অজিত রায়
“The ghazal is a marvel of the magnetic dynamism of husn o i’shq (beauty and live) in highly charged metaphoric idiom. It is a celebration of love and freedom in an ambience of pure ecstasy and unremitting joy as well profound capacity for enduring pain and suffering. The ghazal is the soul of Urdu poetry and the play of creativity at its peak.”—এভাবেই গজলকে সংজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে পাতনামা করেছেন গোপীচাঁদ নারং, তাঁর ‘The Urdu Ghazal : A Gift of India’s Composite Culture’ নামের স্মৃতিসৌধ গ্রন্থটির। মোদ্দা কথা, গজল উর্দু কাব্যসাহিত্যের আত্মা এবং উর্দু কবিদের মননবিশ্বে সরাসরি শীর্ষে তার অবস্থান।
গজল বিষয়ক আমার এই যে বইটি, এটি নিছক কোনও মনোগ্রাফ অথবা প্রকরণগ্রন্থ নয়, বরং পারস্যে সুফিবাদের হামাল-পর্বে ফার্সি ভাষায় ফিটাস লাভ করে ক্রমে ক্রমে পথম মিলিনিয়ামের সান্ধ্যকালে সুফি রহস্যবাদ তথা ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের গাঁঠছড়া বাঁধার মওকা বাগিয়ে তা কীভাবে অঞিনব মিশ্রকৃষ্টির ড়ুপ পরিগ্রহ করে ভারতীয় সংস্কৃতির ক্রোড়ে লালিত হয়ে ক্রমে ক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মিলিনিয়ামে এসে উর্দু তমদ্দুনের গুলবাগিচায় সবচেয়ে বেহত্রিণ মুঞ্জরির শিরোপা হাসিল করল, তার বিশদ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টাও লক্ষিত হবে এতে। এমনিতে গজলের প্রকরণগত তত্ত্ব নিয়ে উর্দু, হিন্দী এবং ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু উন্নতমানের গবেষণাগ্রন্থ বিদ্যমান, কিন্তু আমার এটি সেগুলি থেকে সর্বৈব ভিন্ন। এতে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছে একজন অপেশাদার গবেষকের আ-তারুণ্যসিঞ্চিত গজলের প্রতি নিজস্ব জিজ্ঞাসা ও কোতূহল এবং ঐকান্তিক মমত্ব।
সাহিত্যরাজ্যে গজলের সংবৃত্তি বা সূচনা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে যখন এই উপকহাদেশে ভাষা ও সাহিত্য তথা সংস্কৃতি ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক রাহুর যাদুটোনায় হয়ে পড়েছিল একুনে মোহাচ্ছন্ন। গজল সেই জীয়নকাঠি যা মানুষের প্রাণনে নিষেক করল নতুন আস্তিত্বক চেতনা, প্রেমময় দৃষ্টি এবং অন্তঃস্যন্দী মানবতার তরস্বান তোড়।
খানিক পেছনে ফিরে যাই। ইতিহাসের যে-লগ্নে ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ও আগ্রাসন শুরু হয়েছিল এবং যার ফলস্বরূপ এই উপমহাদেশে কম্পোজিট কালচারের সূচনা, সেই একই কালপটে আমরা হিন্দু ভক্তি আন্দোলনের মূর্তিটিকে অদূরে দণ্ডায়মান দেখতে পাই, যা ক্রমশ ভারতীয় হিন্দু মানসে বাসাও বাঁধতে শুরু করেছিল। ভারতীয় বহুত্ববাদী ও সমন্বয়ী ঐতিহ্যের এক প্রোজ্জ্বল প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ভক্তি ও সুফি আন্দোলনের মধ্যে। দুটি আন্দোলনই বেশ কয়েক শতাব্দী জুড়ে সৃষ্টিশীল কবি, চিন্তাবিদ এবং ভারতীয় আম জনতাকে প্রভাবিত করে রেখেছিল এবং উভয়েরই একটি সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল।
যদিও সুফি মতবাদের উদ্ভব আরবে, কিন্তু এর জন্মলগ্নেই এই মতাদর্শের ওপর যোগ, উপনিষদ ও বৌদ্ধ ধর্ম এবং বিভিন্ন ভারতীয় দার্শনিক প্রস্তাবের গভীর প্রভাব পড়েছিল। ভারতে খৃস্টীয় নবম-দশম শতকে ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরে যে প্রগতিশীল আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটিই ছিল এখানকার সুফি আন্দোলন। যারা সুফ বা পশমের বস্ত্র পরিধান করে, তারাই সুফি। অর্থাৎ সুফি শব্দটির সঙ্গে ‘সাফা’ বা ‘শুচিতা’ অথবা ‘পবিত্রতা’র কোনো যোগ নেই। সুফিদের মধ্যে মতাদর্শ ও তত্ত্বগত বৈভিন্ন্যের দরুন তাঁদের পারস্পরিক বিরোধও ছিল। ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্য পত্তনের ফলে মুসলিমদের মধ্যে ভোগবিলাস তথা ঐশ্বর্যের দাপ ও উন্মাদনা তথা নৈতিক অধঃপতন চাগিয়ে উঠলে কতিপয় ধর্মপ্রাণ মুসলমান সুফি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন এবং গোঁড়া মুসলমানদের উষ্মা ও রোষের কোপে পড়েন। গোঁড়ারা সুফিদের সরাসরি ইসলাম-বিরোধী আখ্যা দিয়েছিলেন। ফলে সুফিরা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে জনৈক পীর বা শেখের অধীনে নিজস্ব ধর্মমঠ গড়ে তুলে নির্জনে ধর্মচর্চা শুরু করেন এবং তাঁরা হয়ে ওঠেন ফকির বা দরবেশ।
সুফিদের মূল তত্ত্ব হলো, প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বরলাভের একমাত্র পথ। এঁরা কোনও বিপ্লবের প্রত্যাশা করেননি, কেবল বিশ্বাস করতেন এমন দিন আসবে যেদিন আল্লাহ স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে ইসলামের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন। ভারতবর্ষে বিখ্যাত সুফি সন্তদের মধ্যে গোড়ার দিকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন শাহ রুমি, নথর শা, গনজ বকশ প্রমুখ। রুমি বাঙলায় এসেছিলেন ১০৫৩ সালে। ময়মনসিংহের নেত্রকোণায় তাঁর মকবরা আছে। শেষোক্ত জনকে ভারতের প্রথম সুফি সাধক বলে মান্য করা হয়। ভারতের দাক্ষিণাত্যে সুফি মতবাদ নিয়ে যান নথর শা। চেন্নাইয়ের ত্রিচিনোল্লিতে তাঁর সমাধিভূমি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দ্বাদশ শতক থেকে ভারতবর্ষে সুফি-সন্তদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। আসমুদ্রহিমাচল সুফি সাধকেরা ছড়িয়ে পড়েন। যাঁরা এই সময় ভারতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন চিশতি ও সুরাবর্দি সম্প্রদায়। ভারতবর্ষে সুফিদের প্রধানত তিনটি শাখা প্রভাবশালী ছিল—দিল্লি ও দোয়াব অঞ্চলে চিশতি; সিন্ধু, পাঞ্জাব ও মুলতানে সুরাবর্দি; এবং বিহারে ফিরদৌসী। এছাড়া আরও একটি সম্প্রদায় গড়ে ওঠে, সেটি হলো মদানি সম্প্রদায়। চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মৈনুদ্দীন চিশতি, যিনি মহম্মদ ঘুরির সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন এবং আজমিরে বসবাস শুরু করেন। চিশতি শাধকদের মধ্যে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নাম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত কবি আমির খুসরো এবং ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দীন বরানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাঙলায় প্রভাবশালী ছিলেন। এঁদের মধ্যে শিহাবউদ্দীন সুরাবর্দি ও হামিদউদ্দীন নাগরি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই সম্প্রদায়ের সুফিরা চিশতিদের মতো কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন না, এঁরা মেনকি রাষ্ট্রের অধীনে উচ্চপদও গ্রহণ করতেন। এই তিনটি ধারা ব্যতিরেকে সুফিদের আরও কতিপয় উল্লেখযোগ্য ধারা ছিল, এবং কতকগুলি এখনও বিদ্যমান। একাদশ শতকে বাগদাদের সৈয়দ আবদুল কাদির প্রতিষ্ঠা করেন কাদেরিয়া সম্প্রদায়। চতুর্দশ শতাব্দে উদ্ভব হয় বদিউদ্দীন শাল মদারের নেতৃত্বে মদারি সম্প্রদায়। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে তুর্কিস্তানের খাজা বাহাউদ্দীন নক্কশ বনদ গঠন করেন নকশাবন্দি সম্প্রদায়।
সুফি আর ভক্তি মতবাদের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও ভক্তি আন্দোলন আসলে সুফি আন্দোলনের চেয়েও প্রাচীন। উপনিষদে এর দার্শনিক ও তাত্ত্বিক লক্ষণ সমূহের প্রতিপাদন রয়েছে। ভক্তি আন্দোলন বস্তুত হিন্দুদের সংস্কারবাদী আন্দোলন। ঈশ্বরে অগাধ ভক্তি, মানুষের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, যাবতীয় ধর্মের সমানতার প্রচার তথা জাতি ও কর্মকাণ্ডের ভর্ৎসনা করা হয়েছে।বাস্তবত, ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে, সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দের মাঝামাঝি সময়ে, যার উদ্দশ্য ছিল নায়ম্মার তথা আলওয়ার গোষ্ঠীদ্বয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও মনোমালিন্য দূরীভূত করা। কথিত আছে, এই আন্দোলনের প্রথম প্রচারক নাকি শঙ্করাচার্য। ধর্মভিত্তিক হলেও, ভক্তি আন্দোলন অচিরেই গণচরিত্র অর্জন করেছিল। এই চরিত্র অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক সংগীত তথা হয়েছিল বাদ্যযন্ত্র। ধর্মপ্রচারক সন্তদের অধিকাংশই ছিলেন কবি ও গায়ক।
পরবর্তীকালে ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রসারের ফলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে উদ্বেগ ও অস্থিরতা দেখা দিলে এই আন্দোলন পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মুসলিম শাসকেরা গদি জাঁকিয়ে বসলে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম বরণের ব্যাপক হিড়িক দেখা দেয়। ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত মুসলমান। যদিও এই ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব কখনোই বিপন্ন করেনি, তবু এটি হিন্দুদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল। আত্মরক্ষা ও সমালোচনার পড়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে রামানন্দ, নামদেব, কবীর, গুরুনানক, শ্রীচৈতন্য, মহন্ত শঙ্করদেব, বল্লভাচার্য, মীরাবাঈ, দাদু প্রমুখের নাম সবিশেষ উচ্চার্য।
গজলের উৎপত্তি আরবে হলেও ফার্সি ভাষায় এই জঁরটির যথাযথ বিকাশ ঘটে। যদিও জন্মলগ্নে ভ্রুণটির নাম ছিল ‘কাশিদা’। কাশিদার শাব্দিক অর্থ এমব্র্যাসি বা হেম স্টিচ। বাংলায় যাকে বলে, ঝুলপি-সেলাই; আর হিন্দীতে কাপড়ে বেল-বুটি বসানোর কাজ, যেমন ‘কসিদা কাঢ়না’। অথচ এখানে যে অর্থে ‘কাশিদা’, তার সঙ্গে সূচীকর্ম বা বোনাবুনির কোনো যোগ নেই। আরবি শব্দ ‘কাসাদ’ থেকে এর উৎপত্তি। কাসিদা একটি পুংলিঙ্গবিশিষ্ট বিশেষ্য পদ এবং এটি শায়রির এমন একটি জঁর বা রূপ, যার মাধ্যমে কারও প্রশস্তি বা প্রশংসা করা হয়। মূলত বাদশা-শাহেনশাদের প্রশস্তি গাওয়ার জন্যই লেখ্য-মাধ্যমে এর স্ফুরণ ঘটেছিল। এর সঙ্গে ঈশ্বরের স্তুতি গাওয়ার কোনও যোগ নেই। ইসলাম আগমনের বহু আগে থেকেই আরবে কাশিদা লেখা ও গাওয়া হতো। গোড়ার দিকে ফার্সি-উর্দু কাশিদা লেখা হতো সতেরো চরণে, যাতে থাকত প্রশংসা, নিন্দা অথবা উপদেশের ভাব। কাশিদা লেখকদের বলা হতো ‘কাসিদাগো’ আর যাঁরা কাশিদা পাঠ করতেন, তাঁরা ছিলেন ‘কাসিদাখাঁ’। গোড়ার দিকে ইমাম গজালী, মৌলানা জালালুদ্দীন রুমি, হাফিজ সিরাজী, ফখরুদ্দীন আত্তার, হাকিম শানাঈ প্রমুখ এই নবপ্রসূত জঁরটির অনুশীলন করে বেশ সুনাম অর্জন করেন।
তো, গোড়াতেই আমাদের খুঁড়ে বের করতে হবে উর্দু গজলের সেই অধঃপ্রোথিত ক্রস-কালচারাল শেকড়টি। এগারো শতকের গোড়া থেকেই ইসলামি এবং হিন্দু সংস্কৃতির মিশ্র ধারাটি শেকড় চারাতে শুরু করেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে, যা লক্ষ-লক্ষ মানুষকে সম্মোহিত ও বিমুগ্ধ করেছিল। দিল্লির চিশতি সুফি সন্ত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকটতম অনুগামী আমির খহুসরোর (১২৫৩-১৩২৫) উত্থান সময়ের সেই পৃষ্ঠকালে, যিনি ছিলেন মূলত কবি ও সংগীতশিল্পী। আমিরের সমস্ত লেখকর্ম ছিল ফার্সিতে, যেটি মধ্য এশিয়ায় পরচলিত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ইরানীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা। পারস্যের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে ফার্সির উদ্ভব। বস্তুত, উত্তর ভারতের তৎকালীন ভাষাপদ্ধতির সঙ্গে ফার্সির মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষার এক অভিনব হাইব্রিড প্রোটো-মডে, যা অভিহিত হয় ‘হিঁদয়ী’ বা ‘হিন্দভী’ নামে,—সেটিই ছিল আমিরের মাতৃভাষা (তাঁর বাবা ছিলেন তুর্কি কাছারির কর্মী এবং মা রাকপুত)। আমির ঐ হিন্দভী ভাষাথ কবিতা লিখতরন এবং সেগুলি সুফি সভাসমূহে গান করে বেড়াতেন। পরবর্তী কালে ঐ মিশ্রভাষাটি ‘রেখতা’ নামে চিহ্নিত হয়। রেখতা অর্থে ‘বিক্ষিপ্ত’, কিন্তু একই সঙ্গে ‘মিশ্রিত’; যার আধার ছিল মূলত ফার্সি।
মুসলিম শাসকেরা, যাঁরা নিজেদের রাজত্বের বিসার ঘটিয়েছিলেন গুজরাত এবং সুদূর দাক্ষিণাত্য অবধি, তাঁরা সরকারি কাজকর্মের সুবিধার্থে গুজরাতের ‘গুজারি’ আর ডেকানের ‘দখিনি’র পাশাপাশি এই হাইব্রিড ভাষাকেও ব্যবহার করতে শুরু করেন তখন থেকেই। এই মিশ্রভাষাটি একই অর্থে ‘হিন্দয়ী’, ‘হিন্দুস্তানি’, ‘উর্দু’, ‘উর্দু-এ-মুয়ল্লা’ এবং ‘হিন্দী’ নামেও চিহ্নত। আমির খুসরোই সেই আদিকবি যিনি ভারতবর্ষে দোহা, পহেলি, গীত, কাওয়াল, কাওয়ালা এবং নতুন ধরনের প্রাণবন্ত আধ্যাত্মিক গানের প্রবর্তক যেটি ফার্সি-রেখতার মিশ্র ফর্মে পরবর্তী কালে ‘গজল’ নামে চিহ্নিত হয়। এভাবেই আমির খুসরোর কব্জি ধরে ভারতীয় গজলের সূচনা। আমির খুসরোকে একাধারে হিন্দী আর উর্দুর প্রথম কবিও বলা যেতে পারে।
উর্দুর উৎসমূলে রয়েছে কতিপয় আপাত-বিচ্ছিন্ন অথচ পরস্পর বিলীয়মান ভাষাপদ্ধতির অভিনব সংমিশ্রণ। উর্দু ভাষা গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্বে এটি চিহ্নিত ছিল ‘হিন্দভী’ নামে, যা একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও জনতাত্ত্বিক ভাষাপদ্ধতি রূপে গণ্য হতে পারে। ঐ হিন্দভীর উৎকর্ষে পৌঁছনোর পেছনে রৈখিক বা নগণ্য হলেও, যুক্ত হয় দাক্ষিণাত্যের দখিনি, দিল্লির দেহলভী এবং লখনউয়ের লখনভী।
উর্দু ভাষা ‘উর্দু’ নামে আখ্যায়িত হওয়ার আগেও শব্দটি বিদ্যমান ছিল। উর্দু মূলত তুর্কী থেকে এসেছে এবং ‘শাহী শিবির’ কিংবা ‘খেমা’ (তাঁবু) অর্থে এটি ব্যবহৃত হতো। তুর্কীদের সঙ্গেই শব্দটি ভারতে প্রবেশ করে এবং গোড়ার দিকে খেমা বা সৈন্য শিবির অর্থেই এটির ব্যবহার বজায় ছিল। শাহজাহান দিল্লিতে যে লালকেল্লাটি গঠন করেন, সেটিও ছিল একটি উর্দু বা শাহী শিবিরই; কিন্তু যথেষ্ট বৃহদাকার হওয়ার দরুন লাল কিলাকে বলা হতো ‘উর্দু’, ‘উর্দু-এ-মুয়ল্লা’ (শ্রেষ্ঠ রাজকীয় শিবির)। তারই সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘উর্দু’।
এই গল্পের সঙ্গেই সাদৃশ্যযুক্ত আর একটি মজার উপগল্প প্রচলিত। উর্দু অভিধান মান্য করলে, ‘উর্দু’ শব্দটির অর্থ সামান্য ভিন্ন। এর অর্থ লশকর বা ছাউনির বাজার। এমন বাজার যেখানে সবধরনের জিনিশপত্র কিনতে পাওয়া যায়। যাই হোক, গল্পটি এরকম। পাঠান, তুর্কি, বেলুচি, আরবি, ইরানি, পখতুনি, মঙ্গোল প্রভৃতি সৈনিকদের নিয়ে গঠিত হতো এক-একটি মুঘল সামরিক বাহিনী। বাহিনীগুলির বেশির ভাগ শিবির বা ছাউনি পড়ত দিল্লি, মেরেঠ, ব্যারেলি, সাহারানপুর প্রভৃতি এলাকায়। এসব অঞ্চলের কথ্যভাষা ছিল খড়িবোলি হিন্দী। অবসর বিনোদনের জন্য সৈন্যরা যখন পথেঘাটে বেড়াতে বেরতো তখন তারা ‘খড়ী’ বুলি বলার চেষ্টায় তুর্কি, বেলুচি ইত্যাদি শব্দযোগে একটি নতুন ধরনের জারগন বা অপভাষা বা শব্দজাল তৈরি করে নিয়েছিল। বাজারকে যেহেতু ‘উর্দু’ বলা হয়, সুতরাং সেখানে ঐ উর্দুর (অর্থাৎ বাজারের) ভাষাকেই উর্দু বলা হতে লাগল।অতএব, দুটি গল্পেই দেখা যাচ্ছে, গোড়ার দিকে উর্দুর প্রচলন ঘটেছিল লোকের মুখে মুখে। যতদিন খড়ী ভাষায় হিন্দী আর সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য ছিল ততদিন এই ভাষাকে হিন্দী, হিন্দভী না রেখতা বলা হতো। কিন্তু এর ওপর আরবি-ফার্সির প্রভাব পড়তেই এটি বদলে গিয়ে ‘উর্দু’ হয়ে যায়। পরে সাহিত্যে ব্যবহার শুরু হলে একে ফার্সি লিপি (বিদেশি) প্রদান করা হয়। তখন থেকেই উর্দু একটি পৃথক ভাষা হিশেবে গণ্য।
অন্যদিকে, প্রখ্যাত উর্দু লেখক মুহম্মদ হুসেন আজাদ উর্দুর উৎপত্তি ব্রজভাষা থেকে, এমত দাবি করেন। অবশ্য, এ বিতণ্ডা আমাদের মূল আলোচনায় দুর্যোগ ঘটাতে পারে, সুতরাং নীরব থাকছি। মোটা অর্থে বলতে পারি, উর্দু হলো হিন্দী ভাষার তেমন একটি রূপ যাতে আরবি, ফার্সি, তুর্কি ইত্যাদি শব্দের প্রাচুর্য এবং যা লেখা হয় ফার্সি লিপিতে। বর্তমান কালে ভারতে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিষ মানুষের মনকে কলুষিত করেছে, ফলে, এখন অনেকেই মনে করেন হিন্দুদের ভাষা হিন্দী আর মুসলমানেদের ভাষা উর্দু। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৮০ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ড. জগন্নাথ মিশ্র রাজ্যের বহু মানুষের মুখ চেয়ে দ্বিতীয় রাজ্যভাষা হিশেবে উর্দুকে অভিষিক্ত করতে ‘উর্দু অধ্যাদেশ’ জারি করলে রাজ্যবাপী হিন্দুরা চরম উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য, ধারণাটি সর্বাংশে ভ্রান্ত। উর্দুর ওপর মুসলমান ও হিন্দুদের সমান অধিকার। এখনও পাঞ্জাবের বেশির ভাগ লোক কথ্য ভাষায় উর্দু ব্যবহার করে। জায়সী, রসখান, রহীম প্রমুখ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ফার্সি ছাড়াও ব্রজভাষার (অওধি ভাষা) কবি ছিলেন। খুসরোকে তো হিন্দী ভাষার প্রথম শ্রণীর কবিদের মধ্যে অন্যতাম মনে করা হয়। তাছাড়া, বলা বাহুল্য, উর্দু গজল কেবলমাত্র মুসলিম কবিরাই রচনা করেননি, অনেক আগে থেকেই বেশ কিছু হিন্দু, বিশেষত কায়স্থ বর্ণের হিন্দু কবি এ ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। উল্লখযোগ্য হলেন মুনশি হর করণ, চন্দর ভান ব্রাহ্মণ, মুনশি মাধব রাম, মুনশি লালচন্দ এবং মুনশি উদয়রাজ। এঁদের মধ্যে প্রথম উর্দু গজল লিখেছিলেন চন্দর ভান ব্রাহ্মণ (১৫৭৪-১৬২০)। স্মর্তব্য যে, উর্দুকে মধ্যাকালীন ‘রিয়াসতী’ মানসিকতার কবল থেকে বের করে আনেন স্বয়ং মুনশি প্রেমচন্দ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে হিন্দীর মতো উর্দুও কোনো বিশেষ ধর্ম বা জাতির নিজস্ব সম্পদ নয়। প্রেমচন্দ, কৃশন চন্দর, রাজেন্দ্র সিং বেদী, প্রকাশ পণ্ডিত, ফিরাক গোরখপুরী, রামপ্রসাদ বিসমিল, পণ্ডিত রতনসার সরসার, অমৃতা প্রীতম—এঁরা প্রত্যেকে হিন্দু হয়েও উর্দুতেই বেশি লিখেছেন। উলটো দিকে ড. মলিক মোহম্মদ, রাহী মাসুম রজা, সহয়াত সুলাহী প্রমুখেরা হিন্দীতে এবং নজরুল বাংলায় যুগন্ধর সাহিত্যিক রূপে চিরবরেণ্য।
যে-কথা আগেও বলেছি, উর্দু নামকরণের আগে, এবং পরেও, এই ভাষা স্থানবৈভিন্ন্যে নানান উপনামে চিহ্নিত ছিল। হিন্দী আর উর্দুর সংমিশ্রণ ঘটেছিল যেসব জায়গায় সেখানে এটি হিন্দুয়ী, হিঁদয়ী, হিন্দভী, জবান-এ-হিন্দ, জবান-এ-হিন্দুস্তান, হিন্দুস্তানী বোলি রেখতা ও হিন্দী নামে পরিচিত ছিল, যা পরবর্তীতে দক্ষিণ ভারতে চিহ্নিত হয় জবান-এ-গুজারি, এবং দিল্লিতে জবান-এ-দেহলভী, তথা সমগ্র দিল্লি পরিমণ্ডলে সরাসরি উর্দু নামেই ছিল পরিজ্ঞাত। বস্তুত উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা যার উৎসমূলে রয়েছে দিল্লির জনবুলি বা ডায়ালেক্ট পশ্চিমা হিন্দী। ঐ হিন্দী-ঊর্দু আবার খড়ীবোলি নামেও সমধিক খ্যাত। সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য যে, ভাষার রয়েছে দুটি স্রোতধারা। প্রথমটি প্লুরোসেন্ট্রিক বা পলিসেন্ট্রিক, যা আসলে একাধিক ভাষার সংমিশ্রণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ চাইনিজ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জারমান, কোরিয়ান, স্প্যানিশ এবং তামিল। দ্বিতীয়টি মোনোসেন্ট্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ, যার দৃষ্টান্তে স্থান পায় জাপানিজ ও রাশিয়ান ভাষা। হিন্দুস্তানিও বস্তুত দুটি স্ট্যান্ডার্ড ভাষা পদ্ধতি, আধুনিক মান্য হিন্দী এবং আধুনিক মান্য উর্দুর সংমিশ্রণে গঠিত একটি প্লুরোসেন্ট্রিক বা পলিসেন্ট্রিক ল্যাঙ্গুয়েজ।
যাই হোক, গোড়ার দিকে যাঁরা গজলকে উন্নীত হতে মদত যোগান তাঁরা কিন্তু প্রায় সকলেই ছিলেন দাক্ষিণাত্যের, অর্থাৎ দখিনি ভাষার কবি। যেমন হায়দরাবাদের কুতুব বংশের খ্যাতিমান অধীশ্বর সুলতান মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ (১৫৬৫-১৬১২), মৌলা ওজহী (১৭ শতকের গোড়ার দিকে), মৌলা নুসরতী, দায়েম গওয়াসি (উভয়েই ১৭ শতকের), ওয়লি মোহম্মদ ওয়লি (ওয়লি দখিনি; ১৬৬৭-১৭০৭) এবং সিরাজ অওরঙ্গাবাদী (১৭১৫-১৭৬৩)।
তিনটি লাক্ষণিক বৈশিষ্ট্য—স্থানীয় ভাষা ও শব্দ, উপমা তথা রূপকের সাজুয্য প্রয়োগ, এর দরুন দখিনি ভাষার ধরিত্রীপুত্র কবিরা কালক্রমে রাজ-অনুগ্রহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সুদূর দক্ষিণ ভারত অবধি বিস্তৃত হওয়াও দখিনি কবিতার জনগাহ্যতার আর একটি বড় কারণ। ওয়লি মোহম্মদ ওয়লি ওরফে ওয়লি দখিনি, যিনি ওয়লি গুজরাতি এবং ওয়লি অওরঙ্গাবাদী নামেও সমধিক খ্যাত, জন্মসূত্রে ছিলেন মহারাষ্ট্রের অওরঙ্গাবাদ নিবাসী। তিনি ছিলেন উর্দুর ধ্রুপদী ঘরানার কবি এবং তাঁকে বলা হয়েছে ‘ফাদার অফ উর্দু পোয়েট্রি’। ওয়লির আগে অবধি দক্ষিণ এশিয়ায় উর্দু কবিতা এবং গজল লেখা হতো এবং তাতে সাদদি, জামী তথা রুক্কানি প্রমুখ ফার্সি পণ্ডিতদের ধরন-ধারণ ও শৈলীর অনুসৃতি ও পুনরাবৃত্তি এক ধরনের একঘেয়েমি এনে দিয়েছিল। ওয়লিই সেখানে প্রথম আনলেন বদল। তাঁর কবিতা দখিনির লাক্ষণিক আভায় আলোকিত। ওয়লি কেবল একটি বিশুদ্ধ ভারতীয় ভাষাই ব্যবহার করেননি, উপরন্তু তাঁর কবিতায় ভারতীয় বিষয়, প্রতিমা এবং চিত্রকল্পের সমন্বিত ও সফল প্রয়োগ পরিলক্ষিত। ওয়লি ঘন-ঘন দিল্লি থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ থেকে দিল্লি পাড়ি জমাতেন। দিল্লিতে বসবাসকালে তিনি দিল্লি বলয়ের কবিদের মজলিশে সেগুলি পাঠ করে শোনাতেন এবং দিল্লির কবিরা বিমুগ্ধ চিত্তে সেই শৈলী নিজেদের কবিতায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেন। এভাবে দিল্লির উর্দু ভাষা ও কাব্যসাহিত্যে ওয়লির পরোক্ষ অবদান সংযোজিত হয়েছিল। ওয়লির কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান’ সেসময় দিল্লি বৃত্তে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং সমকালীন ফার্সি কবিরা তাঁর মতো করে কবিতা সৃষ্টির অনুশীলন আরম্ভ করেন। ওয়লি মোহম্মদ ওয়লির হাত ধরেই উর্দু গজলের সূচনা। যদি বলি ওয়লি অগ্রগামীর ভূমিকা পালন করেছিলেন বলেই পরবর্তীতে জৌক, সওদা তথা মীরের মতো শক্তিশালী কবির উদ্ভব সম্ভবপর হয়েছিল, তৃণমাত্র অতিরঞ্জন হবে না।
দিল্লির একগুচ্ছ কবি যাঁরা তদ্দণ্ডে আমির খুসরোর ধারা অনুসরণ করে সমকালে চিহ্নিত ‘সবকে-হিন্দী’ (অর্থাৎ ইন্ডয়ানাইজড ফার্সি) ভাষাতেই তাঁদের সিসৃক্ষা জারি রেখেছিলেন; ওয়লি মোহম্মদ ওয়লি তাঁদের খালিস উর্দুতে টেনে আনেন, যদিও তখন পর্যন্ত সেটি মূলত দখিনি নামেই পরিজ্ঞাত ছিল। অতঃপর গজলের এক নতুন উত্তরণ-পর্বের সূচনা ঘটে নর্দান প্লেনের, অর্থাৎ উত্তর সমভূমির কবিদের প্রযত্নে। অর্থাৎ দেহলভী এবং লখনভী ভাষার মাধ্যমে। এভাবে আমির খুসরো, যিনি গজলের ভ্রুণ সৃষ্টি করে তাকে হিন্দভী ভাষার গর্ভে লালন করেছিলেন, তাঁর সেই হিন্দভী ভাষাপ্রযুক্তি বিলুপ্ত হতে সময় লাগল সুদীর্ঘ তিনটি শতাব্দী। এরই সঙ্গে গজলের প্রথম যুগটির পরিসমাপ্তি ঘটল ঠিকই, কিন্তু ঐ ভস্মস্তূপ থেকেই ঘটল গজলের জীবনের অপেক্ষাকটত বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর-একটি অধ্যায়ের সূচনা। এই নতুন যুগের ভগীরথ দিল্লির স্বনামধন্য শায়র মির্জা মুহম্মদ রফি ‘সওদা’ (১৭১৩-১৭৮১), যিনি মূলত গজল ও কাশিদার জন্য প্রসিদ্ধি হাসিল করলেও মসনভী, মর্সিয়া, তর্জীহবন্দ, মুখম্মস, রুবাই, হিজো এবং কাতাতেও অনুরূপ পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু দিল্লি হয়ে উঠেছিল আজমাদ শাহ আবদালি এবং নাদির শাহর খুনি উল্লাসমঞ্চ। একাধারে আক্রমণ, লুণ্ঠন ও দাওয়াত যুদ্ধের নিরবচ্ছিন্ন নামতা। এর ফলে দিল্লি বৃত্তের বেশির ভাস কবি সেখান থেকে সরে এসে শরণ নিয়েছিলেন অওধ দরবারে, অর্থাৎ লখনউয়ে। স্বভাবতই, তাঁদের সৃজনশীলতায় দেহলভীর ছাল খসে লখনভীর নির্যাস চুইতে শুরু করেছিল।
এর প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মীর মুজম্মদ তকী মীর (১৭২৩-১৮১০), যিনি একাধারে দিল্লি আর লখনউয়ের সর্বাগ্রগণ্য শায়র হিশেবে পরিগণিত ছিলেন। জন্মেছিলেন আগ্রায়, উদিত ও প্রদীপ্ত হয়েছিলেন দিল্লিতে, কিন্তু আবদালির দিল্লি আক্রমণের পর চলে আসেন লখনউ এবং আসাফ-উদ-দৌলার দরবারেই কাটিয়ে দেন বাকিটা জীবন, এমনকি অন্তশয্যাও গ্রহণ করেন লখনউয়ে। খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৫) ছিলেন নকশবাদী-মুজাদ্দাদি সুফি সন্ত। জন্ম দিল্লিতে। তিনি নিজস্ব শায়রানা ও সুফিয়ানা প্রতিভা রক্তসূত্রে পিতা ফার্সির গণ্যমান্য কবি খাজা মুহম্মদ নাসিরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এবং, যে-কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, দিল্লি সেসময় আবদালি আর মারাঠাদের হামলায় ছারখার হয়ে গেছিল ঠিকই, এবং মীর ও সওদার মতো বড় মাপের কবিরা দিল্লি থেকে সরে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন লখনউয়ে; কিন্তু খাজা মীর দর্দ কখনও দিল্লি পরিত্যাগ করেননি। প্রসঙ্গত এও উল্লেখ থাক, মীর, সওদা এবং দর্দ না জন্মালে উর্দু অথবা উর্দু শায়রীর দুনিয়া এতখানি বিসারিত হতে পারত না। ভালো কথা। সারস্বত ক্ষেত্রে ‘উর্দু’ নামটিকে কয়েনড বা মুদ্রিত করেছিলেন গুলাম হামদানি মাসহাফি (১৭৫১-১৮৪৪)। তৎপূর্বে উর্দু পরিজ্ঞাত ছিল ‘জবান-এ-উর্দু’ নামে, যেটি সাধারণভাবে হিন্দুস্তানি, হিন্দভী, হিন্দী, দখিনি বা রেখতা নামেই চালু ছিল এবং যার সম্মিলিত ডাকনাম ছিল লশকরি জবান, অথবা নিছক ‘লশকরি’। সমকালে আরও দুই মহীরূহ সদৃশ শায়রের অবদানও আমরা বিস্মৃত হতে পারি না—মোমিন আর গালিব, যাঁদের পুণ্যস্পর্শে ইতিহাসের দরবারে উর্দুর তাজপোশি সমাধা হয়েছিল। দুজনেই ছিলেন দিল্লির কবি। মোমিন খান মোমিন (১৮০০-১৮৫১) পেশায় ছিলেন হাকিম, কিন্তু তাঁর মননবিশ্বটি দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার। জন্মসূত্রে ছিলেন কাশ্মিরী। বংশগত পেশা ছিল উনানি চিকিৎসা। মোমিন পরবর্তী জীবনে শায়র হিশেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কবিতায় ফার্সি শৈলী এবং তখল্লুসের সাজুয্য প্রয়োগের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। মির্জা অসদউল্লাহ বেগ খান (১৭৯৭-১৮৬৯) মূলত তাঁর ছদ্মনাম ‘গালিব’ এবং ‘অসদ’ নামেই সবিশেষ বিখ্যাত। মির্জা গালিবের জন্ম তৎকালীন অকবরাবাদ বা আধুনিক আগ্রায়। কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভার সমগ্র বিচ্ছুরণ ঘটে দিল্লিতে। ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় সুদক্ষ হলেও তাঁর সৃষ্টিকর্ম সবই উর্দুতে। মাত্র এগারো বছর বয়সেই গালিবের কাব্যযাত্রার সূচনা ঘটেছিল এবং তেরো বছর বয়স থেকে তিনি দিল্লিতে বসবাস শুরু করে নিহস্ব কাব্যপ্রতিভা আদিগন্ত বিস্তৃত করেন। তিনি ছিলেন মুঘল দরবারে সর্বোৎকৃষ্ট কবি। গজল, কাশিদা, রুবাই, কিতা এবং মার্সিয়ায় ছিলেন সমান সিদ্ধহস্ত। অধিকন্তু, উর্দু শায়রী ও গজলের দুনিয়ায় মীরের পর গালিবই সেই অভ্রংলিহ চূড়া যা থেকে বিগলিত হয়েছে শত-শতকের উপজীব্য অমৃত রসের নিরবচ্ছিন্ন সুধা, যার সেবনে কেবলমাত্র পাঠক ও শ্রোতার মনের তৃষ্ণাই নিবৃত হয় না, ভাষারও বাচ্চাদানি উপর্যুপরি স্ফীত হয়।
গালিব ছিলেন বেপরিমাপ মদিরাসক্ত, প্রডিগাল এবং তথালথিত কাফির বা নাস্তিক। তদ্দণ্ডে তাঁর সমীপকালীন মৌলানা আলতাফ হুসেন হালি (১৮৩৭-১৯১৪) ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর আর-এক প্রখ্যাত শায়র। জন্ম উত্তর-পশ্চিমা প্রান্ত বা আধুনিক হরিয়ানার ঐতিহাসিক শহর পানিপতে, এবং প্রয়াণও সেখানেই। বাল্যবয়সেই পিতা-মাতার মৃত্যুর দরুন পড়াশোনার গুটি অচিরেই কেঁচে যায়। কিন্তু ধর্মের প্রতি পরম নিষ্ঠাবান, পাক্কা মুসলমান এবং পাখণ্ডীদের কড়া সমালোচক। তবুও তিনি ঐ কাফের গালিবের প্রতি ছিলেন একান্ত সশ্রদ্ধচিত্ত। ‘য়্যাদগার-এ-গালিব’ নামে গালিবের জীবনীও লিখেছিলেন। যদিও তিনি তাঁর ‘মকদাম-এ-শায়রী’র জন্যই সমধিক বিখ্যাত। নবজাগরণের অগ্রনায়ক এবং ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন হালি, এবং পরবর্তী কালে, ১৮৬০ থেকে তিনি আমৃত্যু সক্রিয় থেকেছেন শের-ও-শায়রীর দুনিয়ায়। সমীপকালীন উর্দু সাহিত্যের প্রচল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন তাঁর সাহিত্য, কিন্তু পাঠকের কাছে তাঁর গজল, নজম, রুবাই এবং মার্সিয়ার সমাদর কম ছিল না। উপরন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকে হালির সুযোগ্য নেতৃত্বেই উর্দু গজলের সমুচিত উন্নতি ঘটেছিল। গজলের উন্নয়ন প্রকল্পে অবশ্য সমকালীন শেখ মুহম্মদ ইব্রাহিম জৌকের (১৭৯০-১৮৫৪) অবদানও কম নয়। তিনিও গালিবের সমকক্ষ এক প্রকাণ্ড দরবারি কবি। মুঘল দরবারে বিশিষ্ট কবি হিশেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন মাত্র উনিশ বছর বয়সেই। জৌকের আর-এক পরিচয়, তিনি ছিলেন আখেরি মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জফরের (১৭৭৫-১৮৬২) উস্তাদ বা গুরু। জৌকের জন্ম দিল্লিতে। কাব্যক্ষেত্রে তাঁর মূল বিষয় ছিল প্রেম। জৌকের গজল আজও সমাদরে গ্রহণ করে থাকেন পাঠসমণ্ডলী। পর্যায়ক্রমে দাগ দেহলভী (১৮৩১-১৯০৫) নামটিও উচ্চার্য। পুরো নাম নবাব মির্জা খান দাগ দেহলভী। জন্ম পুরানী দিল্লির চাঁদনি চৌকে। পিতা নবাব সামসুদ্দীন আহমদ খান ছিলেন যুগপৎ লোহারু এবং ঠিরোজপুর ঝিরকার শাসক এবং মাতা ওয়াজির খানুম দিল্লিবাসী এক জহুরির কন্যা। দাগের বয়স যখন সবে চার, এবং মায়ের চৌঁত্রিশ, গভর্নরের এজেন্ট উইলিয়াম ফ্রেজারের হত্যা-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার দরুন সামসুদ্দীনের ফাঁসি হয়। অতঃপর দিল্লির শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ওয়ারিস মুঘল ক্রাউন প্রিন্স মির্জা মুহম্মদ ফাকরুর সঙ্গে মায়ের নিকাহ হলে দাগেরও সৌভাগ্যের তোরণ বারদিগর খুলে যায়। দিল্লির লাল কেল্লা থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন এবং পাশাপাশী শের ও শাযরীর দুনিয়াতেও তাঁর আসন পাকা হয়ে যায়। পুরানী দিল্লিই ছিল দাগের সৃষ্টিপরিসর, যদিও তিনি হায়দরাবাদেও জীবনের শেষ অংশটি বাহিত করেন। মৃত্যুও ঘটে হায়দরাবাদে। গজল, কাশিদা, মুখম্মসের দরুন যশস্বী হয়েছিলেন। ‘গুলজার-এ-দাগ’ এবং ‘দিওয়ান-এ-দাগ’ বইদুটির জন্য তিনি আজও স্মর্তব্য। রোমান্টিক ও সেনসুয়াস লেখনীতে দাগের জুড়ি ছিল না। আচ্ছা, বাহাদুর শাহর বারম্বার জিগির যখন এলো, জাফরের গজল নিয়ে খাস কথাও রয়েছে। সেটা পরে বলা হবে।
অবশেষে এলো বিংশ শতক। উনিশ শতকী বিশ্বাসের কেল্লা চুরমার হলো বিশ শতকী বাস্তবানুভূতিতে। প্লাটোনিক প্রেম আর ভাবালুতার জোলো মনোভূমি নিমেষে বদলে গেল ধূ ধূ মরুস্থলে। স্বপ্ন ও কল্পনার গজদন্তমিনার ভেঙে গেছে, পড়ে আছে নিছক স্মৃতির চুনসুরকি। বস্তুত, বিদায়মান উনিশ শতকী প্রাণনে ফুটেছিল ব্যক্তিত্ব বিকাশ, যা চূর্ণ হলো বিশ শতকী রাষ্ট্রিক অখণ্ডতায়। মধ্যবিত্ত ও বিধ্বস্ত কবি-শায়রদের মনেও তীব্র উচাটন ও অস্থিরতা। তাঁরা পড়লেন মহা ফাঁপরে, প্রশ্নের বেষ্টনে। পরাধীনতা, বঞ্চনা ও নির্যাতনের বোঝ অসহ্য হয়ে উঠছে। জাগছে চেতনার দিগ্বাহী চোরাস্রোত। প্রসুপ্ত আক্রোশ ও দ্রোহ দাবাগ্নির মতো ধিকিয়ে ধিকিয়ে ফুঁসে উঠছে কেবল। দিকে দিকে লৌহকপাট ভাঙার আকুলতা ও গণজাগরণের জোয়ার। এবার তাঁদের, কবি-শায়ীদের পালা। গজল লিখিয়েদের মধ্যে, যাঁরা ছিলেন অগ্রভাগে, তাঁদের মননে ও সৃজনে দানা বাঁধল জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার আকাঙ্খা, প্রগতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। প্রসঙ্গত এখানে নথি হতে পারে কীভাবে গজলকাররা সমকালীন বিপ্লবকামী প্রগ্রেসিভ রাইটার্স মুভমেন্টে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যার দরুন গজলবিশ্বে তিনটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথমটি অবশ্যই কালচারাল ল্যান্ডস্কেপে এলো নতুন জোয়ার যা ভারতীয় মিশ্রসংস্কৃতিকে আরও মজবুত হতে মদত যোগালো। দ্বিতীয়ত, উর্দু গজলের ধ্রুপদী অন্বেষনের বাতায়ন খুলে রূপক, প্রতীক এবং চিত্রকল্পে এলো নতুনতর অভিব্যক্তি। এবং, তৃতীয়ত, বিশ্বভুবনে জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে চতুরায়তনিক আবিষ্কার গজলকারদের মধ্যে গড়ে তুলল নিও-ক্লাসিসিস্ট, প্রগ্রেসিভ, মডার্নিস্ট এবং পোস্ট-মডার্নিস্টদের এক অফুরন্ত কাতার।
প্রসঙ্গত এখানে আমি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করব, বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালেই যিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুজ অ্যান্ড মুসলিমস আর টু আইজ অফ দ্য বিউটিফুল ব্রাইড দ্যাট ইজ হিন্দুস্তান।’ এই সজাগ ও বেবাক উচ্চারণ বিশ শতকের। কিন্তু সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ছিলেন উনিশ শতকের প্রখ্যাত ইস্লামিক প্র্যাগমাটিস্ট, ধর্মসংস্কারক, দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। ইনিই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। রাজনৈতিক মঞ্চে খান সাহেব ছিলেন সেসময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। প্রকৃত ইসলাম ও মুসলিম দরদী হয়েও যে তিনি হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্বের পক্ষপাতি ছিলেন, তা ছিল তাঁর আস্থা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। উর্দু গজল লিখিয়েদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আকাঙ্খা, কিছুটা-হলেও, তিনিই চাগিয়েছিলেন। মুসলিম ভাবের জগতে এহেন মস্ত মাপের মনবদল কিংবা বাঁকবদল ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।
এতদসত্বেও, যখনই আমরা ‘উর্দু গজল’ শব্দ দুটি একত্রে উচ্চারণ করি, আমাদের মনে আরও কিছু শব্দের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়—কমনীয়তা, মননশীলতা, এক সংগুপ্ত বা পুশিদা রহস্যের অনুভূতি, ভাবনার ঘনত্ব, কাঠামোগত বা স্বরলিপির বাঁধন ও অভিপ্রায়, আবিষ্ট কল্পনা, সহজাত সুরময়তা, এবং অর্থের প্রোচ্চ সৌন্দর্য। গজলের দুই পংক্তিবিশিষ্ট প্রতিটি শের পাঠকের মনে এক-একটি কাল্পনিক ছবি এঁকে চলে, যা মূলত প্রেম,—আস্তিত্বিক ও সর্বজনীন, উভয়ত। গজলের দুনিয়া কল্পনা আর রূপকের খড়কাঠি দিয়েই গড়া। সিংহভাগ উর্দু শায়রের গজলে এই মূলগত বৈশিষ্ট অবশ্য বিশ শতকেও অক্ষুণ্ণ থেকেছে। কেননা, এই বৈশিষ্ট্যই তার প্রাণশক্তি।
গজল, যার সূচনা আরবে, এবং যেটি লালিত হয় ফার্সি ভাষার ক্রোড়ে, পাশাপাশি পশতু বেলুচি ইত্যাদি ভাষা সমূহেও এর রেওয়াজ চলে আসছিল। কিন্তু এর পূর্ণ বিকাশ ঘটল ভারতে এসে। ভারতীয় সাহিত্য ও সংগীতে পারস্য প্রভাব সংক্রমিত হওয়ার পরেই ভারতীয় মিশ্রসংস্কৃতির প্রযত্নে গজলের তাজপোশি সাঙ্গ হয়। গজল খুবই ত্বরান্বিত চালে উর্দুর সহায়ক পাঞ্জাবি, সিন্ধি, সরাইকি এবং বেলুচি সহ পার্শ্ববর্তী কাশ্মিরী প্রভৃতি ভাষাতেও আপ্যায়ন পেতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে গজল বাংলা, গুজরাতি, মারাঠি, ওড়িয়া, তেলুগু তথা কন্নড় ভাষাতেও নিজস্ব গাদি হাসিল করে। পাঞ্জাবি ভাষায় গজলের প্রবর্তক শাহ মুরাদ এবং মৌলা বকাশ কুস্তা। বিশিষ্ট পাঞ্জাবি কবি মোহন সিং পরবর্তী কালে নিজেকে একজন সফল গজলকার হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু শিবকুমার বাতালভির আগে পাঞ্জাবি গজল জনপ্রিয়তার চূড়া ছুঁতে পারেনি। পরবর্তী কালে রাজিন্দর পাল সিং ওরফে সাদা আমবলভীর মতো জনপ্রিয় কবিও গজলের দরুন সবিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পাঞ্জাবি ভাষায় অন্যান্য উল্লেখজনক গজলকারদের মধ্যে ইন্দ্রজিৎ হংসপুরী, ড. জগতার, ড. সুরজিৎ পটার, অজাইব চিতরকার, রণধীর সিং চাঁদ, গুরভজন গিল, তখৎ সিং, চানন গোবিন্দপুরী, দীপক জয়তোই, জশবন্ত জাফর, ত্রিলোক সিং আনন্দ, সুখবিন্দী অমৃত এবং নতুনদের মধ্যে সুরজিৎ জজ, বিবেক বিবেক, জসবিন্দর, বরজিন্দর চৌহান, কবিন্দর চাঁদ প্রমুখ উল্লেখ্য।
মারাঠি ভাষায় প্রথম গজলকার অমৃত রায়। তাঁর ‘জগব্যাপকা হরীলা নাহী কসে মহণাবে’ (‘কীভাবে বিশ্বব্যাপী হরি না বলি’) কবিতাটি ১৭২৯ সনে লেখা, এবং এটিই মারাঠি ভাষার প্রথম গজল হিশেবে স্বীকৃত। অতঃপর প্রখ্যাত কবি মোরপন্ত ওরফে মোরেশ্বর রামচন্দ্র পারদকর (১৭২৯-১৭৯৪) মারাঠির শ্রেষ্ঠ গজলকার রূপে গণ্য হন। পরবর্তী কালে মাধব জুলিয়ান ওরফে মাধব ত্রিম্বক পটবর্দ্ধন (১৮৯৪-১৯৯৯), যিনি বম্বে ইউনিভার্সিটির মারাঠি সাহিত্যের প্রথম ডি-লিট, ফার্সি ও ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন, অসংখ্য গজল লিখেছেন। মাধবই মারাঠি গজল নিয়ে প্রথম গজল-আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ১৯২৫-১৯৩৪ কালাবধিতে। দ্বিতীয় গজল আন্দোলন ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত চলে, যার প্রবর্তক ছিলেন সুরেশ ভাট। পরে ভট্টের অনুপ্রেরণায় তৃতীয় মারাঠি গজল আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৯৭ সালে, যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. সুরেশচন্দ্র নদকরনী। এই অভিনব আন্দোলনের জেরে মারাঠি গজল আরও সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. অবিনাশ সাঙ্গেলকরের সভাপতিত্বে ১২ জানুয়ারি ২০১৭ ‘মারাঠি গজল গ্লোবাল কমিউনিকেশন’ নামে একটি সেমিনারও আয়োজিত হয়েছিল। মারাঠি গজলকারদের মধ্যে ডি এন গাঙ্গান, অনন্ত নান্দুকর, সন্দীপ মালভী, শ্রকৃষ্ণ রাউত, সতীশ দারাদে, ড. রাম পণ্ডিত, লক্ষ্মণ খাওয়ার, গোবিন্দ নায়েক, বিদ্যাধর ব্রহ্মে, প্রকাশ মোড়, প্রফুল্ল শাহ, জয়দীপ ভিঘেন, ড. রবিপাল ভরশঙ্কর প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য।
কাশ্মিরী ভাষায় হমদম কাশ্মিরী, নসিম উল হক কাশ্মিরী, শাজিয়া বশির প্রমুখের গজল যথেষ্ট মননসমৃদ্ধ ও জনপ্রিয়। গুজরাতি গজল লিখিয়েদের মধ্যে কৈলাশ পণ্ডিত, সাইফ পালানপুরী, মেহুল, হেমং জোশী, মনহুর উধাস, জিরো পালানপুরী, শেখাদম আবুওয়ালা, আদিল মনসুরি, রিশ মানিয়ার প্রমুখের নামযশ হাসিল হয়েছে।
বাংলায় গজল রচনার পথিকৃৎ অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)। আইন প্র্যাকটিস সূত্রে উত্তর ভারতের লখনউ শহরে বসবাসকালে তিনি সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে মিশে গিয়ে হিন্দুস্তানি গীতিপদ্ধতিকে রপ্ত করেছিলেন। এই সূত্রেই তিনি গজলের এই বিশিষ্ট ধারার সঙ্গে পরিচিত হন এবং বাংলায় গজলের বনেদ রচনা করেন। অতঃপর নজরুল ইসলামের হাতে বাংলা গজল বিশিষ্ট রূপ লাভ করে এবং তাঁর মাধ্যমেই বঙ্গদেশে গজল সবিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নজরুলের পরে মনিরউদ্দিন ইউসুফ বেশ কিছু গজল লিখলেও বাঙলায় এ নিয়ে আর তেমন উল্লেখজনক চর্চা হয়নি।এইচ এস শিবপ্রকাশ এবং আরও কতিপয় কন্নড় কবি গজল-লেখক হিশেবেই সমধিক পরিচিত। এছাড়া, বর্ষীয়ান ও বলিষ্ঠ কবি আগা শাহিদ আলি থেকে শুরু করে উঠতি কবি মাজ বিন বিলাল, আশিয়া জহুর প্রমুখ এই জঁরকে ইংরেজি ভাষাতেও প্রবিষ্ট করে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তেলুগুতে এসময় ড. গজল শ্রীনিবাসের গজল গানগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়। নেপালি ও সিংহলি ভাষায়ও গজল লেখার প্রচেষ্টা দুর্লক্ষ্য নয়।
গজলের জাদু হিন্দী সিনেমার জগতে সেঁধ মেরেছিল শতেক বছর আগেই, ভারতীয় সিনেমার প্রায় জন্মলগ্নেই, যা ছিল একান্ত স্বাভাবিক। কেননা গজলের অভিনব ও বিস্ময়কর দুনিয়ায় রয়েছে একাধারে সৌন্দর্যের ঐন্দ্রজালিক রূপক ব্যঞ্জনা, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা এবং সাংগিতিক সুরময়তা। এই চতুর্বিধ লাক্ষণিক কারণেই সেকাল থেকে একাল অবধি হিন্দী ছবির জগতে গীতকার, সুরকার তথা গায়ক-গায়িকাদের কাছে গজলের সম্মানীয় আসনটি আনুপূর্ব লোভনীয় থেকেছে এবং তার ধুরন্ধর প্রয়োগের মুন্সিয়ানাও তাঁরা দেখিয়েছেন। হিন্দী ছবিতে একদিকে যেমন মির্জা গালিব, মীর তকী মীর, দাগ, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, জোশ মলিহাবাদী, ইকবাল, ফিরাক গোরখপুরী, জাঁ নিসার আখতার, কৈফ ভোপালী, সাহির লুধিয়ানভি, মজরুহ সুলতানপুরী, শাহরিয়ার, মুজতর খৈরাবাদী, কৈফি আজমী, নাসির কাজমী, শকীল বদায়ুনী, আহমদ ফরাজ, মহেন্দ্র সিং বেদী, রাজ ইলাহাবাদী, হসরত মোহানী, নিদা ফাজলী, জিগর মুরাদাবাদী, হসন কমাল, গুলজার, জাভেদ আখতার প্রমুখের মতো বলিষ্ঠ ও স্বনামধন্য শায়ররা একের পর এক অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর গজল উপহার দিয়েছেন, তেমনি আজকের স্বল্পনামা লিরিসিস্টরাও নিজেদের পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য পরিশ্রম করে চলেছেন। অন্যদিকে, গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে, বেগম আখতার, কমলা ঝরিয়া, কুন্দনলাল সায়গল, নূরজাহাঁ, মেহেদি হসন, উস্তাদ আমানত আলি খান, উস্তাদ নুসরৎ ফতেহ আলি খান, ফরিদা খানুম, শোভা গুরটু, মহম্মদ রফি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, গুলাম আলি, জগজিৎ সিং, পংকজ উধাস, পিনাজ মাসানী, ভূপেন্দ্র, মুন্নি বেগম, ইকবাল বানো, আগা শাহিদ আলি, টিনা সানি, তালাৎ আজিজ এবং এমনি আরও অসংখ্য উঁচুদরের শিল্পী গোড়া থেকেই হিন্দী ছবিতে গজল গেয়ে নিজেদের এক-একটি স্বতন্ত্র আসন গড়ে তুলেছেন। এঁদের মধ্যে কারো-কারো গায়কী নিয়ে যথাস্থানে আলোচনা করব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন