অজিত রায়
আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক ছোটোবেলায় পাঠ্য বইতে পড়া একটি বাক্য কানে দুলের মতো লেগে আছে—‘কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না’।কেন জানি না এই অংশটুকু বাবা খুব টেস দিয়ে পড়াতেন। তিনি হয়তো সুবোধের মতোই ছেলের চরিত্র গড়ে তুলতে চাইতেন। কিন্তু বিলক্ষণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। স্কুলের টিফিন হলেই আমরা ট্যারা চোখওয়ালা এক বুড়ো মাস্টারমশাইকে ‘ট্যারা স্যার’ বলে খচাতাম। এর জন্যে কানমলা খেয়েছি অনেক বার। তাই সন্দেহ হয়, হিন্দীভাষায় লেখা গজলকে যদি ‘হিন্দী গজল’ নামে উল্লেখ করি, তাহলে হয়তো আবার কানমলা খেতে হবে।
হিন্দী ভাষায় লেখা গজলকে ‘হিন্দী গজল’ নামে আখ্যায়িত করার ব্যাপারে যাঁদের প্রবল আপত্তি তাঁরা আসলে পূর্বসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারেননি। সংস্কার অতি দুর্মর। মনে একবার বাসা বাঁধলে তাকে তাড়ানো কষ্টসাধ্য। ড. ধনঞ্জয় বর্মা ‘গজল কো গজল হী রহনে দেঁ’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন—‘আপনারা গজলকে গজলই থাকতে দিন, ‘হিন্দী’ বিশেষণ যোগ করার প্রয়োজন নেই। ‘হিন্দী গজল’ বললে আমি ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাই। হিন্দীভাষী কবি নিজের গজলে ফারসি-উর্দু ছন্দ, লয় ও প্রতীকিগুলি ব্যবহার করুন, আপত্তি নেই।কিন্তু তাকে হিন্দী গজল বলার দরকার কী? গজল শুধুই গজল, তার আবার উর্দু হিন্দী কী?’৪৩
এই মন্তব্যে বস্তুনিষ্ঠার কোনো ছাপ নেই। গোটা নিবন্ধটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন, গবেষণার আগেই ড. বর্মা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন এবং সেটিকে প্রমাণ করার জন্যে তথ্য বা পূর্বকল্পিত ধারণাগুলিকে ঠেসেঠুসে সাজিয়েছেন। সাহিত্য বিষয়ে এইরকম পূর্বকল্পিত ধারণা সংস্কারমাত্র। আর সংস্কার মাত্রই সত্য নির্ধারণের অন্তরায়।
হিন্দী গজল কথাটায় যাঁদের প্রবল আপত্তি তাঁরা হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে এই বিশেষ ছন্দটির প্রয়োগ কোনো একটি বিশেষ ভাষার ক্ষেত্রেই সম্ভব।কিন্তু, যদি ফারসির দায়রা থেকে বেরিয়ে গজল উর্দুর মতো একটি লশকারি জবানে দাখিল হতে পারে, তবে হিন্দীতেই বা হতে পারবে না কেন? হিন্দী উর্দু উভয় ভাষারই সর্বনাম, ক্রিয়াপদ, শব্দ-বাক্য-বাগধারা প্রয়োগ ও রচনারীতি অভিন্ন। ম্যঁয় হম তুম তু ওহ য়ে ইত্যাদি সর্বনামে কোনো প্রভেদ নেই। পণ্ডিত হরিশঙ্কর শর্মা জানিয়েছেন—‘সুমেরু, বিধাতা, বিহারী, শাস্ত্র, পীযুষবর্ষা, ভুজঙ্গপ্রয়াত, খরারী, হরিগীতিকা, আনন্দবর্ধন, দিগপাল, ভুজঙ্গী, চৌবাই প্রভৃতি ছন্দগুলি উর্দুতে ব্যবহার করা হয়।’৪৪ হিন্দী কবিতায় এগুলি প্রত্যাখ্যাত নয়। বরং কোনও কোনও ছন্দে হিন্দী ও উর্দু সমান অংশীদার। বস্তুত উর্দুর সমস্ত ভাব, স্টাইল ও ব্যাসবাক্য হিন্দীর মাত্রিক ছন্দ ও বর্ণবৃত্তে নিহিত আছে। ‘মফলুন ফায়লাতুন মফলুন ফউলুন’-এর মতো অনেক ভাবের কথা হিন্দী গজলে আক্ষরিক অনূদিত কিংবা অপরিবর্তিত থেকেই এসেছে।
হিন্দী কবিরা কেবলমাত্র জনপ্রিয়তা অর্জনের লোভে গজল লেখেননি।দায়িত্ব-সজাগ কবিরা সস্তা বাহবা কুড়োতে, চমৎকারিক শৈলী হিসেবে নয়—একটি সিরিয়াস প্রভাবকারী কাব্যশৈলী রূপে (সমকালীন হিন্দী কবিতায় তার উপযোগিতা বিচার করে) গজলকে গ্রহণ করেছেন। হিন্দী কবিদের সংবেদনশীলতা এবং চিন্তার আধুনিকতা, প্রগতিক উর্দু শায়রদের মতো, গজলকে সামাজিক যাথার্থ্যের নতুন পরিসর প্রদান করেছে। কতিপয় সমালোচক এমন ধারণা করেছেন যে-হিন্দীতে বহুল পরিমাণে গজল লেখা হলেও, সার্থক গজলের অভাব আছে। অনেকের মতে হিন্দী গজল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছান্দিক অনুশাসন মেনে চলে না। গজলের মূল মেজাজের প্রশ্নটাও কেউ কেউ তুলেছেন। বনিয়াদি মেজাজের যে প্রশ্ন—তার জবাব আমার কাছে আছে। যে-কোনো প্রাচীন শৈলীর মূল মেজাজ রক্ষা করবার নামে তাকে যদি সমকালীন চিন্তাধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখি, তবে মেজাজের শর্ত পূরিত হয় ঠিকই।কিন্তু সমকালীন সন্দর্ভে তার প্রায়োগিক সজীবতা বিনষ্ট হয়। যাঁরা গজলকে শুধু গুলো-গুলিস্তাঁ, বুলবুল, শরাব, সাকীসুন্দরী ইত্যাদি প্রাচীন নজাকতের জন্যেই পছন্দ করেন, তাঁরা প্রকৃত অর্থে বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থেকেছেন। উর্দুতে ফয়েজ, মজাজ, জিগর প্রমুখ এই কাল্পনিকতার মোহ ভাঙতে চেষ্টা করেও ভাঙতে পারেননি। কিন্তু হিন্দী কবিরা প্রথম থেকেই ওই স্বপ্নিল অবাস্তবতা থেকে দূরে সরে থেকেছেন।
গজলে শৈল্পিক বন্ধন ও লয়ের একসঙ্গে কায়েম থাকার যে শর্ত আছে, সেটি তার স্বাভাবিক নজাকতের বিরোধী পরিস্থিতিতেও সম্ভব। কেননা, গজলে পরস্পর-বিরোধী অনুভূতিও পাশাপাশি থাকতে পারে। হিন্দী গজলের চরিত্রহীনতার অভিযোগ তাই অবান্তর। হিন্দী গজলকারেরা শুধু আরবি-ফারসি-উর্দুর প্রতীকি ব্যবহারের বিপক্ষে। তাঁদের ঝোঁক বাস্তবতা ও সমসাময়িকতার দিকে।
শুধুমাত্র ভাষার ভিত্তিতে উর্দু আর হিন্দী গজলকে আলাদা করার পক্ষপাতী আমি নই। যাঁরা মেহেদি হাসন, গুলাম আলির গজল শুনেছেন তাঁরা বলবেন—গজলে আবার হিন্দি উর্দু কী? হিন্দি আর উর্দুর উৎস এক। দুটির জন্ম খড়ীবোলী থেকে।৪৫ কিন্তু হিন্দীভাষা কবিরা যদি উর্দুর এই বিশেষ কাব্যছন্দকে ব্যবহার করেন তবে উর্দুর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই থাকবে। হিন্দি গজল নজাকত ও ভাষার দৃষ্টিতে উর্দু গজলের মতো হতে পারে—কিন্তু উভয় ভাষার পার্থক্য যে আছে তা অনস্বীকার্য। অতএব হিন্দি শব্দপুষ্পে গাঁথা মালাকে ‘হিন্দী গজল’ বলতেই হবে।
‘হিন্দী’ কথাটায় যাঁরা ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পান, তাঁদের যুক্তি ধোপে টেকে না। উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক—সবই তো পশ্চিমের আমদানি। এখন কি তবে হিন্দীভাষায় লেখা উপন্যাসকে ইংরেজি উপন্যাস বলতে হবে? যদি উর্দু পরাম্পরার একটি শৈলী হিন্দীতে সম্পূর্ণ ওরিজিন্যালিটি নিয়ে হাজির হয়, তবে তাকে ‘উর্দু শৈলী’ বা শুধু ‘শৈলী’ বলবো কোন যুক্তিতে? সেটি পড়ে যদি কেউ সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পান, তাঁকে বলব—
‘য়্যাদ আনা হ্যয় অগর তো ইস তরহ আয়া করো
কোই কড়ুই বাত শীরীঁ লব সে কহ পায়া করো।’
মৌলানা মহম্মদ হুসেন আজাদ বলেছেন, বেশির ভাগ উর্দুর শায়রই নিজেদের কাব্যবস্তু, কাব্য-শাস্ত্রীয় ছন্দ, উপমা প্রভৃতি ভারতীয় পরিবেশ থেকে গ্রহণ না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফারসি শায়রীর অনুসরণ করেছেন। কিন্তু হিন্দী গজলে, তার উপমায় অলংকরণে, রূপকল্পে, রঙে, বর্ণনায়, ছবির আভাসে কবির মানসিকতা, দেশকাল, জীবনাচরণ, তাঁর ধর্ম-সংস্কৃতি, সৌন্দর্যচেতনা লক্ষ্যে বা অলক্ষ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এই গজলকে অবশ্যই ‘হিন্দী গজল’ বলা হবে।
হিন্দী সাহিত্যের আদি ও মধ্যযুগের বিরাট চত্বরে কোথাও গজলের হদিস মেলেনি। হিন্দীভাষাকে কাব্য-কবিতার একাধিপত্য পরিহার করে সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে নিজেকে সঞ্চারিত করে তুলতে প্রচুর সময় ব্যয়িত হয়েছে। ভারতেন্দুর আগে হিন্দীতে কেউ গজল লেখেননি। মুসলিম সুফিমত আদি হিন্দু সাহিত্যের বহুলাংশে প্রভাবিত করেছিল এবং পারসিক ভাষায় বিখ্যাত কবি আমির খুসরো দেহলবী (১২৫৩-১৩২৫) হিন্দী ভাষার একটি আঞ্চলিক ধারা অবলম্বনে কিছু গান ও ধাঁধা লিখেছিলেন। অনেকে সেই গানগুলিকেই গজল বলে চালাতে চান। কিন্তু সেগুলিকে গজল বলা যায় না।
‘শবানে হিজরাঁ দরাজ চু জুলফ
ও রোজে-ওসলত চুঁ উম্র কোবাহ,
সখী পিয়া কো জো ম্যঁয় ন দেখুঁ
তো কয়সে কাটুঁ অঁধেরী রতিয়াঁ।’
বস্তুত আধুনিক পর্বের আগে পর্যন্ত হিন্দী কাব্যসাহিত্যে গজল ছন্দের ব্যবহার হয়নি।ইতিপূর্বে আমার একটি প্রবন্ধে ভ্রমবশত সন্তকবি কবীরদাসকে (১৩৯৮-১৪৪২) হিন্দীর অন্যতম গজলকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এম এ গণীর ‘History of Persian Language and Literature at the Mughal Court’ গ্রন্থের অনুসরণে ভুলটি করেছিলাম।৪৬ কবীর গজল লিখেছিলেন ঠিক কথা, কিন্তু তা পূর্বী-ফারসি শব্দের অনুষঙ্গে—
‘হমন নে ইশক মস্তানা, হমন কো হোশিয়ারী ক্যা
আজাদ রহে য়্যা জগ মেঁ, ইমন কো ইন্তজারী ক্যা।
কবিরা ইশক কা মারা, দুই বেশ দূর কর দিল সে
জো চলনা রাহ নাজুক হ্যয়, হমন কো সির বোঝ ভারী ক্যা।’
বস্তুত, পঞ্চদশ শতকে কবীর সাহিত্যে জোয়ার নিয়ে আসেন এবং তৎকৃত দোঁহাগুলি হিন্দি সাহিত্যের পরম সম্পদ। কিন্তু দোঁহাগুলির বর্তমান আলোচনায় কোনো মূল্য না থাকায় আমরা ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র (৯ সেপ্টেম্বর ১৮৫০-৬ জানুয়ারি ১৮৮৫) থেকে হিন্দী গজলের সূত্রপাত ধরেছি।
হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে ভারতেন্দু নবযুগের উদগাতা৪৭। একসময় হিন্দী কবিতার ভাষা মানে ছিল ব্রজভাষা, ছন্দ ছিল প্রাচীন সবৈয়া ও দোহা, বিষয় রাধাকৃষ্ণ ও রাসমতীর লীলা। কোথাও ধরার ধুলোর স্পর্শ ছিল না। এই কবিতাকে জীবনের দিকে টেনে এনেছিলেন ভারতেন্দু। তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের মধ্যেও নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। প্রতাপনারায়ণ মিশ্র, অম্বিকাদত্ত ব্যাস, রাধাকৃষ্ণ দাস উপাধ্যায়, বদ্রীনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় আধুনিকতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। এই আধুনিকীকরণের পেছনে ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রভাব। ভারতেন্দু তাঁর ‘নাটক’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন—‘হিন্দী সাহিত্য নিজের সমৃদ্ধা জ্ঞানবৃদ্ধা বড়ো বোন বঙ্গভাষার অক্ষয় রত্নভাণ্ডারের সহায়তায় প্রভূত উন্নতি করেছে।’ ভারতেন্দুর একাধিক মৌল কবিতার উৎস হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বহু কবিতার ভাব, ভাষা ও ছন্দের সম্মান যে হেমচন্দ্রের প্রাপ্য, তা বোধহয় অনেকেই জানেন না।তবে গজলে ভারতেন্দু সম্পূর্ণ মোলিকতা দাবি করতে পারেন।
ভারতেন্দুর গজলে বেজেছে বিদ্রোহের সুর। উর্দু গজলের সাকি জাম মেহেফিল তাতে নেই। আছে সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থনীতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা এবং বিক্ষোভ—
‘হিলা দেঙ্গে অভী এ সঙ্গে দিল তেরে কলেজে কো
হমারী আতিশবারী সে পৎথর পিঘলতে হ্যঁয়।’
ভারতেন্দুর সমকালীন জগন্নাথপ্রসাদ রত্নাকরও কিছু গজল লিখেছিলেন। কিন্তু তাঁর রোলা, কবিত্ত এবং সবৈয়া ছন্দের মতো গজল ততটা ঔৎকর্ষ দাবি করতে পারে না। বরং তাঁর পরবর্তী কালের কবি অযোধ্যা সিং উপাধ্যায় ‘হরিঔধ’কে (১৮৬৫-৬ মার্চ ১৯৪৭) কিছুটা সম্মান দেওয়া যায়। ভারতেন্দু ছিলেন সংক্রান্তিকালীন কবি—একাধারে অতীত ও বর্তমানের পূজারি। তাঁর বেশির ভাগ কবিতাই রীতিকালীন পরম্পরার মায়ায় আচ্ছন্ন। কিন্তু হরিঔধ বর্তমানের পূজারি। তাঁর ভাষা ও ছন্দ অপেক্ষাকৃত নবীন—সহজ ও সরল। হরিঔধ এমন এক যুগে জন্মেছিলেন যখন হিন্দীভাষা সদ্য খোলস ছাড়িয়ে উঠেছে। হিন্দী খুঁজছিল নতুন প্রাণস্পন্দন। ফলত হরিঔধকে প্রতিষ্ঠার বেগ পেতে হয়নি। তাঁর প্রিয় ছন্দ ছিল কবিত্ত, সবৈয়া, ছপ্পয়, দোহা, সংস্কৃত ছন্দ এবং যাবতীয় উর্দু ছন্দ। গজলে তিনি ভারতেন্দুর তুলনায় বেশি সফল—
‘জীবন কভী দেতা নহীঁ উও সুখ জো হমারী মাঁগ হ্যয়
য়ে অফিস অওর কচহরী সব কে সব বকওয়াস হ্যয়।
উঠ জায়ে হাথ সবকে তো ফির ব্যবস্থা হী ক্যা
জীবন উও সব কুছ দে দে জো হমারী মাঁগ হ্যয়।’
বোঝা যাচ্ছে, হিন্দী গজল গোড়া থেকেই লক্ষ্যে স্থির। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের জালে আটকে না থাকলে প্রথম দিককার গজলে ক্ষোভের পরিবর্তে বিদ্রোহই প্রকাশ পেতো। পায়নি। কিন্তু সেই বাঞ্ছিত রাজমার্গের পথে যাত্রা শুরুর একটা ইঙ্গিত অবশ্যই প্রকাশ পেয়েছে।
ভারতেন্দুর পর দ্বিবেদী যুগে (১৯০১-২০) হিন্দীতে গজল লেখার ধুম পড়ে যায়। শ্রীধর পাঠক (ড. ধনঞ্জয় বর্মা শ্রীধরকেই হিন্দী গজলের জনক ধরেছেন), মৈথিলীশরণ গুপ্ত, কেশব প্রসাদ মিশ্র, মন্নন দ্বিবেদী, মাধব শুক্ল, বদ্রীনাথ ভট্ট, সত্যনারায়ণ কবিরত্ন, ঠাকুর সোয়েল, শরণ সিংহ, রায়দেবীপ্রসাদ পূর্ণ, লালা ভগবানদীন, রামনরেশ ত্রিপাঠী প্রমুখের মাধ্যমে এই ধারাবাহিকতা গিয়ে মিশেছে ছায়াবাদী কবিদের লেখনীমুখে। বলা বাহুল্য, ভারতেন্দু থেকে হিন্দী গজলের যে ধারা সূচিত হয়েছিল, দ্বিবেদীযুগে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ছায়বাদী যুগে এসে জয়শংকর প্রসাদের হাতে হিন্দী গজল এক নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করল।
গোবিন্দ চাননপুরী জয়শংকর প্রসাদকে (১৮৯০-১৫ নভেমম্বর ১৯৩৭) হিন্দী গজলের জনক আখ্যা দিয়েছেন।৪৮ বলতে কী, হিন্দী কাব্যজগতে প্রসাদের আবির্ভাব এক যুগান্তকারী ঘটনা। প্রসাদে এসে হিন্দী কবিতা একটা ব্রেক পেল।একটা সহজ সচলতাও লক্ষ করা গেল তাতে শুধু গজল বা কবিতাই নয়, ভারতেন্দুর পর হিন্দী সাহিত্যে সব কটি কক্ষ নিপুণ শিল্পীর মতো সাজিয়ে তুলেছেন প্রসাদ। বিশেষত, কবিতা ও নাটকে তাঁর দক্ষতা ছিল অসন্দিগ্ধ। আর গজলে তিনি আধুনিক জীবনের বৈষম্যকে যেভাবে নিখুঁতরূপে এঁকেছেন, তার তুলনা কোথায়?—
‘জগন দূর কুছ, ক্রিয়া ভিন্ন হ্যয়, ইচ্ছা ক্যুঁ পুরী হো মন কী
এক দুসরে সে ন মিল সকে য়হ বিড়ম্বনা হ্যয় জীবন কী।’
আধুনিক হিন্দী কাব্যসাহিত্যের তৃতীয় পর্যায়ে ধরা হয় ১৯১৮ সালে। বিশ্বযুদ্ধের উন্মত্ততার পর অবসাদ। আবার অসির চেয়ে বড়ো হয়ে উঠল মসি। এশিয়ার প্রথম নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথের অভিনন্দনের জোয়ার তখনও থিতিয়ে পড়েনি। তাঁর ভাব ভাষা ছন্দকে আদর্শ করে হিন্দী কবিরা সাহিত্যের সমৃদ্ধি বিধানে এগিয়ে এলেন। এঁরাই পরবর্তীকালে চিহ্নিত হয়েছিলেন ‘ছায়াবাদী কবি’ হিসেবে। নেতৃত্বে ছিলেন প্রসাদ-পন্ত-নিরালা। প্রসাদজীর কবিতায় রাবীন্দ্রিক প্রভাব সর্বতাশ্রয়ী। এমনকি, তাঁর গজলেও রাবীন্দ্রিক প্রভাব অননুকৃত থাকেনি। ফলে গজলের মূল মেজাজ বা সুর যথাযথ ফুটে উঠতে পারেনি। রবীন্দ্র-কবিতায় যেমন প্রান্তিক মিলহীনতা সত্ত্বেও অন্তঃস্থিত মাত্রাসমকত্ব বজায় থাকে (‘পরিশেষে’র ছন্দ)। প্রসাদের গজলেও সেই ভঙ্গি দুর্লক্ষ্য নয়।কিন্তু মুক্তছন্দ তো ফর্ম বা ছন্দানুশাসনের মুক্তি নয়, তা প্রাচীন ছন্দানুশাসন থেকে মুক্তি এবং নতুন রূপ বা ফর্মের অন্বেষণ। প্রসাদেও এটা ঘটেছে। কিন্তু সেই লয় আর সংরচনার লয়াত্মক চেতনা কোথায়—যা গজলের অনিবার্য শর্ত?—
‘তুমহারে কেশর সে হী সুগন্ধিত পরাগময় হো রহে মধুব্রত
প্রসাদ, বিশ্বেশ কা হো তুম পর, য়হী হৃদয় সে নিকল রহা হ্যয়।’
বক্তব্য স্পষ্ট। কিন্তু সেই বাগধারা, লয়াত্মকতা, বাগবৈদগ্ধ্য নেই—যা শেরকে ‘শের’ করে। এ-কথা অনস্বীকার্য যে হিন্দী গজলের লড়াকু চরিত্র প্রসাদের লেখনীতে আরও বলিষ্ঠ রূপ পেয়েছে—কিন্তু তা গজলের নজাকত-গত কোনো বিশেষ শর্ত পূরণ করে না।
প্রসাদ যুগের (সংবত ১৯৭৫-৯৫) বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে রামনরেশ ত্রিপাঠী, সুমিত্রা নন্দন পন্থ, রামধারী সিং ‘দীনকর’, মহাদেবী বর্মা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।এঁদের কেউই গজলকার রূপে পরিচিত নন। এ-যুগের পণ্ডিত সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ‘নিরালা’ গজল লিখেছিলেন বটে, কিন্তু রাবীন্দ্রিক প্রভাবে সেগুলির বেশিরভাগই অ-গজল।৪৯
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হিন্দীসাহিত্যের যে-যোগ, নিরালাজীই (১৮৯৭-১৫ অক্টোবর ১৯৬১) তার স্বর্ণসেতু। নিতান্ত কৈশোররচনা সহ নিরালার এমন কোনো গ্রন্থ বিরল যাতে রবীন্দ্র-অনুষঙ্গ অনুপস্থিত। তবে নিরালার ছায়াবাদকে নিছক রবীন্দ্রনাথের ছায়াবাদ বললে বিরূপ সমালোচনা হয়। নিরালার কবিতায় রবীন্দ্র-অনুসরণ থাকলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি মৌলিকত্বে সমুজ্জ্বল ‘নবরসরুচিরা হ্লাদৈকময়ী’ কবিতাও সৃষ্টি করেছেন। এই ছায়াবাদ মূলত রবীন্দ্রনাথের ছায়ানুগমনের নামান্তর হলেও হিন্দীতে ‘ছায়াবাদ’ ঠিক সে-অর্থে প্রযুক্ত হয়নি। গঙ্গাপ্রসাদ পণ্ডেয় লিখেছেন, ‘ছায়াবাদ হল এই পরিদৃশ্যমান রূপজগতের রূপাতীতের ছায়ানুভব—কবির আন্তর উপলব্ধির রঙে বহির্বিশ্বের অনুরঞ্জনই ছায়াবাদ।’৫০ মহাদেবী বর্মার ভাষায়—‘বহির্বিশ্বের আপাতবিচ্ছিন্ন খণ্ড বস্তুসমূহের মধ্যে একটা অখণ্ডতা, একটা নিরবচ্ছিন্নতা অনুভব করেন ছায়াবাদীরা। তাঁরা জানেন পৃথিবীর প্রতিটি খণ্ড সুন্দরের মধ্যে দিয়ে এক অখণ্ড সুন্দর নিজেকে নিরন্তর অভিব্যক্তি করে চলেছে।’৫১ এই ছায়াবাদের সঙ্গে নিরালার গজলের সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গী। বিশেষত রাবীন্দ্রিক ছায়াবাদ মুক্তছন্দের সঙ্গে তাঁর গজলের যোগ প্রত্যক্ষ।
এমনিতে নিরালাজীর গজল বাংলা গানের দ্বারাও প্রভাবিত।তাঁর নিজের ভাষায়—‘বঙ্গসাহিত্য গজলকে আপন করে নিয়েছিল। কিন্তু এই ধারা মুসলমান আমলে নয়, ইংরেজ শাসনের পর এসেছিল। উর্দু গজল ঠিক সাহিত্যে যায়নি, বাংলায় তৈরি হয়েছিল নতুন গজল।… কলকাতা আর বাংলাদেশে আমি বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলাম।কলকাতার আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমার গজলে বাংলা সঙ্গীতের সেই ধারা প্রতিফলিত।’৫২ কিন্তু রবীন্দ্র প্রভাবের তুলনায় তা ম্লানায়মান। নিরালা বাংলার সমাস-গুম্ফিত পদ এবং তৎসম পদ (রবীন্দ্র ব্যবহৃত শব্দ) প্রয়োগের মাধ্যমে তথা ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের বিলোপ করে ‘না-হিন্দী’ ভাষায় গজল লিখেছেন—
‘গন্ধ-ব্যাকুল-কুল-উর-সর লহর-কচ কর কমল-মুক পর
হর্ষ-অলি স্পর্শ-পর সর গুঞ্জ বারংবার।’
নিরালা হিন্দী গজলের ভাষাকে ভেঙে চুরমার করেছেন। হিন্দী ভাষায় এসেছে অহিন্দীপনা। তাঁর ‘বেলা’ কাব্যগ্রন্থের গজলগুলিও রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের ভাষা, ছন্দ ও ভাব স্মরণ করিয়ে দেয়—
‘চাঁদনী সম হকতী ফুল জ্যয়সে মেরে দিল মেঁ ছা গই
মধুবন মেঁ খুশবু বাদল সে ভী বেতাব হুই।’
এই কারণে ‘বেলা’র গজলগুলিকে পারফেক্ট বলা যায় না। হিন্দিতে প্রয়োগশীলতার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি নিরালার গজল শেষপর্যন্ত প্রয়োগই থেকে গেছে, গজলে উত্তীর্ণ হতে পারেনি—
‘নিগহ তুমহারী থী, দিল জিসমে বেকরার হুয়া
মগর ম্যঁয় গ্যয়র সে দিল কর, নিগহ কে পার হুয়া।’
এতে বাগবৈদগ্ধ্য আছে, ছন্দও হয়েছে খাসা, কিন্তু তবু শেরটি পড়ে নিরালাকে যথার্থ গজলকার বলা যায় না। এতে শুধু অন্দাজেবয়াঁ নয়, তসব্বসুফের দৃষ্টিতে শৈয়রিয়তেরও প্রভাব আছে। একসময় ফিরাক বলেছিলেন—‘উর্দু গজলের শরবত বানিয়ে খেলে হিন্দী গজল সুন্দর স্বাস্থ্য লাভ করবে।’ ফিরাকের এই ব্যঙ্গ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতো কাজ করেছে। ড. রামবিলাস শর্মা ১৯৪৮ সনেই লিখেছিলেন যে নিরালাজী হিন্দী কাব্যভাষাকে পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে আসবেই ‘বেলা’র গজলগুলি লিখেছিলেন। এই নিরিখে ‘বেলা’ সার্থক হয়েছে নিশ্চয়ই।৫৩
শমশের বাহাদুর সিংয়ের মতে, হিন্দী গজলে নিরালার পরেই ত্রিলোচনের স্থান।হিন্দীতে ত্রিলোচন শাস্ত্রীই সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ গজল রচয়িতা। মধুসূদনের রচনা-প্রভাবে ত্রিলোচন ইটালিয়ান সনেটকে হিন্দীতে এনেছিলেন।তারপর পেত্রার্কান সনেট, শেক্সপিয়রীয় ও অপরাপর মিশ্র গঠনরীতির সনেট এবং চতুর্দশপদী রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। কিন্তু হিন্দী গজলে তাঁর দক্ষতা আমাকে সন্দিহান করে—
‘প্রবল জলবাত পাকর সিন্ধু দুস্তর হোতা জাতা হ্যয়
কঠিন সংঘর্ষ জীবন কা কঠিনতর হোতা জাতা হ্যয়।
কমতা এক থা পরিবার পুরা চয়ন করতা থা
অকেলে কা ভী জীবন অব তো দুভর হোতা জাতা হ্যয়।
বড়োঁ কো ছোটা, ছোটোঁ কো বহুত ছোটা বনা ডালা
পটৈল কে তলে ঢেলা বরাবর হোতা জাতা হ্যয়।
হমেঁ আশা থী অব তো দুঃখ অপনা পীছা ছোড়েঙ্গে
মগর হম ক্যা করেঁ পীছা নিরন্তর হোতা জাতা হ্যয়।
‘ত্রিলোচন’ তুম গজল মেঁ খুব আয়ে বাত বন আই
নয়ে জীবন কা স্বর অব গান কা স্বর হোতা জাতা হ্যয়।’
এরকম হালকা ভাবের কথা তাঁর অধিকাংশ গজলে প্রাপ্তব্য। এ-কথা স্বীকার করব যে হিন্দীতে উক্তি কৌশল এবং অন্দাজেঁবয়ার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে ত্রিলোচন কিছু সার্থক গজল লিখেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি নিরালার মতো, সমাস-গুম্ফিত পদ ও তৎসম শব্দের ব্যবহারে ভারাক্রান্ত—
‘প্রশংসা পরার্থানুসন্ধান কী হ্যয়
কহাঁ স্বার্থ কা রং গহরা ন দেখা।’
‘পরার্থানুসন্ধান’ ইত্যাদি সংস্কৃতক্লিষ্ট সমাসবদ্ধ শব্দ শেরের মেজাজকে ক্ষুণ্ণ করে।এসব শের পড়তে গেলে আমাদের জিভ হোঁচট খায়—
‘সঙমন হী প্রাণ কা উৎকর্ষ হ্যয়
সংবেদন মেঁ কিসলিয়ে সংশয় হুয়া।’
এ ধরনের শের গজলে ঠিক মানায়ে না। গজল যেখানে মর্মস্পর্শী, সেখানে ভাবই মুখ্য, ফর্ম গৌণ। কিন্তু গজল যেখানে স্বয়ং একটি ফর্ম, সেখানে তার ফর্মালিজমের শর্ত পূরিত হলে তবেই ভাব-বিহারের ঔচিত্য। ভাবের দিক থেকে হিন্দী গজল উর্দু গজল থেকে পৃথক। অন্তর্জগতের গূঢ় গহন রহস্যময়তা মানবসত্তার গুহায়িত কামনাবাসনার সূক্ষম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হিন্দী গজলকে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে। ফলত তা উর্দু গজলের নজাকত থেকে পৃথক হতে বাধ্য। কিন্তু মেজাজের প্রশ্ন উঠলে তা অবশ্যই শর্তানুগ হতে হবে। ‘প্রাণ’, ‘উৎকর্ষ’, ‘সংবেদন’, ‘সংশয়’ ইত্যাদি শব্দ সেই মেজাজ আনতে পারে না।
অন্যদিকে আধুনিক কবি, যাঁদের গজলে আছে শুদ্ধ নির্মোহ বাস্তবতার অকুণ্ঠ প্রতিষ্ঠা—ক্ষোভ, দুঃখ আর বিদ্রোহ,—তাঁরা অপেক্ষাকৃত সহজ ও প্রাকৃত ভাষায় গজলের মেজাজ, নজাকত ও ভাবপ্রকাশে আশাব্যঞ্জক ভাবে সফল। আধুনিক গজলের ভাষা কথ্যভাষার দিকে ধাবিত হচ্ছে, তার অজস্র নিদর্শনগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
হিন্দী গজলের তৃতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি শমশের সিং বাহাদুর। ইনি শুধু নতুন ধারার জনক নন, বর্ষীয়ান প্রতিপালক। শমশেরকে বলা হয়েছে বিশিষ্ট অনুভূতির কবি। এঁর গজলের আবেদন সর্বজনীন। উর্দু আর ফারসিতেও সমান ওস্তাদ হবার ফলে শমশেরের হিন্দী গজলে ফারসি শব্দের এত দাপাদাপি—
‘ইল্ম-হিকমৎ, দীনো-ইমাঁ, মুল্ক-দৌলৎ, হুস্নো-ইশক
আপকো বাজার সে জো চাহিয়ে লা দেতা হুঁ।’
উর্দু গজলের ভাবসর্বস্ব বিষয়ের মুখাপেক্ষী শমশের নন। জনপ্রিয়তা লাভের বাসনায়ও তিনি গজল লেখেননি। ‘কুছ অওর কবিতায়েঁ’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় শমশের লিখেছেন—‘পাঠকের প্রতি মোহ তো দূরের কথা, স্বয়ং নিজের কবিতার মোহে আমি বন্দী হতে পারিনি।’ তাঁর একটি শ্রেষ্ঠ গজল—
‘ওহী উম্র কা এক পল কোই লায়ে
তড়পতী হুই সী গজল কোই লায়ে।
হকীকৎ কো লায়ে তরবৈয়ুল সে বাহর
মেরী মুশকিলোঁ কা জো হাল কোই লায়ে।
কহীঁ সর্দ খুঁ মেঁ তড়পতী হ্যয় বিজলী
জমানে কা রদ্দবদল কোই লায়ে।
নজর তেরী দুস্তরে ফিরদৌসী লায়ে
মেরী জিন্দগী মেঁ অসল কোই লায়ে।’
শমশেরের গজলে রয়েছে সংগ্রামের প্রচ্ছন্ন সুর। এই সুর হিন্দী গজলের সুর, যা কোনো ভুঁইফোড় ফসল নয়—বরং হিন্দী কাব্যসাহিত্যের বিবর্তনে খুবই স্বাভাবিক।বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে হিন্দী কবিতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়, তারই অনিবার্য ফসল—ছায়াবাদ, যা ‘রহস্যবাদ’ নামেও চিহ্নিত। কখনও তাকে সামন্তবাদী মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা ও পুঁজিবাদী সংস্কৃতির প্রতিপালক রূপেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। ছায়াবাদের প্রবর্তক হিসেবে কখনও জয়শংকর প্রসাদ, আবার কখনও মুকুটধর পাণ্ডেয়ের নাম উল্লিখিত হয়েছে। একথা অবশ্য স্বীকার্য যে ছায়াবাদী কবিতা মূলত ব্যক্তিচেতনার ফসল, তাই চল্লিশের দশকে তার বিসর্জনের জয়ডঙ্কা বেজে উঠেছে।জন্ম নিয়েছে প্রয়োগবাদ ও প্রগতিবাদ। এ যুগের বচ্চন, নগেন্দ্র শর্মা, ভগবতীচরণ বর্মা প্রমুখ ‘উত্তর-ছায়াবাদী-কালের কবি’ হিসেবে চিহ্নিত। অবশ্যি হরিবংশ রায় বচ্চন ‘হালাবাদ’ নামে একটি পৃথক কাব্যধারারও জন্ম দিয়েছিলেন। বচ্চনের মদিয়া-প্রতীকি ব্যবহার নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছিলেন—
‘ম্যঁয়নে তুমহে মদিরা কী কবিতা নহীঁ দী
ম্যঁয়নে তুমহে কবিতা কী মদিরা দী হ্যয়।’
চল্লিশের দশকে এসে হিন্দী কবিতা ক্রমে পাল্টাতে শুরু করল। বামপন্থী চেতনার জন্ম হল।গদ্য-পদ্য উভয় ক্ষেত্রেই। ড. প্রভাকর মাচওয়ের প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি—…‘Then came the Leftist wave after the first Progressive Writers’ Association meet in Lucknow in 1936, presided over by Premchand (1881-1936). Many poets voiced anti-Fascist and pro-Soviet, pro-China sentiments. Some of them wrote journalistic verse, which now sounds worse. Among the progressive or Marxist poets of that period were Narendra Sharma, Shamsher Bahadur Singh, Kedarnath Agarwal, Shivamangal Singh ‘Suman’, Girija Kumar Mathur, Naresh Mehta, Trilochan Shastri and Prem Dhawan.’৫৪
প্রগতিবাদের পরের দশকে প্রয়োগবাদের জন্ম, যা এসেছিল সচ্চিদানন্দ বাৎসায়েন ‘অজ্ঞেয়’ সম্পাদিত ‘তার সপ্তকে’র মাধ্যমে। ড. মাচওয়ে লিখেছেন—In 1943, Agyeya edited an anthology of seven poets called ‘Tar Saptak’ (Sepiet in Soprano). It started the experimentalist trend, the ‘New Voices’ Agyeya repeated such seplets three times during the past four decades, but with diminishing returns. Some poets out of the 28 were outstanding, such as Bhawaniprasad Mishra, Raghuvir Singh Sahae, Sarweshwardayal Saksena, Harinnarayan Vyas. But non surprised Agyeya, the radical humanist, existentialist and now a neo-mystic all in one. Some poets like Nagarjun, the rebel, wee out of Agyeya’s fold and made a great mark…’৫৫
১৯৫১ সালে ‘দুসরা সপ্তক’ এবং ১৯৫৯ সালে ‘তীসরা সপ্তক’ প্রকাশের মাধ্যমে প্রযোগবাদী ‘নয়ী কবিতা’র শেকড় আরও মজবুত হলেও, সত্তর দশকে ‘চৌথা সপ্তকে’র প্রকাশ অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। প্রগতিক দল বলল, নয়ী কবিতা বা নিউ পোয়েট্রি মুভমেন্টের জন্যে নাগার্জুন, মুক্তিবোধ ও ধূমিল আমাদের নমস্য, কিন্তু চৌথা সপ্তক নয়। চৌথা সপ্তক নতুন ধারার কাব্যান্দোলনের নেতৃত্ব দাবি করলে সমালোচনায় জর্জরিত হলেন অজ্ঞেয়জী। ‘…in spite of all these achievements till the sixties, and several movements in poetry like ‘New Poetry’, ‘Anti-Poetry’ and so on late, the past 20 years have not seen any single outstanding genius in Hindi Poetry. These are scores of good and passble poetasters and singers (gitkars) of lyricist. But even in lyrics Mahadevi and Bachchan have not been surprised, both in output, popularity and mellifluence. It is sad to think that most of great names in poetry are people who have crossed seventy. Today the scene in Hindi poetry is like a Kumbha Fair (in Bhopal, the called the recent poets’ meet Kavi-Kumbha) where each is blowing his or her own trumpet.’৫৬
আধুনিক হিন্দী গজলে অ-কবিতা বা অ্যান্টি-পোয়েট্রির বিশেষ ভূমিকা আছে। প্রয়োগবাদী কবিতা, নয়ী কবিতা এবং অ-কবিতা—বস্তুত একই কাব্যপ্রকৃতির গতিশীল চরণবিন্যাসের তিনটি পৃথক নাম। অ-কবিতা রচয়িতাদের মতে, ‘অ-কবিতা’ শব্দের ‘অ’ উপসর্গটির মানে হল, ‘পরম্পরা-রহিত’—গতানুগতের বিরোধী। অ-কবিতা শুধুমাত্র কতিপয় বক্র, পিরামিডি বা সর্পিল পঙক্তির সমন্বয় নয়—এর তিনটি উপাদান, ভাষা ভাব অর্থ—যা কবিতারই নামান্তর।৫৭
অকবিতার জন্মলগ্নে মার্কসীয় চিন্তাধারার যে দীপশিখা শমশের বাহাদুর সিংহের গজলে স্ফুরিত হয়েছিল, পরবর্তী কালে তারই উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে দুষ্যন্ত কুমারের গজলে। এই দুই মহান আলোকস্তম্ভের মাঝখানে ‘হিন্দী গজলের শাহজাদা’ বেকল উৎসাহীর অবস্থান। বেকলের আসল নাম মহম্মদ শফি খাঁ (জন্ম ১৯ জুলাই ১৯২৮)। সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ নিজের পূর্বপুরুষদের সর্বদা ঘৃণা করে এসেছেন বেকল। তাঁর প্রিয় কবি গালিব ও নজীর। ইকবালকে ভালো লাগলেও, বেকল বলেছেন—‘জাতপাতের গন্ধ থাকায় ইকবালের শের আমাকে প্ররোচিত করে না।’৫৮ যাঁরা তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করেছেন তাঁরা হলেন, ফরজন্দ আলি, কলীম উল্লাহ এবং মৌলভী রৌনক আলি ছঙ্গা। এই প্রভাব তাঁর গজলেও—
‘ব্যঙ্গ কে তাঁর, মুঝী পর খীঁচে হোঙ্গে
আপ জব অওর মেরে, অওর মেরে নগীচে হোঙ্গে।
জিসকী হর শাখা পর রাধায়েঁ মচলতী হোঙ্গী
দেখ না কৃষ্ণ উসী পেড় পর কে নীচে হোমের।’
‘পাঁচ বছর আচার্য নরেন্দ্র দেবের সন্নিধি আমাকে সমাজবাদী করেছে’—কবির এ উক্তি মিথ্যে নয়। এই সোশ্যালিজম তাঁর গজলের সর্বত্র ভাস্বর :
‘পূজনেওয়ালে মহলোঁ মেঁ ব্যয়ঠে হুয়ে
তফসরে লু কে ঝোঁকে পর করতে হ্যঁয়।
এক জখমি কবুতর সা পীপল তলে
বক্ত কে দেবতা ফড়ফড়াতে হ্যঁয়।’
আধুনিক হিন্দী কবিদের মানস-বিবর্তনের তত্ত্বটি আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা গজলের মাধ্যমে ভাবালুতার উন্মোচন করে জীবনের নগ্ন বাস্তবরূপই দেখতে চাননি, মানুষের সুন্দর বাসনা-কামনার পূর্তির পথ ও সমাজরোগের নিদান দিতেও চেষ্টা করেছেন। মার্কসবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য স্বীকৃত হলেও ব্যক্তি প্রাধান্যের স্থান নেই—সমষ্টি চেতনাই সাম্যবাদের মৌল ভিত্তি—আধুনিক হিন্দী গজলে এই বোধের প্রাধান্য হেতু আঙ্গিকেও পরিবর্তন এসেছে। শমশের থেকেই এই ধারার যাত্রা শুরু, তার অনিবার্য প্রতিফলন দুষ্যন্ত কুমারের গজলে।
হিন্দী গজলের দুনিয়ায় দুষ্যন্ত কুমারের আবির্ভাব সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দুষ্যন্ত এসে হিন্দি গজল একটা ব্রেক পেল, আধুনিক অর্থে গজলের যেসব লক্ষণ মেলে—সব দুষ্যন্তে প্রতিফলিত। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চার। ‘সূর্য কা স্বাগত’-এ তাঁর অনুভূতির উষ্ণ চাঞ্চল্য, সরস সজীবতা এবং প্রাঞ্জল ভাষায় এক অনাস্বাদিতপূর্ব হৃদয়গাথা; দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ‘আওয়াজোঁ কে ঘেরে’-তে আমরা পাই জীবনরহস্য উন্মোচনরত কবিকে; তৃতীয় সংগ্রহ ‘জ্বলতে হুয়ে বল কা বসন্ত’-এর মাধ্যমে তিনি আরও সমৃদ্ধির পরিচয় দেন; এবং সর্বশেষ কীর্তি ‘এক কণ্ঠ বিষপায়ী’-তে পৌরাণিক আখ্যানের অনুসরণে রচিত এমন একটি গীতিনাট্য তিনি উপহার দিয়েছেন যা ‘অন্ধাযুগ’-এর মতো সশক্ত কীর্তির সঙ্গে তুলনীয়।৫৯
হিন্দি গজলে দুষ্যন্ত কুমার সাম্যবাদ ও জীবনবাদের প্রবর্তক। তাঁর রচনার প্রধান অবলম্বন হৃদয়বেদনা, জ্বালা আর ক্ষোভ। মার্কসীয় চিন্তাধারার এমন নির্মল প্রতিফলন দুষ্যন্তের আগে শমশের ছাড়া অন্যকারও গজলে পড়েনি। নই কবিতার সর্বজনপ্রিয় কবি দুষ্যন্ত কুমার গজলের আসরে পদার্পণ করার আগেই স্বলক্ষ্য সম্বন্ধে নির্দ্বিধ হয়ে গিয়েছিলেন। ‘জ্বলতে হুয়ে বন কা বসন্ত’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন—‘আমার কাছে কবিতার কোনো মুখাদর্শ নেই, মুখোশ নেই, আন্তর্জাতিক মুদ্রা নেই, আনকোরা শব্দের পোশাক নেই। কবিতাকে আমি চমক সৃষ্টি কিংবা আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিনি। সমাজ ও ব্যক্তির প্রসঙ্গে তার দায়িত্ব এ-থেকে অনেক বড়ো’ হিন্দি কবিতার গতানুগতিক ধারায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি দুষ্যন্ত। তিনি তাঁর অনুভূত যুগসত্যকে আড়ম্বরহীন ভাবে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তিনি খুঁজছিলেন বৃহত্তর পরিসর, যেখান থেকে মনের সমস্ত ভাবনা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে। নই কবিতা তাঁকে সেই বাঞ্ছিত পরিসর দেয়নি। ফলে তিনি দীর্ঘদিন ভুগেছেন অতৃপ্তির জ্বালায়। তিনি সেই সংকীর্ণ পরিসর থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন—‘আমি সবসময় অনুভব করেছি—আধুনিকতার মিথ্যা ছদ্মবেশ সর্বদা পাঠককে কবিতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কবিতা ও পাঠকের মাঝখানে এতটা ব্যবধান আগে ছিল না। নতুন কবিরা কবিতার নামে যা চালাচ্ছে, তাকে ঘসা মুদ্রার মতো বাজারে চালানোর অর্থ পাঠককে ধোঁকা দেওয়া।’ তাই দুষ্যন্ত নঈ কবিতার গলি ছেড়ে এসে ঢুকেছেন গজলের উন্মুক্ত আঙিনায়। তিনি বুঝেছিলেন, প্রাচীন ও বহুব্যবহৃত শৈলী হলেও গজলের সম্ভবনা অনেক।৬০
এই প্রসঙ্গে দুষ্যন্ত কুমার স্বয়ং লিখেছেন—‘গোড়ার দিকে গজল আমার প্রতি সদয়া হয়নি। বেশ সময় গেছে তাকে বুঝতে। তারই মাঝে লুকিয়ে-চুরিয়ে কখনো-সখনো একটু-আধটু হাত মকশো করেছি। মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন মনে খোঁচা মারত—ভারতীয় কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রখর অনুভূতির কবি মির্জা গালিব নিজের হৃদয় পীড়ার অভিব্যক্তিকে রূপ দিতে শেষপর্যন্ত গজলকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন? আর যদি গজলের মাধ্যমে গালিব নিজের বেদনাকে এতটা সার্বজনিক করে তুলতে পারেন, তাহলে আমার এই বেদনাবার্তা (ব্যক্তিগত ও সামাজিক) গজলের সাহায্যে বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছোতে পারবে না কেন? …জীবনে কখনো-কখনো এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন হৃদয়ের জ্বালা আর ভেতরে আবদ্ধ থাকতে পারে না বেরিয়ে আসতে চায় বাইরে। আমি গজল লিখেছি সেই অবস্থার মধ্যে।’—নিজের দুঃখ ও হৃদয়-যাতনাকে অধিকসংখ্যক মানুষের মধ্যে চারিয়ে দেবার অত্যুগ্র বাসনাই দুষ্যন্ত কুমারকে গজলকার করেছে। তাঁর গজলের বেদনা আজকের প্রতিটি ব্যক্তির বেদনা, যাতে জীবনের বাধাবিপত্তি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, মূঢ়তা, প্রদাহ, প্রজ্জ্বলন, নির্বাপণ—জীবনের একটা পুরো অধ্যায় জুড়ে থাকে।—
‘ন হো কমীজ তো পাঁও সে পেট ঢক লেঙ্গে
য়ে লোগ কিতনে মুনাসিব হ্যঁয় ইস সফর কে লিয়ে।’
দুষ্যন্তের গজলেই প্রথমে শোনা যায় জোরালো ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর, শোষণ ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।যে-সময় হিন্দী কবিতা ধুঁকছিল মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীর ড্রয়িংরুমে, সেই সময় দুষ্যন্ত লিখেছিলেন—
‘কহাঁ তো তয় থা চিরাঙ্গা হরেক ঘর কে লিয়ে
চলো য়হাঁ সে চলেঁ অওর উম্রভর কে লিয়ে।
য়হাঁ দরখতোঁ কে সায়ে মেঁ ধূপ লগতী হ্যয়
কহাঁ চিরাগ ময়সসর নহী শহর কে লিয়ে।’
এই ধরনের কাব্যভঙ্গিমা ও গণচেতনাই দুষ্যন্তকে অমরত্ব প্রদান করেছে। জীবনে জুড়ে থাকা কৃষ্ণ-ক্রূরতাকে অনুভব করেই তিনি লিখেছেন—
‘য়হ জুবাঁ হমসে সী নহী জাতী
জিন্দগী হ্যয় কি জী নহীঁ জাতী।’
শুধু হাঙ্গামা খাড়া করা দুষ্যন্তের লক্ষ্য নয়। ফাঁকা বিদ্রোহের অর্থ অরাজকতার পুনর্বাসন, যার পরিণাম হতাশা—এ সত্য দুষ্যন্তের জানা। তিনি চান একটা বিকল্প হাতিয়ার, অর্থাৎ ব্যবস্থা ভাঙো! আমি না পারলেও আগামী প্রজন্ম যেন তা ভাঙতে পারে—
‘মেরে সীনে মেঁ নহীঁ তো তেরে সীনে মেঁ সহী
হোঁ কহীঁ ভী আগ লেকিন আগ জ্বলনী চাহিয়ে।
সির্ফ হঙ্গামা খড়া করনা মেরা মকসদ নহীঁ
মেরী কোশিশ হ্যয় কি য়হ সুরত বদলনী চাহিয়ে।’
দুষ্যন্তের দ্বারা প্রবর্তিত গজলের ছোট্ট সড়ক আজ রাজমার্গে প্রবর্তিত হয়ে গেছে—এটা বাড়িয়ে বলা নয়। হিন্দী গজলের দুনিয়ায় এখন বিরাট আলোড়ন। দুষ্যন্তের প্রভাবকে এড়িয়ে চলা নতুন কবিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। হিন্দী গজলের দুনিয়ায় এখন দুটি নাম—শমশের বাহাদুর সিং ও দুষ্যন্ত কুমার। দুজনের রচনা-ব্যক্তিত্ব ছিল যেমন পাহাড় প্রমাণ, তার প্রভাবও হয়েছে তেমনি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। প্রভাবিতদের সকলেই যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, এমন কথা বলব না—কিন্তু তবুও এ প্রবাহে ছেদ পড়েনি।
‘লাজিম নহী’ কি সবকো মিলে এক সা জবাব
আও ন হম ভী স্যয়র করঁ কোহে-তুর কী!’
এখনকার গজলে ফুটে উঠেছে যুগপৎ শোষিতের আকুতি ও বিদ্রোহ। এ জোয়ার নিছক ভাববিলাস নয়, কেন-না এর মূলে আছে মধ্যবিত্ত মানস। গোড়ার দিকে রুশ কাব্যধারা এর নির্মাণকল্পে সহায়ক ছিল, এখন হয়েছে চৈনিক কবিতার ধারা। সর্বহারার হাতে মুষ্টিবদ্ধ ভাবে ওপরের দিকে উঠছে, উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিরোধ গড়ার প্রতিজ্ঞা।জাতীয় জীবনের এই ভাবে এখনকার গজল সংক্রামিত। শমশেরের ভাষায় বলব—
‘ভাব হো জো শক্তি-সাধন কে লিয়ে
লুট গয়ে কিস আন্দোলন কে লিয়ে
ধুল মেঁ হমকো মিলা দো লেকিন
চালতে হ্যঁয় ধুল কণ-কণ কে লিয়ে।’
মতান্তরে, গজল এখন আর শুধুই গজল নয়, তার সঙ্গে ঘটেছে ধরার ধুলোর স্পর্শ, গণ-আন্দোলনে পরিণয়। চিকন আর সুডৌল শব্দের ব্যবহার উঠে গিয়ে আসছে চাঁচাছোলা তীক্ষ্ণধার শব্দ। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ শমশেরের গজল, যেখানে পাই শ্রমজীবী মানুষের তেজালো কণ্ঠ—
‘উও জলওয়ে লৌটতে ফিরতে হ্যঁয়, খাকো-খুনে-ইনসা মেঁ
তুমহারা তুর পর জানা, মর জানা নবীনা হোনা হ্যয়।’
এই কণ্ঠই আরও স্পষ্টতা লাভ করেছে দুষ্যন্তের গজলে—
‘ম্যয়কদে কা রাস্তা অব ভী খুলা হ্যয়
সির্ফ আমদ রফত হী জ্যাদা নহীঁ হ্যয়।’
দুষ্যন্ত কুমারের স্থির বিশ্বাস—‘বিপ্লব আসবেই! আকাশে শুধু কালো মেঘই নেই, আছে একটা লাল আগুনের গোলাও—যার নাম কমিউনিজম।’—
‘মত কহো আকাশ মেঁ কোহরা ঘনা হ্যয়
য়হ কিসী কী ব্যক্তিগত আলোচনা হ্যয়।’
এর পরে মার্কসায়নে যাঁরা আবর্তিত হয়েছেন, তারাও যে মার্কসীয় চিন্তার উষ্ণ সুবাস গজলের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারছেন—এ অত্যন্ত আশার কথা। এই ধারার কবিদের মধ্যে বলবীর সিং রঙ, চন্দ্রসেন বিরাট, সূর্যভানু গুপ্ত, মাহেশ্বর তিওয়ারী, সত্যপাল সাকসেনা, নরেন্দ্র বশিষ্ঠ, রামাবতার ত্যাগী, কুঁওর বেচৈন, শেরজঙ গর্গ, সরস্বতীকুমার দীপক বিশেষ স্মরণীয়। বিশ্লেষণে দেখা যাবে এঁদের কেউ কেউ চান গজলকে হকিকৎ (বাস্তবতা) ও তখৈউল (কল্পনা) থেকে মুক্ত রাখতে। এই চাওয়াকে ‘কাল্পনিকতা’ ধরেল ভুল হবে। আসলে এই চাওয়া কল্পনাশীলতার দাবি—
‘স্যাহী সে ইরাদোঁ কী তসবীর বনাতে হো
গর খুন সে বনাও তো তসবীর অসলী হোগী।’
শেরজঙ গর্গকে অনেক সমালোচক আত্মবিরোধী গজলগো বলেছেন। এটি বিতর্কের ব্যাপার। আমার মতে তাঁর গজলে আত্মবিরোধ নেই, আত্মানুসন্ধান আছে।নীচের গজলটি পড়লে বোঝা যাবে তিনি যন্ত্রণার আয়নায় নিজেকে খুঁজেছেন—
‘কোই শহর গুমশুদা হ্যয়, কোই গাঁও অনমনা হ্যয়
ইনহী খাস উলঝনোঁ সে নয়া আদমী বনা হ্যয়।
অভী রোশনী কা টুকরা, নহীঁ আসমাঁ সে উতরা
নহীঁ কোপলোঁ পে ছায়া, য়হাঁ কোহরা ঘনা হ্যয়।
তুমহে চন্দ মুঁহলগোঁ নে বহকা দিয়া হ্যয় শায়দ
জরা রূপ অপনা দেখো মেরা দর্দ আইনা হ্যয়।
নহীঁ মঞ্জিলোঁ কো ম্যঁয়নে দিয়া দোস্তোঁ কা দর্জা।
সভী কাময়াবিয়োঁ সে মেরা যুদ্ধ সা ঠনা হ্যয়।
মেরে খুশনুমা ইরাদোঁ, মেরী দেখভাল করনা
কিসী অওর সে নহীঁ হ্যয়, খুদ সে সামনা হ্যয়।’
শেরজঙের মতে, অনুভূতি ও অভিব্যক্তির শৈলী বলিষ্ঠ না হলে গজলও বলিষ্ঠ হতে পারে না। তাঁর প্রিয় গজলকার দুষ্যন্ত কুমার, কেননা ‘দুষ্যন্তের গজলে সেই বলিষ্ঠতা আছে।’ আজ হিন্দীতে বলিষ্ঠ কবিদের একটি সারি রচিত হয়েছে যাঁদের মধ্যে বলবীর সিং রঙ, নীরজ, ত্যাগী, বালস্বরূপ রাহী, সূর্যভানু গুপ্তের ওপর দুষ্যন্তের প্রভাব অত্যন্ত সক্রিয়। কেননা, শেরজঙের ভাষায়—‘দুষ্যন্ত কী গজলোঁ নে এক সীসা তক হিন্দি গজল কো নেই ভাবভূমি তথা তেবর প্রদান কিয়া হ্যয়, জিসকা প্রভাব হিন্দি গজলকারোঁ পর পড়না লাজিমী হ্যা।’৬১
সমকালীন হিন্দী গজলকারদের মধ্যেও দুষ্যন্তের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। এর কারণ কী? জবাবে নরেন্দ্র বশিষ্ঠ বলেছেন—‘নয়ে লিখনে ওয়ালোঁ পর দুষ্যন্ত কা প্রভাব কা এক খাস কারণ হ্যয়। তব সমুচা রাষ্ট্র রীজনীতিক মুদ্দোঁ সে প্রভাবিত থা অওর দুষ্যন্ত কা লেখন উন স্থিতিয়োঁ কো উকের রহা থা। স্বাভাবিক হী থা কি উসে ব্যাপক স্বীকৃতি মিলতীর্।৬২ অর্থাৎ রাজনীতিক কারণেই দুষ্যন্তের প্রভাব এতটা স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বয়ং নরেন্দ্র বশিষ্ঠের গজল দুষ্যন্তের দ্বারা প্রভাবিত—
‘য্যকিন জিসকো সমঝতা থা উও গুমাঁ নিকলা
জলানে ওয়ালা মেরে ঘর কা পাসবাঁ নিকলা।
কিসী সে তেরা পতা হী ন মিল সকা হমকো
তেরী গলী মেঁ হর এক শখস বেজুবাঁ নিকলা।
বিখর গয়ে হ্যঁয় পরখতে হমারী কশতী কে
হমরা দিল সে অভী হওসলা কহাঁ নিকলা।
সজা দিয়ে কই গুলদান উসনে ফুলোঁ সে
চমন উজাড়নে ওয়ালা ভী বাগবাঁ নিকলা।
সভী কে পাঁও সফর সেঁ লহুলুহান হুয়ে
তলাশে অমন মেঁ জব কোই কারওয়াঁ নিকলা।’
এর পাশাপাশি পড়া যাক মাধব কৌশিকের—
‘কাগজ কী পত্তিয়োঁ কা গুলশন খিলা দিয়া
কিসনে হমারে খুন মেঁ পানী মিলা দিয়া।
ইনসানিয়ৎ কে দর্দ কো জিন্দা ন কর সকে
নফরত কা চাহে সোপনে মুরদা জিলা দিয়া।
পড়নে লগী হ্যয় দোস্তোঁ দীওয়ার মেঁ দরার
শায়দ কিসী সে নীঁও কা পথর হিলা দিয়া।
হঁসনে কী বাত আই তো মায়ুস হো উঠা
রোনে কে হর মুকাস পে উও খিলখিলা দিয়া।
সুকরাত কো দুরুস্ত বতানে কে জুর্ম মেঁ
লোগোঁ নে উসে জহর কা প্যালা পিলা দিয়া।’
দুষ্যন্তীয় গজলের প্রভাব স্পষ্টত ফুটে উঠেছে রামাবতার ত্যাগীর রচনাতেও। এ শুধু ভাবগত নয়, ভাষা, শব্দ ও অলংকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও—
‘রোশনী তো চাহিয়ে পর লৌ জরা মদ্ধম রখো
চাহিয়ে মুঝসে গজল তো আঁখ মেরী নম রখো।
ম্যাঁয় হুয়া তৈয়ার তুলনে কো অভী কহনে লগে
দুসরে পলড়ে মেঁ অপনী জিন্দগী কে গম রখো।
আঁখ মেরী দেখকর কহনে লগে বুঢ়ে হকীম
ইন পে বর খুরদার খ্বাবোঁ কা বজন কুছ কম রখো।
তুম খুদা হোগে মগর য়হ শায়রোঁ কী হ্যয় গলী
শওক সে গুজরো উসুলনে সর জরা সা খম রখো।
চাহা নহীঁ যা দর্দ সে ফির ভী আল্লুক হো গয়া
অব তো ইসী মেঁ শান হ্যয় জ্যসে বনে কায়ম রখো।
কওন স ফনকার যা জিসকো ন দী ঘুমনে কসম
আঁখ মেঁ জো ভী রহে পর হোঁট পর সরগম রখো।
জো করো ‘ত্যাগী’ তুমহেঁ পহচানতে হ্যঁয় লোগ বাগ
অপনে চেহরে পর ভলে তুম জিস কদর মাতম রখো।’
এর পাশাপাশি ভবানীশংকর মিশ্র, জানকীবল্লভ শাস্ত্রী, জনঞ্জয় সিংহ প্রমুখের একটি অপার রোমান্টিক গজলের ধারা চলেছে। এই ধারা ঠিক ভারতেন্দু বা নিরালা যুগের না হলেও, খুব নবীন বলে সুখ্যাতি পাবে না। যদিও উল্লিখিত তিন কবির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আমি নির্দ্বিধ। এঁদের মধ্যে ভবানীশংকর মিশ্রের নাম সবিশেষ স্মর্তব্য। কেন-না এঁর গজল প্রাক্তন ও নব্যযুগের সেতু রচনা করেছে। নিচের গজলটিতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট—
‘ইসলিয়ে তারীখ নে হমকো কভী চাহা নহীঁ
হম অকেলে হ্যয়, হমারে পাস চৌরাহা নহীঁ।
চওখটোঁ কে পার চমড়ে কা ভরা বাজার হ্যয়
অওর কানোঁ মেঁ হমারে ইএ কা ফাহা নহী।
দোস্তোঁ, তুমনে বহুত চাহা মগর হম ক্যা করেঁ
জিন্দগী বাকায়দা হোতী কভী স্বাহা নহীঁ।
জানকীবল্লভ শাস্ত্রী গীতিকার হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি যে গজলেও দক্ষ, সে প্রমাণ তিনি রেখেছেন। কিন্তু সুর না থাকলে তাঁর গজল নেবানো প্রদীপের মতো—
‘ধূপ দুপহর কী মুখতসর-কী সী
রাত ভর ম্যঁয়নে চাঁদনী পী থী!
মৌন বেমওতে মর গই হোতী
ম্যঁয়নে উসকো জিন্দগী দী থী!’
আর ধনঞ্জয় সিংয়ের গজল শুধু সুখপাঠ্যই নয়, কথ্যের দিক থেকেও স্বচ্ছ সরল; কৃত্রিমতায় আবিল নয়।নিচের গজলটি তাঁর একটি সর্বাঙ্গসুন্দর রচনার নমুনা—
‘ইস তরহ ভীড় কে সৈয়লাব সে গুজরতা হুঁ
জ্যয়সে দলদল ভরে আলাব সে গুজরতা হুঁ।
সারী দুনিয়া বড়ী রঙীন নজর আতী হ্যয়
জব তেরে বসল কে উস স্তাব সে গুজরতা হুঁ।
ডুব জাতা হ্যয় পাহাড়োঁ কা বদন চোরী তক
জব তেরী আখোঁ কে দোআব সে গুজরতা হুঁ।
কাঁপ উঠতে হ্যঁয় ইমরেৎ কে কঁগুরে থর-থর
জব তেরী য়্যাদ কী মেহরার সে গুজরতা হুঁ।
দেখকর অপনী হী পরছাঁই চঁওক উঠতা হুঁ।
জব কভী সায়া-এ-মেহতাব সে গুজরতা হুঁ।
ভরী দোপহর মেঁ সূরজ কা ঘুট রহা হ্যয় দম
ম্যঁয় তেরে জুল্ম কে সীমাব সে গুজরতা হুঁ।’
এই প্রাচীন ও রোমান্টিক ধারার অন্যান্য কবিদের মধ্যে হরিপ্রসাদ যাদব,বিন্দেশ্বরী চৌহান, লক্ষণপ্রসাদ মাথুর, শ্যামল গুলাব কর্ণ, দেবশোয়া গৌরী, বাণীরানী দেবী, বিমল ত্রিপাঠা ‘অশক’, পুর্ণ সিং জেঠলানী প্রমুখের সাফল্যও কম নয়।
নতুনদের মধ্যে এমন কবির সংখ্যা কম নয় যাঁরা নিছক উর্দু গজলের নকলকে হিন্দী গজল বলে চালাতে চান। এই শ্রেণীর কবিদের মধ্যে শ্যাম বিমল, মধুর নজমী, পাকিজা খাতুন, চন্দ্রশেখর ঝা ‘ইন্দু’, বলরাজ হ্যয়রৎ প্রমুখের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। এঁরা গজলের শর্ত ও তার প্রকৃতিকে না বুঝেই পঞ্চরঙ্গী হিন্দীতে বিজু তুকবন্দী লিখে ‘গজল’-এর স্ট্যাম্প মেরে লটারির জাল টিকিটের মতো বাজারে ছাড়ছেন। উদাহরণ হিশেবে মধুর নজমীর রচনা পড়া যাক—
‘দর্দ কিতনা গঝিন হো গয়া—
আদমী আলপিন হো গয়া।।
অপনে কিরদার কী মওত সে—
আদমী মুতইন হো গয়া।।’
ফারসিয়ানায় ভারাক্রান্ত এ ধরনের রচনা গজলমূলক নজমা বা ‘গজলের মতো কবিতা’ হতে পারে, কিন্তু গজল হয় না। তাই এঁদের রচনাকে ‘গজল’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া অসম্ভব।
আবার আর এক শ্রেণীর কবি আছেন যাঁরা গজলের নামে প্রাচীন কাব্যিক শব্দের ব্যবহারে বা অতি-হিন্দী ভাষায় ‘পদাবলী’ লিখে ঘসা-মুদ্রার মতো বাজারে ছাড়ছেন।সত্যপ্রকাশ সাকসেনা, ড. শিওবেশ, বিশ্বম্ভরনাথ উপাধ্যায়, চন্দ্রমণি ত্রিপাঠী, বিশ্রান্ত বসিষ্ঠ, ব্রহ্মাশংকর পাণ্ডেয়, অজিত শর্মা প্রমুখকে এই দলের শ্রেণীভুক্ত বলা যায়। এঁদের রচনায় যথার্থ মেজাজ ও ভঙ্গির অভাব, কাফিয়া-রদীফের ও ছন্দের ত্রুটি খুবই দৃষ্টিকটু। উদাহরণত সত্যপ্রকাশ সাকসেনার দুটি শের উদ্ধৃত করছি—
‘রাম সী বনবাস মেঁ হ্যয় জিন্দগী
পহচান কী তলাশ মেঁ হ্যয় জিন্দগী।
উও উমড়তা বাদল জানে হ্যয় কহাঁ
শুষ্ক কেদে প্যাস মেঁ হ্যয় জিন্দগী।’
কিন্তু নতুনদের দলে এমন কবির সংখ্যাও কম নয়, যাঁরা রচনাগুণে স্বতন্ত্র অভিনিবেশের দাবি করতে পারেন। বেদপ্রকাশ রাহী, সরস্বতীকুমার ‘দীপক’, শ্রীরাম মিনা, জ্ঞানপ্রকাশ, জাহির কুরেশি, সুরেশ বিমল, তারাদত্ত নির্বিরোধ, বাবুরাম শর্মা ‘বিভাকর’, ব্রহ্মাশংকর পাণ্ডেয়, কলীম আনন্দ, কুঁওর বেচৈন, ভট্ট মধুর শাস্ত্রী, পশুপতিনাথ ব্যাকুল, বলরাজ হ্যয়রৎ, ইশরৎ কিরৎপুরী, মনমোহন তলখ, রাজীব সাকসেনা, রাজকুমারী রশ্মি, মৃত্যুঞ্জয় মিশ্র ‘করুণেশ’, প্রতাপ সহগল, পূরণ সরমা প্রমুখ এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, যাঁদের গজলে জীবনের বিবিধ পক্ষগুলিকে সহজ স্বাভাবিক ভাষায় ও শৈল্পিক পদ্ধতিতে উদঘাটিত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। কোথাও শহুরে জীবনের বিড়ম্বনা চিত্রিত আছে, কোথাও গ্রাম আর পুরোনো স্বর্গ থাকেনি। ড. সুধেশ বর্মা যথার্থই লিখেছেন, ‘গজল মূলত শহুরে সংস্কৃতির প্রতীক, কিন্তু যেভাবে উর্দু শায়রগণ গজলের কথ্য ও শিল্পে বিস্তার সাধন করেছেন, ঠিক সেইভাবে হিন্দি কবিগণ কেবলমাত্র নগরীয় সংস্কারে সীমিত না থেকে গজলকে ব্যাপক জনজীবনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন।’৬৩ নমুনা স্বরূপ জ্ঞানপ্রকাশ বিবেকের একটি গজল উদ্ধৃত করছি। মানুষের দুর্দশা ও আজকের অভাবের ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর এই গজলে—
‘য়্যে জিন্দগী হ্যয় ফকত রেল কী তরহ অওর হম
হ্যঁয় পায়দান পে লটকী সওয়ারিয়োঁ কী তরহ।
য়ে জিন্দগী উমীদোঁ কা এক বিস্তরা থী
কভী খেলতা রহা হুঁ কভী বাঁধতা রহা হুঁ।
কর্জ কী উম্মীদ লেকর ম্যঁয় গয়া থা জিসকে পাস
ফীস মাফী কে লিয়ে উও লিখ রহা থা অর্জিয়াঁ।
জ্ঞানপ্রকাশ বিবেকের গজলের সবচেয়ে প্রধান বিশেষতা হল পরম্পরাগত ভারতীয় প্রতীকগুলির কলাত্মক প্রয়োগ।লঙ্কা, পঞ্চবটী, তাজমহল, মুমতাজ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার লক্ষ করুন—
‘অশকোঁ কী সজী লংকা তো আঁখো মে খড়ী হ্যয়
খুশিয়োঁ কী মগর পঞ্চবটী সুনী পড়ী হ্যয়।
কিস-কিস কে লিয়ে তাজমহল অশক বহায়ে
হর দর পে ফটেহাল সী মুমতাজ খড়ী হ্যয়।’
গজলে রদীফ ও কাফিয়ার মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে নতুন কবিরা অনেক সজাগ। এঁদের ভাষা অধিকাংশত প্রচলিত কথ্যভাষা, যা সহজেই পাঠক-মনকে আকৃষ্ট করে। প্রসঙ্গত, মৃত্যুঞ্জয় মিশ্র ‘করুণেশে’র একটি গজল উদাহৃত করছি—
‘আকাশ মহল আপকা, দুঙ্গা না দখল ম্যঁয়
রহনে দেঁ মেরী ঝোপড়ী, সমঝুঙ্গা মহল ম্যঁয়।
করতে হো ক্যোঁ হর বার তুম আসান কো মুশকিল
করতা হুঁ তো কিতনা করুঁ মুশকিল কো সহল ম্যঁয়।
আঁসু হ্যঁয়, গরীবী হ্যয়, ভুখ, প্যাস, বেবসী
শায়র হুঁ, উন আঁখোঁ কো ক্যয়সে কহুঁ কমল ম্যঁয়।
মেরা থা কাম, খুন-পসীনা লগা দিয়া
কাটেঙ্গে কোই অওর, ন কাটুঙ্গা ফসল ম্যয়।
ঠোকর তো বহুত বার লগী, হোশ ন আয়া
হ্যয় মর্জ লা-জবাব, ন পাউঙ্গা সঁভল ম্যঁয়।
তব তক ন কোই ছন্দ, কোই গীত উতরতা
জব তক কি আঁচ-তাপ মেঁ জাতা ন পিঘল ম্যঁয়।
কহনে কো তো কহতে হ্যঁয় গজল অওর বহুত লোগ
কহতে হ্যঁয় মগর লোগ কি কহতা হুঁ গজল ম্যঁয়।
শুধু ভাষার সহজতা বা শব্দের সুচারুতাই নয়, নতুন উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক প্রভৃতির ছটাও আজকের গজলের বিশেষত্ব। আধুনিক কবির কাছে ‘উপমাই কবিত্ব’। উদাহরণত শ্রীরাম মীনার একটি গজল পড়া যাক—
‘দহকতা অঙ্গার পানী মেঁ ডুবাও মত
ইস তরহ সে ডুবকর, ইতনা নহও মত।
য়হ নদী গহরী নহীঁ হ্যয়, আপমে জ্যাদা
আপ দরিয়া মেঁ, অওর দরিয়া ডুবাও মত।
জুলফ জ্যয়সে ঘটায়েঁ ভী নহাকর নিকলী—
মোতিয়োঁ সী বুন্দ কো, নীচে গিরাও মত।
বস্ত্র সারী দেহ সে, লিপটে হুয়ে চুম্বন
চুমতে হ্যঁয় উও, অধর মেরে জ্বলাও মত।’
যৌন ও গণ এই দুই ধারায় উত্তর-দুষ্যন্তীয় গজলায়ণ এগিয়েছে। যৌনভিত্তিতে গড়ে উঠেছে গণজ প্রবাহ। কেন-না ‘মানুষের সত্যকার মুক্তি তার নিজের ভেতরকার প্রেরণা ছাড়া আসে না’—এবং তা মুখ্যত যৌনজ। ফ্রয়েডীয়-মার্কসীয় তত্ত্ব গজলে কীভাবে এসেছে, তা একটি উদাহরণ সহযোগে বোঝাচ্ছি। ১৯৮২ সালে জাঁ-লুক গোদারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘রাগী’ ছবি ‘ব্রিটিশ সাউন্ডস’ নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্কের ঝড় ওঠে। ছবিটির দ্বিতীয় সিকোয়েন্সের একটি দৃশ্য দিয়েই বিতর্ক। দৃশ্যটিতে ছিল একটি নগ্ন রমণী—সাউন্ডট্র্যাকে নারীমুক্তি আন্দোলনের কথা। মেয়েটির নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যোনির সামনাসামনি ক্লোজশট। এই পুরো সিকোয়েন্সটিতে গোদার কিন্তু দর্শকদের দেখাতে চাননি যৌনতা বা নারীদেহের সৌন্দর্য। বরং ফুটিয়ে তুলেছেন যৌনতা ও স্বাধীনতার পারস্পরিক জটিল ও অসম সম্পর্ক। দৃশ্যটিতে ডায়ালেকটিক্যাল ইনটার প্লে নারী-স্বাধীনতা বিষয়টাকে ছাপিয়ে যৌন আচরণ ও রাজনৈতিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। হঠাৎ পর্দায়—‘যৌন বিকৃতি ও স্টালিনইজম’, ‘একজনের লিঙ্গকে চাপা দিয়ে শ্রমিক সংগঠনের সিদ্ধান্তকে গোপন রাখা’ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে সমান্তরালতা দেখানোর প্রচেষ্টা। এই রকম জটিল বিষয় নিয়ে হিন্দীতে শ্রীরাম মীনা, ভগবতী প্রসাদ, মীনাক্ষী চৌহান প্রমুখ গজল লেখার চেষ্টা করছেন, যা নতুনত্বের পরিচায়ক।
কিন্তু জীবন শুধু মননসর্বস্ব নয়, দেহের নৈরাজ্যও সেখানে চলে না। তাই অনেকের গজলের দেহবাদে ফুটে উঠেছে মার্কস-লেনিনীয় তত্ত্ব। প্রোলেতারীয় গজলের জন্ম হয়েছে। সুরেশ বিমলের এই গজলটি তারই নমুনা—
‘আগ হী আগ হুই সব তরফ য়্যারো
বচ কে অব জায়েঁ তো কহাঁ য়্যারো।
হাথ মেঁ শখস কে জলতী মশাল
কিস-কিস কো সমঝায়েঁ যহাঁ য়্যারো।
বস্তী মেঁ লগী হ্যয় আগ ঘর-ঘর মেঁ
ধুনী সা সুলগ রহা জরা-জরা য়্যারো।
আজ কী ইস সভ্যতা তো ক্যা কহেঁ
আদমী কো আদমী নশতর হুয়া য়্যারো।
জুলম অওর শোষণ কী সমাপ্তি চাহিয়ে
গজল সে সর্বহারা কী চাহত লিখী য়্যারো।’
এই ধারার বিশিষ্ট কবি কলীম আনন্দ আবৃত্তিযোগ্য বহু গজল লিখেছেন।লেখনভঙ্গিতে হৃদয়াবেগের সাবলীল উচ্ছ্বাস বেশ মর্মস্পর্শী। নিচে উদ্ধৃত গজলটিতে কলীম নবজাগরিত ভিয়েতনামের মানবতার পূর্ণ অধিকার ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াসকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন—
‘তেজ অওর তেজ দওড়তে রহিয়ে
জিন্দগী ক্যা হ্যয় সোচতে রহিয়ে।
অব পহাড়োঁ সে লওট আয়ী হ্যয়
অপনী আওয়াজ খোজতে রহিয়ে।
মুফলিসী বন গয়ী হ্যয় আজাদী
জিতনা জী চাহে বোলতে রহিয়ে।
পৎথরো কা য়হী জমানা হ্যয়
লাখ শীশোঁ কো কোসতে রহিয়ে।
ক্যোঁ ন সূরজ সে দোস্তী করকে
রোশনী রোজ তোলতে রহিয়ে।’
ওই চেতনা বা প্রত্যয় আরও শৈল্পিক রূপ পেয়েছে জাহির কুরেশির গজলে।তাঁর একটি গজলের দুটি শের নিচে নিচে লিখছি—
‘আগ কো ভী নহীঁ পতা হ্যয়, সুনো
য়্যে ‘হিমালয়’ সুলগ রহা হ্যয়, সুনো।
তুমনে মুঝকো সমঝ লিয়া কি নহীঁ?
ম্যঁয়নে তুমকো সমঝ লিয়া হ্যয়, সুনো।’
সংযত হৃদয়াবেগের জন্য সত্যপাল সাকসেনা ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তা হাসিল করেছেন। ইনি দরদের কবি—সাম্যবাদী চিন্তায় বিশিষ্ট। তাঁর রচনার নমুনা—
‘রেত পর হাথ সে কুছ অশক বনা দেতা হুঁ
দিল পে মুশকিল-সে লমহে এ্যয়সে বিতা দেতা হুঁ।
মেরা মকসদ তেরী রাহত তো নহীঁ হ্যয় লেকিন
জিন্দগী! আ, ম্যঁয় তেরে বোঝ উঠা দেতা হুঁ।’
এর পাশাপাশি পড়া যাক আনোয়ার শামীমের একটি গজল। আনোয়ার ধানবাদের কবি, জন্ম ১৯৬২; হিন্দী ভাষায় নতুন ধারার কবিতা ও গজল লিখছেন বিগত চার দশক ধরে। আসুন, শামীমের গজলটি পাঠ করা যাক—
‘চাঁদ হোগা, ন চাঁদনী হোগী।
জিন্দগী মেরী জল রহী হোগী।
মেরে কমরে মেঁ কৌন আয়েগা,
ভুলী-ভটকী সী য়্যাদ হী হোগী।
কিতনে দরওয়াজে মুন্তজির হোঙ্গে।
মেরী খিড়কী ভী জাগতী হোগী।
মেরে অশআর থক গয়ে হোঙ্গে,
নীঁদ খওয়াবোঁ কো আ গঈ হোগী।
আইনা জব জুবান খোলেগা,
মেরী সুরত থকী-থকী হোগী।’
পরিশেষে সরস্বতী কুমার ‘দীপক’-এর একটি গজলের কিয়দংশ উদ্ধৃতি অসংগত হবে না—বরং যথেষ্ট প্রাসংগিক
‘চুপ খড়ে হ্যঁয় পেড় সারে, আজকল
রো রহে তম কে সিতারে, আজকল।
বহ রহী কিস অওর সরিতা, ক্যা পতা—
কহ রহে দোনোঁ কিনারে, আজকল।
হটো জী, অব কহাঁ কবিতা কী জগহ—
গজলোঁ কী ধুম মচী হ্যয় প্যারে, আজকল।’
হিন্দীতে এখন গজলেরই জয়যাত্রা। অসংখ্য কবির দল গজলচর্চা করে চলেছেন এবং গতানুগতিক ভাবধারা বর্জন করে অভিনব ভাবধারার সন্ধানে ব্রতী আছেন। এঁদের সকলেই যে গজলেও সফল, এমন কথা বলব না। অনেকের কাছে গজল একটা চ্যালেঞ্জে মতো, এবং তাঁরা অজীম শায়র ফয়েজ আহমদ ‘ফয়েজে’র এই শেরটি সম্ভবত কবুলও করেন :
‘গর বাজী ইশক কী বাজী হ্যয় জো কুছ ভী লগা দো ডর ক্যয়সা
গর জীত গয়ে তো ক্যা কহনে, হারে ভী তো বাজী মাত নহীঁ।’
.
তথ্যসূত্র
৪৩. ড. ধনঞ্জয় বর্মা, ‘গজল কো গজল রহনে দেঁ’, ধর্মযুগ, ১৬ নভেম্বর ১৯৮০
৪৪. হরিশংকর শর্মা, ‘উর্দু সাহিত্য কা ইতিহাস’, পৃ. ১৯
৪৫. অজিত রায়, ‘রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে হিন্দী’, দেশলোক, ১ এপ্রিল ১৯৮৪
৪৬. Mohun Kumar Manghaulam : ‘Indian Language Crisis’, p. 129
৪৭. রামচন্দ্র শুক্ল, ‘হিন্দী সাহিত্য কা ইতিহাস’, পৃ. ৬৬
৪৮. ড. রাজনাথ শর্মা, ‘হিন্দী সাহিত্য কা বিবেচনাত্মক ইতিহাস’, পৃ. ৭৯
৪৯. অজিত রায়, ‘বিষয় হিন্দী গজল’, ধনবাদ সমাচার, অগাস্ট ১৯৮৪
৫০. আনন্দ নারায়ণ শর্মা, ‘ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র’, কিশোর ভারতী, অগাস্ট ১৯৬৪
৫১. মহাদেবী বর্মা, ‘ছায়াবাদ’, পৃ. ৭৮
৫২. ড. সুধাকর চট্টোপাধ্যায়, ‘আধুনিক হিন্দী সাহিত্যে বাঙলার স্থান’, পৃ. ৯৪-১১১
৫৩. ড. রামবিলাস শর্মা, ‘রচনাবলী’, ১৯৪৮
৫৪. Dr. Prabhakar Machwe : ‘Hindi Writing : Poetry in Plenty’, Statesman, 19 Ausust 1984
৫৫. Dr. Prabhakar Machwe : ঐ
৫৬. Dr. Prakash Verma : ‘The History of Hindi Poetries’
৫৭. অজিত রায়, ‘অকবিতা’, আজকাল, ডিসেম্বর ১৯৮২
৫৮. আশুতোষ সিনহা, বেকল উৎসাহীর সাক্ষাৎকার, আজকল, জুন ১৯৮২
৫৯. সওয়াই সিং শেখাওৎ, ‘দুষ্যন্ত কুমার : নঈ কবিতা সে ওয়াপসি অওর গজল’, আজকল, মে ১৯৮১
৬০. সওয়াই সিং শেখাওৎ, ঐ
৬১. শেরজং গর্গ, ‘গজল : জনজীবন কী সহী অভিব্যক্তি’, আজকল, মে ১৯৮১
৬২. নরেন্দ্র বশিষ্ঠ, ‘গজল পর পরিচর্চা’, আজকল, মে ১৯৮১
৬৩. ড. সুধেশ বর্মা, ‘হিন্দী গজল’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন