গজলের মুক্তি

অজিত রায়

কবিতা কী? এই অস্বস্তিকর প্রশ্নটা তুলে পাঠককে বিব্রত করার ইচ্ছে আমার নেই। কেউ দিতে পেরেছে আজ অবধি এর উত্তর? তাই ঋষিরা বলে গেছেন, কাব্য হচ্ছে ব্রহ্ম স্বাদ সহোদর অনুচ্ছিষ্ট। অর্থাৎ কারও মুখ দিয়ে এর সংজ্ঞা উচ্চারিত হয়ে এঁটো হয়ে যায়নি। কবিতা কী, এর সঠিক জবাব দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ—‘কবিতা অনেকরকম’। আমি লিখছি সেই অনেক রকমের এক রকম নিয়ে। গজল নিয়ে। গজল কী? এ প্রশ্ন আরও অস্বস্তিকর। গজল মানেই কবিতা, কিন্তু সব কবিতাই গজল নয়। তা ঠিক কী ধরনের, এক কথায় সেটা বোঝানোর চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। এক প্রেমিক তার প্রিয়তমার উদ্দেশে যা বলেছিলেন, সেই কথাটা প্রাথমিক পর্যায়ে বলা যায়—‘তোমারি উপমা প্রিয়ে তুমি এ মহিমমণ্ডলে!’

কিন্তু এতে আলোচকের দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না। জন্মান্ধের কাছে হাতির আকার মুলোও হতে পারে, কুলোও হতে পারে। তাই সংজ্ঞাটা আবশ্যিক। আর, সেটা নির্ধারণ করাই সম্ভবত বুদ্ধি-ক্ষমতার সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা। মোটামুটি একটা জেনাসের নির্ধারণ করা যায় বটে, কিন্তু যাকে বলে ডিফারেনশিয়া বা বৈশেষিক লক্ষণ সেটা নির্দেশ করাই এক মহা সমস্যা। এতে সাফল্যের মাত্রা যে পরিমাণে বেশি, সেই পরিমাণেই বুদ্ধির নৈয়ায়িক সামর্থ্য। অব্যাপ্তি আর অতিব্যাপ্তিকে পরিহার করতে নৈয়ায়িক বুদ্ধির প্রয়োজন আরও বেশি। অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি, এই দুই দোষের মাঝখানে সংজ্ঞাটি আলগা হয়ে ফুলে থাকে। ফলত, পুরো সংজ্ঞাটি মৃদু মোলায়েম আর পাণ্ডুবর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তাতে বিষয়বস্তু, প্রকরণ এবং অন্যান্য সম্পৃক্ত তথ্য সম্পর্কে একটা ধারণা মেলে বটে, কিন্তু তার সামগ্রিক পরিচয় অনুপস্থিত থেকে যেতে বাধ্য। একদিকে প্রজাতির প্রত্যেক ব্যক্তিটিতে অবিরোধে প্রবিষ্ঠ হবে, অন্যদিকে জাতির সেই বিশেষ প্রজাতিটি পৃথক হবে—সেখানেই তো সংজ্ঞার সার্থকতা। পণ্ডিত প্রদত্ত গজলের পরিভাষায় বর্তমান প্রাবন্ধিকের সংশয় কিছুতেই কাটতে চায় না। গজলের সংজ্ঞা নিরূপণে ও স্বরূপ-বিচারে উর্দুর আলংকারিকের কতটুকু সফলতা পেয়েছেন তার পর্যালোচনার মাধ্যমে সেই সংশয়ের কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

গজল গবেষিকা মাজদা অসদ বলেছেন, গজলের জন্ম আরবি কাশিদা থেকে। গোড়ার দিকে আরব দেশে গজলকে ‘কাশিদা’ বলা হত। কাশিদা অর্থাৎ কারও শৌর্যের গুণগান করা। দাদরা গাওয়ার আগে যেমন শের পাঠ করা হয়, তেমনি কাশিদা গাওয়ার আগে কড়ি বাঁধার রীতি ছিল। মাজদা একেই গজল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু আজকের দিনে কাশিদা আর গজলে তফাত বিস্তর। কাশিদা হল এক ধরনের বর্ণনামূলক ক্ষুদ্র কবিতা, আর গজল একটি বিশেষ ছন্দের নাম।

প্রসিদ্ধ সংগীতজ্ঞ অনিল বিশ্বাস একসময় গজল নিয়ে খুব সিরিয়াস কাজ করেছিলেন। তাঁর কাছে ঐসময় গজলের ব্যুৎপত্তি বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন তা-ও মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। অনিলবাবুর মতে, গজল শব্দটির ব্যুৎপত্তি আরব দেশে।আরবি অভিধানগত এর অর্থ ‘অলংকরণ’। এ-কথা অনস্বীকার্য যে গজলের একটি লক্ষণ হল অলম করা।ভাব বা বিষয়ের অলংকার (যথেষ্টীকরণ) গজলের একটি শর্ত। কিন্তু সেটাই সব নয়।

গজলকার পশুপতিনাথ ব্যাকুলের মতে গজল ফারসি শব্দ। ব্যাকুলজি সম্ভবত ‘গজালা’ শব্দের সঙ্গে গজলকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ফারসি গজালা শব্দের অর্থ মৃগনয়নী বা মৃগশাবক। জনাব মহম্মদ মুস্তফা খাঁ উর্দু-হিন্দী অভিধানে গজলের প্রতিশব্দ দিয়েছেন, ‘বাজনান গুফতগু করদ্যান’। অর্থাৎ নারীর সঙ্গে কথা বলা। সংজ্ঞাটি বেশ বিভ্রান্তিকর। কেননা, নারী—যাকে পরিভাষায় প্রধান উপাদান ধরা হয়েছে—সে কোন জাতীয়া, তা বলা হয়নি। বাংলা আর হিন্দীতে ‘নারী’ ও ‘স্ত্রী’ সাধারণ শব্দ।সমস্ত স্ত্রীজাতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হিন্দীতে স্ত্রীজাতির নারী, মহিলা, ঔরত, রমণী, বধূ, ললনা, অঙ্গনা, কামিনী, ঘোষিৎ, অবলা, বনিতা ইত্যাদি নানা প্রতিশব্দ রয়েছে। এগুলির মধ্যে কোন শ্রেণীর নারীর সঙ্গে কথা বলা গজলের বৈশিষ্ট্য, তার ইঙ্গিত এই সংজ্ঞায় অনুপস্থিত। কথা বলার বিষয়টাই বা কী, তারও কোনো উল্লেখ নেই। যদি ধরে নিই বিষয়ের কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই, তবে এটাও মেনে নিতে হবে যে গজলে কোনো নিরন্তর বা পৌনঃপুনিক চিন্তনপ্রক্রিয়ও নেই।

গজলের ফারসি সংজ্ঞা হল, ‘সুখন অজ জনান (বা অজমাশুক) গুফতন’—অর্থাৎ সুন্দরী রমণী সম্পর্কে কথা বলা। পক্ষান্তরে, আশিক (প্রেমিক) ও মাশুকের (প্রেমিকা) প্রেমালাপকেই গজল বলা হয়। প্রেমালাপের ভিত্তি শুধু ইশক হকীকী নয়, ইশক মত্যজিও বটে।অর্থাৎ গজলের দুটি ঘর—একটি মিলনের, অন্যটি বিরহের। মাঝখানে পর্দা টাঙানো, সামান্য বাতাসেই দুলে দুলে ওঠে—একবার এ-ঘর একবার ও-ঘর।

ওপরের সংজ্ঞাগুলির কোনোটিতেই ছন্দের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ গজল একটি ছন্দ-বিশেষ। দ্বিতীয়ত, এইসব সংজ্ঞায় পারিভাষিকদের ব্যক্তিগত অনুভূতিই প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বোপরি প্রশ্ন জাগে, ফারসি থেকে আরম্ভ করে উর্দু এবং আজ হিন্দী, মারাঠি, সিন্ধী, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, বাংলা প্রভৃতি ভাষার সিঁড়ি বেয়ে গজল যেখানে উঠে এসেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে বিচার করলে এইসব ব্যাখ্যা বাতিল হয়ে যায় না কি? সংজ্ঞাগুলি দেখে মনে হয়, গজল মানেই রোমান্টিকতা, প্রণয়।গজল মানেই সুরা, আঙুরফল, খর্জুরবীথি, শিরিণচাঁদ ইত্যাদি। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেই এইসব সংজ্ঞা ভ্রান্ত বলে গণ্য হওয়া উচিত ছিল। কেননা সেই সময় যখন উর্দু শায়রীর গা থেকে শবাব-শরাব সাকী-জাম গুলো-গুলিস্তাঁ আর বুলবুলি-বিলাসের আঁশ ছাড়েনি, তখনও ফয়েজ মোহিউদ্দীন লুধিয়ানাভি হালি ইকবালের দল এক-একটি বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন রক্তমাখা গজলের জন্ম দিতে—যাতে জেগে উঠেছে মধ্যবিত্ত সমাজ, ঘোষিত হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ, উচ্চারিত হয়েছে প্রতিকারের দাবি।

তাই বলছিলাম, গজলের সামগ্রিক পরিচয় এইসব সংজ্ঞায় অনুপস্থিত। প্রকৃত সংজ্ঞাটি খাড়া করার দায়িত্ব আমাদের। তা খাড়া করা তখনই সম্ভব হতে পারে, যখন আমরা গজলকে বুঝব, যখন জানব তার স্বরূপকে। শিল্প বিচারে কোনো পূর্বকল্পিত ধারণা সংস্কারমাত্র, যা সত্য-সন্ধানের অন্তরায়। সংজ্ঞা-নির্ধারণেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য।

কাব্যের সামান্য ধর্ম মাইমেসিস বা অনুকরণ। প্রাক-অ্যারিস্টটলীয় যুগ থেকে অদ্যাবধি সারস্বত মহলে এ ধারণা অনড়। অনুকরণই কবির আর্ট ইমপালস। প্রশ্ন ওঠে, মহাকাব্য, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি জীবনের অনুকরণ হতে পারে। কিন্তু কবি যেখানে নিজের কথা বলেন সেক্ষেত্রে অনুকরণ কোথায়? জবাবে প্লেটোর মন্তব্য ধার করে বলা যায়, কবিতার উপকরণ জীবনের রূপ—ব্যক্তিচরিত্র, হৃদয়াবেগ ও ঘটনা।হৃদয়াবেগ কবির মাধ্যমে ব্যক্ত হলে তা অনুকরণ। কেন-না তাতে বিশেষ ভাবের একটা পরাদর্শক বা অ্যাকচুয়াল ফর্মে গড়া আঙ্গিকের অনুকৃতিই ব্যক্ত হয়। এই অর্থে গজলও কবিতা এবং তা অনুকরণ-বিশেষ। শাশ্বত সত্যেরই প্রকাশ। বাইরে থেকে যা ‘সৃষ্টি’ মনে হয়, ভেতরের দিক থেকে তা ইমিটেশন রূপ-রচনা।

গজল কবিমনের উপলব্ধির প্রকাশ। এর ছন্দ মূলত সুরের মুখাপেক্ষী। গানে রূপায়িত হয়েও তা অনন্য। বিষয়ের ক্ষেত্রে স্টাইলের দিক থেকেও সংগীত জগতে গজল একক ও নিঃসঙ্গ। এর প্রধান কারণ, গজলের স্রষ্টা এক মস্ত অনুকরণকারী জীব। মনস্তত্ত্বের দিক থেকেও গজল সৃষ্টির মূলে দুটি কারণ—অনুকরণ বৃত্তি ও সংগতিবোধ। তা মানবজীবনের সাধারণ বা ইউনিভারসাল সত্যকে ব্যক্ত করে। কলাকৈবল্যবাদীদের মতে, গজলের মূল লক্ষ্য আনন্দ-সৃষ্টি। কবিতা মাত্রেই, অ্যারিস্টটল অনুসরণে বলা যায়, মানুষের সর্বজনীন রূপটির প্রকাশ। তা জীবনকে আদর্শায়িত করে। আদর্শায়িত বা আইডিয়ালাইজ কথাটা দ্ব্যর্থক। প্রথমত, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে তার চিরন্তন ও স্বরূপ ধর্মে প্রকাশ করা এবং দ্বিতীয়ত, লৌকিক সাদৃশ্য অক্ষুণ্ণ রেখে অনুরঞ্জনী মমতায় ভাবকে সৌন্দর্যায়িত করা তথা যুগপৎ উজ্জ্বল ও চিত্তাকর্ষক করে তোলা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে গজলের লক্ষণ নির্ধারণে মনীষীরা বহুধা বিভক্ত। নানা মতবাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বলা বাহুল্য, পারস্পরিক সাদৃশ্য এগুলির মধ্যে নেই। কিন্তু দুটি সিদ্ধান্তে সবাই একমত। প্রথমত, গজল সৃষ্টি হচ্ছে অনুভব, কল্পনা আর বুদ্ধির সমন্বয়ে এক যৌগিক মানসিক বৃত্তি। দ্বিতীয়ত, তা হল রস-রূপ-ভাবনার সমবায়—জীবন ও জগতের রস-রূপের অভিব্যক্তি। এ থেকে আমরা গজলের সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রচয়িতার মনোভঙ্গি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি। এই মনোভঙ্গিকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, ‘বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজনের চেষ্টা’। এতে ফুটে ওঠে গজলকারের সামাজিক বাসনা, কামনা তথা অভিযোজনের রূপটি।

তাবৎ শিল্পসৃষ্টির মূলে একটি প্রেরণা কাজ করে। সামাজিক প্রাণী হিশেবে গজল-স্রষ্টার মনে যে বাসনাই থাকুক, ‘গজলকার’ পদবাচ্য হন তখনই যখন তাঁর মধ্যে প্রকাশের আবেগ জাগে। আত্মোপলব্ধিকে বাইরে প্রকাশ করার ব্যাকুলতাই সৃজন প্রক্রিয়া। প্রকাশ-বিষয়কে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলাতেই গজলের সার্থকতা। আধুনিক গজলকারেরা প্রেরণা বলতে বোঝেন পরিশ্রমকে। এঁদের সার্থকতা পারিশ্রমিকে।

উদ্দেশ্য ও প্রেরণার মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট ভেদরেখা টানা সম্ভব নয়। এ দুটির তাৎপর্য অনেকের কাছেই এক ও অভিন্ন। কিন্তু কাব্যতত্ত্বে এদের সংজ্ঞা ভিন্ন ভিন্ন। কাজ করবার জন্যে কর্তার মধ্যে যে একটা চাপ অনুভূত হয়, সেটা প্রেরণা বা ইমপালস।আর উদ্দেশ্য বা পারপাস হল কর্তা ক্রিয়ার মাধুর্যে যে ইপ্সিত ক্ষমতা অর্জন করতে চান সেই ইপ্সিত ফল বা লক্ষ্য। গজল সৃষ্টির প্রেরণার কথা আগেই আলোচিত হয়েছে। এখন বিবেচ্য তার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য দু রকমের—শৈল্পিক ও সামাজিক। প্রথমটি হল বিষযবস্তুকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবার ইচ্ছা এবং দ্বিতীয়টি, সুন্দর রূপ সৌন্দর্য সৃষ্টির দ্বারা মানুষের মনোতুষ্টি করার বাসনা। গজল শুধু সুন্দরের সাধনা নয়, শিব ও সত্যেরও সাধনা। প্রকাশ তার প্রথম সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সাহিত্যের পথে’ প্রবন্ধে সাহিত্য সম্পর্কে যে-কথা বলেছিলেন সেটাই গজল সম্পর্কে বলা যায়—গজলের আদিম সত্য হচ্ছে প্রকাশ মাত্র, কিন্তু তার পরিণাম সত্য হল ইন্দ্রিয়, মন এবং আত্মার সমষ্টিগত মানুষের প্রকাশ।

এটি অবশ্যি কলাকৈবল্যবাদীর বিশ্বাস। বহুদিন আগেই বেনিডেট্টো ক্রোচে ‘Art is expression’ বলে একটা মতবাদ প্রচার করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তারই অনুসরণে বলেছেন, এক্সপ্রেশন হচ্ছে সৃষ্টির আদি-মধ্য-অন্ত। এক্সপ্রেশনিজম কলা-কৈবল্যবাদেরই সমর্থক। ভিক্টর হুগো সেই ১৮১৯ সনে এর প্রচার শুরু করেছিলেন। এই মতবাদে বিশ্বাসী যাঁরা, তাঁরা কবিতার সার্থকতা খুঁজতে কবিত্বের বাইরে যেতে চাননি। অবশ্য, কলা হি কেবলম বলে লম্ফঝম্প করলেও, পরোক্ষত তাঁরা ফলাকাঙ্ক্ষা না করে পারেননি। এতেই ঘটেছে শিল্পের সামাজিক উপযোগিতার জয়। প্রসঙ্গত, আমরা দেখতে পাই কলাকৈবল্যবাদের প্রচারক হুগো ১৮৬৪ সনে স্বয়ং যোগ দিয়েছেন বিরোধী শিবিরে।

কিন্তু কলাকৈবল্যবাদের মৃত্যু ঘটেনি। ১৮৪৫ সনে তার যে ইতিহাস আনুষ্ঠানিক ভাবে আরম্ভ হয়েছিল, তার ধারা আজও অব্যাহত। ভিক্টর কুজাঁ সেই বছরেই ‘I’ art pour I ‘art’ অর্থাৎ ‘শিল্প তো বিশুদ্ধ শিল্প’ প্রবচনটি চালু করেন। ফরাসি দেশে গোতিয়ে, ফ্লুবারট, বোদলেয়ার, ভার্লেন, ইংল্যান্ডের ওয়াল্টার পেটার, অসকার ওয়াইল্ড, ব্র্যাডলে, হুইসলার, ইতালির বেনিডেট্টো ক্রোচে এবং ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, নামদেব প্রমুখ এই মতবাদের সমর্থক হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন।

ফিরাক গোরখপুরী বলেছেন, ‘অদবের (সাহিত্য) কোনো মকসদ (লক্ষ্য) থাকে না’। তিনি মনে করতেন, ‘All art is useless’ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অসকার ওয়াইল্ড যে-কথা বলেছিলেন, তার সঙ্গে বিশ শতকের ফিরাক গোরখপুরীর মন্তব্যের কোনো ফারাক নেই। কিন্তু এই উক্তির ওপর ভিত্তি করে ফিরাককে দায়িত্বজ্ঞানহীন, উন্নাসিক কিংবা বেপরোয়া শায়র হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। কেননা, তিনি অত্যন্ত সতর্ক ও চিন্তাশীল শায়র। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি যখন যা বলি সেটাই আমার বক্তব্যের সার ধরলে বিভ্রান্তিই সৃষ্টি হবে। আওয়াজ কখনও বলবার ওপর নির্ভর করে না, কণ্ঠ কখনও মনের অপেক্ষায় থাকে না।শেরের ভেতর যেমন মৌন থাকে, গজলকারের কথার পিঠে তেমনি থাকে তাৎক্ষণিক উত্তেজনার ঝাপটা। মুখ হাঁ করিয়ে যা বলিয়ে নেয়, সেটাই কবিমনের সব নয়।

ফিরাককে ঠিক কলাকৈব্যলবাদী বলা যায় না। ওয়াইল্ডের মতো তিনিও যে শেষাবধি গরলামৃত-অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন, তার প্রমাণ আছে।বস্তুত যতই তিনি All art is useless বলে প্রচার করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত শিল্পের ঔপযৌগিক মূল্যকে নাকচ করতে পারেননি। টি এস এলিয়টের মতো তিনিও বলেছেন, এই মন্তব্যটি হল more advertised than practised. যাঁরা একসময় কলাকৈবল্যবাদের উগ্র প্রচারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তাঁদের অনেকেই শেষ বয়সে কলাকৈবল্যবাদের শিবির ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন।ফিরাক তাঁদেরই একজন। ফ্লুবারট পরবর্তীকালে যে ভাষায় কলাকৈবল্যবাদের অসম্পূর্ণতা ব্যাখ্যা করেছিলেন, ঠিক সেই ভাষাতেই ফিরাক বলেছেন, আসলে চাই—an aesthetico-moral theory—the heart is inseparable from the intelligence. Those who have drawn a line between the two possessed neither.

‘গজলের জন্য গজল’ কথাটা যাঁরা চালাতে চান, তাঁরা নিছক দম্ভের প্রচারক।নিরলস প্রকাশ, নির্বিষয় প্রকাশ এ-যুগে অবান্তর—ভাববিলাস মাত্র। এ যুগে অসির চেয়ে মসি বড়ো। তাই যদি বলি ‘গজলের পাথেয় গজল’, তবে গজলকে ছোটো করা হয়। একথা ঠিক যে সৌন্দর্যসৃষ্টি গজলের একটি শর্ত, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য ‘সুফল’ ফলানো। কোমতে বলেছেন, শিল্পের উদ্দেশ্য উন্নততর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সহায় হওয়া। গজলেরও উদ্দেশ্য তাই হওয়া উচিত।রাসকিনকে অনুসরণ করে বলবো, গজলকে didactic to the people and that as their chief end হওয়া দরকার। এখন ‘গজলের জন্য গজল’ নিছক নিষ্ফলা ভাববাদী চিন্তা ব্যতিরেকে কিছুই নয়। তাই সাম্প্রতিক কবি গজলের বিষয়কে সমাজের বিষয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না, তার সামাজিক উপযোগিতার কথা ভুলতে পারেন না। জীবনের বিচিত্র ছবি যে গজলের পর্দায় ভেসে উঠেছে, সেখানে পরোক্ষত জীবনতত্ত্বের শিক্ষাও পরিবেশিত।

গজলের উদ্দেশ্য নিয়ে যে সমস্যা, তার উদ্ভব গজলের রূপ ও বিষয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের ধোঁয়াটে ধারণা থেকে। এক দলের বক্তব্য, গজলের প্রকাশটাই শেষ কথা, বিষয় বা কনটেন্ট বলে কিছু নেই।পক্ষান্তরে, এঁরা মনে করেন, গজলের বিষয়টা ফালতু ব্যাপার—প্রকাশেই গজলের সার্থকতা। এ ধারণায় গজলের পতন অনিবার্য। কিন্তু এ ধারণায় বিশ্বাসী অনেক কবিই তো গজল লিখছেন, তাঁদের রচনা ব্যর্থ নয় কেন? এ প্রশ্নের জবাব সহজ। বস্তুত, তাঁরা যে গজলচর্চা করছেন তাতে প্রকাশের দাবিই পূরিত হচ্ছে। আর সেই প্রকাশ আসলে বিষয়েরই প্রকাশ। প্রকাশের সার্থকতা বিষয়ের প্রকাশেই নিহিত। ভাষান্তরে, গজলের প্রকাশ বিষয় নিরপেক্ষ কোনো নৈর্ব্যক্তিক তত্ত্ব নয়।

গজলের বিষয়বস্তু কোনো সিদ্ধ বস্তু নয়। প্রকাশের মধ্যেই বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট। এখানে তা অরূপ নয়। গজলে কোনো বিষয় নেই, আছে শুধু রূপ বা ফর্ম।রোমিও-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু, শীরি-ফরাদের গল্পের কাঠামো মোটামুটি এক হলেও বিষয়ে ভিন্নতা আছে। স্রষ্টার আত্মসংস্কৃতির সঙ্গে মিশে কাহিনি বিশেষ ফর্ম পায়। প্রকাশের বিশিষ্টতাই আসল চরিত্র। প্রকাশ যত তীব্র, বিষয়ের অভিব্যক্তিও তেমনি তীব্রতা পায়। একেই বলে conquest of matter by form. রূপ বা ফর্ম যত বড়ো বিষয়ও তত বড়ো। সত্য ও শিবকে (progress of mind and improvement of morals) এড়িয়ে জীবনের গভীর রূপ বা মহান শিল্প কিংবা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। অতএব গজলের উদ্দেশ্য যেমন আনন্দ বিতরণ, তেমনি তা জীবনসত্যেরও প্রকাশক।

গজলের ফর্ম কোনো ফালতু ব্যাপার নয়। রূপই আমাদের অহসাস ও অলফাজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। গজলকারের আত্মসংস্কৃতির সঙ্গে তার অনুভূতি মিলেমিশে যে রূপ-বৈশিষ্ট্য লাভ করে, পরিস্থিতি-কল্পনায়, চরিত্র-কল্পনায়, ভাবাভিব্যক্তিতে, চিন্তার ঐশ্বর্যে প্রকাশ যে বিশেষতা হাসিল করে, সেই খাস ফর্মই গজলের বিষয়বস্তু। প্রখ্যাত হিন্দী কবি মুক্তিবোধ সম্ভবত এই প্রসঙ্গেই বলেছেন, ‘রূপ নিজস্ব পরিস্থিতির কারণে তত্ত্বের ওপর অবলম্বিত থাকে এবং তত্ত্ব স্বপ্রকাশের প্রক্রিয়ায় রূপকে নির্ধারিত ও বিকশিত করে।’

কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, গজলে তত্ত্বের প্রকাশ হয় কীভাবে? রূপ ব্যতিরেকে কোনো বস্তুকে দেখা সম্ভব? আমি মনে করি, সাহিত্য ও শিল্প কোথাও রূপের ভূমিকা গৌণ নয়। শিল্পের অর্থই হল রূপায়ণ, will to form. কৃতিকে যা শিল্প হিশেবে পরিচিত করে, তা রূপ বই তো নয়।যদি কোনো গজলকার ফর্মকে ধ্রুব ও নির্ণায়ক রূপে মানতে অস্বীকার করেন তবে কোন যুক্তিতে ধরে নেব যে তাঁরা যা কিছু লিখছেন, সবই গজল? ফর্ম ভিন্ন গজলকে চেনবার উপায় তবে কী? গজল শুধু বাইরের চেহারাতেই নয়, বিশেষ আন্তরিক সংরচনাতেও অন্যবিধ কাব্যরূপ থেকে স্বতন্ত্র। গজলের প্রাণ তার আন্তরিক সংগীত। যখন পাঠ করা হয়, তখনও স্বতন্ত্র ধ্বনি ও ব্যঞ্জনায় তা গীতিধর্মী।

ভাব ভিন্ন যেমন ভাষা আসে না, তেমনি ভাষা ভিন্ন ভাবও অসম্ভব।একেবারে কৃত্রিমতা বর্জিত কোনো শিল্প হয় না।যে-কোনো সৃষ্টিই সজাগ চিন্তা ও সচেতন ভাবের ফসল।ভাষা ব্যবহার তো বটেই।এই ভাষা মানুষের জন্মলব্ধ সংস্কার অথবা শারীরবৃত্তিয়-লব্ধ অভ্যাস নয়। চিন্তার সঙ্গে এর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।মানুষের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাষাও বদলায়।এই পরিবর্তন ধর্মকে লক্ষ করেই স্ট্যালিন বলেছিলেন, ‘Whatever the thoughts that may arise in the mind of man, they can arise and exist only on the basis of the language materials, on the basis of language termology and phrases. Bare thought, free from the language material, free from the ‘natural matter’ of language does not exist একই কথার অনুরণন শুনি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের লেখনী-মুখে ‘যে কোনো একটি ভাষা মনে মনে আবৃত্তি করিয়াই চিন্তা করে—সেখানে ভাষা নাই, চিন্তাও নাই।’ মোট কথা, চিন্তার বিকাশের সঙ্গে সংগতি রেখে ভাষা বিকশিত হয়। এই ভাষা একটা বিষয়মাত্র নয়। জ্ঞান জগতের সমস্ত বিষয়ের ভিত্তি।ভাষা আমাদেরকে রচনা করে।

গজলের ভাষাও স্থির কিংবা স্থিত নয়। তা বদলায়মান। সামাজিক ও মানসিক পরিবেশের অনুসরণে গজলের ভাষা বদলে যায়। এমনিতে গজলের ভাষা বলতে মূলত কথ্যভাষাকেই বোঝায়। কিন্তু রচনা যেহেতু লিপির মুখাপেক্ষী, লিপি যেহেতু বাঙ্ময় ধ্বনির দৃশ্যরূপ এবং লেখ্যভাষা যেহেতু কথ্যভাষার স্থায়ীরূপ—সুতরাং গজলে ব্যবহৃত ভাষাকে আক্ষরিক অর্থে মুখের ভাষা বলা যায় না। তা কথ্যভাষার চেয়ে আপাত স্বতন্ত্র এবং কিছুটা লিপি-আদর্শের অনুগত। এই কারণেই গেয় গজলের তুলনায় লেখ্য গজলের জনপ্রিয়তা ও প্রসারতা কম। কিন্তু লেখ্যভাষাই স্থায়ী, কথ্যভাষা অস্থায়ী। মুখের ভাব বা ভাষা যাতে কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের শ্রোতার কাছে পৌঁছোতে পারে, তারই জন্যে লিপির উদ্ভাবন। তাই গজলের ভাষা শুধু কর্ণস্পর্শী হলে চলবে না, তাকে মর্মস্পর্শীও হওয়া চাই। গজলের কাজই হল কাল থেকে প্রাণে পৌঁছানো।এটাই তার সাধনা। কানের দরজা পেরিয়ে মনের অলিন্দে যা প্রবেশ করে, তা-ই গজলের ভাব।

গজলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে কবিদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তার আসল উদ্দেশ্য সাধারণভাবে সত্যের সঙ্গে আনন্দের মিলনসাধন। যদিচ তাতে যুক্তিতর্কের কচকচানির প্রশ্রয় নেই, অথচ তা যুক্তিবর্জিত বিষয়ের লক্ষ্যহীন কল্পনা নয়। জনসন যেভাবে বলেছেন—It is the art of uniting pleasure with truth by calling imagination of the help of reason, সেইভাবে বলব, যুক্তির সাহায্যে কল্পনাকে আহ্বান করে সত্যের সঙ্গে আনন্দের একত্রীকরণের কলাই গজল। বলা বাহুল্য, এ-দেশে এই পাশ্চাত্য চিন্তা হালের আমদানি। তখনকার কবিরা মনে করতেন, গজলের আঁতুড়ঘর কল্পনা এবং কল্পনামূলক শিল্প কখনোই বিজ্ঞানমূলক হতে পারে না। তাঁরা প্রচার করতেন, গজল হল বিজ্ঞানের বিপরীত বস্তু, যার অন্বেষণ নিদারুণ সত্যের দিকে নয়, আনন্দের অভিমুখে। কিন্তু আনন্দ যদি সত্যের অনুসারী না হয় তবে তা বায়বীয় বা ক্ষণস্থায়ী হয় না কি? ইদানীন্তন গজলের মূল ভাবনা মোটেই অলীক অসত্যের ওপর অবলম্বিত নয়।কেননা, আজকের কবিরা জানেন, ‘রূপ নাহি ধরা দেয়—বৃথা সে প্রয়াস।’

শায়রীর এক বিশেষ স্টাইল হল গজল। তার শেরের মধ্যস্থিত নিছক শব্দার্থের অতিরিক্ত কোনো তাৎপর্যের আভাস থাকে, অন্যান্য কাব্যশৈলীর তুলনায় বেশি নির্দিষ্ট ভাবে থরে থরে সাজানো থাকে গজলের শব্দসমূহ এবং শব্দসজ্জার সুষমায় গজল বিধিবদ্ধ ভাবপথ ছাড়িয়ে আনন্দের স্বর্গ রচনা করে। তাই ছন্নছাড়া কিছু শব্দকে পাশাপাশি বসিয়ে দিলে গজল হয় না। তার শব্দসাজ এমন হতে হবে যাতে শের-এ শব্দগুলির পৃথক অর্থের বাইরেও অর্থ-ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হতে পারে। এইজন্য শব্দচয়ন, শব্দসজ্জা, অলংকার ও ছন্দ যথেষ্ট কার্যকরী। গজল কেবলই শব্দের ধ্বনি নয়, শব্দপ্রয়োগের গুণপনাও বটে।—যা শায়রের সূক্ষ্ণভাব, অনুভূতিকে পাঠকসাধারণের মনের ঘরে সহজেই পৌঁছে দেয় অথবা অচেতন বা অর্ধচেতন শ্রোতার অনুভূতির তন্ত্রীতে ঘা দিয়ে মনের মণিকোঠায় সুরেল অনুরণন সৃষ্টি করে।

অতএব গজল উদেশ্যমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অনুদিষ্ট গজল নিরর্থ বিড়ম্বনা।গজলের আর্ট এমনই সুকুমার, তার কৌশল এমন চতুর, কথা এমনই মর্মস্পর্শী, ব্যাখ্যা এত সজীব, এত অসন্দিগ্ধ, আবেগ এমন গভীর, এমনই অখল যে তা মহৎ উদ্দেশ্যে রচিত না হলে ক্ষতির সম্ভাবনা। সুখের কথা, আধুনিক কবিদের মধ্যে এ সচেতনতা এসেছে। অনেক কবির গজলে কথকতার স্বচ্ছ প্রাঞ্জলতা তর্কের ঝঞ্ছায় কোনও ক্রমেই আবিল নয়, গজলের আলোয়ায় পাঠককে ধর্মান্তরে টানবার কোনও চেষ্টাই নেই। ফলত আজকের গজলে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয় ঐক্য, বিশ্ববন্ধুতা, যুদ্ধবিরোধী তত্ত্ব এবং ক্রিয়েটিভ মার্কসিজমের প্রসার ও প্রচারের দরজাও খুলে দিতে পারছে, এটি শুভ লক্ষণ। আমার বিশ্বাস, কাল-দরবার সেই জগলই বেঁচে থাকবে যা সচেতন প্রয়াসের ফসল এবং যাতে থাকবে যুগরোগের নির্ভুল নিদান।

ভাব আর ভাষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। কেন-না ‘ভাষা ও ভাব সম্বন্ধে কোনো রকম পূর্বসংস্কার পোষণীয় নয়, এবং আধুনিক তরুণ-তরুণীদের মতো তারাও মিলন-ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের হিতোপদেশ মানে না, বলে আবেগদৃষ্টিই যখন তাদের ধর্ম, তখন স্বয়ংবর প্রথার পুনঃপ্রচলন অত্যাবশ্যক। ন্যায় হোক, অন্যায় হোক, আমাদের কপটতার ভয় দেখিয়ে তারা তাদের অভিষ্ট সিদ্ধ করেছে।’ অতএব ভাব ও ভাষার কথা বাদ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে ছন্দের আলোচনা।

গজলকারের কাছে প্রথম প্রশ্ন হল—কোন ছন্দে লিখব? ছন্দ মানে, তার মিল নয়।মিল হল অপেক্ষাকৃত নতুন অলংকার, কিন্তু ছন্দ অনাদি। কবির পক্ষে মাত্রাবিতরণ কীরকম হবে এবং মিসরা ও মিতলা কতদূর ছড়িয়ে পড়বে, এসব জানা সবচেয়ে জরুরি। ব্যক্তিগতভাবে বলে নিই, আমি ছন্দশাস্ত্রে পণ্ডিত নই। তা ছাড়া গজলের ছন্দ-প্রসঙ্গ এত এলায়িত যে তার খুঁটিনাটি চর্চা এখানে অসম্ভব।

সংক্ষেপে বলা যায়, আবেগের সঙ্গে ছন্দের সন্নিপাতে গজলের জন্ম। উপমা-সহযোগে বলতে পারি, ছন্দ ও আবেগ সাঁড়াশির মতো। দুটি হাতলের মিলন বা আকর্ষণেই তার কার্যকারিতা। আদিম মানুষ প্রথম যেদিন ভাষা শিখল, তারা বুঝল যে সেই বাক্যগুলিই অনায়াসে আমাদের মনে থাকে যেগুলির মধ্যে যতির কোনো ব্যতিক্রম নেই। মুখর আবেগ শৃঙ্খলিত হল যতিতে। সুকুমার সেনের ভাষায়, ‘কথা বলিবার সময় মাঝে মাঝে শ্বাসাবেগ স্বতই শিথিল হইয়া আসে এবং নূতন করিয়া শ্বাস গ্রহণ করিতে হয়, তখন বাক্যে যে বিরাম হয় তাহাকে বলে যতি (pause, caesura)।  ধ্বনি ও যতির এই শেকলই সম্ভবত ছন্দ। ছন্দের প্রধান লক্ষণই হল যতিচ্ছেদ। কিন্তু ছন্দশাস্ত্রের এই বিধিনিয়ম বোধহয় সর্বত্র সমান কার্যকর নয়। প্রসঙ্গত, প্রসিদ্ধ হিন্দি কবি ধূমিলের কবিতা পড়া যাক—

‘এক সম্পূর্ণ স্ত্রী হোনে কে পহলে হী
গর্ভাধান কী ক্রিয়া সে গুজরতে হুয়ে
উসনে জানা কি প্যার
ঘনী আবাদী ওয়ালী বস্তিয়োঁ মেঁ
মকান কী তলাশ হ্যয়।
লগাতার বারিশ সে ভীগতে হুয়ে
উসনে জানা কি হর লড়কী
তীসরে গর্ভপাত কে বাদ ধর্মশালা হো জাতী হ্যয়।’

এ-কবিতায় ব্যাকরণগত সংজ্ঞার সীমাসন্ধি কোথায়? অথচ এতেই রয়েছে অদৃশ্য সুরঝংকার। ধ্বনি ও যতির সুসম্বদ্ধ উদগার। ব্যাকরণ বই বন্ধ করে শুনলে তা ধরা পড়বে। তখন মানতেই হবে যে আলংকারিকের কঠিন গণিতসাপেক্ষ ছন্দ ব্যতিরেকেও কবিতা লেখা যায়। বস্তুত সুকুমারবাবুরা যাকে ছন্দ বলেন সেটা যান্ত্রিক কৌশল মাত্র। হিন্দির অনেক কবি ওই যন্ত্রকৌশলটা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। তাঁরা আবার গজলও লিখছেন। কিন্তু আবেগের চৌবাচ্চা যেখানে শুকনো, সেখানে আস্বাদনের জন্যে ঘটি ডোবালে রসের জল উঠবে কেন? সনেটের কবি ত্রিলোচন শাস্ত্রীর গজল সংস্কৃতগন্ধী ভাষা আর সমাস-গুম্ফিত পদ ও তৎসম শব্দের ব্যবহারে ভারাক্রান্ত। যেমন ‘প্রশংসা পরার্থানুসন্ধান কী হ্যয়’, ‘কহাঁ স্বার্থ কা রঙ…’ ইত্যাদি। অন্যদিকে অতীন্দ্রিয় শ্রুতির কল্যাণে আমরা প্রচণ্ড রকমের গদ্যের মধ্যেও কখনও কখনও ছন্দোবদ্ধ কবিতার ধ্বনি শুনতে পাই। এই দুটি দিক নিয়ে চিন্তা করলে মনে হতে পারে, আবেগকে নিজের ছন্দ খুঁজে নিতে দেওয়াই প্রশস্ত। কোনও কোনও আধুনিক কবিতায় যতির কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নেই, কিন্তু চরণ বা চরণাংশের অর্থানুযায়ী শ্বাস নিয়মিত হয়। উদাহরণত—

‘ওহ শোষণ কে সিংহদ্বার পর
প্রতিশোধ কী গজ টক্কর হ্যয়
ওহ অন্যায় কে রাস্তে মেঁ
এক বারুদী সুরংগ হ্যয়
ওহ অনির্ণয় কী স্থিতি মেঁ
এক উঠা হুয়া হাত হ্যয়
ওহ ভারতী অওর অজ্ঞেয়-কে সামনে
মুক্তিবোধ অওর
নিরালা হ্যয়
ওহ এলিয়ট অওর পাউণ্ড কে খিলাফ
নেরুদা অওর মায়কোভস্কী হ্যয়।’

কবি নরেন্দ্র বশিষ্ঠ এখানে যে ছন্দ ব্যবহার করেছেন তাতে যতির ব্যতিক্রম আছে, ধ্বনিও ভিন্ন-ভিন্নতর। সাধারণ কবিতার ক্ষেত্রে এ ছন্দের বিকল্প নেই। কিন্তু গজলে তেমন নয়। এখানে নির্দিষ্ট অক্ষরের পরে শ্বাসের বিরাম অনিবার্য। গজল ছন্দ একটা স্বয়ম্ভর নিয়মের নিবিড় বন্ধনে নিটোল। কবিতায় যেমন ছন্দ মাত্রেই আবেগের পদাঙ্কে চলতে পারে, গজলকার তেমন আবেগের তাড়নায় ছন্দের বাঁধন ছিঁড়তে পারেন না। এ ছন্দের বিবর্তন ঘটেছে ঠিক কথা, কিন্তু সব ছন্দোবদ্ধ হয়ে চলে—এক ও পাশাপাশি। গজলের লক্ষণ যেহেতু তার গতিময়তা, সুতরাং ছন্দের নিয়ম এখানে আরও কঠোর—

‘খুশক পত্তা সহী প্যয়রোঁ মে ন ডালো মুঝকো।
অওর কুছ দের হথেলী পে সঁম্ভালো মুঝকো।।
আজ কে দওর মেঁ দম তোড় রহা হ্যয় কিরদার।
জল্দ অহসাস কে মলবে সে নিকালো মুঝকো।।
অওর কুছ দের অগর ঘর মেঁ উজালা চাহো।
শমআ কা আখিরী টুকড়া হুঁ জলা লো মুঝকো।।’

জকি আরিক সিদ্দিকীর এই গজলটিতে মনোযোগ দেওয়া যাক। এর প্রতিটি শেরের প্রথম পংক্তিগুলি একে অপরের চেয়ে পৃথক। কিন্তু দ্বিতীয় পংক্তিগুলি নয়।প্রত্যেকটি দ্বিতীয় পংক্তির শেষ পদ ‘মুঝকো’। এতে শুধু লালিত্য আর প্রবহমানতাই রক্ষা পায়নি, উপরন্তু গান অথবা পাঠ ব্যাপারেও সুবিধে। প্রতিটি শেরের প্রথম পঙক্তিগুলি আবৃত্তির সময় দু-বার করে এবং তার লয় আপাত বিলম্বিত করতে হয়। বিপরীতে, দ্বিতীয় পংক্তিগুলি একবারই এবং দ্রুত উচ্চার্য।

পাঠ্য গজলও সুরনির্ভর। তান-মান-তাল সংগীতের যেমন, গজলেরও তেমনি বিশিষ্ট গুণ।তাই শেরের অক্ষরবৃদ্ধি শ্রবণে ব্যাঘাত ঘটায় না। গজলের প্রথম পাদার্ধে বর্ণবৃদ্ধির সঙ্গে ছান্দসিকের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু দ্বিতীয় পাদার্ধে ছন্দের ঠাট অটুট। এই বিধিবদ্ধ সংকীর্ণতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে আবেগের আতিশয্য উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর। তবুও, এই স্বয়ংবহ ছন্দ-বাঁধন ছিঁড়ে কোনো কোনো কবি গজলকে কেন প্রথাসিদ্ধ ছাঁচে ঢালতে অসম্মত, তার উত্তরানুসন্ধান আবশ্যিক। প্রথমত, আজকের গজলে বিচিত্র ও বিচিত্রতর বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে, বিধিবদ্ধ সরু গলির মধ্যে গেগুলিকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করছেন। তাদের চাই খেয়ালি আবহাওয়া, প্রশস্ত পরিসর। ভাষা ও আবেগের স্বচ্ছন্দ বিচরণ ক্ষেত্র। তাঁদের মতে, প্রশস্ততা ও স্বাচ্ছন্দ্য গতানুগতিক ছন্দোবদ্ধতায় দুর্লভ। বুড়ো ছন্দের শাসন মানতে তাঁরা নারাজ। ভাষার ঝোঁক যেমন সরলতার দিকে, ছন্দের ঝোঁক তেমনি বিস্তৃতির দিকে।বহু আধুনিক কবি তাই গাণিতিক সূত্রের প্রতিবাদে সোচ্চার।

এঁদের দাবিকে ষোলো আনা নির্ভুল বলে উল্লেখ করেছেন সমালোচক খুর্শীদ আলম খাঁ। উপরন্তু তিনি এঁদের প্রতি নিজের অনুমোদনকে জোরদার করতে ত্রিলোচন শাস্ত্রীর একটি গজলের উদ্ধৃতি দিয়েছেন—

‘প্রবল জলবাত পা কর সিন্ধু দুস্তর হোতা জাতা হ্যয়,
কঠিন সংঘর্ষ জীবন কা কঠিনতর হোতা জাতা হ্যয়।
কমাতা এক থা পরিবার পুরা চয়ন করতা থা,
অকেলে কা জীবন অব তো দুভর হোতা জাতা হ্যয়।
‘ত্রিলোচন’ তুম গজল মেঁ খুব আয়ে বাত বন আঈ,
নয়ে জীবন কা স্বর অব গান কা স্বর হোতা জাতা হ্যয়।’

এবং দেখিয়েছেন যে, এতে ছন্দের শাসন অক্ষরে অক্ষরে অনুপালিত হয়েছে কিন্তু তা শ্রোতার মনে গুঞ্জরন ঘটাতে পারে না। খাঁ সাহেব বলেছেন—যা শ্রোতাকে আবেগে আপ্লুত করতে পারে না, যা শুনে বুকে গুঞ্জরন ঘটে না, সে গজলের দাম কী? এখানেই আসে নতুনের প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। খাঁ সাহেবের বক্তব্য—গজল এমনই এক লোভনীয় ও আবেগপ্রবণ কাব্যশৈলী, যাকে বিশেষ কোনো ফর্মের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা অন্যায়।

এ দাবির পুরোপুরি অনুমোদন আমার পক্ষে অসম্ভব। তাতে গজলের মিউজের অবমাননা হবে। যাঁরা গতানুগতিকতার বিরোধিতা করছেন তাঁদের ‘গজল’ সিদ্ধির চূড়ান্ত সীমাস্বর্গে পৌঁছাতে পেরেছে কি? পারেনি। তাঁদের সাম্প্রতিক কাব্যচর্চার নমুনা দেখলে বোঝা যায় তাঁদের ব্যর্থতা। পক্ষান্তরে অ্যান্টি-ফর্মিস্ট কবিদের দাবিমতো তাঁদের সমগ্র রচনাকর্ম তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও গজল-সংগঠনে সাফল্য, ভাষার যথার্থ ব্যবহার, নতুন শব্দ নির্মাণ ও প্রয়োগের কুশলতা কিছুই মেলে না। মিতলা-মিলের নিয়ম অনুসৃত না হলে এবং ছন্দরহিত গজলের নামে কিন্তু ছন্নছাড়া শব্দের পৌনপুনিক ব্যবহারে গজল হয় না। বস্তুত, মিতলা-মিলের গূঢ় শৃঙ্খলের মোচন তখনই বাঞ্ছনীয়, যখন কোনও উপায় ও ভাবের বৈকল্পিক বিন্যাসে সেই প্রতিসাম্য হবে সুগঠিত।

গজলের বাঞ্ছিত সহজতার পেছনে রয়েছে নতুন কবির অপ্রাকৃত আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা পূরিত হলে গজলের পতন অনিবার্য। কিন্তু যে-হারে তাঁদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে, ভয় হয়, তাতে হয়তো একদিন গজলের মাত্রাগণনাই উঠে যাবে। তখন গজল হয়ে দাঁড়াবে ডিসকো প্যাটার্নের এক হালকা জিনিস। বস্তুত, ছন্দ ছাড়া গজল নৈব নৈব। ছন্দের জ্ঞান যে-কবির হয়নি, গজলের মহাপ্রাসাদে তার প্রবেশ দুরাশা মাত্র। গজলের একটা নির্দেশ আছে। নির্দেশিকাটি হল তার ব্যাকরণ—ছন্দ। যা হারালে পথভোলা হবার আশঙ্কা। এটি অস্বীকার করে যাঁরা দুর্গম পথে পা বাড়াতে সাহসী হয়েছেন তাঁদের বোঝা উচিত, যে বিশিষ্ট ছন্দের বলে গজল কাব্যরাজ্যে রাজতনয়ার সম্মান পেয়েছে তাকে নিয়ে এলোমেলো ব্যবহারে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।প্রকৃত গজলকারের অগ্নিপরীক্ষার শুরু এখানেই। তাঁকে বুঝতে হবে, যে সীমায়িত গণ্ডি তিনি পেয়েছেন তার মধ্যেই তাঁর বিচরণ। তাঁকে ওই সংকীর্ণতাকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করেই আধুনিকতার সীমারেখায় পৌঁছোতে হবে।

গজলের মুক্তি ছন্দমুক্তিতে নয়। এ সত্য অনেকে অস্বীকার করলেও, কার্যত অগ্রাহ্য করতে পারেননি। উদাহরণত, সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ‘নিরালা’, যিনি বলেছিলেন ‘ছন্দের শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াতেই কাব্যের মুক্তি’, তিনিও নিজের ‘বেলা’ কাব্যগ্রন্থের গজলগুলিতে ফারসি ছন্দের অনুশাসন না মেনে পারেননি। অনেকের ধারণা, মুক্তছন্দের অর্থ রূপ বা ছন্দানুশাসনের মুক্তি। বস্তুত, তা প্রাচীন ছন্দানুশাসন থেকে বেরিয়ে আসা এবং নতুন রূপানুসন্ধানেরই নামান্তর, ছন্দমুক্তি নয়। ক্বচিৎ তা প্রাচীন ছন্দেরই আধুনিকীকরণ। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্বয়ং নিরালাজী। এই নবীনতাই কবিতার অম্বিতি। আমি বলব, লয় আর সংরচনার লয়াত্মক চেতনা ব্যতীত গজল হয় না।

অনুবাদের প্রশ্নটা এখানেই বিবেচ্য। যা-কিছুই প্রাচীন, তার সঙ্গে আধুনিক জীবন ও দেশকালের ব্যবধান স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ব্যবধান অনতিক্রম্য নয়। প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যে যোগসূত্র, অনুবাদই তার স্বর্ণসেতু। গালিব, মীর বা ফয়েজের সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যে সংলগ্নতা—এটা সম্ভব ছিল না যদি-না আমাদের জীবনের সঙ্গে তাঁরা এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যেতেন। শ্রেষ্ঠ রচনামাত্রেই অনুবাদের মুখাপেক্ষী। তারই প্ররোচনায় আমরা যুগে যুগে সেগুলিকে বয়ে নিয়ে এসে ‘ক্লাসিক’ সংজ্ঞা দিই। আজকের সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিবেশেও তাই মীর-গালিবের সংলগ্নতা নিবার্য হয়ে যায়নি।

অনুবাদের অনুবাদও বাঞ্ছনীয়। ভাষা যেহেতু একটি নিত্যসাধন ও পরিবর্তনধর্মী বস্তু এবং ভাষাই যেহেতু সাহিত্যের বাহন, সুতরাং কোনো একটি অনুবাদ একসময় উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হলেও পরবর্তী কালে তা পর্যাপ্ত থাকে না। আজ যে ভাষা সরল, ভবিষ্যতে সেই ভাষাই দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে পারে। নতুন অনুবাদই পারে সরলতর ভাষার মাধ্যমে প্রাচীনকে সজীব ও সমকালীন সাহিত্যের অংশ করে তুলতে।প্রত্যেকটি যুগ ভাষার যে বিশেষ ভঙ্গিকে নিয়ে এগোয়, তার সঙ্গে গাঁটছাড়া না বাঁধলে প্রাচীনের পুনরুজ্জীবন ঘটানো যায় না।

সুন্দরী মেয়েরা নাকি বিশ্বস্ত হয় না, যদি হয় তবে সে সুন্দরীই নয়। এইরকম একটা প্রবচন শুনতে পাই। গজলের অনুবাদ সম্পর্কেও অনেকে এই প্রবচনটা চালাতে চান। সত্যিই কি তাই? সুন্দর ও বিশ্বস্ত অনুবাদ কি এমনই অসম্ভব? প্রশ্নটা অমূলক নয়। সাধারণ কবিতায় এ-ধারণা ভ্রান্ত, কিন্তু গজলের বেলায় যুক্তিযুক্ত। সাধারণ কবিতার অনুবাদ মূলানুগ করতে গেলে মূলের রস পাওয়া যাবে না বলে যাঁদের ধারণা, আমি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে পারি ঢাকা বাংলা আকাদেমি কর্তৃক প্রকাশিত অলবিরূণীর বঙ্গানুবাদ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব কৃত কালিদাস-অনুবাদ; এমনকি, শুভম চক্রবর্তীর ‘শ্রীচৈতন্যের শিক্ষাষ্টক ও অন্যান্য কবিতা’। এইসব তর্জমা কেবলমাত্র মূল কাব্যের প্রতিনিধিত্বই করেনি, রচয়িতা ও অনুবাদকের ব্যক্তিত্বের পরিচয়বাহী হয়েছে।

আসলে, ভাষাকে আমরা জন্ম দিই না, ভাষাই আমাদেরকে রচনা করে।ভাষা সহচরী হয়ে, সহধর্মিণীর মতো আমাদের জীবনের ‘ঋত’ পূরণ করে। ভাষা সেই আত্মজা, যে আমাদের ‘আত্মসম্ভবা অভিব্যক্তিকে’ সার্থক করে। অনেকের ধারণা, সৃজনশীল লেখকের পক্ষে অনুবাদ অকর্তব্য। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে অনুবাদ মৌলিক রচনার চেয়েও অধিক সমাবেশী সৃজনাত্মক প্রতিভার কাজ। সেখানে দুটি ভাষার রচনাভঙ্গির সঙ্গে অনুবাদককে একাত্ম হতে হয়। মৌল লেখকের সমপরিমাণ শৈল্পিক ক্ষমতা এবং সৃজনশীল কল্পনা ছাড়া অনুবাদ ‘ভাষিক রূপান্তর’ মাত্র। ভাষা শাড়ি পালটানোর মতো স্থূল বা বাহ্যিক ব্যাপার নয়।তা যদি হত, তাহলে অনুবাদের কাজ কমপিউটার যন্ত্রই স্বচ্ছন্দে করতে পারত। বস্তুত, অনুবাদ সৃজন-ব্যাপার এবং তা অনুবাদকের কাছে চ্যালেঞ্জ ছাড়া কিছু নয়। অন্যের লেখার মধ্যে তিনি নিজের সৃষ্টিকে খোঁজেন। এ-কাজে ব্যক্তিগত আস্বাদনের স্থান অনেকখানি এবং তাতে ব্যক্তিগত আনন্দের অবাধ খেয়ালি রূপটাই ধরা পড়ে। অনুবাদকের ব্যক্তিগত আস্বাদন থেকে উদ্ভূত অনুবাদে মূল স্রষ্টার ব্যক্তিকে ছোঁয়া যায়।

কিন্তু এখানেই গজল-অনুবাদকের সীমাবদ্ধতা। মূল রচনাকার যেখানে স্বতন্ত্র, অনুবাদক সেখানে পরতন্ত্র। যে অভিজ্ঞতা বা যন্ত্রণা নিজের নয়, অপরের, তাকে আত্মসাৎ করে ভাষান্তরে প্রকাশ করতে গেলে তা প্রমাণিত হবে কি? ভাষানুবাদের মূল্য আছে। একটি গজল যখন অন্য ভাষায় রূপান্তরিত হয় তখন তা নিজের সমস্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ‘ইথস’কে বহন করে আনে। মূলের আঙ্কিক ও অখণ্ড পরিপূর্ণতা নিয়েই তা আসে। অনুবাদের একটা নির্বিবাদ শর্তই হল, তাতে মূলের জীবন্ত ও সংবেদিত বিম্ব যেন সংপ্রেষিত হয়। প্রকৃত অনুবাদে মূলের যাবৎ প্রাণশক্তি ও সজীবতা তার অন্তর্নিহিত প্রতীকী-ব্যবস্থায় ও ফ্যানটাসি-উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।

হুবহু অনুবাদে মূলের স্বাদ দুর্লভ।তাতে ‘ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি শুধু ব্যঙ্গ করে, ধ্বনির কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে’। ভালো অনুবাদক শুধু মূলের ওপর নির্ভর করেন না। যেটুকু ভাষা তিনি পান সেটুকুই তাঁর পুঁজি নয়। তিনি স্বয়ং ভাষা তৈরি করেন। কেন-না তিনি জানেন, অনুবাদ যে ভাষায় করা হচ্ছে সেই ভাষারই লেখ্য ও কথ্যশৈলীতে তা জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, অন্য ভাষার শৈলীতে নয়। তর্জমার অর্থই হল পরের জিনিসকে আপন করে নেওয়া।

কিন্তু, এই শর্তের পূরণে গজলের অনুবাদ সম্ভব নয়। গজলের অনুবাদ সুন্দর হলে তার প্রামাণিকতায় সন্দেহ জাগে এবং তা প্রামাণিক হলে কখনোই সুন্দর হয় না। রুবাই-কতএ-নগমা প্রভৃতি শৈলীর কবিতা অনুবাদ একাধারে সুন্দর ও বিশ্বস্ত হতে পারে, কিন্তু গজলের বেলায় তা হয় না। কবিতা ও শের ভিন্ন। ফিরাকের ভাষায়, ‘যা মনকে ছুঁয়ে যায় তা শের, এবং কবিতা লেখা হয় যোগীর ধ্যান ভাঙানোর জন্য।’ যদিচ দুটিতেই কবিসত্তা স্বয়ং দীপ্যমান, অথচ আধার-ভেদে ভাব-ভঙ্গি ও আঙ্গিক তথা শব্দগঠনের দরুন প্রকাশে কিছু কিছু নিজস্ব বিশেষতা দেখা দেয়-যাকে নাকতোলা করা যায় না। কবিতার আক্ষরিক অনুবাদে মূলের রস পাওয়া যায় না, আবার গজলের ভাবানুবাদেও সেই রস দুর্লভ। অনেক প্রথিতযশা কবি গালিব, মীর, ইকবাল প্রমুখের গজল তর্জমা করেছেন, সেগুলির বেশির ভাগই ভাবানুবাদ হওয়ার দরুন মূলানুগ (ছন্দের দিক থেকে) হতে পারেনি। ফলত সেই অনূদিত বস্তুগুলিকে গজল না বলে কবিতা বলাই বাঞ্ছনীয়। দেশকাল ও পারস্পরিক সংলগ্নতা রক্ষার জন্যে এই ধরনের ভাবানুবাদের প্রয়োজন আছে স্বীকার করি, কিন্তু তাতে ব্যাকরণটা থেকে যায় দাসীর মতো পিছিয়ে।

গজলের ফর্মের একটা অপরিহার্য লক্ষণই হল এই সংকীর্ণতা। চৈতন্যধারাকে আতলস্বচ্ছ রাখতে হলে তাতে খাল কেটে বাইরের জল ঢোকানো যায় না। জনাব মুমতাজুর্রশীদ সাহেব লিখেছেন, ‘গজল এমনই এক নজম, যার প্রতিটি শের স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অন্য শেরের ভাব থেকে ভিন্ন।’ অর্থাৎ গজল কেবলমাত্র দুটি পঙক্তির মধ্যে লেখা হয়। দুটি পঙক্তির ডোরে যে সুরভিত পুষ্পের মালা গাঁথা হয় তাকে কাব্যিক ভাষায় বলতে পারি ‘রদীফোকাফিয়া’। কাফিয়া শব্দটির অর্থ ছন্দমিল, আর যে শব্দসমষ্টি সমগ্র গজলটিতে এঁটে থাকে তাকে বলে রদীফ। বলতে কি, রদীফ আর কাফিয়া বাদ দিয়ে আর যাই হোক, গজল হয় না।রদীফ ও কাফিয়ার যুগ্ম মিলনে গজল এমনই এক লিরিক, যার প্রতিটি শের স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।

এখনকার কিছু কবি গজলকে এই প্রথাসিদ্ধ ছাঁচে ঢালতে সম্মত নন।কিন্তু তাঁরা যে স্টাইলে অভ্যস্ত হতে চাইছেন, সেটাকে ‘নতুন’ বলা যায় না। অনুমানত আটশো বছর আগে ফারসি ভাষায় গজলের জন্ম। আদি পর্বে যখন গজলের বিষয় ছিল শুধুই প্রেম, দ্রাহ্মাজাত, মদ ও মৌমাছি, সেই সময় রমাণি, সাদী, হিকমত প্রমুখের গজলে থাকত মাত্র দুটি পংক্তি বা মিসরা। প্রসঙ্গ হত একটাই। শায়রের আত্মতৃপ্তিতে তার বিস্তারপর্বের পরিসমাপ্তি ঘটত, কেননা গজল আগে শায়রের, পরে অন্যের। প্রতীক ব্যবহার ছিল না, বস্তু শুধুই বস্তু। ছিল দার্শনিক তত্ত্বের অভাব। তাই একাধিক শেরের প্রয়োজনও ছিল না।

পরবর্তী কালে এই আঙ্গিক অব্যাহত থাকেনি বটে, কিন্তু ভাবের দিকেও কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়নি বহুকাল। গজলে একাধিক শেরের ব্যবহার তখন থেকেই। কিন্তু প্রসঙ্গ ছিল এক ও অভিন্ন। একই ভাব ঘুরেফিরে আসত। তাকে টেনে বড়ো করা হত নিছক কারিকুরি দিয়ে। সেটায় খুব একটা ফলশ্রুতি ঘটত না। কেননা কালোয়াতির ঘোরপ্যাঁচে মূল বক্তব্যটাই চাপা পড়ে যেত। এইসময় হাফিজ সিরাজীর আবির্ভাব ফারসি গজলের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ সিদ্ধ হয়েছে। তাঁর গজলেই প্রথম শব্দ আর অভিব্যক্তিতে দুটি বিশিষ্ট রূপ ফুটে উঠেছে। তিনি কাব্যপ্রকরণেও আনলেন অভিনবত্ব। একই গজলে দুই বা ততোধিক প্রসঙ্গ এল, অথচ গজলের ঐক্য অক্ষুণ্ণ রইল। ‘আপাত বিষম প্রসঙ্গ জুড়ে এক অপূর্ব সামঞ্জস্য পৌঁছোল—গজলে এ জিনিস হাফিজের আগে ছিল না। কোনো প্রসঙ্গ পুরোপুরি আনারও দরকার নেই। খণ্ডভাবে আনলেও তা সমগ্রের অঙ্গীভূত হবে। অভ্যস্ত শ্রোতাদের স্মৃতিতে বহুশ্রুত কবিতার সঞ্চিত ভাণ্ডার থাকায় হাফিজের এই নতুন রীতির গজল রসগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটেনি। ল্যাজ টানতেই মাথা এসে গেছে।’১০

এই আনুকূল্যের ফলে, হাফিজ নতুন ফর্মের বোঝা স্বচ্ছন্দে চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন তাঁর উত্তরসাধকদের রথের মাথায়। সেই রথ যেখানে এসে থেমেছে সেখান থেকেই শুরু হয়েছে ভারতীয় গজলের উত্থানপর্ব। আমির খুসরোর জমানা থেকে শুরু হয়েছে গজলে ভিন্ন ভিন্ন চরণে একই কথা বিভিন্ন ভাবে ও সুরে একাধিক শেরের ব্যবহার। প্রথম শেরের দুটি মিসরাতে হামকাফিয়া হয়। এটিকে বলা হয় শেরে-মিতলা। পরের শেরগুলিতে অন্য মিসরাগুলিও এক-একটি হামকাফিয়া রচনা করে। গজলের শেষ শেরটিকে বলা হয় মকতা, যাতে শায়র নিজের মুখসর নাম (Take Name) কিংবা তখল্লুস বা মূল বক্তব্য প্রকাশ করেন। যেমন

‘উও কৈস অব জিসে মজনু পুকারতে হ্যঁয় ফরাজ
তেরী তরহ কোঈ দিওয়ানা ঘর সে নিকলা থা।’

শেরটি একবার পড়েই আমরা বলে দিতে পারব এর রচয়িতা আহমদ ফরাজ। এ ধরনের ভণিতার কারণেই শ’ শ’ বছর আগে লেখা গজলেও কবি-শনাক্ত করা সহজ। একটি গজলে একাধিক মিতলা হতে পারে, কিন্তু মকতা নয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ফর্মের নামে এত টেকনিক্যাল ঝামেলার দরকার কী? বরং স্রষ্টা নিজেই সেইসব বন্দিশগুলিকে ভেঙে ফেলুন, যেগুলি ফর্মের নামে জটিলতা সৃষ্টি করছে। এর জবাবে গজলকার ধনঞ্জয় বর্মা বলেছেন—‘আমরাও ফর্মালজিমের অন্ধ অনুগামী নই।তার জানিবদার না-হওয়াই আমাদের পক্ষে সুবিধাজনক। কিন্তু গজলের ফর্ম কোনও তুচ্ছ অনুষঙ্গ বা ফালতু ব্যাপার নয়। গজলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তই হল প্রচলিত গতে অহসাস ও অলফাজ (অনুভূতি ও ভাবনা) ব্যক্ত করা। গজলের আসরে শ্রোতার মনে যে স্বর্গীয় ভাব উদ্রিক্ত হয় তা গজলের পক্ষেই সম্ভব। তার এক-একটি শেরে সৌন্দর্যের গাঁট থেকে অপূর্ব রূপচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়, সুগন্ধী পুষ্পের সুবাসে ভরে যায় মন, নির্মোচন ঘটে স্বর্গীয় অনুভূতির।’১১

একথা স্বীকার করব যে গজল মূলত লিরিক এবং তাতে বাড়তি শব্দ ও ইঙ্গিতময় ভাষার আপাত উদ্ভটতা, আঙ্গিকের দুরূহতা তথা মর্মময়তার পার্থক্য যত কম থাকবে ততই ভালো। এরই সঙ্গে ফ্রস্টের উক্তি ধার করে দাবি জানাব—ঝরাপাতা, শুকনো পাতা সরিয়ে দাও, যাতে স্বচ্ছ জল আসতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে গজলের ফর্মকেই অগ্রাহ্য করব। বস্তুত, গজলের গঠন এত পুষ্ট ও দৃঢ় যে অপরাপর কাব্যশৈলী অভিব্যক্তির তীব্রতা নিয়ে সেই সীমা পর্যন্ত এগোতে পারেনি, যেখানে গজলের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এতে যে ভিন্ন ভিন্ন শের থাকে সেগুলি নিজেদের মধ্যেই সম্পূর্ণ সংবেদনের সংবাহক। অর্থাৎ প্রতিটি শের স্ব-নির্ভর। তারা অনুভূতি ও চেতনাকে নিজের মধ্যে গুছিয়ে রাখার সমতা রাখে।যেমন ফিরাক বলেছেন, ‘গজলের প্রতিটি শের নিজেদের মধ্যে এক-একটি দুনিয়া। তারা বড়ো কথাকে ন্যূনতম শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম।’

পুনরুক্তি হোক, তবু বলব, গজলের প্রতিটি শের রচনাচাতুর্যের গুণে এক-একটি সংসার। এখানেই স্বীকৃতি পায় তার শিল্পের অন্তর্নিহিত প্রসরণশীলতার গুরুত্ব। গজলের শিল্প, কথ্যকে যুগপৎ বাঁধন ও স্থিতিস্থাপকতা—দুই-ই প্রদান করে। নানা রঙের লাচ্ছি ক্রমে খুলে যেতে থাকে, যার সেই ছোট্ট সংসার এমনভাবে বিস্তার লাভ করে, যা গজলের শিল্পে বক্তব্যের প্রসরণশীলতারই চমৎকার। ফিরাক গোরখপুরীর ভাষায়—‘গজলের প্রতিটি শেরে এমন একটা জাদু থাকে যে জীবনের অনেক পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে ও অবকাশে, বিষয়ে ও ব্যবহারে খাপ খেয়ে যায়।’১২ আধুনিক গজলের ক্ষেত্রে নানা অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার সহাবস্থান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দেশ ও মানুষের ইতিহাসগত অস্তিত্বে যে অবস্থান্তর তর্কাতীত সত্য, গজলের প্রবহমান সত্তায়ও তা সমাক্রান্ত সত্য। এ হচ্ছে মনের বদল, মননের আদান-প্রদান, বাচনভঙ্গির মিথষ্ক্রিয়া।

বর্তমান প্রাবন্ধিকের এ মন্তব্যে কেউ যদি স্ববিরোধ বা বিরোধাভাস লক্ষ করে থাকেন, তাঁর সঙ্গে বিবাদে নামব না। বরং বলব, সেই অন্তর্বিরোধটা গজলেরই শক্তি এবং এই শক্তির ওপর নির্ভর করেই জীবনের অন্তর্বিরোধসমূহ ব্যক্ত করার ব্যাপারে গজল সম্ভাবনাময়। গজল পাঠের সময় মনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে এবং সমস্ত নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে দিলে মনের গভীরতম বেদনা বা উপলব্ধি চেতনার উপরিভাগে ভেসে উঠবে। হয়তো এই কারণেই চেতনার অন্তর্লোকে অবতরণ করা আধুনিক গজলকারদের পক্ষে সহজ হয়েছে। মানসিক চেতনা প্রকাশের প্রকৃষ্টতম মাধ্যম হল গজল এবং মীর, গালিব, ইকবাল, হালি, ফিরাক, ফয়েজের গজলে যার সন্ধান একেবারে দুর্লক্ষ্য নয়। কেননা কবিতার জন্ম ‘from a strong personal need, rather than from any thorough understanding of any ideology.’

গজলের পারস্পরিক সংস্কারে কল্পনার রং এমনই চড়া যে তা থেকে অব্যহতি পেতে কোনো কবির আকাঙ্খা নেই। এমনিতে, প্রসরণশীলতা হল গজলের মেজাজ, যার সংবেদনশীলতাকে বজায় রাখতে স্থিতিস্থাপকতা একটি জরুরি শর্ত। কিন্তু গজলের প্রধানতম বিশেষত্ব কল্পনা ও দ্রবণশীলতা। কল্পনা দোষের নয়, কাল্পনিকতা দোষের। আর দরদভরা দ্রবণশীলতা তো কোনো কালেই অনাদৃত নয়। কেননা আমাদের ভেতরতর সমস্ত অনুভূতির মধ্যে দরদ বা বেদনার স্থান সর্বাগ্রে। দরদের সঙ্গে গজলের হার্দ্যতা সর্বকালের। যে-সব গজল আমরা তৃপ্তিহীনভাবে আবৃত্তি করে যাই সেগুলির মূল ভাবই হল বেদনাবোধ। অন্তরের গভীরতম বেদনা বা উপলব্ধি চেতনার উপরিভাগে উঠে আসে বলেই এই ধরনের শের রচিত হয়েছে—

‘ফিক্র মোমিন কী, অদা দাগ কী, গালিব কা বয়াঁ
জোক কা রঙে-সুখন হো তো গজল হোতী হ্যয়।’

আজকের বহু প্রতিষ্ঠিত গজলগোর ‘কবি হয়ে ওঠা’র ইতিহাস অন্বেষণ করলে জানা যাবে, তাঁদের প্রত্যেকেই একটি সস্তাবনাময় শৈলী হিসেবে গজলকে ব্যবহার করেছেন। মনের বেদনা যখন ছাপিয়ে উঠতে চেয়েছে তখনই তাঁরা গজলে আশ্রয় নিয়েছেন। দুষ্যন্ত কুমার যখন বলেন, ‘আধুনিক কবিতার বাগজাল ও একঘেয়েমিতায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি গজলে আশ্রয় নিয়েছি’১৩ তখন বুঝতে হবে তিনি গজলের প্রসরণশীলতার গুরুত্ব বুঝেছিলেন। এবং তিনি যখন বলেন, ‘আমি নিজের যন্ত্রণাকে—সেই সুদুঃসহ বেদনাকে, যাতে আমার বুক ফেটে যায়—প্রকাশ করতে এবং অধিকাধিক সততা ও সমগ্রতা সহ বহুসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গজল লিখেছি’, তখনও ধরতে হবে তিনি গজলের মেজাজ-গত সেই দ্রবণশীলতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।

যাঁরা মনে করেন কবিতার সামাজিক দায়িত্ব নেই, তারা এই চিন্তায় আত্মতুষ্টি প্রকাশ করেন যে আধুনিক কবিতার পাঠক কম হলেও তাদের সংখ্যায় হ্রাস-বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু গজলের ক্ষেত্রে এই যুক্তি অমান্য। গজলের পাঠক বাড়ছে এবং গজলের মূল ভাবধারা—বেদনা ও হৃদয়বোধ অটুট থাকলে, ভবিষ্যতে পাঠক বাড়বে এটা নিশ্চিত। পাঠক সবসময় স্বসময়ের ও স্বহৃদয়ে মুখপাত্র খোঁজে, যে আয়নার কাজ করবে। গজল সেই আয়না। সব গজলকারই যে জনগণের জন্যে লেখেন—এটা বাড়িয়ে বলা। ‘সকলের জন্যে লেখা’ সবাই পড়ে না। বরং বলা উচিত গজলের ব্যক্তি প্রকাশিত হলে পাঠকের ব্যক্তি হয়ে ওঠে বলেই তার কদর।

তাই প্রশ্ন ওঠে, কে আগে?—গজল না গজলকার? গজলটি যখন আমাদের শ্রদ্ধা কেড়ে নেয় তখন তার প্রশংসা লাভ করেন অবশ্যই স্রষ্টা, গজলকার। অথচ এ-কথা সত্য যে, গজলকার ছিলেন বলেই গজল এল, যা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। গজলে যে বিশেষ কিছু একটা থাকে সেটা কী? সেটা পারসেপশন, কান আর চোখ দিয়েই আমরা গজল বুঝি। বিপরীতে বলা যায়, গজল ছিল, ছিল বলেই কবির সৃষ্টি-বেদনা এবং কবি তাকে ভ্রূণ থেকে অবয়বে রূপান্তরিত করলেন বলেই তিনি স্রষ্টা। অন্যপক্ষে গজলকারের পক্ষাবলম্বন করে বলব—

‘জাতককে নিয়ে সবাই মেতে থাকলে জননী রাগ করে না
বৃষ্টিকে নিয়ে সবাই মাতলে মেঘ অভিমান করে না।’

গজলের নিয়তি গজল নিজেই খুঁজে নিয়েছে। আজ যখন সাধারণ কবিতার পাঠক ডোডো পাখির মতো অবলুপ্তির পথে, তখন গজলের সম্ভাবনা আমাদের আশা জাগায়। উর্দু ও হিন্দী ভাষার অনেক কবিই সাধারণ কবিতা, নঈ কবিতা, নজম, রুবাই, দোঁহা, ছপ্পয়ের পুষ্করিণী ছেড়ে চলে আসছেন গজলের বহবতী নদীতে। দুষ্যন্ত কুমারের ভাষায়—‘কৃত্রিম আধুনিকতা কবিতাকে সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে ক্রমে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কবিতা নিরন্তর সেলফ-আইডেনটিটি খুঁজেই চলেছে। তাই কবিরা দলে দলে গজলের দরবারে ধর্ণা দিচ্ছেন। পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ যাতে সহজ ও অটুট হয়, তাই এই ধর্না।’১৪

আবার পূর্ব-প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গজলের জটিল নির্মাণভূমির ইতিহাস আলোচনার মধ্যে দিয়ে গজলের ‘উৎস’ সম্পর্কে কিছু তথ্য জানানো সম্ভব হয়েছে বলে ধরে নিতে পারি। কিন্তু ফর্মালিজমের এই কচকচিতে তার ‘ব্যাকরণ’ সম্পর্কে একটা ধারণা মিললেও, গজলের সংজ্ঞা জানা যায়নি। বস্তুত, সত্যি সত্যিই গজলের কোনো সংজ্ঞা আছে কি না, তা-ও জানা যায়নি। সাহিত্যের বহমান ধারাতে যে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে চলেছে—তাতে কোনো সাহিত্য প্রকরণের যথাযথ সংজ্ঞা স্থিত হতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস। কাব্যশাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে গজলের কোনো নিশ্চিত ছান্দিক ছাঁচ কখনও ছিল না, এখনও নেই। এক মুহূর্ত এর দাঁড়াবার অবকাশ নেই। যার গতি এমনই তীব্র যে কোনো একটি সংজ্ঞা প্রদত্ত হলে, পরক্ষণেই তার আমূলপ্রোথিত ভিতটুকু নড়ে যায়। আসলে, গজল একটি কাব্যশৈলী, ‘উক্তিপরক’ ধরনের গীতিশৈলী। কবিতার ‘অর্থ’ যেমন নিশ্চল নির্দিষ্ট পদার্থ নয়, গজলও তেমনি একটা বেগ, গতির বেগ—যা কাব্যশব্দসমূহকে আমাদের কাছে হাজির করে আবার হাওয়ার মতো উড়িয়ে দেয়। আমাদের মন দূর থেকে দূরে চলতে থাকে। কবির দায়িত্ব যেখানে শেষ, আমরা সেখানে থামতে পারি না। গজল এমনই এক অবিশ্লেষ্য বস্তু যা ব্যক্তের মধ্যে অব্যক্তকে, বস্তুর মধ্যে অনির্বচনীয়কে ধারণ করে পাঠকের অভিনিবেশ দাবি করে। স্রষ্টার গল্পটি ফুরোলেও পাঠকের কাছে নটে গাছটি সহজে মুড়োয় না।

এমন অবিশ্লেষ্য ও জটিল জিনিশের কোনো একটি সর্বমান্য সংজ্ঞা নির্ধারণ সম্ভব নয়। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যদি বলি গজল মানেই ‘নারী-পুরুষের প্রেমালাপ’ বা ‘রমণীর সঙ্গে বার্তালাপ’, তাহলে আমি ক্ষমারও অযোগ্য। যদি বলি ‘গজল হল আত্ম-জিজ্ঞাসা, আত্মচেতনা এবং আত্মঅভিজ্ঞানের সন্ধানী আলো ফেলার যন্ত্র’ কিংবা যদি বলা হয়, ‘গজল হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হাতিয়ার,’ তা হবে ব্যক্তিগত উপলব্ধির প্রকাশ। সংজ্ঞা যতই ‘ব্যাপক’ হোক তা সংকীর্ণ হতে বাধ্য। গজলের গজলত্ব তার সুনিপুণ নির্মিতিতে—অনন্য রূপবন্ধে, অনুপম রসৈকভাবনায়। গজল এমনই অনন্য, স্বতন্ত্র ও অভিনব যে, কোনো একটি সংজ্ঞার শেকলে বেঁধে তাকে সীমায়িত করা সম্ভব নয়।

.

তথ্যসূত্র

১. মাজদা অসদ, ‘গজল : উত্তর অওর দক্ষিণ মেঁ’, আজকল, মে ১৯৮১

২. পশুপতিনাথ পাঠক ব্যাকুল, ‘সংগীত মেঁ গজল কা স্থান’, আজকল, মে ১৯৮১

৩. সাধনকুমার ভট্টাচার্য, ‘এরিস্টটলের পোয়েটিক্স ও সাহিত্যতত্তষ’, পৃষ্ঠা ২৩৭

৪. ফিরাক গোরখপুরী, ‘মেরী শায়রী’, পৃ. ১০৪

৫. Firaq Gorakhpuri, ‘On Poetry’, p. 126

৬. Joseph Vissarionovich Stalin, ‘Selected Works’, vol. 1

৭. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ‘কাব্যের মুক্তি’, ‘স্বগত’, প্রথম সিগনেট সংস্করণ, পৃ. ৩২

৮. সুকুমার সেন, ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’, পৃ. ২০৮

৯. মোহম্মদ মুমতার্জু রশীদ খাঁ, ‘অসনাফে সুখন’, পৃ. ২০৬

১০. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ‘হাফিজের কবিতা’, দেশ, ২৪ এপ্রিল ১৯৮১

১১. ড. ধনঞ্জয় বর্মা, ‘গজল কো গজল হী রহনে দেঁ’, ধর্মযুগ, ১৬ নভেম্বর ১৯৮০

১২. ফিরাক গোরখপুরী, ‘উর্দু কী ইশকিয়া শায়রী’, পৃ. ১৩

১৩. দুষ্যন্ত কুমার, ‘কল্পনা’, মার্চ ১৯৭৫

১৪.  দুষ্যন্ত কুমার, ‘সারিকা’-সম্পাদক কমলেশ্বরকে লেখা চিঠি

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন