মৌসিকী-এ-গজল

অজিত রায়

‘গজল শায়রী নয়, তহজীব।’—বলেছেন অধ্যাপক আহমদ সিদ্দিকি। অর্থাৎ, গজল কেবলমাত্র কাব্য নয়, তা সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতি হলো মৌসিকীর। অর্থাৎ সংগীতের। সুরবিহীন গজল নেবানো প্রদীপের মতো। এ-মন্তব্যের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। শায়রকে অনুসরণ করে বলব—

‘চাঁদ কে বিনা সারী রাত স্যাহ হ্যয়
ফুল কে বিনা চমন তবাহ হ্যয়,
শায়র কী গজল তো এক আহ হ্যয়
গায়ী ন গঈ তো লিখনা গুনাহ হ্যয়।’

 মূলত, গজল লঘু শাস্ত্রীয় বা রাগসংগীত বিশেষ। আবার হালকা-গম্ভীর রসের মিশ্রণে সিক্ত আধ্যাত্মিক গানও বটে। উদ্ভব পারস্যে। ভারতীয় সংগীতের মধুস্পর্শ সংযোজিত হলে গজল গানের ধারা হিন্দুস্তানে অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় সংগীতের যে দুটি ধারা হিন্দুস্তানি (উত্তর ভারতীয়) এবং কর্নাটকী (দক্ষিণ ভারতীয়), গজল তার প্রথম ধারার অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুস্তানি সংগীতধারায় গজলের সংযুক্তি ঘটলে ফার্সি, উর্দু ও অন্যবিধ ভাষার গজল রচনার প্রবাহ শুরু হয় এবং তাতে রাগসংগীতের মাধুর্য যুক্ত হওয়ায় গজল গান হিশেবে নতুন মাত্রা পায়।

 গজলের মধ্যে সততই মনকে আপ্লুত করার একটি খাস গুণ রয়েছে। এতে সুরের চেয়ে কথার প্রাধান্য বেশি। এ গান শৃঙ্গাররসাত্মক এবং এর মূল উপজীব্য প্রেম অথবা প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক নিবেদন হলেও গজল এমন এক অভিনব শৈলী যাতে প্রেম ও ভক্তির অপূর্ব সঙ্গম ঘটেছে। এছাড়াও, গজলে অন্যতর বিষয়ও স্বাভাবিক ভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ গানে অনেকগুলি চরণ, কলি বা তুক বিদ্যমান। প্রথম কলিটি ‘স্থায়ী’, বাদবাকি কলি ‘অন্তরা’ এবং সেগুলি একই সুরে গাওয়া হয়। মধ্যে-মধ্যে কোনো স্তবক ছন্দ ভেঙে ধীর লয়ে আবৃত্তি করা হয়। গজল গানের প্রকৃতি বা স্বভাব কোমল। টপ্পা আর ঠুমরির মতো গজল গানে মধুর ও মৃদু স্বভাবের রাগ ব্যবহৃত হয়। সচরাচর কাফি, ঝিঝিঁট, খাম্বাজ, ভৈরবী, পিলু, বারোয়া প্রভৃতি রাগ এবং পশতু ও দীপচন্দী তালে গজল গাওয়া হয়।৬৪

 গজল গানের কলিগুলির অর্থ প্রায়ই দ্ব্যর্থবোধক। প্রেম যখন পুরুষ বা নারীর প্রতি নিবেদিত হয় তখন সে গজল মানব-প্রেম বা পার্থিব প্রেম; আবার প্রেম যখন স্রষ্টার উদ্দেশে নিবেদিত, তখন তা আধ্যাত্মিক প্রেম। তাই গজল এক ধরনের ‘ভাবসংগীত’ বলেও পরিচিত। গজলের আর একটি রূপও আছে, যা অন্য গানে নেই। সেটা হলো, আবৃত্তি আকারে গজল পরিবেশন। এসব ধর্মের গুণেই গজল শাস্ত্রীয় সংগীতের ভুবনে আলাদা জাত হিশেবে গণ্য।

 এবার সরাসরি গঠনবৈশিষ্ট্যের কথায় আসি। যে-কথার আভাস আগেও দিয়েছি,—গজল দুটি পংক্তি নিয়ে রচিত। দুটি পংক্তি নিয়ে এক-একটি খণ্ড। প্রতিটি খণ্ডকে বলে ‘শের’। একাধিক বা অনেকগুলি শের নিয়ে এক-একটি গজলের অবয়ব। গজলের কাব্যভাষাই মুখ্য। ভাষার লালিত্য, শব্দের ঝংকার, ছন্দের মাধুর্য গজলের বৈশিষ্ট্য। গজলের প্রথম শেরই হলো ‘স্থায়ী’, এবং বাদবাকি ‘অন্তরা’। গজল গাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো রাগ নেই, কিন্তু মূলত যেসব রাগে শৃঙ্গাররস সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে সেই সব রাগে, যেমন একটু আগেই বললাম, কাফি, পিলু, খাম্বাজ, ভৈরবী প্রভৃতি তথাকথিত চটুল রাগের ব্যবহার গজলে বেশি দেখা যায়। তা বলে দরবারী কানাড়া, মিয়া-কী-মল্লার, বিলাসখানি টোড়ি, চন্দ্রকোষ প্রভৃতি গম্ভীর চালের রাগেও গজলের পরিবেশনে বাধা নেই। তবে ধ্রুপদ বা খেয়ালের মতো তাল, বাঁট করার ব্যাপার নেই এবং স্থায়ী ব্যতিরেকে সমস্ত অন্তরা একই সুরে গাওয়া হয়। অবশ্য, তালের ব্যাপারে গজল পরিবেশনের পরিধি কিছুটা সীমাবদ্ধ। তালের গজলে কাব্যিকভাবে অন্তরার সৃষ্টি হয়। তাই স্বল্পমাত্রা আর সরল ছন্দের কাহারবা ও দাদরা তালেই বেশির ভাগ গজল গীত হয়। তালের ক্ষেত্রেও কোনও ধরনের কূটলয়কারী বা তেহাই প্রয়োগ করা হয় না এবং গজল প্রধানত মধ্য লয়ে পরিবেশিত হয়।

 ‘মাতাল যেমন মদপিয়াসী, চিরমধুর সেই বঁধুরে তেমনি আমি ভালোবাসি।’—কৃষ্ণচন্দ্রের গজল ঢঙে গাওয়া এই ভজনটি দিয়েই আমার বৈঠকী গানের শ্রবণযাত্রা শুরু হয়েছিল। গোঁফ গজানোর বয়স তখনও আসেনি, কিন্তু সেই অপক্ক বয়সেই সায়গল, বেগম আখতার, কমলা ঝরিয়াদের গান শুনে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগত। এখনও জাগে। ওইসব সুরেলা গলায় কী এক জাদু আছে, যার মোহজালে আমি আকৈশোর বাঁধা পড়ে আছি। আজ জলসায় গুলাম আলি, জগজিৎ সিং, নুসরৎ ফতেহ আলি খান, পংকজ উধাস, পিনাজ মসানিদের প্রত্যক্ষ গান শোনবার জন্য লোকের হুটোপুটি দেখে যত আনন্দ হয়, ততটাই কষ্ট জাগে। আনন্দ এই কারণে যে এখনও গজলের মতো বন্দেশি গানের শ্রোতা আছে। আর কষ্ট পাই, কারণ এখন যে-হারে সস্তা বাহারী গজলের হরিল্লুঠ চলছে তাতে গজলের শর্বরী ঘনাতে বোধকরি আর সময় নেবে না। খানদানি গজল তো ডোডো পাখির মতো অবলুপ্তির পথে। এখনকার বেশির ভাগ গায়কই শ্রোতার বুক ভরাতে অক্ষম। অথচ, সেকালে বেগম আখতারের গজল এমন ছুরি বসিয়ে দিত যে একবার শোনার পর তা উপড়ে ফেলতে অন্তত দিন-পাঁচেক সময় লাগত।

 গজলের পাঠেও অনেক ফেরবদল ঘটেছে। আমি যে-কটি মুশায়রা বা সাধারণ মেহেফিলে গজল পাঠ শুনেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাঠের ধরন-ধারণ দেখে মনে হয়েছে—যাঁরা এই তরন্নুম আবৃত্তি করেন তাঁদের মধ্যে গজল পাঠ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণার অভাব রয়েছে। গজলের প্রতিটি শেরে দুটি করে যে পংক্তি থাকে সে-দুটির উচ্চারণ ও সুর বিধিতে তারতম্য থাকা বাঞ্ছনীয়। শেরের প্রথম পংক্তিটিকে দু-বার এবং দ্বিতীয়টিকে একবার বলাই বিধেয়। প্রথমটির বেলায় ঈষৎ বিলম্বিত তথা দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত দ্রুত—এইভাবে আবৃত্তি বা পাঠ করা উচিত। কিন্তু সেই প্রলম্বিত বা হ্রস্ব উচ্চারণের মান বা প্রোপোরেশন কতখানি হবে সে-সম্পর্কে পাঠকর্তার সম্যক জ্ঞান না থাকলে একটা আন্দোলিত ভঙ্গির সৃষ্টি হয় মাত্র—তাকে ‘গজল পাঠ’ বললে সত্যের অপলাপ হয়। অপিচ, আজকের দিনে গজলের নিখুঁত পাঠ হয় না বললেই চলে।

 গেয় গজলের সবচেয়ে বড়ো বিবেচনা-স্থল হলো উচ্চারণ ও সুরের জ্ঞান। পাঠের ক্ষেত্রেও যুক্তাক্ষরে উচ্চারণ ব্যাপারটা বিচার্য। একটি যুক্তাক্ষরকে কীভাবে ভেঙে কোন অংশটা চড়া আর কোনটা নিচে উচ্চারিত হবে, তা জানতে হবে গায়ক ও পাঠককে। কাজটা যে সহজ নয় এটা সকলে স্বীকার করবেন। কেননা উচ্চারণের সুরেলা কোমল বৃত্তিকে সম্পূর্ণ বজায় রেখে তা বোঝানোর চেষ্টা করাও বাতুলতা। নিদেনপক্ষে লেখাতে যদি আশেপাশের ডায়মেনশন এনে হাজির করি, তাহলে হয়ত-বা পড়তে জিনিশটা ইন্টারেস্টিং ঠেকবে; কিন্তু সেই সালিসি তো ফাঁকি। অতএব এখানে শুধু এইটুকু বলার, যে, উচ্চারণ ও সুরজ্ঞান পর্যাপ্ত না হলে গজল বিকৃত হতে পারে, যা গর্হিত ও অন্যায়।

বাঈজী, বাদশা আর শায়র—এই তিনের সন্নিপাতে শুরু হয়েছিল ভারতীয় গজল গানের অভিযাত্রা। পক্ষান্তরে, ত্রয়োদশ শতকের রাজন্যপোষিত বাঈজীরা যেদিন প্রথম শায়রদের পাশাপাশি বাদশাহী দরবারে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল, সেদিনই গজল গানের জন্ম। সেটা ছিল আমির খুসরোর (১২৫৩-১৩২৫) জমানা। তারপর শত শত বছর বয়ে গেছে পাহাড়ের বুকে ঝরনার মতো। কিন্তু এই সন্নিপাতের ডোর বহুদিন পর্যন্ত থেকেছে অচ্ছিন্ন।

 ইসলাম ধর্মে গানবাজনা করা ‘গুনাহ’—অর্থাৎ পাপ। কিন্তু এ-কথা উল্লেখের অবকাশ নেই যে আমাদের দেশে সংগীতের প্রভূত উন্নতি মুসলিম যুগেই ঘটেছে এবং এদেশের প্রাচীন সংগীতধারাকে নবনব রসে সিঞ্চিত করার মূলে মুসলমানরাই ছিলেন অগ্রণী। আসলে সংগীত বা মৌসিকী এমনই এক হৃদয়কাড়া ফুলবাগিচা যার আকর্ষণ ধর্মের নিষেধাজ্ঞার বেড়াকেও টপকে যায়। মুসলমানদের ধর্মগুরু মরমী সুফিসন্ত মোইনুদ্দিন চিস্তির (১১৪৩-১২৩৬) আগ্রহে সংগীতের ওপর থেকে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়েছিল। অবশ্য, যাকে বলে প্রভাব, ভারতীয় সংগীতের ওপর মুসলমানরা তা ফেলতে পারেননি। শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, রীতি-রেওয়াজ ইত্যাদির ওপর মুসলিম প্রভাব পড়লেও ভারতীয় সংগীতকে তাঁরা ইসলামিকরণ করতে পারেন নি। এর কারণ, তখনকার ভারতীয় সংগীত এত নিয়মবদ্ধ, উচ্চাঙ্গের এবং স্থায়ী রূপ নিয়ে বর্তমান ছিল যে বহিরাগতের আলোড়ন তাকে তেমনভাবে টলাতে পারেনি।৬৫ বরং মুসলিম গাইয়ে-ওস্তাদরাই ভারতীয় সংগীতের প্রাচীন ঐতিহ্য ও রসধারার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন।

 তবে এ-কথা অনস্বীকার্য যে গজল ও বাঈজী সংস্কৃতির জনক ও প্রতিপালক ছিলেন মুসলিমরাই। আমির খুসরোর জমানা অবধি দেবদাসী ও বাঈজীদের মধ্যে কোনও তফাৎ ছিল না। এদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি শুরু হয় ১২৭০-৭৫ নাগাদ। দেবদাসীরা চিহ্নিত হলো মন্দিরের নর্তকী হিসেবে এবং বাইজিরা রাজসভার নর্তকী হিসেবে। দক্ষিণে ছিল দেবদাসীদের প্রচলন আর উত্তর ভারতে বাইজিদের। মুসলিম শাসকের বাইজিদের কোঠাতেই সপারিষদ খানাপিনা আর নাচ-গান উপভোগ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। ‘একদিকে বিপুল রাজস্বের কাঁচা টাকা, অন্যদিকে অন্তহীন চক্রান্ত আর শাসক বংশের দ্রুত ও আকস্মিক উত্থান-পতনের অনিশ্চয়তা—এর মধ্যে মুসলমান শাসকেরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে ভুলে গিয়ে দু’হাতে পাগলের মতো খরচ করতেন।গানবাজনা, সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ আর কবিতা—তাঁদের ছিল এই তিন নেশা। এই সাংস্কৃতিক জীবনের শতবর্ষ পূর্ণ হবার আগেই তৈমুর দিল্লি তছনছ করে দিয়ে যান (১৩৯৮-৯৯)। সমরখন্দকে একটি সুন্দর রাজধানীর রূপ দেবার জন্য অনেক কারিগর ও ভবঘুরেদের সাংস্কৃতিক জীবনে আকর্ষিত করার জন্যে গাইয়ে বাজিয়েদের সঙ্গে করে তিনি নিয়ে গেলেন। অন্যান্য কারিগর আর গাইয়ে বাজিয়েরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন মুসলমান প্রধান জায়গাগুলিতে—উত্তরে জৌনপুর, মাঞ্চু, দাক্ষিণাত্যের দিকে আহমদনগর, বহিপুর, গোলকুণ্ডায়।ফলত বাইজিরা দেশের বহু জায়গায় বসবাস শুরু করলেন। দিল্লির সুলতানরা আবার যখন শক্তিশালী হলেন তখন আবার সেখানে জড়ো হতে লাগলেন প্রতিভাবানরা। মোগলরা চিত্রশিল্পীদের উৎসাহ দিতেন, তবেই বোধহয় বাঈজীদের পোশাকেও লাগলো রঙ ও শহুরে সংস্কৃতির ছোঁয়া। আগেকার উগ্র রঙের বদলে এল মৃদু সূক্ষ আভা। তাদের সংগীত সংগ্রহে পারসিক গজল ও হিন্দি গীতের সঙ্গে যুক্ত হল উর্দু গজল।’ ৬৬

 ‘বাঈ’ কথাটা নিয়ে যাতে বিভ্রাট না ঘটে তার জন্যে দু-চার কথা বলা দরকার।‘বাঈ’ শব্দটির অর্থ—মেয়ে বা সম্ভ্রান্ত মহিলা। কিন্তু শব্দটির আসল অর্থ এখন লুপ্ত হয়েছে, লোকে বাঈজী বলতে বোঝে স্খলিত, পতিত, বিনোদিনীকুলকে। ‘তবায়েফ’ শব্দটিরও অনুরূপ সর্বনাশ হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়িয়েছে বেশ্যা বা চরিত্রহীনা নর্তকী। কিন্তু ইতিহাসের পাতা ওলটালে এমন বহু নর্তকী বা বাঈজীর সাক্ষাৎ মিলবে যাঁদের ‘বেশ্যা’ বললে অপমান করা হয়। মহারাষ্ট্রে আজও ধনী ও অভিজাত বংশের মহিলারা তাঁদের নামের পেছনে ‘বাঈ’ শব্দটি ব্যবহার করতে গর্ববোধ করেন। মোগল আমলেও ‘বাঈ’ শব্দটি ছিল সম্ভ্রান্ত—কোনও কোনও রাজদরবারে রানিসাহেবার ওপরে ছিল বাঈজীদের স্থান। তাঁরা সুশিক্ষিত, সংগীতকলায় নিপুণ ও সমাজে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। গোড়ার দিকে বেশির ভাগ বাঈজী ছিলেন এক-পুরুষবিহারিনী। তার প্রমাণ, ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দের আগে পৃথিবীতে উপদংশ রোগ জন্মায়নি। বাঈজী কথাটি যে সম্মানের প্রতীক ছিল, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ—‘বাঈজীরা চাইতেন তাঁদের মেয়ে হোক, কেননা মেয়ে হয়ে জন্মালে রাজসম্মান লাভ করা যেত।’ ৬৭

 পরে অবশ্যি দেবদাসীদের মতো, বাঈজীরাও গণিকাবৃত্তির অসহায় শিকার হয়ে পড়েছিলেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার (১৫২৬) পর থেকে বাঈজীদের মধ্যে ব্যভিচারিণীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। মোগল সাম্রাজ্যের পতন আমাদের প্রপিতামহদের যুগ থেকে একটি বহু-আলোচিত বিষয়; কিন্তু দুঃখের কথা এই দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আটকে থাকা বাঈজীদের পতন ও তাঁদের কারুণ্যঘন জীবনের গল্প এমন সাশ্রুনেত্রে কোনো ঐতিহাসিকই বলেলনি। এ দেশে আরভিং স্টোনের মতো লেখক থাকলে সেই গল্প লেখা হতো ঠিকই। ভারতের মধ্যযুগে শুরু হয়েছিল বাঈজী সংস্কৃতি, কিন্তু এই যুগের প্রথম (ছয় শতক থেকে ১২০০ খ্রি.) কিংবা দ্বিতীয় ভাগের (১২০০-১৫২৬) কোনো বাঈজীর জীবনকাহিনী ইতিহাস লিখে রাখেনি। সুতরাং আমাদের আলোচনা শুরু করতে হবে মধ্যযুগের তৃতীয় ভাগ (১৫২৬-১৭০৭) থেকে।

 আকবরি জমানায় হাফ-গজলের সৃষ্টি। বাঈজীরা যে গজল গাইতেন তাতে ঠুংরির অনুপ্রবেশ ঘটায় এই নামকরণ। শাজাহানের শাসনকালে এই হাফ-গজল আরও সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করে।হিন্দুস্তানি সংগীত সম্বন্ধে প্রথম গ্রন্থ ‘শমস-উল-অসওয়াত’ এই সময়ে লিখিত। গজলের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও ওই কালের একটি বড়ো ঘটনা। ইতিহাসে যে জৈনব বাঈয়ের কথা পাই, তিনি ছিলেন ঔরঙ্গজেবের প্রিয়তমা। অসাধারণ রূপবতী ছিলেন জৈনব বাঈ। সেই রূপানলে পুড়ে মরতে অনেক পুরুষই প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু জৈনব নিজের প্রাণমন সঁপে দিয়েছিলেন ঔরঙ্গজেবকে। প্রথম দর্শনে ঔরঙ্গজেব তাঁর কৃপাপ্রার্থী হলে জৈনব তাঁকে প্রণয়দানে সম্মত হয়েছিলেন এই শর্তে যে, ঔরঙ্গজেবকে মদিরাপানে বীতরাগ দূর করতে হবে। জানা যায়, এই বাঈজী ঔরঙ্গজেবের মদাসক্তি অনেক পরিমাণে শিথিল করতে কৃতকার্য হয়েছিলেন।৬৮

 আঠারো শতক ছিল বাঈজীদের স্বর্ণযুগ। রাজনৈতিক দিক থেকে দিল্লি তখন টলমল হলেও শায়র ও বাঈজীদের কাছে তা হয়ে উঠেছিল স্বর্ণভূমি। বাঈজীরা এই যুগে তাঁদের শিল্পকে করে তুলেছিলেন অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন। বাঈজীদের কোঠা ফরাসি মলেঁর মতো মানুষের মেলামেশার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই যুগের কেক্তো বাঈজীর গল্প ইতিহাস লিখে রাখেনি কেন, তা আমার কাছে দুর্বোধ্য।

 এরপর শাসক হঠাৎ শাসিতে রূপান্তরিত হলে যা হয়, পলাশীর ময়দানে মারণযুদ্ধের শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থাও সেইরকম দাঁড়াল। সামাজিক-আর্থিক ভারসাম্য চোট খেল। ইংরেজ শাসনের আগে দেশের সমূহ গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলমানরা অধিষ্ঠিত ছিলেন, এখন সেই প্রতিষ্ঠা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন। ফলত পরবর্তী বহু ব্রিটিশ-বিরোধী সংঘর্ষে ফেটে পড়েছে তাঁদের ক্ষোভ আর শক্তি। বলতে কী, মুসলিমরা তখনও হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের ও দারুল ইসলাম (ইসলামি রাজ্য) প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকায় ভারতবর্ষকে দারুল হারব (বিধর্মী শাসিত রাজ্য হিসেবে সমরভূমি) বলে কল্পনা করতেন। তাঁরা হিন্দুদের মতো সহজে ব্রিটিশ শাসনকে মেনে নিতে পারেননি এবং দীর্ঘকাল ইংরেজ-প্রবর্তিত শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে বিমুখ থেকেছেন। পরিণামে তাঁদের নিজস্ব সংগীত-শিল্প-সাহিত্য বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছে। গজল আর বাঈজী-সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত থেকেছে।

 মারাঠারা বাঈজী সংস্কৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করতে দিল্লি আর লখনউ থেকে কিছু বীজ তুলে নিয়ে গিয়ে পুঁতেছিলেন পুনা ও বম্বেতে। কিন্তু তা অঙ্কুরিত হবার আগেই বিনষ্ট হয়েছিল। শেরবাঈ, মুগুবাঈ, হীরাবাঈ কিংবা গাঙ্গুবাঈ অথবা তামাঞ্জা জান তো পরের ঘটনা। মস্তানী বাঈকে পেশোয়া বাজীরাও অনেক চেষ্টায় তাঁর রক্ষিতা হতে সম্মত করিয়েছিলেন। তাঁদেরই পুত্র বাহাদুর খান, যিনি পানিপথের তৃতীয় লড়াইয়ে আফগানদের সঙ্গে লড়েছিলেন এবং পরে ঝাঁসির নবাব বংশ ধ্বংস করেছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় পর্যন্ত মারাঠি পতাকা উত্তোলিত ছিল।পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে (১৭৬১) পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে, গোয়ালিয়র রাজবংশের সংস্থাপক মাধাজি সিন্ধিয়া যুদ্ধভূমি থেকে পালানোর সময় ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়েছিলেন এক রূপবতী বাঈজীকে। কাশ্মিরের দুহিতা বেগম সমরু ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। একের পর এক ইউরোপীয় ভাগ্যান্বেষী যুবকের তিনি শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন। এইরকম আরও কিছু বাঈজীর সন্ধান মারাঠা-ইতিহাসে পাওয়া যায়।কিন্তু সত্যি বলতে কী, মারাঠারা মুসলমানদের ঐতিহ্যপুষ্ট বাঈজী-সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখতে পারেননি। সেই সংস্কৃতির জল দিল্লি থেকে গড়িয়ে বয়ে গিয়েছিল আওধের দিকে।

 হিন্দুস্তানে ইংরেজ আগমনের পরেও প্রাচ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল একমাত্র আওধের গুজিস্তা দরবারে। এদেশের প্রাচীন তহজীব ও সংস্কৃতির অবশিষ্ট অংশটুকু জীবিত ছিল লখনউ দরবারে। লখনউ শুধু আওধের নয়, তামাম হিন্দুস্তানের শেষ দরবার। লছমন টিলা বা লক্ষণপুরের নাম পালটে কোন সময়ে ‘লখনউ’-এর জন্ম, তা জানি না, কিন্তু ইতিহাস থেকে জেনেছি এই দরবারের উত্থান ও পতনের মর্মন্তুদ কাহিনি। সেই কাহিনি বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে বহুলাংশে প্রাসঙ্গিক।

 ১৫৯০ সনে আকবর যখন হিন্দুস্তানকে বারোটি প্রান্তে ভাগ করেন তখন আওধ প্রদেশের রাজধানী হয় অযোধ্যা। ১৭৩২ সনে নবাব সাদাত খাঁ বুরহান-উল-মুল্ক সুবেদার নিযুক্ত হলে আওধের এই রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ঘাগরা নদীর ধারে। সেখানেই বাঈজী ও গজল-ঠুংরি সংস্কৃতির পত্তন হয়েছিল নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায়।নৃত্য ও গীত পটিয়সী রমণীদের জন্য বুরহান একটি নগর গড়ে তুলেছিলেন। নগর না বলে তাকে বস্তি বলাই সংগত। কেবলমাত্র গাইয়ে-বাজিয়েদের বসবাসের অধিকার ছিল সেখানে। মির্জা সাকীম আবদুল মনসুর খাঁ সফদরজঙের জমানায় এই বস্তির নাম রাখা হয় ফৈজাবাদ। সফদরজঙও নৃত্যগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সৈন্যদল মজবুত করা, নতুন ঘোড়সওয়ার তৈরি আর নগর জুড়ে ইমারত খাড়া করা—এই তিন ছিল নখনউয়ের বাদশাদের প্রধান কাজ। সফদরজঙের নবাবজাদা সুজাউদ্দৌলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবদুল হলীম শরর লিখেছেন—‘ফৈজাবাদ সুজাউদ্দৌলার রাজধানী হল, সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার জনসংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোক এসে ফৈজাবাদে বসতি গেড়ে বসলো। দিকে দিকে আকাশছোঁয়া ইমারৎ গজিয়ে উঠলো। কয়েক বছরের মধ্যে ফৈজাবাদের চেহারাই পালটে গেলো। শহরে মৃগয়া আর সান্ধ্যবিহারের জন্য সাতখানা বাগিচা তৈরি হল। লখনউ সড়কের পাশে আসফবাগ ও বুলন্দবাগ নামে দুটি উপনগর গড়ে উঠলো, মুমতাজ নগরে চালু হল বাজার—চারদিকে এক সাংস্কৃতিক বাতাবরন রচিত হল। নবাব আর আমির ভদ্রজনেরা মেতে উঠলেন গান-বাজনা নিয়ে।’ ৬৯

 আফসউদ্দৌলার জমানায় এই বাতাবরণের কোনো হেরফের ঘটেনি। বরং একদিকে যেমন শাসনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে শহরের সৌন্দর্য, শান-শওকৎ। একদিকে ব্রিটিশ রাজসিংহের আগ্রাসী থাবা সমগ্র শাসনব্যবস্থাকে কব্জা করতে তৎপর, অন্যদিকে নর্তকী বিলাসে মেতে উঠেছে সমস্ত লখনউবাসী ।এই সন্ধিক্ষণেই আবির্ভূত হয়েছিলেন তদানীন্তন ভারতবর্ষের স্বনামধন্য গজলিয়া চুম্মন বাঈ। তাঁর ডেরা ছিল ইমামবাড়ায়। আফসউদ্দৌলা শিল্পের কদর জানতেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা হয়েছিল ‘উসুল-উল-নগমাত-উল-আফসিয়া’। ভারতীয় সংগীতশিল্প নিয়ে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট গ্রন্থ তৎপূর্বে লেখা হয়নি।

 ১৭৯৮ সনে আফসউদ্দৌলার দেহাবসানের পর নবাব ওয়াজির আলি খাঁ আওধের শাসক হলেন। কিন্তু কিছুদিনের শাসনে তিনি এমন কতকগুলি কাজের নমুনা দিলেন যাতে তাঁর প্রজারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। গোপনে মন্তব্য প্রচারিত হল—তিনি আসনে আফসউদ্দৌলার ঔরসজাত সন্তানই নন। চার মাসের মধ্যে নবাবি হস্তান্তরিত হল। এলেন সাদাত আলি খাঁ। আর এসেই আওধের অর্ধেকটা তুলে দিলেন ব্রিটিশের হাতে। রাজকার্য তিলাঞ্জলি দিয়ে সাদাব আলি বেনারসের বাঈজীদের নিয়ে মেতে থাকলেন।প্রায় এক মন সোনার বিনিময়ে তিনি হায়দরাবাদের কোঠা থেকে কিনে নিয়ে এসেছিলেন চন্দা বাইকে। চন্দাই ছিলেন আঠারো শতকের শেষ বাঈজী। অসাধারণ রূপসী চন্দকে ঘিরে থাকতেন যেসব রাজপুরুষ তাঁদের সকলের দীর্ঘশ্বাস ও কামকাতর দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি শুধু সংগীতকেই প্রেম দান করেছিলেন। ইংরেজ যুবাপুরুষেরাও তাঁর অনুরাগী ছিলেন। তার প্রমাণ, সেনাবাহিনী ব্যান্ডে তখন এমন একটি সুর বাজত যার নামকরণ হয়েছিল ‘চন্দার ব্যান্ড’। লর্ড ওয়েলেসলির আদেশে এই সুর তোলা হয়েছিল।৭০

 সাদাতের মৃত্যুর পর তার পুত্র গাজীউদ্দীন ১৮১৪ সনে সিংহাসন লাভ করেন। বাপের জমানো সমস্ত টাকা তিনি ব্যয় করেছিলেন ইমারত নির্মাণ ও নাচগানের পেছনে।মেহফিল বসত মজলিশ বাগে। শিল্পীদের প্রতি অদ্ভুত নির্দেশ ছিল গাজীউদ্দীনের—তাঁকে নাচ বা গানের মাধ্যমে কাঁদাতে না পারলে শিল্পীদের তিনি গোমতীর জলে ডুবিয়ে মারতেও দ্বিধা করতেন না।৭১  তাঁর শাসনকালে দুজ্জু খাঁ ও গুলাম রসুল খাঁ কাওয়ালি ঢঙের গজল গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। গাজীউদ্দীনের সময় থেকে আওধের শাসকের পদবি ‘নবাব’ কেটে ‘বাদশাহ’ হয়েছিল। ১৮২৭ সনে তাঁর পুত্র নাসিরউদ্দৌলা হায়দর বাদশাহি পেলেন। ইনি জ্যোতিষচর্চা করতে ভালোবাসতেন। আর আসক্ত ছিলেন নারীবিলাসে। এ তথ্য সর্বজনবিদিত যে তাঁর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়েছিল এক প্রতিমাসদৃশ্য রূপসী বাঈজীর হাতে। সেই বাঈজীর নাম মেহেন্দি বাই। মেহেন্দির দেহ ছিল আশ্চর্যরকম ভাবে যৌব ও জৈবতায় স্পন্দ্যমান। লখনউয়ের কোঠায় তাঁর নাচ দেখে দর্শকরা এতদূর মোহিত হয়ে উঠতেন যে কেউ কেউ লাফিয়ে উঠে তাঁকে আলিঙ্গন না-করে পারতেন না। পীন, বর্তুল ও পরস্পর আশ্লিষ্ট স্তন, ক্ষীণ কটি, গভীর নাভি, বিশাল উরু ও জঘন—সংস্কৃত কাব্যে বর্ণিত নায়িকার যাবতীয় লক্ষণ এসে মিশেছিল মেহেন্দির মধ্যে।আরও আশ্চর্য ছিল তাঁর ঠুংরি ও গজলের গলা। একদিন রাত্রিবিহারের সময় তিনি বিষ দিয়ে হায়দরের জীবন হরণ করেন। মৃত্যুকালে হায়দর নিঃসন্তান ছিলেন। এর পর বাদশাহ হন মোহম্মদ আলি শাহ, ১৯৩৭ সনে, যখন তাঁর বয়স তেষট্টি।লখনউয়ের অঙ্গসজ্জায় ইনিও তৎপর হয়েছিলেন এবং বলা বাহুল্য, গানবাজনার পৃষ্ঠপোষকতাতেও।

‘আরব্য উপন্যাস পড়তে পড়তে যে ছবিগুলি মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে, সেগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে লখনউ নগরীতে’—লিখেছেন সমীপকালীন এক বিদেশিনী, এমা রবার্টস। চার দিশায় অট্টালিকা, মহল, মসজিদ, ইমামবাড়া, গম্বুজ, মিনার তথা বাগবাগিচা আর ফোয়ারার ছড়াছড়ি। প্রজারা নিজেদের শহরের গর্ভভরে নাম দিয়েছে, ‘আখতার নগরী’। অর্থাৎ, স্বর্গীয় শহর। কেউ-বা বলছে ‘হিন্দুস্তান কা বাবুল’,—ভারতের ব্যাবলিন। হজরতগঞ্জ, আমিনাবাদ আর চকবাজারে হরদম দেশবিদেশের সওদাগরদের জমাত। চতুর্দিকে শের আর শায়রদের জলসা, বাঈজী নাচ, পতংবাজী, মুর্গা লড়াইয়ের হুজুম।

 সত্যিই, লখনউ নগরীর একটা নিজস্ব ছাঁদ আছে। এক ঝলকেই আন্দাজ করা যায় এক-দেড়শো বছর আগে সেখানকার মানুষের মধ্যে আধুনিকসুলভ কেমন শিল্পবোধ ছিল। চওড়া রাস্তার দু-পাশে সোজা লাইন ধরে বাড়ির পর বাড়ির লম্বা সারি। কেউ কারো গায়ে গাদাগাদি করে নেই। একটা থেকে আর-একটা বেশ দূরে। অলঙ্কৃত, কিন্তু ঠুনকো নয়—খিলানগুলি পর্যন্ত ভারি মজবুত। নগরের মধ্যে কেউ এসে ঢুকলে তার গা ঢাকা দিয়ে থাকা শক্ত, সবারই নজরে পড়বে। এই রাস্তার ওপর দিয়ে ফিটনে চড়ে আসত বাঈজীদের দল, তাঁদের নতুন নতুন কুঁড়িদের নিয়ে। সঙ্গে আসত তবলচি, সারেঙ্গিয়া আর তানপুরা নিয়ে বুড়ো ওস্তাদ মিয়ারা। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ পেয়ে খিড়কি আর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়ত কৌতূহলী নাগরিকরা। দুই সারি বাড়ির মাঝখানের রাস্তা হেঁটে যেত ফিটনের সওয়ারি। লোকে হাঁ করে দেখত কার বাড়িতে ঢোকে জুড়িগাড়ি। খোঁজ নিত, এই বাঈটাকে নতুন দেখছি, কোত্থেকে এলো—বেনারস না হায়দরাবাদ?

 আমজাদ আলি শাহর জমানা তখন। শুধু রাজনর্তকী আর বাঈজীই কেন, বারবনিতাদেরও মর্যাদা অঢেল। তিন ধাঁচের বারবণিতা ছিল লখনউয়ে। খ্যাতিমান রূপোপজীবিনীদের বলা হতো কাঞ্চনী। দ্বিতীয় চুনেওয়ালি, তৃতীয় নাগরনি।

 আমজাদ আলির জমানারই এক প্রখ্যাত বাঈজী বা তওয়াইফের কথা এখানে বলব। নাম উমরাও জান। লখনউয়ের রাজনর্তকী উমরাওয়ের জন্ম ফৈজাবাদের এক অতি সাধারণ পরিবারে। পিতৃদত্ত নাম ছিল আমিরন। ভাগ্যের ফেরে মাত্র এক থলি মোহরের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে কিশোরী আমিরন চলে এসেছিলেন খানুম সাহেবের কোঠিতে, গণিকালয়ে। সেখানে নাচেগানে-পড়াশোনায় চৌকস হয়ে ওঠেন। উঠতি যৌবনে প্রেমে পড়েন নবাব সুলতানের। কিন্তু খানুম সাহেবের কোঠার কঠোর বিধিনিষেধ ডিঙিয়ে সে প্রেম জয়ী হতে পারেনি। শেষে ফৈয়জ আলি নামের এক ডাকাতের সঙ্গে তিনি পালিয়ে যান। এক গভীর অরণ্যে ফৈয়জ নিহত হয়। অসহায় উমরাওকে আবার লখনউয়ের নবাব দরবারে ‘ভেঁট’ বা উপহার হিশেবে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে এই ‘তওয়াইফে’র যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের বেড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উমরাও জান অদার কবর রয়েছে বারাণসীর সিগরা গোরস্থানে। এই মর্মন্তুদ জীবনকাহিনী নিয়ে ১৯৮১ সালে তৈরি হয় ‘উমরাও জান অদা’—এক উল্লেখযোগ্য ফিচার ফিল্ম। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত মির্জা হাদি রুসওয়ারের (১৮৫৭-১৯৩১) উপন্যাস অবলম্বনে উত্তর প্রদেশেরই এক তরুণ ও কমিটেড পরিচালক মুজফফর আলি ছবিটি তৈরি করেছিলেন। উমরাও জানের লীড চরিত্রটি অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন রেখা। রেখা, ফারুক শেখ, নাসিরুদ্দিন শাহ, রাজ বব্বর, শওকত কাইফির অভিনয়ধন্য সেই ছবি, খৈয়ামের সুর আর আশা ভোঁসলের অবিস্মরণীয় কণ্ঠ যাকে অমরত্ব দিয়েছে। উমরাও জানকে ঘিরে সেই সময়কার লখনউ নবাব-ঘরানার অবক্ষয়ের একটা স্বচ্ছ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক মুজফফর। তিনি বলেছিলেন, ‘উনিশ শতকের সেই মূল্যবোধ ও জীবনের সার্বিক ধ্বংসের চেহারাটা চোখের সামনে থাকলে অন্য মাত্র পাবে ছবিটা। ইংরেজরাজ ধীরে ধীরে থাবা ফেলছে ভারতের শাসননীতিতে, আর অলস ফুর্তিবাজ বাদশাহ-জমিদার-জায়গিরদার-আমিরের দল নিরুৎকণ্ঠায় ভেসে চলেছেন। এ-ছবি সেই ছবি।’ এর পরেও, ২০০৬ সনে একই কাহিনী নিয়ে আর একটি ছবি তৈরি হয় জে পি দত্তর নির্দেশনায়, তাতে উমরাও চরিত্রে ছিলেন ঐশ্বর্যা রায় বচ্চন।

 এই সময় লখনউয়ের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মহম্মদ আলি যখন নিজের লখনউকে হিন্দুস্তানের ব্যাবিলন বানানোর জন্য শূন্যোদ্যানের নকশা মোতাবিক বর্তমান ঘণ্টা ঘরের পাশে মেহরাব বা খিলানের একের পর এক বৃত্ত গেঁথে বিশাল সাততলা প্রাসাদ গড়ে তুলছেন, সেই রাজকীয় যজ্ঞ পণ্ড করতে তেড়ে এল হাজার হাজার ইংরেজ সেপাই। ইংরেজ ও পারসিক স্থাপত্যরীতির মিশেলে এক নতুন অট্টালিকা তৈরি হল বাদশাহের নতুন ইমামবাড়া চৌহদ্দিতে।৭২  মহম্মদ আলির এই পরাজয় লখনউয়ের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা—সে অন্য গল্প। বরং বলা যাক চামেলি বাইয়ের কথা—যিনি ছিলেন একাধারে গজল গায়িকা ও মহম্মদের নর্মসহচরী। দূর দেশ থেকে লোক আসত তাঁর গান শুনতে। মহম্মদের পুত্র আমজাদ আলি শাহের জমানায় চামেলি ছিল খ্যাতির সিংহাসনে। অবশ্যি আমজাদের শাসনকালে বিন্দয়া জান, সুমন বাই এবং রাহেলা বানোও অসামান্য যশ লাভ করেছিলেন।

 অওধ বা লখনউয়ের নবাবী ইতিহাসের সূচনা বুরহান-উল-মুল্ক থেকে এবং নবাব ওয়াজিদ আলি শাহতে (১৮২২-১৮৭৩) এসে তার পরিসমাপ্তি। ইংরেজদের ভণ্ডামি, শঠতা আর চাতুরী দেখে যেমন রীঢ়ামিশ্রিত বিবমিষা জাগে, সেসময়কার দেশীয় রাজা আর নবাবদের দেখে তেমনি জাগে ক্ষোভসংপৃক্ত করুণা। অলস, অকর্মণ্য, আর নিজেদের শখ-আহ্লাদ বিলাসিতা ও লাম্পট্য বজায় রাখতে ফিরিঙ্গি প্রভুদের চরণে চড়া হারে জরিমানা আর উপঢৌকন দিতে দিতে আখেরে গোটা রাজ্যখানাই তাঁরা ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছেন।

 আমজাদের পর অওধের একাদশতম নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ যখন তখতে বসেন, ১৮৪৮ সনে, তখনই শোনা গিয়েছিল লখনউ দরবারের বিসর্জনের বাজনা।শোহরত হয়েছিল ব্রিটিশের বিজয়ডঙ্কা। ওয়াজিদ আলির দেশকালের একটি নিখুঁত রেখাচিত্র মেলে প্রেমচন্দের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ গল্পে—‘লখনউ বিলাসিতার সমুদ্রে ডুবে ছিল। ছোটো-বড়ো, ধনী-দরিদ্র সবাই বিলাসিতায় মগ্ন ছিল। কেউ নাচ-গানের আসর বসাত, কেউ বা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল আমোদ-প্রমোদের প্রাধান্য।শাসনকার্যে, সাহিত্যে, সামাজিকতায়, কলাকৌশলে, শিল্প-উদ্যোগে, আচার-অনুষ্ঠানে সর্বত্র বিলাসিতা পরিব্যাপ্ত ছিল।’

 ছবিটা একেবারে নিখুঁত। ওয়াজিদ আলি শাহ নাচগান আর বাঈজীদের নিয়ে এমনই মশগুল ছিলেন যে ফিরিঙ্গি রেজিমেন্টের ষড়যন্ত্রের কণামাত্র টের পাননি। সিপাহী বিদ্রোহের অজুহাতে ইংরেজরা নবাবকে নজরবন্দী করে রাখলেন ফোর্ট উইলিয়ামের আর্মহার্স্ট কুঠিতে। ‘লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো।’—লিখছেন হুতোম। আর ওয়াজিদ আলির শখ-আহ্লাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘কমলাকান্তে’ লিখছেন : ‘ওয়াজিদালিশাহা লক্ষ্ণৌ নগরী হইতে স্বচ্ছন্দে চতুর্দ্দোলারোহণে মুচিখোলায় আগমন করিয়া, স্বয়ানুরূপ পিঞ্জরস্থ বুলবুলিকে সঘৃত পলান্ন প্রদান করেন।’

 নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ স্বয়ং ছিলেন শখ-আহ্লাদ আর অসঙ্গতির পরাকাষ্ঠা। ওয়াজিদের জীবনের তিনটি স্তম্ভ—নবাবী ঠাটবাট, সংগীত ও শিল্পপ্রেম এবং তাঁর অগণিত প্রেমের দাস্তান। তিনটিকে একে-অপর থেকে পৃথক করা অসম্ভব।সহবাস-ব্যাপারে তাঁর বাছবিচার কিছুই ছিল না। নিজের অগণিত প্রেম ও যৌবনের নানান অসঙ্গতির কাহিনী মসিলিপ্ত করে ‘ইশকনামা’ গ্রন্থের মাধ্যমে দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছেন। রেণ্ডী, দাসী, বাঈজী—বিভিন্ন নিচু স্তরের নারীর সঙ্গেও তাঁর দেহালাপ চলত।৭২ শুধু বাদশাহ কেন, তাঁর আমলে গোটা লখনউ হয়ে উঠেছিল মণ্ডী বা বাজারের মতো। এই আমলেই বাইজিদের ওপর আর্থনীতিক ও সামাজিক নিপীড়ন শুরু হয়েছিল। নাচ-গান ছেড়ে অনেক বাইজিকে ভিন্ন জীবিকা ধরতে হয়েছিল। আবার অনেককে সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে এই পঙ্কতিলককেই নিজের ভবিতব্য বলে মেনে নিতে হয়েছিল।

 অগণিত প্রেমের দাস্তান। নবাব খোদ লিখছেন তাঁর প্রথম শরীরী আস্বাদ গ্রহণ ঘটে আট বছর বয়সে। তাঁকে এই ঘাটের প্রথম জল খাওয়ান তাঁর মায়ের এক প্রৌঢ়া পরিচারিকা যাঁর ওপর ছিল বালক ওয়াজিদের সেবাযত্নের দায়িত্ব, নাম রহীমন। ওয়াজিদ সোজাসুজি জানাচ্ছেন—এগারো থেকে তিনি নিজে উড়তে শেখেন। পরিচারিকা, দাসী, বাবার বাঁদি, বাঈজী, রেণ্ডী—কোনো বাছবিচার ছিল না। তাঁদের নামের সূচি এমন বিস্তর, গল্প ফুরোবার নয়। অধুনা লখনউয়ের যে বিল্ডিংটি ভারতখণ্ডে সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় নামে চিহ্নিত, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর জমানায় সেটি ছিল তাঁর ‘পরীখানা’। এই ভব্য অট্টলিকায় তাঁর পরীরা বাস করতেন। পরী, অর্থাৎ নবাবের বাছাই-করা সুন্দরী বাঁদিরা। তাঁদের মধ্যে কেউ দৈবাৎ গর্ভবতী বা শিশুর জনয়ত্রী হয়ে পড়লে, তাঁকে বলা হতো ‘মহল’। বেগম হজরত মহল এভাবেই বাঁদি থেকে মহল অবধি যাত্রাটি সম্পন্ন করেছিলেন। আবার যেসব রমণী ছিলেন নবাবের অত্যন্ত প্রিয়, তাঁদেরকে বলা হতো খাসমহল, অর্থাফ স্পেশাল ওয়াইফ। নবাব ওয়াজিদ আলি প্রায় তিনশোটি বিবাহ করেন এবং তালাকও দেন গুচ্ছ-গুচ্ছ। এর মধ্যে কতিপয় ছিল নিকাহ, আর ১১২ জনের সঙ্গে মুতাহ। মুতাহ, অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদি শাদি। অবশ্য নিকাহ বা মুতাহ, কোনোটিরই মেয়াদ নির্দিষ্ট ছিল না। ‘লাস্ট জেনারেশন’ গ্রন্থের লেখিকা নিধি দুগ্গর জানাচ্ছেন, শাহর সবচেয়ে প্রিয় বেগম সরফরাজ মহল একজন হিন্দু কিশোরী ছিলেন। দশ বছর বয়সে নবাবের সঙ্গে নিকাহ সম্পন্ন হলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু তার পরপরই নবাব তাঁকে তালাক দিয়ে দেন। অন্যদিকে নবাবের প্রথম মুতাহ-করা বিবি মাশুক মহলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক টিকেছিল তিরিশ বছর। নারী-ব্যাপারে সচরাচর পুরুষেরা শ্বেতাঙ্গিনীদেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকে, কিন্তু নবাব ওয়াজিদ আলির পছন্দ ছিল গাঢ়বর্ণ ত্বকের নারী। এ-ব্যতিরেকে, বিশাল স্তনের প্রতি তাঁর ছিল অপরিমেয় আকর্ষণ। তিনি আরব বণিকদের আফ্রিকান দাসীদেরও বিয়ে করে নিজস্ব পরীখানায় তুলেছিলেন। তেমনি এক আফ্রিকান বিবির নাম ছিল অজায়ব খাতুন।

 ওয়াজিদ আলি ১৮৪৭ থেকে ১৮৫৬, মোট ন’বছর নবাব পদে আসীন ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি একটি দুর্বল মসনন লাভ করেছিলেন। তাঁর পূর্ববর্তী নবাবেরা ইংরেজদের সঙ্গে টক্কর নিয়ে বারম্বার মুখ থুবড়ে পড়তেন এবং খেসারত স্বরূপ দরবার থেকে মোটা জরিমানা অর্পণ করতে হতো ইংরেজ প্রভুর পদতলে। ওয়াজিদ আলি শাহর অবশ্য ন্যায় তথা সৈন্যব্যবস্থার প্রতি বেশ কড়া নজর ছিল। তাই ফি দুপুরে লখনউয়ের ময়দানে পলটনের প্যারেড করিয়ে সেলামি উসুল করতেন। তবে, একজন কুশল শাসক হবার সবরকম গুণ তথা বৈশিষ্ট্য থাকা সত্বেও বিলাসিতা এবং কলাপ্রেম তথা রাজপাটের প্রতি অত্যধিক ঔদাসীন্যের কারণে শাসন-ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ সিদ্ধ হয়েছেন।

 কিন্তু ব্যসন বা বিলাসিতাই নবাবের একমাত্র টাইমপাস ছিল না। তিনি ছিলেন পারসিক বংশজ। উদার ও দয়ালু নবাব শুধু নন, তিনি ছিলেন আদ্যন্ত শিল্পী। কবি, ঠুমরি ও গজল লিখিয়ে, গায়ক, সুরকার, নাট্যকার, কত্থক নাচিয়ে, সাহিত্যিকও। রেখতা, শের-শায়রি, গজল, ঠুমরি, নাটক, আত্মজীবনীর পাশাপাশি নাচ, গান, পশুপাখি, সুগন্ধী, এমনি আরও নানান বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন শতাধিক গ্রন্থ। তিনি তাঁর দরবারে একদিকে যেমন বেশ কিছু লেখক ও কবিকে সংরক্ষণ প্রদান করেছিলেন, তেমনি বহু নর্তকী, বাঈজী ও তবলচি তথা গাইয়েকেও রোজগার প্রদান করেছেন। কিংবদন্তী শাস্ত্রীয় নর্তক পণ্ডিত বিরজু মহারাজের পূর্বপুরুষদের, দুর্গাপ্রসাদ ও ঠাকুরপ্রসাদকে ঠাঁই দিয়েছিলেন নিজের দরবারে; তাঁদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় নৃত্যের। ওয়াজিদ আলি শাহকে বলা হয়েছে ‘ঠুমরির জনক’। বাংলায়ও ঠুমরি গীতধারার প্রবর্তক তিনিই। তাঁর জমানায় ঠুমরি গাওয়া হতো কত্থক নৃত্যের অনুষঙ্গ হিশেবে। বেশ কিছু উঁচু দরের ঠুমরির স্রষ্টাও ছিলেন এই বাদশা। তাঁর জমানায় লখনউয়ের সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রায় হিন্দু-মুসলিমের পুরাণ, উপকথা, লোকগাথার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহই হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রবর্তক। তিনি যে ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’ মঞ্চস্থ করেন, সেটিই ছিল উর্দুর প্রথম নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন নবাবের রোল মডেল। যমুনাতটে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকাল অবশেসন ছিল। কৃষ্ণের এই রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজভূমে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে কত্থকের কমপোজিশন মিলিয়েছিলেন।

 আসলে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন শিল্পপাগল। দরবারে ঢুকে কারুক্কে দেখতে না পেলে চেল্লামিল্লি শুরু করে দিতেন। আমি যে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি! তিনি সবচেয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন রমণীসঙ্গের জন্য। ব্যাকুল নাচগানের জন্য। কোথায় গাইয়েরা, তবলচি, সারেঙ্গিবাদক কোথায় গেল? কোথায় তাম্বুরা? কোথায় সুরশৃঙ্গার? কোথায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী বাঈজীরা? কজন টপ্পা গাইয়েকে হাজির কর চট করে, কিছু খেয়াল গাইয়েকে ডাকো। গজল আর ঠুমরি গায়করাও আসুক। হে আল্লাহ, সারা জীবন যেন নাচগানের পরিবেশ পাই! বাঈজী আর গাইয়েদের নিয়েই যেন কাটিয়ে দিতে পারি সারাটা জীবন!

 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা প্রতিরোধে অওধকে নিজের সাম্রাজ্যে তাংড়ে নিল আর সদ্য-রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলি কী করলেন? তিনি কোম্পানির বারো লক্ষ টাকা বাৎসরিক পেনশন নিয়ে লখনউ নগরীতেই নিজের পরীখানায় স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারতেন গুচ্ছ-গুচ্ছ সুন্দরী রমণী, নাচগান, পাখপাখি আর অন্যবিধ শখ-আহ্লাদ নিয়ে। কিন্তু তা না করে ছুটলেন অজানা শহরের উপান্তে হুগলী নদীপাড়ে পড়ে থাকা ততোধিক বেগানা এক পরিত্যক্ত বস্তি, মেটিয়াবুরুজে। তাঁর প্রিয় প্রজাদের চিরতরে আলবিদা জানাবার প্রাক্কালেও তাঁর চোখে অশ্রু আর অধরে তাঁরই লেখা সেই বিখ্যাত ঠুমরিটি—

‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটো জায়’

মনে আদ্র, কিন্তু কলম সান্দ্র—নিজের মা, যুবরাজ, খাস-বেগম ও সৎ বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ১৮৫৬ সালে মেটিয়াবুরুজ রওনা হয়ে গেলেন। এইভাবে ভারতবর্ষের শেষ দরবারের পতন ঘটল—

‘পরীনহুফতা রুখাঁ-ও-দেও দরকরিশমা-ও-নাজ
বসৌখত অকলজ হ্যয়রৎ কি ইচে বুলাজবীস্ত।’
‘পরীনহুফতা রুখাঁ-ও-দেও দরকরিশমা-ও-নাজ
বসৌখত অকলজ হ্যয়রৎ কি ইচে বুলাজবীস্ত।’

 সাশ্রুনেত্রে লখনউবাসী বিদায় জানালেন তাঁদের শেষ নবাবকে। অতঃপর শুরু হয় তাঁর বিদায়ী শোভাযাত্রা। মা বেগম আউলিয়া, যুবরাজ কমর কদ্র, খাসমহল সহ আরও কতিপয় বেগম, আত্মীয়-পরিজন তথা শ-পাঁচেক লোকলশকর নিয়ে ১৮৫৬ সনে অজানা শহর কলকাতার গার্ডেন রিজ নামের ততোধিক বেগানা এক বস্তির উদ্দেশে রওনা দিলেন। প্রথম রাতে পৌঁছলেন উত্তর প্রদেশের উন্নাও। গঙ্গাতীরভূমে নামাজ পড়লেন নবাব। পরদিন সেতু পেরিয়ে পৌঁছলেন কানপুর, সুহৃদ মিস্টার ব্রান্ডনের বাংলোয়। ক’দিন পরে কানপুর থেকে জলপথে এলাহাবাদ। সেখানে জনগণ আর পড়শি রাজ্যের অধীশ্বরদের সখেদ অভ্যর্থনা হাসিল করে ক’দিন কাটিয়ে এলেন বারাণসীতে। আরও ক’দিন কেটে গেল কাশীনরেশ ঈশ্বরীপ্রসাদ নারায়ণ সিংয়ের রাজকীয় আতিথ্যে এবং ভব্য সমারোহে। তারপর আবার যাত্রা শুরু। তাঁর মা, তাঁর প্রধানা বেগম ও দুই যুবরাজকে সঙ্গে নিয়ে নবাব বেনারস থেকে জলপথের কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি জমালেন ম্যাকলয়েড কোম্পানির এক স্টিমারে। অন্যান্য সহযাত্রীরা রওনা দেন বিশাল বিশাল বজরায়, এবং কয়েকজনের একটি দল যাত্রা করেন সড়কপথে। গাড়িঘোড়া, বজরা, স্টিমার—সে এক বিচিত্র ও ভব্য শোভাযাত্রা।

 বিশদিন বদে, ৬ মে ১৮৫৬ সন্ধ্যায় রমজানের চাঁদ দেখা দিলে নবাবের স্টিমার এসে ভিড়ল কলকাতার বাবুঘাটে। অনুগত উজির-নাজির আমির ওমরাহ ছাড়াও নবাবের সঙ্গে ছিলেন মা মালকা-ই-কিসবর (বেগম আউলিয়া), ভাই সিকন্দর হসমত, যুবরাজ কমর কদ্র, খাসমহল সহ পাঁচ-ছজন বেগম এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও শ্বশুর আলি নকী খান। অন্যান্য বেগমরা থেকে গিয়েছেন লখনউতেই। কথিত আছে, প্রাথমিক পর্যায়ে নবাব সদলবলে আস্তানা গেড়েছিলেন বেলগাছিয়ায়। সেখান থেকে মেটিয়াবুরুজে বর্ধমান রাজার একটি বাগানবাড়িতে। ‘গুজস্তা লখনউ’-এর লেখক আবদুল হলিম ‘শরর’ জানাচ্ছেন, মেটিয়াবুরুজে হুগলী নদীর ধারে দু-আড়াই মাইল জুড়ে বেশ কয়েকখানা বাড়ি ছিল। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া ঐ বাড়িগুলি নবাবকে প্রদান করলেন। দুটি বাড়ি খাস নবাবের জন্য, একটি তাঁর খাসমহলের আর একটি আলি নকী খাঁর থাকবার জন্য।৭৪

 মেটিয়াবুরুজের ইতিবৃত্ত কলকাতা থেকেও পুরনো। মূল কলকাতা থেকে তিন-চার মাইল দূরে দক্ষিণে ভাগীরথী কিনারে জায়গাটার আসন নাম ছিল গার্ডেনরিচ। নদীর দুই তীরে দুটি কেল্লা ছিল মাটির। নাম ছিল ‘আলিগড় কেল্লা’ আর ‘থানা’। একটি রাজা প্রতাপাদিত্যের অন্যটি ডাচদের হাতে তৈরি। বৃটিশ আমলে লর্ড ক্লাইভ কেল্লা দুটির দখল নিয়েছিলেন। অবশ্য, কলকাতা পত্তনের পর কেল্লা দুটি ধ্বংস হয়ে গেছিল এবং পড়ে ছিল মাটির দুটি বিশাল টিপি বা বুরুজ। আসলে মাটিয়া বুর্জ, অর্থাৎ মাটির কেল্লা, থেকে পরবর্তী কালে এই মেটিয়াবুরুজ। ফিরিঙ্গিদের অনুকম্পায় হাসিল বারো লক্ষ টাকা বাৎসরিক পেনশনের ওপর নির্ভর করে রাজ্যহারা নবাব কলকাতা শহরের উপান্তে এই পরিত্যক্ত মেটিয়াবুরুজেই পাতলেন তাঁর ওস্তাগর সাম্রাজ্য এবং গড়ে তুললেন তাঁর সাধের লখনউ নগরীর দ্বিতীয় সংস্করণ। মনের ভিতর তখনও ধিকিধিকি আশ হয়ত ছিল, একদিন ফিরে পাওয়া যাবে হারানো অওধ।—

‘দর-ও-দিওয়ার পর হসরত সে নজর করতে হ্যঁয়
খুশ রহো অহলে-বতন হম তো সফর করতে হ্যঁয়’

 সেই সফর আর শেষ হয়নি। শেষমেস এই কলকাতা শহরের প্রান্তশায়ী মেটিয়াবুরুজেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি তিরিশটা বছর।৭৫

 কোথায় কাশ্মিরী উল আর কোথায় বগলের চুল! কোথায় কেতাদুরস্ত শাহী শহর লখনউ, আর কোথায় ধ্যাদধেড়ে মেটিয়াবুরুজ! কিন্তু অভাবিত হলেও, নবারের হাতে পড়ে যথেষ্ট ত্বরিত গতিতে এই মেটিয়াবুরুজই হয়ে উঠল ছোটো লখনউ। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর একার উদ্যোগেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল এক অসামান্য নগরী। একদম লখনউ আদলে তৈরি হয়েছিল প্রশস্ত রাস্তাঘাট। সেই রাস্তার দু-পাশ রাতের বেলা সেজে উঠত গ্যাসের আলোয়। ছিল নিজস্ব বাজার, বাগবাগিচা, দুর্গ, মিনার, মসজিদ, ইমামবাড়া। এমনকি চিড়িয়াখানাও। এশিয়াটিক সোসাইটির কুইরেটর ব্লিথের মাধ্যমে সেই চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়ারদের খোঁজ নিতেন নাকি খোদ চার্লস ডারউইন। মেটিয়াবুরুজে গড়ে উঠেছিল নবাবী ছাপাখানা—’মতরা-ই-সুলতানি’। ওয়াজিদ আলি ছিলেন ধর্মভীরু শিয়া মুসলমান। তিনি সেখা গড়ে তুলেছিলেন একের পর এক মসজিদ আর ‘মাদ্রাসা সুলতান-এ-অওধ’। সেখানে নিছক ইসলামের শিক্ষাই দেওয়া হতো না, শেখানো হতো প্রতীচ্যের বিজ্ঞানও। ঘোড়সওয়ারি আর দেহগঠনের কসরতের পাশাপাশি চলত ক্যালিগ্রাফির তালিম। বাড়িতে বাড়িতে বড় বড় হাঁড়ায় তৈরি হতো খাস লখনউই শাহী বিরিয়ানি। বিভিন্ন রকমের রান্নার শখ ছিল ওয়াজিদ আলির। ‘দমপোখত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না, বিশেষত বিরিয়ানি, তিনিই নিয়ে আসেন কলকাতায়। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন তাঁরই হাতে। ওয়াজিদ আলির ঘুড়ি ওড়ানোর শখ ছিল। ঘুড়ির সুতো অবধি বয়ে এনেছিলেন গার্ডেনরিচে, যা দিয়ে পরে সেখানে শুরু হয় নতুন কেতার পোশাক তৈরির ব্যবসা। কলকাতার এমনি আরও অনেক ঐতিহ্যের সূচনাই ওয়াজিদ আলি শাহর হাত ধরে। চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও জীবনের রসে তালভঙ্গ হতে দেননি নবাব। ওয়াজিদ আলির জীবনচর্যার উদ্ধারও তাই কোনও অস্তমিত রাজমহিমার কাশিদা বা গুণকীর্তন নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের শিকড়সন্ধানও। নিছক স্বপ্নবিলাস নয়, এক ভিন্নতর জাগরণ।

 কলকাতার সংস্কৃতি সমৃদ্ধতর হওয়ার মূলে নবাব ওয়াজিদ আহি শাহর অবদান অবিসংবাদিত। এখানে বসে তিনি শায়রি, গজল, মসনবি, নজম, মারসিয়ার বন্যা বইয়ে দেন। তাঁর দেখাদেখি তাঁর ছেলেও শায়রি শুরু করে। পথেঘাটে গুলতানি মারা ছোঁড়া-ছোকরাদের মুখেও শের-শায়রি, ছ্যাকড়াগাড়ির সহিসও মুসাফিরকে শোনাচ্ছেন মৌসিকী-এ-নজম। অবিকল সেই লখনভী মাহোল। এছাড়া সমস্ত মেটিয়াবুরুজে সেদিন শায়রি, গজল, নজম আর কাওয়ালির বাতাবরন। আর ওয়াজিদের ঠুমরির তো জবাবই নেই। নবাব ওয়াজিদ আলিই কলকাতায় ঠুমরির ভগীরথ এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাঁর অন্যতম সুহৃদ সংগীতবেত্তা রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) পাথুরিয়াঘাটা থেকে মেটিয়াবুরুজে আসতেন ওয়াজিদের লখনউই ঠুমরির টানে। আরও দুই সুহৃদ যদুভট্ট ওরফে যদুনাথ ভট্টাচার্য (১৮৪০-১৮৮৩) এবং অঘোরনাথ চক্রবর্তী (১৮৫২-১৯১৫) নবাবের দরবারি ঠুমরির রীতিমতো ফ্যান ছিলেন। ওয়াজিদের দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মেটিয়াবুরুজ থেকে লখনউয়ের ঠুমরি ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে। ওয়াজিদ আলি বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শিখেছিলেন। সেনি ঘরানার উস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে আসেন। সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, ওয়াজিদ আলি এই যন্ত্রটিকে জনপ্রিয় করেন। ছিলেন বিখ্যাত বিনকার ও রবাবিয়া কাসিম আলি খান। ওয়াজিদের আমন্ত্রণে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দরবারে সুরবাহার বাজিয়ে যান। এই দরবারেই নাকি উস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। ওয়াজিদ তবলাকেও জনপ্রিয় করেন কলকাতায়। সানাই, এসরাজে জড়িয়ে ছিল তাঁর নাড়ির টান।

 অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাগীরথী তটে বইতে শুরু করল গোমতী তীরের সুরভিত গন্ধবাহ।অবশ্য, ‘মেটিয়াবুরুজে যেন লক্ষ্ণৌয়ের সূর্যাস্তের আভা।’ আসলে মেটিয়াবুরুজের চার দেওয়ালে ঘেরা জগৎ ছিল বাইরের দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ওয়াজিদ আলি শাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন (মৃত্যু ১৮৮৭) এখানে টিকে ছিল মুঘল দরবারি সংস্কৃতির পড়ন্ত ছায়া। যে ছায়া খোদ এই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র দিল্লি থেকে বিদায় নিয়েছিল বাহাদুর শাহ জাফরের জমানা শেষ হবার অনেক আগেই।৭৬

নবাবী আমল ফুরিয়ে যাওয়ার পরও লখনউয়ের সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্য অটুট থেকেছে। ওয়াজিদ আলি বিদায় নেবার পর তাঁর অন্যতম বেগম, বীরাঙ্গনা হজরত মহল নবাবের তখতে বসালেন ছেলে মির্জা বিজরিস কদ্র বাহাদুরকে এবং ইংরেজদের চরমশত্রু বাগী সিপাহীদের হেফাজতে বিজরিসের নবাবী খানিককাল চললও বটে, কিন্তু লখনউ ছেড়ে ভাগলেন যখন, শেষমেস নেপালের সরহদে পৌঁছেই হাঁফ ছেড়েছিলেন। তবে লখনউয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এত তাড়াতাড়ি চিড় ধরেনি। লখনউয়ে তখন ইংরেজদের সেই বাগী ফৌজ ছাড়াও স্থানীয় জমিদার ও তালুকদারদের রমরমা শুরু হয়ে গেছে। বৃটিশ ও পারসিক স্থাপত্য রীতির মিশ্রনে গড়ে উঠল নতুন নতুন ইমারৎ। চতুর্দিকে কবুতরবাজি, ঘুড়িবাজি, আফিম-চরস, ব্যভিচার আর বিলাস-ব্যসনের ছররা। এমনকি বৃটিশ অফিসাররাও পাইক বরকন্দাজ, বাবুর্চি খানসামা, হুকুমবরদার এইসব লোকলশকরদের নিয়ে এক-একজন খুদে নবাব ব’নে বসল। ফলে লখনউয়ের সংস্কৃতিতে ঘটল আর-এক নয়াল মিশ্রসংস্কৃতির মিশেল।

 ইংরেজ শাসন কায়েম হতে বাঈজীরা হারালেন রাজনর্তকীর সম্মান। উদ্ভব হলো এক নতুন ধনিক শ্রেণীর, যারা মনে করত টাকা দিয়ে বাঈজী কেনা যায়। এই ধনী, অশিক্ষিত জমিদার আর বণিকরাই হয়ে উঠল বাঈজী আর গজল-ঠুমরি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।

 লখনউ নগরীর একটি নিজস্ব ছাঁদ আছে। এক ঝলকেই আন্দাজ করা যায় একশো বছর আগে সেখানকার মানুষের মধ্যে আধুনিকসুলভ কেমন শিল্পবোধ ছিল। চওড়া রাস্তার দু’পাশে সোজা লাইন ধরে বাড়ির লম্বা সারি। কেউ কারও গায়ে গাদাগাদি করে নেই। একটা থেকে আর একটা বেশ দূরে। অলংকৃত, কিন্তু ঠুনকো নয়—খিলানগুলি পর্যন্ত ভারি মজবুত। নগরের মধ্যে কেউ এসে ঢুকলে তার গা ঢাকা দিয়ে থাকা শক্ত, সবারই নজরে আসবে।এই রাস্তার ওপর দিয়ে ফিটনে চড়ে আসত বাইজিদের দল, তাঁদের নতুন নতুন কুঁড়িদের দল। সঙ্গে আসত তবলচি, সারেঙ্গিয়া আর তানপুরা নিয়ে বুড়ো ওস্তাদ মিয়ারা।ঘোড়ার খুরের শব্দ পেয়ে খিড়কি আর দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়ত কৌতূহলী নাগরিকেরা। দুই সারি বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতো ফিটনের সওয়ারি।লোকেরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখত কার বাড়িতে ঢোকে জুড়িগাড়ি।খোঁজ নিত, এই বাইটাকে নতুন দেখছি, কোত্থেকে এসেছে—বেনারস না হায়দরাবাদ?

 উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বাইজি আর গজলের ওপর থেকে লখনউয়ের একাধিপত্য নষ্ট হতে থাকে। বাঈজীরা ছড়িয়ে পড়েন দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর, লখনউ, হায়দরাবাদ, বেনারস, বম্বে, পুনে, মহীশূর, এলাহাবাদ, জয়পুর, বিকানীর, মুজফফরপুর, ছাপরা, যোধপুর, আজমগঞ্জ, লাহোর, ইসলামাবাদ, করাচি—অবিভক্ত ভারতবর্ষের নানান জায়গায়। ফলত গজলের প্রসারও ঘটেছিল তেমনি ব্যাপকভাবে। ওই সময়কার বেনারসের সরস্বতী বাঈয়ের গান শুনে আমাদের অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়েছিলেন। সরস্বতী বাঈ শীতের সময় কলকাতায় আসতেন। বিদ্যাধরী ছিলেন বেনারসের আর শ্যামলতা এলাহাবাদের নামকরা বাঈজী। বেনারসেরই শিউকুঙর বাঈ গজল গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। জয়পুরের চুম্মনবাঈ, আগ্রার রুমানী জান ও মালকাজান, বেনারসের জদ্দন বাঈ, বম্বের বিন্দুদেবী, ছাপরার রামকলী প্রমুখ কয়েকজন সফল বাঈজীর নাম এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—অবশ্যি এঁদের গজল তেমন সুখ্যাতি পায়নি।

 এখানে বলি সে-যুগের দুর্দান্ত সুন্দরী নৃত্যপটীয়সী এক গন্ধর্বকন্যার কাহিনি। নাম তাঁর গওহরজান। তৎকালীন হিন্দুস্তানে বিপুল খ্যাতি অর্জনকারিনী এই বাঈজী আজ প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। জন্মসূত্র গওহর ছিলেন আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান, আসল নাম মিস ইডিলিয়ান অ্যাঞ্জেলিনা ইউওয়ার্ড। জন্ম বেনারসে। মা ভিক্টোরিয়া ইমাংগার্স স্বামী হারানোর পর হায়দরাবাদের নিজাম মীর মেহবুব আলির আগ্রহে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। তখন অ্যাঞ্জেলিনা কিশোরী। এবার মা ও মেয়ের নতুন নামকরণ হল, যথাক্রমে বিবি মালকাজান ও গওহরজান। নিজাম বাহাদুর দুজনকেই নিয়ে আসেন কলকাতায়।

 মালকাজান আগ্রাওয়ালী ছিলেন ডাকের সুন্দরী, তাঁর মেয়েও হয়েছিলেন আগুনের মতো রূপবতী। গওহরজান ছিলেন বহুভোগ্যা রমণী। প্রথম যৌবনে প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল মাত্র দুজন পুরুষকে ঘিরে। সেই দুজন ভাগ্যবানের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর খাস তবলচি তরুণ রূপবান আব্বাস মিঞা, অন্যজন বহরমপুরের জমিদার নিমাই সেন।প্রথম জনের সঙ্গে প্রেমপর্ব গওহরের জীবনে মামলা-মোকদ্দমা এবং দারুণ বিপর্যয় এনে দিয়েছিল। গওহর এমনই স্বাধীনচেতা ও মুক্তবিহারিণী রমণী ছিলেন যে কোনো একজনের প্রণয়ীর সঙ্গে চিরতরের জন্য ঘর বাঁধার স্বপ্ন তাঁর আদৌ মনঃপূত ছিল না। এই কারণে জনসমাজের ‘রক্ষণশীল ভদ্রজনদের’ কাছে তিনি যথেষ্ট নিন্দিত ছিলেন। খ্যাতি ও কুখ্যাতি দুই জুটেছিল তাঁর কপালে।৭৭

 গওহরজানের বিলাসিতা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি গল্প চালু আছে। তিনি অজস্র টাকা রোজগার করেছেন নিজের পেশায়। কলকাতায় চিৎপুর রোড এবং ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ‘গওহর বিল্ডিংস’ নামে প্রকাণ্ড বাড়ি দুটি তাঁরই কীর্তি। বেলা করে ঘুম থেকে উঠতেন। এক ডজনের বেশি চাকর-বাকর ছিল। সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য চার-ঘোড়ায় টানা শৌখিন জুড়ি গাড়ি, ফিটন, টমটম, ল্যান্ডো ছিল বেশ কয়েকটি। তিনি সখবশত কোনও কোনও দিন কোচোয়ানের আসনে বসে এক হাতে ঘোড়ার লাগাম আঁটোকরে ধরে ও অন্য হাতে চাবুক নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ময়দানের দিকে। শোনা যায়, একবার বড়োলাটের গাড়ি তাঁর গাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় হিরে জহরতে মোড়া সুন্দরী গওহরজানকে কোনো রাজকুমারী ভেবে লাটসাহেব টুপি খুলে আনত হয়ে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। পরে গওহরের পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কলকাতা পুলিশ কমিশনার বাঈজীদের চার ঘোড়ায় গাড়িতে ময়দানে বেড়ানো নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন।৭৮

 বয়ঃপ্রাপ্তির পর গওহরজান খুব কম সময়ের মধ্যে বাঈজী মহলের শীর্ষ স্থানটি দখল করেছিলেন। মুজরো নিতে বা পেশার খাতিরে তাঁকে মাঝে মাঝে বেনারস লখনউ যেতে হলেও তাঁর বাসস্থান ও কর্মস্থল ছিল কলকাতা শহরে। অবশ্যি শেষ জীবনে তিনি মহীশূর রাজ-দরবারে রাজনর্তকী ও গায়িকা রূপে কলকাতা ছেড়ে মহীশূরে চলে যান। গওহরজান থেকে কলের গানের বিকাশপর্ব শুরু। উর্দু, ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি চার ভাষাতেই অবলীলাক্রমে গান গাইতে পারতেন তিনি। ধ্রুপদ গাইতেন প্রাণ ঢেলে। হাফিজের গজলেও ছিল সমান দক্ষতা। দারুণ জনপ্রিয় ছিল তাঁর রেকর্ড। প্রতিটি রেকর্ডের শেষে তিনি সগর্বে ঘোষণা করতেন—‘My name is Gauhar Zan’.

 ১৯২৩ সনে এই কিংবদন্তি নায়িকার মৃত্যু ঘটে। সেই সঙ্গে মৃত্যু ঘটে পূর্ব ভারতের বাঈজী প্রথার। তখন রীতিমতো কলের গানের যুগ শুরু হয়ে গেছে। প্রথম গ্রামাফোন ডিস্কে যাঁদের গান উঠেছিল তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন নামকরা গজল গায়িকা। দুজনের নামই জোহরাবাই—ছোটোজোহরা আর বড়ো জোহরা। এঁরাও নিয়মিত বেনারস-কলকাতা-বেনারস করতেন, সময়াবকাশে পাটনাও যেতেন।বিখ্যাত গায়িকা রোশন আরা, যিনি দেশবিভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান। ছোটোজোহরার কন্যা।

 বিশ শতকের গোড়ার দিকে গজল গানে বিখ্যাত হয়েছিলেন আর এক কিংবদন্তি সুন্দরী বাঈজী ছপ্পন ছুরি। এঁর সম্পর্কে দুটি গল্প প্রচলিত আছে। একটি গল্পে জানা যায়, আশ্চর্য লাবণ্যে ভরা দেহ ছিল তাঁর। কোথাও খামতি ছিল না, এক ছটাক মেদবাহুল্য ছিল না। সর্বত্র এক পুষ্ট ভাব। গোড়ালি থেকে চুল পর্যন্ত টের মিলত সুষমার। যৌবনপুষ্ট দেহ ঠিকরে বেরোত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এক মদির আবেদন। তাঁর স্বামী নপুংসক থাকায় তাঁর শরীর উপভোগ করতেন অর্থবান সাহেসবুবোরা। বিনিময়ে যা আয় হত লুটেপুটে খেতেন তাঁর শাশুড়ি ও স্বামী। একবার বখরা ভাগ নিয়ে বচসা চলে শাশুড়ি-বউয়ের মধ্যে। শাশুড়ি তখন ছেলেকে বলেন—‘এ দজ্জাল মাগীকে দূর করো!’ মাতৃআজ্ঞা পালন করতে ছপ্পন ছুরির স্বামী তাঁর শরীরে ছাপ্পান্ন বার ছুরিকাঘাত করে বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দেন। সে-যাত্রায় বেঁচে যান ছপ্পন ছুরি। বীভৎস ভাবে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়েও তাঁর কত্থক নৃত্য বোদ্ধা মহলে অবহেলিত হয়নি। তিনি সমাদৃত হন এবং ক্রমে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ভারতময়। গজলচর্চার শুরু তার পরে। লোকের ধারণা, তাঁর সুন্দর রূপটা অক্ষত থাকলে হয়তো এমন দরদ দিয়ে গজল গাইতে পারতেন না।

 অন্যদিকে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শংকরলাল ভট্টাচার্য ‘শেষ বাঈজী’ নামে বেড়ে একটা গপ্পো ফেঁদেছেন—‘একদিন এক বাঈজীকে ছত্রাখান অবস্থায় পাওয়া গেল তার ঘরে, দেহে ছাপ্পান্নটি ছুরির ক্ষত। খুব সুন্দরী ছিল, প্রেমিকও ছিল প্রচুর, ছুরির ঘা থেকে বোঝা যায় হত্যাকারী গভীর প্রেমিক।’ সেই বাঈজীর নাম রানী এবং হত্যাকারী প্রেমিকটির নাম শঙ্করলাল। গল্পটির দু-একটি অংশের উদ্ধৃতি এখানে দিচ্ছি—‘শঙ্করলাল মেপে মেপে, জায়গা খুঁজে খুঁজে রানীর দেহে একটার পর একটা কোপ মারছে আর রানী কোপগুলো গুনে যাচ্ছে। এক … দো … তিন … সাত … আঠারো … বত্তিশ … পঁচপন … রানী তৃতীয়বার ছুরির ঘা খেয়ে বলেছিল, তোমার যত খুশি মারো বাবু শুধু চোখে মেরো না। আমি তোমায় দেখতে দেখতে মরতে চাই। আমার চোখ নিও না বাবু …। রানী পঞ্চান্ন পর্যন্ত গুনেছিল, তারপর একদম চুপ হয়ে গেল। সাতবারের পর সে আর আয়নার নীচে থেকে নড়তে পারেনি। তার আগে ঘরের এদিক ওদিক ছুটে বেড়িয়েছে। দরজার ছিটকিনিটা খোলার জন্য যখন ও ওপরে হাত বাড়িয়েছিল তখনই শঙ্করলাল ওর হাতের ওপর প্রচণ্ড কোপটা বসায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনটে আঙুল ছিটকে মাটিতে গিয়ে পড়ে। শঙ্করলাল ছুরির শেষ আঘাত হেনেছিল রানীর বুকের ঠিক মাঝখানে, দুই রক্তাক্ত, সুডৌল, গোল সূর্যের মাঝখানে। তখন বুকের দুই বোঁটা দিয়েও রক্ত ঝরছে রানীর। শঙ্করলাল দুই বোঁটাতে শিশুর মতন দুটি চুম্বন দিল …’ এর পর আর এক জায়গায় আছে—‘প্রথম আঘাতটাই ছিল শঙ্করের অভিপ্রেত, বাকি চুয়ান্নটি লজ্জা ও পাপবোধ থেকে, ছুরির নিজস্ব হঠকারিতা থেকে।… রানী কোপগুলো গুনছিল দেখে কিছুটা নেশা হয়েছিল শঙ্করেরও। অন্তত ছাপান্ন ঘা মারার বাসনা জেগেছিল ওরও। কিন্তু পঞ্চান্ন বারের পর রানীর চোখ দুটো ছাড়া আর জায়গা ছিল না। চোখ খারাপ শঙ্করের, তাই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের চোখের জন্য ওর বড়ো মায়া। আর রানী চেয়েছিল চোখ দুটি যেন বেঁচে থাকে।’৭৯

 ছপ্পন ছুরির সমীপকালীন জানকী বাঈ বিখ্যাত হয়েছিলেন গজলেরই জন্য। তিনি বেশ্যা ছিলেন না—কিন্তু তাঁর সহেলিরা দেহের ব্যাবসা করত, যাদের লালন করত জমিদার ও ধনী ব্যবসায়ীরা এবং এই ব্যাবসায় মদত জোগাত নারীকল্যাণ সমিতি। জানকী বাই গভর্নরের কাছে এই বলে আবেদন জানান যে নারী সমিতি ও জমিদাররা স্বৈরিণীদের উৎখাত করে প্রকৃতপক্ষে সংগীতের ওপর আক্রমণ করছেন—কেননা এদেরই মধ্যে নাচগান বেঁচে আছে। সরকার এর প্রতিকারের জন্য বাঈজীদের কোঠায় সেনা মোতায়েন করেন। গজল-ঠুংরির বিকাশে এটা হয়েছিল সহায়ক। শুরু হয়েছিল জিয়া বেগমের যুগ।ইনি ছিলেন আম্বালার বাইজি। গোটা তিরিশের দশকটা মাত করে রেখেছিল ত্রিয়া বেগমের গজল। এঁর জমানায় বাঈজীদের চারিত্রিক অধঃপতন কেউ রুখতে পারেনি। নব্য সভ্যতার চাপে তাঁরা ক্রমে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। অবশ্যি গজলের চর্চা ছিল অব্যাহত।

 ১৯২০-এর শেষ আর তিরিশের শুরুতে লখনউয়ের মিস দুলারী গ্রামাফোনে গজল গেয়ে বিখ্যাত হলেন। ‘মিস’ কথাটা তখন খুব চলেছিল। থিয়েটারে, সিনেমায়, রেকর্ডে সর্বত্র মিস মিস মিস। প্রসঙ্গত, দেশবন্ধুর সহোদরা অমলা দাস, ‘মিস দাস’, নামেই রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। বম্বের মূক ছবি এই মিসদের জন্যেই সম্ভব হয়েছিল। কাগজে এঁদের পরিচয় ছাপা হত কোনো রাজা বা নবাবের ভগিনী অথবা কন্যা হিসেবে। কলকাতায় গোড়ার দিকে সিনেমার মিস কাজ্জন নামে এক বাঈজী অভিনয় করতেন। প্রখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী ও পরে সংসদ-সদস্যা নার্গিস দত্ত ছিলেন জদ্দন বাঈয়ের কন্যা।

 চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে বিখ্যাত হয়েছিলেন জম্মুর মালকাজান ও জয়পুরের শমশাদ বেগম। পূর্ব ভারতে বাঈজী প্রথা ঘুচে গেলেও, মহারাষ্ট্রে তার কিছুটা চল ছিল। পুনেতে মারাঠারা জোর করে দিল্লির কিছু বাঈজীকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানকার অনিকা বানু ও বুরগাইজানের খ্যাতি ছিল গজলের জন্যে।পেশোয়ারের তামাঞ্জা জান ছিলেন স্বনামধন্যা। তামাঞ্জা শব্দটির অর্থ নির্মল। সত্যিই তিনি ছিলেন নির্মল রূপের অধিকারিণী। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যাবতীয় সম্পদ তাঁর দেহের যথাযথ স্থানে ও সুন্দরভাবে বিদ্যমান ছিল।অনেকের মতে, সৃষ্টিকর্তা যেন বিশ্বের সব সৌন্দর্য একাধারে দেখবার লোভ সামলাতে পারেননি। নিখিলের তাবৎ সুন্দর বস্তুর সৌন্দর্য আহরণ করে এই রমণীকে গড়েছিলেন। হবিবুর শেখ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অতিরঞ্জিত ভাষায় লিখেছেন—‘তামাঞ্জাজান ছিলেন আল্লার শেষ সৃষ্টি গজেন্দ্রগামিনী তামাঞ্জার পদসঞ্চারে অঙ্গ-দুলনে মনে হত লাবণ্যের নদীতে ছোটো ছোটো বীচিকলা। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে পুরুষের বুকের হাড় চূর্ণিত হত। তামাঞ্জা যে সালোয়ার কামিজ পরতেন তাতে বসানো থাকত চোখ ধাঁধানো চুমকি। যখন নড়তেন, মনে হত বিদ্যুৎ ঠিকরে বেরোচ্ছে। প্রত্যেকটি আঙুলে ছিল হিরের আংটি, কানের দুলও হিরের। তামাঞ্জার কাছে ইংরেজদেরই আনাগোনা ছিল বেশি। সকলের তিনি নর্মসহচরী ছিলেন। গানের গলা ছিল অসম্ভব রকমের মিঠে। গালিব, মীর, শকীল ও দতের গজল গাইবেন দরদ ঢেলে। সে-সব গান আজ কোথায় হারিয়ে গেছে।’৮০

 বাঈজী প্রথাটা ছিল সামন্ত্রতন্ত্রের প্রতীক, তাই এর পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী। প্রথমে দেখা দিল অর্থনৈতিক সংকট, নাচগান ছেড়ে অনেকে নেমে গেলেন গণিকাবৃত্তিতে; আবার কেউ কেউ আঁকড় ধরে রইলেন শুধু গানকে। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে গানের জগতে বাইজিদের অনুপ্রবেশ বাড়তে থাকে। শুরু হল কমলা ঝরিয়া, মলিকা পুখরাজ, মাস্টার মদনের দিন। কলের গানে তখন হরেক কিসিমের রং, হরেক সুর। তখন এই গান ঘিরেই উত্তেজনার চরম। ঘরে ঘরে মেহফিলের মেজাজ।কখনও কোনো গগনচুম্বী ইমারত থেকে মুজরোর বোলের সঙ্গে ভেঙ্গে আসত কমলা ঝরিয়ার কুহুতান—‘আইয়ে আকর মেরী খুশকিসমতী বন জাইয়ে’ কিংবা ‘কাসিম লায়া থা খবর এ্যয়সী খবর ভী ক্যা খবর’। কোথাও কোনো গাব্বাগোব্বা মহল থেকে ভেসে আসত মলিকা পুখরাজের—‘বে সুবাঁ না হো জায়ে’ অথবা মাস্টার মদনের মিহি গলায়—‘য়্যুঁ ন রহ রহকর মুঝে তড়পাইয়ে’।

 এই প্রসঙ্গে একটা ব্যক্তিগত ক্ষোভ আর বেদনার কথা উল্লেখ করছি। বিগত যুগে যেসব বাঈজী গজল ঠুংরি দাদরা টপ্পা কাজরী চৈতী হোরী ভোজপুরী বুন্দেলখণ্ডী ঔষী বান্দ্রা খামসা বাবান বাহাই শুনিয়ে তামাম হিন্দুস্তানকে মাতিয়ে রেখেছিল, আজকের ‘রক্ষণশীল ভদ্রজনেরা’ তাঁদের ঘৃণা করে। এখনকার বাঈজীদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা সামাজিক স্বীকৃতির অভাব। সমাজের এক অংশ তাঁদের বাঈজী কিংবা তবায়েফ বলে সমাজে নীচের তলায় দাবিয়ে রাখে। যাঁরা আক্ষরিক অর্থে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের ধারাবাহক সংরক্ষক, তাঁরাই কার্যত সংগীত সমাজের হরিজন। যাঁদের কাছে তালিম পেয়ে অন্যরা হল ‘শিল্পী’, কিন্তু নিজেরা তাঁরা বরাবরের মতন কোঠাবন্দি ‘বাঈজী’। টিভি রেডিওতে তাঁদের গান গাওয়ার এক্তিয়ার নেই, বড়ো বড়ো জলসায় তাঁরা সামান্যতম উল্লেখিত নন। যাঁদের কাছে সংগীত দুনিয়ার বৃহৎ ঋণের কণামাত্রও শোধ করার প্রচেষ্টা হয়নি ১৯৮৪-র আগে পর্যন্ত। সেইসব কিংবদন্তি প্রায় বাঈজীদের অনেকে আজও জীবিত আছেন। কিন্তু সমাজের লাথি খেয়ে অনেকেই এখন গানবাজনার প্রতি উদাসীন। ছেলেমেয়েদের নাচগান না শিখিয়ে স্কুল-কলেজে পাঠাচ্ছেন পড়াশোনা করতে। এক গৌরবের যুগের ধ্বংসাবশেষের মতো এক-একজন তাঁদের কোঠা আগলে পড়ে আছেন। দেখলে চোখে জল আসে।

 এইসব স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া বাঈজীদের সমাজে ফিরিয়ে আনার একটা আন্দোলন গত ১৯৮৪ থেকে চলেছে। গোড়ার দিকে আন্দোলনের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন তিনি কিন্তু সেই অর্থে বাঈজী নন, তার নাম রীতা গাঙ্গুলী।—‘রীতা লখনউয়ের প্রবাসী বাঙালি লেখক, স্বাধীনতাযোদ্ধা, জার্মান সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশারদ ড. কে এল গাঙ্গুলীর দুহিতা। তাঁর বড়ো বোন প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী গীতা ঘটক।রীতার সংগীত ও নৃত্য নিয়ে পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে। রীতার বিবাহ ভিন্ন প্রদেশে হলেও এবং গানের চর্চা উত্তর ভারতীয় রাগধারী সংগীতে হলেও তিনি মনে প্রাণে, সমাজ ও সংস্কৃতিতে বাঙালিই।’৮১

 ‘বাঈজীর শিল্পীসত্তার বিকাশের অনুকূল করে তুলতে হবে সমাজকে’—এই হল রীতার স্লোগান। বাঈজীদের সমাজে প্রতিষ্ঠার ব্রতকে রীতা গুরুবন্দনার অঙ্গ মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও যে পরিবেশে যে-তালিম পেয়েছি তাতে আমিও এক বাঈজী। কিন্তু সমাজ বাঈজী বলতে যা বোঝে আমরা সে বাঈজী নই।’ নিজের গবেষণাকর্মে তিনি বাঈজীদের নতুন নামকরণ করেছেন ‘পেশাদার মহিলা সংগীতশিল্পী’। রীতার গবেষণায় অর্থ সাহায্য দিতে এগিয়ে এসেছে ফোর্ড ফাউন্ডেশন। বাঈজীদের বংশলতিকা রচনায় বহুদিন ধরে ব্যাপৃত আছেন তরুণ গজলিয়া চন্দ্রনাথ। গত ১৯৮৪ সালের ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম নিখিল ভারত বাঈজী বা পেশাদার মহিলা সংগীতশিল্পী সম্মেলন, রীতা গাঙ্গুলীর তত্ত্বাবধানে। এই মহোৎসবে গজল ঠুংরি কাজরী চৈতী প্রভৃতি গানে অংশ নিয়েছিলেন বম্বের শমশাদ বেগম, লখনউয়ের জারিনা আনোয়ারি ও কুমার জাহান, বেনারসের বাগেশ্বরী দেবী, বিকানীরের আত্তা জিলাই বাই, জয়পুরের আফরোজ বেগম, এলাহাবাদের শান্তী দেবী জৈন, মুজফফরপুরের ব্রিজবালা দেবী। বম্বের চন্দ্রকলা, যোধপুরের গৌরী বাঈ, আজমগড়ের রামেশ্বরী দেবী, মুজফফরপুরের রানী দেবী ও জীনৎ বানু, ছাপরার নুরাদন বানু ও ঊর্মিলা দেবী প্রমুখ। সাকুল্যে বাইশ জন। এঁদের অধিকাংশেরই বয়স ষাট ছাড়িয়ে গেছে। প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধা বাঈজীদের কণ্ঠে গান শুনে দিল্লিবাসী একেবারে হাঁ। তাঁরা যেন সারা জীবনে এই স্তরের, এই রসের, এই ঠমকের গান শোনেনি।

বাঈজীদের কোঠা-নিষিক্ত সেই স্বরের, সেই রসের, সেই ঠমকের গজল কাজী নজরুল ইসলাম আর অমর গায়ক কুন্দনলাল সায়গলের কণ্ঠে ভিন্ন মাত্রা লাভ করল। বাদশা-নবাব, আমির-উমরাহদের দরবার ও দহলিজ, বাঈজীদের নাচঘর বা কোঠায় নিয়ত ধ্বনিত গজল আম-জনতা বা সাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। গ্রামোফোন কোম্পানি এসে আম আদমির বৈঠকখানায় গজলকে পৌঁছে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তখনও তা অধিকাংশ মানুষের এক্তিয়ারের বাইরেই থেকে গেছে। বস্তুত, বাঈজীদের মেহফিল যদি গজলের বিষ্ণুপদ হয়, তাহলে সিনেমায় গজলের ভগীরথ সায়গল আর বেগম আখতার। অনভিজাত ভারতীয় শ্রোতাদের কাছে গজলকে পৌঁছে দেওয়ার যাবতীয় কৃতিত্ব এই দুজনের। এছাড়া সেসময় গজল গায়কীর দুনিয়ায় প্রভূত উচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছিলেন মলিকা পুখরাজ, কমলা ঝরিয়া, মাস্টার মদন প্রমুখ।

 তো, দেখা যাচ্ছে, একসময় গজলকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বাঈজীদের মেহফিল, পরে বিগত শতকের তিরিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত গজলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মূলে ছিল প্লেব্যাক গানে তার অনর্গল ব্যবহার। ক্রমে ক্রমে যমুনা বয়ে এসেছে বহুদূর। সময়টা গেল-শতকের সাতের দশক। বম্বের তলপেট থেকে ক্রমাগত মন্থিত হচ্ছে একের পর এক ‘মশালা’ ফিল্ম। মঞ্চ থেকে সরে গেছেন অনিল বিশ্বাস, নৌশাদ আলি, রোশনলাল নাগরথ, মদনমোহন কোহলী, ওমকার প্রসাদ ন্যইয়র, হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়, শংকর জয়কিশন, রামচন্দ্র চিতলকর, বক্স-অফিস কাঁপানো সব নাম! ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন সলিল চৌধুরী, শচীন দেববর্মণ, রবিশংকর শর্মা, মহম্মদ জহুর খৈয়াম, আরও অনেকে। পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, খেমচাঁদ প্রকাশের তৈরি করা প্লেব্যাক গানের মডেলটা বদলে গিয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু ভিত্তিটি মোটামুটি একই ছিল। মেলোডির চূড়ান্ত মহিমা। গড়নটির মধ্যে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে গমাগম করে মতলা, রদীফ, কাফিয়া, কাশিদার নির্দিষ্ট ছাঁচটি। অর্থাৎ, দিনের শেষে গজলই বাদশা। এখানেও মেলোডিই শেষ কথা। যদিও এই ঐতিহ্যটি হাজার বছরের প্রাচীন, এবং গোটা নির্মাণটির মধ্যে নিহিত রয়েছে এক ধরনের নিমীলিত ও ফুরিয়ে যাওয়া সামন্তগন্ধী সুবাস। তাকেই ধরে রাখল হিন্দী সিনেমার গানের ভুবন। এরই মাঝখানে কোনও মতে গুঁজে পড়ে রইল গজল নামক গীতিধারাটিও। পূর্বোক্ত সুরকারদের মধ্যে অনেকেই এই গীতিধারাটি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, বিশেষত মদনমোহন, নৌশাদ, রোশন, রবি এবং খৈয়াম। এঁদের সুরসৃষ্টির আধার ছিলেন মহম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের মতো দিগ্বজয়ী শিল্পীরা। এঁদের যুগলবন্দি থেকে ভারতীয় লোকপ্রিয় সংগীতে গজলের যে জঁরটি রচিত হয়েছিল তার স্বীকৃতি ও প্রাসঙ্গিকতা প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পরেও অম্লান।

 সত্তর দশকের শেষদিকে হিন্দী ছায়াছবির গানের জগতে ভাঁটার পর্ব শুরু হয়ে যায়। গগনস্পর্শী নামগুলি একে একে বিদায় নিতে থাকে। স্তিমিত হতে থাকে মুগ্ধকর গজলের রেশ। সেই অনার্তব সময়ে কতিপয় উচ্চকোটির শিল্পী শ্রোতাদের প্রত্যাশা আর গানের যোগানের মধ্যে ব্যবধানটি পূরণ করার সদিচ্ছায় নেমে পড়েন। তাঁদের মধ্যে প্রধান নামগুলি, যেমন মেহদি হসন, গুলাম আলি, জগজিৎ সিং প্রমুখ ভারতীয় সংগীত ঐতিহ্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। এছাড়া শাস্ত্রীয় সংগীতে, এবং অবশ্যই গজলে, সবিশেষ নৈপুণ্য নিয়ে হাজির হয়েছেন হরিহরণ। এ-ব্যতিরেকে, গুণগত সিদ্ধির নিরীখ নাকতোলা করলে, অনুপ জলোটা, ভূপেন্দ্র, চন্দন দাস, পংকজ উধাস, রূপকুমার রাঠোর, তালাত আজিজ, চিত্রা সিং, মিতালী সিং, সোনালী রাঠোর প্রমুখের নামও বাদ দেওয়া যায় না।

 আমরা সায়গল (১১ এপ্রিল ১৯০৪-১৮ জানুয়ারি ১৯৪৭) থেকেই শুরু করব। কুন্দনলাল সায়গল সেসময় ছায়াছবির হার্টথ্রব হিরো, অথচ তেমনি সুদক্ষ গায়ক। গজল গানে তাঁর সহজাত নৈপুণ্য ছিল। বস্তুত তাঁর গায়নের বা সুর লাগানোর কৌশলটিই ছিল বনেদি গায়কীর অনুসারী।৮২ আক্ষরিক অর্থেই সায়গলে এসে গজল যেন নবজন্ম লাভ করল। ‘সায়গল সৃষ্টিশীল মন নিয়ে গজলের এমন এক নতুন শৈলী, মতান্তরে ফরমুলা চালু করলেন—যাতে একাধারে বাংলার শস্য-শ্যামলা ধরিত্রীর সোঁদা গন্ধ ছিল, আওধের উদারতা ও ভাবালুতা ছিল, আবার পঞ্জাবের বীররস ও উচ্ছলতার ছোঁয়াও ছিল।কোথাও ছিল মীরের সরলতা, কোথাও বা গালিবের গভীরতা।’৮৩

 সংগীতের জগতে সায়গল এত অবিস্মরণীয় প্রতিভা। জন্ম পঞ্জাবের জলন্ধরে।হরিশ্চন্দ্র বালি তাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। তখন তিনি বাংলা জানতেন না, ইংরেজি জানতেন, কথা বলতেন হিন্দি-উর্দুতে। হঠাৎ একদিন তিনি একা কলকাতা বেতার অফিসে এসে উপস্থিত। ‘কলকাতা বেতারের প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর তখন নৃপেন মজুমদার। পঙ্কজকুমার মল্লিক তখন কলকাতা বেতারের সংগীত বিভাগে কিছু কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। নৃপেন ডেকে পাঠালেন পঙ্কজকুমারকে। বললেন—পঙ্কজ, দ্যাখো তো, এই ছেলেটি রেডিয়োতে গাইতে চায়, তুমি ওর অডিশন নাও তো একটু। পঙ্কজকুমার ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন—কী ধরনের গান গেয়ে থাকেন আপনি? জবাব এল—গীত, ভজন, গজল, ঠুংরি এইসব। পঙ্কজকুমার তাঁর গান শুনলেন, শুনে মুগ্ধ হলেন। ছুটে গেলেন নৃপেন্দ্রনাথের কাছে। বললেন—নৃপেনদা, আপনি নিজে এসে একবার শুনে যান। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়ালও তখন কলকাতা বেতারের সঙ্গে সংযুক্ত। তাঁকে নিয়ে নৃপেন এলেন। গান শুনলেন। চমৎকৃত হয়ে বললেন—ওহে, ছেলেটাকে আজই মাইক্রোফোনে বসিয়ে দাও। সেদিনই সন্ধ্যায় ব্রডকাস্ট করা হল একজন অজানা-অচেনা পঞ্জাবি যুবকের দুখানা গজল।’৮৪

এ দেশে তখনও সিনেমায় প্লে-ব্যাক প্রথা চালু হয়নি, গায়ক-অভিনেতার খুব কদর। সায়গল ঢুকলেন নিউ থিয়েটার্সে। ফিলম দুনিয়ায় সায়গলের আবির্ভাবে রাইচাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ‘পুরাণ ভকৎ’ ছবিতে সায়গলকে দিয়ে প্রথম গান গাইয়েছিলেন। ১৯৩৫ সনে মুক্তি পায় প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’। এই ছবিতে দুখানা গানে সায়গল মাত করে দিয়েছেন—‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তোমার রাঙা কপোলখানি’ এবং ‘কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা’। গায়ক-অভিনেতা হিসেবে সায়গল বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৩৬ সনে নির্মিত ‘দিদি’ (হিন্দি প্রেসিডেন্ট) ছবিতে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ। পঙ্কজকুমারের মতে, সায়গল অভিনয়ে মোটামুটি, কিন্তু গানে অসাধারণ। এ-বিষয়ে সম্ভবত কারও দ্বিমত নেই।

 বিশেষত, গজলের দুনিয়ায় সায়গলের সমকক্ষ অন্য কেউ ছিলেন না। তাঁর মধুকণ্ঠে গজল এক নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করেছে, জনপ্রিয় হয়েছে—

‘জানে ক্যয়সে য়্যে দর্দ ছুপায়ে রখুঁ দিল মেঁ
এক শখস ওয়দিম জ্বলায়ে রখুঁ দিল মেঁ।’

 সায়গলের দরদঘন গজলগুলির জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে আজও যখন লোকের মুখে মুখে শুনি—‘দুনিয়া মেঁ হুঁ দুনিয়া কা তলবগার নহীঁ হুঁ’ কিংবা ‘নুকতাচী হ্যয় গমে দিল উসকো সুনায়ে ন বনে’ অথবা—

‘শুক্রিয়া হস্তী কা লেকিন তুনে য়্যে কর দিয়া
পরদে হী পরদে মেঁ আপনা রাজ আসফাঁ কর দিয়া।’

 সায়গলের গজলের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ—তাঁর অনন্য গায়কী। এমনই স্বতন্ত্র তাঁর শৈলী যে অনুকরণ করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। পঞ্চাশের দশকে সি এইচ আত্মা সেই শৈলী আয়ত্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। নৈবেদ্যর চূড়ায় সন্দেশের যতটুকু মূল, গজলের দুনিয়ায় আত্মাজীর গানের অস্তিত্ব তার বেশি কিছু নয়। সায়গলের অনন্যতা এখানেই। তাই বলা যায়, গজলের দুনিয়ায় তাঁরে অনুপস্থিতি খুব বেদনাদায়ক।

 অল্পায়ু প্রতিভাধরের উদ্দেশে প্রায়ই খেদোক্তি শোনা যায়—তিনি অকাল প্রয়াত না হলে সম্ভাবনা ছিল দিগ্বিজয়ের। মহম্মদ রফির ক্ষেত্রে এ আক্ষেপ বহুলাংশে সমর্থিত। হিন্দী ফিলমী গানের এই দুর্দিনে রফির মতো একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মৃত্যু (৩১ জুলাই ১৯৮০) এক বিরাট ক্ষতি। রফির জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯২৪ পঞ্জাবের কোটালা সুলতানসিং গ্রামে। সংগীতে হাতেখড়ি বড়ো দাদা হামিদ মিয়ার কাছে। সায়গল তখন সংগীতাকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। একবার লাহোরে তাঁর প্রোগ্রাম ছিল। রফি সেই অনুষ্ঠানে চারটি গান শোনান। গান শুনে সায়গল তাঁকে বুকে চেপে ধরে বলেন—তেরী আওয়াজ মেঁ বড়া দম হ্যয়, তু এক রোজ নাম কমায়েগা। এই ভবিষ্যদবানী ফলেছিল রফির জীবনে। ফিলমে আসেন ১৯৪১ সনে, প্রথম ছবি পঞ্জাবী ‘গুলবলোচ’। এর পর বম্বে এসে গাইলেন ‘গাঁও কী গোরী’, ‘লয়লা মজনু’, ‘সমাজ কো বদল ডালো’ ও ‘জুগনু’ ছবিতে। জুগনু-র গান ‘র‍্যহাঁ বদলা বফা কা’ তখন দারুণ আলোড়ন তুলেছিল। রফির প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড়ো কথা হল—সেটা ছিল সায়গল ও সুরইয়াদের যুগ, সুরের চেয়ে গলারই দাম ছিল বেশি—রফির আগমনে অবস্থাটা পাল্টে গেল। যাঁরা শাস্ত্রীয় সংগীতে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁদের পক্ষে অন্য সুরকারের নির্দেশে গান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। সায়গলের একাধিপত্য নষ্ট হল। সূচিত হল রফি-লতা-মুকেশের যুগ। রফি ছিলেন নরফনমৌলা গায়ক—সব ধরনের গানে তাঁর দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত।৮৫

 মহম্মদ রফির গজল মানে সিনেমার গজল, বন্দেশী গজল—সেখানে তাঁর মোকাবিলা করার মতো কেউ ছিল না। রফির পরিচ্ছন্ন ও আড়ষ্টতাবর্জিত কণ্ঠে মীড় ও বারিক মুরকিগুলির অদ্ভুত সামঞ্জস্য ছিল। মীড় ওঠানোর সময় স্বরগুলিতে যে কাঁপন হত, তা অন্যান্য গায়কের গলায় দুর্লভ। তাঁর একটি জনপ্রিয় গজল নিচে উদ্বৃত করছি। গীত ঢঙে ক্যাইফি আজমির লেখা ও মদনমোহনের সুর দেওয়া এই গজলটি তিনি গেয়েছেন ‘হকীকৎ’ ছবিতে। এতে কোনো স্থায়ী-অন্তরা নেই, আছে শুধু দরদ আর সুরের খেলা—

‘ম্যয় য়্যে সোচকর উসকে দর সে উঠা থা
কি উও রোক লেগী, মনা লেগী মুঝকো।
হওয়াওঁ মেঁ লহরাতা আতা হ্যয় দামন
কি দামন পকড়কর বিঠা লেগী মুঝকো।
কদম এ্যয়সে অন্দাজ সে উঠা রহে থে
কি আওয়াজ দেকর বুলা লেগী মুঝকো।
নগর উসনে ন রোকা, ন উসনে মনায়া
ন দামন হী পকড়া, ন বিঠায়া মুঝকো।’

 সায়গলের জীবনাবসানের পর নন-ফিলমি গজলে সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন অখতার বাঈ ফৈজাবাদী, যিনি পরবর্তী কালে বেগম অখতার (৭ অক্টোবর ১৯১৪-৩০ অক্টোবর ১৯৭৪) নামে বিখ্যাত হয়ে উঠে গিয়েছিলেন জনপ্রিয়তার শেষ চূড়ায়। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়—‘যেমন শ্বেতপাথর ছাড়া অন্য কোনো পাথরে তাজমহলের কল্পনা করা যায় না, তেমনি বেগম অখতার ছাড়া গজলের কল্পনা অসম্ভব।’৮৬

 এটি অতিশয়োক্তি নয়—বাস্তবিকই বেগম অখতার ছিলেন সংগীতাকাশের ‘অখতার’ অর্থাৎ নক্ষত্র। জন্ম ফৈজাবাদে। সংগীতচর্চা ছিল ঘরানাগত। বাঈজীদের ঢঙে গাইতেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল অখতার বাঈ। এই নাম তাঁর পছন্দ ছিল না। স্বামী ছিলেন লখনউয়ের নামজাদা ব্যারিস্টার, তিনিও চেয়েছিলেন স্ত্রী ‘বাঈ’-এর বদলে ‘বেগম’ নামে পরিচিত হোন। তিনি অখতারকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। বেগম সাহিবা পারসি থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানিতে গায়িকা রূপে যোগ দেন। মাঝেমধ্যে অভিনয় ও নৃত্যও পরিবেশন করতে হত। অভিনয়-নৃত্য-গীতে বেগম অখতার বিনা মাইকে যে গান গাইতেন তবলা, বাঁশি, বেহালা, ক্ল্যারিওনেট, ঘুঙুর ও হারমোনিয়মের সমবেত যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে যে গানের বিশেষ আবেদন ছিল প্রথম সারির ধনী ‘বাবু’ দর্শকদের কাছে, তাঁরা উচ্ছ্বাসে চেয়ারের হাতলে উঠে বসতেন এবং ‘ওয়ানস মোর’ ধ্বনি তুলে প্রিয় গান একাধিকবার গাওয়াতেন। আক্ষেপের কথা সেই সময় তিনি গালিব-মীর-জোকের ভাণ্ডার উজাড় করে দেবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করা সত্ত্বেও কলকাতার সাড়া পাননি। কেন-না সেই গান ‘বাবু’দের তেষ্টা মেটাতে পারেনি। অখতারে গজল গায়কী ছিল পরিচ্ছন্ন, মার্জিত এবং তাই তার আবেদন ছিল পরিশীলিত ও নান্দনিক চিত্তবিনোদনে সীমিত। তাই তিনি চলে গিয়েছিলেন বম্বে। সেখানকার রেডিয়ো স্টেশনটা ছিল ব্যালার্ড পিয়রের অট্টালিকায়। বড়ো একটি হলের পাশে ঘোষকের কামরা, হলের বাইরে অপেক্ষাগৃহ। বেগম অখতার একদিন সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। বিভিন্ন নামকরা শিল্পীদের—শামসুদ্দীন খাঁ, কামুরাও মঙ্গেশকর, রত্নাকর রামনাথকর, গোবিন্দ ইয়াল্লাপুর, নিমকর, দীনকর রাও এবং রেডিয়ো স্টার শ্রীধর পার্সেকরের বাঁকা হাসি উপেক্ষা করে অখতার গিয়ে ঢুকলেন জুলফিকার খান রোখারির চেম্বারে। গান শুনে মুগ্ধ হলেন বোখারি সাহেব।সেদিনই অখতারের একটি গজল রেকর্ড করা হল—

‘দিওয়ানা বনানা হ্যয় তো দিওয়ানা বনা দে….’

 গজলের অর্থ গৌণ। শায়র সম্ভবত বহজাদ, শকীলও হতে পারেন। কিংবা আর কেউ। কে এই গজলের রচয়িতা, কেই বা সুরকার তা কখনও জানবার ইচ্ছা হয়নি আমার। কিন্তু কলের গানে প্রথম যেদিন শুনি গানটা, সেদিন সুর ও কথা ছাপিয়ে গায়িকার বেদনাসিক্ত কণ্ঠস্বর, রেকর্ডের ঘস ঘস আওয়াজ সব মিলে আমাকে বস্তুজগৎ থেকে প্রবলবেগে টেনে-হিঁচড়ে কোন দূরদূরান্তে এক অজানা জগতে নিয়ে চলে গিয়েছিল।

 ভাব-লয়-স্বর-সুরের ওপর সুন্দর দখল ছিল বেগম অখতারের। এই বিশেষত্বের কারণেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মলিকা-এ-গজল’। গজলের প্রথম স্বর-অনুরণনটা হওয়া উচিত অবগুণ্ঠনবতী নারীর মতো। শ্রোতা সেই ঘোমটার ফাঁকে দৃষ্টি প্রেরণ করার চেষ্টা করবেন। চন্দ্রমুখের ওপর করাল কুশ্রী রাহুগ্রাসের মতো অস্বচ্ছ ওড়নার অবগুণ্ঠন ক্রমে ক্রমে অপসারিত হতে থাকবে। আর গানের যবনিকার পূর্বমুহূর্তে তা সম্পূর্ণ উন্মোচিত হবে। বেগম সাহিবার গলায় এই জাদু ছিল।

 আগেই বলেছি বেগম অখতারের গাইবার ঢঙটা ছিল বাইজিদের মতো। কোনো অহংকারী অভিনিবেশ তাতে ছিল না। মঞ্চের ওপর তানপুরা নিয়ে বসার ভঙ্গিটা ছিল কুলীন। প্রথমে আদাব জানাতেন শ্রোতাদের উদ্দেশে। সেটা কমন এটিকেটের মতো—না অতি নম্র, না দাম্ভিক।গানের ফাঁকে ফাঁকে বাঁ হাতের তর্জনী ও মধ্যমা জুড়ে শেরের মিসরা আউড়ে ছুড়ে দিতেন শ্রোতার দিকে। কারুকে মাত করার প্রবৃত্তি তাতে থাকত না, কিন্তু তাতেই শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে বয়ে যেত অদ্ভুত এক শিরশিরানি। উৎফুল্ল শ্রোতাদের মধ্যে ‘কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ’ গুঞ্জন উঠতো। মুহুর্মুহু ঘটে যেত করতালির করকাপাত। অথচ তান পালটানোর ফালতু সার্কাস বা তানের বাজি ফাটানোর ব্যাপারটা ছিল বেগম সাহিবার উশুলের খেলাপ। গাইতেন খুব আদুরে গলায়—নারীসুলভ, মোহময়ী, স্নেহার্দ্র, শীতল কণ্ঠে। ‘আজ যে গজলের ঝোড়ো জনপ্রিয়তা সে তো ফিলমি, অশিক্ষিত, কাব্যরহিত গজল’—বলেছেন রীতা গাঙ্গুলী—‘বেগম অখতারের সেই তন্নিষ্ঠ আচারনিষ্ঠ, কাব্যময় গজল কজন শুনেছে?’—

‘দর্দ মিন্নত কশ-এ-দওয়া ন হুয়া
ম্যঁয় ন অচ্ছা হুয়া বুরা ন হুয়া।’

 বেগম সাহিবার জীবনের শেষ বছরটি কলকাতার মানুষের কাছে চিরস্মরণীয়। তাঁর বয়স তখন ষাটের ওপারে, অথচ তাঁর কণ্ঠে ভর করেছে এক আশ্চর্য যৌবন। সত্তর দশকের মধ্যবর্তী এই সময়টায় তিনি সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গানগুলি গাইছিলেন। তাঁর এক অনুষ্ঠানের আলোচনায় ‘দেশ’ পত্রিকায় শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ইয়েটসের পরিণত বয়সের কবিতার প্রসঙ্গ এনেছিলেন। ওই অসম্ভব যৌবনের মধ্যেও একটা মৃত্যুর প্রচ্ছায়া তিনি লক্ষ করেছিলেন। সেবার কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার দিন কতকের মধ্যেই, আহমদাবাদে ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪ তাঁর ইন্তেকাল হয়।

 আস্তিকেরা যাকে বলে ‘ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা’ সেই ধরনের কিছু নিশ্চয়ই ছিল বেগম অখতারের মধ্যে। শম্ভুনাথ মিশ্র লিখেছেন—‘তাঁর গলায় এমন কিছু ছিল যা অন্যান্য গজল গায়ক বা গায়িকার মধ্যে দুর্লভ। তাঁর আওয়াজে এমন একটা দরদ ছিল, যাতে তিনি যখন গালিব, জিগর, ফয়েজ বা শকীলের গজল গাইতেন—তখন শ্রোতারা রোমাঞ্চ অনুভব করতেন। তাঁর গানে একটা স্বতন্ত্র ভঙ্গি ছিল, ভাবে ছিল স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য। হাজার হাজার শ্রোতার মাঝেও মনে হত তিনি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে গাইছেন।’৮৭—এই খাস রবিশ বা স্টাইলের নাম মুক্ত গজল বা খুলী গজল। মেহফিলের গজলও বলা চলে। এই শৈলীতে তরন্নুম ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি খোলে, শিল্পীর ওস্তাদি প্রকাশ পায়। এতে বাদ্যযন্ত্রের ভূমিকাও যথেষ্ট। মুজরো ঢঙের গজল মানে এই খুনি গজল। বেগম সাহিবা এই ঢঙের গজলেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

 একটা কথা তাবড় তাবড় শিল্পীরাও মাঝে মাঝে ভুলে যান যে গজল গাওয়ার সময় মীড়ের ওঠানামা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয়। মীড়টা যেখান থেকে শুরু করে যেখানে গিয়ে শেষ হয়—একটা নির্দিষ্ট সময়ে, সেই সময়জ্ঞান—এটা একটা মস্ত বড়ো বিবেচ্য বিষয়। বেগম সাহিবা এই ধরনের জ্ঞানী ছিলেন। শুধু স্ববিরোধ নয়, তার সঙ্গে লয়বোধেরও একটা সামঞ্জস্য থাকা চাই। লয়বোধহীন গজলের কোনো দাম নেই। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বলেছেন—যে সমস্ত সৃষ্টি কোনো সংগীতের মধ্যে স্বর দিয়ে হয়ে থাকে, সেখানে লয়ের সামঞ্জস্য বিধান অত্যন্ত আবশ্যিক। নইলে সৃষ্টি নিরর্থক। লয়বোধ গণিতশাস্ত্রের মতো কোনো স্থির নিশ্চিত ব্যাপার নয়। অঙ্ক কষে সেটা বোঝানো অসম্ভব। এক অর্থে গানের গতিকে বোঝানোর ক্ষমতাকেই লয়বোধ বলা যায়। ইংরেজিতে যাকে অনুভূতি-স্পেস বলে,—তা কি লিখে বোঝানো যায়? সে গতিবোধ বা স্পেস একটা মেধা, ইনটিউশন বা স্বতোঃলব্ধ জ্ঞান।৮৮ অন্তরের গভীরে স্তরে স্তরে এই যে লয়ের অনুভূতি, অনুভূতি-জ্ঞান ও উপলব্ধি—এটা না থাকলে গজলের ভাবের প্রকাশই হয় না। এই অনুভূতি, কোনটা কতদূর যেতে পারে বা পারে না—বেগম অখতার ভালোভাবেই জানতেন। পরিমিতির সম্যক জ্ঞান তার মধ্যে পুরোমাত্রায় ছিল।

 তাঁর গায়কীয় বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলব। লয়ের যে পথ বা যাকে বলে লয়ভঙ্গ, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এক, আধ, চার, একের আট, একের ষোলো এইরকম কিছু বুনিয়াদি ভাগ থাকে। কিন্তু মাত্রাগুলিই সব নয়। শিল্পী ওইসব ভগ্নাংশ নিয়ে যখন গজল গান তখন তার মধ্যে একটা ছবিও আঁকেন—যা রাগের প্রতিকৃতি।এই ভগ্নাংশ আসে সৌন্দর্যবোধ থেকে। এ-কথা অনস্বীকার্য যে শ্রোতারা আজও বেগম সাহিবাকে স্মরণ করে তাঁর সুরেলা টেনে তোলার স্বরকাজ ও অস্থায়ী অন্তরার পর সর্পিল গতিতে বিলম্বিত বিহার-এর বিশেষত্বের জন্যেই। কিন্তু তাঁর স্বরজানের মোহিনী জাদুটা থাকত একটি মাত্র স্বরে—ওপরের ষড়জে। সেই ষড়জ কানে এসে পড়লেই সমস্ত কাজকর্ম, কোলাহল, কথাবার্তা, গুনগুনের একশেষ—

‘অয় মোহব্বৎ তেরে অনজাম পে রোনা আয়া
জানে ক্যুঁ আজ তেরে নাম পে রোনা আয়া।’

 বুকের ভেতর কান্না গুমরে ওঠে। এই গজলের শায়র শকীল আজ বেঁচে নেই, আর এটিকে যিনি চোখের জলে ভিজিয়ে গেয়েছিলেন সেই বেগম সাহিবাও ইহলোকে নেই। কিন্তু তীর্থে যারা যেতে পারে না তারা তীর্থ-ফেরত বন্ধুদের আলিঙ্গন করেই তীর্থের স্বাদ মেটায়। আমাদেরকেও তেমনি আজ ঘ্যাসঘেসে রেকর্ডে বেগম সাহিবাকে শুনে তার গায়ে মমতার হাত বুলিয়ে আবার সযত্নে তুলে রাখতে হয়। ব্যথা পাই? থাক সে-কথা। এখন উদ্ধৃত করি মীর তকী মীরের লেখা একটি গজল, যেটি আমার মনে হয়—বেগম অখতারের গাওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ গজল—

‘উল্টী হো গয়ীঁ সব তদবীরেঁ, কুছ ন দওয়া নে কাম কিয়া
দেখা, ইস বিমারি-এ-দিল নে, আখির কাম তমাম কিয়া।
অহদে-জওয়ানী রো-রো কাটী, পীরী মেঁ লী আঁখেঁ মুঁদ
য়্যানী রাত বহুত থে জাগে, সুবহ হুই আরাম কিয়া।
নাহক হম মুজবুরোঁ পর, য়্যহ তোহমত হ্যয় মুখতারী কী
চাহতে হ্যঁয় সো আপ করে হ্যঁয়, হমকো অবস বদনাম কিয়া।
য়্যাঁ কে সুপইদ-ও-সিয়াহ মেঁ হমকো, দখল জো হ্যয় সো ইতনা হ্যয়
রাত কো রো-রো সুবহ কিয়া, অওর দিন কো জুঁ তুঁ শাম কিয়া
‘মীর’ কে দীন-ও-মজহব কো অব পুছতে ক্যা হো, উননে তো
কশকা খঁইচা, দ্যর মেঁ ব্যয়ঠে, কব কা তর্ক ইসলাম কিয়া।

 বেগম অখতারের সমীপকালীন তালাৎ মাহমুদের (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯২৪-৯ মে ১৯৯৮) গজলও বেশ জনপ্রিয় ছিল। আজকের বহু ঠাকুরদার কৈশোর ও যৌবনকে ভরিয়ে রেখেছিল তালাৎ তাঁর বলিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন কণ্ঠ এবং অনুপম গায়কী দিয়ে। তাঁর গজল ছিল জীবন ও প্রকৃতির সমন্বয়—‘বাস্তবকল্প প্রতিরূপ’। নীরব শেরকে মুখর করতে তাঁর জুড়ি ছিল না—

‘ম্যঁয় তো পরেশাঁ হো গয়া তুমহারী ইশকবাজী সে
অব ছোড়ো ভী দামন, মুঝে বাহর জানে দে।’

 এটি যদি মামুদ না গাইতেন তবে আমরা জানতেই পারতাম না, নবাব ওয়াজিদ আলির এক আত্মীয় ইয়াসিন আলি, যিনি মেটিয়াবুরুজের এক জীর্ণশীর্ণ প্রপিতামহ বাড়ির মালিক, কিছু গজল লিখেছিলেন। মামুদের গায়কীর প্রধান খাসিয়ৎ ছিল ভাবলেশহীন কথা ও দরদ ঢেলে গাওয়া। তাঁর গানেই ছিল এক ধরনের ভাবময়তা।তাঁর এক-একটি গজল স্পর্শকাতর ফুলের মতো—সেটি সুন্দর, সুবাসিত—কিন্তু ছুঁলেই ঝরে যাবে। এই বিশেষত্বের কারণে মামুদকে আজও ভোলা শক্ত। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক নির্মলা অরুণ কিংবা মুসদ্দিদ নিয়াজীকে ভুলে যাওয়া হয়েছে সহজ।

 অন্যদিকে, বেগম অখতারের ঢঙে গজল গেয়ে নাম করেছেন এরকম শিল্পীর সংখ্যা অগণন। বম্বের শোভা গুরটু (৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫-২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৪) তাঁর উপযুক্ত শার্গিদ। শোভার গলায় ক্ষমতা ছিল, গায়নে ছিল বিশিষ্ট উপশাস্ত্রীয় গায়কীর তালিম। অবশ্যি গজলের ভাষায় তেমন দখল ছিল না, যা মাঝে মাঝে কানে লাগত। এই দোষ থেকে মুক্ত হতে পারলে, অমন গলা ভারত-পাকিস্তানে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। রাজ খোসলা নির্দেশিত তথা লছমীকান্ত-প্যারেলালের সুরারোপিত ১৯৭৮ সালের হিট ছবি ‘ম্যয় তুলসী তেরে আঙ্গন কী’ ছবিতে শোভার মুজরো ঢঙের গজল ‘সইঁয়া রুঠ গয়ে ম্যঁয় মনাতী রহী’ যাঁরা শুনেছেন এ মন্তব্যের তাৎপর্য তাঁরা বুঝবেন।

 বেগম অখতারের বিশিষ্ট গায়কীর অবিকল ছাব্বা শোনা যায় জরিনা বেগমের আসরে। জরিনার বিখ্যাত গান ‘আজ নহীঁ তো কল হ্যয় আতা মেরে পাস’-এর মুখটা হুবহু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে অখতারের গাওয়া ‘ওয়াফাওঁ কে বদলে জফা কর রহে হ্যঁয়’-এর মুখে। একই ভাবে অখতারের কণ্ঠস্বর সমেত গায়কী ভেসে উঠতে চায় মধুরাণী দেবীর জনপ্রিয় গান ‘হমে তো আপ দিওয়া বনা দিয়ে’-এর ভেতর থেকে।

 বেগম অখতার যখন সেবার কলকাতার মেহফিলে গাইছিলেন, তাঁর পেছনে বসে তানপুরায় গলা মিলিয়ে তাঁকে গানে সহযোগিতা করছিলেন এক নজরকাড়া সুন্দরী তরুণী। দর্শকেরা তাঁকে ক্রমান্বয়ে ভুল করছিলেন বেগমের কন্যা বলে। সেই সুন্দরীটি ছিলেন আজকের বাঈজীদের সমাজে প্রতিষ্ঠায় ব্রতী রীতা গাঙ্গুলী (জন্ম ১৯৪০)। গর্ভে ধারণ না করলেও রীতা ছিলেন বেগমের কন্যার মতোনই। ‘সিদ্ধেশ্বরী দেবীর এই ছাত্রীটিকে বেগম নিজে গিয়ে চেয়ে এনেছিলেন নিজের গানের সঙ্গে তালিম দেবেন বলে। যেমন করে তারও বছর কয়েক আগে সিদ্ধেশ্বরী চেয়ে নিয়েছিলেন রীতাকে কত্থক গুরু শম্ভু মহারাজের কাছ থেকে। এই সৌভাগ্য কজন সংগীত শিক্ষার্থীর হয়?’৮৯ কলকাতার প্রৌঢ় মানুষের মনে এখনও স্মৃতি আছে বেগমের পাশে বসা তরুণী রীতার দড় কণ্ঠধ্বনির, ত্রিসপ্তকব্যাপী সুরেলা চলাচলের, ঠুংরির অনবদ্য মেজাজের, গজলের উর্দুর চোস্ত উচ্চারণের, শিল্পীসুলভ মগ্ন চোখের। রীতা গাঙ্গুলী বেগম অখতারের একনিষ্ঠ অনুগামিনী ও আজকের ফিলমি গজলের উগ্র বিরোধী—‘আজকের অধিকাংশ শিল্পীরা তো উর্দু উচ্চারণই জানেন না, তাঁদের গান সুরেলা হোক, জনপ্রিয় হোক, গজল হবে কেন? গজলের সঙ্গে ফিল্মি গানের তাহলে তফাত থাকল কই?’ মেহফিলে গানের জটিল জায়গায় সুর ধরতে বলে রীতাকে মস্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে নিক্ষেপ করতেন বেগম অখতার। রীতা তাতে জয়ী হতেন। বেগম আজ নেই, কিন্তু রীতার গজলে এখনও তিনি জীবিত।

 বেগম অখতারের উচ্চারণ, ভঙ্গি, সুর ও গায়কী রক্তের মতোই চলে এসেছে তাঁর আর এক কন্যাসমা শিষ্যা শান্তি হীরানন্দের (১৯৩২-১০ এপ্রিল ২০০৭) মধ্যে। বেগম অখতারের কাছে উপশাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাথমিক তালিম, পরে অন্ধশিল্পী ইন্দিরা কোহলী ও এজাজ হুসেন খাঁয়ের তালিম—শান্তি তাঁর গানে তিন গুরুর তিন শিক্ষারই ত্রিবেণী সংগম ঘটিয়েছেন। তাঁর গজল পাকিস্তানেও বেশ জনপ্রিয়। সে-দেশের বিখ্যাত গজল গায়িকা ইকবাল বানো ও ফল্লিদা খাতুনের মতে ভারতবর্ষে এই সেদিন পর্যন্ত মজলিশি গজল একমাত্র শান্তিই জিইয়ে রেখেছিলেন। সুখের কথা, শান্তি কখনো বাজারি গজলের স্রোতে ভেসে যাননি।

সেই রাজন্যপোষিত যুগ আর নেই। মালকাজান আগ্রাওয়ালী, গওহরজান, ছপ্পন ছুরি, কমলা ঝরিয়া, বেগম আখতারের দিনও ফুরিয়েছে। গজল গানে এখন অন্য সুর, অন্য রং। এখন গজল শুধু মেহফিলের গান নয়। এখন গজল একটা ক্রেজ—একটা ফ্যাশন।

 এ-কথা বুঝিয়ে দরকার নেই যে সাধারণ মানুষই সত্যিকারের অসাধারণ। অন্তত রুচির দিক থেকে। আজ একরকম, কাল আর এক। বেগমের গানে এখনকার ছেলেদের মন ভরে না, অনেকে তাঁর নামই শোনেনি। যারা প্রথমে কিশোর-আশার মৌতাতে বুঁদ হয়ে ছিল তাদেরও মনটা হেজে গেছে ওই পচা লিরিক আর বাসি গলায়। তাদের দরকার নতুনত্ব—সে যাই হোক না কেন, নতুন হওয়া চাই। সংগীতের কর্মকর্তারাও তাদের মন ভরাতে মাঝেমধ্যে বাজারে ছাড়ছেন ‘নতুন কিছু’। সাধারণ মানুষের উদ্ভট খেয়ালের দৌলতে পঞ্চদশী নাজিয়া হাসান প্ল্যাটিনাম গার্ল। মোদ্দা কথা, মালটা নতুন হওয়া চাই—ভালো লাগলে ভালো, খারাপ লাগলে নো কোশ্চেন।

 গজলকে ড্রিম ফুলফিলমেন্টের কাজে লাগাতে আশির দশকের মাঝামাঝি (১৯৭৬) এক মস্ত বড়ো পথ দেখাল জগজিৎ-চিত্রা সিং জুটির ‘দ্য আনফরগেটাবলস’। হিন্দি ফিলম অহর্নিশ যে স্বপ্নরাজ্যের চাবি ঘোরায়, সেই চাবিকাঠি ফিলমে ছাড়াই প্রথম রপ্ত করল একটি এল পি রেকর্ড। এর পর গজলকে আর রাস্তা বাতলে দিতে হয়নি, সে নিজের খাল নিজেই কেটে চলল।রাজকুমার-ইন্দ্রাণী, রাজেন্দ্র-লীনা, ভুপেন্দ্র-মিতালী, রূপকুমার-সোনালী, তালাৎ আজিজ, পঙ্কজ উধাস, অনুপ জলোটা, পিনাজ মসানি—সবাই উঠে পড়ে লাগলেন Ghazals Era গড়ার কাজে। শ্রোতাদের মন মজে গেল বাহারি গজলে। ‘সাত সহেলিয়াঁ খড়ী’ খড়ী ছাঁদের ছেঁদো গান তারা আর নেবে না—জগজিৎ-পঙ্কজের মাধ্যমে সেই প্রতিবাদ তাদের। শহরে তো বটেই, শহরতলী আর গ্রামেও টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেট ফাঁসিয়ে লোকে গজল শুনছে। জিনস, খেলোয়াড় গেঞ্জি, চার্মস, বিলিতি লাইটার, ব্রুস-লী কিংবা অমিতাভের ছবির মতো এখন ‘হর শাম গজল কে নাম’।

 গজল কিন্তু একদিনে ক্রেজ হয়নি। একটা হিসট্রি আছে। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে, যখন সায়গলের মার্জিত ও পরিশীলিত গজলের রেশ পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি এবং যখন বেগম অখতার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত—সেই সময় মেহেদি হাসন (১৮ জুলাই ১৯২৭-১৩ জুন ২০১২) প্রথম ভারতে আসেন। অবশ্য, জন্মসূত্রে মেহদি হসন ভারতেরই। রাজস্থানের ঝুঁঝনুঁ জেলার লুণা গ্রামে জন্ম। বংশের পাঁচটি প্রজন্ম ইতিপূর্বে কলাবন্ত ঘরানার সংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সংগীতে মেহদির প্রাথমিক শিক্ষা পিতা উস্তাদ আজিম খান আর কাকা উস্তাদ ইসমাইল খানের কাছে। ভারত-বিভাজনের পর পরিবারটি চলে যায় পাকিস্তানে। সেখানে মেহদি কিছুকাল একটি সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করেন, পরে মোটর মেকানিকেরও চাকরি করেন। কিন্তু গানের প্রতি তাঁর যে জুনূন, তা কিন্তু হৃদয়ে রয়েই গেছিল। ভারতে আগমনের আগেই মেহেদি খুলী গজলের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে পাকিস্তানে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভারতে তখনও স্থায়ী মতলাকে তালবদ্ধ করে খুলী গজল গাওয়ার প্রচলন ছিল। এই রীতিতে অন্তরা মিসরা গাওয়ার সময় তাল পুরোপুরি থামিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু মেহদি যে প্রয়োগটা করেছিলেন তাতে তাল থামে না—নিরন্তর চলতে থাকে। এই পদ্ধতিতে তালের বাইরেও শিল্পী নিজের মুনশিয়ানা প্রকাশ করতে পারেন। পাকিস্তানে গুলাম আলির মতো উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পীও এই শৈলীতে গজল গেয়েছেন এবং আমাদের জগজিৎ সিংয়ের খ্যাতি এরই জন্যে।

 পাকিস্তানি গজল গায়কীতে তখন তিনটি নাম—মেহদি হাসন, গুলাম আলি এবং ফরিদা খানুম। মেহদির গলা অদ্ভুত মিষ্টি, সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ বোলবাণীর সমন্বয়ে ছন্দের বৈচিত্র্যে লয়ের ওপর অধিকার—সব আছে তাঁর। ত্রিসপ্তকে অনায়াস সঞ্চারী গতির সৌন্দর্যই বা কম কীসের? কণ্ঠের ওটানামায় প্রকাশ পায় তার শিল্পসৃষ্টির নৈপুণ্য। তাঁর অজস্র জনপ্রিয় গজলের মধ্যে একটির উদ্ধৃতি নিচে দিলাম।এই সুন্দর গজলটির রচয়িতা আহমদ ফরাজ—

‘অজব জুনুনে মুসাফত মেঁ ঘর সে নিকলা থা
খবর নহীঁ হ্যয় কি সূরজ কিধর সে নিকলা থা।
য়্যই কওন ফির সে উনহেঁ রাস্তোঁ মেঁ ছোড় গয়া
অভি-অভি তো অজাবে-সফল যে নিকলা থা।
য়্যে তীর দিল মেঁ মগর বেসব্ব নহীঁ উতরা
কোই তো হর্ফ লবে-চারগার সে নিকলা থা।
উও ক্যয়সে অব জিসে মজনু পুকারতে হ্যঁয় ফরাজ
তেরী তরহ কোই দিওয়ানা ঘর সে নিকলা থা।’

 দেশ ভাগ হলে মানুষের গমনাগমন ব্যাহত হয় মাত্র, শিল্পীর কণ্ঠস্বর সীমান্তের চৌহদ্দি লংঘন করেও গুঞ্জরিত হতে থাকে। মেহদি হসনের মখমল কণ্ঠ অদ্যাপি সীমান্তের দুই পাশে অনুরণিত—

‘দিল কী বাত লবোঁ পর লা কর অব হম দুখ সহতে হ্যঁয়
হম নে সুনা থা ইস বস্তী মেঁ দিল ওয়ালে রহতে হ্যঁয়।’
‘য়ে মানা জিন্দগী হ্যয় চার দিন কী
বহুত হোতে হ্যঁয় য়্যারো চার দিন ভী’
‘দেখ তো দিল কি জাঁ সে উঠতা হ্যয়
য়ে ধুয়াঁ সা কহাঁ সে উঠতা হ্যয়’

 গুলাম আলির জন্ম ৫ ডিসেম্বর ১৯৪০ পাকিস্তানের সিয়ালকোটে। গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান। গুলাম আলি গজলে সচরাচর স্বয়ং সুরারোপ করেন। এছাড়া অন্যের সুরেও বেশ কিছু গজল গেয়েছেন। গুলাম আলির লোকপ্রিয়তা তাঁর চটুল অঙ্গের গজলের জন্য। কিন্তু তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতে পাকা ওস্তাদি ভরাট গলায় উঁচুদরের নাট্যময়তা বিদ্যমান। রাগরূপ উন্মোচনে যন্ত্রপাতির স্বর সমন্বয়ে যে আবেদন সৃষ্টি করেন গুলাম তা নিঃসন্দেহে মর্মস্পর্শী। মীড়ের টানে যে সূক্ষ্ণতর স্বরধ্বনির প্রয়োগ নৈপুণ্য অসামান্য দক্ষতায় বিভাসিত হয়, মধুকণ্ঠে স্বরধ্বনির রেশ ধরে স্বরের বিচিত্র লীলার যে প্রকাশ ঘটে সেখানে তিনি অনন্য। রাগরূপের প্রকাশ বেদনায় গুলাম আলি যেন নিজেকেই প্রকাশ করতে চান। গজলের মকতা অংশে তিনি কণ্ঠে বেদনা বা দরদ ফুটিয়ে তোলার সমস্ত সম্ভাবনার শেষ সীমাটিকে বারবার ছুঁয়ে যান প্রদর্শনের জন্য নয়, অন্তরের প্রেরণার তাগিদে। ‘চুপকে চুপকে রাত দিন আঁসু বহানা য়্যাদ হ্যঁয়’ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। স্যর মহম্মদ ইকবালের লেখা গুলাম আলির একটি শ্রেষ্ঠ গজল এখানে উদ্ধৃত করছি—

‘কোই সমঝায়ে য়্যহ ক্যা রঙ হ্যয় ময়খানে কা
আঁখ সাকী কী উঠে নাম হো পয়মানে কা।
গর্মি-এ-শম্মা কা অফসানা সুননেওয়ালোঁ
রুখস দেখা হী নহীঁ তুমনে অভী পরওয়ানে কা।
কিসকো মালুম থী পহলে সে খিরদ কী কীমৎ
আলামে-হোশ পয় অহসান হ্যয় দিওয়ানে কা।
চশমে-সাকী মুঝে হর গাম পয় য়্যাদ আতী হ্যয়
রাস্তা ভুল ন জাউঁ কহীঁ ময়খানে কা।
অব তো হর শ্যাম গুজরতী হ্যয় উসী কুচে মেঁ
য়্যহ নতীজা হুয়া লাসেহ তেরে সমঝানে কা।’

 ‘আজ জানে কী জিদ ন করো’—মশহুর পাকিস্তানি শায়র ফৈয়াজ হাশমীর লেখা এবং সোহৈল রাণার সুরবদ্ধ এই বিখ্যাত গানটি শোনেননি এমন শ্রোতা সম্ভবত নেই বলেই মনে হয়। গজলটি অনেকেই গেয়েছেন, এমনকি এদেশের আশা ভোঁসলেও গেয়েছেন; এবং গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার বিজেতা মীরা নায়ারের ‘মনসুন ওয়েডিং’-এও এটি ব্যবহৃত হয়েছিল; কিন্তু গজলটিকে প্রথম যিনি জনপ্রিয়তার উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছে দেন, তিনি ‘কুইন অফ গজল’ ফরিদা খানুম। ১৯২৯ সনে কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ফরিদা। পাকিস্তানি মৌসিকীর দুনিয়ায় এঁর খ্যাতি মূলত গজলের কারণে হলেও ইনি দাদরা, খেয়াল এবং ঠুমরির জন্যও সুখ্যাত। গুরু ছিলেন উস্তাদ আশিক আলি খান। ১৯৫০ সালে ২১ বছর বয়সে একটি পাবলিক কনসার্টের মাধ্যমে ফরিদার আত্মপ্রকাশ। ভারতে আসার আগে ইনি পাকিস্তান ও কাবুলে গজল গেয়ে প্রভূত নাম কুড়িয়েছিলেন।

 পাকিস্তানি গজলিয়াদের মধ্যে প্রথম ভারতে এসেছিলেন মেহেদি হাসন। তারপর সাবিরী কাওয়াল, ওস্তাদ সলামৎ আলি খাঁ, গুলাম আলি, ফরিদা খানুম আরও অনেক শিল্পী। সত্তর দশকের দোর গোড়ায় মেহেদির সংবর্ধনা ও সমর্থনেই ভারতবর্ষে বাহারি গজলের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ভারতকে নিজের সুরে মাতিয়ে দিয়ে গেলেন মেহেদি, তার পরেই দেখতে দেখতে গজলের সুবাসে ভরে গেল ভারত। এদেশীয় গায়ক-গায়িকারা অনতিবিলম্বে উঠেপড়ে লাগলেন মেহেদির সুরে সুর মেলাতে।৯০

 তরুণ জগমোহন সিং ধিমান ওরফে জগজিৎ সিং (৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১-১০ অক্টোবর ২০১১) তখন পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ ডিগ্রি নিয়ে প্রখ্যাত হাস্যাভিনেতা ওমপ্রকাশের নিমন্ত্রণে সদ্য বম্বে এসেছেন। হোটেল সিঙ্গার হিসেবে কিছুটা খ্যাতিও পেয়েছেন। কিন্তু সে খ্যাতি তো ঠুনকো, তাই তিনি তৃপ্ত ছিলেন না। তিনি সিনেমায় গাওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁকে সে-সুযোগ দেননি। সেই দুঃখ তিনি ভুলতে পারেননি—

‘জানে কে সবকুছ, কুছ ভী ন জানে হ্যঁয় কিতনে অনজানে লোগ
বক্ত পর কাম নহীঁ আতে য়্যে অনজানে লোগ।’

 গান ছেড়ে মডেলিংয়ে পেশা ধরলেন জগজিৎ। কিছু টাকা জমলে দু-একটা করে রেকর্ড বার করতে লাগলেন। ফিলমে চান্স পেলেন—বাসু চ্যাটার্জির ‘আবিষ্কার’ ছবিতে গাইলেন ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটো যায়’—লুফে নিল সাধারণ মানুষ। এরপর ‘নশীলী রাত’, ‘বহুরূপী’, ‘এক থী রাত’ ছবিতে গেয়েছেন। কিন্তু তবুও তৃপ্তি পাননি। কোনও এক প্রত্যাশিত ভোরের প্রতীক্ষায় তিনি জেগে রইলেন—

‘ইক ন ইক শম্মা অধর মেঁ জ্বলায়ে রখিয়ে
সুবহ হোনে কো হ্যয় মাহওল বনায়ে রখিয়ে।’

 এরপর জীবনে এলেন চিত্রা দত্ত ওরফে চিত্রা সোম। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় দুজনের যে মোলাকাৎ হয়েছিল তা নিয়ে পৌঁছোল মনের দুনিয়ায়—

‘অপনে হাথোঁ কী লকীরোঁ মেঁ বসা লো মুঝকো
ম্যঁয় হুঁ তেরা নসীব, অপনা বনা লো মুঝকো।’

 প্রথম বিদেশ সফরের আগে, ১৯৬৯-এ বিয়ে হয়েছিল দুজনের। বিদেশে বিপুল জনসমর্থন লক্ষ করে ফিরে মেহেদি সন্নিধি জগজিৎকে আরও চৌকশ করে তুলল। বের হল প্রথম এল পি The Unforgetables রেকর্ডের প্রথম নগমা ওস্তাদি ঢঙে গাওয়া ‘বাত নিকলেগী তো দূর তলক জায়েগী’ বোদ্ধা শ্রোতা কখনও ভুলতে পারবে? রেকর্ডটির মাধ্যমে জগজিৎ যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবিকই তিনি এই রেকর্ডটির মাধ্যমে গজল রেকর্ডের ইতিহাসে রেকর্ড করেছেন। লোকেরা লাইন দিয়ে ছুটেছে জগজিৎ এল পি কিনতে। The Unforgetables বাজারে নামার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার কপি বিকিয়ে যায়। নন-ফিল্মি গানে ইতিপূর্বে এমনটা হয়নি। আশা বা কিশোরের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরও নন-ফিল্মি রেকর্ড এত বিকোয়নি। লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে লতার গাওয়া গান নিয়ে যে রেকর্ড হয়েছে তা ছ-সাত বছরে ৭০ হাজারের মতো কেটেছিল। ক্লাসিক্যাল বেস্ট সেলার রবিশঙ্করের এল পি ৫০-৬০ হাজারের বেশি কাটে না। লন্ডন-ফেরত মিউজিশিয়ান বিড্ডু ডিসকোর রিদম ও দোঁ-আঁশলা সুর দিয়ে নাজিয়া হাসনকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘দিওয়ানে’ যা সতেরো দিনে ‘গোল্ড’ হয়েছিল, অর্থাৎ এক লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল এবং ‘প্ল্যাটিনাম’ অর্থাৎ দু’লক্ষ কপি নিঃশেষ হয়েছিল দু মাসে। কিন্তু সেটা পরের ঘটনা, তৎপূর্বে ‘শোলে’ এবং তরুণ জগজিতের এল পি সেই রেকর্ড কায়েম করেছিল। আজ জগজিৎই গজলের বেস্ট সেলার। সুর বা কথার বৈচিত্র্যই এই জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ নয়। তাঁর গলায় ছিল এক অদ্ভুত মিষ্টতা। স্বরসজ্জায় সহজ সৌন্দর্য, চমক সৃষ্টি করার কোনো চেষ্টা ছিল না। গলাবাজিও না। সুর যেন কোনো যুবতি নির্ঝরিণীর ফল্গু ধারা তা টলমল হয়ে নদীর রূপ ধারণ করত। জগজিতের আওয়াজে ছিল একটা দরদ যা শ্রোতার বুককে আপ্লুত করার পক্ষে যথেষ্ট।৯১

 তীব্র সময়ানুভূতিই জগজিতের জনপ্রিয়তার প্রধান ভূমিস্বর। তিনি জানতেন তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে সাধারণ মানুষ এবং তাদের রুচি বড়ো চঞ্চলা। ক্যাসেট কিনে ভালো না লাগলে সেকেন্ড হ্যান্ড শপে ঝেড়ে দেবে। তাই জগজিৎ সদা সতর্ক, তৎপর আরও সমৃদ্ধ হতে। তাঁর স্বতন্ত্র পন্থা ও অভিন্ন অন্বেষায় দীর্ঘকাল সাথী ছিলেন তাঁর প্রেয়সী ও সহধর্মিনি চিত্রা সিং। চিত্রার গলায় একটা যৌবনের ঝাঁঝ আছে, যা লোকের মনকে ছোঁয়। গলায় এমন একটা দরদ আছে যা শ্রোতাদের বিদ্ধ করে। পাকিস্তানি গায়িকা নুরজাহাঁ বেগম চিত্রাকে বলেছেন ‘জগজিতের পরছায়া’। চিত্রা জগজিতের সঙ্গে দেশ-বিদেশের সমস্ত প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁকে নিছক জগজিতের পরছায়া বলা অন্যায়। চিত্রা সোম জন্মসূত্রে বাঙালি, এবং কলকাতার। গজল, ক্লাসিকাল, ডিভোশনাল, ফোক সব ধরেনর গানই গেয়েছেন, কিন্তু গজলের জন্যই সত্তর-আশির দশকে তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে পৌঁছয়। ১৯৬৮ সালে চিত্রা তাঁর পূর্বস্বামীকে ছেড়ে পরের বছর জগজিৎকে বিয়ে করেন। তারপর জগজিৎ-চিত্রা জুটি গজলের দুনিয়ায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। গজলের জগতে চিত্রাও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁর আওয়াজ ধারালো তরবারির মতো সূক্ষ্ণ। হয়তো বা সেই তীক্ষ্ণ প্রবর কণ্ঠই ঝকঝকে তরবারির মতো আমাদের বুকে আমূল বসে যায়।

 জগজিৎ-চিত্রার প্রসঙ্গ উঠতেই পাঁচকাহন হয়ে যায়।কথা শুরু করলেই বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়ে যায়—

‘বাত নিকলেগী তো দূর তলক জায়েগী
লোগ বেবজহ উদাসী কা সরব পুছেঙ্গে, উংলিয়াঁ উঠেঙ্গী।’

একদিন যাঁরা ছিলেন সাধারণ শিল্পী-দম্পতি, ক্রমে ক্রমে আজ তাঁরা গজল স্টার—

‘সরকতী জায়ে হ্যয় রুখ সে নকাব আহিস্তা-আহিস্তা
নিকলতা আ রহা আফতাব আহিস্তা-আহিস্তা।’

 গালিব থেকে শুরু করে আধুনিকতম সর্বস্তরের কবির গজল এঁদের গলায়। জগজিৎ কখনও শক্ত ভাষার গজল গান নি, কেননা ‘তাতে শ্রোতা মেলে কম’। জনপ্রিয়তার অনিবার্য শর্তই হল ‘পাবলিক রেসপন্স’, সুতরাং চাই সহজ সরল ভাষার শের।জগজিৎ একবার আমাকে বলেছিলেন—‘পাবলিক আমার প্রেরণা, তাঁরা না থাকলে সব বেকার’—

‘তুম নহীঁ, গম নহীঁ, শরাব নহীঁ
এ্যয়সী তনহাই কা জবাব নহীঁ।
উও করম গলিয়োঁ পর গিনতে হ্যঁয়
জুল্ম কা জিনকে কুছ হিসাব নহীঁ।

 সুরকার হিসেবেও জগজিৎ শাশা, আক্রান্ত, প্রেমগীত, ম্যঁয় অওর মেরী তনহাই প্রভৃতি ছবিতে নাম কুড়িয়েছেন। প্রেমমূলক গীতে তাঁর সুর অনবদ্য। উদাহরণত তাঁর কতিপয় জনপ্রিয় ফিল্মি-গজল—

‘কওন কহতা হ্যয় মুহব্বত কী জুবাঁ হোতী হ্যয়
য়্যে হকীকৎ তো নিগাহোঁ সে বয়াঁ হোতী হ্যয়।’
‘তুমকো দেখা তো খয়্যাল আয়া
জিন্দগী ধুপ, তুম ঘনা সায়া’
‘আজ ফির দিল নে এক তমন্না কী
আজ ফির দিল কো হম নে সমঝায়া।’
‘ঝুকী ঝুকী সী নজর বেকরার হ্যয় কি নহীঁ
দবা দবা সা সহী দিল মেঁ প্যার হ্যয় কি নহীঁ’
‘তুম ইতনা জো মুস্করা রহে হো
ক্যা গম হ্যয় জিসকো ছুপা রহে হো’
‘হোঠেঁ সে ছু লো তুম
মেরা গীত অমর কর দো
বন জাও মীত মেরে
মেরী প্রীত অমর কর দো’

 তবে, এ-কথা ঠিক, ভারতীয় গানের জগতে এ-যুগে গজলের যে শীর্ষস্থানীয় জনপ্রিয়তা, এতখানি সম্ভব ছিল না যদি না হিন্দী চলচ্চিত্রে গজলের তাশপোশি ঘটত। আর, এ-কথা আগেই বলেছি, গজলের জাদু হিন্দী সিনেমার জগতে সেঁধ মেরেছিল শতেক বছর আগেই, ভারতীয় সিনেমার প্রায় জন্মলগ্নেই, যা ছিল একান্ত স্বাভাবিক। কেননা গজলের অভিনব ও বিস্ময়কর দুনিয়ায় রয়েছে একাধারে সৌন্দর্যের ঐন্দ্রজালিক রূপক ব্যঞ্জনা, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা এবং সাংগিতিক সুরময়তা। এই চতুর্বিধ লাক্ষণিক কারণেই সেকাল থেকে একাল অবধি হিন্দী ছবির জগতে গীতকার, সুরকার তথা গায়ক-গায়িকাদের কাছে গজলের সম্মানীয় আসনটি আনুপূর্ব লোভনীয় থেকেছে এবং তার ধুরন্ধর প্রয়োগের মুন্সিয়ানাও তাঁরা দেখিয়েছেন। হিন্দী ছবিতে একদিকে যেমন মির্জা গালিব, মীর তকী মীর, দাগ, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, জোশ মলিহাবাদী, ইকবাল, ফিরাক গোরখপুরী, জাঁ নিসার আখতার, কৈফ ভোপালী, সাহির লুধিয়ানভি, মজরুহ সুলতানপুরী, শাহরিয়ার, মুজতর খৈরাবাদী, কৈফি আজমী, নাসির কাজমী, শকীল বদায়ুনী, আহমদ ফরাজ, মহেন্দ্র সিং বেদী, রাজ ইলাহাবাদী, হসরত মোহানী, নিদা ফাজলী, জিগর মুরাদাবাদী, হসন কমাল, গুলজার, জাভেদ আখতার প্রমুখের মতো বলিষ্ঠ ও স্বনামধন্য শায়ররা একের পর এক সুন্দর সুন্দর গজল উপহার দিয়েছেন, তেমনি আজকের স্বল্পনামা লিরিসিস্টরাও নিজেদের পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য পরিশ্রম করে চলেছেন। অন্যদিকে, গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে, বেগম আখতার, কমলা ঝরিয়া, কুন্দনলাল সায়গল, নূরজাহাঁ, মেহেদি হসন, উস্তাদ আমানত আলি খান, ফরিদা খানুম, শোভা গুরটু, মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, গুলাম আলি, জগজিৎ সিং, পংকজ উধাস, পিনাজ মাসানী, ভূপেন্দ্র, মুন্নি বেগম, ইকবাল বানো, উস্তাদ নুসরৎ ফতেহ আলি খান, আগা শাহিদ আলি, টিনা সানি, তালাৎ আজিজ এবং এমনি আরও অসংখ্য উঁচুদরের শিল্পী গোড়া থেকেই হিন্দী ছবিতে গজল গেয়ে নিজেদের এক-একটি স্বতন্ত্র আসন গড়ে তুলেছেন।

 ইকবাল বানো জন্মেছিলেন দিল্লিতে, ১৯৩৫ সনে। কিন্তু পাকিস্তানেই তাঁর জীবন ও মৌসিকীর উত্তরণ। মৃত্যুও লাহোরে। সেমি-ক্লাসিকাল শিল্পী ইকবাল বানো ঠুমরী, দাদরা ও খেয়ালও গেয়েছেন, কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় গজল গায়িকা হিশেবে। ইকবালের জীবনের শ্রেষ্ঠ গজলের একটি শের এখানে তুলে দিচ্ছি

‘হম দেখেঙ্গে, লাজিম হ্যয় কি হম ভী দেখেঙ্গে
ওহ দিন কি জিসকা ওয়াদা হ্যয়, জো লৌহ-এ-অজল মেঁ লিকখা হ্যয়।’

 আশা ভোঁসলে ভারতীয় গানের ভুবনে একটি স্বতন্ত্র নাম। ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩ সনে জন্ম, হিন্দী বাংলা, মারাঠী, গুজরাটি, পাঞ্জাবী, ভোজপুরী, তামিল, মালয়ালাম, ইংরেজি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় নানান আঙ্গিকের ১৬ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। গজলের স্বতন্ত্র অ্যালবাম রয়েছে আশার, এ-বাদে হিন্দী ছবিতেও বহু উচ্চাঙ্গের গজল গেয়েছেন। তাঁর অজস্র ফিল্মী ও নন-ফিল্মী সদাবাহার গজলের মধ্যে ‘আজ জানে কী জিদ ন করো’, ‘দয়ার-এ-দিল’, ‘ইন আঁখো কী মস্তী’, ‘খালি হাথ শাম আয়ী’, ‘ইয়ুঁ সজা চাঁদ’, ‘লোগ কহতে হ্যঁয়’, ‘কিসী নজর কো তেরা’, ‘সাথী রে তুম ন জানা’, ‘জব সামনে তুম আ জাতে হো’, ‘রাত চুপ চুপ’—হামেশা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেছে। এখানে উদ্ধৃত করি আশাজীর গাওয়া ‘উমরাও জান’ ছবির সেই বিখ্যাত গজলটি

‘ইন আঁখোঁ কী মস্তী কে মস্তানে হজারোঁ হ্যঁয়
ইন আঁখোঁ সে বাবস্তা অফসানে হজারোঁ হ্যঁয়
ইক তুম হী নহীঁ তনহা, উলফৎ মেঁ মেরী রুসওয়া
ইস শহর মেঁ তুম জৈসে দীওয়ানে হজারোঁ হ্যঁয়
ইক সির্ফ হম হী ময় কো আঁখোঁ সে পিলাতে হ্যঁয়
কহনে কো তো দুনিয়া মেঁ ময়খানে হজারোঁ হ্যঁয়
ইস শম্ম-এ-ফরোজাঁ কো আঁধি সে ডরাতে হো
ইস শম্ম-এ-ফরোজাঁ কে পরওয়ানে হজারোঁ হ্যঁয়’

 ভূপেন্দ্র সিংয়ের জন্ম পাটিয়ালার শিখ পরিবারে ৮ এপ্রিল ১৯৩৯। এঁর পরিচয় মূলত হিন্দী ফিল্মের পার্শ্বগায়ক আর সুরকার হিশেবে। ভালো গিটারিস্টও তিনি। স্ত্রী মিতালীও সুশিল্পী। দুজনে মিলে গানের জগতে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৬৮ সুরকার মদনমোহন অল ইন্ডয়া রেডিওতে ভূপেন্দ্রর গান শুনে তাঁকে দিল্লি থেকে বম্বে ডেকে নেন। প্রথম ছবি ‘হকিকৎ’, যাতে তিনি একটি গজলই গান ‘হোকে মজবুর মুঝে উসনে বুলায়া হোগা’। গোড়াতেই হিট। যদিও ভূপেন্দ্রর তাতে পরিচিতি তৈরি হয়নি। এর পর তিনি স্প্যানিশ গিটার আর ড্রাম সহযোগে কতিপয় গজল পেশ করেন। বেরোয় দ্বতীয় এল-পি, সবার দৃষ্টি কুড়োতে সফল হন। ‘দিল ঢুঁঢ়তা হ্যয়’, ‘দো দিওয়ানে শহর মেঁ’, ‘নাম গুম জায়েগা’, ‘করোগে য়্যাদ তো’ ইত্যাদি নগমার পাশাপাশি তাঁর অজস্র গজলও শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে। যেমন—

‘দরো-দিওয়ার পে হসরত সে নজর করতে হ্যঁয়,
খুশ রহো অহলে-বতন হম তো সফর করতে হ্যঁয়।’

 সুফি ঘরানার উস্তাদ নুসরৎ ফতেহ আলি খানকে (জন্ম ১৩ অক্টোবর ১৯৪৮, পাঞ্জাবের ফৈসলাবাদে) বলা হয়েছে ‘শহংশাহ-এ-কওয়াল’। কিন্তু কাওয়ালির পাশাপাশি গজল ও ফিউজনের জন্যও তাঁর খ্যাতি। তাঁর একটি বিখ্যাত গজল

‘উনকী তরফ সে তর্ক-এ-মুলাকাত হো গঈ
হম জিসসে ডর রহে থে ওহী বাত হো গঈ’

 অনুপ জলোটার মূল পরিচয় ‘ভজন সম্রাট’ (জন্ম নৈনিতালে, ২৯ জুলাই ১৯৫৩) হলেও একসময় কিছু হালকা ছাঁদের গজল গেয়েও এক শ্রেণীর শ্রোতাদের কাছে হাততালি কুড়িয়েছিলেন। ‘রাত গহরায়ী হ্যয়’, ‘তকদীর’ ইত্যাদি তাঁর গজলের অ্যালবাম। ভারতীয় গজলের দুনিয়ায় অনুপ জলোটা ও পংকজ উধাসের উত্থান একই সময়ে, কিন্তু এই শৈলীতে পংকজের সমৃদ্ধি ও অ্যাচিভমেন্ট অনেক বেশি। পংকজ উধাসের জন্ম গুজরাটের জেতপুরে, ১৭ মে ১৯৫১। ১৯৮০-৮১ সালে রিলিজ পাওয়া দুটি অ্যালবাম ‘আহট’ এবং ‘মুকররে’র মাধ্যমে প্রথম পরিচিতি। এযাবৎ মোট ২৮টি অ্যালবাপ রিলিজ পেয়েছে। প্রথম সুপারহিট গজলটি ছিল মহেশ ভট্টের ‘নাম’ ছবিতে গাওয়া ‘চিটঠি আয়ী হ্যয়’। তাঁর দুটি জনপ্রিয় গজলের উল্লেখ এখানে করছি

‘সব কো মালুম হ্যয় ম্যঁয় শরাবী নহীঁ
ফির ভী কোঈ পিলায়ে তো ম্যঁয় ক্যা করুঁ’
‘শরাব চিজ হী এ্যয়সী হ্যয় না ছোড়ী জায়ে
য়ে মেরে য়্যার কে জ্যয়সী হ্যয় না ছোড়ী জায়ে’

 সমসাময়িক দিনে চন্দন দাসও গজল গাইয়ে হিশেবে যথেষ্ট মনোযোগের দাবিদার ছিলেন। তাঁর ‘আ ভী জাও কে জিন্দগী কম হ্যয়, কল খাব মেঁ দেখা সখী ম্যঁয়নে পিয়া কা গাও রে, জব মেরী হকিকৎ জা জা কর, জব কোঈ ফয়সলা কিজিয়ে, সাথ ছুটেগা ক্যয়সে মেরা আপকা’ ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত গজলগুলির অন্যতম। আরেকটি—

‘কুছ তবিয়ত হী মিলী থী এ্যয়সী চ্যয়ন সে জীনে কী সুরত না হুঈ
জিসকো চাহা উসে অপনা না সকে জো মিলা উসসে মুহব্বত না হুঈ’

 ছায়াছবির নেপথ্য গায়ক ও গজলিয়া হরিহরণ সম্পর্কে বিশদ আলোকনের অবকাশ আছে, তবে স্থানাভাবে সংক্ষেপেই বলি। ৩ এপ্রিল ১৯৫৫ তিরুবনন্তপুরমে জন্মেছিলেন। ক্যারিয়ারের গোড়ার দিকে বেশ কিছু কনসার্ট ও টিভি শো করেছিলেন। ১৯৭৭-এ প্রখ্যাত সুরকার জয়দেব ‘গমন’ ছবিতে গাওয়ার মাধ্যমে প্রথম ব্রেক দেন হরিহরণকে। তিরিশটির বেশি গজলের অ্যালবাম রয়েছে তাঁর। বেশির ভাগই নিজের সুরারোপিত। গোড়ার দিকের একটি অ্যালবাম ছিল আশা ভোঁসলের সঙ্গে। হরিহরণের দু-তিনটি বিখ্যাত গজলের একটি করে শেরের উদ্ধৃতি দিই :

‘দরো দিওয়ার পে শকলেঁ সী বনানে আয়ী
ফির য়ে বারিশ মেরী তনহাঈ চুরানে আয়ী’
‘আজ ভী মেরে কদমোঁ কে নিশাঁ আওয়ারা
তেরী গলিয়োঁ মেঁ ভটকতে থে জহাঁ আওয়ারা’
‘ময়কদে বন্দ করেঁ লাখ জমানে ওয়ালে
শহর মেঁ কম নহীঁ আঁখো সে পিলানেওয়ালে’

 তালাৎ আজিজ (জন্ম ১১ নভেম্বর ১৯৫৬, হায়দরাবাদ) বেশ কয়েক দশক ধরে গজল গাইছেন। বাবা আবদুল আজিম খান ও মা সাজিদা আবিদ উভয়েই বিখ্যাত কবি। বাড়িতে গানেরও কদর ছিল। জগজিৎ সিং, জান নিসার আখতারের মতো বিখ্যাত গজলিয়ারা প্রায়ই আসতেন। গজলের প্রতি আকর্ষণ তখন থেকেই। আজিজের প্রাথমিক তালিম কিরানা ঘরানায় হলেও পরবর্তীকালে তাঁর অন্যতম গুরু হন মেহদি হসন। মেহদি প্রায়ই আজিজের মধুর কণ্ঠের বিশুদ্ধতার তারিফ করতেন। ফিল্মে গাওয়া তালাৎ আজিজের কয়েকটি বিখ্যাত গজল হলো ‘জিন্দগী জব ভী তেরী বজম মেঁ লাতী হ্যয় হমেঁ’ (উমরাও জান), ‘ছিড়ী রাত বাত ফুলোঁ কী’ (বাজার), ‘আইনা মুঝসে মেরী’ (ড্যাডি), ‘না কিসী কী আঁখ কা নূর’ (শরারৎ) ইত্যাদি।

 গজলের রাজপথে গুজরাটি-কন্যা পিনাজ মশানির যাত্রা শুরু ১৯৮১ সালে। এযাবৎ রিলিজ পাওয়া অ্যালবামের সংখ্যা কুড়ি। বিখ্যাতগুলি হলো ‘তু জী মেরা দিল তু হী মেরী জান’, ‘ধড়কন’, ‘আপকী বজম মেঁ’, ‘দিল মেঁ’, ‘আঁখোঁ মেঁ’ ইত্যাদি। বহু ভাষায় গান গেয়ে বিখ্যাত রূপকুমার রাঠোরও (জন্ম ১০ জুন ১৯৭৩, মুম্বাই) গজলের জগতে এক সুবিদিত নাম। রূপ ও তাঁর সহধর্মিনী সোনালীর বেশ কিছু হিট গজলের অ্যালবাম রয়েছে।

 আলোচনার একেবারে শেষে এসে মনে পড়ল এমন একজনের নাম, যাঁকে খুব কম লোকেই চেনে। তিনি গুজরাটের ওসমান মীর ওরফে ‘ময়ংক’ (জন্ম ২২ মে ১৯৭৪)। মানুষটা যেমন অন্য ধরনের, সংগীতক্ষেত্রে তাঁর কাজও একেবারে অন্য ধাঁচের। গ্ল্যামারের তো প্রশ্নই নেই। বেগম আখতারের গজলগুলিকে তিনি নতুন আঙ্গিকে উদ্ধার করেছেন। ওসমান ও তাঁর ছেলে আমির দায়রো মুসলমান হয়েও রামকথা গানে নিবেদিত, এবং সেই নিবেদনও এক অতুলনীয় নান্দনিক ঔৎকর্ষে উত্তীর্ণ। অবশ্য, এ ধরনের প্রতিভার কোনও মূল্য আজকের সমাস শনাক্ত করতে অপারক, এবং তা দিতেও পারে না। মুড়ি-মিছরি আজ এক হয়ে গেছে। ওসমানের বিখ্যাত গজলগুলির মধ্যে ‘মুঝে তুম য়্যাদ আতে হো’, ‘য়্যু হী বে সব্ব’, ‘তেরী তো চাঁদ সিতারোঁ মেঁ বাত হোতী হ্যয়’, ‘হো জহাঁ মেঁ’, ‘দিল মেঁ এক লহর সী’, ‘জমানে মেঁ তেরে গুম কী’, ‘কিসী কা দর্দ ছুপানা’ ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখনীয়।

 আর একজন মাত্র তরুণ গজলিয়ার উল্লেখ করি, আসামের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী অঙ্গরাগ মোহন্ত ওরফে ‘পাপন’। অসমিয়া ছাড়াও হিন্দী, বাংলা, মারাঠি আর তামিল ভাষায় গাইছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত। ২৪ নভেম্বর ১৯৭৫-এ গুয়াহাটিতে জন্ম। আসাম তথা পূর্বঞ্চালের ধর্মীয় গান সমূহকে ফিউজনের মাধ্যমে হাজির করেছেন পাপন। অসমিয়া ফিল্ম ‘রামধেনু’ সহ হিন্দী ‘সাউন্ডট্র্যাক’, ‘আই অ্যাম কালাম’ ও ‘সিস্টেম’-এর মতো ব্যতিক্রমী তথা ভিন্নধর্মী ছবিগুলিতে কণ্ঠদান করেছেন। নতুন অ্যালবাম ‘দোস্ত বন বন কে’ রিলিজ পেয়েছে ২০২১-এ। পাপনের গলায় মেহদি হসনের মখমলি জাদু আর জগজিৎ সিংয়ের বেদনাসিক্ত কণ্ঠের মিশেল—দুইই লক্ষ্যনীয়।

 উপরিল্লিখিত নামগুলি বাদেও গজলের দুনিয়ায় আরও বেশ কিছু অভিনিবেশ-যোগ্য গজলিয়া ছিলেন এবং রয়েছেন। যেমন—আহমেদ রুশদি, আবিদা পারভিন, আলি শেঠী, আমজাদ পরভেজ, অনুরাধা পোডয়াল, আতাউল্লাজ খান, আতিক হুশেন খান, সালমা আগা, কিরণ আহলুওয়ালিয়া, নজমা আখতার, গুলবাহার বানো, বিউটি শর্মা বড়ুয়া, রহমতুল্লাহ দর্দ, মুহম্মদ হুশেন, সাজ্জাদ আলি, ক্যাশিয়াস খান, সফকৎ অমানৎ আলি খান, হামিদ আলি খান, শাহনবাজ অমন, খলিল হায়দর, রুনা লায়লা, আজিজ মিয়া, হাবিব ওয়ালি মোহম্মদ, জশপ্রীত জাজিম শর্মা, ওয়াদাত রমিজ, সোনু নিগম, নিজামি ব্রাদার্স, নায়্যর নূর, ভীমরাও পঞ্চলে, প্রতিভা সিং বাঘেল, শিশির পারেখি, রেশমা, রাহত ফতেহ আলি খান, সাবরি ব্রাদার্স, সাজিদ আলি, জশবিন্দর সিং, গজল শ্রীনিবাস, আদিত্য শ্রীনিবাসন, তাহিরা সাইদ, মনহর উধাস, সুরেশ ওয়াডেকর, শ্রীচঞ্চল, আহমদ ওয়ালি, অলকা য়্যাগনিক, আয়ুষ্মান খুরানা, অরিজিৎ সিং, মোহিত চৌহান, শিল্পা রাও, পরিনীতা চোপড়া, নবতেজ সিং, স্মৃতি মিশ্র—নামের অফুরন্ত কাতার।

 পরিশেষে বলি, এই মুহূর্তে নতুন ও অর্বাচীন প্রজন্মের কাছে হয়ত গজল তেমন জনপ্রিয় গানের ধারা নয়; কিন্তু তবু, মানব-মানবীর প্রেমের গজল আজও আমাদের মনকে অভিভূত ও আপ্লুত করে। প্রিয়া-মিলন আর স্রষ্টা-মিলনের অমর গাথা হয়ে গজলের প্রেম-রসে মানুষের মন সিক্ত হয়ে ভলবে নিরবধি, হয়ত-বা অনন্তকাল। মালকা-এ-গজল বেগম আখতারের বিখ্যাত উক্তিটি মিথ্যে হবার নয়—‘গজল সহী ঢং সে গাঈ জায়ে তো উসকা নশা সর চঢ়কে বোলতা হ্যয়।’ বেশক বেগমজান! উওহ নশা লগে, পর কতঈ ছুটে নহীঁ।

.

তথ্যসূত্র

৬৪.  মোবারক হোসেন খানের লেখা থেকে বাংলাপিডিয়া

৬৫. আবদুল হলিম শরর, ‘গুজিস্তা লখনউ’, পৃ. ৪৭-৪৮

৬৬. হামদি বে, ‘বাঈজী’, বর্তমান দিনকাল, এপ্রিল ১৯৮৪

৬৭. রেবা মুহুরী, ‘ঠুংরী ও বাঈজী’, প্রতিক্ষণ, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪

৬৮. অজিত রায়, ‘গানের গজল’, গোধূলি মন, জানুয়ারি ১৯৯৭

৬৯. আবদুল হলিম শরর, ‘গুজিস্তা লখনউ’

৭০. অজিত রায়, ‘চন্দার ব্যান্ড’, আজকাল, ৪ জুলাই ১৯৮৪

৭১. আবদুল হলিম শরর, ‘গুজিস্তা লখনউ’, পৃ. ১১২

৭২. আবদুল হলিম শরর, ‘গুজিস্তা লখনউ’

৭৩. তবে, ‘গুজস্তা লখনউ’ গ্রন্থের লেখক আবদুল হালিম ‘শরর’ জোর দিয়ে বলেছেন, তাম্বুলবিলাসী হলেও নবাব কখনও মদ বা আফিম ছোঁননি।

৭৪. আবদুল হলিম শরর, ‘গুজিস্তা লখনউ’

৭৫. বিশদ বিবরণ রয়েছে শ্রীপান্থ রচিত ‘ মেটিয়াবুরুজের নবাব’ গ্রন্থে।

৭৬. ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, আনন্দবাজার পত্রিকা, অনলাইন সংস্করণ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

৭৭. রেবা মুহুরী, ‘ঠুংরী ও বাঈজী’, প্রতিক্ষণ, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪

৭৮. অরশদ মলিক, ‘গওহর জান’

৭৯. শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, ‘শেষ বাঈজী’, দেশ, ১২ মে ১৯৮১

৮০. হবিবুর শেখ, ‘তামাঞ্জা জান’, পরিবর্তন, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩

৮১. শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, ‘বাঈজীর সম্মান’, দেশ, ২৪ জুলাই ১৯৮৫

৮২. শিবাংশু দে, ‘বইপাড়া’, ই-বাংলা

৮৩. শম্ভুনাথ মিশ্র, ‘গজল গায়কী কা সফর কহাঁ সে কহাঁ তক’, আজকল, মে ১৯৮১

৮৪. অজিত রায়, ‘হিন্দী কবিতা আর গানে গজলের ভূমিকা’, পরিবর্তন, ৪ নভেম্বর ১৯৮১

৮৫. ধীরেন্দ্র আস্থানা, ‘হিন্দী ফিল্মোঁ মেঁ গজল’, ধর্মযুগ, অগাস্ট ১৯৮৩

৮৬. হরিহর দিওয়ানে, ‘বেগম অখতার’, হংস, মার্চ ১৯৮৫

৮৭. শম্ভুনাথ মিশ্র, ‘গজল গায়কী কা সফর কহাঁ সে কহাঁ তক’, আজকল, মে ১৯৮১

৮৮. জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’

৮৯. শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, ‘বাঈজীর সম্মান’, দেশ, ২৪ জুলাই ১৯৮৫

৯০. অজিত রায়, ‘গায়কী কী দুনিয়া’, সারিকা, জুন ১৯৮৫

৯১. অজিত রায়, ‘গজল আজকের ক্রেজ’, বর্তমান দিনকাল, শারদীয়, ১৯৮৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন