ধর কী করার থাকতে পারে?

উনি আপনার প্রেমিক না হলেও আপনার নেতা।

তা হতেই পারে।

তিনি প্রভাব বিস্তার করলে আপনি হয়তো বোস সাহেবকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা পালটাবেন।

নেতারা আজকাল এসবও করেন নাকি?

আমরা তাঁকে অনুরোধ জানাব।

আমরা মানে? আপনার সঙ্গে আরও কেউ আছে নাকি?

দীপনাথ একটু বাধা পেল। ভাবল। ভেবে বলল, না, আমি একাই যাব।

তাই বলুন। আমরা শুনে আমি চমকে গিয়েছিলাম।

আপনি কী ভেবেছিলেন?

ভাবছিলাম, আপনার সঙ্গে বোধহয় বোস সাহেবও আছেন।

না, বোস সাহেবের আত্মসম্মান বোধ একটু বেশি।

মণিদীপা তীব্র শ্লেষের হাসি হেসে বলে, বোস সাহেবের ঘটে আপনার চেয়ে বুদ্ধিও কিছু বেশি আছে। উনি বোকা নন বলেই স্নিগ্ধর কাছে যাওয়ার কথা ভাবেন না।

আমি কি স্নিগ্ধদেবের কাছে গেলে খুবই বোকামি করব?

খুবই বোকামি করবেন।

আমি কি খুবই বোকা?

এখন পর্যন্ত তেমন বুদ্ধির কোনও পরিচয় দেননি।

দীপনাথ প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করছিল। তার বুদ্ধিবৃত্তি এখন ঠিকমতো কাজ করছে না। মাথাটা এলোমেলো, বিভ্রান্ত। একটু ঘাবড়েও যেন যাচ্ছে সে। ভেবেচিন্তে বলল, হয়তো আমি বোকাই। তবু আমি আপনাদের ভাল চাই।

কী ভেবে বুঝলেন যে, বোস সাহেবের সঙ্গে বিয়েটা না ভাঙলেই ভাল হবে?

দীপনাথ গুছিয়ে বলতে পারবে না জানে। তবু কিছু কথা তার বুকে ঠেলাঠেলি করছে। সে মৃদু স্বরে বলল, বিয়ে ভাঙলে বিশ্বাসের ভিত নড়ে যায়।

তার মানে?

ডিভোর্সের চলন বেশি হলে ভবিষ্যতে স্বামী বা স্ত্রী কেউ কারও ওপর নির্ভর করতে পারবে না। অবিশ্বাস এসে পড়বে। কেউ সখী হবে না।

ডিভোর্স না করেও তো অমেকেই সুখী নয়।–মণিদীপার মুখে মৃদু শ্লেষের হাসি।

তা বটে। কিন্তু আপনি যদি বোস সাহেবকে সইতে না পারেন তবে ভবিষ্যতে যে অন্য কাউকে সইতে পারবেন তার তো গ্যারান্টি নেই। হয়তো সামান্য সওয়া বওয়ার অভাবে একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যাবে। মানুষের ঘবদোর খাঁ খাঁ করবে। অফিস থেকে ফেরার সময় একজন মানুষ ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে না, ঘরে তার বউ আছে কি নেই।

হাউ ট্র্যাজিক!–বলে মণিদীপা একটু শব্দ করে হেসে ফেলে।

দীপনাথ গোঁয়ারের মতো তবু বলল, কাজটা ভাল হচ্ছে না মিসেস বোস।

মণিদীপার ঝলমলে মুখের ভ্রু-টা হঠাৎ কুঁচকে যাওয়ায় ভীষণ থমথমে হয়ে গেল। তেমনি গম্ভীর গলায় বলল, বোস পদবিটা কি আমার গায়ে লেগে আছে? আপনি আজ পর্যন্ত আমার নাম ধরে ডাকার সাহস পাননি। ভারী আশ্চর্য!

দীপনাথ অধৈর্যের গলায় বলে, ওসব ইররেলেভেট ব্যাপার। আপনার নাম ধরে ডাকতে আমার এখনও একটু সংকোচ আছে। আমি চট করে ফ্রি হতে পারি না।

তাই দেখছি।–মণিদীপার ভ্রু আবার সটান হল এবং মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বেশ আবার ঝলমলে দেখাল তাকে। মৃদু স্বরে বলল, আপনি সত্যিই খুব ভাল লোক। কিন্তু আমার বিশেষ কিছু অলটারনেটিভ নেই। আপনি যখন অনেকখানিই জেনে ফেলেছেন তখন আপনাকে আর-একটু জানাতে বাধা নেই। শুনুন, ডিভোর্সের পর আমি আর কাউকে বিয়ে করতে যাব না, স্নিগ্ধর সঙ্গে অবৈধ প্রেম করব না। এমনকী আপনার সঙ্গেও নয়।

যাঃ, কী যে বলেন!

মণিদীপা মন্তব্যটা যেন শুনতে পায়নি এমন উদাসীনভাবে বলল, আপনাকে আগেও বলেছি, আমার ধ্যানধারণার সঙ্গে মিস্টার বোসের কোনও মিল নেই। আমরা জাস্ট চুক্তিবদ্ধ স্বামী-স্ত্রী। আমাদের সম্পর্কটা এখন একদম স্টেলমেট হয়ে গেছে।

আপনি কি খুব অহংকারী?

মণিদীপা একটু চেয়ে থেকে গম্ভীর মুখেই মাথাটা ওপরে নীচে নেড়ে বলল, ভীষণ। আমি সহজে কারও কাছে মাথা নিচু করতে পারি না।

হতাশার গলায় দীপনাথ বলে, মিস্টার বোসও তাই। সমস্যা হল দু’জন অহংকারীকে কী করে বশে আনা যায়। একজন একটু মাথা না নোয়ালে তো হয় না।

মণিদীপা গাঢ় এক দৃষ্টিতে দীপনাথকে দেখছিল। এ মেয়েটা বেশ অকপটে চোখে চোখে তাকাতে পারে। সম্ভবত ওর মনে পাপ নেই। মণিদীপা না হেসেই বলল, আপনি তো বিয়ে করেননি, স্বামী-স্ত্রীর এই প্রবলেমটার কথা জানলেন কী করে?

জানি।

মণিদীপা অন্য মনে দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারের দিকে চেয়ে বলল, বোধহয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রবলেম হল অহংকারের লড়াই।

আপনি কি তা মানেন?

মণিদীপা অবাক হয়ে বলল, মানি বলেই তো বলছি।

তা হলে তো প্রবলেমটা থাকে না। সভ হয়ে গেল।

হল না। একটা মানুষ কি সহজে নিজেকে বদলাতে পারে?

কিন্তু বদলালে যদি ভাল হয়?

ভাল হয় কি না তা দেখার জন্য তা হলে মানুষকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো বারে বারে বদলাতে হবে। মানুষ তো পুতুল নয়।

তা হলে কী হবে?

কিছু হবে না। এসব প্রবলেম অত সহজে মেটে না। তার চেয়ে ডিভোর্স ভাল।

দীপনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মণিদীপা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়ান, আপনার বাসভাড়াটা এনে দিই।

দীপনাথ ম্লান মুখে বলল, চলে যেতে বলছেন তো?

মণিদীপা যেমন টপ করে দাঁড়িয়েছিল তেমনই টপ করে বসে পড়ল। অত্যন্ত ব্যথিত চোখে চেয়ে বলল, মানেটা বুঝি তাই দাঁড়াল?

তা জানি না। তবে হঠাৎ বাসভাড়া দেওয়ার কথা শুনে মনে হল আপনি আমার মধ্যস্থতার ব্যাপারটা তেমন পছন্দ করছেন না।

সে তো ঠিকই। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে অন্য কারও মতামত আমি পছন্দ করি না। কিন্তু তা বলে আপনাকে আমার অপছন্দ নয়।

দীপনাথের ফর্সা মুখ লাল হয় একটু।

মণিদীপা তাকে শিউরে দিয়ে বলল, বহুকাল আপনি আসেননি। হয়তো আমার ওপর রাগ করেছিলেন। কিন্তু আপনাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করেছিল ক’দিন। খুব ইচ্ছে করেছিল। বিশ্বাস করুন। আপনার ভালমানুমির একটা দারুণ অ্যাট্রাকশন আছে।

দীপনাথের একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তবু সে নিজের আবেগের ওপর উঠতে পারল প্রাণপণ চেষ্টায়। বলল, মিস্টার বোসের কি কোনও অ্যাট্রাকশনই নেই?

হঠাৎ বোস সাহেবের কথা উঠল কেন?–বলে মণিদীপা হেসে ওঠে। তারপর বলে, আপনার বোধহয় এখনও ধারণা, আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।

না, না, তাই বললাম নাকি?–দীপনাথ আঁকুপাঁকু করে ওঠে।

মণিদীপা স্নিগ্ধ স্বরে বলে, বোস সাহেবের কিছু অ্যাট্রাকশন নিশ্চয়ই আছে দীপনাথবাবু। তবে সেগুলোর কোনও অ্যাপিল আমার কাছে নেই।

একটা মানুষের তো সবরকম সদ্গুণ থাকতে পারে না। তার যেটুকু আছে সেটুকুকে মূল্য দিলেও হয়।

আপনি আজকাল পুরোপুরি বোস সাহেবের দালাল হয়ে গেছেন। কিন্তু বোস সাহেব আপনাকে এ কাজের ভার দিয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, ওর কাছে আমারও কোনও অ্যাট্রাকশন নেই।

দীপনাথ মাথা নেড়ে বলে, না, আমি বোস সাহেবের দূত হয়ে আসিনি। তবে আপনাদের দু’জনকে আমার বেশ লাগত। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে খারাপ লাগবে।

আপনার ভাল লাগার মতো কিছু যে করতে পারছি না তার জন্য দুঃখিত।

দীপনাথ মাথা নিচু করে বলল, আমার ভাল লাগার প্রশ্নটা তো বড় নয়। আমার নিজের এক পিসির কথা খুব মনে পড়ছে। আমি সেই পিসির কাছে শিলিগুড়িতে মানুষ। পিসির দাঁত উঁচু ছিল, সাজগোজ করতে জানতই না, লেখাপড়ারও তেমন বালাই ছিল না। যাকে বলে ভয়েড অফ অল উওম্যানলি অ্যাট্রাকশন, কিন্তু পিসেমশাই তো তার সঙ্গেই একটা জীবন কাটালেন।

মণিদীপা গম্ভীর হয়ে বলে, ওসব বলে লাভ নেই। আমার মা-বাবাও একসঙ্গে এতকাল কাটিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রিলেশনও খুব ভাল। সেই আমলের বিয়েটা ছিল পারিবারিক। এখন ম্যান-উওম্যান রিলেশন। পৃথিবী তো থেমে নেই, দীপনাথবাবু।

থেমে নেই, কিন্তু তার গতিটা খুব মহৎ লক্ষ্যে হয়তো যাচ্ছে না।

সেটা আপনার ধারণা। আমি মনে করি কিছু কিছু জিনিসকে ভেঙে ফেলে ভিতরকার সত্যটিকে খুঁজে দেখা উচিত। রিভ্যালুয়েশনটাই বেঁচে থাকার বড় লক্ষণ।

দীপনাথ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলল, আমাকে বাসভাড়াটা দিন। অনেক রাত হল।

মণিদীপা ঠোঁট দাঁতে চেপে একটু চেয়ে থেকে বলে, নাউ হুঁ ইজ বিয়িং রুড? কথার মাঝখানে বাসভাড়া চাওয়ার মানে কি আমাকে অপমান করা নয়?

দীপনাথ উঠে দাঁড়ায় এবং তেতো গলায় বলে, আপনাকে অপমান করার ইচ্ছে ছিল না। আমি তো অপমান করতে আসি না, অপমানিত হতেই আসি।

এটা থিয়েটারি সংলাপ হয়ে গেল। তবু মণিদীপা ঠাট্টা করল না। গম্ভীর মুখে নিজের করতলের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আচমকা উঠে গিয়ে মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরে এসে নিঃশব্দে তিনটে দশ টাকার নোট সেন্টার টেবিলের ওপর ছাইদানিতে চাপা দিয়ে রাখল।

দীপনাথ তাকিয়ে বলল, অত টাকা দিয়ে কী হবে?

মণিদীপা জবাব দিল না।

দীপনাথ টাকাটা ছুঁল না, গোঁয়ারগোবিন্দর মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আমার পকেটমারের পুরো টাকাটাই তো আপনার দেওয়ার কথা নয়। পঞ্চাশটা পয়সা পেলেই আমার হয়ে যাবে। আর সেটাও ধার হিসেবে। কালই ফেরত দেব।

মণিদীপা যেন চটকা ভেঙে বলল, ওঃ, তাই তো মনে ছিল না যে অহংকারী আমি একাই নই।

আমি অহংকারী নই। অহংকার করার কিছুই যে আমার নেই তা তো আপনি ভালই জানেন।

আপনার সবকিছু আমি জানি এ ধারণা কী করে হল? আমি কারও কিছু জানতে চাইও না।–বলে মণিদীপা আবার গিয়ে একটা আধুলি এনে টঙাস করে টেবিলে ফেলে দিল।

আধুলিটা অচল কি না দেখে নিয়ে দীপনাথ পকেটে ফেলে।

চলি তা হলে।

মণিদীপা জবাব দিল না। মেঝের দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বাইরের ঘরে।

দীপনাথ আবার বলে, আসছি। বোস সাহেব এলে বলবেন, আমি এসেছিলাম।

মণিদীপা হঠাৎ ফুঁসে উঠে বলল, পারব না।

বলেই ঝাপটা দিয়ে ভিতরে চলে গেল।

সকল অধ্যায়

১. ০১. পুতুলরাণী হাপিস হয়ে যাওয়াতে
২. ০২. দাওয়াতে দাঁড়িয়েই ঘটিভরা জলে
৩. ০৩. শিলিগুড়ির হোটেল সিনক্লেয়ার
৪. ০৪. এই শীতে অন্ধকার বারান্দায়
৫. ০৫. তৃষা বিছানা ছাড়ে শেষ রাতে
৬. ০৬. মালদা থেকে গভীর রাতে দার্জিলিং মেল
৭. ০৭. প্রীতমের ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলায়
৮. ০৮. বিয়ের পর যখন অরুণ এ বাড়িতে আসত
৯. ০৯. দীপের ঘুম ভাঙল
১০. ১০. রেসের মাঠে
১১. ১১. এখানে দু’কাঠা চার ছটাক জমি
১২. ১২. কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে
১৩. ১৩. বদ্রীর ইনফ্লুয়েনজা হয়েছিল
১৪. ১৪. চাবিটার কথা
১৫. ১৫. শ্রীনাথ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
১৬. ১৬. রবিবার দিনটা দীপনাথের নিরঙ্কুশ ছুটি
১৭. ১৭. সজল এসে প্রণাম করে
১৮. ১৮. তৃষা দীপনাথকে বসিয়ে রেখে
১৯. ১৯. তুমি বেলুন ফোলাবে
২০. ২০. হাসিমুখে, স্নিগ্ধ মনে
২১. ২১. কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে
২২. ২২. রতনপুরে পাঁচখানা নতুন সাইকেল রিকশা
২৩. ২৩. আমি যদি এই কোম্পানি ছেড়ে দিই
২৪. ২৪. পরদিন অফিসে এসেই দীপনাথ শুনল
২৫. ২৫. দীপ একটু থতমত খেয়েছিল
২৬. ২৬. গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে দীপনাথ
২৭. ২৭. বেজি জাতটা কিছুতেই পোষ মানে না
২৮. ২৮. আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছিল সজল
২৯. ২৯. শ্রীনাথ বাড়ির ফটক পেরিয়ে
৩০. ৩০. বোসোহেবের মুখে খুব ছেলেমানুষি হাসি
৩১. ৩১. হুইলচেয়ারে
৩২. ৩২. টালিগঞ্জ ফাঁড়িতে নামবার মুখে
৩৩. ৩৩. ট্রেনের কথা একদম খেয়াল থাকে না
৩৪. ৩৪. দৈহিক দিক থেকে পঙ্গু
৩৫. ৩৫. চেম্বারে ঢুকতেই বোস সাহেব
৩৬. ৩৬. ওপরে আজকের তারিখ
৩৭. ৩৭. অন্ধকার উঠোন ভরতি জোনাকি
৩৮. ৩৮. রাতের নিস্তব্ধতায় নানা গ্রামীণ শব্দ
৩৯. ৩৯. শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে
৪০. ৪০. প্রীতম কখনও দুরে কোথাও যায়নি
৪১. ৪১. কলকাতায় এবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে
৪২. ৪২. কতকাল পরে রেলগাড়ি দেখছে প্রীতম
৪৩. ৪৩. পরদিন ভাইবোনে অফিসে বেরোল
৪৪. ৪৪. বেয়ারাকে কিছু বলতে হয়নি
৪৫. ৪৫. পুরনো গোয়ালঘরটা ফাঁকা পড়ে থাকে
৪৬. ৪৬. মরা বা জ্যান্ত
৪৭. ৪৭. নিজের ঘরে দু’জনকে বসাল তৃষা
৪৮. ৪৮. এ বাড়িটা অভিশপ্ত কি না
৪৯. ৪৯. ঝোপড়ার দরজায় দীপনাথ
৫০. ৫০. কথা শুনে একটু গম্ভীর হতে গিয়ে
৫১. ৫১. প্রীতম জিজ্ঞেস করে
৫২. ৫২. দক্ষিণের খোলা বারান্দায়
৫৩. ৫৩. বিলু কোনওদিনই খুব সুন্দরী ছিল না
৫৪. ৫৪. টেলিফোন রেখে মণিদীপা
৫৫. ৫৫. সাড়ে তিন ভরি আছে
৫৬. ৫৬. তৃষা তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখছিল
৫৭. ৫৭. একদিন বিকেলে দুই বুড়োর দেখা
৫৮. ৫৮. কুঠে সামন্তর বাড়িটা
৫৯. ৫৯. ফেয়ারলি প্লেসে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে হাতাহাতি
৬০. ৬০. সাতসকালে কে যেন
৬১. ৬১. কোনও মহিলা যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চায়
৬২. ৬২. মণিদীপা অনেক পুরুষকে পার হয়ে
৬৩. ৬৩. নিজের টেবিলে এসে অপেক্ষা
৬৪. ৬৪. এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে আজ ভারী লজ্জা আর অস্বস্তি
৬৫. ৬৫. শরীরে আবদ্ধ এই জীবন
৬৬. ৬৬. গীতা পড়তে পড়তে
৬৭. ৬৭. চিত্রার বিয়ে কেমন হল
৬৮. ৬৮. তৃষা যখন তার জন্য চা করতে গেল
৬৯. ৬৯. দীপনাথ কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে
৭০. ৭০. অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বিকেলে
৭১. ৭১. বহুদিন বাদে ছবির কাছে
৭২. ৭২. প্রীতম নিজে থেকেই মাস দুই আগে
৭৩. ৭৩. এক-একটা সর্বনাশের সময় আসে
৭৪. ৭৪. প্রীতমের বাবা-মা আরও বুড়ো
৭৫. ৭৫. আকাশে অনেক ওপরে
৭৬. ৭৬. অন্ধকারে জল ভেঙে
৭৭. ৭৭. মালটিন্যাশনাল কোম্পানির যত দোষ
৭৮. ৭৮. সানফ্লাওয়ারের শীততাপনিয়ন্ত্রিত বিশাল রিসেপশন
৭৯. ৭৯. শমিতা চিৎকার করেই অজ্ঞান
৮০. ৮০. ঘুম থেকে উঠে বিলুর হাতে
৮১. ৮১. পৃথিবীর রং অনেকটাই পালটে গেছে
৮২. ৮২. কী খাচ্ছে, রান্না কেমন হয়েছে
৮৩. ৮৩. সুখেনের সঙ্গে সন্ধেটা কাটল

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন